পুনরুত্থানের পর তাঁর শিষ্যদের প্রতি যীশুর উক্তি
যোহন ২০:২৬-২৯ এক সপ্তাহ পর আবার শিষ্যরা একটি ঘরে একত্র হয়ে ছিলেন। থোমাও ছিলেন তাঁদের সঙ্গে। ঘরের সব দরজা বন্ধ থাকা সত্ত্বেও যীশু আবির্ভূত হলেন সেখানে। তাঁদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বললেন, তোমাদের শান্তি হোক! তারপর থোমাকে বললেন, এখানে তোমার আঙ্গুল দাও, দেখ আমার হাত দুখানি। হাত বাড়িয়ে আমার কুক্ষিদেশ স্পর্শ কর। সংশয় রেখো না মনে, বিশ্বাস কর। থোমার কন্ঠ থেকে উৎসারিত হল, প্রভু আমার, ঈশ্বর আমার! যীশু তাঁকে বললেন, তুমি আমায় দেখেছ বলেই বিশ্বাস করলে। ধন্য তারা, যারা আমায় না দেখে বিশ্বাস করে।
যোহন ২১:১৬-১৭ যীশু দ্বিতীয়বার তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, যোহনের পুত্র শিমোন, তুমি কি আমায় ভালবাস? তিনি তাঁকে বললেন, হ্যাঁ প্রভু, আপনি জানেন, আপনাকে আমি ভালবাসি। যীশু তাঁকে বললেন, তাহলে আমার মেষপালের তত্ত্বাবধান কর। তিনি তৃতীয়বার বললেন, যোহনের পুত্র শিমোন, তুমি কি আমায় ভালবাস? তৃতীয়বার যীশু ‘তুমি কি আমায় ভালবাস’-এ কথা জিজ্ঞাসা করায় পিতর খুব ক্ষুণ্ণ হলেন। বললেন, প্রভু, আপনি তো সবই জানেন। আপনি জানেন যে আপনাকে আমি ভালবাসি। যীশু তাঁকে বললেন, আমার মেষগুলিকে চরাও।
তাঁর পুনরুত্থানের পর প্রভু যীশু তাঁর শিষ্যদের নিকট যে বিশেষ কিছু কার্য সম্পাদন ও বাক্য উচ্চারণ করেছিলেন, এই অনুচ্ছেদগুলি তা-র বিবরণ দেয়। প্রথমে, পুনরুত্থানের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী প্রভু যীশুর মধ্যে যদি কোনো পার্থক্য থেকে থাকে, তবে সেদিকে একবার তাকিয়ে দেখা যাক। তিনি কি তখনো বিগত দিনের সেই একই প্রভু যীশু ছিলেন? শাস্ত্রে পুনরুত্থান পরবর্তী প্রভু যীশুর বর্ণনাসূচক নিম্নলিখিত পঙক্তিটি রয়েছে: “ঘরের সব দরজা বন্ধ থাকা সত্ত্বেও যীশু আবির্ভূত হলেন সেখানে। তাঁদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বললেন, তোমাদের শান্তি হোক।” এটা খুব পরিষ্কার যে, সেই সময়ে প্রভু যীশু আর কোনো পার্থিব দেহে বাস করছিলেন না, বরং তখন তিনি এক আধ্যাত্মিক দেহে অবস্থান করছিলেন। এর কারণ তিনি দেহের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে গিয়েছিলেন; যদিও দরজা বন্ধ ছিল, তবু তিনি মানুষের মাঝে আবির্ভূত হয়ে তাদের দেখা দিতে পেরেছিলেন। এ হল পুনরুত্থানের পরবর্তীকালীন প্রভু যীশু ও পুনরুত্থানের পূর্বে দেহরূপে জীবনধারণরত প্রভু যীশুর মধ্যে সবচেয়ে বড়ো তফাৎ। যদিও সেই মুহূর্তের আধ্যাত্মিক শরীরের রূপ ও পূর্বের প্রভু যীশুর চেহারার মধ্যে কোনো পার্থক্য ছিল না, কিন্তু সেই মুহূর্তের প্রভু যীশুকে দেখে মানুষের মনে হয়েছিল তিনি যেন কোনো অপরিচিত ব্যক্তি, এর কারণ মৃতাবস্থা থেকে পুনরুত্থিত হওয়ার পর তিনি এক আধ্যাত্মিক দেহে পরিণত হয়েছিলেন বলে, এবং তাঁর পূর্ববর্তী দেহরূপের তুলনায়, এই আধ্যাত্মিক শরীর মানুষের কাছে বেশি বিহ্বলকর ও বিভ্রান্তকর ছিল। এর ফলে প্রভু যীশু ও মানুষের মধ্যে আরো দূরত্বও সৃষ্টি হয়েছিল, এবং মানুষ তাদের অন্তরে অনুভব করেছিল যে, সেই মুহূর্তের প্রভু যীশু আরো বেশি রহস্যময় হয়ে গিয়েছেন। মানুষের দিক থেকে এই অবগতি ও অনুভূতি সহসা তাদের ধরা-ছোঁয়ার অতীত কোনো এক ঈশ্বরে বিশ্বাসের একটি যুগে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। সুতরাং, তাঁর পুনরুত্থানের পর প্রথম যে কার্যটি প্রভু যীশু করেছিলেন, তা ছিল সকল মানুষকে তাঁকে দেখার সুযোগ করে দেওয়া, তিনি যে অস্তিমান, সে বিষয়ে নিশ্চিত করা, এবং তাঁর পুনরুত্থানের