যীশু অলৌকিক কার্য সম্পাদন করলেন
১. যীশু পাঁচ সহস্র মানুষকে খাদ্য জোগালেন
যোহন ৬:৮-১৩ শিমোন পিতরের ভাই আন্দ্রিয় ছিলেন যীশুর শিষ্যদের মধ্যে একজন। তিনি যীশুকে বললেন, এখানে একটি ছেলের কাছে যবের পাঁচখানা রুটি আর দুখানা ভাজা মাছ আছে কিন্তু এত লোকের পক্ষে এ কিছুই না। যীশু বললেন, সবাইকে বসিয়ে দাও। প্রচুর ঘাসে ঢাকা ছিল জায়গাটা। লোকেরা সব বসে পড়ল সেখানে। সেই জনতার মধ্যে পুরুষের সংখ্যাই ছিল পাঁচ হাজার। যীশু রুটিগুলি নিয়ে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিলেন। তারপর উপবিষ্ট লোকদের মধ্যে সেগুলি পরিবেশন করার জন্য শিষ্যদের দিলেন। মাছের বেলাতেও তিনি তাই-ই করলেন। যে যত চাইল, পেল। যথেষ্ট পরিমাণে সকলের খাওয়া হলে যীশু তাঁর শিষ্যদের বললেন, এবার যা কিছু পড়ে আছে সব জড়ো কর যেন কিছুই নষ্ট না হয়। তাঁরা তখন সব জড়ো করলেন। লোকদের খাওয়াদাওয়ার পর পাঁচখানা যবের রুটি থেকে যে টুকরোগুলি বেঁচেছিল তাতে তাঁদের বারোটি ঝুড়ি ভরে গেল।
২. লাসারের পুনরুত্থান ঈশ্বরকে মহিমান্বিত করলো
যোহন ১১:৪৩-৪৪ তারপর যীশু উচ্চকন্ঠে ডেকে বললেন, লাসার, বেরিয়ে এস। লাসার বেরিয়ে এল। তার হাত পা ছিল কাপড়ের ফালি দিয়ে জড়িয়ে বাঁধা আর মুখে জড়ান ছিল একটা কাপড়। যীশু বললেন, ওর বাঁধন খুলে দাও, যেতে দাও ওকে।
প্রভু যীশুর দ্বারা সম্পাদিত অলৌকিক ঘটনাগুলির মধ্যে থেকে, আমরা শুধু এই দুটিকেই নির্বাচন করেছি কারণ এখানে যে বিষয়ে আমি আলোচনা করতে চাই, তা প্রতিপাদন করার জন্য এদুটিই পর্যাপ্ত। এই অলৌকিক ঘটনাদুটি সত্যিই বিস্ময়কর, এবং যথার্থভাবেই অনুগ্রহের যুগ চলাকালীন প্রভু যীশুর দ্বারা সম্পন্ন অলৌকিক কার্যগুলির প্রতিনিধিস্থানীয়।
প্রথমে, প্রথম অনুচ্ছেদটির দিকে এক ঝলক দেখা যাক: যীশু পাঁচ সহস্র মানুষকে খাদ্য জোগালেন।
“পাঁচখানা রুটি আর দুখানা ভাজা মাছ”-এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্যটি কী? সাধারণভাবে, পাঁচ খণ্ড রুটি ও দুটি মাছ দিয়ে কতজন মানুষকে পর্যাপ্তভাবে ভোজন করানো যায়? একজন গড়পড়তা মানুষের ক্ষুধাকে তুমি যদি তোমার পরিমাপের ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করো, তাহলে তা কেবল দুজন মানুষের পক্ষে যথেষ্ট হবে। সবচেয়ে মৌলিক অর্থে এই হল “পাঁচখানা রুটি আর দুখানা ভাজা মাছ”-এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য। কিন্তু, এই অনুচ্ছেদে, পাঁচ খণ্ড রুটি ও দুখানা মাছ দিয়ে কতজন মানুষকে ভোজন করানো হয়েছে? শাস্ত্রে নিম্নলিখিত বাক্যটি নথিভুক্ত আছে: “প্রচুর ঘাসে ঢাকা ছিল জায়গাটা। লোকেরা সব বসে পড়ল সেখানে। সেই জনতার মধ্যে পুরুষের সংখ্যাই ছিল পাঁচ হাজার।” পাঁচ খণ্ড রুটি ও দুখানা মাছের সঙ্গে তুলনায় পাঁচ হাজার কি একটি বড়ো সংখ্যা? সংখ্যাটি যে এতো বড়ো, তাতে কী প্রমাণ হয়? এক মানবীয় পরিপ্রেক্ষিত থেকে, পাঁচ খণ্ড রুটি ও দুটি মাছ পাঁচ হাজার মানুষের মধ্যে বণ্টন করা অসম্ভব ব্যাপার হবে, কারণ মানুষের সংখ্যা ও খাদ্যের পরিমানের মধ্যে তারতম্যটি অত্যন্ত বেশি। এমনকি প্রত্যেক মানুষ কেবল ক্ষুদ্র একগ্রাস খাদ্যও গ্রহণ করে, তাহলেও তা পাঁচ হাজার লোকের পক্ষে যথেষ্ট হবে না। কিন্তু এখানে, প্রভু যীশু এক অলৌকিক কার্য সম্পাদন করেন—তিনি যে শুধু পাঁচ হাজার মানুষের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্যের সংস্থান নিশ্চিত করলেন তা-ই নয়, উপরন্তু আরো খাদ্য উদ্বৃত্ত রয়ে গেলো। ধর্মগ্রন্থে লেখা আছে: “যথেষ্ট পরিমাণে সকলের খাওয়া হলে যীশু তাঁর শিষ্যদের বললেন, এবার যা কিছু পড়ে আছে সব জড়ো কর যেন কিছুই নষ্ট না হয়। তাঁরা তখন সব জড়ো করলেন। লোকদের খাওয়াদাওয়ার পর পাঁচখানা যবের রুটি থেকে যে টুকরোগুলি বেঁচেছিল তাতে তাঁদের বারোটি ঝুড়ি ভরে গেল।” এই অলৌকিক ঘটনাটি মানুষকে প্রভু যীশুর পরিচিতি ও মর্যাদা অনুধাবন করতে, এবং ঈশ্বরের পক্ষে কিছুই যে অসম্ভব নয়, তা উপলব্ধি করতে সমর্থ করেছিল—এইভাবে, তারা ঈশ্বরের