কাজ এবং প্রবেশ (৫)
বর্তমানে তোমরা সকলেই জানো যে ঈশ্বর মানুষকে জীবনের সঠিক পথের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তিনি মানুষকে পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে অন্য একটি যুগে প্রবেশ করার নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তিনি মানুষকে এই অন্ধকার পুরনো যুগ অতিক্রমের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, দেহকে অতিক্রম করে, অন্ধকারের শক্তির নিপীড়ন ও শয়তানের প্রভাবের থেকে দূরে, যাতে প্রত্যেকটি মানুষ এক স্বাধীন বিশ্বে বসবাস করতে পারে। এক সুন্দর আগামীর স্বার্থে, এবং মানুষ যাতে আগামী দিনে সাহসী পদক্ষেপ নিতে পারে সেই জন্য, ঈশ্বরের আত্মা মানুষের জন্য সমস্তকিছু পরিকল্পনা করে রাখেন, এবং মানুষ যাতে আরো বেশি উপভোগ করতে পারে, সে জন্য ঈশ্বর মানুষের সম্মুখের পথ প্রস্তুতের জন্য দেহরূপের সমস্ত প্রচেষ্টা নিয়োজিত করেন, ফলে মানুষের আকাঙ্ক্ষিত দিনের আগমন ত্বরান্বিত হয়। আশা করি তোমরা সকলে এই সুন্দর মুহূর্তকে সযত্নে লালন করবে; কারণ ঈশ্বরের সাথে একত্র হওয়া সহজ কাজ নয়। তোমরা তাঁকে কখনো না জানলেও, বহু আগে থেকে তাঁর সাথেই রয়েছ। শুধু যদি সবাই এই সুন্দর অথচ ক্ষণস্থায়ী দিনগুলিকে চিরকাল মনে রাখত এবং সেগুলিকে পৃথিবীতে তাদের সযত্নলালিত সম্পদে পরিণত করতে পারত। ঈশ্বরের কাজ মানুষের কাছে বহু আগে থেকেই প্রকাশিত—কিন্তু মানুষের হৃদয় অত্যধিক জটিল হওয়ায়, এবং এতে তাদের কোনো আগ্রহ না থাকায়, ঈশ্বরের কাজ তার আসল ভিত্তিমূলেই স্থগিত রয়ে গেছে। মানুষের চিন্তাভাবনা, ধারণা, এবং মানসিক দৃষ্টিভঙ্গি যেন প্রাচীনপন্থীই রয়ে গেছে, এতই প্রাচীন যে তাদের অনেকের মানসিক দৃষ্টিভঙ্গিই প্রাচীন কালের আদিম মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির অবস্থাতেই রয়ে গেছে, বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি। ফলস্বরূপ, ঈশ্বর যে কাজ করেন তার বিষয়ে মানুষ এখনও বিভ্রান্ত ও অস্পষ্ট। তারা কী করে এবং তাদের কীসে প্রবেশ করা উচিত, সেই বিষয়ে তারা আরোই অস্পষ্ট। এই বিষয়গুলি ঈশ্বরের কাজে প্রবল অসুবিধা সৃষ্টি করে এবং মানুষের জীবনের অগ্রগতিকে প্রতিহত করে। মানুষের মূলগত উপাদান ও অপর্যাপ্ত যোগ্যতার কারণে, মৌলিকভাবেই তারা ঈশ্বরের কাজ উপলব্ধি করতে অক্ষম, আর এই সমস্ত বিষয়গুলিকে তারা গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করে না। জীবনে যদি অগ্রগতি করতে চাও, তাহলে তোমাদের অবশ্যই নিজেদের অস্তিত্বের খুঁটিনাটি বিষয়ের প্রতি মনোযোগ দেওয়া শুরু করতে হবে, জীবনে তোমাদের প্রবেশকে নিয়ন্ত্রণের জন্য সেগুলির প্রতিটিকে উপলব্ধি করতে