সত্যটি প্রতিপন্ন করা। তদুপরি, এই কাজটির মাধ্যমে তিনি দেহরূপে কর্মরত থাকাকালীন, তাঁর তাদের কাছে তিনি দৃষ্টিগোচর ও স্পর্শগ্রাহ্য খ্রীষ্ট থাকাকালীন, মানুষের সাথে তাঁর সম্পর্ক যেমন ছিল, সেই অবস্থায় ফিরিয়ে এনেছিলেন। এর একটি ফলাফল হল যে, মানুষের মনে এ বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ রইলো না, যে, ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার পর প্রভু যীশু মৃতাবস্থা থেকে পুনরুত্থিত হয়েছেন, এবং প্রভু যীশুর দ্বারা মানবজাতির পুনরুদ্ধারের কার্য সম্পর্কেও তাদের মনে কোনো সন্দেহ থাকলো না। এর আরেকটি ফলশ্রুতি হল যে, তাঁর পুনরুত্থানের পর মানুষের কাছে প্রভু যীশুর আবির্ভাব এবং মানুষকে তাঁকে দেখতে ও স্পর্শ করতে দেওয়ার এই ঘটনাটি মানবজাতিকে সুদৃঢ়ভাবে অনুগ্রহের যুগের সঙ্গে সংযুক্ত করলো, এতে নিশ্চিত হল যে, সেই দিন থেকে, মানুষ আর এই অনুমানের ভিত্তিতে পূর্ববর্তী বিধানের যুগে প্রত্যাবর্তন করবে না, যে, প্রভু যীশু “অন্তর্হিত হয়েছেন” বা তিনি “কিছুই না বলে চলে গিয়েছেন”। এইভাবে, তিনি সুনিশ্চিত করলেন যে, প্রভু যীশুর শিক্ষা ও তাঁর সম্পাদিত কার্যকে অনুসরণ করে তারা তাদের অগ্রগমন অব্যাহত রাখবে। এইভাবে, অনুগ্রহের যুগে কার্যের এক নতুন পর্যায়ের আনুষ্ঠানিক সূচনা ঘটলো, এবং সেই মুহূর্ত থেকে, যে মানুষগুলি বিধানের অধীনে জীবনধারণ করছিলেন, আনুষ্ঠানিকভাবে তারা বিধান ভেঙে বেরিয়ে এসে এক নতুন যুগে, এক নতুন শুভারম্ভে প্রবেশ করলো। এগুলিই হল পুনরুত্থানের পর প্রভু যীশুর মানবজাতির সামনে আবির্ভূত হওয়ার বহুমুখী অর্থ।
প্রভু যীশু এখন যখন এক আধ্যাত্মিক দেহে বাস করছিলেন, তাহলে মানুষ কীভাবে তাঁকে দর্শন ও স্পর্শ করতে পারলো? এই প্রশ্নটি প্রভু যীশুর মানবজাতির কাছে আবির্ভাবের তাৎপর্যকে ছুঁয়ে যায়। শাস্ত্রের যে অনুচ্ছেদটি আমরা সদ্য পাঠ করলাম, সেখানে কিছু কি তোমরা লক্ষ্য করেছো? সাধারণত, আধ্যাত্মিক শরীরকে দেখা বা ছোঁয়া যায় না, এবং পুনরুত্থানের পর প্রভু যীশু যে কার্য গ্রহণ করেছিলেন, তা ইতিপূর্বেই সম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। তাই তত্ত্বগতভাবে, মানুষের মাঝে তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য তাঁর আদি প্রতিমূর্তিতে ফিরে আসার আদৌ কোনো প্রয়োজন ছিল না, কিন্তু থোমার মতো মানুষের কাছে প্রভু যীশুর আধ্যাত্মিক শরীরের আগমন তাঁর এই আবির্ভাবের তাৎপর্যকে আরো বেশি সুনির্দিষ্ট করে তুলেছিল, যার ফলে আরো গভীরভাবে তা মানুষের হৃদয়ের মধ্যে প্রবেশ করেছিল। তিনি যখন থোমার কাছে এসেছিলেন, সন্দিগ্ধ থোমাকে তিনি তাঁর হাত স্পর্শ করতে দিয়েছিলেন, এবং তাকে বলেছিলেন: “এখানে তোমার আঙ্গুল দাও, দেখ আমার হাত দুখানি। হাত বাড়িয়ে আমার কুক্ষিদেশ স্পর্শ কর। সংশয় রেখো না মনে, বিশ্বাস কর।” এই বাক্য ও কর্মগুলি এমন বিষয় ছিল না যা প্রভু যীশু কেবলমাত্র তাঁর পুনরুত্থানের পরেই বলতে ও করতে চেয়েছিলেন; বস্তুত, এই কাজগুলি তিনি ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার পুর্বেই বলতে ও করতে চেয়েছিলেন, কারণ থোমার সন্দেহপ্রবণতা যে তখনই শুরু হয়েছিল এমন নয়, বরং যখন থেকে সে প্রভু যীশুর অনুগমন করছিল তখন থেকে পুরোটা সময়কাল জুড়েই তা তার মধ্যে ছিল। এটা স্পষ্টতই প্রতীয়মান যে, ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার আগেই প্রভু যীশুর থোমার মতো মানুষের সম্বন্ধে ইতিপূর্বেই একটা উপলব্ধি ছিল। তাহলে এর থেকে আমরা কী বুঝি? তাঁর পুনরুত্থানের পরেও তিনি তখনো সেই একই প্রভু যীশু ছিলেন। তাঁর