গল্প ১: একটি বীজ, পৃথিবী, একটি গাছ, সূর্যালোক, পাখি, ও মানুষ
আজ আমি তোমাদের সঙ্গে একটি নতুন বিষয় নিয়ে আলোচনা করব। কী বিষয়? এর শিরোনাম: “ঈশ্বর সমস্ত কিছুর প্রাণের উৎস।” এই বিষয়টি কি একটু বড় শোনাচ্ছে? তোমাদের কি মনে হচ্ছে যে বিষয়টি তোমাদের বোধের পরিধির কিছুটা বাইরে? “ঈশ্বর সমস্ত কিছুর প্রাণের উৎস”—এই বিষয়টি হয়তো মানুষের কিছুটা অগম্য মনে হতে পারে, কিন্তু যারা ঈশ্বরকে অনুসরণ করে, তাদের সকলের অবশ্যই এই বিষয়টি উপলব্ধি করা দরকার, কারণ এটি প্রত্যেক ব্যক্তির ঈশ্বর বিষয়ক জ্ঞানের সঙ্গে এবং তাদের ঈশ্বরকে সন্তুষ্ট করার ও সম্মান করার সক্ষমতার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। সেই কারণেই আমি এই বিষয়টি সম্পর্কে আলোচনা করতে চলেছি। এমনটি খুবই সম্ভব যে এই বিষয়টি সম্পর্কে মানুষের আগে থেকেই কিছু সহজসরল ধারণা আছে, বা তারা কিছুদূর পর্যন্ত বিষয়টি সম্পর্কে সচেতন। কোনও কোনও মানুষের মনে এই জ্ঞান বা সচেতনতার দোসর হতে পারে সরল বা অগভীর মাত্রার ধারণা। অন্য কারো কারো অন্তরে কিছু বিশেষ অভিজ্ঞতা থাকতে পারে এবং তার ফলে এই বিষয়টির সঙ্গে তাদের গভীর ব্যক্তিগত সাক্ষাৎ ঘটে থাকতে পারে। কিন্তু এহেন পূর্ববর্তী জ্ঞান গভীর হোক বা অগভীর, তা একমুখী এবং পর্যাপ্ত মাত্রায় নির্দিষ্ট নয়। তাই, সেই কারণেই আমি এই বিষয়টিকে আলোচনার জন্য বেছে নিয়ছি: তোমাদের গভীরতর ও নির্দিষ্টতর উপলব্ধিতে পৌঁছতে সাহায্য করার জন্য। এই বিষয়টি নিয়ে তোমাদের সঙ্গে আলোচনা করার জন্য আমি একটি বিশেষ পদ্ধতি ব্যবহার করব, সে পদ্ধতি আমরা এর আগে ব্যবহার করিনি, সেটি তোমাদের কিছুটা অস্বাভাবিক বা অস্বস্তিকর বলে মনে হতে পারে। আমি কী বলতে চাইছি তা তোমরা পরে বুঝতে পারবে। তোমরা কি গল্প শুনতে ভালোবাসো? (ভালোবাসি।) যাক, আমার গল্প বলার পদ্ধতি নির্বাচন তাহলে সঠিক বলেই মনে হচ্ছে, কারণ তোমরা সকলেই তা এত পছন্দ করো। এবার তাহলে শুরু করা যাক। তোমাদের কিছু লিখে নেওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই। আমি তোমাদের বলব শান্ত থাকতে এবং চঞ্চল না হতে। তোমাদের যদি মনে হয় যে আশপাশের পরিবেশ বা মানুষজন তোমাদের মনোযোগ বিক্ষিপ্ত করেতে পারো, সেক্ষেত্রে তোমরা চোখ বন্ধ করে রাখতে পারো। আমি তোমাদের একটি চমৎকার গল্প বলব। এই গল্পটি একটি বীজ, পৃথিবী, একটি গাছ, সূর্যালোক, পাখি, ও মানুষকে নিয়ে। এটির মূল চরিত্র কারা? (একটি বীজ, পৃথিবী, একটি গাছ, সূর্যালোক, পাখি, আর মানুষ।) ঈশ্বর কি এদের মধ্যে আছেন? (না।) তা হলেও, আমি নিশ্চিত যে গল্পটি শোনার পর তোমরা সতেজ ও সন্তুষ্ট বোধ করবে। এবার দয়া করে শান্ত হয়ে শোনো।
