ইয়োবের সম্বন্ধে

ইয়োব কীভাবে পরীক্ষাগুলোর মধ্যে দিয়ে গেছিল তা জানার পর তোমাদের মধ্যে বেশিরভাগজনই হয়ত ইয়োবের সম্পর্কে আরও বিস্তারিতভাবে জানতে আগ্রহী হবে, বিশেষত সে কীভাবে ঈশ্বরের প্রশংসা অর্জন করল সেই রহস্য সম্পর্কে। চলো আজ তাহলে ইয়োবকে নিয়ে কথা বলা যাক!

ইয়োবের প্রাত্যহিক জীবনে আমরা তার ত্রুটিহীনতা, ন্যায়পরায়ণতা, ঈশ্বরে ভীতি ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগকে দেখতে পাই

ইয়োবের সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে আমাদের শুরু করতে হবে ঈশ্বরের নিজের মুখে উচ্চারিত ইয়োবের মূল্যায়ন দিয়ে: “তার মত সৎ ও বিশ্বস্ত লোক পৃথিবীতে কেউ নেই। সে আমার ভক্ত, মন্দের পথ সে পরিহার করে চলে।”

প্রথমে ইয়োবের ত্রুটিহীনতা ও ন্যায়পরায়ণতা সম্পর্কে জানা যাক।

“নিখুঁত” ও “ন্যায়পরায়ণ” এই দুটো শব্দ সম্পর্কে তোমাদের কী ধারণা? তোমরা কি বিশ্বাস করো যে ইয়োবের মধ্যে নিন্দা করার মতো কিছু ছিল না, সে সম্মান পাওয়ার যোগ্য ছিল? এটা অবশ্য “নিখুঁত” ও “ন্যায়পরায়ণ” এই শব্দ দুটোর আক্ষরিক ব্যাখ্যা ও ধারণা হবে। কিন্তু ইয়োবের সম্পর্কে প্রকৃত ধারণা পেতে গেলে বাস্তব জীবনের পরিপ্রেক্ষিতেই পেতে হবে—শুধুমাত্র বাক্য, বই বা তত্ত্ব কোনো উত্তর দিতে পারবে না। আমরা প্রথমে ইয়োবের পারিবারিক জীবনের দিকে লক্ষ্য করব, তার জীবনের স্বাভাবিক আচরণ কেমন ছিল, তা জানব। এ থেকে আমরা তার জীবনের নীতি ও উদ্দেশ্যের পাশাপাশি তার ব্যক্তিত্ব ও সাধনা সম্পর্কেও জানতে পারবো। এখন ইয়োব ১:৩-এর শেষ কথাগুলো পড়া যাক: “সমগ্র প্রাচ্য দেশে তিনি ছিলেন সব চেয়ে ধনী ব্যক্তি।” এই কথাগুলো থেকে যা বোঝা যায় তা হল ইয়োবের মর্যাদা ও অবস্থান ছিল খুবই উঁচু, যদিও আমাদের বলা হয়নি যে সে কেন সমগ্র প্রাচ্যের সকলের চেয়ে মহান ছিল, তার প্রচুর সম্পদের জন্য, নাকি সে নিখুঁত ও ন্যায়পরায়ণ এবং ঈশ্বর-ভীত ও মন্দকর্ম পরিত্যাগকারী ছিল বলে, কিন্তু সামগ্রিকভাবে আমরা জানি যে ইয়োবের মর্যাদা ও অবস্থান খুবই প্রশংসনীয় ছিল। বাইবেলে বলা আছে, ইয়োব সম্পর্কে মানুষের প্রাথমিক ধারণা ছিল যে সে নিখুঁত, সে ঈশ্বরে ভীত ও সে মন্দ কর্ম পরিত্যাগ করেছে, এবং সে প্রভূত সম্পত্তি ও শ্রদ্ধেয় মর্যাদার অধিকারী। এইরকম একটা পরিবেশ ও এইরকম একটা পরিস্থিতিতে বসবাসকারী একজন সাধারণ মানুষ হিসাবে ইয়োবের খাদ্যাভ্যাস, তার জীবনের গুণমান, ও তার ব্যক্তিগত জীবনের বিভিন্ন দিকগুলো অধিকাংশ মানুষের মনোযোগের কেন্দ্র হয়ে উঠত; তাই আমাদের অবশ্যই শাস্ত্রবাক্যের পাঠ চালিয়ে যেতে হবে: “ইয়োবের পুত্রেরা তাদের বাড়িতে পালা করে সকলের জন্য ভোজের আয়োজন করত এবং তিন বোনকে তারা সেই ভোজে নিমন্ত্রণ করত। ভোজের পরের দিন ভোরে ইয়োব তাঁর পুত্রদের শুচীকরণের জন্য প্রত্যেকের নামে বলি উৎসর্গ করতেন কারণ তিনি মনে করতেন তাঁর পুত্রেরা হয়তো অনিচ্ছাকৃতভাবে ঈশ্বরকে অবজ্ঞা করে পাপ করে ফেলেছে। (ইয়োবে ১:৪-৫)” এই অনুচ্ছেদ থেকে আমরা দুটো বিষয় জানতে পারি: প্রথমটা হল যে ইয়োবের পুত্র-কন্যারা নিয়মিত প্রচুর খাদ্য ও পানীয় সহযোগে ভোজের আয়োজন করত; আর দ্বিতীয়টা হল, ইয়োব প্রায়ই অগ্নিদগ্ধ বলি উৎসর্গ করত কারণ সে প্রায়ই তার পুত্র-কন্যাদের নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ত, তার ভয় হত যে তারা পাপ করছে, তাদের হৃদয়ে তারা ঈশ্বরকে পরিত্যাগ করেছে। এর মধ্যে দুই ভিন্ন ধরনের মানুষের জীবনযাত্রা বর্ণিত হয়েছে। প্রথম হল ইয়োবের পুত্র-কন্যারা, যারা ঘনঘন ভোজের আয়োজন করত, তারা তাদের পার্থিব সম্পদের প্রাচুর্যের কারণে মন ভরে আহার ও পানীয় আহরণ করে বিলাসবহুল জীবন যাপন করত। এইরকম জীবনযাপনের ফলে অপরিহার্যভাবে তারা প্রায়ই পাপকর্ম করত ও ঈশ্বরকে ক্ষুব্ধ করে তুলত—তবুও তারা নিজেদের পরিশুদ্ধ করেনি বা অগ্নিদগ্ধ বলি উৎসর্গ করেনি। তাহলে তোমরা দেখতেই পাচ্ছ যে সেইসময়ে তাদের মনে ঈশ্বরের জন্যে কোনো জায়গা ছিল না, তারা ঈশ্বরের অনুগ্রহ নিয়ে কখনো চিন্তা করেনি, ঈশ্বরকে ক্ষুব্ধ করতে ভয় পায়নি, এবং নিজেদের হৃদয়ে ঈশ্বরকে পরিত্যাগ করতেও ভয় পায়নি। অবশ্য আমাদের কেন্দ্রবিন্দু ইয়োবের সন্তানেরা নয়, বরং এই ধরণের পরিস্থিতির সামনে পড়ে ইয়োব কী করেছে সেইটা কেন্দ্রবিন্দু; এটাই