অধ্যায় ৩০
ঈশ্বরের বাক্যের বিষয়ে কিছু মানুষের হয়তো কিছুটা অন্তর্দৃষ্টি রয়েছে, কিন্তু তাদের কেউই নিজেদের অনুভূতির উপর ভরসা করে না; নেতিবাচকতায় পতিত হতে তাদের ভীষণ ভয়। তাই, সবসময় তারা পর্যায়ক্রমে আনন্দ ও দুঃখের মধ্যে পালাবদল করে চলে। এমন বলা ন্যায্য হবে যে, সকল মানুষের জীবন শোকে পরিপূর্ণ; আরেকটু এগিয়ে গিয়ে বলা যায় যে, সকল মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে পরিমার্জন রয়েছে, তবু আমি বলতে পারি যে প্রতিটি দিন কেউই তার আত্মায় কোনো নির্মুক্তি লাভ করে না, এবং মনে হয় যেন তিনখানা সুবিশাল পর্বত তাদের মাথার উপর চেপে বসে রয়েছে। তাদের জীবনের একটি দিনও সর্বক্ষণ আনন্দমুখর ও উৎফুল্ল নয়—এবং এমনকি যখন তারা কিছুটা খুশি, তখনও তারা কেবল ভালো থাকার ভান করার চেষ্টা করছে মাত্র। নিজ অন্তরে মানুষ সতত এক অসম্পূর্ণতার বোধ পোষণ করে। এই কারণেই, তাদের হৃদয়ে তারা অবিচল নয়; এইভাবে জীবন যাপন করতে করতে, সবকিছুই শূন্যগর্ভ ও অন্যায্য বলে মনে হয়, আর ঈশ্বর-বিশ্বাসের প্রসঙ্গ যখন আসে, তখন তারা ভারি ব্যস্ত এবং তাদের সময়ের খুব অভাব, নতুবা তাদের হাতে ঈশ্বরের বাক্য ভোজন ও পান করার মতো পর্যাপ্ত সময় নেই, নয়তো ঈশ্বরের বাক্যকে কীভাবে যথাযথ ভোজন ও পান করতে হয়, তা-ই তাদের জানা নেই। তাদের একজনও অন্তর থেকে প্রশান্ত, প্রাঞ্জল, ও অবিচল নয়। মনে হয় যেন তারা সর্বদাই এক মেঘাচ্ছন্ন আকাশের নিচে বাস করেছে, যেন তারা অক্সিজেন-শূন্য কোনো পরিসরে বসবাস করে, এবং এর ফলে তাদের জীবনে বিভ্রান্তির উদ্ভব ঘটেছে। মানুষের দুর্বলতার বিষয়ে ঈশ্বর সর্বদা সরাসরি কথা বলেন, সর্বদাই তিনি তাদের অরক্ষিততম স্থানে আঘাত হানেন—নিয়ত কোন কণ্ঠস্বরে তিনি বাক্যালাপ করেছেন তা কি স্পষ্টতই তোমরা লক্ষ্য করো নি? ঈশ্বর মানুষকে কখনো অনুতাপ করার অবকাশ দেন নি; এবং সকল মানুষকে তিনি অক্সিজেন-বিহীন “চাঁদ”-এ গিয়ে বসবাস করতে বাধ্য করেন। প্রারম্ভকাল থেকে আজ অবধি, ঈশ্বরের বাক্যসমূহ বাহ্যিকভাবে মানুষের প্রকৃতিকে অনাবৃত করেছে, তবু কেউই এই বাক্যগুলির সারসত্য পরিষ্কারভাবে বুঝে উঠতে পারে না। মনে হয় যেন মানুষের উপাদানকে অনাবৃত করার মাধ্যমে মানুষ নিজেদের জানতে পারে, এবং এইভাবে, ঈশ্বরকে জানতে পারে, কিন্তু সারমর্মগতভাবে, এটা পথ নয়। ঈশ্বরের বাক্যের বাচনভঙ্গি ও প্রগাঢ় গভীরতা ঈশ্বর ও মানুষের মধ্যের এক সুস্পষ্ট পার্থক্যকে প্রকট করে তোলে। এর ফলে, মানুষ, তাদের