ছোট্ট একটি বীজ একদিন পৃথিবীর বুকে এসে পড়ল। প্রচন্ড বৃষ্টিপাত হলো, এবং সেই বীজ থেকে জন্ম নিলো এক কোমল অঙ্কুর, ধীরে ধীরে নিচের মাটিতে প্রবেশ করতে লাগলো শিকড়। হিংস্র হাওয়ার দাপট ও প্রখর বৃষ্টির ঝাপটা সহ্য করে, পূর্ণিমা ও অমাবস্যার সঙ্গে সঙ্গে ঋতু পরিবর্তনের সাক্ষী থেকে, সময়ের সাথে সাথে সেই অঙ্কুরের দৈর্ঘ্য বেড়ে উঠল। গ্রীষ্মকালে পৃথিবী নিয়ে এল জলের উপহার, যাতে অঙ্কুরটি সে ঋতুর প্রখর তাপ সহ্য করতে পারে। এবং পৃথিবীর জন্যই অঙ্কুরটি গ্রীষ্মের তাপে ঝলসে গেল না, এবং এভাবেই গ্রীষ্মের চরম দাবদাহের সময়টি কেটে গেল। শীতকাল আসতে পৃথিবী সেই অঙ্কুরটিকে নিজের উষ্ণ আলিঙ্গনে ঢেকে ফেলল, এবং পৃথিবী ও অঙ্কুর পরস্পরকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে থাকল। পৃথিবী অঙ্কুরটিকে উষ্ণতা দিল এবং সেভাবেই সেটি সেই ঋতুর তীব্র শীতের মধ্যে টিকে থাকল, শীতল বাতাসের ঝাপটা ও তুষারঝড়ের মধ্যেও অক্ষত থাকল। পৃথিবীর আশ্রয়ে অঙ্কুরটি সাহসী ও আনন্দিত হয়ে উঠল; পৃথিবীর নিঃস্বার্থ পরিচর্যা পেয়ে সে হয়ে উঠল স্বাস্থ্যবান ও শক্তিশালী। সে বেড়ে উঠতে লাগল আনন্দের সঙ্গে, বর্ষায় গান গেয়ে, বাতাসে নেচে, দোল খেয়ে। অঙ্কুর ও পৃথিবী পরস্পরের উপর নির্ভর করে চলে …
বছরের পর বছর কেটে গেল, এবং অঙ্কুরটি বৃদ্ধি পেয়ে একটি বিরাট গাছে পরিণত হয়ে উঠল। সেই গাছটি পৃথিবীর বুকে শক্তপোক্ত হয়ে দাঁড়াল, তার মজবুত ডালপালার ডগায় অসংখ্য পাতা। গাছটির শেকড় এখনও আগের মতোই পৃথিবীর গভীরে প্রবেশ করে যাচ্ছে, এবং নিচের মাটির গভীরে ঢুকে যাচ্ছে। যে পৃথিবী এক সময়ে ছোট্ট অঙ্কুরটিকে রক্ষা করেছে, সে এখন একটি শক্তিশালী গাছের ভিত্তি।
গাছটির উপর ঝলমলিয়ে নেমে এলো সূর্যালোকের রশ্মি। গাছ তার শরীর তখন দুলিয়ে উঠল এবং শাখাগুলি ছড়িয়ে দিয়ে সূর্যালোকিত বাতাসে গভীর নিঃশ্বাস নিল। তার নীচের মাটিও গাছের সঙ্গেই নিঃশ্বাস নিল এবং পৃথিবী যেন পুনর্জীবন পেল। ঠিক তখনই এক ঝলক টাটকা বাতাস ডালপালার মধ্যে থেকে বয়ে এল এবং গাছের শরীরে আনন্দের শিহরণ খেলে গেল, শক্তির ঢেউ উঠল। গাছ ও সূর্যালোক পরস্পরের উপর নির্ভর করে চলে …
গাছের শীতল ছায়ায় বসে মানুষ সতেজ সুগন্ধি বাতাস উপভোগ করে উঠলো। বাতাস তাদের হৃদয় ও ফুসফুস পরিষ্কার করে দিল, এবং তাদের শরীরের রক্ত শোধন করে দিল, তাদের শরীর আর মন্থর বা অসাড় রইল না। মানুষ ও গাছ পরস্পরের উপর নির্ভর করে চলে …
একদল ছোট ছোট পাখি কিচিরমিচির ডাক দিতে দিতে গাছের ডালের উপর নেমে এল। হয়তো তারা সেখানে এসে নেমেছিল কোনও শিকারির হাত এড়ানোর জন্য, বা বংশবৃদ্ধি ও তাদের ছানাদের বড় করার জন্য, বা হয়তো তারা নিছকই কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম নিচ্ছিল। পাখি ও গাছ পরস্পরের উপর নির্ভর করে চলে …