সেই অন্য বিষয় যা ওই অনুচ্ছেদে বর্ণনা করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ইয়োবের প্রাত্যহিক জীবন এবং তার মানবিকতার নির্যাস। বাইবেলে যেখানে ইয়োবের পুত্র ও কন্যাদের ভোজের কথা বলা হয়েছে, সেখানে কোথাও ইয়োবের উল্লেখ নেই, শুধু এটুকুই বলা হয়েছে যে তার পুত্র-কন্যারা একসাথে ঘনঘন ভোজন ও পানাহার করত। অন্যভাবে বললে, ইয়োব কখনো এই ভোজ আয়োজন করেনি, কখনো তার পুত্র ও কন্যার সাথে লাগামহীন ভোজনে যোগও দেয়নি। যদিও ইয়োব সমৃদ্ধিশালী ছিল এবং প্রচুর সম্পদ ও ভৃত্যের মালিক ছিল, কিন্তু তার জীবন বিলাসবহুল ছিল না। জীবনযাপনের এই সর্বশ্রেষ্ঠ পরিবেশেও সে বিভ্রান্ত হয়নি, তার সম্পত্তির প্রাচুর্য তাকে দৈহিক উপভোগে নিমজ্জিত করতে পারেনি, ঐশ্বর্যের কারণে সে অগ্নিদগ্ধ বলি উৎসর্গ করতে ভুলে যায়নি, এবং ঐশ্বর্য তার হৃদয় থেকে ধীরে ধীরে ঈশ্বরকে পরিত্যাগ করার কোনো কারণও সৃষ্টি করতে পারেনি। স্পষ্টতই, ইয়োব সেইসময় তার জীবনযাত্রায় অনুশাসন মেনে চলত, তার উপরে ঈশ্বরের আশীর্বাদ থাকার ফলে সে লোভী বা ভোগবাদী ছিল না, এবং জীবনের গুণমানের বিষয়েও তার কোনো কঠোর মনোভাব ছিল না। বরং সে ছিল বিনয়ী, নম্র, সে নিজেকে আড়ম্বরপূর্ণ ভাবে জাহির করেনি, এবং সে ঈশ্বরের সম্মুখে সতর্ক ও যত্নশীল ছিল। সে প্রায়ই ঈশ্বরের অনুগ্রহ ও আশীর্বাদ নিয়ে চিন্তাভাবনা করত, এবং সবসময়েই ঈশ্বরে ভীত ছিল। তার প্রাত্যহিক জীবনে সে প্রায়ই সকালে উঠে তার পুত্র-কন্যাদের কারণে অগ্নিদগ্ধ বলি উৎসর্গ করত। অন্যভাবে বলা যায়, ইয়োব শুধু যে নিজে ঈশ্বরে ভীত ছিল তাই নয়, সে আশা করত যে তার সন্তানেরাও একইভাবে ঈশ্বরকে ভয় পাবে এবং ঈশ্বরবিরুদ্ধ কোনো পাপ কাজ করবে না। ইয়োবের হৃদয়ে তার পার্থিব সম্পদের কোনো জায়গা ছিল না, বা সেগুলো তার হৃদয়ে ঈশ্বরের স্থান অধিকার করেনি; তার নিজের স্বার্থেই হোক বা তার সন্তানদের স্বার্থেই হোক, ইয়োবের প্রাত্যহিক কর্ম ঈশ্বর ভীতি ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগের সঙ্গে যুক্ত ছিল। যিহোবার ঈশ্বর-ভীতি তার মুখের কথাতেই থেমে থাকেনি, বরং সেটাকে সে তার কাজে বাস্তবায়িত করেছিল, এবং তা তার দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটা কাজেই প্রতিফলিত হয়েছিল। ইয়োবের এই বাস্তব আচরণ থেকে আমরা দেখতে পাই যে সে ছিল সৎ, এবং তার মধ্যে ন্যায় ও ইতিবাচক বিষয়ের প্রতি ভালোবাসার এক নির্যাস ছিল। ইয়োব যে প্রায়ই তার পুত্রকন্যাদের পরিশোধনের জন্যে পাঠাত, তা থেকে বোঝা যায় যে তার সন্তানদের আচরণে তার অনুমোদন ছিল না, বরং মনে মনে সে তাদের আচরণে বীতশ্রদ্ধ ছিল এবং তাদের নিন্দা করত। সে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিল যে তার পুত্রকন্যাদের আচরণ যিহোবা ঈশ্বরের কাছে প্রীতিকর নয়, এবং তাই সে প্রায়ই তাদের বলত যিহোবা ঈশ্বরের সম্মুখে গিয়ে তাদের পাপ স্বীকার করতে। ইয়োবের কর্ম আমাদের কাছে তার মানবিকতার অন্য একটা দিক তুলে ধরে, যেখানে সে কখনোই তাদের সঙ্গ দেয়নি যারা প্রায়ই পাপ করে ও ঈশ্বরকে ক্ষুব্ধ করে, বরং তাদের পরিত্যাগ করেছে ও এড়িয়ে চলেছে। এমনকী তারা তার পুত্র-কন্যা হওয়া সত্ত্বেও সে তার আদর্শ থেকে সরে যায়নি, বা তাদের পাপকর্মকে নিজের ভাবাবেগের কারণে প্রশ্রয় দেয়নি। বরং সে তাদের উপদেশ দিয়েছে নিজেদের পাপ স্বীকার করে যিহোবা ঈশ্বরের সহিষ্ণুতা লাভ করতে, এবং তাদের সতর্ক করেছে যাতে তারা তাদের লোভ ও আনন্দের স্বার্থে ঈশ্বরকে পরিত্যাগ না করে। অন্যদের সাথে ইয়োবের আচরণের নীতিগুলো তার ঈশ্বরভীতি ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগের নীতির থেকে অবিচ্ছেদ্য। ঈশ্বর যা গ্রহণ করেছেন তা সে ভালোবেসেছে, এবং ঈশ্বর যা প্রত্যাখ্যান করেছেন তাকে সে ঘৃণা করেছে; নিজেদের হৃদয়ে যারা ঈশ্বরে ভীত তাদের সে ভালোবেসেছে, এবং যারা মন্দ কাজ করেছে বা ঈশ্বরের বিরুদ্ধে পাপ করেছে তাদের ঘৃণা করেছে। এরকম ভালোবাসা ও ঘৃণা তার প্রাত্যহিক জীবনে প্রকাশিত হয়েছে, এবং ঈশ্বরের চোখে ইয়োবের ন্যায়পরায়ণতা ছিল এটাই। স্বাভাবিকভাবেই, সেইসাথে এটা প্রাত্যহিক জীবনে অন্যদের সাথে ইয়োবের সম্পর্কের ক্ষেত্রে তার মানবিকতার এক বহিঃপ্রকাশ ও যাপন, যে বিষয়ে আমাদের অবশ্যই জানতে হবে।