সারসত্যের কোনো পরিবর্তন ঘটে নি। কিন্তু, তিনি ছিলেন মৃতাবস্থা থেকে পুনরুত্থিত প্রভু যীশু যিনি আধ্যাত্মিক জগৎ তাঁর দি প্রতিমূর্তি, মূল স্বভাব, এবং দেহরূপে থাকাকালীন সময় থেকে মানবজাতি সম্বন্ধে তাঁর অর্জিত উপলব্ধি সহযোগেই প্রত্যাবর্তন করেছিলেন, তাই প্রথমেই তিনি থোমার কাছে গিয়েছিলেন ও থোমাকে তাঁর পাঁজর স্পর্শ করতে দিয়েছিলেন, থোমাকে শুধু পুনরুত্থানের পর তাঁর আধ্যাত্মিক দেহ দেখতে দিতেই নয়, বরং যাতে থোমা তাঁর আধ্যাত্মিক শরীরের অস্তিত্ব স্পর্শ ও পরখ করে দেখতে পারে, এবং তার সন্দেহের সম্পূর্ণ বিদূরণ ঘটে। প্রভু যীশু ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার পূর্বে, তিনি খ্রীষ্ট কিনা সে বিষয়ে থোমা সর্বদাই সন্দিগ্ধ ছিল, এবং সে বিশ্বাস করতে অসমর্থ ছিল। স্বচক্ষে সে যা দেখতে পেতো, নিজের হাতে সে যা স্পর্শ করতে পারতো, শুধু সেসবের উপরেই তার ঈশ্বর-বিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত ছিল। এই প্রকারের মানুষের বিশ্বাস সম্বন্ধে প্রভু যীশুর একটা উত্তম উপলব্ধি ছিল। এরা শুধু স্বর্গস্থ ঈশ্বরেই বিশ্বাস করতো, এবং এদের আদৌ কোনো বিশ্বাস ছিল না ঈশ্বর-প্রেরিত অবতারে বা দেহরূপী খ্রীষ্টে, এবং এরা তাঁকে গ্রহণও করতে পারতো না। থোমা যাতে প্রভু যীশুর অস্তিত্বের বাস্তবতাকে মেনে নেয় এবং তা বিশ্বাস করে, মেনে নেয় যে, যথার্থই তিনি ঈশ্বরের অবতার, সেই উদ্দেশ্যেই থোমাকে তিনি হাত বাড়িয়ে তাঁর পাঁজর স্পর্শ করতে দিয়েছিলেন। প্রভু যীশুর পুনরুত্থানের পূর্ববর্তী ও পরবর্তীকালে থোমার সংশয়ের মধ্যে কি কোনো বৈসাদৃশ্য ছিল? সবসময়ই সে সন্দিগ্ধচিত্ত ছিল, এবং প্রভু যীশুর আধ্যাত্মিক দেহ ব্যক্তিগতভাবে তার কাছে আবির্ভূত হয়ে তাঁর শরীরের পেরেকের ক্ষতচিহ্নগুলি তাকে পরখ করে দেখতে না দিলে, কেউই কোনোভাবে তার সন্দেহগুলির নিরসন ঘটিয়ে তাকে সংশয়মুক্ত করতে পারতো না। তাই, যখন থেকে প্রভু যীশু থোমাকে তাঁর পাঁজর স্পর্শ করার অনুমতি দিয়েছিলেন এবং বাস্তবিকই তাকে পেরেকের ক্ষতচিহ্নগুলি অনুভব করতে দিয়েছিলেন, তবে থেকে থোমার সংশয় অন্তর্হিত হয়েছিল, এবং সে প্রকৃতই অবহিত হয়েছিল যে, প্রভু যীশু পুনরুত্থিত হয়েছেন, এবং সে মেনে নিয়েছিল ও বিশ্বাস করেছিল যে, প্রভু যীশুই হলেন প্রকৃত খ্রীষ্ট ও ঈশ্বরের অবতার। যদিও এই সময় থেকে থোমা আর কখনও সংশয় প্রকাশ করতো না, কিন্তু চিরকালের জন্য সে খ্রীষ্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সুযোগ হারিয়েছিল। চিরকালের জন্য সে তাঁর সঙ্গে মিলিত হওয়ার, তাঁকে অনুসরণ করার, তাঁকে জানার সুযোগ হারিয়েছিল। খ্রীষ্টের দ্বারা নিখুঁত হয়ে ওঠার সুযোগ সে খুইয়ে ফেলেছিল। যারা সংশয়ে পরিপূর্ণ ছিল, প্রভু যীশুর আবির্ভাব ও তাঁর বাক্যগুলি তাদের বিশ্বাসের সম্বন্ধে একটা সিদ্ধান্ত ও একটি রায় দিয়েছিল। সংশয়বাদীদের জানানোর জন্য, যারা শুধু স্বর্গস্থ ঈশ্বরে বিশ্বাস করতো কিন্তু খ্রীষ্টে বিশ্বাস করতো না তাদের অবহিত করার উদ্দেশ্যে, তিনি তাঁর প্রকৃত বাক্যাবলী ও কার্যকলাপকে ব্যবহার করেছিলেন: ঈশ্বর তাদের বিশ্বাসের তারিফ করতেন না, তাঁর প্রতি সংশয়ান্বিত হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে অনুসরণ করার জন্য তাদের প্রশংসাও করতেন না। যে দিন তারা পরিপূর্ণভাবে ঈশ্বরে ও খ্রীষ্টে বিশ্বাস করেছিল, একমাত্র সেই দিনই ঈশ্বর তাঁর মহান কার্যের সমাপন ঘটাতে পারতেন। নিঃসন্দেহে, সেই একই দিনে, তাদের সন্দেহের বিষয়ে একটি রায়দানও করা হয়েছিল। খ্রীষ্টের প্রতি তাদের মনোভাব তাদের নিয়তি নির্ধারণ করেছিল, এবং তাদের দৃঢ়বদ্ধ সংশয়ের কারণে তাদের বিশ্বাস ফলপ্রসূ হয় নি, এবং তাদের অনমনীয়তার কারণে তাদের আশা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল। স্বর্গস্থ ঈশ্বরে তাদের বিশ্বাস যেহেতু বিভ্রমের ভিত্তির দাঁড়িয়ে ছিল, এবং যেহেতু খ্রীষ্টের প্রতি তাদের সংশয়ই বস্তুত ঈশ্বরের প্রতি তাদের প্রকৃত মনোভাব ছিল, তাই প্রভু যীশুর শরীরে পেরেকের ক্ষতচিহ্নগুলি তারা স্পর্শ করা সত্ত্বেও তাদের বিশ্বাস তখনো নিষ্ফলাই রয়ে গিয়েছিল, এবং তাদের অর্জিত ফলাফল ছিল বাঁশের ঝুড়িতে করে জল বইবার শামিল—পুরোটাই ব্যর্থ। একই সাথে, থোমাকে প্রভু যীশু যা বলেছিলেন, তা অতি স্পষ্টতই ছিল তাঁর প্রতিটি মানুষকে অবগত করার এক পদ্ধতি: পুনরুত্থিত প্রভু যীশু হলেন সেই প্রভু, যীশু যিনি সাড়ে তেত্রিশটা বছর মানবজাতির মাঝে কার্য সম্পাদন করে অতিবাহিত করেছিলেন। যদিও তাঁকে ক্রুশকাষ্ঠে পেরেকবিদ্ধ করা হয়েছিল এবং তিনি মৃত্যুর ছায়াচ্ছন্ন উপত্যকার অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন, এবং যদিও তাঁর পুনরুত্থান ঘটেছিল, কিন্তু কোনো দিক দিয়েই তাঁর কোনো রূপান্তর ঘটেনি। যদিও এখন তাঁর শরীরে পেরেকের ক্ষতচিহ্ন ছিল, এবং যদিও তিনি পুনরুত্থিত হয়ে কবর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে এসেছিলেন, কিন্তু তাঁর স্বভাব, মানবজাতি সম্পর্কে তাঁর উপলব্ধি, এবং মানবজাতির প্রতি তাঁর অভিপ্রায় সামান্যতমও পরিবর্তিত হয় নি। একই সঙ্গে, মানুষের উদ্দেশ্যে তিনি বার্তা দিচ্ছিলেন যে ক্রুশকাষ্ঠ থেকে তিনি অবতরণ করেছেন, পাপকে পরাভূত করেছেন, দুঃখযন্ত্রণাকে বশীভূত করেছেন, এবং মৃত্যুকে জয় করেছেন। পেরেকের ক্ষতচিহ্নগুলি ছিল শয়তানের বিরুদ্ধে তাঁর জয়লাভের সাক্ষ্যচিহ্ন মাত্র, সেগুলি প্রতিপন্ন করেছিল যে, তিনি সমগ্র মানবজাতিকে সাফল্যের সঙ্গে পুনরুদ্ধার করার মানসেপাপস্খালনের বলিতে পরিণত হয়েছেন। মানুষকে তিনি জানাচ্ছিলেন যে, ইতিমধ্যেই তিনি মানবজাতির পাপসমূহকে গ্রহণ করেছেন এবং তাঁর পুনরুদ্ধারের কার্য তিনি সম্পূর্ণ করেছেন। যখন তাঁর শিষ্যদের দর্শন করতে তিনি ফিরে এসেছিলেন, তখন তাঁর আবির্ভাবের মাধ্যমে তিনি তাদের এই বার্তা জ্ঞাপন করেছিলেন: “আমি এখনো জীবিত, এখনো আমার অস্তিত্ব রয়েছে; আজ তোমাদের সামনে আমি প্রকৃতই দাঁড়িয়ে রয়েছি, যাতে তোমরা আমায় দেখতে পাও ও স্পর্শ করতে পারো। সবসময়ই আমি তোমাদের সঙ্গে থাকবো।” প্রভু যীশুর থোমার ঘটনাটিকে পরবর্তীকালের মানুষদের উদ্দেশ্যে এক সাবধানবাণী হিসাবেও ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন: তাঁর প্রতি বিশ্বাসে যদিও প্রভু যীশুকে তুমি দর্শন বা স্পর্শ কোনোটাই করতে সক্ষম হবে না, তবু তোমার প্রকৃত বিশ্বাসের কারণে তুমি আশীর্বাদধন্য, এবং তোমার প্রকৃত বিশ্বাসের কারণেই তুমি তাঁকে দেখতে পাবে, আর এই প্রকারের মানুষই হল যারা আশীর্বাদ পেয়েছে।
থোমার সামনে আবির্ভূত হওয়ার পর প্রভু যীশু যা বলেছিলেন, বাইবেলে লিপিবদ্ধ সেই বাক্যগুলি অনুগ্রহের যুগের সকল মানুষের জন্য অত্যন্ত সহায়ক ছিল। থোমার সামনে তাঁর আবির্ভাব এবং তার উদ্দেশ্যে কথিত তাঁর বাক্যগুলি পরবর্তী প্রজন্মের উপর এক গভীর ছাপ রেখেছিল; এগুলির মধ্যে চিরকালীন তাৎপর্য নিহিত রয়েছে। থোমা সেই ধরনের মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে যারা, ঈশ্বরে বিশ্বাস করে অথচ ঈশ্বরের প্রতি সংশয় প্রকাশ করে। এরা সন্দিগ্ধ প্রকৃতির, অশুভ হৃদয়ের অধিকারী মানুষ, এরা নির্ভরযোগ্য নয়, এবং ঈশ্বর যেসকল কার্যসাধনে সক্ষম, তাতে এরা বিশ্বাস করে না। এরা