মানবতার ভাগ্য এবং মহাবিশ্বের ভাগ্য সৃষ্টিকর্তার সার্বভৌমত্ব থেকে অবিচ্ছেদ্য
তোমরা সবাই বয়ঃপ্রাপ্ত। কেউ কেউ মধ্যবয়স্ক, কেউ আবার বৃদ্ধ বয়সে পৌঁছেছো। ঈশ্বরের প্রতি অবিশ্বাস ছেড়ে তোমরা ঈশ্বরবিশ্বাসী হয়েছো, ঈশ্বর-বিশ্বাস থেকে তাঁর বাণী গ্রহণ করতে শুরু করেছো এবং তাঁর কাজের অভিজ্ঞতা লাভ করেছো। কিন্তু ঈশ্বররে সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে তোমার জ্ঞান কতটুকু? মানুষের ভাগ্য সম্পর্কে তোমাদের কতটুকু অন্তর্দৃষ্টি লাভ হয়েছে? জীবনে যা কিছু প্রার্থিত তা কি তোমরা লাভ করতে পেরেছো? তোমরা যা চেয়েছো, তোমাদের জীবনকালের শেষ কয়েক দশকে তার কতটুকু চাওয়া পূর্ণ করতে পেরেছো? এমন কতগুলি ঘটনা ঘটেছে যা কখনো আশা করো নি? মনোরম বিস্ময় হিসাবে কত জিনিস ঘটেছে? কত বিষয়ে বাঞ্ছিত ফলপ্রাপ্তির আশায় মানুষ এখনো অবচেতনে সঠিক মুহূর্তটির জন্য স্বর্গীয় ইচ্ছার উপরে নির্ভর করে অপেক্ষা করে আছে? কত জিনিস মানুষকে অসহায় এবং ব্যর্থ করে তোলে? কত জিনিসে মানুষ নিজেকে অসহায় এবং বাধাপ্রাপ্ত মনে করে? প্রত্যেকেই নিজেদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশাবাদী হয়ে অনুমান করে জীবনে সব কিছুই ঘটবে তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী, অন্ন বস্ত্রের অভাব হবে না এবং ভাগ্যের উন্নতি হবে দর্শনীয়ভাবে। কেউই দরিদ্র ও নিপীড়িত, কষ্ট ও বিপর্যয়ে পরিপূর্ণ জীবন চায় না। কিন্তু মানুষ এসব আগে থাকতে দেখতে পায় না বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। হয়ত কারো কারো কাছে অতীত হল উদ্দেশ্যহীন অভিজ্ঞতার সমষ্টি মাত্র; দৈব—ইচ্ছা কী তা তারা কখনই শিখতে পারে না এবং এটি কী তা তারা গ্রাহ্যও করে না। কোনরকম চিন্তাভাবনা ছাড়াই জন্তুর মত বেঁচে থাকে ও দিন যাপন করে; চিন্তা করে না মানবজাতির ভাগ্য কেমন হতে চলেছে বা কেন মানুষ বেঁচে আছে বা কীভাবে তাদের বেঁচে থাকা উচিত। এই ধরনের মানুষ ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কোন জ্ঞান লাভ না করেই বৃদ্ধ হয় এবং মৃত্যু পর্যন্ত জানতে পারে না জীবনের স্বরূপ কী। এই ধরনের মানুষ মৃতই। তারা আত্মাবিহীন পশুর মত জীব। যদিও মানুষ সৃষ্টির মধ্যে বাস করে এবং পৃথিবী থেকেই তাদের বস্তুগত চাহিদা পূরণের বিভিন্ন উপায় উপভোগ করে, যদিও তারা এই জড় জগতকে ক্রমাগত উন্নত হতে দেখে, তবুও তাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা—যা তাদের আত্মা এবং হৃদয় অনুভব করে এবং যে অভিজ্ঞতা অর্জন করে—সেগুলির সঙ্গে বস্তুর কোন সম্পর্ক নেই, এবং বস্তুগত কোন কিছুই অভিজ্ঞতার বিকল্প নয়। অভিজ্ঞতা