দ্বিতীয় সন্ধিক্ষণ: বড়ো হয়ে ওঠা
কোন ধরনের পরিবারে তাদের জন্ম হয়েছে, তার উপরে নির্ভর করে তাদের গৃহের পরিবেশ এবং পিতা মাতার কাছ থেকে তারা কী প্রকার শিক্ষা পাচ্ছে। এই সব উপাদান থেকেই নির্ধারিত হয় তারা কীভাবে বয়ঃপ্রাপ্ত হচ্ছে, এবং এই বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়াই হল একজন মানুষের জীবনের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ। একথা বলা নিষ্প্রয়োজন যে, এই সন্ধিক্ষণেও মানুষের কাছে কোনো বিকল্প থাকেনা। এই পর্বটিও নির্দিষ্ট ও পূর্বনির্ধারিত।
১. প্রত্যেক মানুষের বয়ঃপ্রাপ্তির নির্দিষ্ট শর্ত সৃষ্টিকর্তা আগে থেকেই নির্ধারিত করে রেখেছেন
একজন মানুষ বড়ো হওয়ার সময় কোন মানুষ, ঘটনাবলী অথবা বস্তুর দ্বারা নৈতিকভাবে উন্নীত অথবা প্রভাবিত হবে তা সে নির্বাচন করতে পারেনা। কোন ধরনের জ্ঞান অথবা দক্ষতা সে লাভ করবে, তার মধ্যে কোন অভ্যাস গড়ে উঠবে, কিছুই সে নির্বাচন করতে পারেনা। কারা তার পিতা মাতা বা আত্মীয়, কোন পরিবেশে সে বড়ো হয়ে উঠছে, এইসব বিষয়ে তার কোনো মতামত থাকেনা। তার চারপাশের মানুষ, ঘটনাবলী এবং বস্তুর সঙ্গে তার সম্পর্ক এবং তার বিকাশে এগুলি কী প্রভাব বিস্তার করে, সবকিছুই তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তাহলে এইসব বিষয়ে কে সিদ্ধান্ত নেন? কে সবকিছু সংগঠিত করেন? যেহেতু এইসব বিষয়ে মানুষের নিজের পছন্দের কোনো সুযোগ নেই, যেহেতু নিজেদের এইসব বিষয়ে তারা নিজেরা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনা, এবং স্পষ্টতই এগুলি স্বাভাবিকভাবে হয়না, তাহলে নিশ্চিতভাবেই একথা বলা যায় যে সব মানুষ, ঘটনাবলী এবং বস্তুর গঠন রয়েছে স্রষ্টার হাতে। একথা অবশ্যই বলা যায় যে স্রষ্টা যেমন প্রত্যেক মানুষের জন্মের জন্য নির্দিষ্ট পরিস্থিতির ব্যবস্থা করেন, ঠিক তেমনই তিনি তার বড়ো হয়ে ওঠার জন্যও নির্দিষ্ট পরিস্থিতির ব্যবস্থা করেন। যদি একজন মানুষের জন্ম তার পারিপার্শ্বিক মানুষজন, ঘটনাবলী ও বস্তুর মধ্যে পরিবর্তন সৃষ্টি করে, তাহলে, সেই মানুষের বৃদ্ধি এবং বিকাশও সেইসবকিছুকে অবশ্যই প্রভাবিত করবে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, কিছু মানুষ দরিদ্র পরিবারে জন্মানো সত্ত্বেও বড়ো হয় সম্পদের মাঝে। অন্য অনেকে সম্পদশালী পরিবারে জন্মানো সত্ত্বেও তাদের দুর্ভাগ্যের কারণে তাদের পরিবারের ভাগ্যের অবনতি হয়, এবং তারা দরিদ্র পরিবেশে বড়ো হয়। কারো জন্মের পিছনেই কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম নেই এবং কেউই কোনো অনিবার্য, নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে বড়ো হয়ে ওঠেনা। এগুলি কোনো মানুষ কল্পনা বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনা। এগুলি তাদের নিজ নিজ ভাগ্যের ফল এবং ভাগ্যের দ্বারাই নির্ধারিত। অবশ্যই এই সবকিছুর মূলে রয়েছে যে ভাগ্য তা স্রষ্টা প্রতিটি মানুষের জন্য পূর্বনির্ধারিত করে রেখেছেন। এগুলি মানুষের ভাগ্যের উপর স্রষ্টার সার্বভৌমত্ব, এবং তাঁর পরিকল্পনার দ্বারাই এগুলি নির্ধারিত হয়।
২. মানুষ যেসব বিবিধ পরিস্থিতিতে বেড়ে ওঠে তার থেকেই তাদের নানারকম ভূমিকার উদ্ভব হয়