গাছটির প্যাঁচানো, জট পাকানো শিকড় পৃথিবীর গভীরে প্রবেশ করে। গাছ তার গুঁড়ি দিয়ে পৃথিবীকে বাতাস ও বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা করে, এবং তার পায়ের তলার পৃথিবীকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য সে তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছড়িয়ে দেয়। গাছ এ কাজ করেছে কারণ পৃথিবী তার মা। তারা পরস্পরকে শক্তি জোগায় এবং পরস্পরের উপর নির্ভর করে, এবং তাদের মধ্যে কখনোই বিচ্ছেদ হবে না …
এখানেই এ গল্পের শেষ। যে গল্পটি আমি বললাম, তা একটি বীজ, পৃথিবী, একটি গাছ, সূর্যালোক, পাখি, ও মানুষকে নিয়ে। এতে মাত্র কয়েকটাই দৃশ্য ছিল। এই গল্পটি তোমাদের মধ্যে কী ধরনের অনুভূতির জন্ম দিল? আমি যখন এভাবে কথা বলি, তখন কি তোমরা বুঝতে পারো যে আমি কী বলছি? (আমরা বুঝতে পারি।) দয়া করে তোমাদের অনুভূতি সম্পর্কে বলো। এই গল্পটি শোনার পর তোমাদের কী অনুভূতি হল? প্রথমেই আমি তোমাদের বলি যে এ গল্পের সবকটি চরিত্রকেই দেখা ও ছোঁয়া সম্ভব; তারা বস্তব জীব, রূপক নয়। আমি চাই যে আমি যা বললাম, তা নিয়ে তোমরা ভাবনাচিন্তা করো। আমার গল্পে গূঢ় কোনও উপাদান ছিল না, এবং এর মূল বক্তব্যগুলি গল্পেরই কয়েকটি মাত্র বাক্য দিয়ে প্রকাশ করা যায়। (যে গল্পটি আমরা শুনলাম, তা একটি চমৎকার ছবিকে তুলে ধরে: একটি বীজের জন্ম হয়, এবং সে যখন বেড়ে ওঠে, সে বছরের চার ঋতুর অভিজ্ঞতা অর্জন করে: বসন্ত, গ্রীষ্ম, শরৎ ও শীত। পৃথিবী ঠিক মায়ের মতোই অঙ্কুরিত বীজটিকে লালন-পালন করে। শীতে পৃথিবী অঙ্কুরটিকে উষ্ণতা দেয়, যাতে সে ঠান্ডায় বেঁচে থাকতে পারে। অঙ্কুরটি বেড়ে উঠে গাছে পরিণত হওয়ার পর সূর্যালোকের রশ্মি তার ডালপালাগুলি ছুঁয়ে দেয় এবং তার ফলে গাছ অত্যন্ত উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। এখানে আমি দেখতে পাই যে ঈশ্বরের অসংখ্য সৃষ্টির মধ্যে পৃথিবীও জীবন্ত এবং সে ও গাছ পরস্পরের উপর নির্ভরশীল। আমি আরও দেখতে পাই যে সূর্যালোক গাছকে বিপুল উষ্ণতার আস্বাদ দেয়, এবং আমি দেখতে পাই যে পাখিরা খুব সাধারণ প্রাণী হলেও নিখুঁত সমন্বয়ের এই ছবিতে তারা গাছ ও মানুষের পাশাপাশি এসে দাঁড়াচ্ছে। গল্পটি শুনে আমার হৃদয়ে এই অনুভূতিগুলিই এসেছে; আমি উপলব্ধি করতে পারছি যে এই বস্তুগুলি সকলেই বস্তুতই জীবন্ত।) চমৎকার বলেছ? আর কারোর কি কোনও কিছু যোগ করার আছে? (একটি বীজের অঙ্কুরিত হয়ে ওঠা ও বিশাল এক বৃক্ষে পরিণত হওয়ার এই গল্পের মধ্যে আমি ঈশ্বরের সৃষ্টির বিস্ময়কে দেখতে পাই। আমি দেখতে পাই যে ঈশ্বর সমস্ত কিছুকে এমনভাবে তৈরী করেছেন যাতে তারা পরস্পরকে শক্তিশালী করে ও পরস্পরের উপর নির্ভর করে, এবং সমস্ত কিছু যাতে পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে ও পরস্পরের কাজে লাগে। আমি দেখতে পাই ঈশ্বরের প্রজ্ঞাকে, তাঁর বিস্ময়কে, এবং আমি বুঝতে পারি যে তিনিই সমস্ত কিছুর প্রাণের উৎস।)