সর্বশক্তিমত্তার সত্যকে প্রত্যক্ষ করেছিল। পাঁচ খণ্ড রুটি ও দুখানা মাছ পাঁচ হাজার মানুষকে ভোজন করানোর পক্ষে পর্যাপ্ত ছিল, কিন্তু যদি কোনো খাদ্যই না থাকতো, তখনো কি ঈশ্বর পাঁচ হাজার লোককে আহার করাতে সক্ষম হতেন? নিশ্চিতভাবেই, তিনি তা-ও করতে পারতেন! এ হল এক অলৌকিক কাণ্ড, তাই মানুষ অবধারিতভাবে ভেবেছিল যে, তা ধারণাতীত, অবিশ্বাস্য ও রহস্যজনক, কিন্তু ঈশ্বরের কাছে, এহেন কর্মসম্পাদন কোনো বিষয়ই ছিল না। ঈশ্বরের কাছে যদিও তা ছিল এক সাধারণ বিষয়, তবু, ব্যাখ্যাদানের নিমিত্ত এটিকে এখন আলাদা করে বেছে নেওয়া হবে কেন? কারণ, এই অলৌকিক সংঘটনের পিছনে যা নিহিত, তা হল প্রভু যীশুর অভিপ্রায়, যা মানবজাতি আগে কখনো ঠাহর করেনি।
প্রথমে, বোঝার চেষ্টা করা যাক যে এই পাঁচ হাজার জন মানুষ কী ধরনের ব্যক্তি ছিল। তারা কি প্রভু যীশুর অনুসরণকারী ছিল? শাস্ত্র থেকে আমরা জানতে পারি যে, তারা তাঁর অনুসরণকারী ছিল না। প্রভু যীশু কে, তা কি তারা জানতো? নিশ্চিতভাবেই জানতো না! অন্ততপক্ষে, তারা জানতো না যে তাদের সামনে যে মানুষটি দাঁড়িয়ে আছেন তিনি খ্রীষ্ট, অথবা হয়তো কিছু মানুষ কেবল তাঁর নামটুকুই জানতো এবং তাঁর কার্যকলাপের বিষয়ে কিছু কথাবার্তা জানতো বা শুনেছিল। কেবলমাত্র তাঁর সম্বন্ধে গল্পগাথাগুলি শোনার পরেই প্রভু যীশুর বিষয়ে তাদের কৌতূহল জেগে উঠেছিল, কিন্তু তুমি অবশ্যই এমনটা বলতে পারো না যে তারা তাঁকে অনুসরণ করতো, তাঁকে উপলব্ধির করার তো প্রশ্নই ওঠে না। প্রভু যীশু যখন এই পাঁচ হাজার মানুষকে দেখেন, তারা তখন ক্ষুধার্ত এবং কেবল নিজেদের ক্ষুন্নিবারণের চিন্তাতেই ব্যস্ত ছিল, সুতরাং এহেন এক পরিস্থিতিতেই প্রভু যীশু তাদের কামনা পূরণ করেছিলেন। তাদের ইচ্ছা যখন তিনি পূরণ করেন, তখন তাঁর অন্তরে কী ছিল? যে মানুষগুলি শুধু উদরপূর্তি করে ভোজন করতে চেয়েছিল, তাদের প্রতি তাঁর মনোভাব কী ছিল? সেই সময়, প্রভু যীশুর চিন্তা ও তাঁর মনোভাব ঈশ্বরের স্বভাব ও সারসত্যের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। শূন্যজঠর ও শুধুমাত্র একটা পূর্ণ আহারের আকাঙ্ক্ষী এই পাঁচ সহস্র মানুষের মুখোমুখি হয়ে, তাঁর প্রতি কৌতূহল ও প্রত্যাশায় ভরপুর এই মানুষগুলির সম্মুখীন হয়ে, কেবলমাত্র তাদের উপর অনুগ্রহ বর্ষণের উদ্দেশ্যেই প্রভু যীশু এই অলৌকিক সংঘটন প্রয়োগ করবেন বলে ভেবেছিলেন। কিন্তু, তাঁর মনে এমন কোনো আশা জাগ্রত হয়নি যে তারা তাঁর অনুগামীতে পরিণত হবে, কারণ তিনি জানতেন যে তারা শুধু তামাসায় অংশ নিতে ও তাদের পেট পুরে খেতে চেয়েছিল, তাই সেখানে তাঁর কাছে যা ছিল তা দিয়েই তিনি যতটা সম্ভব করেছিলেন, এবং পাঁচ খণ্ড রুটি ও দুখানা মাছ দিয়ে পাঁচ সহস্র লোককে খাইয়েছিলেন। এই লোকগুলি, যারা রোমাঞ্চকর ব্যাপার দেখতে ভালোবাসতো, যারা অলৌকিক ঘটনা চাক্ষুষ করতে চাইতো, তিনি তাদের চোখ খুলে দিয়েছিলেন, এবং ঈশ্বরের অবতার যা সম্পন্ন করতে পারেন, তা তারা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছিল। যদিও তাদের কৌতূহল চরিতার্থ করার জন্য প্রভু যীশু স্পর্শগ্রাহ্য কিছু দ্রব্যের ব্যবহার করেছিলেন, কিন্তু তাঁর অন্তরে তিনি আগেই জানতেন যে এই পাঁচ হাজার মানুষ শুধু একটা উত্তম আহার্য পেতে চেয়েছিল, তাই তাদের কাছে তিনি ধর্মপ্রচার করেন নি বা আদৌ কিছুই বলেন নি—তিনি কেবল এই অলৌকিক ঘটনাটি সংঘটনকালে তাদের তা দেখার সুযোগ দিয়েছিলেন। যারা তাঁকে সত্যিকারের অনুসরণ করতো তাঁর সেই শিষ্যদের সঙ্গে তিনি যে আচরণ করতেন, এই লোকগুলির সঙ্গে কোনোক্রমেই তিনি সেই একই আচরণ করতে পারতেন না, কিন্তু ঈশ্বরের অন্তরে, সকল প্রাণীই তাঁর শাসনের অধীন, এবং যখন প্রয়োজন হবে তখন তাঁর দৃষ্টিসীমার মধ্যে সকল জীবকেই তিনি ঈশ্বরের অনুগ্রহ উপভোগ করতে দেবেন। যদিও এই লোকগুলি তিনি কে তা জানতো না, এবং তাদের তাঁর বিষয়ে কোনো উপলব্ধি, বা তাঁর সম্বন্ধে কোনো নির্দিষ্ট ধারণা, বা এমনকি, ঐ রুটি ও মাছ আহার করার পরেও তাঁর প্রতি কোনো কৃতজ্ঞতাবোধ ছিল না, কিন্তু