মানুষের সঙ্গে এক সন্ধিচুক্তি স্থাপন করতে ঈশ্বর তাঁর বাক্যরাজির ব্যবহার করলেন
আদিপুস্তক ৯.১১-১৩ আমি এক সন্ধি চুক্তি স্থাপন করব, তার শর্ত হবে এই যে, আর কখনো জলপ্লাবনে সমস্ত প্রাণী বিনষ্ট হবে না এবং আর কখনো পৃথিবীবিধ্বংসী প্লাবন হবে না। ঈশ্বর আরও বললেন, তোমাদের ও তোমাদের সঙ্গে যত প্রাণী আছে তাদের সঙ্গে পুরুষানুক্রমে স্থায়ী যে সন্ধি চুক্তি আমি স্থাপন করলাম, তার নিদর্শন হবে এইঃ আকাশের গায়ে আমি আমার ধনু স্থাপন করব, আর তা-ই হব পৃথিবীর সঙ্গে স্থাপিত আমার সন্ধি চুক্তির প্রতীক।
তাঁর সকলকিছু সৃজন করার পর, মেঘধনু সন্ধিচুক্তির মধ্য দিয়ে সৃষ্টিকর্তার কর্তৃত্ব আরেকবার প্রতিপন্ন ও প্রদর্শিত হল
সকল প্রাণীর মাঝে নিরন্তর সৃষ্টিকর্তার কর্তৃত্ব প্রদর্শিত ও প্রযুক্ত হয়, এবং তিনি যে কেবল সকলকিছুর ভাগ্যকে নিয়ন্ত্রণ করেন তা নয়, উপরন্তু তিনি পরিচালনা করেন মানবজাতিকে, সেই বিশিষ্ট প্রাণীকে যাদের তিনি তাঁর নিজের হাতে সৃষ্টি করেছিলেন এবং যা এক স্বতন্ত্র জীবন-নির্মিতির অধিকারী এবং এক ভিন্ন জীবনরূপে বিদ্যমান। সকলকিছুকে সৃজন করার পর, তাঁর কর্তৃত্ব ও ক্ষমতাকে অভিব্যক্ত করতে ঈশ্বর বিরত হননি; তাঁর কাছে, যে কর্তৃত্ব নিয়ে তিনি সমস্ত কিছুর উপর এবং সমগ্র মানবজাতির নিয়তির উপর সার্বভৌমত্বকে ধারণ করেন তার আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়েছিল শুধুমাত্র তখনই যে মুহূর্তে মানবজাতি প্রকৃতই তাঁর হস্ত থেকে জন্ম নিয়েছিল। তিনি মানবজাতিকে পরিচালনা করতে এবং নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিলেন; মানবজাতিকে তিনি উদ্ধার করতে এবং প্রকৃত অর্থে অর্জন করতে চেয়েছিলেন, এমন এক মানবজাতিকে অর্জন করতে চেয়েছিলেন যা সকল বস্তুকে শাসন করতে পারবে; তিনি চেয়েছিলেন এরকম এক মানবজাতি তাঁর কর্তৃত্বের অধীনে জীবনযাপন করুক, এবং তাঁর কর্তৃত্বকে জানুক ও মান্য করুক। তাই, ঈশ্বর তাঁর বাক্যের সাহায্যে তাঁর কর্তৃত্বকে মানুষের মাঝে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করতে আরম্ভ করলেন, এবং তাঁর বাক্যকে কার্যায়িত করতে তাঁর কর্তৃত্বের ব্যবহার শুরু করলেন। স্বভাবতই, এই প্রক্রিয়া চলাকালীন ঈশ্বরের কর্তৃত্ব সর্বত্রই প্রদর্শিত হয়েছিল; আমি কেবল কিছু সুনির্দিষ্ট ও সুবিদিত দৃষ্টান্তকে বেছে নিয়েছি যেগুলি থেকে তোমরা ঈশ্বরের অনন্যতা এবং তাঁর অনন্য কর্তৃত্বকে বুঝে উঠতে ও জানতে পারো।