অনুভূতিতে, অচেতনভাবে বিশ্বাস করে যে ঈশ্বর নাগালের বাইরে ও অনধিগম্য; ঈশ্বর সকলকিছুকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসেন, এবং মনে হয় কেঊই যেন ঈশ্বর ও মানুষের মধ্যে সম্পর্কটিকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম নয়। এমনটা লক্ষ্য করা দুষ্কর নয় যে, ঈশ্বরের সকল উচ্চারণের উদ্দেশ্য হল বাক্যের সাহায্যে সমুদয় মানুষকে “ভূপাতিত” করা, এইভাবে তাঁর কার্য সিদ্ধ করা। এগুলি হল ঈশ্বরের কার্যের ধাপ। তবু মানুষ তাদের মনে তা বিশ্বাস করে না। তারা মনে করে যে ঈশ্বরের কার্য তার চরম পরিণতির দিকে অগ্রসর হচ্ছে, মনে করে যে, তা তার সবচেয়ে বোধগম্য ফলাফলের দিকে এগিয়ে চলেছে, যাতে অতিকায় লাল ড্রাগনকে পরাভূত করা যায়, অর্থাৎ, গির্জাগুলিকে সমৃদ্ধশালী করা যায়, যেখানে কেউই ঈশ্বরের অবতার সম্বন্ধে কোনো পূর্বধারণা পোষণ করবে না, নয়তো সকল মানুষই ঈশ্বরকে জানবে। তবু ঈশ্বর কী বলেছেন তা পড়ে দেখা যাক: “মানুষের চিন্তাধারায়, ঈশ্বর ঈশ্বরই, এবং তাঁর সাথে সহজভাবে মেলামেশা করা যায় না, সেখানে মানুষ মানুষই, এবং অনায়াসে তাদের ইন্দ্রিয়পরায়ণ হয়ে ওঠা উচিত নয়। … ফলস্বরূপ, আমার সম্মুখে তারা সবসময় বিনীত ও ধৈর্যশীল; আমার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয়ে উঠতে তারা অক্ষম, কারণ তাদের মধ্যে অত্যধিক পরিমাণে পূর্বধারণাসমূহ রয়েছে।” এর থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ঈশ্বর যা-ই বলুন বা মানুষ যা-ই করুক না কেন, ঈশ্বরকে জানতে মানুষ সম্পূর্ণরূপে অসমর্থ; তাদের উপাদান যে ভূমিকা পালন করে তার কারণে, যা-ই হোক না কেন, চূড়ান্ত বিচারে, তারা ঈশ্বরকে জানতে অক্ষম। তাই, ঈশ্বরের কার্য তখনই সমাপ্ত হবে যখন মানুষ নিজেদের নরকের সন্তানরূপে প্রত্যক্ষ করবে। তাঁর সমগ্র ব্যবস্থাপনাকে সমাপ্ত করার লক্ষ্যে তাঁর ক্রোধকে মানুষের উপর অর্গলমুক্ত করার, অথবা তাদের সরাসরি অভিযুক্ত করার, কিংবা পরিশেষে তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার কোনো প্রয়োজন ঈশ্বরের নেই। তাঁর নিজস্ব চলার বেগে তিনি কেবল তুচ্ছ আলাপচারিতায় রত হন, যেন তাঁর কার্যের নিষ্পাদন আনুষঙ্গিক ঘটনা মাত্র, এমন এক বিষয় যা সামান্যতম পরিশ্রম ব্যতিরেকেই তাঁর অবসরকালীন সময়ে সম্পন্ন হয়। বাহ্যিক দৃষ্টিতে, ঈশ্বরের কার্যে কিছুটা তাড়া আছে বলে মনে হয়—অথচ ঈশ্বর কিছুই করেন নি। বাক্য উচ্চারণ ব্যতীত আর কিছুই তিনি করেন না। বিগত দিনে