ভালো বন্ধু কি সমস্যা দেখেও নীরব থাকে?
সিস্টার বারবারা আর আমি পরস্পরকে দু’বছর ধরে চিনি, আমাদের মধ্যে বেশ সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, যখনই আমরা কথা বলতাম, মনে হত যেন বলতেই থাকি। প্রায়ই আমাদের প্রত্যেকটা অভিজ্ঞতার বিষয়ে আর তা থেকে কী শিখেছি সেই সম্পর্কে কথা বলতাম। যখনই তার কিছু হতো, আমার খোঁজ করত, আর আমিও কোনো সমস্যায় পড়লেই তার সাথে আলোচনা করতে চাইতাম। সে সব সময় ধৈর্য ধরে আমার সাথে আলোচনা করত, আমাদের এই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আমার খুব প্রিয় ছিল। মনে হতো, আমাকে সাহায্য আর সমর্থন করতে পারে এমন একজন সিস্টারের আমার পাশে থাকাটা দারুণ ব্যাপার।
গত বছর, আমি ঘটনাচক্রে বারবারাকে কয়েকজন সিস্টারের কাছে বলতে শুনলাম, সে সম্প্রতি তার সুসমাচারের কাজে দারুণ ফল পাচ্ছে, সে যাদের কাছে প্রচার করছিল তাদের মধ্যে অনেকে ধর্মীয় ধারণায় পরিপূর্ণ ছিল, তারপর, প্রার্থনা আর ঈশ্বরের উপর ভরসা করার মাধ্যমে, তাদের সাথে আলোচনা করে, আর তাদের ঈশ্বরের বাক্য পড়ে শুনিয়ে, তাদেরকে অচিরেই সে ঈশ্বরের অন্তিম সময়ের কাজ গ্রহণ করিয়েছে। দেখলাম তা শুনে সিস্টাররা তার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে, তাকে নানান প্রশ্ন করছে, অনুশীলনের ভালো পথ কী, তা জানতে চাইছে। একটু চিন্তিত বোধ করলাম আর ভাবলাম, “ভালো কথা যে ওর সুসমাচারের কাজ এত ভালো চলছে, কিন্তু ও শুধু কতটা দুর্দান্ত ফল পেয়েছে তা-ই বলল, কোন নির্দিষ্ট পথে ফল পাচ্ছিল, বা এই সময় ঈশ্বর কীভাবে ওকে পথনির্দেশ দিয়েছেন তা বলল না। এভাবে কথা বলে ও কি নিজেকেই জাহির করছে না?” কয়েকদিন পর, সিস্টার ফে আমাকে বলল, “বারবারা কত প্রতিভাবান, ইতিমধ্যেই সুসমাচারের কাজে এত বড় সাফল্য পেয়েছে। সে বলল যে এমনকি একজন নেতা একটা সমাবেশে তার অভিজ্ঞতা নিয়ে আলোচনা করার জন্য তাকে আমন্ত্রণও জানিয়েছে।” এটা শুনে আমার বুক কেঁপে উঠল: বারবারা এসব বলছে কেন? ফে এখন তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ, কিন্তু এতে ওর কোনো উপকার হবে না। বুঝলাম যে দায়িত্ব পালন করে অর্জিত ভালো ফলগুলো বারবারা সবসময় জাহির করছিল, আমার অস্বস্তি হল। ঈশ্বর বলেন, নিজেকে জাহির করা আর নিজের প্রশংসা করা হল শয়তানোচিত স্বভাবের প্রকাশ, তাই এভাবে চলতে থাকা বিপজ্জনক। এটা চলতে দিতে পারছিলাম না। বিষয়টা বারবারাকে বলার একটা সুযোগ খুঁজতে হতো। কিন্তু যখনই ওকে এই সমস্যাটা বোঝানোর কথা ভাবতাম, তখনই দ্বিধা হতো। আমার কয়েক বছর আগেকার কথা মনে পড়ল। আমার সহকর্মী জেনি প্রায়ই তাত্ত্বিক মতবাদ আওড়াত, নিজেকে উচ্চকোটির ভেবে অন্যদের বকাঝকা করত, কিন্তু সে কখনোই নিজেকে বিশ্লেষণ করেনি বা চেনেনি। আমি তাকে এই সমস্যাটা ধরিয়ে দিলে, সে তা মেনে না নিয়ে আমার অতীতের ব্যর্থতা আর অপরাধগুলো তুলে ধরে পালটা আঘাত করে। এরপর আমাকে চিনতেও যেন তার অনীহা হতো। এটা আমার জন্য অস্বস্তিকর আর বেদনাদায়ক হয়ে উঠেছিল। আরেকবার, সিস্টার রোক্সানা একটা সমাবেশের সময় আলোচনার বিষয়ের বাইরে চলে যাচ্ছিল বলে তাকে সেটা ধরিয়ে দিয়েছিলাম। পরে সে আমাকে বলে যে যখন আমি তার সমস্যার উল্লেখ করি, সে খুব বিব্রত আর প্রতিরোধী হয়ে পড়েছিল, তার মনে হয়েছিল আমি ইচ্ছা করে তাকে কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলার চেষ্টা করছি, এমনকি সে পরের সমাবেশগুলোতে আলোচনা করতেও চায়নি। যদিও সে অন্বেষণ ও চিন্তাভাবনা ক’রে তার সমস্যগুলো চিনতে পারে, তবু তাকে এটা বলতে শুনে আঘাত পেয়েছিলাম। এরপর থেকে অন্যদের সমস্যা উল্লেখ করার ক্ষেত্রে খুব সতর্ক হয়ে পড়ি। বারবারার সাথে আমার সুন্দর সম্পর্কের কথা ভাবলাম, আর ভাবলাম যে তার সমস্যাটা ধরিয়ে দিলে, সেটা কি তার পক্ষে অস্বস্তিকর হবে? যদি সে না শুনে বরং উল্টে আমাকে খারাপ ভাবে, যদি মনে করে আমি তার ঘাটতি অনাবৃত করার আর তাকে কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলার চেষ্টা করছি, আর তারপর যদি আমাকে চিনতেই অস্বীকার করে তাহলে কী করব? প্রতিদিন আমাদের বহুবার দেখা হয়, কাজেই ব্যাপারটা বেশ অস্বস্তিকর হবে। তাছাড়া সে সবসময় এভাবে জাহির করত না। হয়তো ঈশ্বরের বাক্য পড়ে, সে চিন্তাভাবনা করতে পারবে, নিজে থেকেই বুঝতে পারবে। বরং থাক, আমি এ নিয়ে কিছু বলব না।
একদিন, বারবারা আমাকে বলল যে কিছু ব্রাদার-সিস্টার তাকে কিছু পরামর্শ দিয়েছে। তারা বলেছে যে ওর আলোচনায় বড়াই করার আর অন্যদের প্রশংসা আদায়ের প্রবণতা আছে। এটা ওকে বেশ অস্বস্তিতে ফেলেছিল। ওর কথা শুনে আমার ভিতরটা তালগোল পাকিয়ে গেল। সত্যি বলতে, আমিও তো ওকে ইদানীং লোকদেখানো আচরণ করতে দেখেছি, কিন্তু আমাদের সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার ভয় ছিল বলে মুখ বুজে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছিলাম। এটাই কি নিখুঁত সুযোগ ছিল না? যে সমস্যাগুলো দেখেছি সেগুলো সম্পর্কে আমারও কি বলা উচিত ছিল না? কিন্তু তারপর ভাবলাম ওর পরিস্থিতি ইতিমধ্যেই যথেষ্ট কঠিন, তাই আমার কথা শুনে ও হয়ত নেতিবাচক হয়ে যেতে পারে। আমিও বুঝতে পারলাম, ওর যে সমস্যাগুলো দেখেছি সেগুলো ওকে ধরিয়ে দিতে হবে, কিন্তু চিন্তা হলো যে ও হয়তো ভাববে আমি ওর প্রতি খুব কঠোর, নিজেকে আমার থেকে দূরে সরিয়ে নেবে, তাই ভালো করে ভেবে দেখলাম কেমন সুরে আর কোন কৌশলে বিষয়টা ব্যক্ত করা যায় যাতে ও বিব্রত বোধ না করে। তাই ওর কাছে শুধু উদাহরণ তুলে ধরলাম, কীভাবে আগে নিজেকে মহান হিসাবে দেখাতাম, বড়াই করতাম, তারপরে কীভাবে সেটা নিয়ে ভাবার পর বুঝতে পারি, আর একেবারে শেষে ওর সমস্যার কথাটা একটুখানি ছুঁয়ে গেলাম। ওকে বিব্রত করার ভয় পাচ্ছিলাম বলে কিছু সান্ত্বনার কথাও বললাম, “প্রত্যেকেরই ভ্রষ্ট স্বভাব আছে, সেটা প্রকাশ করাও পুরোপুরি স্বাভাবিক। আমিও করি। আমিও সব সময় খুব অহংকারী আর দাম্ভিক ছিলাম, বড়াই করতাম। এতে দমে যেও না, নিজের প্রতি সঠিক মনোভাব রাখো।” এর জবাবে ও কিছুই বলল না। কিন্তু তারপর এমন কিছু ঘটল যা আমাকে আবার অস্থির করে তুলল।
