পর্বতে প্রদত্ত যীশুর উপদেশ, প্রভু যীশুর উপাখ্যানসমূহ এবং আদেশসমূহ
পর্বতে প্রদত্ত যীশুর উপদেশ
ঐশ্যরাজ্যের সুখ (মথি ৫:৩-১২)
লবণ ও জ্যোতি (মথি ৫:১৩-১৬)
বিধান (মথি ৫:১৭-২০)
ক্রোধ (মথি ৫:২১-২৬)
ব্যভিচার (মথি ৫:২৭-৩০)
বিবাহবিচ্ছেদ (মথি ৫:৩১-৩২)
শপথ (মথি ৫:৩৩-৩৭)
চোখের বদলে চোখ (মথি ৫:৩৮-৪২)
তোমার শত্রুদের ভালোবাসো (মথি ৫:৪৩-৪৮)
দান করার বিষয়ে নির্দেশ (মথি ৬:১-৪)
প্রার্থনা (মথি ৬:৫-৮)
প্রভু যীশুর উপাখ্যানসমূহ
বীজবপনকারীর উপাখ্যান (মথি ১৩:১-৯)
শ্যামাঘাসের উপাখ্যান (মথি ১৩:২৪-৩০)
সরিষা বীজের উপাখ্যান (মথি ১৩:৩১-৩২)
খামিরের উপাখ্যান (মথি ১৩:৩৩)
শ্যামাঘাসের উপাখ্যানের ব্যাখ্যা (মথি ১৩:৩৬-৪৩)
গুপ্তধনের উপাখ্যান (মথি ১৩:৪৪)
মুক্তার উপাখ্যান (মথি ১৩:৪৫-৪৬)
টানাজালের উপাখ্যান (মথি ১৩:৪৭-৫০)
আদেশসমূহ
মথি ২২:৩৭-৩৯ যীশু উত্তর দিলেন, তুমি কায়মনোবাক্যে তোমার ঈশ্বরকে ভালবাসবে—এটি হল সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সর্বপ্রথম আদেশ। আর দ্বিতীয়টিও এরই তুল্য, তুমি তোমার প্রতিবেশীকে আত্মজ্ঞানে ভালবাসবে।
প্রথমে “পর্বতে অবস্থানকালে প্রদত্ত ধর্মোপদেশ”-এর বিভিন্ন অংশের প্রত্যেকটির দিকে তাকিয়ে দেখা যাক। এই বিভিন্ন অংশগুলির সবকটিই কোন বিষয়টি আলোচনা করে? নিশ্চিতভাবে বলা যায়, এই সকল বিভিন্ন অংশগুলির বিষয়বস্তু বিধানের যুগের বিধিনিষেধগুলির তুলনায় আরো সমুন্নত, অধিকতর বস্তুগত, এবং মানুষের জীবনের নিকটতর। আধুনিক পরিভাষায় বললে, এই বিষয়গুলি মানুষের বাস্তব অনুশীলনের সঙ্গে আরো বেশি প্রাসঙ্গিক।
নিম্নবর্ণিত সুনির্দিষ্ট বিষয়বস্তুটির সম্বন্ধে পাঠ করা যাক: ঐশ্যরাজ্যের সুখ বিষয়ক যীশুর ধর্মোপদেশগুলি তোমার কীভাবে উপলব্ধি করা উচিত? বিধান সম্পর্কে তোমার কী অবগত থাকা বিধেয়? ক্রোধকে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করা উচিত? ব্যভিচারীদের কীভাবে মোকাবিলা করা উচিত? বিবাহবিচ্ছেদের বিষয়ে কীভাবে কথা বলা বিধিসম্মত, এবং এর বিষয়ে কী ধরনের আইনকানুন রয়েছে? কারা বিবাহবিচ্ছিন্ন হতে পারে এবং কারা পারে না? শপথ, প্রতিহিংসা, শত্রুকে ভালোবাসা, এবং বদান্য হওয়া বিষয়গুলিকেই বা কীভাবে দেখা বিধেয়? এবং এজাতীয় আরো অনেক বিষয়। এই বিষয়গুলির সবই মানবজাতির ঈশ্বর-বিশ্বাস সম্বন্ধীয় অনুশীলন, ও তাদের ঈশ্বর-অনুসরণের প্রতিটি দিকের সঙ্গে সম্পর্কিত। এই অনুশীলনগুলির কয়েকটি আজও প্রযোজ্য হলেও ইদানিং মানুষের কাছ থেকে যা প্রার্থিত তার তুলনায় এগুলি অপেক্ষাকৃত অগভীর—এগুলি মানুষের ঈশ্বর-বিশ্বাসের পথে সম্মুখীন হওয়া মোটামুটি প্রাথমিক কিছু সত্য। প্রভু যীশু যখন তাঁর কার্য সম্পাদন শুরু করেছিলেন, তখন ইতিমধ্যেই তিনি মানুষের জীবন চরিত্রের উপর কাজ করতে আরম্ভ করেছিলেন, কিন্তু তাঁর কার্যের এই দিকগুলি বিধানের ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। এই সব নিয়মাবলী এবং এই প্রসঙ্গগুলির বিষয়ে কথা বলার পদ্ধতির সাথে সত্যের কি কোনো সম্পর্ক রয়েছে? অবশ্যই রয়েছে! পূর্বাতন যাবতীয় বিধিনিষেধ ও নীতিসমূহ, এবং অনুগ্রহের যুগের এই ধর্মানুশাসনসমূহ, উভয়ই ঈশ্বরের স্বভাব এবং তাঁর যা আছে ও তিনি যা, তা-র সঙ্গে সম্পর্কিত, এবং অবশ্যই, সত্যের সঙ্গেও সম্পর্কিত। ঈশ্বর যা-ই অভিব্যক্ত করুন, এবং ভাষা বা অভিব্যক্তির যে প্রণালীই তিনি ব্যবহার করে থাকুন না কেন, তাঁর দ্বারা প্রকাশিত সকল বিষয়ের ভিত্তি, ব্যুৎপত্তি ও সূচনাবিন্দু রয়েছে তাঁর স্বভাব এবং তাঁর যা আছে ও তিনি যা, তা-র নীতিসমূহের মধ্যে। এ হল এক নিপাট সত্য। তাই তাঁর এই উক্তিগুলি এখন কিছুটা অগভীর বলে মনে হলেও, তুমি তাদের অসত্য বলতে পারো না, কারণ, ঈশ্বরের ইচ্ছা