হল হৃদয়ের গভীরে একটি স্বীকৃতি, যা খালি চোখে দেখা যায় না। এই স্বীকৃতি মানুষের জীবন এবং মানুষের ভাগ্য সম্পর্কে একজনের বোধ এবং উপলব্ধি। এবং তা প্রায়শই মানুষকে এই বোধের দিকে নিয়ে যায় যে, কোন এক অদৃশ্য প্রভু মানুষের জন্য সমস্ত কিছু সাজিয়েছেন এবং তাদের মধ্যে সমন্বয় ঘটিয়ে চলেছেন। এই সবকিছুর মাঝে মানুষের বিশ্বাস করা ছাড়া উপায় থাকে না যে ভাগ্যই এই সবকিছুর বিন্যাস ও সমন্বয়কারী; তাকে স্বীকার করতেই হয়, সামনে যে পথ রয়েছে তা স্রষ্টা—নির্ধারিত—প্রত্যকের ভাগ্যের উপরেই স্রষ্টার সার্বভৌমত্ব। এটি হলো অবিসংবাদিত সত্য। ভাগ্য সম্পর্কে মানুষের ধারণা এবং মনোভাব যাই হোক না কেন তাতে কিছুই যায় আসে না, কোন কিছুই বদলাতে পারে না ভাগ্যকে।
প্রতিদিন তুমি কোথায় যাবে, কী করবে, কার বা কোন কোন জিনিসের সঙ্গে তোমার সাক্ষাৎ হবে, কী বলবে এবং কীই বা তোমার সাথে ঘটবে—এর কোনোটিই কি ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব? এইসব ঘটনার কোনটিই আগে থাকতে মানুষ জানতে পারেনা। শুধু তা-ই নয়, যে পরিপ্রেক্ষিতে এগুলি ঘটবে সেগুলি নিয়ন্ত্রণ করতেও পারে না। এই অপ্রত্যাশিত ঘটনা জীবনে সব সময় ঘটে; এগুলি প্রত্যহের ঘটনা। প্রতিদিনের এই অস্থিরতা এবং তারা যেভাবে উদ্ভাসিত হয়, বা তারা যে পদ্ধতি অনুসরণ করে, তা মানুষকে ক্রমাগতই মনে করিয়ে দেয় যে লক্ষ্যহীন ভাবে কিছুই ঘটে না, প্রতিটি ঘটনা সংঘটনের প্রক্রিয়া, তাদের অনিবার্যতা, মানুষের ইচ্ছার দ্বারা অপসারিত হতে পারে না। প্রতিটি ঘটনাই স্রষ্টার কাছ থেকে মানবজাতির উদ্দেশ্যে একটি মৃদু তিরস্কার। আর তা এই বার্তাও দেয় যে মানুষ নিজের ভাগ্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। প্রতিটি ঘটনা মানবজাতির অনিয়ন্ত্রিত ও নিরর্থক উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং ভাগ্যকে নিজের হাতে নেওয়ার ইচ্ছাকে প্রতিহত করে। এগুলি মানুষের মুখে ক্রমাগত শক্তিশালী চপেটাঘাতের মতো, যা মানুষকে পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করে, শেষ পর্যন্ত কে তাদের ভাগ্যকে শাসন এবং নিয়ন্ত্রণ করে। এবং যখন তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং ইচ্ছা বারবার প্রতিহত হয় এবং ভেঙে যায়, মানুষ স্বাভাবিকভাবেই তার অদৃষ্টকে অবচেতনে স্বীকার করে নেয়—যা আসলে বাস্তবতার স্বীকৃতি, স্বর্গের ইচ্ছা এবং সৃষ্টিকর্তার সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি। এই দৈনন্দিন অনিশ্চয়তা থেকে সমগ্র মানব জীবনের ভাগ্য—কোথাও এমন কিছু নেই যা স্রষ্টার পরিকল্পনা এবং তাঁর সার্বভৌমত্ব প্রকাশ করে না; এমন কিছু নেই যা এই বার্তা পাঠায় না যে “স্রষ্টার কর্তৃত্বকে অতিক্রম করা যায় না”, যা এই চিরন্তন সত্যকে প্রকাশ করে না যে “স্রষ্টার কর্তৃত্বই সর্বোচ্চ”।
