পঞ্চম সন্ধিক্ষণ: পরবর্তী প্রজন্ম
বিবাহের পর মানুষ পালন করে পরবর্তী প্রজন্মকে। কতজন এবং কী ধরণের সন্তান হবে তাতে মানুষের করণীয় কিছু নেই; এটিও সেই ব্যক্তির ভাগ্য-নির্ধারিত, স্রষ্টার দ্বারা পূর্বনির্দিষ্ট। এটি পঞ্চম সন্ধিক্ষণ যার মধ্য দিয়ে কোনো ব্যক্তিকে যেতে হয়।
কারো সন্তানের ভূমিকা পালন করার জন্য যদি কেউ জন্মগ্রহণ করে, তবে তার পিতামাতার ভূমিকা পালনের জন্যও কেউ পরবর্তী প্রজন্মকে লালন-পালন করে। ভূমিকার এই পরিবর্তন বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো মানুষের জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ের উপলব্ধি ঘটায়। এটি জীবনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে মানুষকে অভিজ্ঞতা প্রদান করে যার মাধ্যমে কোনো মানুষ স্রষ্টার সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে জানতে পারে, যা সর্বদা একইভাবে প্রণীত হয় এবং যার মাধ্যমে মানুষ এই সত্যের মুখোমুখি হয় যে স্রষ্টার পূর্বনির্ধারণকে কেউই অতিক্রম বা পরিবর্তন করতে পারে না।
১. সন্তানসন্ততি কেমন হবে তার উপর কারো নিয়ন্ত্রণ নেই
জন্ম, বড়ো হয়ে ওঠা, এবং বিবাহ সবই বিভিন্ন ধরনের এবং বিভিন্ন মাত্রায় হতাশা নিয়ে আসে। কিছু মানুষ নিজেদের পরিবার বা তাদের নিজেদের শারীরিক আকৃতি নিয়ে অসন্তুষ্ট; কেউ কেউ অপছন্দ করে তাদের পিতামাতাকে; যে পরিবেশে তারা বেড়ে উঠেছে তা নিয়ে কেউ কেউ বিরক্ত বা অভিযোগ করে। এবং এই সব হতাশার মধ্যে বেশিরভাগ মানুষের কাছে বিবাহ হল সবচেয়ে অসন্তোষজনক। জন্ম, পরিণত অবস্থা প্রাপ্তি বা বিবাহ নিয়ে কেউ যতই অসন্তুষ্ট হোক না কেন, যারাই এই বিষয়গুলির মধ্য দিয়ে গিয়েছে তারা সকলেই জানে যে, জন্মের স্থান ও সময়, শারীরিক সৌন্দর্য, পিতামাতার বা জীবনসঙ্গীর পরিচয় এসব কেউ নিজে নির্বাচন করতে পারে না, বরং এগুলোকে স্বর্গের ইচ্ছা হিসাবে সহজভাবে মেনে নিতে হয়। তারপরও যখন মানুষের পরবর্তী প্রজন্ম গড়ে তোলার সময় আসে, তখন তারা তাদের জীবনের প্রথমার্ধে বাস্তবায়িত করতে ব্যর্থ হওয়া সমস্ত বাসনা তাদের বংশধরদের মধ্যে প্রক্ষেপ করে, এই আশায় যে তাদের নিজেদের জীবনের প্রথমার্ধের সমস্ত হতাশা যেন তাদের সন্তানেরা পূরণ করে। তাই মানুষ নিজের সন্তানদের নিয়ে নানা ধরনের কল্পনায় বিভোর থাকেঃ কন্যারা যেন অনিন্দ্য সুন্দর হয়ে বেড়ে ওঠে, ছেলেরা হয় উজ্জ্বল ভদ্রলোক; মেয়েরা হবে সংস্কৃতিমনা ও প্রতিভাদীপ্ত এবং ছেলেরা হবে মেধাবী ছাত্র ও তারকা ক্রীড়াবিদ; মেয়েরা হবে সুভদ্র, গুণবতী ও বিচক্ষণ এবং ছেলেরা হবে বুদ্ধিমান, সক্ষম ও সংবেদনশীল। তারা আশা করে যে তাদের সন্তানরা, তারা