আদিপুস্তকের ৯:১১-১৩ স্তবকে বর্ণিত অনুচ্ছেদ এবং ঈশ্বরের বিশ্বসৃষ্টির নথি সমন্বিত পূর্ববর্ণিত অনুচ্ছেদগুলির মধ্যে একটি সাদৃশ্য আছে, আবার তাদের মধ্যে একটি পার্থক্যও রয়েছে। সাদৃশ্যটি কী? সাদৃশ্যটি নিহিত রয়েছে অভীষ্ট কার্য সিদ্ধ করার জন্য ঈশ্বরের দ্বারা বাক্যের ব্যবহারের মধ্যে, এবং পার্থক্যটি হল এই যে এখানে উদ্ধৃত অনুচ্ছেদগুলি মানুষের সঙ্গে ঈশ্বরের এক কথোপকথনকে তুলে ধরে, যেখানে মানুষের সাথে তিনি এক সন্ধিচুক্তি স্থাপন করেছিলেন এবং ওই সন্ধিচুক্তির অন্তর্ধৃত বিষয়বস্তুগুলির ব্যাপারে মানুষকে অবহিত করেছিলেন। ঈশ্বরের কর্তৃত্বের এই প্রয়োগ অর্জিত হয়েছিল মানুষের সাথে তাঁর সংলাপ চলাকালীন, অর্থাৎ, মানবজাতি সৃষ্টির পূর্বেই, যে প্রাণীদের তিনি সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন, ঈশ্বরের বাক্যসমূহ ছিল তাদের প্রতি জারিকৃত তাঁর আজ্ঞা ও নির্দেশ। কিন্তু এখন ঈশ্বরের বাক্যগুলি শ্রবণ করার মতো কেউ ছিল, আর তাই তাঁর বাক্যনিচয় একই সাথে মানুষের সাথে এক কথোপকথন এবং মানুষের উদ্দেশ্যে এক উপদেশ ও সতর্কীকরণও বটে। তদুপরি, ঈশ্বরের বাক্যগুলি তাঁর কর্তৃত্ববাহী সেই সব আদেশ যা সকল বস্তুর উদ্দেশ্যে প্রেরিত হয়েছিল।
এই অনুচ্ছেদে ঈশ্বরের কোন কার্যের কথা লিপিবদ্ধ আছে? এক জলপ্লাবনের দ্বারা পৃথিবীকে ধ্বংস করার পর ঈশ্বর মানুষের সাথে যে সন্ধিচুক্তি স্থাপন করেছিলেন এই অনুচ্ছেদে তারই বিবরণ রয়েছে; এর মাধ্যমে মানুষকে জানানো হয়েছে যে ঈশ্বর ধরিত্রীর উপর আর কখনো এজাতীয় ধ্বংসলীলা ডেকে আনবেন না, এবং, অন্তিমে, তিনি এক প্রতীকী চিহ্ন সৃজন করেছেন। প্রতীকটি কী ছিল? শাস্ত্রে বলা হয়েছে: “আকাশের গায়ে আমি আমার ধনু স্থাপন করব, আর তা-ই হবে পৃথিবীর সঙ্গে স্থাপিত আমার সন্ধি চুক্তির প্রতীক।” এগুলিই মানবজাতির উদ্দেশ্যে সৃষ্টিকর্তার উচ্চারিত বাক্যের অবিকৃত ভাষ্যরূপ। তিনি এই বাক্য উচ্চারণের সাথে সাথেই, মানুষের চোখের সম্মুখে এক মেঘধনুর উদয় ঘটলো, এবং আজ অবধি তা সেখানেই রয়ে গেছে। প্রত্যেকেই এধরনের এক মেঘধনু দর্শন করেছে, আর তুমি কি জানতে পারো তা কেমন করে আবির্ভূত হয়? বিজ্ঞান তা প্রমাণ করতে, বা তার উৎস নির্দেশ করতে, বা অবস্থান নিরূপণ করতে, অসমর্থ। তার কারণ, এই মেঘধনু সৃষ্টিকর্তা ও মানুষের মধ্যে স্থাপিত সন্ধিচুক্তির এক প্রতীক; এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তির প্রয়োজন নেই, এটি মানুষের দ্বারা নির্মিত হয় নি, এবং মানুষ এর পরিবর্তন ঘটাতেও সক্ষম নয়। এটি হল সৃষ্টিকর্তার বাক্যোচ্চারণের পর তাঁর কর্তৃত্বের এক নিরবচ্ছিন্নতা। মানুষের সঙ্গে তাঁর সন্ধিচুক্তি ও তাঁর