অধ্যায় ৩৮
মানবজাতির সহজাত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলি, অর্থাৎ মানবজাতির প্রকৃত স্বরূপ বিবেচনা করে, আজ অবধি চালিয়ে যেতে সক্ষম হওয়াটা যথার্থই সহজসাধ্য হয়নি, এবং শুধুমাত্র এর মাধ্যমেই ঈশ্বরের মহান ক্ষমতা সত্যই প্রতীয়মান হয়ে ওঠে। দেহের উপাদান, এবং মানুষ যে আজ অবধি অতিকায় লাল ড্রাগনের দ্বারা ভ্রষ্ট হয়েছে এই বাস্তব সত্যের কথা বিবেচনা করলে, ঈশ্বরের আত্মার পথনির্দেশনা ব্যতীত আর কীভাবেই বা সে বর্তমান কাল অবধি দণ্ডায়মান রইতে সক্ষম হতো? মানুষ ঈশ্বরের সম্মুখে আসার অযোগ্য, কিন্তু তাঁর ব্যবস্থাপনার খাতিরে এবং তাঁর মহান কার্যকে সত্ত্বর ফলপ্রসূ করে তুলতে, ঈশ্বর মানবজাতিকে ভালোবাসেন। সত্যি বলতে, মানবজাতির প্রতি ঈশ্বরের প্রেম এমনই যে কোনো মানুষ তার জীবৎকালে কখনো তা পরিশোধ করতে পারতো না। হয়তো কিছু মানুষ আছে যারা তাদের জীবন উৎসর্গ করে ঈশ্বরের অনুগ্রহ পরিশোধ করার ইচ্ছা পোষণ করে, কিন্তু আমি তোমায় বলি: মানুষ ঈশ্বরের সম্মুখে মৃত্যুবরণ করার অনুপযুক্ত, এবং সেহেতু তার মৃত্যু নিরর্থক হবে। এর কারণ, ঈশ্বরের কাছে, কোনো মানুষের মৃত্যু এমনকি উল্লেখনীয়ও নয়, কানাকড়ি মূল্যও নেই, ভূতলে কোনো পিপীলিকার মৃত্যুর মতো। মানুষকে আমি নিজেদের উপর খুব বেশি মূল্য আরোপ না করার, এবং ঈশ্বরের জন্য মৃত্যুবরণ করা তাই পর্বতের মতো বিপুল গুরুত্ব বহন করে এমন চিন্তা না করার পরামর্শ দিই। বস্তুত, কোনো মানুষের মৃত্যু পালকের মতোই লঘু, উল্লেখের যোগ্য নয়। যতোই হোক, মানবদেহ প্রকৃতির দ্বারাই মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত, এবং সেই কারণেই ধরাধামে পরিশেষে কায়িক দেহের অবশ্যই সমাপ্তি ঘটবে। এ এক প্রকৃত সত্য, যা কেউই অস্বীকার করতে পারে না। এ এক “প্রকৃতির বিধান” যা আমি সার্বিক মানবীয় অভিজ্ঞতা থেকে আহরণ করি, এবং সেকারণেই ঈশ্বর মানুষের পরিণামকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন, অথচ কেউই তা প্রণিধান করেনি। তুমি কি উপলব্ধি করো? এতে আশ্চর্যের কিছু নেই যে ঈশ্বর বলেন, “মানুষের আনুগত্যহীনতাকে আমি ঘৃণা করি। কেন করি, তা জানি না; মনে হয় মানুষকে আমি যেন আদি থেকেই ঘৃণা করেছি, তা সত্ত্বেও তার প্রতি গভীর সমবেদনাও অনুভব করি। এইভাবে আমার প্রতি মানুষের সততই দ্বিবিধ মনোভাব ছিল—কারণ মানুষকে আমি ভালোবাসি, এবং মানুষকে আমি ঘৃণাও করি।”