মানবজাতি এবং মহাবিশ্বের ভাগ্য নিবিড়ভাবে সৃষ্টিকর্তার সার্বভৌমত্বের সাথে জড়িত, অবিচ্ছেদ্যভাবে স্রষ্টার সমন্বয়-প্রক্রিয়ার সঙ্গে আবদ্ধ; শেষ পর্যন্ত, তারা সৃষ্টিকর্তার কর্তৃত্ব থেকে অবিচ্ছেদ্য। সব কিছু যে নিয়মে বাঁধা, তা থেকে স্রষ্টার সমন্বয়—সাধনের ক্ষমতা এবং সার্বভৌমত্ব মানুষ বুঝতে পারে; সব কিছুর অস্তিত্ব-রক্ষার নিয়ম থেকে মানুষ উপলব্ধি করে সৃষ্টিকর্তার শাসন; সমস্ত কিছুর ভাগ্য থেকে, মানুষ অনুমান করে স্রষ্টার সার্বভৌমত্বের প্রয়োগ এবং তাদের উপর নিয়ন্ত্রণ; মানুষ এবং অন্যান্য সব কিছুর জীবনচক্র থেকে মানুষ উপলব্ধি করতে পারে প্রতিটি বস্তু ও প্রাণীর মধ্যে সৃষ্টিকর্তার সমন্বয় ও ব্যবস্থাপনাকে, এবং সাক্ষী হয় কীভাবে এই সমন্বয় ও বুবস্থাপনা সমস্ত পার্থিব আইন, নিয়ম, প্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য সমস্ত শক্তি এবং ক্ষমতাকে ছাড়িয়ে যায়। এইভাবে, মানবজাতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় যে স্রষ্টার সার্বভৌমত্ব তাঁর সৃষ্ট কোনও সত্তা লঙ্ঘন করতে পারে না; কোনও শক্তিই স্রষ্টার দ্বারা পূর্বনির্ধারিত ঘটনা এবং বস্তু অধিকার করতে, বা তার পরিবর্তন ঘটাতে পারে না। এই ঐশ্বরিক আইন এবং নিয়মের অধীনেই মানুষ এবং সমস্ত কিছু প্রজন্মের পর প্রজন্ম বেঁচে থাকে এবং বর্ধিত হয়। এটিই কি সৃষ্টিকর্তার কর্তৃত্বের প্রকৃত মূর্ত প্রতীক নয়? যদিও মানুষ বস্তুনিষ্ঠ আইনে স্রষ্টার সার্বভৌমত্ব এবং প্রতিটি ঘটনা এবং বস্তুর প্রতি তাঁর নির্দেশ প্রত্যক্ষ করে, কিন্তু কতজন মানুষ মহাবিশ্বের উপর স্রষ্টার সার্বভৌমত্বের নীতিটি উপলব্ধি করতে সক্ষম? কতজন মানুষ সঠিকভাবে নিজেদের ভাগ্যের উপর সৃষ্টিকর্তার সার্বভৌমত্ব এবং ব্যবস্থাপনাকে জানতে, চিনতে, গ্রহণ করতে এবং নিজেকে তার কাছে সমর্পণ করতে পারে? সমস্ত কিছুর উপর স্রষ্টার সার্বভৌমত্বের সত্যে বিশ্বাস এবং উপলব্ধি করার পরেও, কে স্বীকার করে যে স্রষ্টা মানুষের জীবনের ভাগ্যও নির্ধারণ করেন? মানুষের ভাগ্য যে স্রষ্টার হাতেই নিহিত এই সত্য কে উপলব্ধি করতে পারে? সৃষ্টিকর্তাই মানবজাতির ভাগ্য পরিচালনা এবং নিয়ন্ত্রণ করেন, এই সত্যের মুখোমুখি হওয়ার পর তাঁর সার্বভৌমত্বের প্রতি মানবজাতির কী ধরনের মনোভাব নেওয়া উচিত? এটি এমন একটি সিদ্ধান্ত যা এই সত্যের মুখোমুখি হওয়া প্রতিটি মানুষকে নিজেদেরই নিতে হবে।
—বাক্য, খণ্ড ২, ঈশ্বরকে জানার প্রসঙ্গে, স্বয়ং অনন্য ঈশ্বর ৩