অধ্যায় ১৭
বস্তুত, ঈশ্বরের মুখনিঃসৃত সকল উচ্চারণই মানুষের অজানা; সেগুলির সবই মানুষের অশ্রুত ভাষায় কথিত। সেই অর্থে, বলা যায়, ঈশ্বরের বাক্যগুলি নিজেরাই এক রহস্য। অধিকাংশ মানুষ ভ্রান্তিক্রমে বিশ্বাস করে যে, মানুষ ধারণাগতভাবে যে বিষয়গুলির নাগাল পায় না শুধু সেইগুলিই রহস্যের অন্তর্ভুক্ত, যেমন, স্বর্গের যে বিষয়সমূহ ঈশ্বর বর্তমানে মানুষকে জানতে দেন না, বা আধ্যাত্মিক জগতে ঈশ্বরের সম্পাদিত কার্যাদি বিষয়ক সত্য। এর থেকে, এটি স্পষ্টতই প্রতীয়মান যে ঈশ্বরের সকল বাক্যকে মানুষ সমভাবে বিবেচনা করে না, বা সেগুলিকে তারা মূল্যবান বলে গণ্যও করে না; বরং, যে বিষয়গুলিকে তারা নিজেরা “রহস্য” বলে মনে করে, সেগুলির উপরেই তারা তাদের মনোযোগ নিবদ্ধ করে। এর থেকে প্রমাণ হয় যে, ঈশ্বরের বাক্যসমূহ কী, অথবা রহস্যই বা কী মানুষের তা জানা নেই; তারা নিছক তাদের স্বীয় পূর্বধারণার পরিসরের মধ্যেই তাঁর বাক্যগুলিকে পাঠ করে। বাস্তব ঘটনা হল, এমন একজন মানুষও নেই যে ঈশ্বরের বাক্যগুলিকে প্রকৃতই ভালোবাসে, এবং সম্যকভাবে এটিই তাঁর এই উক্তির মূল কারণ যে “আমায় প্রতারণা করতে মানুষ কুশলী।” ঈশ্বর এমন বলেন না যে মানুষ সম্পূর্ণ গুণহীন বা পুরোদস্তুর বিভ্রান্ত; এই উক্তি মানবজাতির প্রকৃত পরিস্থিতির বিবরণ দেয়। মানুষ নিজেরাই খুব স্পষ্ট করে জানে না ঈশ্বর সত্যিই তাদের অন্তরের কতখানি স্থান জুড়ে অবস্থান করেন; একমাত্র ঈশ্বরই তা সম্পূর্ণরূপে জানেন। তাই, এই মুহূর্তে, মানুষ দুগ্ধপোষ্য শিশুর মতো। কেন তারা স্তন্যদুগ্ধ পান করে এবং কেন তাদের জীবনধারণ করা উচিত, সে বিষয়ে তারা সম্পূর্ণ অনবহিত। কেবলমাত্র মা-ই এক শিশুর প্রয়োজনগুলি বোঝে; তাকে সে অনাহারে মরতে দেবে না, আবার অতিরিক্ত ভোজনের কারণেও শিশুটিকে সে মরতে দেবে না। ঈশ্বরই মানুষের প্রয়োজন সবথেকে ভালো জানেন, তাই কখনো তাঁর বাক্যের মধ্যে তাঁর ভালোবাসা অঙ্গীভূত হয়ে থাকে, কখনো সেগুলির মাধ্যমে তাঁর বিচার প্রকাশিত হয়, কখনো বা তা মানুষের অন্তরের গভীরে গিয়ে তাদের আহত করে, আবার কখনো বাক্যগুলি আন্তরিক ও ঐকান্তিক। এর থেকে মানুষ ঈশ্বরের সদাশয়তা ও অভিগম্যতাকে অনুভব করতে পারে, অনুভব করতে পারে যে তিনি এমন কোনো কল্পিত, ভাবগম্ভীর ব্যক্তিত্ব নন যাকে স্পর্শ করা যায় না। আবার তিনি মানুষের মানসস্থিত সেই স্বর্গপুত্রও নন যার মুখের পানে সরাসরি তাকানো যায় না, এবং মানুষের কল্পনামাফিক নিরপরাধ মানুষের সংহারক কোনো ঘাতক তো তিনি একেবারেই নন। ঈশ্বরের সামগ্রিক স্বভাব তাঁর কার্যের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়; আজকের