যদিও ঈশ্বরের ক্রোধ মানুষের কাছে লুক্কায়িত ও অজ্ঞাত, তবু তা কোনো অপরাধ বরদাস্ত করে না
সমগ্র মানবতার প্রতি, মূর্খ ও অজ্ঞান মানবতার প্রতি, ঈশ্বরের আচরণ মূলত করুণা ও সহনশীলতার ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। উল্টো দিকে, তাঁর ক্রোধ অধিকাংশ সময় ও অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রচ্ছন্ন রাখা থাকে, এবং মানুষের কাছে তা অজ্ঞাত। ফলস্বরূপ, মানুষের পক্ষে ঈশ্বরকে ক্রোধ প্রকাশ করতে দেখাটা দুষ্কর, এবং তাঁর ক্রোধকে উপলব্ধি করাটাও কঠিন। বস্তুত, ঈশ্বরের ক্রোধকে মানুষ হালকা ভাবে দেখে। মানুষ যখন ঈশ্বরের অন্তিম কাজ এবং মানুষের প্রতি সহনশীলতা ও ক্ষমাপরায়ণতার পর্যায়ের সম্মুখীন হয়—অর্থাৎ, যখন ঈশ্বরের কৃপার অন্তিম দৃষ্টান্ত ও তাঁর শেষ সাবধানবাণী মানবজাতির উপর নেমে আসে—মানুষ যদি তখনো ঈশ্বরকে প্রতিরোধ করার একই পদ্ধতি ব্যবহার করে এবং অনুতপ্ত হওয়ার, তাদের জীবনধারাকে সংশোধন করার ও তাঁর করুণাকে গ্রহণ করার কোনো চেষ্টা না করে, তাহলে তখন ঈশ্বর আর তাদের উপর তাঁর সহিষ্ণুতা ও ধৈর্য বর্ষণ করবেন না। বরং উল্টে, এই সময় ঈশ্বর তাঁর করুণা প্রত্যাহার করে নেবেন। অতঃপর, তিনি কেবলই তাঁর ক্রোধ প্রেরণ করবেন। তিনি বিভিন্ন উপায়ে তাঁর ক্রোধ অভিব্যক্ত করতে পারেন, ঠিক যেমন মানুষকে শাস্তি দিতে ও ধ্বংস করতেও তিনি বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারেন।
সদোম নগরী ধ্বংস করতে ঈশ্বরের যে অগ্নির ব্যবহার, তা হল মানবতা বা অন্য কোনো কিছুকে সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন করার জন্য তাঁর ক্ষিপ্রতম পদ্ধতি। সদোমের লোকজনের দগ্ধীভবন তাদের কায়িক দেহের চেয়ে অতিরিক্ত কিছুকে ধ্বংস করেছিল; তা সামগ্রিকভাবে তাদের মনন, তাদের আত্মা ও তাদের দেহকে ধ্বংস করেছিল, এবং এইভাবে তা নিশ্চিত করেছিল যে এই নগরীর অধিবাসীদের অস্তিত্ব শুধু লৌকিক জগৎ থেকে নয়, মানুষের কাছে যে জগৎ অদৃশ্য, তা থেকেও অবলুপ্ত হল। এ হল ঈশ্বরের ক্রোধ প্রকাশ ও অভিব্যক্ত করার এক পন্থা। উদ্ঘাটন ও অভিব্যক্তির এই পদ্ধতি ঈশ্বরের ক্রোধের সারসত্যের একটি দিক, ঠিক যেমন তা স্বভাবতই ঈশ্বরের ধার্মিক প্রকৃতির সারসত্যের একটি উদ্ঘাটনও বটে। ঈশ্বর যখন তাঁর ক্রোধ প্রেরণ করেন, তিনি তখন তাঁর প্রেমময় করুণা প্রকাশে ক্ষান্ত হন, তিনি তাঁর আর কোনো সহিষ্ণুতা বা ধৈর্যও প্রদর্শনও করেন না; এমন কোনো ব্যক্তি, বস্তু বা হেতু নেই যা তাঁকে তাঁর ধৈর্য বজায় রাখতে, পুনরায় তাঁর করুণা বিতরণ করতে, আরেকবার তাঁর সহিষ্ণুতা প্রদর্শন করতে