একটা সমাবেশে, বারবারা ঈশ্বরের বাক্যের বিষয়ে তার উপলব্ধি নিয়ে আলোচনা করছিল, আর সুসমাচার প্রচারের সময় তার একটা সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতার কথা বলছিল। ও এমন এক যাজকের কাছে প্রচার করছিল যে কয়েক দশক ধরে প্রভুতে বিশ্বাস করে। লোকটার নানা ধর্মীয় পূর্বধারণা ছিল আর অনেক গুজবও শুনেছিল। তাকে সুসমাচার বারবার শোনানোর পরেও সে তা মানতে নারাজ ছিল। কিন্তু তারপর ও তার সাথে আলোচনা আর বিতর্ক করে, আর ঈশ্বরের প্রাসঙ্গিক বাক্যগুলো খুঁজে বের ক’রে এক এক করে তার পূর্বধারণাগুলো খণ্ডন করে, শেষ পর্যন্ত, সে ধীরে ধীরে তার পূর্বধারণা ত্যাগ করে ঈশ্বরের অন্তিম সময়ের কাজ গ্রহণ করে। ও যখন বলা শেষ করল, তখন সবার মনোযোগ ওর সুসমাচারের অভিজ্ঞতার দিকেই গেল, আর ঈশ্বরের বাক্য থেকে দূরে সরে গেল। সেইসময় আমি খেয়াল করিনি: এটা কি বিষয়বস্তুর থেকে সরে যাওয়া নয়? যদিও ও নিজের সুসমাচারের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলছিল, কিন্তু বলা শেষ হলে সবাই ওরই প্রশংসা করতে শুরু করল, ওকেই উঁচু নজরে দেখছিল। এটা কি ওর নিজেকে জাহির করা নয়? ওকে সেটা ধরিয়ে দিতে চাইলাম যাতে ও এই বিষয়ে বলা বন্ধ করে, কিন্তু কথাগুলো মুখ দিয়ে বেরোলো না: এত লোকের সামনে বাধা দিলে ও কি সত্যিই বিব্রত হবে না? এটা ঠিক যে বারবারা ওর সুসমাচারের কাজে কিছুটা সাফল্য পেয়েছিল, কাজেই এটা বললে, সবাই কি ভাববে যে আমি ওকে ঈর্ষা করছি আর ইচ্ছা করেই ওকে কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলছি? হয়ত ওর উদ্দেশ্য ভালোই, হয়ত ও লোকদেখানোর চেষ্টা করছে না? তাই কিছু বলিনি, কিন্তু ঈশ্বরের বাক্য নিয়ে চিন্তাভাবনা করার পক্ষে যথেষ্ট শান্ত করতে পারলাম না নিজেকে, আর আমার আলোচনাও জ্ঞানগর্ভ ছিল না কারণ নিছকই কিছু শুকনো কথা বলেছিলাম, আর এভাবেই সমাবেশ শেষ হলো।
সেদিন বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছিলাম, ঘুমাতেই পারিনি। সমাবেশে বারবারার লোকদেখানোর জন্য বলা কথাগুলো, আর সবার চোখেমুখে প্রশংসা, এগুলোর কথা মাথা থেকে বার করতে পারছিলাম না। ও যা আলোচনা করেছে তা ঈশ্বরের বাক্য সম্পর্কে অন্যদের আরও ভালো কোনও উপলব্ধি দেয়নি, বরং ও নিজের সুসমাচার প্রচারের কাজের প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, আর তাই সমাবেশ থেকে ভালো কিছু পাওয়া যায়নি। ওকে বিব্রত করার ভয়ে কিছুই না বলে আমি গির্জার-জীবনের সুরক্ষায় ব্যর্থ হয়েছি। ন্যায়বিচারের পরোয়া না করে আমি কি শুধুই লোকজনকে খুশি রাখার চেষ্টা করছিলাম না? ঈশ্বরের বাক্যের একটা অংশ মনে এল: “তুমি একজন সঠিক ব্যক্তি কি না তা জানতে তোমার নিজেকে ভালো ভাবে পরীক্ষা করা উচিত। তোমার লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য কি আমাকে মনে রেখে তৈরি করা হয়েছে? তোমার সমস্ত কথা এবং কাজ কি আমার উপস্থিতিতে বলা এবং করা হয়েছে? আমি তোমার সমস্ত চিন্তাভাবনা এবং ধারণাগুলি পরীক্ষা করি। তুমি কি নিজেকে দোষী মনে করো না? … তোমার কি মনে হয় যে শয়তান এই বার যে ভোজন ও পান কেড়ে নিয়েছে পরের বার তুমি তা পূরণ করতে সক্ষম হবে? সুতরাং, তুমি এখন এটি স্পষ্টভাবে বুঝতে পারছ; এটি কি এমন ঘটনা যার তুমি ক্ষতিপূরণ করতে পারো? তুমি কি হারিয়ে যাওয়া সময়ের ক্ষতিপূরণ করতে পারো? বিগত কয়েকটি সমাবেশে কেন ভোজন ও পান করা হয়নি এবং কারা এই সমস্যা সৃষ্টি করেছে তা দেখার জন্য নিজেদের কঠোরভাবে পরীক্ষা করতে হবে। এই বিষয়গুলো স্পষ্ট না হওয়া অবধি তোমায় এগুলো নিয়ে এক এক করে আলোচনা করতে হবে। যদি এই ধরনের ব্যক্তিকে দৃঢ়ভাবে নিয়ন্ত্রণ না করা হয়, তবে তোমাদের ব্রাদার-সিস্টাররা এটি বুঝতে পারবে না, এবং তারপর এটি আবার ঘটবে। তোমাদের আধ্যাত্মিক চোখ বন্ধ; তোমরা অনেকেই অন্ধ! আর তাছাড়া, যারা দেখতে পায় তারাও এই ব্যাপারে উদাসীন। তারা সরব হয় না; এবং তারাও অন্ধ। যারা দেখে কিন্তু সেই বিষয়ে কথা বলে না তারা মূক। এখানে প্রতিবন্ধী অনেকেই আছে” (বাক্য, খণ্ড ১, ঈশ্বরের আবির্ভাব ও তাঁর কার্য, সূচনাকালে খ্রীষ্টের বাক্য, অধ্যায় ১৩)। ঈশ্বরের বাক্য আমায় গভীর কষ্ট দিল। মনে পড়ল কীভাবে আলোচনার সময় বারবারা বিষয়ের বাইরে চলে গিয়েছিল, প্রত্যেকের সময় নষ্ট করেছিল আর তা সমাবেশের কার্যকারিতায় প্রভাব ফেলেছিল, তবুও আমি চুপচাপ দেখেছিলাম। মনে মনে কেবলই ভাবলাম, স্পষ্টতই জানতাম যে বারবারা বিষয়ের বাইরে চলে যাচ্ছে, তাহলে কেন গির্জার জীবনকে রক্ষা করিনি? কেন নীরব থাকার সিদ্ধান্ত নিই? প্রথমত, বারবারার কাজকর্ম নিজেকে উঁচু দেখানো আর জাহির করা কি না, তা নিয়ে সংশয়ে ছিলাম। একথা সত্যি যে সুসমাচার প্রচারে ওর কিছু অভিজ্ঞতা ছিল, আর সেসব অভিজ্ঞতা নিয়ে আলোচনা করলে অন্যদের জন্য তা উপকারীও হতে পারে, তাহলে কি ওর এই রকম আলোচনাকে লোকদেখানো বলা চলে? দ্বিতীয়ত, চিন্তিত ছিলাম হয়তো আমি সবকিছু পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারছি না, আমি মুখ খুললে ও হয়ত দমে যেতে পারে, আর অন্যরা ভাববে যে হিংসার বশে এসব বলছি।