দেহরূপী ঈশ্বরের স্বভাব এখনও তাঁর কার্যের মধ্য দিয়েই মূর্ত হয়ে ওঠে। তাই, তাঁর সেবাব্রত হল বাক্যের সেবাব্রত, তিনি যা সম্পাদন করেন বা বাহ্যিকভাবে তাঁকে যেমন মনে হয় তার নয়। অন্তিমে, ঈশ্বরের বাক্যের মাধ্যমে সকলেই নৈতিক উন্নতিসাধন করবে, এবং সেগুলির দ্বারা সম্পূর্ণ হয়ে উঠবে। ঈশ্বরের বাক্যের দ্বারা পথপ্রদর্শিত হয়ে, মানুষ, তাদের অভিজ্ঞতায়, অনুশীলনের এক পথ লাভ করবে, এবং ঈশ্বরের মুখনিঃসৃত বাক্যের মধ্য দিয়ে, তারা তাঁর সামগ্রিক স্বভাবকে জানতে পারবে। তাঁর বাক্যের কারণে, ঈশ্বরের সকল কার্য নিষ্পন্ন হবে, মানুষ উজ্জীবিত হয়ে উঠবে, এবং সকল শত্রু পরাভূত হবে। এটিই হল প্রাথমিক কাজ, যা কেউ উপেক্ষা করতে পারে না। তাঁর বাক্যের প্রতি লক্ষ্য করা যাক: “আমার উচ্চারণসমূহ বজ্রনির্ঘোষের মতো নিনাদিত হয়, সকল অভিমুখে ও সমগ্র বিশ্বের উপর আলোক সম্পাত করে, এবং বজ্রনিনাদ ও বিদ্যুচ্ছটার মাঝে, মানুষ আঘাতপ্রাপ্ত হয়। বজ্র-বিদ্যুতের মাঝে কোনো মানুষ কখনো অবিচল থাকেনি; আমার আলোকের অভ্যাগমে অধিকাংশ মানুষ আতঙ্কতাড়িত হয়ে হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে এবং কী করবে বুঝে উঠতে পারে না।” ঈশ্বর যখনই মুখব্যাদান করেন, তক্ষুনি বাক্য নির্গত হয়। বাক্যের মাধ্যমেই তিনি সকলকিছু সম্পন্ন করেন, বাক্যের দ্বারাই সমস্ত কিছু রূপান্তরিত হয়, এবং বাক্যের মাধ্যমেই প্রত্যেকে নবায়িত হয়। “বজ্রনির্ঘোষ” কীসের নির্দেশ করে? এবং “আলোক” কাকে সূচিত করে? একটি বিষয়ও ঈশ্বরের বাক্য থেকে অব্যাহতি পায় না। এগুলির সাহায্যে তিনি মানুষের মনকে অনাবৃত করেন এবং তাদের কদর্যতার বিবরণ দেন; তাদের পুরাতন প্রকৃতির সাথে মোকাবিলা করতে ও তাঁর সকল লোকজনকে সম্পূর্ণ করে তুলতে তিনি বাক্যকে ব্যবহার করেন। সম্যকভাবে এটাই কি ঈশ্বরের বাক্যের গুরুত্ব নয়? সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে, ঈশ্বরের বাক্যের সহায়তা ও সুরক্ষা ব্যতীত, সমগ্র মানবজাতি অনেক আগেই ধ্বংসপ্রাপ্ত হতো, অস্তিত্বলোপের দোরগোড়ায় গিয়ে উপনীত হতো। এটিই হল ঈশ্বরের কার্যের নীতি, এবং তাঁর ছয় হাজার বছরের পরিচালনামূলক পরিকল্পনা চলাকালীন এই পদ্ধতিতেই তিনি কার্য সম্পাদন করেন। এতেই ঈশ্বরের কার্যের গুরুত্ব প্রতিপন্ন হয়। তাঁর বাক্যগুলি সরাসরি গিয়ে মানুষের আত্মার অন্তঃস্থলকে বিদ্ধ করে। তাঁর বাক্য শ্রবণমাত্র মানুষ আশ্চর্যান্বিত ও আতঙ্কিত বোধ করে, এবং ক্ষিপ্রগতিতে পলায়ন করে। তারা তাঁর বাক্যের বাস্তবিকতা থেকে পালাতে চায়, এই কারণেই এধরনের “শরণার্থীদের” সর্বত্র দেখা যায়। ঈশ্বরের