হবে, তোমাদের প্রত্যেকের হৃদয় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে রূপান্তরিত করতে হবে, নিজেদের হৃদয়ের শূন্যতাজনিত সমস্যা এবং জরাজীর্ণ বিষণ্ণতাময় যে বিষয়গুলি তোমাদের বেদনা দেয় সেগুলির সমাধান করতে হবে, যাতে তোমাদের প্রত্যেকেরই অন্তর থেকে নবায়ন হয় এবং তোমরা এক উন্নীত, উৎকৃষ্ট ও মুক্ত জীবন প্রকৃতপক্ষেই উপভোগ করতে পারো। তোমরা প্রত্যেকে যাতে প্রাণবন্ত হয়ে উঠতে পারো, আত্মায় পুনরুজ্জীবিত হতে পারো, এবং জীবিত সত্তার অনুরূপ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হতে পারো, সেটাই লক্ষ্য। তোমরা যে সমস্ত ভাই ও বোনেদের সংস্পর্শে এসেছ, তাদের মধ্যে খুব কমজনই আছে যারা প্রাণবন্ত ও সতেজ। তারা প্রাচীন কালের বনমানুষের মতো, সহজসরল ও বোকা, যাদের মধ্যে কার্যত বিকাশের কোনো সম্ভাবনাই নেই। তার থেকেও খারাপ ব্যাপার হল, আমি যে ভাই ও বোনেদের সংস্পর্শে এসেছি, তারা পাহাড়ি বর্বরদের মতো অভদ্র ও অসভ্য। ভদ্র ব্যবহার সম্পর্কে তাদের জ্ঞান খুবই সামান্য, আর কীভাবে আচরণ করতে হয় সে বিষয়ে তাদের মৌলিক জ্ঞান আরোই কম। অনেক তরুণী বোনেদের দেখলে যদিও বুদ্ধিমতী ও পরিশীলিত বলে মনে হয়, তারা ফুলের মতোই প্রস্ফুটিত হয়েছে, কিন্তু তবুও নিজেদের “বিকল্প” শৈলীতে সজ্জিত করে রাখে। এক বোনের[ক] চুল তার পুরো মুখমণ্ডলকে এমনভাবে আবৃত করে রেখেছে যে তার চোখ কোনোভাবেই দৃষ্টিগোচর হয় না। যদিও তার মুখমণ্ডলের বৈশিষ্ট্য পরিচ্ছন্ন ও গুণসম্পন্ন, কিন্তু তার চুলের শৈলী খুবই বিরক্তি উদ্রেককারী, দেখলেই অদ্ভুত অনুভূতি হয়, যেন সে অপ্রাপ্তবয়স্কদের সংশোধনাগারের এক নম্বর অপরাধী। তার চোখদুটি যেন জলের মধ্যে থাকা পান্নার মতোই নির্মল ও উজ্জ্বল, কিন্তু তার পোশাক ও চুলের শৈলী সেগুলিকে নিষ্প্রভ করে দিয়েছে, যেন নীরন্ধ্র অন্ধকার রাতে হঠাৎ চোখে পড়া একজোড়া লন্ঠন, যা মাঝে মধ্যে এমন চোখধাঁধানোভাবে জ্বলে উঠছে যে মানুষের মনে ভয়ের সঞ্চার হয়, তাছাড়াও মনে হয় যেন সে ইচ্ছে করে কারো কাছ থেকে নিজেকে আড়াল করতে চাইছে। আমার যখনই তার সাথে দেখা হয়, সে সর্বদাই “দৃশ্য” থেকে সরে যাওয়ার উপায় খোঁজে, যেন সদ্য খুন করে আসা এক হত্যাকারী ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে গভীরভাবে ভীত, প্রতিনিয়তই পালিয়ে চলেছে; একইভাবে, সে যেন কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকাবাসীদের[১] মতো, যারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে দাস হয়ে থেকেছে, কখনোই অন্যদের সামনে মাথা উঁচু করতে পারে না। এই আচরণের পরিসর, এই জনগণ যেভাবে পোশাক পরে এবং নিজেকে প্রস্তুত করে, তার উন্নতি করার জন্য বেশ কয়েক মাস কাজ করতে হবে।