এগুলি ঈশ্বরের কাছে কোনো মতান্তরের বিষয় ছিল না—সেই মানুষগুলিকে তিনি ঈশ্বরের অনুগ্রহ উপভোগ করার এক চমৎকার সুযোগ দিয়েছিলেন। কিছু মানুষ বলে থাকে যে ঈশ্বর তাঁর সকল কার্যে নীতিনিষ্ঠ, বলে যে, তিনি নাকি অবিশ্বাসীদের দেখভাল করেন না বা তাদের সুরক্ষা দেন না, এবং বিশেষ করে বলে, যে, তিনি নাকি তাদের তাঁর অনুগ্রহ উপভোগের সুযোগ দেন না। ঘটনাটি কি প্রকৃতই তাই? ঈশ্বরের দৃষ্টিতে, যতক্ষণ তারা স্বয়ং তাঁর সৃষ্ট জীবিত প্রাণী, ততক্ষণ তিনি তাদের পরিচালনা ও তত্ত্বাবধান করবেন, এবং বিবিধ উপায়ে তিনি তাদের সাথে আচরণ করবেন, তাদের জন্য পরিকল্পনা করবেন, এবং তাদের শাসন করবেন। সকল কিছুর প্রতি এটাই হল ঈশ্বরের চিন্তাভাবনা ও মনোভাব।
যদিও এই পাঁচ হাজার মানুষ, যারা সেই রুটি ও মাছ আহার করেছিল, তাদের প্রভু যীশুর অনুগামী হওয়ার কোনো পরিকল্পনা ছিল না, কিন্তু তিনি তাদের কাছে কঠোর কোনো দাবি রাখেন নি; তোমরা কি জানো, যে, তাদের পেট ভরে আহার সমাপন হলে, প্রভু যীশু কী করেছিলেন? তিনি কি আদৌ তাদের উদ্দেশ্যে ধর্মপ্রচার করেছিলেন? এই কার্য সম্পাদনের পর তিনি কোথায় গিয়েছিলেন? শাস্ত্রবাক্যে লিপিবদ্ধ নেই যে প্রভু যীশু লোকগুলিকে কিছু বলেছিলেন, কেবল বলা আছে যে, সেই অলৌকিক কার্য সম্পাদনের পর তিনি শান্তভাবে চলে গিয়েছিলেন। তাহলে তিনি কি এই লোকগুলির কাছে কোনো চাহিদা জ্ঞাপন করেছিলেন? এর মধ্যে কি কোনো ঘৃণাবোধ ছিল? না, এসব কিছুই ছিল না। তিনি কেবল সেই ব্যক্তিগণ, যারা তাঁর অনুগমনে সক্ষম ছিল না, তাদের প্রতি আর কোনো মনোযোগ দিতে চান নি, এবং সেই সময়ে তাঁর হৃদয় বেদনায় কাতর ছিল। কারণ তিনি মানবজাতির নৈতিক অধোগমন প্রত্যক্ষ করেছিলেন, এবং তাঁর প্রতি মানবজাতির প্রত্যাখ্যানকে অনুভব করেছিলেন, সেই মানুষদেরকে দেখার ও তাদের সঙ্গে অবস্থান করার পরে, মানুষের মূঢ়তা ও অজ্ঞতার কারণে তিনি দুঃখ বোধ করেছিলেন, এবং তাঁর হৃদয় বেদনায় দীর্ণ হয়েছিল, তিনি শুধু যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেই ব্যক্তিগণকে ছেড়ে চলে আসতে চেয়েছিলেন। প্রভু তাঁর অন্তরে এই লোকগুলির কাছে কোনো জ্ঞাপন করেন নি, তিনি তাদের প্রতি কোনো মনোযোগ দিতে চান নি, তাদের জন্য তিনি তাঁর শক্তি ব্যয় করতে চান নি। তিনি জানতেন তারা তাঁর অনুগমনে সক্ষম নয়, কিন্তু তা সত্ত্বেও, তাদের প্রতি তাঁর মনোভাব তখনো খুব স্পষ্ট ছিল। তিনি শুধু তাদের প্রতি সদয় আচরণ করতে, তাদের উপর অনুগ্রহ অর্পণ করতে চেয়েছিলেন, এবং বস্তুত তাঁর শাসনাধীন প্রতিটি জীবের প্রতি এটাই ছিল ঈশ্বরের মনোভাব—সকল জীবের প্রতি সহৃদয় আচরণ করা, রসদ সংস্থান করে তাদের পুষ্টিসাধন করা। প্রভু যীশু ঈশ্বরের অবতার ছিলেন বলেই, খুব স্বাভাবিক ভাবেই তিনি ঈশ্বরের নিজস্ব সারসত্যের প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন, এবং এই লোকগুলির প্রতি সদয় আচরণ করেছিলেন। এক জনহিতৈষী ও সহিষ্ণু হৃদয় নিয়ে তাদের তিনি বিবেচনা করেছিলেন, এবং এমন একটা হৃদয় থেকেই তাদের প্রতি তিনি সহৃদয়তা প্রদর্শন করেছিলেন। এই লোকগুলি প্রভু যীশুকে যেভাবেই দেখে থাকুক না কেন, এবং ফলাফল যেমনই হোক না কেন, প্রত্যেক সত্তাকে তিনি দেখেছিলেন সমগ্র সৃষ্টির প্রভু হিসাবে তাঁর অবস্থানের ভিত্তিতে। যাকিছু তিনি প্রকাশ করেছিলেন, ব্যত্যয়হীন ভাবে তা ছিল ঈশ্বরেরই স্বভাব, এবং তাঁর যা আছে ও তিনি যা। প্রভু যীশু শান্তভাবে এই কার্য সম্পাদন করেছিলেন, আর তারপর তিনি শান্তভাবে চলে গিয়েছিলেন—এটি ঈশ্বরের স্বভাবের কোন দিক? একে কি ঈশ্বরের প্রেমময় সহৃদয়তা বলা যায়? একে কি ঈশ্বরের পরার্থপরতা বলা যেতে পারে? একজন গড়পড়তা মানুষ কি এমনটা করতে সক্ষম? নিশ্চিতভাবেই তা নয়! সারমর্মগতভাবে, প্রভু যীশু এই যে পাঁচ হাজার জন মানুষকে পাঁচ টুকরো রুটি ও দুটি মাছের সাহায্যে ভোজন করালেন, তারা কারা ছিল? এমন কি বলা যায় যে, তারা তাঁর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ মানুষ ছিল? এমনটা কি বলা