বাক্যসমুহ নিষ্ক্রান্ত হওয়া মাত্র, মানুষ ছুটে পালায়। এটাই হল ঈশ্বর-চিত্রিত মানবীয় কদর্যতার প্রতিচ্ছবির একটি দিক। এই মুহূর্তে, সকল মানুষ ক্রমশ তাদের হতচেতন অবস্থা থেকে জেগে উঠছে; যেন তারা সকলেই পূর্বে স্মৃতিভ্রংশ রোগে আক্রান্ত হয়েছিল—এবং, এখন ঈশ্বরের বাক্য শ্রবণ করার পর, মনে হয় তারা যেন ঐ রোগের অবশিষ্ট লক্ষণগুলির প্রভাবে ভুগছে, এবং তাদের পূর্বেকার অবস্থা ফিরে পেতে অক্ষম। সকল মানুষ বাস্তবিক এমনই, এবং তা এই বাক্যগুলির এক যথার্থ প্রতিকৃতিও বটে: “বহু মানুষ, এই ক্ষীণ আলোকপ্রভার দ্বারা উদ্দীপিত হয়ে, ক্ষণিকের মধ্যে তাদের দৃষ্টিবিভ্রম থেকে জেগে ওঠে। তবু কেউ কখনো উপলব্ধি করেনি যে সেই দিনটি সমাগত হয়েছে যেদিন আমার আলোক পৃথিবীপৃষ্ঠে অবতরণ করে।” এই কারণেই ঈশ্বর বলেছেন, “আলোকের আকস্মিক অভ্যাগমের কারণে অধিকাংশ মানুষ হতবাক।” বিষয়টিকে এই ভাবে উপস্থাপন করা একেবারে যথাযথ। ঈশ্বর-প্রদত্ত মানবজাতির বর্ণনায় এমনকি সূচাগ্রমাত্র প্রবেশের মতো যৎসামান্য ফাঁকটুকুও নেই, এবং তিনি সত্যিই যথাযথ ও নির্ভুলভাবে এটিকে ব্যক্ত করেছেন, এই কারণেই সকল মানুষ সম্পূর্ণরুপে স্থিতপ্রত্যয় হয়েছে। উপরন্তু, তাদের অগোচরেই, তাদের অন্তঃকরণের গভীরে তাদের ঈশ্বর-প্রেম গড়ে উঠতে শুরু করেছে। একমাত্র এভাবেই তাদের হৃদয়ে ঈশ্বরের অবস্থান আরো অকৃত্রিম হয়ে ওঠে, এবং এ-ও হল ঈশ্বরের কার্যসাধনের এক প্রণালী।
“অধিকাংশ মানুষ কেবলই হতচকিত; আলোকের দ্বারা তাদের দৃষ্টি আহত এবং তারা কর্দমে নিক্ষিপ্ত।” এই ধরনের মানুষগুলি যেহেতু ঈশ্বরের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যায় (অর্থাৎ, তারা ঈশ্বরকে প্রতিরোধ করে), যখন তাঁর বাক্যের আগমন ঘটে, তাদের বিদ্রোহী মনোভাবের কারণে শাস্তি ভোগ করে; এই কারণেই বলা হয় যে, আলোকের হেতু তাদের চোখে পীড়া অনুভব হয়। এহেন ব্যক্তিগণকে ইতিমধ্যেই শয়তানের হাতে অর্পণ করা হয়েছে; তাই, নতুন কার্যে প্রবেশকালে, তাদের আলোকপ্রাপ্তি বা প্রদীপ্তি কোনোটাই থাকে না। যাদের মধ্যে পবিত্র আত্মার কার্য নেই, তারা সকলেই শয়তানের দ্বারা কবলিত, এবং তাদের অন্তরের অন্তঃস্থলে ঈশ্বরের কোনো স্থান নেই। তাই, বলা হয় এই মানুষগুলি “কর্দমে নিক্ষিপ্ত।” এরকম পরিস্থিতিতে স্থিত সকল মানুষই এক বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে রয়েছে। সঠিক দিশাপথে এরা প্রবেশ করতে পারে না, এবং নিজেদের স্বাভাবিকত্ব পুনরুদ্ধার করতেও পারে না; তাদের সকল চিন্তাই বিসদৃশ। পৃথিবীতে সকলেই শয়তানের দ্বারা চূড়ান্তভাবে ভ্রষ্ট হয়েছে। মানুষের জীবনীশক্তি নেই, এবং