মানুষের জন্মের পরিস্থিতিই মূলত নির্ধারণ করে তার বেড়ে ওঠার পরিবেশ ও পরিমন্ডল। আবার যে পরিমন্ডলে সে বেড়ে ওঠে, তা তার জন্মের পরিস্থিতিরই ফল। এইসময় একজন মানুষ ভাষা শিখতে শুরু করে, তার মন নানা ধরনের নতুন বিষয়ের সম্মুখীন হয় এবং তা মনের মধ্যে একত্রিত হয়। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে মানুষ ক্রমাগত বৃদ্ধি পায়। মানুষ যেসব জিনিস নিজের কানে শোনে, নিজের চোখে দেখে এবং নিজের মস্তিষ্কের সাহায্যে গ্রহণ করে তা ক্রমে তার অন্তর্জগতকে পরিপূর্ণ এবং উদ্দীপ্ত করে। একজন যেসব মানুষ, ঘটনা এবং বস্তুর সংস্পর্শে আসে, যে সাধারণ বোধ, জ্ঞান এবং দক্ষতা সে লাভ করে, যে চিন্তাশৈলী তাকে প্রভাবিত করে, যে পদ্ধতিতে তাকে শিক্ষাদান করা হয়, এই সবগুলিই তার জীবনের ভাগ্যকে নির্দেশ ও প্রভাবিত করে। বড়ো হওয়ার সময় মানুষ যে ভাষা শেখে এবং যেভাবে সে চিন্তা করে তা তার যৌবনের পরিবেশের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। এই পরিবেশেরই অঙ্গ হল তার বাবা মা, ভাইবোন এবং অন্যান্য মানুষজন, চারপাশের ঘটনাবলী এবং বস্তু। সুতরাং, একজন মানুষের বিকশিত হওয়ার গতিপথ নির্ধারিত হয় যে পরিবেশে সে বড়ো হয় তার দ্বারা এবং সেইসঙ্গে, তা নির্ভর করে সেই সময়ে সে যেসব মানুষজন, ঘটনাবলী এবং বস্তুর সংস্পর্শে আসে তার উপরেও। যেহেতু মানুষ যে পরিস্থিতিতে বড়ো হবে তা অনেক আগে থেকেই নির্ধারিত, তাই স্বাভাবিকভাবেই এই প্রক্রিয়ার মধ্যে সে কোন পরিবেশে থাকবে তাও পূর্বনির্ধারিত। এটি কোনো মানুষের পছন্দ বা অগ্রাধিকারের দ্বারা নির্ধারিত হয়না, বরং স্রষ্টার পরিকল্পনা এবং তাঁর সতর্ক ব্যবস্থাপনা ও মানুষের ভাগ্যের উপর তাঁর সর্বময় কর্তৃত্বের দ্বারা নির্ধারিত হয়। সুতরাং মানুষ তার বড়ো হয়ে ওঠার সময় যেসব মানুষজনের সংস্পর্শে আসে বা যেসব বস্তুর সম্মুখীন হয় তার সবকিছু স্বাভাবিকভাবেই স্রষ্টার সমণ্বয় ও ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত। মানুষ এই ধরনের জটিল আন্তঃসম্পর্কের কোনো পূর্বাভাস পায়না, তাকে নিয়ন্ত্রণ অথবা পরিমাপ করার ক্ষমতাও তার নেই। একজন মানুষ যে পরিবেশে বেড়ে ওঠে, তার উপরে প্রচুর বিভিন্ন ধরনের ব্যক্তি ও বস্তুর প্রভাব থাকে। এই বিপুল সংযোগের জালের আয়োজন বা তাকে সমণ্বিত করার ক্ষমতা কোনো মানুষেরই নেই। সব মানুষ, বস্তু অথবা ঘটনাবলীর উপস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা কেবল স্রষ্টারই আছে, কোনো মানুষ বা বস্তুর নেই, এমনকী তাদের উপস্থিতি বজায় রাখা অথবা অন্তর্ধানকে নিয়ন্ত্রণ করাও তাদের ক্ষমতার বাইরে। এ হল সংযোগের এক সুবিস্তৃত জাল যা একজন মানুষের বিকশিত হওয়াকে আকার দেয়, এবং বিভিন্ন পরিবেশ সৃষ্টি করে যার মধ্যে দিয়ে মানুষ বেড়ে ওঠে, যেমনভাবে স্রষ্টা তাকে পূর্বেই নির্ধারিত করেছেন। এটিই স্রষ্টার ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন ভূমিকা সৃষ্টি করে, মানুষের জীবনের উদ্দেশ্যকে সাফল্যের সঙ্গে পূরণ করার জন্য দৃঢ় ও শক্তিশালী ভিত্তি স্থাপন করে।
—বাক্য, খণ্ড ২, ঈশ্বরকে জানার প্রসঙ্গে, স্বয়ং অনন্য ঈশ্বর ৩