ইয়োবের পরীক্ষা চলাকালীন তার মানবিকতার প্রকাশ (পরীক্ষা চলাকালীন ইয়োবের যে ত্রুটিহীনতা, ন্যায়পরায়ণতা, ঈশ্বর-ভীতি, ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগ, তাকে উপলব্ধি করা)

আমরা উপরে যা আলোচনা করেছি তা ইয়োবের পরীক্ষা পূর্ববর্তী প্রাত্যহিক জীবনে মানবিকতার বিভিন্ন দিক। নিঃসন্দেহে, এই বিভিন্ন প্রতিভাস ইয়োবের ন্যায়পরায়ণতা, ঈশ্বরভীতি ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগ করার একটা প্রাথমিক পরিচয় ও ধারণা প্রদান করে, এবং স্বাভাবিকভাবেই তা একটা প্রাথমিক স্বীকৃতিও প্রদান করে। “প্রাথমিক” বলছি কারণ ইয়োবের ব্যক্তিত্ব এবং সে যে মাত্রায় ঈশ্বরের প্রতি সমর্পন ও ঈশ্বর-ভীতির পথে সাধনা করেছিল, বেশীরভাগ মানুষেরই এখনও সে সম্পর্কে প্রকৃত ধারণা নেই। বলা যায় যে বাইবেলের দুটো অনুচ্ছেদে ইয়োবের বাক্য থেকে ইয়োবের সম্বন্ধে যে কিছুটা অনুকূল ধারণা পাওয়া যায়, ইয়োব সম্পর্কে অধিকাংশ মানুষের ধারণা তার চেয়ে বেশী গভীরে প্রসারিত নয়; সেই বাক্যদুটো হল, “যিহোবা দিয়েছিলেন, যিহোবাই ফিরিয়ে নিয়েছেন, যিহোবার নাম ধন্য হোক।” এবং “ঈশ্বরের হাত থেকে আমরা কি শুধু মঙ্গলই গ্রহণ করব? অমঙ্গল কিছুই গ্রহণ করব না?” তাই আমাদের ভীষণভাবে বোঝা প্রয়োজন যে ইয়োব যখন ঈশ্বরের পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছিল, তখন সে কীভাবে তার মানবিকতাকে নিজের জীবনে যাপন করেছিল; এইভাবেই ইয়োবের প্রকৃত মানবিকতার রূপকে সামগ্রিক ভাবে সকলের কাছে উপস্থাপিত করা যাবে।