পূর্ণ করার এবং তাদের জীবন চরিত্রে একটা পরিবর্তন অর্জনের লক্ষ্যে, অনুগ্রহের যুগের মানুষজনের কাছে এই বিষয়গুলি অপরিহার্য ছিল। এই ধর্মোপদেশগুলির যে কোনো একটি সত্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, এমন কি তুমি বলতে পারো? না, পারো না! এগুলির প্রত্যেকটিই সত্য, কারণ এই সকলই ছিল মানবজাতির প্রতি ঈশ্বরের চাহিদা; এগুলির সমস্তই ছিল নীতিসমূহ ও ঈশ্বর-প্রদত্ত এক পরিসর, এগুলির মাধ্যমেই প্রদর্শিত হতো যে একজন ব্যক্তির কীভাবে নিজেকে পরিচালিত করা উচিত, এবং এগুলি ঈশ্বরের স্বভাবেরই প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু, সেই সময়ে জীবন-বিকাশের যে পর্যায়ে তারা অবস্থান করছিল তা-র ভিত্তিতে, শুধুমাত্র এই বিষয়গুলিই তারা গ্রহণ ও উপলব্ধি করতে সক্ষম ছিল। যেহেতু মানবজাতির পাপ তখনো অবধি মীমাংসিত হয়নি, তাই প্রভু যীশু কেবলমাত্র এই বাক্যগুলিই নিঃসৃত করতে পারতেন, এবং তাদের কেমন আচরণ করা উচিত, তাদের কী করা উচিত, কোন নীতিসমূহ ও পরিসরের মধ্যে তাদের কাজকর্ম সম্পন্ন হওয়া উচিত, এবং কীভাবে তাদের ঈশ্বরে বিশ্বাস ও তাঁর চাহিদাগুলি পূরণ করা উচিত, তৎকালীন মানুষদের এইসব বিষয়গুলি জানাতে একমাত্র এই ধরনের পরিসরে অন্তর্ধৃত সরল কৌশলগুলিই তিনি ব্যবহার করতে পারতেন। এই সমস্তকিছুই নির্ধারিত হয়েছিল তৎকালীন মানবজাতির আত্মিক উচ্চতার উপর ভিত্তি করে। বিধানের অধীনে বসবাসকারী মানুষদের পক্ষে এই শিক্ষাগুলি গ্রহণ করা সহজসাধ্য ছিল না, অতএব প্রভু যীশুর প্রদত্ত শিক্ষাকে এই পরিসরের মধ্যেই সীমিত থাকতে হয়েছিল।
এবার, “প্রভু যীশুর উপাখ্যানসমূহ”-এর অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলির দিকে একবার দৃষ্টিপাত করা যাক।
প্রথমটি হল বীজবপনকারীর উপাখ্যান। এটি খুবই কৌতূহলোদ্দীপক এক উপাখ্যান; বীজ বপন করা হল মানবজীবনের এক সাধারণ ঘটনা। দ্বিতীয়টি হল শ্যামাঘাসের উপাখ্যান। “শ্যামাঘাস” কী, তা যে ফসল বুনন করেছে, এবং সকল প্রাপ্তবয়স্করা নিশ্চয়ই জানবে। তৃতীয়টি হল সরিষা বীজের উপাখ্যান। সরিষা কী, তা তোমাদের সকলেই নিশ্চয় জানো, জানো না কি? যদি না জানো, তাহলে বাইবেলে একবার দেখে নিতে পারো। চতুর্থ উপাখ্যানটি হল খামিরের উপাখ্যান। এখন, অধিকাংশ মানুষ জানে যে গাঁজিয়ে তোলার কাজে খামির ব্যবহৃত হয়, এবং তা হল এমন এক পদার্থ, যা মানুষ তাদের প্রাত্যহিক জীবনে ব্যবহার করে। ষষ্ঠ উপাখ্যান, গুপ্তধনের উপাখ্যান; সপ্তম, মুক্তার উপাখ্যান; এবং অষ্টম, টানাজালের উপাখ্যানকে ধরে, বাদবাকি সবকটি উপাখ্যানই মানুষের বাস্তব জীবন থেকে গৃহিত হয়েছে, এবং মানুষের জীবনই হল তাদের উৎসস্থল। এই উপাখ্যানগুলি কোন প্রকারের চিত্র অঙ্কিত করে? চিত্রটি হল যে, ঈশ্বর একজন স্বাভাবিক মানুষে পরিণত হয়েছেন এবং মানবজাতির পাশাপাশি জীবনযাপন করছেন, মানুষের সাথে বার্তা বিনিময়ের জন্য ও তাদের প্রয়োজনীয় রসদ সরবরাহের উদ্দেশ্যে জীবনের ভাষা, মানবীয় ভাষা, ব্যবহার করছেন। ঈশ্বর যখন দেহধারণ করে মানবজাতির মাঝে দীর্ঘকাল বসবাস করেছিলেন, তখন মানুষের বিভিন্ন জীবনশৈলীর অভিজ্ঞতা লাভ ও সেসমস্ত প্রত্যক্ষ করার পর, এই অভিজ্ঞতাগুলি তাঁর শিক্ষাদানের উপাদানে পরিণত হয়, যার মাধ্যমে তিনি তাঁর ঐশ্বরিক ভাষাকে মনুষ্যসুলভ ভাষায় রূপান্তরিত করেছিলেন। নিশ্চিতভাবে, তাঁর জীবনে এই যে বিষয়গুলি তিনি দর্শন ও শ্রবণ করেছিলেন তা মনুষ্যপুত্রের মানবিক অভিজ্ঞতাকেও সমৃদ্ধ করেছিল। যখন কোনো সত্য তিনি মানুষকে অনুধাবন করাতে চাইতেন, ঈশ্বরের কোনো ইচ্ছাকে উপলব্ধি করাতে চাইতেন, তখন ঈশ্বরের ইচ্ছা ও মানবজাতির প্রতি তাঁর চাহিদার বিষয়ে মানুষকে জানাতে তিনি উপরের উপাখ্যানগুলির অনুরূপ নীতিকাহিনীসমূহ ব্যবহার করতে পারতেন। এই উপাখ্যানগুলি মানুষের জীবনের সঙ্গে জড়িত ছিল; সেগুলির একটিও মানুষের জীবনের সাথে সংযোগ-বিরহিত ছিল না। প্রভু যীশু যখন মানবজাতির সঙ্গে বসবাস করেছিলেন, তখন তিনি কৃষকদের তাদের শস্যক্ষেত্রের তদারকি করতে দেখেছিলেন, এবং শ্যামাঘাস কী ও গাঁজানো কাকে বলে, তা তিনি জানতেন; তিনি বুঝেছিলেন যে মানুষ গুপ্তধন পছন্দ করে, তাই তিনি গুপ্তধন ও মুক্তা উভয়ের রূপকই ব্যবহার করেছিলেন। তাঁর জীবনে, অনেকবার তিনি মৎস্যজীবীদের তাদের মাছ ধরার জাল নিক্ষেপ করতে দেখেছিলেন; প্রভু যীশু এই কাজ ও মনুষ্যজীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য কর্মকাণ্ড লক্ষ্য করেছিলেন, এবং এই ধরনের জীবনের অভিজ্ঞতাও তিনি লাভ করেছিলেন। ঠিক অন্য যেকোনো স্বাভাবিক মানুষের মতোই, তিনি মানুষের দৈনন্দিন কর্মপরম্পরা এবং তাদের দিনে তিনবার খাদ্যগ্রহণের অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে একজন গড়পড়তা মানুষের অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন, এবং অন্যদের জীবনগুলি পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। এই সবকিছুর পর্যবেক্ষণ ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা অর্জনের পর, তিনি এই নিয়ে চিন্তা করেননি যে, কীভাবে এক সুন্দর জীবনের অধিকারী হওয়া যায় বা কীভাবে তিনি আরো স্বাধীন ও আরামদায়কভাবে জীবনযাপন করতে পারবেন। পরিবর্তে, তাঁর নির্ভেজাল মনুষ্যজীবনের অভিজ্ঞতা থেকে, প্রভু যীশু মানুষের জীবনের দুঃখকষ্টকে প্রত্যক্ষ করলেন। শয়তানের শাসনের অধীনে বাসরত মানুষের দুঃখকষ্ট, দুরবস্থা, ও বিমর্ষতাকে তিনি লক্ষ্য করলেন, এবং দেখলেন যে, তারা শয়তানের ভ্রষ্টতার অধীনে এক পাপমগ্ন জীবন যাপন করছে। তাঁর ব্যক্তিগতভাবে মনুষ্যজীবনের অভিজ্ঞতা অর্জনকালে, ভ্রষ্টতার মাঝে বসবাসকারী মানুষগুলি যে কতটা অসহায়, তা-ও তিনি অনুভব করেছিলেন, যারা পাপের মধ্যে জীবনধারণ করে, শয়তান ও মন্দের অত্যাচারের শিকার হয়ে যে মানুষগুলি দিকভ্রান্ত হয়েছে, তাদের দুর্দশাপীড়িত অবস্থা তিনি প্রত্যক্ষ এবগ অনুভব করেছিলেন। প্রভু যীশু যখন এই বিষয়গুলি চাক্ষুষ করেন, তখন কি তিনি তা তাঁর দেবত্বের মাধ্যমে দর্শন করেন, নাকি করেন তাঁর মানবতার মাধ্যমে? তাঁর মধ্যে প্রকৃতই মানবতা ছিল, এবং তা যথেষ্ট পরিমাণে সক্রিয় ছিল; তিনি এই সমস্তকিছুই অনুভব ও অবলোকনে ছিলেন সক্ষম। কিন্তু নিশ্চিতভাবে, এই বিষয়গুলি তিনি তাঁর সারসত্য দ্বারাও দর্শন করেছিলেন, যে সারসত্য হল তাঁর দেবত্ব। অর্থাৎ, স্বয়ং খ্রীষ্ট, প্রভু যীশু, যিনি ছিলেন একজন মানব, তিনি এসবই দেখেছিলেন, এবং তিনি যাকিছু দেখেছিলেন তা তাঁকেঅবতাররূপ ধারণকালীন তাঁর দ্বারা গৃহীত কার্যের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনুভব করিয়েছিল। যদিও তিনি নিজেও জানতেন যে, দেহরূপে যে দায়িত্ব তাঁকে গ্রহণ করতে হবে, তা অতি সুবিশাল, এবং যে ব্যথার তিনি সম্মুখীন হবেন, তা কতখানি নিষ্ঠুর হবে তাও তিনি জানতেন, তবু মানবজাতিকে যখন তিনি অসহায়ভাবে পাপে নিমজ্জিত অবস্থায় দেখলেন, যখন তিনি তাদের জীবনের শোচনীয়তা ও বিধানের অধীনে তাদের নিস্তেজ লড়াইকে দেখলেন, তখন তিনি উত্তরোত্তর আরো মনঃকষ্ট অনুভব করলেন, এবং পাপাচার থেকে মানবজাতিকে উদ্ধার করতে আরো অধীর হয়ে পড়লেন। যে ধরনের সমস্যারই তাঁকে সম্মুখীন হতে হোক না কেন, বা যে প্রকারের যন্ত্রণাই তাঁকে ভোগ করতে হোক না কেন, পাপের মধ্যে জীবনযাপনরত মানবজাতিকে পুনরুদ্ধার করার সংকল্পে ক্রমাগত তিনি আরো দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে উঠলেন। বলা যায়, এই প্রক্রিয়া চলাকালীন, যে কার্য তাঁকে সম্পন্ন