অধ্যায় ৩৯
ঈশ্বরের বাক্যকে ছাড়িয়ে আমাদের জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিষয়বস্তুগুলি নিয়ে অল্প কিছু আলাপ-আলোচনা করা যাক, যাতে আমাদের জীবন আরো বেশি প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে, এবং আমাদের কাছে ঈশ্বরের যে প্রত্যাশা, তা যাতে আমরা পূরণ করতে পারি। সুনির্দিষ্ট করে, আজকের দিবস—যা প্রকার অনুসারে প্রত্যেক মানুষকে শ্রেণীবিভাজন এবং শাস্তিদানের কাল—এই দিনটির আবির্ভাবের পর, বৃহত্তর চিত্রটির উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করা ও “সমষ্টিগত স্বার্থের” বিষয়ে মনোনিবেশ করা আরো বেশি করে প্রয়োজন। এ-ই হল ঈশ্বরের ইচ্ছা, এবং সকল মানুষের এমনটিই অর্জনীয়। স্বর্গস্থ ঈশ্বরের ইচ্ছাপূরণের জন্য কীভাবে আমরা নিজেদের উৎসর্গ না করে থাকতে পারি? ঈশ্বর “সকল প্রকারের মানুষের জন্য ক্রমাঙ্ক ধার্য করেন, প্রত্যেক ধরনের মানুষের উপর ভিন্ন ভিন্ন মান-সূচক সংখ্যা আরোপ করেন, যাতে তাদের পূর্বপুরুষরা তাদেরকে পথ দেখিয়ে তাদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারে,” যা প্রতিপন্ন করে যে, মানুষ প্রকার অনুযায়ী শ্রেণীবিভক্ত হয়েছে, আর তার ফলে, সকল প্রকারের মানুষ তাদের স্বরূপ প্রকাশ করছে। সেই অর্থে, ন্যায্যতই বলা যায় যে, মানুষ তাদের পিতৃপুরুষদের প্রতি অনুগত, ঈশ্বরের প্রতি নয়। কিন্তু, তাদের পিতৃপুরুষদের নির্দেশমাফিক, সকল মানুষ ঈশ্বরের সেবাতেও নিয়োজিত রয়েছে, যা হল ঈশ্বরের কার্যের বিস্ময়কারিতা। সকল বস্তুই ঈশ্বরের সেবায় ব্রতী, এবং শয়তান মানুষকে ব্যাহত করলেও, ঈশ্বর তাঁর সেবার জন্য “স্থানীয় সম্পদ”-এর সদ্ব্যবহার করার এই সুযোগকে কাজে লাগান। মানুষ অবশ্য বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারে না। ঈশ্বর যেমন বলেছেন, “এইভাবে, একই সঙ্গে আমি শ্রম বিভাজন করে দিই, এবং প্রচেষ্টা বণ্টন করে দিই। এ হল আমার পরিকল্পনার অংশ, এবং কোনো মানুষের দ্বারা তা বিঘ্নিত হতে পারে না।” ঈশ্বরের দ্বারা যাকিছু নির্ধারিত হয়, এবং যাকিছু তিনি সম্পন্ন করতে চান, তা যতক্ষণ না তিনি নিষ্পন্ন করেন, ততক্ষণ মানুষ তা দেখতে পায় না। কেবল ঈশ্বরের কার্য সম্পূর্ণ হওয়ার পরই তারা তা দেখতে পায়; যদি না দেখে, তবে তারা অন্ধ, তারা কিছুই দেখতে পায় না।
