কীভাবে ঈশ্বর আধ্যাত্মিক জগতকে শাসন ও পরিচালনা করেন: বিভিন্ন বিশ্বাসী মানুষের জীবন-মৃত্যুর চক্র
আমরা এইমাত্র প্রথম শ্রেণি, অর্থাৎ অবিশ্বাসী মানুষের জীবন-মৃত্যুর চক্রের বিষয়ে আলোচনা করেছি। এখন, দ্বিতীয় শ্রেণির মানুষ, অর্থাৎ বিভিন্ন বিশ্বাসী মানুষের বিষয়ে আলোচনা করা যাক। “বিভিন্ন বিশ্বাসী মানুষের জীবন-মৃত্যুর চক্র”—এটি হল আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং এই বিষয়টিকে কিছু হলেও উপলব্ধি করা তোমাদের পক্ষে খুবই দরকারি। প্রথমত, আমাদের জানা উচিত, “বিভিন্ন বিশ্বাসী মানুষের” মধ্যে “বিশ্বাস” বলতে কোন ধর্মবিশ্বাসের কথা বলা হচ্ছে: প্রধান পাঁচটি ধর্ম হল ইহুদি, খ্রীষ্টীয়, ক্যাথলিক, ইসলাম এবং বৌদ্ধ ধর্ম। অবিশ্বাসীরা ছাড়াও, এই পাঁচটি ধর্মের বিশ্বাসী মানুষেরা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে। এই পাঁচটি ধর্মের মধ্যে, নিজেদের বিশ্বাস থেকে পেশা বা কর্মজীবন গঠনকারী লোকের উদাহরণ কম, তবুও এই সব ধর্মের অনেক অনুসারী রয়েছে। মৃত্যুর পর তারা একটি ভিন্ন স্থানে যাবে। কীসের থেকে “ভিন্ন”? অবিশ্বাসী—যারা বিশ্বাসহীন মানুষ—যাদের কথা এইমাত্র আলোচনা করলাম—তাদের থেকে ভিন্ন৷ এই পাঁচটি ধর্মের বিশ্বাসীরা মৃত্যুর পর অবিশ্বাসীদের থেকে আলাদা কোনো স্থানে চলে যায়। তবে, এখানেও সেই একই প্রক্রিয়া বিদ্যমান থাকে; মৃত্যুর আগে তারা যা করেছিল তার ভিত্তিতে আধ্যাত্মিক জগতে তাদের বিচার করা হবে, তারপরে সেই অনুযায়ী তাদের প্রক্রিয়াকরণ ঘটবে। তবু, কেন এই লোকেদের প্রক্রিয়াকরণের জন্য পৃথক স্থানে প্রেরণ করা হয় কেন? এর একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে। সেটি কী? আমি তোমাদের একটা উদাহরণ দিয়ে তা ব্যাখ্যা করব। তবে, তার আগে, তোমরা হয়তো নিজেদের মনে ভাবছ: “তাদের ঈশ্বরে একটু হলেও বিশ্বাস আছে বলেই হয়ত এমনটা হয়! তারা তো সম্পূর্ণ অবিশ্বাসী নয়।” তবে, কারণটা এটা নয়। তাদের অন্যদের থেকে ভিন্ন স্থানে রাখার পিছনে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কারণ রয়েছে।
উদাহরণ হিসাবে বৌদ্ধ ধর্মের কথাই নেওয়া যাক। আমি তোমাদের একটা ঘটনা বলি। একজন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ব্যক্তি হল, প্রথমত এমন একজন যে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হয়েছে, যে তার বিশ্বাসের বিষয়ে অবগত। যখন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ব্যক্তি মাথা ন্যাড়া করে সন্ন্যাসী বা সন্ন্যাসিনী হয়, তার অর্থ হল তারা ধর্মনিরপেক্ষ বিশ্ব থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে, মনুষ্য জগতের কোলাহলকে পিছনে ফেলে চলে এসেছে। প্রত্যহ তারা সূত্র পাঠ করে, বুদ্ধের নাম জপ করে, কেবলমাত্র নিরামিষ ভোজন করে, সন্ন্যাস জীবন পালন করে, এবং