তৃতীয় পর্ব: ঈশ্বর মানবজাতিকে লালনের জন্য পরিবেশ ও প্রাণীজগতের সংরক্ষণ করেন
ঈশ্বর সকলকিছু সৃষ্টি করেছিলেন এবং সেগুলির সীমারেখা স্থাপন করেছিলেন; এই সকলকিছুর মধ্যে তিনি সকল প্রকার জীবিত বস্তুর প্রতিপালন করেছিলেন। একই সঙ্গে, মানবজাতির উদ্দেশ্যে জীবনধারণের বিভিন্ন উপায়ও তিনি প্রস্তুত করেছিলেন, অতএব তুমি দেখতে পাও যে, মানবজাতির জীবনধারণের কেবল যে একটিমাত্রই উপায় রয়েছে, এমন নয়, তাদের জীবনধারণের উপযোগী কেবল যে এক ধরনেরই পরিবেশ বিদ্যমান, তা-ও নয়। পূর্বে আমরা ঈশ্বর কর্তৃক মানুষের জন্য নানাবিধ খাদ্য ও জলের উৎসের প্রস্তুতিকরণের বিষয়ে আলোচনা করেছিলাম, যে খাদ্য ও জল মানবজাতির জীবনকে দৈহিকভাবে অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই মানবজাতির ভিতর সকল মানুষই যে খাদ্যশস্য খেয়ে প্রাণধারণ করে তা নয়। ভৌগোলিক পরিবেশ ও ভূমিরূপের পার্থক্যের কারণে মানুষের জীবনধারণের বিভিন্ন উপায় থাকে। জীবনধারণের এইসকল উপায়গুলি ঈশ্বরের দ্বারা প্রস্তুতকৃত। তাই সকল মানুষই প্রাথমিকভাবে কৃষিকাজে নিযুক্ত নয়। অর্থাৎ, সকল মানুষই যে ফসল উৎপাদনের মাধ্যমে তাদের খাদ্য আহরণ করে, তা নয়। এবার আমরা তৃতীয় অংশটির বিষয়ে আলোচনা করতে চলেছি: মানবজাতির নানাবিধ বৈচিত্রময় জীবনশৈলীর কারণে, সীমারেখার উদ্ভব ঘটেছে। তাহলে মানুষের অন্যান্য কী কী প্রকারের জীবনশৈলী বিদ্যমান? খাদ্যের উৎসের প্রকারভেদ অনুযায়ী অন্য কী কী ধরনের মানুষ রয়েছে? বেশ কিছু মৌলিক প্রকারের মানুষ রয়েছে।
প্রথম প্রকারটি হল শিকারজীবী জীবনশৈলী। সেটা কী তা সকলেই জানে। শিকার অবলম্বন করে যারা জীবনধারণ করে তারা কী খায়? (শিকার করা পশুপাখি।) তারা অরণ্যের পশুপাখি আহার করে। “শিকার করা পশুপাখি” একটি আধুনিক শব্দবন্ধ। শিকারীরা বিষয়টিকে ক্রীড়া হিসাবে দেখে না; তারা তা গণ্য করে খাদ্য হিসাবে, তাদের দৈনন্দিন পরিপোষণ আকারে। ধরা যাক, কেউ একজন একটি হরিণ শিকার করেছে। তাদের এই হরিণ শিকার করাটা একজন কৃষকের মাটি থেকে খাদ্য আহরণ করার অনুরূপ। একজন কৃষক জমি থেকে খাদ্য সংগ্রহ করে, এবং এই খাদ্য যখন সে দেখে, তখন সে খুশি ও স্বচ্ছন্দ বোধ করে। ভোজনের পক্ষে পর্যাপ্ত ফসল থাকলে, পরিবার আর ক্ষুধার্ত থাকবে না। কৃষকের হৃদয় হয় উদ্বেগমুক্ত, এবং সে পরিতৃপ্ত বোধ করে। একজন শিকারীও তার শিকার-লব্ধ বস্তুকে দেখে স্বচ্ছন্দ ও পরিতৃপ্ত বোধ করে কারণ তাকে আর খাদ্যের বিষয়ে উদ্বিগ্ন হতে হবে না। পরবর্তী ভোজনকালে আহারের উপযোগী কিছু একটা রয়েছে, এবং ক্ষুধার্ত থাকার আর প্রয়োজন নেই। এ হল এমন এক ব্যক্তি যে জীবনধারণের জন্য শিকার করে। শিকারের দ্বারা যারা ক্ষুন্নিবৃত্তি করে, তাদের অধিকাংশই পার্বত্য অরণ্যে বসবাস করে। এরা কৃষিকাজ করে না। সেইসকল অঞ্চলে কর্ষণযোগ্য জমি পাওয়া দুষ্কর, তাই তারা বিভিন্ন জীবন্ত প্রাণীর উপর, শিকার-লব্ধ পশুর উপর, নির্ভর করে জীবনধারণ করে। এই হল সাধারণ মানুষের থেকে স্বতন্ত্র প্রথম প্রকারের জীবনশৈলী।