আজ, গির্জাগুলির মধ্যে ঈশ্বরের নতুন কার্য আছে। সকলকিছুকে তিনি প্রাকৃতিক গতিপথ অনুসরণ করতে বাধ্য করান, সম্যক অর্থে মানুষের স্বাভাবিক ক্রিয়াকর্মকে কার্যকর করেন। ঈশ্বর যেমন বলেছেন, “যাকিছু আছে, তার সকলকিছুকে আমি নিয়ন্ত্রণ করি, সমুদয় বস্তুর মধ্যে যাবতীয়কিছুকে আমি আদেশ করি, যাকিছু রয়েছে সেসকলকে আমি প্রাকৃতিক গতিপথ অনুসরণ করতে ও প্রকৃতির নির্দেশের কাছে সমর্পণ করতে বাধ্য করি।” “প্রাকৃতিক গতিপথ অনুসরণ করা”-র ক্ষেত্রে কোন বুদ্ধিদীপ্ত অন্তর্দৃষ্টি তোমাদের রয়েছে, তা আমার জানা নেই, তাই এই বিষয়ে আলোচনা করা যাক। বিষয়টাকে আমি যেভাবে দেখি, তা হল: যেহেতু তাদের পিতৃপুরুষরা তাদেরকে ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যায়, সেহেতু সকল প্রকারের মানুষকে এগিয়ে এসে “কর্ম সম্পাদন” করতে হবে। এবং তারা প্রাকৃতিক গতিধারা অনুসরণ করছে বলে, তাদের আদি ক্রিয়াকর্মকে কার্যকর করতে, তাদের মধ্যে যা সহজাত তা সেই নিয়মিত নকশা অনুসারে তাদেরকে পবিত্র আত্মার পথনির্দেশ অনুসরণ করানোর উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়। পবিত্র আত্মার কার্য নির্বাহ হয় প্রতিটি মানুষের আভ্যন্তরীন অবস্থা অনুযায়ী; যথাযথভাবে বললে, এ হল “ঈশ্বরের দ্বারা সকল বস্তুর নিপুণ পরিচালন যাতে সেগুলি তাঁর সেবা করে,” এরপর একে প্রকৃতির গতিপথ অনুসরণ করার বিষয়টির সাথে সম্বন্ধযুক্ত করা হয়। যদিও একজন মানুষের মধ্যে শয়তানোচিত উপাদানসমূহ রয়েছে, কিন্তু ঈশ্বর তা কাজে লাগাবেন, মানুষের অভ্যন্তরে সহজাতভাবে বিদ্যমান ভিত্তির সাথে পবিত্র আত্মার কার্যকে সংযুক্ত করবেন, এইভাবে ঈশ্বরকে সেবাদানের পক্ষে মানুষকে পর্যাপ্ত করে তুলবেন। “প্রকৃতির গতিপথ অনুসরণ করা” বিষয়ে শুধু এটুকুই আমি বলছি—তোমাদের হয়তো উৎকৃষ্টতর কোনো প্রস্তাবন থাকতে পারে। তোমরা মূল্যবান কোনো প্রসঙ্গ সরবরাহ করতে পারো বলে আমি আশা রাখি। তোমরা কী বলো? প্রকৃতির গতিপথ অনুসরণ করার বিষয়ে সহযোগিতা করতে তোমরা কি ইচ্ছুক? তোমরা কি ঈশ্বরের সঙ্গে কার্যকে ভাগ করে নিতে ইচ্ছুক? কীভাবে তা অর্জন করা যায়, সে বিষয়ে কখনো কি তোমরা ভেবেছো? আমি আশা রাখি যে, মানুষ ঈশ্বরের ইচ্ছাকে উপলব্ধি করতে সক্ষম, এবং, সার্বজনীন আদর্শের স্বার্থে ঈশ্বরকে সন্তুষ্ট করার বিষয়ে তারা অনন্যমনা হতে পারে, এবং রাজ্যের পথে একত্রে অগ্রসর হতে পারে। অপ্রয়োজনীয় পূর্বধারণা উত্থাপিত করার কী প্রয়োজন? আজ পর্যন্ত কার অস্তিত্ব ঈশ্বরের নিমিত্তই হয় নি? এবং বিষয়টি যেহেতু এমনই, তাহলে দুঃখ, শোক ও দীর্ঘশ্বাস ফেলার কী প্রয়োজন? এতে কারো কোনো উপকার হবে না। মানুষের সমগ্র জীবন ঈশ্বরের করপুটে ন্যস্ত, এবং ঈশ্বরের সম্মুখে তাদের সংকল্প না থাকলে, এই রিক্ত মনুষ্যলোকে কে-ই বা অনর্থক বেঁচে থাকতে চাইবে? কী লাভ তাতে? শশব্যস্ত হয়ে পৃথিবীতে এসে এবং পুনরায় ব্যতিব্যস্ত ভাবে প্রস্থান করে, তারা যদি ঈশ্বরের জন্য কিছুই না করে, তাহলে কি তাদের গোটা জীবনটা অপব্যয়িত হয়ে যেতো না? এমনকি