কাজ এবং প্রবেশ (৩)
ঈশ্বর মানুষকে বহুকিছু অর্পণ করেছেন এবং তাদের প্রবেশ প্রবেশের বিষয়েও অনেকভাবে বলেছেন। কিন্তু মানুষের ক্ষমতা যথেষ্ট দুর্বল হওয়ায়, ঈশ্বরের অনেক বাক্যই তাদের মধ্যে দৃঢ়মূল হতে ব্যর্থ হয়েছে। এই দুর্বল ক্ষমতার নানা কারণ রয়েছে, যেমন মানুষের ভাবনাচিন্তা ও নৈতিকতার বিকৃতি, যথাযথ প্রতিপালনের অভাব; সামন্ততান্ত্রিক কুসংস্কার যা মানুষের হৃদয়কে বেশ গুরুতরভাবে দখল করেছে; অধঃপতিত ও অনৈতিক জীবনশৈলী, যা মানুষের হৃদয়ের গভীরতম কোণেও অনেক অশুভের বীজ বপন করেছে; সাংস্কৃতিক সাক্ষরতার অগভীর উপলব্ধি, যেখানে প্রায় আটানব্বই শতাংশ মানুষের সাংস্কৃতিক সাক্ষরতার বিষয়ে শিক্ষার অভাব রয়েছে, এবং তাছাড়াও, খুব অল্প সংখ্যক মানুষই উচ্চতর সাংস্কৃতিক শিক্ষা লাভ করছে। সুতরাং, ঈশ্বর বা আত্মা বলতে কী বোঝায়, সে সম্পর্কে মানুষের মূলত কোনো ধারণাই নেই, রয়েছে শুধু সামন্ততান্ত্রিক কুসংস্কার থেকে প্রাপ্ত একটা অস্পষ্ট এবং অস্বচ্ছ প্রতিমূর্তি। হাজার হাজার বছরের “জাতীয়তাবাদের দাম্ভিক আত্মা” মানুষের মনে যে গভীর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেছে, তার পাশাপাশি রয়েছে মানুষের সামন্ততান্ত্রিক চিন্তাভাবনা, যার দ্বারা সে আবদ্ধ ও শৃঙ্খলিত, যেখানে বিন্দুমাত্র স্বাধীনতা নেই, উচ্চাকাঙ্ক্ষা বা উদ্যমী হওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই, তার বদলে রয়েছে নিষ্ক্রিয় ও পশ্চাদমুখী, গেঁথে থাকা দাস-মনোবৃত্তি, এবং এরকম অনেক কিছু—এই উদ্দেশ্যমূলক বিষয়গুলো মানবজাতির ভাবগত দৃষ্টিভঙ্গি, আদর্শ, নৈতিকতা ও স্বভাবের উপরে এক অমোচনীয়ভাবে কলঙ্কিত ও কুৎসিত প্রভাব বিস্তার করেছে। মনে হয় মানুষ যেন সন্ত্রাসবাদের এক অন্ধকার জগতে বসবাস করছে, তাদের মধ্যে কেউ যেটাকে অতিক্রম করার অন্বেষণ করে না, এবং তাদের কেউই এক আদর্শ বিশ্বে স্থানান্তরিত হওয়ার কথা চিন্তা করে না; বরং তারা জীবনে তাদের এই ভাগটুকু পেয়েই সুখী, সন্তান ধারণ ও তাদের বড়ো করে তোলা, সংগ্রাম করা, ঘাম ঝরিয়ে যাওয়া, দৈনন্দিন কাজ করা, আরামপ্রদ ও সুখী পরিবারের স্বপ্ন দেখা, এবং দাম্পত্যের মমতা, যোগ্য সন্তানের স্বপ্ন দেখা, শান্ত জীবনযাপনের গোধূলি বেলায় আনন্দের স্বপ্ন দেখা, এ নিয়েই তাদের দিনযাপন…। কয়েক দশক, কয়েক শতক, কয়েক সহস্র বছর ধরে আজ পর্যন্ত, মানুষ তার সময় বৃথা অতিবাহিত করে চলেছে, কেউই নিখুঁত একটা জীবন নির্মাণ করেনি, সমস্ত অভিপ্রায় শুধু এই অন্ধকার দুনিয়ায় পারস্পরিক হত্যার, খ্যাতি ও সৌভাগ্য লাভের জন্য দৌড়ানোর, এবং একে