ঈশ্বরের সর্বশক্তিমত্তা ও তাঁর সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস করে না, এবং ঈশ্বরের অবতারেও তাদের বিশ্বাস নেই। কিন্তু, প্রভু যীশুর পুনরুত্থান তাদের এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলিকে সম্পূর্ণ নস্যাৎ করে দিয়েছিল, এবং ঘটনাটি তাদের নিজস্ব সংশয়কে আবিষ্কার করার, তাদের নিজস্ব সন্দেহকে শনাক্ত করার, এবং তাদের নিজস্ব বিশ্বাসঘাতকতাকে স্বীকার করে নেওয়ার একটা সুযোগ দান করেছিল, এবং এইভাবে, তারা প্রভু যীশুর অস্তিত্ব ও পুনরুত্থানে যথার্থরূপে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল। থোমার সঙ্গে যা ঘটেছিল, তা ছিল পরবর্তী প্রজন্মের জন্য এক সাবধানবাণী ও সতর্কীকরণ, যাতে আরো বেশি সংখ্যক মানুষ থোমার মতো সন্দিগ্ধবাদী না হওয়ার বিষয়ে নিজেদের সতর্ক করতে পারে, এবং যদি নিজেদের তারা সংশয়াকীর্ণ করেই তোলে, তাহলে তারা অন্ধকারের মধ্যে নিমজ্জিত হবে। যদি তুমি ঈশ্বরের অনুসরণ করো, কিন্তু ঠিক থোমার মতোই, নিশ্চিত হওয়ার জন্য, যাচাই করার জন্য, ঈশ্বর আছেন কি নেই তা অনুমান করার জন্য, সর্বদাই প্রভুর পাঁজর স্পর্শ করতে এবং তাঁর পেরেকের ক্ষতচিহ্ন অনুভব করতে চাও, তাহলে ঈশ্বর তোমায় পরিত্যাগ করবেন। তাই, প্রভু যীশু চেয়েছিলেন যে, মানুষ যেন থোমার মতো না হয়, যে, যা তারা স্বচক্ষে দেখতে পাবে, একমাত্র তাই-ই বিশ্বাস করবে, বরং তিনি চেয়েছিলেন যে, তারা যেন বিশুদ্ধ, সৎ মানুষ হয়, যেন তারা ঈশ্বরের প্রতি কোনো সন্দেহ পোষণ না করে, বরং তিনি চেয়েছিলেন তারা যেন শুধু তাঁকে বিশ্বাস করে ও তাঁর অনুগমন করে। এই ধরনের মানুষরাই হল আশীর্বাদধন্য। এ হল মানুষের কাছে প্রভু যীশুর এক অতি ক্ষুদ্র চাহিদা, এবং তাঁর অনুগামীদের উদ্দেশ্যে এক সাবধানবাণী।
যারা সংশয়াকীর্ণ, তাদের প্রতি প্রভু যীশুর মনোভাব উপরে আলোচিত হল। কিন্তু যারা তাঁকে সৎভাবে বিশ্বাস করতে ও অনুসরণ করতে সক্ষম, তাদের উদ্দেশ্যে প্রভু যীশু কী বলেছিলেন ও তাদের জন্য কী করেছিলেন? এর পর প্রভু যীশু ও পিতরের মধ্যে এক সংলাপের মধ্য দিয়ে সেই দিকেই আমরা দৃকপাত করতে চলেছি।
এই কথোপকথনে, প্রভু যীশু বারংবার পিতরকে একটাই জিনিস জিজ্ঞেস করেছিলেন: “যোহনের পুত্র শিমোন, তুমি কি আমায় ভালবাস?” এটি একটি উচ্চতর আদর্শমান যা প্রভু যীশু তাঁর পুনরুত্থানের পর দাবি করেছিলেন পিতরের মতো মানুষের কাছে, যে ব্যক্তিগণ খ্রীষ্টে প্রকৃত অর্থেই বিশ্বাস রাখে এবং প্রভুকে ভালোবাসার জন্য উদ্যমীভাবে সচেষ্ট হয়, তাদের কাছে। এই প্রশ্নটি এক প্রকারের তদন্ত ও জিজ্ঞাসাবাদ ছিল, কিন্তু তার চেয়েও বেশি, এটি ছিল পিতরের মতো মানুষদের কাছে এক চাহিদা ও এক প্রত্যাশা। প্রভু যীশু এই জিজ্ঞাসাবাদের পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলেন, যাতে মানুষ আত্ম-প্রতিফলন করে এবং নিজেদের অভ্যন্তরকে পরীক্ষা করে দেখে প্রশ্ন করে: মানুষের কাছে প্রভু যীশুর চাহিদাগুলি কী? আমি কি প্রভুকে ভালোবাসি? আমি কি একজন ঈশ্বরপ্রেমী মানুষ? কীভাবে আমার ঈশ্বরকে ভালোবাসা উচিত? এই প্রশ্নটি প্রভু যীশু শুধুমাত্র পিতরের উদ্দেশ্যে করলেও, আসলে তাঁর অন্তরে, পিতরকে লক্ষ্য করে প্রশ্নগুলি নিক্ষেপ করার মাধ্যমে, ঈশ্বরপ্রেমের অন্বেষণকারী আরো অনেক মানুষের কাছেও এই একই রকম প্রশ্ন পেশ করার এই সুযোগটি ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। পিতর শুধু এই জাতীয় মানুষগুলির প্রতিনিধির ভূমিকা পালনের, প্রভু যীশুর স্বমুখ থেকে প্রশ্নটি গ্রহণের অশিসলাভ করেছিল।
