ঈশ্বর বন্যার মাধ্যমে পৃথিবীকে ধ্বংস করে দেওয়ার অভিপ্রায় করেন এবং নোহকে একটা জাহাজ নির্মাণের নির্দেশ দেন
আদিপুস্তক ৬:৯-১৪ নোহের কাহিনী: নোহ তখনকার লোকদের মধ্যে ধার্মিক ও সিদ্ধপুরুষ ছিলেন। তিনি ঈশ্বরের সান্নিধ্যে জীবন যাপন করতেন। নোহের তিন পুত্র ছিল, শেম, হাম ও যাফত। সেই সময় পৃথিবী ঈশ্বরের দৃষ্টিতে ভ্রষ্ট ও দৌরাত্মে পরিপূর্ণ ছিল। ঈশ্বর পৃথিবীর প্রতি দৃষ্টিপাত করে দেখলেন, পৃথিবী ভ্রষ্ট হয়েছে, কারণ পৃথিবীর সমস্ত মানুষই তখন বিপথগামী হয়েছিল। ঈশ্বর নোহকে বললেন, আমি দেখছি পৃথিবীর সকল প্রাণীর অন্তিম কাল ঘনিয়ে এসেছে, তাদের দৌরাত্ম্যে পৃথিবী আজ পরিপূর্ণ। দেখ, আমি পৃথিবীর সঙ্গে সঙ্গে তাদেরও ধ্বংস করব। তুমি গোফর কাঠের একটি জাহাজ তৈরী কর। কাঠের লম্বা ফালি দিয়ে সেটি তৈরী করবে এবং তার ভিতরে ও বাইরে আলকাতরার প্রলেপ দেবে।
আদিপুস্তক ৬:১৮-২২ কিন্তু তোমার সঙ্গে আমি এক সম্বন্ধ স্থাপন করব। তুমি নিজের স্ত্রী, পুত্র ও পুত্রবধূদের সঙ্গে নিয়ে জাহাজে প্রবেশ করবে। আর সমস্ত জাতের জীবজন্তুর মধ্য থেকে স্ত্রী ও পুরুষ এক এক জোড়া সংগ্রহ করে তাদের প্রাণ রক্ষার জন্য নিজের সঙ্গে জাহাজে নেবে। সকল জাতের পাখী, পশু ও ভূচর সরীসৃপ প্রাণ রক্ষার জন্য তোমার সঙ্গে জাহাজে প্রবেশ করবে। তোমার ও তাদের খাওয়ার জন্য সব রকমের খাদ্যবস্তু সংগ্রহ করে মজুত করে রাখবে। নোহ ঈশ্বরের নির্দেশ অনুযায়ী সব কাজই করলেন।
এই দুটো অনুচ্ছেদ পড়ার পর নোহ কে ছিলেন সে সম্বন্ধে এখন তোমাদের একটা সাধারণ ধারণা তৈরি হয়েছে তো? নোহ কেমন মানুষ ছিল? মূল পাঠ বলে: “নোহ তখনকার লোকদের মধ্যে ধার্মিক ও সিদ্ধপুরুষ ছিলেন”। আধুনিক মানুষের উপলব্ধি অনুযায়ী, ঠিক কোন ধরনের ব্যক্তিকে তখনকার দিনে “ধার্মিক মানুষ” বলা হত? একজন ধার্মিক মানুষকে একজন নিখুঁত মানুষ হতে হবে। সেই নিখুঁত মানুষ মানুষের চোখে নিখুঁত ছিল, না ঈশ্বরের চোখে, তা কি তোমরা জানো? সন্দেহাতীতভাবেই, সেই নিখুঁত মানুষ ছিল ঈশ্বরের চোখে একজন নিখুঁত মানুষ, মানুষের চোখে নয়। এমনটা নিশ্চিত! কারণ মানুষ অন্ধ এবং তারা দেখতে পায় না, এবং শুধুমাত্র ঈশ্বরই সমগ্র পৃথিবী ও প্রতিটা মানুষকে দেখেন, এবং একমাত্র ঈশ্বরই জানতেন যে নোহ একজন নিখুঁত মানুষ। যে মুহূর্তে ঈশ্বর নোহকে দেখলেন, সেই মুহূর্ত থেকেই বন্যার মাধ্যমে পৃথিবীকে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য তাঁর পরিকল্পনার সূত্রপাত ঘটল।