পরের দিনের সমাবেশে নিজের দুশ্চিন্তার কথা কয়েকজন সিস্টারকে জানিয়ে সাহায্য চাইলাম। আমরা একসাথে ঈশ্বরের বাক্যের একটা অনুচ্ছেদ পড়লাম: “নিজেকে উচ্চে স্থাপন করা ও নিজের সাক্ষ্যপ্রদান করা, নিজেকে জাহির করা, এমন চেষ্টা করা যাতে লোকজন তাদেরকে বিরাট কিছু ভাবে—ভ্রষ্ট মানবজাতি এইসব করতে সক্ষম। মানুষ যখন শয়তানোচিত প্রকৃতির দ্বারা পরিচালিত হয় তখন তাদের সহজাত প্রতিক্রিয়া এরকমই হয়, এবং সমগ্র ভ্রষ্ট মানবজাতির জন্যেই তা সত্যি। সাধারণত কীভাবে মানুষ নিজেদের উচ্চে স্থাপন করে আর নিজের সাক্ষ্যপ্রদান করে? তারা কীভাবে এই লক্ষ্যে পৌঁছয়? তারা সাক্ষ্য দেয় যে কত বেশি কাজ তারা করেছে, কত কষ্টভোগ তারা করেছে, নিজেদের তারা কত বেশি পরিমাণে ব্যয় করেছে, আর কী মূল্য তারা প্রদান করেছে। এইগুলোকেই তারা নিজেদের উচ্চে স্থাপন করার জন্য মূলধন হিসাবে ব্যবহার করে, যা মানুষের মনে তাদের এক উচ্চতর, দৃঢ়তর, আরও স্থিতিশীল স্থান প্রদান করে, যাতে আরও বেশি সংখ্যক মানুষ তাদের সম্মান করে, প্রশংসা করে, শ্রদ্ধা করে, এমনকি তাদের উপাসনা করে, আদর্শজ্ঞান করে, এবং অনুসরণ করে। এই লক্ষ্যে উপনীত হতে মানুষ এমন অনেক কিছু করে যা উপরিভাগে ঈশ্বরের সাক্ষ্যপ্রদান করে, কিন্তু আসলে তাদের নিজেদেরই উচ্চে স্থাপন করে, নিজেদেরই সাক্ষ্য দেয়। এইভাবে কাজ করা কি যুক্তিযুক্ত? এগুলো যৌক্তিকতার পরিধির বাইরে। এদের কোনো লজ্জা নেই: এরা নির্লজ্জভাবে সাক্ষ্যপ্রদান করে যে ঈশ্বরের জন্য তারা কী করেছে এবং তাঁর জন্য কত কষ্টভোগ করেছে। তারা এমনকি তাদের প্রতিভা, মেধা, অভিজ্ঞতা, বিশেষ দক্ষতা, নিজেদের পরিচালনা করার জন্য তাদের চতুর কৌশল, মানুষের সঙ্গে খেলা করার জন্য তাদের পদ্ধতি, ও এরকম আরও অনেক কিছু জাহির করে। নিজেদের উচ্চে স্থাপন করার ও নিজেদের সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য তাদের পদ্ধতি হল নিজেদের জাহির করা ও অন্যদের হেয় করা। এছাড়াও তারা নিজেদের মুখোশের আড়ালে রাখে এবং ছদ্মবেশ ধারণ করে, নিজেদের দুর্বলতা, দোষত্রুটি, ও ঘাটতি মানুষের কাছ থেকে গোপন করে যাতে মানুষ সবসময় শুধু তাদের ঔজ্জ্বল্যটুকুই দেখতে পায়। তারা যখন নেতিবাচক বোধ করে, সেকথা অন্যদের এমনকি বলার সাহসটুকুও করে না; মানুষের কাছে উন্মুক্ত হওয়ার ও তাদের সাথে আলোচনা করার সাহসেরও অভাব রয়েছে তাদের, আর যখন তারা কিছু ভুল করে, তারা যথাসাধ্য চেষ্টা করে তা গোপন করতে ও ঢাকা দিয়ে রাখতে। কর্তব্য পালনের সময়ে তারা গির্জার কাজের যে ক্ষতি করেছে সেকথা কখনোই উল্লেখ করে না। তবে নিজেদের সামান্য কিছু অবদান থাকলে বা ছোটোখাটো কোনো সাফল্য অর্জন করে থাকলে সেগুলো জাহির করতে তারা এতটুকু দেরি করে না। তারা কত যোগ্য, তাদের ক্ষমতা কত বেশি, তারা কত ব্যতিক্রমী, আর সাধারণ মানুষের চেয়ে তারা কত উন্নত, সেকথা সারা পৃথিবীকে জানাতে তারা অধীর হয়ে ওঠে। এটা কি তাদের নিজেদের উচ্চে স্থাপন করার এবং নিজেদের সাক্ষ্যপ্রদান করার একটা উপায় নয়?” (বাক্য, খণ্ড ৪, খ্রীষ্টবিরোধীদের উন্মোচন, চতুর্থ পরিচ্ছেদ: তারা নিজেদের মহিমান্বিত হিসাবে তুলে ধরে এবং নিজেদের সাক্ষ্য নিজেরাই দেয়)। ঈশ্বরের বাক্যের উদ্ঘাটনে বুঝলাম খ্রীষ্টবিরোধীদের বড়াই করার একটা চিহ্ন হল, অন্যের সামনে নিজেদের প্রতিভা, শক্তি, অবদান, আর সাফল্য জাহির করা, যাতে মানুষ তাদের প্রতিভাবান আর যোগ্য বলে মনে করে, সম্মান আর প্রশংসা করে। সুসমাচার প্রচার আর ঈশ্বরের সাক্ষ্য দেওয়া কার্যত ইতিবাচক বিষয়। একজন দক্ষ সুসমাচারকর্মী হিসাবে, কাজ করতে গিয়ে বারবারা যেসব অসুবিধার সামনে পড়ছে, কীভাবে ঈশ্বরকে ভরসা করেছে আর তাঁর কাজের অভিজ্ঞতা লাভ করেছে, তা থেকে কী অর্জন করেছে আর কী শিখেছে, কোন ভালো অনুশীলনের পথ বের করেছে, তা নিয়ে সে আলোচনা করলে সেটা উন্নতিমূলক হতো। অথচ বারবারা শুধুই বলল কত লোককে সে ধর্মান্তরিত করেছে, কত কষ্ট সহ্য করেছে, কত মূল্য দিয়েছে, কিন্তু তার অভিজ্ঞতা শুনে কেউ যে ঈশ্বরকে আরো ভালো বুঝতে পারল, এমনটা নয়, অনুশীলনের বা নানা সমস্যা সামলানোর উপায়েও কেউ স্পষ্টতা পেল না। উল্টে, তারা শুধু তার সম্পর্কেই আরও জানল, জানল যে তার সুসমাচার প্রচারের প্রতিভা আর ক্ষমতা আছে, অন্যদের তুলনায় সে বেশি উদ্দীপ্ত। সবাই তার প্রশংসা করল, তাকে ঈর্ষা করল, আর নিজেদের অযোগ্য মনে করল। দেখতে পেলাম যে দেখনদারি আর বড়াই করার এবং ঈশ্বরের সাক্ষ্য দেওয়ার ফল ভিন্ন হয়। আলোচনার মাধ্যমে আমার আগের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে নিশ্চিত হলাম, নির্ণয় করলাম, বারবারা যা বলেছে তার বেশিরভাগটাই ঈশ্বরের সাক্ষ্য দেওয়া নয়, বরং নিজেকে বড় করে দেখানো, জাহির করা। এটা তার খ্রীষ্টবিরোধী স্বভাবের বহিঃপ্রকাশ, যা ঈশ্বরের বিতৃষ্ণা আর ঘৃণার উদ্রেক ঘটাবে। সিস্টাররাও মনে করিয়ে দিল যে বারবারা তখনও হয়তো তার ভ্রষ্ট স্বভাবের প্রকাশ নিয়ে সচেতন হয়নি, আর এটা দেখার পরে, আমাদের উচিত সস্নেহে তাকে সেটা ধরিয়ে দেওয়া। আমরা নিছকই সম্পর্করক্ষার জন্য লোকজনকে খুশি করে চলতে পারি না। সিস্টারদের কথায় লজ্জা হল, যত শীঘ্র সম্ভব বারবারার সাথে আলোচনা করার সিদ্ধান্ত নিলাম।
