অধ্যায় ২২ ও ২৩
আজ, সবাই ঈশ্বরের অভিপ্রায় উপলব্ধি করতে ও ঈশ্বরের প্রকৃতিকে জানতে ইচ্ছুক, কিন্তু কেন তারা যা করতে ইচ্ছুক তা করতে অক্ষম, কেন সবসময় তাদের হৃদয় তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে, আর তারা যা চায় তা অর্জন করতে পারে না, সেই কারণটা কেউ জানে না। ফলে, আবার তারা এক চূড়ান্ত মরিয়া পরিস্থিতিতে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে, এদিকে আবার তারা ভয়ও পাচ্ছে। তাদের পরস্পরবিরোধী আবেগগুলোকে প্রকাশ করতে না পেরে তারা কেবল বিষাদে মাথা অবনত করে নিজেদের অবিরত প্রশ্ন করতে পারে: “এমন কি হতে পারে যে ঈশ্বর আমায় আলোকিত করেননি? এমন কি হতে পারে যে গোপনে তিনি আমায় পরিত্যাগ করেছেন? হয়তো বাকি সবাই চমৎকার আছে, আর আমাকে বাদ দিয়ে তাদের সবাইকে ঈশ্বর আলোকিত করেছেন। ঈশ্বরের বাক্য পাঠ করার সময় আমি সবসময় কেন বিচলিত বোধ করি—কেন আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারি না?” মানুষের মনে এরকমের চিন্তা থাকলেও মুখে প্রকাশ করতে কেউ সাহস করে না; কেবল তারা ভিতরে-ভিতরে লড়াই চালিয়ে যায়। আসলে, ঈশ্বর ছাড়া আর কেউই তাঁর বাক্যকে উপলব্ধি করতে বা তাঁর প্রকৃত অভিপ্রায় আঁচ করতে পারে না। তবু ঈশ্বর সবসময় মানুষকে তাঁর ইচ্ছা উপলব্ধি করতে বলেন—এটা কি পাতিহাঁসকে জবরদস্তি দাঁড়ে বসানোর চেষ্টা করার মতো ব্যাপার নয়? ঈশ্বর কি মানুষের অক্ষমতাগুলির বিষয়ে জানেন না? এ হল ঈশ্বরের কার্যের এক সন্ধিক্ষণ, মানুষ এটাই বুঝতে পারে না, আর তাই ঈশ্বর বলেন, “মানুষ আলোর মধ্যে বাস করে, তবু সে আলোর মহার্ঘতার বিষয়ে সচেতন নয়। আলোর সারসত্য ও আলোর উৎস, এবং তদুপরি, এই আলো কার অধিকারভুক্ত, সে বিষয়ে সে অনবহিত।” ঈশ্বরের বাক্য মানুষকে যা বলে এবং মানুষের কাছে যা দাবি করে সেই হিসাবে ধরলে, একজন মানুষও বাঁচবে না, কারণ মানুষের লৌকিক অস্তিত্বের মধ্যে ঈশ্বরের বাক্যকে গ্রহণ করার মতো কিছুই নেই। তাই, সর্বোচ্চ আদর্শ মান হল ঈশ্বরের বাক্যগুলি পালন করতে সমর্থ হওয়া, সেগুলিকে লালন ও আকাঙ্ক্ষা করা, এবং ঈশ্বরের যেসব বাক্য মানুষের অবস্থাকে নির্দেশ করে তা তাদের নিজেদের পরিস্থিতির ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা ও তার মাধ্যমে নিজেদের বিষয়ে অবগত হওয়া। রাজ্য অবশেষে যখন বাস্তবায়িত হবে, স্থূল শরীরে জীবনধারণকারী মানুষ তখনো ঈশ্বরের