যখন ইয়োব জেনেছিল যে তার সম্পত্তি চুরি হয়ে গেছে, তার পুত্র-কন্যারা প্রাণ হারিয়েছে, এবং তার ভৃত্যরা নিহত হয়েছে, তখন তার প্রতিক্রিয়া এরকম ছিল: “ইয়োব তখন আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। শোকে অভিভূত হয়ে তিনি তাঁর পোশাক ছিঁড়ে ফেললেন, মাথা কামালেন এবং মাটিতে উপুড় হয়ে প্রার্থনা করলেন” (ইয়োব ১:২০)। এই বাক্যগুলো থেকে আমরা একটা বিষয় দেখতে পাই: এই খবর শোনার পর ইয়োব আতঙ্কিত হয়ে পড়েনি, সে কেঁদে ওঠেনি বা যে ভৃত্যরা তাকে এই সংবাদ দিয়েছিল তাদের দোষারোপ করেনি, আর অপরাধস্থানে দিয়ে তদন্ত করে আসলে কী ঘটেছে তা খুঁজে বার করা তো আরোই দূরের কথা। সে তার সম্পত্তি হারিয়ে যাওয়ার কারণে কোনো কষ্ট বা আফশোস অভিব্যক্ত করেনি, বা তার সন্তান ও প্রিয়জনদের হারানোর ফলে কান্নায় ভেঙে পড়েনি। পরিবর্তে সে তার পোশাক ছিঁড়ে ফেলেছিল, মাথা কামিয়ে ফেলেছিল, মাটিতে বসে পড়েছিল, এবং উপাসনা করেছিল। ইয়োবের কার্যকলাপ কোনো সাধারণ মানুষের মতো নয়। তার এই কাজ অনেককেই বিভ্রান্ত করে দেয়, এবং তারা নিজেদের হৃদয়ে ইয়োবকে তার “অনুভূতিহীনতা”-র জন্য তিরস্কার করে। সম্পত্তির এই আকস্মিক ক্ষতির জন্য সাধারণ মানুষ মনমরা ও হতাশ হয়ে পড়ে, অথবা কিছুক্ষেত্রে তারা গভীর মানসিক অবসাদে চলে যায়। কারণ তাদের কাছে সম্পত্তি হল সারা জীবনের কাজের ফল—এর উপরেই তাদের বেঁচে থাকা নির্ভর করে, এটাই সেই আশা যা তাদের বাঁচিয়ে রাখে; সম্পত্তি হারানো মানে তাদের সারাজীবনের চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাওয়া, তাদের আর কোনো আশা নেই, এমনকী তাদের কোনো ভবিষ্যতও নেই। নিজের সম্পত্তি এবং সেই সম্পত্তির সাথে তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের প্রতি যে কোনো সাধারণ মানুষের মনোভাব এরকমই, এবং তাছাড়াও মানুষের চোখে সম্পত্তির গুরুত্বও এরকম। সেই গুরুত্ব এতটাই, যে তার সম্পত্তির ক্ষতি হয়ে যাওয়ার প্রতি ইয়োবের উদাসীন মনোভাবে অধিকাংশ মানুষ বিভ্রান্ত বোধ করে। ইয়োবের হৃদয়ে তখন কী ঘটছিল তার ব্যাখ্যার মাধ্যমে আজকে আমরা এই সব মানুষের অন্তরের এই বিভ্রান্তি দূরীভূত করতে চলেছি।

সাধারণ বুদ্ধিতে বলে যে ঈশ্বরের কাছ থেকে এরকম প্রভূত ঐশ্বর্য পেয়েও সেই সম্পদ হারানোর জন্য ঈশ্বরের সামনে ইয়োবের লজ্জিত হওয়া উচিত, কারণ সে সেই সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ ও যত্ন করতে পারেনি; ঈশ্বর তাকে যে সম্পদ দিয়েছিলেন তা সে রাখতে পারেনি। তাই, যখন সে শুনতে পেয়েছিল যে তার সম্পত্তি চুরি হয়ে গেছে, তার প্রথম প্রতিক্রিয়া হওয়া উচিত ছিল সেই অপরাধের জায়গায় যাওয়া আর যা যা হারিয়েছে সেই সবকিছুর একটা তালিকা তৈরি করা, ও তারপর ঈশ্বরের কাছে দোষ স্বীকার করা যাতে সে আরো একবার ঈশ্বরের আশীর্বাদ লাভ করতে পারে। কিন্তু ইয়োব এর কোনোটাই করেনি, এবং এরকম না করার জন্য তার নিজস্ব কিছু কারণ ছিল। ইয়োব গভীরভাবে বিশ্বাস করত যে তার যা কিছু আছে সব ঈশ্বরই তাকে দিয়েছেন, কিছুই তার নিজের শ্রমের ফল নয়। তাই, সে এই আশীর্বাদকে মূলধন হিসাবে ব্যবহার করার কথা ভাবেনি, বরং তার বেঁচে থাকার নীতিগুলোকে দৃঢ়বদ্ধ করেছিল সর্বশক্তি দিয়ে যে পথ তার ধরে রাখা উচিত তা ধরে রাখার জন্য। সে ঈশ্বরের আশীর্বাদকে সযত্নে লালন করেছিল এবং তার জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেছিল, কিন্তু সে আশীর্বাদে মোহিত হয়ে পড়েনি, বা আরও আশীর্বাদ প্রার্থনাও করেনি। সম্পত্তির প্রতি তার মনোভাব এরকমই ছিল। সে আশীর্বাদ লাভ করার লক্ষ্যেও কিছু করেনি, আবার ঈশ্বরের আশীর্বাদ কমে যাওয়ায় বা হারিয়ে যাওয়ায় চিন্তিত বা শোকস্তব্ধও হয়ে যায়নি; সে কখনোই ঈশ্বরের আশীর্বাদ লাভের ফলে বন্য ও বিকারগ্রস্তের মতো আনন্দিতও হয়নি, আবার প্রায়শই ঈশ্বরের আশীর্বাদ উপভোগ করার কারণে ঈশ্বরের করুণাকে ভুলে যায়নি বা ঈশ্বরের পথকে এড়িয়েও চলেনি। তার সম্পত্তির প্রতি ইয়োবের মনোভাব মানুষের কাছে তার প্রকৃত মানবিকতার রূপ প্রকাশিত করে: প্রথমত, ইয়োব লোভী ছিল না, এবং জাগতিক জীবনে সে চাহিদাবিহীন মানুষ ছিল। দ্বিতীয়ত, তার যা আছে সবই ঈশ্বর কেড়ে নেবেন এরকম দুশ্চিন্তা বা ভয় ইয়োবের কখনোই ছিল না, আর এটাই ঈশ্বরের প্রতি তার হৃদয়ের মনোভাব ও আনুগত্য; অর্থাৎ, ঈশ্বর তার কাছে থেকে সবকিছু কেড়ে নেবেন কি না বা কখন নেবেন সে বিষয়ে তার কোনো চাহিদা বা অভিযোগ ছিল না, এবং সে কারণ জানতে না চেয়েই শুধু ঈশ্বরের আয়োজনের প্রতি সমর্পিত থাকতে চেয়েছে। তৃতীয়ত, সে কখনো বিশ্বাস করেনি যে তার সম্পদ তার নিজের শ্রমের ফল, বরং বিশ্বাস করতো এই সমস্তই তার প্রতি ঈশ্বরের দান। এটাই হল ঈশ্বরের প্রতি ইয়োবের বিশ্বাস, আর এটাই তার দৃঢ়তার চিহ্ন। ইয়োবের মানবিকতা ও তার প্রকৃত দৈনন্দিন সাধনা কি এই তিনটে বক্তব্যে পরিষ্কার হয়েছে? ইয়োবের মানবিকতা ও সাধনা তার সম্পত্তির ক্ষতির সম্মুখে শান্ত আচরণের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ইয়োবের প্রাত্যহিক জীবনের সাধনাই তাকে ঈশ্বরের পরীক্ষার সময়ে আত্মিক উচ্চতা ও দৃঢ়তা প্রদান করেছিল এই বাক্য বলার: “যিহোবা দিয়েছিলেন, যিহোবাই ফিরিয়ে নিয়েছেন, যিহোবার নাম ধন্য হোক”। এই কথাগুলো রাতারাতি অর্জিত হয়নি, বা অকস্মাৎ ইয়োবের মস্তিষ্কে আবির্ভূত হয়নি। তার বহু বছরের জীবনের অভিজ্ঞতা লাভের সময় সে যা দেখেছে ও অর্জন করেছে এগুলো আসলে সেটাই। যারা ঈশ্বরের কাছে শুধু আশীর্বাদের সন্ধান করে, যারা ভয় পায় যে ঈশ্বর তাদের কাছ থেকে সমস্ত কিছু ছিনিয়ে নেবেন, এবং সেটাকে ঘৃণা করে ও সে সম্পর্কে অভিযোগ করে, তাদের তুলনায় ইয়োবের আনুগত্য কী অনেক বেশী বিশুদ্ধ নয়? যারা বিশ্বাস করে যে ঈশ্বর আছেন, কিন্তু তিনিই যে সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ড পরিচালনা করেন তা বিশ্বাস করে না, তাদের সকলের সাথে তুলনা করলে ইয়োব কি প্রভূত সততা ও ন্যায়পরায়ণতার অধিকারী নয়?