বৈঠক শেষ হওয়ার পর, কিছুতেই নিজেকে শান্ত করতে পারিনি। আমি আগেই বারবারার সমস্যাগুলো দেখেছি কিন্তু সেগুলো তাকে দেখিয়ে দেওয়ার সাহস করিনি, এমনকি যখন কিছু বলেছিলাম, তখনও সমস্যাটা শুধুই উপর উপর ছুঁয়ে গেছিলাম, তাতে কিছু লাভ হয়নি, অর্থাৎ বারবারা কখনোই তার সমস্যা সম্পর্কে ভাবেনি বা সচেতন হয়নি। এসব ভেবে অস্বস্তি আর অপরাধবোধ হল, নিজেকে জিজ্ঞাসা করলাম, “সাধারণত বারবারার কাছে থাকলে খুব হাসিখুশি আর প্রাণবন্ত থাকি, ওকে সবকিছু বলি, তাহলে ওর সমস্যাগুলো ধরিয়ে দেওয়া এত কঠিন লাগছে কেন? কেন কথাগুলো মুখ ফুটে বলতে পারছি না?” উত্তর খুঁজতে গিয়ে আর চিন্তা করতে গিয়ে ঈশ্বরের এই বাক্য পড়লাম। “তোমরা সকলেই সুশিক্ষিত। তোমরা সকলেই বক্তৃতার সময় মার্জিত ও নম্র থাকার প্রতি এবং কথা বলার রীতিনীতির প্রতি মনোযোগ দিয়ে থাকো: তোমরা কৌশলী, এবং অন্যের মর্যাদা ও গৌরবের হানি না করার শিক্ষাই পেয়েছ। তোমাদের কথায় ও কাজে, তোমরা মানুষের সম্মান রক্ষা করার মতো স্থান রেখে দাও। মানুষকে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করানোর তোমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করো। তোমরা তাদের ক্ষত বা ঘাটতিগুলো প্রকাশ করো না, এবং চেষ্টা করো তাদের আঘাত না করতে বা বিব্রত না করতে। বেশিরভাগ মানুষ নিজেদের মধ্যে আচরণে এরকম নীতিই অনুসরণ করে থাকে। আর এটা কী ধরনের নীতি? (লোকেদের খুশী করার নীতি, প্রতারণাপূর্ণ এবং অনির্ভরযোগ্য নীতি।) এই নীতি অনৈতিক, বিশ্বাসের অযোগ্য, প্রবঞ্চনাময় এবং কপট। মানুষের হাস্যোজ্জ্বল মুখের আড়ালে লুকিয়ে আছে বিদ্বেষপূর্ণ, কপট এবং ঘৃণ্য অনেককিছু” (বাক্য, খণ্ড ৩, অন্তিম সময়ের খ্রীষ্টের উপদেশ, জীবনের উন্নতির ছয়টি সূচক)। “যে সকল ব্যক্তিগণ মধ্যবর্তী অবস্থানে দৃঢ় থাকে, তারাই সবচেয়ে বেশি খল। তারা চেষ্টা করে যাতে কেউই ক্ষুব্ধ না হয়, তারা হল মানুষের মন জুগিয়ে চলা ব্যক্তি, তারা বিষয়-সকলের সাথে মানিয়ে নেয়, আর কেউই তাদের পরিষ্কারভাবে দেখতে পায় না। এহেন ব্যক্তি হল এক জীবন্ত শয়তান!” (বাক্য, খণ্ড ৩, অন্তিম সময়ের খ্রীষ্টের উপদেশ, কেবলমাত্র সত্যের অনুশীলনের মাধ্যমেই ভ্রষ্ট স্বভাবের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়া যেতে পারে)। “জীবনযাপনের দর্শনে একটা নীতি আছে, ‘ভালো বন্ধুর দোষে চুপ থাকা সুদীর্ঘ আর ভালো বন্ধুত্ব তৈরি করে’। এর অর্থ, একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ধরে রাখতে হলে কাউকে তার বন্ধুর সমস্যাগুলো সম্পর্কে নীরব থাকতে হবে, এমনকি যদি সে স্পষ্টভাবে তা দেখতে পায় তাহলেও—মানুষের মুখে আঘাত না করা অথবা তাদের ঘাটতিগুলোর দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ না করানোর নীতিই তাকে মেনে চলতে হবে। তাদের একে অপরকে প্রতারণা করতে হবে, একে অপরের থেকে লুকোতে হবে, একে অপরের বিরুদ্ধে কৌশল অবলম্বন করতে হবে; এবং অন্য মানুষটা ঠিক কীরকম তা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে জানা সত্ত্বেও তারা খোলাখুলি সেকথা বলে না, বরং নিজেদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষা করার জন্য ধূর্ত পদ্ধতির প্রয়োগ করে। এরকম সম্পর্ক কেউ রক্ষা করতে চাইবে কেন? কারণ যাতে সমাজে, নিজের গোষ্ঠীর মধ্যে, শত্রু তৈরী না হয়, যা কাউকে প্রায়ই বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে ফেলে দিতে পারে। একথা জেনে যে তুমি যদি কারো ঘাটতির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করাও বা তাকে আঘাত করো তাহলে সে তোমার শত্রু হয়ে উঠবে আর তোমার ক্ষতি করবে, এবং নিজেকে এরকম পরিস্থিতিতে ফেলতে না চেয়ে, তুমি জীবনযাপনের দর্শনে এই নীতি অনুসরণ করো যে ‘কাউকে যদি আঘাত করতেই হয়, তার মুখে আঘাত কোরো না; যদি অন্যের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করাতেই হয়, তাদের ঘাটতিগুলোর দিকে করিও না’। এই দিক থেকে দেখলে, দুজন মানুষ যদি এরকম একটা সম্পর্কের মধ্যে থাকে, তাদেরকে কি বন্ধু বলে গণ্য করা যায়? (না।) তারা প্রকৃত বন্ধু নয়, পরস্পরের অন্তরঙ্গ তো নয়ই। তাহলে এটা ঠিক কী ধরনের সম্পর্ক? এ কি এক মৌলিক সামাজিক সম্পর্ক নয়? (হ্যাঁ।) এই ধরনের সামাজিক সম্পর্কে মানুষ নিজেদের অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে না, তাদের মধ্যে কোনো গভীর বিনিময়ও হয় না, যা ইচ্ছা করে সে বিষয়ে তারা বলতে পারে না। নিজেদের অন্তরে কী আছে, বা অপরের মধ্যে যে সমস্যা তারা দেখতে পাচ্ছে, বা অন্যকে যে কথা উপকৃত করবে, তা সোচ্চারে বলতে পারে না। তার পরিবর্তে, তারা সুন্দর সুন্দর কথা বলে, যাতে অপরজনের অনুগ্রহ পাওয়া যায়। তারা সত্যি বলতে বা নীতিকে সমর্থন করতে সাহস করে না, পাছে তা অন্যদের মধ্যে তাদের প্রতি শত্রুতার জন্ম দেয়। যখন কেউ কোনো একজনকে হুমকি দিচ্ছে