সে শবদেহের ন্যায় পূতির্গন্ধময়। পৃথিবীর সকল মানুষ রোগজীবাণুবাহিত মহামারীর মধ্যে জীবনধারণ করে, কেউ তা এড়াতে পারে না। তাদের কেউই মর্ত্যলোকে জীবনধারণে ইচ্ছুক নয়, কিন্তু সতত তারা ভাবে যে মানুষের জন্য বৃহত্তর কিছু একটা ঘটবে, যা তারা নিজের চোখেই দেখতে পাবে; সেহেতু, সকল মানুষ জোর করে জীবনযাপন অব্যাহত রাখে। বহু দিন হল তাদের কোনো মনোবল নেই; তারা কেবল তাদের অদৃশ্য আশাকে এক আধ্যাত্মিক স্তম্ভ হিসাবে ব্যবহার করে, এবং এই ভাবে তারা মানুষ হওয়ার ছলনায় তাদের মাথাকে খাড়া রাখে, এবং কোনোক্রমে পৃথিবীতে তাদের দিনগুলি অতিবাহিত করে। মনে হয় যেন সকল মানুষই শয়তানের অবতারের সন্তানসন্ততি। এই কারণেই ঈশ্বর বলেছেন, “পৃথিবী বিশৃঙ্খলায় আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে, এ এক দুঃসহ রকমের বেদনাবহ দৃশ্য, অভিনিবেশ সহকারে নিরীক্ষণ করলে, আমাদের তা এক দুর্বহ বিষন্নতায় জর্জরিত করে তোলে।” এমনতর পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে বলেই, ঈশ্বর সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড জুড়ে “আমার আত্মার বীজকণিকা ছড়াতে” শুরু করেছিলেন, এবং সমগ্র পৃথিবীব্যাপী তিনি তাঁর পরিত্রাণের কার্য সম্পাদন আরম্ভ করেছিলেন। এই কার্যকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যই ঈশ্বর সকল প্রকার বিপর্যয় বর্ষণ করতে শুরু করেন, এইভাবে কঠোরহৃদয় মানুষদের উদ্ধার করেন। ঈশ্বরের কার্যের পর্যায়গুলিতে, পরিত্রাণ এখনো বিবিধ বিপর্যয়ের আকার ধারণ করে, এবং দণ্ডপ্রাপ্ত কেউই তা এড়াতে পারে না। কেবল অন্তিমেই পৃথিবীর বুকে এরকম এক পরিস্থিতি অর্জন করা সম্ভবপর হবে যা “তৃতীয় স্বর্গের মতো প্রশান্ত: এখানে ছোটো-বড়ো সব জীবন্ত প্রাণীরা সমন্বয়পূর্ণভাবে সহাবস্থান করে, একবারের জন্যও ‘খাদ্য-খাদকের দ্বন্দ্ব’-এ লিপ্ত হয় না।” ঈশ্বরের কার্যের একটি দিক হল সমগ্র মানবজাতিকে জয় করা এবং তাঁর বাক্যের মাধ্যমে মনোনীত লোকদের অর্জন করা; আরেকটি দিক হল বিভিন্ন বিপর্যয়ের সহায়তায় বিদ্রোহের সকল সন্তানকে জয় করা। ঈশ্বরের বৃহদায়তন কার্যের এটি হল একটি অংশ। একমাত্র এই উপায়েই ধরাতলে ঈশ্বরের কাঙ্ক্ষিত রাজ্য সম্পূর্ণরূপে অর্জিত হতে পারে, এবং তাঁর কার্যের এই অংশটি বিশুদ্ধ সোনার মতো খাঁটি।