যদি ঈশ্বর তোমার ক্রিয়াকলাপকে উল্লেখযোগ্য হিসাবে গণ্য না-ও করেন, তবু তুমি কি তোমার মৃত্যুর মুহূর্তে একটা পরিতৃপ্তির হাসি হাসবে না? তোমার ইতিবাচক অগ্রগতির অন্বেষণ করা উচিৎ, নেতিবাচক পশ্চাদ্গমনের নয়—এ-ই কি শ্রেয়তর অনুশীলন নয়? তোমার কাজকর্ম যদি পূর্ণত ঈশ্বরকে সন্তুষ্ট করার স্বার্থে হয়, তাহলে তুমি নেতিবাচক বা পশ্চাদ্গামী হবে না। তারা নিজেরা তা উপলব্ধি না করলেও, যেহেতু মানুষের হৃদয়ে যেহেতু সর্বদাই দুর্জ্ঞেয় বিষয়াদি রয়েছে, সেহেতু তাদের মুখ মেঘাচ্ছন্ন আকাশের মতো, যার ফলে তাদের অজান্তেই তাদের মুখমণ্ডলে অনেক “পরিখা” দৃষ্টিগোচর হয়, যেন ভূভাগ বিদীর্ণ হয়ে সেগুলি সৃষ্ট হয়েছে। যেন ভূপৃষ্ঠ সঞ্চালিত হচ্ছে, যার ফলে মানুষের উপলব্ধি ব্যতিরেকেই “টিলা” ও “খাদ” স্থানপরিবর্তন করছে। এমনটা বলে আমি মানুষকে ব্যঙ্গ করছি না, বরং “ভৌগোলিক জ্ঞান”-এর বিষয়ে বলছি।
ঈশ্বর সকল মানুষকে শাস্তির দিকে চালিত করলেও, এই বিষয়ে তিনি কোনো বক্তব্য রাখেন না। পরিবর্তে, তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে এই বিষয়টিকে এড়িয়ে গিয়ে প্রসঙ্গান্তরে উপনীত হন, এক অর্থে তাঁর এমনটা করার হেতু হল তাঁর কার্য, এবং আরেক অর্থে, তাঁর এমনটা করার উদ্দেশ্য হল এই পর্যায়ের কাজকে অনতিবিলম্বে সম্পূর্ণ করা। যেহেতু কার্যের এই পর্যায়টিকে সম্পন্ন করার ঈশ্বরের যে লক্ষ্য তা অনেক পূর্বেই অর্জিত হয়েছে, তাই এই বিষয়ে অধিকতর আলাপচারিতা নিষ্প্রয়োজন। বর্তমানে, ঈশ্বরের কার্যের পদ্ধতিগুলির কতখানি তোমরা দেখেছো আমি তা জানি না; আমার চেতনায়, আমি সর্বদা অনুভব করি যে, ঈশ্বরের কার্য আর আগের মতো সুস্পষ্টভাবে বিভিন্ন পর্যায় ও সময়কালে বিভক্ত নয়। পরিবর্তে, প্রতিটি দিবসের আগমন ঘটে সেটির নিজস্ব কর্মপন্থা সহ, প্রায় প্রতি তিন থেকে পাঁচ দিনে পরিবর্তন সাধিত হয়, এবং এমনকি পাঁচ দিনের মধ্যেও, ঈশ্বরের করা কার্যে দুটি ভিন্ন প্রকারের উপাদান থাকতে পারে। এর থেকে ঈশ্বরের কার্যের গতিবেগের সম্বন্ধে ধারণা পাওয়া যায়; মানুষের প্রতিক্রিয়া দেখানোর ও নিকটে গিয়ে সম্যকভাবে দেখার মতো সময় পাওয়ার পূর্বেই, চিহ্নমাত্র না রেখে ঈশ্বর অদৃশ্য হয়ে যান। এইভাবে, মানুষের কাছে ঈশ্বর সদাসর্বদা উপলব্ধির অতীত থেকে যান, এবং এর থেকেই পবিত্র আত্মার কার্যের অননুভবনীয়তার উৎপত্তি। ঈশ্বর কেন সর্বদা “আর তাই আমি মানুষকে পরিত্যাগ করলাম”—এই জাতীয় শব্দবন্ধনী উচ্চারণ করেন? এই বাক্যগুলির প্রতি মানুষ কিছুটা মনোযোগ দিয়ে থাকতেও পারে, কিন্তু বাক্যগুলির অর্থ তারা অনুধাবন করে না। বর্তমানে পরিস্থিতিটি কেমন, তোমরা কি তা অনুধাবন করো? এতে