সত্তরগুণ সাতবার ক্ষমা করো এবং প্রভুর ভালোবাসা
সত্তরগুণ সাতবার ক্ষমা করো
মথি ১৮:২১-২২ পিতর তখন যীশুর কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, প্রভু, আমার ভাই যদি আমার বিরুদ্ধে কোনো অপরাধ করে, তবে আমি তাকে কতবার ক্ষমা করব? সাতবার? যীশু তাঁকে বললেন, না, সাতবার নয়, কিন্তু সত্তরগুণ সাতবার।
প্রভুর ভালোবাসা
মথি ২২:৩৭-৩৯ যীশু উত্তর দিলেন, তুমি কায়মনোবাক্যে তোমার ঈশ্বরকে ভালবাসবে—এটি হল সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সর্বপ্রথম আদেশ। আর দ্বিতীয়টিও এরই তুল্য, তুমি তোমার প্রতিবেশীকে আত্মজ্ঞানে ভালবাসবে।
এই দুটি অনুচ্ছেদের মধ্যে একটি বলে ক্ষমাশীলতার বিষয়ে এবং অন্যটি বলে ভালোবাসার বিষয়ে। এই প্রসঙ্গদুটি প্রকৃতই অনুগ্রহের যুগে প্রভু যীশু যে কার্য সম্পন্ন করতে চেয়েছিলেন তা-র প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
দেহধারণ করাকালীন ঈশ্বর তাঁর সঙ্গে করে তাঁর কার্যের একটি পর্যায়কে নিয়ে এসেছিলেন, তা ছিল সেই নির্দিষ্ট করণীয় কার্যসমূহ ও স্বভাব, যা তিনি এই যুগে প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন। এই সময়কালে, মনুষ্যপুত্র যাকিছু করেছিলেন, তা এই যুগে যে কার্য ঈশ্বর সম্পন্ন করতে চেয়েছিলেন সেটিকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছিল। তা-র অতিরিক্ত বা তা-র কম কিছুই তিনি করতেন না। তাঁর উচ্চারিত প্রতিটি বাক্য ও তাঁর সম্পাদিত যাবতীয় প্রকার কার্যের সমস্তই এই যুগের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। এটি তিনি মনুষ্যসুলভ পদ্ধতিতে মানুষের ভাষাতেই ব্যক্ত করে থাকুন কি ঐশ্বরিক ভাষায়, এবং যে উপায়ে বা যে পরিপ্রেক্ষিত থেকেই তিনি তা করে থাকুন না কেন, তাঁর লক্ষ্য ছিল যে, তিনি যা করতে চেয়েছিলেন, তাঁর যা ইচ্ছা ছিল, এবং মানুষের প্রতি তাঁর চাহিদা যা ছিল, তা উপলব্ধি করতে মানুষকে সাহায্য করা। হতে পারে যে, তাঁর ইচ্ছা ও তাঁর মানবজাতির উদ্ধারের কার্যকে বুঝতে ও জানতে মানুষকে সহায়তা করার উদ্দেশ্যে তিনি বিবিধ উপায় ও বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত ব্যবহার করেছিলেন। তাই অনুগ্রহের যুগে মানবজাতির প্রতি অভীষ্ট বার্তা ব্যক্ত করার ক্ষেত্রে প্রভু যীশুকে অধিকাংশ সময় আমরা মানুষের ভাষা ব্যবহার করতে দেখেছি। উপরন্তু, তাঁকে আমরা দেখেছি একজন সাধারণ পথপ্রদর্শকের পরিপ্রেক্ষিত থেকে, যিনি মানুষের প্রতি বক্তব্য রাখছেন, তাদের চাহিদার সংস্থান করেছেন, এবং তারা যা অনুরোধ করেছিল