অঙ্গীকারের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে সৃষ্টিকর্তা তাঁর নিজস্ব বিশেষ পদ্ধতির প্রয়োগ ঘটিয়েছিলেন, আর তাই তাঁর স্থাপিত সন্ধিচুক্তির এক প্রতীক হিসাবে সৃষ্টিকর্তার দ্বারা মেঘধনুর ব্যবহার হল এক ঐশ্বরিক অধ্যাদেশ এবং এমন এক বিধান যা চিরকাল অপরিবর্তিত রয়ে যাবে, সৃষ্টিকর্তা ও সৃজিত মানবজাতি উভয়ের পক্ষ থেকেই। বলতেই হবে যে, এই অপরিবর্তনীয় বিধান হল সৃষ্টিকর্তার দ্বারা সকলকিছুর সৃজনের পরবর্তী কালে তাঁর কর্তৃত্বের আরেকটি অকৃত্রিম বহিঃপ্রকাশ, এবং এও বলতেই হবে যে সৃষ্টিকর্তার কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা সীমাহীন; প্রতীক হিসাবে তাঁর মেঘধনুর ব্যবহার সৃষ্টিকর্তার কর্তৃত্বের এক ধারাবাহিকতা ও সম্প্রসারণ। এটি ছিল তাঁর বাক্যের ব্যবহারের মাধ্যমে ঈশ্বরের দ্বারা সম্পাদিত আরেকটি কর্ম, এবং বাক্যের মাধ্যমে ঈশ্বর মানুষের সাথে যে সন্ধিচুক্তি স্থাপন করেন তারই এক প্রতীক। যা ঘটাতে তিনি সংকল্পবদ্ধ ছিলেন এবং যেভাবে তা কার্যকর ও অর্জিত হওয়ার ছিল মানুষকে সে বিষয়ে তিনি অবহিত করেছিলেন। এইভাবে, ঈশ্বরের মুখ-নিঃসৃত বাক্য অনুসারেই বিষয়টি সম্পন্ন হয়েছিল। একমাত্র ঈশ্বরই এই ধরনের ক্ষমতার অধিকারী, এবং আজ, তাঁর এই বাক্যোচ্চারণের বহু সহস্র বছর পরেও, মানুষ এখনো ঈশ্বরের মুখে উচ্চারিত ওই মেঘধনুকে উপরে তাকিয়ে দেখতে পারে। ঈশ্বরের দ্বারা উচ্চারিত ওই বাক্যগুলির কারণেই, এই জিনিসটি আজ পর্যন্ত অবিকৃত ও অপরিবর্তিত রয়ে গেছে। এই মেঘধনুকে কেউ সরিয়ে ফেলতে পারে না, এর বিধানসমূহকে কেউ পাল্টে দিতে পারে না, এবং শুধুমাত্র ঈশ্বরের বাক্যের দরুনই এটি বিদ্যমান। সম্যক অর্থে এটিই ঈশ্বরের কর্তৃত্ব। “ঈশ্বর তাঁর বাক্যের মর্যাদা রাখেন, এবং তাঁর বাক্য নিষ্পন্ন হবেই, এবং তিনি যা নিষ্পন্ন করেন তা চিরকাল টিকে থাকে।” এধরনের বাক্যগুলি এখানে পরিষ্কারভাবে প্রতিপন্ন হয়েছে, এবং ঈশ্বরের কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার এটি এক সুস্পষ্ট লক্ষণ ও বৈশিষ্ট্য। সৃজিত সত্তাদের মধ্যে কেউ এজাতীয় লক্ষণ বা বৈশিষ্ট্যের অধিকারী নয়, বা তাদের মধ্যে তা দৃষ্ট হয় না, এবং অসৃজিত সত্তাদের কারোর মধ্যেও তা পরিলক্ষিত হয় না। এই বৈশিষ্ট্য একমাত্র অনন্য ঈশ্বরেরই অধিকৃত, এবং শুধুমাত্র সৃষ্টিকর্তার অধিকৃত স্বরূপ ও সারসত্যের সঙ্গে তা সৃজিত প্রাণীদের স্বরূপ ও সারসত্যের পার্থক্য নির্দেশ করে। একই সঙ্গে, তা এমন এক লক্ষণ ও বৈশিষ্ট্য, স্বয়ং ঈশ্বর ব্যতীত, কোনো সৃজিত বা অসৃজিত সত্তা যা কখনো ছাপিয়ে যেতেও পারে না।