হাজার হাজার বছর ধরে চীনদেশীয় জনগণ ক্রীতদাসের জীবন যাপন করেছে, এবং তা তাদের চিন্তাভাবনা, ধারনা, জীবন, ভাষা, আচরণ, ও ক্রিয়াকলাপকে এতোই অবরুদ্ধ করেছে যে তাদের বিন্দুমাত্র স্বাধীনতাও আর অবশিষ্ট নেই। কয়েক হাজার বছরের ইতিহাস প্রাণশক্তিময় আধ্যাত্মিক জনগণকে অধিকার করেছে এবং তাদের এতই জরাজীর্ণ করে তুলেছে যেন তারা আত্মাহীন মৃতদেহ। অনেকেই আছে যারা শয়তানের কসাইয়ের ছুরির নিচে জীবনযাপন করে, অনেকে বন্য পশুর গুহার মতো ঘরবাড়িতে বসবাস করে, অনেকে বলদ ও ঘোড়াদের মতো একই খাদ্য গ্রহণ করে, এবং অনেকে আছে যারা বিশৃঙ্খল ও অজ্ঞানভাবে “নরকে” শুয়ে থাকে। বাহ্যিক চেহারায়, জনগণ কোনোভাবেই আদিম মানুষের থেকে আলাদা নয়, তাদের বিশ্রামস্থল নরকের মতো, এবং অপবিত্র অপদেবতা ও মন্দ আত্মারা তাদের সঙ্গী হিসাবে পরিবেষ্টিত করে রাখে। বহিরঙ্গ থেকে মানুষকে উন্নত “প্রাণী” বলেই মনে হয়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা অপবিত্র অপদেবতাদের সাথেই বসবাস করে ও জীবনযাপন করে। তাদের পরিচর্যা করার মতো কেউ না থাকায়, জনগণ শয়তানের ফাঁদের মধ্যে বাস করে, তার জালে আটক, যেখান থেকে পালানোর কোনো উপায় নেই। মানুষ নিজেদের প্রিয়জনের সাথে আরামদায়ক বাড়িতে একসাথে বাস করে, এমন বলার পরিবর্তে বরং বলা উচিত হবে যে মানুষ মৃতস্থানে বাস করে, অপদেবতাদের সাথে লেনদেন করে ও শয়তানের সহযোগী হয়। প্রকৃতপক্ষে, মানুষ এখনও শয়তানের দ্বারা আবদ্ধ, যেখানে অপবিত্র অপদেবতারা সমবেত হয় সেখানে তারা বাস করে, এইসমস্ত অপবিত্র অপদেবতাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, যেন তাদের শয্যা মৃতদেহের শয়নস্থল, যেন সেগুলো তাদের আরামদায়ক আবাস। তাদের গৃহে প্রবেশ করলে দেখা যায়, আঙিনাখানি শীতল ও নিঃসঙ্গ, গাছের শুকনো ডালের মধ্যে দিয়ে শীতল বাতাস আওয়াজ করে বয়ে যাচ্ছে। “বসবাসের স্থানের” দ্বার উন্মুক্ত করলে দেখা যায় ঘরখানি মিশকালো—তুমি নিজের হাত বাড়িয়ে তাকালেও আঙুল দেখতে পাবে না। দরজার সামান্য ফাটল দিয়ে সামান্য আলো প্রবেশ করছে, যার ফলে ঘরটিকে আরোই তমসাচ্ছন্ন ও ভয়ঙ্কর লাগছে। মাঝে মধ্যে ইঁদুরের অদ্ভুত আওয়াজ শুনে মনে হয় যেন তারা আনন্দ করছে। ঘরের সমস্ত কিছুই এত বীভৎস ও ভীতিপ্রদ যে মনে হয় যেন এই বাড়িতে একজন বাস করত যাকে সদ্য কফিনে কবরস্থ করা হয়েছে। বিছানা, তোষক, এবং ঘরের মধ্যে চোখে না পড়ার মতো ছোট ক্যাবিনেট, সবই ধূলায় আচ্ছাদিত, মেঝেতে বেশ কিছু ছোট ছোট বসার স্টুল যেন ধারালো দাঁত আর নখরযুক্ত থাবা বার করে ভয় দেখাচ্ছে, আর দেওয়ালে ঝুলে রয়েছে মাকড়সার জাল। টেবিলের উপরে একটি আয়না বসানো, তার পাশেই রয়েছে