ঈশ্বরের কর্ম, ঈশ্বরের স্বভাব এবং স্বয়ং ঈশ্বর ৩

আমাদের বিগত কয়েকটি আলাপ-আলোচনা তোমাদের প্রত্যেকের উপর গভীর ছাপ ফেলেছিল। এখন যা পরিস্থিতি, তাতে মানুষ অবশেষে ঈশ্বরের প্রকৃত অস্তিত্বকে যথার্থই অনুভব করতে পারে, এবং অনুভব করতে পারে, যে, ঈশ্বর প্রকৃতপক্ষে মানুষের অত্যন্ত সন্নিকটেই রয়েছেন। যদিও মানুষ হয়তো অনেক বছর ধরেই ঈশ্বরে বিশ্বাস করেছে, কিন্তু তারা কখনো আজকের মতো করে তাঁর চিন্তা ও ধারণাকে সত্যিকারের উপলব্ধি করেনি, এবং তাঁর ব্যবহারিক কাজকর্মকেও আজকের মতো করে যথার্থরূপে অনুভব করেনি। জ্ঞানের ক্ষেত্রেই হোক বা বাস্তব অনুশীলনে, অধিকাংশ মানুষ নতুন কিছু শিখেছে এবং উন্নততর উপলব্ধি অর্জন করেছে, এবং তারা তাদের অতীত অনুসরণের ভ্রান্তিটি ধরতে পেরেছে, তাদের অভিজ্ঞতার অগভীরতা উপলব্ধি করেছে, বুঝেছে যে তাদের অভিজ্ঞতার অনেকখানি ঈশ্বরের ইচ্ছার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, এবং হৃদয়ঙ্গম করেছে যে মানুষের সবচেয়ে বড়ো ঘাটতি রয়েছে ঈশ্বরের স্বভাব বিষয়ক জ্ঞানের ক্ষেত্রে। মানুষের অর্জিত এই যে জ্ঞান, তা নিছক এক প্রকারের প্রত্যক্ষণ-ভিত্তিক জ্ঞান; যুক্তিসিদ্ধ জ্ঞানের পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিটির অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে তা ক্রমাগত গভীরতর ও বলিষ্ঠতর হওয়া প্রয়োজন। মানুষ যথার্থ অর্থে ঈশ্বরকে উপলব্ধি করার পূর্বে, বিষয়গতভাবে বলা যায় যে, তাদের অন্তরে তারা ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে ঠিকই, কিন্তু নির্দিষ্ট কিছু প্রশ্নের বিষয়ে তাদের বাস্তব কোনো উপলব্ধি নেই, যেমন, তিনি ঠিক কী ধরনের ঈশ্বর, তাঁর ইচ্ছা কী, তাঁর স্বভাব কেমন, এবং মানবজাতির প্রতি তাঁর যথার্থ মনোভাবটি কীরূপ? এই কারণে, মানুষের ঈশ্বরবিশ্বাসের ভিত্তি অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ে, এবং তাদের বিশ্বাস কখনো বিশুদ্ধতা বা ত্রুটিহীনতা অর্জন করতে পারে না। এমনকি তুমি যদি ঈশ্বরের বাক্যের মুখোমুখি দাঁড়াও, বা তোমার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে তুমি ঈশ্বরের সাক্ষাৎ পেয়েছো বলে অনুভব করো, তবু, তুমি যে তাঁকে সম্পূর্ণভাবে উপলব্ধি করো, এমনটা বলা যায় না। কারণ তুমি ঈশ্বরের চিন্তাধারা জানো না, জানো না তিনি কী পছন্দ করেন ও কী ঘৃণা করেন, কীসে তিনি রাগান্বিত হন ও কী তাঁকে আনন্দ এনে দেয়, তাই তাঁর সম্বন্ধে তোমার প্রকৃত উপলব্ধি নেই। তোমার বিশ্বাস অস্পষ্টতা ও কল্পনার এক বুনিয়াদের উপর নির্মিত, তা দাঁড়িয়ে রয়েছে তোমার বিষয়নিষ্ঠ বাসনার ভিত্তির উপর। এখনো তা আদৌ কোনো প্রামাণিক বিশ্বাস নয়, এবং তুমি এখনো আদৌ কোনো প্রকৃত অনুসরণকারী হয়ে উঠতে পারো নি। বাইবেলের এই গল্পগুলি থেকে নেওয়া উদাহরণসমূহের ব্যাখ্যা মানুষকে ঈশ্বরের অন্তরকে জানতে দিয়েছে, জানতে দিয়েছে তাঁর কার্যের প্রতিটি পদক্ষেপে তিনি কী ভাবছিলেন আর এই কার্য তিনি কেন সম্পন্ন করেছিলেন, সম্পন্ন করার সময় তাঁর আদি অভিপ্রায় ও পরিকল্পনা কী ছিল, তাঁর ধারণাগুলিকে তিনি কীভাবে অর্জন করেছিলেন, এবং কীভাবে তিনি তাঁর পরিকল্পনার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন ও তা বিকশিত করেছিলেন। এই গল্পগুলির মাধ্যমে ছয় হাজার বৎসরব্যাপী ঈশ্বরের পরিচালনামূলক কার্য চলাকালীন সময়ে তাঁর প্রতিটি বিশেষ অভিপ্রায় ও প্রতিটি বাস্তব চিন্তাভাবনা, এবং বিভিন্ন সময় ও বিভিন্ন যুগে মানুষের প্রতি তাঁর মনোভাব বিষয়ে আমরা একটা বিশদ ও সুনির্দিষ্ট উপলব্ধি লাভ করতে পারি। ঈশ্বর কী ভাবছিলেন, তাঁর মনোভাব কী ছিল, এবং প্রতিটি পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে যে স্বভাব তিনি ব্যক্ত করেছিলেন, তা যদি মানুষ উপলব্ধি করতে পারে, তাহলে প্রত্যেক মানুষকে তা ঈশ্বরের প্রকৃত অস্তিত্বকে আরো গভীরভাবে অনুধাবন করতে, এবং তাঁর ব্যবহারিকতা ও প্রামাণিকতাকে আরো গভীরভাবে অনুভব করতে সহায়তা করতে পারে। মানুষকে বাইবেলের ইতিহাস বিদিত করা, অথবা বাইবেলের পদ্য বা এর লোকজনের সাথে পরিচিত হতে তাদের সাহায্য করা আমার এই গল্পগুলি বলার লক্ষ্য নয়, এবং বিশেষ করে, বিধানের যুগে ঈশ্বর যা করেছিলেন তার প্রেক্ষাপট উপলব্ধিতে মানুষকে সহায়তা করা তো একেবারেই লক্ষ্য নয়। বরং লক্ষ্য হল ঈশ্বরের ইচ্ছা, তাঁর স্বভাব, ও তাঁর যাবতীয় খুঁটিনাটি প্রণিধান করতে, এবং ঈশ্বরের বিষয়ে আরো প্রামাণ্য ও আরো যথাযথ এক উপলব্ধি ও জ্ঞান অর্জন করতে মানুষকে সহায়তা করা। এইভাবে, মানুষের হৃদয় একটু-একটু করে ঈশ্বরের কাছে উন্মীলিত হতে পারে, ঈশ্বরের অন্তরঙ্গ হয়ে উঠতে পারে, এবং তারা তাঁকে, তাঁর স্বভাবকে, তাঁর সারসত্যকে আরো ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারে, এবং স্বয়ং সত্য ঈশ্বরকে আরো ভালোভাবে জানতে পারে।

ঈশ্বরের স্বভাব এবং তাঁর যা আছে ও তিনি যা, সেই বিষয়ে জ্ঞান মানুষের উপর একটা ইতিবাচক প্রভাব রাখতে পারে। ঈশ্বরের উপর আরো ভরসা করতে এবং তাঁর প্রতি প্রকৃত আনুগত্য ও ভীতি অর্জন করতে এটি তাদের সহায় হতে পারে। তখন, আর তারা অন্ধের মতো তাঁর অনুসরণ বা আরাধনা করবে না। ঈশ্বর নির্বোধ বা অন্ধভাবে জনস্রোতে গা ভাসানো মানুষদের কামনা করেন না, বরং তিনি এমন একদল মানুষকে চান, যারা তাদের অন্তরে ঈশ্বরের স্বভাব বিষয়ে এক স্বচ্ছ উপলব্ধি ও জ্ঞনের অধিকারী এবং এমন মানুষ, যারা ঈশ্বরের সাক্ষীরূপে ভূমিকা পালনে সক্ষম, যারা ঈশ্বরের মাধুর্য, তাঁর যা আছে ও তিনি যা, এবং তাঁর ধার্মিক স্বভাবের কারণে, কখনো তাঁকে পরিত্যাগ করবে না। ঈশ্বরের একজন অনুসরণকারী হিসাবে তোমার অন্তরে এখনো যদি স্বচ্ছতার অভাব থাকে, অথবা ঈশ্বরের প্রকৃত অস্তিত্ব, তাঁর স্বভাব, তাঁর যা আছে ও তিনি যা, এবং মানবজাতির ত্রানের জন্য তাঁর পরিকল্পনার বিষয়ে অনিশ্চয়তা বা বিভ্রান্তি থাকে, তাহলে তোমার বিশ্বাস ঈশ্বরের প্রশংসালাভ করতে পারে না। এই ধরনের মানুষ তাঁকে অনুসরণ করুক, ঈশ্বর তা চান না, এবং তাঁর পছন্দ নয় যে এজাতীয় মানুষ তাঁর সামনে আসুক। এহেন মানুষজন ঈশ্বরকে উপলব্ধি করে না বলে তারা তাদের হৃদয় ঈশ্বরকে নিবেদন করতে অক্ষম—তাঁর প্রতি তাদের হৃদয় অবরুদ্ধ, তাই তাদের ঈশ্বর-বিশ্বাস অশুদ্ধিতে পরিপূর্ণ। তাদের ঈশ্বরানুসরণকে নিছক অন্ধ-অনুসরণ বলা যেতে পারে। কেবল ঈশ্বর সম্পর্কে প্রকৃত উপলব্ধি ও জ্ঞান থাকলেই মানুষ প্রকৃত বিশ্বাস অর্জন করতে ও প্রকৃত অনুসরণকারী হতে পারে, এবং এই জ্ঞান ও উপলব্ধি তাদের মধ্যে যথার্থ আনুগত্য ও ঈশ্বরভীতি উৎপন্ন করে। একমাত্র এই ভাবেই তারা তাদের হৃদয় ঈশ্বরকে নিবেদন করতে এবং তা ঈশ্বরের প্রতি উন্মুক্ত করতে পারে। ঈশ্বর সেটাই চান, কারণ তাদের সকল কাজকর্ম ও চিন্তাভাবনা ঈশ্বরের পরীক্ষা সহন করতে ও ঈশ্বরের সাক্ষ্য প্রদান করতে সমর্থ। ঈশ্বরের স্বভাব, বা তাঁর যা আছে ও তিনি যা, বা তাঁর প্রতিটি কার্যের মধ্যে নিহিত তাঁর ইচ্ছা ও তাঁর চিন্তাভাবনা বিষয়ে যাকিছু আমি তোমাদের জ্ঞাপন করি, এবং যে পরিপ্রেক্ষিত বা যে দৃষ্টকোণ থেকেই এবিষয়ে আলোচনা করি না কেন, এই সবকিছুই ঈশ্বরের প্রকৃত অস্তিত্ব বিষয়ে নিশ্চিততর হতে তোমাদের সাহায্য করার জন্য, এবং মানবজাতির প্রতি তাঁর ভালোবাসা, মানুষের জন্য তাঁর উদ্বেগ, তথা মানবজাতিকে পরিচালনা ও উদ্ধার করার জন্য তাঁর আন্তরিক কামনাকে আরো যথার্থরূপে উপলব্ধি ও সমাদর করার নিমিত্ত।

বিশ্বসৃষ্টির পর থেকে, ঈশ্বরের চিন্তাভাবনা, ধ্যানধারণা ও কার্যকলাপের পর্যালোচনা

আজ আমরা প্রথমে ঈশ্বরের দ্বারা মানবজাতি সৃষ্টির পর থেকে তাঁর চিন্তাভাবনা, ধ্যানধারণা, এবং তাঁর প্রতিটি কর্মপদক্ষেপ সংক্ষেপে উপস্থাপিত করবো। বিশ্বসৃষ্টির পর থেকে অনুগ্রহের যুগের আনুষ্ঠানিক সূচনা পর্যন্ত যে কার্যগুলি তিনি নিষ্পন্ন করেছেন, সেগুলির দিকে আমরা দৃষ্টিপাত করবো। ঈশ্বরের যে চিন্তাভাবনা ও ধ্যানধারণাগুলি মানুষের অজানা, সেগুলি আমরা তখন আবিষ্কার করতে পারবো, এবং সেখান থেকে আমরা ঈশ্বরের পরিচালনামূলক পরিকল্পনার অনুক্রমটি স্পষ্টভাবে বুঝে নিতে পারবো, এবং যে পটভূমিকায় ঈশ্বর তাঁর পরিচালনামূলক কার্য সৃজন করেন, সেই কার্যের উৎস ও বিকাশের পদ্ধতি, আর তাঁর পরিচালনামূলক কার্য থেকে তিনি যে ফলাফল লাভ করতে চান—অর্থাৎ, তাঁর পরিচালনামূলক কার্যের মর্মবস্তু ও উদ্দেশ্যকে আমরা বিশদভাবে উপলব্ধি করতে পারবো। এই বিষয়গুলি উপলব্ধি করার জন্য আমাদের প্রত্যাবর্তন করতে হবে এক সুদূর, নিস্পন্দ ও নীরব সময়ে, যখন কোনো মানুষ ছিল না …

ঈশ্বর ব্যক্তিগতভাবে প্রথম জীবন্ত মানুষের সৃষ্টি করলেন

তাঁর শয্যা থেকে উত্থিত হওয়ার পর প্রথম যে চিন্তাটি ঈশ্বরের মনে উদিত হয়েছিল তা হল: এক জীবন্ত মানুষ সৃজন করা—এক বাস্তব, জীবন্ত মানুষ—যার সঙ্গে তিনি বসবাস করবেন ও যে তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী হবে; এই মানুষটি তাঁর কথা শ্রবণ করতে পারবে, এবং তিনি বিশ্বাসস্থাপন করে তার সঙ্গে কথা বলতে পারবেন। তারপর, প্রথমবারের মতো, তিনি একমুঠো কাদা হাতে তুলে নেন এবং তা দিয়ে তাঁর মনে যে মূর্তি তিনি কল্পনা করেছিলেন সেই অনুযায়ী সর্বপ্রথম জীবন্ত মানুষটিকে সৃষ্টি করেন, এবং তারপর এই জীবন্ত প্রাণীটির তিনি একটি নাম দেন—আদম। এই জীবন্ত ও শ্বাসরত মানুষটিকে পাওয়ার পর তাঁর কেমন অনুভূতি হয়েছিল? সেই প্রথমবারের জন্য, তিনি কোনো প্রিয়জনকে পাওয়ার, একজন সঙ্গীকে পাওয়ার আনন্দ অনুভব করেছিলেন। প্রথমবার তিনি পিতা হওয়ার দায়িত্ব ও সেই দায়িত্বজনিত উদ্বেগও অনুভব করেছিলেন। এই জীবন্ত ও শ্বাসরত মানুষটি ঈশ্বরকে খুশি ও আনন্দ এনে দিয়েছিল; প্রথমবারের জন্য, তিনি পরিতৃপ্ত বোধ করেছিলেন। এটাই ছিল প্রথম ঈশ্বর-কৃত কাজ যা তাঁর চিন্তা বা এমনকি বাক্যের দ্বারাও নিষ্পন্ন হয়নি, হয়েছিল তাঁর স্বহস্তে। যখন এই ধরনের সত্তা—এক জীবন্ত ও শ্বাসরত মানুষ—ঈশ্বরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল, রক্ত-মাংসে গড়া, শরীর ও আকৃতি-বিশিষ্ট, এবং ঈশ্বরের সঙ্গে কথা বলতে সক্ষম, তিনি অননুভূতপূর্ব এক প্রকার আনন্দের অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন। ঈশ্বর প্রকৃতই তাঁর দায়িত্ব অনুভব করেছিলেন, এবং এই জীবন্ত সত্তাটি কেবল তাঁর হৃদয়তন্ত্রীতে আকর্ষণই করে নি, উপরন্তু তার প্রতিটি সামান্য সঞ্চালনও তাঁর হৃদয়কে উদ্বেলিত ও আলোড়িত করেছিল। এই জীবন্ত সত্তাটি যখন ঈশ্বরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল, তখনই প্রথমবার এরকম আরো মানুষ অর্জনের চিন্তা তাঁর মাথায় এসেছিল। ঈশ্বরের সেই চিন্তাটি থেকেই এই ঘটনাপরম্পরার সূচনা হয়েছিল। ঈশ্বরের কাছে এই সমস্ত ঘটনাই প্রথমবারের জন্য সংঘটিত হচ্ছিল, কিন্তু এই প্রারম্ভিক ঘটনাগুলির কারণে সেসময়ে তিনি যেমনই অনুভব করে থাকুন না কেন—আনন্দ, দায়িত্ববোধ, উদ্বেগ—সেই অনুভূতিগুলি ভাগ করে নেওয়ার মতো কেউ তাঁর সঙ্গে ছিল না। সেই মুহূর্ত থেকেই, ঈশ্বর সত্যই এমন এক একাকিত্ব ও বিষণ্ণতা অনুভব করেছিলেন যা আগে কখনো করেননি। তাঁর মনে হয়েছিল যে, মানুষ তাঁর ভালোবাসা ও উদ্বেগ, বা মানুষের উদ্দেশ্যে তাঁর অভিপ্রায় গ্রহণ বা উপলব্ধি করতে পারবে না, তাই তিনি তাঁর অন্তরে তখনো দুঃখ ও বেদনা অনুভব করেছিলেন। এই কাজগুলি তিনি মানুষের জন্য সম্পন্ন করলেও, মানুষ এবিষয়ে সচেতন ছিল না এবং বুঝে উঠতে পারেনি। মানুষ তাঁর কাছে যে খুশি, আনন্দ ও পরিতৃপ্তি বয়ে এনেছিল, তার সাথেই সত্বর নিয়ে এসেছিল তাঁর প্রথম দুঃখ ও একাকিত্ববোধ। এসবই হল সেই সময়ে ঈশ্বরের চিন্তাভাবনা ও অনুভূতি। ঈশ্বর যখন এই সব কার্য সম্পাদন করছিলেন, তাঁর অন্তরে তখন তিনি চলেছিলেন আনন্দ থেকে দুঃখ ও দুঃখ থেকে বেদনার দিকে, এবং এই অনুভূতিগুলি মিশে গিয়েছিল উৎকণ্ঠার সাথে। তিনি শুধু তাড়াতাড়ি এই মানুষকে, এই মানবজাতিকে, তাঁর অন্তরে যা ছিল তা জানাতে চাইছিলেন, চাইছিলেন অবিলম্বে তারা তাঁর অভিপ্রায় উপলব্ধি করুক। তখন, তারা তাঁর অনুগামী হতে পারবে এবং তাঁর চিন্তাভাবনা ভাগ করে নিতে ও তাঁর ইচ্ছায় শামিল হতে পারবে। আর তারা কেবল নির্বাকভাবে ঈশ্বরের বক্তব্য শুনবে না; আর তারা কীভাবে ঈশ্বরের কাজে তাঁর সাথে যোগদান করা যায়, সেবিষয়ে অনবহিত রইবে না; সর্বোপরি, আর তারা ঈশ্বরের চাহিদার ব্যাপারে উদাসীন মানুষ হয়ে থাকবে না। ঈশ্বরের এই প্রারম্ভিক কার্যগুলি খুবই অর্থপূর্ণ, এবং তাঁর পরিচালনামূলক পরিকল্পনাও আজকের মানুষের কাছে অত্যন্ত মূল্যবান।

সকল বস্তু ও মানবজাতিকে সৃষ্টি করার পর, ঈশ্বর বিশ্রাম নেননি। তাঁর ব্যবস্থাপনাকে সম্পন্ন করার জন্য, এবং মানবজাতির মধ্যে যাদের তিনি এত ভালোবাসেন তাদের অর্জন করার জন্য তিনি উতলা ও অধীর হয়ে উঠেছিলেন।

বিধানের যুগের সময়কালে ঈশ্বর একাদিক্রমে অভূতপূর্ব কাজ করেন

এরপর, ঈশ্বরের মনুষ্যসৃষ্টির খুব পরে নয়, বাইবেল থেকে আমরা জানতে পারি যে সারা পৃথিবী জুড়ে এক ভয়ঙ্কর বন্যা হয়েছিল। প্লাবনের লিখিত বিবরণে নোহ-র উল্লেখ আছে, এবং এমনটা বলা যায় যে, নোহই হল প্রথম মানুষ, যে ঈশ্বরের একটি কাজ সম্পূর্ণ করতে তাঁর সাথে কাজ করার উদ্দেশ্যে ঈশ্বরের দ্বারা আহূত হয়েছিল। নিশ্চিতভাবে, সেই প্রথম ঈশ্বর পৃথিবীর কোনো মানুষকে ডেকে তাঁর আজ্ঞা অনুযায়ী কোনো কাজ করতে বলেছিলেন। নোহ-র জাহাজ নির্মাণ সমাপ্ত হওয়ার পর ঈশ্বর প্রথমবারের জন্য পৃথিবীকে প্লাবিত করেছিলেন। ঈশ্বর যখন প্লাবনের মাধ্যমে পৃথিবীকে বিনষ্ট করেন, মনুষ্যসৃষ্টির পর তখনই প্রথমবার তিনি তাদের প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে উঠেছিলেন, এই কারণেই তিনি বন্যার মাধ্যমে মনুষ্যজাতিকে ধ্বংস করার বেদনাদায়ক সিদ্ধান্তটি নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। প্লাবনের দ্বারা পৃথিবী বিধ্বস্ত হওয়ার পর, ঈশ্বর মানুষের সাথে তাঁর প্রথম চুক্তিটি সম্পাদন করেছিলেন, যে চুক্তিতে বলা হয়েছিল যে তিনি আর কখনো প্লাবনের দ্বারা পৃথিবীকে ধ্বংস করবেন না। রামধনু ছিল সেই চুক্তির স্বাক্ষরচিহ্ন। সেটিই ছিল মানবজাতির সঙ্গে ঈশ্বরের প্রথম চুক্তি, তাই রামধনু হল চুক্তিপত্রে ঈশ্বর-প্রদত্ত প্রথম স্বাক্ষর; রামধনু হল এক বাস্তব, প্রাকৃতিক বস্তু যার অস্তিত্ব রয়েছে। এই রামধনুর অস্তিত্বই প্রায়শ ঈশ্বরকে তাঁর খুইয়ে ফেলা পূর্বতন মানবজাতির জন্য শোকাতুর করে তোলে, এবং তাদের যা ঘটেছিল এই রামধনু তার স্মারক হিসাবে কাজ করে…। ঈশ্বর তাঁর কার্যের গতি মন্থর করেন নি—তাঁর ব্যবস্থাপনার পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য তিনি উতলা ও ব্যগ্র হয়ে উঠেছিলেন। পরবর্তীকালে, ইসরায়েল জুড়ে তাঁর কার্য সম্পাদনের জন্য প্রথম পছন্দের মানুষ হিসাবে ঈশ্বর অব্রাহামকে মনোনীত করেছিলেন। ঈশ্বরের দ্বারা এইভাবে প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে এ-ও প্রথম দৃষ্টান্ত। এই মানুষটির মাধ্যমে ঈশ্বর তাঁর মানবজাতির উদ্ধারকার্-সম্পাদন আরম্ভ করতে, এবং সেই ব্যক্তিটির সন্তান-সন্ততিদের মধ্যে তাঁর কার্য অব্যাহত রাখতে মনস্থ করেছিলেন। বাইবেলে আমরা দেখতে পাই যে অব্রাহামের ক্ষেত্রে ঈশ্বর এটাই করেছিলেন। এরপর ঈশ্বর ইসরায়েলকে প্রথম মনোনীত ভূমিতে পরিণত করেন, এবং তাঁর মনোনীত মানুষদের, অর্থাৎ ইসরায়েলবাসীদের মাধ্যমে তাঁর বিধানের যুগের কার্যের সূচনা করেন। আরও একবার, প্রথম বারের জন্য, মানবজাতির পালনীয় সুনির্দিষ্ট নিয়ম ও বিধানগুলি ঈশ্বর ইসরায়েলবাসীদের হাতে প্রদান করেন, এবং বিশদে সেগুলির ব্যাখ্যা করেন। এই প্রথমবার, ঈশ্বর মানুষকে কীভাবে তাদের উৎসর্গ নিবেদন করা উচিত, কীভাবে তাদের জীবনযাপন করা উচিত, তাদের কী করা উচিত ও উচিত নয়, কোন উৎসব ও দিনগুলি তাদের উদযাপন করা উচিত, এবং তাদের সকল কাজে অনুসরণীয় নীতির বিষয়ে এরকম সুনির্দিষ্ট, আদর্শায়িত নিয়মকানুন প্রদান করেছিলেন। এই প্রথমবার ঈশ্বর মানবজাতিকে তাদের জীবনযাপন করার পদ্ধতির বিষয়ে এত বিশদ, আদর্শায়িত নিয়মবিধি ও নীতিসমূহ প্রদান করেছিলেন।

যতবার আমি “প্রথমবারের জন্য” শব্দবন্ধনীটি বলি, ততবার এমন এক প্রকার কার্যের প্রতি নির্দেশ করা হয় যা ঈশ্বর আগে কখনো হাতে নেন নি। এমন কার্যের প্রতি তা নির্দেশ করে, পূর্বে যার অস্তিত্ব ছিল না, এবং যদিও ঈশ্বর মানবজাতি এবং সব রকমের প্রাণী ও জীবিত বস্তু সৃষ্টি করেছিলেন, কিন্তু এই ধরনের কাজ তিনি আগে কখনো সম্পন্ন করেন নি। এই কার্যের সম্পূর্ণটাই ঈশ্বর কর্তৃক মানবজাতির ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল; শুধুমাত্র মানুষ এবং তাঁর দ্বারা তাদের পরিত্রাণ ও ব্যবস্থাপনার সঙ্গে এটি সম্পর্কিত। অব্রাহামের পর, আরেকবার ঈশ্বর প্রথমবারের জন্য সম্পাদিত আরেকটা কাজ করলেন—ইয়োবেকে তিনি সেই ব্যক্তি হিসাবে মনোনীত করলেন যে বিধানের অধীনে জীবনধারণ করে শয়তানের প্রলোভনসমূহকে প্রতিরোধ করতে পারবে, এবং একই সঙ্গে ঈশ্বরভীতি, শয়তানকে পরিহার, ও ঈশ্বরের সাক্ষ্যদান অব্যাহত রাখবে। এটাও ছিল সর্বপ্রথম দৃষ্টান্ত যেখানে শয়তানকে ঈশ্বর কোনো মানুষকে প্রলোভিত করার সুযোগ দেন, এবং সেই প্রথমবার তিনি শয়তানের সাথে বাজি ধরেছিলেন। পরিশেষে, সেই প্রথমবার তিনি এমন কাউকে অর্জন করেছিলেন যে শয়তানের মুখোমুখি হয়ে ঈশ্বরের প্রতি সাক্ষ্যদানে ও তাঁর নিকট সাক্ষ্যবহনে সক্ষম ছিল, এবং শয়তানকে যে সর্বতোভাবে লজ্জায় ফেলতে পারতো। ঈশ্বর কর্তৃক মনুষ্যসৃষ্টির পর থেকে, ইয়োবে ছিল তাঁর অর্জিত প্রথম মানুষ, যে তাঁর হয়ে সাক্ষ্য বহনে সমর্থ ছিল। এই ব্যক্তিটিকে অর্জন করে ফেলার পর, ঈশ্বর তাঁর ব্যবস্থাপনা অব্যহত রাখতে ও তাঁর কার্যের পরবর্তী পর্যায়কে সম্পন্ন করতে আরো অধীর হয়ে পড়েছিলেন, তাঁর কার্যের পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য যে স্থান ও মানুষগুলিকে তিনি চয়ন করবেন, তা প্রস্তুত করছিলেন।

এই সবকিছুর সম্বন্ধে আলাপ-আলোচনার পর, তোমরা কি ঈশ্বরের ইচ্ছার বিষয়ে প্রকৃত উপলব্ধি লাভ করেছো? মানবজাতির নিমিত্ত তাঁর ব্যবস্থাপনার, তাঁর দ্বারা মানবজাতির পরিত্রাণের এই দৃষ্টান্তটিকে ঈশ্বর অন্য সবকিছুর থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করেন। এই বিষয়গুলি তিনি শুধুমাত্র তাঁর মনন বা তাঁর বাক্যের সাহায্যে নিষ্পন্ন করেন না, এবং নিঃসন্দেহে কোনো লঘু মনোভাব সহকারে করেন না তো বটেই—এসবকিছুই তিনি এক পরিকল্পনামাফিক, লক্ষ্যনিষ্ঠ ভাবে, মানের উৎকর্ষতা বজায় রেখে, এবং তাঁর ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে সম্পন্ন করেন। এটা স্পষ্ট যে, মানবজাতির উদ্ধারের এই কার্য ঈশ্বর ও মানুষ উভয়ের কাছেই অত্যন্ত তাৎপর্যমণ্ডিত। কাজটি যত দুরূহই হোক না কেন, যত বড়ো প্রতিবন্ধকতাই থাক, মানুষ যত দুর্বলই হোক, বা মানুষের বিদ্রোহপ্রবণতা যতই গভীর হোক, এর কোনোকিছুই ঈশ্বরের কাছে জটিল কিছু নয়। তাঁর কষ্টসাধ্য প্রচেষ্টার ব্যয়সাধনে এবং যে কার্য তিনি নিজে নির্বাহ করতে চান তার পরিচালনায় ঈশ্বর নিজেকে ব্যাপৃত রাখেন। একই সঙ্গে সকলকিছুকে তিনি বিন্যস্ত করছেন, এবং যে সকল মানুষের উপর তিনি কার্য নিষ্পন্ন করবেন ও যে সমস্ত কার্য সম্পূর্ণ করবেন তাদের উপর তাঁর সার্বভৌমত্ব প্রয়োগ করছেন—এর কোনোটিই পূর্বে কখনো সম্পন্ন হয়নি। এই প্রথমবার ঈশ্বর এই পদ্ধতিগুলির ব্যবহার করেছেন এবং মানবজাতির পরিচালনা ও উদ্ধারের এই মুখ্য প্রকল্পের জন্য এত ব্যাপক মূল্য পরিশোধ করেছেন। তাঁর এই কার্য সম্পাদনকালে ঈশ্বর ধীরে ধীরে, কোনো সংশয় ব্যতিরেকে, তাঁর কষ্টকর প্রচেষ্টা, তাঁর যা আছে ও তিনি যা, তাঁর প্রজ্ঞা ও সর্বশক্তিমানতা, এবং তাঁর স্বভাবের সকল দিক মানবজাতির কাছে এমনভাবে উন্মুক্ত ও ব্যক্ত করছেন, যা তিনি আগে কখনো করেননি। সুতরাং, ঈশ্বরের পরিচালনা ও উদ্ধারের লক্ষ্যবস্তু ব্যক্তিগণ ব্যতীত, সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের অপর কোনো জীব কখনো ঈশ্বরের এতখানি ঘনিষ্ঠ, তাঁর সাথে এমনতর অন্তরঙ্গতার সম্পর্কে বিজড়িত হয় নি। তাঁর অন্তরে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল মানবজাতি, যাকে তিনি পরিচালনা ও উদ্ধার করতে চান; এই মানবজাতিকে তিনি অন্য সকলকিছুর থেকে বেশি মূল্যবান জ্ঞান করেন; যদিও তিনি তাদের জন্য অনেক মূল্য পরিশোধ করেছেন, এবং যদিও তারা তাঁকে ক্রমাগত আহত ও অমান্য করে, তবু তাদের উপর তিনি কখনো হাল ছেড়ে দেন না, এবং কোনো অনুযোগ বা অনুতাপ ছাড়াই অক্লান্তভাবে তাঁর কার্য করে যান। তার কারণ তিনি জানেন যে আজ না হোক কাল, তাঁর মানুষ তাঁর আহ্বানে জাগরিত হবেই, এবং তাঁর বাক্যের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠবে, উপলব্ধি করবে যে, তিনিই সৃষ্টির প্রভু, এবং তাঁর পাশে ফিরে আসবে …

আজকের এই সকলকিছু শ্রবণ করার পর, তোমরা অনুভব করতে পারো যে ঈশ্বর যাকিছু করেন তার সবই অত্যন্ত স্বাভাবিক। মনে হয় যে, তাঁর বাক্য ও তাঁর কার্য দ্বারা মানুষ তাদের বিষয়ে ঈশ্বরের অভিপ্রায়সমূহের কিছুটা সততই অনুভব করেছে, কিন্তু তাদের অনুভব বা তাদের জ্ঞান এবং ঈশ্বরের চিন্তাভাবনার মধ্যে সর্বদাই নির্দিষ্ট একটা ব্যবধান রয়েছে। এই কারণেই আমার মনে হয় ঈশ্বর কেন মানবজাতি সৃষ্টি করেছিলেন, এবং মানবজাতিকে অর্জন করার যে আশা তিনি পোষণ করেছিলেন তাঁর সেই ইচ্ছার পটভূমির বিষয়ে সকল মানুষকে অবহিত করাটা প্রয়োজনীয়। সকলের সাথে তা ভাগ করে নেওয়াটা আবশ্যক, যাতে তারা বিষয়টি নিয়ে সকলেই অন্তর থেকে স্পষ্টভাবে অবহিত হয়, বিষয়টি উপলব্ধি করে। ঈশ্বরের প্রতিটি চিন্তা ও ধারণা, এবং তাঁর কার্যের প্রতিটি পর্যায় ও সময়কাল যেহেতু তাঁর সমগ্র পরিচালনামূলক কার্যের সঙ্গে গ্রন্থিবদ্ধ ও ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত, সেহেতু তাঁর কার্যের প্রতিটি পদক্ষেপে তোমার ঈশ্বরের চিন্তাভাবনা, ধ্যানধারণা, ও তাঁর অভিপ্রায় উপলব্ধি করা, এবং তাঁর পরিচালনামূলক পরিকল্পনার কার্য কীভাবে সংঘটিত হয়েছিল, তা উপলব্ধি করা সমতুল। এই ভিত্তির উপরেই তোমার ঈশ্বর-বিষয়ক উপলব্ধি গভীরতর হয়। ঈশ্বর প্রথম যখন বিশ্বসৃষ্টি করেন তখন যাকিছু তিনি করেছিলেন, যে বিষয়ে পূর্বেই আমি উল্লেখ করেছিলাম, যদিও তা এখন সত্যান্বেষণের সঙ্গে অপ্রাসঙ্গিক নিছক “তথ্য” বলে মনে হয়, কিন্তু তোমার অভিজ্ঞতার সম্প্রসারণের পথে এমন একটা সময় আসবে যখন তুমি একে আর গুটিকয় তথ্যের মতো সাদামাটা কোনো বিষয়, বা নিছকই একপ্রকার রহস্য বলে গণ্য করবে না। তোমার জীবনের অগ্রগতির সাথে, ঈশ্বর তোমার হৃদয়ে যখন একটি জায়গা করে নেবেন, বা যখন তুমি তাঁর ইচ্ছাকে আরো পুঙ্খানুপুঙ্খ ও নিগূঢ়ভাবে উপলব্ধি করবে, তখন তুমি আজ আমি যে বিষয়ে আলোচনা করছি তার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সম্যকরূপে প্রণিধান করবে। আজ তোমরা এটিকে যে পরিমাণেই গ্রহণ করে থাকো না কেন, তারপরেও এই বিষয়গুলি তোমাদের উপলব্ধি করা ও জানা প্রয়োজন। ঈশ্বর যখন কিছু সম্পাদন করেন, যখন তিনি তাঁর কার্য নির্বাহ করেন, সে তাঁর চিন্তার দ্বারাই হোক বা তাঁর স্বহস্তে, সে তিনি তা প্রথম বারের জন্যই করুন কি অন্তিম বারের জন্য, পরিশেষে, ঈশ্বরের একটি পরিকল্পনা আছে, এবং তিনি যাকিছু করেন সেগুলির মধ্যে তাঁর উদ্দেশ্য ও তাঁর চিন্তাভাবনা আছে। এই উদ্দেশ্য ও চিন্তাভাবনাই ঈশ্বরের স্বভাবকে তুলে ধরে, এবং এগুলিই তাঁর যা আছে ও তিনি যা তা ব্যক্ত করে। ঈশ্বরের স্বভাব এবং তাঁর যা আছে ও তিনি যা—এই দুটি বিষয় প্রত্যেকটি মানুষকে অবশ্যই উপলব্ধি করতে হবে। একবার যখন কোনো ব্যক্তি তাঁর স্বভাব এবং তাঁর যা আছে ও তিনি যা, তা উপলব্ধি করে, তখন সে ক্রমশ ঈশ্বর যা করেন তা তিনি কেন করেন, এবং তিনি যা বলেন তা কেন বলেন, তা-ও উপলব্ধি করতে পারে। এর মাধ্যমে, তখন তারা ঈশ্বর-অনুসরণ এবং সত্যের উদ্দেশ্যে এবং নিজ-নিজ স্বভাবের পরিবর্তনসাধনের নিমিত্ত অন্বেষণের ক্ষেত্রে আরো বিশ্বাস পেতে পারে। অর্থাৎ, মানুষের ঈশ্বর-উপলব্ধি ও ঈশ্বর-বিশ্বাস অবিচ্ছেদ্য।

