তৃতীয় সন্ধিক্ষণ: স্বাধীনতা
শৈশব এবং কৈশোর অতিক্রম করার পরে কোনো ব্যক্তি যখন ধীরে ধীরে অনিবার্যভাবে পরিণত অবস্থায় পৌঁছয়, তার পরবর্তী পদক্ষেপ হল তারুণ্য থেকে তাদের সম্পূর্ণভাবে বিদায় নেওয়া, তাদের পিতামাতাকে বিদায় জানানো এবং একজন স্বাধীন প্রাপ্তবয়স্ক হিসাবে সামনের পথের মুখোমুখি হওয়া। এই পর্বে, একজন প্রাপ্তবয়স্কের মতই তাদের অবশ্যই সমস্ত মানুষ, ঘটনা এবং বস্তুর মুখোমুখি হতে হবে, সম্মুখীন হতে হবে তাদের ভাগ্যের সকল অংশের, যে অংশগুলি শীঘ্রই তাদের সামনে আসবে। এটি হল তৃতীয় সন্ধিক্ষণ যা প্রতিটি মানুষকে অতিক্রম করতে হবে।
১. স্বাধীন হওয়ার পর, কোনো ব্যক্তি সৃষ্টিকর্তার সার্বভৌমত্ব অনুভব করতে শুরু করে
জন্ম এবং বেড়ে ওঠা যদি কোনো ব্যক্তির জীবনের যাত্রাপথে “প্রস্তুতিমূলক সময়” হয়, যা তার ভাগ্যের ভিত্তি স্থাপন করে, তাহলে স্বাধীনতা হল তার জীবনে ভাগ্যের সূচনাপর্বের আত্মকথন। কোনো ব্যক্তির জন্ম এবং বেড়ে ওঠা যদি তার ভাগ্যের প্রস্তুতিপর্বের সংগৃহীত সম্পদ হয়, তাহলে সে স্বাধীন হয় তখন, যখন সে সেই সম্পদ ব্যয় বা তা বৃদ্ধি করতে শুরু করে। যখন কেউ পিতামাতাকে ছেড়ে স্বাধীন হয়, তখন সে যে সামাজিক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়, এবং যে ধরনের কাজ ও কর্মজীবন প্রাপ্ত হয়, তা উভয়ই তার ভাগ্য দ্বারা নির্ধারিত এবং তার পিতামাতার সাথে সম্পর্কহীন। কেউ কেউ উচ্চশিক্ষার জন্য একটি ভাল বিষয় বেছে নিয়ে স্নাতক হয়ে সন্তোষজনক চাকরি খুঁজে পায় যা জীবনের যাত্রাপথের প্রথম পদক্ষেপে তাদের বিজয়ী করে তোলে। কিছু মানুষ বিভিন্ন বিষয় শিখে এবং দক্ষভাবে আয়ত্ত করেও কখনোই তাদের উপযুক্ত চাকরি খুঁজে পায় না বা যোগ্য পদ পায় না, ভালো কর্মজীবন তো দূরস্থান; জীবনের যাত্রার শুরু থেকেই, জীবনের প্রতিটি মোড়ে তারা নিজেদের ব্যর্থ দেখতে পায়, জর্জরিত হয় সমস্যায়, তাদের সম্ভাবনার পরিণতি হয় হতাশাজনক, এবং তাদের জীবন হয় অনিশ্চিত। কিছু মানুষ অধ্যবসায়ের সাথে পড়াশোনা করলেও, উচ্চশিক্ষা লাভের প্রতিটি সুযোগই অল্পের জন্য হারায়; মনে হয় তাদের ভাগ্যে কখনই সাফল্য লাভ নেই, জীবনের যাত্রার প্রথম আকাঙ্খাই মিশে যায় লঘু বাতাসে। সামনের পথ মসৃণ নাকি পাথুরে তা তারা জানে না, কিন্তু প্রথমবারের মতো অনুভব করে যে মানুষের ভাগ্য কতটা পরিবর্তনশীল, এবং তাই জীবনকে প্রত্যাশা এবং ভয়ের সাথে নিরীক্ষণ করে। খুব শিক্ষিত না হওয়া সত্ত্বেও কিছু লোক বই লেখে এবং খ্যাতি অর্জন করে; প্রায় সম্পূর্ণ নিরক্ষর কিছু মানুষ ব্যবসায় অর্থ উপার্জন করে এবং তার মাধ্যমে নিজেদের সংস্থান করতে পারে…। কোনো ব্যক্তি কী পেশা বেছে নেয়, কীভাবে জীবিকা নির্বাহ করে: এই বিষয়গুলিতে তার সিদ্ধান্ত ভালো হবে না