মেয়ে হোক বা ছেলে, তাদের গুরুজনদের সম্মান করবে, তাদের পিতামাতার প্রতি যত্নশীল হবে, সবার প্রিয় ও প্রশংসিত হবে…। এই পর্বে, মানুষের জীবনে নবীন আশা সঞ্চারিত হয় এবং হৃদয়ে নতুন আবেগ জাগে। মানুষ জানে যে তারা এই জীবনে শক্তিহীন এবং আশাহীন, জনতার মাঝে অন্যতম হওয়ার আর কোনো সুযোগ বা আশা তাদের সামনে নেই এবং ভাগ্যকে মেনে নেওয়া ছাড়া তাদের আর কোন বিকল্প নেই। এবং তাই তারা তাদের সমস্ত আশা, তাদের অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা এবং আদর্শ পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরে, এই আশায় যে তাদের সন্তানরা যেন তাদের অপূর্ণ স্বপ্ন অর্জনে এবং তাদের আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়নে সহায়তা করতে পারে; তাদের কন্যা এবং পুত্ররা পরিবারের নাম উজ্জ্বল করে, বিশিষ্ট, ধনী বা বিখ্যাত হয়ে ওঠে। সংক্ষেপে, তারা তাদের সন্তানদের সৌভাগ্যশালী দেখতে চায়। মানুষের পরিকল্পনা এবং কল্পনা নিখুঁত; কিন্তু তারা কি জানে না যে তাদের সন্তানের সংখ্যা, অবয়ব, ক্ষমতা এবং আরও অনেক ব্যাপারই তাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নির্ধারিত হয় না, তাদের সন্তানদের ভাগ্য নির্ধারণের সামান্য ক্ষমতাও তাদের হাতে নেই? মানুষ নিজেরই ভাগ্য-বিধাতা নয়, তবুও তারা তরুণ প্রজন্মের ভাগ্য পরিবর্তনের আশা করে; নিজেদের ভাগ্য থেকে রক্ষা পেতেই তারা অক্ষম, তবুও তারা পুত্র-কন্যাদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণে সচেষ্ট হয়। তারা কি নিজেদের ক্ষমতায় অধিক আস্থাশীল নয়? এটা কি মানুষের মূর্খতা ও অজ্ঞতা নয়? সন্তানদের জন্য মানুষ যে কোন পর্যায়ে যেতে পারে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত, কোনো মানুষের পরিকল্পনা এবং আকাঙ্ক্ষা নির্ধারণ করতে পারে না যে তার কতজন সন্তান হবে বা সেই সন্তানরা কেমন হবে। দরিদ্র হয়েও কিছু মানুষ একাধিক সন্তানের জন্ম দেয়; আবার ধনী হওয়া সত্ত্বেও অনেক মানুষেরই কোনো সন্তান থাকে না। কেউ কেউ কন্যাসন্তান চায়, কিন্তু সেই ইচ্ছা পূরন হয় না; অনেকে পুত্র চাইলেও পুত্রসন্তানের জন্ম দিতে ব্যর্থ হয়। অনেকের কাছে সন্তান হলো আশীর্বাদ, আবার অনেকের কাছে তারা অভিশাপ। অনেক দম্পতি ধীশক্তিসম্পন্ন হলেও তাদের সন্তানরা হয় ধীর-মতি, অনেক পিতা-মাতা পরিশ্রমী এবং সৎ হলেও তাদের সন্তানরা হয় অলস। সদয় এবং ন্যায়পরায়ণ পিতামাতা হলেও তাদের সন্তানরা হয় ধূর্ত এবং দুশ্চরিত্র। শরীরে এবং মনে সুস্থ পিতা-মাতাও জন্ম দেয় প্রতিবন্ধী সন্তানের। অনেক পিতা মাতাই হয়তো খুব সাধারণ এবং অসফল, কিন্তু তাদের সন্তানরা চূড়ান্ত কৃতিত্ব অর্জন করে। কোনো কোনো বাবা-মা নিম্ন-মর্যাদাসম্পন্ন হলেও তাদের সন্তানেরা সাফল্যের শিখরে পৌঁছে যায়। …
২. পরবর্তী প্রজন্মকে পালনের পরে, ভাগ্য সম্পর্কে মানুষ এক নতুন উপলব্ধি অর্জন করে
ত্রিশের কাছাকাছি বয়সে বেশিরভাগ মানুষ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, জীবনের এই পর্বে ভাগ্য সম্পর্কে মানুষের কোন ধারণাই হয় না। কিন্তু মানুষ যখন সন্তান প্রতিপালন করতে শুরু করে এবং তাদের সন্তানেরা বেড়ে ওঠে, তারা নতুন প্রজন্মকেও আগের প্রজন্মের জীবন ও সমস্ত অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি করতে দেখে। এবং সন্তানদের মধ্যে নিজেদের অতীতের প্রতিফলন দেখে তারা উপলব্ধি করে যে তরুণ প্রজন্ম যে পথে হাঁটছে, তারাও একদিন সেই পথ অতিক্রম করেছিল, এবং এই পথ পূর্বপরিকল্পনা বা নির্বাচন করা যায় না। এই সত্যের মুখোমুখি হয়ে, তাদের কাছে স্বীকার করা ছাড়া কোন উপায় থাকে না যে প্রতিটি ব্যক্তির ভাগ্য পূর্বনির্ধারিত, এবং এই সত্য সম্যক উপলব্ধি না করেই, তারা ধীরে ধীরে তাদের ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষাগুলি বাতিল করে, এবং তাদের হৃদয়ের আবেগগুলি ক্ষণিক বিচ্ছুরণের পর মুছে যায়…। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ পথচিহ্নগুলিকে অতিক্রম করে জীবনের এই পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়া মানুষ জীবনের এক নতুন উপলব্ধি অর্জন করেছে, এক নতুন মনোভাব গ্রহণ করেছে। এই বয়সের কোনো মানুষ ভবিষ্যতের কাছ থেকে কতটাই বা আশা করতে পারে, আর কোন সম্ভাবনার প্রত্যাশাতেই বা তারা অপেক্ষা করবে? কোন পঞ্চাশ বছর বয়সী মহিলা এখনও প্রিন্স চার্মিং-এর স্বপ্ন দেখে? কোন পঞ্চাশ বছর বয়সী পুরুষ এখনও তার স্নো হোয়াইট খোঁজে? কোন মধ্যবয়সী মহিলা এখনও কুৎসিত হংস-শাবক থেকে রাজহাঁসে পরিণত হওয়ার আশা করে? বেশিরভাগ বয়স্ক পুরুষদের কি আর যুবকদের মতো একই কর্ম-প্রচেষ্টা থাকে? সব মিলিয়ে, পুরুষ বা মহিলা নির্বিশেষে, যে কেউ এই বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকে তার বিবাহ, পরিবার এবং সন্তানদের প্রতি তুলনামূলকভাবে যুক্তিযুক্ত, ব্যবহারিক মনোভাব নিয়ে। এই জাতীয় ব্যক্তির কাছে মূলত কোনও বিকল্প নেই, ভাগ্যকে প্রশ্ন করার কোনও তাগিদ নেই। মানুষের অভিজ্ঞতা সাপেক্ষে, এই বয়সে পৌঁছানোর সাথে সাথে স্বাভাবিকভাবেই কোনো মানুষ নির্দিষ্ট এক মনোভাব গড়ে তোলে: “ভাগ্যকে মেনে নিতে হবে; সন্তানদের নিজস্ব ভাগ্য আছে; মানুষের ভাগ্য দৈব—নির্ধারিত।” বেশিরভাগ মানুষ যারা এই সত্য উপলব্ধি করে না, তারা এই পৃথিবীর