মানুষ যে সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করে ও যা উপলব্ধি করে তা যদি হয় ঈশ্বরের স্বভাব এবং তাঁর যা আছে ও তিনি যা, তবে তারা যা লাভ করবে তা হল জীবন, যা ঈশ্বর থেকে আগত। তোমার অভ্যন্তরে এই জীবন একবার দৃঢ়মূল হয়ে গেলে, তোমার ঈশ্বরভীতি ক্রমাগত বৃদ্ধি পাবে। এ হল এমন এক প্রাপ্তি, যা অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই আসে। তুমি যদি ঈশ্বরের স্বভাব বা তাঁর সারসত্যকে উপলব্ধি করতে বা সেগুলি সম্পর্কে জানতে না চাও, যদি তুমি এই বিষয়গুলির উপর এমনকি চিন্তাভাবনা বা মনোনিবেশও করতে না চাও, তাহলে আমি তোমায় নিশ্চিতভাবে বলতে পারি যে, বর্তমানে যে পথে তুমি তোমার ঈশ্বর-বিশ্বাসে নিরত রয়েছো, তা কখনোই তোমায় তাঁর ইচ্ছা পূরণ বা তার প্রশংসা অর্জন করতে দিতে পারে না। তার থেকেও বড়ো কথা, তুমি কখনো সম্যকরূপে পরিত্রাণ অর্জন করতে পারবে না—এসবই হল অন্তিম পরিণাম। মানুষ যখন ঈশ্বরকে উপলব্ধি করে না এবং তাঁর স্বভাব সম্বন্ধে অবগত হয় না, তখন তাদের হৃদয় কখনোই তাঁর কাছে প্রকৃত অর্থে উন্মোচিত হতে পারে না। একবার ঈশ্বরকে উপলব্ধি করে ফেললে, তখন তারা আগ্রহ ও আস্থা সহকারে তাঁর অন্তরে যা আছে তা উপভোগ ও আস্বাদন করতে শুরু করবে। ঈশ্বরের অন্তরে যা আছে তুমি যখন তা উপভোগ ও আস্বাদন করবে, তোমার হৃদয় তখন ক্রমশ, একটু একটু করে, তাঁর প্রতি উন্মোচিত হবে। তোমার হৃদয় যখন তাঁর প্রতি উন্মোচিত হবে, তখন তুমি অনুভব করবে ঈশ্বরের সঙ্গে তোমার বিনিময়গুলি, ঈশ্বরের কাছে রাখা তোমার দাবিসকল, এবং তোমার নিজের অসংযত কামনাসমূহ কতখানি লজ্জাজনক ও ঘৃণার্হ ছিল। তোমার হৃদয় যখন প্রকৃতই ঈশ্বরের প্রতি উন্মোচিত হবে, তখনই তুমি লক্ষ্য করবে যে তাঁর হৃদয় এমন এক অনন্ত ভুবন, এবং তুমি এমন এক জগতে প্রবেশ করবে যার অভিজ্ঞতা তুমি আগে কখনো লাভ করো নি। এই জগতে কোনো প্রতারণা নেই, নেই কোনো ছলনা, নেই কোনো অন্ধকার, এবং নেই কোনো মন্দতা। শুধুমাত্র আন্তরিকতা ও বিশ্বস্ততা রয়েছে; রয়েছে কেবল আলো ও নৈতিকতা; কেবলই ন্যায়পরায়ণতা ও সহৃদয়তা। তা প্রেম ও দরদে ভরপুর, সহমর্মিতা ও সহিষ্ণুতায় পরিপূর্ণ, এবং এর মাধ্যমে তুমি জীবিত থাকার আনন্দ ও পুলক অনুভব করো। তুমি যখন ঈশ্বরের প্রতি তোমার হৃদয়কে উন্মোচিত করবে তখন এই বিষয়গুলিই তিনি তোমার সন্নিধানে প্রকাশ করবেন। এই অনন্ত ভুবন ঈশ্বরের প্রজ্ঞা ও সর্বশক্তিমত্তায় পরিব্যাপ্ত; একই সঙ্গে তা তাঁর প্রেম ও কর্তৃত্বে পরিপূর্ণ। এখানে তুমি ঈশ্বরের যা আছে ও তিনি যা, কী তাঁকে আনন্দ দেয়, কেন তিনি উদ্বিগ্ন হন ও কেন তিনি বিমর্ষ হয়ে পড়েন, কেনই বা তিনি রাগান্বিত হন, এসবের প্রতিটি দিক প্রত্যক্ষ করতে পারো…। নিজ-হৃদয় উন্মোচিত করে ঈশ্বরকে প্রবেশ করতে দেয় এমন প্রত্যেকেই এগুলি চাক্ষুষ করতে পারে। একমাত্র তখনই ঈশ্বর তোমার হৃদয়ে প্রবেশ করতে পারেন যদি তুমি তা তাঁর কাছে উন্মোচিত করে দাও। তিনি যদি তোমার হৃদয়ে প্রবেশ করে থাকেন, একমাত্র তবেই তুমি ঈশ্বরের যা আছে ও তিনি যা, এবং তোমার জন্য তাঁর অভিপ্রায়সমূহ দৃষ্টিগোচর করতে পারো। সেই সময়, তুমি আবিষ্কার করবে যে, ঈশ্বর সম্পর্কিত সকলকিছুই কত মহার্ঘ, এবং তাঁর যা আছে ও তিনি যা তা কত বেশি মূল্যবান হিসাবে পরিগণিত হওয়ার যোগ্য। সেই তুলনায়, তোমায় ঘিরে যে মানুষজন রয়েছে, তোমার জীবনে যে বস্তুসমূহ ও ঘটনাবলী রয়েছে, এবং এমনকি তোমার প্রিয়জনগণ, তোমার জীবনসঙ্গী, এবং যাকিছু তুমি ভালোবাসো, তা নামমাত্র উল্লেখনীয়। এসবকিছু বড়ো তুচ্ছ, এবং অত্যধিক হীন; তুমি অনুভব করবে যে কোনো ভৌতবস্তু আর কখনো তোমাকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হবে না, অথবা কোনো ভৌতবস্তু আর কখনো তোমাকে সেটির জন্য কোনোপ্রকার মূল্য পরিশোধে প্রলুব্ধ করতে সক্ষম হবে না। ঈশ্বরের বিনয়ের মধ্যে তুমি তাঁর মাহাত্ম্য ও তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব প্রত্যক্ষ করবে। উপরন্তু, পূর্বে তুমি নেহাতই তুচ্ছ বলে ভেবেছিলে ঈশ্বরের এমন কিছু ক্রিয়াকলাপের মধ্যে তুমি তাঁর অপার প্রজ্ঞা ও তাঁর সহিষ্ণুতা দর্শন করবে, এবং তাঁর স্থৈর্য, তাঁর আত্মসংযম, ও তোমার সম্পর্কে তাঁর উপলব্ধি চাক্ষুষ করবে। এতে তাঁর প্রতি তোমার ভিতর এক শ্রদ্ধাবোধ জন্ম নেবে। সেই দিন, তুমি অনুভব করবে যে মানবজাতি এহেন এক ক্লেদাক্ত জগতে জীবনযাপন করছে, এবং তোমার পাশের মানুষজন ও তোমার জীবনে সংঘটিত ঘটনাবলী, এবং এমনকি যাদের তুমি ভালোবাসো, তোমার প্রতি তাদের ভালোবাসা, এবং তোমার জন্য তাদের তথাকথিত তত্ত্বাবধান বা তাদের উদ্বেগ, উল্লেখেরই যোগ্য নয়—একমাত্র ঈশ্বরই তোমার প্রিয়জন, এবং একমাত্র ঈশ্বরকেই তুমি সর্বাপেক্ষা মূল্যবান জ্ঞান করো। সেই দিন যখন আসবে, আমার বিশ্বাস এমন কিছু মানুষ থাকবে যারা বলে উঠবে: ঈশ্বরের ভালোবাসা কত মহান, এবং তাঁর সারসত্য কত পবিত্র—ঈশ্বরের মধ্যে কোনো প্রতারণা নেই, মন্দ কিছু নেই, ঈর্ষা নেই, এবং নেই কোনো বিবাদ, বরং রয়েছে শুধু ন্যায়পরায়ণতা ও প্রামাণিকতা, এবং ঈশ্বরের যাকিছু আছে ও তিনি যা, তা মানুষের কাঙ্ক্ষিত হওয়া উচিত। তা লাভের উদ্দেশ্যে মানুষের কঠোর প্রচেষ্টা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা পোষণ করা উচিত। মানবজাতির এটিকে অর্জন করার সামর্থ্য কোন ভিত্তির উপর নির্মিত? তা নির্মিত তাদের ঈশ্বরের স্বভাব ও ঈশ্বরের সারসত্য বিষয়ক উপলব্ধির ভিত্তির উপর। তাই ঈশ্বরের স্বভাব এবং তাঁর যা আছে ও তিনি যা, তা উপলব্ধি করা প্রত্যেক মানুষের এক জীবনব্যাপী পাঠ; এ হল এমন এক জীবনব্যাপী লক্ষ্য, যার অন্বেষণ করে নিজের স্বভাব পরিবর্তন করতে ও ঈশ্বরকে জানতে উদ্যোগী প্রতিটি মানুষ।

কর্ম সম্পাদনের উদ্দেশ্যে ঈশ্বরের প্রথম দেহধারণ

এইমাত্র আমরা ঈশ্বরের সম্পাদিত সকল কার্য, যে নজিরবিহীন কার্যপরম্পরা তিনি নির্বাহ করেছিলেন সেই বিষয়ে আলোচনা করলাম। এই বিষয়গুলির প্রত্যেকটিই ঈশ্বরের পরিচালনামূলক পরিকল্পনার এবং ঈশ্বরের ইচ্ছার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক। স্বয়ং ঈশ্বরের স্বভাব ও তাঁর সারসত্যের সাথেও এগুলি সম্পর্কিত। ঈশ্বরের যা আছে ও তিনি যা, তা-র বিষয়ে আমরা যদি আরো উপলব্ধি করতে চাই, তাহলে আমাদের পুরাতন নিয়মে বা বিধানের যুগে থেমে গেলে চলবে না—তাঁর কার্যের ক্ষেত্রে ঈশ্বর যে পদক্ষেপগুলি গ্রহণ করেছিলেন সেগুলির অনুসরণ করে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। তাই, ঈশ্বর যখন বিধানের যুগের সমাপ্তি ঘটিয়ে অনুগ্রহের যুগের সূচনা করলেন, তখন আমাদের পদক্ষেপও এর পিছু পিছু অনুগ্রহের যুগে প্রবেশ করুক—যে যুগ কৃপা ও পরিত্রাণে পরিপূর্ণ। এই যুগে, ঈশ্বর আবার খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ করলেন যা আগে কখনো সম্পন্ন হয়নি। ঈশ্বর ও মানবজাতি উভয়ের কাছেই এই নতুন যুগের কার্য এক অভিনব সূচনাবিন্দু ছিল—ছিল ঈশ্বরের দ্বারা নিষ্পন্ন অপর এক অভূতপূর্ব তথা অভিনব কার্যসম্বলিত এক সূচনাবিন্দু। এই নতুন কার্যটি ছিল নজিরবিহীন, এমনকিছু যা মানুষ ও সকল সত্তার কল্পনাশক্তির অতীত। এটি এমন এক বিষয় যা বর্তমানে সকল মানুষের কাছে সুবিদিত—প্রথমবারের জন্য, ঈশ্বর মনুষ্যসত্তায় পরিণত হলেন, এবং প্রথমবারের জন্য তিনি মানুষরূপে, একজন মানুষের পরিচয়ে, নতুন কার্যের সূচনা করলেন। এই নতুন কার্য সূচিত করলো যে, ঈশ্বর তাঁর বিধানের যুগের কার্য সমাধা করেছেন, এবং বিধানের অধীনে তিনি আর কখনো কোনো কার্য সম্পাদন বা বাক্য উচ্চারণ করবেন না। এবং তিনি বিধানের আকারে অথবা বিধানের নীতি বা নিয়ম অনুসারেও কোনো বাক্য উচ্চারণ বা কার্য সম্পাদন করবেন না। অর্থাৎ, বিধানের ভিত্তির উপর সম্পাদিত তাঁর সকল কার্য চিরতরে নিবৃত্ত হয়ে গেল, এবং তা আর অব্যাহত হওয়ার নয়, কারণ ঈশ্বর নতুন কার্যের সূচনা করতে ও নতুন কিছু সম্পন্ন করতে চেয়েছিলেন। তাঁর পরিকল্পনা পুনরায় এক নতুন সূচনাবিন্দু পেল, এবং সেহেতু, ঈশ্বরকে এক নবযুগের দিকে চালিত করতে হল মনুষ্যগণকে।

এই সংবাদ মানুষের কাছে আনন্দদায়ক ছিল না অমঙ্গলসূচক, তা নির্ভর করেছিল প্রতিটি ব্যক্তিগত মানুষের সারমর্মের উপর। বলা যেতে পারতো যে, কিছু মানুষের কাছে তা আনন্দদায়ক নয়, বরং ছিল দুর্ভাগ্যজনক সংবাদ, কারণ ঈশ্বর যখন নতুন কার্য শুরু করেছিলেন, তখন যে মানুষগুলি কেবল বিধান ও নিয়মকে অনুসরণ করতো, যারা শুধু মতবাদসমূহকে অনুসরণ করতো কিন্তু ঈশ্বরে ভীত ছিল না, ঈশ্বরের নতুন কার্যের নিন্দা করার জন্য তারা পুরাতন কার্যকে ব্যবহার করতে লাগলো। এই মানুষগুলির কাছে, সংবাদটি অমঙ্গলসূচক ছিল। কিন্তু প্রত্যেক নিরপরাধ ও অবারিতহৃদয় মানুষের কাছে, যারা ঈশ্বরের প্রতি আন্তরিক ও তাঁর পরিত্রাণ গ্রহণ করতে ইচ্ছুক ছিল তাদের কাছে, ঈশ্বরের প্রথম অবতাররূপ ধারণ ছিল এক অত্যন্ত আনন্দদায়ক সংবাদ। কারণ, মানুষ অস্তিত্বলাভ করার পর থেকে, এই প্রথম বার ঈশ্বর আবির্ভূত হয়েছিলেন, এবং মানবজাতির মধ্যে আত্মা নন এমন কোনো রূপ নিয়ে বসবাস করেছিলেন; এই বার, তিনি মানবরূপে জন্ম নিয়েছিলেন এবং মানুষের মধ্যে মনুষ্যপুত্ররূপে বসবাস করেছিলেন, এবং তাদের মাঝেই কাজ করেছিলেন। এই “প্রথমবার”-টি মানুষের পূর্বধারণা চূর্ণ করে দিয়েছিল; এই ঘটনা ছিল সকল কল্পনার অতীত। অধিকন্তু, ঈশ্বরের সকল অনুসরণকারী এক ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সুফল লাভ করেছিল। ঈশ্বর যে শুধু পুরাতন যুগের সমাপ্তি ঘটিয়েছিলেন তা-ই নয়, একই সঙ্গে তিনি তাঁর পুরানো কার্যপদ্ধতি ও কার্যশৈলীরও অবসান ঘটিয়েছিলেন। তিনি তাঁর বার্তাবাহকদের আর তাঁর ইচ্ছার কথা জ্ঞাপন করতে বললেন না, মেঘের আড়ালে প্রচ্ছন্ন রইলেন না তিনি আর, এবং বজ্রনির্ঘোষের মাধ্যমে মানুষের সমক্ষে অবির্ভূত হওয়া বা তাদের প্রতি বক্তব্য রাখলেন না তিনি আর। পূর্বের সকলকিছুর থেকে অন্যরকম ভাবে, মানুষের অকল্পনীয় ও তাদের পক্ষে উপলব্ধি বা গ্রহণ করা কঠিন এমন এক পদ্ধতি অবলম্বন করে—দেহধারণ করে—সেই যুগটির কার্যের সূত্রপাত ঘটানোর উদ্দেশ্যে তিনি মনুষ্যপুত্রে পরিণত হলেন। ঈশ্বরের এই কর্মের বিষয়ে মানুষ সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত ছিল; তা তাদের অপ্রতিভ করে দিল, তার কারণ ঈশ্বর আরেকবার নতুন কার্যের সূচনা করেছিলেন, যা তিনি পূর্বে কখনো সম্পন্ন করেন নি। নবযুগে যে নতুন কার্য ঈশ্বর নিষ্পন্ন করেছিলেন, সেটির দিকে আজ আমরা একবার দৃষ্টিপাত করবো, এবং এই অভিনব কার্য থেকে ঈশ্বরের স্বভাব এবং তাঁর যা আছে ও তিনি যা, সেই বিষয়টিতে আমাদের যা শিক্ষনীয় রয়েছে তা বিবেচনা করে দেখবো।

বাইবেলের নতুন নিয়মে নিম্নলিখিত বাক্যগুলি লিপিবদ্ধ রয়েছে:

১. বিশ্রামবারে আহারের উদ্দেশ্যে যীশু কর্তৃক ভুট্টার আবরণ উৎপাটন

মথি ১২:১ সেই সময়ে যীশু এক সাব্বাথ দিনে শস্যক্ষেত্রের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁর শিষ্যরা ক্ষুধার্ত ছিলেন। তাই তাঁরা শস্যের শীষ ছিঁড়ে খেতে লাগলেন।

২. মনুষ্যপুত্র হলেন বিশ্রামবারের প্রভু

মথি ১২:৬-৮ আমি তোমাদের বলছি, মন্দিরের চেয়ে মহত্তর কিছু এখানে উপস্থিত। ‘দয়াতেই আমার প্রীতি, বলিদানে নয়,’ এ কথার মর্ম যদি বুঝতে তাহলে তোমরা নির্দোষকে দোষী সাব্যস্ত করতে না। মানবপুত্রই সাব্বাথ দিনের অধিপতি।

প্রথমে এই অনুচ্ছেদটি পর্যালোচনা করে দেখা যাক: “সেই সময়ে যীশু এক সাব্বাথ দিনে শস্যক্ষেত্রের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁর শিষ্যরা ক্ষুধার্ত ছিলেন। তাই তাঁরা শস্যের শীষ ছিঁড়ে খেতে লাগলেন।”

আমি এই অনুচ্ছেদটি কেন বেছে নিয়েছি? এর সঙ্গে ঈশ্বরের স্বভাবের কী সম্পর্ক আছে? এই পাঠ্যাংশে, প্রথম যে বিষয়টি আমরা জানতে পারি তা হল যে, দিনটি ছিল বিশ্রামবার, কিন্তু প্রভু যীশু ঘরের বাইরে বেরিয়ে তাঁর শিষ্যদের ভুট্টার খেতের মধ্য দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। তার চেয়েও বেশি “গর্হিত” বিষয়টা হল তারা এমনকি “শস্যের শীষ ছিঁড়ে খেতে লাগলেন।” বিধানের যুগে, যিহোবা ঈশ্বরের বিধান নির্দেশারোপ করেছিল যে, বিশ্রামবারে মানুষ ইচ্ছে মতো বাড়ির বাইরে বেরোতে বা কর্যকলাপে অংশগ্রহণ করতে পারবে না—বিশ্রামবারে অনেককিছুই করা যেতো না। দীর্ঘদিন যাবৎ যারা বিধানের অধীনে জীবনযাপন করেছিল, প্রভু যীশুর তরফে এই কাজ তাদের কাছে ছিল বিহ্বলকর, এবং এমনকি তা সমালোচনার উদ্রেকও করেছিল। তাদের বিভ্রান্তি এবং যীশুর এই কার্য বিষয়ে তারা কী কথাবার্তা বলেছিল, সে প্রসঙ্গটি আপাতত সরিয়ে রেখে প্রথমে আমরা আলোচনা করবো, এতো দিন থাকতে, প্রভু যীশু এই কাজের জন্য বিশ্রামবারটিকেই কেন বেছে নিয়েছিলেন, এবং এই কাজের মাধ্যমে বিধানের অধীনে জীবনযাপনরত মানুষদের তিনি কোন বার্তা দিতে চেয়েছিলেন। এই অনুচ্ছেদ ও ঈশ্বরের স্বভাবের মধ্যে সম্পর্কটির বিষয়েই আমি আলোচনা করতে চাই।