মানুষের সঙ্গে তাঁর সন্ধিচুক্তি স্থাপন ঈশ্বরের সম্পাদিত এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কর্ম, এমন এক কর্ম যার মাধ্যমে তিনি মানুষকে এক সত্য জ্ঞাপন করতে চেয়েছিলেন এবং মানুষকে তাঁর ইচ্ছার কথা জানাতে চেয়েছিলেন। এই উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে, তিনি এক অনন্য পদ্ধতি প্রয়োগ করেছিলেন, মানুষের সঙ্গে এক সন্ধিচুক্তি স্থাপন করতে এক বিশেষ প্রতীককে কাজে লাগিয়েছিলেন, যে প্রতীক ছিল মানুষের সঙ্গে স্থাপিত তাঁর সন্ধিচুক্তির এক অঙ্গীকার। তাহলে, এই সন্ধিচুক্তির স্থাপন কি এক মহান ঘটনা ছিল? ঘটনাটি ঠিক কতখানি মহান ছিল? ঠিক এটিই হচ্ছে সেই সন্ধিচুক্তির বিশেষত্ব: এটি দুটি মানুষের মধ্যে, বা দুটি গোষ্ঠীর মধ্যে, বা দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে স্থাপিত কোনো সন্ধিচুক্তি নয়, বরং এ হল সৃষ্টিকর্তা ও সমগ্র মানবজাতির মধ্যে স্থাপিত সন্ধিচুক্তি, এবং যতদিন না সৃষ্টিকর্তা যাবতীয় কিছুর বিলোপ ঘটান ততদিন এই চুক্তি কার্যকর থাকবে। এই সন্ধিচুক্তির নির্বাহক হলেন সৃষ্টিকর্তা, এবং সৃষ্টিকর্তাই এর প্রতিপালক। সংক্ষেপে, মানবজাতির সঙ্গে স্থাপিত মেঘধনু সন্ধিচুক্তির পুরোটাই সাধিত ও অর্জিত হয়েছিল সৃষ্টিকর্তা ও মানবজাতির মধ্যে সংলাপ অনুযায়ী, এবং আজ অবধি তা তেমনই রয়ে গেছে। সৃষ্টিকর্তার কর্তৃত্বের অধীনে আত্মসমর্পণ করা, সেই কর্তৃত্বকে মান্য করা, বিশ্বাস করা, সমাদর করা, তাকে প্রত্যক্ষ করা, এবং তার বন্দনা করা ভিন্ন সৃষ্ট প্রাণীরা আর কী-ই বা করতে পারে? কারণ অদ্বিতীয় ঈশ্বর ব্যতিরেকে আর কেউই এজাতীয় এক সন্ধিচুক্তি স্থাপনের ক্ষমতার অধিকারী নয়। মেঘধনুর উদয়, যুগ-যুগান্ত ধরে বারংবার, মানবজাতির কাছে এক উদ্ঘোষণ এবং সৃষ্টিকর্তা ও মানবজাতির মধ্যে এই সন্ধিচুক্তির প্রতি তা মানবজাতির অভিনিবেশ আকর্ষণ করে। সৃষ্টিকর্তা ও মানবজাতির মধ্যে এই সন্ধিচুক্তির ক্রমাগত আবির্ভাবের মাধ্যমে মানবজাতির কাছে যা প্রদর্শিত হয় তা কোনো মেঘধনু নয়, বা খোদ সন্ধিচুক্তিটিও নয়, বরং তা হল সৃষ্টিকর্তার অপরিবর্তনীয় কর্তৃত্ব। মেঘধনুর পৌনঃপুনিক অভ্যুদয় প্রচ্ছন্ন স্থানসমূহে সৃষ্টিকর্তার সুমহান ও অলৌকিক কার্যকলাপের প্রদর্শন ঘটায়, এবং, একই সঙ্গে, তা সৃষ্টিকর্তার কর্তৃত্বের এক অতীব গুরুত্বপূর্ণ প্রতিফলন, যে কর্তৃত্ব কোনো দিন ম্লান হবে না, এবং কখনো পরিবর্তিত হবে না। এ কি ঈশ্বরের অনন্য কর্তৃত্বের আরেকটি দিকের প্রদর্শন নয়?
—বাক্য, খণ্ড ২, ঈশ্বরকে জানার প্রসঙ্গে, স্বয়ং অনন্য ঈশ্বর ১