গির্জাগুলির মধ্যে যে বৃহৎ মাত্রায় কাজকর্ম সাধিত হতো এখন সেই মাত্রায় হয় না: ঈশ্বর নতুন মানুষ যুক্ত করেন না, কিংবা কাউকে বহিষ্কার অথবা উন্মোচিতও করেন না—এজাতীয় কাজগুলি নেহাৎই মামুলি। মনে হয় ঈশ্বরের যেন এধরনের কাজকর্মের প্রতি কিছুমাত্র স্পৃহা নেই। তিনি কেবল তাঁর কী করা উচিত সে বিষয়ে স্বল্প কয়েকটি বাক্য উচ্চারণ করেন, তারপর পিছন ফিরে চিহ্নমাত্র না রেখে অন্তর্হিত হন—যা, স্বভাবতই, তাঁর বাক্যোচ্চারণ সমাপনের দৃশ্যপট। এবং সেই মুহূর্ত যখন উপনীত হবে, সকল মানুষ তখন তাদের সুপ্তাবস্থা থেকে জেগে উঠবে। হাজার-হাজার বছর ধরে মানবজাতি অলস নিদ্রায় আচ্ছন্ন রয়েছে, আদ্যন্ত সে গভীর ঘুমে অচৈতন্য হয়ে ছিল। এবং বহু বছরকাল যাবৎ মানুষ তাদের স্বপ্নের মধ্যে ইতি-উতি ধাবমান হয়েছে, এবং, মুখ ফুটে তাদের হৃদয়ের অভ্যন্তরে সঞ্চিত অবিচারের কথা বলতে না পেরে, তারা এমনকি তাদের স্বপ্নের মধ্যেও উচ্চৈঃস্বরে আর্তনাদও করে ওঠে। তাই, তারা “তাদের অন্তরে কিছুটা বিষণ্ণতা বোধ করে”—কিন্তু জেগে উঠে তারা প্রকৃত সত্যকে আবিষ্কার করে আশ্চর্য হয়ে বলে উঠবে: “ব্যাপারটা তাহলে এই!” সেই কারণেই বলা হয়েছে যে, “আজ, অধিকাংশ মানুষ এখনো ঘুমে অচৈতন্য। রাজ্যের স্তবগান যখন ধ্বনিত হয় একমাত্র তখনই তারা তাদের নিদ্রাতুর চক্ষু উন্মীলিত করে এবং তাদের অন্তরে কিছুটা বিষণ্ণতা বোধ করে।”
কারো আত্মাকে কখনো মুক্ত করা হয়নি, কারো আত্মা কোনোদিন নিরুদ্বেগ ও সুখী ছিল না। ঈশ্বরের কার্য যখন সম্পূর্ণরূপে সমাপ্ত হবে, তখন মানুষের আত্মা মুক্তি পাবে, কারণ প্রত্যেককে প্রকারভেদ অনুযায়ী শ্রেণীবিভক্ত করা হবে, এবং এইভাবে তারা সকলেই অন্তরে অবিচল হয়ে উঠবে। মনে হয় মানুষ যেন পৃথিবীর অতি দূরবর্তী প্রান্তে কোনো সমুদ্রযাত্রায় নির্গত হয়েছে, এবং যখন তারা বাড়ি ফেরে তখন তাদের হৃদয় দৃঢ়সঙ্কল্প হয়ে ওঠে। বাড়ি ফেরার পর, মানুষ আর পৃথিবীকে রিক্ত ও ন্যায়বিচারহীন বলে বোধ করবে না, বরং নিজ-নিজ গৃহে শান্তিতে জীবনযাপন করবে। সমগ্র মানবজাতির মধ্যে পরিস্থিতি এমনই দাঁড়াবে। তাই, ঈশ্বর বলেন যে “মানুষ নিজেদের কখনো শয়তানের দাসত্ব থেকে মুক্ত করতে সক্ষম হয়নি।” দেহে অবস্থান করাকালীন এই পরিস্থিতি থেকে নিজেকে মুক্ত করতে কেউই সক্ষম নয়। আপাতত, মানুষের বিবিধ বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে ঈশ্বর যা বলেছেন তা দূরে সরিয়ে রেখে যে রহস্যগুলি ঈশ্বর এখনো মানুষের কাছে অপ্রকাশিত রেখেছেন