একটি চিরুনি। আয়নার দিকে এগিয়ে গিয়ে তুমি একটি মোমবাতি তুলে নিয়ে জ্বালালে। তুমি দেখতে পেলে আয়না ধুলোয় ঢেকে রয়েছে, মানুষের প্রতিচ্ছবিতে[খ] একরকমের “রূপসজ্জা” ফুটিয়ে তুলছে, যেন তারা সদ্য কবর থেকে উঠে এসেছে। চিরুনি চুলে ভরে আছে। সব জিনিসপত্রই পুরনো ও ময়লা, আর দেখে মনে হয় যেন সদ্যমৃত কেউ সেগুলো ব্যবহার করেছে। চিরুনিটির দিকে তাকালে কারো হয়তো মনে হবে পাশে যেন মৃতদেহ শোয়ানো রয়েছে। চিরুনিতে থাকা চুলে কোনো রক্ত সঞ্চালন নেই, তাদের মধ্যে রয়েছে মৃতের ঘ্রাণ। দরজার ফাটল দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস প্রবেশ করছে, যেন সেই ফাটল দিয়ে এক প্রেতাত্মা বেঁকেচুরে ঢুকতে চাইছে, সেই ঘরে বাস করার জন্য ফিরে আসছে। সেই ঘরের ভিতরে কষ্টদায়ক ঠাণ্ডা, অকস্মাৎ ভেসে আসে পচা মৃতদেহের গন্ধ, আর সেই মুহূর্তেই দেখতে পাওয়া যায় দেওয়াল থেকে অনেক জিনিস জড়াজড়ি করে ঝুলছে, বিছানায় রয়েছে এলোমেলো বিছানাপত্র, ময়লা ও দুর্গন্ধময়, ঘরের কোণায় রয়েছে কিছু শস্য, ক্যাবিনেটে ধুলার আস্তরণ, ঘরের মেঝেতে পড়ে আছে গাছের ভাঙা ডালপালা আর ময়লা, এরকম আরো অনেক কিছু—যেন সেগুলো সদ্য কোনো মৃত মানুষ ব্যবহার করেছে, যেন তারা ঝুঁকে আছে সামনের দিকে, দাঁতে দাঁত ঘষে হাওয়ায় নখের থাবা দিচ্ছে। এগুলিই তোমাকে কাঁপুনি ধরিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। সেই ঘরের কোথাও জীবনের কোনো চিহ্ন নেই, সবই অন্ধকার ও স্যাঁতসেঁতে, ঠিক ঈশ্বরের বর্ণিত মৃতস্থান ও নরকের মতোই। এটি ঠিক একজন মানুষের সমাধির মতো, রঙ না করা ক্যাবিনেট, স্টুল, জানালার কাঠামো, এবং দরজা যেন শোক জ্ঞাপনের সাজে সজ্জিত আর মৃত মানুষটির উদ্দেশ্যে তারা যেন নীরবে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে। মানুষ এই নরকে কয়েক দশক বা শতক এমনকি কয়েক সহস্রাব্দ ধরে বাস করে আসছে, খুব তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যায় আর ফিরে আসে অনেক দেরিতে। তারা নিজেদের “সমাধি” থেকে বেরিয়ে পড়ে আলো ফোটার সাথে সাথে, যখন মোরগে ডাক দিতে শুরু করে, আর উপরে আকাশ ও নিচে মাটির দিকে তাকিয়ে তাদের দৈনিক কার্যকলাপ শুরু হয়। যখন পর্বতের আড়ালে সূর্য ঢলে পড়ে, তারা নিজেদের ক্লান্ত শরীরকে টেনে “সমাধি”-তে ফিরে আসে, যতক্ষণে তাদের পেট ভর্তি হয়, ততক্ষণে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। তারপর, পরেরদিন “সমাধি” ছেড়ে বেরোনোর প্রস্তুতি শেষ করে তারা আলো নিভিয়ে দেয়, মনে হয় সেই আলো যেন ফসফরাসের আগুনের মতো উজ্জ্বলতা বিচ্ছুরণ করছে। এই সময়, চাঁদের আলোয় যাকিছু চোখে পড়ে তা হল প্রতিটি কোণে টিলার মতো ছড়ানো শবাধার। সেই