করতে হতো, এবং যে দায়িত্ব তাঁর উপর অর্পিত হয়েছিল, তা প্রভু যীশু ক্রমাগত স্পষ্টতরভাবে উপলব্ধি করতে শুরু করলেন। একই সঙ্গে যে কার্যের দায়িত্বভার তিনি গ্রহণ করতে যাচ্ছিলেন তা নিষ্পন্ন করার জন্য—মানবজাতির সকল পাপ ধারণ করার জন্য, যাতে মানবজাতি আর পাপের মধ্যে বাস না করে তাই তাদের হয়ে প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য, এবং সেই সাথে, যাতে তাঁর পাপস্খালনে বলি হয়ে ওঠার ফলে মানুষের পাপাচারকে ঈশ্বর ক্ষমা করতে পারেন, মানবজাতির উদ্ধারের নিমিত্ত তাঁর যে কার্য, যাতে তিনি তা আরো এগিয়ে নিয়ে পারেন, তা-র জন্য তিনি উত্তরোত্তর তিনি আরো ব্যগ্র হয়ে উঠেছিলেন। বলা যায় যে, প্রভু যীশু, তাঁর অন্তরে, মানবজাতির জন্য নিজেকে উৎসর্গ করতে, নিজেকে বলিদান দিতে ইচ্ছুক ছিলেন। একই সাথে, তিনি পাপস্খালনের বলিরূপে ভূমিকা পালন করতে, ক্রুশকাষ্ঠে বিদ্ধ হতেও তিনি ইচ্ছুক ছিলেন, সেই কার্য সম্পূর্ণ করতে তিনি বস্তুতই অধীর হয়ে উঠেছিলেন। মানবজীবনের দুরবস্থা চাক্ষুষ করার পর, তিনি আরো বেশি করে যত শীঘ্র সম্ভব, এক দণ্ড বা এমনকি এক লহমাও কালবিলম্ব না করে, তাঁর ব্রত পূরণ করতে চেয়েছিলেন। এমন এক আশু প্রয়োজনীয়তা অনুভব করার পর তাঁর যন্ত্রণা কতটা তীব্র হবে, সেবিষয়ে তিনি চিন্তামাত্র করেন নি, এবং কতখানি লাঞ্ছনা তাঁকে সহ্য করতে হবে সে বিষয়েও তিনি আর কোনো আশঙ্কা পোষণ করেন নি। তাঁর হৃদয়ে তিনি কেবল একটিমাত্র প্রত্যয় ধারণ করে রেখেছিলেন: নিজেকে তিনি উৎসর্গ করতে পারলে, পাপস্খালনের বলি হিসাবে ক্রুশবিদ্ধ হতে পারলে, তা হবে ঈশ্বরের ইচ্ছা পালন করা, এবং ঈশ্বর নতুন কার্যের সূচনা করতে পারবেন। মানবজাতির জীবন ও তাদের পাপমগ্ন অস্তিত্বের পরিস্থিতি সম্পূর্ণভাবে রূপান্তরিত হবে। তাঁর প্রত্যয় ও তাঁর এই কর্মসংকল্প মানুষের উদ্ধারের সঙ্গে জড়িত ছিল, এবং তাঁর একটিমাত্র লক্ষ্য ছিল, তা হল ঈশ্বরের ইচ্ছা পালন করা, যাতে ঈশ্বর সাফল্যের সঙ্গে তাঁর কার্যের পরবর্তী পর্যায় আরম্ভ করতে পারেন। সেই সময় প্রভু যীশুর মনে এই চিন্তাই ছিল।
দেহরূপে জীবনযাপনরত ঈশ্বরের অবতার স্বাভাবিক মানবিকতার অধিকারী ছিলেন; তাঁর আবেগ ও যৌক্তিকতা ছিল একজন স্বাভাবিক মনুষ্যসুলভ। আনন্দ কী, বেদনা কী, তা তিনি জানতেন, এবং মানবজাতিকে এই ধরনের এক জীবন যাপন করতে দেখে তিনি গভীরভাবে অনুভব করেছিলেন যে, মানুষকে নিছক কিছু শিক্ষাদান, তাদের জন্য কিছু রসদের সংস্থান, বা তাদের কোনোকিছু শেখানো, তাদের পাপমুক্ত করার পক্ষে যথেষ্ট হবে না। আবার কেবলমাত্র আদেশসমূহ মান্য করতে বাধ্য করানোর মাধ্যমেও তাদের পাপমুক্ত করা যাবে না—যখন তিনি মানবজাতির পাপ নিজের মধ্যে ধারণ করে পাপময় দেহের প্রতিরূপ হয়ে উঠবেন, একমাত্র তখনই তিনি তার বিনিময়ে মানবজাতির স্বাধীনতা ও মানবজাতির প্রতি ঈশ্বরের ক্ষমা অর্জন করে আনতে পারবেন। তাই, মানুষের পাপমগ্ন জীবনের অভিজ্ঞতা অর্জন ও তা চাক্ষুষ করার পর, প্রভু যীশুর অন্তরে এক তীব্র বাসনা প্রতিভাত হয়ে উঠলো—তাদের পাপের মধ্যে সংগ্রামরত জীবন থেকে মানবজাতিকে নিজেদের মুক্ত করার সুযোগ দান করা। এই বাসনার দরুন তিনি ক্রমাগত আরো বেশি করে অনুভব করলেন যে, তাঁকে যথাশীঘ্র সম্ভব ক্রুশারোহন করে মানুষের পাপগুলি গ্রহণ করতে হবে। মানুষের মধ্যে বসবাস করে তাদের পাপমগ্ন জীবনের দুর্দশাকে দর্শন, শ্রবণ ও অনুভব করার পর, প্রভু যীশুর মনে এই চিন্তাগুলিই উদিত হয়েছিল। মানবজাতির নিমিত্ত ঈশ্বরের অবতার যে এই ধরনের ইচ্ছা পোষণ করতে পেরেছিলেন, তিনি যে এই ধরনের স্বভাব অভিব্যক্ত ও প্রকাশিত করতে পেরেছিলেন—একজন গড়পড়তা মানুষ কি তা পেরে উঠতো? এই রকমের এক পরিবেশে বাস করার পর একজন গড়পড়তা মানুষ কী