শয়তান আরো একবার ইয়োবকে প্রলুব্ধ করে (ইয়োবের সারা শরীর জুড়ে যন্ত্রণাময় ফোঁড়া দেখা দিল) (পর্ব ১)
১. ঈশ্বরের কথিত বাক্যসমূহ
ইয়োবে ২:৩ এবং যিহোবা শয়তানকে বললেন, তুমি কি আমার সেবক ইয়োবের কথা বিবেচনা করেছ, তার মত লোক পৃথিবীতে কেউ নেই, যে নিখুঁত এবং ন্যায়পরায়ণ, যে ঈশ্বরে ভয় পায় ও মন্দ পথ পরিত্যাগ করে? যদিও তুমি আমাকে তার বিরুদ্ধে চালিত করেছ যাতে অকারণে তার ক্ষতি করতে পারো, কিন্তু তবুও সে তার সততায় অবিচল রয়েছে।
ইয়োবে ২:৬ তখন যিহোবা শয়তানকে বললেন, দেখো, সে এখন তোমার হাতে, কিন্তু তার প্রাণ যেন রক্ষা পায়।
২. শয়তান যা বলেছিল
ইয়োবে ২:৪-৫ শয়তান তখন যিহোবাকে উত্তর দিল, মানুষ নিজের চামড়া বাঁচাতে সবকিছু করতে পারে, হ্যাঁ, মানুষের যা আছে সেই সবই সে তার প্রাণ বাঁচানোর জন্য দিয়ে দিতে পারে। কিন্তু এখন একবার তার রক্তমাংসের শরীরে আঘাত করে দেখুন, সে আপনার মুখের উপর আপনাকে অভিসম্পাত করবে।
৩. ইয়োব যেভাবে পরীক্ষার মোকাবিলা করল
ইয়োবে ২:৯-১০ ইয়োবের স্ত্রী তখন তাঁকে বললেন, এখনও তুমি তোমার বিশ্বাস আঁকড়ে ধরে আছ? এর চেয়ে বরং ঈশ্বরকে ধিক্কার দিয়ে মৃত্যুবরণ কর। ইয়োব তাঁকে বললেন, তুমি মূর্খের মত কথা বলছ, ঈশ্বরের হাত থেকে আমরা কি শুধু মঙ্গলই গ্রহণ করব? অমঙ্গল কিছুই গ্রহণ করব না? এতসব দুর্বিপাকের যন্ত্রণার মধ্যেও ইয়োব ঈশ্বরের বিরুদ্ধে কোন কথা বললেন না, নিন্দা করলেন না।
ইয়োবে ৩:৩-৪ যেদিন আমি জন্মগ্রহণ করেছিলাম অভিশপ্ত হোক সেই দিন, যে রাতে আমি এসেছিলাম মাতৃজঠরে, সেই রাতও হোক অভিশপ্ত। সেই দিনটি হোক অন্ধকারে আচ্ছন্ন, ঈশ্বর যেন সেই দিনটি আর স্মরণ না করেন, আর যেন কখনও আলোকিত না হয় সেই দিন।
ঈশ্বরের পথের প্রতি ইয়োবের ভালোবাসা বাকি সমস্তকিছুকে অতিক্রম করে গিয়েছিল
শয়তান ও ঈশ্বরের মধ্যে যে কথোপকথন হয়েছিল, তা শাস্ত্রে নথিভুক্ত আছে: “এবং যিহোবা শয়তানকে বললেন, তুমি কি আমার সেবক ইয়োবের কথা বিবেচনা করেছ, তার মত লোক পৃথিবীতে কেউ নেই, যে নিখুঁত এবং ন্যায়পরায়ণ, যে ঈশ্বরে ভয় পায় ও মন্দ পথ পরিত্যাগ করে? যদিও তুমি আমাকে তার বিরুদ্ধে চালিত করেছ যাতে অকারণে তার ক্ষতি করতে পারো, কিন্তু তবুও সে তার সততায় অবিচল রয়েছে” (ইয়োবে ২:৩)। এই কথোপকথনে, ঈশ্বর শয়তানের কাছে একই প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করেন। প্রথম পরীক্ষার সময় ইয়োব যা প্রদর্শন করেছিল ও যাপন করেছিল, এই প্রশ্নের মাধ্যমে আমরা সে সম্পর্কে যিহোবা ঈশ্বরের ইতিবাচক মূল্যায়ন দেখতে পাই, এবং শয়তানের