পঞ্চম দিবসে, বিবিধ এবং বৈচিত্র্যময় গঠনের জীবন বিভিন্ন উপায়ে সৃষ্টিকর্তার কর্তৃত্ব প্রদর্শন করে
শাস্ত্রে বলা হয়েছে, “ঈশ্বর বললেন, জলরাশি পূর্ণ হোক নানা জাতির জলচর প্রাণীতে এবং পৃথিবীর উপরে আকাশে উড়ে বেড়াক পক্ষীকুল। ঈশ্বর সৃষ্টি করলেন বৃহদাকার সামুদ্রিক জীব এবং সকল শ্রেণীর জলচর প্রাণী। তারা দলে দলে জলধিবক্ষে বিচরণ করতে লাগল। তিনি সৃষ্টি করলেন সকল জাতির পক্ষীকুল। ঈশ্বর দেখলেন, সবই চমৎকার।” (আদিপুস্তক ১:২০-২১)। শাস্ত্র আমাদের স্পষ্টভাবে বলে যে, এই দিনটিতে, ঈশ্বর জলের প্রাণী এবং আকাশের পাখি তৈরি করেছিলেন, অর্থাৎ তিনি বিভিন্ন মাছ ও পাখি সৃষ্টি করেছিলেন এবং সেগুলির প্রতিটিকে তাদের নিজ নিজ প্রকার অনুসারে শ্রেণিবদ্ধ করেছিলেন। এইভাবে, পৃথিবী, আকাশ এবং জল ঈশ্বরের সৃষ্টি দ্বারা সমৃদ্ধ হয়েছিল …
ঈশ্বরের বাক্যগুলি কথিত হওয়ামাত্র, সৃষ্টিকর্তার বাক্যসমূহের মাঝেই, ভিন্ন ভিন্ন আকারের সজীব নবীন প্রাণসত্তা জেগে উঠল। ঠেলাঠেলি, লাফালাফি ও আনন্দে নৃত্য করতে করতে তারা এই পৃথিবীতে এল…। সকল প্রকার আকার ও আকৃতির মাছ জলের মধ্যে সাঁতরে বেড়ানো শুরু করল; সকল প্রকার শামুক-জাতীয় খোলসে আবৃত জলজপ্রাণ বালি ফুঁড়ে উঠে এল; আঁশযুক্ত, খোলসযুক্ত ও অমেরুদণ্ডী জীবসকল ক্ষুদ্র, দীর্ঘ কিংবা খর্ব—নানাবিধ আকার ধারণ করে সত্বর বেড়ে উঠল। তেমনই বিবিধ প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবালও দ্রুত বেড়ে উঠতে শুরু করল, বিবিধ প্রজাতির জলজ প্রাণসত্তার জীবনের গতিতে দোদুল্যমান হয়ে, তরঙ্গায়িত হয়ে, স্থির জলরাশিকে যেন আর্জি জানিয়ে বলে উঠল: “তাড়াতাড়ি করো! তোমার বন্ধুদের নিয়ে এসো! কারণ তুমি আর কখনোই একা থাকবে না!” ঈশ্বর-সৃষ্ট বিভিন্ন জীবের জলে আবির্ভূত হওয়ার মুহূর্ত থেকে, প্রতিটি নতুন জীব এতদিন ধরে নিশ্চল হয়ে থাকা জলরাশিতে প্রাণশক্তি নিয়ে এল, এবং সূচনা ঘটাল এক নতুন যুগের…। সেই মুহূর্ত থেকে, তারা একে অপররকে আলিঙ্গন করল, এবং পরস্পরকে সঙ্গ দিতে আরম্ভ করল, নিজেদের মধ্যে আর কোনো ব্যবধান রাখলো না। জলরাশির বিদ্যমান হয়েছিল স্বীয় অভ্যন্তরস্থ জীবসমূহের উদ্দেশ্যেই, জলরাশি তার আলিঙ্গনে আবদ্ধ প্রতিটি প্রাণীকে পরিপোষণ করেছিল, এবং জলের জন্যই, জলের পরিপোষণেরকারণেই, প্রতিটি প্রাণীর অস্তিত্বলাভ সম্ভব হয়য়। প্রত্যেকে প্রত্যকেকে প্রাণ প্রদান করেছিল, এবং, সেই সাথে, একইভাবে প্রত্যেকেই ঈশ্বরের সৃষ্টির চমকপ্রদতা ও মাহাত্ম্যের, এবং ঈশ্বরের কর্তৃত্বের অনতিক্রম্য শক্তির সাক্ষ্য বহন করেছিল …