প্রভু যীশুর যখন আবির্ভাব হয়েছিল, তখন তিনি তাঁর ব্যবহারিক কাজকর্মের মাধ্যমেই মানুষকে জানিয়েছিলেন যে ঈশ্বর বিধানের যুগ থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে নতুন কার্য শুরু করেছেন, এবং এই নতুন কার্যে বিশ্রামবার উদযাপনের প্রয়োজন নেই। বিশ্রামবারের বাধ্যবাধকতা থেকে ঈশ্বরের এই বের হয়ে আসাটা ছিল তাঁর নতুন কাজের পূর্বাস্বাদন মাত্র; প্রকৃত ও মহান কার্য তখনো শুরু হয়নি। প্রভু যীশু যখন তাঁর কার্য আরম্ভ করেন, তখন ইতিমধ্যেই তিনি বিধানের যুগের “নিগড়”-কে পিছনে ফেলে এসেছেন, এবং ঐ যুগের বিধিনিষেধ ও নীতিনিয়ম ভেঙে বেরিয়ে এসেছেন। তাঁর মধ্যে বিধানের সঙ্গে সম্পর্কিত কোনোকিছুর চিহ্নমাত্র ছিল না; তিনি একে সামগ্রিকভাবে পরিত্যাগ করেছিলেন এবং তা আর মেনে চলতেন না, এবং মানবজাতিরও আর তা পালন করা আবশ্যক মনে করতেন না। সেই কারণেই, প্রভু যীশুকে এখানে বিশ্রামবারে ভুট্টা খেতের মধ্য দিয়ে যেতে দেখা গিয়েছিল, এবং তিনি বিশ্রাম গ্রহণ করেননি; তিনি ঘরের বাইরে কাজ করছিলেন, এবং বিশ্রামরত ছিলেন না। মানুষের পূর্বধারণায় তাঁর এই কাজ ছিল এক ধাক্কা, এবং তা তাদের জানিয়েছিলেন যে, তিনি বিধানের অধীনে জীবনধারণ করেন না আর, এবং যে, তিনি বিশ্রামবারের বিধিনিষেধ পরিত্যাগ করেছেন এবং মানবজাতির সামনে ও তাদের মাঝে এক নতুন প্রতিমূর্তিতে, এক নতুন কার্যপদ্ধতিসহ অবতীর্ণ হয়েছেন। তাঁর এই কাজ মানুষকে জানিয়েছিল যে, তিনি সাথে করে নতুন কার্য নিয়ে এসেছেন, যে কার্যের সূচনা হয়েছিল বিধানের অধীনস্থতা থেকে বেরিয়ে আসার, এবং বিশ্রামবার থেকে প্রস্থান করার মধ্য দিয়ে। ঈশ্বর যখন তাঁর নতুন কার্য সম্পন্ন করেছিলেন, তিনি আর অতীতকে আঁকড়ে থাকেন নি, এবং তিনি আর বিধানের যুগের নিয়মকানুন নিয়ে চিন্তিত ছিলেন না। পূর্ববর্তী যুগে তাঁর কৃত কার্যের দ্বারা তিনি প্রভাবিতও হন নি, পরিবর্তে বরং আর পাঁচটা দিনের মতো বিশ্রামবারেও কাজ করেছিলেন, এবং বিশ্রামবারে তাঁর শিষ্যরা যখন ক্ষুধার্ত হয়েছিল, ভুট্টার শিষ তুলে খেতে তাদের কোনো বারণ ছিল না। ঈশ্বরের চোখে তা খুবই স্বাভাবিক ছিল। ঈশ্বরের কাছে, যে নতুন কার্য তিনি শুরু করতে চান ও যে নতুন বাক্য তিনি উচ্চারণ করতে চান, সেগুলির অধিকাংশের ক্ষেত্রে এক নতুন সূচনা থাকা অনুমোদনযোগ্য। যখন তিনি নতুন কিছু আরম্ভ করেন, তিনি তাঁর পূর্ববর্তী কার্যের উল্লেখমাত্র করেন না, বা তা-র সম্পাদন অব্যাহতও রাখেন না। তাঁর কার্যে ঈশ্বরের যেহেতু নিজস্ব নীতি রয়েছে, সেহেতু তিনি কেবল তখনই নতুন কার্যের সূচনা করতে চান, যখন মানবজাতিকে তিনি তাঁর কার্যের এক নতুন পর্যায়ের মধ্যে আনতে চান, এবং তাঁর কার্য যখন এক উচ্চতর স্তরে প্রবেশ করবে। মানুষ যদি পুরাতন বাণী বা নিয়মকানুন অনুযায়ী কর্মসাধন চালিয়ে যায়, অথবা সেগুলি আঁকড়ে ধরে থাকে, তিনি তা মনে রাখবেন না বা অনুমোদন করবেন না। এর কারণ তিনি ইতিমধ্যেই নতুন কার্য নিয়ে এসেছেন, এবং তাঁর কার্যের এক নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করেছেন। যখন তিনি নতুন কার্যের সূত্রপাত করেন, মানুষের কাছে তিনি তখন এক সম্পূর্ণ নতুন প্রতিমূর্তিতে, এক সম্পূর্ণ নতুন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, এবং এক সম্পূর্ণ নতুন রীতিতে আবির্ভূত হন, যাতে মানুষ তাঁর স্বভাবের এবং তাঁর যা আছে ও তিনি যা, তা-র ভিন্নতর দিকগুলি চাক্ষুষ করতে পারে। তাঁর নতুন কার্যে এটি তাঁর অন্যতম লক্ষ্য। ঈশ্বর পুরানো বস্তুসমূহ আঁকড়ে থাকেন না অথবা প্রথামাফিক পথে চলেন না; যখন তিনি কর্ম করেন অথবা বক্তব্য রাখেন, তখন তিনি ততটাও নিষেধাজ্ঞা জারি করেন না যতটা মানুষ ভাবে। ঈশ্বরের মধ্যে সকলই মুক্ত ও স্বাধীন, এবং কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই, কোনও সীমাবদ্ধতা নেই—তিনি মানবজাতির জন্য যা নিয়ে আসেন তা হল মুক্তি এবং স্বাধীনতা। তিনি হলেন এক জীবন্ত ঈশ্বর, এক ঈশ্বর যাঁর যথার্থ এবং প্রকৃত অর্থেই অস্তিত্ব রয়েছে। তিনি কোনো পুতুল অথবা মাটির প্রতিমা নন, যে সকল বিগ্রহ মানুষ উপাসনালয়ে প্রতিষ্ঠা করে আরাধনা করে তার থেকে তিনি সম্পূর্ণভাবে ভিন্ন। তিনি জীবন্ত এবং প্রাণবন্ত, এবং তাঁর বাক্য মানুষের কাছে যা নিয়ে আসে তা হল সকল প্রাণ ও আলোক, সকল মুক্তি ও স্বাধীনতা, কারণ তিনিই ধারণ করেছেন সত্য, জীবন এবং পথ—তিনি তাঁর কর্মে কোনও কিছুর দ্বারাই প্রতিহত হন না। লোকে যা-ই বলুক বা যেভাবেই তারা তাঁর নতুন কার্যকে দেখুক বা মূল্যায়ন করুক, তিনি কোনো মানসিক দ্বন্দ্ব ছাড়াই তাঁর কার্য সম্পন্ন করবেন। তাঁর কার্য ও বাক্যের বিষয়ে কারো পূর্বধারণা বা অঙ্গুলিনির্দেশে, অথবা এমনকি তাঁর নতুন কার্যের প্রতি তাদের কঠোর বিরোধিতা ও প্রতিরোধের কারণেও, তিনি উদ্বেগপীড়িত হবেন না। ঈশ্বর যা করেন তা পরিমাপ করতে বা তাকে সংজ্ঞায়িত করতে, তাঁর কার্যের সম্মানহানি, বিঘ্নসাধন বা অন্তর্ঘাত ঘটাতে, সমগ্র সৃষ্টির মধ্যে কেউ মানবিক যুক্তিবোধ, বা মানবিক কল্পনা, জ্ঞান, বা নৈতিকতা ব্যবহার করতে পারে না। তাঁর কার্য ও তিনি যা করেন তাতে কোনো নিষেধ নেই; কোনো মানুষ, ঘটনাবলী, বা বস্তুসমূহের দ্বারা তা সীমায়িত হবে না, অথবা কোনো বৈরীশক্তির দ্বারা তা বিঘ্নিতও হবে না। তাঁর নতুন কার্যের ক্ষেত্রে, তিনি হলেন এক সদা-জয়যুক্ত নৃপতি, এবং যেকোনো বৈরীশক্তি এবং মানবজাতির সকল ধর্মবিরোধিতা ও ভ্রান্ত বিশ্বাস তাঁর পাদপীঠের নীচে পদদলিত হয়। তাঁর কার্যের যে নতুন পর্যায়ই তিনি নিষ্পন্ন করুন না কেন, তা নিশ্চিতভাবেই মানবজাতির মাঝে বিকশিত ও সম্প্রসারিত হবে, এবং তাঁর মহান কার্য সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত নিশ্চিতভাবেই তা সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ড জুড়ে অপ্রতিহত গতিতে সম্পাদিত হবে। এ-ই হল ঈশ্বরের সর্বশক্তিমানতা ও প্রজ্ঞা, তাঁর কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা। তাই, প্রভু যীশু বিশ্রামবারে প্রকাশ্যে ঘর থেকে বেরিয়ে কাজ করতে পারলেন, কারণ তাঁর হৃদয়ে মানবজাতি-সঞ্জাত কোনো নিয়ম, কোনো জ্ঞান বা মতবাদ ছিল না। তাঁর যা ছিল তা হল ঈশ্বরের নতুন কার্য ও ঈশ্বরের পথ। তাঁর কার্য ছিল মানবজাতিকে মুক্ত করার, নিষ্কৃতি প্রদানের, তাদের আলোর মধ্যে থাকতে ও জীবনযাপন করতে দেওয়ার পথ। ইতিমধ্যে, যারা মূর্তিপূজা এবং ভণ্ড ঈশ্বরের আরাধনা করে, তারা প্রতিদিন শয়তানের দ্বারা আবদ্ধ হয়ে কালপাত করে, সমস্ত ধরনের নিষিদ্ধ বস্তু এবং নিষেধাজ্ঞার দ্বারা তারা প্রতিহত হয়—আজ একটা কিছুর উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয় তো কাল অন্য কিছুর উপর—তাদের জীবনে কোনো স্বাধীনতা নেই। তারা বন্দীদের মতো শৃঙ্খলে বাঁধা জীবন যাপন করেন, তাদের জীবন বলার মতো কোনো আনন্দ নেই। “নিষেধাজ্ঞা” বলতে কী বোঝানো হয়? বোঝানো হয় প্রতিবন্ধকতা, সীমাবদ্ধতা, এবং অন্যায়। মানুষ যখনই মূর্তিপূজা শুরু করে, তখনই সে আরম্ভ করে এক ভণ্ড ঈশ্বরের, এক দুষ্ট আত্মার আরাধনা। এই সমস্ত কাজকর্মের সঙ্গেই নিষেধাজ্ঞার প্রশ্ন জড়িত। কী খেতে পারবে বা পারবে না, আজ তুমি বেরোতে পারবে না পারবে না, কাল তুমি রান্না করতে পারবে না, তার পরের দিন নতুন গৃহে প্রবেশ করতে পারবে না, বিবাহ ও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া এমনকি সন্তানের জন্ম দেওয়ারও আলাদা করে দিন বেছে রাখতে হবে। এসবের অর্থ কী? এর অর্থ হল নিষেধাজ্ঞা; মানবজাতির জন্য দাসত্ব, শয়তান ও যে সকল দুষ্ট আত্মা মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, মানুষের হৃদয় এবং শরীরের উপর প্রতিবন্ধকতা আরোপ করতে চায়, এ সকল হল তাদেরই শৃঙ্খল। এই নিষেধাজ্ঞাগুলি কি ঈশ্বরের মধ্যে বিদ্যমান? যখন ঈশ্বরের পবিত্রতার বিষয়ে বলা হয়, সর্বপ্রথম তোমার যা চিন্তা করা উচিত তা হল: ঈশ্বরের মধ্যে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। তাঁর বাক্যে ও কার্যে ঈশ্বরের নীতিসমূহ রয়েছে, কিন্তু কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই, কারণ স্বয়ং ঈশ্বরই হলেন সত্য, পথ, ও জীবন।

এবার শাস্ত্র থেকে নিম্নলিখিত অনুচ্ছেদটির দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক: “আমি তোমাদের বলছি, মন্দিরের চেয়ে মহত্তর কিছু এখানে উপস্থিত। ‘দয়াতেই আমার প্রীতি, বলিদানে নয়,’ এ কথার মর্ম যদি বুঝতে তাহলে তোমরা নির্দোষকে দোষী সাব্যস্ত করতে না। মানবপুত্রই সাব্বাথ দিনের অধিপতি” (মথি ১২:৬-৮)। এখানে “মন্দির” শব্দটি কী নির্দেশ করে? সহজ কথায়, শব্দটি এক চমকপ্রদ, উঁচু ইমারতকে নির্দেশ করে, এবং বিধানের যুগে, যাজকরা এই মন্দিরেই ঈশ্বরের আরাধনা করতো। প্রভু যীশু যখন বলেছিলেন “মন্দিরের চেয়ে মহত্তর কিছু এখানে উপস্থিত,” এই “কিছু” বলতে কার বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছিল? স্পষ্টতই, এই “কিছু” হলেন দেহরূপী প্রভু যীশু, কারণ একমাত্র তিনিই ছিলেন মন্দিরের থেকে মহত্তর। এই বাক্যগুলি মানুষকে কী বলেছিল? এগুলি মানুষকে মন্দির থেকে নিষ্ক্রান্ত হতে বলেছিল—ঈশ্বর ইতিপূর্বেই মন্দির ত্যাগ করেছিলেন এবং সেখানে আর কার্য করছিলেন না, তাই মানুষের উচিত মন্দিরের বাইরে ঈশ্বরের পদচিহ্নের সন্ধান করা, এবং তাঁর নতুন কার্যে তাঁর পদক্ষেপ অনুসরণ করা। প্রভু যীশু যখন এমনটি বলেছিলেন, তখন তাঁর বাক্যের পিছনে এক ভিত্তিপ্রস্তাবনা ছিল, যা হল, বিধানের অধীনে, মন্দিরকে মানুষ স্বয়ং ঈশ্বরের থেকেও মহত্তর কিছু বলে বিবেচনা করেছিল। অর্থাৎ, ঈশ্বরের আরাধনা করার বদলে মানুষ মন্দিরের আরাধনা করেছিল, তাই প্রভু যীশু তাদের সতর্ক করেছিলেন যাতে তারা মূর্তির আরাধনা না করে বরং পরিবর্তে ঈশ্বরের আরাধনা করে, কারণ তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ। তাই, তিনি বলেছিলেন: “দয়াতেই আমার প্রীতি, বলিদানে নয়।” এটি স্পষ্টতই প্রতীয়মান যে প্রভু যীশুর দৃষ্টিতে, বিধানের অধীনে যাপনরত অধিকাংশ মানুষ আর যিহোবার আরাধনা করতো না, বরং, নিছকই আন্তরিকতাশূন্যভাবে তারা উৎসর্গ প্রদানের বিধি পালন করে যাচ্ছিল, এবং প্রভু যীশু নির্ণয় করেছিলেন যে, তা মূর্তিপূজারই নামান্তর। মন্দিরকে এই মূর্তি-উপাসকরা ঈশ্বর অপেক্ষাও মহত্তর ও উচ্চতর কিছু বলে জ্ঞান করেছিল। তাদের অন্তরে শুধু মন্দিরই ছিল, ঈশ্বর ছিলেন না, এবং তাদের যদি মন্দিরকে খোয়াতে হতো, তাহলে তারা তাদের বাসস্থানই হারিয়ে ফেলতো। মন্দিরের অবর্তমানে তাদের পূজার্চনার কোনো স্থান থাকতো না, এবং তারা তাদের উৎসর্গদান সম্পন্ন করতে পারতো না। মন্দিরে অবস্থানরতভাবে স্বীয় বিষয়কর্মাদি নির্বাহ করার উদ্দেশ্যে যেখানে তারা যিহোবা ঈশ্বরের অর্চনা করার মিথ্যা ছলনাকে ব্যবহার করতো, তা-ই হল তাদের তথাকথিত “বাসস্থান”। তাদের তথাকথিত “উৎসর্গ নিবেদন” ছিল নিতান্তই মন্দিরে সেবাকার্য পরিচালনার ছদ্মবেশে স্বীয় ব্যক্তিগত লজ্জাজনক কারবারগুলি নির্বাহ করা। এই কারণেই সেই সময়ের লোকজন মন্দিরকে ঈশ্বরের থেকে মহত্তর মনে করতো। মানুষের প্রতি এক সতর্কবার্তা হিসাবে প্রভু যীশু এই বাক্যগুলি উচ্চারণ করেছিলেন, কারণ মানুষকে এবং ঈশ্বরকে প্রতারণা করার জন্য মন্দিরকে তারা এক ছদ্ম বাহ্যরূপ, এবং উৎসর্গ নিবেদনকে এক মিথ্যা অন্তরাল হিসাবে ব্যবহার করছিল। এই বাক্যগুলিকে তোমরা যদি বর্তমান সময়ের উদ্দেশে প্রয়োগ করো, তবে তা এখনো একই রকম কার্যকর ও সমান প্রাসঙ্গিক। যদিও আজকের দিনের মানুষ বিধানের যুগের মানুষ অপেক্ষা ঈশ্বরের কার্যের বিচিত্রতর অভিজ্ঞতা লাভ করেছে, কিন্তু তাদের প্রকৃতির সারমর্ম অভিন্ন। আজকের কার্যের পরিপ্রেক্ষিতে, মানুষ এখনও “মন্দির ঈশ্বর অপেক্ষা মহত্তর” শব্দগুলির মাধ্যমে যা উপস্থাপিত হয়েছে, সেই একই ধরনের কাজই করবে। উদাহরণস্বরূপ, নিজেদের দায়িত্ব পালন করাকে মানুষ তাদের কাজ হিসাবে দেখে; ঈশ্বরের সাক্ষ্য বহন করা ও অতিকায় লাল ড্রাগনের সঙ্গে লড়াই করাকে তারা মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার সমর্থনে রাজনৈতিক আন্দোলন হিসাবে দেখে; নিজেদের দক্ষতার সদ্ব্যবহার করার কর্তব্যকে তারা তাদের পেশাগত বৃত্তিতে পরিণত করে, কিন্তু ঈশ্বরে ভীতি ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগের মতো বিষয়কে তারা এক পালনীয় ধর্মীয় মতবাদের অতিরিক্ত কোনোকিছু বলে গণ্য করে না; এবং ইত্যাদি আরো অনেক কিছু। এই আচরণগুলি মূলগতভাবে “মন্দির ঈশ্বর অপেক্ষা মহত্তর”-র সাথে অভিন্ন নয় কি? পার্থক্যটি হল, দু’হাজার বছর আগে, বাস্তব ইঁট-কাঠের মন্দিরে মানুষ তাদের ব্যক্তিগত কারবারগুলি নিষ্পন্ন করছিল, কিন্তু আজকাল, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয় এমন মন্দিরে মানুষ তাদের ব্যক্তিগত ব্যবসায় নির্বাহ করে থাকে। যেসব মানুষ নিয়মকানুনকে মূল্যবান জ্ঞান করে, তারা নিয়মকে ঈশ্বরের থেকে মহান বলে মনে করে, যেসব মানুষ পদমর্যাদা পছন্দ করে, তারা পদমর্যাদাকে ঈশ্বরের থেকে মহান বলে মনে করে, যারা নিজেদের পেশাগত বৃত্তিকে কে ভালোবাসে তারা তাদের পেশাগত বৃত্তিকে ঈশ্বরের থেকে মহান বলে মনে করে, ইত্যাদি—তাদের এইসব অভিব্যক্তি আমাকে বলতে প্ররোচিত করে: “মানুষ মুখের কথায় ঈশ্বরকে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে বন্দনা করে, কিন্তু তাদের দৃষ্টিতে সবকিছুই ঈশ্বর অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।” এর কারণ হল, যেইমাত্র মানুষ নিজ-নিজ ঈশ্বরানুসরণের পথে স্বীয় প্রতিভা প্রদর্শনের, অথবা তাদের নিজস্ব ব্যবসায় বা বৃত্তি নির্বাহের কোনো সুযোগ দেখতে পায়, তখনই তারা নিজেদের ঈশ্বর থেকে দূরবর্তী করে ফেলে, এবং তাদের অতিপ্রিয় পেশাদারী জীবনে তারা নিজেদের নিক্ষিপ্ত করে। ঈশ্বর তাদের যে দায়িত্ব অর্পণ করেছেন, এবং তাঁর অভিপ্রায়ের ন্যায় বিষয়গুলি বহু পূর্বেই পরিত্যক্ত হয়েছে। এই মানুষগুলির সঙ্গে দু’হাজার বছর আগে যারা মন্দিরে তাদের নিজস্ব ব্যবসায় পরিচালনা করতো সেই মানুষগুলির অবস্থার তফাৎটা কী?