ঈশ্বর ক্রমাগত দাবি করেন মানুষ যেন স্বর্গের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াগুলিকে উপলব্ধি করে। তারা কি সত্যিই তা অর্জন করতে পারে? বাস্তবটা হল, ৫,৯০০ বছরের অধিক কালব্যাপী শয়তানের দ্বারা কলুষিত হওয়ার পর মানুষের যা বাস্তব বর্তমান পরিস্থিতি, তার উপর ভিত্তি করে, তারা পিতরের সমকক্ষ হতে পারে না; সেই অর্থে, তারা তা অর্জন করতে মোটেই সমর্থ নয়। এই হল ঈশ্বরের কার্যের অন্যতম পদ্ধতি। মানুষকে তিনি নিষ্ক্রিয়ভাবে অপেক্ষারত থাকতে দেবেন না; পরিবর্তে, তিনি তাদের সক্রিয় সন্ধানে নিয়োজিত করবেন। কেবল এভাবেই ঈশ্বর মানুষের মধ্যে কার্য সম্পাদনের সুযোগ পাবেন। তোমায় আরেকটু ব্যাখ্যাদান করা ভালো; নাহলে, মানুষ কেবল এক ভাসাভাসা উপলব্ধি লাভ করবে। মানবজাতির সৃজন ও তাদের আত্মাদান সম্পন্ন করার পর, ঈশ্বর তাদের আদেশ করেন যে, তারা যদি তাঁকে আহ্বান না করে, তাহলে তাঁর আত্মার সঙ্গে তারা সংযোগস্থাপন করতে পারবে না, এবং এভাবে, স্বর্গ থেকে আগত “কৃত্রিম উপগ্রহ-চালিত দূরদর্শন সম্প্রসারণ” পৃথিবীর গ্রাহকযন্ত্রে ধরা অসম্ভব হয়ে পড়বে। যখন ঈশ্বর আর মানুষের আত্মায় অবস্থান করেন না, তখন অন্য সামগ্রীর অধিকারের জন্য একটি আসন ফাঁকা পড়ে থাকে, এবং শয়তান এভাবে অনুপ্রবেশ করার এই সুযোগটি লুফে নেয়। মানুষ যখন তাদের অন্তর থেকে ঈশ্বরের সাথে যোগাযোগ করে, শয়তান তৎক্ষণাৎ আতঙ্কিত হয়ে সবেগে পলায়ন করে। মানবজাতির ক্রন্দনধ্বনি শুনে, ঈশ্বর তাদের প্রয়োজনীয় সবকিছু দেন, কিন্তু শুরুতেই তিনি তাদের অভ্যন্তরে “বসবাস” করেন না। তাদের কান্নার দরুন তিনি ক্রমাগত শুধু তাদের সহায়তা করেন, এবং সেই অভ্যন্তরীণ শক্তি থেকে মানুষ বলিষ্ঠতা লাভ করে, যাতে শয়তান তার ইচ্ছামতো “খেলতে” আসার স্পর্ধা করে না। তাই, মানুষ যদি সদাসর্বদা ঈশ্বরের আত্মার সঙ্গে সংযুক্ত থাকে, তাহলে শয়তান এসে ব্যাঘাত সৃষ্টির স্পর্ধা করে না। শয়তানের বিঘ্নসাধন না থাকলে, সকল মানুষের জীবন হয় স্বাভাবিক, এবং ঈশ্বর তখন তাদের ভিতর নির্বাধে কাজ করার সুযোগ পান। সেই অর্থে, ঈশ্বর যা করতে চান, তা মানুষের মাধ্যমেই অর্জিত হতে পারে। এর থেকে জানা যায় যে, ঈশ্বর সর্বদাই কেন মানুষকে তাদের বিশ্বাস বর্ধিত করতে বলেছেন, এবং কেনই বা তিনি বলেছেন, “পৃথিবীতে মানুষের আত্মিক উচ্চতা অনুযায়ী উপযুক্ত চাহিদাগুলি আমি পেশ করি। আমি কখনো কাউকে সমস্যার মধ্যে ফেলিনি, এবং আমার তুষ্টির নিমিত্ত কাউকে কখনো ‘তার রক্ত নিংড়ে দিতে’ বলিনি।” অধিকাংশ মানুষ ঈশ্বরের চাহিদাগুলির কারণে বিহ্বল। তারা ভেবে অবাক হয় যে, মানুষের যদি সেই মানসিক ক্ষমতা না-ই থাকে, এবং তারা যদি শয়তানের দ্বারা সংশোধনাতীতভাবে ভ্রষ্ট হয়ে গিয়েই থাকে, তাহলে ঈশ্বর কেন এখনো তাদের কাছে চাহিদা পেশ করেন। ঈশ্বর কি মানুষকে এক জটিল পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দিচ্ছেন না? তাদের