ইয়োবের যৌক্তিকতা

ইয়োবের বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং ন্যায়নিষ্ঠ ও সৎ মানবিকতাই তাকে সম্পত্তি ও সন্তানাদি হারানোর কালে সর্বাধিক যৌক্তিকতাপূর্ণ বিচার ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে চালিত করেছিল। এই ধরনের যুক্তিপূর্ণ পছন্দগুলো তার প্রাত্যহিক সাধনার সাথে, এবং ঈশ্বরের যেসকল কর্মের বিষয়ে সে তার দৈনন্দিন জীবনে জানতে পেরেছিল তার সাথে, অবিচ্ছেদ্য ভাবে জড়িত ছিল। ইয়োবের সততাই তাকে বিশ্বাস করতে সমর্থ করে তুলেছিল যে যিহোবাই সমস্ত বস্তুর নিয়ন্তা; তার বিশ্বাসই তাকে জানতে দিয়েছিল সমস্ত বস্তুর উপরে যিহোবা ঈশ্বরের সারভৌমত্বের বিষয়ে; তার জ্ঞানই তাকে যিহোবা ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব ও আয়োজন মান্য করার বিষয়ে ইচ্ছুক ও সক্ষম করে তুলেছিল; তার আনুগত্যই যিহোবা ঈশ্বরের প্রতি ভীতির ক্ষেত্রে তাকে আরো খাঁটি করে তুলেছিল; তার ভীতি তাকে মন্দ কর্ম পরিত্যাগের পথে আরো বিশুদ্ধ করে তুলেছিল; পরিশেষে, ইয়োবের ঈশ্বর ভীতি ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগের কারণেই সে নিখুঁত হয়ে উঠেছিল; তার নিখুঁত হয়ে ওঠাই তাকে প্রাজ্ঞ করে তুলেছিল, দিয়েছিল পরম যৌক্তিকতা।