সেই বিষয়ে তাদের সহায়তা করেছেন। এহেন কার্যসম্পাদন পদ্ধতি অনুগ্রহের যুগের অগ্রবর্তী বিধানের যুগে দেখা যায় নি। মানবজাতির সাথে তিনি আরো অন্তরঙ্গ ও আরো সহমর্মী হয়ে উঠেছিলেন, তদসহযোগে, যুগপৎ আকারে ও প্রকারে ব্যবহারিক ফলাফল অর্জনে আরো বেশি সক্ষম হয়ে উঠেছিলেন। মানুষকে সত্তর গুণ সাতবার ক্ষমা করার এই রূপকটি বস্তুতই এই বিষয়টিকে পরিস্ফূট করে। এই রূপকে উল্লেখিত সংখ্যাটি যে উদ্দেশ্য সাধন করে তা হল, এই বাক্য উচ্চারণকালীন প্রভু যীশুর অভিপ্রায় মানুষকে উপলব্ধি করতে অনুমোদিত করা। তাঁর অভিপ্রায় ছিল, মানুষ যেন অন্যদের ক্ষমা করে—একবার বা দুইবার নয়, এমনকি সাতবারও নয়, বরং সত্তর গুণ সাতবার। এই “সত্তর গুণ সাতবার” বিষয়টির মধ্যে কী প্রকারের ধারণা আধৃত রয়েছে? এটির উদ্দেশ্য ছিল ক্ষমাধর্মকে মানুষের নিজস্ব দায়িত্বে পরিণত করে তোলা, তাদের অবশ্যশিক্ষণীয় এক বিষয়, এবং অবশ্যপালনীয় এক “পন্থা”-য় পরিণত করা। যদিও এ হল এক রূপকমাত্র, তবু তা এক অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে লক্ষণীয় করে তোলার উদ্দেশ্যসাধন করেছিল। তিনি যা বলতে চাইছিলেন তা গভীরভাবে অনুধাবন করতে, এবং অনুশীলনের সঠিক পথ এবং অনুশীলনের নীতি ও আদর্শমানটি খুঁজে নিতে মানুষকে তা সহায়তা করেছিল। এই রূপকটি পরিষ্কারভাবে উপলব্ধি করতে মানুষকে সাহায্য করেছিল এবং তাদের এক সঠিক ধারণা দিয়েছিল যে—তাদের ক্ষমাশীলতার শিক্ষা নেওয়া উচিত এবং যতবারই হোক নিঃশর্তে ক্ষমা করা উচিত, কিন্তু তারা তা করবে এক সহিষ্ণুতা ও অন্যদের বোঝার মনোভাব নিয়ে। প্রভু যীশু এই বক্তব্যটি যখন রেখেছিলেন, তখন তাঁর অন্তরে কী ছিল? তিনি কি সত্যিই “সত্তর গুণ সাত” সংখ্যাটির বিষয়ে চিন্তা করছিলেন? না, তিনি তা করছিলেন না। ঈশ্বর কতবার মানুষকে ক্ষমা করবেন, তার কি কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যা হয়? কিছু মানুষ আছে যারা এখানে উল্লেখিত “এত সংখ্যক বার” শব্দবন্ধনীটি নিয়ে খুবই আগ্রহান্বিত, যারা এই সংখ্যাটির উৎস ও অর্থ প্রকৃতই বুঝে উঠতে চায়। তারা উপলব্ধি করতে চায় এই সংখ্যাটিই কেন প্রভু যীশুর মুখ থেকে নির্গত হয়েছিল; তাদের বিশ্বাস হল যে, এই সংখ্যাটির গভীরতর কোনো ব্যঞ্জনার্থ রয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, তা ছিল নিছকই ঈশ্বরের দ্বারা ব্যবহৃত এক মানবীয় বাচ্যালংকার। কোনো তাৎপর্য বা অর্থকে অবশ্যই মানবজাতির কাছে প্রভু যীশুর চাহিদার সঙ্গে একত্রে গ্রহণ করতে হবে। যেকালে ঈশ্বর তখনো দেহধারণ করেননি, তখন মানুষ তাঁর বক্তব্য খুব বেশি উপলব্ধি করতো না, কারণ তাঁর বাক্যসমূহ সম্পূর্ণ দেবত্ব থেকে উদ্গত হয়েছিল। তিনি যে উক্তিসমূহ করেছিলেন সেগুলির পরিপ্রেক্ষিত ও প্রসঙ্গ মানবজাতির কাছে অলক্ষ্য ও অনধিগম্য ছিল; তা মানুষের দর্শনাতীত এক আধ্যাত্মিক জগৎ থেকে ব্যক্ত হয়েছিল। স্থূল শরীরে জীবনধারণরত মানুষ আধ্যাত্মিক জগতকে ভেদ করে যেতে পারে নি। কিন্তু দেহধারণের পর ঈশ্বর মানবীয় পরিপ্রেক্ষিত থেকে মানবজাতির প্রতি বক্তব্য রেখেছিলেন, এবং আধ্যাত্মিক জগৎ থেকে বিনির্গত হয়ে তিনি ঐ জগতের পরিসর অতিক্রম করে গিয়েছিলেন। তিনি তাঁর ঐশ্বরিক স্বভাব, ইচ্ছা, ও মনোভাব এমন বিষয়ের মাধ্যমে অভিব্যক্ত করতে পারতেন যা মানুষ কল্পনা করতে পারতো, যা তারা তাদের জীবনে প্রত্যক্ষ করেছিল ও অভিজ্ঞতা লাভ করেছিল, এবং তিনি তা করতেন মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য পদ্ধতিতে, তাদের বোধগম্য ভাষায়, এবং তারা অনুধাবন করতে সক্ষম এমন প্রজ্ঞার সাথে, যাতে মানবজাতি ঈশ্বরকে উপলব্ধি করতে ও জানতে পারে, তাদের ক্ষমতার পরিসর ও সামর্থ্যের মাত্রার মধ্যে, তাঁর অভিপ্রায় ও তাঁর আদর্শমানের চাহিদাকে উপলব্ধি করতে পারে। এ-ই ছিল মানুষের মাঝে ঈশ্বরের কার্যের পদ্ধতি ও নীতি। দেহরূপে ঈশ্বরের কার্যনির্বাহের পন্থা ও নীতি মুখ্যত মানবতার সহায়তায় বা মানবতার মাধ্যমেই অর্জিত হলেও, তা প্রকৃতপক্ষেই তা এমন সব ফল লাভ করেছিল যা প্রত্যক্ষভাবে দেবত্বের মধ্যে কার্য সম্পাদনের দ্বারা অর্জন করা যেতো না। ঈশ্বরের মানবমাঝে সম্পাদিত কার্য ছিল অধিকতর মূর্ত, প্রামাণিক, ও লক্ষ্যনিষ্ঠ, পদ্ধতিগুলি ছিল আরো অনেক বেশি নমনীয়, এবং তা আকারগতভাবে বিধানের যুগে সম্পন্ন কার্যকে অতিক্রম করে গিয়েছিল।
এবার, প্রভুকে ভালোবাসা ও আত্মজ্ঞানে নিজের প্রতিবেশীকে ভালোবাসার বিষয়ে আলোচনা করা যাক। এটি কি এমনকিছু যা প্রত্যক্ষভাবে দেবত্বের মাঝেই ব্যক্ত হয়? না, স্পষ্টতই তা নয়! এগুলি হল সেই সকল প্রসঙ্গ, যে বিষয়ে মনুষ্যপুত্র মানবতার মাঝে বক্তব্য রেখেছিলেন; একমাত্র মানুষই এমন কিছু বলতে পারে যে “আত্মজ্ঞানে তোমার প্রতিবেশীকে ভালোবাসো,” এবং “যেভাবে তুমি তোমার জীবনকে লালন করো সেভাবেই অন্যদের ভালোবাসো।” এমনতর বাচনরীতি একান্তভাবেই মানবোচিত। ঈশ্বর কখনো এভাবে বক্তব্য রাখেননি। অন্ততপক্ষে তাঁর দেবত্বে, ঈশ্বরের এই প্রকারের ভাষা নেই, কারণ তাঁর মানবপ্রেমকে নিয়ন্ত্রিত করার জন্য ঈশ্বরের “আত্মজ্ঞানে তোমার প্রতিবেশীকে ভালোবাসো”-জাতীয় নীতির কোনো প্রয়োজন নেই, কারণ ঈশ্বরের মানবপ্রেম