সমস্ত অস্থিরতা, হতাশা এবং কষ্ট সহ্য করার পরে, মানব জীবন সম্পর্কে তাদের অন্তর্দৃষ্টি দুটি সংক্ষিপ্ত শব্দে প্রকাশ করবে: “এটাই ভাগ্য!” যদিও এই বাক্যাংশটি মানুষের ভাগ্য সম্পর্কে জাগতিক মানুষের উপলব্ধি এবং তারা যে উপসংহারে এসেছে তা গ্রথিত করে, এবং যদিও তা মানবতার অসহায়ত্বকে প্রকাশ করে, এবং এটিকে সূক্ষ্ম এবং নির্ভুল বিবেচনা করা যায়, তবুও এটি স্রষ্টার সার্বভৌমত্ব উপলব্ধির থেকে অনেক দূরের কথা, এবং কোনোভাবেই সৃষ্টিকর্তার কর্তৃত্ব সম্পর্কে জ্ঞানের এটি কোন বিকল্প নয়।
৩. ভাগ্যের প্রতি বিশ্বাস স্রষ্টার সার্বভৌমত্বের জ্ঞানের বিকল্প নয়
এত বছর ধরে ঈশ্বরকে অনুসরণ করার পর, ভাগ্য সম্পর্কে তোমাদের জ্ঞান এবং সাধারণ পার্থিব মানুষের ধারণার মধ্যে কি কোনো মূলগত পার্থক্য খুঁজে পাও? স্রষ্টার পূর্বনির্ধারণ কি সত্যই উপলব্ধি করতে পেরেছ এবং সত্যই অবগত হয়েছো স্রষ্টার সার্বভৌমত্বে? “এটাই ভাগ্য” এই বাক্যাংশটির অন্তর্নিহিত এবং গভীরভাবে অনুভূত উপলব্ধি রয়েছে কিছু মানুষের, তবুও তারা ঈশ্বরের সার্বভৌমত্বে সামান্যতম বিশ্বাসও করে না; তারা বিশ্বাস করে না যে মানুষের ভাগ্য ঈশ্বর আয়োজিত এবং তাঁর দ্বারা সমন্বিত, এবং তারা ঈশ্বরের সার্বভৌমত্বের কাছে নতি স্বীকার করতে চায় না। এই ধরনের মানুষ যেন সাগরে ভাসমান, ঢেউয়ে আন্দোলিত, স্রোতের সাথে ভেসে যায়, নিষ্ক্রিয়ভাবে অপেক্ষা করা এবং ভাগ্যের কাছে নিজেকে ছেড়ে দেওয়া ছাড়া তারা নিরুপায়। তবুও তারা অনুভব করে না যে মানুষের ভাগ্য ঈশ্বরের সার্বভৌমত্বের অধীন; তারা স্বউদ্যোগে ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব জানতে এবং এর মাধ্যমে ঈশ্বরের কর্তৃত্ব সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে পারে না, ঈশ্বরের সমন্বয়-সাধন এবং ব্যবস্থার কাছে নতিস্বীকার করতে পারে না, দুর্ভাগ্যকে প্রতিরোধ করতে পারে না এবং ঈশ্বরের যত্ন, সুরক্ষা ও নির্দেশনায় জীবনযাপন করতে পারে না। অন্যভাবে বলা যায়, ভাগ্যকে মেনে নেওয়া আর স্রষ্টার সার্বভৌমত্বের কাছে বশ্যতা স্বীকার করাদুটো এক ব্যাপার নয়; ভাগ্যে বিশ্বাসের অর্থ এই নয় যে কোনো ব্যক্তি সৃষ্টিকর্তার সার্বভৌমত্বকে স্বীকার করে, অনুভব করে এবং জানে; ভাগ্যের প্রতি বিশ্বাস হল এর সত্যতার এবং বহিরঙ্গের প্রকাশের স্বীকৃতি মাত্র। স্রষ্টা কীভাবে মানবতার ভাগ্য শাসন করেন তা জানার থেকে এই উপলব্ধি ভিন্ন, প্রতিটি অস্তিত্বের ভাগ্যের উপর স্রষ্টার কর্তৃত্বের উৎসকে স্বীকৃতি দেওয়া থেকে এটি পৃথক এবং অবশ্যই স্রষ্টার সমন্বয়-সাধন এবং তাঁর মানবতার ভাগ্য-আয়োজনের সামনে সমর্পিত হওয়া থেকে বহু দূরের