প্রলোভনের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার আগে ঈশ্বর ইয়োবের যে মূল্যায়ন করেছিলেন, তার থেকে এই মূল্যায়ন অভিন্ন। এর অর্থ হল, ইয়োবের ওপর প্রলোভন নেমে আসার আগে, ঈশ্বরের দৃষ্টিতে সে ছিল নিখুঁত, আর তাই ঈশ্বর তাকে ও তার পরিবারকে রক্ষা করেছিলেন, এবং তাকে আশীর্বাদ করেছিলেন; ঈশ্বরের দৃষ্টিতে সে আশীর্বাদ পাওয়ার যোগ্য ছিল। এই প্রলোভনের পরে, নিজের সম্পত্তি ও সন্তানদের হারিয়ে ফেলেও ইয়োব নিজের মুখে পাপবাক্য উচ্চারণ করেনি, বরং যিহোবার নামের গুণগান চালিয়ে গিয়েছিল। সে বাস্তবে যে আচরণ করেছিল সেজন্য ঈশ্বর তার প্রশংসা করেছিলেন, এবং তার জন্য ঈশ্বর তাকে পূর্ণ নম্বর দিয়েছিলেন। কারণ ইয়োবের দৃষ্টিতে, তার সন্তান বা তার সম্পত্তি তাকে ঈশ্বরকে পরিত্যাগ করানোর পক্ষে যথেষ্ট ছিল না। অন্যভাবে বলা যায়, তার হৃদয়ে ঈশ্বরের যে স্থান তা তার সন্তানদের দ্বারা বা যেকোনো পরিমাণ সম্পত্তির দ্বারাই প্রতিস্থাপিত হতে পারতো না। প্রথম প্রলোভনের সময় ইয়োব ঈশ্বরকে দেখিয়েছিল যে ঈশ্বরের প্রতি তার ভালোবাসা, এবং ঈশ্বরে ভীতির পথ ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগের পথের প্রতি তার প্রেম, বাকি সমস্তকিছুকে ছাপিয়ে গেছে। শুধু এটুকুই যে এই পরীক্ষা থেকে ইয়োব যিহোবা ঈশ্বরের কাছ থেকে পুরস্কার লাভ করার অভিজ্ঞতা লাভ করেছিল, এবং তাঁর দ্বারা সম্পত্তি ও সন্তানদের কেড়ে নেওয়ার অভিজ্ঞতাও লাভ করেছিল।
ইয়োবের কাছে, এটা ছিল এক প্রকৃত অভিজ্ঞতা যা তার আত্মাকে পরিশুদ্ধ করেছিল; এটা ছিল জীবনের একটা বাপ্তিস্ম যা তার অস্তিত্বকে পরিপূর্ণ করেছিল, এবং এছাড়াও, এটা ছিল একটা জমকালো ভোজের সমান, যেখানে তার ঈশ্বরের প্রতি আনুগত্য ও তার ঈশ্বর-ভীতি পরীক্ষিত হয়েছিল। এই প্রলোভন ইয়োবকে ধনী ব্যক্তি থেকে কপর্দকশূন্য ব্যক্তিতে রূপান্তরিত করেছিল, আর এই প্রলোভন তাকে মানবজাতির প্রতি শয়তানের নিপীড়নের অভিজ্ঞতা লাভ করতেও দিয়েছিল। চরম দারিদ্রও ইয়োবকে দিয়ে শয়তানকে ঘৃণা করাতে পারেনি; বরং শয়তানের জঘন্য কাজে সে প্রত্যক্ষ করেছিল শয়তানের কদর্যতা ও ঘৃণ্যতা, সেইসাথে প্রত্যক্ষ করেছিল ঈশ্বরের প্রতি শয়তানের শত্রুতা ও বিদ্রোহ, এবং এটাই তাকে আরও বেশি করে উৎসাহ দিয়েছিল সর্বদা ঈশ্বরে ভীতি ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগের পথে অটল থাকতে। সে শপথ করেছিল যে সে কখনও সম্পত্তি, সন্তান, বা আত্মীয়দের মতো বাহ্যিক কারণে ঈশ্বরকে পরিত্যাগ করবে না এবং ঈশ্বরের পথ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে না, অথবা কখনও শয়তান, সম্পত্তি, বা কোনো ব্যক্তির দাস হবে না; যিহোবা ঈশ্বর ছাড়া কেউই তার প্রভু বা তার ঈশ্বর হতে পারবে না। এমনই ছিল ইয়োবের আকাঙ্ক্ষা। অন্যদিকে, ইয়োব এই প্রলোভন থেকে কিছু অর্জনও করেছিল: ঈশ্বর প্রদত্ত পরীক্ষায় সে প্রচুর সম্পদ অর্জন করেছিল।