অন্যের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার। কেউ কি কখনো ঈশ্বরের ইচ্ছার অন্বেষণ করেছে? কেউ কি কখনো ঈশ্বরের কাজে মনোযোগ দিয়েছে? মানবতার যে অংশ অন্ধকারের প্রভাব দ্বারা অধিকৃত, সেগুলো সবই বহুকাল আগে মানুষের প্রকৃতি হয়ে উঠেছে, তাই ঈশ্বরের কার্য সম্পাদন করা বেশ কঠিন, এবং ঈশ্বর মানুষকে বর্তমানে যে কাজ অর্পণ করেছেন সেদিকে মনোযোগ দেওয়ার ইচ্ছাও তাদের খুব কম। যাই হোক না কেন, আমার বিশ্বাস যে আমার এই বাক্যগুলো উচ্চারণ করাতে মানুষ কিছু মনে করবে না, কারণ আমি যে বিষয়ে বলছি তা হাজার হাজার বছরের ইতিহাস। ইতিহাস নিয়ে কথা বলা মানে হচ্ছে, সত্য, এবং তার থেকেও বেশী, সেইসব কলঙ্কজনক অধ্যায় নিয়ে কথা বলা যা সকলেরই জানা, তাই সত্যঘটনার যা বিরোধী সেকথা বলার কি কোনো মানে আছে? কিন্তু আমি এটাও বিশ্বাস করি যে যুক্তিবাদী মানুষেরা এই বাক্যগুলো শুনে জাগ্রত হবে এবং অগ্রসর হওয়ার প্রচেষ্টা করবে। ঈশ্বর আশা করেন মানুষ শান্তি ও তৃপ্তির সাথে কাজ করবে ও জীবনযাপন করবে, আবার একই সময়ে সে ঈশ্বরকে ভালোবাসতেও সক্ষম হবে। ঈশ্বরের ইচ্ছা হল যে সমস্ত মানবজাতি যেন বিশ্রামের মধ্যে প্রবেশ করতে পারে; তার চেয়েও বেশী করে, ঈশ্বরের সুবিশাল আকাঙ্ক্ষা হল এই সমগ্র জগত তাঁর মহিমায় পূর্ণ করে তোলা। এটা খুবই লজ্জার বিষয় যে মানুষ এখনও বিস্মৃতিতে নিমজ্জিত এবং নিদ্রিত রয়েছে, শয়তানের দ্বারা সে এতটাই ভ্রষ্ট হয়ে রয়েছে যে বর্তমানে তার মধ্যে মানুষের কোনো গুণ আর অবশিষ্ট নেই। তাই মানুষের চিন্তাভাবনা, নৈতিকতা ও শিক্ষা একটা গুরুত্বপূর্ণ যোগসূত্র নির্মাণ করে, এবং সাংস্কৃতিক সাক্ষরতার প্রশিক্ষণ দ্বিতীয় একটা যোগসূত্র তৈরি করে, যাতে আরো ভালোভাবে মানুষের ক্ষমতা বৃদ্ধি হয় এবং তার আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়।
প্রকৃতপক্ষে, মানবজাতির কাছে ঈশ্বরের চাহিদা খুব বেশী নয়, কিন্তু মানুষের ক্ষমতা ও ঈশ্বরের প্রয়োজনীয় মানের মধ্যে ব্যবধান এত বেশী, যে বেশীরভাগ মানুষ শুধু মাথা উঁচু করে ঈশ্বরের চাহিদার দিকে তাকায়, কিন্তু তাদের সেগুলো পূর্ণ করার ক্ষমতার অভাব রয়েছে। মানুষের সহজাত গুণাবলী ও তাদের জন্মের পরবর্তী কালে অর্জিত সমস্তকিছুর সমষ্টিও ঈশ্বরের প্রয়োজনীয়তা পূরণ করার পক্ষে যথেষ্টর চেয়ে অনেক কম। কিন্তু শুধু এই বিষয়টা বুঝতে পারাই কোনো নিশ্চিত সমাধান নয়। দূরবর্তী জল কখনো এই মুহূর্তের তৃষ্ণা নিবারণ করতে পারে না। এমনকি মানুষ যদি নিজেকে ধূলিকণার চেয়েও নিকৃষ্ট জ্ঞান করে, যদি তাদের ঈশ্বরের হৃদয়কে সন্তুষ্ট করার সংকল্প না থাকে, ঈশ্বরের চাহিদা পূরণের জন্য সে যদি উন্নততর পথ অবলম্বনের চেষ্টাই না করে, তাহলে এই ধরনের জ্ঞানের মূল্য কী? এটা কী বাঁশের ঝুড়ি দিয়ে জল তোলার মতো নয়—যা সম্পূর্ণভাবে নিষ্ফল? আমার বক্তব্যের মূল নির্যাস প্রবেশের সঙ্গে সম্পর্কিত; এটাই প্রধান বিষয়।