মাখনের প্রদীপের স্মিত, শীতল স্বল্প আলোকে দিনাতিপাত করে। তারা এইভাবেই তাদের সমগ্র জীবন নির্বাহ করে। একজন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মানুষের ভৌত জীবনের অবসান ঘটলে, তারা নিজেদের জীবনের একটা সংক্ষিপ্তসার তৈরি করবে, কিন্তু মৃত্যুর পর তারা কোথায় যাবে, কার সাথে সাক্ষাত করবে, বা তাদের পরিণতি কী হবে, সে বিষয়ে তারা অন্তরে অনবগত থাকবে: তাদের অন্তরের অন্তঃস্থলে এই বিষয়ে কোনো স্পষ্ট ধারণা থাকবে না। তারা সারা জীবন অন্ধভাবে এক ধরনের বিশ্বাস বহন করা ছাড়া আর কিছুই করবে না, তারপর তারা নিজেদের সকল অন্ধ ইচ্ছা এবং আদর্শ সহ মনুষ্যলোক থেকে বিদায় নেবে। জীবজগত ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় বৌদ্ধদের দৈহিক জীবনের অবসান এইভাবেই ঘটে; এর পরে, তারা আধ্যাত্মিক জগতে তাদের আদি স্থানে ফিরে আসে। সেই ব্যক্তি পুনর্জন্ম লাভ করে পৃথিবীতে ফিরে যাবে কিনা এবং আত্মচর্চা চালিয়ে যাবে কিনা, তা মৃত্যুর পূর্বে তাদের করা আচরণ এবং অনুশীলনের উপর নির্ভর করে। জীবদ্দশায় কোনো ভুল না করলে, তারা দ্রুত পুনর্জন্ম লাভ করবে এবং আবার পৃথিবীতে প্রেরিত হবে, সেখানেও তারা আরও একবার সন্ন্যাসী বা সন্ন্যাসিনী হয়ে উঠবে। অর্থাৎ, তারা তাদের জীবনকালে প্রথমবার যেভাবে আত্মচর্চা অনুশীলন করেছিল, সেভাবেই আত্মচর্চা চালিয়ে যাবে, এবং তারপর ভৌত জীবনকাল শেষ হওয়ার পরে আধ্যাত্মিক জগতে ফিরে আসবে, যেখানে তাদের পরীক্ষা করা হবে। তারপরে, কোনো সমস্যা না থাকলে, তারা পুনরায় মনুষ্যজগতে প্রত্যাবর্তন করতে পারে এবং আরও একবার বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হতে পারে, এইভাবে তাদের অনুশীলন চলতে থাকে। তিন থেকে সাতবার পুনর্জন্ম লাভের পর, তারা আবারও আধ্যাত্মিক জগতে অর্থাৎ, যে স্থানে প্রতিবার জীবদ্দশার শেষে ফিরে আসে, সেখানে ফিরবে। মনুষ্যজগতে তাদের বিভিন্ন যোগ্যতা ও আচরণ যদি আধ্যাত্মিক জগতের স্বর্গীয় আদেশের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হয়ে থাকে, তবে, সেই বিন্দু থেকে, তারা সেখানেই থেকে যাবে; তারা আর মানুষ হিসাবে পুনর্জন্ম লাভ করবে না, পৃথিবীতে করা অন্যায়ের জন্য শাস্তি পাওয়ার ঝুঁকি থেকেও তারা বেঁচে যাবে। তাদের আর কখনো এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে না। বরং, তাদের পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে, তারা আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে একটি পদ অর্জন করতে পারবে। এটিকেই বৌদ্ধরা “বুদ্ধত্ব অর্জন করা” বলে উল্লেখ করে। বুদ্ধত্ব অর্জনের প্রধান অর্থ হল আধ্যাত্মিক জগতের একজন আধিকারিকের পদলাভের সাফল্য অর্জন করা, এবং তারপরে আর পুনর্জন্ম লাভের অথবা শাস্তি পাওয়ার ঝুঁকির মধ্যে না থাকা। তদুপরি, এর অর্থ হল