দেখতো? কোন চিন্তা তার মাথায় আসতো? একজন গড়পড়তা মানুষ যদি এই সবকিছুর সম্মুখীন হতো, তাহলে কি সে এক সমুন্নত পরিপ্রেক্ষিত থেকে সমস্যাগুলির প্রতি দৃষ্টিপাত করতো? অবশ্যই তা করতো না! যদিও বাহ্যিক অবয়বে ঈশ্বরের অবতার হলেন অবিকল কোনো মানুষের মতো, এবং যদিও তিনি মনুষ্যসুলভ জ্ঞানের শিক্ষা গ্রহণ করেন ও মানবোচিত ভাষায় বাক্যালাপ করেন, এবং কখনো কখনো এমনকি তাঁর চিন্তাভাবনাকেও মানবজাতির নিজস্ব পদ্ধতিতে বা তাদের বাকরীতি অনুসারে প্রকাশ করেন, তবু, যে প্রণালীতে তিনি মানুষকে ও বিষয়াদির সারসত্যকে নিরীক্ষণ করেন, তা কোনোক্রমেই ভ্রষ্ট মানুষের দ্বারা মানবজাতি ও বিষয়াদির সারমর্ম অবলোকনের পদ্ধতির অনুরূপ ছিল না। কোনো ভ্রষ্ট মানুষের পক্ষে তাঁর পরিপ্রেক্ষিত ও অবস্থানগত উচ্চতা অর্জন করা সম্ভব ছিল না। এর কারণ হল ঈশ্বর সত্য, এর কারণ হল, যে দেহরূপ তিনি পরিগ্রহ করেন, তা-ও ঈশ্বরের সারসত্যকেই ধারণ করে, এবং তাঁর চিন্তাচেতনা ও তাঁর মানবতার দ্বারা যা অভিব্যক্ত হয়, সেগুলিও সত্যই। দেহরূপে তিনি যা ব্যক্ত করেন ভ্রষ্ট মানুষের কাছে তা সত্যের এবং জীবনের রসদ। এই সংস্থান কেবল কোনো একজন মানুষের জন্যই নয়, তা সমগ্র মানবজাতির উদ্দেশ্যে। কোনো ভ্রষ্ট মানুষের অন্তরে, তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এমন কতিপয় মানুষই কেবল অধিষ্ঠান করে। শুধুমাত্র এই মুষ্টিমেয় মানুষদের নিয়েই তাদের যত প্রযত্ন ও মাথাব্যথা। যখন দিগন্তে বিপর্যয় উপনীত হয়, তখন সর্বাগ্রে তারা তাদের সন্তানসন্ততি, স্বামী-স্ত্রী, পিতা-মাতার কথা চিন্তা করে। বড়োজোর, একটু বেশি দরদী কোনো মানুষ তার কোনো আত্মীয় বা ভালো কোনো বন্ধুর নিমিত্ত কিছুটা চিন্তা ব্যয় করবে, কিন্তু এরকম দরদী কোনো মানুষের চিন্তাও কি তা অতিক্রম করে আরো দূরে প্রসারিত হয়? না, তা কখনোই হয় না! কারণ, যতোই হোক, মানুষ শুধু মানুষই, এবং সমস্তকিছুকে তারা কেবলমাত্র মানুষের অবস্থানগত উচ্চতা ও পরিপ্রেক্ষিত থেকেই অবলোকন করতে সক্ষম। কিন্তু, ঈশ্বরের অবতার ভ্রষ্ট কোনো মানুষের থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। ঈশ্বরের অবতাররূপী দেহ যত সাধারণ, যত স্বাভাবিক, যত সামান্যই হোক না কেন, বা এমনকি মানুষ তাঁর দিকে যত তাচ্ছিল্যের চোখেই দেখুক না কেন, তবু মানবজাতির প্রতি তাঁর বিবেচনা ও তাঁর মনোভাব এমনই বস্তু যা কোনো মানুষের অনধিগম্য, অননুকরণীয় করতে পারে না। সর্বদাই তিনি দেবত্বের পরিপ্রেক্ষিত থেকেই, তাঁর সৃষ্টিকর্তারূপী অবস্থানগত উচ্চতা থেকেই, মানবজাতিকে পর্যবেক্ষণ করবেন। সর্বদাই তিনি ঈশ্বরের সারসত্য ও মানসিকতার মধ্য দিয়েই মানবজাতিকে লক্ষ্য করবেন। কোনোক্রমেই তিনি একজন গড়পড়তা মানুষের অবনমিত উচ্চতা থেকে, বা একজন ভ্রষ্ট মানুষের পরিপ্রেক্ষিত থেকে মানবজাতিকে অবলোকন করতে সক্ষম হবেন না। মানুষ মানবজাতিকে নিরীক্ষণ করে মানবীয় দৃষ্টির সাহায্যে, এবং মাপকাঠি হিসাবে তারা মানবোচিত জ্ঞান এবং মনুষ্যসুলভ আইনকানুন ও ন্যায়নীতির মতো বিষয়গুলির প্রয়োগ ঘটায়। এগুলি মানুষর দৃষ্টিগ্রাহ্য পরিসরেরই অন্তর্ভুক্ত এবং ভ্রষ্ট মানুষের দ্বারা অর্জনসাধ্য পরিসরেরও অন্তর্ভুক্ত। ঈশ্বর যখন মানবজাতির দিকে তাকান, তখন তিনি ঐশ্বরিক দৃষ্টির সাহায্যে দৃষ্টিপাত করেন, এবং মাপকাঠি হিসাবে তিনি তাঁর সারসত্য এবং তাঁর যা আছে ও তিনি যা, সেগুলির প্রয়োগ ঘটান। সেই পরিসরের মধ্যে এমন বস্তুসকল রয়েছে, যা মানুষের দৃষ্টিগোচর নয়, আর এখানেই ঈশ্বরের অবতার ও ভ্রষ্ট মানুষ সম্পূর্ণ পৃথক। এই পার্থক্য নিরূপিত হয় মানুষ ও ঈশ্বরের স্বতন্ত্র সারসত্যের দ্বারা—এই পৃথক সারসত্যই তাদের পরিচয় ও অবস্থান, এবং যে পরিপ্রেক্ষিত ও উচ্চতা থেকে