এইমাত্র আমি যাকিছুর বিষয়ে কথা বললাম সে সবই তোমরা আগে দেখেছো। উদাহরণ হিসাবে বীজের কথা ধরা যাক—বীজ থেকে গাছ জন্ম নেয়, আর যদিও এই প্রক্রিয়ার প্রতিটি খুঁটিনাটি লক্ষ্য করে উঠতে হয়তো তুমি সক্ষম না-ও হতে পারো, কিন্তু তুমি জানো যে এরকমই হয়, তাই নয় কি? তুমি পৃথিবী আর সূর্যালোকের বিষয়েও জানো। গাছের ডালে বসে থাকা পাখিদের ছবি তো সবাই দেখেছে, তাই না? আর গাছের ছায়ায় মানুষের শরীর শীতল করার ছবি—এ-ও তোমরা সকলেই দেখেছো, তাই তো? (হ্যাঁ, দেখেছি।) তাহলে, এই সবকিছুই যদি একটিমাত্র ছবির মধ্যে এসে যায়, তখন ছবিটি কী রকম অনুভূতি সৃষ্টি করে? (এক সুসমন্বয়ের অনুভূতি।) এরকম একটি ছবির প্রত্যেকটি বস্তুই কি ঈশ্বরের থেকে আসে? (হ্যাঁ।) এগুলি ঈশ্বরের কাছ থেকে আসে বলে ঈশ্বর এইসব বিভিন্ন জিনিসের পার্থিব অস্তিত্বের মূল্য ও তাৎপর্য জানেন। ঈশ্বর যখন সমস্তকিছু সৃষ্টি করেছিলেন, যখন তিনি প্রতিটি বস্তুর পরিকল্পনা করে সেগুলিকে রূপদান করেছিলেন, তখন তাঁর এই কার্যের পিছনে সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ছিল; এবং তাঁর দ্বারা এই বস্তুগুলির সৃজনের সময়, প্রতিটির মধ্যেই জীবন সঞ্চারিত হয়েছিল। মানুষের জীবনধারণের জন্য যে পরিমণ্ডল তিনি রচনা করেছিলেন, আমাদের কাহিনীতে সদ্য যার বর্ণনা দেওয়া হল, সেই পরিমণ্ডলে বীজকণিকা ও মৃত্তিকা পরস্পরের উপর নির্ভরশীল, সেখানে মৃত্তিকা বীজগুলির পুষ্টিবিধান করে এবং বীজসমূহ মৃত্তিকার সঙ্গে সংলগ্ন থাকে। তাঁর সৃষ্টিকার্যের একেবারে সূচনালগ্নেই এই আন্তঃসম্পর্ক ঈশ্বরের দ্বারা নির্ধারিত হয়েছিলো। বৃক্ষ, সূর্যালোক, পাখপাখালি, ও মানব সম্বলিত কোনো দৃশ্যপট মানবজাতির নিমিত্ত ঈশ্বর-সৃষ্ট প্রাণময় পরিবেশেরই এক চিত্রায়ণ। প্রথমত, বৃক্ষ মৃত্তিকা ত্যাগ করে যেতে পারে না, আবার সূর্যালোক বিনা থাকতেও তা অক্ষম। তাহলে, ঈশ্বরের বৃক্ষ সৃজনের উদ্দেশ্য কী ছিল? এমন বলা কি যুক্তিযুক্ত যে শুধু মৃত্তিকার জন্যই বৃক্ষের সৃজন করা হয়েছিল? এমন কি বলা যায় যে এর নির্মাণ কেবল পাখিদের জন্য? এমন কি বলতে পারি যে একমাত্র মানুষের সুবিধার্থেই বৃক্ষের সৃষ্টি? (না।) তাদের মধ্যে সম্পর্কটি কী? তাদের মধ্যে সম্পর্কটি হল পারস্পরিক শক্তিদান, পারস্পরিক নির্ভরতা, ও অবিচ্ছেদ্যতার সম্পর্ক। অর্থাৎ বলা যায়, মৃত্তিকা, বৃক্ষ, সূর্যালোক, পক্ষিকুল, ও মানুষ তাদের জীবনধারণের জন্য পরস্পরের উপর ভরসা করে এবং একে অপরকে