না, তখন কি সে অপেক্ষাকৃত স্বাচ্ছন্দ্য ও শান্তিতে বাস করছে না? ‘কাউকে যদি আঘাত করতেই হয়, তার মুখে আঘাত কোরো না; যদি অন্যের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করাতেই হয়, তাদের ঘাটতিগুলোর দিকে করিও না’, এই কথাগুলো বিজ্ঞাপিত করার পিছনে এটাই কি মানুষের উদ্দেশ্য নয়? (হ্যাঁ।) স্পষ্টতই, এটা বেঁচে থাকার এক ধূর্ত, প্রতারণাপূর্ণ পদ্ধতি যার মধ্যে রয়েছে আত্মরক্ষার উপাদান, যার উদ্দেশ্য হল নিজেকে সুরক্ষিত করা। এরকমভাবে যারা জীবনযাপন করে তাদের অন্তরঙ্গ বলে কেউ থাকে না, এমন কোনো ঘনিষ্ঠ বন্ধু থাকে না যার সাথে তারা যা ভালো লাগে তাই বলতে পারে। তারা একে অপরের প্রতি আত্মরক্ষামূলক মনোভাব পোষণ করে, হিসাব কষে, কৌশল অবলম্বন করে, তাদের সম্পর্কের মধ্যে থেকে নিজের নিজের যা প্রয়োজন তা সংগ্রহ করে নেয়। তাই নয় কি? এর উৎস, ‘কাউকে যদি আঘাত করতেই হয়, তার মুখে আঘাত কোরো না; যদি অন্যের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করাতেই হয়, তাদের ঘাটতিগুলোর দিকে করিও না’—এর উদ্দেশ্য হল অন্যকে ক্ষুব্ধ করে শত্রু তৈরী করা থেকে বিরত রাখা, কাউকে আঘাত না ক’রে নিজেকে সুরক্ষিত রাখা। নিজেকে আহত হওয়া থেকে বাঁচানোর জন্যই কেউ এই কৌশল আর পদ্ধতি গ্রহণ করে। এর সারমর্মের বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে একথা বলা যায় কি, যে মানুষের নৈতিক আচরণ যা দাবি করে—‘কাউকে যদি আঘাত করতেই হয়, তার মুখে আঘাত কোরো না; যদি অন্যের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করাতেই হয়, তাদের ঘাটতিগুলোর দিকে করিও না’—তা এক মহৎ আচরণ? এটা কি ইতিবাচক আচরণ? (না।) তাহলে মানুষকে এটা কী শিক্ষা দেয়? যে তুমি অবশ্যই কাউকে ক্ষুব্ধ বা আহত করবে না, নাহলে শেষ পর্যন্ত তুমিই আঘাত পাবে; এবং তাছাড়াও, তোমার কাউকে বিশ্বাস করা উচিত নয়। তুমি যদি তোমার যে কোনো একজন ভালো বন্ধুকে কষ্ট দাও, তোমাদের বন্ধুত্ব নিঃশব্দে পরিবর্তিত হতে আরম্ভ করবে: তোমার একজন ভালো ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু থেকে তারা উঠবে অপরিচিত, অথবা একজন শত্রু। … তাহলে, এই প্রবচন মানুষকে যা শিক্ষা দেয় তার শেষে কী আসে? তা কি মানুষকে আরও সৎ করে তোলে, না কি আরও প্রতারণাপূর্ণ? এর ফলে মানুষ আরও প্রতারণাপূর্ণ হয়ে ওঠে; মানুষের হৃদয় পরস্পরের থেকে আরও দূরে সরে যায়, মানুষের মধ্যে দূরত্ব বৃদ্ধি পায়, আর মানুষের মধ্যে সম্পর্ক জটিল হয়ে ওঠে; তা মানুষের সামাজিক সম্পর্কের এক জটিলতারই সমতুল্য। মানুষের হৃদয়ের সাথে হৃদয়ের যোগাযোগ হারিয়ে যায়, এবং পারস্পরিক আত্মরক্ষামূলক মানসিকতার উদ্ভব হয়। এইভাবে কি মানুষের সম্পর্কগুলো এরপরেও স্বাভাবিক থাকতে পারে? এতে কি সামাজিক বাতাবরণের উন্নতি হবে? (না।) এই কারণেই, ‘কাউকে যদি আঘাত করতেই হয়, তার মুখে আঘাত কোরো না; যদি অন্যের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করাতেই হয়, তাদের ঘাটতিগুলোর দিকে করিও না’, এই প্রবচন অবশ্যই ভুল। মানুষকে এই কাজ করার শিক্ষা দিলে তা কখনোই তাকে স্বাভাবিক মানবিকতার জীবন যাপন করতে দেয় না; উপরন্তু, তা মানুষকে উন্মুক্ত, ন্যায়নিষ্ঠ, বা অকপট করে তুলতে পারে না। তা ইতিবাচক কিছু একেবারেই অর্জন করতে পারে না” (বাক্য, খণ্ড ৬, সত্যের অন্বেষণের বিষয়ে, সত্যের অন্বেষণ কী? (৮))। ঈশ্বরের বাক্য পাঠ করে বুঝলাম, বারবারার সাথে মেলামেশায় আমি শয়তানসুলভ দর্শনের উপর নির্ভর করছিলাম, যেমন “ভালো বন্ধুর দোষে নীরব থাকা সুদীর্ঘ আর ভালো বন্ধুত্ব তৈরি করে”, “মানুষকে যদি আঘাত করতেই হয়, তার মুখে আঘাত কোরো না”, আর “আরেকটা বন্ধু মানে আরেকটা পথ।” সেই মুহূর্ত পর্যন্ত, এই দর্শনগুলোকেই মানুষের সাথে মেলামেশার নীতি ভেবে এসেছি। ভেবেছি যে এই ধরনের আচরণই পারস্পরিক সম্পর্ক বজায় রাখার একমাত্র উপায়, অন্যদের ক্ষুব্ধ না করে নিজের ঝামেলা এড়িয়ে চলা। ঈশ্বরের বাক্যের উদ্ঘাটনের মাধ্যমে, শেষ পর্যন্ত বুঝলাম, এসব দর্শন ছিল জীবনযাপনের কপট, চতুর ও শঠ উপায়, এগুলো সন্দেহপ্রবণতা সৃষ্টি করে, বাধা দেয় আন্তরিক মেলামেশায়, পারস্পরিক ভালবাসায়। যদিও এইভাবে মেলামেশা করলে কাউকে ক্ষুব্ধ করা বা নিজের ঝামেলা এড়ানো যায়, তবে তা সত্যিকারের বন্ধু পেতে বাধা দেয়, শুধু মানুষকে আরও মেকি আর প্রবঞ্চক করে তোলে। এ-ও বুঝলাম যে অন্যদের সাথে আলাপচারিতার সময় অকপট হওয়া উচিত, কারও কোনও সমস্যা দেখলে, সহানুভূতি দিয়ে তাদের যথাসাধ্য সাহায্য করা উচিত। এমনকি যদি সেই মুহূর্তে, তারা তা মানতে না পারে আর তোমাকে ভুল বোঝে, তাহলেও সেই নীতিগুলো মেনে চলতে হবে, আর এই বিষয়ে তোমার উদ্দেশ্য সঠিক হওয়া চাই। যারা সত্যকে অকৃত্রিমভাবে গ্রহণ করে, তাদের মোকাবিলা করা হলে, তারা মুহূর্তের জন্য বিব্রত হয়ে তা না মানলেও, পরে সত্যে অন্বেষণ ও আত্মসমীক্ষা করতে পারবে। তারা অন্যদের প্রতি বিক্ষুব্ধ হবে না, বরং সংশোধনকারীর প্রতি কৃতজ্ঞ হবে। বারবারার সাথে আমার কথাবার্তা নিয়ে আবার চিন্তা করলাম। বেশ কয়েকবার ওকে দেখেছি অন্যদের সামনে স্পষ্টতই নিজেকে জাহির করতে, আর অন্যরা ওর সম্পর্কে খুব উঁচু ধারণা করতো, কিন্তু ভয় পেয়েছিলাম যে ওর সমস্যার উল্লেখ করলে ওর অহং আহত হবে আর ও ভবিষ্যতে আমায় উপেক্ষা করবে। তাই ওর সাথে সুসম্পর্ক