সব “সমাধি” থেকে মাঝে মধ্যে নাক ডাকার আওয়াজের ওঠাপড়া ভেসে আসে। সমস্ত মানুষ গভীর ঘুমে নিমগ্ন হয়, এবং সমস্ত অপবিত্র অপদেবতা আর প্রেতাত্মারাও শান্তিতে বিশ্রাম নিচ্ছে বলেই মনে হয়। কিচ্ছুক্ষণ পর পর দূর থেকে কাকের ডাক শুনতে পাওয়া যায়—এরকম এক নিঝুম ও নিস্তব্ধ রাতে এমন নিঃসঙ্গ আওয়াজ তোমার শিরদাঁড়ায় কাঁপুনি ধরিয়ে দিতে ও তোমার প্রতিটি রোমকূপে শিহরণ জাগিয়ে তুলতে যথেষ্ট…। কে জানে মানুষ কত বছর ধরে এই পরিবেশে কাটিয়ে দিয়েছে, মারা গেছে, আবার পুনর্জন্ম লাভ করেছে; কে-ই বা জানে কত দিন তারা এমন এক মনুষ্য জগতে রয়ে গেছে যেখানে মানুষ ও অপদেবতারা একসাথে থাকে, উপরন্তু, তারা কত বার পৃথিবীকে বিদায় জানিয়েছে তা-ই বা কে জানে! পৃথিবীর মধ্যে অবস্থিত এই নরকেই মানুষ আনন্দে জীবনযাপন করে, যেন তাদের মধ্যে অভিযোগ করার মতো কোনো বিষয়ই নেই, কারণ বহু আগেই তারা মৃতস্থানের জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। আর তাই, যেখানে অপবিত্র অপদেবতাদের বাস সেইসব স্থানই মানুষকে আকর্ষণ করে, যেন এই অপবিত্র অপদেবতারা তাদের বন্ধু ও সঙ্গী, যেন মনুষ্য জগত এক গুণ্ডার দল[২]—কারণ মানুষের আসল উপাদান বহু আগেই নিঃশব্দে অদৃশ্য হয়ে গেছে, কোনো চিহ্ন না রেখেই তা বিলীন হয়ে গেছে। মানুষের চেহারাতে অপবিত্র অপদেবতার মতো কিছু ব্যাপার রয়েছে, উপরন্তু তাদের কাজকর্মও অপবিত্র অপদেবতাদের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত। বর্তমানে, তাদের অপবিত্র অপদেবতাদের থেকে আলাদা দেখায় না, যেন তারা তাদের থেকেই জন্ম নিয়েছে। উপরন্তু, মানুষ তাদের এই পূর্বপুরুষদের প্রতি অত্যন্ত প্রেমপূর্ণ এবং তাদের সমর্থক। কেউ জানে না যে মানুষ অনেক আগে থেকেই শয়তানের দ্বারা এত নিপীড়িত হয়েছে যে তারা পাহাড়ি গোরিলার মতো হয়ে গেছে। তাদের রক্তিম চোখে রয়েছে মিনতিপূর্ণ দৃষ্টি, আর সেখান থেকে যে ম্লান আলো নির্গত হয় তার মধ্যে রয়েছে এক অপবিত্র অপদেবতার অমঙ্গলকারী অসূয়ার অস্পষ্ট চিহ্ন। তাদের মুখ বলিরেখায় পূর্ণ, পাইন গাছের ছালের মতো কর্কশ, চোয়াল বাইরের দিকে প্রসারিত, যেন শয়তানের নকশায় তৈরী, তাদের কানের ভিতরে ও বাইরে ময়লায় আবৃত, তাদের পিঠ বাঁকা, তাদের পা-কে শরীরের ভার বহন করার জন্য কষ্ট করতে হয়, এবং তাদের অস্থিসর্বস্ব হাত ছন্দোবদ্ধভাবে সামনে পিছনে দুলতে থাকে। বিষয়টা এমন যেন তারা অস্থি-চর্ম ছাড়া কিছু নয়, কিন্তু আবার তারা পাহাড়ি ভালুকের মতো স্থূলও। ভিতর ও বাইরে থেকে তারা যেন আদিমকালের এক বনমানুষের মতো সজ্জিত—যেন আজও এই বনমানুষেরা আধুনিক মানুষের আকৃতিতে সম্পূর্ণরূপে বিবর্তিত[৩] হয়ে উঠতে পারেনি, এতোই পশ্চাৎপদ তারা!