দ্বিতীয় প্রকারটি হল পশুপালকের জীবনপ্রণালী। জীবিকার জন্যে যারা পশুপালন করে তারা কি জমিতে কৃষিকাজও করে? (না।) কীভাবে তারা জীবনধারণ করে? (বছরের অধিকাংশ সময় জীবিকার জন্য তারা গবাদি পশু ও মেষ পালন করে, এবং শীতের সময় তাদের সেই পশুসম্পদকে বধ করে তারা ভক্ষণ করে। তাদের প্রধান খাদ্য হল গোমাংস ও মেষমাংস, এবং তারা দুধ সহযোগে চা পান করে। পশুপালকরা বছরের চারটি ঋতুতেই কর্মব্যস্ত থাকে বটে, কিন্তু তাদের খাওয়াদাওয়ার মান বেশ ভালো। দুধ, দুগ্ধজাত সামগ্রী ও মাংস তাদের পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকে।) জীবিকার জন্য যারা পশুপালন করে মুখ্যত তারা গোমাংস ও মেষমাংস আহার করে, মেষ ও গরুর দুধ পান করে, এবং গবাদি পশু ও ঘোড়ার পিঠে চড়ে তাদের পালিত পশুদের তারা চারণভূমিতে চরাতে নিয়ে যায়। তাদের চুলের মধ্যে দিয়ে বাতাস খেলে যায়, রোদ্দুর এসে পড়ে তাদের মুখে। আধুনিক জীবনের মানসিক চাপের সম্মুখীন তাদের হতে হয় না। সারাদিন তারা সুনীল আকাশ ও তৃণাচ্ছন্ন প্রান্তরের উন্মুক্ত বিস্তারের দিকে চেয়ে থাকে। পশুপালনজীবী মানুষদের অধিকাংশ তৃণভূমি অঞ্চলে বাস করে, এবং প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তারা তাদের যাযাবরসুলভ জীবনধারা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। কিছুটা একাকিত্বময় হলেও তৃণভূমির জীবন অত্যন্ত সুখের জীবনও বটে। এই জীবনরীতি মন্দ নয়!
জীবনরীতির তৃতীয় প্রকারটি হল মৎস্যশিকারীর জীবন। মনুষ্যজাতির একটি ক্ষুদ্রাংশ সমুদ্রের তীরে বা ক্ষুদ্র দ্বীপে বাস করে। তাদের বাসভূমি জল দ্বারা পরিবেষ্টিত, সমুদ্র অভিমুখী। জীবিকার জন্য এই মানুষগুলি মৎস্যশিকার করে। মৎস্যজীবী মানুষদের খাদ্যের উৎস কী? তাদের খাদ্যের উৎসগুলির অন্তর্ভুক্ত রয়েছে সকল প্রকার মৎস্য, সামুদ্রিক আহার্য, এবং অন্যান্য সমুদ্রজাত পদার্থ। মৎস্যজীবীগণ জমিতে কৃষিকাজ করে না, পরিবর্তে তাদের প্রত্যেকটা দিন অতিবাহিত হয় মৎস্যশিকার করে। তাদের প্রধান খাদ্যের মধ্যে পড়ে বিভিন্ন ধরনের মাছ ও সমুদ্রজাত দ্রব্য। সময় বিশেষে সেগুলির বিনিময়ে তারা চাল, আটা-ময়দা ও অত্যাবশ্যক প্রাত্যহিক সামগ্রী ক্রয় করে। এ হল জলের নিকটে বসবাসকারী মানুষদের দ্বারা নির্বাহিত এক ভিন্নপ্রকার জীবনশৈলী। জলের কাছাকাছি বসবাস করার ফলে তাদের খাদ্যের জন্য তারা জলের উপর নির্ভর করে, এবং মাছ ধরার মাধ্যমে তারা তাদের জীবিকা নির্বাহ করে। মৎস্যশিকার শুধু যে তাদের খাদ্যের একটা উৎসের সন্ধান দেয় তা-ই নয়, এই কাজ তাদের জীবিকানির্বাহের উপায়ও বটে।