আশ্চর্যের কিছু নেই যে, পবিত্র আত্মার উপস্থিতির বিষয়ে মানুষের কোনো উপলব্ধি নেই। নিয়ত তারা আবছা চাঁদের আলোয় ঈশ্বরের সন্ধান করেছে—এমনটা সম্পূর্ণ সত্য—এবং ঈশ্বর যেন ইচ্ছা করেই মানুষের সাথে কৌতুক করছেন, সমস্ত মানুষের মস্তিষ্ককে স্ফীত করে তুলছেন, যাতে তারা স্থূলবুদ্ধি ও দিকভ্রান্ত বোধ করে। তারা প্রায় জানেই না যে, তারা কী করছে; যেন তারা স্বপ্ন দেখছে, এবং, জাগ্রত হওয়ার পর, তারা জানবেও না যে কী ঘটে গিয়েছে। মানুষকে বিমূঢ় করে তোলার জন্য ঈশ্বরের কিছু সাধারণ বাক্যই যথেষ্ট। তাই, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই, যে ঈশ্বর বলেছেন, “আজ, পরিমার্জিত হয়ে ওঠার জন্য সকল মানুষকে আমি ‘বৃহৎ অগ্নিকুণ্ডে’ নিক্ষেপ করি। মানুষ যখন আগুনে দগ্ধ হয়, ঊর্ধ্বে দাঁড়িয়ে আমি তাদের ঘনিষ্ঠভাবে অবলোকন করি, এবং, বহ্নিশিখার দহন-তাড়নায় মানুষ প্রকৃত সত্য নিবেদন করে।” ঈশ্বরের সদাপরিবর্তনশীল বাক্যের মাঝে উদ্ভ্রান্ত মানুষ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে; বস্তুত, ঈশ্বর যেমন বলেছেন, শাস্তি বহুপূর্বেই শুরু হয়েছে, এবং তারা তা উপলব্ধি করেনি বলে, ঈশ্বর যখন সুস্পষ্টভাবে তা বলেন, একমাত্র তখনই তারা সেবিষয়ে অবগত হয়, কেবল ঈশ্বর তাদের বলার পরেই তারা মনোযোগ দেয়। বলা যায় যে, ঈশ্বরের কার্য এই পর্যায় পর্যন্ত সম্পন্ন হয়ে যাওয়ার পরে সবেমাত্র এখন মানুষ শাস্তিকে খুঁটিয়ে নিরীক্ষা করতে শুরু করেছে। বিষয়টা ঠিক মানুষ যখন পারমানবিক বোমার বিষয়ে অবহিত হয়েছিল তার মতো—কিন্তু যেহেতু সময় আসেনি, মানুষ কোনো গুরুত্বও দেয় নি; কেবল কেউ একজন যখন একটা বোমা বানাতে শুরু করলো, তখনই মানুষ মনোযোগ দিতে আরম্ভ করলো। কেবল যখন পারমানবিক বোমার বিষয়টা প্রকাশ্যে এলো, তখনই মানুষ এর সম্পর্কে আরো উপলব্ধি করলো। কেবল ঈশ্বর যখন বলেন যে মানুষকে তিনি অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করবেন, তখনই মানুষ কিছুটা সচেতন হয়। ঈশ্বর যদি কথা না বলতেন, তাহলে কেউ জানতেও পারতো না—তাই নয় কি? সেই কারণেই ঈশ্বর বলেছেন, “মানুষ তাদের অজ্ঞাতসারেই অগ্নিকুণ্ডে প্রবেশ করে, যেন তাদের কোনো রজ্জু দ্বারা আকর্ষণ করা হয়েছে, যেন তারা অসাড় হয়ে পড়েছে।” বিষয়টি বিশ্লেষণ করে দেখাই যাক না: মানুষ কখন সত্য নিবেদন করে, ঈশ্বর যখন বলেন যে শাস্তি আরম্ভ হয়ে গিয়েছে—তখন, নাকি তার আগেই? এর থেকে পরিদৃষ্ট হতে পারে যে, ঈশ্বর শাস্তির প্রসঙ্গে কিছু উচ্চারণের পূর্বেই মানুষ অপরাধ স্বীকার করতে শুরু করেছিল, এতে প্রমানিত হয় যে, ঈশ্বর এবিষয়ে বক্তব্য রাখার আগেই শাস্তি শুরু হয়ে গিয়েছিল—এমনটা কি সত্যি নয়?