মানুষ পশুদের পাশাপাশিই জীবনযাপন করে, এবং কোনোরকম বিবাদ বা মৌখিক মতানৈক্য ছাড়াই বেশ আনন্দেই থাকে। পশুদের প্রতি তার যত্ন ও খেয়াল রাখার বিষয়ে মানুষ অতিসতর্ক, এবং পশুদের অস্তিত্বই আছে মানুষের বেঁচে থাকার স্বার্থে, স্পষ্টতই মানুষের উপকারের জন্য, নিজেদের কোনোরকম সুবিধা ছাড়া এবং মানুষের প্রতি সম্পূর্ণ আনুগত্য সহকারে তারা আছে। সমস্ত দিক থেকেই মানুষ ও পশুদের এই সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ[৪] ও সমন্বয়পূর্ণ[৫]—এবং অপবিত্র অপদেবতাকে মানুষ ও পশুর নিখুঁত সংমিশ্রণ বলেই মনে হয়। সুতরাং, মানুষ এবং পৃথিবীর অপবিত্র অপদেবতারা আরোই ঘনিষ্ঠ ও অবিচ্ছেদ্য: অপবিত্র অপদেবতাদের থেকে দূরে থাকলেও মানুষ তাদের সাথে সংযুক্তই থাকে; ইতিমধ্যে, অপবিত্র অপদেবতারা মানুষের প্রতি তাদের সমস্তকিছুই “উৎসর্গ” করে, কিছুই বাদ রাখে না। জনগণ প্রতিদিন “নরকের রাজার প্রাসাদে” ঘোরাফেরা করে, “নরকের রাজা” (তাদের পূর্বপুরুষ)-এর সাথে ক্রীড়াকৌতুক করে এবং তার দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়, এতটাই, যে বর্তমানে মানুষ আবর্জনায় আচ্ছাদিত হয়ে পড়েছে, এবং এতটা সময় মৃতস্থানে অতিবাহিত করার পরে, তারা অনেক আগেই “জীবিতদের জগতে” ফিরে আসার ইচ্ছা পোষণ করা ছেড়ে দিয়েছে। তাই, যখনই তারা আলো দেখতে পায়, এবং প্রত্যক্ষ করে ঈশ্বরের চাহিদা, তাঁর চরিত্র, ও তাঁর কাজ, তারা চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে, তারপরেও নরকে ফিরে গিয়ে প্রেতাত্মাদের সাথেই বাস করতে চায়। তারা ঈশ্বরকে বহু আগেই ভুলে গেছে, আর তাই চিরকাল কবরস্থানেই ঘোরাফেরা করে চলেছে। যখন কোনো একজনের সাথে আমার দেখা হয়, আমি তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করি, আর ঠিক সেই সময়েই আমি আবিষ্কার করি যে আমার সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে সে মানুষই নয়। তার চুল অবিন্যস্ত, মুখ অপরিচ্ছন্ন আর তার দাঁত বার করা হাসির মধ্যে নেকড়ে সদৃশ ব্যাপার আছে। একইভাবে, তার মধ্যেও এমন এক অস্বস্তি রয়েছে যেন কোনো প্রেতাত্মা সদ্য সমাধি থেকে উঠে এসে জীবিতদের জগতের মানুষকে দেখছে। এই ব্যক্তি সর্বদা ঠোঁটে হাসি লাগিয়ে রাখার চেষ্টা করছে; তা একাধারে