যায় যে, তারা সকলেই ঈশ্বর-বিদ্বেষী ব্যক্তি ছিল? নিশ্চিতভাবেই বলা যায় এরা মোটেই প্রভুর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না, এবং সারমর্মের দিক থেকে, তারা ছিল সর্বতোভাবেঈশ্বরের প্রতি বৈরীভাবাপন্ন। কিন্তু ঈশ্বর তাদের প্রতি কেমন আচরণ করলেন? মানুষগুলির ঈশ্বর-বিদ্বেষকে নিষ্ক্রিয় করতে তিনি একটি পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলেন—এই পদ্ধতিটিকে বলে “সহৃদয়তা।” অর্থাৎ, প্রভু যীশু এই লোকগুলিকে পাপী মানুষ বলে জানলেও, ঈশ্বরের দৃষ্টিতে তবু তারা তাঁরই সৃষ্টি ছিল, তাই তিনি তখনো এই পাপীদের প্রতি সহৃদয় আচরণই করেছিলেন। এটাই হল ঈশ্বরের সহিষ্ণুতা, এবং এই সহিষ্ণুতা ঈশ্বরের নিজস্ব পরিচয় ও সারসত্যের দ্বারা নির্ধারিত হয়। তাই, এ হল এমন এক বিষয়, যা ঈশ্বর-সৃষ্ট কোনো মানুষের পক্ষে করে ওঠা সক্ষম নয়—একমাত্র ঈশ্বরই তা করতে পারেন।
যখন তুমি যথার্থভাবেই মানবজাতির প্রতি ঈশ্বরের চিন্তাভাবনা ও মনোভাব অনুধাবন করতে সক্ষম হবে, যখন সৃষ্টির প্রতিটি সত্তার জন্য ঈশ্বরের ভাবাবেগ ও উদ্বেগকে প্রকৃতপক্ষেই উপলব্ধি করতে পারবে, তখনই তুমি সৃষ্টিকর্তার দ্বারা সৃজিত প্রত্যেকটি মানুষের উপর যে নিষ্ঠা ও ভালোবাসা ব্যয়িত হয়েছে, তা উপলব্ধিতে সক্ষম হবে। এটা ঘটে গেলে, ঈশ্বরের ভালোবাসাকে বর্ণনার জন্য তুমি দুটিমাত্র শব্দ ব্যবহার করবে। সেই শব্দদুটি কী? কিছু মানুষ বলে “নিঃস্বার্থ”, এবং কিছু মানুষ বলে “মানবহিতৈষী”। এই দুটির মধ্যে, ঈশ্বরের ভালোবাসাকে বর্ণনা প্রসঙ্গে “মানবহিতৈষী” শব্দটি সবচেয়ে কম সুপ্রযুক্ত। মহানুভব বা উদারচেতা কোনো মানুষের বর্ণনা প্রসঙ্গে মানুষ এই শব্দটি ব্যবহার করে থাকে। এই শব্দটি আমি ঘৃণা করি, কারণ শব্দটি ন্যায়নীতির প্রতি কোনো বিবেচনা ব্যতিরেকেই যথেচ্ছ ও বাছবিচারহীনভাবে বদান্যতা বিতরণ করাকে নির্দেশ করে। এ হল এক মাত্রাতিরিক্ত আবেগাত্মক প্রবণতা, যা নির্বোধ ও বিভ্রান্ত মানুষদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। ঈশ্বরের ভালোবাসার বর্ণনায় এই শব্দটি ব্যবহার করা হলে, অবধারিতভাবেই এক ঈশ্বরনিন্দাসূচক দ্যোতনা চলে আসে। এখানে আমি দুটো শব্দ বলছি যেগুলি আরো যথাযথভাবে ঈশ্বরের ভালোবাসাকে বর্ণনা করে। সেদুটি কী? প্রথমটি হল “বিপুল”। এই শব্দটি কি খুবই ব্যঞ্জনাময় নয়? দ্বিতীয়টি হল “বিশাল”। ঈশ্বরের ভালোবাসাকে বর্ণনা করতে এই যে শব্দদুটি আমি ব্যবহার করেছি তাদের মধ্যে বাস্তব অর্থ নিহিত আছে। আক্ষরিক অর্থে নিলে, “বিপুল” শব্দটি কোনো বস্তুর আয়তন বা ধারণক্ষমতা নির্দেশ করে, কিন্তু বস্তুটি যত বড়োই হোক না কেন, মানুষ সেটিকে স্পর্শ ও দর্শন করতে পারে। এর কারণ হল যে, বস্তুটির অস্তিত্ব রয়েছে—সেটি কোনো বিমূর্ত বিষয় নয়, বরং তা হল এমন একটা কিছু, যা মানুষকে এক অপেক্ষাকৃত নির্ভুল ও ব্যবহারিক ভাবে ধারণা দিতে পারে। বস্তুকে তুমি দ্বিমাত্রিক বা ত্রিমাত্রিক যে পরিপ্রেক্ষিতেই দেখো, তোমাকে এর অস্তিত্ব কল্পনা করতে হবে না, কারণ এট হল এমন এক বস্তু, যা বাস্তবে প্রকৃতই অস্তিমান। যদিও ঈশ্বরের ভালোবাসা বর্ণনা প্রসঙ্গে “বিপুল” শব্দটির প্রয়োগ তাঁর ভালোবাসাকে পরিমিত করার একটা প্রচেষ্টা বলে মনে হতে পারে, কিন্তু, একই সাথে, শব্দটি এমন অনুভূতিও দেয় যে, তাঁর ভালোবাসা অপরিমেয়। আমি ঈশ্বরের ভালোবাসাকে পরিমাপযোগ্য বলছি কারণ তাঁর ভালোবাসা শূন্যগর্ভ নয়, এবং তা কিংবদন্তিতে বর্ণিত কোনো বিষয়ও নয়। বরং, এটা এমন একটা জিনিস যা ঈশ্বরের কর্তৃত্বাধীন সকল বস্তুই ভাগ করে নেয়, সকল সত্তাই যা বিভিন্ন মাত্রায় ও বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত থেকে উপভোগ করে। যদিও মানুষ একে দর্শন বা স্পর্শ করতে পারে না, কিন্তু এই ভালোবাসা সকল বস্তুর মধ্যে বহন করে আনে পুষ্টিসাধকতা ও প্রাণশক্তি, যা তাদের জীবৎকালে ক্রমে ক্রমে প্রকাশিত হয়, এবং প্রতিটি অপসৃয়মান মুহূর্তে তাদের উপভোগ করা ঈশ্বরের ভালোবাসাকে তারা তাৎপর্যপূর্ণ মনে করে, এবং