তারা বিষয়াদিকে নিরীক্ষণ করে, সেসকল নির্ধারণ করে। প্রভু যীশুর মধ্যে তোমরা কি স্বয়ং ঈশ্বরের অভিব্যক্তি ও উদ্ঘাটন দেখতে পাও? তোমরা বলতে পারো যে, প্রভু যীশু যা করেছিলেন ও বলেছিলেন, তা তাঁর সেবাব্রত ও ঈশ্বরের নিজস্ব পরিচালনামূলক কার্যের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল, বলতে পারো যে, এর সবই ছিল ঈশ্বরের সারসত্যের অভিব্যক্তি ও উদ্ঘাটন। যদিও তাঁর একটি মানবীয় উদ্ভাস বস্তুতই ছিল, কিন্তু তাঁর ঐশ্বরিক সারসত্য এবং তাঁর দেবত্বের উদ্ঘাটনকে অস্বীকার করা যায় না। এই মানবীয় উদ্ভাস কি সত্যিই কোনো মনুষ্যসুলভ প্রকাশ ছিল? মূলগত উপাদানের দিক দিয়ে, তাঁর মানবীয় উদ্ভাস ভ্রষ্ট মানুষের মানবোচিত বহিঃপ্রকাশের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। প্রভু যীশু ছিলেন ঈশ্বরের অবতার। যদি তিনি যথার্থই চিরাচরিত তথা ভ্রষ্ট মানুষদের একজন হতেন, তাহলে কি তিনি মানবজাতির পাপমগ্ন জীবনকে এক ঐশ্বরিক পরিপ্রেক্ষিতে অবলোকনে সক্ষম হতেন? কখনও হতেন না! মনুষ্যপুত্র ও সাধারণ মানুষের মধ্যে এটাই হল পার্থক্য। ভ্রষ্ট মানুষেরা সবাই পাপের মধ্যে বাস করে, এবং পাপাচার প্রত্যক্ষ করার পর, সেই বিষয়ে তাদের মধ্যে বিশেষ কোনো অনুভূতি পরিলক্ষিত হয় না; তারা সকলেই একই প্রকার, ঠিক কাদায় বসবাসরত এক শূকরের মতো, যে আদৌ কোনো অস্বচ্ছন্দ বা মলিনতা অনুভব করে না—উল্টে বরং, ভালো খাওয়াদাওয়া করে ও গভীর নিদ্রা যায়। কেউ যদি খোঁয়াড়টি সাফসুতরো করে, তাহলেই বরং শূকরটি সত্যিকারের অস্বচ্ছন্দ বোধ করবে, এবং সে পরিচ্ছন্ন থাকবে না। অচিরেই, সেটি আবার কাদায় গড়াগড়ি দেবে, সম্পূর্ণ স্বচ্ছন্দে, কারণ সেটি হল এক কলুষিত পশু। শূকরদের মানুষ নোংরা মনে করে, কিন্তু তুমি যদি কোনো শূকরের বাসস্থান সাফ করো, তাহলে সে কিছুমাত্র আরাম বোধ করে না—এই কারণেই কেউ তার নিজের বাড়ির ভিতর শূকর রাখে না। মানুষ যে চোখে শূকরদের দেখে তা শূকরেরা নিজে যেমন অনুভব করে তা-র থেকে সর্বদাই আলাদা হবে, কারণ মানুষ ও শূকর সমগোত্রীয় নয়। আর যেহেতু অবতাররূপী মনুষ্যপুত্র ভ্রষ্ট মনুষ্যগণের সমগোত্রীয় নন, সেহেতু কেবলমাত্র ঈশ্বরের অবতারই এক ঐশ্বরিক পরিপ্রেক্ষিতে, ঈশ্বরের উচ্চতায়, অবস্থানরত হতে পারেন, যেখান থেকে তিনি মানবজাতি এবং সমস্তকিছুর প্রতি দৃষ্টিপাত করেন।
দেহধারণ করে মানবজাতির মাঝে বসবাস করাকালীন যে যন্ত্রণা ঈশ্বরকে ভোগ করতে হয়, সেই বিষয়ে কী বলা যায়? এই যন্ত্রণাটি কী? কেউ কি প্রকৃতই তা উপলব্ধি করে? কিছু মানুষ বলে যে, ঈশ্বর প্রভূত কষ্টভোগ করেন, তারা বলে তিনি স্বয়ং ঈশ্বর হওয়া সত্ত্বেও মানুষ তাঁর সারসত্য উপলব্ধি করে না, বরং তাঁকে একজন মানুষ হিসাবে গণ্য করতে চায়, এতে তিনি ক্ষুব্ধ হন ও নিজেকে অবিচারের শিকার বলে বোধ করেন—তারা বলে যে, এই সব কারণেই, ঈশ্বরের যন্ত্রণা যথার্থই বিপুল। অন্যেরা বলে যে ঈশ্বর নিরপরাধ ও অপাপবিদ্ধ, কিন্তু মানবজাতির মতো একইভাবে তিনিও কষ্টভোগ করেন, মানবজাতির পাশাপাশি তিনিও উৎপীড়ন, কুৎসারটনা, এবং অসম্মান ভোগ করেন; তারা বলে যে, তাঁকেও ভুল বোঝাবুঝি ও তাঁর অনুগামীদের আনুগত্যহীনতা সহ্য করতে হয়—এই কারণেই, তাদের বক্তব্য অনুসারে, ঈশ্বরের যন্ত্রণাভোগ সত্যিই অপরিমেয়। এখন, মনে হচ্ছে যে, তোমরা ঈশ্বরকে প্রকৃত অর্থে উপলব্ধি করো না। বস্তুত, তোমরা যে কষ্টভোগের কথা বলো তা ঈশ্বরের ভোগ করা প্রকৃত কষ্ট হিসাবে পরিগণিতই হয় না, কারণ এর থেকেও তীব্র যন্ত্রণা রয়েছে। তাহলে স্বয়ং ঈশ্বরের সত্যিকারের যন্ত্রণাটি কী? ঈশ্বরের অবতাররূপী দেহের প্রকৃত বেদনাটি কী? ঈশ্বরের কাছে, মানবজাতির তাঁকে বুঝতে না পারাটা কষ্টভোগ বলে গণ্য হয় না, এবং মানুষের ঈশ্বরের