মানুষ হিসাবে পুনর্জন্ম লাভের পরে আর যন্ত্রণাভোগ না করা। তাহলে, তাদের পশু হিসাবে পুনর্জন্মলাভের কি আর কোনো সম্ভাবনা থাকে? (না।) এর অর্থ হল তারা আধ্যাত্মিক জগতে নিজেদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে এবং তাদের আর পুনর্জন্ম হবে না। এটাই হল বৌদ্ধ ধর্মে বুদ্ধত্ব অর্জনের পরিণতি। যারা এই ফল অর্জন করতে পারে না, আধ্যাত্মিক জগতে প্রত্যাবর্তনের পরে তারা আবারও সংশ্লিষ্ট আধিকারিকের দ্বারা যাচাইকরণ ও পরীক্ষার সম্মুখীন হয়, যারা আবিষ্কার করে যে জীবদ্দশায় তারা অধ্যবসায় সহকারে আত্মচর্চা করেনি অথবা বৌদ্ধধর্মের নির্দেশিত সূত্র পাঠ এবং বুদ্ধের নাম জপ করার ক্ষেত্রে বিবেকবান ছিল না, বরং এর পরিবর্তে অনেক মন্দ কাজ ও অসদাচরণে লিপ্ত ছিল। তখন, আধ্যাত্মিক জগতে তাদের মন্দ কর্মের বিচার করা হয়, এবং তদনুসারে তাদের নিশ্চিতভাবেই শাস্তি দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে কোনোরকম ব্যতিক্রম হয় না। এইভাবে, কোনো ব্যক্তি কখন কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জন করতে পারে? যে জীবনকালে তারা কোনোরকম মন্দ কর্মে লিপ্ত হয় না—তার সমাপ্তিতে যখন আধ্যাত্মিক জগতে তারা ফিরে আসে, দেখা যায় যে মৃত্যুর পূর্বে তারা কোনো খারাপ কাজ করেনি। তারপরে তারা পুনর্জন্ম লাভ করে, সূত্র পাঠ এবং বুদ্ধের নাম উচ্চারণ চালিয়ে যায়, মাখনের প্রদীপের শীতল, স্তিমিত আলোকে দিনাতিপাত করে যায়, কোনও জীবন্ত সত্তাকে হত্যা করা বা আমিষ খাওয়া থেকে বিরত থাকে। তারা মনুষ্যজগতে অংশ নেয় না, এই জগতের সমস্যাকে পিছনে ফেলে আসে এবং অন্যান্যদের সাথে কোনোরকম বিরোধে জড়ায় না। এই পদ্ধতি অনুসারে, যদি তারা কোন মন্দ কাজ না করে থাকে, তবে আধ্যাত্মিক জগতে ফিরে আসার পরে এবং তাদের দ্বারা কৃত সমস্ত ক্রিয়াকলাপ এবং আচরণ পরীক্ষা করার পরে, তাদেরকে পুনরায় মনুষ্যজগতে প্রেরণ করা হয়, এক একটা চক্রে তিন থেকে সাতবার এমন ঘটনা ঘটে। এই সময়ের মধ্যে যদি কোনোরকম অসদাচরণ না করা হয়, তবে তাদের বুদ্ধত্বপ্রাপ্তি প্রভাবিত এবং বিলম্বিত হবে না। বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাসী মানুষদের জীবন-মৃত্যুর চক্রে এই বৈশিষ্ট্যটি প্রতীয়মান থাকে: তারা কাঙ্ক্ষিত “ফলাফল অর্জন” করতে এবং আধ্যাত্মিক জগতে পদ অধিকার করতে পারে; এটাই তাদেরকে অবিশ্বাসীদের থেকে আলাদা করে দেয়। প্রথমত, আধ্যাত্মিক জগতে পদ গ্রহণ করতে সক্ষম লোকেরা পৃথিবীতে জীবদ্দশায় কীভাবে আচরণ করবে? তাদের কোনোভাবেই মন্দ কাজে লিপ্ত হওয়া চলবে না: তারা খুন, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ বা লুণ্ঠন করবে না; যদি তারা প্রতারণা, তছরুপ, চুরি বা ডাকাতির সাথে জড়িত থাকে, তবে কোনো ফল লাভ করতে পারবে না। অন্যভাবে বললে, যদি কোনো মন্দ কর্ম বা তদনুরূপ কোনো কিছুর সাথে তাদের কোনো সংযোগ বা সংশ্লিষ্টতা থাকে, তবে তারা আধ্যাত্মিক জগতের শাস্তির হাত থেকে বাঁচতে পারবে না। আধ্যাত্মিক জগতে বুদ্ধত্ব অর্জনকারী বৌদ্ধদের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা রয়েছে: তাদেরকে বৌদ্ধধর্মে,এবং আকাশে অবস্থিত প্রবীণ মানুষে বিশ্বাসী লোকেদের পরিচালনায় নিযুক্ত করা যেতে পারে—তাদেরকে একটি এক্তিয়ার বরাদ্দ করা যেতে পারে। তাদের শুধুমাত্র অবিশ্বাসীদের দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে, বা খুব ছোট দায়িত্ব অর্পণ করা হতে পারে। আত্মার বিভিন্ন প্রকৃতি অনুসারে এই ধরনের বরাদ্দকরণ ঘটে। এ-ই হল বৌদ্ধ ধর্মের একটি উদাহরণ।
আমি যে পাঁচটি ধর্মের কথা বললাম, তাদের মধ্যে খ্রীষ্ট ধর্ম তুলনামূলকভাবে বিশিষ্ট। কোন বিষয়টা খ্রীষ্ট ধর্মকে এত বিশেষ করে তোলে? এই ধর্মাবলম্বীরাই একমাত্র সত্য ঈশ্বরে বিশ্বাস করে। একমাত্র ঈশ্বরে বিশ্বাসীদের কীভাবে এখানে তালিকাভুক্ত করা হয়? খ্রীষ্টধর্ম যে এক ধরনের বিশ্বাস, তা বলার মধ্যে দিয়েই বোঝা যায় যে, তা নিঃসন্দেহে বিশ্বাসের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হতে হবে, যে, তা হতে হবে শুধুই এক ধরনের অনুষ্ঠান, এক ধরনের ধর্ম, এবং যারা প্রকৃতপক্ষেই ঈশ্বরের অনুসরণ করে, তাদের বিশ্বাস থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয় হতে হবে। আমি যে পাঁচটি প্রধান ধর্মের মধ্যে খ্রীষ্টধর্মকে তালিকাভুক্ত করেছি, তার কারণ হল, এটিও ইহুদি, বৌদ্ধ এবং ইসলামের মতো একই স্তরে অবনমিত হয়েছে। এখানে অধিকাংশ মানুষই বিশ্বাস করে না যে ঈশ্বর বলে কেউ আছেন, অথবা, যে, তিনি সব কিছুর শাসন করেন; আর তাঁর অস্তিত্বে বিশ্বাস করা তো আরোই দূরের কথা। পরিবর্তে, তারা শুধুমাত্র ধর্মগ্রন্থ ব্যবহার করে ধর্মতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করে, এবং সেই ধর্মতত্ত্ব ব্যবহার করে মানুষকে সদয় হতে, দুঃখকষ্ট সহ্য করতে এবং ভাল কাজ করতে শেখায়। খ্রীষ্ট ধর্ম এখন এমন ধর্মেই পর্যবসিত হয়েছে: তাতে এখন শুধুমাত্র ধর্মতত্ত্বের তাত্ত্বিক দিকই সন্নিবিষ্ট থাকে, তা আর ঈশ্বরের দ্বারা মানুষের ব্যবস্থাপনা ও উদ্ধারকার্যের বিন্দুমাত্র সম্পর্কযুক্ত নয়। তা এখন ধর্ম হয়ে উঠেছে এমন এক ধরনের মানুষের, যারা ঈশ্বরকে অনুসরণ করলেও, আদতে তাঁর দ্বারা স্বীকৃত নয়। তবুও, এই ধরনের মানুষের ক্ষেত্রেও ঈশ্বরের অভিগম্যতার কিছু নীতি বিদ্যমান। তিনি অবিশ্বাসীদের ক্ষেত্রে যেমন ইচ্ছাপূর্বক মোকাবিলা বা পরিচালনা করেন, এদের ক্ষেত্রে কিন্তু তা করেন না। তিনি বৌদ্ধদের সাথে যেমন আচরণ করেন, এদের সাথেও অনুরূপ ভাবেই আচরণ করেন: যদি জীবদ্দশায় কোনো খ্রীষ্টান আত্মনিয়ন্ত্রণ করতে পারে, দশটি আদেশ কঠোরভাবে মেনে চলতে পারে, এবং বিধান ও নীতিসমূহ অনুসরণে আচরণে