সেই ভালোবাসার সাক্ষ্য বহন করে। ঈশ্বরের ভালোবাসাকে আমি অপরিমেয় বলছি কারণ ঈশ্বর কর্তৃক সকল বস্তুকে সংস্থান ও পুষ্টিসাধনের রহস্যটি অনুধাবন করা মানুষের পক্ষে কঠিন, যেমন কঠিন সকলকিছুর জন্য, বিশেষত মানবজাতির জন্য, ঈশ্বরের চিন্তাভাবনাকে বুঝে ওঠা। অর্থাৎ, মানবজাতির নিমিত্ত ঈশ্বর যে কতখানি পরিশ্রম করেছেন, তা কেউই জানে না। তাঁর স্বহস্তে সৃজিত মানবজাতির প্রতি সৃষ্টিকর্তার ভালোবাসার গভীরতা বা গুরুত্ব কেউই উপলব্ধি করতে পারে না, কেউই তা বুঝে উঠতে সক্ষম নয়। ঈশ্বর ভালোবাসাকে বিপুল বলে বর্ণনা করার উদ্দেশ্য মানুষকে এর প্রসার এবং এর অস্তিত্বের সত্যতাকে হৃদয়ঙ্গম ও উপলব্ধি করতে সহায়তা করা। এর আরেকটা লক্ষ্য হল যে, মানুষ যাতে “সৃষ্টিকর্তা” শব্দটির প্রকৃত অর্থ আরো গভীরভাবে অন্তরঙ্গম করতে পারে, এবং যাতে তারা “সৃষ্টি” অভিধাটির সম্যক অর্থ বিষয়ে এক গভীরতর উপলব্ধি লাভ করতে পারে। “বিশাল” শব্দটি সাধারণত কীসের বর্ণনা দেয়? সাধারণত, এটি সমুদ্র বা মহাবিশ্বের বর্ণনা প্রসঙ্গে ব্যবহৃত হয়, যেমন: “বিশাল মহাবিশ্ব”, বা “বিশাল সমুদ্র”। মহাবিশ্বের প্রসারতা এবং নীরব গভীরতা মানুষের বোধশক্তির অতীত; এ হল এক বিষয়, যা মানুষের কল্পনাকে আকর্ষণ করে, যার প্রতি তারা প্রভূত বিস্ময়বোধ অনুভব করে। এর রহস্য ও নিগূঢ়তা দৃষ্টিগোচর হলেও ধরা-ছোঁয়ার অতীত। সমুদ্রের কথা ভাবলে তুমি তার প্রসারের কথা চিন্তা করো—সমুদ্রকে দেখে সীমাহীন মনে হয়, এবং তুমি এর রহস্যময়তা ও অপরিসীম ধারণক্ষমতা অনুভব করতে পারো। এই কারণেই ঈশ্বরের ভালোবাসাকে বর্ণনা করতে আমি “বিশাল” শব্দটি ব্যবহার করেছি, যাতে এই ভালোবাসার মহার্ঘতা অনুভব করতে মানুষের সুবিধা হয়, যাতে তারা আরো সহজে তাঁর ভালোবাসার প্রগাঢ় সৌন্দর্যের অনুভূতি পায়, এবং তারা উপলব্ধি করতে পারে যে, ঈশ্বরের ভালোবাসার ক্ষমতা অপার ও সুদূরপ্রসারী। এই শব্দটি আমি ব্যবহার করেছিলাম মানুষকে তাঁর ভালোবাসার পবিত্রতা এবং তাঁর ভালোবাসার মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের যে মর্যাদা ও অপ্রতিরোধ্যতা প্রকাশিত হয়, তা অনুভবে সহায়তার উদ্দেশ্যে। এখন কি তোমাদের মনে হচ্ছে যে ঈশ্বরের ভালোবাসার বর্ণনা প্রসঙ্গে “বিশাল” হল এক উপযুক্ত শব্দ? ঈশ্বরের ভালোবাসা কি, “বিপুল” ও “বিশাল”, এই শব্দদুটির উচ্চতাকে স্পর্শ করতে পারে? অবশ্যই পারে! মানুষের ভাষায়, এই দুটি শব্দই একমাত্র কিছুটা সুপ্রযুক্ত, এবং ঈশ্বরের ভালোবাসাকে বর্ণনা করার ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত ধারেকাছে আসে। তোমাদের কি তা-ই মনে হয় না? আমি যদি তোমাদের ঈশ্বরের ভালোবাসাকে বর্ণনা করতে বলি, তাহলে তোমরা কি এই শব্দদুটি ব্যবহার করবে? খুব সম্ভবত করবে না, কারণ ঈশ্বরের ভালোবাসার বিষয়ে তোমাদের উপলব্ধি ও মূল্যায়ন এক দ্বিমাত্রিক পরিপ্রেক্ষিতের পরিসরের ভিতর সীমাবদ্ধ, এবং তা ত্রিমাত্রিক ক্ষেত্রের উচ্চতায় উন্নীত হয় নি। তাই, আমি যদি তোমাদের ঈশ্বরের ভালোবাসাকে বর্ণনা করতে বলি, তখন তোমরা উপযুক্ত শব্দের অভাব বোধ করবে কিম্বা এমনকি হয়তো নির্বাক হয়ে যাবে। আজ আমি যে শব্দদুটির কথা বলেছি, সেগুলি হয়তো তোমাদের পক্ষে উপলব্ধি করা কঠিন, কিম্বা হয়তো তোমরা আমার সঙ্গে একমতই নও। তা থেকে শুধু এটাই প্রমাণিত হয় যে, ঈশ্বরের ভালোবাসার বিষয়ে তোমাদের মূল্যায়ন ও উপলব্ধি উপরিগত ও এক সংকীর্ণ পরিসরের মধ্যে সীমাবদ্ধ। আমি আগেও বলেছি যে ঈশ্বর স্বার্থশূন্য; তোমাদের এই “স্বার্থশূন্য” শব্দটি মনে পড়ছে? এমন কি সম্ভব, যে, ঈশ্বরের ভালোবাসাকে শুধুমাত্র স্বার্থশূন্য বলেই অভিহিত করা যায়? তা কি অতি সংকীর্ণ এক পরিসর নয়? এই বিষয়টার উপর তোমাদের আরো বেশি চিন্তাভাবনা করা উচিত, যাতে এর থেকে তোমরা কিছু অর্জন করতে পারো।