অভিপ্রায় অনুধাবন করতে অসমর্থ হবে, এবং তখনো তাদের তাঁর ব্যক্তিগত পথনির্দেশনার প্রয়োজন হবে—কিন্তু মানুষ তখন সম্পূর্ণরূপে শয়তানের হস্তক্ষেপমুক্ত হবে, এবং মানবসুলভ স্বাভাবিক জীবনের অধিকারী হবে; শয়তানকে পরাভূত করতে এটাই ঈশ্বরের লক্ষ্য, আর তিনি তা করেন মূলত ঈশ্বর-সৃষ্ট মানুষের আদি সারবত্তাকে উপাদানকে পুনরুদ্ধার করার উদ্দেশ্যে। ঈশ্বরের চেতনায় “দেহ” শব্দটি নিম্নলিখিত বিষয়কে নির্দেশ করে: ঈশ্বুরের সারসত্যকে জানার অক্ষমতা; আধ্যাত্মিক জগতের বিষয়সমূহ দর্শনের অক্ষমতা; অধিকন্তু, ঈশ্বরের আত্মার দ্বারা চালিত হওয়া সত্ত্বেও শয়তানের দ্বারা কলুষিত হওয়ার সামর্থ্য। এটাই ঈশ্বর-সৃষ্ট স্থূল শরীরের সারসত্য। স্বভাবতই, শৃঙ্খলার অভাবজনিত কারণে মানবজাতির জীবনের নৈরাজ্যকে এড়ানোর জন্যও এটা বোঝানো হয়েছে। ঈশ্বর যত বেশি বাক্য বলেন, এবং যত বেশি মর্মভেদী ভাষায় তা বলেন, মানুষ তত বেশি করে উপলব্ধি করে। মানুষ নিজেদের অজান্তে পরিবর্তিত হয়, এবং অজান্তেই আলোর মধ্যে বাস করে, আর তাই, “আলোর কারণে তারা বিকশিত হচ্ছে, এবং তারা অন্ধকার ত্যাগ করেছে।” এটি রাজ্যের অপূর্ব দৃশ্য, এবং এই হল সেই বহুকথিত “মৃত্যু থেকে প্রস্থান করে আলোর মধ্যে বসবাস”। পৃথিবীর বুকে যখন আসোয়ান বাস্তবায়িত হবে—রাজ্য যখন বাস্তবায়িত হবে—পৃথিবীতে তখন আর যুদ্ধবিগ্রহ থাকবে না; আর কখনো দুর্ভিক্ষ, মহামারী, ও ভূমিকম্পের প্রাদুর্ভাব ঘটবে না; মানুষ অস্ত্র উৎপাদনে বিরত হবে; সবাই শান্তি ও সুস্থিতির মধ্যে বসবাস করবে; এবং মানুষে-মানুষে ও রাষ্ট্রে-রাষ্ট্রে স্বাভাবিক সম্পর্ক থাকবে। কিন্তু এর সাথে বর্তমান সময়ের কোনো সাদৃশ্য নেই। স্বর্গের নীচে সবকিছু নৈরাজ্যে ডুবে আছে, এবং প্রত্যেক দেশে ক্রমশ সামরিক অভ্যুত্থান মাথা চাড়া দিতে শুরু করেছে। ঈশ্বরের উচ্চারণের ফলশ্রুতি হিসাবে, মানুষ ক্রমশ পরিবর্তিত হচ্ছে, এবং, প্রতিটি রাষ্ট্রকে ধীরে ধীরে অভ্যন্তরীণভাবে ভেঙে টুকরো টুকরো করা হচ্ছে। ব্যাবিলনের সুদৃঢ় ভিত্তি বালির উপর নির্মিত দুর্গের মতো কাঁপতে শুরু করে, এবং ঈশ্বরের অভিপ্রায়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে পৃথিবীতে অলক্ষিতে বিশাল রূপান্তর ঘটে যায়, এবং সহসা নানান ধরনের লক্ষণ প্রতীয়মান হয়, মানুষকে জানায় যে পৃথিবীর অন্তিম লগ্ন সমাগত হয়েছে! এটাই ঈশ্বরের পরিকল্পনা; যেভাবে তিনি কার্য সম্পন্ন করেন