হল তাঁর যা আছে ও তিনি যা, তা-র এক স্বাভাবিক উদ্ঘাটন। কবে তোমরা ঈশ্বরকে এরকম কিছু বলতে শুনেছো যে: “আমি নিজেকে যেভাবে ভালোবাসি মানবজাতিকে সেভাবেই ভালোবাসি”? তোমরা কখনো শোনো নি, কারণ ঈশ্বরের সারসত্য ও তাঁর যা আছে ও তিনি যা, তা-র মধ্যেই রয়েছে ভালোবাসা। মানবজাতির প্রতি ঈশ্বরের ভালোবাসা, তাঁর মনোভাব, এবং আচরণের ধরন হল তাঁর স্বভাবের এক স্বাভাবিক অভিব্যক্তি ও উদ্ঘাটন। তাঁর প্রতিবেশীকে আত্মজ্ঞানে ভালোবাসার ক্ষমতা অর্জন করার জন্য সুচিন্তিতভাবে এক নির্দিষ্ট উপায়ে তা সম্পন্ন করা, অথবা সুচিন্তিতভাবে কোনো বিশেষ পদ্ধতি বা নৈতিক নিয়মাবলী অনুসরণ করার কোনো প্রয়োজন তাঁর নেই—তিনি ইতিমধ্যেই এহেন সারসত্যের অধিকারী। এর মধ্যে তুমি কী দেখতে পাও? ঈশ্বর যখন মানবমাঝে স্বীয় কার্য সম্পাদন করেছিলেন, তখন তাঁর অনেক পদ্ধতি, বাক্য, ও সত্য মানবীয় ধরনে অভিব্যক্ত হয়েছিল। কিন্তু একই সঙ্গে, ঈশ্বরের প্রকৃতি, তাঁর যা আছে ও তিনি যা, এবং তাঁর ইচ্ছাও প্রকাশিত হয়েছিল, যাতে মানুষ তা জানতে ও উপলব্ধি করতে পারে। যা তারা জানতে ও উপলব্ধি করতে পেরেছিল, তা যথাযথভাবে তাঁরই সারসত্য এবং তাঁর যা আছে ও তিনি যা, যা স্বয়ং ঈশ্বরের সহজাত স্বরূপ ও মর্যাদার প্রতিনিধিত্ব করে, তা-ই। অর্থাৎ, মনুষ্যপুত্র দেহরূপে যতদূর সম্ভব এবং যতটা নির্ভুলভাবে সম্ভব স্বয়ং ঈশ্বরের সহজাত প্রকৃতি ও সারসত্যকেই অভিব্যক্ত করেছিলেন। মনুষ্যপুত্রের মানবতা শুধু যে স্বর্গস্থ ঈশ্বরের সাথে মানুষের যোগাযোগ ও বিনিময়ের ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধক বা অন্তরায় হয়ে ওঠেনি তা-ই নয়, বরং প্রকৃতপক্ষে, তা ছিল সৃষ্টির প্রভুর সাথে মানবজাতির সংযোগ স্থাপনের একমাত্র মাধ্যম ও একমাত্র সেতু। এখন, এই বিন্দুতে এসে, তোমাদের কি মনে হচ্ছে না, যে, অনুগ্রহের যুগে প্রভু যীশুর সম্পাদিত কার্যের প্রকৃতি ও পদ্ধতির সাথে কার্যের বর্তমান পর্যায়ের প্রভূত সাদৃশ্য আছে? কার্যের এই চলতি পর্যায়টিও ঈশ্বরের স্বভাবকে ব্যক্ত করার জন্য প্রচুর পরিমানে মানবীয় ভাষা, এবং স্বয়ং ঈশ্বরের ইচ্ছাকে ব্যক্ত করার জন্য মানবজাতির দৈনন্দিন জীবন ও মানবীয় জ্ঞান থেকে পর্যাপ্ত পরিমানে ভাষা ও পদ্ধতি ব্যবহার করে। ঈশ্বর একবার অবতাররূপ ধারণ করার পর, তিনি কোনো মানবীয় পরিপ্রেক্ষিত থেকেই বক্তব্য রাখুন বা কোনো ঐশ্বরিক পরিপ্রেক্ষিত থেকে, তাঁর অভিব্যক্তির ভাষা ও পদ্ধতির অনেকখানি মানবীয় ভাষা ও পদ্ধতির মাধ্যম দিয়ে এসে পৌঁছায়। অর্থাৎ, ঈশ্বর যখন দেহধারণ করেন, তখনই তা তোমার