কাজ এবং প্রবেশ (১০)
মানবজাতি যে এতদূর অগ্রগতি করেছে, তা নজিরবিহীন ঘটনা। ঈশ্বরের কাজ ও মানুষের জীবনে প্রবেশ একসাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়েছে, এবং তাই ঈশ্বরের কর্মও সর্বোৎকৃষ্ট দর্শনীয় এক ঘটনা যার কোনো তুলনা নেই। আজকের দিন পর্যন্ত মানুষের প্রবেশ এক বিস্ময়কর ঘটনা, যা মানুষ আগে কখনো কল্পনা করেনি। ঈশ্বরের কর্ম সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছে গেছে—এবং তার সাথে সাথে মানুষের “প্রবেশ”[১]-ও তার শীর্ষবিন্দু ছুঁয়ে ফেলেছে। ঈশ্বর নিজেকে যথাসম্ভব নিম্নতর স্তরে নামিয়ে এনেছেন, এবং তিনি কখনোই মানবজাতির কাছে বা এই মহাবিশ্ব ও সমস্তকিছুর কাছে প্রতিবাদ জানাননি। ইতিমধ্যে, মানুষ ঈশ্বরের মাথার উপরে দাঁড়িয়ে পড়েছে, এবং ঈশ্বরের প্রতি তাদের নিপীড়নও চরম সীমায় পৌঁছে গেছে; সমস্ত কিছুই চূড়ান্ত অবস্থায় পৌঁছে গেছে, এবং এটাই ন্যায়পরায়ণতার দিন আবির্ভূত হওয়ার উপযুক্ত সময়। কেন এখনও বিষণ্ণতা সমস্ত ভূমিকে আচ্ছন্ন করতে থাকবে, আর অন্ধকার সমস্ত মানুষকে আবৃত করতে থাকবে? বহু সহস্র বছর ধরে, এমনকি লক্ষ লক্ষ বছর ধরে ঈশ্বর পর্যবেক্ষণ করেছেন, এবং তাঁর সহিষ্ণুতা বহু আগেই চরমসীমা ছুঁয়ে ফেলেছে। তিনি মানুষের প্রতিটি পদক্ষেপে নজর রেখে চলেছেন, মানুষের অধার্মিকতা কতদিন বিশৃঙ্খলা চালিয়ে যেতে পারে তা পর্যবেক্ষণ করছেন, এবং তবুও, বহুকাল আগেই অসাড় হয়ে যাওয়া মানুষেরা কিছুই অনুভব করে না। কখনো কি কেউ ঈশ্বরের কর্ম পর্যবেক্ষণ করেছে? কে-ই বা কখনও চোখ তুলে দূরের দিকে দৃষ্টিপাত করেছে? মনোযোগ সহকারে কে-ই বা কখনও শুনেছে? সর্বশক্তিমানের হাতে কেউ কি কখনো থেকেছে? মানুষেরা সকলেই কাল্পনিক ভীতিতে জর্জরিত।[২] খড়কুটোর গাদা কোন কাজে লাগে? ঈশ্বরের অবতারকে আমৃত্যু অত্যাচার করা—এই একটা কাজই তারা করতে পারে। যদিও তারা খড়কুটোর গাদা ছাড়া কিছু নয়, কিন্তু তবুও একটা কাজ তারা “সবার চেয়ে ভালো”[৩] ভাবে করে: আমৃত্যু ঈশ্বরের ওপর অত্যাচার করা ও তারপর চিৎকার করে বলা যে “এটা মানুষের হৃদয়কে আনন্দিত করে।” কী অকাজের একটা দল! লক্ষণীয়ভাবে, মানুষের অবিরাম স্রোতের মাঝে তারা কিন্তু ঈশ্বরের প্রতিই মনোযোগ কেন্দ্রীভূত রাখে, দুর্ভেদ্য অবরোধে বৃত্তাকারে তাঁকে ঘিরে রাখে। তাদের উদ্দীপনা সর্বকালীন উত্তপ্ততর হয়ে জ্বলে উঠছে,[৪] তারা দলে দলে ঈশ্বরকে ঘিরে রেখেছে, যাতে তিনি এক ইঞ্চিও নড়তে না পারেন। নিজেদের হাতে তারা সমস্ত রকমের অস্ত্র ধারণ করে রেখেছে, এবং ঈশ্বরের প্রতি এমনভাবে দৃষ্টিপাত করছে যেন একজন শত্রুর দিকে দেখছে, তাদের দৃষ্টি ক্রোধে পূর্ণ; তারা “ঈশ্বরের সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছিঁড়ে ফেলা”-র জন্য উদগ্রীব। কী বিভ্রান্তিকর! মানুষ ও ঈশ্বর কেন এই রকম মিলনের অযোগ্য শত্রুতে পরিণত হল? এমন কি হতে পারে যে ঈশ্বর, যিনি সবচেয়ে মনোরম, তাঁর এবং মানুষের মধ্যে কোনো বিদ্বেষ রয়েছে? এমন কি হতে পারে যে ঈশ্বরের কর্ম মানুষের কোনো উপকারেই আসে না? তা কি মানুষের ক্ষতি করে? মানুষ ঈশ্বরের প্রতি অবিচল দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখে, গভীরভাবে ভীত থাকে যে তিনি মানুষের অবরোধ ভেঙে ফেলবেন, তৃতীয় স্বর্গে প্রত্যাবর্তন করবেন, এবং আরো একবার মানুষকে অন্ধকূপে নিক্ষেপ করবেন। মানুষ ঈশ্বরের বিষয়ে সতর্ক, সে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন, অস্বস্তিতে মাটির চারিদিকে এপাশ ওপাশ করে, হাতে ধরে থাকা “মেশিনগান” তাক করা থাকে মানুষের মাঝখানে থাকা ঈশ্বরের দিকে। ব্যাপারটা এমন, যেন ঈশ্বরের সামান্যতম নড়াচড়াতেও মানুষ তাঁর সমস্তকিছু নিশ্চিহ্ন করে ফেলবে—তাঁর সমস্ত শরীর এবং তিনি যা কিছু পরিধান করেন—কিছুই ছেড়ে দেবে না। মানুষ ও ঈশ্বরের সম্পর্ক সংশোধনের ঊর্ধ্বে চলে গেছে। মানুষের কাছে ঈশ্বর বোধগম্য নয়; ইতিমধ্যে, মানুষ সুচিন্তিতভাবে নিজের চোখ বন্ধ করে নির্বোধের মতো আচরণ করে, আমার অস্তিত্ব প্রত্যক্ষ করতে একেবারেই অনিচ্ছুক, এবং আমার বিচারের প্রতি ক্ষমাহীন। তাই, মানুষ যখন প্রত্যাশা করে না, তখন আমি নীরবে প্রস্থান করি, এবং