কথা। যদি কোনো ব্যক্তি কেবল ভাগ্যকে বিশ্বাস করে—এমনকি যদি সে এটি সম্পর্কে গভীরভাবে অনুভবও করে—কিন্তু এর দ্বারা মানবতার ভাগ্যের উপর স্রষ্টার সার্বভৌমত্বকে জানতে এবং স্বীকৃতি দিতে, এর বশ্যতা স্বীকার করতে এবং গ্রহণ করতে সক্ষম না হয়, তবে তাদের জীবনে কেবল দুঃখই থাকবে, ব্যর্থতা ও শূন্যতায় অতিবাহিত এক জীবন; তারা এখনও স্রষ্টার আধিপত্যের অধীনে আসতে, সর্বার্থে এক সৃষ্ট-মানব হতে এবং সৃষ্টিকর্তার অনুমোদন উপভোগ করতে অক্ষম হবে। একজন ব্যক্তি যে সদর্থে স্রষ্টার সার্বভৌমত্ব জানে এবং অনুভব করে তার সক্রিয় অবস্থায় থাকা উচিত, নিষ্ক্রিয় বা অসহায় নয়। এই ধরনের ব্যক্তি যেমন স্বীকার করে যে সব কিছুই ভাগ্য-নির্ধারিত, সেই সাথে তাদের জানা উচিত জীবন এবং ভাগ্যের একটি সঠিক সংজ্ঞা: প্রতিটি জীবনই সৃষ্টিকর্তার সার্বভৌমত্বের অধীন। যখন কেউ তার পেরিয়ে আসা পথের দিকে ফিরে তাকায়, তার যাত্রাপথের প্রতিটি পর্বের কথা মনে করে, সে দেখতে পায় যে তার প্রতিটি পদক্ষেপে, তা সে কঠিন বা মসৃণ যাই হোক, ঈশ্বর তার পথ নির্দেশ করছিলেন, পরিকল্পনা করছিলেন। এটা ঈশ্বরের সূক্ষাতিসূক্ষ ব্যবস্থা, তাঁর সযত্ন পরিকল্পনা, যা কোনো মানুষকে তার অজান্তেই পরিচালিত করেছে আজকের দিনে। সৃষ্টিকর্তার সার্বভৌমত্ব স্বীকার করতে পারা, তাঁর পরিত্রাণ পেতে পারা—এ এক বিশাল সৌভাগ্য! ভাগ্যের প্রতি কোনো ব্যক্তির বিরূপ মনোভাব প্রমাণ করে যে তাদের জন্য ঈশ্বর-আয়োজিত সমস্ত ব্যবস্থাকে তারা প্রতিহত করছে, সমর্পণের মনোভাব তাদের নেই। মানুষের ভাগ্যের উপর ঈশ্বরের সার্বভৌমত্বের প্রতি যদি কারও ইতিবাচক মনোভাব থাকে, তাহলে যখন সে নিজের যাত্রাপথের দিকে ফিরে তাকায় এবং সদর্থে ঈশ্বরের সার্বভৌমত্বকে আঁকড়ে ধরে, তখন সে আরও আন্তরিকভাবে ঈশ্বরের আয়োজিত সকল ব্যবস্থার কাছে আত্মসমর্পণ করতে চায়, মানুষের ভাগ্য নির্ধারণে ঈশ্বরের সমন্বয়সাধনের প্রতি আরও দৃঢ়সংকল্প এবং আত্মবিশ্বাসী হয় এবং ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বন্ধ করে। কারণ যখন কেউ ভাগ্যকে উপলব্ধি করতে পারে না, উপলব্ধি করতে পারে না ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব, অথচ হাতড়ে হাতড়ে স্বেচ্ছায় এগিয়ে যায় কুয়াশার মধ্যে স্খলিত ও এলোমেলো পা ফেলে, তখন সেই যাত্রা হয় খুব কঠিন, অতি হৃদয়বিদারক। তাই মানুষ যখন ভাগ্যের উপর ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব চিনতে পারে, তখন ধীমান ব্যক্তিরা তা জানতে এবং মেনে নিতে চায়, বিদায় জানাতে চায় সেই বেদনাদায়ক দিনগুলিকে যখন তারা স্বীয় প্রয়াসে একটি ভালো জীবন গড়ার চেষ্টা করেছিল, এবং