সচেষ্ট হতে পারে, এবং জীবৎকাল সেগুলি পালন করে চলতে পারে, তাহলে প্রকৃতপক্ষেই তথাকথিত “উন্নীত হওয়ার” অবস্থা অর্জন করার আগে, তাদেরও অবশ্যই জীবন-মৃত্যুর চক্রের মধ্যে একই পরিমাণ সময় অতিবাহিত করতে হবে। এই উন্নীত অবস্থা অর্জনের পর, তারা আধ্যাত্মিক জগতেই রয়ে যায় আর একটি পদ লাভ করে আধিকারিক হিসাবে অবস্থান করে। তেমনই, যদি তারা পৃথিবীতে থাকাকালীন মন্দ কর্ম করে—যদি তারা খুবই পাপী হয় এবং অনেক মন্দ কাজ করে থাকে—তাহলে তাদের অনিবার্যভাবে শাস্তি দেওয়া হবে এবং বিভিন্ন মাত্রায় অনুশাসন করা হবে। বৌদ্ধ ধর্মে, ফলাফল অর্জনের অর্থ হল পরম সুখের শুদ্ধ ভূমিতে স্থানান্তরিত হওয়া, কিন্তু খ্রীষ্টধর্মের ক্ষেত্রে একে কী বলা হয়? একে বলা হয় “স্বর্গে প্রবেশ করা” এবং “উন্নীত হওয়া”। যারা প্রকৃতপক্ষে উন্নীত হয়, তাদেরকেও তিন থেকে সাতবার জীবন ও মৃত্যুর চক্রের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, তারপর, জীবনাবসানে, তারা আধ্যাত্মিক জগতে ফিরে আসে, ঠিক যেন তারা ঘুমিয়ে পড়েছিল। তারা যদি মানসম্মত হয়, তাহলে পদ গ্রহণ করার জন্য সেখানে থেকে যেতে পারে, তাদের আর পৃথিবীর লোকের মতো সাধারণ উপায়ে বা গতানুগতিকভাবে পুনর্জন্ম লাভ করতে হবে না।
এই সমস্ত ধর্মের মধ্যে,যে অন্তিম অবস্থার কথা বলা হয়, বা যে পরিণামের উদ্দেশ্যে সকলে সচেষ্ট থাকে, তা বৌদ্ধ ধর্মের ফলাফল অর্জনের সমান; কেবলমাত্র পার্থক্য হল যে, এই “ফলাফল” অর্জনের উপায়গুলি আলাদা। তারা সকলেই একই গোষ্ঠীভুক্ত। এই সমস্ত ধর্মের এই অংশের অনুসারী, যারা নিজেদের আচরণের মাধ্যমে কঠোরভাবে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলে, ঈশ্বর তাদের যথাযথ গন্তব্য, গমনের পক্ষে উপযুক্ত স্থান প্রদান করেন, তাদের উপযুক্তভাবে পরিচালনা করেন। এগুলির সমস্তটাই যৌক্তিক হলেও, মানুষ যেভাবে তা কল্পনা করে, তেমনটা আসলে নয়। এখন তোমরা শুনে নিয়েছ যে খ্রীষ্ট ধর্মাবলম্বীদের সাথে কী ঘটে, তাহলে তোমাদের এখন কী মনে হচ্ছে? তোমাদের কী মনে হয় যে তাদের এই দুর্দশা অন্যায্য? তোমরা কি তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল? (একটু।) এখানে কিছুই করার নেই; তারা কেবল নিজেদেরই দোষারোপ করতে পারে। আমি কেন এমন বলছি? ঈশ্বরের কাজ সত্য; তিনি জীবন্ত এবং বাস্তবিক, তাঁর কাজ সমস্ত মানবজাতি এবং প্রত্যেকটি জীবের উদ্দেশ্যেই সম্পাদিত হয়। তাহলে কেন তারা এটা মেনে নিতে পারে না? তারা কেন এত উন্মত্তভাবে ঈশ্বরের বিরোধিতা করে, তাঁকে নিগ্রহ করে? এই ধরণের ফলাফল প্রাপ্তির জন্য তাদের অন্তত নিজেদের ভাগ্যবান বলেই মনে করা উচিত, তাহলে তোমরা কেন তাদের জন্য দুঃখিত? তাদের এইভাবে পরিচালনা করাটাও মহান সহনশীলতার পরিচায়ক। যে মাত্রায় তারা ঈশ্বরের বিরোধিতা করে, তাতে তাদের ধ্বংস করে দেওয়াই উচিত, তবুও