রাজি করাতে পারে। এগুলির পরিবর্তে, মুহূর্তের জন্যও দ্বিধা না করে, ঈশ্বর তাঁর ক্রোধ ও মহিমা প্রেরণ করেন, তাঁর যেমন বাসনা তেমন-ই করেন। এই জিনিসগুলি তিনি তাঁর নিজের ইচ্ছা অনুসারে, ত্বরিত গতিতে এবং পরিচ্ছন্ন ভাবে সম্পাদন করবেন। এভাবেই ঈশ্বর তাঁর ক্রোধ ও মহিমা প্রেরণ করেন, যেগুলিকে মানুষ অবশ্যই লঙ্ঘন করবে না, এবং এ তাঁর ধার্মিক প্রকৃতির একটি অভিমুখের বহিঃপ্রকাশও বটে। মানুষ যখন ঈশ্বরকে তাদের প্রতি মমতা ও ভালোবাসা প্রদর্শন করতে প্রত্যক্ষ করে, তখন তারা তাঁর ক্রোধকে সনাক্ত করতে, তাঁর মহিমাকে দর্শন করতে বা অপরাধের প্রতি তাঁর অসহিষ্ণুতাকে অনুভব করতে অসমর্থ হয়। এই বিষয়গুলি সবসময় মানুষকে এই বিশ্বাসের দিকে চালিত করেছে যে ঈশ্বরের ধার্মিক প্রকৃতি কেবলমাত্র তাঁর করুণাঘন, সহিষ্ণু ও প্রেমময় প্রকৃতি। কিন্তু, কেউ যখন ঈশ্বরকে একটি নগরী ধ্বংস করতে বা মানবতাকে ঘৃণা করতে দেখে, মানব-সংহারে তাঁর রোষ ও তাঁর মহিমা মানুষকে তাঁর ধার্মিক প্রকৃতির অপর দিকটি এক ঝলক দেখার দেখার সুযোগ দেয়। এটাই অপরাধের প্রতি ঈশ্বরের অসহিষ্ণুতা। ঈশ্বরের যে প্রকৃতি কোনো অপরাধ সহ্য করে না, তা যেকোনো সৃজিত সত্তার সকল কল্পনাকে ছাপিয়ে যায়, এবং অসৃজিত সত্তাদের মধ্যে কেউ সেখানে হস্তক্ষেপ করতে বা তা প্রভাবিত করতে সক্ষম নয়; তা মূর্ত করা বা তার অনুকরণ করা তো আরো দুষ্কর। তাই, ঈশ্বরের স্বভাবের এই দিকটিই মানুষের সবুচেয়ে বেশি করে জানা উচিৎ। কেবলমাত্র স্বয়ং ঈশ্বরেরই এই ধরনের স্বভাব রয়েছে, এবং কেবলমাত্র স্বয়ং ঈশ্বরই এহেনস্বভাবের অধিকারী। ঈশ্বর এই প্রকার ধার্মিক স্বভাবের অধিকারী কারণ তিনি ঘৃণা করেন অসদাচার, অন্ধকার, বিদ্রোহী মনোভাব, ও শয়তানের পাপ কর্ম—যে পাপ মানবজাতিকে ভ্রষ্ট ও গ্রাস করে— এর কারণ হল যে, তিনি তাঁর বিরুদ্ধে কৃত সকল পাপ কর্মকে ঘৃণা করেন, এবং এর কারণ হল তাঁর পবিত্র ও অকলুষিত সারসত্য। এই কারণেই কোনো সৃজিত বা অসৃজিত সত্তা প্রকাশ্যে তাঁর বিরোধিতা করবে বা তাঁর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে,তা তিনি বরদাস্ত করবেন না। এমনকি যে ব্যক্তির প্রতি একদা তিনি করুণা দেখিয়েছেন বা যাকে তিনি মনোনীত করেছেন, সে-ও যদি তাঁর প্রকৃতিকে প্ররোচিত করে এবং তাঁর ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার নীতিকে লঙ্ঘন করে, তাহলে কণামাত্র করুণা বা দ্বিধার অবকাশ না রেখে ঈশ্বর অবারিত ও প্রকাশিত করবেন তাঁর ধার্মিক প্রকৃতিকে, যে প্রকৃতি কোনো অপরাধ সহ্য করেনা।
—বাক্য, খণ্ড ২, ঈশ্বরকে জানার প্রসঙ্গে, স্বয়ং অনন্য ঈশ্বর ২