প্রবেশ চলাকালীন মানুষের জীবন সর্বদাই বিরক্তিকর, তা প্রার্থনা করা, ঈশ্বরের বাক্য ভোজন ও পান করা, বা সভার আয়োজন করার মতো একঘেয়ে আধ্যাত্মিক জীবনের উপাদান দিয়ে পরিপূর্ণ, আর তাই মানুষ সর্বদাই ভাবে যে ঈশ্বরে বিশ্বাস বিশাল কিছু আনন্দ নিয়ে আসে না। এই ধরনের আধ্যাত্মিক ক্রিয়াকলাপ সর্বদাই মানুষের আদি প্রকৃতির উপর ভিত্তি করে নির্বাহ করা হয়, যে প্রকৃতি শয়তানের দ্বারা কলুষিত হয়েছে। যদিও মানুষ কখনো কখনো পবিত্র আত্মার প্রদত্ত আলোকপ্রাপ্তি লাভ করতে পারে, কিন্তু তাদের আসল চিন্তাধারা, স্বভাব, জীবনশৈলী এবং অভ্যাস তখনও তাদের মধ্যে বদ্ধমূল থাকে, তাই তাদের প্রকৃতি অপরিবর্তিত থেকে যায়। মানুষ যে সমস্ত কুসংস্কারমূলক ক্রিয়াকলাপে ব্যস্ত থাকে, ঈশ্বর সেগুলোকেই সবচেয়ে বেশী ঘৃণা করেন, কিন্তু বহু মানুষ তবুও এই ভেবে তা ত্যাগ করতে পারে না যে এই কুসংস্কারমূলক ক্রিয়াকলাপ ঈশ্বরের জারি করা নির্দেশ, এবং তারা এমনকি আজও তা সম্পূর্ণ ভাবে পরিত্যাগ করতে পারেনি। কনের সাজসজ্জা ও বিবাহের ভোজ যা তরুণেরা আয়োজন করে; নগদ উপহার, ভোজ, এবং এরকম অন্যান্য যেসব উপায়ে আনন্দপূর্ণ উৎসবগুলো পালিত হয়; প্রাচীন নিয়মকানুন যা হস্তান্তরিত হয়ে এসেছে; মৃতব্যক্তির জন্য এবং তাদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যে সমস্ত অর্থহীন কুসংস্কারমূলক ক্রিয়াকলাপ পালিত হয়: এই সমস্তই ঈশ্বরের আরো অনেক বেশী অপছন্দের বিষয়। এমনকি উপাসনার দিনটাও (বিশ্রামবার সহ, যা ধর্মীয় জগত পালন করে) তাঁর কাছে অপছন্দের; এবং মানুষের সাথে মানুষের সামাজিক সম্পর্ক ও জাগতিক আদানপ্রদান ঈশ্বরের দ্বারা প্রভূতভাবে ঘৃণ্য ও প্রত্যাখ্যাত। এমনকি বসন্তকালীন উৎসব ও বড়দিন, যা সবার কাছে পরিচিত, তা ঈশ্বরের ফরমান নয়, একইভাবে এই সমস্ত উৎসবে ব্যবহৃত বিভিন্ন খেলনা ও সাজসজ্জার সরঞ্জাম, যেমন মন্ত্রোচ্চারণ, আতশবাজি, লন্ঠন, পবিত্র ভোজনোৎসব, বড়দিনের উপহার, বড়দিনের বিভিন্ন উৎসব, এসব তো ছেড়েই দাও—এই সমস্তই কী মানুষের মনগড়া নির্মাণ নয়? বিশ্রামবারে রুটি টুকরো করা, দ্রাক্ষারস, এবং সূক্ষ্ম বস্ত্র মানুষের মনের আরও জোরালো নির্মাণ। যে সমস্ত ঐতিহ্যবাহী উৎসবের দিন চীনদেশে জনপ্রিয়, যেমন ড্রাগন হেডস-রেইজিং দিবস, ড্রাগন বোট উৎসব, মধ্য-শরৎকালীন উৎসব, লাবা উৎসব, ও