কেবল সেগুলির বিষয়েই আলোচনা করা যাক। “অগণিত বার মানুষ আমার দিকে বিদ্রূপের চোখে তাকিয়েছে, আমার শরীর যেন কণ্টকাকীর্ণ ও তাদের কাছে বিতৃষ্ণাজনক, আর তাই মানুষ আমাকে ঘৃণাসহকারে পরিহার করে, এবং মনে করে আমার কোনো মূল্য নেই।” বিপরীতক্রমে, মূলগতভাবে, ঈশ্বরের বাক্যের মাধ্যমেই মানুষের প্রকৃত স্বরূপ উন্মোচিত হয়: মানুষের শরীর পালকে ঢাকা, তার মধ্যে প্রীতিপ্রদ কিছুই নেই, আর তাই মানুষের প্রতি ঈশ্বরের ঘৃণা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়, কারণ মানুষ নিছকই এক কণ্টকাবৃত শজারু মাত্র যার মধ্যে প্রশংসনীয় কোনোকিছুই নেই। উপরিগতভাবে, এই বাক্যগুলি ঈশ্বরের প্রতি মানুষের পূর্বধারণাসমূহকে বর্ণনা করে বলে মনে হয়—কিন্তু বাস্তবে, মানুষের প্রতিকৃতির উপর ভিত্তি করে ঈশ্বর তার এক চিত্র অঙ্কন করছেন। এই বাক্যগুলি হল ঈশ্বরকৃত মানুষের চিত্রায়ণ, এবং মনে হয় বুঝি ঈশ্বর মানুষের প্রতিকৃতির উপর কোনো আসঞ্জক পদার্থ লেপন করেছেন; যার ফলে, মহাবিশ্বে মানুষের প্রতিকৃতি সগর্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে, যা এমনকি মানুষকেও বিস্ময়াবিষ্ট করে। যখন থেকে তিনি বাক্য উচ্চারণ আরম্ভ করেছিলেন, তখন থেকেই ঈশ্বর মানুষের বিরুদ্ধে এক ভীষণ যুদ্ধের জন্য তাঁর বাহিনীকে সন্নিবিষ্ট করছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বীজগণিতের কোনো অধ্যাপকের মতো মানুষের কাছে তথ্যগুলি তিনি মেলে ধরছেন, এবং যে তথ্যগুলি তিনি তালিকাবদ্ধ করেন—সাক্ষ্যপ্রমাণ ও প্রতিপ্রমাণ—সেগুলির দ্বারা যা প্রতিপন্ন হয়, তা সকল মানুষকে সম্পূর্ণরূপে প্রতীত করে। ঈশ্বরের যাবতীয় বাক্যের লক্ষ্য হল এটাই, এবং এই কারণেই ঈশ্বর মানুষের উদ্দেশ্যে এই বিহ্বলকর বাক্যগুলি আলগোছে নিক্ষেপ করেন: “এক কথায়, মানুষের হৃদয়ে আমি সম্পূর্ণ মূল্যহীন, আমি পরিহার্য এক গার্হস্থ্য সামগ্রী মাত্র।” এই বাক্যগুলি পাঠ করার পর, মানুষ তাদের অন্তরে একটি প্রার্থনা উচ্চারণ না করে পারে না, এবং তারা ঈশ্বরের কাছে তাদের ঋণগ্রস্ততার কথা জানতে পারে, যার ফলে তারা নিজেদের দোষী সাব্যস্ত করে, যার ফলে তারা প্রতীত হয় যে মানুষের মৃত্যুবরণ করাই বিধেয়, এবং প্রতীত হয় যে মানুষের যৎসামান্যও যোগ্যতা নেই। ঈশ্বর বলেন, “এই কারণেই আমি আজকের এই পরিস্থিতিতে এসে উপনীত হয়েছি,” এই উক্তির সাথে প্রকৃত বর্তমান পরিস্থিতির সম্বন্ধ স্থাপন করা হলে, মানুষ নিজেদের অভিযুক্ত করতে বাধ্য হয়। এ কি বাস্তব সত্য নয়? তোমায় যদি নিজেকে জানতে বাধ্য করা হয়, তাহলে কি তোমার মুখ দিয়ে “সত্যিই আমার মৃত্যুবরণ করা উচিত!” জাতীয় বাক্য নির্গত হতে পারে? এ-ই হল মানুষের যথার্থ পরিস্থিতি, এবং এ বিষয়ে খুব বেশি চিন্তা করে কোনো লাভ নেই—এটি নিছক এক যথোপযুক্ত উদাহরণ মাত্র।