জন্য ঈশ্বরের সর্বশক্তিমত্তা ও তাঁর প্রজ্ঞা প্রত্যক্ষ করার, এবং ঈশ্বরের প্রতিটি বাস্তব দিককে জানার সর্বশ্রেষ্ঠ সুযোগ। অবতাররূপ ধারণের পর ঈশ্বর যখন বড়ো হয়ে উঠছিলেন, তখন তিনি মানবজাতির কিছু জ্ঞান, সাধারণ বুদ্ধি, ভাষা ও মনুষ্যসুলভ অভিব্যক্তির কিছু পদ্ধতি উপলব্ধি করতে, শিখতে, আর আয়ত্ত করতে পেরেছিলেন। যে মনুষ্যকুল তিনি সৃষ্টি করেছিলেন, সেই মানুষের থেকে আগত এই বিষয়গুলির অধিকারী হয়েছিলেন। তাঁর প্রকৃতি ও তাঁর দেবত্বকে অভিব্যক্ত করার ক্ষেত্রে এগুলি দেহরূপী ঈশ্বরের হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল, এবং যখন তিনি মানবজাতির মাঝে এক মনুষ্যসুলভ পরিপ্রেক্ষিত থেকে ও মানবীয় ভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে কার্যসম্পাদন করছিলেন, তখন এগুলির সাহায্যে তিনি তাঁর কার্যকে আরো প্রাসঙ্গিক, অধিকতর প্রামাণ্য ও নির্ভুলতর করে তুলেছিলেন। এটি তাঁর কার্যকে মানুষের পক্ষে আরো অধিগম্য ও আরো সহজবোধ্য করে তুলেছিল, এইভাবে ঈশ্বরের কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জিত হয়েছিল। এইভাবে দেহরূপে ঈশ্বরের কার্য সম্পাদন কি অধিকতর ব্যবহারিক নয়? তা কি ঈশ্বরের প্রজ্ঞা নয়? ঈশ্বর যখন অবতাররূপ ধারণ করেছিলেন, যখন ঈশ্বর দেহরূপে তাঁর অভীষ্ট কার্যের দায়িত্বভার গ্রহণে সক্ষম হয়েছিলেন, তখনই তিনি ব্যবহারিকরূপে তাঁর স্বভাব ও তাঁর কার্যকে ব্যক্ত করতে সক্ষম হয়েছিল, এবং সেই সময়েই তিনি মনুষ্যপুত্র রূপে তাঁর সেবাব্রতের আনুষ্ঠানিক সূচনা করতে পারতেন। এর অর্থ ছিল, ঈশ্বর ও মানুষের মধ্যে আর কোনো “প্রজন্মগত ব্যবধান” রইলো না, ঈশ্বর শীঘ্রই তাঁর বার্তাবাহকের মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষার কার্যে ক্ষান্তি দেবেন, এবং ঈশ্বর স্বয়ং ব্যক্তিগতভাবে তাঁর দেহরূপের মাধ্যমে যে সকল বাক্য ও কার্য ব্যক্ত করতে চেয়েছিলেন তা ব্যক্ত করতে পারতেন। এর অর্থ ছিল এ-ও যে, ঈশ্বর যে মানুষদের উদ্ধার করেন, তারা তাঁর অধিকতর অন্তরঙ্গ ছিল, তাঁর পরিচালনামূলক কার্য নতুন কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেছিল, এবং সমগ্র মানবজাতি এক নতুন যুগের সম্মুখীন হতে চলেছিল।
যারা বাইবেল পাঠ করেছে তারা সকলেই জানে যে প্রভু যীশুর জন্মের সময় অনেক ঘটনা ঘটেছিল। সেই ঘটনাসমূহের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল দানবরাজ কর্তৃক তাঁর তল্লাশ, ঘটনাটি এমনই চরম সীমায় পৌঁছেছিল যে নগরীর দুই বছর বা তার কম বয়সী সকল শিশুকে হত্যা করা হয়েছিল। এটি স্পষ্টতই প্রতীয়মান যে মানুষের মাঝে দেহধারণ করে ঈশ্বর চরম এক ঝুঁকি নিয়েছিলেন; মানবজাতির উদ্ধারের নিমিত্ত তাঁর ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণ করার জন্য যে বিশাল মূল্য তাঁকে পরিশোধ করতে হয়েছিল, তা-ও সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান। দেহরূপে মানবজাতির মাঝে তাঁর কার্য সম্পাদনের ব্যাপারে ঈশ্বর যে গভীর প্রত্যাশা পোষণ করতেন, তা-ও এখানে দৃশ্যমান। ঈশ্বরের দেহরূপী অবতার যখন মানবজাতির মধ্যে কার্য সম্পাদনের দায়িত্ব গ্রহণ করতে সমর্থ হয়েছিলেন, তখন তাঁর অনুভূতি কেমন ছিল? মানুষের তা কিছু পরিমানে তা উপলব্ধি করতে পারা উচিত, উচিত নয় কি? অন্ততপক্ষে, ঈশ্বর খুশি হয়েছিলেন কারণ মানবজাতির মাঝে তিনি তাঁর নতুন কার্যের সূচনা করতে পেরেছিলেন। প্রভু যীশু যখন দীক্ষিত হয়েছিলেন ও আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁর সেবাব্রত পালনের কার্য আরম্ভ করেছিলেন, তখন ঈশ্বরের হৃদয় আনন্দে আপ্লুত হয়েছিল, কারণ বহু বছরের অপেক্ষা ও প্রস্তুতির পর, অবশেষে তিনি এক সাধারণ মানুষের দেহ ধারণ করতে এবং মানুষের দৃষ্টি ও স্পর্শগ্রাহ্য রক্তমাংসের এক মানুষের আকৃতিতে তাঁর নবকার্যের সূচনা ঘটাতে পেরেছিলেন। এক মানুষের পরিচয়ে অবশেষে তিনি মানুষের সাথে সামনাসামনি ও খোলামনে কথা বলতে পেরেছিলেন। মানবীয় পন্থা ও মানবীয় ভাষার মধ্যস্থতায় অবশেষে তিনি মানবজাতির মুখোমুখি আসতে পেরেছিলেন; মানবীয় ভাষা ব্যবহার করে তিনি মানবজাতির জন্য সংস্থান বিধান করতে, তাদের আলোকিত করতে ও সহায়তা করতে পেরেছিলেন; তাদের সঙ্গে একই টেবিলে বসে খাদ্যগ্রহণ করতে ও একই পরিসরে বসবাস করতে সক্ষম হয়েছিলেন। মানুষ যেভাবে দেখে সেভাবেই এবং এমনকি তাদের নিজস্ব চক্ষু দিয়েই তিনি মানুষ, দ্রব্যাদি ও সকলকিছু চাক্ষুষ করতেও সমর্থ হয়েছিলেন। ঈশ্বরের কাছে, তা ইতিমধ্যেই ছিল তাঁর দেহরূপে সাধিত কার্যে প্রথম জয়লাভ। এ-ও বলা যায় যে, তা ছিল এক মহান কার্যের অভীষ্টসিদ্ধি—নিশ্চিতভাবে এই কারণেই ঈশ্বর সবচেয়ে বেশি আনন্দিত হয়েছিলেন। তখন থেকে শুরু করে, সেই প্রথম ঈশ্বর মানবজাতির মধ্যে তাঁর কার্যে এক ধরনের স্বস্তি অনুভব করলেন। যে ঘটনাগুলো ঘটে গিয়েছিল তাদের সবই ছিল অত্যন্ত ব্যবহারিক ও স্বাভাবিক, এবং যে স্বস্তি ঈশ্বর অনুভব করেছিলেন তা ছিল অত্যন্ত যথার্থ। মানবজাতির জন্য, যতবার ঈশ্বরের কার্যের কোনো নতুন পর্যায় সুসম্পন্ন হয়, এবং যতবার ঈশ্বর চরিতার্থ বোধ করেন, মানবজাতি তত বেশি করে ঈশ্বরের ও পরিত্রাণের নিকটবর্তী হতে পারে। ঈশ্বরের কাছে, তাঁর পরিচালনামূলক পরিকল্পনাকে অগ্রবর্তী করে এটি তাঁর নতুন কার্যের সূত্রপাতও বটে, এবং, তদুপরি, এমনতর সময়গুলিতে তাঁর অভিপ্রায় সম্পূর্ণ চরিতার্থতার দিকে এগিয়ে যায়। মানবজাতির কাছে, এহেন সুযোগের আগমান সৌভাগ্যজনক, ও অতীব শুভ; যে সকল মানুষ ঈশ্বরের পরিত্রাণের অপেক্ষায় রয়েছে, তাদের জন্য তা হল অতি গুরুত্ববহ ও আনন্দদায়ক সংবাদ। ঈশ্বর যখন কার্যের এক নতুন পর্যায় সম্পন্ন করেন, তখন তিনি এক নব সূচনায় উপনীত হন, এবং মানবজাতির মাঝে যখন এই নতুন কার্য ও নব সূচনার প্রবর্তন ও সূত্রপাত ঘটে, তা হল যখন কার্যের এই পর্যায়ের ফলাফল ইতিমধ্যেই নিরূপিত ও অর্জিত হয়েছে এবং এর চূড়ান্ত পরিণতি ও ফলশ্রুতি ঈশ্বর ইতিমধ্যেই দৃষ্টিগোচর করেছেন। আর তখনই এই ফলাফলগুলি ঈশ্বরকে পরিতৃপ্ত করে, এবং, নিশ্চিতভাবে, তখনই তাঁর হৃদয় উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। ঈশ্বর আশ্বস্ত বোধ করেন, কারণ তাঁর দৃষ্টিতে, যে মানুষগুলির তিনি অন্বেষণ করছিলেন, তাদের ইতিমধ্যেই তিনি চাক্ষুষ ও নির্ধারিত করে ফেলেছিলেন, এবং এই জনগোষ্ঠীটিকে ইতিমধ্যেই তিনি অর্জন করেছিলেন, যে গোষ্ঠীটি তাঁর কার্যকে সাফল্যমণ্ডিত করতে ও তাঁকে পরিতৃপ্তি এনে দিতে সক্ষম। অতএব, তিনি তাঁর দুশ্চিন্তাগুলিকে দূরে সরিয়ে রেখে আনন্দিত বোধ করেন। অন্য ভাবে বললে, ঈশ্বরের দেহরূপী অবতার যখন মানুষের মাঝে তাঁর নতুন কার্যের সূত্রপাত করতে সক্ষম হন, এবং অপ্রতিহতভাবে তাঁর করণীয় কার্যের সম্পাদন শুরু করেন, এবং যখন তিনি অনুভব করেন যে সকলকিছু সুসম্পন্ন হয়েছে, তখন ফলাফলটি তাঁর কাছে ইতিমধ্যেই দৃষ্টিগোচর। এই কারণেই তিনি সন্তুষ্ট ও তাঁর হৃদয় উৎফুল্ল। ঈশ্বরের প্রফুল্লতা কীভাবে অভিব্যক্ত হয়? উত্তরটি কী হতে পারে, তা কি তোমরা কল্পনা করতে পারো? ঈশ্বর কি আনন্দে অশ্রুপাত করতে পারেন? ঈশ্বরের পক্ষে অশ্রুপাত করা কি সম্ভব? ঈশ্বর কি করতালি দিতে পারেন? ঈশ্বর কি নৃত্যে প্রবৃত্ত হতে পারেন? ঈশ্বর কি গান গেয়ে উঠতে পারেন? যদি পারেন, তাহলে কোন গীত তিনি গাইবেন? অবশ্যই, ঈশ্বর কোনো এক শ্রুতিমধুর, মর্মস্পর্শী গান গেয়ে উঠতে পারেন, এমন এক সঙ্গীত যা তাঁর হৃদয়ের আনন্দ ও তৃপ্তিকে প্রকাশ করতে পারে। এই গান তিনি মানবজাতির উদ্দেশ্যে, তাঁর নিজের জন্য, এবং সকলকিছুর উদ্দেশ্যে গেয়ে উঠতে পারেন। ঈশ্বরের আনন্দ যে কোনো ভাবেই প্রকাশ পেতে পারে—এই সবকিছুই স্বাভাবিক কারণ ঈশ্বরের সুখদুঃখ রয়েছে, এবং তাঁর বিবিধ অনুভূতি বিবিধ উপায়ে ব্যক্ত হতে পারে। এটি তাঁর অধিকার, এবং আর কোনোকিছুই এর থেকে বেশি স্বাভাবিক ও যথাযথ হতে পারে না। এই বিষয়ে মানুষের অন্য কিছু চিন্তা করা উচিত নয়। ঈশ্বরের উপর তোমাদের “বন্ধনী শক্ত করা মন্ত্র”[ক] প্রয়োগের চেষ্টা করা উচিত নয়, তোমাদের এমনটা বলা সঙ্গত নয় যে, তাঁর এটা বা ওটা করা অনুচিত, তাঁর এহেন বা সেহেন ধরনের আচরণ অনুচিত, এবং উচিত নয় তাঁর আনন্দ বা তাঁর সম্ভাব্য অন্য যেকোনো অনুভূতিকে এইভাবে সীমাবদ্ধ করা। মানুষ মনে করে যে ঈশ্বর খুশি হতে পারেন না, অশ্রুবিসর্জন করতে পারেন না, কাঁদতে পারেন না—কোনো ভাবাবেগই বুঝি তিনি প্রকাশ করতে পারেন না। এই দুটি আলোচনার মাধ্যমে আমরা যে আলাপচারিতা করেছি, তার পরে আমার বিশ্বাস যে, তোমরা ঈশ্বরকে আর এইভাবে দেখবে না, বরং ঈশ্বরকে কিছু স্বাধীনতা ও অব্যাহতি মঞ্জুর করবে। তা অতি উত্তম বিষয়। ভবিষ্যতে, ঈশ্বরকে দুঃখিত হতে শুনলে তোমরা যদি তাঁর দুঃখকে প্রকৃতই অনুভব করতে পারো, এবং তাঁকে আনন্দিত হতে শুনলে যদি তাঁর আনন্দকে যথার্থই অনুভবে সমর্থ হও, তাহলে, অন্ততপক্ষে, তোমরা এটুকু স্পষ্টভাবে জানতে ও উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে যে, কী ঈশ্বরকে খুশি করে, আর কী-ই বা তাঁকে করে দুঃখিত। যখন ঈশ্বর বিষণ্ণ বলে তুমি নিজেও বিষণ্ণ বোধ করতে, এবং ঈশ্বর আনন্দিত বলে আনন্দিত বোধ করতে সক্ষম হবে, তখন তিনি তোমার হৃদয়কে সম্পূর্ণরূপে অর্জন করে ফেলবেন, এবং তোমার নিজের ও তাঁর মধ্যে আর কোনো প্রতিবন্ধক থাকবে না। তুমি মানবীয় কল্পনা, পূর্বধারণা, ও জ্ঞানের দ্বারা ঈশ্বরকে গণ্ডিবদ্ধ করার চেষ্টা করবে না আর। সেই সময়ে, ঈশ্বর জীবন্ত ও প্রাণবন্ত হয়ে উঠবেন তোমার অন্তরে। তিনি হয়ে উঠবেন তোমার জীবনের ঈশ্বর এবং তোমার সম্পর্কিত সকলকিছুর প্রভু। তোমাদের কি এই জাতীয় উচ্চাকাঙ্ক্ষা রয়েছে? তোমরা কি তা অর্জন করতে পারবে বলে আত্মবিশ্বাসী?
—বাক্য, খণ্ড ২, ঈশ্বরকে জানার প্রসঙ্গে, ঈশ্বরের কর্ম, ঈশ্বরের স্বভাব এবং স্বয়ং ঈশ্বর ৩
পাদটীকা:
ক. “বন্ধনী শক্ত করা মন্ত্র” হচ্ছে চীনাভাষার উপন্যাস “পশ্চিমের পথে যাত্রা”-তে ভিক্ষু তাং সানজাং এর ব্যবহৃত একটি মন্ত্র। সান উকং কে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এই মন্ত্র তিনি ব্যবহার করেন, তার মাথার চারিদিকে একটি ধাতব পাত মন্ত্রের দ্বারা শক্ত করে তাকে প্রচণ্ড শিরঃপীড়া দিয়ে, এবং এইভাবে তাকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসে। মানুষকে বেঁধে রাখে এরকম কোনো বস্তুকে বর্ণনা করার জন্য এটা একটা রূপকে পরিণত হয়েছে।