সেই যুগে, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ করার জন্য ঈশ্বর নোহকে অহ্বান করবেন বলে মনস্থ করলেন। কেন সেই কাজটা করতে হত? কারণ সেই মুহূর্তে ঈশ্বরের অন্তঃকরণে একটা পরিকল্পনা ছিল। তাঁর পরিকল্পনা ছিল এক বন্যার মাধ্যমে পৃথিবীকে ধ্বংস করে দেওয়া। কেন তিনি পৃথিবীকে ধ্বংস করবেন? এখানে বলা রয়েছে: “সেই সময় পৃথিবী ঈশ্বরের দৃষ্টিতে ভ্রষ্ট ও দৌরাত্মে পরিপূর্ণ ছিল”। “পৃথিবী... দৌরাত্মে পরিপূর্ণ ছিল”—বাক্যবন্ধ থেকে তোমরা কী ধারণা করো? পৃথিবীর উপর তা ছিল এমন এক ঘটনা, যেখানে বিশ্ব ও বিশ্বের মানুষ চূড়ান্তভাবে ভ্রষ্ট হয়েছিল; সুতরাং, “পৃথিবী... দৌরাত্মে পরিপূর্ণ ছিল”। আজকের ভাষায়, “দৌরাত্মে পরিপূর্ণ”-র অর্থ হল সবকিছুই বিশৃঙ্খল। মানুষের কাছে এর অর্থ হল জীবনের সর্ব ক্ষেত্রে শৃঙ্খলার সাদৃশ্যটুকুও হারিয়ে গিয়েছিল, সব কিছুই বিশৃঙ্খল ও অনিয়ন্ত্রণীয় হয়ে উঠেছিল। ঈশ্বরের চোখে এর অর্থ ছিল যে পৃথিবীর মানুষ অত্যন্ত ভ্রষ্ট হয়ে পড়েছে। কিন্তু কতটা মাত্রায় ভ্রষ্ট? এত মাত্রায় ভ্রষ্ট যে ঈশ্বর আর সেই দৃশ্য সহ্য করতে, বা তাদের প্রতি ধৈর্য বজায় রাখতে পারছিলেন না। এতটা মাত্রায় ভ্রষ্ট যে, ঈশ্বর তাদের ধ্বংস করে দেওয়ার অভিপ্রায় পোষণ করেছিলেন। ঈশ্বর যখন এই পৃথিবীকে ধ্বংস করে দেওয়ার সংকল্প নিয়েছিলেন, তখন একটা জাহাজ নির্মাণের জন্য কোনো একজনকে খুঁজে নেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। এই কার্য সাধনের জন্য ঈশ্বর নোহকে মনোনীত করলেন; অর্থাৎ, তিনি নোহকে দিয়ে একটা জাহাজ নির্মাণ করালেন। তিনি নোহকে কেন মনোনীত করেছিলেন? ঈশ্বরের চোখে, নোহ ছিলেন একজন ধার্মিক মানুষ; ঈশ্বর তাকে যে কাজেরই নির্দেশ দিতেন, নোহ তা-ই পালন করত। অর্থাৎ বলা যেতে পারে যে ঈশ্বর তাকে যা-ই করতে বলুন নোহ তা করতে ইচ্ছুক ছিল। ঈশ্বর এরকম একজন মানুষকেই খুঁজতে চেয়েছিলেন যে তাঁর সঙ্গে কাজ করবে, তাঁর অর্পিত কর্মভার সম্পন্ন করবে—পৃথিবীতে তাঁর কাজ সম্পূর্ণ করবে। সেই সময়, নোহ ব্যতীত অন্য কোনো ব্যক্তি কি ছিল, যে এই রকম একটা কাজ সম্পন্ন করতে পারত? অবশ্যই না! নোহ ছিল একমাত্র প্রার্থী, একমাত্র ব্যক্তি যে ঈশ্বরের অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে পারত, এবং তাই ঈশ্বর তাকে মনোনীত করেছিলেন। কিন্তু সেই সময় মানুষকে উদ্ধারের জন্য ঈশ্বরের যে সীমারেখা ও মাপকাঠি ছিল, তা কি এখনও একই রয়েছে? উত্তরটা হল, অবশ্যই একটা পার্থক্য আছে! আমি কেন এ কথা জিজ্ঞাসা করছি? সেই সময়ে ঈশ্বরের চোখে একমাত্র নোহই ধার্মিক ব্যক্তি ছিল, যার অর্থ হল, তার স্ত্রী বা তার কোনো পুত্র বা কোনো পুত্রবধূই ধার্মিক ব্যক্তি ছিল না, কিন্তু নোহর কারণে ঈশ্বর তাদের অব্যাহতি দেন। ঈশ্বর এখন যেভাবে দাবি করেন সেভাবে তিনি তাদের কাছ থেকে কোনো দাবি করেননি, এবং তার পরিবর্তে, নোহর পরিবারের আটজন সদস্যকেই তিনি জীবিত রেখেছিলেন। নোহর ন্যায়পরায়ণতার কারণে তারা ঈশ্বরের আশীর্বাদ লাভ করেছিল। নোহ ছাড়া তাদের কেউই