ইয়োবের জীবনের গত কয়েক দশক সময়কালে, সে যিহোবার কাজ প্রত্যক্ষ করেছিল এবং নিজের জন্য তাঁর আশীর্বাদ লাভ করেছিল। এই আশীর্বাদ পেয়ে সে চরম অস্বস্তি ও ঋণী বোধ করেছিল, কারণ তার বিশ্বাস ছিল সে ঈশ্বরের জন্য কিছুই করেনি, তা সত্ত্বেও এত আশীর্বাদ লাভ করেছে এবং এত অনুগ্রহ উপভোগ করেছে। এই কারণে সে প্রায়শই মনে মনে প্রার্থনা করত, আশা করত যে সে ঈশ্বরকে প্রতিদান দিতে পারবে, আশা করত যে সে ঈশ্বরের কাজ ও মহানুভবতার সাক্ষ্য দেওয়ার সুযোগ পাবে, এবং আশা করত যে ঈশ্বর তার আনুগত্যের পরীক্ষা নেবেন, এবং এছাড়াও, যতক্ষণ না তার বিশ্বাস ও আনুগত্য ঈশ্বরের অনুমোদন লাভ করছে, ততক্ষণ যেন তার বিশ্বাস পরিশুদ্ধ হতে পারে। তাপরে, যখন ইয়োব পরীক্ষার সম্মুখীন হল, সে বিশ্বাস করেছিল যে ঈশ্বর তার প্রার্থনা শুনেছেন। ইয়োব এই সুযোগকে সমস্তকিছুর চেয়ে বেশি করে লালন করেছিল, আর তাই এটাকে হালকাভাবে নেওয়ার সাহস করেনি, কারণ এর মাধ্যমে তার আজীবনের ইচ্ছা বাস্তবায়িত হতে পারে। এই সুযোগ আসার অর্থ ছিল, তার আনুগত্য এবং ঈশ্বর ভীতির পরীক্ষা নেওয়া হতে পারে, এবং তা পরিশুদ্ধ করে তোলা যেতে পারে। এছাড়াও, এর অর্থ ছিল যে ইয়োবের কাছে ঈশ্বরের অনুমোদন পাওয়ার সুযোগ এসেছে, যেটা তাকে ঈশ্বরের আরো ঘনিষ্ঠ করে তুলবে। পরীক্ষা চলাকালীন, এইরকম বিশ্বাস ও সাধনা তাকে আরো নিখুঁত হয়ে ওঠার সুযোগ দিয়েছিল, এবং ঈশ্বরের ইচ্ছার বৃহত্তর উপলব্ধি অর্জনের সুযোগ দিয়েছিল। এছাড়াও ঈশ্বরের আশীর্বাদ ও অনুগ্রহ লাভ করার কারণে ইয়োব আরো কৃতজ্ঞ হয়ে উঠেছিল, নিজের অন্তরে সে ঈশ্বরের কর্মের প্রতি আরো স্তুতি জ্ঞাপন করেছিল, সে ঈশ্বরের প্রতি আরো ভীত ও সশ্রদ্ধ হয়ে উঠেছিল, এবং আরো বেশি করে আকাঙ্ক্ষা করেছিল ঈশ্বরের মাধুর্য, মহানুভবতা, ও পবিত্রতা। সেই সময়ে, যদিও ঈশ্বরের দৃষ্টিতে ইয়োব তখনও এমন একজন মানুষ ছিল যে ঈশ্বরে ভীত ও মন্দকে পরিত্যাগ করে চলে, কিন্তু তার অভিজ্ঞতার দিক থেকে বিচার করলে, ইয়োবের বিশ্বাস ও জ্ঞান দ্রুতহারে অগ্রগতি লাভ করেছিল: তার বিশ্বাস বৃদ্ধি পেয়েছিল, তার আনুগত্য দৃঢ় ভিত্তি লাভ করেছিল, আর ঈশ্বরের প্রতি ভীতি আরও প্রবল হয়ে উঠেছিল। যদিও এই পরীক্ষা ইয়োবের আত্মা ও জীবনকে রূপান্তরিত করে দিয়েছিল, কিন্তু