সমুদ্র যেমন আর নীরব রইল না, তেমনই আকাশও প্রাণপূর্ণ হয়ে উঠতে শুরু করল। ছোট-বড় একের পর এক পাখি মাটি থেকে আকাশেরপানে উড়ে গেল। সমুদ্রের জীবসমূহ থেকে পৃথক এই পাখিদের ছিল ডানা এবং তাদের অস্থূল ও সুতনু অবয়বগুলি আবৃত ছিল পালকে। তারা সদম্ভে এবং গর্বভরে ডানা ঝাপটিয়ে তাদের পালকের আবরণ এবং সৃষ্টিকর্তার দ্বারা প্রাপ্ত বিশেষ ক্রিয়াকলাপ ও দক্ষতাগুলি প্রদর্শন করেছিল। তারা স্বাধীনভাবে ক্রমশ ঊর্ধ্বে উড্ডীন হল, এবং আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যে, তৃণভূমি ও অরণ্যময় বিচরণ শুরু করল…। তারা ছিল বাতাসের প্রিয়, তারা ছিল সকল বস্তুর প্রিয়পাত্র। অচিরেই তারা আকাশ ও পৃথিবীর সংযোগস্বরূপ হয়ে উঠতে চলেছিল, শীঘ্রই তারা সকল বস্তুর বার্তাবাহক হয়ে উঠতে চলেছিল…। তারা গান গাইল, তারা সানন্দে উড্ডীয়মান হল, তারা একদা শূন্য এই পৃথিবীতে নিয়ে এল আনন্দ, উল্লাস ও প্রাণবন্ততা…। প্রদত্ত জীবনের জন্য তারা সৃষ্টিকর্তার প্রশংসা করতে তাদের সুস্পষ্ট, সুরেলা সঙ্গীতের ব্যবহার করেছিল, ব্যবহার করেছিল তাদের অন্তরের কথাগুলি। তারা ঈশ্বরের সৃষ্টির যথাযথতা তথা চমকপ্রদতা প্রদর্শন করার উদ্দেশ্যে উল্লসিত হয়ে নেচে উঠেছিল, সৃষ্টিকর্তার দ্বারা তাদের প্রতি প্রদত্ত সেই বিশিষ্ট প্রাণসত্তার মাধ্যমে তাঁর কর্তৃত্বের সাক্ষ্য বহন করার উদ্দেশ্যে তারা তাদের সমগ্র জীবন উৎসর্গ করল …
জলচর কিংবা খেচর, সৃষ্টিকর্তার আদেশবলে জীবনের বিভিন্ন অবয়বে এই বিবিধ জীবসকল বিদ্যমান ছিল, এবং সৃষ্টিকর্তার আজ্ঞায়, নিজ নিজ প্রজাতি অনুযায়ী একত্রিত হয়েছিল—এবং এই বিধান, এই নিয়ম ছিল কোনো জীবের দ্বারা অপরিবর্তনীয়। তারা কখনোই সৃষ্টিকর্তা দ্বারা নির্ধারিত সীমানা অতিক্রম করার স্পর্ধা দেখায়নি, তারা তা করতে সক্ষমও ছিল না। সৃষ্টিকর্তা দ্বারা নির্ধারিত হিসাব অনুসারেই তারা বেঁচেছিল এবং সংখ্যাবৃদ্ধি করেছিল, এবং আজ অবধি চিরকাল তারা সৃষ্টিকর্তা দ্বারা তাদের জন্য নির্ধারিত জীবনধারা ও বিধানগুলি কঠোরভাবে পালন করে এসেছে, এবং সজ্ঞানে তাঁর অব্যক্ত আদেশ এবং তাদেরকে সৃষ্টিকর্তার দেওয়া স্বর্গীয় অনুশাসন তথা কর্মবিধিসমূহ মান্য করে চলে। তারা তাদের নিজ-নিজ বিশেষ উপায়ে সৃষ্টিকর্তার সাথে কথোপকথন করেছিল, সৃষ্টিকর্তার অর্থের মর্ম উপলব্ধি করতে পেরেছিল, এবং তাঁর আদেশসমূহ পালন করেছিল। কেউ কখনও সৃষ্টিকর্তার কর্তৃত্বের সীমা লঙ্ঘন করেনি, এবং সৃষ্টিকর্তার চিন্তার মাধ্যমেই তাদের উপর তাঁর সার্বভৌমত্ব ও শাসন প্রযুক্ত হয়েছিল; কোনো বাক্য জারি করা হয়নি, তবু ঈশ্বরের অনন্য কর্তৃত্ব সমস্তকিছু নিয়ন্ত্রণ করে গিয়েছিল নিঃশব্দে, যার মধ্যে কোনো ভাষাগত ক্রিয়াকলাপ ছিল না, এবং যা ছিল মানুষের চেয়ে পৃথক। এই বিশেষ উপায়ে তাঁর কর্তৃত্বের প্রয়োগ মানুষকে এক নতুন জ্ঞান লাভ করতে, এবং সৃষ্টিকর্তার অনন্য কর্তৃত্বের এক নতুন ব্যাখ্যা তৈরী করতে বাধ্য করেছিল। এখানে, আমাকে বলতেই হবে যে এই নতুন দিনটিতে, সৃষ্টিকর্তার কর্তৃত্বের প্রয়োগ আরও একবার সৃষ্টিকর্তার অনন্যতা প্রদর্শন করেছিল।