কে উচ্চ ও কে নীচ তা আমি মানুষের সাথে আর তুলনা করবো না। মানবজাতি সকলের মধ্যে নিকৃষ্ট “প্রাণী”, এবং আমি তার প্রতি আর মনোযোগ দিতে চাই না। আমি বহুকাল আগেই আমার সমগ্র অনুগ্রহ সেই স্থানে ফিরিয়ে নিয়েছি যেখানে আমি শান্তিতে বসবাস করি; মানুষ যেহেতু এত অবাধ্য, তাই তার কী কারণ আছে আমার মূল্যবান অনুগ্রহের আর একটুও উপভোগ করার? যে শক্তি আমার প্রতি বিদ্বেষী, তাদের বৃথা আমার অনুগ্রহ প্রদান করতে আমি ইচ্ছুক নই। আমি বরং আমার মূল্যবান ফল কনানের সেই কৃষকদের প্রদান করবো যারা উদ্যোগী, এবং আন্তরিকভাবে আমার প্রত্যাবর্তনকে স্বাগত জানায়। আমি শুধু চাই স্বর্গ যেন অনন্তকাল স্থায়ী হয়, এবং তার চেয়েও বেশি করে, চাই মানুষ যেন কখনো বৃদ্ধ না হয়, স্বর্গ এবং মানুষ যেন চিরকাল বিশ্রামে থাকে, এবং সেই চিরসবুজ “পাইন ও সাইপ্রাস” যেন চিরকাল ঈশ্বরকে সঙ্গ দেয়, এবং একত্রে আদর্শ যুগে প্রবেশ করার ক্ষেত্রে স্বর্গের চিরসঙ্গী হয়।
আমি মানুষের সাথে বহু দিন ও রাত অতিবাহিত করেছি, মানুষের সঙ্গে একসাথে পৃথিবীতে বসবাস করেছি, এবং মানুষের থেকে কখনো আর কোনো চাহিদা জ্ঞাপন করিনি; আমি শুধু চিরকাল মানুষকে সম্মুখের পথনির্দেশ দিই, মানুষকে পথনির্দেশ দেওয়া ছাড়া আমি কিছুই করি না, এবং মানবজাতির গন্তব্যের স্বার্থে আমি অবিরত আয়োজনের কাজ নির্বাহ করি। স্বর্গস্থ পিতার ইচ্ছা কে-ই বা কখনো উপলব্ধি করেছে? স্বর্গ ও মর্ত্যের মধ্যে কে-ই বা যাতায়াত করেছে? আমি আর মানুষের “বার্ধক্য অবস্থা” তার সাথে কাটাতে চাই না, কারণ মানুষ খুবই পুরাতন-পন্থী, সে কিছুই বোঝে না; একমাত্র যা সে জানে তা হল, অন্য সমস্ত বিষয় থেকে নিজেদের নির্লিপ্ত রেখে, অন্য কোনো বিষয়ে চিন্তা না করে, আমার পরিকল্পিত ভোজন-অনুষ্ঠানে লোভীর মতো আহার করা। মানবজাতি খুবই কৃপণ, মানুষের মধ্যে কোলাহল, বিষণ্ণতা, এবং বিপদ অত্যন্ত বেশি, আর সেই কারণেই আমি অন্তিম সময়ে অর্জিত বিজয়ের মূল্যবান ফল তাদের সাথে ভাগ করে নিতে ইচ্ছুক নই। মানুষ তার নিজের সৃষ্ট উচ্চমানের আশীর্বাদ উপভোগ করুক, কারণ সে আমায় স্বাগত জানায় না—তাহলে আমি মানবজাতিকে জোর করে আনন্দিত হওয়ার ভান করতে বলবো কেন? বিশ্বের প্রতিটি কোণ উষ্ণতাবিহীন, পৃথিবীর মানচিত্র জুড়ে বসন্তের চিহ্নমাত্র নেই, কারণ জলচর প্রাণীর মতোই মানুষের মধ্যে সামান্যতম উষ্ণতাও নেই, সে যেন এক মৃতদেহ, এমনকি তার শিরার মধ্যে দিয়ে চলাচল করা রক্তও বরফশীতল, হৃদয়ে শৈত্যপ্রবাহ জাগায়। উষ্ণতা কোথায়? মানুষ অকারণেই ঈশ্বরকে ক্রুশবিদ্ধ করেছে, এবং তারপরেও সে সামান্যতম সংশয়ও অনুভব করেনি। কেউই কখনো অনুশোচনা বোধ করেনি এবং এই নির্দয় স্বৈরাচারীরা নিজেদের হৃদয়ের মধ্যে থাকা ঘৃণার অবসানের জন্য এখনও আরও একবার মনুষ্যপুত্রকে “জীবিত অবস্থায় বন্দী করা”[৫]-র এবং তাঁকে বন্দুকবাজদলের গুলির সামনে এনে ফেলার পরিকল্পনা করে চলেছে। এই বিপজ্জনক ভূমিতে আমার থেকে গিয়ে কী লাভ? আমি থেকে গেলে মানুষের জন্য শুধুমাত্র যা নিয়ে আসবো তা হল বিবাদ ও হিংসা, এবং সমস্যার কোনো অবসান হবে না, কারণ আমি মানুষকে কখনো শান্তি এনে দিতে পারিনি, দিয়েছি শুধুই যুদ্ধ। মানবজাতির অন্তিম সময় যুদ্ধের দ্বারাই পূর্ণ হতে হবে, এবং মানুষের গন্তব্যের পতনও ঘটতে হবে এই বিবাদ ও হিংসার মাঝেই। আমি যুদ্ধের “আনন্দ”-র ভাগ নিতে চাই না, আমি মানুষের রক্তক্ষয় ও বলিদানের সঙ্গী হবো না, কারণ মানুষের প্রত্যাখ্যান আমাকে “নিরাশা”-র দিকে ঠেলে দিয়েছে এবং মানুষের যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করার কোনো বাসনা আমার নেই—মানুষ নিজের হৃদয়ের সন্তুষ্টির জন্য লড়াই করুক। আমি বিশ্রাম নিতে চাই, ঘুমোতে চাই; মানবজাতির অন্তিম সময়ে প্রেতাত্মারাই তাদের সঙ্গী হোক! আমার ইচ্ছা কে-ই বা জানে? যেহেতু আমি মানুষের কাছে অভ্যর্থনা পাইনি, এবং সে আমার জন্য কখনোই অপেক্ষা করেনি, তাই আমি তাকে কেবল বিদায়ই জানাতে পারি, এবং আমি মানবজাতিকে তার গন্তব্য প্রদান করছি, আমি মানুষের কাছেই আমার সমস্ত সম্পদ ছেড়ে যাচ্ছি, মানুষের মধ্যেই আমার জীবন বপন করে যাচ্ছি, মানুষের হৃদয়ভূমিতে আমার জীবনের বীজ রোপণ করে যাচ্ছি, তার জন্য ছেড়ে যাচ্ছি চিরন্তন স্মৃতি, মানবজাতিকে দিয়ে যাচ্ছি আমার সমস্ত ভালোবাসা, এবং প্রদান করছি মানুষ আমার মধ্যে যা কিছু লালন করে, দিয়ে যাচ্ছি এক ভালোবাসার উপহার হিসাবে যে ভালোবাসা দিয়ে আমরা একে অপরের জন্য আকুল হই। আমি আশা করব যে আমরা যেন চিরকাল একে অপরকে ভালোবাসি, আমাদের বিগত কালই যেন হয় সেই সেরা জিনিস যা আমরা পরস্পরকে দিতে পারি, কারণ আমি ইতিমধ্যেই আমার সমগ্রতা মানবজাতিকে প্রদান করে ফেলেছি—তাদের অভিযোগ করার মতো আর কিছু থাকতে পারে কি? আমি ইতিমধ্যেই আমার জীবনের সামগ্রিকতা মানুষের হাতে ছেড়ে দিয়েছি, এবং একটাও কথা না বলে আমি মানবজাতির জন্য ভালোবাসার সুন্দর জমি চাষ করার জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছি; আমি কখনোই মানুষের কাছে কোনোরকম ন্যায়সঙ্গত দাবি করিনি, মানুষের আয়োজনের কাছে নতি স্বীকার করা এবং মানবজাতির জন্য আরও সুন্দর আগামী তৈরি করা ছাড়া আর কিছুই করিনি।
যদিও ঈশ্বরের কাজ সমৃদ্ধ ও প্রাচুর্যময়, তবু মানুষের প্রবেশের বিষয়টা অত্যন্ত কাঙ্ক্ষিত। মানুষ ও ঈশ্বরের যৌথ “সংস্থা”-য় প্রায় সমস্তটাই হল ঈশ্বরের কর্ম; মানুষ যতটা প্রবেশ করেছে, সেখানে তার দেখানোর মতো প্রায় কিছুই নেই। মানুষ, যে রিক্ত ও অন্ধ, সে এমনকি নিজের আয়ত্তে থাকা “প্রাচীন অস্ত্রশস্ত্রের” দ্বারা বর্তমানের ঈশ্বরের বিরুদ্ধে নিজের ক্ষমতার পরিমাপ করে। এই “আদিম বনমানুষেরা” নামমাত্রই সোজা হয়ে হাঁটতে পারে এবং তারা নিজেদের “উলঙ্গ” শরীরের জন্য কোনোরকম লজ্জা বোধ করে না। ঈশ্বরের কাজের মূল্যায়ন করার জন্য তাদের কী যোগ্যতা রয়েছে? এই চার-পেয়ে বনমানুষদের অনেকের চোখই ক্রোধে পূর্ণ হয়ে ওঠে, এবং তারা হাতে আদিম প্রস্তরের অস্ত্র নিয়ে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে নিজেদেরকে দাঁড় করায়, বনমানুষদের এমন এক প্রতিযোগিতা শুরু করার চেষ্টা করে যা পৃথিবী আগে কখনও দেখেনি, বনমানুষ ও ঈশ্বরের মধ্যে অন্তিম সময়ের এক প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে চায় যা সমগ্র ভূমি জুড়ে বিখ্যাত হয়ে উঠবে। তাছাড়াও, এই অর্ধেক সোজা হয়ে চলা আদিম বনমানুষদের মধ্যে অনেকেই আত্মতৃপ্তিতে পূর্ণ। তাদের মুখমন্ডল আবৃত করা চুলগুলো একসাথে জট পাকিয়ে রয়েছে, খুনের উদ্দেশ্যে পূর্ণ, এবং তারা তাদের সামনের পা বাড়ায়। তারা এখনও আধুনিক মানুষে সম্পূর্ণরূপে বিকশিত হতে পারেনি, তাই কখনও কখনও তারা সোজা হয়ে দাঁড়ায়, কখনো হামাগুড়ি দেয়, তাদের ঘামের ফোঁটা নিবিড়ভাবে এক গুচ্ছ শিশিরবিন্দুর মতো কপালকে ঢেকে রাখে—তাদের আগ্রহ স্বতঃসিদ্ধ। আদিম, প্রাচীনকালের বনমানুষ, তাদের সঙ্গী, চারপায়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে, তাদের চার পা ভারী ও ধীর, নামমাত্র আঘাত প্রতিরোধ করতে পারে এবং প্রত্যাঘাত করার শক্তি নেই, তারা কোনোভাবে নিজেদের শুধু সামালটুকুই দিতে পারে। চোখের একটা পলকেই—কী ঘটেছে তা দেখার আগেই—মঞ্চের “নায়ক” মাটিতে গড়িয়ে পড়ে, হাত পা শূন্যে তুলে। যে সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এত বছর ধরে মাটির উপরে ভুল ভঙ্গিমায় ছিল, হঠাৎ করে উপর-নিচে উল্টে গেছে, এবং সেই বনমানুষের আর প্রতিরোধ করার ইচ্ছা নেই। তখন থেকেই, বনমানুষদের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন যে, সে পৃথিবী থেকে মুছে গেছে—এটা সত্যিই “মর্মান্তিক”। এই প্রাচীন বনমানুষের এইরকম আকস্মিক সমাপ্তি ঘটেছিল। মানুষের এই অপরূপ জগত থেকে এত শীঘ্র তাকে বিদায় নিতে হয়েছিল কেন? সে তার সঙ্গীদের সাথে কৌশলের পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করেনি কেন? ঈশ্বরের বিরুদ্ধে ক্ষমতা পরিমাপের গোপন ব্যাপারটা না জানিয়েই এই পৃথিবীকে সে বিদায় জানিয়েছিল, কী দুঃখজনক! এত প্রবীণ এক বনমানুষের নিজের বংশধরদের “প্রাচীন কলা ও সংস্কৃতির” বিষয়ে অবহিত না করেই নিঃশব্দে মারা যাওয়া কতই না অবিবেচনার ব্যাপার। কাছের লোকদের ডেকে তাদের ভালবাসার কথা বলার মতো সময়ও তার ছিল না, পাথরের ফলকেও সে কোনও বার্তা রেখে যায়নি, সে স্বর্গসূর্যকে উপলব্ধি করেনি, এবং নিজের অকথ্য কষ্টের কথাও কিছু বলে যেতে পারেনি। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার সময়, চোখ বন্ধ করার আগে সে তার বংশধরদের তার মৃত্যুপথযাত্রী দেহের পাশে ডেকে বলার সুযোগ পায়নি যে, “ঈশ্বরকে চ্যালেঞ্জ জানাতে মঞ্চে আরোহণ কোরো না”, তার চারটে শক্ত হয়ে যাওয়া অঙ্গ উপরের দিকে রয়ে গেছে, যেন আকাশমুখী গাছের ডাল। মনে হবে সে যেন এক অসন্তোষজনক মৃত্যুবরণ করেছে…। হঠাতই মঞ্চের নিচ থেকে এক হাসির রোল ভেসে আসে; অর্ধেক সোজা হয়ে চলা বনমানুষদের একজন তার পাশে এসে দাঁড়ায়, তার হাতে ধরা একটা “পাথরের মুগুর”, হরিণ বা অন্যান্য বন্য পশু যা সেই বৃদ্ধ বনমানুষের চেয়ে বেশি উন্নত তাকে শিকার করার জন্য, সে মঞ্চে লাফিয়ে ওঠে, তার মনে একটা সুচিন্তিত পরিকল্পনা রয়েছে।[৬] যেন সে বুদ্ধিমানের মতো কোনো কাজ করেছে। তার পাথরের মুগুরের “ক্ষমতা” ব্যবহার করে সে “তিন মিনিট”-এর জন্য সোজা হয়ে দাঁড়াতে সক্ষম হয়। এই তৃতীয় “পা”-এর “শক্তি” কতই না প্রচণ্ড! তা সেই দশাসই, অপরিচ্ছন্ন, অর্ধেক সোজা হয়ে দাঁড়ানো নির্বোধ বনমানুষকে তিন মিনিট দাঁড় করিয়ে রাখতে পেরেছে—এই সম্মানীয়[৭] বৃদ্ধ বনমানুষ যে প্রভাবশালী, এতে অবাক হওয়ার মতো কিছু নেই। নিশ্চিতভাবেই, এই প্রাচীন পাথরের অস্ত্র “তার মর্যাদার মান পূরণ করে”: তাতে রয়েছে একটা ছুরি ধরার হাতল, প্রান্তভাগ এবং অগ্রভাগ, খালি প্রান্তভাগে উজ্জ্বলতার ঘাটতিটাই এটার একমাত্র খুঁত—কী দুঃখজনক। সেই প্রাচীনকালের “ছোট্ট নায়কের” দিকে আবার তাকাও, যে মঞ্চে দাঁড়িয়ে নিচের লোকজনের দিকে অবজ্ঞাপূর্ণ দৃষ্টিতে দেখছে, যেন তারা নপুংসক নিকৃষ্ট, আর সে হল সাহসী নায়ক। মঞ্চের সামনে যারা রয়েছে, তাদের সে গোপনে অন্তর থেকে ঘৃণা করে। “দেশ এখন সমস্যায় রয়েছে এবং আমরা প্রত্যেকেই তার জন্য দায়ী, তোমরা কেন লজ্জায় পিছিয়ে রয়েছ? এমন কি হতে পারে যে দেশ এমন বিপর্যয়ের সম্মুখীন দেখেও তোমরা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত হবে না? এই দেশ এখন বিপর্যয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছে—কেন তোমরা এমন হতে পারছ না যারা সর্বপ্রথমে উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং সবার শেষে উপভোগ করে? দেশ শেষ হয়ে যাচ্ছে, তার লোকজন ধ্বংসের মুখে পতিত হচ্ছে, সেটা তুমি কীভাবে দাঁড়িয়ে দেখতে পারো? তোমরা কি পরাধীন জাতি হওয়ার লজ্জা সহ্য করতে ইচ্ছুক? অকর্মণ্যের দল!” এটা ভাবার সাথে সাথে মঞ্চের সামনে ঝগড়া শুরু হয়ে গেল এবং তার চোখ আরও বেশি উত্তেজিত হয়ে উঠল, যেন অগ্নিশিখা বর্ষণ[৮] করতে চলেছে। সে যুদ্ধের আগেই ঈশ্বরকে ব্যর্থ দেখতে উৎসুক, মানুষকে খুশি করার জন্য ঈশ্বরকে মৃত্যুদণ্ড দিতে মরিয়া। সে প্রায় জানেই না যে তার পাথরের অস্ত্র হয়তো প্রাপ্য খ্যাতির যোগ্য, কিন্তু সেটা কখনোই ঈশ্বরের বিরোধিতা করতে পারে না। আত্মরক্ষার সময় পাওয়ার আগেই, শুয়ে পড়ে তারপর আবার নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সময় পাওয়ার আগেই, সে আগুপিছু দুলে ওঠে, দুচোখের দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে যায়। সে তার পুরোনো পূর্বপুরুষের কাছেই গড়িয়ে পড়ে যায়, আর ওঠে না; প্রাচীন বনমানুষটাকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরে, সে আর চিৎকার করে না, তার নিকৃষ্টতা স্বীকার করে নেয়, আর প্রতিরোধ করার কোনো ইচ্ছা নেই তার। ওই দুই হতভাগ্য বনমানুষ মঞ্চের সামনেই মারা যায়। কতই না দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা যে, মানবজাতির পূর্বপুরুষ, যারা আজ পর্যন্ত বেঁচে ছিল, তারা ন্যায়পরায়ণতার সূর্যের আবির্ভাবের দিনেই অজ্ঞতায় মৃত্যুবরণ করল! কী ভীষণ মূর্খতা যে তারা এমন এক মহান আশীর্বাদ চলে যেতে দিল—যে হাজার হাজার বছর ধরে অপেক্ষমান বনমানুষেরা তাদের আশীর্বাদের দিনেই শয়তানের রাজার সাথে “উপভোগ” করার জন্য সেই আশীর্বাদ মৃতস্থানে নিয়ে গেছে! এই আশীর্বাদ জীবিত বিশ্বে তাদের পুত্র কন্যাদের সাথে উপভোগ করার জন্য রেখে দেয়নি কেন? তারা শুধু নিজেদের সমস্যা ডেকে আনছে! কত বড় অপচয় যে