খারাপ, তার উপর কি কারো নিজের কোন নিয়ন্ত্রণ আছে? এগুলি কি মানুষের ইচ্ছা এবং সিদ্ধান্তের সাথে সঙ্গতি রেখে চলে? বেশিরভাগ মানুষেরই এরকম ইচ্ছা থাকে: কম পরিশ্রম ও বেশি উপার্জন করা, রোদ এবং বৃষ্টিতে পরিশ্রম না করা, ভাল পোশাক পরা, সর্বত্র দীপ্তিমান এবং উজ্জ্বল হওয়া, অন্যদের উপরে কর্তৃত্ব করা এবং পূর্বপুরুষদের জন্য খ্যাতি অর্জন করা। মানুষ নিখুঁত হওয়ার আশা করে, কিন্তু জীবনের যাত্রায় প্রথম পা ফেলার পরেই তারা ধীরে ধীরে বুঝতে পারে যে মানুষের ভাগ্য কতটা ত্রুটিপূর্ণ, এবং প্রথমবার তারা এই সত্য উপলব্ধি করে যে, কেউ ভবিষ্যতের জন্য সাহসী পরিকল্পনা করতে পারে, দুঃসাহসী কল্পনারআশ্রয় নিতে পারে, কিন্তু নিজের স্বপ্নগুলির বাস্তবায়নের ক্ষমতা কারোরই নেই, এবং নিজের ভবিষ্যত নিয়ন্ত্রণ করার পরিস্থিতিতেও কেউই নেই। একজনের স্বপ্ন এবং বাস্তবতার মধ্যে সর্বদাই কিছু দূরত্ব থাকবে যার মুখোমুখি তাকে হতেই হবে; মানুষ যেমন চায় ঘটনাপ্রবাহ কখনই তেমন হয় না, এবং এই বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে মানুষ কখনই সন্তুষ্টি বা তৃপ্তি অর্জন করতে পারে না। কিছু মানুষ ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টায় কল্পনাতীত যে কোন সীমায় চলে যায়, নিজেদের জীবিকা ও ভবিষ্যত গড়ার জন্য সর্বোচ্চ প্রয়াস করে এবং বিপুল ত্যাগ স্বীকার করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজের কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে যদি তারা তাদের স্বপ্ন এবং আকাঙ্ক্ষাগুলির বাস্তবায়ন করেও, তারা কখনই তাদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারে না, এবং যতই দৃঢ়তার সাথে চেষ্টা করুক না কেন, ভাগ্য তাদের জন্য যা বরাদ্দ করেছে তারা কখনই তাকে অতিক্রম করতে পারে না। ক্ষমতা, বুদ্ধিমত্তা এবং ইচ্ছাশক্তির পার্থক্য নির্বিশেষে, ভাগ্যের সামনে সব মানুষই সমান, সে পার্থক্য করে না মহান বা নগণ্য, উচ্চ বা তুচ্ছ, উদার বা নীচের মধ্যে। কেউ কী পেশা গ্রহণ করবে, কী ভাবে জীবিকা নির্বাহ করবে এবং জীবনে কতটা বিত্তশালী হবে তা তার পিতামাতা, তার প্রতিভা, তার প্রচেষ্টা বা তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা দ্বারা নির্ধারিত হয় না, আসলে তা স্রষ্টার দ্বারা পূর্বনির্ধারিত।
২. পিতামাতাকে ছেড়ে যাওয়া এবং জীবন নাট্যে নিজের ভূমিকা পালনের আন্তরিক সূত্রপাত