ঈশ্বরের অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে পারত না। তাই নোহই একমাত্র ব্যক্তি যার পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পরও বেঁচে যাওয়ার কথা ছিল, বাকিরা শুধুমাত্র পারিপার্শ্বিক কারণবশত সুবিধা পেয়েছিল। এর মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে, ঈশ্বর আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁর পরিচালনামূলক কার্য আরম্ভ করার পূর্বের যুগে যে নীতি ও মাপকাঠি নিয়ে মানুষের সঙ্গে আচরণ করতেন ও দাবি জানাতেন, তা ছিল অপেক্ষাকৃতভাবে শিথিল। ঈশ্বর নোহর আট-সদস্যভুক্ত পরিবারের সঙ্গে যেভাবে আচরণ করেছিলেন, তা আজকের দিনের মানুষের কাছে “নিরপেক্ষতার” অভাব বলে মনে হয়। কিন্তু মানুষের উপর যে বিপুল পরিমাণ কাজ তিনি এখন করেন, এবং এবং তিনি এখন যে বিপুল সংখ্যক বাক্য প্রচার করেন তার সাথে তুলনা করলে, তাঁর সেই সময়ের কর্মের কর্মের প্রেক্ষাপটে নোহর আটজনের পরিবারের সঙ্গে তাঁর আচরণ ছিল নিছকই এক কর্মসংক্রান্ত নীতি। তুলনামূলক বিচারে, নোহর আটজনের পরিবার ঈশ্বরে কাছ থেকে বেশি অর্জন করেছে, নাকি বর্তমানের মানুষ বেশি অর্জন করে?
নোহকে যে আহ্বান করা হয়েছিল, সেটা একটা সাধারণ ঘটনা, কিন্তু আমাদের আলোচনার মূল বিষয়, অর্থাৎ এই ঘটনায় প্রকাশিত ঈশ্বরের স্বভাব, তাঁর ইচ্ছা, ও তাঁর সারসত্য, তা তত সরল নয়। ঈশ্বরের এই বিভিন্ন দিকগুলো উপলব্ধি করতে গেলে, আমাদের প্রথমে উপলব্ধি করতে হবে কোন ধরনের ব্যক্তিকে ঈশ্বর আহ্বান করতে ইচ্ছা করেন, এবং এর মাধ্যমেই তাঁর স্বভাব, ইচ্ছা, ও সারসত্য উপলব্ধি করতে হবে। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাহলে, ঈশ্বরের চোখে সেই মানুষটা ঠিক কীরকম যাকে তিনি আহবান করেন? তাকে অবশ্যই হতে হবে এমন একজন ব্যক্তি, যে তাঁর বাক্য শুনতে পারে, এবং যে তাঁর নির্দেশ অনুসরণ করতে পারে। একইসঙ্গে, তাকে এমন একজন ব্যক্তিও হতে হবে যার একটা দায়িত্ববোধ রয়েছে, এমন একজন যে ঈশ্বরের বাক্যকে অবশ্যপূরণীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য হিসাবে বিবেচনা করে পালন করবে। তাকে কি এমন কোনো ব্যক্তি হতে হবে যে ঈশ্বরকে জানে? না। সেই সময়ে, নোহ ঈশ্বরের শিক্ষার বেশি কিছু শোনেনি, বা ঈশ্বরের কোনো কাজের অভিজ্ঞতাও লাভ করেনি। সুতরাং, ঈশ্বর সম্বন্ধে নোহর জ্ঞান ছিল খুবই স্বল্প। যদিও লিপিবদ্ধ রয়েছে যে নোহ ঈশ্বরের সঙ্গে পথ চলেছিল, কিন্তু সে কি কখনও ঈশ্বরের ছবি প্রত্যক্ষ করেছিল? উত্তরটা হল, অবশ্যই না। কারণ সেইসময়, শুধুমাত্র ঈশ্বরের বার্তাবাহকরাই মানুষের মধ্যে আসত। কথন বা কার্যে তারা ঈশ্বরের প্রতিনিধিত্ব করতে পারলেও, তারা নিছকই ঈশ্বরের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়গুলোকেই