তারা সামান্য মর্যাদা, খ্যাতি এবং সম্মানের জন্য নিহত হওয়ার দুর্ভাগ্য ভোগ করে, নরকের দরজা খোলায় প্রথম হয়ে সেখানকার সন্তান হওয়ার জন্য ঠেলাঠেলি করে। এত মূল্য পরিশোধ একেবারেই অপ্রয়োজনীয়। কতই না দুঃখজনক ঘটনা যে, এমন প্রাচীন পূর্বপুরুষ, যারা “জাতীয় চেতনায় পূর্ণ” ছিল, তারা “নিজেদের প্রতি এত কঠোর ও অন্যদের প্রতি এত সহিষ্ণু” হতে পারে, তারা নিজেদের নরকে আটক করে রাখছে, এবং সেই নপুংসক নিকৃষ্টদের বাইরে রেখে দিয়েছে। এরকম “জনগণের প্রতিনিধি” কোথায় পাওয়া যাবে? “তাদের সন্তানদের হিতার্থে” এবং “আগামী প্রজন্মের শান্তিময় জীবনের” জন্য তারা ঈশ্বরকে হস্তক্ষেপ করতে দেয় না, এবং তাই তারা তাদের নিজেদের জীবনের প্রতিও কোনো মনোযোগ দেয় না। বিনা বাধায় তারা “জাতীয় উদ্দেশ্যের” জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে, কোনো শব্দ ছাড়াই মৃতস্থানে প্রবেশ করে। এমন জাতীয়তাবাদ কোথায় পাওয়া যাবে? ঈশ্বরের সাথে যুদ্ধ করার সময় তারা মৃত্যুকে ভয় করে না, রক্তপাতকেও ভয় করে না, আগামীর চিন্তা তো প্রায় করেই না। তারা কেবল যুদ্ধক্ষেত্রে যায়। কী দুঃখের বিষয় যে তারা তাদের “ভক্তির উদ্যম”-এর জন্য শুধু যা পায় তা হল চিরন্তন অনুশোচনা এবং নরকের চির-জ্বলন্ত শিখা দ্বারা গ্রাস হওয়া!
কী আকর্ষক! ঈশ্বরের অবতার কেন সর্বদা মানুষের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত ও নিন্দিত হয়েছেন? ঈশ্বরের অবতার সম্পর্কে কখনোই মানুষের কোনো উপলব্ধি হয়নি কেন? এমন কি হতে পারে যে ঈশ্বর ভুল সময়ে এসেছেন? ভুল স্থানে এসেছেন? ঈশ্বর মানুষের কাছ থেকে “অনুমোদনের স্বাক্ষর” না নিয়ে একাকী কর্ম সম্পাদন করেছেন বলেই কি এমন হয়েছে? ঈশ্বর মানুষের অনুমতি ছাড়াই নিজের মনস্থির করে নিয়েছিলেন বলেই কি এমন হয়েছে? সত্য ঘটনা থেকে জানা যায়, ঈশ্বর আগেই বিজ্ঞপ্তি জারি করেছিলেন। দেহধারণ করে ঈশ্বর কোনো ভুল কাজ করেননি—তাঁকে কি মানুষের কাছ থেকে সম্মতি চাইতে হবে? তার থেকেও বড় কথা, ঈশ্বর বহুকাল আগেই মানুষকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, হয়ত মানুষ তা ভুলে গিয়েছে। তাদের দোষ দেওয়া যায় না, কারণ মানুষ বহু আগে থেকেই শয়তানের দ্বারা এতোই ভ্রষ্ট হয়েছে যে স্বর্গের নিচে কী হয়ে চলেছে সে বিষয়েই তার কোনো উপলব্ধি নেই, আধ্যাত্মিক জগতের কথা তো দূরে থাক! কী লজ্জার বিষয় যে মানুষের পূর্বপুরুষ, সেই বনমানুষ, মঞ্চেই মৃত্যুবরণ করেছিল, কিন্তু এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই: স্বর্গ ও পৃথিবী কখনোই সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না, আর সেই বনমানুষ যার মন প্রস্তরনির্মিত সে কীভাবে উপলব্ধি করতে পারবে যে ঈশ্বর আবার দেহধারণ করতে পারেন? কী দুঃখজনক যে এমন একজন “বৃদ্ধ” যে “তার ষাটতম বর্ষে আছে” সে ঈশ্বরের আবির্ভাবের দিনেই মারা গেল। এত বড় আশীর্বাদের আবির্ভাবের সময় সে পৃথিবীকে আশীর্বাদহীন রেখে চলে গেল, তা কি আশ্চর্যজনক নয়? ঈশ্বরের অবতার সমস্ত ধর্ম ও পরিবৃত্তে একটা শক্তিশালী ঢেউ প্রেরণ করেছেন, ধর্মীয় বৃত্তের মূল শৃঙ্খলাকে সেটা “বিশৃঙ্খলার মধ্যে নিক্ষেপ করেছে”, এবং যারা ঈশ্বরের আবির্ভাবের অপেক্ষায় আকুল, তাদের সকলের হৃদয়কে নাড়া দিয়েছে। কে প্রশংসা করছে না? কে ঈশ্বরকে দেখার জন্য আকুল নয়? ঈশ্বর ব্যক্তিগতভাবে মানুষের মাঝে বহু বছর রয়েছেন, তা সত্ত্বেও মানুষ তা কখনো উপলব্ধি করেনি। আজ, ঈশ্বর স্বয়ং আবির্ভূত হয়েছেন এবং জনসমক্ষে তাঁর পরিচয় তুলে ধরেছেন—তা মানুষের হৃদয়ে আনন্দ বয়ে আনবে না, তা কি হতে পারে? ঈশ্বর একবার মানুষের সাথে সুখ-দুঃখ ভাগ করে নিয়েছিলেন, আর আজ তিনি মানবজাতির সাথে একত্রিত হয়েছেন, এবং সময়ের সাথে সাথে তাঁর অভিজ্ঞতার কাহিনী ভাগ করে নিচ্ছেন। যিহুদিয়া থেকে তাঁর প্রস্থানের পরে মানুষ আর তাঁর কোনো চিহ্নও খুঁজে পায়নি। তারা আরো একবার ঈশ্বরের সাথে সাক্ষাতের জন্য আকুল, কিন্তু তারা জানে না যে আজ আবার তাঁর সাথে তাদের সাক্ষাৎ হয়েছে এবং তারা তাঁর সাথে পুনর্মিলিত হয়েছে। এটা বিগত সময়ের চিন্তাভাবনাকে নাড়া না দিয়ে