পুনরুত্থানের পর থোমার উদ্দেশ্যে প্রভু যীশু যে বাক্য উচ্চারণ করেছিলেন: “এখানে তোমার আঙ্গুল দাও, দেখ আমার হাত দুখানি। হাত বাড়িয়ে আমার কুক্ষিদেশ স্পর্শ কর। সংশয় রেখো না মনে, বিশ্বাস কর,” তার সাথে তুলনাক্রমে, পিতরের উদ্দেশ্যে তিনবার জিজ্ঞাসিত তাঁর এই প্রশ্নটি: “যোহনের পুত্র শিমোন, তুমি কি আমায় ভালবাস?” মানুষকে প্রভু যীশুর মনোভাবের কঠোরতা, এবং জিজ্ঞাসাবাদের সময় তাঁর উপলব্ধ তাগিদকে আরো ভালো করে অনুভব করার সুযোগ দেয়। শঠ প্রকৃতির, সন্দিগ্ধমনা থোমার ক্ষেত্রে, প্রভু যীশু তাকে হাত বাড়িয়ে তাঁর শরীরে পেরেকের ক্ষতচিহ্নগুলি স্পর্শ করতে দেন, যার ফলে সে প্রতীত হয় যে, প্রভু যীশুই ছিলেন পুনরুত্থিত মনুষ্যপুত্র, এবং খ্রীষ্ট হিসাবে প্রভু যীশুর পরিচয়কে সে মেনে নেয়। আর প্রভু যীশু যদিও থোমাকে কঠোরভাবে ভর্ৎসনা করেন নি এবং মৌখিকভাবে তার সম্বন্ধে কোনো স্পষ্ট মতামতও ব্যক্ত করেন নি, তবু তিনি ব্যবহারিক কর্মের সাহায্যে থোমাকে অবগত করেছিলেন যে তিনি তাকে বুঝতেন, একই সঙ্গে এই ধরনের মানুষের প্রতি তিনি তাঁর মনোভাব ও নির্ণয়ও প্রদর্শন করেছিলেন। ওই প্রকারের মানুষের কাছ থেকে প্রভু যীশুর চাহিদা ও প্রত্যাশা তাঁর উক্তিতে দেখা যাবে না, কারণ থোমার মতো মানুষগুলির মধ্যে আদৌ প্রকৃত বিশ্বাসের কোনো লেশমাত্র থাকে না। এমন ব্যক্তিদের প্রতি প্রভু যীশুর চাহিদা শুধু এটুকুর মধ্যেই সীমিত, কিন্তু পিতরের মতো মানুষের প্রতি যে মনোভাব তিনি ব্যক্ত করেছিলেন, তা ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। পিতরকে তিনি হাত বাড়িয়ে তাঁর ক্ষতচিহ্নগুলি ছুঁয়ে দেখতে আদেশ করেন নি, বা পিতরকে এমন কথাও তিনি বলেন নি যে: “সংশয় রেখো না মনে, বিশ্বাস কর।” পরিবর্তে, বারংবার পিতরকে তিনি একই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেন। প্রশ্নটি ছিল চিন্তা-উদ্রেককারী ও অর্থপূর্ণ এমন এক প্রশ্ন, যা খ্রীষ্টের প্রত্যেক অনুগামীর মনে অনুশোচনা ও ভীতির অনুভূতি সৃষ্টি করবেই, এবং একই সঙ্গে তা তাদের প্রভু যীশুর চিন্তিত ও দুঃখভারাক্রান্ত মানসিক অবস্থাকেও অনুভব না করিয়ে ছাড়ে না। আর যখন তারা বেদনা ও যন্ত্রণায় কাতর, তখনই তারা প্রভু যীশু খ্রীষ্টের দুশ্চিন্তা ও তাঁর প্রযত্নকে উপলব্ধি করতে বেশি সক্ষম; তারা তাঁর ঐকান্তিক শিক্ষাদান এবং খাঁটি ও সৎ মানুষ হওয়ার কঠোর আবশ্যিক শর্তগুলি হৃদয়ঙ্গম করে। প্রভু যীশুর প্রশ্ন মানুষকে অনুভব করায় যে, এই সরল বাক্যগুলির মাধ্যমে মানুষের প্রতি ঈশ্বরের যে চাহিদা ব্যক্ত হয়েছে তা কেবলই তাঁকে বিশ্বাস ও অনুসরণ করা নয়, বরং তা হল প্রেমময়তার অর্জন, তোমার প্রভু ও তোমার ঈশ্বরের প্রতি প্রেম। এমন ভালোবাসাই হল যত্নবান ও আজ্ঞাকারী হওয়া। এই ভালোবাসা হল মানুষের ঈশ্বরের নিমিত্ত বাঁচা-মরা, ঈশ্বরকে যথাসর্বস্ব সমর্পণ করা, এবং ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে যথাসর্বস্ব ব্যয় ও সম্প্রদান করা। এই প্রকারের ভালোবাসা হল ঈশ্বরকে তৃপ্তি দেওয়া, তা তাঁকে সাক্ষ্য উপভোগ করতে ও উদ্বেগমুক্ত থাকতে দেওয়াও বটে। এ-ও হল মানবজাতির ঈশ্বরের প্রতি ঋণপরিশোধ, মানুষের দায়িত্ব, বাধ্যবাধকতা এবং কর্তব্য, এবং এ হল এমন এক পথ, যা মানুষের আজীবন অনুসরণীয়। এই প্রশ্ন তিনটি পিতর ও নিখুঁত করা হবে এমন সকল মানুষের কাছে প্রভু যীশুর এক চাহিদা ও এক সনির্বন্ধ অনুরোধ। এই প্রশ্ন তিনটিই পিতরকে তার জীবনের পথে শেষ অবধি হেঁটে যেতে চালিত ও প্রণোদিত করেছিল, এবং বিদায়গ্রহণকালীন প্রভু যীশুর জিজ্ঞাসিত এই প্রশ্নগুলিই পিতরকে তার নিখুঁত হয়ে ওঠার পথে পা রাখার দিকে চালিত করেছিল, প্রভুর প্রতি তার ভালোবাসার দরুন, এই প্রশ্নগুলিই তাকে প্রভুর অন্তরের প্রতি যত্নশীল হতে, প্রভুকে মান্য করতে, প্রভুকে সান্ত্বনা নিবেদন করতে, এবং এই ভালোবাসার নিমিত্ত তার সমগ্র জীবন ও তার সম্পূর্ণ সত্তাকে উৎসর্গ করার দিকে চালিত করেছিল।