এক অর্থে, ঈশ্বর যখন মানুষের মার্জনা ও সহিষ্ণুতা ভিক্ষা করেন, তখন মানুষ মনে করে যে ঈশ্বর তাদের নিয়ে কৌতুক করছেন, এবং অন্য অর্থে, তারা নিজেদের বিদ্রোহী মনোভাবকেও দেখতে পায়—ঈশ্বর কখন মানুষের নিমিত্ত সর্বাধিক সচেষ্ট হবেন কেবল তার জন্যই তারা অপেক্ষারত। এছাড়াও, মানুষের পূর্বধারণার প্রসঙ্গে ঈশ্বর বলেন যে, মানুষের জীবনযাপনের দর্শন বা মানুষের ভাষার বিষয়ে তিনি ব্যুৎপত্তিসম্পন্ন নন। এইভাবে, একদিক থেকে, মানুষ এর দরুন এই বাক্যগুলিকে বাস্তববাদী ঈশ্বরের সঙ্গে তুলনা করে দেখে, এবং অন্য দিক থেকে, ঈশ্বরের বাক্যগুলির মধ্যে তারা তাঁর অভিপ্রায়কে প্রত্যক্ষ করে—ঈশ্বর তাদের উপহাস করছেন, কারণ তারা বুঝতে পারে যে ঈশ্বর মানুষের প্রকৃত স্বরূপ উন্মোচিত করছেন, এবং সত্যিই তিনি মানুষকে ঈশ্বরের প্রকৃত পরিস্থিতির বিষয়ে অবগত করছেন না। ঈশ্বরের বাক্যের অন্তর্নিহিত অর্থ ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ, শ্লেষোক্তি, উপহাস, এবং মানুষের প্রতি ঘৃণায় পরিপূর্ণ। মনে হয়, তার সকল কাজকর্মে, মানুষ যেন বিধানের বিকৃতিসাধন করছে এবং উৎকোচ গ্রহণ করছে; মানুষ হল বারাঙ্গনা বিশেষ, এবং ঈশ্বর যখন বাক্য উচ্চারণের জন্য মুখব্যাদান করেন, তারা আতঙ্কে কম্পিত হয়, গভীরভাবে ভয় পায় যে, তাদের সম্পর্কিত সত্যগুলি আনুপুঙ্খিকভাবে অনাবৃত করা হবে, ফলে ভীষণ লজ্জায় তারা কারো কাছে মুখ দেখাতে পারবে না। কিন্তু যা সত্য, তা সত্যই। মানুষের “অনুতাপ”-এর কারণে ঈশ্বর তাঁর উচ্চারণ স্থগিত করেন না; মানুষ যত বেশি অকথ্য রকমের লজ্জিত ও বর্ণনাতীতভাবে অপ্রতিভ হয়, তত বেশি করে ঈশ্বর তাঁর জ্বলন্ত দৃষ্টি তাদের মুখমণ্ডলের উপর নিবদ্ধ করেন। তাঁর মুখনিঃসৃত বাক্য মানুষের সকল কুৎসিত কাণ্ডকারখানাকে টেবিলের উপর বিছিয়ে ধরে—এ হল ন্যায্য ও পক্ষপাতশূন্য হওয়া, একে বলে কুইংচিয়েন,[ক] এ হল মানুষের সর্বোচ্চ আদালতের দেওয়া রায়। এইভাবে, মানুষ যখন ঈশ্বরের বাক্যসমূহ পাঠ করে, তখন সহসা তারা হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়, তাদের রক্তচাপ বৃদ্ধি পায়, মনে হয় তারা যেন ধমনীতে রক্ততঞ্চনজনিত হৃদ্রোগে ভুগছে, যেন