পারে? দুই হাজার বছর আগে, আজকের দিনে, ইহুদিদের বংশধর শিমোন বারজোনা পরিত্রাতা যীশুকে প্রত্যক্ষ করেছিল, তাঁর সাথে একই টেবিলে ভোজন করেছিল এবং বহু বছর তাঁকে অনুসরণ করার পরে হৃদয়ের মধ্যে তাঁর প্রতি গভীর অনুরাগ অনুভব করেছিল: সে নিজের হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকেই তাঁকে ভালবেসেছিল; প্রভু যীশুকে গভীরভাবে ভালবেসেছিল। এই সোনালী চুলের শিশু, যে শীতল পশুখাদ্যের পাত্রের মধ্যে জন্মেছিল, সে-ই যে ঈশ্বরের অবতারের প্রথম প্রতিমূর্তি, তা ইহুদি জনগণের জানা ছিল না। তারা সকলেই ভেবেছিল যে তিনি তাদেরই মতো, কেউই তাঁকে আলাদা হিসাবে ভাবেনি—এই সাধারণ, সামান্য যীশুকে লোকেরা কীভাবে চিনতে পারতো? ইহুদি জনগণ তাঁকে সেই সময়কার ইহুদি পুত্র বলে মনে করেছিল। কেউই তাঁকে একজন মনোরম ঈশ্বর হিসাবে দেখেনি, এবং মানুষ তাঁর কাছে অন্ধ দাবি ছাড়া আর কিছুই করেনি, চেয়েছিল যে তিনি তাদের প্রচুর ও অগাধ অনুগ্রহ, শান্তি এবং আনন্দ প্রদান করুন। তারা শুধু জানত যে তিনি একজন কোটিপতি মানুষেরই মতো, মানুষের কাম্য সমস্তকিছুই তাঁর কাছে ছিল। তথাপি মানুষ কখনই তাঁকে প্রিয়তম বলে গণ্য করেনি; তৎকালীন মানুষ তাঁকে ভালোবাসেনি, শুধু তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিল এবং তাঁর কাছে অযৌক্তিক দাবি করেছিল। তিনি কখনোই প্রতিরোধ করেননি, বরং মানুষ তাঁকে না জানলেও তিনি তাদের ক্রমাগত অনুগ্রহ প্রদান করেছিলেন। তিনি নীরবে মানুষকে উষ্ণতা, ভালবাসা এবং করুণা দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করেননি, এবং তাঁর সাথে তিনি মানুষকে অনুশীলনের নতুন উপায় প্রদান করেছিলেন, মানুষকে বিধানের বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার প্রতি নির্দেশিত করেছিলেন। মানুষ তাঁকে ভালোবাসেনি, শুধু তাঁকে ঈর্ষা করেছে এবং তাঁর ব্যতিক্রমী প্রতিভাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। মানবজাতির মধ্যে অবতীর্ণ হওয়ার সময় মনোরম ত্রাণকর্তা যীশু কতই না অপমানের যন্ত্রণা ভোগ করেছিলেন, তা অন্ধ মানবজাতি কীভাবে জানতে পারতো? কেউই তাঁর বেদনা বিবেচনা করেনি, পিতা ঈশ্বরের প্রতি তাঁর ভালোবাসার বিষয়ে কেউ জানতো না, কেউই তাঁর একাকীত্বর কথা উপলব্ধি করেনি; এমনকি মরিয়ম যদিও তাঁর জন্মদাত্রী মা, তার পক্ষেই বা কীভাবে করুণাময় প্রভু যীশুর হৃদয়ের চিন্তাভাবনা জানা সম্ভব ছিল? মনুষ্যপুত্রের সহ্য করা অকথ্য যন্ত্রণার কথা কে-ই বা জানতো? তাঁর কাছে অনুরোধ করার পরে, সেই সময়কার মানুষ তাঁকে শীতলভাবে মনের পেছনে ঠাঁই দিয়েছিল এবং তাঁকে পরিত্যাগ করেছিল। তারপর তিনি দিনের পর দিন, বছরের পর বছর রাস্তায় ঘুরে বেরিয়েছেন, তাঁর তেত্রিশ বছরের জীবনে তিনি বহু বছর ভেসে বেরিয়েছিলেন, যে বছরগুলো ছিল একাধারে দীর্ঘ ও সংক্ষিপ্ত। যখন মানুষের তাঁকে প্রয়োজন হতো, তারা তাঁকে হাসিমুখে নিজের বাড়িতে আমন্ত্রিত করত, তাঁর কাছ থেকে দাবি আদায়ের চেষ্টা করত—আর তিনি তাদের চাহিদা পূরণ করার অনতিবিলম্বেই তারা তাঁকে বাড়ি থেকে দূর করে দিত। মানুষ তাঁর মুখনিঃসৃত সরবরাহ ভোজন করেছিল, তাঁর রক্ত পান করেছিল, তাদের প্রতি তাঁর প্রদত্ত আশীর্বাদ উপভোগ করেছিল, তা সত্ত্বেও তারা তাঁর বিরোধিতা করেছিল, কারণ তারা কখনোই জানতে পারেনি কে তাদের জীবন প্রদান করেছে। অবশেষে, তারা তাঁকে ক্রুশবিদ্ধ করেছিল, তবু তাতেও তিনি একটা শব্দও করেননি। এমনকি আজও তিনি নীরব রয়েছেন। মানুষ তাঁর দেহ ভক্ষণ করছে, তাঁর রক্তপান করছে, তিনি তাদের জন্য যে খাদ্য প্রস্তুত করছেন সেগুলোও ভোজন করছে, তাদের জন্য যে পথ উন্মুক্ত করেছিলেন তাতে চলেছে, তবু তারা এখনও তাঁকে প্রত্যাখ্যান করতে চায়; যে ঈশ্বর তাদের জীবন দিয়েছেন তাঁর সাথে তারা আসলে শত্রুর মতো আচরণ করে, এবং পরিবর্তে তাদের সাথে স্বর্গস্থ পিতার মতো আচরণ করে যারা ঠিক তাদেরই মতো দাস। এতে তারা কি সুচিন্তিতভাবে তাঁর বিরোধিতা করছে না? যীশু কীভাবে ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন? তোমরা কি জানো? যিহুদা, যে ছিল তাঁর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ, যে তাঁকে ভোজন