নববর্ষের দিন, এবং ধর্মীয় জগতে পালিত উৎসব যেমন ইস্টার, বাপ্তিষ্ম দিবস, বড়দিন, এইসমস্ত অযৌক্তিক উৎসব বহু মানুষের দ্বারা প্রাচীনকালে আয়োজিত ও বর্তমান পর্যন্ত হস্তান্তরিত হয়ে আসছে। মানবজাতির সমৃদ্ধ কল্পনাশক্তি এবং উদ্ভাবনী ধারণাই এগুলোকে ধারাবাহিকভাবে আজ পর্যন্ত বয়ে আসতে দিয়েছে। এগুলো আপাতভাবে ত্রুটিহীন মনে হয়, কিন্তু এগুলো আসলে মানবজাতির উপর শয়তানের কৌশল। শয়তানদের দ্বারা কোনো একটা জায়গা যত বেশী জনবহুল, এবং সেই জায়গা যত বেশী পুরানো ও পশ্চাৎপদ, সেখানকার সামন্ততান্ত্রিক প্রথাগুলো তত গভীরভাবে গেঁথে বসেছে। এই বিষয়গুলো মানুষকে শক্ত করে বেঁধে রাখে, তার বিন্দুমাত্র নড়াচড়া করার অবকাশ থাকে না। ধর্মীয় বিশ্বে পালিত উৎসবের অনেকগুলোতেই মনে হয় বিশাল মৌলিকত্ব রয়েছে এবং মনে হয় সেগুলো ঈশ্বরের কাজ পর্যন্ত পৌঁছোবার একটা সেতুবন্ধন করে, কিন্তু এগুলো আসলে শয়তানের অদৃশ্য বাঁধন, যার মাধ্যমে সে মানুষকে বেঁধে রাখে এবং ঈশ্বরকে জানতে বাধা দেয়—এগুলো সবই শয়তানের চতুর কারসাজি। আসলে, ঈশ্বরের একটা পর্যায়ের কাজ যখন শেষ হয়েছে, তখন তিনি ইতিমধ্যেই কোনো চিহ্ন না রেখে সেই সময়ের সামগ্রী এবং শৈলী ধ্বংস করে দিয়েছেন। কিন্তু “ধর্মপ্রাণ বিশ্বাসী”-রা এইসব স্পর্শযোগ্য বস্তুগত সামগ্রীকেই উপাসনা করে চলে; ইতিমধ্যে, ঈশ্বরের যা আছে সেটাকে তারা তাদের মাথার পিছনে পাঠিয়ে দেয়, তা নিয়ে আর অধ্যয়ন করে না, মনে হয় যেন তারা ঈশ্বরের প্রতি ভালোবাসায় পূর্ণ, যেখানে আসলে তারা অনেক আগেই তাঁকে ঘর থেকে ঠেলে বার করে দিয়েছে এবং শয়তানকে উপাসনার বেদীতে বসিয়ে রেখেছে। খ্রীষ্টের, ক্রুশের, ও মেরির প্রতিকৃতি, খ্রীষ্টের বাপ্তিষ্ম এবং খ্রীষ্টের শেষ নৈশভোজ—মানুষ এগুলোকে স্বর্গের প্রভু হিসেবে গভীরভাবে শ্রদ্ধা করে, সমস্ত সময় “প্রভু, স্বর্গস্থ পিতা” এই চিৎকার করতে থাকে। এগুলো সবই শুধু তামাশা নয় কি? এরকম অনেক বাক্য ও আচার-অনুষ্ঠান যা আজ পর্যন্ত মানবজাতির মধ্যে ধারাবাহিক ভাবে বয়ে চলেছে, সেগুলো ঈশ্বরের কাছে ঘৃণ্য; সেগুলো গুরুতরভাবে ঈশ্বরের এগিয়ে যাওয়ার পথ রোধ করে, এবং তাছাড়াও, মানবজাতির প্রবেশে বিশাল বাধার সৃষ্টি করে। শয়তান মানবজাতিকে যে পরিমাণে কলুষিত করেছে সে বিষয়টা সরিয়ে রাখলে, মানুষের অন্তর উইটনেস লি এর নীতি, লরেন্সের অভিজ্ঞতা, ওয়াচম্যান নি এর সমীক্ষা, এবং পৌলের কার্যের মতো বিষয় দ্বারা পরিপূর্ণ। মানুষের উপর কাজ করার জন্য ঈশ্বরের কোনো উপায়ই নেই, কারণ মানুষের মধ্যে অত্যন্ত বেশী পরিমাণে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ, আইন, বিধি, নিয়মকানুন, পদ্ধতি, এবং