তাঁর উপস্থিতি বা আবির্ভাবের কারণে কোনজন ঈশ্বরের বন্দনা করে না? এক্ষণে, মনে হয় আমি বুঝি মানুষের অভ্যন্তরীন অশুদ্ধতা ও অন্যায়পরায়ণতা সম্পূর্ণরূপে বিস্মৃত হয়েছি। মানবজাতির নিজের নৈতিকতা বিষয়ে ঔদ্ধত্য, নিজেকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দান, আনুগত্যহীনতা, বিরুদ্ধাচরণ, এবং তাদের সকল বিদ্রোহী মনোভাব গ্রহণ করে এর সমস্তকিছু আমি আমার মনের পশ্চাদ্দেশে ঠেলে দিই, বিস্মৃত হই। মানবজাতির প্রকৃতির এই দৃষ্টান্তগুলির দরুন ঈশ্বর অপ্রতিভ নন। যেহেতু আমিও ঈশ্বরের মতোই “একই পীড়ার অংশভোগী”, তাই আমিও নিজেকে এই বিপাক থেকে মুক্ত করি, অন্যথায় আমি মানুষের দ্বারা আরো সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বো। এ সমস্ত জ্বালাতনের মধ্যে যাওয়ার দরকারটা কী? মানুষ যেহেতু আমার সঙ্গে ঈশ্বরের পরিবারে যোগদানে অনিচ্ছুক, তাহলে আমার শক্তি প্রয়োগ করে কীভাবে তাদের বাধ্য করবো? মানুষের প্রতি দমনমূলক কোনোকিছু আমি করি না, এবং যেহেতু আমি ঈশ্বরের পরিবারে জন্ম নিয়েছিলাম, সেহেতু এতে আশ্চর্যের কিছু নেই যে, মানুষ ও আমি সততই বিসদৃশ। এটিই মানুষকে তার সাম্প্রতিক শোচনীয় পরাভূত অবস্থার দিকে চালিত করেছে। কিন্তু এখনো আমি মানুষের দুর্বলতাগুলি থেকে পর্যাপ্ত দূরত্ব বজায় রেখে চলি; এছাড়া আমার আর কী-ই বা বিকল্প রয়েছে? এটি কি এই কারণেই নয় যে আমি ক্ষমতাহীন? এতে আশ্চর্যান্বিত হওয়ার কিছু নেই যে ঈশ্বর মানবজাতির “কার্য একক” থেকে “অবসর” নিতে চান, এবং তদুপরি “অবসরভাতা” দাবি করেন। আমি যখন কোনো মানুষের পরিপ্রেক্ষিত থেকে বাক্যোচ্চারণ করি, মানুষ তখন শোনে না, কিন্তু যখন এমনকি আমি ঈশ্বরের পরিপ্রেক্ষিত থেকে বক্তব্য রাখি, তখনও কি মানুষ তা অমান্য করা থেকে কখনো বিরত হয়েছে? সম্ভবত সে দিবস সমাগত হবে যখন ঈশ্বর সহসা মানবজাতির “কার্য একক” থেকে “অবসর” নেবেন, এবং যখন সেদিন আসবে, তখন ঈশ্বরের বাক্য হয়ে উঠবে তীব্রতর। আজ, হয়তো আমার কারণেই ঈশ্বর এভাবে বাক্যোচ্চারণ করেন, এবং সেই দিনটি যদি আসে, ঈশ্বর তখন আমার মতন শান্তভাবে ও ধৈর্যসহকারে “কিণ্ডারগার্টেনের শিশুদের গল্প শোনাবেন” না। হয়তো আমার বাক্যগুলি ঠিক সুপ্রযুক্ত নয়, কিন্তু ঈশ্বর শুধুমাত্র ঈশ্বরের অবতারের খাতিরেই মানুষের উপর তাঁর কব্জা কিছুটা আলগা করতে ইচ্ছুক; নচেৎ, ভবিতব্য ধারণাতীত রকমের ভয়াবহ হতো। ঠিক যেমনটি ঈশ্বর বলেছিলেন, “একদা মানুষের উপর আমার আয়ত্তি আমি কিছু পরিমাণ শিথিল