এরপর, দেখে নেওয়া যাক শাস্ত্রের এই অনুচ্ছেদের শেষ বাক্যটি: “ঈশ্বর দেখলেন, সবই চমৎকার।” তোমাদের এর অর্থ কী বলে মনে হয়? এই বাক্যগুলির মধ্যে ঈশ্বরের আবেগসমূহ নিহিত রয়েছে। ঈশ্বর তাঁর সৃষ্ট সকলকিছু, যা তাঁর বাক্যসমূহের কারণেই প্রাণ পেয়েছিল, অবিচল ছিল, এবং ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হতে শুরু করেছিল, সেগুলি পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। এই সময়ে, ঈশ্বর কি তাঁর বাক্যসমূহ দ্বারা প্রস্তুত বিবিধ বস্তু, এবং তাঁর অর্জিত বিবিধ কর্ম নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন? এর উত্তর হল যে “ঈশ্বর দেখলেন, সবই চমৎকার।” তোমরা এখানে কী দেখো? “ঈশ্বর দেখলেন, সবই চমৎকার।”—এই শব্দবন্ধনী কিসের প্রতিনিধিত্ব করে? এটি কী চিহ্নিত করে? এর অর্থ হল, ঈশ্বর যা পরিকল্পনা করেছিলেন ও নির্দেশ দিয়েছিলেন তা সাধন করার, তথা তিনি যা সম্পাদন করবেন বলে নির্ধারণ করেছিলেন সেই লক্ষ্যগুলি সম্পাদন করার, ক্ষমতা ও প্রজ্ঞা তাঁর রয়েছে। প্রতিটি করণীয় কাজ সম্পন্ন করার পর ঈশ্বর কি অনুশোচনা অনুভব করেছিলেন? এর উত্তর, এখনও, “ঈশ্বর দেখলেন, সবই চমৎকার।” প্রকারান্তরে বললে, শুধু যে তাঁর কোনো অনুশোচনা বোধ হয়নি তা-ই নয়, বরং, পরিবর্তে, তিনি সন্তুষ্ট বোধ করেছিলেন। তঁর কোনো অনুশোচনা বোধ না করার অর্থ কী? এর অর্থ হল, ঈশ্বরের পরিকল্পনা নিখুঁত, তাঁর শক্তি ও প্রজ্ঞা নিখুঁত, এবং কেবলমাত্র তাঁর কর্তৃত্ব দ্বারাই এহেন যথাযথতা অর্জন করা যায়। মানুষ যখন কোনো করণীয় কাজ সম্পাদন করে, সে কি তখন ঈশ্বরের মত সেটিকে ভালো হিসাবে দেখতে পায়? মানুষ যা কিছু করে তাতে কি সে যথাযথতা অর্জন করতে পারে? মানুষ কি একেবারে এবং চিরতরে কোনোকিছু সম্পূর্ণ করতে পারে? মানুষ যেমন বলে, “কিছুই নিখুঁত নয়, শুধু অন্য কিছুর চেয়ে বেশি ভালো,” তেমনই, মানুষের করা কোনো কাজই যথাযথতা অর্জন করতে পারে না। ঈশ্বর যখন দেখলেন যে তিনি যা যা সম্পাদন ও অর্জন করেছিলেন সে সকলই উত্তম, ঈশ্বরের করা সমস্তকিছুই তাঁর বাক্য দ্বারা নির্ধারিত, অর্থাৎ, যখন “ঈশ্বর দেখলেন, সবই চমৎকার”, তখন তাঁর সৃষ্ট সকলকিছুই চিরতরে একটি স্থায়ী রূপ ধারণ করল, প্রকার অনুযায়ী সেগুলি শ্রেণিবদ্ধ করা হল, এবং নির্দিষ্ট একটা অবস্থান, উদ্দেশ্য ও কার্যকারিতা প্রদান করা হল। উপরন্তু, সকল বস্তুর মধ্যে তাদের যা ভূমিকা, এবং ঈশ্বরের সকলকিছুর ব্যবস্থাপনা চলাকালীন তাদের আবশ্যিক যে যাত্রা, তা ইতিমধ্যেই ঈশ্বর দ্বারা নিরূপিত করা হয়ে গিয়েছিল, এবং সেগুলি ছিল অপরিবর্তনীয়। এ-ই ছিল ঈশ্বরের দ্বারা সকল বস্তুর প্রতি প্রদত্ত স্বর্গীয় বিধান।
