চতুর্থ সন্ধিক্ষণ: বিবাহ
বয়ঃপ্রাপ্ত এবং পরিণত হওয়ার পাশাপাশি বাবা-মা-র সঙ্গে, জন্ম ও বড় হয়ে ওঠার পরিবেশের সঙ্গে, মানুষের দূরত্ব বাড়তে থাকে। জীবনে সে একটি দিকনির্দেশ খোঁজা শুরু করে এবং পিতামাতার থেকে ভিন্ন একটি শৈলীতে নিজের জীবনের লক্ষ্য অনুসরণ করতে চায়। এই পর্বে মানুষের জীবনে পিতা-মাতার আর প্রয়োজনীয়তা থাকে না, বরং সে এমন এক সঙ্গী চায় যার সঙ্গেই সে জীবন কাটাবে, অর্থাৎ একজন স্বামী বা স্ত্রী—যার সঙ্গে তার ভাগ্য নিবিড় ভাবে জড়িত। সুতরাং, স্বাধীন হওয়ার পর মানুষের জীবনের প্রথম বড় ঘটনা হলো তার বিবাহ। চতুর্থ এই সন্ধিক্ষণ মানুষকে পেরোতেই হবে।
১. ব্যক্তিগত পছন্দে কারোর বিবাহ হয় না
মানুষের জীবনে বিবাহ একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই সময় থেকেই সে সত্যিকারের অর্থে নানা ধরনের দায়িত্ব নিতে শুরু করে এবং ধীরে ধীরে সিদ্ধ করে বিভিন্ন ধরণের উদ্দেশ্য। বিবাহের অভিজ্ঞতার আগে বিবাহ সম্পর্কে মানুষ নানা বিভ্রমের মধ্যে থাকে, তবে সেই সব বিভ্রম খুবই মনোরম। মেয়েরা কল্পনা করে যে তাদের স্বামীরা হবে প্রিন্স চার্মিং এবং ছেলেদের মনে হয় তাদের বিবাহ হবে স্নো হোয়াইট এর সঙ্গে। অলীক এই কল্পনাগুলি থেকেই বোঝা যায়, প্রত্যেকেরই বিবাহের জন্য নির্দিষ্ট কিছু চাহিদা থাকে, নিজের নির্ধারিত দাবী ও মান থাকে। এই দুষ্ট বয়সে বিবাহ সম্পর্কে বহু বিকৃত বার্তার ক্রমাগত শিকার হয়ে মানুষ বহু অতিরিক্ত দাবি এবং বিচিত্র মনোভাব পোষণ করে। বিবাহের অভিজ্ঞতা আছে এমন সকল ব্যক্তিই জানে যে বিবাহকে যে যেভাবেই বুঝুক বা যে মনোভাবই পোষণ করুক না কেন—তাতে কিছুই যায় আসে না, বিবাহ ব্যক্তিগত পছন্দের বিষয় নয়।
জীবনে অনেক মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় কিন্তু কেউই জানেনা তার বিবাহিত জীবনের সঙ্গী কে হবে। যদিও বিবাহ সম্পর্কে প্রত্যেকেরই ব্যক্তিগত ধারণা এবং দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে, কেউই কিন্তু আগে থেকে জানে না যে কে সত্য এবং চূড়ান্তভাবে তাদের সঙ্গী হবে। এ ব্যাপারে কোনো মানুষেরই ব্যক্তিগত ধারণার কোন মূল্য নেই। পছন্দের কারোর দেখা পেলে তুমি তার অনুসরণ করতে পারো, কিন্তু সে তোমার প্রতি আগ্রহী কি না বা তোমার জীবনসঙ্গী হতে পারবে কিনা, সেই সিদ্ধান্ত তোমার নয়। তোমার অনুরাগের ব্যক্তিকেই যে তুমি জীবনসঙ্গী হিসেবে পাবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই; এবং