করেছিলাম, তাদের দৈহিক বাসনাদি অবাধে চরিতার্থ করার অনুমোদন দিয়েছিলাম—এবং এই কারণেই তারা এক নিয়ন্ত্রণহীন, লাগামছাড়া ধরনের আচরণ করার স্পর্ধা করেছিল, যার থেকে প্রতিপন্ন হয় যে প্রকৃতপ্রস্তাবে তারা আমায় ভালোবাসে না, কারণ তারা সকলেই দেহের মধ্যে জীবনযাপন করছে।” এখানে ঈশ্বর কেন “তাদের বাসনাদি চরিতার্থ করা” এবং “দেহের মধ্যে জীবনযাপন”-এর কথা বলেন? সত্যি কথা বলতে, আমার ব্যাখ্যা ব্যতিরেকেই মানুষ স্বাভাবিকভাবেই এজাতীয় বাক্যগুলি অনুধাবন করবে। সম্ভবত এমন কিছু মানুষ রয়েছে যারা বলবে তারা বুঝতে পারেনি, এবং আমি একে অভিহিত করি ইতিপূর্বে উত্তর জানা সত্ত্বেও প্রশ্ন করার, ভান করার, এক দৃষ্টান্ত হিসাবে । কয়েকটি বিষয় স্মরণ করিয়ে দিই: ঈশ্বর কেন বলেন, “মানুষের কাছে আমি শুধু চাই যে আমার সঙ্গে সে সহযোগিতা করুক”? ঈশ্বর কেন এ-ও বলেন যে মানবপ্রকৃতি দুষ্পরিবর্তনীয়? মনুষ্যপ্রকৃতিকে ঈশ্বর কেন ঘৃণা করেন? মনুষ্যপ্রকৃতির উপাদানগুলি ঠিক কী? মানবপ্রকৃতির বহির্ভূত বিষয়গুলিই বা কী? এই প্রশ্নগুলি নিয়ে ভাবনাচিন্তা করেছে এমন কেউ কি আছে? সম্ভবত মানুষের কাছে এ এক নতুন বিষয়, তবু আমি মানুষকে এগুলির উপর যথাযথ বিবেচনা প্রয়োগ করতে অনুরোধ করি, অন্যথায় মানুষ অনুক্ষণ “মানবপ্রকৃতি দুষ্পরিবর্তনীয়” ধরনের বাক্যবন্ধের দ্বারা ঈশ্বরকে কুপিত করবে। এইভাবে তাঁর বিরুদ্ধে গিয়ে কোন উপকার সাধিত হয়? অন্তিমে, তা কি শুধু সমস্যা ডেকে আনা নয়? পরিণামটি কি প্রস্তরখণ্ডে ডিম্ব নিক্ষেপণের অনুরূপ হবে না?
যে সকল পরীক্ষা ও প্রলোভনের মধ্য দিয়ে মানুষকে নিয়ে যাওয়া হয় তা প্রকৃতপক্ষে সেই পাঠসমূহ, মানুষ যার শিক্ষালাভ করুক বলে ঈশ্বর চান। ঈশ্বরের অভিপ্রায় অনুযায়ী, মানুষ এগুলি অর্জনে সক্ষম, এমনকি এর জন্য যদি তাকে তার ভালোবাসার বস্তুটি বিসর্জন করতে হয় তাহলেও, কিন্তু, যেহেতু মানুষ সততই নিজেকে ভালোবাসে, সেহেতু ঈশ্বরের সঙ্গে যথাযথ সহযোগিতা করতে সে ব্যর্থ হয়। মানুষের কাছ থেকে ঈশ্বর বেশি কিছু চান না। মানুষের তিনি যাকিছু চান তা সহজেই ও আনন্দসহকারে অর্জনসাধ্য; আসলে বিষয়টি হল মানুষ কষ্টভোগ করতে অনিচ্ছুক। ঠিক যেমন, সন্তান হিসাবে, কেউ নিজ পিতামাতার যত্ন নেওয়ার জন্য মিতব্যয়ী জীবনযাপন ও সাশ্রয়ের দ্বারা সে তার কর্তব্য পালন করতে পারে। তবু সে আশঙ্কা করে যে হয়তো সে যথেষ্ট ভালো খাওয়াদাওয়ায় অসমর্থ হবে, কিংবা তার পোশাকপরিচ্ছদ নিতান্তই সাদামাটা