জ্ঞাপন করত। ঈশ্বরের ছবি মানুষের সামনাসামনি উন্মোচিত হয়নি। শাস্ত্রের এই অংশে আমরা মূলত দেখি নোহকে কী করতে হয়েছিল, এবং তার প্রতি ঈশ্বরের নির্দেশগুলো কী ছিল। সুতরাং, এখানে ঈশ্বর কোন সারসত্য প্রকাশ করেছেন? ঈশ্বর যা করেন, তা সকলই অত্যন্ত নিখুঁত ভাবে পরিকল্পিত। তিনি যখন দেখেন যে কোনো ঘটনা বা পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে, তখন তাঁর চোখে সেই ঘটনা বা পরিস্থিতির পরিমাপের একটা মাপকাঠি থাকে, এবং সেই মাপকাঠিই নির্ধারণ করে যে তিনি এর মোকাবিলায় কোনো পরিকল্পনার সূচনা করবেন কি না, বা এই ঘটনা বা পরিস্থিতির মোকাবিলায় কী ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণীয়। তিনি উদাসীন নন, বা সকল বস্তুর প্রতি তাঁর অনুভূতিতে কোনো ঘাটতি নেই। বস্তুত, বিষয়টা ঠিক তার বিপরীত। এখানে একটা স্তবক রয়েছে যাতে বলা আছে ঈশ্বর নোহকে কী বলেছেন: “আমি দেখছি পৃথিবীর সকল প্রাণীর অন্তিম কাল ঘনিয়ে এসেছে, তাদের দৌরাত্ম্যে পৃথিবী আজ পরিপূর্ণ। দেখ, আমি পৃথিবীর সঙ্গে সঙ্গে তাদেরও ধ্বংস করব”। ঈশ্বর যখন এই বাক্য বলেছিলেন, তখন কি তিনি বুঝিয়েছিলেন যে তিনি শুধুমাত্র মনুষ্যজাতিকেই ধ্বংস করবেন? না! ঈশ্বর বলেছিলেন যে, তিনি সকল জীবিত প্রাণীকে ধ্বংস করবেন। ঈশ্বর কেন ধ্বংস চেয়েছিলেন? এখানে ঈশ্বরের স্বভাবের আরো একটা উদ্ঘাটন রয়েছে, ঈশ্বরের চোখে মানুষের অনাচারের প্রতি, এবং সমস্ত প্রাণীর কলুষতা, দৌরাত্ম্য ও অবাধ্যতার প্রতি ঈশ্বরের ধৈর্যের একটা সীমা রয়েছে। কী সেই সীমা? ঈশ্বর এভাবে বলছেন: “ঈশ্বর পৃথিবীর প্রতি দৃষ্টিপাত করে দেখলেন, পৃথিবী ভ্রষ্ট হয়েছে, কারণ পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীই তখন বিপথগামী হয়েছিল”। “কারণ পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীই তখন বিপথগামী হয়েছিল”—এই কথার অর্থ কী? এর অর্থ হল, যেকোনো জীবিত বস্তু, এর মধ্যে তারাও রয়েছে যারা ঈশ্বরকে অনুসরণ করত, যারা ঈশ্বরের নাম ভজনা করত, যারা একসময় ঈশ্বরকে অগ্নিদগ্ধ উৎসর্গ করেছিল, যারা মৌখিক ভাবে ঈশ্বরকে স্বীকার করেছিল এবং এমনকি ঈশ্বরের স্তুতিও করেছিল—একসময় তাদের আচরণ অনাচারে পরিপূর্ণ হয়ে যায়, এবং তা ঈশ্বরের দৃষ্টিগোচর হয়, তাঁকে এদের ধ্বংস করতেই হত। সেটাই ছিল ঈশ্বরের সীমা। তাই কতদূর পর্যন্ত মানুষের প্রতি ও সমস্ত প্রাণীর অনাচারের প্রতি ঈশ্বর ধৈর্যশীল ছিলেন? ততক্ষণ পর্যন্ত, যতক্ষণ না ঈশ্বরের অনুগামী ও অবিশ্বাসী নির্বিশেষে সমস্ত মানুষ সঠিক পথ থেকে সরে আসে। ততক্ষণ পর্যন্ত, যতক্ষণ না মানুষ যে শুধুমাত্র নৈতিকভাবে ভ্রষ্ট ও মন্দত্বে পরিপূর্ণ হয়ে পড়েছিল তা-ই নয়, বরং ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করার জন্য কেউই অবশিষ্ট ছিল না, ঈশ্বরই যে এই বিশ্বের শাসনকর্তা এবং তিনিই যে মানুষকে আলোর মধ্যে ও সঠিক পথে আনতে পারেন, তা বিশ্বাস করার মতো মানুষ অবশিষ্ট থাকা তো দূরের কথা। ততক্ষণ পর্যন্ত, যতক্ষণ না মানুষ ঈশ্বরের অস্তিত্বে ঘৃণা করেছিল, এবং ঈশ্বরের অস্তিত্বকে না-মঞ্জুর করেছিল। মানুষে অনাচার এই মাত্রায় পৌঁছনোর পর ঈশ্বর আর তা সহ্য করতে পারেননি। কীসের দ্বারা তা প্রতিস্থাপিত হতে পারতো? ঈশ্বরের ক্রোধ ও ঈশ্বরের শাস্তির আগমনের দ্বারা। তা কি ঈশ্বরের স্বভাবের আংশিক প্রকাশ ছিল না? বর্তমান এই যুগে, এমন কোনো মানুষ কি নেই, যারা ঈশ্বরের চোখে ধার্মিক? এমন কোনো মানুষ কি নেই, যারা ঈশ্বরের চোখে নিখুঁত? এই যুগ কি তেমনই এক যুগ, যেখানে ঈশ্বরের চোখে পৃথিবীর সকল প্রাণীর আচরণ কলুষে পরিপূর্ণ? এই সময়ে ওএই যুগে, যাদের ঈশ্বর সম্পূর্ণ করে তুলতে চান, এবং যারা ঈশ্বরকে অনুসরণ ও তাঁর পরিত্রাণ গ্রহণ করতে পারে, তারা ব্যতীত আর সকলেই কি ঈশ্বরের ধৈর্যের সীমাকে পরীক্ষা করছে না? তোমাদের চারপাশে যাকিছু ঘটে—যাকিছু তোমরা নিজেদের চোখে দেখো, নিজেদের কানে শোনো, এই জগতে প্রতিদিন ব্যক্তিগতভাবে যাকিছুর অভিজ্ঞতা লাভ করো—তা সকলই কি হিংসায় পরিপূর্ণ নয়? ঈশ্বরের চোখে, এমন এক বিশ্বের, এমন এক যুগের, বিলোপসাধনই কি কাম্য নয়? যদিও বর্তমান যুগের পটভূমি নোহর যুগের পটভূমির চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন, কিন্তু মানুষের অনাচারের প্রতি ঈশ্বরের অনুভূতি ও ক্রোধ অবিকল একই রয়েছে। ঈশ্বর তাঁর কাজের কারণে ধৈর্যশীল হতে সক্ষম, কিন্তু পরিবেশ ও পরিস্থিতির নিরিখে এই পৃথিবীর অনেক আগেই ধ্বংস হয়ে যাওয়া উচিত ছিল। বন্যার দ্বারা এই পৃথিবীকে যখন ধ্বংস করা হয়েছিল, তখনকার পরিস্থিতিকে বর্তমান পরিস্থিতি বহুদূর অতিক্রম করে গেছে। কিন্তু পার্থক্যটা কী? এটা আবার সেই বিষয়ও যা ঈশ্বরের হৃদয়কে সবচেয়ে ভারাক্রান্ত করে, এবং হয়তো তা এমন কিছু যা তোমরা কেউই অনুধাবন করতে পারো না।
তিনি যখন বন্যার দ্বারা এই পৃথিবীকে ধ্বংস করেছিলেন, তখন তিনি একটা জাহাজ নির্মাণ ও কিছু প্রস্তুতিমূলক কার্য সম্পাদনের জন্য নোহকে আহ্বানে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর জন্য এই ধারাবাহিক কাজগুলো সম্পন্ন করার জন্য একজন মানুষকে—নোহকে—আহ্বান করতে পেরেছিলেন। কিন্তু বর্তমান যুগে এমন কোনো মানুষ নেই যাকে ঈশ্বর আহ্বান করতে পারেন। কিন্তু কেন? যারা এখানে বসে রয়েছে, তাদের প্রত্যেকেই সম্ভবত খুব ভালো করে কারণটা উপলব্ধি করে ও জানে। তোমরা কি চাও যে আমি তা উচ্চারণ করি। তা করলে হয়তো তোমাদের সম্মানহানি ঘটবে, এবং সকলে মর্মাহত হবে। কেউ কেউ হয়তো