মানবজাতিকে জীবনধারণের একটা স্থিতিশীল পরিবেশ প্রদান করার উদ্দেশ্যে ঈশ্বর সকলকিছুর পারস্পরিক সম্পর্ককে ভারসাম্য-সমন্বিত করেন
সকল বস্তুর মধ্যে ঈশ্বর তাঁর কার্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটান, এবং সকলকিছুর মধ্যে তিনি সকল বস্তুর বিধানসমূহ পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত করেন। ঈশ্বর কীভাবে সকলকিছুর বিধানসমূহ পরিচালিত করেন, এবং এই বিধানসমূহের অধীনে কীভাবে তিনি সমগ্র মানবজাতির সংস্থান ও প্রতিপালন করেন, সেই বিষয়ে কিছুপূর্বেই আমরা আলোচনা করেছিলাম। তা হল আলোচনার একটি অভিমুখ। এবার আমরা অপর এক অভিমুখ বিষয়ে আলোচনা করতে যাচ্ছি, যা সকল বস্তুর উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম রাখার উদ্দেশ্যে ঈশ্বর দ্বারা ব্যবহৃত একটি পন্থা। সকল বস্তু সৃজন করার পর, ঈশ্বর সেগুলির পারস্পরিক সম্পর্ককে কীভাবে ভারসাম্য-সমন্বিত করলেন, আমি সেই বিষয়ে আলোচনা করতে চলেছি। এটিও তোমাদের পক্ষে বিলক্ষণ বিস্তৃত এক প্রসঙ্গ। সবকিছুর পারস্পরিক সম্পর্কে ভারসাম্যবিধানের কার্যটি কি মানুষের দ্বারা সম্পন্ন হতে পারে? না, মানুষ এহেন দুরূহ কার্য সম্পন্ন করতে অক্ষম। মানুষ কেবলই ধ্বংসসাধনে পারঙ্গম। সকলকিছুর পারস্পরিক সম্পর্ককে তারা ভারসাম্য-সমন্বিত করতে পারে না; তারা তা পরিচালনা করতে অসমর্থ, এবং এই ধরনের বিপুল কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা মানবজাতির অনায়ত্ত। একমাত্র স্বয়ং ঈশ্বরেরই এমন কার্য সম্পাদন করার ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু ঈশ্বরের এহেন কার্য সম্পাদনের উদ্দেশ্যটি কী—কী জন্য তা করা হয়? এটাও মানবজাতির উদ্বর্তনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। ঈশ্বর যা কিছু করতে চান তার সকলই আবশ্যক—করলেও চলে, আবার না-করলেও চলে, এমন কিছুই তাতে নেই। মানবজাতির উদ্বর্তনকে সুরক্ষিত রাখতে এবং মানুষকে জীবনধারণের পক্ষে এক অনুকূল প্রতিবেশ প্রদান করতে, এমন কিছু অত্যাবশ্যক ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে যা ঈশ্বরকে অবশ্যই সম্পন্ন করতে হবে।
“ঈশ্বর সকলকিছুর মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখেন” বাক্যাংশটির আক্ষরিক অর্থ থেকে তা অতি সুদূরপ্রসারী এক প্রসঙ্গ বলে বোধ হয়। প্রথমত, তা মানুষকে এই ধারণাটি দেয় যে “সকলকিছুর ভারসাম্য রক্ষা” একই সাথে সকলকিছুর উপর ঈশ্বরের কর্তৃত্বকেও নির্দেশ করে। এই “ভারসাম্য” শব্দটির অর্থ কী? প্রথমত, “ভারসাম্য” বলতে বোঝায় কোনোকিছুকে টাল হারিয়ে পড়ে যেতে না দেওয়া। বিষয়টা হল কোনো সামগ্রী ওজন করতে দাঁড়িপাল্লা ব্যবহার করার মতো। দাঁড়িপাল্লাকে সাম্যাবস্থায় রাখতে গেলে দুইদিকের ওজনকে সমান হতে হবে। ঈশ্বর বিবিধ প্রকারের বস্তু সৃজন করেছিলেন: স্বস্থানে সংবদ্ধ বস্তু, চলমান বস্তু, সজীব বস্তু, শ্বাস গ্রহণ করে এমন বস্তু, এবং শ্বাসগ্রহণ করে না এমন বস্তু। এই সকল বস্তুগুলির মধ্যে উভয়েই উভয়কে শক্তি যোগায় এবং পরস্পরকে সংযত রাখে এমন এক পারস্পরিক নির্ভরশীলতার, পারস্পরিক সংযুক্তির সম্পর্ক অর্জন করা কি সহজসাধ্য? এই সকলকিছুর মধ্যে অবশ্যই নীতিসমূহ রয়েছে, কিন্তু সেগুলি অত্যন্ত জটিল, তাই নয় কি? ঈশ্বরের কাছে দুরূহ না হলেও, মানুষের পক্ষে তা নিরীক্ষা করা অত্যন্ত জটিল ব্যাপার। “ভারসাম্য”—এই শব্দটি খুব সহজ-সরল। কিন্তু, মানুষ যদি বিষয়টিকে খুঁটিয়ে বিবেচনা করতো, এবং মানুষকে যদি নিজেদের প্রচেষ্টায় ভারসাম্য সৃষ্টি করতে হতো, এমনকি সকল প্রকারের বিদ্বজ্জনরাও যদি এই বিষয়ে কাজ করতো—মানব জীববিজ্ঞানী, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, পদার্থবিদ, রসায়নবিদ মায় ঐতিহাসিক অবধি—তাহলে সেই গবেষণার চূড়ান্ত পরিণাম কী হতো? পরিণাম কিছুই হতো না। তার কারণ, ঈশ্বর কর্তৃক সকলকিছুর সৃজন অতি আশ্চর্যজনক, এবং মানবজাতি কোনোদিনই এর রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারবে না। ঈশ্বর