হবে, তাই, কোনো না কোনো কারণে, পিতামাতার স্নেহময় তত্ত্বাবধানের দরুন তাদের কাছে যে ঋণে সে ঋণী তা সে সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়, যেন-বা যতদিন না সন্তানটি বিপুল ধনদৌলতের অধিকারী হয় ততদিন তাদের দেখাশুনার কাজটি স্থগিত চলে। এর থেকে আমি বুঝতে পারি যে মানুষের অন্তরে তাদের পিতামাতার জন্য কোনো সন্তানোচিত ভালোবাসা নেই—তারা সকলেই অসন্তানসুলভ অপত্য। আমার উক্তিটি হয়তো অত্যধিক মাত্রায় চরম, কিন্তু বাস্তব সত্যের মুখোমুখি হয়ে অসার বাক্য উচ্চারণে আমি অপারগ। আত্মপরিতুষ্টির খাতিরে ঈশ্বর-প্রতিরোধের ক্ষেত্রে “অন্যদের সমকক্ষ হয়ে উঠতে” আমি অক্ষম। ধরাধামে কেউই এক সন্তানোচিত হৃদয়ের অধিকারী নয় বলেই ঈশ্বর বলেছিলেন, “স্বর্গলোকে, শয়তান আমার প্রতিপক্ষ; ধরিত্রীলোকে, মানুষ আমার শত্রু। স্বর্গ ও মর্ত্যের সম্মিলনের কারণে, তাদের সকলকেই আমি, নবম মাত্রার জ্ঞাতিত্ব পর্যন্ত, দোষী সাব্যস্ত করি।” শয়তান ঈশ্বরের এক শত্রু; ঈশ্বরের এমন উক্তির কারণ হল, তাঁর অকুণ্ঠ সহায়তা ও সদাশয়তার বিনিময়ে শয়তান ঈশ্বরকে কিছুই দেয় না, বরং “উজান স্রোতে দাঁড় বায়”, এবং তা করার সূত্রে, ঈশ্বরের প্রতি সন্তানোচিত নিষ্ঠা প্রদর্শনের কর্তব্য পালন করে না। মানুষও কি এমনতরোই নয়? স্বীয় “পিতামাতা”-র প্রতি তারা কোনো সন্তানোচিত শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে না, এবং “পিতামাতা”-র সস্নেহ প্রযত্নের ঋণ তারা কখনোই পরিশোধ করে না। তা পর্যাপ্তরূপে প্রতিপন্ন করে যে, পৃথিবীর মানুষ স্বর্গস্থ শয়তানের জ্ঞাতিবর্গ। ঈশ্বর-বিরোধিতায় মানুষ ও শয়তান অভিন্নহৃদয় তথা সমভাবাপন্ন, অতএব এতে আশ্চর্যান্বিত হওয়ার কিছু নেই যে, ঈশ্বর তাদের নবম মাত্রার জ্ঞাতিত্ব পর্যন্ত অপরাধী সাব্যস্ত করবেন এবং কাউকেই মার্জনা করবেন না। অতীতে, মানুষকে পরিচালনার নিমিত্ত স্বর্গে ঈশ্বরের বশংবদ ভৃত্য ছিল, কিন্তু সে মান্য করেনি, পরিবর্তে নিজের মেজাজ ও বিদ্রোহীসুলভ মানসিকতাকে চরিতার্থ করেছিল। বিদ্রোহী মানুষও কি একই রাস্তায় হাঁটছে না? “লাগামগুলি” ঈশ্বর যতই আঁটসাঁট করুন না কেন, মানুষ কিছুতেই বিচলিত হবে না এবং নিজেদের গতিপথের মোড় ফেরাতে অসমর্থ হবে। আমার দৃষ্টিতে, মানুষ যদি এভাবে চালিয়ে যায়, তাহলে তারা নিজেদের বিনাশের কারণ হবে। এখন সম্ভবত তুমি ঈশ্বরের এই বাক্যগুলির প্রকৃত অর্থ উপলব্ধি করতে পারো: “পুরাতন প্রকৃতির সাথে নিজেদের