অনুগ্রহের যুগ চলাকালীন, ঈশ্বরের কার্যের লক্ষ্যবস্তু ছিল মুখ্যত দুই ধরনের মানুষ। প্রথম প্রকারটি হল সেই ধরনের মানুষেরা যারা তাঁকে বিশ্বাস ও অনুসরণ করেছিল, যারা তাঁর আদেশসমূহ মেনে চলতে পেরেছিল, আর, যারা ক্রুশকাষ্ঠকে বহন করতে, এবং অনুগ্রহের যুগের পথে চলা অব্যহত রাখতে সক্ষম হয়েছিল। এই প্রকারের মানুষেরা ঈশ্বরের আশীর্বাদ লাভ করতো এবং ঈশ্বরের অনুগ্রহ উপভোগ করতো। দ্বিতীয় প্রকারের মানুষেরা ছিল পিতরের মতো, যাদের নিখুঁত করে তোলা সম্ভব ছিল। তাই, পুনরুত্থিত হওয়ার পর, প্রভু যীশু প্রথমেই এই দুটি অত্যন্ত অর্থপূর্ণ কাজ করলেন। প্রথম কাজটি করা হল থোমার সাথে, অন্যটি করা হল পিতরের সাথে। এই দুটি কাজ কীসের ব্যঞ্জনাবাহী? তারা কি ঈশ্বরের মানবজাতিকে উদ্ধারের যথার্থ অভিপ্রায়কে তুলে ধরে? তারা কি মানবজাতির প্রতি ঈশ্বরের আন্তরিকতার দ্যোতক? থোমার সঙ্গে যে কাজ তিনি করলেন, সেটির উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে সতর্ক করে দেওয়া, যাতে তারা সংশয়বাদী না হয়ে শুধুই বিশ্বাস করে যায়। পিতরের সাথে তিনি যে কাজটি করলেন, সেটির উদ্দেশ্য ছিল পিতরের মতো মানুষের বিশ্বাসকে শক্তিদান করা, এবং এহেন ব্যক্তিগণের প্রতি তাঁর চাহিদাগুলি স্পষ্ট করে তোলা, তাদের কোন লক্ষ্যের অন্বেষণ করা উচিত তা দেখিয়ে দেওয়া।
পুনরুত্থিত হওয়ার পর, যে ব্যক্তিগণের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা প্রভু যীশু আবশ্যক মনে করেছিলেন তাদের কাছে তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন, তাদের সঙ্গে আলাপচারিতা করেছিলেন, এবং, মানুষের প্রতি তাঁর অভিপ্রায় ও প্রত্যাশাসমূহ পরিত্যাগ করে, তিনি তাদের উদ্দেশ্যে চাহিদা জ্ঞাপন করেছিলেন। অর্থাৎ, ঈশ্বরের অবতার হিসাবে, মানবজাতির জন্য তাঁর উদ্বেগ ও মানুষের কাছে তাঁর চাহিদা কোনোদিন পরিবর্তিত হয় নি; তাঁর দেহরূপে থাকাকালীন এবং ক্রুশকাষ্ঠে পেরেক-বিদ্ধ ও পুনরুত্থিত হওয়ার পর তাঁর আধ্যাত্মিক দেহে অধিষ্ঠানকালীন—সর্বদাই এগুলি একই থেকে গিয়েছিল। ক্রুশকাষ্ঠে আরোহন করার পূর্বে এই শিষ্যদের বিষয়ে তিনি চিন্তিত ছিলেন, এবং তাঁর অন্তরে তিনি প্রতিটি মানুষের অবস্থা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণার অধিকারী ছিলেন, এবং প্রতিটি মানুষের ঘাটতিগুলি তিনি বুঝতে পারতেন এবং, অবশ্যই, তাঁর মৃত্যু, পুনরুত্থান, এবং আধ্যাত্মিক দেহে রূপান্তরের পরেও প্রতিটি মানুষ সম্পর্কে তাঁর উপলব্ধি তাঁর দেহরূপে অবস্থানকালীন যেমন ছিল তেমনই রয়ে গিয়েছিল। তিনি জানতেন যে, খ্রীষ্ট হিসাবে তাঁর পরিচয়ের বিষয়ে মানুষ সম্পূর্ণ নিশ্চিত ছিল না, কিন্তু দেহরূপে থাকাকালীন মানুষের কাছ থেকে তিনি কঠোর কিছু দাবি করেন নি। কিন্তু, পুনরুত্থিত হওয়ার পর, তাদের কাছে তিনি আবির্ভূত হন, এবং তাদের সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিত করেন যে প্রভু যীশু ঈশ্বরের থেকে উদ্ভূত এবং তিনি ঈশ্বরের অবতার, এবং তাঁর আবির্ভাব ও পুনরুত্থানের ঘটনাটিকে তিনি মানবজাতির আজীবনের সাধনার মহত্তম দর্শন ও অনুপ্রেরণা হিসাবে ব্যবহার করেন। মৃতাবস্থা থেকে তাঁর পুনরুত্থান শুধু যে তাঁর সকল অনুগামীদের শক্তি যুগিয়েছিল তা-ই নয়, একই সঙ্গে তা মানবজাতির মাঝে তাঁর অনুগ্রহের যুগের কার্যকে আনুপুঙ্খিকভাবে বাস্তবায়িতও