যখন সকল বস্তু সৃষ্টি করেছিলেন, তখনই তিনি সেগুলির পারস্পরিক নীতিসমূহ প্রণয়ন করেছিলেন, পারস্পরিক সংযতকরণ, পরিপূরকতা ও ভরণপোষণের নিমিত্ত জীবনধারণের বিভিন্ন পদ্ধতি স্থাপন করেছিলেন। এই বিবিধ পদ্ধতিগুলি অত্যন্ত জটিল, সেগুলি বিন্দুমাত্রও সরল অথবা একরৈখিক নয়। সকলকিছুর উপর ঈশ্বরের নিয়ন্ত্রণের পিছনের নিহিত নীতিসমূহ প্রতিপন্ন অথবা অধ্যয়ন করার উদ্দেশ্যে মানুষ যখন তাদের মন, তাদের অর্জিত জ্ঞান ও তাদের নিরীক্ষিত ঘটনাবলীকে ব্যবহার করে, দেখা যায় যে এই বিষয়গুলি আবিষ্কার করার পক্ষে অত্যন্ত দুরূহ, এবং কোনো পরিণাম অর্জন করাও খুবই কঠিন। মানুষের পক্ষে কোনো ফলাফল লাভ করা শক্ত; মানবীয় চিন্তাভাবনা ও জ্ঞানের উপর নির্ভর করে ঈশ্বরসৃষ্ট সকল বস্তুকে পরিচালনা করতে গেলে মানুষের পক্ষে সেগুলির ভারসাম্য বজায় রাখা অত্যন্ত দুঃসাধ্য। এর কারণ, মানুষ যদি বস্তুসকলের উদ্বর্তনের নীতিগুলি না জানে, তাহলে এই জাতীয় ভারসাম্যকে কীভাবে সুরক্ষিত রাখতে হয়, তা-ও তারা জানবে না। তাই, মানুষকে যদি সকলকিছুর পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করতে হতো, তাহলে খুব সম্ভবত এই ভারসাম্যকে তারা ধ্বংস করে ফেলতো। এই ভারসাম্য ধ্বংস হওয়ামাত্র, মানবজাতির জীবনধারণের পরিবেশও বিনষ্ট হয়ে যেতো, এবং তা যদি ঘটতো, তাহলে এর পর মানবজাতির উদ্বর্তনের ক্ষেত্রে এক সঙ্কটকাল উপস্থিত হতো। এর ফলে এক বিপর্যয় ঘনিয়ে আসতো। মানুষ যদি বিপর্যয়ের মধ্যে বাস করতো, তাহলে তাদের ভবিষ্যৎ কী হতো? ফলাফল নিরূপণ করা খুবই কঠিন হতো, এবং নিশ্চিতভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব হতো না।
তাহলে, সকল বস্তুর পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ঈশ্বর কীভাবে ভারসাম্য বজায় রাখেন? প্রথমত, পৃথিবীর কিছু স্থান সারা বছর বরফ ও তুষারে আবৃত থাকে, সেখানে অন্য কিছু স্থানে, চারটি ঋতুই বসন্তের মতো, আর শীতকাল কখনো আসে না, এবং এই ধরনের জায়গায় এক ফালি বরফ-ঢাকা জমি বা একটি তুষারকণাও তুমি কখনো দেখতে পাবে না। এখানে আমরা বৃহত্তর জলবায়ুর বিষয়ে কথা বলছি, এবং এই উদাহরণটি ঈশ্বরের সকলকিছুর মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার অন্যতম এক পদ্ধতি। দ্বিতীয় পদ্ধতিটি হল এইরকম: একটি পর্বতমালা সতেজ উদ্ভিজ্জে আচ্ছাদিত, বিবিধ প্রকারের উদ্ভিদ মাটির উপর গালিচার আস্তরণ আকীর্ণ করেছে, এবং বিস্তির্ণ বনভূমি এত নিবিড় যে তার ভিতর দিয়ে হেঁটে গেলে এমনকি তুমি মাথার উপর সূর্যকেও দেখতে পাবে না। কিন্তু অন্য আরেকটি পর্বতমালার দিকে তাকালে ঘাসের একটি ফলাও সেখানে গজাতে দেখবে না, শুধু স্তরের পর স্তর জুড়ে ঊষর, অবিন্যস্ত পর্বতের বিস্তার। আপাতদৃষ্টিতে, উভয় ক্ষেত্রেই, মূলত শিথিল মৃত্তিকার বিপুল রাশি স্তূপীকৃত হয়ে পর্বতের আকার নিয়েছে, কিন্তু সেগুলির মধ্যে একটি ঘন অরণ্যে আবৃত, সেখানে অপরটি উদ্ভিদ-বিবর্জিত, এমনকি ঘাসের একটি ফলাও দেখা যায় না। এটি হল ঈশ্বরের সকলকিছুর সম্পর্কের মধ্যে ভারসাম্য স্থাপনের দ্বিতীয় পদ্ধতি। তৃতীয় পদ্ধতিটি হল: এক দিকে তাকালে হয়তো তুমি অন্তহীন তৃণভূমি, এক তরঙ্গায়িত হরিৎক্ষেত্র দেখতে পাচ্ছো। অন্যদিকে তাকালে দেখছো, দিগন্তপ্রসারিত মরুভূমি, ঊষর, শোঁ শোঁ শব্দে প্রবাহিত বায়ু-তাড়িত বালুরাশির মধ্যে কোনো জনপ্রাণী নেই, জলের কোনো উৎস তো নেই-ই। চতুর্থ উপায়টি এবম্বিধ: এক দিকে তাকালে দেখা যায়, সবকিছু সমুদ্রের তলায়, সেই বিপুল জলরাশির তলদেশে নিমজ্জিত, অন্য দিকে তাকালে, এমনকি এক বিন্দু সুমিষ্ট নির্ঝরিণীর জল খুঁজে মেলা ভার। পঞ্চম পদ্ধতিটি এইরকম: এখানকার এই ভূখণ্ডে প্রায়শই ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ে এবং আবহাওয়া কুয়াশাচ্ছন্ন ও স্যাঁতসেঁতে, সেখানে অপর এক ভূখণ্ডে, আকাশে প্রায়শই এক চণ্ড সূর্য বিরাজ করে, এমনকি এক বিন্দু বৃষ্টিপাতও সেখানে বিরল ঘটনা। ষষ্ঠ উপায়টি এবম্প্রকার: এক স্থানে এক মালভূমিতে বাতাস এত লঘু যে মানুষের