“যুক্তিবাদী” শব্দটাকে আমাদের কীভাবে উপলব্ধি করা উচিত? আক্ষরিক ব্যাখ্যা অনুসারে এর অর্থ হল মঙ্গলময় বোধের অধিকারী হওয়া, চিন্তাভাবনায় যুক্তিসঙ্গত ও সংবেদনশীল হওয়া, দৃঢ় বক্তব্য, ক্রিয়াকলাপ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম হওয়া, এবং সঠিক ও স্বাভাবিক নৈতিক মানের অধিকারী হওয়া। তবুও ইয়োবের যৌক্তিকতা এত সহজে ব্যাখ্যা করা যায় না। যখন বলা হয় যে ইয়োব পরম যৌক্তিকতার অধিকারী ছিল, সে কথা তার মানবিকতা ও ঈশ্বরের সম্মুখে তার আচরণের বিষয়েই বলা হয়। সৎ হওয়ার কারণে, ইয়োব ঈশ্বরের সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস করতে ও তা মান্য করতে সক্ষম হয়েছিল, আর এটাই তাকে এমন জ্ঞান প্রদান করেছিল, যা বাকিদের পক্ষে অর্জন করা অসম্ভব ছিল; তার সাথে যা ঘটেছিল, সে এই জ্ঞানের মাধ্যমেই তা আরো সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে, বিচার করতে, ও সংজ্ঞায়িত করতে পেরেছিল, আর এগুলোই তাকে কী করতে হবে ও কীসে দৃঢ় থাকতে হবে তা নির্ভুল ও বিচক্ষণভাবে বেছে নিতে সক্ষম করেছিল। অর্থাৎ বলা যায় যে তার বাক্য, আচরণ, তার ক্রিয়াকলাপের পিছনে নিহিত নীতি, এবং কার্যকলাপের বিধি ছিল নিয়মিত, স্পষ্ট, ও সুনির্দিষ্ট, এবং তা অন্ধ, আবেগপ্রবণ, বা অনুভূতিপ্রবণ ছিল না। তার সাথে যা ঘটেছিল সেটার প্রতি কেমন আচরণ করতে হবে তা সে জানত, সে জানত কীভাবে জটিল ঘটনাগুলোর মধ্যে সম্পর্কে ভারসাম্য বজায় রাখতে এবং পরিচালনা করতে হয়, যে পথে দৃঢ় থাকা উচিত সেখানে কীভাবে দৃঢ় থাকতে হয় তা সে জানত, তাছাড়াও, যিহোবা ঈশ্বরের দেওয়া ও ফিরিয়ে নেওয়ার প্রতি কেমন মনোভাব দেখানো উচিত তা-ও সে জানত। এটাই ছিল ইয়োবের প্রকৃত যৌক্তিকতা। সুনির্দিষ্টভাবে এরকম যৌক্তিকতায় সজ্জিত ছিল বলেই তার সম্পত্তি ও পুত্র-কন্যাদের হারিয়েও ইয়োব বলেছিল, “যিহোবা দিয়েছিলেন, যিহোবাই ফিরিয়ে নিয়েছেন, যিহোবার নাম ধন্য হোক।”

যখন ইয়োব সমস্ত শরীরে প্রবল যন্ত্রণার সম্মুখীন হয়েছিল, যখন সে তার আত্মীয় ও বন্ধুদের অভিযোগের সম্মুখীন হয়েছিল, এবং যখন সে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিল, তখন ইয়োব যে আচরণ করেছিল তা আরও একবার তার প্রকৃত রূপ সকলকে দেখিয়েছিল।

ইয়োবের বাস্তবিক রূপ: প্রকৃত, বিশুদ্ধ, এবং কৃত্রিমতা বিহীন

ইয়োব ২:৭-৮ পড়া যাক: “শয়তান যিহোবার কাছ থেকে চলে গেল এবং ইয়োবের আপাদমস্তক যন্ত্রণাদায়ক ক্ষতে ভরিয়ে দিল। এবং সে গা চুলকানোর জন্য ভাঙ্গা কলসীর টুকরো নিয়ে ছাইয়ের গাদায় গিয়ে বসল।” সারা শরীরে যন্ত্রণাময় ফোঁড়ার প্রাদুর্ভাবের সময় ইয়োবের আচরণের বিষয়ে এই বিবরণ দেওয়া হয়েছে। এই সময়ে, ইয়োব যন্ত্রণা সহ্য করতে ছাইয়ের ওপর গিয়ে বসেছিল। কেউই তার তার চিকিৎসা করেনি, তার শরীরের যন্ত্রণা কমাতে কেউই সাহায্য করেনি; পরিবর্তে সে নিজের যন্ত্রণাময় ফোঁড়ার উপরিভাগ চেঁছে তোলার জন্য পাত্রের টুকরো ব্যবহার করেছিল। বাহ্যিকভাবে, এটা শুধু ছিল ইয়োবের যন্ত্রণার একটা পর্যায় মাত্র, এর সাথে ইয়োবের মানবিকতা বা ঈশ্বরের প্রতি ভীতির কোনো সম্পর্ক ছিল না, কারণ ইয়োব সেই সময়ে কোনো কথাই বলেনি যা থেকে তার মানসিক অবস্থা ও দৃষ্টিভঙ্গি বোঝা যায়। তবু তা সত্ত্বেও ইয়োবের ক্রিয়াকলাপ এবং আচরণই তার মানবিকতার প্রকৃত প্রকাশ। আগের অধ্যায়ের বিবরণে আমরা পড়েছি যে ইয়োব ছিল প্রাচ্যের শ্রেষ্ঠ মানুষ। ইতিমধ্যে, দ্বিতীয় অধ্যায়ের এই অনুচ্ছেদ থেকে আমরা দেখতে পাই যে প্রাচ্যের শ্রেষ্ঠ মানুষ সত্যিসত্যিই ছাইয়ের গাদায় বসে নিজের শরীর চুলকানোর জন্য ভাঙা কলসীর টুকরো তুলে নিয়েছিল। এই দুটো বিবরণের মধ্যে কি স্পষ্ট পার্থক্য দৃশ্যমান নয়? এই বৈপরীত্যই ইয়োবের প্রকৃত সত্তা আমাদের দেখায়: সম্মানীয় অবস্থান ও মর্যাদা থাকা সত্ত্বেও সে কখনো এসবের প্রতি কোনো অনুরাগ বা মনোযোগ প্রদর্শন করেনি; তার সামাজিক অবস্থানকে অন্যরা কীভাবে দেখত সে বিষয়ে তার কোনো মনোযোগ ছিল না, অথবা তার আচরণ বা ক্রিয়াকলাপ তার মর্যাদায় কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে কি না, সে বিষয়েও সে নিরুদ্বেগ ছিল; সে নিজের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য কোনো চেষ্টা করেনি, বা নিজের মর্যাদা ও অবস্থানের কারণে আসা মহিমাও সে উপভোগ করেনি। সে শুধু যিহোবা ঈশ্বরের নজরে নিজের জীবনযাপনের মূল্য ও গুরুত্বের প্রতি মনোযোগ দিয়েছিল। তাই ইয়োবের সারসত্যই ছিল তার প্রকৃত রূপ: সে খ্যাতি ও সৌভাগ্যকে ভালোবাসেনি, এগুলোর জন্য জীবন অবিবাহিতও করে নি; সে ছিল প্রকৃত, বিশুদ্ধ, এবং কৃত্রিমতা বিহীন।