হয়তো ইতিমধ্যেই তোমার জীবনে নিঃশব্দে প্রবেশ করেছে এমন কেউ যাকে তুমি আশা করনি এবং সে তোমার জীবন সঙ্গী হয়ে উঠল, যে তোমার ভাগ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার, তোমার অর্ধাংশ, যার সঙ্গে তোমার ভাগ্য নিবিড়ভাবে জড়িত। যদিও পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ বিবাহ-সম্পর্ক আছে, কিন্তু তারা প্রত্যেকে একে অপরের থেকে আলাদা—অনেক বিবাহ অসন্তোষজনক, অনেকগুলি সুখী; অনেক বিবাহ পূর্ব ও পশ্চিমে বিস্তৃত, অনেকগুলো উত্তর ও দক্ষিণে; অনেক বিবাহে দুজন পরস্পরের নিখুঁত সঙ্গী, অনেকগুলি সমান সামাজিক পদমর্যাদার; অনেক দাম্পত্য সুখী এবং এক সুরে বাজে, অনেক বিবাহ বেদনাদায়ক এবং দুঃখজনক; অনেক বিবাহ অন্যদের ঈর্ষা জাগিয়ে তোলে, আবার অনেক বিবাহই ভুল বোঝাবুঝি এবং বিরাগে ভরা; অনেকের বিবাহ আনন্দে পূর্ণ, অনেকে চোখের জলে ভেসে যায় এবং হতাশা নিয়ে আসে…। অগণিত এই ধরণের বিবাহে, বিবাহের প্রতি কখনো মানুষের আনুগত্য এবং আজীবন প্রতিশ্রুতির প্রকাশ ঘটে; তাদের ভালবাসা, বন্ধন ও অবিচ্ছেদ্যতা প্রকাশিত হয়, আবার অনেকে হাল ছেড়ে দেয় এবং পারস্পরিক দুর্জ্ঞেয়তা প্রকাশ করে। কেউ কেউ তাদের বিবাহের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে, অথবা এমনকি এর প্রতি ঘৃণাও বোধ করে। বিবাহ সাথে করে সুখ বা বেদনা যাই আনুক না কেন, প্রতিটি বিবাহের উদ্দেশ্য স্রষ্টার দ্বারা পূর্বনির্ধারিত এবং অপরিবর্তনীয়; এটি এমন এক অভীষ্ট যা প্রত্যেককে অবশ্যই সম্পূর্ণ করতে হবে। প্রতিটি বিবাহের অন্তরালে থাকা প্রতিটি ব্যক্তির ভাগ্য অপরিবর্তনীয়, সৃষ্টিকর্তার দ্বারা অনেক আগেই নির্ধারিত।
২. দুজন সঙ্গীর সম্মিলিত ভাগ্যেই বিবাহ সম্পন্ন হয়
একজন মানুষের জীবনে বিবাহ একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ। বিবাহ তার ভাগ্যের ফল এবং গুরুত্বপূর্ণ এক যোগাযোগ। এটি কোনও ব্যক্তির ব্যক্তিগত ইচ্ছা বা পছন্দের উপর প্রতিষ্ঠিত নয়, এবং কোনও বাহ্যিক কারণ দ্বারা প্রভাবিত হয় না, তবে সম্পূর্ণরূপে দুই পক্ষের ভাগ্য দ্বারা এবং দম্পতির উভয় সদস্যের ভাগ্যের উপর স্রষ্টার ব্যবস্থা এবং পূর্বনির্ধারণের দ্বারা নির্ধারিত হয়। বিবাহের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হল মানব জাতির ক্রমকে চালিয়ে যাওয়া, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, বিবাহ হল নেহাতই এমন একটি প্রথা যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মানুষকে যেতে হয় তার অভীষ্ট পূরণের জন্য। বৈবাহিক সম্পর্কে মানুষ শুধু পরবর্তী প্রজন্মকে লালন-পালনের ভূমিকাই নেয় না, সেই বিবাহ বজায় রাখার প্রয়োজনে তার সাথে জড়িত সব রকমের ভূমিকা গ্রহণ করে এবং সেই লক্ষ্যগুলিও সে সম্পূর্ণ করে যা ওই ভূমিকাগুলির জন্য প্রয়োজন। যেহেতু কোনো মানুষের জন্ম তার চারপাশের মানুষ, বস্তু ও ঘটনাবলীর পরিবর্তনকে প্রভাবিত করে, তেমনই তার বিবাহ অনিবার্যভাবে এই সব ব্যক্তি, ঘটনা ও বস্তুদের প্রভাবিত করবে এবং উপরন্তু, সেগুলিকে বিভিন্ন উপায়ে রূপান্তরিত করবে।
স্বাধীন হওয়ার পর, মানুষের নিজের জীবনের যাত্রা শুরু হয়, যা ধাপে ধাপে কোনো মানুষকে নিয়ে যায় অন্য মানুষ, ঘটনা এবং এমন সব জিনিসের দিকে যা তার বিবাহের সাথে সম্পর্কযুক্ত। একই সময়ে, এই বিবাহের অপর পক্ষও ধাপে ধাপে এগিয়ে আসে সেই একই ব্যক্তি, ঘটনা এবং জিনিসগুলির দিকে। ভাগ্যের বন্ধনে আবদ্ধ দুই অপরিচিত ব্যক্তি সৃষ্টিকর্তার সার্বভৌমত্বে জড়িয়ে পড়ে এক বিবাহবন্ধনে এবং অলৌকিকভাবে হয়ে ওঠে একটি পরিবারঃ “দুটি পঙ্গপাল জড়িয়ে যায় একই রশিতে”। সুতরাং, বিবাহে প্রবিষ্ট হলে কোনো মানুষের জীবনের যাত্রা প্রভাবিত এবং স্পর্শ করে তার সঙ্গীকে এবং অনুরূপভাবে তার সঙ্গীর জীবনের যাত্রাও তার ভাগ্যকে প্রভাবিত এবং স্পর্শ করে। অর্থাৎ, মানুষের ভাগ্য পারস্পরিকভাবে যুক্ত, এবং অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন ও স্বাধীনভাবে কেউই জীবনের লক্ষ্য সম্পূর্ণ করতে বা নিজের ভূমিকা পালন করতে পারে না। কোনো মানুষের জন্ম প্রভাব ফেলে সম্পর্কের এক বিশাল শৃঙ্খলের উপর; বেড়ে ওঠাও জড়িয়ে থাকে সম্পর্কের এক জটিল শৃঙ্খলের সাথে; এবং অনুরূপভাবে, একটি বিবাহ অনিবার্যভাবে বিদ্যমান এবং রক্ষিত হয় মানব সংযোগের এক বিশাল এবং জটিল জালের মধ্যে যেখানে জড়িয়ে থাকে সেই জালের প্রতিটি সদস্য, এবং তা প্রতিটি জড়িত মানুষের ভাগ্যের উপর প্রভাব ফেলে। দুই পরিবারের সদস্যদের যোগাযোগের ফলে কোনো বিবাহ সংঘটিত হয় না, তারা যে পরিস্থিতিতে বড় হয়েছে, তাদের চেহারা, তাদের বয়স, তাদের গুণাবলী, তাদের প্রতিভা বা অন্য কোন কারণেও নয়, বরং দুই পক্ষের যৌথ অভীষ্ট এবং একই ভাগ্যের দোসর হওয়ার কারণে হয়। এটাই বিবাহের উৎস, যা স্রষ্টার দ্বারা আয়োজিত ও সুসংবদ্ধ মানুষের ভাগ্যের ফল।
—বাক্য, খণ্ড ২, ঈশ্বরকে জানার প্রসঙ্গে, স্বয়ং অনন্য ঈশ্বর ৩