“ঈশ্বর দেখলেন, সবই চমৎকার”, এই সহজ, অবমূল্যায়িত, প্রায়শই উপেক্ষিত বাক্যগুলিই হল সকল প্রাণীকে ঈশ্বর প্রদত্ত স্বর্গীয় বিধান এবং স্বর্গীয় ফরমান-সমন্বিত বাক্যসমূহ। এগুলি হল সৃষ্টিকর্তার কর্তৃত্বের ভিন্নতর এক প্রতিরূপ, যা অধিকতর বাস্তবিক ও গভীরতর। তাঁর বাক্যসমূহের মধ্য দিয়ে, সৃষ্টিকর্তা যে শুধুমাত্র তিনি যা অর্জন করতে চেয়েছিলেন তা অর্জনে, এবং তিনি যা সাধন করতে চেয়েছিলেন তা সাধনেই সক্ষম ছিলেন, তা-ই নয়, বরং তিনি তাঁর সৃষ্ট সকল বস্তুকেই স্বহস্তে নিয়ন্ত্রণ, এবং তাঁর কর্তৃত্বের অধীনে সৃষ্ট সকল বস্তুর উপর শাসন করতে পারতেন, এবং, উপরন্তু, সকলকিছুই ছিল নিয়মাবদ্ধ ও নিয়মিত। সকল বস্তুই তাঁর বাক্য দ্বারা বিস্তারলাভ করেছিল, বিদ্যমান হয়েছিল এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল, উপরন্তু তাঁর কর্তৃত্ব দ্বারা সেগুলি তাঁর প্রকাশিত বিধানের মধ্যেই বিদ্যমান ছিল, কেউই অব্যাহতি পায়নি! এই বিধানের সূচনা হয়েছিল ঠিক সেই মুহূর্তে, যখন, “ঈশ্বর দেখলেন, সবই চমৎকার”, এবং, ঈশ্বরের পরিচালনামূলক পরিকল্পনার উদ্দেশ্যে, এই বিধান বিদ্যমান, অব্যাহত, এবং কার্যকারী রইবে যেদিন সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং তা প্রত্যাহার করবেন ততদিন পর্যন্ত! ঈশ্বরের অনন্য কর্তৃত্ব শুধুমাত্র তাঁর সকল বস্তু সৃষ্টি করার ক্ষমতা তথা সকল বস্তুকে সত্তায় পরিণত হওয়ার জন্য আদেশ দেওয়ার মধ্যেই প্রকাশ পায়নি, তা প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর সকল বস্তুকে শাসন করার এবং সকল বস্তুর উপর সার্বভৌমত্ব কায়েম করার, এবং সকল বস্তুর মধ্যে জীবন তথা প্রাণশক্তি সঞ্চার করার ক্ষমতায়, এবং, উপরন্তু, তা প্রকাশ পেয়েছিল তাঁর পরিকল্পনায় তিনি যাকিছু সৃষ্টি করতে চলেছিলেন সেই সকল বস্তুর অনন্তকালের জন্য, তথা চিরতরে, তাঁর দ্বারা নির্মিত এই বিশ্বচরাচরে, সম্পূর্ণ যথাযথ আকৃতিতে, এবং যথাযথ এক জীবন-কাঠামোয় ও যথাযথ ভূমিকায়, উৎপত্তি ঘটানোর, এবং সেগুলিকে বিদ্যমান রাখার ক্ষমতার মধ্যেও। সৃষ্টিকর্তার চিন্তাভাবনাগুলির কোনও সীমাবদ্ধতার অধীনে না থাকার এবং সেগুলির স্থান-কাল বা ভৌগলিক সীমাবদ্ধতায় না থাকার মধ্যেও তা প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁর কর্তৃত্বের মতই, সৃষ্টিকর্তার অনন্য পরিচয়ও শাশ্বত ও চিরন্তনই রয়ে যাবে। তাঁর কর্তৃত্ব সততই তাঁর পরিচয়ের এক প্রতিনিধি ও চিহ্ন হয়ে থাকবে, এবং তাঁর কর্তৃত্ব চিরকালই তাঁর পরিচয়ের পাশাপাশি বিদ্যমান রয়ে যাবে!
—বাক্য, খণ্ড ২, ঈশ্বরকে জানার প্রসঙ্গে, স্বয়ং অনন্য ঈশ্বর ১