কপট আর অশুভ প্রতীয়মান হচ্ছে। যখন সে আমার দিকে তাকিয়ে হাসে, মনে হয় যেন তার কিছু বলার আছে কিন্তু বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না, আর তাই সে শুধু একপাশে দাঁড়িয়েই থাকতে পারে, বিহবল ও নির্বোধের মতো। পিছন থেকে দেখলে তাকে মনে হয় যেন “চৈনিক শ্রমজীবী মানুষের মহৎ প্রতিমূর্তি”, সেই মুহূর্তে তাকে আরোই ঘৃণ্য লাগে, অতীতের কিংবদন্তি ইয়ান হুয়াং/ইয়ান ওয়াং-এর[গ] বংশধরদের ছবি স্মরণ করায়, যার কথা লোকে বলে। আমি তাকে প্রশ্ন করলে, সে নীরবে মাথা নিচু করে। তার উত্তর দিতে অনেক সময় লেগে যায়, এবং যখন উত্তর দেয়, তখনও বেশ ইতস্তত বোধ করে। সে তার হাতগুলো স্থির রাখতে পারে না, বিড়ালের মতো দুটো আঙুল চুষতে থাকে। শুধু তখনই আমি উপলব্ধি করি যে তার হাত দেখে মনে হচ্ছে যেন সবেমাত্র আবর্জনা তুলেছে, অমসৃণ নখ এতই বিবর্ণ যে কেউ কখনো বুঝতেই পারবে না যে সেগুলি আসলে সাদা হওয়ার কথা, “পাতলা” নখে লেগে আছে ময়লার মোটা রেখা। আরো বিশ্রী ব্যাপার হল, তাদের হাতের পিছনের দিকটা ঠিক সদ্য পালক ছাড়ানো মুরগির চামড়ার মতো দেখতে। তাদের হাতের প্রায় সমস্ত রেখাই মানুষের শ্রমের রক্ত এবং ঘামের মূল্যে সম্পৃক্ত, প্রতিটির মধ্যে ময়লার মতো কিছু না কিছু রয়েছে, তা থেকে “মাটির সুগন্ধ” নিঃসৃত হচ্ছে বলে মনে হয়, তা মানুষের কষ্টভোগের চেতনার বহুমূল্যতা এবং প্রশংসাযোগ্যতাই আরো ভালোভাবে উপস্থাপিত করে—যার ফলে মানুষের হাতের প্রতিটি রেখায় এই কষ্টভোগের চেতনা গভীরভাবে গেঁথে আছে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত মানুষ যে পোশাক পরিধান করে তার কোনোটিই দেখতে কোনো পশুর চর্মের মতো নয়, কিন্তু তারা জানে না যে তারা যতই “সম্মানিত” হোক, তাদের মূল্য আসলে একটি শেয়ালের পশমের থেকেও কম—এমনকি ময়ূরের একখানি পালকের থেকেও কম, কারণ বহু আগেই তাদের পরিধেয় তাদেরকে এত কদর্য করে দিয়েছে যে তাদের শুকর বা কুকুরের থেকেও বাজে দেখায়। তার ঊর্ধ্বাঙ্গের অপ্রতুল পোশাক পিছনের দিকে অর্ধেক ঝুলে থাকে, আর মুরগির অন্ত্রের মতো তার প্যান্টের পা উজ্জ্বল দিবালোকে তার কদর্যতাকে উন্মোচিত করে। সেগুলি স্বল্পদৈর্ঘ্য ও সরু, যেন শুধু দেখানোর জন্য যে তার পায়ের পাতা বহু আগে থেকেই বন্ধনমুক্ত: তাদের পায়ের পাতা বড়, পুরানো সমাজের “তিন ইঞ্চি সোনালী পদ্ম” নয়। এই ব্যক্তির পরিচ্ছদ অত্যন্ত পাশ্চাত্যশৈলীর, ও সেইসাথে খুবই সস্তা প্রলোভন উদ্রেককারীও। যখন তার সাথে আমার দেখা হয়, সে সর্বদাই লাজুক থাকে, তার মুখে রক্তিমাভা, সে একেবারেই মাথা তুলে তাকাতে পারে না, যেন অপবিত্র অপদেবতারা তাকে পদদলিত করেছে এবং সে আর চোখ তুলে মানুষের মুখের দিকে তাকাতে পারছে না। ধুলো মানুষের মুখকে আচ্ছাদিত করে। এই আকাশের থেকে নেমে আসা ধুলো যেন অন্যায়ভাবে মানুষের মুখের উপর পড়ে, তাকে করে তোলে চড়ুইয়ের পালকের মতো। মানুষের চোখও চড়ুইয়ের মতোই: ছোট ও শুষ্ক, তাতে কোনো উজ্জ্বলতা নেই। জনগণ যখন কথা বলে, তখন তাদের বক্তৃতা অভ্যাসগতভাবে দ্বিধাপূর্ণ ও অসরল, অন্যদের কাছে ঘৃণ্য এবং বিরক্তিকর। তবুও অনেকে এই ধরনের মানুষদের “দেশের প্রতিনিধি” বলে প্রশংসা করে। এ কি রসিকতা নয়? ঈশ্বর মানুষকে পরিবর্তন করতে চান, তাদের উদ্ধার করতে চান, তাদের মৃত্যুর সমাধি থেকে পরিত্রাণ দিতে চান, যাতে তারা মৃতস্থান ও নরকের যে জীবনযাপন করে তা থেকে বাঁচতে পারে।
পাদটীকা:
১. “কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকাবাসী” বলতে ঈশ্বরের অভিশাপ প্রাপ্ত কৃষ্ণাঙ্গ জনগণের কথা বলা হচ্ছে, যারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ক্রীতদাস ছিল।
২. “গুণ্ডার দল” বলতে মানবজাতির ভ্রষ্টাচারের কথা বলা হচ্ছে, এবং মানবজাতির মধ্যে যে কোনো পবিত্র মানুষ নেই তা বোঝানো হচ্ছে।
৩. “বিবর্তিত” বলতে আদিম বনমানুষ থেকে বর্তমানের মানুষের চেহারায় “বিবর্তন হওয়ার” কথা বলা হচ্ছে। এটা ব্যঙ্গাত্মক উদ্দেশ্যে বলা হচ্ছে: প্রকৃতপক্ষে, আদিম বনমানুষ থেকে সোজা হয়ে হাঁটা মানুষের রূপান্তর সংক্রান্ত যে তত্ত্ব আছে, আসলে তেমন কিছু কখনো হয়নি।
৪. “ঘনিষ্ঠ” এখানে ব্যঙ্গ করে বলা হয়েছে।
৫. “সমন্বয়পূর্ণ” এখানে ব্যঙ্গ করে বলা হয়েছে।
ক. মূল পাঠ্যে রয়েছে “তার”।
খ. মূল পাঠ্যে রয়েছে “মানুষের মুখে।”
গ. “ইয়ান” এবং “হুয়াং” হল দুই পৌরাণিক সম্রাটের নাম, যারা চীনের প্রথম সংস্কৃতি-দাতাদের মধ্যে অন্যতম ছিল। “ইয়ান ওয়াং” হল “নরকের রাজা”-র চীনা নাম। “ইয়ান হুয়াং” এবং “ইয়ান ওয়াং” মান্দারিন উচ্চারণে প্রায় একই শোনায়।