এগুলো তার পর্যায়, এবং প্রত্যেক রাষ্ট্র নিশ্চিতভাবে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। অতীতের সদোম দ্বিতীয়বার নিশ্চিহ্ন হবে, এবং তাই ঈশ্বর বলেন, “পৃথিবী অধঃপতিত হচ্ছে! ব্যাবিলন পক্ষাঘাতগ্রস্ত!” স্বয়ং ঈশ্বর ব্যতীত আর কেউই তা সম্পূর্ণভাবে উপলব্ধি করতে সমর্থ নয়; যতোই হোক, মানুষের সচেতনতার একটা সীমা আছে। উদাহরণস্বরূপ, অভ্যন্তরীন বিষয়ের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রীরা অবগত থাকতে পারে যে বর্তমান পরিস্থিতি টলমলে ও বিশৃঙ্খল, কিন্তু তারা সেগুলোর সাথে মোকাবিলা করতে অক্ষম। তারা কেবল স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়ে মনে-মনে সেই দিনের প্রত্যাশা করতে পারে যেদিন তারা মাথা উঁচু করে চলতে পারবে, সেদিনের আগমনের প্রত্যাশা, যেদিন সূর্য আবার পূর্বদিকে উদিত হয়ে গোটা দেশ জুড়ে কিরণসম্পাত করবে এবং এই শোচনীয় পরিস্থিতির মোড় ফেরাবে। কিন্তু তাদের বিন্দুমাত্র ধারণা নেই যে সূর্য যখন দ্বিতীয়বার উদিত হয়, সেই উদয় পুরাতন ব্যবস্থাকে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে হয় না—সে এক পুনরভ্যুদয়, এক আমূল পরিবর্তন। সমগ্র মহাবিশ্বের জন্য ঈশ্বরের এমনই পরিকল্পনা। তিনি এক নতুন বিশ্বের সৃজন ঘটাবেন, কিন্তু, সবার আগে, তিনি মানুষকে নবায়িত করবেন। আজ, সবচেয়ে যা গুরুত্বপূর্ণ তা হল, মানবজাতিকে ঈশ্বরের বাক্যের মধ্যে নিয়ে আসা, নিছকই তাদের মর্যাদার আশীর্বাদ উপভোগ করতে দেওয়া নয়। উপরন্তু, ঈশ্বর যেমন বলেন, “রাজ্যে, আমি রাজা—কিন্তু আমাকে তাদের রাজা হিসাবে গণ্য করার পরিবর্তে মানুষ আমায় ‘স্বর্গ থেকে অবতীর্ণ পরিত্রাতা’ বলে জ্ঞান করে। এর ফলে, তাদের ভিক্ষাদানের নিমিত্ত তারা আমার আকাঙ্খা করে, আমার বিষয়ে জ্ঞানের অন্বেষণ করে না।” মানুষের প্রকৃত অবস্থা এমনই। আজ, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল মানুষের তৃপ্তিহীন লোভকে সম্পূর্ণরূপে বিদূরিত করা, যাতে তারা প্রতিদানে কিছু না চেয়েই ঈশ্বরকে জানতে পারে। তাহলে, এটা আশ্চর্যজনক নয় যে, ঈশ্বর বলেন, “কত মানুষ আমার সম্মুখে ভিক্ষুকের মতো কাকুতি মিনতি করেছে; কত মানুষ আমার কাছে তাদের ‘ভিক্ষার ঝুলি’ খুলে ধরেছে আর তাদের বেঁচে থাকার অন্ন দানের জন্য আমায় অনুনয় করেছে।” এই ধরনের অবস্থা মানুষের লোভের ইঙ্গিতবাহী, এবং তা প্রতিপন্ন করে যে মানুষ ঈশ্বরকে ভালোবাসে না, বরং তাঁর কাছে দাবি তোলে, বা তাদের কাঙ্ক্ষিত বস্তুগুলি লাভ করতে সচেষ্ট হয়। মানুষের প্রকৃতি ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো; তারা সবাই চতুর ও লোভী, আর তাই ঈশ্বর মাঝেমাঝেই তাদের কাছে চাহিদা রেখে তাদের লুব্ধ হৃদয়কে বর্জন করতে ও ঈশ্বরকে আন্তরিক হৃদয়ে ভালোবাসতে বাধ্য করান। বাস্তবে, আজ অবধি মানুষ তাদের সম্পূর্ণ হৃদয় ঈশ্বরকে নিবেদন করে উঠতে পারে নি; তারা দুই নৌকায় পা রেখে চলে, কখনো নিজেদের উপর নির্ভর করে, আবার কখনো ঈশ্বরের উপর নির্ভর করে, কিন্তু তাঁর উপর সম্পূর্ণ ভরসা রাখে না। ঈশ্বরের কার্য একটা বিশেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেলে সকল মানুষ যথার্থ ভালোবাসা ও আস্থার মধ্যে বাস করবে, এবং ঈশ্বরের অভিপ্রায় পূরণ হবে; তাই, ঈশ্বরের চাহিদাগুলো উঁচু কিছু নয়।
দেবদূতরা অনবরত ঈশ্বরের সন্তান ও লোকদের মধ্যে, স্বর্গ ও পৃথিবীর মধ্যে যাতায়াত করে, প্রতিদিন তারা মানবজগতে নেমে এসে পুনরায় আধ্যাত্মিক জগতে ফিরে যায়। এটা তাদের দায়িত্ব, আর এইভাবে প্রতিদিন ঈশ্বরের সন্তান ও লোকেরা পরিচালিত হয়, এবং তাদের জীবন ক্রমশ পরিবর্তিত হয়। ঈশ্বর যেদিন তাঁর রূপ পরিবর্তিত করবেন, পৃথিবীতে দেবদূতদের কাজ সেদিন আনুষ্ঠানিকভাবে সমাপ্ত হবে এবং তারা স্বর্গরাজ্যে ফিরে যাবে। আজ, ঈশ্বরের সকল সন্তান ও লোকজন একই অবস্থায় আছে। প্রতি মুহূর্তে সমস্ত মানুষ পরিবর্তিত হছে, এবং ঈশ্বরের সন্তান ও লোকেরা ক্রমশ পরিণত হচ্ছে। তুলনাক্রমে, সকল বিদ্রোহীও অতিকায় লাল ড্রাগনের সামনে পরিবর্তিত হছে: মানুষ আর অতিকায় লাল ড্রাগনের প্রতি অনুগত নয়, এবং দৈত্যরা আর তার বন্দোবস্ত মেনে চলে না। পরিবর্তে তারা “সবাই তাদের যা সঙ্গত মনে হয় তা-ই করে, এবং প্রত্যেকেই নিজ নিজ পথে চলে।” তাই, ঈশ্বর যখন বলেন, “পৃথিবীর রাষ্ট্রগুলি কীকরে ধ্বংস না হয়ে পারতো? আমার লোকজন উল্লসিত না হয়ে কীকরে পারতো?” তখন লহমায় স্বর্গ ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে…। একটা অশুভ অনুভূতি যেন মানবজাতির পরিসমাপ্তির পূর্বাভাস দিচ্ছিল। এখানে যে অশুভ লক্ষণগুলির ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে অতিকায় লাল ড্রাগনের দেশে অবিকল সেগুলোই ঘটছে, এবং পৃথিবীর কেউ রক্ষা পাবে না। ঈশ্বরের বাক্যের ভবিষ্যদ্বাণী এমনই। আজ, সকল মানুষের মনে একটা