এইরকম বহু জিনিস রয়েছে; মানুষের সামন্ততান্ত্রিক কুসংস্কারমূলক প্রবণতার পাশাপাশি এই জিনিসগুলো মানবজাতিকে বন্দী ও গ্রাস করেছে। যেন মানুষের কল্পনা একটা আকর্ষক চলচ্চিত্র, যা এক রূপকথাকে সম্পূর্ণ রঙীনভাবে বর্ণনা করছে, যেখানে অপূর্ব জীবেরা মেঘে চড়ে রয়েছে, তা এতটাই বর্ণাঢ্য যে মানুষকে বিস্মিত ও বাকরুদ্ধ করে তুলছে। সত্যি কথা বললে, ঈশ্বর বর্তমানে প্রধানত মানুষের মনের কুসংস্কারমূলক বৈশিষ্ট্যগুলির সাথে মোকাবিলা করে তা দূরীভূত করার জন্য, এবং সম্পূর্ণভাবে তাদের মানসিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করার জন্যই এসেছেন। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মানবজাতি যে উত্তরাধিকার হস্তান্তরিত করে এসেছে তার জন্যই ঈশ্বরের কাজ আজ পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারেনি; কোনো বিশেষ মহান আধ্যাত্মিক মানুষের উত্তরাধিকার অনুসরণ না করে, বা প্রতিনিধিস্থানীয় কোনো কাজ যা ঈশ্বর অন্য কোনো যুগে করেছেন তা উত্তরাধিকারসূত্রে অনুসরণ না করে ঈশ্বর নিজেই ব্যক্তিগতভাবে এই কাজের সূচনা করেছেন ও নিজেই সম্পূর্ণ করেছেন। মানুষের এই বিষয়গুলোর কোনোটা নিয়েই চিন্তা করার কোনো প্রয়োজন নেই। বর্তমানে ঈশ্বরের কথা বলার ও কাজের ধরণ ভিন্ন, তাই মানুষ কেন তা নিয়ে নিজেকে উদ্বিগ্ন করবে? মানুষ যদি বর্তমানের স্রোতের মধ্যে আজকের পথে চলে, এদিকে তাদের তাদের “পূর্বপুরুষ”-দের উত্তরাধিকারও সাথে বয়ে নিয়ে চলে, তাহলে তারা তাদের গন্তব্যে পৌঁছতে পারবে না। ঈশ্বর মানুষের এই বিশেষ আচরণের ধরণকে তীব্রভাবে ঘৃণা করেন, ঠিক যেমন তিনি ঘৃণা করেন মানব জগতের বছর, মাস, ও দিনকে।
মানুষের স্বভাব পরিবর্তন করার শ্রেষ্ঠ উপায় হল মানুষের হৃদয়ের অন্তরতম যে অংশে গভীরভাবে বিষক্রিয়া হয়েছে তার নিরাময় করে মানুষকে তার চিন্তাভাবনা ও নৈতিকতা পরিবর্তনের সুযোগ দেওয়া। সবার প্রথমে, মানুষকে স্পষ্টভাবে প্রত্যক্ষ করতে হবে যে এইসমস্ত ধর্মীয় আচার, ধর্মীয় কার্যকলাপ, বছর এবং মাস, ও উৎসব ঈশ্বরের কাছে ঘৃণ্য। তাদের এইসমস্ত সামন্ততান্ত্রিক চিন্তাভাবনার বাঁধন থেকে মুক্তিলাভ করতে হবে এবং তাদের অন্তরে গেঁথে বসা কুসংস্কারের প্রবণতার প্রতিটা চিহ্নকে নির্মূল করতে হবে। এগুলো সবই মানবজাতির প্রবেশের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। তোমাদের অবশ্যই বুঝতে হবে ঈশ্বর কেন মানবজাতিকে নেতৃত্ব দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ জগৎ থেকে বার করে নিয়ে আসেন, আবার কেন