অদৃষ্টের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও তথাকথিত “জীবনের লক্ষ্য” অনুসরণ বন্ধ করে। যখন কোনো মানুষের ঈশ্বর থাকে না, যখন তিনি দৃশ্যমান হন না, তাঁর সার্বভৌমত্বকে স্পষ্টভাবে সে চিনতে পারে না, তখন তার প্রতিটি দিনই নিরর্থক, মূল্যহীন, দুঃখজনক। যে কোনো স্থানেই সে থাকুক, তার কাজ যা-ই হোক, শুধুমাত্র জীবনধারণের উপায় এবং নিজ লক্ষ্যের অন্বেষণ তাকে শুধুই অসীম হৃদয়বিদারণ ও নিরন্তর যন্ত্রণা ছাড়া আর কিছুই দেয় না, এমন কি সে অতীত স্মৃতিচারণও সহ্য করতে পারে না। কেবলমাত্র যখন কেউ স্রষ্টার সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে, তাঁর সমন্বয়সাধন ও ব্যবস্থাপনার কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং সদর্থে মানবজীবনের সন্ধান করে তখনই ধীরে ধীরে তার সমগ্র হৃদয় যন্ত্রণা-মুক্ত হতে শুরু করে এবং মোচন হতে শুরু করে জীবনের সমস্ত শূন্যতা।
৪. স্রষ্টার সার্বভৌমত্বে যারা আত্মসমর্পণ করে শুধুমাত্র তারাই অর্জন করতে পারে প্রকৃত স্বাধীনতা
ঈশ্বরের সমন্বয়-সাধন এবং সার্বভৌমত্বকে যেহেতু মানুষ স্বীকৃতি দেয় না, তাই তারা সর্বদাই প্রতিবাদী ও বিদ্রোহী মনোভাব নিয়ে ভাগ্যের মুখোমুখি হয়, এবং নিজেদের বর্তমান পরিস্থিতি ও ভাগ্য পরিবর্তনের বৃথা আশায় নিয়তই ঈশ্বরের কর্তৃত্ব ও সার্বভৌমত্ব এবং ভাগ্যের নিয়ন্ত্রণাধীন বিষয়গুলি বাতিল করতে চায়। কিন্তু তারা কখনই সফল হতে পারে না এবং প্রতিটি মোড়েই ব্যর্থ হয়। মানুষের আত্মার গভীরে সংঘটিত হয় এই দ্বন্দ্ব, তার অস্থি পর্যন্ত এই দ্বন্দ্বের গভীর যন্ত্রণায় এতোই আর্ত হয়ে ওঠে, যেন তার জীবন এখনই বিনষ্ট হয়ে যাবে। এই যন্ত্রণার কারণ কী? এর কারণ কি ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব, নাকি সেই ব্যক্তি মন্দ ভাগ্য নিয়ে জন্মেছে? নিশ্চিত ভাবে কোনোটিই সত্য নয়। প্রকৃতপক্ষে সেই ব্যক্তি যে রাস্তা গ্রহণ করে, জীবনযাপনের জন্য যে পথ বেছে নেয়, তাই এর আসল কারণ। এইসব বিষয়গুলি অনেক মানুষ হয়তো উপলব্ধি করে না। কিন্তু যখন তুমি সত্যই জানবে, সদর্থে উপলব্ধি করবে যে মানুষের ভাগ্যের উপর ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব রয়েছে, যখন তুমি প্রকৃত অর্থে বুঝবে যে তোমার জন্য ঈশ্বরের পরিকল্পনা এবং সিদ্ধান্ত হল এক বিশাল সুবিধা ও সুরক্ষা, তারপর তুমি অনুভব করবে যে তোমার যন্ত্রণা হালকা হতে শুরু করেছে এবং তোমার সমগ্র সত্তা শিথিল, মুক্ত, ও স্বাধীন হয়ে আসছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অবস্থা থেকে বিচার করলে, বস্তুনিষ্ঠভাবে তারা মানব-ভাগ্যের উপর স্রষ্টার সার্বভৌমত্বের বাস্তব মূল্য এবং অর্থের সাথে যথার্থরূপে একমত হতে পারে না, যদিও বিষয়গত স্তরে, তারা আর আগের মতো জীবন যাপন করতে চায় না এবং নিজেদের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি চায়; বস্তুনিষ্ঠভাবে, তারা প্রকৃত অর্থে স্রষ্টার সার্বভৌমত্ব উপলব্ধি করতে এবং তার কাছে সমর্পিত হতে পারে না, এবং নেহাতই কম জানে কী ভাবে স্রষ্টার সম্ন্বয়-সাধন ও ব্যবস্থাপনাগুলির অনুসন্ধান করতে হয় এবং সেগুলি গ্রহণ করতে হয়। সুতরাং, মানুষ যদি সত্যই স্বীকার করতে না পারে যে মানুষের ভাগ্য এবং মানব-সংক্রান্ত প্রতিটি বিষয়ের উপর স্রষ্টার সার্বভৌমত্ব রয়েছে, তারা যদি প্রকৃত অর্থে স্রষ্টার কর্তৃত্বের কাছে আত্মসমর্পণ করতে না পারে, তবে তাদের পক্ষে “কারো ভাগ্য তার নিজের হাতে” এই ধারণায় চালিত হওয়া ও বদ্ধ হয়ে পড়া থেকে বেরিয়ে আসা খুবই কঠিন। ভাগ্য এবং সৃষ্টিকর্তার কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে তাদের তীব্র সংগ্রামের বেদনা ঝেড়ে ফেলা তাদের পক্ষে কঠিন হবে, এবং বলাই বাহুল্য, তাদের পক্ষে প্রকৃত মুক্ত ও স্বাধীন হওয়া, ঈশ্বরের উপাসনাকারী মানুষ হওয়াও কঠিন হবে। কিন্তু এই অবস্থা থেকে নিজেকে মুক্ত করার একটি অত্যন্ত সহজ উপায় আছে, তা হল আগের জীবনযাপন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া; বিদায় জানানো জীবনের পূর্ববর্তী লক্ষ্যগুলিকে; কোনো ব্যক্তির পূর্ববর্তী জীবনধারা, জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি, সাধনা, আকাঙ্ক্ষা এবং আদর্শের সংক্ষিপ্তসার নেওয়া ও বিশ্লেষণ করা; এবং তারপর সেগুলিকে মানুষের জন্য ঈশ্বরের অভিপ্রায় ও চাহিদার সাথে তুলনা করা, এবং দেখা যে সেগুলির মধ্যে কোনগুলি ঈশ্বরের অভিপ্রায় ও চাহিদার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, তাদের মধ্যে কোনগুলি জীবনের সঠিক মূল্যবোধ প্রদান করে, মানুষকে সত্যের বৃহত্তর উপলব্ধির দিকে নিয়ে যায় এবং অনুমতি দেয় মানবতা ও মানুষের বৈশিষ্ট্য নিয়ে বেঁচে থাকার। মানুষ জীবনে যে বিভিন্ন লক্ষ্য অনুসরণ করে, যে অসংখ্য উপায়ে তার জীবনযাপন করে, সেগুলিকে তুমি যদি বারংবার অনুসন্ধান করো ও সযত্নে ব্যবচ্ছেদ করে দেখো, তুমি দেখতে পাবে তাদের মধ্যে একটিও স্রষ্টার মূল উদ্দেশ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, যে উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছিলেন। এগুলির প্রত্যেকটিই মানুষকে সৃষ্টিকর্তার সার্বভৌমত্ব এবং যত্ন থেকে দূরে সরিয়ে দেয়; এগুলি সব ফাঁদ যা মানুষকে বঞ্চিত করে এবং যা তাদের নরকের দিকে নিয়ে যায়। এটি অনুভব