ইয়োব কর্তৃক ভালোবাসা ও ঘৃণার পৃথকীকরণ

ইয়োবের ও তার স্ত্রীর এই কথোপকথনের মাধ্যমেও তার মানবিকতার অপর একটা দিক প্রদর্শিত হয়: “ইয়োবের স্ত্রী তখন তাঁকে বললেন, এখনও তুমি তোমার বিশ্বাস আঁকড়ে ধরে আছ? এর চেয়ে বরং ঈশ্বরকে ধিক্কার দিয়ে মৃত্যুবরণ কর। ইয়োব তাঁকে বললেন, তুমি মূর্খের মত কথা বলছ, ঈশ্বরের হাত থেকে আমরা কি শুধু মঙ্গলই গ্রহণ করব? অমঙ্গল কিছুই গ্রহণ করব না?” (ইয়োবে ২:৯-১০)। ইয়োবকে যন্ত্রণায় কষ্ট পেতে দেখে তার স্ত্রী যন্ত্রণা থেকে অব্যাহতি পেতে সাহায্য করার জন্য তাকে পরামর্শ দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তার এই “হিতকারী উদ্দেশ্য” ইয়োব অনুমোদন করেনি; পরিবর্তে এতে সে ক্রোধান্বিত হয়েছিল, কারণ তার স্ত্রী যিহোবা ঈশ্বরের প্রতি তার বিশ্বাস ও আনুগত্যকে অস্বীকার করেছিল, যিহোবা ঈশ্বরের অস্তিত্বকেও অস্বীকার করেছিল। এটা ছিল ইয়োবের পক্ষে অসহনীয়, কারণ সে কখনোই নিজেকে, বা অন্য কাউকেই এমন কোনো কাজ করতে অনুমতি দেয়নি যা ঈশ্বরের বিরোধিতা করে বা তাঁকে আহত করে। অন্যদের মুখে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে ধর্মনিন্দাকারী এবং অপমানজনক বাক্য শোনার পরেও সে কীভাবে উদাসীন থাকতে পারত? তাই সে নিজের স্ত্রীকে “নির্বোধ স্ত্রীলোক” বলে সম্বোধন করেছিল। নিজের স্ত্রীর প্রতি ইয়োবের মনোভাবে ছিল ক্রোধ ও ঘৃণা, সেইসাথে নিন্দা ও তিরস্কার। এটাই ছিল ইয়োবের মানবিকতার স্বাভাবিক প্রকাশ—ভালোবাসা এবং ঘৃণার পৃথকীকরণ—আর এটাই ছিল তার ন্যায়পরায়ণ মানবিকতার প্রকৃত উপস্থাপনা। ইয়োবের মধ্যে ন্যায়নিষ্ঠতার উপলব্ধি ছিল—যার ফলে সে মন্দত্বের প্রবণতাকে ঘৃণা করতে পেরেছিল, এবং অযৌক্তিক ধর্মদ্রোহ, হাস্যকর যুক্তি ও আজগুবি বক্তব্যকে ঘৃণা করতে, নিন্দা করতে ও প্রত্যাখ্যান করতে সক্ষম হয়েছিল, আর জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত ও নিকটজন কর্তৃক পরিত্যক্ত হওয়ার সময় সে তার নিজস্ব সঠিক নীতি ও অবস্থানে প্রকৃতই দৃঢ় থাকতে পেরেছিল।

ইয়োবের উদারতা এবং আন্তরিকতা

যেহেতু ইয়োবের আচরণ থেকেই আমরা তার মানবিকতার বিভিন্ন দিকের অভিব্যক্তি দেখতে পাই, তাহলে নিজের জন্ম দিবসকে অভিসম্পাত করার জন্য যখন ইয়োব মুখ খুলেছিল, সেখান থেকে আমরা তার মানবিকতার কোন দিকটা প্রত্যক্ষ করতে পারি? নিচের অংশে আমরা এই বিষয়টা নিয়েই আলোচনা করবো।

নিজের জন্মদিবসকে ইয়োবের অভিসম্পাত করার ঘটনার উৎপত্তি বিষয়ে আমি উপরে আলোচনা করেছি। তোমরা সেখানে কী দেখতে পাও? ইয়োব যদি কঠিন হৃদয়সম্পন্ন একজন মানুষ হতো, তার মধ্যে ভালোবাসা না থাকত, সে যদি নিঃস্পৃহ, আবেগবর্জিত ও মানবিকতাহীন হতো, তাহলে কি সে ঈশ্বরের হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষার বিষয়ে যত্নবান হতে পারত? ঈশ্বরের হৃদয়ের বিষয়ে যত্নবান ছিল বলেই কি সে নিজের জন্মের দিনটির প্রতি অভিসম্পাত করেছিল? অন্য ভাষায়, যদি ইয়োব কঠিন হৃদয়ের মানবিকতা বর্জিত মানুষ হতো, তাহলে ঈশ্বরের যন্ত্রণা কি তাকে পীড়িত করতে পারত? ঈশ্বর তার দ্বারা ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন বলেই কি সে তার জন্মের দিনটাকে অভিসম্পাত দিয়েছিল? উত্তর হল, একেবারেই না! সহৃদয় হওয়ার কারণে ইয়োব ঈশ্বরের হৃদয়ের প্রতি যত্নবান ছিল; ঈশ্বরের হৃদয়ের প্রতি যত্নবান ছিল বলেই ইয়োব ঈশ্বরের বেদনা অনুভব করেছিল; সহৃদয় ছিল বলেই সে ঈশ্বরের যন্ত্রণা অনুধাবন করার ফলে নিজে আরও বেশি যন্ত্রণা ভোগ করেছিল; ঈশ্বরের যন্ত্রণা অনুভব করেছিল বলেই সে তার জন্মের দিনটাকে ঘৃণা করতে শুরু করেছিল, এবং সেজন্যই তার জন্মের দিনটাকে অভিসম্পাত করেছিল। বাইরের লোকেদের কাছে, পরীক্ষার সময় ইয়োবের সম্পূর্ণ আচরণ ছিল দৃষ্টান্তমূলক। শুধুমাত্র নিজের জন্মের দিনটাকে অভিসম্পাত করাই ইয়োবের ত্রুটিহীনতা ও ন্যায়নিষ্ঠতার উপর একটা প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দেয়, অথবা একটা পৃথক মূল্যায়ন প্রদান করে। প্রকৃতপক্ষে, এটাই ছিল ইয়োবের মানবিকতার সারসত্যের বিশুদ্ধতম প্রকাশ। তার মানবিকতার সারসত্য প্রচ্ছন্ন বা মোড়কে আবৃত ছিল না, অথবা অন্য কারোর দ্বারা সংশোধিত ছিল না। নিজের জন্মের দিনটাকে অভিসম্পাত করার মাধ্যমে সে তার গভীর হৃদয়ের উদারতা ও আন্তরিকতা প্রদর্শন করেছিল; সে ছিল এমন একটা প্রস্রবণের মতো, যার জল এতই স্বচ্ছ ও পরিষ্কার যে তার তলদেশ পর্যন্ত দৃশ্যমান।