বিষয়ে কিছু ভ্রান্ত উপলব্ধি থাকা, ও তাঁকে ঈশ্বর বলে মনে না করাটাও যন্ত্রণা হিসাবে পরিগণিত হয় না। তবু, মানুষ প্রায়শই মনে করে যে, ঈশ্বর নিশ্চয়ই বিপুল অবিচারের শিকার হয়েছেন, মনে করে যে, অবতাররূপে অবস্থানকালীন, ঈশ্বর মানবজাতিকে তাঁর ছবিটি প্রদর্শন করতে পারেন না, এবং মানুষকে তাঁর মাহাত্ম্য দর্শন করার সুযোগ দিতে পারেন না, এবং ঈশ্বর তাঁর তুচ্ছ দেহরূপের ভিতর সবিনয়ে লুক্কায়িত রয়েছেন, তারা মনে করে যে, এমনটি ঈশ্বরের কাছে নির্ঘাত এক নিদারুণ উৎপীড়ন। ঈশ্বরের যন্ত্রণা সম্বন্ধে মানুষ যা উপলব্ধি করতে পারে ও তারা যা দেখতে পায়, সেগুলিকে তারা আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করে, এবং ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে যাবতীয় প্রকারের সহানুভূতি প্রক্ষেপ করে, এবং এমনকি মাঝেমধ্যেই তাঁর কষ্টভোগের দরুন তাঁকে কিছুটা তারিফও জানায়। বাস্তবে, একটা পার্থক্য আছে; ঈশ্বরের বেদনার বিষয়ে মানুষ যা উপলব্ধি করে, এবং তিনি প্রকৃতই যা অনুভব করেন, এই দুইয়ের মধ্যে একটা ফারাক রয়েছে। আমি তোমাদের অকপটে বলছি—ঈশ্বরের কাছে, তা তিনি ঈশ্বরের আত্মাই হন কি ঈশ্বরের অবতাররূপী দেহই হন, উপরে বর্ণিত যন্ত্রণাগুলি প্রকৃত বেদনা নয়। তাহলে প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বর কোন যন্ত্রণা ভোগ করেন? কেবলমাত্র ঈশ্বরের অবতারের পরিপ্রেক্ষিত থেকেই ঈশ্বরের যন্ত্রণাভোগ বিষয়ে আলোচনা করা যাক।
ঈশ্বর যখন অবতাররূপ ধারণ করেন, মানবজাতির মাঝে মানুষের পাশাপাশি যাপনরত একজন গড়পড়তা, স্বাভাবিক মানুষে পরিণত হন, তখন কি তিনি মানুষের জীবনধারণের পদ্ধতি, নিয়মকানুন, ও দর্শনগুলি দেখতে ও অনুভব করতে পারেন না? বেঁচে থাকার এই পদ্ধতি ও বিধানগুলি তাঁকে কেমন অনুভব করায়? তিনি কি তাঁর অন্তরে ঘৃণাবোধ করেন? কেন তিনি ঘৃণাবোধ করবেন? মানবজাতির জীবনধারণের পদ্ধতি ও নিয়মকানুনগুলি কী কী? কোন নীতিগুলির উপর সেগুলি প্রতিষ্ঠিত? কোন ভিত্তিভূমির উপর সেগুলি দাঁড়িয়ে রয়েছে? বেঁচে থাকার উপায়ের সঙ্গে সম্পর্কিত রয়েছে মানবজাতির পদ্ধতিসমূহ, নিয়মকানুন, ইত্যাদি—এগুলির সবকিছুই শয়তানের যুক্তিবোধ, জ্ঞান, ও দর্শনের উপর ভিত্তি করে রচিত। এহেন বিধানসমূহের অধীনে জীবনধারণরত মানুষগুলির কোনো মানবতা নেই, কোনো সত্য নেই—তারা সকলেই সত্যকে অগ্রাহ্য করে এবং ঈশ্বরের প্রতি বৈরীভাবাপন্ন। আমরা ঈশ্বরের সারসত্যের প্রতি একবার দৃষ্টিনিবদ্ধ করি, তাহলে দেখি যে, তাঁর সারসত্য শয়তানের যুক্তি, জ্ঞান, ও দর্শনের ঠিক বিপরীত। তাঁর সারসত্য ন্যায়পরায়ণতা, সত্য, ও পবিত্রতা এবং সকল ইতিবাচক বস্তুর অন্যান্য বাস্তবিকতার দ্বারা পরিপূর্ণ। যে ঈশ্বর এই সারসত্যের অধিকারী এবং এমনতর এক মানবজাতির মাঝে বসবাস করেন, তিনি কেমন বোধ করেন? তাঁর অন্তরে তিনি কী অনুভব করেন? এই অন্তর কি ব্যথায় জর্জরিত নয়? তাঁর হৃদয় ব্যথিত, এমন এক বেদনা, যা কোনো মানুষ উপলব্ধি বা অনুভবে অক্ষম। এর কারণ হল যে, তিনি যাকিছুর মুখোমুখি হন, মোকাবিলা করেন, শ্রবণ, দর্শন, ও অভিজ্ঞতা লাভ করেন তার সবই হল মানবজাতির কলুষ, দুষ্টতা, এবং সত্যের বিরুদ্ধে তাদের বিদ্রোহ ও প্রতিরোধ। মানুষ থেকে যাকিছু আসে, তা-ই হল তাঁর যন্ত্রণার উৎস। অর্থাৎ, যেহেতু তাঁর সারসত্য ভ্রষ্ট মানুষদের মতো নয়, সেহেতু তাঁর তীব্রতম যন্ত্রণার উৎস হয়ে ওঠে মানুষের কলুষ। ঈশ্বর যখন দেহধারণ করেন, তখন কি তিনি এমন কাউকে খুঁজে পেতে পারেন, যে তাঁর মতো একই ভাষায় বক্তব্য রাখে? মানবজাতির মাঝে এমন একজন মানুষও খুঁজে পাওয়া যাবে না। এমন কাউকেই পাওয়া সম্ভব নয়, যে ঈশ্বরের সঙ্গে কথোপকথন চালাতে বা মতামত বিনিময় করতে পারে—এই