পক্ষে শ্বাস নেওয়া কঠিন, সেখানে অপর এক স্থানে রয়েছে কেবলই জলা ও নিম্নভূমি, যা বিভিন্ন প্রজাতির পরিযায়ী পাখিদের বাসস্থান হিসাবে কাজ করে। এগুলি হল বিবিধ প্রকার জলবায়ু, অথবা বিভিন্ন ভৌগোলিক পরিবেশের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জলবায়ু বা আবহমণ্ডল। অর্থাৎ, ঈশ্বর মানবজাতির জীবনধারণের মৌলিক পরিবেশগুলিকে বৃহদায়তন আবহমণ্ডলের সাপেক্ষে ভারসাম্যে বিন্যস্ত করেন, জলবায়ু থেকে ভৌগোলিক পরিবেশ, এবং মাটির বিভিন্ন উপাদান থেকে জলের উৎসের সংখ্যা, এই সকলকিছুই নির্ণিত হয় মানুষের জীবনযাপনের পরিবেশের বায়ু, তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার ক্ষেত্রে একটা ভারসাম্য অর্জন করার উদ্দেশ্যে। এই সকল বিপরীতধর্মী ভৌগোলিক পরিমণ্ডলের কারণে মানুষের এক স্থিতিশীল বায়ুমণ্ডল রয়েছে, এবং বিভিন্ন ঋতুর উষ্ণতা ও আর্দ্রতা সুস্থিত থেকেছে। এর ফলে মানুষ জীবনধারণের ঐরূপ পরিবেশে চিরকালের মতো করেই জীবনধারণ করে যেতে পারে। প্রথমে, এই বৃহদায়তন পরিবেশটিকে অবশ্যই ভারসাম্যান্বিত হতে হবে। এই শর্তটি অর্জিত হয় বিভিন্ন ভৌগোলিক অবস্থান ও সংগঠন এবং বিবিধ প্রকারের জলবায়ুর মধ্যে পরিবর্তনকে কার্যকর করে, ঈশ্বরের কাঙ্ক্ষিত তথা মানবজাতির জন্য প্রয়োজনীয় ভারসাম্যকে অর্জন করার লক্ষ্যে যা পরস্পরকে নিয়ন্ত্রণ ও সংবরণ করার সুযোগ প্রদান করে। বৃহদায়তন পরিবেশের পরিপ্রেক্ষিতেই এমন বলা হচ্ছে।
এখন আমরা সূক্ষ্ণতর অনুপুঙ্খসমূহের বিষয়ে আলোচনা করবো, যেমন ধরা যাক উদ্ভিজ্জ। তাদের ভারসাম্য কীভাবে অর্জিত হয়? অর্থাৎ, জীবনধারণের একটি সুষম পরিবেশের মধ্যে কীভাবে উদ্ভিজ্জদের টিকে থাকতে সমর্থ করে তোলা যায়? উত্তরটা হল, তাদের উদ্বর্তনের পরিবেশকে সুরক্ষিত রাখতে বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদের আয়ুষ্কাল, বৃদ্ধির মাত্রা এবং বংশবৃদ্ধির হার পরিচালনা করার মাধ্যমে। উদাহরণ হিসাবে অতি ক্ষুদ্র তৃণের বিষয়ে ধরা যাক—বসন্তে তাদের অঙ্কুরোদ্গম ঘটে, গ্রীষ্মে ফুল ধরে, এবং শরতে ফল ধরে। সেই ফল মাটিতে পড়ে। পরের বছর, সেই ফলের বীজ অঙ্কুরিত হয় এবং একই বিধানসমূহ অনুসারে সেই ঘটনার অনুবৃত্তি ঘটে। ঘাসের আয়ুষ্কাল খুবই হ্রস্ব; প্রতিটি বীজ মাটিতে পতিত হয়, শিকড় গজায় ও অঙ্কুরিত হয়, পুষ্পধারণ ও ফল উৎপাদন করে, এবং বসন্ত, গ্রীষ্ম ও হেমন্ত—মাত্র তিনটি ঋতুর মধ্যেই সমগ্র প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ হয়ে যায়। সব ধরনের গাছেরই তাদের নিজস্ব আয়ুষ্কাল এবং অঙ্কুরোদ্গম ও ফলধারণের বিভিন্ন সময়কাল থাকে। কিছু গাছ কেবল ৩০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যেই মারা যায়—সেটাই তাদের আয়ুষ্কাল। কিন্তু তাদের ফল মাটিতে পড়ে, তারপর তাতে শিকড় গজায় ও অঙ্কুরিত হয়, পুষ্পিত হয় ও ফল ধারণ করে, এবং আরো ৩০ থেকে ৫০ বছর বাঁচে। এটাই হল গাছটির পুনরাবর্তনের হার। পুরানো গাছ মারা যায় আর নবীন গাছ বেড়ে ওঠে; এই কারণেই অরণ্যে তুমি সততই তুমি বৃক্ষরাজির বৃদ্ধি ঘটতে দেখতে পাও। কিন্তু তাদেরও স্বাভাবিক জীবনচক্র এবং জন্ম ও মৃত্যুর প্রক্রিয়া রয়েছে। কিছু গাছ এক হাজার বছরেরও বেশি বেঁচে থাকতে পারে, এবং কিছু গাছ এমনকি তিন হাজার বছরও জীবিত থাকতে পারে। কোনো উদ্ভিদ যে প্রজাতিরই হোক বা তার আয়ুষ্কাল যাই-ই হোক না কেন, সাধারণভাবে, তা কত দিন বাঁচে, তার বংশবিস্তারের ক্ষমতা, বংশবিস্তারের দ্রুততা ও পর্যাবৃত্তির হার এবং উৎপাদিত অপত্যজনের সংখ্যার উপর ভিত্তি করে ঈশ্বর সেই উদ্ভিদটির ভারসাম্য পরিচালনা করেন। এর ফলে তৃণ থেকে বৃক্ষ অবধি সকল উদ্ভিদ একটি সুষম বাস্তুতান্ত্রিক পরিবেশের মধ্যে তেজীয়ানভাবে বিকশিত ও বর্ধিত হওয়া অব্যাহত রাখতে পারে। সেহেতু, পৃথিবীর যেকোনো অরণ্যের দিকে তাকালে দেখবে, যাকিছু সেখানে জন্মায়, তৃণ ও বৃক্ষ উভয়ই, তাদের নিজের নিয়ম অনুযায়ী ক্রমাগত বংশবৃদ্ধি করছে ও বেড়ে চলেছে। মনুষ্যজাতির কাছ থেকে তাদের উদ্বৃত্ত কোনো শ্রম অথবা সহায়তার প্রয়োজন ঘটে না। শুধুমাত্র এহেন ভারসাম্য তাদের রয়েছে বলেই তারা তাদের নিজস্ব বেঁচে থাকার পরিবেশ বহাল রাখতে সমর্থ হয়। কেবলমাত্র তাদের উদ্বর্তনের এক উপযুক্ত পরিমণ্ডল রয়েছে বলেই বিশ্বের অরণ্য ও তৃণভূমিগুলি পৃথিবীর বুকে টিকে থাকতে সমর্থ হয়। তাদের অস্তিত্ব মানুষের প্রজন্মের পর প্রজন্মকে এবং অরণ্য ও তৃণভূমিতে বসবাসকারী পশু-পাখি, পতঙ্গ ও সকল প্রকার অণুজীব সহ সমস্ত ধরনের প্রাণসত্তার প্রজন্মের পর প্রজন্মকে প্রতিপালিত করে।