কোনো সন্ন্যাস রোগ তাদের পশ্চিমের স্বর্গোদ্যানে স্বীয় পূর্বপুরুষদের সাথে মিলিত হওয়ার উদ্দেশ্যে ফেরৎ পাঠাতে উদ্যত—ঈশ্বরের বাক্যগুলি পাঠ করার সময় এ-ই হয় তাদের প্রতিক্রিয়া। বছরের পর বছর কঠোর পরিশ্রমের কারণে মানুষ ক্ষীণবল হয়ে পড়েছে, ভিতরে ও বাইরে সে রুগ্ন, তার সমস্তটাই অসুস্থ, তার হৃৎপিণ্ড থেকে তার রক্তবাহ, বৃহদন্ত্র, ক্ষুদ্রান্ত্র, পাকস্থলী, ফুসফুস, বৃক্ক, ইত্যাদি সবকিছুই। তার সমগ্র দেহের কোনোকিছুই নীরোগ নয়। এইভাবে, ঈশ্বরের কার্য মানুষের পক্ষে অপ্রাপণীয় কোনো স্তরে উন্নীত হয় না, বরং মানুষকে তা নিজেদেরকে জানতে বাধ্য করে। ভাইরাস এসে মানুষের শরীরকে ছেঁকে ধরেছে বলে, এবং মানুষ বৃদ্ধ হয়ে পড়েছে বলে, তার মৃত্যুর দিন ঘনিয়ে আসছে, এবং ফেরার আর কোনো পথ নেই। কিন্তু এটা কেবল গল্পের এক অংশবিশেষ; অন্তর্নিহিত অর্থটি প্রকাশ্যে আসতে এখনো দেরি আছে, কারণ মানুষের অসুস্থতার উৎস খুঁজে বের করা হচ্ছে। বাস্তবে, পৃথিবীর বুকে ঈশ্বরের কার্য যে সময়ে সম্পূর্ণ হবে, সেই মুহূর্তেই যে ঈশ্বরের সামগ্রিক কার্যও সম্পূর্ণ হয়ে যাবে, এমনটা নয়, কারণ কার্যের এই পর্যায়টি একবার সমাপ্ত হয়ে গেলে, ভবিষ্যতের কার্য দেহরূপে সম্পন্ন করার কোনো উপায় থাকবে না, এবং এই কার্য নিষ্পন্ন করার জন্য ঈশ্বরের আত্মাকে প্রয়োজন হবে। তাই ঈশ্বর বলেন, “আমি যখন আনুষ্ঠানিকভাবে সেই গ্রন্থ উন্মোচন করি, সেটাই সেই সময় যখন মহাবিশ্বের সকল মানুষ শাস্তিপ্রাপ্ত হয়, যে ক্ষণে আমার কার্য তার চরম পরিণতিতে উপনীত হয়, যখন সারা পৃথিবী জুড়ে মানুষ পরীক্ষার সম্মুখীন হয়।” দেহরূপে কার্য যে সময়ে পরিসমাপ্ত হয় তখনই যে ঈশ্বরের কার্য তার চূড়ান্ত পরিণতিতে উপনীত হয় এমনটা নয়—এই সময়ের চরম পরিণতি শুধুমাত্র বর্তমান পর্যায়ের কার্যের প্রতিই নির্দেশ করে, এবং তা সমগ্র পরিচালনামূলক পরিকল্পনার চূড়ান্ত পরিণতি নয়। তাই, মানুষের কাছে ঈশ্বরের চাহিদাগুলি অত্যুচ্চ কিছু নয়। তিনি কেবল চান যে মানুষ নিজেদের জানুক, এইভাবে কার্যের পরবর্তী পর্যায়ের প্রয়োজন সাধন করুক, যে পর্যায়ে ঈশ্বরের ইচ্ছা অর্জিত হয়ে যাবে। ঈশ্বরের কার্যের পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের “কার্য একক”-ও পাল্টে যায়। চলতি সময় হল পৃথিবীবক্ষে ঈশ্বরের কার্যের পর্যায়, আর তাই মানুষকে অবশ্যই তৃণমূল স্তরে কাজ করতে হবে। ভবিষ্যতে, রাষ্ট্রকে পরিচালনা করার প্রয়োজন হবে, এবং সেহেতু তখন তাদেরকে “কেন্দ্রীয় সমিতি”-তে পুনর্নিযুক্ত করা হবে। তারা যদি বিদেশে যায়, তাহলে অন্য দেশে যাওয়ার জন্য যে কার্যপ্রণালী রয়েছে, সেটির মোকাবিলা করতে হবে তাদের। এরকম সময়ে তারা প্রবাসে থাকবে, স্বদেশ থেকে অনেক দূরে—কিন্তু তখনও তা ঈশ্বরের কার্যের প্রয়োজনবশতই ঘটবে। লোকে যেমন বলেছে, “প্রয়োজন হলে ঈশ্বরের পায়ের তলায় আমরা আমাদের জীবন বিছিয়ে দেবো”—এ-ই কি ভবিষ্যতের চলার পথ নয়? এমন জীবন কে-ই বা কবে উপভোগ করেছে? কোনো ব্যক্তি সর্বত্র ভ্রমণ করতে পারে, বিদেশে যেতে পারে, গ্রামাঞ্চলে গিয়ে নির্দেশনা দান করতে পারে, সাধারণ মানুষদের মাঝে নিজেকে অঙ্গীভূত করতে পারে, আবার তারা উচ্চপর্যায়ের প্রতিষ্ঠানসমূহের সদস্যদের সঙ্গে রাষ্ট্র সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলাপ-আলোচনাও করতে পারে; এবং প্রয়োজন হলে, তারা ব্যক্তিগতভাবে নরকের জীবনের আস্বাদও গ্রহণ করতে পারে, যার পর ফিরে এসে তখনো তারা স্বর্গীয় আশীর্বাদ উপভোগ করতে সমর্থ হবে—মানুষের পক্ষে এসকল কি শুভাশিস নয়? কে-ই বা কবে ঈশ্বরের সমতুল্য হয়ে ঊঠতে পেরেছে? কোনজন কবে সমস্ত রাষ্ট্রব্যাপী পরিভ্রমণ করেছে? বস্তুত, মানুষ কোনো সূচক বা ব্যাখ্যা ব্যতিরেকেই ঈশ্বরের কিছু কিছু বাক্যের অর্থ কিছুটা হলেও উপলব্ধি করতে সক্ষম হতো—সমস্যাটা হল যে, তাদের নিজেদের প্রতি কোনো আস্থা নেই, এই কারণেই ঈশ্বরের কার্য বর্তমানকাল অবধি প্রলম্বিত হয়েছে। যেহেতু মানুষের অনেক ঘাটতি রয়েছে—যেমন ঈশ্বর বলেছিলেন, “তাদের কিছুই নেই”—সেহেতু বর্তমান কার্য তাদের কাছে প্রবল সমস্যার সৃষ্টি করে; তার উপর, তাদের দুর্বলতা, স্বাভাবিকভাবেই, ঈশ্বরের জিহ্বার উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে—এবং সম্যকভাবে এই বিষয়গুলিই কি ঈশ্বরের কার্যকে ব্যাহত করছে না? তোমরা এখনো কি তা দেখতে পাচ্ছো না? ঈশ্বরের সকল বাক্যের প্রচ্ছন্ন অর্থ রয়েছে। কথনকালে ঈশ্বর সাম্প্রতিকতম বিচার্য বিষয়গুলিকে কাজে লাগান, এবং কোনো নীতিকথার কাহিনীর মতোই, তাঁর উচ্চারিত যাবতীয় বাক্যের ভিতরও নিগূঢ় বার্তা থাকে। সরল এই বাক্যগুলি গভীর অর্থ ধারণ করে, এবং এইভাবে, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহের ব্যাখ্যা দেয়—এই উদ্দেশ্য সাধনেই কি ঈশ্বরের বাক্যগুলি সবচেয়ে পারঙ্গম নয়? তুমি কি তা জানো?
পাদটীকা:
ক। কুইংচিয়েন: চীনদেশে যখন সাম্রাজ্যতন্ত্র বহাল ছিল, তখন এই পরিভাষাটি একজন ন্যায়পরায়ণ বিচারককে বোঝাতে ব্যবহৃত হতো।