এই রূপান্তর ইয়োবকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি, অথবা তার কে মন্থর করতেও পারেনি। এই পরীক্ষা থেকে সে কী অর্জন করেছে সে কথা হিসাব করার সময়, এবং তার নিজের কী কী ঘাটতি আছে তা বিবেচনা করার সময়, সে নীরবে প্রার্থনা করেছে, অপেক্ষা করেছে তার উপর পরবর্তী পরীক্ষা নেমে আসার, কারণ সে আকাঙ্ক্ষা করেছিল তার বিশ্বাস, আনুগত্য ও ঈশ্বর ভীতি যেন ঈশ্বরের পরবর্তী পরীক্ষা চলাকালীন আরও উচ্চস্তরে উন্নীত হয়।
ঈশ্বর মানুষের অন্তর্নিহিত চিন্তাভাবনা, এবং তাদের সব কথা ও কাজকর্ম পর্যবেক্ষণ করেন। ইয়োবের চিন্তাভাবনা যিহোবা ঈশ্বরের কানেও পৌঁছে গিয়েছিল, আর ঈশ্বর তার প্রার্থনা শুনেছিলেন, এবং এইভাবেই প্রত্যাশিতভাবে ঈশ্বরের পরবর্তী পরীক্ষা ইয়োবের উপর নেমে এসেছিল।
চরম যন্ত্রণাভোগের মধ্যেই ইয়োব মানবজাতির প্রতি ঈশ্বরের যত্নকে প্রকৃতভাবে উপলব্ধি করেছিল
যিহোবা ঈশ্বর শয়তানকে প্রশ্নগুলো করার পর, শয়তান গোপনে খুশি হয়েছিল। কারণ শয়তান জানত যে সে আরো একবার সেই মানুষটার উপর আক্রমণ করার অনুমতি পেতে চলেছে যে ঈশ্বরের দৃষ্টিতে নিখুঁত—শয়তানের কাছে এটা একটা বিরল সুযোগ। শয়তান এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ইয়োবের দৃঢ় প্রত্যয়ের ভিত্তি সম্পূর্ণ ধ্বংস করতে চেয়েছিল, ঈশ্বরের প্রতি তার আস্থা বিনষ্ট করতে চেয়েছিল, যাতে সে আর ঈশ্বরে ভীত না হয় অথবা যিহোবার নামের বন্দনা না করে। এটা শয়তানকে একটা সুযোগ করে দিত: স্থান-কাল নির্বিশেষে, সে ইয়োবকে তার আদেশে চালিত একটা খেলার পুতুলে পরিণত করে দিত। শয়তান কোনোরকম চিহ্ন না রেখেই নিজের দুষ্ট উদ্দেশ্য আড়াল করেছিল, কিন্তু নিজের মন্দ প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে নি। শাস্ত্রে লিপিবদ্ধ যিহোবা ঈশ্বরের কথার উত্তরে এই সত্যের ইঙ্গিত পাওয়া যায়: “শয়তান তখন যিহোবাকে উত্তর দিল, মানুষ নিজের চামড়া বাঁচাতে সবকিছু করতে পারে, হ্যাঁ, মানুষের যা আছে সেই সবই সে তার প্রাণ বাঁচানোর জন্য দিয়ে দিতে পারে। কিন্তু এখন একবার তার রক্তমাংসের শরীরে আঘাত করে দেখুন, সে আপনার মুখের উপর আপনাকে অভিসম্পাত করবে” (ইয়োবে ২:৪-৫)। ঈশ্বর ও শয়তানের এই কথোপকথন থেকে শয়তানের বিদ্বেষ সম্পর্কে প্রয়োজনীয় ধারণা ও জ্ঞান লাভ না করতে পারা অসম্ভব। শয়তানের এই সমস্ত বিভ্রান্তিকর কথা শোনার পরে, সত্যকে ভালোবাসে এবং মন্দকে ঘৃণা করে এমন সকল ব্যক্তি নিঃসন্দেহে শয়তানের হীনতা ও নির্লজ্জতার প্রতি তীব্র ঘৃণা পোষণ করবে, তারা শয়তানের এই বিভ্রান্তিকর