ঈশ্বর সকল প্রজাতির প্রাণীদের মধ্যে ভারসাম্যকেও নিয়ন্ত্রণ করেন। কীভাবে তিনি এই ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করেন? এটা উদ্ভিদদের অনুরূপই—তিনি তাদের ভারসাম্যকে পরিচালিত করেন এবং তাদের প্রজনন ক্ষমতা, তাদের বংশবৃদ্ধির পরিমাণ ও হার এবং প্রাণিজগতে তারা যে ভূমিকা পালন করে তার উপর ভিত্তি করে তাদের সংখ্যা নির্ধারণ করেন। উদাহরণস্বরূপ, সিংহ জেব্রা ভক্ষণ করে, সেহেতু, যদি সিংহের সংখ্যা জেব্রার থেকে বেশি হতো, তাহলে জেব্রাদের নিয়তি কী হতো? তারা বিলুপ্ত হয়ে যেতো। আর জেব্রারা যদি সিংহের তুলনায় অনেক কম শাবকের জন্ম দিতো, তাহলে তাদের পরিণতি কী হতো? তাহলেও তারা বিলুপ্ত হয়ে যেতো। তাই, জেব্রার সংখ্যা অবশ্যই সিংহের সংখ্যা অপেক্ষা অনেক বেশি হবে। তার কারণ, জেব্রাদের অস্তিত্ব শুধু তাদের নিজেদের জন্য নয়, উপরন্তু সিংহদের জন্যও বটে। ব্যাপারটা এইভাবেও বলা যায়: প্রতিটি জেব্রা হল সামগ্রিক জেব্রা প্রজাতির একটি অংশ, কিন্তু একই সাথে তা সিংহদের মুখের খাবারও বটে। সিংহদের প্রজননের হার কখনও জেব্রাদের প্রজননের হারকে ছাড়িয়ে যেতে পারে না, তাই সিংহের সংখ্যা কখনো জেব্রার সংখ্যার চেয়ে অধিক হতে পারে না। একমাত্র এই ভাবেই সিংহের খাদ্যের উৎসকে সুনিশ্চিত করা যায়। এবং সেহেতু, সিংহেরা জেব্রাদের স্বাভাবিক শত্রু হলেও, মানুষ প্রায়ই এই দুই প্রজাতিকে একই অঞ্চলে অবসর সময়ে বিশ্রামরত অবস্থায় দেখতে পায়। সিংহ তাদের শিকার করে ভক্ষণ করে বলে জেব্রাদের সংখ্যা কখনো কমে যাবে না বা তারা বিলুপ্ত হয়ে যাবে না, এবং তাদের “রাজা” মর্যাদার অধিকারবলেই সিংহদের সংখ্যা যে বৃদ্ধি পাবে, তা-ও নয়। বহু পূর্বেই ঈশ্বর এই ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। অর্থাৎ, ঈশ্বর সকল প্রাণীদের মধ্যে সুষমতার বিধানসমূহ প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, যাতে তারা এহেন ভারসাম্য অর্জন করতে পারে, এবং এই বিষয়টি মানুষ প্রায়শই দেখতে পায়। সিংহই কি জেব্রার একমাত্র প্রাকৃতিক শত্রু? না, কুমিরেও জেব্রা খায়। জেব্রাদের খুব অসহায় ধরনের প্রাণী বলে মনে হয়। সিংহের হিংস্রতা তাদের নেই, এবং যখন তাদের দুর্ধর্ষ শত্রু সিংহের সম্মুখীন হতে হয়, তখন দৌড়ে পালানো ছাড়া আর কিছুই তারা করতে পারে না। এমনকি প্রতিরোধ করার ক্ষেত্রেও তারা শক্তিহীন। যখন তারা দৌড়ে সিংহকে ছাড়িয়ে যেতে পারে না, তখন সিংহের খাদ্য হওয়া ছাড়া তাদের গত্যন্তর থাকে না। প্রাণীজগতে প্রায়শই এমন দেখা যায়। এহেন কিছু দেখলে তোমাদের কীধরনের অনুভূতি ও চিন্তা হয়? জেব্রাটির জন্য তোমাদের কি দুঃখবোধ হয়? সিংহটিকে তোমরা কি ঘৃণা করো? জেব্রারা দেখতে কত সুন্দর! কিন্তু সিংহ, তারা সবসময় লোভীর মতো তাদের লক্ষ্য করছে। আর জেব্রাগুলোও বোকার মতো ছুটে অনেকটা দূরে চলে যায় না। তারা দেখে সিংহ সেখানে গাছের তলায় ঠাণ্ডা ছায়ায় বসে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। যেকোনো মুহূর্তে সে এসে তাদেরকে খেতে পারে। মনে মনে তারা এটা জানে, কিন্তু তবু সেই ভূখণ্ড ছেড়ে নড়বে না। এটা একটা অত্যাশ্চর্য ব্যাপার, এমন অত্যাশ্চর্য এক বিষয় যা ঈশ্বরের পূর্বনির্ধারণ ও তাঁর নিয়মকে প্রতিভাত করে। জেব্রাটির জন্য তুমি দুঃখবোধ করো কিন্তু তুমি একে রক্ষা করতে অক্ষম, আর সিংহটিকে তুমি ঘৃণা করো কিন্তু একে তুমি ধ্বংস করতে পারো না। জেব্রা হল সিংহের জন্য ঈশ্বরের প্রস্তুতকৃত খাদ্য, কিন্তু সিংহেরা যতই ভক্ষণ করুক না কেন, জেব্রারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে না। সিংহেরা খুব স্বল্প সংখ্যক অপত্য উৎপাদন করে, এবং তারা অত্যন্ত শ্লথ গতিতে বংশবিস্তার করে, তাই যত সংখ্যক জেব্রাই তারা ভক্ষণ করুক না কেন, তাদের সংখ্যা কখনো জেব্রার সংখ্যাকে ছাড়িয়ে যাবে না। এখানেই, রয়েছে ভারসাম্য।