পূর্বাশঙ্কা কাজ করছে যে, সময় বড়ো কম, এবং তারা যেন অনুভব করছে যে, তাদের উপর একটা বিপর্যয় নেমে আসতে চলেছে—তবু তাদের পালাবার কোনো উপায় নেই, আর তাই তারা সকলেই আশাহীন। ঈশ্বর বলেন, “যখন আমি দিনে দিনে আমার রাজ্যের ‘অন্তর্প্রকোষ্ঠ’-কে সজ্জিত করি, আমার কার্যের বিঘ্ন ঘটাতে কেউ কখনো সহসা আমার ‘কার্যকক্ষে’ প্রবেশ করেনি।” বস্তুত, ঈশ্বরের বাক্যের অর্থ নিছক এই নয় যে মানুষ তাঁর বাক্যের মধ্যে ঈশ্বরকে জানতে পারে। সর্বোপরি, বাক্যগুলি সূচিত করে যে, তাঁর কার্যের পরবর্তী পর্যায়ের প্রয়োজন মেটাতে প্রতিদিন ঈশ্বর সারা বিশ্বজগত জুড়ে নানা ধরনের সংঘটনের আয়োজন করেন। যে কারণে তিনি বলেন “আমার কার্যের বিঘ্ন ঘটাতে কেউ কখনো সহসা আমার ‘কার্যকক্ষে’ প্রবেশ করেনি” তা হল, ঈশ্বর দেবত্বের মধ্যে কাজ করেন, এবং মানুষ চাইলেও তাঁর কার্যে অংশগ্রহণ করতে অক্ষম। তোমাদের একটা কথা জিজ্ঞেস করি: সমগ্র মহাবিশ্বের প্রতিটি সংঘটনের বন্দোবস্ত তুমি কি সত্যিই করে উঠতে পারতে? পৃথিবীর মানুষকে তুমি কি তাদের পিতৃপুরুষদের অগ্রাহ্য করাতে পারতে? সারা মহাবিশ্বের মানুষকে তুমি কি এমন নিপুণভাবে পরিচালিত করতে পারতে যাতে তারা ঈশ্বরের অভিপ্রায় পূরণের কাজে লাগে? তুমি কি শয়তানকে উত্তাল বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে দিতে পারতে? তুমি কি মানুষকে অনুভব করাতে পারতে যে পৃথিবী ঊষর ও শূন্য? এসব করতে মানুষ অক্ষম। অতীতে, যখন শয়তানের “দক্ষতা”-কে তখনো পুরোপুরি বাগে আনা যায়নি, তখন ঈশ্বরের কার্যের প্রতিটি পর্যায়ে সে প্রতিনিয়ত হস্তক্ষেপ করতো; এই পর্যায়ে এসে, শয়তানের চালাকির ভাঁড়ার ফুরিয়ে গেছে, আর ঈশ্বর তাই তাকে তাঁর স্বরূপ দেখানোর সুযোগ দেন, যাতে সকল মানুষ তা জানতে পারে। এই হল “কেউ কখনো আমার কার্যকে বিঘ্নিত করেনি” বাক্যটিতে নিহিত সত্যতা।
প্রতিদিন, গির্জার লোকেরা ঈশ্বরের বাক্যকে পাঠ করে, এবং প্রতিদিন, তাদের উপর “অস্ত্রোপচারের টেবিলে” ব্যবচ্ছেদ-কর্ম সম্পাদন করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, “তাদের পদ হারাবার”, “পদচ্যুত হওয়ার”, “তাদের ভীতি লাঘব হয়ে আত্মস্থতা ফিরে পেলে”, “পরিত্যাগ”, এবং “‘অনুভূতি’-শূন্য”—এজাতীয় বিদ্রূপাত্মক শব্দগুলো মানুষকে “মানসিক যন্ত্রণা” দেয় এবং তাদের লজ্জায় নির্বাক করে দেয়। যেন মাথা থেকে পা, ভিতর থেকে বাইরে পর্যন্ত তাদের গোটা দেহের কোনো অঙ্গই ঈশ্বরের অনুমোদন পায় না। ঈশ্বর কেন তাঁর বাক্যের মাধ্যমে মানুষের জীবনকে এমন পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে উন্মোচিত করেন? ঈশ্বর কি ইচ্ছাকৃতভাবে মানুষের কাছে সবকিছুকে এমন জটিল করে দিচ্ছেন? মনে হয় যেন সকল মানুষের মুখে এমন কাদা লেপে দেওয়া হয়েছে যা ধুলেও পরিষ্কার হবে না। প্রতিদিন, নতমস্তকে তারা তাদের পাপের বিবরণ দিয়ে যায়, যেন তারা কোনো প্রতারক। মানুষ শয়তানের দ্বারা এতো কলুষিত হয়ে গিয়েছে যে তারা তাদের নিজেদের প্রকৃত অবস্থার বিষয়ে পুরোপুরি সচেতন নয়। কিন্তু ঈশ্বর জানেন, শয়তানের বিষ তাদের শরীরের প্রত্যেক অঙ্গে, এমনকি অস্থিমজ্জা অবধি ছড়িয়ে পড়েছে; ফলস্বরূপ, ঈশ্বরের উদ্ঘাটন যত বেশি প্রগাঢ় হয়, মানুষ তত বেশি শঙ্কিত হয়ে ওঠে, এবং এইভাবে, সকল মানুষকে মানুষের মধ্যেই বিদ্যমান শয়তানের বিষয়ে অবগত করানো হয় ও তাকে প্রত্যক্ষ করানো হয়, কারণ মানুষ খালি চোখে শয়তানকে দেখতে অক্ষম। এবং সকলেই যেহেতু বাস্তবের মধ্যে প্রবেশ করেছে, ঈশ্বর মানুষের প্রকৃতিকে অনাবৃত করেন—অর্থাৎ, তিনি শয়তানের প্রতিমূর্তি অনাবৃত করেন—এবং এভাবে মানুষকে বাস্তব, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য শয়তানকে দেখার সুযোগ করে দেন, সেই সাথে তারা যদি বাস্তববাদী ঈশ্বরকে জানতে পারে তাহলে তো আরো ভালো কথা। ঈশ্বর মানুষকে দেহীরূপে তাঁকে জানতে দেন, এবং শয়তানকে আকৃতি দান করে সকল মানুষের দেহের মধ্যে ক্রিয়াশীল বাস্তব, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য শয়তানকে জানার সুযোগ করে দেন। যে বিবিধ অবস্থার কথা বলা হয় তা সবই শয়তানের কর্মের অভিব্যক্তি। আর সেই কারণেই বলা যায়, মরদেহে বিদ্যমান সকলেই শয়তানের প্রতিরূপের মূর্ত প্রকাশ। ঈশ্বর তাঁর শত্রুদের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নন—তারা পরস্পরের প্রতি বৈরিভাবাপন্ন, ও দুটি ভিন্ন শক্তি; সুতরাং, দৈত্যরা সর্বদাই দৈত্য, এবং ঈশ্বর সর্বদাই ঈশ্বর; তারা আগুন ও জলের ন্যায় সঙ্গতিরহিত, চিরদিন স্বর্গ ও পৃথিবীর মতো পরস্পরবিযুক্ত। ঈশ্বর যখন মানুষ সৃষ্টি করেন, এক প্রকার মানুষের দেবদূতের আত্মা ছিল, সেখানে আরেক প্রকারের মানুষের মধ্যে কোনো আত্মা ছিল না, আর তাই দ্বিতীয় প্রকারের মানুষরা দৈত্যের আত্মার দ্বারা অধিকৃত হয়েছিল, আর তাই তাদের দৈত্য বলা হয়। শেষ পর্যন্ত, দেবদূতরা হল দেবদূত, দৈত্যরা দৈত্যই—এবং ঈশ্বর হলেন ঈশ্বর। প্রত্যেকে তাদের গোত্রের অনুসারী কথাটির মাধ্যমে এটাই বোঝানো হয়, আর তাই, দেবদূতরা যখন পৃথিবী শাসন করে ও আশীর্বাদ উপভোগ করে, ঈশ্বর তাঁর বাসভূমিতে ফিরে যান, এবং বাকিরা—ঈশ্বরের শত্রুরা—ভস্মে পরিণত হয়। বস্তুত, বহিরঙ্গে সকল মানুষকেই ঈশ্বরপ্রেমী বলে মনে হয়, কিন্তু তাদের মূল তাদের উপাদানের মধ্যে নিহিত—তাহলে যারা দেবদূতের প্রকৃতি-বিশিষ্ট, কীভাবে তারা ঈশ্বরের হাত ফসকে অতল গহ্বরে পতিত হতে পারে? আর যারা দৈত্যের প্রকৃতি-বিশিষ্ট কীভাবে তারা ঈশ্বরকে যথার্থ ভালোবাসতে পারে? এধরনের লোকদের সারসত্য প্রকৃত ঈশ্বরপ্রেমানুগ নয়, তাহলে কেমন করে তারা কখনো রাজ্যে প্রবেশের সুযোগ লাভ করতে পারে? জগৎ-সৃজনের সময়েই ঈশ্বর সকলকিছুর ব্যবস্থা করে ফেলেছিলেন, ঠিক যেমন ঈশ্বর বলেন: “আমি বৃষ্টি ও বাতাসের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হই, এবং মানুষের মাঝে আমি বছরের পর বছর অতিবাহিত করেছি, আর যথাসময়ে আমি বর্তমান দিনে উপনীত হয়েছি। এগুলিই কি সম্যকভাবে আমার পরিচালনামূলক পরিকল্পনার ধাপ নয়? আমার পরিকল্পনায় কে কবে সংযোজন করেছে? আমার পরিকল্পনার পর্যায়গুলি থেকে কে-ই বা অব্যাহতি পেতে পারে?” দেহরূপ ধারণ করার পর ঈশ্বরকে অবশ্যই মানবজীবনের অভিজ্ঞতা লাভ করতে হবে—এটা কি বাস্তববাদী ঈশ্বরের ব্যবহারিক অভিমুখ নয়? ঈশ্বর যে মানুষের দুর্বলতার কারণে মানুষের কাছ থেকে কিছু গোপন করেন, তা নয়; পরিবর্তে, সকল সত্য তিনি মানুষের কাছে উন্মোচিত করে ধরেন, ঠিক যেমনটি ঈশ্বর বলেন: “মানুষের মাঝে আমি বছরের পর বছর অতিবাহিত করেছি।” ঈশ্বর দেহরূপ ধারণ করেছেন বলেই তিনি বছরের পর বছর পৃথিবীতে অতিবাহিত করেছেন; সেই হিসাবে, সকল প্রকার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাওয়ার পরেই তিনি ঈশ্বরের অবতার হিসাবে গণ্য হতে পারেন, এবং একমাত্র তার পরেই দেহরূপে অবস্থানকালে তিনি দেবত্বের মধ্যে কার্য সম্পাদন করতে পারেন। তারপর, সকল রহস্য উদ্ঘাটিত করে ফেলার পরেই, তিনি তাঁর রূপ পরিবর্তনের সুযোগ পান। এটা অতিপ্রাকৃত বৈশিষ্ট্য না থাকার ব্যাখ্যার আর একটি দিক, ঈশ্বর প্রত্যক্ষভাবে যার ইঙ্গিত দিয়েছেন।
কোনোরকম আন্তরিকতাশূন্য দায়সারা মনোভাব প্রদর্শন না করে, ঈশ্বরের প্রতিটি বাক্য অনুসারে যথোপযুক্ত হয়ে ওঠা জরুরি—এ হল ঈশ্বরের অর্পিত দায়িত্ব!