বলবে: “যদিও আমরা ধার্মিক ব্যক্তি নই, এবং আমরা ঈশ্বরের চোখে নিখুঁত মানুষ নই, কিন্তু ঈশ্বর যদি আমাদের কোনো কার্য সম্পাদনের নির্দেশ দিতেন, তা সত্ত্বেও আমরা তা করতে সক্ষম হতাম। আগে, তিনি যখন বলেছিলেন যে একটা ভয়াবহ বিপর্যয় আসছে, তখন আমরা খাদ্যসামগ্রী ও অন্যান্য দ্রব্য তৈরি করতে শুরু করে দিয়েছিলাম, যা বিপর্যয়ের সময় কাজে লাগবে। এই সবকিছুই কি ঈশ্বরের দাবিগুলোর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ভাবে সম্পন্ন করা হয়নি? আমরা কি প্রকৃতই ঈশ্বরের কর্মের সঙ্গে সহযোগিতা করিনি? আমরা যা করেছি, তা কি নোহর কাজের সঙ্গে তুলনীয় নয়? আমরা যা করেছি, তা করা কি প্রকৃত আনুগত্য নয়? আমরা কি ঈশ্বরের নির্দেশ অনুসরণ করিনি? ঈশ্বরের বাক্যের উপর বিশ্বাস রয়েছে বলেই কি আমরা ঈশ্বর যা বলেছেন তা করিনি? তাহলে ঈশ্বর এখনও কেন মর্মাহত? ঈশ্বর কেন বলেন যে তাঁর আহবান করার মতো কেউ নেই?” তোমাদের ও নোহর কার্যকলাপের মধ্যে কি কোনো পার্থক্য রয়েছে? কী সেই পার্থক্য? (বিপর্যয়ের জন্য বর্তমানে খাদ্য প্রস্তুত করাটা আমাদের নিজস্ব অভিপ্রায় ছিল।) (আমাদের কাজ “ধার্মিক” হিসাবে গণ্য হতে পারে না, অথচ ঈশ্বরের চোখে নোহ একজন ধার্মিক মানুষ ছিল।) তোমরা যা বলেছ তা খুব একটা অপ্রাসঙ্গিক নয়। নোহ যা করেছিল, তা বর্তমানে মানুষ যা করছে তার তুলনায় মূলত ভিন্ন। নোহ যখন ঈশ্বরের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করেছিল, তখন সে জানত না ঈশ্বরের অভিপ্রায় কী। সে জানত না ঈশ্বর কী সম্পাদন করতে চান। ঈশ্বর তাকে শুধুমাত্র একটা আদেশ দিয়েছিলেন ও তাকে কিছু কাজ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন, এবং নোহ বিশেষ কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই সেই কাজে প্রবৃত্ত হয় ও তা সম্পন্ন করে। সে গোপনে ঈশ্বরের অভিপ্রায় খুঁজে বার করার চেষ্টা করেনি, বা ঈশ্বরকে প্রতিরোধ করেনি, বা আন্তরিকতার অভাব দেখায়নি। সরল ও বিশুদ্ধ চিত্তে সে শুধু সেইমতো কার্য সাধন করেছিল। ঈশ্বর তাকে যে কাজই করতে বলেছিলেন, সে তা করেছিল, এবং সে যা করেছিল, ঈশ্বরের বাক্যকে মান্য করা ও শোনাই ছিল সেই কাজের উপর তার বিশ্বাসের ভিত্তি। এমন অকপট ও সহজ ভাবেই সে ঈশ্বরের অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছিল। তার সারসত্য, তার কর্মের সারসত্য, ছিল আনুগত্য, অনুমান না করা, প্রতিরোধ না করা, এবং সর্বোপরি, ব্যক্তিগত স্বার্থ বা নিজস্ব লাভ-ক্ষতির কথা না ভাবা। উপরন্তু, ঈশ্বর যখন বললেন যে, এক বন্যা দিয়ে তিনি এই পৃথিবীকে ধ্বংস করে দেবেন, তখন সে প্রশ্ন করেনি কবে, বা এ-ও জিজ্ঞাসা করেনি যে সমস্ত জিনিসের কী পরিণতি হবে, এবং সে অবশ্যই ঈশ্বরকে এই