পরিণত অবস্থায় পৌঁছে, মানুষ যখন পিতামাতার নির্ভরতা ছেড়ে নিজেকে পালন করতে সমর্থ হয়, সেই মুহূর্তে থেকে সে প্রকৃত অর্থে নিজের ভূমিকা পালন করতে শুরু করে, কুয়াশা কেটে গিয়ে ধীরে ধীরে তার জীবনের লক্ষ্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। হয় তো কেউ তখনও তার পিতামাতার সাথে নামমাত্র ঘনিষ্ঠতায় বদ্ধ থাকে, কিন্তু যেহেতু তার লক্ষ্য এবং জীবনে পালনীয় ভূমিকায় তার মা এবং বাবার কোনও সম্পর্ক নেই, তাই সে ধীরে ধীরে স্বাধীন হওয়ার সাথে সাথে এই ঘনিষ্ঠ বন্ধনটি ছিন্ন হয়ে যায়। জৈবিক দৃষ্টিকোণ থেকে, এ সময়েও মানুষ অবচেতনে তাদের পিতামাতার উপর নির্ভরশীল থেকে যায়, কিন্তু বস্তুনিষ্ঠভাবে বলা যায়, যে একবার তারা সম্পূর্ণভাবে বড় হয়ে গেলে, পিতামাতার থেকে তারা সম্পূর্ণ পৃথক জীবনযাপন করে, এবং স্বাধীনভাবে যে ভূমিকা গ্রহণ করে তা সম্পাদন করে। জন্ম এবং সন্তান লালন-পালন ব্যতীত, সন্তানদের জীবনে পিতামাতার দায়িত্ব কেবল তাদের বেড়ে ওঠার জন্য একটি আনুষ্ঠানিক পরিবেশ প্রদান করা, কারণ স্রষ্টার পূর্বনির্ধারণ ছাড়া আর কোনো কিছুই কোনো ব্যক্তির ভাগ্যের উপর প্রভাব ফেলে না। কোনো ব্যক্তির ভবিষ্যৎ কেমন হবে তা কেউই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না; বহু পূর্বেই এটি নির্ধারিত, এমন কি কারো পিতা-মাতাও তার ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারে না। ভাগ্যের বিষয়ে, প্রত্যেকে স্বাধীন, এবং প্রত্যেকের নিজস্ব ভাগ্য আছে। তাই, কারোর পিতামাতাই তার ভাগ্য খণ্ডাতে পারে না বা জীবনে সে যে ভূমিকা পালন করে তার উপর সামান্যতম প্রভাবও ফেলতে পারে না। একথা বলা যেতে পারে, যে পূর্বনির্ধারণ অনুসারেই কোনো এক নির্দিষ্ট পরিবারে কেউ জন্ম নেয় এবং নির্দিষ্ট এক পরিবেশে সে বেড়ে ওঠে, জীবনের লক্ষ্য পূরণের পূর্বশর্ত ব্যতীত তা আর কিছুই নয়। তারা কোনভাবেই কোনো ব্যক্তির ভাগ্য, বা কোন ধরনের ভাগ্যের মধ্যে সে তার অভীষ্ট পূরণ করবে, তা নির্ধারণ করে না। এবং তাই, কারোর পিতামাতাই তার জীবনের লক্ষ্যপুরণে সহায়তা করতে পারে না, এবং একইভাবে, কোনো আত্মীয়স্বজনও কাউকে তার জীবনে পালনীয় ভূমিকা গ্রহণ করতে সহায়তা করতে পারে না। কীভাবে কোনো মানুষ তার অভীষ্ট সিদ্ধ করবে এবং কী রকম পরিবেশে সে তার ভূমিকা পালন করবে তা সম্পূর্ণরূপে তার ভাগ্য দ্বারা নির্ধারিত হয়। অন্য কথায় বলা যায়, অপর কোনো বস্তুগত অবস্থা কোনো মানুষের অভীষ্টকে প্রভাবিত করতে পারে না, যা স্রষ্টার দ্বারা পূর্বনির্ধারিত। সব মানুষ যে বিশেষ পরিবেশে বেড়ে ওঠে সেখানেই পরিণত হয়; তারপর ধীরে ধীরে, ধাপে ধাপে, তারা তাদের জীবনের নিজস্ব পথ তৈরি করে এবং স্রষ্টার দ্বারা তাদের জন্য পরিকল্পিত নিয়তি পূরণ করে। স্বভাবতই, অনিচ্ছাকৃতভাবে, তারা মানবতার বিশাল সমুদ্রে প্রবেশ করে এবং জীবনে তাদের নিজস্ব স্থান গ্রহণ করে, যেখানে তারা সৃষ্ট প্রাণী হিসাবে সৃষ্টিকর্তার পূর্বনির্ধারিত এবং তাঁর সার্বভৌমত্বের নির্দেশিত দায়িত্ব পালন করতে শুরু করে।
—বাক্য, খণ্ড ২, ঈশ্বরকে জানার প্রসঙ্গে, স্বয়ং অনন্য ঈশ্বর ৩