ভাবগম্ভীর মুখ দেখে, এবং তারপর তাদের বিব্রত চাহনি দেখে, হাসি চেপে রাখা কঠিন। মানুষের বিভিন্ন কদর্য অবয়বগুলি সবচেয়ে হাস্যকর: কখনো, তারা খেলতে ভালোবাসা শিশুদের মতো, আবার কখনো বা, তারা “মায়ের” সঙ্গে ক্রীড়ারত এক ছোট বালিকার মতো। কখনো তারা ইঁদুর ভক্ষণরত কোনো কুকুরের মতো। তাদের এই সমস্ত কুৎসিত অবস্থাগুলি দেখে হাসবো কি কাঁদবো ভেবে ওঠা দায়, এবং প্রায়শই, ঈশ্বরের ইচ্ছাগুলি মানুষ যত কম উপলব্ধি করতে পারে, তাদের বিপত্তিতে পড়ার সম্ভাবনা তত বেশি। এই কারণেই, ঈশ্বরের এই বাক্যটি—“আমি কি সেই ঈশ্বর, যিনি কেবলমাত্র সৃষ্টির উপর নীরবতাই জারি করেন?”—মানুষ যে কতটা মূর্খ তা পর্যাপ্তরূপে প্রতিপন্ন করে, এবং বাক্যটি এ-ও জানায় যে, কোনো মানুষই ঈশ্বরের ইচ্ছা বুঝতে পারে না। এমনকি তিনি যদি তাঁর ইচ্ছা স্বকণ্ঠে ব্যক্তও করেন, তবু তারা এর প্রতি সহানুভূতিশীল হতে অক্ষম। তারা কেবল মানুষের ইচ্ছা অনুযায়ী ঈশ্বরের কার্য সম্পন্ন করে। তাহলে, কীভাবে তারা তাঁর ইচ্ছা উপলব্ধি করতে পারে? “পৃথিবীর বুকে আমি ভ্রমণে যাই, সর্বত্র আমার সৌরভ বিকীর্ণ করি, এবং, সর্বস্থানে, আমি আমার অবয়ব রেখে যাই। সকল স্থান আমার কণ্ঠধ্বনিতে অনুরণিত হয়। সর্বত্র মানুষ বিগতদিনের মনোরম দৃশ্যপটে কালাতিপাত করে, কারণ সকল মানুষ অতীতদিনকে স্মরণ করছে …” রাজ্য গঠিত হওয়ার পর পরিস্থিতিটা এমনই দাঁড়াবে। বস্তুত, নানান স্থানে, ঈশ্বর ইতিমধ্যেই রাজ্যের বাস্তবায়নের সৌন্দর্যের ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, এবং এই সমস্তই সম্মিলিতভাবে রাজ্যের এক সম্পূর্ণ চিত্র নির্মাণ করে। কিন্তু, মানুষ এর প্রতি কোনো মনোযোগ দেয় না; তারা নিছক রঙ্গচিত্রজ্ঞানে তা অবলোকন করে।
কয়েক সহস্র বছরব্যাপী শয়তানের ভ্রষ্ট আচরণের কারণে, মানুষ সর্বদা অন্ধকারের মধ্যেই বাস করেছে, তাই অন্ধকারের কারণে তাদের কোনো সমস্যা হয় না, এবং তারা আলোর আকাঙ্ক্ষাও করে না। এর ফলে নিম্নবর্ণিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, সুতরাং, আজ যখন আলোকের অভ্যুদয় হয়, “তখন তারা সকলেই আমার আগমনের প্রতি বিমুখ, এবং আলোকের অভ্যাগমকে তারা নির্বাসিত করে, যেন স্বর্গে আমি মানুষের শত্রু ছিলাম। স্বীয় দৃষ্টিতে এক রক্ষণাত্মক উদ্ভাস নিয়ে মানুষ আমায় সম্ভাষণ করে।” যদিও অধিকাংশ মানুষ আন্তরিকভাবেই ঈশ্বরকে ভালোবাসতে চেষ্টা করে, তবু এখনো তিনি সন্তুষ্ট নন, এবং এখনো তিনি মানবজাতিকে দোষী সাব্যস্ত করেন। মানুষের কাছে এটি বিহ্বলকর। তারা অন্ধকারে বাস করে বলে, আলোর অনুপস্থিতিতে তারা যেভাবে ঈশ্বরের সেবা করতো, এখনো সেভাবেই তা করে। অর্থাৎ, সকল মানুষ স্বীয় পূর্বধারণা ব্যবহার করে ঈশ্বরের সেবা করে, এবং যখন তাঁর আগমন ঘটে, তখন তাদের পরিস্থিতি হয় এমনই, এবং নতুন আলোকে স্বীকার করে তারা তাঁর সেবা করতে অক্ষম; বরং, নিজেদের সকল অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই তারা তাঁর সেবা করে। মানবজাতির “ভক্তি”-তে ঈশ্বর আনন্দ লাভ করেন না, তাই আঁধারে নিমজ্জিত মানুষ আলোর স্তুতি করতে পারে না। এই কারণেই ঈশ্বর উপরের বাক্যগুলি উচ্চারণ করেছিলেন; এটি মোটেই বাস্তববিরোধী নয়, এবং তা মানবজাতির প্রতি ঈশ্বরের দুর্ব্যবহার নয়, বা তাদের প্রতি এটি তাঁর অন্যায় আচরণও নয়। বিশ্বসৃষ্টির পর থেকে আজ পর্যন্ত, একটি মানুষও প্রকৃত অর্থে ঈশ্বরের ক্রোধ আস্বাদন করেনি; সকল মানুষ ঈশ্বরের প্রতি রক্ষণাত্বক থেকেছে, ভীষণ ভয় পেয়েছে যে, তিনি বুঝি তাদের আঘাত করে নিশ্চিহ্ন করবেন। এইভাবে, এই ৬,০০০ বছর ব্যাপী, মানুষের আন্তরিকতার বিনিময়ে ঈশ্বর সর্বদাই উষ্ণতা প্রদান করেছেন, এবং প্রতিটি মোড়ে ধৈর্যসহকারে তাদের পথ দেখিয়ে গিয়েছেন। মানুষ এত দুর্বল বলে, এবং ঈশ্বরের ইচ্ছা তারা সম্পূর্ণরূপে জানতে বা তাঁকে সর্বান্তকরণে ভালোবাসতে অক্ষম বলে, তারা শয়তানের কৌশলের শিকার না হয়ে পারে না। তবু, ঈশ্বর সহিষ্ণু থাকেন, তারপর একদিন, এত ধৈর্য অবলম্বনের পর—অর্থাৎ, যখন তিনি বিশ্বকে নবায়িত করেন—তিনি আর মায়ের মতো করে মানুষের তত্ত্বাবধান করবেন না। পরিবর্তে, মানুষকে তিনি উপযুক্ত শাস্তি বিধান করেন। এই কারণে, তখন এই ঘটনা ঘটবে: “সমুদ্রের উপরিতলে শবদেহ ভেসে বেড়ায়,” অন্য দিকে “জলশূন্য অঞ্চলসমূহে, অন্যান্য মানুষসকল, হাস্যগীতির মাঝে, তাদের কাছে যে অঙ্গীকারসমূহ আমি সানুগ্রহে প্রদান করেছি এখনো তা উপভোগ করে।” এ হল দণ্ডপ্রাপ্ত ও পুরস্কৃত মানুষের গন্তব্যের মধ্যে এক তুলনা। “সমুদ্রের উপরিতল” ঈশ্বর-কথিত মানবজাতির শাস্তির অতল গহ্বরকে নির্দেশ করে। এ-ই হল শয়তানের গন্তব্য, এবং এ-ই হল তাঁর প্রতিরোধকারী ব্যক্তিগণের উদ্দেশ্যে ঈশ্বর-নির্মিত “বিশ্রামস্থল”। ঈশ্বর সর্বদাই মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসা চেয়েছেন, তবু মানুষ তা জানে না, এবং এই বিষয়টির প্রতি তারা অসংবেদনশীল, এবং এখনো তারা নিজেদের কাজই করে যায়। এই কারণে, তাঁর সকল বাক্যে, ঈশ্বর সর্বদাই মানুষের কাছ থেকে নানা্নকিছু দাবি করেন এবং তাদের ঘাটতিগুলির প্রতি অঙ্গুলিনির্দেশ করেন, এবং তাদের জন্য সেই অনুশীলনের পথটির প্রতি নির্দেশ করেন, যা তারা এই বাক্যগুলির মাধ্যমে অনুসরণ করতে পারে। মানুষের প্রতি তিনি তাঁর নিজের