এবার, এই অনুচ্ছেদটির শেষ বাক্যের দিকে একবার দৃষ্টিপাত করা যাক: “মানবপুত্রই সাব্বাথ দিনের অধিপতি।” এই বাক্যটির কি কোনো ব্যবহারিক দিক আছে? তোমরা কি এই ব্যবহারিক দিকটি দেখতে পাচ্ছো? ঈশ্বরের প্রত্যেকটি বাক্য তাঁর হৃদয় থেকে উৎসারিত হয়, তাহলে এমনটা তিনি কেন বলেছিলেন? বিষয়টি তোমরা কীভাবে প্রণিধান করছো? এখন হয়তো তোমরা এই বাক্যটির অর্থ উপলব্ধি করতে পারছো, কিন্তু যে সময় এটি উক্ত হয়েছিল তখন খুব বেশি মানুষ এর অর্থোদ্ধার করতে পারেনি, কারণ মানবজাতি তখন সবেমাত্র বিধানের যুগ থেকে বিনির্গত হয়েছিল। তাদের কাছে, বিশ্রামবার থেকে বিচ্যুত হওয়াটাই ছিল এক ভীষণ দুরূহ কর্ম, প্রকৃত বিশ্রামবার কী, তা উপলব্ধি করার বিষয়টা তো উল্লেখ না করাই শ্রেয়।

“মানবপুত্রই সাব্বাথ দিনের অধিপতি” বাক্যটি মানুষকে জানায় যে ঈশ্বরের সকলকিছুই এক বস্তুগত ভৌত প্রকৃতির নয়, যদিও ঈশ্বর তোমার সকল পার্থিব প্রয়োজনের যোগান দিতে পারেন, কিন্তু তোমার সকল স্থূল প্রয়োজন একবার মিটে গেলে, এই সব বস্তুগত পরিতৃপ্তি কি তোমার সত্যান্বেষণকে প্রতিস্থাপিত করতে পারে? স্পষ্টতই তা সম্ভব নয়! ঈশ্বরের স্বভাব এবং তাঁর যা আছে ও তিনি যা, যে বিষয়ে আমরা আলাপ-আলোচনা করেছি, উভয়ই সত্য। কোনো ভৌত বস্তুর নিরিখে এর মূল্য পরিমাপ করা যায় না, সে বস্তুটি যতই মহার্ঘ হোক, অথবা অর্থের ভিত্তিতেও এর মূল্য নির্ধারণ করা যায় না, কারণ তা কোনো পার্থিব সামগ্রী নয়, এবং তা প্রত্যেকটি মানুষের হৃদয়ের প্রয়োজনীয় সংস্থানসাধন করে। প্রতিটি মানুষের কাছে, এই স্পর্শাতীত সত্যগুলির মূল্য তুমি কদর করো এমন যেকোনো ভৌত বস্তুর মূল্য অপেক্ষা বেশি হওয়া উচিত, তা-ই নয় কি? এটি এমন এক উক্তি যার বিষয়ে তোমাদের সময় নিয়ে ভেবে দেখা প্রয়োজন। আমার বক্তব্যের মূল কথাটি হল, প্রতিটি মানুষের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি হল ঈশ্বরের যা আছে ও তিনি যা এবং ঈশ্বর সংক্রান্ত সকলকিছু, এবং কোনো পার্থিব সামগ্রীর দ্বারা এগুলিকে প্রতিস্থাপন করা যায় না। তোমাকে একটা উদাহরণ দিচ্ছি: খিদে পেলে তোমার খাদ্য প্রয়োজন। এই খাবার মোটের উপর ভালো বা অসন্তোষজনক দুই-ই হতে পারে, কিন্তু তুমি যদি যথেষ্ট পরিমাণে খেয়ে থাকো, তাহলে ক্ষুধার্ত হওয়ার ঐ অপ্রীতিকর অনুভূতিটি আর থাকবে না—চলে যাবে। তুমি শান্তিতে বসতে পারবে, এবং তোমার শরীর বিক্ষোভমুক্ত হবে। মানুষের ক্ষুধা খাদ্যের সাহায্যে মেটানো যায়, কিন্তু ঈশ্বরকে অনুসরণ করতে গিয়ে তুমি যদি অনুভব করো যে তাঁর সম্বন্ধে তোমার কোনো উপলব্ধি নেই, তাহলে তুমি তোমার অন্তরের শূন্যতাকে কীভাবে মেটাতে পারো? খাদ্য দিয়ে কি তা মেটানো যাবে? কিংবা ঈশ্বরকে অনুসরণ করতে গিয়ে তুমি যদি তাঁর ইচ্ছাকে উপলব্ধি না করো, তোমার হৃদয়ের সেই শূন্যতা নিবারণে তুমি কীসের সাহায্য নিতে পারো? ঈশ্বরের মাধ্যমে তোমার পরিত্রাণ লাভের অভিজ্ঞতা চলাকালীন, যখন তুমি তোমার স্বভাবের এক পরিবর্তন অন্বেষণ করছো, তখন যদি তুমি তাঁর ইচ্ছা উপলব্ধি না করো, বা সত্য কী, তা না জানো, তুমি যদি ঈশ্বরের স্বভাবকে উপলব্ধি করতে না পারো, তাহলে কি তুমি খুব অস্বচ্ছন্দ বোধ করবে না? তোমার অন্তরে তুমি কি এক প্রবল ক্ষুধা ও তৃষ্ণা অনুভব করবে না? এই অনুভূতিগুলি কি তোমাকে অস্থিরচিত্ত করে তুলবে না? তাহলে তুমি তোমার অন্তরের ওই ক্ষুধা কীভাবে নিবারণ করতে পারো—তা নিরসনের কি কোনো উপায় রয়েছে? কিছু মানুষ কেনাকাটা করতে বের হয়, মনের কথা বিশ্বাস করে বলার জন্য কিছু মানুষ তাদের বন্ধুদের খুঁজে নেয়, কেউ কেউ আবার লম্বা একটা ঘুম দেয়, অন্যেরা আরো বেশি করে ঈশ্বরের বাক্য পাঠ করে, কিম্বা তারা আরো পরিশ্রম করে এবং নিজেদের দায়িত্ব পালন করার জন্য আরো প্রচেষ্টা ব্যয় করে। এই কাজগুলি কি তোমার প্রকৃত সমস্যাগুলির সমাধান করতে পারে? তোমাদের সকলেরই এই ধরনের অনুশীলনগুলির বিষয়ে সম্পূর্ণ উপলব্ধি রয়েছে। তুমি যখন অসহায় বোধ করো, যখন তুমি সত্যের বাস্তবতা ও তাঁর ইচ্ছার বিষয়ে অবগত হওয়ার উদ্দেশ্যে ঈশ্বরের থেকে আলোকপ্রাপ্তিলাভের জন্য এক তীব্র আকুতি অনুভব করো, তখন তোমার সবথেকে বেশি কীসের প্রয়োজন? তখন তোমার একপ্রস্থ ভরপেট আহার সেরে নেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই, এবং কিছু সহানুভূতিপূর্ণ বাক্যও কোনো কাজে আসবে না, দৈহিক কামনাবাসনার ক্ষণস্থায়ী আরাম ও পরিতৃপ্তির কথা তো ছেড়েই দাও—তোমার যা প্রয়োজন তা হল ঈশ্বর যেন তোমায় প্রত্যক্ষ ও সুস্পষ্টভাবে জানান যে, তোমার কী করা উচিত, এবং কীভাবেই বা তা করা উচিত, যেন তিনি তোমায় পরিষ্কারভাবে জানান যে, সত্য কী। বিষয়টি তুমি উপলব্ধি করার পর, এমনকি যদি তুমি কেবল সামান্য একটু উপলব্ধি লাভ করো তবুও, তা থেকে তুমি কি তোমার অন্তরে একপ্রস্থ উত্তম ভোজনের অপেক্ষা অধিকতর পরিতৃপ্তি অনুভব করবে না? তোমার অন্তর তৃপ্ত হলে কি তোমার চিত্ত ও তোমার সমগ্র সত্তাও প্রকৃত বিশ্রাম লাভ করে না? এই উপমা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে, তোমরা কি এখন উপলব্ধি করেছো কেন তোমাদের সাথে আমি “মানবপুত্রই সাব্বাথ দিনের অধিপতি” বাক্যটি ভাগ করে নিতে চেয়েছিলাম? এর অর্থ হল, ঈশ্বরের থেকে যা আসে, তাঁর যা আছে ও তিনি যা, এবং তাঁর সঙ্গে সম্পর্কিত সকলকিছু, অন্য যেকোনো বস্তুর থেকে মহত্তর, যে বস্তু বা ব্যক্তিকে সবচেয়ে মূল্যবান জ্ঞান করো বলে একসময় তোমার বিশ্বাস ছিল, তাদের সমেত। অর্থাৎ, কোনো মানুষ যদি ঈশ্বরের মুখনিঃসৃত বাক্য লাভ করতে না পারে, বা সে যদি তাঁর ইচ্ছা উপলব্ধি না করে, তাহলে সে মানসিক স্থিরতা লাভ করতে পারে না। তোমাদের ভবিষ্যৎ অভিজ্ঞতায়, তোমরা উপলব্ধি করবে আজ কেন আমি এই অনুচ্ছেদটি তোমাদের দেখাতে চেয়েছিলাম—এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ঈশ্বর যাকিছু করেন তা সকলই সত্য ও জীবন। সত্য হল এমন এক বিষয়, মানুষের জীবনে যার ঘাটতি থাকলে চলে না, এবং তা হল এমনকিছু, যা না হলে তাদের কখনোই চলবে না; তুমি এমনটাও বলতে পারো যে, সত্যই হল মহত্তম বিষয়। যদিও তুমি সেটিকে চাক্ষুষ বা স্পর্শ করতে পারো না, তবু তোমার কাছে এর গুরুত্ব উপেক্ষণীয় নয়; সত্যই হল একমাত্র বস্তু যা তোমার অন্তরে স্থিরতা আনতে পারে।

সত্য সম্পর্কে তোমাদের উপলব্ধি কি তোমাদের নিজেদের অবস্থার সঙ্গে সমন্বিত? বাস্তব জীবনে, তোমাকে প্রথমে চিন্তা করতে হবে যে, কোন সত্যগুলি যেসকল মানুষ, ঘটনাবলী, ও বস্তুসমূহের তুমি সম্মুখীন হয়েছো, সেসকলের সঙ্গে সম্পর্কিত; এই সত্যগুলির মধ্যেই তুমি ঈশ্বরের ইচ্ছাকে খুঁজে পেতে পারো, এবং তুমি যা-র সম্মুখীন হয়েছো তা-র সাথে তাঁর ইচ্ছাকে সংযুক্ত করতে পারো। তোমারা যে বিষয়সকলের সম্মুখীন হয়েছো, তা সত্যের কোন দিকগুলির সঙ্গে সম্পর্কিত, তা যদি তোমার জানা না থাকে, তার বদলে যদি তুমি সরাসরি ইশ্বরের ইচ্ছার সন্ধান করো, তাহলে তা হবে এক অন্ধ অভিগমন, যা ফললাভ করতে পারে না। তুমি যদি সত্যের সন্ধান ও ঈশ্বরের ইচ্ছা উপলব্ধি করতে চাও, প্রথমে তোমার দেখা দরকার তোমার সাথে কী জাতীয় ঘটনা ঘটেছে, সত্যের কোন দিকগুলির সাথে তা সম্পর্কিত, এবং ঈশ্বরের বাক্যের মধ্যে তোমার অভিজ্ঞতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নির্দিষ্ট সত্যটিকে খুঁজে দেখো। এরপর তোমাকে ওই সত্যের মধ্যে তোমার জন্য যথাযথ অনুশীলনের পথটি খুঁজতে হবে; এইভাবে, ঈশ্বরের ইচ্ছার বিষয়ে তুমি এক পরোক্ষ উপলব্ধি লাভ করতে পারো। সত্যের অনুসন্ধান ও অনুশীলন যান্ত্রিকভাবে কোনো মতবাদের প্রয়োগ বা কোনো সূত্রের অনুসরণ করা নয়। সত্য কোনো বাঁধাধরা নিয়ম নয়, কোনো সূত্রও নয়। সত্য নিষ্প্রাণ বস্তু নয়—তা স্বয়ং প্রাণস্বরূপ, তা হল এক জীবন্ত বস্তু, এবং সত্য হল প্রতিটি সৃজিত সত্তার জীবনে অবশ্যপালনীয় এবং প্রত্যেক মানুষের জীবনে অবশ্যপ্রাপণীয় বিধি। তা হল এমনকিছু যা তুমি অবশ্যই, যত বেশি করে সম্ভব, তোমার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে উপলব্ধি করবে। তোমার অভিজ্ঞতার যে পর্যায়েই তুমি উপনীত হয়ে থাকো না কেন, ঈশ্বরের বাক্য বা সত্যের থেকে তুমি অবিচ্ছেদ্য, ঈশ্বরের স্বভাব বিষয়ে তুমি যা উপলব্ধি করো, এবং ঈশ্বরের যা আছে ও তিনি যা, সেই বিষয়ে যেটুকু তুমি জানো, তা-র সবই ঈশ্বরের বাক্যের মধ্যে ব্যক্ত হয়; সত্যের সঙ্গে এগুলি অচ্ছেদ্যভাবে সংযুক্ত। ঈশ্বরের স্বভাব এবং তাঁর যা আছে ও তিনি যা, এই সকলকিছুই স্বয়ংরূপে সত্য; সত্য হল ঈশ্বরের স্বভাব এবং তাঁর যা আছে ও তিনি যা, তা-র এক অকৃত্রিম উদ্ভাস। তাঁর যা আছে ও তিনি যা, তা-ই মূর্ত করে তোলে সত্য, এবং তাঁর যা আছে ও তিনি যা, সত্য তা-র এক স্পষ্ট বিবৃতি দেয়; ঈশ্বর কী পছন্দ করেন, কী তিনি পছন্দ করেন না, তোমার কোন কাজগুলি তাঁর কাঙ্ক্ষিত এবং কোন কাজগুলির তিনি অনুমোদন করেন না, কোন মানুষকে তিনি ঘৃণা করেন এবং কোন মানুষ তাঁকে তৃপ্তি দেয়—সত্য আরো সহজবোধ্য করে তোমাকে এসব জ্ঞাপন করে। ঈশ্বরের দ্বারা প্রকাশিত সত্যের মধ্যে মানুষ তাঁর পরিতোষ, ক্রোধ, বিষাদ, ও হর্ষ, সেই সঙ্গে তাঁর সারসত্য নিহিত দেখতে পায়—অর্থাৎ, দেখতে পায় তাঁর স্বভাবের উদ্ঘাটন। ঈশ্বরের যা আছে ও তিনি যা, তা জানা, এবং তাঁর বাক্য থেকে তাঁর স্বভাবকে উপলব্ধি করা ছাড়াও, সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ যা, তা হল ব্যবহারিক অভিজ্ঞতার মাধ্যমে এই উপলব্ধিতে উপনীত হওয়ার প্রয়োজনীয়তা। ঈশ্বরকে জানতে গিয়ে কোনো মানুষ যদি নিজেকে বাস্তব জীবন থেকে সরিয়ে নেয়, তাহলে সে ঈশ্বরকে জানতে সক্ষম হবে না। এমনকি ঈশ্বরের বাক্য থেকে কিছু উপলব্ধি অর্জনে সক্ষম এমন মানুষ যদি থাকেও, তাদের উপলব্ধি তত্ত্ব ও বাক্যের মধ্যেই সীমিত, এবং স্বয়ং ঈশ্বর বস্তুতই যেরূপ, তা-র সাথে সেই উপলব্ধির এক তারতম্য সৃষ্টি হয়।