কিন্তু ঈশ্বর তা করেন না; পরিবর্তে তিনি সাধারণ ধর্মের মতোই খ্রীষ্টধর্মকেও পরিচালনা করেন। সুতরাং, অন্যান্য ধর্ম সম্পর্কে আরও বিশদে যাওয়ার দরকার আছে কি? এই সমস্ত ধর্মের নীতি হল যে, মানুষ আরও কষ্ট সহ্য করবে, কোনো মন্দ কর্ম করবে না, সুকর্ম করবে, অন্যকে গালিগালাজ করবে না, অন্যের প্রতি বিচারের মনোভাব পোষণ করবে না, বিবাদ থেকে নিজেকে দূরে রাখবে এবং একজন ভালো মানুষ হবে—অধিকাংশ ধর্মীয় শিক্ষাই এমনতর। সুতরাং, যদি এই সকল বিশ্বাসী মানুষ—বিভিন্ন ধর্ম এবং সম্প্রদায়ের অনুগামীগণ—তাদের নিজ-নিজ ধর্মের নীতিসমূহ কঠোরভাবে অনুসরণ করতে পারে, তাহলে তারা এই পৃথিবীতে তাদের অতিবাহিত সময়কালে মারাত্মক কোনও ভ্রান্তি অথবা পাপকার্য থেকে বিরত থাকবে; এবং, তিন থেকে সাত বার পুনর্জন্ম লাভের পর এই সকল ব্যক্তি—যারা ধর্মীয় নীতিসমূহ কঠোরভাবে পালনে সক্ষম—তারা মূলত আধ্যাত্মিক জগতে পদমর্যাদা ও অবস্থান গ্রহণ করে। এই ধরণের কি প্রচুর মানুষ রয়েছে? (না, আদৌ নেই।) তোমার উত্তরের ভিত্তি কী? ভালো কাজ করা এবং ধর্মীয় জগতের নীতি ও নিয়মগুলি পালন করে চলা সহজ নয়। বৌদ্ধ ধর্মে মাংস খাওয়া অনুমোদিত নয়—তুমি কি তা পারবে? যদি তোমাকে ধূসর পরিধান পরে, সারা দিন বুদ্ধ মন্দিরে সূত্র পাঠ এবং বুদ্ধের নাম জপ করতে হত, তুমি কি তা পারতে? এটা সহজ হত না। খ্রীষ্ট ধর্মে দশটি আদেশ রয়েছে, এই আদেশ এবং নিয়মগুলি পালন করা কি সহজ? না তা নয়, তাই না? উদাহরণ হিসাবে অন্যদের গালমন্দ করার বিষয়টাই ধরো: মানুষ এই নিয়ম মেনে চলতে অপারগ। নিজেদের আটকাতে না পেরে, তারা গালমন্দ করে ফেলে—আর তা করার পরে আর সেই কথাগুলি ফিরিয়ে নেওয়া যায় না, তাই তারা কী করে? রাতের বেলা তারা নিজেদের পাপ স্বীকার করে। অনেক সময় অন্যান্যদের গালমন্দ করার পরেও তাদের নিজেদের মনে ঘৃণা সঞ্চিত থাকে, আর সেগুলির মাত্রা ছাড়িয়ে এমন পর্যায়ে চলে যায় যে, তারা সময় বার করে সেই মানুষগুলির আরও ক্ষতিসাধন করার ফন্দি আঁটে। সংক্ষেপে, যারা নিষ্প্রাণ মতবাদ আঁকড়ে বাঁচে, তাদের পক্ষে পাপ বা মন্দ কর্ম করা থেকে নিজেদের আটকানো সম্ভব নয়। অতএব, প্রত্যেক ধর্মেই শুধুমাত্র মুষ্টিমেয় কিছু মানুষই এই ফলাফল অর্জন করতে পারে। তুমি কি মনে করো যে, এত বেশি সংখ্যক মানুষ এই ধর্ম অনুসরণ করার জন্য এদের বেশ বৃহৎ একটা অংশ আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে পদ বা ভূমিকা লাভে সক্ষম হবে? তাদের সংখ্যা বেশি নয়; কেবল কয়েকজনই তা অর্জন করতে পারে। এটাই হল বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাসী মানুষদের জীবন-মৃত্যুর সাধারণ চক্র। ফলাফল অর্জনের বিষয়টাই তাদের আলাদা করে, আর এই বিষয়টাই তাদের অবিশ্বাসীদের থেকে পৃথক করে দেয়।
—বাক্য, খণ্ড ২, ঈশ্বরকে জানার প্রসঙ্গে, স্বয়ং অনন্য ঈশ্বর ১০