আচরণে আতঙ্কিত ও বিরক্ত বোধ করবে, এবং একই সাথে ইয়োবের জন্য গভীর প্রার্থনা ও আন্তরিক কামনা করবে, প্রার্থনা করবে যে এই ন্যায়নিষ্ঠ ব্যক্তি যেন ত্রুটিহীনতা অর্জন করতে পারে, কামনা করবে এই ঈশ্বরে ভীত ও মন্দকর্ম পরিত্যাগকারী ব্যক্তি যেন সর্বদাই শয়তানের প্রলোভন জয় করতে পারে, এবং ঈশ্বরের পথনির্দেশ ও আশীর্বাদের মাঝে আলোর মধ্যে জীবনযাপনে সক্ষম হয়; এবং একইভাবে, এমন মানুষেরা এটাও আশা করবে যে ইয়োবের ন্যায়পরায়ণ কার্যকলাপ যেন চিরকাল তাদের সকলকে উদ্দীপনা ও উৎসাহ জোগায়, যারা ঈশ্বরে ভীতির ও মন্দকর্ম পরিত্যাগের পথের সাধনা করে। যদিও শয়তানের বিদ্বেষপূর্ণ উদ্দেশ্য এই ঘোষণার মধ্যেই দেখতে পাওয়া যায়, তবুও ঈশ্বর সানন্দে শয়তানের “অনুরোধে” সম্মতি দিয়েছিলেন—কিন্তু সেইসাথে তিনি একটা শর্তও আরোপ করেছিলেন: “সে এখন তোমার হাতে, কিন্তু তার প্রাণ যেন রক্ষা পায়” (ইয়োবে ২:৬)। যেহেতু এইবারে শয়তান ইয়োবের রক্তমাংসের শরীরের ক্ষতি করার জন্য তার হস্ত প্রসারিত করার অনুমতি চেয়েছিল, তাই ঈশ্বর বলেছিলেন, “কিন্তু তার প্রাণ যেন রক্ষা পায়”। এই কথাগুলোর অর্থ হল, ঈশ্বর ইয়োবের দেহ শয়তানের হাতে তুলে দিয়েছিলেন, কিন্তু তার প্রাণের দায়িত্ব ঈশ্বরের উপরেই ন্যস্ত ছিল। শয়তান ইয়োবের প্রাণ হরণে সক্ষম না হলেও, এটা বাদে যেকোনো উপায় বা পদ্ধতি সে ইয়োবের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করতে পারত।
ঈশ্বরের অনুমতি লাভের পরে, শয়তান ইয়োবের দিকে ধাবিত হল ও তার দেহের চামড়ায় যন্ত্রণা দেওয়ার উদ্দেশ্যে হাত বাড়াল, তার সারা শরীর যন্ত্রণাময় ফোঁড়ায় ভরে দিল, এবং ইয়োব তার চামড়ায় ভীষণ যন্ত্রণা অনুভব করল। ইয়োব যিহোবা ঈশ্বরের বিস্ময়করতা ও পবিত্রতার বন্দনা করল, আর তা শয়তানের দুঃসাহস আরও ভীষণরকম বাড়িয়ে তুলল। যেহেতু শয়তান মানুষের দেহে নিপীড়নের আনন্দ অনুভব করেছিল, তাই সে তার হাত বাড়িয়ে ইয়োবের দেহে আঁচড়ে দিয়েছিল, যার ফলে তার যন্ত্রণাদায়ক ফোঁড়াগুলোতে পচন ধরে গিয়েছিল। ইয়োব সঙ্গে সঙ্গেই নিজের দেহে অকল্পনীয় যন্ত্রণা ও পীড়ন অনুভব করল, সে নিজের পা থেকে মাথা পর্যন্ত ঘষতে শুরু করল, যেন তার আত্মার উপর যে আঘাত করা হয়েছে তা থেকে তার দেহের এই যন্ত্রণা কিছুটা স্বস্তি দেবে। সে উপলব্ধি করেছিল যে ঈশ্বর তার পাশে থেকে তাকে পর্যবেক্ষণ করছেন, এবং সে সমস্তরকম চেষ্টা করল নিজেকে ইস্পাতকঠিন রাখতে। সে আরো একবার ভূমিতে নতমস্তক হয়ে বলল: “তুমি মানুষের অন্তর প্রত্যক্ষ করো, তার দুর্দশা পর্যবেক্ষণ করো, তার