প্রথম অলৌকিক কার্যটি থেকে ঈশ্বরের স্বভাব ও তাঁর সারসত্য সম্বন্ধে যা আমরা জানলাম, তা উপরে বর্ণিত হল। যদিও এই গাথাটি মানুষ হাজার হাজার বছর ধরে পাঠ করে আসছে, যদিও এর রূপরেখাটি সরল, এবং মানুষকে তা এক অনলঙ্কৃত ঘটনা অবলোকনের সুযোগ দেয়, তবু এই সরল কাহিনীচিত্রণের মধ্য দিয়ে আমরা আরো মূল্যবান কিছু প্রত্যক্ষ করতে পারি, যা হল ঈশ্বরের স্বভাব এবং তাঁর যা আছে ও তিনি যা। তাঁর যা আছে ও তিনি যা, সেই বিষয়গুলিই স্বয়ং ঈশ্বরের প্রতিনিধিত্ব করে, এবং তা হল ঈশ্বরের নিজস্ব চিন্তাভাবনার এক অভিব্যক্তি। ঈশ্বর যখন তাঁর চিন্তাকে প্রকাশিত করেন, তখন তা তাঁর অন্তরের কণ্ঠস্বরের এক অভিব্যক্তি হয়ে দাঁড়ায়। তিনি আশা করেন যে, এমন মানুষ থাকবে, যে তাঁকে উপলব্ধি করতে, তাঁকে জানতে ও তাঁর ইচ্ছাকে প্রণিধান করতে পারবে, এবং যে তাঁর হৃদয়ের কণ্ঠস্বরকে শুনতে পাবে এবং তাঁর ইচ্ছা পূর্ণ করার জন্য সক্রিয় সহযোগিতায় সক্ষম হবে। এই যে কার্যগুলি প্রভু যীশু সাধন করেছিলেন, এগুলি ছিল ঈশ্বরের নিরুচ্চার অভিব্যক্তি।
এবার, নিম্নলিখিত অনুচ্ছেদটির দিকে লক্ষ্য করা যাক: লাসারের পুনরুত্থান ঈশ্বরকে মহিমান্বিত করলো।
এই অনুচ্ছেদটি পাঠ করার পর তোমাদের মনে কী প্রভাব পড়ল? প্রভু যীশুর সম্পাদিত এই অলৌকিক কর্মটির তাৎপর্য আগেরটির অপেক্ষা অনেক বৃহত্তর, কারণ কোনো অলৌকিক সংঘটনই এক মৃত মানুষকে কবর থেকে ফিরিয়ে আনার চেয়ে বেশি বিস্ময়কর হতে পারে না। সেই যুগে, প্রভু যীশু যে এই রকমের কিছু সম্পন্ন করেছিলেন, তা অতীব তাৎপর্যমণ্ডিত। ঈশ্বর যেহেতু দেহধারণ করেছিলেন, তাই মানুষ কেবল তাঁর বাহ্যিক চেহারা, তাঁর ব্যবহারিক দিক, ও তাঁর অকিঞ্চিৎকর দিকটি দেখতে পেতো। কিছু মানুষ যদিও তাঁর চরিত্রের কিছু বিষয় বা যেসকল বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী হিসাবে তিনি প্রতিভাত হতেন সেগুলির কিছুটা প্রত্যক্ষ ও উপলব্ধি করেছিল, কিন্তু প্রভু যীশু কোথা থেকে এসেছেন, তাঁর সারসত্যে তিনি প্রকৃতই কে ছিলেন, এবং আর কী কী কার্য সম্পন্ন করতে তিনি সত্যিই সমর্থ ছিলেন, এসব কেউই জানতো না। মানবজাতির কাছে এই সমস্তকিছুই অজ্ঞাত ছিল। ফলে অনেক মানুষ প্রভু যীশুর সম্পর্কে এই প্রশ্নগুলির উত্তর পাওয়ার এবং সত্যটি জানার জন্য প্রমাণ খুঁজতে চাইছিলো। তাঁর নিজের পরিচয়কে প্রতিপন্ন করতে ঈশ্বর কি কিছু করতে পারেন? ঈশ্বরের কাছে, এ ছিল অতি সহজ কাজ—ছেলেখেলা মাত্র। তাঁর পরিচয় ও সারসত্যকে প্রতিপন্ন করতে যেকোনো স্থানে, যেকোনো সময় তিনি কিছু একটা করতে পারতেন, কিন্তু ঈশ্বরের কার্য সাধনের নিজস্ব পদ্ধতি ছিল—পরিকল্পনা সহকারে, এবং ধাপে ধাপে। তিনি বাছবিচার না করেই কার্যাদি সম্পন্ন করতেন না, বরং মানুষকে দেখার অনুমোদন দেবে, প্রকৃতই এমন অর্থসম্পৃক্ত কোনো কার্য সম্পাদনের উদ্দেশ্যে তিনি সঠিক সময় ও সঠিক সুযোগের সন্ধান করেছিলেন। এই ভাবেই, তিনি তাঁর কর্তৃত্ব ও পরিচয় প্রতিপন্ন করেছিলেন। তাহলে, লাসারের পুনরুত্থান কি প্রভু যীশুর স্বরূপ প্রতিপন্ন করতে পেরেছিল? নিম্নলিখিত শাস্ত্রবাক্যটির দিকে নজর করা যাক: “তারপর যীশু উচ্চকন্ঠে ডেকে বললেন, লাসার, বেরিয়ে এস। লাসার বেরিয়ে এল…।” যখন প্রভু যীশু এমন করলেন, তখন তিনি শুধু একটিই কথা উচ্চারণ করেছিলেন: “লাসার, বেরিয়ে এস।” লাসার তখন তার কবর থেকে বেরিয়ে এলো—প্রভুর কয়েকটি বাক্য উচ্চারণেই এমনটা সম্ভব হয়েছিল। এই সময়ে, প্রভু যীশু কোনো পূজাবেদী প্রতিষ্ঠা করেননি, এবং তিনি অন্য কোনো কর্ম সম্পাদন করেননি। তিনি কেবলমাত্র এই একটিই বাক্য বলেছিলেন। একে কি আমরা অলৌকিক ঘটনা বলব নাকি আজ্ঞা বলব? নাকি এ কোনো প্রকারের মায়াবিদ্যা? বাহ্যিক ভাবে দেখলে, একে অলৌকিক ঘটনা বলা যেতে পারে, এবং, একে যদি তুমি আধুনিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখো, তবে অবশ্যই একে অলৌকিক ঘটনাই বলবে। তবে, একে মৃত ব্যক্তির আত্মাকে পুনরুজ্জীবিত করে তোলার জাদু হিসেবে অভিহিত করা যায় না, এবং তা কোনোভাবেই কোনোধরনের মায়াবিদ্যারও অংশ নয়। বরং এমন বলা সঠিক হবে যে, এই অলৌকিক ঘটনা আসলে সৃষ্টিকর্তার কর্তৃত্বের একটি সাধারণ, সামান্য প্রদর্শনমাত্র। এই হল সৃষ্টিকর্তার কর্তৃত্ব এবং