ধরে রাখতে, ও যখন ভ্রষ্টতা প্রকাশ করেছিল তখন ওকে সাহায্য করিনি বা কিছুই বলিনি, যার অর্থ, ও নিজের সমস্যা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করছিল না, সেটার বিষয়ে জানতোই না, পরে ও আবার নিজের পুরনো পথে ফিরে যায়। দেখতে পেলাম যে এই শয়তানসুলভ দর্শন নিয়ে জীবনযাপন করার মাধ্যমে, আমি শুধুই আমাদের সম্পর্ক রক্ষা করতে চাইতাম, যাতে বারবারার আমাকে বিবেচক আর সহানুভূতিশীল বলে। ওর জীবনে প্রবেশের কথা আমি বিবেচনা করিনি। যদি আমার চোখে পড়া সমস্যাগুলো আগেই ওর কাছে তুলে ধরতাম, তাহলে হয়তো ও নিজের ভ্রষ্ট স্বভাব কিছুটা বুঝতে পারত আর সমাবেশের সময় এই ধরনের অযৌক্তিক কথা বলতো না। সম্পর্ক বজায় রাখতে আমি লোকজনকে খুশি রাখার কাজে মেতে ছিলাম! এই আচরণ সত্যিই ক্ষতিকর! তখন এমন আরেক সিস্টারের কথা মনে পড়ল যার সাথে কথাবার্তা হয়েছিল। তাকে প্রায়ই দায়সারাভাবে কাজ করতে দেখতাম, তার সমস্যাগুলো কেউ ধরিয়ে দিলে সে তা না মেনে তর্ক জুড়ে দিত। তাকে আত্মসমীক্ষায় সাহায্য করার জন্য তার সাথে আলোচনা করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ভাবলাম যে সে বেশ বয়স্কা, সমস্যা ধরিয়ে দিলে তার অহং আহত হবে আর সেও আমাকে কঠোর ভাববে। তাই তার সমস্যা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিই আর তার সাথে বাহ্যিকভাবে হাসিখুশি, আলাপী আর বন্ধুত্বপূর্ণ থেকে যাই। কর্তব্যে দায়সারা হওয়ার কারণে সে যখন বরখাস্ত হলো, তখন আফসোস করলাম কেন তাকে আগে সাহায্য করিনি। সে চলে যাওয়ার পর তবেই তার যে সমস্যাগুলো দেখেছিলাম সেগুলো নিয়ে তার সাথে আলোচনা করি। সে নিজের সমস্যা বুঝতে পারলেও, আগেই বলিনি বলে আমায় তিরস্কার করে। বলে, আগেই তার ভুল সংশোধন করতে পারলে হয়তো তাকে বরখাস্ত করা হতো না। এটা মনে করে অবশেষে বুঝলাম, এইসব দর্শন নিয়ে জীবনযাপন করা আর লোককে খুশি রেখে চলা আদৌ সত্যিকারের ভালো মানুষ হওয়ার পরিচয় নয়। এতে আন্তরিকতা বা অন্যের প্রতি মমত্ববোধ নেই, বরং আছে স্বার্থপরতা আর প্রবঞ্চনা। আমি এক শয়তানোচিত স্বভাব যাপন করে ঈশ্বরের ঘৃণার উদ্রেক করছিলাম। বারবারা সবসময় আমার সাথে কত আন্তরিক ছিল, কিন্তু ওর সাথে মেলামেশার সময় এসব দর্শনের উপর ভরসা করেছি, সত্য অনুশীলন করিনি। শুধু তাকে ক্ষুব্ধ না করে নিজের ভালো ভাবমূর্তি বজার রাখার কথা ভেবেছি, ওকে ভ্রষ্ট স্বভাব প্রকাশ করতে দেখেও তা উপেক্ষা করেছি। এটা কি ভালো বন্ধুর মতো ব্যবহার? বুঝলাম যে “ভালো বন্ধুর দোষে নীরব থাকা সুদীর্ঘ আর ভালো বন্ধুত্ব তৈরি করে” এটা সত্যিই শয়তানের বানানো মিথ্যা, আমি আর সেই অনুসারে জীবনযাপন করতে চাইনি।
চিন্তাভাবনা করতে করতে, বুঝলাম যে আরেকটা কারণে বারবারার সমস্যা ধরিয়ে দেওয়ার সাহস করিনি: আমার একটা ভুল দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। সবসময় ভেবেছি, অন্যের সমস্যা ধরিয়ে দেওয়া মানে তাদের ত্রুটি অনাবৃত করা, এতে তাদের অহং আহত হবে, সম্ভবত তারা ক্ষুব্ধ হবে, এটা করলে কেউ ধন্যবাদ জানাবে না। তাই বারবারার ক্ষেত্রে, সর্বদা ভয় পেতাম যে ওর সমস্যা ধরিয়ে দিলে ও ক্ষুব্ধ হবে, তাতে আমাদের সম্পর্ক নষ্ট হবে, ফলে সত্যের অনুশীলন খুবই কঠিন হয়ে পড়েছিল। তাই ঈশ্বরের কাছে চাইলাম তিনি যেন আমার এই সমস্যার সমাধানের পথ দেখান।
অন্বেষণকালে ঈশ্বরের এই বাক্যগুলো পড়লাম। “ঈশ্বর দাবি করেন যে মানুষ যেন সত্যি কথা বলে, যা চিন্তা করে তা-ই যেন বলে, এবং তার মধ্যে যেন কোনো কৌশল না থাকে, অন্যদের বিপথগামী করা, অন্যদের প্রতি উপহাস, ব্যঙ্গ, অপমান, বিদ্রূপ যেন না থাকে, তাদের সঙ্কুচিত করা, তাদের দুর্বলতাকে অনাবৃত করা, বা তাদের আহত করাও যেন না থাকে। এগুলোই কি কথা বলার রীতিনীতি নয়? এ কথা বলার অর্থ কী যে অন্যদের দুর্বলতাকে অনাবৃত করা কারো উচিত নয়? এর অর্থ অন্যদের কালিমালিপ্ত না করা। অন্যের বিচার করার জন্য বা নিন্দা করার জন্য তাদের অতীত ভুল বা অপূর্ণতা আঁকড়ে ধরে থেকো না। অন্ততপক্ষে এইটুকু তোমার করা উচিত। সদর্থক দিক থেকে, গঠনমূলক বক্তৃতা কেমনভাবে প্রকাশ করা হয়? তা প্রধানত উৎসাহব্যঞ্জক, বিষয়াভিমুখী, পথনির্দেশক, উপদেশমূলক, উপলব্ধিমূলক, এবং স্বস্তিদায়ক। এছাড়াও, কয়েকটা বিশেষ দৃষ্টান্তে, অন্যদের ত্রুটি সরাসরি প্রকাশ করার, তাদের মোকাবিলা করার, এবং তাদের অপ্রয়োজনীয় অংশ কর্তনের দরকার পড়ে, যাতে তারা সত্যের জ্ঞান অর্জন করতে পারে এবং অনুশোচনায় ইচ্ছুক হয়। শুধু তবেই কাঙ্ক্ষিত প্রভাব অর্জিত হয়। এইরূপ অনুশীলনের পন্থা মানুষের পক্ষে খুবই উপকারী। এটা মানুষের পক্ষে খুবই উপকারী। এটা তাদের পক্ষে প্রকৃত সহায়ক এবং গঠনমূলক হয়, তাই নয় কি? … এবং সংক্ষেপে, এই সব আলোচনার নিহিত নীতিটি কী? তা হল: তোমার মনের মধ্যে কী আছে তা বলো, নিজের প্রকৃত অভিজ্ঞতা এবং চিন্তাভাবনার আলাপন করো। এই বাক্যগুলি মানুষের পক্ষে সর্বাপেক্ষা উপকারী, এগুলি মানুষের জন্য রসদের যোগান দেয়, মানুষকে সহায়তা করে, এগুলি ইতিবাচক। যে সকল তঞ্চকতাময় কথা মানুষের কোনো উপকারে লাগে না বা তাকে উন্নীত করে না, সেগুলো বলতে অস্বীকার করো; এতে তাদের ক্ষতি হবে না, তাদের কোনো ভুল করা থেকে আটকাবে, যার ফলে তারা নেতিবাচকতায় নিমজ্জিত থাকা এবং মন্দ প্রভাব থেকে দূরে থাকবে। তোমাকে অবশ্যই ইতিবাচক