প্রতিপালন করে। বৃক্ষ মৃত্তিকার সংরক্ষণ করে, এবং মৃত্তিকা বৃক্ষকে লালন করে; সূর্যালোক বৃক্ষের বেঁচে থাকার সংস্থান যোগায়, সেখানে বৃক্ষ সূর্যালোক থেকে সতেজ বাতাস লাভ করে এবং ভূপৃষ্ঠে আপতিত দাহক রৌদ্রচ্ছটার প্রকোপ হ্রাস করে। পরিণামে কে এর থেকে উপকৃত হয়? উপকৃত হয় মানবজাতি, তা-ই নয় কি? এটি হল ঈশ্বর-সৃষ্ট মানবজাতির জীবনধারণের পরিবেশের অন্যতম মূলগত নীতি; আদি থেকেই ঈশ্বর যেমন মনস্থ করেছিলেন এটি তেমনই। যদিও এটি একটি সরলীকৃত চিত্ররূপ, তবুও এর মধ্যে আমরা ঈশ্বরের প্রজ্ঞা ও তাঁর অভিপ্রায়কে প্রত্যক্ষ করতে পারি। মৃত্তিকা বা বৃক্ষাদি ব্যতিরেকে মানবজাতি জীবনধারণ করতে পারে না, পাখপাখালি ও সূর্যকিরণ ছাড়াও নয়। তাই নয় কি? এটি নিছকই এক কাহিনী হলেও, এর মাধ্যমে যা চিত্রিত হয়ে ওঠে তা হল ঈশ্বর কর্তৃক আকাশ ও পৃথিবী এবং সমস্তকিছুর সৃজন এবং তাঁর দ্বারা মানবজাতির জীবনধারণের উপযোগী এক পরিমন্ডলের উপহারদানের এক ক্ষুদ্র প্রতিরূপ।
মানবজাতির নিমিত্তই ঈশ্বর সৃষ্টি করেছিলেন আকাশ ও পৃথিবী এবং সমস্ত কিছু, সেই সাথে বসবাসের জন্য এক পরিমণ্ডল। প্রথমে, আমাদের কাহিনী যে মূল বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল তা হল পারস্পরিক শক্তিদান, পারস্পরিক নির্ভরতা, এবং সকলকিছুর সহাবস্থান। এই নীতির অধীনে, মানবজাতির জীবনধারণের পরিমণ্ডল সুরক্ষিত থাকে; এটি তার অস্তিত্ব ধরে রাখতে পারে এবং একে অব্যাহত রাখা যায়। এর দরুনই, মানবজাতি সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠতে ও বংশবিস্তার করতে সক্ষম হয়। যে চিত্রটি আমরা দেখেছিলাম তাতে একটি বৃক্ষ, মৃত্তিকা, সূর্যালোক, পক্ষিকুল, এবং মানুষ একসঙ্গে ছিল। সেই ছবিটির মধ্যে ঈশ্বরও কি ছিলেন? সেখানে কেউ তো তাঁকে দেখতে পায়নি। তবে দৃশ্যটিতে অবশ্যই বিবিধ বস্তুর মধ্যে পারস্পরিক শক্তিদান ও আন্তঃনির্ভরতার নিয়মটিকে দেখা গিয়েছিল; এই নিয়মের মধ্যেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব ও সার্বভৌমত্ব পরিলক্ষিত হয়। সকল কিছুর জীবন ও অস্তিত্বকে সংরক্ষিত রাখার জন্যই ঈশ্বর এজাতীয় এক নীতি ও এরকম এক নিয়মের প্রয়োগ ঘটান। এইভাবে, তিনি সকল বস্তুর ও মানবজাতির জন্য সংস্থান করেন। এই কাহিনীটি কি আমাদের মূল আলোচ্য বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত? আপাতদৃষ্টিতে, মনে হয় যেন সম্পর্কিত নয়, কিন্তু বাস্তবে, যে নিয়ম অনুসারে ঈশ্বর সকল বস্তু সৃষ্টি করেছিলেন এবং সকলকিছুর উপর তাঁর যে প্রভুত্ব তা তাঁর সকলকিছুর জীবনের উৎস হওয়ার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। এই সত্যগুলি অবিচ্ছেদ্য। এবার তোমরা কিছু জ্ঞানার্জন করতে শুরু করছো!