তিনি মানবজাতিকে নীতি ও নিয়মকানুন থেকে দূরে নিয়ে যান। এটাই সেই দ্বার যার মধ্যে দিয়ে তোমরা প্রবেশ করবে, এবং যদিও এসবের সাথে তোমাদের আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার কোনো সম্পর্ক নেই, তবুও এগুলোই হল তোমাদের প্রবেশের পথে সবচেয়ে বড় বাধা, যা তোমাকে ঈশ্বরকে জানা থেকে বিরত রাখে। এগুলো একটা জাল তৈরি করে যা মানুষকে তার মধ্যে আটকে রাখে। অনেক মানুষই খুব বেশী করে বাইবেল পাঠ করে, এমনকি বাইবেলের অসংখ্য অনুচ্ছেদ স্মৃতি থেকে বলে দিতে পারে। আজ তাদের প্রবেশে, মানুষ ঈশ্বরের কাজের পরিমাপ করতে অসচেতনভাবে বাইবেলকে ব্যবহার করে, যেন ঈশ্বরের কাজের এই পর্যায়ের ভিত্তি হল বাইবেল এবং এর উৎসও হল বাইবেল। যখন ঈশ্বরের কাজ বাইবেলের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হয়, তখন মানুষজন ঈশ্বরের কাজ দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে এবং তাঁকে সদ্যপ্রাপ্ত শ্রদ্ধার নজরে দেখে; কিন্তু যখন ঈশ্বরের কাজ বাইবেলের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ হয়, তখন মানুষ উদ্বিগ্ন হয়ে বাইবেলে ঈশ্বরের কাজের ভিত্তি খুঁজে বার করতে ঘাম ঝরিয়ে ফেলে; যদি ঈশ্বরের কাজের কোনো উল্লেখ বাইবেলে না থাকে তাহলে মানুষ ঈশ্বরকে উপেক্ষা করে। বলা যায় যে, ঈশ্বরের বর্তমান কাজের বিষয় যতদূর জড়িত, মানুষ সাবধানে ও সতর্কভাবে সেটাকে গ্রহণ করে, তারা নির্বাচিত কিছু বিষয় মেনে চলে, এবং তা জানার বিষয়ে উদাসীন বোধ করে; অতীতের বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে, তারা সেগুলোর অর্ধেক অংশ ধরে রাখে এবং বাকি অংশ পরিত্যাগ করে। একে কি প্রবেশ বলা চলে? অন্যদের বইগুলোকে ধনসম্পত্তির মত আগলে রেখে, এবং সেগুলোকে রাজ্যে প্রবেশের সোনার চাবি হিসেবে বিবেচনা করে, মানুষের কাছে ঈশ্বরের আজকের দাবির প্রতি মানুষ স্রেফ কোনো উৎসাহই দেখায় না। তাছাড়াও, কিছু “বুদ্ধিমান বিশেষজ্ঞ” বামহাতে ঈশ্বরের বাক্য ধরে থাকে এবং ডানহাতে অন্যদের “শ্রেষ্ঠ-কাজ” ধরে রাখে, যেন তারা ঈশ্বরের আজকের বাক্যগুলোর ভিত্তি এই শ্রেষ্ঠ-কাজের মধ্যে খুঁজতে চায় সম্পূর্ণভাবে প্রমাণ করার জন্য যে ঈশ্বরের বাক্যগুলো সঠিক, এবং তারা এমনকি ঈশ্বরের বাক্যগুলোকে মানুষের কাছে ব্যাখ্যা করে এইসব শ্রেষ্ঠ-কাজের সাথে একত্রিত করার মাধ্যমে, যেন এইসব শ্রেষ্ঠ-কাজ কত কার্যকর। সত্যি কথা বলতে, মানবজাতির মধ্যে অনেক “বৈজ্ঞানিক গবেষক” রয়েছে যারা কখনোই আজকের সবচেয়ে নতুন বৈজ্ঞানিক কৃতিত্ব সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পোষণ করেনি, সেইসব