প্রশ্নটাও করেনি যে তিনি কীভাবে এই পৃথিবীকে ধ্বংস করতে চলেছেন। সে শুধু ঈশ্বরের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করে গিয়েছিল। সে ঈশ্বরের ইচ্ছা অনুযায়ী যথাযথ উপায় ও প্রকরণ ব্যবহার করে অবিলম্বে তার কাজ আরম্ভ করে দিয়েছিল। ঈশ্বরকে তুষ্ট করার মনোভাব নিয়ে ঈশ্বরের নির্দেশ অনুসারে সে কাজ করেছিল। সে কি এই কাজ করছিল যাতে সে নিজে বিপর্যয় এড়িয়ে যেতে পারে? না। সে কি ঈশ্বরকে জিজ্ঞাসা করেছিল যে বিশ্ব আর কত সময় পর ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে? না, সে তা করেনি। সে কি ঈশ্বরকে জিজ্ঞাসা করেছিল, বা সে কি জানত, যে সেই জাহাজ নির্মাণ করতে কত সময় লাগবে? সে নিজেও তা জানত না। সে শুধু নির্দেশ মান্য করেছিল, শুনেছিল ও সেইমতো কাজ করেছিল। কিন্তু বর্তমান যুগে মানুষ এরকম নয়: ঈশ্বরের বাক্যের মাধ্যমে কোনো একটা তথ্য ফাঁস হওয়া মাত্র, বাতাসে পাতার শনশন আওয়াজ টের পাওয়া মাত্রই, তারা অবিলম্বে কাজে লেগে পড়ে, যা-ই ঘটুক বা যতই মূল্য হোক, পরবর্তী সময়ে তারা কী পান, ভোজন, ও ব্যবহার করবে তা প্রস্তুত করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে, এমনকি যখন বিপর্যয় আসবে তখন কোন পথে তারা পালাবে সেই পরিকল্পনাও করতে থাকে। তার চেয়েও আকর্ষণীয় ব্যাপার হল, এই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে, মানুষের মস্তিষ্ক “কার্য সম্পন্ন করতে” খুবই দক্ষ। ঈশ্বর কোনো নির্দেশ দেননি এরকম কোনো পরিস্থিতিতে মানুষ যথাযথভাবে সমস্তকিছুর জন্য পরিপাটি পরিকল্পনা ছকে ফেলতে পারে। এরকম পরিকল্পনাগুলোকে বর্ণনা করার জন্য তোমরা “নিখুঁত” শব্দটা ব্যবহার করতে পারো। ঈশ্বর যা বলেন, ঈশ্বর যে অভিপ্রায় পোষণ করেন, বা ঈশ্বর যা চান, তা নিয়ে কেউ-ই চিন্তিত নয়, এবং কেউ-ই তা অনুধাবনের চেষ্টা করে না। এটাই কি বর্তমান যুগের মানুষ ও নোহর মধ্যে সবচেয়ে বড় পার্থক্য নয়?
নোহর কাহিনীর এই নথিতে তোমরা কি ঈশ্বরের স্বভাবের একটা অংশ দেখতে পাও? মানুষের অনাচার, কলুষতা ও হিংসার প্রতি ঈশ্বরের ধৈর্যের একটা সীমা রয়েছে। তিনি যখন সেই ধৈর্যের সীমায় উপনীত হবেন, তখন তিনি আর ধৈর্যশীল থাকবেন না, এবং পরিবর্তে, তাঁর নতুন ব্যবস্থাপনা ও নতুন পরিকল্পনা আরম্ভ করবেন, তাঁর করণীয় কার্যসকল নির্বাহ করা আরম্ভ করবেন, তাঁর কর্ম ও তাঁর স্বভাবের অন্য দিকটাকে প্রকাশ করবেন। তাঁর এই কাজ এটা প্রদর্শন করার জন্য নয় যে মানুষ কখনোই যেন তাঁকে ক্ষুব্ধ না করে, অথবা তিনি কর্তৃত্ব ও ক্রোধে পূর্ণ, এবং তা এটা দেখানোর জন্যও নয় যে তিনি মানবজাতিকে ধ্বংস করতে পারেন। বিষয়টা হল, তাঁর স্বভাব ও তাঁর পবিত্র সারসত্য এই ধরনের মানবজাতিকে তাঁর সম্মুখে ও তাঁর