ঈশ্বর সেই নিয়মগুলির নির্দেশ দিয়ে থাকেন যেগুলি সমস্তকিছুর কার্যকারিতা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে, সমস্তকিছুর অস্তিত্ব যে সকল নিয়মের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, তারও আজ্ঞাকারী স্বয়ং ঈশ্বর; তিনি সকল বস্তুকে নিয়ন্ত্রণ করেন, তিনিই সকল বস্তুর শক্তিবৃদ্ধি করেন, সকল বস্তুকে পরস্পর-নির্ভরশীল করে তোলেন যাতে তাদের ধ্বংস অথবা বিলয় না ঘটে। একমাত্র এইভাবেই মানবজাতি জীবিত থাকতে পারবে; কেবলমাত্র এইভাবেই তারা ঈশ্বরের নির্দেশিকার অধীনে থেকে এই পরিবেশে বেঁচে থাকতে পারবে। ঈশ্বরই এই সকল কার্যবিধির নিয়ন্ত্রক, এবং অন্য কেউ সেই বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে বা সেই নিয়মগুলির পরিবর্তন করতে পারে না। কেবলমাত্র স্বয়ং ঈশ্বরই এই নিয়মগুলি জানেন এবং কেবলমাত্র স্বয়ং ঈশ্বরই সেগুলি পরিচালনা করেন। বৃক্ষ কখন অঙ্কুরিত হবে; কখন বৃষ্টিপাত ঘটবে; মৃত্তিকা কতখানি জল ও কত সংখ্যক পুষ্টিউপাদান উদ্ভিদদের প্রদান করবে; কোন ঋতুতে পত্রমোচন ঘটবে; কোন ঋতুতেই বা বৃক্ষাদি ফল ধারণ করবে; সূর্যালোক গাছদের কত সংখ্যক পুষ্টিউপাদান সরবরাহ করবে; সূর্যকিরণ গ্রহণের পর নিঃশ্বাসবায়ুর সাথে বৃক্ষাদি কীসের নিঃসারণ ঘটাবে—ঈশ্বর যখন সমস্তকিছু সৃষ্টি করেছিলেন, তখনই অলঙ্ঘনীয় বিধান হিসাবে এইসব তিনি পূর্বনির্ধারিত করেছিলেন। ঈশ্বর যাকিছু সৃষ্টি করেছিলেন, সে সজীব বস্তুই হোক অথবা মানুষের দৃষ্টিতে নির্জীবই হোক, সকলকিছুই তাঁর করতলে অধিষ্ঠান করে, সেখানেই তিনি তাদের নিয়ন্ত্রণ করেন এবং তাদের উপর রাজত্ব করেন। এই নিয়মগুলির কোনো পরিবর্তন বা ব্যত্যয় ঘটাতে কেউই সক্ষম নয়। অর্থাৎ, ঈশ্বর যখন সকলকিছুর সৃজন ঘটান, তখনই তিনি পূর্বনির্ধারিত করে দিয়েছিলেন যে মৃত্তিকা ব্যতিরেকে, গাছপালা তাদের শিকড় চালনা করতে, অঙ্কুরিত হতে, এবং বেড়ে উঠতে পারবে না; ভূপৃষ্ঠে কোনো গাছপালা না থাকলে তা শুকিয়ে যাবে; বৃক্ষই হয়ে উঠবে পাখপাখালির বাসগৃহ ও বায়ুপ্রবাহ থেকে রক্ষা পেতে তাদের আশ্রয়স্থল। মৃত্তিকা ছাড়া কোনো গাছ কি বাঁচতে পারে? কখনোই পারে না। সূর্য বা বৃষ্টিপাত ব্যতীত কি তা জীবনধারণ করতে পারে? তা-ও পারে না। এই সমস্ত বস্তুই মানবজাতির জন্য, তাদের অস্তিত্বরক্ষার জন্য। বৃক্ষের কাছ থেকে, মানুষ তাজা বাতাস প্রাপ্ত হয়, এবং মানুষ গাছপালার দ্বারা সুরক্ষিত মৃত্তিকার উপর বসবাস করে। সূর্যালোক বা নানাবিধ জীবিত সত্তার সাহচর্য ব্যতীত মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না। এই আন্তঃসম্পর্কগুলি জটিল হলেও, তোমাকে মনে রাখতেই হবে যে ঈশ্বর সমস্ত কিছুর নিয়ন্ত্রক এই নিয়মসমূহের প্রণয়ন করেন যাতে তারা পরস্পরকে শক্তিদান করতে