এহেন ভারসাম্য বিধানের পিছনে ঈশ্বরের লক্ষ্য কী? মানুষের উদ্বর্তনের উপযোগী পরিবেশ এবং মানবজাতির জীবনধারণ উভয়ই এর সাথে সংশ্লিষ্ট। সিংহের জেব্রা অথবা অনুরূপ কোনো শিকার—হরিণ অথবা অপর কোনো পশু—যদি খুব বেশি মন্থরগতিতে বংশবিস্তার করতো এবং সিংহের সংখ্যা হঠাৎ খুব বেড়ে যেতো, মানুষরা তখন কী ধরনের বিপদের সম্মুখীন হতো? সিংহের তাদের শিকার আহার করাটা একটা স্বাভাবিক ঘটনা, কিন্তু একটা সিংহ কোনো মানুষকে আহার করলে তা একটা দুঃখজনক ঘটনা। এই শোকাবহ ঘটনাটি ঈশ্বরের দ্বারা পূর্বনির্ধারিত কিছু নয়, তা তাঁর নিয়মের অধীনে সংঘটিত কোনো ঘটনা নয়, মানবজাতির উপর তাঁর ডেকে আনা কোনো দুর্দৈব তো নয়ই। বরং, তা এমনকিছু যা মানুষ নিজেরাই নিজেদের উপর ডেকে আনে। তাই ঈশ্বরের দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে, সকল বস্তুর মধ্যে ভারসাম্য বজায় থাকাটা মানবজাতির উদ্বর্তনের পক্ষে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। তা উদ্ভিদই হোক কি প্রাণী, কোনোকিছুই তার যথাযথ ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতে পারে না। উদ্ভিদ, প্রাণী, পর্বত ও হ্রদ—মানবজাতির উদ্দেশ্যে ঈশ্বর একটি সুষম বাস্তুতান্ত্রিক প্রতিবেশ প্রস্তুত করেছেন। কেবলমাত্র এমন এক সুষম বাস্তুতান্ত্রিক পরিবেশ থাকলে তবেই মানুষের উদ্বর্তন সুরক্ষিত থাকতে পারে। যদি বৃক্ষ বা তৃণাদির বংশবিস্তারের ক্ষমতা নগণ্য হতো, কিংবা তাদের বংশবিস্তারের গতি অতীব মন্থর হতো, তাহলে কি মৃত্তিকা তার আর্দ্রতা হারিয়ে ফেলতো না? মৃত্তিকা যদি তার আর্দ্রতা হারিয়ে ফেলে তাহলে তখনো কি তা স্বাস্থ্যবান থাকবে? মৃত্তিকা যদি তার উদ্ভিজ্জ ও আর্দ্রতা হারিয়ে ফেলে, তখন তা খুব দ্রুত হারে ক্ষয়প্রাপ্ত হবে, এবং তার স্থলে বালুরাশি সঞ্চিত হবে। মৃত্তিকার ক্রমাবনতি ঘটলে মানুষের জীবনধারণের পরিবেশও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে যাবে। অনেক বিপর্যয় এই বিনাশের সঙ্গী হবে। এই প্রকার বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্য ও এহেন বাস্তুতান্ত্রিক পরিবেশ না থাকলে, সকলকিছুর মধ্যে ভারসাম্যহীনতার কারণে মানুষকে প্রায়শই বিপর্যয়ের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, যখন কোনো পরিবেশগত ভারসাম্যহীনতার কারণে ব্যাঙদের বাস্তুতান্ত্রিক পরিবেশ বিনষ্ট হয়, তারা সকলে তখন এক জায়গায় জড়ো হয়, তাদের সংখ্যা আচমকা বেড়ে যায়, এবং মানুষ এমনকি নগরীর মধ্যেও বিপুল সংখ্যক ব্যাঙকে রাস্তা পার হতে দেখে। বিপুল সংখ্যক ব্যাঙ যদি মানুষের জীবনধারণের পরিবেশ দখল করে বসতো, তাহলে ঘটনাটিকে কী বলা যেতো? এক বিপর্যয়। একে বিপর্যয় কেন বলা হতো? মানবজাতির পক্ষে হিতকর এই ক্ষুদ্র প্রাণীগুলি তখনই মানুষের কাজে লাগে যখন তারা তাদের জন্য উপযুক্ত একটা জায়গায় অবস্থান করে; তখন তারা মানুষের জীবনধারণের পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে। কিন্তু তারা যদি হয়ে ওঠে বিপর্যয়স্বরূপ, তখন তারা মানুষের জীবনের সুশৃঙ্খলাকে বিঘ্নিত করবে। ব্যাঙগুলি যে সকল পদার্থ ও উপাদান তাদের দেহের দ্বারা বহন করে আনে তা মানবজীবনের গুণমানকে প্রভাবিত করতে পারে। এমনকি তা মানুষের শারীরিক অঙ্গগুলির আক্রান্ত হবার কারণ হতে পারে—এ হল এক ধরনের বিপর্যয়। আরেক প্রকার বিপর্যয়, মানুষ মাঝেমাঝেই যার সম্মুখীন হয়েছে, তা হল বিপুল সংখ্যায় পঙ্গপালের প্রাদুর্ভাব। তা কি এক বিপর্যয় নয়? হ্যাঁ, তা বস্তুতই এক ভীতিপ্রদ বিপর্যয়। মানুষ কতটা সমর্থ তাতে কিছু যায় আসে না—মানুষ বিমানপোত, কামান, ও পারমাণবিক