আধিপত্যের অধীনে বেঁচে থাকার আর অনুমতি দিতে পারে না, বা তাদের প্রতি ধৈর্যশীল হয়ে থাকতে পারে না। অর্থাৎ, যখন সমগ্র মানবজাতি তাঁর বিরুদ্ধে, যখন সারা পৃথিবীতে এমন কেউ নেই যাকে তিনি উদ্ধার করতে পারেন, তখন এহেন মানবজাতির প্রতি তাঁর আর কোনো ধৈর্য অবশিষ্ট থাকবে না, এহেন মানবজাতিকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে তাঁর পরিকল্পনাকে তিনি নিঃসংশয়ে বাস্তবায়িত করবেন। ঈশ্বরের এমন এক পদক্ষেপ তাঁর স্বভাবের দ্বারা নির্ধারিত হয়। এ হল এক আবশ্যক পরিণাম, এবং ঈশ্বরের আধিপত্যের অধীনে থাকা প্রত্যেক সৃষ্ট সত্তাকে এই পরিণাম বহন করতেই হবে। এর মাধ্যমে কি এটা বোঝা যায় না যে এই বর্তমান যুগে তাঁর পরিকল্পনাকে সম্পূর্ণ করার জন্য এবং তিনি যাদের উদ্ধার করতে চান তাদের উদ্ধারের জন্য ঈশ্বর আর অপেক্ষা করতে পারছেন না? এই পরিস্থিতিতে, কী নিয়ে ঈশ্বর সবচেয়ে বেশি ভাবনা করেন? যারা তাঁকে আদৌ অনুসরণ করে না বা যারা তাঁর বিরোধিতা করে, তারা তাঁর প্রতি কেমন আচরণ করে বা কীভাবে তাঁর প্রতিরোধ করে, বা মানবজাতি কীভাবে তাঁকে অপবাদ দেয়, তা নিয়ে তিনি ভাবিত নন। তিনি শুধু এই নিয়েই ভাবিত যে যারা তাঁকে অনুসরণ করে, যারা তাঁর পরিচালনামূলক পরিকল্পনায় তাঁর পরিত্রাণের লক্ষ্যবস্তু, তারা তাঁর দ্বারা সম্পূর্ণ হয়েছে কি না, তারা তাঁর সন্তুষ্টিবিধানের যোগ্য হয়েছে কি না। যারা তাঁকে অনুসরণ করে তাদের ছাড়া বাকি মানুষদের ক্ষেত্রে, তিনি শুধুমাত্র নিজের ক্রোধ প্রকাশ করতে মাঝেমাঝে শাস্তি প্রদান করেন। উদাহরণস্বরূপ: সুনামি, ভূমিকম্প, এবং আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত। একইসঙ্গে, তিনি অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে তাদের রক্ষা ও পরিচর্যা করে চলেছেন যারা তাঁকে অনুসরণ করে এবং যারা তাঁর দ্বারা উদ্ধার পেতে চলেছে। ঈশ্বরের স্বভাব এইরকম: একদিকে, যাদের তিনি সম্পূর্ণ করে তোলার অভিপ্রায় পোষণ করেন, তাদের প্রতি তাঁর অসীম ধৈর্য ও সহনশীলতা থাকতে পারে, এবং তাদের জন্য তিনি যথাসাধ্য প্রতীক্ষা করতে পারেন; অন্যদিকে, যে সকল শয়তানোচিত ব্যক্তি তাঁর অনুসরণ করে না ও তাঁর বিরোধিতা করে, তাদের তিনি মনেপ্রাণে ঘৃণা ও অপছন্দ করেন। যদিও এই শয়তানোচিত ব্যক্তিরা তাঁর অনুসরণ বা উপাসনা করল কি না সেবিষয়ে তিনি বিন্দুমাত্র ভাবিত নন, তবে তাঁর অন্তরে তাদের জন্য ধৈর্য থাকা সত্ত্বেও তিনি তাদের অপছন্দ করেন, এবং যখন তিনি এই শয়তানোচিত ব্যক্তিদের পরিণাম নির্ধারণ করেন, তিনি তাঁর পরিচালনামূলক পরিকল্পনার পদক্ষেপসমূহের আগমনের নিমিত্ত প্রতীক্ষারতও রয়েছেন।
—বাক্য, খণ্ড ২, ঈশ্বরকে জানার প্রসঙ্গে, ঈশ্বরের কর্ম, ঈশ্বরের স্বভাব এবং স্বয়ং ঈশ্বর ১