কথাবার্তা বলতে হবে, লোকেদের সাহায্য করার বিষয়ে অবশ্যই সর্বোত্তমভাবে সচেষ্ট হতে হবে, যাতে তাদের উপকার হয়, তাদের রসদ যোগান দেওয়া যায়, যাতে তাদের মধ্যে ঈশ্বরের প্রতি প্রকৃত বিশ্বাস জন্মায়; এবং তোমাকে অবশ্যই দেখতে হবে যাতে মানুষের সহায়তা করা সম্ভব হয়, এবং যাতে তারা তোমার ঈশ্বরের বাক্যের অভিজ্ঞতা ও সমস্যা সমাধানের উপায় থেকে প্রভূত বিষয়বস্তু অর্জন করতে পারে, এবং যাতে তারা ঈশ্বরের কাজের, তথা সত্যের বাস্তবিকতায় প্রবেশের পথ উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়, তোমাকে অবশ্যই দেখতে হবে যাতে তারা তাদের জীবনে প্রবেশ করার অনুমোদন পেয়ে নিজ-নিজ জীবনের বৃদ্ধি সাধন করতে পারে—যেগুলি সকলই আদতে তোমার বাক্যে নীতি এবং মানুষের উন্নতিসাধনের ক্ষমতা থাকার প্রভাব” (বাক্য, খণ্ড ৬, সত্যের অন্বেষণের বিষয়ে, সত্যের অন্বেষণ কী? (৩))। “একজন ব্রাদার বা সিস্টারের সাথে যদি তোমার ভালো সম্পর্ক থাকে, আর সে যদি তোমাকে বলে তার কোথায় ভুল হচ্ছে তা দেখিয়ে দিতে, তাহলে কীভাবে তোমার সেই কাজ করা উচিত? তা নির্ভর করবে তুমি কীভাবে বিষয়টা দেখছো তার উপর। … তাহলে, সত্যের নীতি অনুসারে, কীভাবে তোমার এই বিষয়টার দিকে অগ্রসর হওয়া উচিত? কোন্ কাজ সত্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ? এ বিষয়ে কতগুলো প্রাসঙ্গিক নীতি আছে? প্রথমত, অন্ততপক্ষে অন্যকে অকস্মাৎ অস্বস্তিতে ফেলে দিও না। তোমাকে প্রথমে অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে অপরপক্ষের দুর্বলতাগুলো কী কী আর কীভাবে তার সাথে কথা বললে সে অস্বস্তিতে পড়বে না। ন্যূনতম এই বিষয়টুকু বিবেচনা করা উচিত। এর পর, যদি তুমি জানো যে সে এমন কেউ যে ঈশ্বরে প্রকৃতই বিশ্বাস করে এবং সত্যকে গ্রহণ করতে পারে, সেক্ষেত্রে যখন তুমি লক্ষ্য করবে যে তার কোনোএকটা সমস্যা রয়েছে, তখন তোমারই উচিত হবে তাকে সাহায্য করার উদ্যোগ নেওয়া। যদি তুমি কিছুই না করো আর তাকে উপহাস করো, তাহলে সেই উপহাসের মধ্যে রয়েছে তাদের আহত করা ও ক্ষতি করা। যে এমন কাজ করে তার বিবেক বা বোধ বলে কিছু নেই, এবং অন্যের প্রতি ভালোবাসাও নেই। যাদের বিন্দুমাত্র বিবেক ও বোধ আছে তারা কিছুতেই তাদের ব্রাদার-সিস্টারদের উপহাসের পাত্র হিসাবে দেখতে পারে না। তাদের উচিত তার সমস্যার সমাধানে তাকে সাহায্য করার জন্য বিভিন্ন উপায় চিন্তা করা। তাদের উচিত সেই ব্যক্তিকে বুঝতে দেওয়া যে কী হয়েছে আর তার ভুল কোথায় ছিল। সে অনুতাপ করতে পারবে কি না তা তার নিজস্ব ব্যাপার; আমরা আমাদের দায়িত্ব যথাযোগ্যভাবে পালন করবো। যদি সে এখন অনুতাপ না-ও করে, আজ নয়তো কাল এমন একটা দিন আসবে যেদিন তার বোধ জাগ্রত হবে, এবং সে তোমাকে দোষ দেবে না বা অভিযুক্ত করবে না। অন্ততপক্ষে, তুমি ব্রাদার-সিস্টারদের সাথে যে আচরণ করো তা যেন বিবেক এবং বোধের মানদণ্ডের নিচে না হয়। নিজেকে অন্যদের কাছে ঋণী করে রেখো না; যতদূর পর্যন্ত পারো তাদের সাহায্য করো। এটাই মানুষের করণীয়। যারা তাদের ব্রাদার-সিস্টারদের সঙ্গে ভালোবাসার সাথে এবং সত্যের নীতির সঙ্গে সঙ্গতভাবে আচরণ করতে পারে তারাই শ্রেষ্ঠ ধরনের মানুষ। তারা সবচেয়ে সহৃদয় মনোভাবাপন্নও। অবশ্যই, যথার্থ ব্রাদার-সিস্টাররা হল সেই ব্যক্তি যারা সত্যকে গ্রহণ ও অনুশীলন করতে পারে। কেউ যদি শুধু নিজের উদরপূর্তির জন্য বা আশীর্বাদ লাভ করার জন্যই ঈশ্বরে বিশ্বাস করে, কিন্তু সত্যকে গ্রহণ না করে, তাহলে সে ব্রাদার বা সিস্টার নয়। ব্রাদার-সিস্টারদের সাথে তোমার অবশ্যই সত্যের নীতি অনুযায়ী আচরণ করা উচিত। সে যেভাবেই ঈশ্বরে বিশ্বাস করুক বা যে পথেই থাকুক, তোমার উচিত ভালোবাসার চেতনা নিয়ে তাকে সাহায্য করা। কারো যে ন্যূনতম প্রভাব অর্জন করা উচিত তা কী? প্রথমত, তাকে অস্বস্তিতে না ফেলা, এবং তাকে নেতিবাচক হতে না দেওয়া; দ্বিতীয়ত, তাকে সাহায্য করা এবং ভুল পথ থেকে ফিরিয়ে আনা; আর তৃতীয়ত, তাকে সত্য উপলব্ধি করানো এবং সে যাতে সঠিক পথ বেছে নেয় তা নিশ্চিত করা। এই তিন রকমের প্রভাব অর্জন করা সম্ভব শুধুমাত্র ভালোবাসার চেতনায় তাকে সাহায্য করার মাধ্যমে। তোমার যদি সত্যিকারের ভালোবাসা না থাকে, তাহলে তুমি এই তিন ধরনের প্রভাব অর্জন করতে পারবে না, খুব বেশি হলে একটা বা দুটোই পারবে। এই তিন ধরনের প্রভাবই হল অন্যদের সাহায্য করার তিনটে নীতিও। তুমি এই তিনটে নীতি জানো এবং সেগুলো সামলাতেও পারো, কিন্তু আসলে সেগুলো কীভাবে বাস্তবায়িত করা হয়? তুমি কি সত্যিই অপরপক্ষের অসুবিধার বিষয়ে বোঝো? এটাও কি অন্য একটা সমস্যা নয়? তোমাকে অবশ্যই এটাও ভাবতে হবে, ‘ওর অসুবিধার উৎস কী? আমি কি ওকে সাহায্য করতে সক্ষম? আমার আত্মিক উচ্চতা যদি খুবই সামান্য হয়, আর আমি যদি ওর সমস্যার সমাধান করতে না পারি, যদি অযত্ন নিয়ে কথা বলি, তাহলে হয়ত আমি ওকে ভুল পথে নির্দেশিত করবো। তার উপরে, এই মানুষটা সত্য উপলব্ধি করতে কতদূর সক্ষম, ওর যোগ্যতা কতটুকু? ও কি নিজের মতামতে গোঁড়া? ও কি আধ্যাত্মিক বিষয় বুঝতে পারে? সত্যকে স্বীকার করতে পারে? সত্যের অন্বেষণ করে? ও যদি দেখে যে আমি ওর চেয়ে যোগ্যতাসম্পন্ন, আর আমি ওর সাথে আলোচনা করি, ওর মধ্যে কি ঈর্ষা বা নেতিবাচক মনোভাব জন্মাতে পারে?’ এই সমস্ত প্রশ্নই বিবেচনা করতে হবে। এই সব প্রশ্ন বিবেচনা করে এগুলোর উপর স্বচ্ছতা লাভ করার পর তুমি সেই ব্যক্তির সাথে আলোচনা কোরো, তাদের সমস্যায় প্রযুক্ত ঈশ্বরের বাক্যের বহুবিধ অনুচ্ছেদ পাঠ কোরো যেগুলো, এবং ঈশ্বরের বাক্যে নিহিত সত্য উপলব্ধি করতে এবং অনুশীলনের পথ খুঁজে পেতে তাকে সক্ষম করে তুলো। তাহলে সমস্যার সমাধান হবে এবং সে অসুবিধা থেকে বেরিয়ে আসবে। এটা কি সহজ ব্যাপার? মোটেই সহজ ব্যাপার নয়। যদি তোমার সত্যের উপলব্ধি না থাকে, তুমি যতই বলো, তা কোনো কাজে লাগবে না। তোমার যদি সত্যের উপলব্ধি থাকে, তাহলে তোমার কয়েকটা কথাতেই সে আলোকিত ও উপকৃত হতে পারবে” (বাক্য, খণ্ড ৩, অন্তিম সময়ের খ্রীষ্টের উপদেশ, কেবলমাত্র সত্যের অন্বেষণের মাধ্যমেই ঈশ্বর সম্বন্ধে পূর্বধারণা ও ভুল বোঝাবুঝির সমাধান সম্ভব)। ঈশ্বরের বাক্য পাঠ করে বুঝতে পারলাম যে যদি কারও ঘাটতিগুলোকে অনাবৃত করে, তাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে, তাদের বিচার আর নিন্দা করতে চাও, আর যদি তা করার উদ্দেশ্য হয় তাদের উপহাস, বিদ্রূপ আর তিরস্কার করা, তবে ঈশ্বর তা ঘৃণা করেন। কিন্তু কাউকে সাহায্য করার উদ্দেশ্য নিয়ে তার সমস্যা আর ঘাটতি ধরিয়ে দিলে তা উন্নতিসাধক, তাতে অন্যদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ পায়, তাদের জীবনের প্রতি দায়িত্ববোধ দর্শায়। সেই ব্যক্তি সত্যান্বেষী হলে, সে অন্যের সাহায্যে নিজের সমস্যার সমাধানের জন্য আত্মসমীক্ষা আর সত্যের সন্ধান করতে পারবে, আর জীবনে প্রবেশে এগিয়ে যাবে। তবে কেউ কেউ প্রতিরোধী এবং মোকাবিলার সম্মুখীন হতে চায় না, চায় না যে কেউ তাদের ভুল ধরিয়ে দিক। এটা দেখায় যে তারা সত্যকে স্বীকার করে, তাদের স্বভাব সত্যের বিষয়ে বীতশ্রদ্ধ। দেখতে পেলাম, আগে বিশ্বাস করতাম যে অন্যের সমস্যাগুলো ধরিয়ে দেওয়া তাদের ঘাটতিগুলোকে অনাবৃত করার মতোই, তা করলে কেউ ধন্যবাদ দেবে না। এই দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ ভুল ছিল। বুঝতে পারলাম, অন্যের সমস্যা ধরিয়ে দেওয়ার নীতি রয়েছে। শুধু ভালো উদ্দেশ্য আর আগ্রহ থাকলেই হবে না, অথবা ব্যক্তি নির্বিশেষে লোকজনের কাছে তাদের সমস্যা সরাসরি তুলে ধরলেই হবে না। কখনও কখনও তোমাকে প্রজ্ঞা ব্যবহার করতে হবে, সত্যর নীতি অনুসরণ করতে হবে। সবচেয়ে জরুরি হল প্রাসঙ্গিক সত্য বিবেচনায় রাখা, বিষয়গুলো দেখিয়ে দিয়ে অন্যদের সত্য আর ঈশ্বরের ইচ্ছা উপলব্ধিতে সাহায্য করা, অনুশীলনের পথ দেখানো। শুধুমাত্র এভাবেই মানুষকে সত্যিকারের সাহায্য করা যায়। এবারে অবশেষে বুঝলাম আগে অন্যদের সমস্যা ধরিয়ে দেওয়ার সময় খারাপ ফল পেয়েছিলাম কারণ সত্যের নীতির সন্ধান করিনি। ঠিক যেমন হয়েছিল রোক্সানার ক্ষেত্রে, যে ছিল দাম্ভিক এবং নিজের খ্যাতি নিয়ে চিন্তিত, যে আগে মোকাবিলার সম্মুখীন হয়নি। যখন দেখতে পেলাম যে সে তার আলোচনায় বিষয়-বহির্ভূত কথা বলছে, তখন আমার উচিত ছিল তার সমস্যাটা ধরিয়ে দেওয়া, তারপর তাকে ঈশ্বরের বাক্য নিয়ে আলোচনা করার নীতিগুলো জানানোও, যাতে সে অনুশীলনের পথ খুঁজে পায়। এতে সে সঙ্কুচিত না হয়ে নীতি মেনে আলোচনা করতে সমর্থ হতো। এই নীতি বোঝার পরে বারবারার সমস্যাগুলো ধরিয়ে দিতে আর ভয় পাইনি, জেনেছি যে নীতি মেনে আর সহানুভূতির সাথে আমার ওকে সাহায্য করা উচিত যাতে ও ভুল পথে না যায়। মনে মনে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলাম, “কীভাবে বারবারার সাথে আলোচনা করতে পারি যাতে তা কার্যকরী হয়, ও সীমাবদ্ধ না হয়, আর সত্যের এই দিকটা উপলব্ধি ক’রে নিজের সমস্যা বুঝতে পারে?”
সময় পেলেই সমস্যাটা নিয়ে ভাবতাম, ঈশ্বরের সেইসব বাক্যের সন্ধান আর বিবেচনা করতাম যেগুলো তাদের অনাবৃত করে যারা নিজেদের জাহির করে, বড় ক’রে দেখায়। সময় খুঁজছিলাম বারবারার সাথে খোলাখুলি আলোচনা করতে, এই সময়কালে তার যেসব সমস্যা লক্ষ্য করেছি তা নিয়ে, নিজেকে জাহির করার পরিণতি নিয়ে, আর এমন আচরণ ঈশ্বর কোন চোখে দেখেন তা নিয়ে। আলোচনার পর, বারবারা বুঝতে পারল যে ওর সমস্যা কতটা গুরুতর, ও মর্যাদার আবেশে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছিল, মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিতে আর লোকজনের প্রশংসা পেতে পছন্দ করতো, আর বুঝল যে এই ধরনের অন্বেষণ ঈশ্বর ঘৃণা করেন। পরে ও একটা সমাবেশে ওর এই আচরণ খোলামেলাভাবে বিশ্লেষণ করে, যা সবাইকে সেটা চিনতে সাহায্য করে। বারবারা নিজের সমস্যা নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে, বুঝতে, আর নিজেকে ঘৃণা করতে পারছে দেখে খুশি হলাম। কিন্তু একই সাথে অপরাধবোধও হল। অনুতাপ হলো যে আলোচনা করে ওকে এটা ধরিয়ে দিতে আমার এত সময় লাগলো। ওর সমস্যা ধরিয়ে দেওয়া বা অনাবৃত করার জন্য ও আমার প্রতি মনঃক্ষুন্ন হয়নি, আমাদের সম্পর্কও ভেঙে যায়নি, বরং আমরা আগের চেয়েও বেশি ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠি। বুঝলাম, শুধুমাত্র ঈশ্বরের বাক্য অনুযায়ী জীবনযাপন করলে আর নীতি অনুসারে মানুষের সাথে মেলামেশা করলে তবেই শান্তি অনুভব করা যায়।
প্রতিদিন আমাদের কাছে 24 ঘণ্টা বা 1440 মিনিট সময় থাকে। আপনি কি ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভের জন্য তাঁর বাক্য শিখতে 10 মিনিট সময় দিতে ইচ্ছুক? শিখতে আমাদের ফেলোশিপে যোগ দিন। কোন ফি লাগবে না।