দুর্বলতায় তুমি উদ্বিগ্ন কেন? যিহোবা ঈশ্বরের নাম ধন্য হোক।” শয়তান ইয়োবকে অসহনীয় যন্ত্রণা ভোগ করতে দেখল, কিন্তু তাকে যিহোবা ঈশ্বরের নাম পরিত্যাগ করতে দেখতে পেল না। তাই ইয়োবের অস্থিতে আঘাত করার জন্য সে দ্রুত নিজের হাত বাড়িয়ে দিল, তার প্রতিটা অঙ্গে আঘাত করতে মরিয়া হয়ে উঠল। মুহূর্তের মধ্যে, ইয়োব অভূতপূর্ব যন্ত্রণা অনুভব করল; যেন তার অস্থি থেকে মাংস ছিঁড়ে আলাদা করে ফেলা হয়েছে, এবং যেন তার অস্থিগুলোকে টুকরো টুকরো করে ভেঙে দেওয়া হচ্ছে। এই মর্মান্তিক যন্ত্রণা তাকে ভাবতে বাধ্য করল যে তার মরে যাওয়াই ভালো…। সে এই যন্ত্রণা সহ্য করার সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল…। সে চিৎকার করে কাঁদতে চেয়েছিল, ব্যথা কমানোর প্রয়াসে নিজের শরীরের চামড়া ছিঁড়তে চেয়েছিল—তবুও সে তার চিৎকারের কণ্ঠরোধ করেছিল, শরীরের চামড়া ছেঁড়া থেকে বিরত থেকেছিল, কারণ সে শয়তানকে তার দুর্বলতা দেখতে দিতে চায় নি। তাই ইয়োব আরও একবার নতজানু হল, কিন্তু এইবারে সে যিহোবা ঈশ্বরের উপস্থিতি অনুভব করল না। সে জানত যিহোবা ঈশ্বর প্রায়শই তার সামনে, পিছনে, এবং উভয় পাশেই উপস্থিত থাকতেন। তবুও এই যন্ত্রণার সময় ঈশ্বর তার দিকে একবারও তাকাননি; তিনি নিজের মুখমণ্ডল আবৃত করে আড়ালে ছিলেন, কারণ তাঁর মানুষ সৃষ্টি করার উদ্দেশ্য তাদের কষ্ট দেওয়া ছিল না। এই সময়ে, ইয়োব কাঁদছিল, এই শারীরিক কষ্ট সহ্য করার যথাসাধ্য চেষ্টা করছিল, কিন্তু এর মধ্যেও সে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দেওয়া থেকে নিজেকে আটকাতে পারেনি: “মানুষ প্রথম আঘাতেই লুটিয়ে পড়ে, সে দুর্বল ও শক্তিহীন, সে নবীন ও অজ্ঞ—তুমি তার প্রতি এত যত্নবান ও কোমল হতে চাও কেন? তুমি আমার ওপর আঘাত হানো, কিন্তু সেটা করতে গিয়ে নিজেও ব্যথিত হও। মানুষের কোন জিনিসটা তোমার যত্ন ও উদ্বেগের উপযুক্ত?” ইয়োবের প্রার্থনা ঈশ্বরের কানে পৌঁছেছিল, এবং তিনি নীরব ছিলেন, কোনো আওয়াজ না করে লক্ষ্য করে যাচ্ছিলেন…। নিজের জানা সমস্ত রকমের কৌশল প্রয়োগ করার পর শয়তান নীরবে বিদায় নিল, কিন্তু তাতেও ইয়োবের প্রতি ঈশ্বরের পরীক্ষা সমাপ্ত হয়নি। যেহেতু ইয়োবের মধ্যে ঈশ্বরের যে শক্তি প্রকাশিত হয়েছিল তা তখনও জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি, তাই শয়তানের পশ্চাদপসরণের মধ্যে দিয়ে ইয়োবের কাহিনী সমাপ্ত হয়নি। অন্যান্য চরিত্রগুলোর প্রবেশের সাথে সাথে, আরো দর্শনীয় দৃশ্যের অবতারণা হওয়া তখনও বাকি ছিল।