মনোভাব ব্যক্ত করেছেন: “তবু কখনো দৈবাৎ আমি খেলনা ভেবে একটি মনুষ্যজীবনকে নিয়েও খেলা করিনি। মানুষ যে বেদনা অনুভব করেছে ও যে মূল্য সে পরিশোধ করেছে তা আমি লক্ষ্য করেছি। যখন সে আমার সম্মুখে এসে দাঁড়ায়, মানুষকে শাস্তি দেওয়ার জন্য তাকে আমি অপ্রস্তুত অবস্থায় পাকড়াও করতে চাই না, কিংবা কোনো অবাঞ্ছিত বস্তু মানুষের উপর চাপিয়ে দিতেও আমি চাই না। পরিবর্তে, সদাসর্বদা, মানুষকে আমি শুধু সংস্থান যুগিয়েছি ও প্রদান করেছি।” মানুষ যখন ঈশ্বর-কথিত এই বাক্যগুলি পাঠ করে, তৎক্ষণাৎ তারা তাঁর আন্তরিকতাকে অনুভব করে, এবং চিন্তা করে: সত্যিই তো, অতীতে ঈশ্বরের নিমিত্ত আমি এক মূল্য পরিশোধ করেছিলাম, কিন্তু তাঁর সাথে আমি দায়সারা আচরণও করেছি, এবং মাঝে মাঝে তাঁর কাছে অনুযোগ করেছি। ঈশ্বর তাঁর বাক্যের মাধ্যমে সবসময় আমায় পথনির্দেশ দান করেছেন, এবং আমার জীবনের বিষয়ে তিনি এত খেয়াল রাখেন, তবু সময়ে সময়ে তা নিয়ে আমি খেলনাজ্ঞানে খেলাধুলা করি। সত্যিই আমার তা করা অনুচিত। ঈশ্বর আমায় এত ভালোবাসেন, তাহলে কেন আমি যথেষ্ট পরিমাণে কঠোর প্রচেষ্টা করতে পারি না? এরকম চিন্তা যখন তাদের মনে উদয় হয়, তখন তারা সত্যিই তাদের নিজের গালে চপেটাঘাত করতে চায়, এবং এমনকি কিছু লোকের নাক কেঁপে ওঠে আর তারা তারস্বরে আর্তনাদ করে ওঠে। তারা কী চিন্তা করে ঈশ্বর তা বোঝেন, এবং সেই অনুযায়ীই বক্তব্য রাখেন, এবং এই কতিপয় বাক্য—যেগুলি কঠোর অথবা কোমল কোনোটাই নয়—তাঁর প্রতি মানুষের প্রেমকে প্রণোদিত করে। অন্তিমে, মেদিনীবক্ষে যখন রাজ্য গঠিত হবে, তখন তাঁর কার্যধারার পরিবর্তনের বিষয়ে ঈশ্বর ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন: ঈশ্বর যখন পৃথিবীর বুকে বিরাজ করবেন, মানুষ তখন বিপর্যয় ও দুর্দৈব থেকে মুক্ত হতে সক্ষম হবে, এবং অনুগ্রহের ওম উপভোগ করতে পারবে; কিন্তু, যখন তিনি সেই মহান দিবসে বিচার শুরু করবেন, সেই সময়েই তিনি সকল মানুষের মধ্যে অবতীর্ণ হবেন, এবং পৃথিবীতে তাঁর সকল কার্য সম্পূর্ণ হবে। সেই সময়ে, সেই দিনটি যেহেতু আগত হবে, বাইবেলে যেমন লিখিত ছিল ঠিক তেমনই ঘটবে: “যে অন্যায় করে, সে তবু অন্যায় করুক: এবং যে পবিত্র, সে তবু পবিত্র থাকুক।” অসাধু ব্যক্তি বিচারের সম্মুখীন হবে, এবং পুণ্যাত্মা ব্যক্তিরা সিংহাসনের সম্মুখে সমাগত হবে। একজন মানুষও ঈশ্বরের প্রশ্রয় লাভে সমর্থ হবে না; এমনকি রাজ্যের সন্তান ও লোকেরাও নয়। এই সবকিছুই হল ঈশ্বরের ন্যায়পরায়ণতা, এবং এই সমস্তই তাঁর স্বভাবের এক উদ্ঘাটন। দ্বিতীয়বার তিনি মানবজাতির দুর্বলতার দরুন উৎকণ্ঠা প্রকাশ করবেন না।