পারে, পরস্পরের উপর নির্ভর করতে পারে, এবং একত্রে অবস্থান করতে পারে। বাক্যান্তরে, তাঁর সৃষ্ট প্রত্যেকটি বস্তুর মূল্য ও তাৎপর্য আছে। ঈশ্বর যদি তাৎপর্যরহিত কিছু সৃজন করতেন, তাহলে ঈশ্বরই সেটির বিলোপ ঘটাতেন। যাবতীয় কিছুর জন্য সংস্থান যোগানোর কাজে এ হল ঈশ্বরের অবলম্বিত অন্যতম পদ্ধতি। এই কাহিনীতে “সংস্থান সরবরাহ করা” বলতে কী বোঝায়? ঈশ্বর কি প্রতিদিন গাছপালায় জল সিঞ্চন করেন? শ্বাসপ্রশ্বাস চালাতে বৃক্ষের কি ঈশ্বরের সহায়তার প্রয়োজন পড়ে? (না।) এখানে “সংস্থান সরবরাহ করা” বলতে সকল কিছুকে সৃষ্টি করার পর ঈশ্বর কর্তৃক সেগুলির ব্যবস্থাপনার কথা বোঝায়; সৃজিত বস্তুগুলির নিয়ন্ত্রক নিয়মসমূহ প্রতিষ্ঠা করার পর সেগুলির পরিচালনা করাই ঈশ্বরের পক্ষে যথেষ্ট। মৃত্তিকাগর্ভে বীজকণা একবার উপ্ত হয়ে গেলে, বৃক্ষ নিজে থেকেই বিকশিত হয়। বৃক্ষাদির বেড়ে ওঠার সকল শর্তই ঈশ্বরের দ্বারা প্রণীত হয়েছিল। ঈশ্বর সূর্যকিরণ, জল, মাটি, বায়ু, এবং চতুষ্পার্শ্বের পরিমণ্ডল গড়ে তুলেছিলেন; ঈশ্বর বায়ুপ্রবাহ, হিম, তুষার, এবং বৃষ্টিপাত ও চারটি ঋতুর নির্মাণ করেছিলেন। এগুলিই হল গাছপালার বিকশিত হওয়ার প্রয়োজনীয় শর্তাবলী, এবং এগুলিই সেই সব বস্তু যা ঈশ্বর সৃজন করেছিলেন। তাহলে, ঈশ্বরই কি এই প্রাণময় পরিমণ্ডলের উৎস? (হ্যাঁ।) ঈশ্বরকে কি প্রত্যেক দিন গাছের প্রতিটি পাতা গুনে রাখতে হবে? না! এবং গাছপালার শ্বাসকার্য চালানোর জন্য বা “এবার বৃক্ষের উপর কিরণ সম্পাতের সময় হয়েছে” বলে প্রতিদিন সূর্যালোককে জাগিয়ে তোলার জন্যও ঈশ্বরের সহায়তার কোনো দরকার নেই। এসব করার তাঁর কোনো প্রয়োজন পড়ে না। সূর্যালোকের যখন প্রভা দানের সময় হয় তখন সে স্বতই, নিয়ম অনুযায়ীই, ভাস্বর হয়ে ওঠে; তা উদিত হয় ও বৃক্ষের উপর দীপ্তি দান করে এবং বৃক্ষের যখন প্রয়োজন হয় তখন বৃক্ষ সেই সূর্যালোক শোষণ করে নেয়, এবং যখন প্রয়োজন পড়ে না, তখনও বৃক্ষ বিধানের অভ্যন্তরেই জীবননির্বাহ করে। তোমরা হয়তো এই বিষয়টি স্পষ্ট করে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম না-ও হতে পারো, কিন্তু তাহলেও এটি সকলের দৃষ্টিগ্রাহ্য ও স্বীকার্য এক বাস্তব ঘটনা। তোমাদের একমাত্র যা প্রয়োজন তা হল সমস্তকিছুর অস্তিত্বের নিয়ন্ত্রণকারী বিধানগুলিকে ঈশ্বরের থেকে আগত বলে চিহ্নিত করতে পারা, এবং ঈশ্বরই যে যাবতীয় বস্তুর বিকাশ ও উদ্বর্তনের উপর সার্বভৌম ক্ষমতা ধারণ করেন সে বিষয়ে অবহিত হওয়া।