করেছিল, পান করেছিল, ও উপভোগ করেছিল, যীশু কি তারই বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হননি? যিহুদা কি এইজন্য যীশুর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি যে যীশু একজন নগণ্য, সাধারণ শিক্ষক ছাড়া আর কিছুই ছিলেন না? মানুষ যদি সত্যিই উপলব্ধি করতে পারত যে যীশু অসাধারণ, এবং এমন একজন যিনি স্বর্গ থেকে আগত, তাহলে তারা কীভাবে তাঁকে জীবন্ত অবস্থায় চব্বিশ ঘণ্টা ক্রুশে বিদ্ধ করে রাখতে পারত, যতক্ষণ না তাঁর শেষ নিঃশ্বাসটুকুও শরীর থেকে বেরিয়ে যায়? ঈশ্বরকে কে চিনতে পারে? মানুষ অতৃপ্ত লোভের সাথে ঈশ্বরকে ভোগ করা ছাড়া আর কিছুই করে না, কিন্তু তারা কখনোই তাঁকে জানেনি। তাদের এক ইঞ্চি দেওয়া হয়েছিল, তারা সেখানে এক মাইল নিয়েছে, এবং তারা “যীশু”-কে তাদের আদেশ, তাদের হুকুমের প্রতি সম্পূর্ণ বাধ্য করেছে। কে-ই বা কখনো এই মনুষ্যপুত্র, যার মাথা রাখার জায়গা নেই, তাঁর প্রতি কোনো করুণা দেখিয়েছে? কে-ই বা তাঁর সাথে বাহিনীতে যোগ দেওয়ার কথা ভেবেছে যাতে পিতা ঈশ্বরের অর্পিত দায়িত্ব পালন করা যায়? কে-ই বা কখনো তাঁর জন্য কিছু চিন্তা ব্যয় করেছে? কে-ই বা কখনো তাঁর অসুবিধার প্রতি সহানুভূতিশীল হয়েছে? মানুষ তাঁর প্রতি কণামাত্র ভালোবাসা না রেখেই তাঁকে এদিক ওদিক টানাটানি করেছে; মানুষ জানে না তাদের জীবন ও আলো কোথা থেকে এসেছে এবং তারা শুধুমাত্র গোপনে পরিকল্পনা করে দুই হাজার বছর আগেকার “যীশু”-কে কীভাবে আরো একবার ক্রুশবিদ্ধ করা যায়, যিনি মানুষের মাঝে যন্ত্রণা ভোগ করেছেন। “যীশু” কি সত্যিই এই ধরনের ঘৃণার অনুপ্রেরণা হতে পারেন? তিনি যা কিছু করেছেন, সেসব কি বহু আগেই বিস্মৃত হয়েছে? হাজার হাজার বছর ধরে পুঞ্জীভূত হওয়া ঘৃণা অবশেষে বহিঃপ্রকাশিত হবে। তোমরা হলে ইহুদিদেরই নামান্তর! “যীশু” কখন তোমাদের প্রতি শত্রুতাপরায়ণ ছিলেন, যে তোমরা তাঁকে এতখানি ঘৃণা করো? তিনি এত কিছু করেছেন, এত কিছু বলেছেন—সেগুলোর কোনোটাই কি তোমাদের উপকারের নয়? তিনি তাঁর জীবন তোমাদের প্রতি সঁপে দিয়েছেন, বিনিময়ে কিছুই চাননি, তিনি তোমাদেরকে নিজের সামগ্রিকতা প্রদান করেছেন—তোমরা কি এখনও সত্যিই তাঁকে জীবন্ত খেয়ে ফেলতে চাও? তিনি কোনোকিছু আগলে না রেখে তোমাদেরকে তাঁর সমস্ত কিছু দিয়েছেন, কখনো জাগতিক গরিমা মহিমা উপভোগ করেননি, মানুষের উষ্ণতা, ভালোবাসা, বা অনুগ্রহ উপভোগ করেননি। মানুষ তাঁর প্রতি কতই না নীচ, পৃথিবীতে তিনি কখনোই প্রাচুর্য উপভোগ করেননি, তিনি তাঁর আন্তরিক, আবেগপ্রবণ হৃদয়ের সমস্তটুকুই মানুষের প্রতি নিবেদিত করেছেন, তিনি তাঁর সামগ্রিকতা মানবজাতির প্রতি নিবেদিত করেছেন—এবং কেউই কি কখনো তাঁকে উষ্ণতা প্রদান করেছে? কেউই কি কখনো তাঁকে স্বস্তি দিয়েছে? মানুষ তাঁর উপরে সমস্ত চাপের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে, সমস্ত দুর্ভাগ্য তাঁকে হস্তান্তর করেছে, মানুষের মাঝে সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক অভিজ্ঞতা তাঁর উপরে চাপিয়ে দিয়েছে, সমস্ত রকমের অন্যায়ের জন্য সে তাঁকে দায়ী করেছে, এবং তিনি নীরবে তা মেনে নিয়েছেন। তিনি কি কখনো কারো কাছে প্রতিবাদ জানিয়েছেন? তিনি কি কখনো কারো কাছে সামান্য প্রতিদান চেয়েছেন? কেউ কি কখনো তাঁর প্রতি কোনো সহানুভূতি দেখিয়েছে? স্বাভাবিক মানুষ হিসাবে, তোমাদের মধ্যে কে সুন্দর শৈশব পায়নি? কে রঙিন যৌবন পায়নি? প্রিয়জনের উষ্ণতা কার কাছে নেই? আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুদের ভালোবাসা বিহীন কে আছে? অন্যের সম্মান না পেয়ে কে থেকেছে? উষ্ণ পরিবারবিহীন কে আছে? অন্তরঙ্গ মানুষদের সাহচর্যের আরাম ছাড়া কে আছে? এবং এগুলোর একটাও কি তিনি কখনও উপভোগ করেছেন? কে-ই বা কখনো তাঁকে একটু উষ্ণতা দিয়েছে? কে-ই বা তাঁকে সামান্য স্বাচ্ছন্দ্য দিয়েছে? কে-ই বা তাঁর প্রতি সামান্য মানবিক নৈতিকতা দেখিয়েছে? কে-ই বা কখনো তাঁর প্রতি সহনশীল হয়েছে? কঠিন সময়ে কে-ই বা কখনো তাঁর সাথে থেকেছে? কে কখনো তাঁর সাথে কঠিন জীবন পার করেছে? মানুষ কোনোদিনই তাঁর প্রতি চাহিদার বোঝা লাঘব করেনি; সে শুধু নিঃসঙ্কোচে তাঁর