দীর্ঘস্থায়ী বন্ধন ছেদনে মানুষ অপারগ।” বহুবার ঈশ্বর মানুষকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন: “মানুষের অবাধ্যতার কারণে আমি তাকে পরিত্যাগ করি।” ঈশ্বর বারংবার এমন বাক্য বলেন কেন? ঈশ্বর কি প্রকৃতই এতখানি হৃদয়হীন হতে পারেন? ঈশ্বর কেন এমন বাক্যও উচ্চারণ করেন যে, “আমি মনুষ্য প্রজাতির অন্তর্গত কেউ নই”? এতগুলি অলস দিবসের অবকাশে, এমন কেউ কি রয়েছে যে এই বিশদ প্রসঙ্গগুলির ব্যাপারে সতর্ক বিচারবিবেচনা প্রয়োগ করেছে? মানবজাতিকে আমি সনির্বন্ধ প্রবর্তনা দিই যাতে আরো প্রাণশক্তি সহকারে তারা ঈশ্বরের বাক্যগুলির উপর মনোনিবেশ করে এবং সেগুলির প্রতি দায়সারা মনোভাব পোষণ না করে, তা যদি করো তবে তোমার, বা অন্যের, কোনো উপকার সাধিত হবে না। যেকথা বলার প্রয়োজন নেই তা না বলা, এবং যে বিষয়ে ভাবনাচিন্তার দরকার নেই তা নিয়ে চিন্তা না করাই সবচেয়ে শ্রেয়। সেটিই কি সহজতর হবে না? এহেন জীবনচর্চায় কোন সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে? মর্ত্যলোকে ঈশ্বর তাঁর কার্যের সমাপ্তি ঘোষণার পূর্বে, কেউ তার “গতি” স্তব্ধ করবে না; কেউই তার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পাবে না। এখনো সময় হয়নি; ঈশ্বরের এক পথপ্রদর্শকের বা অগ্রদূতের ভূমিকা পালনের বিষয়ে পূর্বানুমান কোরো না। আমার মনে হয় স্তব্ধ হওয়ার বা অগ্রগমন স্থগিত করার উপযুক্ত সময় এখনো আসেনি—তোমার কী মনে হয়?
ঈশ্বর মানুষকে শাস্তির মাঝে নিয়ে আসেন, এবং তিনি তাদের এক মৃত্যুময় আবহাওয়ার মাঝে এনে হাজির করেন, কিন্তু, বিপরীতক্রমে, ধরাধামে মানুষকে দিয়ে ঈশ্বর কী করাতে চান? নিশ্চিতভাবেই, মানুষের উদ্দেশ্য নয় ঈশ্বরের গৃহের কোনো আলমারির ভূমিকা পালন করা—এমন এক বস্তু যা ভক্ষণ বা পরিধান করা যায় না, শুধু তাকিয়ে দেখা যায়। তা-ই যদি হতো, তাহলে দেহরূপে মানুষকে এত বেশি কষ্টভোগ করানোর জন্য এত রকমের জটিল প্রক্রিয়া প্রয়োগের দরকার কী ছিল? ঈশ্বর বলেন, “আমি প্রহরা দিয়ে মানুষকে ‘প্রাণদণ্ডের ময়দান’-এ নিয়ে যাই, কারণ মানুষের অপরাধ আমার শাস্তিপ্রাপ্তির যোগ্যতা অর্জনের পক্ষে পর্যাপ্ত।” এই সময়ে ঈশ্বর কি মানুষকে নিজেনিজে প্রাণদণ্ডের ময়দানে হেঁটে যেতে দেন? কেউ কেন “করুণাভিক্ষা করে” না? তাহলে, মানুষের কীভাবে সহযোগিতা করা উচিত? রায়দানকালে ঈশ্বর যেভাবে আবেগের বশবর্তী না হয়ে আচরণ করেন, মানুষও কি সত্যিই তা করতে সক্ষম? এই