এখন, মানুষ যাকে “রূপক” বলে উল্লেখ করে থাকে এই কাহিনীতে সেরকম কিছু কি রয়েছে? এটি কি ব্যক্তিত্বারোপের দৃষ্টান্ত? (না।) আমি এক বাস্তব কাহিনীই শুনিয়েছি। সকল প্রকারের জীবন্ত বস্তু, জীবন আছে এমন সমস্ত কিছুই, ঈশ্বরের দ্বারা শাসিত; প্রতিটি জীবিত বস্তু সৃষ্টির সময় ঈশ্বর তাদের জীবনের দ্বারা সম্পৃক্ত করে তুলেছিলেন; প্রতিটি জীবিত সত্তার জীবন ঈশ্বরের থেকে আগত এবং এই জীবন তার পরিচালক গতিপথ ও বিধানসমূহকে অনুসরণ করে। এর পরিবর্তনের জন্য মানুষের দরকার পড়ে না, এবং মানুষের সহায়তারও এর কোনো প্রয়োজন নেই; ঈশ্বরের সকলকিছুকে সংস্থান সরবরাহের এটি অন্যতম এক পদ্ধতি। বিষয়টি তোমরা বুঝতে পারছো, তাই তো? তোমাদের কি মনে হয় যে মানুষের এটি উপলব্ধি করা জরুরী? (হ্যাঁ, মনে হয়।) তাহলে, এই কাহিনীটির কি জীববিদ্যার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রয়েছে? এটি কি কোনো ভাবে জ্ঞানের কোনো ক্ষেত্র বা শিক্ষার কোনো শাখার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট? আমরা জীববিদ্যার আলোচনা করছি না, এবং নিশ্চিতভাবেই আমরা জীববৈজ্ঞানিক কোনো গবেষণা চালাচ্ছি না। আমাদের আলোচনার মূল বিষয়টি কী? (ঈশ্বর সমস্ত কিছুর প্রাণের উৎস।) সৃষ্টির মধ্যে তোমরা কী লক্ষ্য করেছো? তোমরা কি গাছপালা দেখতে পেয়েছো? তোমরা কি ভূভাগ লক্ষ্য করেছো? (হ্যাঁ।) তোমরা সূর্যালোকও দেখতে পেয়েছো, তাই না? তোমরা তো গাছে বসে থাকা পাখিদেরও লক্ষ্য করেছো? (করেছি।) এই রকম এক পরিবেশে জীবনযাপন করতে পেরে মানবজাতি কি খুশি? (হ্যাঁ।) অর্থাৎ, ঈশ্বর সমস্ত বস্তুকে—যে সমস্ত বস্তু তিনি সৃষ্টি করেছেন—সেগুলিকে ব্যবহার করেন মানবজাতির বাসস্থানকে, তাদের জীবন-পরিবেশকে অক্ষুণ্ণ ও সুরক্ষিত রাখতে। এইভাবেই ঈশ্বর মানবজাতির এবং অন্য সমস্ত কিছুর জন্য সংস্থানের যোগান দেন।
কথাবার্তার এই শৈলী, যে ভাবে আমি আলাপ-আলোচনা করছি, তা তোমাদের কেমন লাগছে? (এটা উপলব্ধি করার পক্ষে সহজ, এবং এতে বাস্তব-জীবন থেকে অনেক উদাহরণ আছে।) আমি যা বলছি তা তো অন্তঃসারশূন্য বাগাড়ম্বরমাত্র নয়, তাই না? ঈশ্বর যে সমস্ত কিছুর প্রাণের উৎস তা উপলব্ধি করার জন্য মানুষের কি এই কাহিনীটির প্রয়োজন আছে? (হ্যাঁ, আছে।) সেক্ষেত্রে, চলো আমরা আমাদের পরের গল্পটির দিকে এগিয়ে যাই। পরের কাহিনীটি বিষয়বস্তুতে একটু অন্যরকম, এবং গল্পের কেন্দ্রবিন্দুটিও কিছুটা আলাদা। এই কাহিনীতে যা কিছু আছে সেগুলি সবই এমন বস্তু যা মানুষ তাদের দৃষ্টিতে ঈশ্বরের সৃষ্টির মধ্যেই দেখতে পায়। এবার, আমি আমার পরের আখ্যান শুরু করবো। অনুগ্রহ করে শান্ত মনে শোনো এবং দ্যাখো আমার অর্থটি তোমরা ধরতে পারো কি না। গল্পটি শেষ হলে, তোমরা কতটা উপলব্ধি করেছো তা যাচাই করতে আমি তোমাদের কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবো। এই কাহিনীর চরিত্রগুলি হল এক প্রকাণ্ড পর্বত, একটি ছোট্ট নদী, এক তুমুল হাওয়া, এবং একটি দৈত্যাকার তরঙ্গ।
—বাক্য, খণ্ড ২, ঈশ্বরকে জানার প্রসঙ্গে, স্বয়ং অনন্য ঈশ্বর ৭