করেছিল, আর এই কারণেই, অনুগ্রহের যুগে প্রভু যীশুর পরিত্রাণের সুসমাচার মানবজাতির প্রতিটি কোণে ছড়িয়ে পড়েছিল। তোমার কি মনে হয় যে, তাঁর পুনরুত্থানের পর, প্রভু যীশুর আবির্ভাবের কোনো তাৎপর্য ছিল? তুমি যদি সেই সময়ের থোমা বা পিতর হতে এবং নিজের জীবনে এত অর্থপূর্ণ কোনো ঘটনার সম্মুখীন হতে, তাহলে ঘটনাটি তোমার উপর কী প্রকারের অভিঘাত সৃষ্টি করতো? তুমি কি এই ঘটনাটিকে তোমার ঈশ্বর-বিশ্বাসের জীবনে সর্বোত্তম ও মহত্তম দর্শন বলে বিবেচনা করতে? তুমি যখন ঈশ্বরের অনুগমন করছো, তাঁকে পরিতুষ্ট করার জন্য কঠোর প্রচেষ্টা করছো, এবং আজীবৎকাল ঈশ্বরপ্রেমে প্রয়াসী থেকেছো, তখন কি তুমি এই ঘটনাটিকে তোমার এক চালিকাশক্তি বলে গণ্য করতে? এই মহত্তম দর্শনের প্রচারের জন্য তুমি কি গোটা একটা জীবনের প্রচেষ্টা ব্যয় করতে? প্রভু যীশুর পরিত্রাণের প্রচারকে তুমি কি ঈশ্বরের অর্পিত এক দায়িত্ব হিসাবে গ্রহণ করতে? যদিও তোমরা এর অভিজ্ঞতা লাভ করোনি, তবু ঈশ্বর আর তাঁর ইচ্ছার বিষয়ে এক স্পষ্ট উপলব্ধি লাভ করতে আধুনিক মানুষদের কাছে থোমা ও পিতরের দৃষ্টান্তদুটিই যথেষ্ট। বলা যায় যে, দেহধারণ করে ঈশ্বর স্বয়ং মানবজাতির মাঝে বসবাস ও মানবজীবনের অভিজ্ঞতা লাভ করার পর, এবং মানবজাতির নৈতিক অধোগমন ও তৎকালীন মানবজীবনের পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করার পর, মানবজাতি যে কতটা অসহায়, শোচনীয়, ও করুণা-উদ্রেককর অবস্থার মধ্যে রয়েছে, তা দেহরূপী ঈশ্বর গভীরতর ভাবে অনুভব করলেন। দেহরূপে বসবাসকালীন তাঁর অধিকারলব্ধ মানবতার কারণে, তাঁর দেহীসুলভ প্রবৃত্তির দরুন মানুষের পরিস্থিতির সাথে ঈশ্বর আরো বেশি সহমর্মিতা অর্জন করেছিলেন। এর ফলে, তাঁর অনুগামীদের জন্য তিনি গভীরতর উদ্বেগ অনুভব করেছিলেন। এই বিষয়গুলি সম্ভবত তোমরা উপলব্ধি করতে পারো না, কিন্তু তাঁর প্রত্যেক অনুগামীর জন্য দেহরূপী ঈশ্বরের অনুভূত এই দুশ্চিন্তা ও প্রযত্নকে আমি দুটি মাত্র শব্দ ব্যবহার করে বর্ণনা করতে পারি: “তীব্র উদ্বেগ”। এই পরিভাষাটি মানবীয় ভাষা থেকে উদ্ভূত এবং অত্যন্ত মনুষ্যোচিত হওয়া সত্ত্বেও তাঁর অনুগামীদের প্রতি ঈশ্বরের অনুভূতিকে যথার্থরূপে অভিব্যক্ত ও বর্ণিত করে। মানুষের জন্য ঈশ্বরের গভীর উদ্বেগের বিষয়ে বলা যায় যে, তোমাদের অভিজ্ঞতা অর্জনের পথে ক্রমে ক্রমে তোমরা এটি অনুভব করবে ও এর আস্বাদন লাভ করবে। কিন্তু, এটি কেবলমাত্র তোমার নিজের স্বভাবের পরিবর্তন অন্বেষণের ভিত্তিতে, ঈশ্বরের স্বভাবের বিষয়ে ক্রমিক উপলব্ধির মাধ্যমেই অর্জিত হতে পারে। প্রভু যীশু যখন এভাবে আবির্ভূত হয়েছিলেন, তখন তা মানবতার মধ্যে তাঁর অনুগামীদের জন্য তাঁর তীব্র উদ্বেগকে তাঁর আধ্যাত্মিক দেহে, কিংবা বলা যায় যে, তাঁর দেবত্বের মধ্যে, মূর্ত ও সঞ্চারিত করেছিল। তাঁর আবির্ভাব মানুষকে আরেকবার ঈশ্বরের উদ্বেগ ও তত্ত্বাবধানের অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি লাভের সুযোগ দিয়েছিল, একই সঙ্গে তা সুদৃঢ়ভাবে প্রতিপন্ন করেছিল যে, ঈশ্বরই কোনো যুগের অবতারণা করেন, কোনো যুগকে উন্মোচিত করেন, এবং কোনো যুগের পরিসমাপ্তিও ঘটান। তাঁর আবির্ভাবের মাধ্যমে, সকল মানুষের বিশ্বাসকে তিনি শক্তিশালী করে তুলেছিলেন এবং জগতের কাছে এই সত্যকে প্রতিপন্ন করেছিলেন যে, তিনিই স্বয়ং ঈশ্বর। তা তাঁর অনুসরণকারীদের চিরকালীন নিশ্চয়তা প্রদান করেছিল, এবং তাঁর আবির্ভাবের মাধ্যমেই তিনি তাঁর নতুন কার্যের একটি পর্যায়ের সূত্রপাতও ঘটিয়েছিলেন।
—বাক্য, খণ্ড ২, ঈশ্বরকে জানার প্রসঙ্গে, ঈশ্বরের কর্ম, ঈশ্বরের স্বভাব এবং স্বয়ং ঈশ্বর ৩