বর্তমানে আমরা যে বিষয়ে আলাপচারিতা করছি তার সবটাই বাইবেলে লিপিবদ্ধ কাহিনীগুলির পরিসরের মধ্যে সীমায়িত। এই আখ্যানগুলির মাধ্যমে, এবং সেখানে যা ঘটেছিল তার বিশ্লেষণের মাধ্যমে, তাঁর স্বভাব এবং তাঁর যা আছে ও তিনি যা, সেই বিষয়ে তিনি যা প্রকাশিত করেছেন, তা মানুষ উপলব্ধি করতে পারে, এইভাবে তারা ঈশ্বরের প্রতিটি দিক সম্বন্ধে আরো বিশদভাবে, আরো গভীরভাবে, আরো ব্যাপকভাবে, এবং আরো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জানতে পারে। তাহলে কি একমাত্র এই আখ্যানগুলির মাধ্যমেই ঈশ্বরের প্রতিটি দিকের বিষয়ে জানা সম্ভব? না, এটাই একমাত্র পন্থা নয়! কারণ রাজ্যের যুগে ঈশ্বর যা বলেন ও যে কার্য তিনি সম্পন্ন করেন, তা মানুষকে তাঁর স্বভাবের বিষয়ে জানতে আরো উত্তমরূপে, ও আরো সম্পূর্ণরূপে, জানতে সহায়তা করতে পারে। কিন্তু আমার মনে হয়, কিছু দৃষ্টান্তের মাধ্যমে বা বাইবেলে লিপিবদ্ধ মানুষের জানাশোনা আখ্যানগুলির মাধ্যমে ঈশ্বরের স্বভাবকে জানা, এবং তাঁর যা আছে ও তিনি যা, তা উপলব্ধি করা কিছুটা বেশি সহজসাধ্য। আমি যদি বিচার ও শাস্তি সংক্রান্ত বাক্যগুলি এবং সাম্প্রতিককালে ঈশ্বরের দ্বারা ব্যক্ত সত্যগুলি এইভাবে অক্ষরে অক্ষরে ধরে তাঁর বিষয়ে তোমায় অবগত করানোর চেষ্টা করি, তাহলে তোমার তা খুবই নীরস ও ক্লান্তিকর বোধ হবে, এবং কিছু মানুষের এমনও মনে হতে পারে যে, ঈশ্বরের বাক্যগুলি বুঝি কিছু ছকে বাঁধা সূত্র। কিন্তু আমি যদি বাইবেলের এই আখ্যানগুলিকে দৃষ্টান্ত হিসাবে নিয়ে মানুষকে ঈশ্বরের স্বভাবের বিষয়ে জানতে সহায়তা করি, তাহলে তাদের কাছে তা ক্লান্তিকর মনে হবে না। বলা যায় যে, এই দৃষ্টান্তগুলি ব্যাখ্যাকালীন, সেসময় ঈশ্বরের অন্তরে যা ছিল—তাঁর মেজাজ বা ভাবানুভূতি, অথবা তাঁর চিন্তাভাবনা ও ধ্যানধারণা—তা মানবীয় ভাষায়মানুষের প্রতি উক্ত হয়েছে, এবং এই সকলকিছুর লক্ষ্য হল তাদেরকে উপলব্ধি করানো, অনুভব করানো, যে, ঈশ্বরের যা আছে ও তিনি যা, তা নিছকই সূত্রবদ্ধ নয়। তা কোনো লোকগাথা নয়, বা এমনকিছু নয় যা মানুষ চাক্ষুষ বা স্পর্শ করতে পারে না। এটি এমনকিছু যার বাস্তবিক অস্তিত্ব রয়েছে, যা মানুষ অনুভব ও উপলব্ধি করতে পারে। এটিই হল চূড়ান্ত লক্ষ্য। বলা যেতে পারে, এই যুগে বেঁচে থাকা মানুষরা আশীর্বাদধন্য। বাইবেলের উপাখ্যানগুলিকে কাজে লাগিয়ে তারা ঈশ্বরের পূর্ববর্তী কার্য বিষয়ক বিস্তৃততর উপলব্ধি লাভ করতে পারে; তাঁর সম্পাদিত কার্যের মাধ্যমে তারা তাঁর স্বভাবকে প্রত্যক্ষ করতে পারে; তাঁর দ্বারা অভিব্যক্ত এই স্বভাবগুলির মাধ্যমে তারা মানবজাতির নিমিত্ত ঈশ্বরের ইচ্ছাকে উপলব্ধি করতে পারে, এবং তাঁর পবিত্রতা ও মানুষের প্রতি তাঁর যত্নশীলতার মূর্ত উদ্ভাসনের মর্মগ্রহণ করতে পারে, এবং এই ভাবে, ঈশ্বরের স্বভাবের বিষয়ে তারা আরো অনুপুঙ্খ ও গভীরতর এক জ্ঞানে উপনীত হতে পারে। আমার বিশ্বাস যে তোমাদের সকলেই এখন তা অনুভব করতে পারছো!

অনুগ্রহের যুগে প্রভু যীশু যে কার্য সম্পূর্ণ করেছিলেন তার পরিসরের মধ্যে, তুমি ঈশ্বরের যা আছে ও তিনি যা, তা-র আরেকটি দিক প্রত্যক্ষ করতে পারো। এই দিকটি তাঁর দেহরূপের মাধ্যমে অভিব্যক্ত হয়েছিল, এবং তাঁর মানবতার কারণে মানুষ তা চাক্ষুষ ও উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিল। মনুষ্যপুত্রের মধ্যে, মানুষ প্রত্যক্ষ করেছিল কীভাবে দেহরূপী ঈশ্বর তাঁর মানবতা যাপন করেছিলেন, এবং তারা দেখেছিল ঈশ্বরের দেবত্বকে দেহের মাধ্যমে ব্যক্ত হতে। এই দুই ধরনের অভিব্যক্তি মানুষকে এক অত্যন্ত বাস্তব ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করতে দিয়েছিল, এবং এগুলি মানুষকে ঈশ্বরের বিষয়ে এক ভিন্নতর ধারণা গঠনের সুযোগ দিয়েছিল। কিন্তু, বিশ্বসৃষ্টি ও বিধানের যুগের সমাপ্তির মধ্যবর্তী সময়কালে, অর্থাৎ, অনুগ্রহের যুগের পূর্বে, ঈশ্বরের একমাত্র যে দিকটি মানুষ দেখেছিল, শ্রবণ করেছিল, এবং অনুভব করেছিল তা ছিল ঈশ্বরের দেবত্ব, এক অপার্থিব জগতে ঈশ্বর যাকিছু সম্পাদন ও উচ্চারণ করেছিলেন, তা, এবং তাঁর বাস্তব সত্তার মাধ্যমে যে দর্শনাতীত ও স্পর্শাতীত বিষয়গুলি তিনি ব্যক্ত করেছিলেন, সেগুলি। প্রায়শই, এই বিষয়গুলি মানুষকে অনুভব করিয়েছিল যে ঈশ্বর তাঁর মাহাত্ম্যে এতটাই অত্যুচ্চ যে তারা তাঁর কাছাকাছি যেতে পারে না। সচরাচর ঈশ্বর মানুষের মনে যে ধারণাটি সৃষ্টি করেছিলেন তা হল মানুষের তাঁকে অনুভব করার ক্ষমতার মাঝে তিনি ক্ষণে ক্ষণে উদ্ভাসিত ও নির্বাপিত হন, এবং মানুষ এমনকি এমনও অনুভব করেছিল যে তাঁর প্রতিটি চিন্তাভাবনা ও ধ্যানধারণা এতই রহস্যময় ও এতই অগম্য যে, সেগুলির নাগাল পাওয়ার কোনো উপায় নেই, সেগুলি উপলব্ধি বা অনুধাবনের চেষ্টামাত্রও আরোই দুষ্কর। মানুষের কাছে, ঈশ্বর সম্বন্ধীয় সকলকিছুই ছিল অতি দূরবর্তী বিষয়, এত দূরবর্তী যে মানুষ তা প্রত্যক্ষ বা স্পর্শ করতে অসমর্থ ছিল। মনে হতো যেন তিনি আকাশের অতি ঊর্ধ্বে রয়েছেন, মনে হতো যেন তাঁর যেন আদৌ কোনো অস্তিত্বই নেই। তাই ঈশ্বরের হৃদয় ও মন বা তাঁর কোনো চিন্তাকে উপলব্ধি করা মানুষের পক্ষে অসাধ্য, এমনকি তাদের নাগালের বাইরে ছিল। যদিও বিধানের যুগে ঈশ্বর কিছু বাস্তব কার্য সম্পাদন করেছিলেন, এবং নির্দিষ্ট কিছু বাক্যও তিনি উচ্চারণ করেছিলেন, এবং তাঁর বিষয়ে মানুষকে কিছু প্রকৃত জ্ঞানের উপলব্ধি ও অনুভব করতে দেওয়ার জন্য সুনির্দিষ্ট কিছু স্বভাবও তিনি ব্যক্ত করেছিলেন, কিন্তু তবু, অন্তিমে, ঈশ্বরের যা আছে ও তিনি যা, সেই বিষয়ক এই অভিব্যক্তিগুলি এসেছিল এক অপার্থিব জগত থেকে, এবং মানুষ যা উপলব্ধি করেছিল, তারা যা জেনেছিল, তা তবু ছিল তাঁর যা আছে ও তিনি যা, সেই বিষয়টির ঐশ্বরিক দিক সংক্রান্ত। তাঁর যা আছে ও তিনি যা, সেই বিষয়ক এই অভিব্যক্তি থেকে মানবজাতি কোনো সুনির্দিষ্ট ধারণা লাভ করতে পারেনি, এবং ঈশ্বর সম্বন্ধে তাদের বোধ তখনো আবদ্ধ ছিল নিম্নোক্ত পরিসরের ভিতর—“এক আধ্যাত্মিক সত্তা যার নিকটে যাওয়া দুষ্কর, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতার মধ্যে যিনি যাওয়া-আসা করেন”। যেহেতু ঈশ্বর মানুষের সম্মুখে আবির্ভূত হওয়ার জন্য পার্থিব জগতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো নির্দিষ্ট বস্তু বা কোনো প্রতিমূর্তি ব্যবহার করেননি, সেহেতু মানবীয় ভাষার সাহায্যে তাঁকে সংজ্ঞায়িত করতে মানুষ অসমর্থ রয়ে গিয়েছিল। মানুষ, স্বীয় হৃদয়ে ও মনে সর্বদা নিজস্ব ভাষা ব্যবহার করতে চেয়েছিল ঈশ্বরের পরিমাপের জন্য এক মানদণ্ড স্থাপন করতে, তাঁকে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য করে তুলতে, এবং তাঁর উপর আরোপ করতে মনুষ্যসুলভ চরিত্র, যেমন তিনি কতখানি দীর্ঘকায়, তিনি কতটা বৃহৎ, তিনি দেখতে কেমন, তিনি ঠিক কী পছন্দ করেন, এবং তাঁর ব্যক্তিত্ব কেমন। বস্তুত, মানুষ যে এহেন চিন্তা করছিল, তা ঈশ্বর মনে মনে জানতেন। মানুষের প্রয়োজনগুলির বিষয়ে তাঁর খুব স্পষ্ট ধারণা ছিল, এবং বলা বাহুল্য, তাঁর কী করণীয়, তা-ও তিনি জানতেন, তাই অনুগ্রহের যুগে তিনি তাঁর কার্য এক ভিন্নতর পন্থায় নিষ্পন্ন করেছিলেন। এই নতুন পদ্ধতিটি ছিল যুগপৎ ঐশ্বরিক ও মনুষ্যগুণসমন্বিত। যে সময়কালে প্রভু যীশু তাঁর কর্ম করেছিলেন, তখন মানুষ দেখতে পেয়েছিল যে, ঈশ্বরের অজস্র মানবিক অভিব্যক্তি রয়েছে। উদাহারণস্বরূপ, তিনি নাচতে পারতেন, তিনি বিবাহযাত্রায় অংশগ্রহণ করতে পারতেন, তিনি মানুষের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারতেন, তাদের প্রতি বক্তব্য রাখতে এবং বিভিন্ন বিষয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনা করতে পারতেন। এছাড়াও প্রভু যীশু এমনও অনেক কর্ম সম্পাদন করেন যার মাধ্যমে তাঁর দেবত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, এবং এই সকল কর্মই ছিল ঈশ্বরের এক অভিব্যক্তিস্বরূপ ও তাঁর স্বভাবের উদ্‌ঘাটন। এই সময়কালে, সাধারণ মানবদেহে ঈশ্বরের দেবত্ব এমনভাবে বাস্তবায়িত হয়েছিল যে, মানুষ তা দেখতে এবং স্পর্শ করতে সক্ষম হয়েছিল, তাদের আর এমন অনুভব হয়নি যে তিনি এক ঝলক দেখা দিয়েই আবার দৃষ্টিপথের বাইরে অপসৃত হচ্ছেন, বা, তারা তাঁর নিকটে পৌঁছাতে পারছে না। বরং, তারা মনুষ্যপুত্রের প্রতিটি সঞ্চালনে, এবং তাঁর বাক্যের ও কর্মের মাধ্যমে ঈশ্বরের ইচ্ছা অথবা তাঁর দেবত্ব উপলব্ধির চেষ্টা করতে পারতেন। মনুষ্যপুত্রের অবতার তাঁর মানবতার মাধ্যমে ঈশ্বরের দেবত্বকে প্রকাশ করেছিলেন, এবং মানবজাতির কাছে ঈশ্বরের ইচ্ছা জ্ঞাপন করেছিলেন। এবং একই সঙ্গে, ঈশ্বরের দ্বারা স্বীয় ইচ্ছা ও স্বভাবের এই অভিব্যক্তির মধ্য দিয়ে একই সঙ্গে তিনি ধরা-ছোঁয়ার অতীত সেই ঈশ্বরকে মানুষের কাছে প্রকাশিত করেছিলেন যিনি আধ্যাত্মিক জগতে অবস্থান করেন। স্বয়ং ঈশ্বরকে মানুষ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য রূপে, রক্ত-মাংসে নির্মিত রূপে, চাক্ষুষ করেছিল। তাই মনুষ্যপুত্রের অবতার স্বয়ং ঈশ্বরের পরিচিতি, ঈশ্বরের মর্যাদা, প্রতিমূর্তি, স্বভাব, এবং তাঁর যা আছে ও তিনি যা, প্রমূখ বিষয়কে মূর্ত ও মানবিকগুণসম্পন্ন করে তুলেছিলেন। যদিও ঈশ্বরের প্রতিমূর্তির বিষয়ে মনুষ্যপুত্রের বাহ্যিক রূপের কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল, কিন্তু তাঁর সারসত্য এবং তাঁর যা আছে ও তিনি যা, তা স্বয়ং ঈশ্বরের পরিচিতি ও মর্যাদার প্রতিনিধিত্ব করতে সম্পূর্ণরূপে সক্ষম ছিল—কেবল অভিব্যক্তির ধরনের ক্ষেত্রে কিছুটা পার্থক্য ছিল। একথা অনস্বীকার্য যে মনুষ্যপুত্র স্বয়ং ঈশ্বরের পরিচিতি ও মর্যাদার প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন, যুগপৎ তাঁর মানবিক রূপে ও তাঁর দেবত্বের মাঝে। অবশ্য এই সময়ে, ঈশ্বর দেহরূপের মাধ্যমে কার্য নির্বাহ করেছিলেন, দেহরূপের পরিপ্রেক্ষিত থেকে বক্তব্য রেখেছিলেন, এবং মনুষ্যপুত্রের পরিচিতি ও মর্যাদা সহযোগে মানবজাতির সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন, এবং তা মানুষকে মানবজাতির মাঝে ঈশ্বরের প্রকৃত বাক্য ও কার্যের মুখোমুখি হওয়ার ও অভিজ্ঞতালাভের সুযোগ দান করেছিল। একই সঙ্গে মানুষকে তা বিনয়ের মাঝে তাঁর দেবত্ব ও মাহাত্ম্যের বিষয়ে অন্তর্দৃষ্টি দান করেছিল, এবং ঈশ্বরের প্রামাণিকতা ও বাস্তবতার বিষয়ে এক প্রাথমিক উপলব্ধি ও সংজ্ঞা লাভের সুযোগ দিয়েছিল। যদিও প্রভুর যীশুর দ্বারা নিষ্পন্ন কার্য, তাঁর কার্যসম্পাদনের পদ্ধতি, এবং যে পরিপ্রেক্ষিত থেকে তিনি বক্তব্য রেখেছিলেন, তা আধ্যাত্মিক জগতে ঈশ্বরের প্রকৃত সত্তার থেকে স্বতন্ত্র ছিল, তবু তাঁর সংক্রান্ত সকলকিছুই যে সম্যকভাবে মানুষের অদৃষ্টপূর্ব স্বয়ং ঈশ্বরের প্রতিনিধিত্ব করেছিল—তা অনস্বীকার্য! অর্থাৎ, যে রূপেই ঈশ্বর আবির্ভূত হন না কেন, যে পরিপ্রেক্ষিত থেকেই তিনি বক্তব্য রাখুন না কেন, বা যে প্রতিমূর্তিতেই তিনি মানুষের মুখোমুখি হন না কেন, ঈশ্বর স্বয়ং নিজের ছাড়া অন্য কোনোকিছুর প্রতিনিধিত্ব করেন না। তিনি নির্দিষ্ট কোনো একজন মানুষের বা ভ্রষ্ট মানবজাতির মধ্যে কারো প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন না। ঈশ্বর কেবল স্বয়ং ঈশ্বরই, এবং তা-ও অনস্বীকার্য।

এবার, আমরা অনুগ্রহের যুগে প্রভু যীশু কথিত একটি উপাখ্যানের দিকে নজর দেবো।

৩. হারানো মেষের উপাখ্যান

মথি ১৮:১২-১৪ কোন লোকের যদি একশোটি মেষ থাকে ও তার মধ্যে যদি একটি হারিয়ে যায় তবে সে কি সেই নিরাব্বইটি মেষ পাহাড়ে ফেলে রেখে সেই হারানো মেষটিকে খুঁজতে যাবে না? তোমরা কি মনে কর? আর সে যদি কোন প্রকারে ঐটিকে খুঁজে পায়, তবে আমি তোমাদের সত্যই বলছি, যে নিরানব্বইটি মেষ হারায়নি, তাদের চেয়ে সেই ফিরে পাওয়া মেষটির জন্যই সে বেশি আনন্দ করবে। তেমনি এই নগণ্য ব্যক্তিদের মধ্যে একজনও বিনষ্ট হয়, এ আমার স্বর্গস্থ পিতার অভিপ্রেত নয়।