বোমা বানিয়ে থাকতে পারে—কিন্তু, পঙ্গপাল যখন আক্রমণ করে, মানবজাতির কাছে তার কী সমাধান রয়েছে? পঙ্গপালের উপর তারা কি কামান দাগতে পারে? যন্ত্রচালিত বন্দুক থেকে তাদের দিকে গুলি ছুঁড়তে পারে? না, পারে না। তাহলে তারা কি পঙ্গপাল বিতাড়নের উদ্দেশ্যে কীটনাশক প্রয়োগ করতে পারে? তা-ও মোটেই সহজ কাজ নয়। এই খুদে পঙ্গপালগুলি কী করতে আসে? তারা নির্দিষ্টভাবে ফসল ও খাদ্যশস্য খেয়ে ফেলে। পঙ্গপাল যেখানেই যায়, সমস্ত ফসল সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। পঙ্গপালের আক্রমণের সময়, যাবতীয় খাদ্য, যার উপর চাষীরা সারা বছরের জন্য নির্ভর করে, পঙ্গপালরা চোখের নিমেষে তা সম্পূর্ণ খেয়ে শেষ করে ফেলতে পারে। মানুষের কাছে, পঙ্গপালের প্রাদুর্ভাব নিছকই এক উপদ্রবমাত্র নয়—তা হল এক বিপর্যয়। তাহলে আমরা জানলাম যে বিশাল সংখ্যায় পঙ্গপালের আবির্ভাব হল এক ধরনের বিপর্যয়, কিন্তু ইঁদুরের ক্ষেত্রে বিষয়টা কী? ইঁদুর খাওয়ার মতো কোনো শিকারী পাখি যদি না থাকে, তাহলে ইঁদুরের সংখ্যা খুব দ্রুত হারে বেড়ে যাবে, তোমরা যতটা কল্পনা করতে পারো তার থেকেও দ্রুত হারে। আর ইঁদুর যদি অনিয়ন্ত্রিতভাবে ছড়িয়ে পড়ে, মানুষ কি তাহলে সন্তোষজনক জীবন যাপন করতে পারে? মানুষকে কী ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হতো? (মহামারীর সম্মুখীন হতো।) কিন্তু মহামারীই কি একমাত্র ফলশ্রুতি হতো বলে তোমাদের মনে হয়? ইঁদুর সবকিছুতে দাঁত বসাবে, এমনকি কাঠের উপরেও তারা একনাগাড়ে কামড়ে যাবে। একটা বাড়িতে যদি কেবল দুটি ইঁদুরও থাকে, তবু বাড়ির সকল বাসিন্দাদের কাছে তারা একটা উপদ্রব হয়ে উঠবে। কখনো তারা তেল চুরি করে খায়, আবার কখনো তারা রুটি বা খাদ্যশস্য খায়। আর যে দ্রব্য তারা খায় না, সেগুলিকে চিবিয়ে সম্পূর্ণ অব্যবহারযোগ্য করে ছাড়ে। জামাকাপড়, জুতো, আসবাবপত্র—সবকিছুকে তারা দাঁতে কাটে। কখনো সখনো তারা দেরাজের উপরেও চড়ে বসে—ইঁদুর বাসনকোসনের উপর দিয়ে চলে বেড়ানোর পরেও কি সেগুলি ব্যবহার করা যায়? এমনকি জীবাণুমুক্ত করার পরেও তখনো তুমি স্বস্তিবোধ করবে না, তাই সেগুলো তুমি বাইরে ফেলেই দেবে। ইঁদুর মানুষের জন্য এইসব উৎপাত নিয়ে আসে। ইঁদুর ছোটোখাটো জীব হলেও, মানুষের কাছে তাদের মোকাবিলা করার কোনো উপায় জানা নেই, পরিবর্তে তাদের লুঠতরাজ কেবলই সহ্য করে যেতে হয়। কেবল এক জোড়া ইঁদুরই ব্যাঘাত সৃষ্টি করার জন্য যথেষ্ট, এক দঙ্গলের কথা না-হয় ছেড়েই দাও। তাদের সংখ্যা যদি বৃদ্ধি পেতো এবং তারা বিপর্যয় হয়ে উঠতো, তাহলে পরিণাম হতো অকল্পনীয়। এমনকি, পিঁপড়ের মতো অতি ক্ষুদ্র জীবও বিপর্যয় হয়ে উঠতে পারে। তা যদি ঘটতো, তাহলে মানবজাতির যে ক্ষতি তারা করতো, তা-ও উপেক্ষণীয় হতো না। পিঁপড়েরা ঘরবাড়ির এতটাই ক্ষতিসাধন করতে পারে যে সেগুলি ধ্বসে পড়ে। পিঁপড়েদের শক্তিকে তাচ্ছিল্য করা যাবে না। নানা ধরনের পাখিও যদি এক বিপর্যয়ের সৃষ্টি করতো তাহলে কি তা ভীতিপ্রদ হয়ে উঠতো না? (হ্যাঁ।) অন্যভাবে বললে, যখনই প্রাণী ও জীবিত বস্তু, সে তারা যে প্রজাতিরই হোক, তাদের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলবে, তারা তখন সংখ্যায় বৃদ্ধি পাবে, বংশবিস্তার করবে, এবং এক অস্বাভাবিক পরিসরের মধ্যে, অনিয়মিত পরিসরের ভিতর বাস করবে। এবং তা মানবজাতির জন্য অকল্পনীয় পরিণাম বয়ে আনতো। তা শুধু মানুষের উদ্বর্তন ও জীবনধারণকেই প্রভাবিত করতো না, উপরন্তু মানবজাতির জন্য তা বিপর্যয়ও বয়ে আনতো, যা এমনকি মানুষের নিয়তি সম্পূর্ণ বিলয় ও বিলুপ্তি সংঘটনের পর্যায়েও উপনীতে হতে পারতো।