জমিতে কৃষিকাজ করা ছাড়াও মানুষ প্রধানত উল্লিখিত জীবনযাত্রার তিনটি পদ্ধতি অনুযায়ী জীবন নির্বাহ করে। কিন্তু, মানুষদের গরিষ্ঠ অংশ জীবিকার প্রয়োজনে কৃষিকাজই করে, মানুষের স্বল্প কয়েকটি গোষ্ঠী কেবল পশুপালন, মৎস্যশিকার, এবং পশুপাখি শিকারের মাধ্যমে জীবননির্বাহ করে। কৃষিজীবী মানুষদের কীসের প্রয়োজন রয়েছে? তাদের প্রয়োজন হয় জমির। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মাটিতে ফসল বপন করে তারা জীবনধারণ করে, এবং শাকসবজি, ফলমূল অথবা খাদ্যশস্য, যা-ই তারা বপন করুক না কেন, মৃত্তিকা থেকেই তারা তাদের খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী লাভ করে।
এই বিভিন্ন জীবনশৈলীগুলি যে প্রাথমিক শর্তগুলির উপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে সেগুলি কী? যে পরিবেশে তারা জীবনধারণ করতে সক্ষম তাকে এক বুনিয়াদি স্তর থেকে সংরক্ষণ করা কি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় নয়? অর্থাৎ, যারা শিকারের মাধ্যমে জীবনধারণ করে তারা যদি পার্বত্য অরণ্য বা পশুপাখি খুইয়ে ফেলতো, তাহলে তাদের জীবিকানির্বাহের উৎস নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতো। এই মানবগোষ্ঠী ও এই ধরনের মানুষগুলির কোন অভিমুখে যাওয়া উচিৎ তা অনিশ্চিত হয়ে পড়তো এবং এমনকি হয়তো তাদের অস্তিত্বই লোপ পেতো। আর যারা জীবিকার জন্য পশুপালন করে তাদের বিষয়টা কীরকম? তারা কীসের উপর নির্ভর করে? তারা প্রকৃতপক্ষে যার উপর নির্ভর করে তা তাদের পালিত পশু নয়, বরং তা হল সেই পরিবেশ যেখানে তাদের পালিত পশুগুলি বেঁচে থাকতে পারে—অর্থাৎ, তৃণভূমি। যদি কোনো তৃণভূমি না থাকতো তাহলে পশুপালকরা কোথায় গিয়ে পশুচারণ করত? গবাদি পশু ও মেষগুলি তাহলে কী ভক্ষণ করতো? পালিত পশু না থাকলে এই যাযাবর মানুষগুলির কোনো জীবিকা থাকতো না। জীবিকা নির্বাহের উৎসের অবর্তমানে এই মানুষগুলি কোথায় যেতো? জীবনযাপন অব্যাহত রাখা তাদের পক্ষে অত্যন্ত দুরূহ হয়ে পড়তো; তাদের কোনো ভবিষ্যৎ থাকতো না। যদি জলের কোনো উৎস না থাকতো, এবং নদী ও হ্রদগুলি সম্পূর্ণ শুকিয়ে যেতো, তাহলে তখনো কি বেঁচে থাকার জন্য জলের উপর নির্ভরশীল ওই সমস্ত মাছের অস্তিত্ব থাকতো? থাকতো না। জীবিকার জন্য জল ও মাছের উপর নির্ভরশীল এই মানুষগুলির জীবন কি অব্যাহত থাকতো? এই মানুষগুলি যখন খাদ্য বা জীবিকার সকল উৎস হারিয়ে ফেলতো, তখন তারা তাদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে অসমর্থ হতো। অর্থাৎ, কোনো বিশেষ জনগোষ্ঠী যদি কখনো তাদের জীবিকা বা জীবনধারণের বিষয়ে সমস্যায় সম্মুখীন হতো, তাহলে সেই জনগোষ্ঠী টিকতো না, পৃথিবীর বুক থেকে তারা নিশ্চিহ্ন ও অবলুপ্ত হয়ে যেতো। এবং জীবিকার উদ্দেশ্যে যারা কৃষিকাজ করে তারা যদি তাদের জমি হারিয়ে ফেলতো, যদি