ইয়োবের বিষয়ে এই সমস্ত কিছু জানার পরে, বেশিরভাগ লোকই নিঃসন্দেহে ইয়োবের মানবিকতার সারসত্যের বিষয়ে বেশ নির্ভুল ও বস্তুগত মূল্যায়ন করবে। এছাড়াও তাদের মধ্যে ঈশ্বর কর্তৃক ব্যক্ত ইয়োবের ত্রুটিহীনতা ও ন্যায়নিষ্ঠতা সম্পর্কে দৃঢ়, বাস্তবিক এবং আরো উন্নত উপলব্ধি ও প্রশংসার মনোভাব থাকা উচিত। আশা করি, এই উপলব্ধি ও প্রশংসা মানুষকে ঈশ্বরে ভীতি ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগের প্রকৃত পথে চলার সূচনা করতে সাহায্য করবে।

—বাক্য, খণ্ড ২, ঈশ্বরকে জানার প্রসঙ্গে, ঈশ্বরের কর্ম, ঈশ্বরের স্বভাব এবং স্বয়ং ঈশ্বর ২

পূর্ববর্তী: শয়তান আরো একবার ইয়োবকে প্রলুব্ধ করে (ইয়োবের সারা শরীর জুড়ে যন্ত্রণাময় ফোঁড়া দেখা দিল) (পর্ব ২)

পরবর্তী: ঈশ্বরের ইয়োবকে শয়তানের হাতে তুলে দেওয়া এবং ঈশ্বরের কাজের লক্ষ্যের মধ্যে সম্পর্ক

প্রতিদিন আমাদের কাছে 24 ঘণ্টা বা 1440 মিনিট সময় থাকে। আপনি কি ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভের জন্য তাঁর বাক্য শিখতে 10 মিনিট সময় দিতে ইচ্ছুক? শিখতে আমাদের ফেলোশিপে যোগ দিন। কোন ফি লাগবে না।

সম্পর্কিত তথ্য

ষষ্ঠ দিবসে, সৃষ্টিকর্তা কথা বলেন, এবং তাঁর মনের মধ্যে থাকা প্রতিটি জীব একাদিক্রমে আবির্ভূত হয়

ইন্দ্রিয়াতীতভাবে, সৃষ্টিকর্তার সমস্ত সৃষ্টিকার্য পাঁচ দিন ধরে অব্যাহত ছিল, ঠিক তার পরপরই সৃষ্টিকর্তা তাঁর সকল বস্তু সৃষ্টির ষষ্ঠ দিবসকে...

শয়তানকে দেখে মানবিক, ন্যায়পরায়ণ ও সদ্গুনসম্পন্ন মনে হলেও, শয়তানের সারসত্য নিষ্ঠুর ও অশুভ

মানুষকে প্রতারণার মাধ্যমে শয়তান তার সুনাম নির্মাণ করে, এবং নিজেকে প্রায়শই ন্যায়পরায়ণতার একজন পুরোধা তথা আদর্শ নমুনা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে।...

ঈশ্বর হবাকে সৃষ্টি করলেন

আদিপুস্তক ২:১৮-২০ তারপর প্রভু পরমেশ্বর বললেন, মানুষের একা থাকা ভাল নয়, আমি তাকে তার যোগ্য এক সঙ্গিনী দেব। প্রভু পরমেশ্বর মৃত্তিকা থেকে...

তৃতীয় দিবসে, ঈশ্বরের বাক্যসমূহ জন্ম দেয় পৃথিবী এবং সমুদ্রের এবং ঈশ্বরের কর্তৃত্ব বিশ্বে প্রাণসঞ্চার করে

এরপর, পাঠ করা যাক আদিপুস্তক ১:৯-১১-এর প্রথম বাক্যটি: “ঈশ্বর বললেন, আকাশের নীচে সমস্ত জলরাশি এক স্থানে সংহত হোক, প্রকাশিত হোক শুষ্ক ভূমি!”...

সেটিংস

  • লেখা
  • থিমগুলি

ঘন রং

থিমগুলি

ফন্টগুলি

ফন্ট সাইজ

লাইনের মধ্যে ব্যবধান

লাইনের মধ্যে ব্যবধান

পৃষ্ঠার প্রস্থ

বিষয়বস্তু

অনুসন্ধান করুন

  • এই লেখাটি অনুসন্ধান করুন
  • এই বইটি অনুসন্ধান করুন

Messenger-এর মাধ্যমে আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন