অধ্যায় ২১
ঈশ্বরের চোখে, মানুষ প্রাণীজগতের প্রাণীদের মতোই। তারা পরস্পরের সঙ্গে লড়াই করে, পরস্পরকে হত্যা করে, আর একে অপরের সঙ্গে অসামান্য মিথষ্ক্রিয়া সম্পন্ন করে। ঈশ্বরের চোখে, তারা বানর প্রজাতির মতোও, তারা বয়স বা লিঙ্গ নির্বিশেষে একে অপরের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করে চলেছে। সেইভাবে, সমগ্র মানবজাতি যেসব কর্ম করে আর যা প্রকাশ করে তা কখনই ঈশ্বরের ইচ্ছার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না। ঈশ্বর যে সময়ে তাঁর মুখমণ্ডল ঢেকে ফেলেন সেটি ঠিক সেই সময়ে যখন বিশ্বজুড়ে সকল মানুষ পরীক্ষিত হয়। সব মানুষ যন্ত্রণায় কাতরায়, তারা সকলে বিপর্যয়ের ঝুঁকির মধ্যে বাস করে, আর তাদের মধ্যে একজনও কখনো ঈশ্বরের বিচারের হাত থেকে রেহাই পায়নি। আসলে, ঈশ্বরের দেহে পরিণত হওয়ার প্রাথমিক লক্ষ্য হল মানুষকে বিচার করা এবং তাঁর দেহরূপে মানুষকে তিরস্কার করা। ঈশ্বরের মনে, এটা অনেক পূর্বেই স্থির হয়ে গিয়েছিল যে তাদের উপাদান অনুসারে কাদের উদ্ধার করা অথবা ধ্বংস করা হবে, আর চূড়ান্ত পর্যায়ে এটি ধীরে ধীরে স্পষ্ট করে তোলা হবে। যত দিন আর মাস যায়, মানুষ বদলে যায় আর তাদের আসল রূপ প্রকাশিত হয়। ডিম ফাটলে তার মধ্যে মুরগী আছে নাকি হাঁস সেটা স্পষ্ট হয়ে যায়। ডিম ফাটার সময়টাই হল ঠিক সেই সময় যখন পৃথিবীতে বিপর্যয়ের পরিসমাপ্তি ঘটবে। এ থেকে এটা দেখা যেতে পারে যে, ভিতরে “মুরগী” আছে না “হাঁস” তা জানতে, “ডিমটিকে” ফাটাতেই হবে। এটাই ঈশ্বরের অন্তরের পরিকল্পনা, আর এটি অর্জন করতেই হবে।
“বেচারা, অভাগা মানবজাতি! এমন কেন হয় যে মানুষ আমাকে ভালবাসে, অথচ আমার আত্মার অভিপ্রায় অনুসরণ করতে অক্ষম?” মানুষের এহেন অবস্থার কারণে, ঈশ্বরের ইচ্ছাকে চরিতার্থ করতে তাকে অবশ্যই মোকাবিলা করার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। আর মানবজাতির প্রতি ঈশ্বরের ঘৃণার কারণে, তিনি বহুবার ঘোষণা করেছেন: “হে মানবজাতির বিদ্রোহীসকল! তাদের আমার পদতলে পিষ্ট হতে হবে; আমার শাস্তির মাঝে তাদের বিলীন হয়ে যেতে হবে, এবং আমার মহান উদ্যোগ সম্পূর্ণ হওয়ার দিন মানবজাতির মধ্য থেকে তাদের বহিষ্কৃত হতে হবে, যাতে সমগ্র মানবজাতি তাদের কদর্য চেহারা জানতে পারে।” ঈশ্বর দেহরূপে সকল মানবজাতির সঙ্গে কথা বলছেন, আর আধ্যাত্মিক জগতে তিনি শয়তানের সঙ্গেও কথা বলছেন, যে জগৎ সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের ঊর্ধ্বে। এই হল ঈশ্বরের ইচ্ছা, আর ঈশ্বরের ৬,০০০ বছরের পরিকল্পনার দ্বারা এটিই অর্জন করতে হবে।