করার পরে, তোমার কাজ হল জীবন সম্পর্কে নিজের পুরানো দৃষ্টিভঙ্গি পরিত্যাগ করা, বিভিন্ন ফাঁদ থেকে দূরে থাকা, ঈশ্বরকে তোমার জীবনের দায়িত্ব এবং তোমার জন্য ব্যবস্থা নিতে দেওয়া; তুমি শুধুমাত্র সচেষ্ট হবে ঈশ্বরের সমন্বয়-সাধন এবং নির্দেশনায় সমর্পিত হতে, ব্যক্তিগত পছন্দ বিহীন জীবনযাপনে এবং ঈশ্বর-উপাসনাকারী ব্যক্তি হতে। এটি শুনতে সহজ মনে হলেও, বাস্তবে খুবই কঠিন। কেউ কেউ এর যন্ত্রণা সহ্য করতে পারে, আবার অনেকে পারে না। অনেকে এটি মেনে চলতে ইচ্ছুক, অনেকে আবার নিরুৎসাহী। অনিচ্ছুক ব্যক্তিদের এই আকাঙ্ক্ষা এবং সংকল্পই থাকে না। তারা স্পষ্টভাবে ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে অবগত, ভালোভাবেই জানে যে ঈশ্বরই মানুষের ভাগ্যের পরিকল্পনা এবং ব্যবস্থা করেন, এবং তবুও তারা এখনও বিরোধিতা ও সংগ্রাম করে এবং তাদের ভাগ্যকে ঈশ্বরের হাতে তুলে দিতে এবং ঈশ্বরের সার্বভৌমত্বের কাছে আত্মসমর্পণ করতে অপারগ হয়; অধিকন্তু, তারা ঈশ্বরের সমন্বয়-সাধন এবং ব্যবস্থাপনায় বিরূপ। তাই সবসময় এমন কিছু লোক থাকবে যারা নিজেরাই দেখতে চায় তারা কী করতে সক্ষম; তারা স্বহস্তেই তাদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে চায়, অথবা তাদের নিজস্ব শক্তিতে সুখ অর্জন করতে চায়, তারা পরখ করে দেখতে চায় যে তারা ঈশ্বরের কর্তৃত্বের সীমা অতিক্রম করতে এবং ঈশ্বরের সার্বভৌমত্বের ঊর্ধ্বে উঠতে পারে কিনা। মানুষের বিয়োগান্তক জীবনের কারণ এই নয় যে সে একটি সুখী জীবন খোঁজে, এই নয় যে সে খ্যাতি এবং ভাগ্যের পিছনে ছুটে যায় বা অনিশ্চতার মধ্য দিয়ে নিজের ভাগ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে, বরং তার কারণ হচ্ছে, স্রষ্টার অস্তিত্বপ্রত্যক্ষ করাএবং মানুষের ভাগ্যের উপর তাঁর সার্বভৌমত্ব উপলব্ধি করার পরেও সে তার পথ সংশোধন করতে পারে না, কাদা থেকে তার পা বের করতে পারে না, উপরন্তু কঠিন সংকল্পে তার ভুলগুলিকেই অনুসরণ করে। ঐ কর্দমেই সে মাতামাতি করে, স্রষ্টার সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু করে, তিক্ত সমাপ্তি পর্যন্ত তাকে প্রতিহত করে এবং এ সব কিছুই করে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা ছাড়া। শেষ পর্যন্ত যখন সে ভেঙে পড়ে এবং রক্তাক্ত হয়, একমাত্র তখনই সে হাল ছেড়ে দিয়ে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এটিই মানুষের প্রকৃত দুঃখ। তাই আমি বলি, যারা আত্মসমর্পণ করা বেছে নেয় তারা জ্ঞানী, আর যারা সংগ্রাম করে পালিয়ে যাওয়া বেছে নেয়, তারা আসলেই মূর্খ।
—বাক্য, খণ্ড ২, ঈশ্বরকে জানার প্রসঙ্গে, স্বয়ং অনন্য ঈশ্বর ৩