প্রতি দাবি জানিয়ে গেছে, যেন এই মনুষ্যজগতে এসে তাঁকে মানুষের বলদ বা ঘোড়া হয়ে, মানুষের বন্দী হয়েই থাকতে হবে, এবং মানুষকে তাঁর সবকিছুই দিয়ে দিতে হবে; নাহলে মানুষ কখনোই তাঁকে ক্ষমা করবে না, কখনো তাঁর সাথে সহজ হবে না, কখনো তাঁকে ঈশ্বর বলে ডাকবে না, এবং কখনো তাঁকে উচ্চ মর্যাদায় আসীন করবে না। ঈশ্বরের প্রতি আচরণের ক্ষেত্রে মানুষ অত্যন্ত কঠোর, যেন ঈশ্বরকে মৃত্যু পর্যন্ত আক্রমণ করাই তার কাজ, কেবল তাঁর মৃত্যুর পরেই সে ঈশ্বরের প্রতি তার দাবি শিথিল করবে; অন্যথায় মানুষ ঈশ্বরের প্রতি তার দাবির মানদণ্ড কখনোই নামাবে না। এই ধরনের মানুষ ঈশ্বরের দ্বারা ঘৃণিত হবে না তা কী করে হতে পারে? এটাই কি বর্তমানের দুঃখজনক বিষয় নয়? মানুষের বিবেক কোথাও দেখা যায় না। মানুষ বলতে থাকে যে সে ঈশ্বরের ভালোবাসা পরিশোধ করে দেবে, কিন্তু আসলে সে ঈশ্বরের ব্যবচ্ছেদ করে এবং আমৃত্যু তাঁর উপর অত্যাচার করে। এটা কি ঈশ্বরের প্রতি তার বিশ্বাসের “গোপন কৌশল” নয়, যা তার পূর্বপুরুষদের প্রদত্ত? এমন কোনো স্থান নেই যেখানে “ইহুদি”-দের দেখা মেলে না, এবং আজও তারা একই কাজ করে, তারা এখনও ঈশ্বরের বিরোধিতার একই কাজ সম্পাদন করে, এবং তারপরেও বিশ্বাস করে যে তারা ঈশ্বরকে উচ্চে স্থাপন করছে। মানুষের নিজের চোখ ঈশ্বরকে কীভাবে জানতে পারে? মানুষ, যে দেহে জীবনযাপন করে, সে কীভাবে ঈশ্বরকে আত্মার কাছ থেকে আগত ঈশ্বরের অবতার বলে মনে করতে পারে? মানুষের মধ্যে কে-ই বা তাঁকে জানতে পারে? মানুষের মধ্যে সত্য কোথায়? প্রকৃত ধার্মিকতা কোথায়? ঈশ্বরের মনোভাব কে উপলব্ধি করতে সক্ষম? কে স্বর্গের ঈশ্বরের সাথে প্রতিযোগিতা করতে পারে? আশ্চর্যের কিছু নেই যে তিনি যখন মানুষের মাঝে অবতীর্ণ হয়েছেন, কেউই তাঁকে চিনতে পারেনি, এবং তিনি প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। ঈশ্বরের অস্তিত্ব মানুষ কীভাবে সহ্য করতে পারে? সে কীভাবে আলোকে অনুমতি দিতে পারে পৃথিবী থেকে অন্ধকার দূর করার? এগুলো সবই কি মানুষের সম্মানীয় ভক্তি নয়? এটা কি মানুষের ধার্মিক প্রবেশ নয়? আর ঈশ্বরের কর্ম কি মানুষের প্রবেশকে কেন্দ্র করেই নয়? আমি কামনা করি তোমরা ঈশ্বরের কর্মকে মানুষের প্রবেশের সাথে সম্মিলিত করো, মানুষ ও ঈশ্বরের মধ্যে ভালো সম্পর্ক স্থাপন করো, এবং মানুষের যে কর্তব্য পালন করা উচিত তা তোমাদের যথাসাধ্য সামর্থ্য অনুযায়ী পালন করো। এইভাবেই, ঈশ্বরের কর্ম ক্রমশঃ সমাপ্তিতে এসে পৌঁছবে, যার উপসংহার হবে তাঁর গৌরব অর্জনের মধ্যে দিয়ে!
পাদটীকা:
১. “মানুষের ‘প্রবেশ’” বলতে এখানে মানুষের অবাধ্য আচরণকে বোঝানো হয়েছে। জীবনে প্রবেশ, যা একটা ইতিবাচক বিষয়, এখানে সেটার উল্লেখ করা হয়নি, বরং এই শব্দগুলো এখানে খারাপ বা নেতিবাচক আচরণ ও কাজ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। বৃহত্তর অর্থে এটা মানুষের সেই সমস্ত কাজকেই বোঝাচ্ছে যা ঈশ্বরের বিরুদ্ধে।
২. “কাল্পনিক ভীতিতে জর্জরিত” কথাটা এখানে মনুষ্যত্বের বিপথে পরিচালিত জীবনকে ব্যঙ্গ করার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়েছে। এটা মানবজাতির জীবনের কুৎসিত অবস্থাকে বোঝাচ্ছে, যেখানে মানুষ প্রেতাত্মার সাথে একত্রে বাস করে।
৩. “সবার চেয়ে ভালো” ব্যঙ্গ করে বলা হয়েছে।
৪. “তাদের উদ্দীপনা সর্বকালীন উত্তপ্ততর হয়ে জ্বলে উঠছে” কথাটা ব্যঙ্গ করে বলা হয়েছে, এবং এটা মানুষের কুৎসিত অবস্থার কথা উল্লেখ করছে।
৫. “জীবিত অবস্থায় বন্দী করা” বলতে মানুষের হিংস্র ও ঘৃণ্য আচরণকে বোঝানো হয়েছে। মানুষ নৃশংস এবং ঈশ্বরের প্রতি সামান্যতমও ক্ষমাশীল নয়, এবং তাঁর কাছ থেকে তারা অযৌক্তিক দাবি করে।
৬. “তার মনে একটা সুচিন্তিত পরিকল্পনা রয়েছে” ব্যঙ্গ করে বলা হয়েছে, এবং ইঙ্গিত করা হয়েছে যে মানুষ নিজেদের জানে না এবং নিজের প্রকৃত উচ্চতার প্রতি অজ্ঞ। এটা একটা অবমাননাকর বিবৃতি।
৭. “সম্মানীয়” ব্যঙ্গ করে বলা হয়েছে।
৮. “বর্ষণ” বলতে মানুষের কুৎসিত অবস্থার কথা বোঝানো হয়েছে, যখন তারা ঈশ্বরের দ্বারা পরাজিত হলে ক্রোধে জ্বলে ওঠে। তারা ঈশ্বরকে কতখানি প্রতিরোধ করে, সেটাই এখানে উল্লেখ করা হয়েছে।