বন্যার পরে নোহকে ঈশ্বরের আশীর্বাদ
আদিপুস্তক ৯:১-৬ ঈশ্বর নোহ এবং তাঁর পুত্রদের আশীর্বাদ করে বললেন, তোমরা প্রজাবন্ত হও এবং বৃদ্ধিলাভ করে পৃথিবী পরিপূর্ণ কর। পৃথিবীর সকল পশু, আকাশের সকল পাখী, ভূচর যাবতীয় সরীসৃপ ও সমুদ্রের মৎস্যকুল তেমাদের ভয়ে ভীত ও সন্ত্রস্ত হবে। তোমাদের হাতেই তাদের সকলকে সমর্পণ করা হয়েছে। সঞ্চরণশীল সমস্ত প্রাণীই হবে তোমাদের ভক্ষ্য। হরিৎ উদ্ভিদ্রাজির মত সেগুলিও আমি তোমাদের দিলাম। কেবল তোমরা কাঁচা মাংস অর্থাৎ রক্তসমেত মাংস ভক্ষণ করো না। কারণ রক্তই জীবন। তোমাদের রক্তপাত ও জীবনহানির প্রতিশোধ আমি অবশ্যই নেব। কোন পশু যদি মানুষের রক্তপাত ঘটায়, আমি তার প্রতিশোধ নেব এবং মানুষের ক্ষেত্রে কেউ যদি অন্যের জীবনহানি করে তবে আমি তারও প্রতিশোধ নেব। মানুষের রক্তপাত যে করবে তারও রক্তপাত হবে মানুষের হাতে কারণ ঈশ্বরের সাদৃশ্যে সৃষ্ট হয়েছে মানুষ।
এই অনুচ্ছেদে তোমরা কী দেখতে পাচ্ছ? আমি কেন এই স্তবকগুলোকেই বেছে নিয়েছি? জাহাজে নোহ ও তার পরিবারের জীবন সম্পর্কে কোনো উদ্ধৃতি আমি কেন বেছে নিইনি? কারণ আমরা আজ যে বিষয়ে আলোচনা করছি তার সঙ্গে সেই তথ্যের খুব একটা বেশি সংযোগ নেই। যে বিষয়টার উপর আমরা মনোনিবেশ করছি তা হল ঈশ্বরের স্বভাব। তোমরা যদি ঐসব বিষয়ে বিশদ জানতে চাও তাহলে নিজেরা বাইবেল তুলে নিয়ে পাঠ করে দেখতে পারো। এখানে আমরা ঐসব বিষয়ে আলোচনা করব না। আজ আমরা মূল যে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করছি, তা হল কীভাবে ঈশ্বরের কার্য সম্বন্ধে জানা যেতে পারে।
নোহ যখন ঈশ্বরের নির্দেশ অনুযায়ী একটা জাহাজ নির্মাণ করল এবং যে দিনগুলোতে ঈশ্বর বন্যার মাধ্যমে পৃথিবীকে ধ্বংস করে দিলেন সেই দিনগুলো বেঁচে থাকল, তখন তার আটজনের পরিবার রক্ষা পেল। নোহর পরিবারভুক্ত আটজন সদস্য ব্যতীত সমগ্র মানবজাতি ধ্বংস হল, এবং পৃথিবীর সমস্ত জীবিত প্রাণীকুলও ধ্বংস হল। নোহকে ঈশ্বর আশীর্বাদ দিলেন, এবং তাঁকে ও তাঁর পুত্রদের কিছু বিষয়ে বললেন। সেগুলো ছিল সেইসকল বিষয় যা ঈশ্বর তার উপর অর্পণ করেছিলেন, এবং সেগুলো তার প্রতি ঈশ্বরের আশীর্বাদও ছিল। এই আশীর্বাদ ও প্রতিশ্রুতিই ঈশ্বর তাদের দেন যারা তাঁকে শুনতে পায় ও তাঁর নির্দেশ গ্রহণ করে, এবং এইভাবেই ঈশ্বর মানুষকে পুরস্কৃত করেন। অর্থাৎ, ঈশ্বরের চোখে নোহ একজন নিখুঁত মানুষ বা ধার্মিক মানুষ ছিল কি না, অথবা সে ঈশ্বর সম্বন্ধে কতটুকু জানত, তা নির্বিশেষে, সংক্ষেপে বলতে গেলে, সে ও তার তিন পুত্র ঈশ্বরের বাক্যগুলো পালন করেছিল, ঈশ্বরের কার্যের সঙ্গে সহযোগিতা করেছিল, এবং ঈশ্বেরের নির্দেশাবলির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ভাবে তাদের যা করণীয় তা করেছিল। এর ফলস্বরূপ, বন্যার অভিঘাতে এই পৃথিবীর ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে, তারা ঈশ্বরের জন্য মানবজাতি ও বিভিন্ন ধরনের প্রাণীকুলকে সংরক্ষণ করেছিল, ঈশ্বরের পরিচালনামূলক পরিকল্পনার পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল। যা কিছু সে করেছিল সেসবের কারণে ঈশ্বর তাকে আশীর্বাদ করেছিলেন। হয়তো আজকের মানুষের কাছে নোহ যা করেছিল তা এমনকি উল্লেখের যোগ্যও ছিল না। কেউ কেউ হয়তো এমনকি এমনও ভাবতে পারে: “নোহ কিছুই করেনি, তাকে অব্যাহতি দেবেন বলে ঈশ্বর মনস্থির করে রেখেছিলেন, তাই সে নিশ্চিতভাবেই রেহাই পেত। তার বেঁচে যাওয়াটা তার নিজের কর্মের কারণে নয়। ঈশ্বর এটাই ঘটাতে চেয়েছিলেন, কারণ মানুষ নিষ্ক্রিয়।” ঈশ্বর কিন্তু তেমনটা ভাবছিলেন না। ঈশ্বরের কাছে একজন মানুষ মহানই হোক বা অকিঞ্চিৎকর, যতক্ষণ তারা তাঁর বাক্য শুনছে, তাঁর নির্দেশ ও তাঁর অর্পিত দায়িত্ব পালন করছে, এবং তাঁর কর্ম, তাঁর অভিপ্রায়, ও তাঁর পরিকল্পনার সঙ্গে সহযোগিতা করতে পারছে, যাতে তাঁর অভিপ্রায় ও পরিকল্পনা মসৃণভাবে সম্পন্ন হতে পারে, ততক্ষণ তাদের সেই আচরণ তাঁর স্মরণে থাকার ও তাঁর আশীর্বাদ লাভের যোগ্য। এই ধরনের মানুষকে ঈশ্বর মূল্যবান মনে করেন, এবং তাদের তাদের কাজকর্ম এবং তাঁর প্রতি তাদের ভালোবাসা ও মমতাকে তিনি সযত্নে লালন করেন। এ-ই হল ঈশ্বরের মনোভাব। তাহলে কেন তিনি নোহকে আশীর্বাদ করেছিলেন? কারণ এভাবেই তিনি মানুষের এহেন ক্রিয়াকলাপ ও আনুগত্যকে বিবেচনা করেন।
নোহর প্রতি ঈশ্বরের আশীর্বাদের প্রসঙ্গে কেউ কেউ বলবে: “মানুষ যদি ঈশ্বরের যা বলছেন তা শোনে এবং ঈশ্বরকে সন্তুষ্ট করে, তবে ঈশ্বরের উচিত মানুষকে আশীর্বাদ করা। এমনটা কি বলাই বাহুল্য নয়?” আমরা কি একথা বলতে পারি? কিছু মানুষ বলবে: “না।” কেন আমরা একথা বলতে পারি না? কিছু মানুষ বলে: “মানুষ ঈশ্বরের আশীর্বাদ উপভোগের যোগ্য নয়।” এমনটা পুরোপুরি সঠিক নয়। কারণ ঈশ্বরের অর্পিত দায়িত্ব যখন একজন ব্যক্তি গ্রহণ করে, তখন তা বিচারের জন্য ঈশ্বরের একটা মাপকাঠি রয়েছে যে তাদের কাজকর্ম ভালো না মন্দ, এবং সেই ব্যক্তি তাঁকে মান্য করেছে কি না, এবং সেই ব্যক্তি ঈশ্বরের ইচ্ছাকে সন্তুষ্ট করেছে কি না, এবং তারা যা করে তা সেই মানদণ্ড পূর্ণ করতে পেরেছে কি না। ঈশ্বর যে বিষয়ে যত্নবান তা হল মানুষের হৃদয়, তাদের উপরিভাগের ক্রিয়াকলাপ নয়। বিষয়টা এরকম নয় যে মানুষ কোনো একটা কাজ করলে, তারা যেমনভাবেই সেই কাজ করুক তা নির্বিশেষে, ঈশ্বরের উচিত তাকে আশীর্বাদ প্রদান করা। এটা শুধুই ঈশ্বরের সম্পর্কে মানুষের ভুল ধারণা। ঈশ্বর শুধুমাত্র কোনোকিছুর অন্তিম পরিণতিটুকুই দেখেন না, বরং আরো বেশি গুরুত্ব দেন একজন মানুষের অন্তর কেমন, এবং বিভিন্ন বিষয়ের ক্রমবিবর্তনকালে সেই ব্যক্তির মনোভাব কেমন তার উপর, এবং তিনি দেখেন যে তাদের অন্তরে আনুগত্য, বিবেচনা, এবং