সমস্তকিছুতে ঈশ্বরের নামের স্তুতিই হল ইয়োবের ঈশ্বর ভীতি ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগের অপর একটা বহিঃপ্রকাশ
ইয়োব শয়তানের ধ্বংসসাধন ভোগ করেছিল, তবুও সে যিহোবা ঈশ্বরের নাম পরিত্যাগ করেনি। ইয়োবের স্ত্রীই ছিল প্রথম, যে এগিয়ে এসে ইয়োবকে আক্রমণ করেছিল, এমনভাবে শয়তানের ভূমিকা পালন করেছিল যা মানুষের চোখে দৃশ্যমান। মূল শাস্ত্রে এটার বিবরণ এইভাবে দেওয়া আছে: “ইয়োবের স্ত্রী তখন তাঁকে বললেন, এখনও তুমি তোমার বিশ্বাস আঁকড়ে ধরে আছ? এর চেয়ে বরং ঈশ্বরকে ধিক্কার দিয়ে মৃত্যুবরণ কর” (ইয়োবে ২:৯)। মানুষের ছদ্মবেশে শয়তান এই কথাগুলোই বলেছিল। এই কথাগুলো ছিল আক্রমণ, অভিযোগ, সেইসাথে প্রলোভন, প্ররোচনা এবং অপবাদমূলক। ইয়োবের উপর শারীরিক আক্রমণে ব্যর্থ হয়ে, শয়তান তারপর সরাসরি ইয়োবের সততায় আক্রমণ করেছিল, এটা ব্যবহার করতে চেয়েছিল যাতে ইয়োব নিজের সততা পরিত্যাগ করে, ঈশ্বরকে ত্যাগ করে এবং আর বেঁচে থাকতেই না চায়। একইভাবে, শয়তান এই ধরনের কথার প্রয়োগে ইয়োবকে প্রলোভিত করতেও চেয়েছিল: ইয়োব যদি যিহোবার নাম পরিত্যাগ করে, তাহলে তাকে এরকম যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে না; সে দেহের এই যন্ত্রণা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারবে। স্ত্রীর মুখে এই পরামর্শ শুনে ইয়োব তাকে এই বলে তিরস্কার করেছিল, “তুমি মূর্খের মত কথা বলছ, ঈশ্বরের হাত থেকে আমরা কি শুধু মঙ্গলই গ্রহণ করব? অমঙ্গল কিছুই গ্রহণ করব না?” (ইয়োবে ২:১০)। ইয়োব অনেক আগে থেকেই এই কথাগুলো জানত, কিন্তু সেগুলোর বিষয়ে তার জ্ঞান যে সত্যি, তা এইবারে প্রমাণিত হয়ে গিয়েছিল।
ইয়োবের স্ত্রী যখন তাকে ঈশ্বরকে অভিশাপ দিয়ে মৃত্যুবরণ করে নিতে বলেছিল, তখন সে বোঝাতে চেয়েছিল যে: “তোমার ঈশ্বর তোমার সাথে এমন আচরণ করছেন, তাহলে তুমি তাঁকে অভিশাপ দেবে না কেন? এখনও বেঁচে থেকে তুমি কী করছ? তোমার ঈশ্বর তোমার সাথে এত অন্যায় করেছেন, তবুও তুমি বলছ ‘যিহোবার নাম ধন্য হোক’। তুমি তাঁর নামের বন্দনা করছ, তা সত্ত্বেও তিনি তোমার ওপর বিপর্যয় কীভাবে আনতে পারেন? এখনই ঈশ্বরের নাম পরিত্যাগ করো, তাঁকে আর অনুসরণ কোরো না। তাহলে তোমার সব সমস্যা দূর হয়ে যাবে।” সেই মুহূর্তে, ঈশ্বর ইয়োবের মধ্যে যে সাক্ষ্য প্রত্যক্ষ করতে চেয়েছিলেন, তা সৃষ্ট হয়েছিল। কোনো সাধারণ মানুষ এমন সাক্ষ্য বহন করতে পারত না, অথবা আমরা বাইবেলের কোনো কাহিনীর মধ্যেও এমন ঘটনা পড়তে পাই না—কিন্তু ইয়োব এই কথাগুলো উচ্চারণের অনেক আগেই ঈশ্বর তা দেখে নিয়েছিলেন। ঈশ্বর এই সুযোগকে শুধু