ঈশ্বর যখন সকল বস্তু সৃষ্টি করেছিলেন, তখন সেগুলিকে ভারসাম্যে স্থিত করতে, পর্বত ও হ্রদের, উদ্ভিদ ও সকল প্রকার পশু, পাখি ও পতঙ্গের জীবনধারণের পরিস্থিতির ভারসাম্যে নিশ্চিত করতে তিনি যাবতীয় প্রকারের পদ্ধতি ও উপায়সমূহ অবলম্বন করেছিলেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল সকল জীবিত সত্তাকে তাঁর দ্বারা প্রতিষ্ঠিত বিধানসমূহের অধীনে জীবনধারণ ও বংশবৃদ্ধি করার সুযোগ দান করা। সৃষ্টির কোনোকিছুই এই নিয়মগুলির বাইরে যেতে পারে না, এবং এই বিধানসমূহ অলঙ্ঘনীয়। কেবলমাত্র এহেন প্রাথমিক পরিবেশের মধ্যেই মানুষ প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সুরক্ষিতভাবে জীবনধারণ ও বংশবিস্তার করতে পারে। কোনো জীবিত সত্তা যদি ঈশ্বর-নির্ধারিত পরিমাণ বা পরিসরকে অতিক্রম করে যায়, বা যদি তা ঈশ্বর-নির্দেশিত বৃদ্ধির হার, প্রজনন পুনরাবৃত্তির হার, বা সংখ্যাকে ছাড়িয়ে যায়, তাহলে মানবজাতির জীবনধারণের পরিবেশকে বিভিন্ন মাত্রায় ধ্বংসের সম্মুখীন হতে হবে। এবং একই সাথে, মানবজাতির উদ্বর্তন বিপন্ন হয়ে উঠবে। যদি কোনো এক প্রকারের জীবিত সত্তা সংখ্যায় খুব বেশি হয়, তাহলে তা মানুষের খাদ্য ছিনিয়ে নেবে, মানুষের জলের উৎসকে ধ্বংস করবে, ও তাদের বাস্তুভূমির সর্বনাশ করবে। এই ভাবে, মানবজাতির বংশবিস্তার বা জীবনধারণের পরিস্থিতি তৎক্ষণাৎ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। উদাহরণস্বরূপ, সকল বস্তুর কাছেই জল খুব গুরুত্বপূর্ণ। ইঁদুর, পিঁপড়ে, পঙ্গপাল, ব্যাঙ বা যেকোনো প্রকারের অন্য পশু অত্যধিক সংখ্যায় বিদ্যমান হলে, তারা বেশি পরিমাণে জল পান করবে। তাদের পান করা জলের পরিমাণ বাড়লে, পানীয় জলের উৎস ও জলময় এলাকার সুনির্দিষ্ট পরিসরের মধ্যে মানুষের পানীয় জল ও জলের উৎস হ্রাস পাবে এবং তারা জলের ঘাটতির সম্মুখীন হবে। বিবিধ প্রকারের জীবজন্তু সংখ্যায় বৃদ্ধি পেয়েছে বলে মানুষের পানীয় জল যদি বিনষ্ট, সংক্রমিত, বা ব্যাহত হয়, তাহলে জীবনধারণের ওই রকম প্রতিকূল পরিবেশে মানবজাতির উদ্বর্তন গুরুতররূপে বিপন্ন হয়ে পড়বে। যদি কেবল এক প্রকারের বা বেশ কিছু প্রকারের জীবিত সত্তা তাদের যথাযথ সংখ্যাকে অতিক্রম করে যায়, তাহলে মানবজাতির জীবনধারণের পরিসরের মধ্যে বায়ু, উষ্ণতা, আর্দ্রতা, এমনকি বাতাসের উপাদানগত গঠনও বিভিন্ন মাত্রায় বিষাক্ত ও বিনষ্ট হবে। এহেন পরিস্থিতিতে, মানুষের উদ্বর্তন ও নিয়তিও এই বাস্তুতন্ত্রগত কারণসমূহের ফলস্বরূপ বিপন্নতার শিকার হবে। অতএব, এই ভারসাম্যগুলি যদি হারিয়ে যায়, তাহলে মানুষ শ্বাসপ্রশ্বাসের বায়ু বিনষ্ট হয়ে যাবে, তাদের পানীয় জল দুষিত হয়ে যাবে, এবং যে তাপমাত্রা তাদের দরকার তা-ও বিভিন্ন মাত্রায় পরিবর্তিত ও প্রভাবিত হবে। যদি তা-ই ঘটে, তাহলে মানবজাতি সহজাতভাবে জীবনধারণের যে পরিবেশের অধিকারী তা অপরিমেয় অভিঘাত ও পরীক্ষার সম্মুখীন হবে। এমনতর এক পরিস্থিতিতে, মানুষের জীবনধারণের প্রাথমিক পরিবেশ যেখানে ধ্বংস করা হয়েছে, সেখানে মানবজাতির নিয়তি ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা কী দাঁড়াবে? এ অত্যন্ত গুরুতর এক সমস্যা! যেহেতু ঈশ্বর জানেন ঠিক কী কারণে সৃষ্টির প্রতিটি বস্তু মানবজাতির স্বার্থে অস্তিমান, তাঁর দ্বারা সৃজিত প্রতিটি প্রকারের বস্তুর ভূমিকা কী, মানবজাতির উপর প্রতিটি বস্তুর প্রভাব কী ধরনের, এবং সেগুলি কতো মাত্রায় মানবজাতির উপকার সাধন করে, যেহেতু এই সকল বিষয়ে ঈশ্বরের অন্তরে একটা পরিকল্পনা রয়েছে, এবং যেহেতু তাঁর সৃষ্ট সকল বস্তুকে প্রত্যেকটি বিষয়েই তিনি পরিচালনা করেন, সেহেতু তাঁর সম্পাদিত প্রতিটি কার্য মানবজাতির পক্ষে এত গুরুত্বপূর্ণ ও আবশ্যক। অতএব, এখন থেকে, ঈশ্বরের সৃষ্টির বস্তুসমূহের মধ্যে যখনই তুমি কোনো বাস্তুতান্ত্রিক সংঘটন পর্যবেক্ষণ করবে, বা কোনো প্রাকৃতিক নিয়মকে ক্রিয়ারত দেখবে, তখন তুমি আর ঈশ্বরের সৃষ্ট প্রতিটি জিনিসের আবশ্যকতা বিষয়ে সন্দিহান হবে না। তুমি আর ঈশ্বরের দ্বারা সকল বস্তুর সুবিন্যস্তকরণ এবং মানবজাতির সংস্থান সরবরাহের উদ্দেশ্যে তাঁর দ্বারা গৃহীত বিভিন্ন পদ্ধতির বিষয়ে অজ্ঞতাপ্রসূত শব্দাবলী প্রয়োগের মাধ্যমে যদৃচ্ছ বিচার জাহির করবে না। তাঁর সৃষ্টির সকল বস্তুর জন্য ঈশ্বরের নির্ধারিত যে বিধানসমূহ রয়েছে, সেগুলির বিষয়েও তুমি কোনো অযৌক্তিক সিদ্ধান্তে উপনীত হবে না। বিষয়টি এমনই নয় কি?