ব্যাপারে ঈশ্বরের অনুভূতি কেমন বলে তোমার মনে হয়? মানুষ যাকিছু আলোচনা করে, ভালোবাসে, অনুসরণ করে ও কামনা করে, সেগুলির সমস্তই পাপ ও দুষ্ট প্রবণতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। ঈশ্বর যখন এই সবকিছুর সম্মুখীন হন, তখন তাঁর হৃদয়কে কি তা ছুরির মতো বিদ্ধ করে না? এই সবকিছুর মুখোমুখি হওয়ার পরেও কি তাঁর অন্তরে আনন্দ থাকতে পারে? তিনি কি সান্ত্বনা খুঁজে পেতে পারেন? যারা তাঁর সঙ্গে বসবাস করছে তারা বিদ্রোহী মানসিকতা ও পাপাচারে পরিপূর্ণ মানুষ—কীভাবে তাঁর হৃদয় যন্ত্রণাদীর্ণ না হয়ে পারে? এই যন্ত্রণা প্রকৃতপক্ষে কতটা বিপুল, এবং তা নিয়ে কারই বা কোনো মাথাব্যথা আছে? কে-ই বা এবিষয়ে ভ্রুক্ষেপ করে? আর কে-ই বা এর যথাযথ কদর করতে সক্ষম? ঈশ্বরের হৃদয়কে উপলব্ধি করার কোনো উপায় মানুষের হাতে নেই। তাঁর দুঃখবেদনা হল এমন একটা বিষয়, যা উপলব্ধি করতে মানুষ সবিশেষরূপে অক্ষম, এবং মানুষের শীতলতা ও অসাড়তা ঈশ্বরের কষ্টকে গভীরতর করে তোলে।
কিছু মানুষ আছে যারা প্রায়শই খ্রীষ্টের দুর্দশার প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করে, কারণ বাইবেলের একটা স্তবকে লেখা আছে: “যীশু তাকে বললেন শিয়ালের গর্ত আছে, আকাশের পাখিদের বাসা আছে, কিন্তু মানবপুত্রের মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই।” এটা শোনার পর, মানুষ তা গুরুত্ব সহকারে নেয়, এবং ভাবে যে ঈশ্বরকে যত কষ্ট সইতে হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে এটাই হল কঠোরতম, এবং খ্রীষ্টকে যত যন্ত্রণা সহন করতে হয়েছে, সেগুলির মধ্যে এটিই হল তীব্রতম। এখন, প্রকৃত তথ্যের পরিপ্রেক্ষিত থেকে দেখলে, বিষয়টা কি তেমনই? না; এই অসুবিধাগুলোকে ঈশ্বর যন্ত্রণা বলে মনে করেন না। দেহরূপে তাঁর সমস্যাসমূহের দরুন ঈশ্বর কখনো অবিচারের বিরুদ্ধে উচ্চকিত হন নি, এবং কখনোই তিনি কোনোকিছুর জন্য মানুষকে তাঁর ঋণ পরিশোধে বা তাঁকে পুরস্কৃত করায় বাধ্য করেন নি। কিন্তু, যখন তিনি মানবজাতি-সংক্রান্ত সকলকিছু, তাদের পাপাচারী জীবন ও ভ্রষ্ট মানুষের দুষ্টতা প্রত্যক্ষ্ করেন, যখন তিনি প্রত্যক্ষ করেন যে, মানবজাতি শয়তানের করায়ত্ত ও শয়তানের হাতে বন্দী এবং পলায়নে অক্ষম, যখন তিনি দেখেন, যে, পাপের মধ্যে বসবাসকারী মানুষ সত্য কী, তা জানে না, তখন তিনি এই সকল পাপ বরদাস্ত করতে পারেন না। মানুষের প্রতি তাঁর বিরাগ নিয়ত বৃদ্ধি পায়, কিন্তু তাঁকে এই সবকিছুই সহ্য করতে হয়। এটাই হল ঈশ্বরের তীব্র যন্ত্রণাভোগ। ঈশ্বর এমনকি তাঁর অন্তরের কণ্ঠস্বর বা তাঁর ভাবাবেগকে তাঁর অনুগামীদের মাঝে সম্পূর্ণরূপে ব্যক্তও করতে পারেন না, এবং তাঁর অনুগামীদের কেউই তাঁর কষ্টকে প্রকৃত অর্থে উপলব্ধিতে সক্ষম নয়। এমনকি কেউই তাঁর হৃদয়কে উপলব্ধি করার বা সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে না, যে হৃদয় দিনের পর দিন, বছরের পর বছর, বারংবার এই কষ্ট সহ্য করে যায়। এসবের মধ্যে তোমরা কী দেখতে পাও? ঈশ্বর যা দিয়েছেন মানুষের কাছ থেকে তার বিনিময়ে তিনি কোনোকিছুই দাবি করেন না, কিন্তু ঈশ্বরের সারসত্যের কারণে, তিনি মানবজাতির দুষ্টতা, কলুষ, এবং পাপাচারকে একেবারেই সহ্য করতে পারেন না, পরিবর্তে তিনি চরম বিতৃষ্ণা ও ঘৃণা বোধ করেন, যার ফলে ঈশ্বরের হৃদয় ও তাঁর দেহরূপকে অন্তহীন যন্ত্রণা সহন করতে হয়। তোমরা কি তা দেখতে পেয়েছো? খুব সম্ভবত, তোমাদের কেউই তা দেখতে পাও নি, কারণ তোমাদের কেউই প্রকৃত অর্থে ঈশ্বরকে উপলব্ধি করো নি। সময়ের সাথে সাথে, তোমাদের নিজেদেরই তা ক্রমে ক্রমে অনুভব করা উচিত।
—বাক্য, খণ্ড ২, ঈশ্বরকে জানার প্রসঙ্গে, ঈশ্বরের কর্ম, ঈশ্বরের স্বভাব এবং স্বয়ং ঈশ্বর ৩