বাস্তবে, ঈশ্বর সবিশেষ স্বাভাবিক, আর এমন কিছু বিষয় আছে যা শুধুমাত্র তখনই সাধিত হতে পারে যদি তিনি ব্যক্তিগতভাবে তা সম্পাদন করেন আর স্বচক্ষে তা দেখেন। এটা মানুষ যেরকমটা কল্পনা করে সেরকম নয় যে, ঈশ্বর সেখানে অবস্থান করেন না অথচ সবকিছু তাঁর ইচ্ছামত চলে; এই হল মানুষে মধ্যে শয়তানের উপদ্রবের পরিণতি, যা মানুষকে ঈশ্বরের প্রকৃতও চেহারা সম্পর্কে অনিশ্চিত করে তোলে। সেই অর্থে, চূড়ান্ত পর্যায়ে, ঈশ্বর মানুষের কাছে প্রকাশ্যে তাঁর বাস্তবতা প্রকাশ করার জন্য দেহে পরিণত হয়েছেন, কিচ্ছু গোপন না করে। ঈশ্বরের স্বভাবের কিছু কিছু বর্ণনা একেবারেই অতিরঞ্জন, যেমন যখন বলা হয় যে ঈশ্বর একটিমাত্র বাক্য দ্বারা অথবা সামান্য চিন্তার মাধ্যমে বিশ্বকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দিতে পারেন। ফলস্বরূপ, অধিকাংশ মানুষই এরকম কথা বলে থাকে যেমন, ঈশ্বর কেন সর্বশক্তিমান হয়েও শয়তানকে একগ্রাসে গলাধঃকরণ করতে পারেন না? এই কথাগুলি অর্থহীন, আর এগুলি এটাই প্রমাণ করে যে মানুষ এখনও ঈশ্বরকে জানে না। ঈশ্বরের তাঁর শত্রুদের বিনাশ করার জন্য একটি প্রক্রিয়ার প্রয়োজন, তবে এটা সত্যি যে ঈশ্বর সর্বজয়ী: ঈশ্বর পরিশেষে তাঁর শত্রুদের পরাজিত করবেন। ঠিক যেমন করে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র যখন দুর্বল একটি রাষ্ট্রকে জয় করে, তখন তাকে অবশ্যই ধাপে ধাপে জয় হাসিল করতে হবে, কখনও বল প্রয়োগ করে, কখনও বা কৌশল ব্যবহার করে। তার একটি প্রক্রিয়া আছে, তবে এটা বলা যায় না যে, শক্তিশালী রাষ্ট্রের কাছে নতুন প্রজন্মের পারমানবিক অস্ত্রসমূহ রয়েছে বলে আর দুর্বল রাষ্ট্রটি তুলনায় অনেক নিম্নশ্রেণীর বলেই, দুর্বল রাষ্ট্রটি বিনা লড়াইয়ে হাল ছেড়ে দেবে। এ একেবারেই অর্থহীন এক যুক্তি। এটা বলা ন্যায্য হবে যে শক্তিশালী রাষ্ট্রটি অবশ্যই জয়ী হবে আর দুর্বল রাষ্ট্রটি নির্ঘাত পরাজিত হবে, কিন্তু শক্তিশালী রাষ্ট্রটির বৃহত্তর বাহিনী রয়েছে সেটা শুধু তখনই বলা যাবে যখন সেটি ব্যক্তিগতভাবে দুর্বল রাষ্ট্রকে আক্রমণ করে। তাই, ঈশ্বর সর্বদাই বলেছেন যে মানুষ তাঁকে জানে না। তাহলে, উপরের কথাগুলি কি মানুষ ঈশ্বরকে কেন জানে না তারই একটি দিককে সূচিত করে? এইগুলি কি মানুষের পূর্বধারণা? ঈশ্বর কেন শুধু এটাই চান যে মানুষ তাঁর বাস্তবতাকে জানুক, এবং তাই ব্যক্তিগতভাবে তিনি দেহে পরিণত হয়েছিলেন? এইভাবে, অধিকাংশ মানুষ ভক্তিভরে স্বর্গের উপাসনা করত, অথচ “মানুষের কাজকর্ম দ্বারা স্বর্গ কোনোদিন সামান্যতমও প্রভাবিত হয়নি, আর মানুষের প্রতিটি কার্যকলাপ যদি তার প্রতি আমার আচরণের ভিত্তি হতো, তাহলে সমগ্র মানবজাতিই আমার শাস্তির মধ্যে বসবাস করতো।”
ঈশ্বর মানুষের উপাদানের স্বরূপকে ধরতে পারেন। ঈশ্বরের উচ্চারণে, মানুষের দ্বারা ঈশ্বর এতটাই “প্রপীড়িত” বলে মনে হয় যে মানুষের প্রতি আর মনোযোগ দেওয়ায় তাঁর কোনো আগ্রহও নেই, আর নেই তার কাছ থেকে সামান্যতম প্রত্যাশাও; মানুষ যেন পরিত্রাণের অতীত। “বহু মানুষের অশ্রু আমি তাদের কপোল বেয়ে ঝরে পড়তে দেখেছি, আর অনেক মানুষকে দেখেছি যারা আমার সম্পদের বিনিময়ে তাদের হৃদয় আমায় অর্পণ করে। এইরকম “ধার্মিকতা” সত্ত্বেও, মানুষের আকস্মিক আকুতির কারণে আমি কখনই তাকে অকাতরে আমার সর্বস্ব দিইনি, কারণ মানুষ কখনই সানন্দে আমার কাছে নিজেকে উৎসর্গ করতে ইচ্ছুক ছিল না”। ঈশ্বর যখন মানুষের প্রকৃতিকে উদ্ঘাটিত করেন, মানুষ নিজের প্রতি লজ্জিত বোধ করে, কিন্তু এ হল নেহাৎ-ই অগভীর জ্ঞান, এবং সে ঈশ্বরের বাক্যের মধ্যে তার প্রকৃতিকে সত্যিই জানতে অক্ষম; সুতরাং, অধিকাংশ মানুষই ঈশ্বরের অভিপ্রায় উপলব্ধি করে না, তারা ঈশ্বরের বাক্যে নিজেদের জীবনের জন্য কোনো পথ খুঁজে পায় না, আর তাই তারা যত বেশি স্থূলবুদ্ধির মানুষ হয়, ঈশ্বর তত তীব্র ভাষায় তাদের উপহাস করেন। এইভাবে, তাদের অজান্তেই তারা কদর্যতার ভূমিকায় প্রবেশ করে—আর ফলস্বরূপ, যখন তারা এই “কোমল তলোয়ার” দ্বারা বিদ্ধ হয় তখন তারা নিজেদের চিনতে পারে। ঈশ্বরের বাক্যের আবির্ভাব ঘটে মানুষের কাজের প্রশংসা করতে, এবং মানুষের কাজকে উৎসাহিত করতে—অথচ মানুষ সর্বদা মনে করে যে ঈশ্বর তাদের উপহাস করছেন। আর তাই, তারা যখন ঈশ্বরের বাক্যসমূহ পাঠ করে, তাদের মুখের পেশীগুলি থেকে থেকেই কেঁপে কেঁপে ওঠে, যেন তারা খিঁচুনিতে আক্রান্ত হচ্ছে। এ হল তাদের বিবেকের অশুদ্ধতা, এবং এর কারণেই তারা অনৈচ্ছিকভাবে প্রকম্পিত হয়। তাদের যন্ত্রণাটা হল এমনই যে তারা হাসতে চায়, কিন্তু হাসতে পারে না—আবার না পারে তারা কাঁদতে, কারণ মানুষের হাস্যকর আবদকায়দাগুলি রিমোট কন্ট্রোল “ভি, সি, আর”-এ চলে, অথচ তারা সেটি বন্ধ করতেও পারে না, শুধুই সহ্য করে যেতে হয়। যদিও সকল সহকর্মীদের সভায় “ঈশ্বরের বাক্যে মনোযোগ নিবদ্ধ করা”-র উপদেশ দেওয়া হয়ে থাকে, কিন্তু অতিকায় লাল ড্রাগনের সন্তানসন্ততির প্রকৃতি কে-ই বা না জানে? সামনা-সামনি, তারা মেষশাবকদের মতোই বাধ্য, আর পিছনে ফিরলেই তারা নেকড়েদের মতই নৃশংস, যা ঈশ্বরের এই বাক্যগুলিতে দেখা যেতে পারে যে “যখন আমি আমার বাক্যগুলি সরবরাহ করি তখন অনেকেই আমায় অকৃত্রিমভাবে ভালোবাসে, তবুও তারা তাদের আত্মার মধ্যে আমার বাক্যগুলি লালন করে না, পরিবর্তে উদ্দেশ্যহীনভাবে সেগুলিকে তারা সর্বসাধারণের সম্পত্তির মতো ব্যবহার করে এবং তাদের ইচ্ছেমতো বাক্যগুলি যেখান থেকে এসেছে তারা সেখানেই তাদের ফিরিয়ে দেয়।” ঈশ্বর কেন সর্বদাই মানুষকে অনাবৃত করেন? এতে এটাই প্রতিপন্ন হয় যে মানুষের আদি প্রকৃতি হল দৃঢ় এবং অবিচল। তাই পর্বতের মতো, লক্ষ লক্ষ মানুষের হৃদয়ে তা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে, কিন্তু সেই দিনটি আসবে যখন ইউ গং সেই পর্বতটিকে স্থানচ্যুত করবে; এটি হল ঈশ্বরের পরিকল্পনা। তাঁর উচ্চারণে, এমন কোনো মুহূর্ত নেই যখন ঈশ্বর মানুষের কাছে চাহিদা স্থাপন করেন না, তাদের সতর্ক করে দেন না, অথবা মানুষের সেই প্রকৃতিকে নির্দেশ করেন না যা তার জীবনের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়: “যখন মানুষ আমার কাছ থেকে দূরে থাকে, আর যখন সে আমার পরীক্ষা নেয়, তার কাছ থেকে আমি নিজেকে মেঘরাজির মধ্যে আড়াল করে ফেলি। এর ফলে, সে আমার চিহ্নমাত্র খুঁজে পায় না, আর সে কেবল দুষ্টদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েই জীবনযাপন করে, তারা যা করতে বলে তা-ই করে।” বাস্তবে, মানুষ কদাচিৎ-ই ঈশ্বরের উপস্থিতিতে জীবন নির্বাহ করার সুযোগ পায়, কারণ তাদের অন্বেষণের আকাঙ্ক্ষা অত্যন্ত কম; ফলস্বরূপ, যদিও অধিকাংশ মানুষই ঈশ্বরকে ভালোবাসে, তা সত্ত্বেও তারা শয়তানের নিয়ন্ত্রণের অধীনে বাস করে, আর তারা যা যা করে সে সমস্তই শয়তানের দ্বারা পরিচালিত হয়। মানুষ যদি সত্যিই ঈশ্বরের আলোকের মধ্যে বাস করত, যদি প্রতিটি দিনের প্রতিটি মুহূর্তে ঈশ্বরের অন্বেষণ করত, তাহলে ঈশ্বরকে এইভাবে কথা বলতে হতো না, হতো কি? মানুষ যখন পাঠ্যবস্তুগুলি সরিয়ে রাখে, তৎক্ষণাৎ তারা বইটির সঙ্গেই ঈশ্বরকেও সরিয়ে রাখে, আর তাই তারা তাদের নিজেদের ব্যাপার নিয়ে চিন্তাভাবনায় মগ্ন হয়, যার পরে ঈশ্বর তাদের হৃদয় থেকে অন্তর্হিত হয়ে যান। তবুও, তারা আবার যখন বইটি হাতে তুলে নেয়, তারা হঠাৎ-ই উপলব্ধি করে যে ঈশ্বরকে তারা ভুলে গিয়েছিল। মানুষের “স্মৃতিবিরহিত” জীবন এমনই। ঈশ্বর যতই কথা বলেন, তাঁর বাক্যসমূহও ততই উচ্চমার্গের হয়। সেগুলি যখন তাদের সর্বোচ্চ শিখরে গিয়ে পৌঁছায়, তখন সমস্ত কার্য সম্পন্ন হয়, আর ফলস্বরূপ, ঈশ্বর তাঁর উচ্চারণে ক্ষান্তি দেন। ঈশ্বর যে নীতিতে কার্য সম্পাদন করেন তা হল, তাঁর কার্য সর্বোচ্চ শিখরে পোঁছলে সেটির সমাপ্তি ঘোষণা; একবার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছবার পর তিনি কার্য সম্পাদন অব্যাহত রাখেন না, বরং আচমকাই তা থামিয়ে দেন। তিনি কখনই এমন কোনো কার্য করেন না যা অপ্রয়োজনীয়।