এক্ষুনি আমরা যে বিষয়সকল নিয়ে আলোচনা করলাম, সেগুলি কী? একবার তা ভেবে দেখো। ঈশ্বরের দ্বারা সম্পাদিত প্রতিটি কাজের পিছনে তাঁর নিজস্ব অভিপ্রায় রয়েছে। যদিও মানুষের কাছে তাঁর অভিপ্রায় দুর্জ্ঞেয়, তবু মানবজাতির জীবনধারণের সঙ্গে সর্বদা তা ওতপ্রোত ও দৃঢ়ভাবে সম্পর্কিত। এটি সম্পূর্ণরূপে অপরিহার্য। তার কারণ, ঈশ্বর কখনো নিরর্থক কিছু করেননি। তাঁর প্রতিটি কার্যের নিহিত নীতিগুলি তাঁর পরিকল্পনা ও প্রজ্ঞা দ্বারা সম্পৃক্ত। সেই পরিকল্পনার লক্ষ্য ও অভিপ্রায় হল মানবজাতিকে সুরক্ষিত রাখা; বিপর্যয়, অন্যান্য জীবিত সত্তার আক্রমণ, এবং ঈশ্বর-সৃষ্ট যেকোনো বস্তুর কারণে সংঘটিত যেকোনো রকম অনিষ্টকে এড়াতে মানবজাতিকে সহায়তা করা। তাহলে, এমন কি বলা যায়, যে, ঈশ্বরের যে সকল কার্যাবলী আমরা এই প্রসঙ্গের আলোচনাক্রমে লক্ষ্য করেছি সেগুলি ঈশ্বরের মানবজাতির জন্য রসদ সংস্থানের আরেকটি উপায় নির্দেশ করে? আমরা কি বলতে পারতাম, এই কাজগুলির মাধ্যমে ঈশ্বর মানবজাতিকে খাদ্য সরবরাহ ও পরিচালিত করেন? (হ্যাঁ।) বর্তমান প্রসঙ্গ ও আমাদের আলোচনার মূল বিষয়বস্তু: “সকল বস্তুর প্রাণের উৎস হলেন ঈশ্বর”—উভয়ের মধ্যে ওতপ্রোত কোনো সম্পর্ক রয়েছে কি? (হ্যাঁ।) খুব মজবুত একটা সম্পর্ক রয়েছে, এবং বর্তমান প্রসঙ্গটি হল মূল বিষয়বস্তুর একটি দিক মাত্র। এই বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা করার পূর্বে ঈশ্বরের বিষয়ে, স্বয়ং ঈশ্বর ও তাঁর কার্যাবলীর বিষয়ে মানুষের কেবল একটি অস্পষ্ট কল্পনা ছিল—তাদের প্রকৃত কোনো উপলব্ধি ছিল না। কিন্তু, মানুষকে যখন তাঁর কার্যকলাপ এবং যাকিছু তিনি করেছেন সেবিষয়ে বলা হয়, তখন তারা ঈশ্বর যা করেন সেগুলির নীতিসমূহ উপলব্ধি ও হৃদয়ঙ্গম করতে পারে, এবং এই বিষয়গুলি সম্বন্ধে তারা উপলব্ধি অর্জন করতে পারে, আর সেগুলি তাদের বোধগম্যতার আয়ত্তাধীন হয়। যদিও ঈশ্বর যখনই সকল বস্তুর সৃজন বা শাসনের মতো কোনো কার্য সাধন করেন, তখন তাঁর হৃদয়ে বিবিধ প্রকারের অত্যন্ত জটিল সব তত্ত্ব, নীতি ও নিয়মকানুন থাকে, তবু, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে তোমাদের এগুলির বিষয়ে কেবল একটা অংশও শেখার সুযোগ করে দিলে, তোমাদের অন্তরে এটুকু উপলব্ধি লাভ করা কি তোমাদের পক্ষে সম্ভব নয়, যে, এগুলি ঈশ্বরের কার্যকলাপ এবং এগুলি যথাসম্ভব বাস্তব? (হ্যাঁ, সম্ভব।) তাহলে ঈশ্বরের বিষয়ে তোমাদের সাম্প্রতিক উপলব্ধি কীভাবে পূর্বের উপলব্ধির থেকে স্বতন্ত্র? এটি উপাদানগতভাবে পৃথক। পূর্বে, তোমাদের উপলব্ধি ছিল অতি অন্তঃসারশূন্য, অতি অস্পষ্ট; কিন্তু এখন তোমাদের উপলব্ধির মধ্যে ঈশ্বরের ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে মানানসই, ঈশ্বরের যা আছে ও তিনি যা তার সাথে মানানসই, প্রভূত সুনির্দিষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণ আছে। সেই কারণেই, আমি যাকিছু আলোচনা করেছি, তা তোমাদের ঈশ্বর-উপলব্ধির ক্ষেত্রে চমকপ্রদ শিক্ষাবিষয়ক উপকরণ।
—বাক্য, খণ্ড ২, ঈশ্বরকে জানার প্রসঙ্গে, স্বয়ং অনন্য ঈশ্বর ৯