ঈশ্বরের ক্ষমতা। মানুষের মৃত্যু ঘটানো, তার দেহ থেকে আত্মার অভিগমন ঘটানো, এবং সে মৃতস্থানে না অন্য কোন স্থানে যাবে তা নির্ধারণের কর্তৃত্ব ঈশ্বরের রয়েছে। কোন সময় মানুষের মৃত্যু হবে, এবং মৃত্যুর পর তার কোথায় গতি হবে—তা ঈশ্বরের দ্বারা নির্ধারিত হয়। তিনি যেকোনো স্থানে এবং কালে এই ধরনের সিদ্ধান্তগুলি গ্রহণ করতে পারেন, কোনো মানুষ, ঘটনাবলী, বস্তুসমূহ, স্থান বা ভূগোল তাঁর পথরোধ করতে পারে না। তিনি যা চান, তা-ই করতে পারেন, কারণ সকল বস্তু এবং প্রাণী তাঁরই নিয়মের অধীন, তাঁরই বাক্যে এবং কর্তৃত্বেই সকল বস্তুর সৃষ্টি, স্থিতি, এবং লয় ঘটে। তিনি মৃতব্যক্তিকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারেন, এবং এই কর্মও তিনি যে কোনও স্থানে ও যেকোনো কালে সম্পাদন করতে পারেন। এই কর্তৃত্ব কেবলমাত্র সৃষ্টিকর্তারই রয়েছে।
প্রভু যীশু যখন লাসারকে মৃতাবস্থা থেকে পুনরুজ্জীবিত করার মতো কার্যাদি সম্পন্ন করেছিলেন, তখন তাঁর লক্ষ্য ছিল মানুষের ও শয়তানের দেখার জন্য প্রমাণ দান করা, এবং মানুষ ও শয়তানকে জানতে দেওয়া যে, মানবজাতি সংক্রান্ত সকলকিছু, মানবজাতির জন্ম ও মৃত্যু, ঈশ্বরেরই দ্বারা নির্ধারিত হয়, এবং তিনি অবতাররূপ ধারণ হয়েছিলেন বটে, কিন্তু দৃষ্টিগ্রাহ্য ভৌত জগত, এবং মানবদৃষ্টির অগোচর আধ্যাত্মিক জগতেরও, কর্তৃত্বভার ছিল তাঁরই হাতে। এমনটি করার উদ্দেশ্য ছিল মানবজাতি ও শয়তানকে জানান দেওয়া যে, মানবজাতি বিষয়ক সকলকিছুর নিয়ন্ত্রণ শয়তানের হাতে নেই। তা ছিল ঈশ্বরের কর্তৃত্বের এক উদ্ঘাটন ও প্রতিপাদন, এবং একই সঙ্গে, তা ছিল সকলকিছুর উদ্দেশ্যে ঈশ্বরের এই বার্তাটি প্রেরণ করার একটি পদ্ধতি, যে, মানবজাতির জন্ম ও মৃত্যু ঈশ্বরেরই হাতে ন্যস্ত। প্রভু যীশুর দ্বারা লাসারের পুনরুজ্জীবন ছিল সৃষ্টিকর্তার মানবজাতিকে শিক্ষা ও নির্দেশ দানের অন্যতম পদ্ধতি। তা ছিল এক সুনির্দিষ্ট কর্মোদ্যোগ, যেখানে মানবজাতিকে নির্দেশদান ও সংস্থান সরবরাহের জন্য তিনি তাঁর ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের প্রয়োগ করেছিলেন। তিনিই যে সমস্ত কিছুর কর্তা, কোনো বাক্যব্যয় না করে, মানবজাতিকে এই সত্য দর্শনের সুযোগ করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে তা ছিল সৃষ্টিকর্তার ব্যবহৃত এক পন্থা। তা ছিল ব্যবহারিক কর্মের মাধ্যমে মানবজাতিকে তাঁর এই সত্য জ্ঞাপন করার এক পদ্ধতি, যে, তাঁর মধ্য দিয়ে ভিন্ন আর অন্য কোনো পরিত্রাণ নেই। মানবজাতিকে শিক্ষাদানের নিমিত্ত তাঁর ব্যবহৃত এই যে নিরুচ্চার পন্থা, তা চিরস্থায়ী ও অনপনেয়, মানুষের হৃদয়ে তা এমন এক অভিঘাত ও আলোকপ্রাপ্তি নিয়ে আসে, যা কখনও বিবর্ণ হয় না। লাসারের পুনরুত্থান ঈশ্বরকে মহিমান্বিত করেছিল—ঘটনাটি ঈশ্বরের প্রতিটি অনুগামীর মনে এক গভীর অভিঘাত সৃষ্টি করেছে। এই ঘটনাটি গভীরভাবে উপলব্ধি করে, এমন প্রতিটি মানুষের মনে তা এই বোধ, এই দর্শনকে দৃঢ়মূল করে, যে, একমাত্র ঈশ্বরই মানবজাতির জন্ম-মৃত্যুকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। যদিও ঈশ্বরের এই ধরনের প্রাধিকার রয়েছে, এবং যদিও লাসারের পুনরুজ্জীবনের মাধ্যমে মানবজাতির জন্ম-মৃত্যুর উপর তাঁর সার্বভৌমত্বের এক বার্তা তিনি প্রেরণ করেছিলেন, কিন্তু তা তাঁর প্রাথমিক কার্য ছিল না। ঈশ্বর কখনো অর্থহীন কিছু করেন না। তাঁর প্রত্যেকটি কার্যই অতীব মূল্যবান, এবং সেগুলি হল এক রত্নভাণ্ডারের অপ্রতিম রত্নরাজি। “কোনো এক ব্যক্তিকে কবর থেকে উত্থিত করা”-র কাজটিকে কোনোক্রমেই তিনি তাঁর কার্যের প্রাথমিক বা একমাত্র লক্ষ্য অথবা প্রকরণ করে তুলবেন না। ঈশ্বর এমন কোনো কার্য সম্পাদন করেন না, যা অর্থহীন। একটি একক ঘটনা হিসাবে লাসারের পুনরুত্থান ঈশ্বরের কর্তৃত্ব প্রদর্শন এবং প্রভু যীশুর স্বরূপ প্রতিপন্ন করার জন্য যথেষ্ট ছিল। এই কারণেই, প্রভু যীশু এজাতীয় অলৌকিক কর্মের পুনরাবৃত্তি ঘটান নি। ঈশ্বর সকলকিছু তাঁর নিজস্ব নীতি অনুসারে সম্পন্ন করেন। মানবীয় ভাষায় বলা