বাক্যসমূহের কার্যকারিতা মূলত নির্ভর করে মানুষের কার্যকলাপের উপর। কোনো পিতা যখন তার উপার্জিত অর্থ ঘরে নিয়ে আসে, তখন মাতা যদি কীভাবে তার সাথে সহযোগিতা করতে হয় বা কীভাবে সংসার পরিচালনা করতে হয় তা না জানে, তাহলে বাড়িটির পরিস্থিতি কেমন দাঁড়াবে? বর্তমানে গির্জার অবস্থার দিকে লক্ষ্য করো: দলনেতা হিসাবে তোমাদের কেমন অনুভব হয়? নিজেদের ব্যক্তিগত চিন্তাভাবনাগুলি আলোচনার জন্য তোমরা এক বৈঠকের আয়োজনও করতে পারো। গৃহের পরিস্থিতি যদি মাতার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে, তবে এমন এক পরিবারে শিশুগুলিকে কেমন দেখাবে? অনাথের মতো? নাকি ভিক্ষুকের মতো? এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই যে ঈশ্বর বলেছিলেন: “সকল মানুষ চিন্তা করে যে আমার প্রকৃতি হল এক দেবত্বের প্রকৃতি, যাতে ‘ধীশক্তি গুণ’-এর ঘাটতি রয়েছে, কিন্তু কে উপলব্ধি করতে পারে যে আমার মানবতায় আমি সমস্তকিছুর মর্মার্থ অনুধাবন করতে সক্ষম?” এরকম এক সহজবোধ্য পরিস্থিতিতে, তাঁর দেবত্ব থেকে বাক্যোচ্চারণের কোনো প্রয়োজন ঈশ্বরের নেই। ঈশ্বর যেমন বলেছেন, “একটি পেরেক পোঁতার জন্য অতিকায় হাতুড়ি ব্যবহারের কোনো আবশ্যকতা নেই।” সম্ভবত, এই মুহূর্তে, এমন কিছু মানুষ রয়েছে যারা ঈশ্বরের এই যে আপ্তবাক্য “মানুষের মাঝে এমন কেউ নেই যে আমায় ভালোবাসে”—এর বিষয়ে কিছু ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা লাভ করেছে। এক্ষণে, বিষয়টি ঠিক ঈশ্বর যেমন বলেছেন: “শুধুমাত্র বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এসে উপনীত হয়েছে বলেই সকল মানুষ অনিচ্ছাসহকারে তাদের মস্তক অবনত করে—কিন্তু তাদের অন্তরে তারা অপ্রতীতই রয়ে যায়।” এই বাক্যগুলি এক দূরবীক্ষণ যন্ত্রের মতো। অনতিদূর ভবিষ্যতে, মানুষ আরেক পরিস্থিতির মধ্যে প্রবেশ করবে। একে অসংশোধনীয়তা বলে। তোমরা কি উপলব্ধি করো? এ-ই হল ঈশ্বরের এই প্রশ্নদুটির উত্তর: “শুধুমাত্র আমার প্রস্থান-আশঙ্কাতেই কি মানুষ পাপকার্য থেকে নিবৃত্ত থাকে না? এমন কি সত্য নয় যে একমাত্র আমার শাস্তির ভয়েই তারা কোনো অনুযোগ করে না?” বস্তুত, বর্তমান পর্যায়ে সকল মানুষই কিছু পরিমাণে শিথিল, যেন-বা ক্লান্তির দ্বারা পরাভূত। ঈশ্বরের কার্যের বিষয়ে মনোযোগ দেওয়ার মতো মানসিক অবস্থায় আদৌ তারা নেই, বরং শুধুমাত্র নিজেদের দেহের স্বার্থে আয়োজন ও সংস্থান করার চিন্তাতেই নিমগ্ন। তাই নয় কি?