বৈজ্ঞানিক কৃতিত্ব যেগুলোর কোনো পূর্বদৃষ্টান্ত নেই (অর্থাৎ ঈশ্বরের কাজ, ঈশ্বরের বাক্য, এবং জীবনে প্রবেশ করার পথ), তাই সব মানুষই “স্বাবলম্বী”, সকলেই তাদের বাকপটুতার সাহায্যে বিস্তৃত এলাকাজুড়ে “ধর্মপ্রচার” করছে, এবং “ঈশ্বরের মহৎ নাম” জাহির করছে। ইতিমধ্যে, তাদের নিজেদের প্রবেশ বিপন্ন হয়ে পড়ে, এবং মনে হয় তারা ঈশ্বরের চাহিদার থেকে ততটাই দূরে চলে গেছে যতটা দূরে সৃষ্টির আদিকাল থেকে এই বর্তমান মুহূর্ত। ঈশ্বরের কাজ করা কতটা সহজ? মনে হয় যে মানুষ স্থির করেই নিয়েছে যে তাদের নিজেদের অর্ধেক তারা অতীতে রেখে আসবে এবং অর্ধেক বর্তমানে নিয়ে আসবে, শয়তানকে অর্ধেক প্রদান করে ঈশ্বরের সামনে বাকী অর্ধেক উপস্থাপিত করবে, যেন তাদের বিবেকবোধকে স্বস্তি দেওয়া ও কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করার এটাই উপায়। মানুষের অন্তর্জগৎ এতটাই কপট যে সে শুধুমাত্র আগামীকাল হারাতেই ভীত নয়, গতকাল হারাতেও ভীত, শয়তানকে এবং বর্তমানের ঈশ্বরকে, মনে হয় যিনি আছেন অথচ নেই, উভয়কেই ক্ষুব্ধ করার ভয়ে গভীরভাবে ভীত। যেহেতু মানুষ তার চিন্তাভাবনা ও নৈতিকতাকে যথাযথ ভাবে অধ্যয়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে, তাই তাদের মধ্যে বিশেষভাবে বিচক্ষণতার অভাব রয়েছে, এবং তারা এটা বলতে একেবারেই অক্ষম যে বর্তমানের কাজ সত্যিই ঈশ্বরের কাজ কি না। হয়তো মানুষের সামন্ততান্ত্রিক এবং কুসংস্কারমূলক চিন্তাভাবনা এতটা গভীর বলেই তারা অনেক আগে কুসংস্কার ও সত্যকে, ঈশ্বর ও বিগ্রহকে, এগুলোর পার্থক্য নিরূপণ করার দিকে মনোযোগ না দিয়েই একই স্থানে বসিয়ে দিয়েছে, এবং মনে হয় তারা অনেক ভেবেও স্পষ্টভাবে এগুলোর পার্থক্য নির্ণয় করতে অক্ষম। এই কারণেই মানুষ তার পথে থেমে গিয়েছে এবং আর এগোতে পারেনি। এইসমস্ত সমস্যা উদ্ভূত হয় মানুষের সঠিক প্রকারের আদর্শগত শিক্ষার অভাবের জন্য, যা তাদের প্রবেশের পক্ষে বিরাট সমস্যা সৃষ্টি করে। তার ফলে, মানুষ প্রকৃত ঈশ্বরের কাজে কোনো আগ্রহ অনুভব করে না, বরং অধ্যাবসায়ের সাথে লেগে থাকে[১] মানুষের কাজে (যাদের তারা মহান মানুষ বলে বিবেচনা করে), যেন তারা সেটার দ্বারাই চিহ্নিত হয়ে গেছে। এগুলোই কি সেইসব নতুনতম বিষয়বস্তু নয় যেগুলোতে মানুষের প্রবেশ করা উচিত?
পাদটীকা:
১. “অধ্যাবসায়ের সাথে লেগে থাকে” এখানে ব্যাঙ্গাত্মকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। এই কথার মাধ্যমে ইঙ্গিত করা হয়েছে মানুষ কতটা জেদী এবং একগুঁয়ে, কীভাবে সে অপ্রচলিত জিনিস আঁকড়ে ধরে রেখেছে এবং তা ত্যাগ করতে চাইছে না।