এইজন্য ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন যাতে ইয়োব সকলের কাছে প্রমাণ করতে পারে যে ঈশ্বর সঠিক ছিলেন। স্ত্রীর কাছ থেকে এমন পরামর্শ শুনে ইয়োব নিজের সততা ত্যাগ করেনি বা ঈশ্বরকে পরিত্যাগ করেনি, বরং সে-ও তার স্ত্রীকে বলেছিল: “ঈশ্বরের হাত থেকে আমরা কি শুধু মঙ্গলই গ্রহণ করব? অমঙ্গল কিছুই গ্রহণ করব না?” এই কথাগুলো কি খুব গুরুত্বপূর্ণ? এখানে, শুধুমাত্র একটা বিষয়ই এই কথাগুলোর গুরুত্ব প্রমাণ করতে পারে। এই কথাগুলোর গুরুত্ব হচ্ছে যে এগুলো ঈশ্বরের হৃদয়ে ঈশ্বরের দ্বারা অনুমোদিত, এগুলোই ঈশ্বর কামনা করেছিলেন, ঈশ্বর এগুলোই শুনতে চেয়েছিলেন, এবং এই ফলাফলই ঈশ্বর দেখতে চেয়েছিলেন; আর এই কথাগুলোই ছিল ইয়োবের সাক্ষ্যের গভীরতম নির্যাস। এর মাধ্যমেই ইয়োবের ত্রুটিহীনতা, ন্যায়পরায়ণতা, ঈশ্বর ভীতি ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগের মনোভাব প্রমাণিত হয়েছিল। ইয়োবের চমৎকারিত্ব এর মধ্যেই নিহিত ছিল যে যখন তাকে প্রলুব্ধ করা হয়েছিল, এমনকি তার গোটা শরীর ফোঁড়ায় আবৃত হয়ে গিয়েছিল, যখন সে এমন চরম যন্ত্রণা সহ্য করেছিল, যখন তার স্ত্রী ও পরিজনরা তাকে পরামর্শ দিয়েছিল, তখনও সে এরকম কথা উচ্চারণ করতে পেরেছিল। অন্য ভাবে বললে, তার অন্তরের বিশ্বাস ছিল যে যেরকম প্রলোভনই আসুক, অথবা কষ্ট বা যন্ত্রণা যত কঠিনই হোক, এমনকি যদি মৃত্যুও তার উপর নেমে আসে, সে ঈশ্বরকে ত্যাগ করবে না, অথবা ঈশ্বরে ভীতি ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগের পথ ছেড়ে যাবে না। তাহলে দেখছ, তার অন্তরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল ঈশ্বরের, তার হৃদয়ে শুধুমাত্র ঈশ্বরই ছিলেন। এই কারণেই আমরা শাস্ত্রে ইয়োবের সম্পর্কে এই রকম বিবরণ দেখতে পাই: এতসব দুর্বিপাকের যন্ত্রণার মধ্যেও ইয়োব ঈশ্বরের বিরুদ্ধে কোন কথা বললেন না, নিন্দা করলেন না। সে শুধু নিজের মুখেই পাপবাক্য উচ্চারণ করা থেকে বিরত ছিল তা নয়, বরং নিজের হৃদয়েও সে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করেনি। ঈশ্বরের সম্পর্কে সে কোনো আঘাতকারী শব্দ উচ্চারণ করেনি, তেমনই তাঁর বিরুদ্ধে কোনো পাপও করেনি। ঈশ্বরের স্তুতি শুধু তার মুখেই উচ্চারিত হয় নি, বরং হৃদয়েও সে ঈশ্বরের নামের বন্দনা করেছিল; তার মুখ ও হৃদয় ছিল অভিন্ন। ঈশ্বর এই প্রকৃত ইয়োবকেই প্রত্যক্ষ করেছিলেন, আর ঠিক এই কারণেই তিনি তাকে এত মূল্যবান মনে করেছিলেন।
—বাক্য, খণ্ড ২, ঈশ্বরকে জানার প্রসঙ্গে, ঈশ্বরের কর্ম, ঈশ্বরের স্বভাব এবং স্বয়ং ঈশ্বর ২