তারা যাবতীয় উদ্ভিদের চাষ করে সেগুলির থেকে খাদ্য আহরণ করতে অসমর্থ হতো, তাহলে পরিণতি কী হতো? খাদ্যের অভাবে এই মানুষগুলি কি অনাহারে মারা পড়তো না? আর মানুষ যদি অনাহারে প্রাণত্যাগ করে, তাহলে সেই মানবসম্প্রদায় কি নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতো না? তাহলে, এই হল ঈশ্বরের নানান রকমের পরিবেশের রক্ষণাবেক্ষণ করার উদ্দেশ্য। বিভিন্ন পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র এবং তাদের মধ্যে থাকা বিভিন্ন জীবন্ত প্রাণীকে বজায় রাখার জন্য ঈশ্বরের শুধু একটিমাত্র উদ্দেশ্যই রয়েছে—এবং তা হলো সমস্ত ধরনের মানুষকে লালনপালন করা, তাদের লালনপালন করা যারা বিভিন্ন ভৌগোলিক পরিবেশে বসবাস করে।
যদি সৃষ্টির সমস্ত জিনিস তাদের নিজস্ব নিয়ম-নীতি হারিয়ে ফেলে, তাহলে তাদের আর অস্তিত্ব থাকবে না; যদি সমস্ত জিনিসের নিয়ম-নীতি হারিয়ে যায়, তাহলে সমস্ত কিছুর মধ্যে জীবন্ত প্রাণীগুলি জীবগুলি আর টিকে থাকতে পারবে না। মনুষ্যজাতিও তাদের সেই পরিবেশ হারিয়ে ফেলবে যার উপর তারা বেঁচে থাকার জন্য নির্ভর করে। মানবজাতি যদি সেগুলি সব হারিয়ে ফেলে, তাহলে তারা আর এগোতে পারবে না, প্রজন্মের পর প্রজন্ম উন্নতি ও সংখ্যাবৃদ্ধি করার জন্য তারা যেমনটা করে আসছে। মানবজাতি যে এখনো পর্যন্ত স্বীয় অস্তিত্ব বজায় রেখেছে, তার কারণ হল তাদের প্রতিপালনের উদ্দেশ্যে, বিবিধ উপায়ে মানবজাতির লালনপালন করার জন্য, ঈশ্বর মানুষকে সৃষ্টির সকলকিছুর যোগান দিয়েছেন। মানবজাতিকে ঈশ্বর বিভিন্ন উপায়ে লালন করে বলেই কেবল মানবজাতি এখনো এই বর্তমান সময় পর্যন্ত টিকে রয়েছে। জীবনধারণের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট, অনুকূল ও সুশৃঙ্খল প্রাকৃতিক বিধানসম্পন্ন পরিমণ্ডল থাকার ফলেই পৃথিবীর সমস্ত মানুষ, বিবিধ জনগোষ্ঠী সমুদয় তাদের স্ব-স্ব নির্ধারিত এলাকার ভিতর জীবন নির্বাহ করতে পারে। কেউই সেই সকল এলাকা বা সেগুলির মধ্যবর্তী সীমারেখাসমূহ অতিক্রম করে যেতে পারে না, কারণ সেগুলি নির্ধারিত হয়েছে ঈশ্বরের দ্বারা। ঈশ্বর কেন এইভাবে সীমানা নির্ধারণ করতে গিয়েছিলেন? সমগ্র মানবজাতির জন্য এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়—প্রকৃতপক্ষেই অত্যন্ত গুরুত্ববাহী! প্রত্যেক প্রকার জীবিত সত্তার জন্য ঈশ্বর একটি নির্দিষ্ট পরিসর চিহ্নিত করে দিয়েছিলেন এবং প্রতিটি প্রকারের মানুষের উদ্বর্তনের কোনো না কোনো পন্থা সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন। একই সঙ্গে, পৃথিবীর বুকে বিবিধ প্রকারের মানুষ ও বিভিন্ন জনগোষ্ঠীকে তিনি বিভাজিত করেছিলেন, এবং তাদের জন্য একটা পরিসর স্থাপন করেছিলেন। এবার এই বিষয়েই আমরা আলোচনা করবো।
—বাক্য, খণ্ড ২, ঈশ্বরকে জানার প্রসঙ্গে, স্বয়ং অনন্য ঈশ্বর ৯