যেতে পারে, শুধুমাত্র গুরুতর বিষয়েই ঈশ্বর মনোনিয়োগ করেন। অর্থাৎ, কার্যাদি সম্পাদনকালে, তিনি তাঁর কার্যের উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হন না। তিনি জানেন যে, এই পর্যায়ে তিনি কী নিষ্পন্ন করতে চান, কোন লক্ষ্য তিনি অর্জন করতে চান, এবং তিনি কঠোর নিয়মানুবর্তিতা সহযোগে তাঁর পরিকল্পনামাফিক কার্য সম্পাদন করবেন। কোনো ভ্রষ্ট মানুষের যদি এধরনের ক্ষমতা থাকতো, তাহলে সে কেবল চিন্তা করতো যে, কোন উপায়ে তার এই ক্ষমতার প্রকাশ ঘটানো যায়, যাতে অন্যেরা জানতে পারে সে কত দুর্ধর্ষ, যাতে তারা তার সামনে মাথা নত করে, যাতে সে তাদের নিয়ন্ত্রণ ও গ্রাস করতে পারে। এই দুষ্টতা শয়তানের থেকে আসে—একে অনাচার বলে। ঈশ্বরের এমন স্বভাব নেই, এবং তাঁর সারসত্যও এমনতর নয়। তাঁর কার্যাদি সম্পাদনের উদ্দেশ্য নিজেকে জাহির করা নয়, তা হল মানবজাতিকে আরো বেশি উদ্ঘাটন ও পথনির্দেশনা প্রদান করা, আর এই কারণেই, মানুষ বাইবেলে এজাতীয় ঘটনার দৃষ্টান্ত খুবই কম দেখতে পায়। এমনটা বলা হচ্ছে না যে প্রভু যীশুর ক্ষমতা সীমিত, বা তিনি এই জাতীয় কার্য সম্পাদনে অপারক। বিষয়টি নিছকই এই, যে, ঈশ্বর তা করতে চান নি, এর কারণ হল যে, প্রভু যীশু কর্তৃক লাসারের পুনরুজ্জীবনের অত্যন্ত ব্যবহারিক তাৎপর্য ছিল, এবং, এর কারণ এ-ও যে, অলৌকিক কর্ম সম্পাদন, মানুষকে মৃতাবস্থা থেকে ফিরিয়ে আনা, ঈশ্বরের অবতাররূপের প্রাথমিক কার্য ছিল না, তাঁর প্রাথমিক কার্য ছিল মানবজাতির মুক্তির কার্য। তাই, প্রভু যীশুর দ্বারা নিষ্পন্ন কার্যের মুখ্য অংশ ছিল মানুষকে শিক্ষাদান, তাদের সংস্থান সরবরাহ করা, এবং তাদের সহায়তা করা, এবং লাসারের পুনরুজ্জীবন জাতীয় ঘটনাগুলি প্রভু যীশু সম্পাদিত সেবাব্রতের নিছকই এক ক্ষুদ্র অংশ ছিল। অধিকন্তু, বলা যায় যে, যেহেতু “জাহির করা”-টা ঈশ্বরের সারসত্যের কোনো অঙ্গ নয়, সেহেতু যে আরো বেশি করে অলৌকিকতার প্রদর্শন না করে প্রভু যীশু ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের উপর সংযম আরোপ করছিলেন, এমন নয়, এমনটাও নয় যে, পারিপার্শ্বিক সীমাবদ্ধতার কারণে তিনি তা করেন নি, এবং তাঁর ক্ষমতার অভাবের কারণে যে তিনি তা করেন নি, এমন তো অবশ্যই নয়।
লাসারকে মৃতাবস্থা থেকে ফিরিয়ে আনার সময় প্রভু যীশু কেবল এই সামান্য কয়টি শব্দ ব্যবহার করেছিলেন: “লাসার, বেরিয়ে এস।” এছাড়া তিনি আর কিছুই বলেন নি। তাহলে, এই শব্দগুলি কী প্রতিপন্ন করে? শব্দগুলি দেখায় যে, মৃত ব্যক্তিকে পুনর্জীবন দান সহ যেকোনো কাজ ঈশ্বর বাক্যোচ্চারণের মাধ্যমে সম্পন্ন করতে পারেন। ঈশ্বর যখন সকলকিছু সৃষ্টি করেছিলেন, যখন তিনি এই বিশ্বের সৃজন ঘটিয়েছিলেন, তিনি তা সম্পন্ন করেছিলেন বাক্যের মাধ্যমেই—ওষ্ঠোচ্চারিত নির্দেশের মাধ্যমে, কর্তৃত্বব্যঞ্জক বাক্যের দ্বারাই, এবং এইভাবে, সকলকিছুর সৃজন ঘটেছিল, এবং এভাবেই, তা সুসম্পন্ন হয়েছিল। প্রভু যীশু কথিত এই শব্দকটি হুবহু আকাশ ও পৃথিবী এবং সমস্ত কিছুর সৃষ্টিকালে ঈশ্বরের উচ্চারিত শব্দসমূহের অনুরূপ ছিল; একই ভাবে, শব্দগুলির মধ্যে ঈশ্বরের কর্তৃত্ব ও সৃষ্টিকর্তার ক্ষমতা নিহিত ছিল। ঈশ্বরের মুখনিঃসৃত বাক্যের কারণেই সকল বস্তু গঠিত হয়ে নিজ নিজ অবস্থান ধরে রেখেছিল, এবং একই ভাবে, প্রভু যীশুর মুখনিঃসৃত বাক্যের দরুনই লাসার তার কবর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়েছিল। এ ছিল ঈশ্বরের প্রাধিকার, যা তাঁর অবতাররূপ দেহের মাধ্যমে প্রদর্শিত ও বাস্তবায়িত হয়েছিল। এহেন কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার অধিকারী হলেন সৃষ্টিকর্তা, এবং মনুষ্যপুত্র, যাঁর মধ্যে সৃষ্টিকর্তা বাস্তবায়িত হয়েছিলেন। লাসারকে মৃতাবস্থা থেকে ফিরিয়ে এনে ঈশ্বর মানবজাতিকে এই উপলব্ধিটির বিষয়ে শিক্ষা প্রদান করেছিলেন। এবার এইখানেই আমরা এই প্রসঙ্গটির আলোচনা সমাপ্ত করবো।
—বাক্য, খণ্ড ২, ঈশ্বরকে জানার প্রসঙ্গে, ঈশ্বরের কর্ম, ঈশ্বরের স্বভাব এবং স্বয়ং ঈশ্বর ৩