ঈশ্বরকে সন্তুষ্ট করার বাসনা রয়েছে কি না। সেই সময়ে ঈশ্বর সম্বন্ধে নোহ কতখানি জানত? বর্তমানে তোমরা যতটা তত্ত্বকথা জানো তা কি ততটাই ছিল? সত্যের পরিপ্রেক্ষিতগুলোর ক্ষেত্রে, যেমন ঈশ্বর বিষয়ক ধারণাসমূহ ও জ্ঞান প্রসঙ্গে, সে কি তোমাদের মতোই সিঞ্চন ও পরিচালনা লাভ করেছিল? না, সে তেমনটা লাভ করেনি! কিন্তু এমন একটা সত্য রয়েছে যা অনস্বীকার্য: বর্তমানের মানুষের চেতনায়, মনে, এবং এমনকি হৃদয়ের গহীনেও, ঈশ্বর সম্বন্ধে ধারণা ও মনোভাব অস্পষ্ট ও অনিশ্চিত। তোমরা এমনকি এটাও বলতে পারো যে, মানুষের একাংশ ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্বন্ধেও একটা নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করে। কিন্তু নোহর অন্তঃকরণে ও চেতনায় ঈশ্বরের অস্তিত্ব ছিল অমোঘ ও সন্দেহাতীত, এবং তাই ঈশ্বরের প্রতি তার আনুগত্য ছিল নিষ্কলঙ্ক, এবং তা পরীক্ষায় অবিচল থাকতে পেরেছিল। তার হৃদয় ছিল নির্মল ও ঈশ্বরের প্রতি উন্মুক্ত। ঈশ্বরের প্রতিটা বাক্য অনুসরণের জন্য নিজেকে প্রত্যয় প্রদান করতে তার খুব বেশি মতবাদসমূহ বিষয়ক জ্ঞানের প্রয়োজন হয়নি, বা ঈশ্বরের অর্পিত দায়িত্ব গ্রহণে সক্ষম হওয়ার জন্য এবং ঈশ্বর তাকে যাকিছু করার নির্দেশ দিচ্ছেন তা করতে সমর্থ হওয়ার জন্য ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করার মতো প্রভূত তথ্যেরও প্রয়োজন পড়েনি। নোহ ও বর্তমানের মানুষের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য এটাই। ঈশ্বরের চোখে সুনির্দিষ্টভাবে একজন নিখুঁত মানুষ যা, তার প্রকৃত সংজ্ঞাও এটা। ঈশ্বর নোহর মতো মানুষদেরই চান। সে হল সেই ধরনের মানুষ ঈশ্বর যার প্রশংসা করেন, এবং সে ঠিক সেই ধরনের মানুষ ঈশ্বর যাকে আশীর্বাদ করেন। এ থেকে তোমরা কি কোনো আলোকপ্রাপ্তি লাভ করেছ? মানুষ বাহ্যিক ভাবে মানুষকে দেখে, কিন্তু ঈশ্বর যা দেখেন তা হচ্ছে মানুষের অন্তঃকরণ ও তাদের সারসত্য। ঈশ্বর কোনো ব্যক্তিকে তাঁর প্রতি নিরুৎসাহ হওয়ার বা সংশয় পোষণ করার অনুমতি দেন না, কিংবা তাঁকে সন্দেহ অথবা কোনোভাবে তাঁর পরীক্ষা নেওয়ার অনুমোদনও তিনি মানুষকে দেন না। সুতরাং, যদিও বর্তমানের মানুষ ঈশ্বরের বাক্যের মুখোমুখি—এমনকি এটাও বলতে পারো যে তারা ঈশ্বরেরই সম্মুখীন—তবু, তাদের হৃদয়ের গভীরে কিছু একটা আছে বলে, অর্থাৎ তাদের ভ্রষ্ট সারমর্মের অস্তিত্বের কারণে, এবং ঈশ্বরের প্রতি তাদের বিরূপ মনোভাবের কারণে, ঈশ্বরের প্রতি প্রকৃত বিশ্বাস অর্জনে তারা বাধাপ্রাপ্ত এবং তাঁর প্রতি অনুগত হওয়ার বিষয়েও তারা অবরুদ্ধ। এই কারণে, নোহর উপর ঈশ্বর যে আশীর্বাদ বর্ষণ করেছিলেন, সেই একই আশীর্বাদ তাদের পক্ষে অর্জন করা অতীব কষ্টসাধ্য।
—বাক্য, খণ্ড ২, ঈশ্বরকে জানার প্রসঙ্গে, ঈশ্বরের কর্ম, ঈশ্বরের স্বভাব এবং স্বয়ং ঈশ্বর ১