এই অনুচ্ছেদটি হল এক উপাখ্যান—মানুষকে এটি কী ধরনের অনুভূতি দান করে? অভিব্যক্তির যে রীতিটি এখানে ব্যবহৃত হয়েছে—অর্থাৎ উপাখ্যানের রীতি—মানুষের ভাষায় তা এক ধরনের অলংকার, আর সেই হিসাবে তা মানবিক জ্ঞানের পরিসরের অন্তর্ভুক্ত। বিধানের যুগে যদি ঈশ্বর এই প্রকারের কিছু উচ্চারণ করতেন, তাহলে মানুষ মনে করতো যে এহেন বাক্যসকল যিনি ঈশ্বর তাঁর সঙ্গে যথাযথভাবে সাযুজ্যপূর্ণ নয়, কিন্তু মনুষ্যপুত্র যখন অনুগ্রহের যুগে এই বাক্যগুলি উচ্চারণ করেছিলেন, তখন তা মানুষের কাছে সান্ত্বনাদায়ক, আন্তরিক, ও অন্তরঙ্গ বলে বোধ হয়েছিল। ঈশ্বর যখন দেহরূপ ধারণ করেছিলেন, যখন তিনি মনুষ্যরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন, তখন তাঁর অন্তরের কণ্ঠস্বরকে ব্যক্ত করার জন্য তিনি স্বীয় মানবতা থেকে আগত এক অতি যথোপযুক্ত উপাখ্যান ব্যবহার করেছিলেন। এই কণ্ঠস্বর ঈশ্বরের নিজের কণ্ঠস্বরের, এবং সেই যুগে যে কার্য তিনি নির্বাহ করতে চেয়েছিলেন তা-র প্রতিনিধিত্ব করেছিল। একই সঙ্গে, তা অনুগ্রহের যুগে মানুষের প্রতি ঈশ্বর প্রদর্শিত মনোভাবকেও তুলে ধরেছিল। মানুষের প্রতি ঈশ্বরের মনোভাবের পরিপ্রেক্ষিত থেকে দেখলে, প্রতিটি মানুষকে তিনি একটি মেষের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। কোনো মেষ যদি হারিয়ে যেতো, তবে তা খুঁজে পাওয়ার জন্য তিনি প্রয়োজনীয় সবকিছু করতেন। এটি দেহরূপধারণকালীন সময়ে মানবজাতির মাঝে ঈশ্বরের সে সময়কার কার্যের এক নীতির দ্যোতক ছিল। সেই কার্যে তাঁর সংকল্প ও মনোভাবকে বর্ণনা করার জন্য ঈশ্বর এই উপাখ্যানটি ব্যবহার করেছিলেন। ঈশ্বরের দেহধারণের এ-ই ছিল সুবিধা: তিনি মানবজাতির জ্ঞান থেকে সুবিধা নিতে পারতেন, এবং মানুষের ভাষা ব্যবহার করে তাদের সাথে প্রতি বক্তব্য রাখতে এবং তাঁর ইচ্ছা প্রকাশ করতে পারতেন। তিনি মানুষের কাছে তাঁর প্রগাঢ়, ঐশ্বরিক ভাষার, এমনভাবে ব্যখ্যা, অথবা “অনুবাদ” করেছিলেন, যা তার আগে অবধি মানুষকে মানুষের ভাষায় এবং মনুষ্যোচিত উপায়ে বুঝতে যারপরনাই ক্লেশ করতে হত। এর ফলে, মানুষের পক্ষে ঈশ্বরের ইচ্ছা উপলব্ধি করা, এবং তিনি কী করতে চাইছেন তা অনুধাবন করাটা অনেক সহজ হল। তিনি মানুষের সাথে মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে, মানুষেরই ভাষা ব্যবহার করে, কথোপকথন করতে পারতেন, এবং এমন ভাবে তাঁদের সাথে যোগাযোগ করতে পারতেন, যা মানুষ বুঝতে পারত। এমনকি মানুষ যাতে ঈশ্বরের দয়া এবং নৈকট্য অনুভব করতে পারে, যাতে তারা তাঁর হৃদয় দর্শন করতে পারে, সেই অভিপ্রায়ে তিনি মানুষের ভাষা এবং জ্ঞান ব্যবহার করে বক্তব্য রাখতে এবং কার্য সম্পাদন করতে পারতেন। এর থেকে তোমরা কী দেখতে পাচ্ছো? ঈশ্বরের বাক্য ও কার্যকলাপে কোনো নিষেধাজ্ঞা রয়েছে কি? মানুষের দৃষ্টিতে, স্বয়ং ঈশ্বর তাঁর অভিপ্রেত বক্তব্য জ্ঞাপনে, কার্য সম্পাদনে, বা স্বীয় ইচ্ছা ব্যক্ত করার বিষয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে কোনোক্রমেই মনুষ্যসুলভ জ্ঞান, ভাষা, অথবা মনুষ্যোচিত বাচনভঙ্গি প্রয়োগ করতে পারেন না। কিন্তু এই চিন্তা ভ্রান্ত। ঈশ্বর এই ধরনের উপাখ্যান ব্যবহার করেছিলেন যাতে মানুষ ঈশ্বরের বাস্তবতা ও আন্তরিকতাকে অনুভব, এবং সেই সময়কালে মানুষের প্রতি তাঁর মনোভাবকে প্রত্যক্ষ করতে পারে। এই উপাখ্যান দীর্ঘকালব্যাপী বিধানের অধীনে বসবাসরত মানুষকে এক স্বপ্ন থেকে জাগ্রত করেছিল, এবং অনুগ্রহের যুগে বসবাসরত মানুষের প্রজন্মের পর প্রজন্মকে তা উদ্বুদ্ধও করেছিল। এই উপাখ্যানের অনুচ্ছেদটি পাঠ করে, মানুষ মানবজাতির উদ্ধার-মানসে ঈশ্বরের আন্তরিকতার বিষয়ে অবগত হয়, এবং ঈশ্বরের অন্তরে মানবজাতিকে যে গুরুত্ব ও প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল, তা উপলব্ধি করে।

এই অনুচ্ছেদের সর্বশেষ বাক্যটির দিকে একবার তাকিয়ে দেখা যাক: “তেমনি এই নগণ্য ব্যক্তিদের মধ্যে একজনও বিনষ্ট হয়, এ আমার স্বর্গস্থ পিতার অভিপ্রেত নয়।” এটি কি প্রভু যীশুর নিজের বাক্য ছিল, নাকি স্বর্গস্থ পিতার বাক্য? বাহ্যিকভাবে মনে হয় প্রভু যীশুই যেন বক্তব্য রাখছেন, কিন্তু তাঁর ইচ্ছা স্বয়ং ঈশ্বরের ইচ্ছার প্রতিনিধিত্ব করে, যে কারণে তিনি বলেছেন: “তেমনি এই নগণ্য ব্যক্তিদের মধ্যে একজনও বিনষ্ট হয়, এ আমার স্বর্গস্থ পিতার অভিপ্রেত নয়।” তৎকালীন মানুষ স্বর্গস্থ পিতাকেই কেবল ঈশ্বর বলে স্বীকৃতি দিতো, এবং মনে করতো, তাদের চোখের সামনে যে মানুষটিকে তারা দেখতে পাচ্ছিলো, তিনি বুঝি তাঁর দ্বারা প্রেরিত হয়েছেন মাত্র, এবং স্বর্গস্থ পিতার প্রতিনিধিত্ব তিনি করতে পারেন না। এই কারণেই প্রভু যীশুকে উপাখ্যানের শেষে এই বাক্যটি যুক্ত করতে হয়েছিল, যাতে মানবজাতির জন্য ঈশ্বরের ইচ্ছাকে মানুষ প্রকৃতই অনুভব করতে পারে, এবং তাঁর বক্তব্যের প্রামাণিকতা ও যথার্থতাকে উপলব্ধি করতে পারে। উচ্চারণ করার পক্ষে যদিও এটি এক সাধারণ বাক্য মাত্র, কিন্তু এটি সতর্কতা ও ভালোবাসা সহকারে উক্ত হয়েছিল, এবং প্রভু যীশুর বিনয় ও প্রচ্ছন্নতাকে উদ্ঘাটিত করেছিল। ঈশ্বর দেহরূপেই অবস্থান করুন বা তিনি আধ্যাত্মিক জগতেই কার্য সম্পন্ন করুন, মানুষের অন্তরকে তিনি সর্বাপেক্ষা উত্তমরূপে জানতেন, এবং মানুষের কী প্রয়োজন তা সবচেয়ে ভালো ভাবে বুঝতেন, জানতেন কী নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন, আর কী-ই বা তাদের বিভ্রান্ত করে, এবং সেই কারণেই তিনি এই বাক্যটি সংযুক্ত করেছিলেন। এই বাক্যটি মানবজাতির মধ্যে লুক্কায়িত এক সমস্যাকে লক্ষণীয় করে তোলে: মনুষ্যপুত্র যা বলেছিলেন, তা নিয়ে মানুষ সন্দিগ্ধ ছিল, যার অর্থ, বক্তব্য রাখার সময় তাঁকে যোগ করতে হয়েছিল: “তেমনি এই নগণ্য ব্যক্তিদের মধ্যে একজনও বিনষ্ট হয়, এ আমার স্বর্গস্থ পিতার অভিপ্রেত নয়,” এবং, শুধুমাত্র এইরূপ উপস্থাপনের সূত্রেই, তাদের যথার্থতা বিষয়ে মানুষকে প্রতীত করতে, এবং তাদের বিশ্বাসযোগ্যতার উন্নতিসাধন করতে, তাঁর বাক্যগুলি ফলপ্রসু হতে পারতো। এটি প্রদর্শন করে যে, ঈশ্বর যখন এক স্বীকৃত মনুষ্যপুত্রে পরিণত হয়েছিলেন, তখন ঈশ্বর ও মানবজাতির মধ্যে এক অতি অস্বস্তিকর সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল, এবং মনুষ্যপুত্রের পরিস্থিতি ছিল খুবই বিব্রতকর। একই সঙ্গে, সেই সময়ে মানুষের মাঝে প্রভু যীশুর মর্যাদা যে কত অকিঞ্চিৎকর ছিল, এটি তা-ও প্রদর্শন করে। এই বাক্য উচ্চারণের প্রকৃত অভিপ্রায় ছিল মানুষকে অবগত করানো যে: তোমরা নিশ্চিত থাকতে পারো—এই বাক্যগুলি আমার অন্তরে যা আছে তার প্রতিনিধিত্ব করছে না, বরং তোমাদের অন্তরে যে ঈশ্বর রয়েছেন, এই বাক্যসমূহ তাঁরই ইচ্ছাস্বরূপ। মানবজাতির কাছে, এটি কি এক বিড়ম্বনার বিষয় ছিল না? যদিও ঈশ্বরের দেহরূপে কার্যসাধনের নানাবিধ সুবিধা ছিল, যা তাঁর দৈব সত্তার ছিল না, কিন্তু তাঁকে তাদের সন্দেহ ও প্রত্যাখ্যান, এবং তাদের অনুভূতিশূন্যতা ও বোধহীনতা সহ্য করতে হয়েছিল। বলা যেতে পারে যে, মনুষ্যপুত্রের কার্যের প্রক্রিয়া ছিল মানবজাতির প্রত্যাখ্যান এবং তাঁর বিরুদ্ধে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার অভিজ্ঞতা লাভের প্রক্রিয়া। তার থেকেও বড়ো ব্যাপার হল যে, তা ছিল ধারাবাহিকভাবে মানবজাতির আস্থা অর্জনের উদ্দেশ্যে, এবং তাঁর যা আছে ও তিনি যা, তা-র মাধ্যমে, তাঁর নিজস্ব সারসত্যের মাধ্যমে, মানবজাতিকে জয় করার উদ্দেশ্যে কার্য সম্পাদনের প্রক্রিয়া। বিষয়টা তেমন ততটা ছিল না যে, ঈশ্বরের অবতার একেবারে যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে শয়তানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হচ্ছেন; বিষয়টা বরং আরো বেশি এমন ছিল যে, ঈশ্বর এক সাধারণ মানুষে পরিণত হয়ে তাঁর অনুসরণকারীদের সঙ্গে এক সংগ্রাম আরম্ভ করেছিলেন, এবং এই সংগ্রামে মনুষ্যপুত্র তাঁর বিনয়, তাঁর যা আছে ও তিনি যা, আর তাঁর প্রেম ও প্রজ্ঞার সাহায্যে তাঁর কার্য সম্পূর্ণ করেছিলেন। যে মানুষদের তিনি চেয়েছিলেন, তাদের তিনি অর্জন করেছিলেন, যে পরিচিতি ও মর্যাদার তিনি যোগ্য, তা তিনি অর্জন করেছিলেন, এবং তাঁর সিংহাসনে “প্রত্যাবর্তন” করেছিলেন।

এবার, শাস্ত্রের নিম্নলিখিত অনুচ্ছেদদুটির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা যাক।

৪. সত্তরগুণ সাতবার ক্ষমা করো

মথি ১৮:২১-২২ পিতর তখন যীশুর কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, প্রভু, আমার ভাই যদি আমার বিরুদ্ধে কোনো অপরাধ করে, তবে আমি তাকে কতবার ক্ষমা করব? সাতবার? যীশু তাঁকে বললেন, না, সাতবার নয়, কিন্তু সত্তরগুণ সাতবার।

৫. প্রভুর ভালোবাসা

মথি ২২:৩৭-৩৯ যীশু উত্তর দিলেন, তুমি কায়মনোবাক্যে তোমার ঈশ্বরকে ভালবাসবে—এটি হল সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সর্বপ্রথম আদেশ। আর দ্বিতীয়টিও এরই তুল্য, তুমি তোমার প্রতিবেশীকে আত্মজ্ঞানে ভালবাসবে।

এই দুটি অনুচ্ছেদের মধ্যে একটি বলে ক্ষমাশীলতার বিষয়ে এবং অন্যটি বলে ভালোবাসার বিষয়ে। এই প্রসঙ্গদুটি প্রকৃতই অনুগ্রহের যুগে প্রভু যীশু যে কার্য সম্পন্ন করতে চেয়েছিলেন তা-র প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

দেহধারণ করাকালীন ঈশ্বর তাঁর সঙ্গে করে তাঁর কার্যের একটি পর্যায়কে নিয়ে এসেছিলেন, তা ছিল সেই নির্দিষ্ট করণীয় কার্যসমূহ ও স্বভাব, যা তিনি এই যুগে প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন। এই সময়কালে, মনুষ্যপুত্র যাকিছু করেছিলেন, তা এই যুগে যে কার্য ঈশ্বর সম্পন্ন করতে চেয়েছিলেন সেটিকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছিল। তা-র অতিরিক্ত বা তা-র কম কিছুই তিনি করতেন না। তাঁর উচ্চারিত প্রতিটি বাক্য ও তাঁর সম্পাদিত যাবতীয় প্রকার কার্যের সমস্তই এই যুগের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। এটি তিনি মনুষ্যসুলভ পদ্ধতিতে মানুষের ভাষাতেই ব্যক্ত করে থাকুন কি ঐশ্বরিক ভাষায়, এবং যে উপায়ে বা যে পরিপ্রেক্ষিত থেকেই তিনি তা করে থাকুন না কেন, তাঁর লক্ষ্য ছিল যে, তিনি যা করতে চেয়েছিলেন, তাঁর যা ইচ্ছা ছিল, এবং মানুষের প্রতি তাঁর চাহিদা যা ছিল, তা উপলব্ধি করতে মানুষকে সাহায্য করা। হতে পারে যে, তাঁর ইচ্ছা ও তাঁর মানবজাতির উদ্ধারের কার্যকে বুঝতে ও জানতে মানুষকে সহায়তা করার উদ্দেশ্যে তিনি বিবিধ উপায় ও বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত ব্যবহার করেছিলেন। তাই অনুগ্রহের যুগে মানবজাতির প্রতি অভীষ্ট বার্তা ব্যক্ত করার ক্ষেত্রে প্রভু যীশুকে অধিকাংশ সময় আমরা মানুষের ভাষা ব্যবহার করতে দেখেছি। উপরন্তু, তাঁকে আমরা দেখেছি একজন সাধারণ পথপ্রদর্শকের পরিপ্রেক্ষিত থেকে, যিনি মানুষের প্রতি বক্তব্য রাখছেন, তাদের চাহিদার সংস্থান করেছেন, এবং তারা যা অনুরোধ করেছিল সেই বিষয়ে তাদের সহায়তা করেছেন। এহেন কার্যসম্পাদন পদ্ধতি অনুগ্রহের যুগের অগ্রবর্তী বিধানের যুগে দেখা যায় নি। মানবজাতির সাথে তিনি আরো অন্তরঙ্গ ও আরো সহমর্মী হয়ে উঠেছিলেন, তদসহযোগে, যুগপৎ আকারে ও প্রকারে ব্যবহারিক ফলাফল অর্জনে আরো বেশি সক্ষম হয়ে উঠেছিলেন। মানুষকে সত্তর গুণ সাতবার ক্ষমা করার এই রূপকটি বস্তুতই এই বিষয়টিকে পরিস্ফূট করে। এই রূপকে উল্লেখিত সংখ্যাটি যে উদ্দেশ্য সাধন করে তা হল, এই বাক্য উচ্চারণকালীন প্রভু যীশুর অভিপ্রায় মানুষকে উপলব্ধি করতে অনুমোদিত করা। তাঁর অভিপ্রায় ছিল, মানুষ যেন অন্যদের ক্ষমা করে—একবার বা দুইবার নয়, এমনকি সাতবারও নয়, বরং সত্তর গুণ সাতবার। এই “সত্তর গুণ সাতবার” বিষয়টির মধ্যে কী প্রকারের ধারণা আধৃত রয়েছে? এটির উদ্দেশ্য ছিল ক্ষমাধর্মকে মানুষের নিজস্ব দায়িত্বে পরিণত করে তোলা, তাদের অবশ্যশিক্ষণীয় এক বিষয়, এবং অবশ্যপালনীয় এক “পন্থা”-য় পরিণত করা। যদিও এ হল এক রূপকমাত্র, তবু তা এক অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে লক্ষণীয় করে তোলার উদ্দেশ্যসাধন করেছিল। তিনি যা বলতে চাইছিলেন তা গভীরভাবে অনুধাবন করতে, এবং অনুশীলনের সঠিক পথ এবং অনুশীলনের নীতি ও আদর্শমানটি খুঁজে নিতে মানুষকে তা সহায়তা করেছিল। এই রূপকটি পরিষ্কারভাবে উপলব্ধি করতে মানুষকে সাহায্য করেছিল এবং তাদের এক সঠিক ধারণা দিয়েছিল যে—তাদের ক্ষমাশীলতার শিক্ষা নেওয়া উচিত এবং যতবারই হোক নিঃশর্তে ক্ষমা করা উচিত, কিন্তু তারা তা করবে এক সহিষ্ণুতা ও অন্যদের বোঝার মনোভাব নিয়ে। প্রভু যীশু এই বক্তব্যটি যখন রেখেছিলেন, তখন তাঁর অন্তরে কী ছিল? তিনি কি সত্যিই “সত্তর গুণ সাত” সংখ্যাটির বিষয়ে চিন্তা করছিলেন? না, তিনি তা করছিলেন না। ঈশ্বর কতবার মানুষকে ক্ষমা করবেন, তার কি কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যা হয়? কিছু মানুষ আছে যারা এখানে উল্লেখিত “এত সংখ্যক বার” শব্দবন্ধনীটি নিয়ে খুবই আগ্রহান্বিত, যারা এই সংখ্যাটির উৎস ও অর্থ প্রকৃতই বুঝে উঠতে চায়। তারা উপলব্ধি করতে চায় এই সংখ্যাটিই কেন প্রভু যীশুর মুখ থেকে নির্গত হয়েছিল; তাদের বিশ্বাস হল যে, এই সংখ্যাটির গভীরতর কোনো ব্যঞ্জনার্থ রয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, তা ছিল নিছকই ঈশ্বরের দ্বারা ব্যবহৃত এক মানবীয় বাচ্যালংকার। কোনো তাৎপর্য বা অর্থকে অবশ্যই মানবজাতির কাছে প্রভু যীশুর চাহিদার সঙ্গে একত্রে গ্রহণ করতে হবে। যেকালে ঈশ্বর তখনো দেহধারণ করেননি, তখন মানুষ তাঁর বক্তব্য খুব বেশি উপলব্ধি করতো না, কারণ তাঁর বাক্যসমূহ সম্পূর্ণ দেবত্ব থেকে উদ্গত হয়েছিল। তিনি যে উক্তিসমূহ করেছিলেন সেগুলির পরিপ্রেক্ষিত ও প্রসঙ্গ মানবজাতির কাছে অলক্ষ্য ও অনধিগম্য ছিল; তা মানুষের দর্শনাতীত এক আধ্যাত্মিক জগৎ থেকে ব্যক্ত হয়েছিল। স্থূল শরীরে জীবনধারণরত মানুষ আধ্যাত্মিক জগতকে ভেদ করে যেতে পারে নি। কিন্তু দেহধারণের পর ঈশ্বর মানবীয় পরিপ্রেক্ষিত থেকে মানবজাতির প্রতি বক্তব্য রেখেছিলেন, এবং আধ্যাত্মিক জগৎ থেকে বিনির্গত হয়ে তিনি ঐ জগতের পরিসর অতিক্রম করে গিয়েছিলেন। তিনি তাঁর ঐশ্বরিক স্বভাব, ইচ্ছা, ও মনোভাব এমন বিষয়ের মাধ্যমে অভিব্যক্ত করতে পারতেন যা মানুষ কল্পনা করতে পারতো, যা তারা তাদের জীবনে প্রত্যক্ষ করেছিল ও অভিজ্ঞতা লাভ করেছিল, এবং তিনি তা করতেন মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য পদ্ধতিতে, তাদের বোধগম্য ভাষায়, এবং তারা অনুধাবন করতে সক্ষম এমন প্রজ্ঞার সাথে, যাতে মানবজাতি ঈশ্বরকে উপলব্ধি করতে ও জানতে পারে, তাদের ক্ষমতার পরিসর ও সামর্থ্যের মাত্রার মধ্যে, তাঁর অভিপ্রায় ও তাঁর আদর্শমানের চাহিদাকে উপলব্ধি করতে পারে। এ-ই ছিল মানুষের মাঝে ঈশ্বরের কার্যের পদ্ধতি ও নীতি। দেহরূপে ঈশ্বরের কার্যনির্বাহের পন্থা ও নীতি মুখ্যত মানবতার সহায়তায় বা মানবতার মাধ্যমেই অর্জিত হলেও, তা প্রকৃতপক্ষেই তা এমন সব ফল লাভ করেছিল যা প্রত্যক্ষভাবে দেবত্বের মধ্যে কার্য সম্পাদনের দ্বারা অর্জন করা যেতো না। ঈশ্বরের মানবমাঝে সম্পাদিত কার্য ছিল অধিকতর মূর্ত, প্রামাণিক, ও লক্ষ্যনিষ্ঠ, পদ্ধতিগুলি ছিল আরো অনেক বেশি নমনীয়, এবং তা আকারগতভাবে বিধানের যুগে সম্পন্ন কার্যকে অতিক্রম করে গিয়েছিল।

এবার, প্রভুকে ভালোবাসা ও আত্মজ্ঞানে নিজের প্রতিবেশীকে ভালোবাসার বিষয়ে আলোচনা করা যাক। এটি কি এমনকিছু যা প্রত্যক্ষভাবে দেবত্বের মাঝেই ব্যক্ত হয়? না, স্পষ্টতই তা নয়! এগুলি হল সেই সকল প্রসঙ্গ, যে বিষয়ে মনুষ্যপুত্র মানবতার মাঝে বক্তব্য রেখেছিলেন; একমাত্র মানুষই এমন কিছু বলতে পারে যে “আত্মজ্ঞানে তোমার প্রতিবেশীকে ভালোবাসো,” এবং “যেভাবে তুমি তোমার জীবনকে লালন করো সেভাবেই অন্যদের ভালোবাসো।” এমনতর বাচনরীতি একান্তভাবেই মানবোচিত। ঈশ্বর কখনো এভাবে বক্তব্য রাখেননি। অন্ততপক্ষে তাঁর দেবত্বে, ঈশ্বরের এই প্রকারের ভাষা নেই, কারণ তাঁর মানবপ্রেমকে নিয়ন্ত্রিত করার জন্য ঈশ্বরের “আত্মজ্ঞানে তোমার প্রতিবেশীকে ভালোবাসো”-জাতীয় নীতির কোনো প্রয়োজন নেই, কারণ ঈশ্বরের মানবপ্রেম হল তাঁর যা আছে ও তিনি যা, তা-র এক স্বাভাবিক উদ্ঘাটন। কবে তোমরা ঈশ্বরকে এরকম কিছু বলতে শুনেছো যে: “আমি নিজেকে যেভাবে ভালোবাসি মানবজাতিকে সেভাবেই ভালোবাসি”? তোমরা কখনো শোনো নি, কারণ ঈশ্বরের সারসত্য ও তাঁর যা আছে ও তিনি যা, তা-র মধ্যেই রয়েছে ভালোবাসা। মানবজাতির প্রতি ঈশ্বরের ভালোবাসা, তাঁর মনোভাব, এবং আচরণের ধরন হল তাঁর স্বভাবের এক স্বাভাবিক অভিব্যক্তি ও উদ্ঘাটন। তাঁর প্রতিবেশীকে আত্মজ্ঞানে ভালোবাসার ক্ষমতা অর্জন করার জন্য সুচিন্তিতভাবে এক নির্দিষ্ট উপায়ে তা সম্পন্ন করা, অথবা সুচিন্তিতভাবে কোনো বিশেষ পদ্ধতি বা নৈতিক নিয়মাবলী অনুসরণ করার কোনো প্রয়োজন তাঁর নেই—তিনি ইতিমধ্যেই এহেন সারসত্যের অধিকারী। এর মধ্যে তুমি কী দেখতে পাও? ঈশ্বর যখন মানবমাঝে স্বীয় কার্য সম্পাদন করেছিলেন, তখন তাঁর অনেক পদ্ধতি, বাক্য, ও সত্য মানবীয় ধরনে অভিব্যক্ত হয়েছিল। কিন্তু একই সঙ্গে, ঈশ্বরের প্রকৃতি, তাঁর যা আছে ও তিনি যা, এবং তাঁর ইচ্ছাও প্রকাশিত হয়েছিল, যাতে মানুষ তা জানতে ও উপলব্ধি করতে পারে। যা তারা জানতে ও উপলব্ধি করতে পেরেছিল, তা যথাযথভাবে তাঁরই সারসত্য এবং তাঁর যা আছে ও তিনি যা, যা স্বয়ং ঈশ্বরের সহজাত স্বরূপ ও মর্যাদার প্রতিনিধিত্ব করে, তা-ই। অর্থাৎ, মনুষ্যপুত্র দেহরূপে যতদূর সম্ভব এবং যতটা নির্ভুলভাবে সম্ভব স্বয়ং ঈশ্বরের সহজাত প্রকৃতি ও সারসত্যকেই অভিব্যক্ত করেছিলেন। মনুষ্যপুত্রের মানবতা শুধু যে স্বর্গস্থ ঈশ্বরের সাথে মানুষের যোগাযোগ ও বিনিময়ের ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধক বা অন্তরায় হয়ে ওঠেনি তা-ই নয়, বরং প্রকৃতপক্ষে, তা ছিল সৃষ্টির প্রভুর সাথে মানবজাতির সংযোগ স্থাপনের একমাত্র মাধ্যম ও একমাত্র সেতু। এখন, এই বিন্দুতে এসে, তোমাদের কি মনে হচ্ছে না, যে, অনুগ্রহের যুগে প্রভু যীশুর সম্পাদিত কার্যের প্রকৃতি ও পদ্ধতির সাথে কার্যের বর্তমান পর্যায়ের প্রভূত সাদৃশ্য আছে? কার্যের এই চলতি পর্যায়টিও ঈশ্বরের স্বভাবকে ব্যক্ত করার জন্য প্রচুর পরিমানে মানবীয় ভাষা, এবং স্বয়ং ঈশ্বরের ইচ্ছাকে ব্যক্ত করার জন্য মানবজাতির দৈনন্দিন জীবন ও মানবীয় জ্ঞান থেকে পর্যাপ্ত পরিমানে ভাষা ও পদ্ধতি ব্যবহার করে। ঈশ্বর একবার অবতাররূপ ধারণ করার পর, তিনি কোনো মানবীয় পরিপ্রেক্ষিত থেকেই বক্তব্য রাখুন বা কোনো ঐশ্বরিক পরিপ্রেক্ষিত থেকে, তাঁর অভিব্যক্তির ভাষা ও পদ্ধতির অনেকখানি মানবীয় ভাষা ও পদ্ধতির মাধ্যম দিয়ে এসে পৌঁছায়। অর্থাৎ, ঈশ্বর যখন দেহধারণ করেন, তখনই তা তোমার জন্য ঈশ্বরের সর্বশক্তিমত্তা ও তাঁর প্রজ্ঞা প্রত্যক্ষ করার, এবং ঈশ্বরের প্রতিটি বাস্তব দিককে জানার সর্বশ্রেষ্ঠ সুযোগ। অবতাররূপ ধারণের পর ঈশ্বর যখন বড়ো হয়ে উঠছিলেন, তখন তিনি মানবজাতির কিছু জ্ঞান, সাধারণ বুদ্ধি, ভাষা ও মনুষ্যসুলভ অভিব্যক্তির কিছু পদ্ধতি উপলব্ধি করতে, শিখতে, আর আয়ত্ত করতে পেরেছিলেন। যে মনুষ্যকুল তিনি সৃষ্টি করেছিলেন, সেই মানুষের থেকে আগত এই বিষয়গুলির অধিকারী হয়েছিলেন। তাঁর প্রকৃতি ও তাঁর দেবত্বকে অভিব্যক্ত করার ক্ষেত্রে এগুলি দেহরূপী ঈশ্বরের হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল, এবং যখন তিনি মানবজাতির মাঝে এক মনুষ্যসুলভ পরিপ্রেক্ষিত থেকে ও মানবীয় ভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে কার্যসম্পাদন করছিলেন, তখন এগুলির সাহায্যে তিনি তাঁর কার্যকে আরো প্রাসঙ্গিক, অধিকতর প্রামাণ্য ও নির্ভুলতর করে তুলেছিলেন। এটি তাঁর কার্যকে মানুষের পক্ষে আরো অধিগম্য ও আরো সহজবোধ্য করে তুলেছিল, এইভাবে ঈশ্বরের কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জিত হয়েছিল। এইভাবে দেহরূপে ঈশ্বরের কার্য সম্পাদন কি অধিকতর ব্যবহারিক নয়? তা কি ঈশ্বরের প্রজ্ঞা নয়? ঈশ্বর যখন অবতাররূপ ধারণ করেছিলেন, যখন ঈশ্বর দেহরূপে তাঁর অভীষ্ট কার্যের দায়িত্বভার গ্রহণে সক্ষম হয়েছিলেন, তখনই তিনি ব্যবহারিকরূপে তাঁর স্বভাব ও তাঁর কার্যকে ব্যক্ত করতে সক্ষম হয়েছিল, এবং সেই সময়েই তিনি মনুষ্যপুত্র রূপে তাঁর সেবাব্রতের আনুষ্ঠানিক সূচনা করতে পারতেন। এর অর্থ ছিল, ঈশ্বর ও মানুষের মধ্যে আর কোনো “প্রজন্মগত ব্যবধান” রইলো না, ঈশ্বর শীঘ্রই তাঁর বার্তাবাহকের মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষার কার্যে ক্ষান্তি দেবেন, এবং ঈশ্বর স্বয়ং ব্যক্তিগতভাবে তাঁর দেহরূপের মাধ্যমে যে সকল বাক্য ও কার্য ব্যক্ত করতে চেয়েছিলেন তা ব্যক্ত করতে পারতেন। এর অর্থ ছিল এ-ও যে, ঈশ্বর যে মানুষদের উদ্ধার করেন, তারা তাঁর অধিকতর অন্তরঙ্গ ছিল, তাঁর পরিচালনামূলক কার্য নতুন কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেছিল, এবং সমগ্র মানবজাতি এক নতুন যুগের সম্মুখীন হতে চলেছিল।

যারা বাইবেল পাঠ করেছে তারা সকলেই জানে যে প্রভু যীশুর জন্মের সময় অনেক ঘটনা ঘটেছিল। সেই ঘটনাসমূহের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল দানবরাজ কর্তৃক তাঁর তল্লাশ, ঘটনাটি এমনই চরম সীমায় পৌঁছেছিল যে নগরীর দুই বছর বা তার কম বয়সী সকল শিশুকে হত্যা করা হয়েছিল। এটি স্পষ্টতই প্রতীয়মান যে মানুষের মাঝে দেহধারণ করে ঈশ্বর চরম এক ঝুঁকি নিয়েছিলেন; মানবজাতির উদ্ধারের নিমিত্ত তাঁর ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণ করার জন্য যে বিশাল মূল্য তাঁকে পরিশোধ করতে হয়েছিল, তা-ও সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান। দেহরূপে মানবজাতির মাঝে তাঁর কার্য সম্পাদনের ব্যাপারে ঈশ্বর যে গভীর প্রত্যাশা পোষণ করতেন, তা-ও এখানে দৃশ্যমান। ঈশ্বরের দেহরূপী অবতার যখন মানবজাতির মধ্যে কার্য সম্পাদনের দায়িত্ব গ্রহণ করতে সমর্থ হয়েছিলেন, তখন তাঁর অনুভূতি কেমন ছিল? মানুষের তা কিছু পরিমানে তা উপলব্ধি করতে পারা উচিত, উচিত নয় কি? অন্ততপক্ষে, ঈশ্বর খুশি হয়েছিলেন কারণ মানবজাতির মাঝে তিনি তাঁর নতুন কার্যের সূচনা করতে পেরেছিলেন। প্রভু যীশু যখন দীক্ষিত হয়েছিলেন ও আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁর সেবাব্রত পালনের কার্য আরম্ভ করেছিলেন, তখন ঈশ্বরের হৃদয় আনন্দে আপ্লুত হয়েছিল, কারণ বহু বছরের অপেক্ষা ও প্রস্তুতির পর, অবশেষে তিনি এক সাধারণ মানুষের দেহ ধারণ করতে এবং মানুষের দৃষ্টি ও স্পর্শগ্রাহ্য রক্তমাংসের এক মানুষের আকৃতিতে তাঁর নবকার্যের সূচনা ঘটাতে পেরেছিলেন। এক মানুষের পরিচয়ে অবশেষে তিনি মানুষের সাথে সামনাসামনি ও খোলামনে কথা বলতে পেরেছিলেন। মানবীয় পন্থা ও মানবীয় ভাষার মধ্যস্থতায় অবশেষে তিনি মানবজাতির মুখোমুখি আসতে পেরেছিলেন; মানবীয় ভাষা ব্যবহার করে তিনি মানবজাতির জন্য সংস্থান বিধান করতে, তাদের আলোকিত করতে ও সহায়তা করতে পেরেছিলেন; তাদের সঙ্গে একই টেবিলে বসে খাদ্যগ্রহণ করতে ও একই পরিসরে বসবাস করতে সক্ষম হয়েছিলেন। মানুষ যেভাবে দেখে সেভাবেই এবং এমনকি তাদের নিজস্ব চক্ষু দিয়েই তিনি মানুষ, দ্রব্যাদি ও সকলকিছু চাক্ষুষ করতেও সমর্থ হয়েছিলেন। ঈশ্বরের কাছে, তা ইতিমধ্যেই ছিল তাঁর দেহরূপে সাধিত কার্যে প্রথম জয়লাভ। এ-ও বলা যায় যে, তা ছিল এক মহান কার্যের অভীষ্টসিদ্ধি—নিশ্চিতভাবে এই কারণেই ঈশ্বর সবচেয়ে বেশি আনন্দিত হয়েছিলেন। তখন থেকে শুরু করে, সেই প্রথম ঈশ্বর মানবজাতির মধ্যে তাঁর কার্যে এক ধরনের স্বস্তি অনুভব করলেন। যে ঘটনাগুলো ঘটে গিয়েছিল তাদের সবই ছিল অত্যন্ত ব্যবহারিক ও স্বাভাবিক, এবং যে স্বস্তি ঈশ্বর অনুভব করেছিলেন তা ছিল অত্যন্ত যথার্থ। মানবজাতির জন্য, যতবার ঈশ্বরের কার্যের কোনো নতুন পর্যায় সুসম্পন্ন হয়, এবং যতবার ঈশ্বর চরিতার্থ বোধ করেন, মানবজাতি তত বেশি করে ঈশ্বরের ও পরিত্রাণের নিকটবর্তী হতে পারে। ঈশ্বরের কাছে, তাঁর পরিচালনামূলক পরিকল্পনাকে অগ্রবর্তী করে এটি তাঁর নতুন কার্যের সূত্রপাতও বটে, এবং, তদুপরি, এমনতর সময়গুলিতে তাঁর অভিপ্রায় সম্পূর্ণ চরিতার্থতার দিকে এগিয়ে যায়। মানবজাতির কাছে, এহেন সুযোগের আগমান সৌভাগ্যজনক, ও অতীব শুভ; যে সকল মানুষ ঈশ্বরের পরিত্রাণের অপেক্ষায় রয়েছে, তাদের জন্য তা হল অতি গুরুত্ববহ ও আনন্দদায়ক সংবাদ। ঈশ্বর যখন কার্যের এক নতুন পর্যায় সম্পন্ন করেন, তখন তিনি এক নব সূচনায় উপনীত হন, এবং মানবজাতির মাঝে যখন এই নতুন কার্য ও নব সূচনার প্রবর্তন ও সূত্রপাত ঘটে, তা হল যখন কার্যের এই পর্যায়ের ফলাফল ইতিমধ্যেই নিরূপিত ও অর্জিত হয়েছে এবং এর চূড়ান্ত পরিণতি ও ফলশ্রুতি ঈশ্বর ইতিমধ্যেই দৃষ্টিগোচর করেছেন। আর তখনই এই ফলাফলগুলি ঈশ্বরকে পরিতৃপ্ত করে, এবং, নিশ্চিতভাবে, তখনই তাঁর হৃদয় উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। ঈশ্বর আশ্বস্ত বোধ করেন, কারণ তাঁর দৃষ্টিতে, যে মানুষগুলির তিনি অন্বেষণ করছিলেন, তাদের ইতিমধ্যেই তিনি চাক্ষুষ ও নির্ধারিত করে ফেলেছিলেন, এবং এই জনগোষ্ঠীটিকে ইতিমধ্যেই তিনি অর্জন করেছিলেন, যে গোষ্ঠীটি তাঁর কার্যকে সাফল্যমণ্ডিত করতে ও তাঁকে পরিতৃপ্তি এনে দিতে সক্ষম। অতএব, তিনি তাঁর দুশ্চিন্তাগুলিকে দূরে সরিয়ে রেখে আনন্দিত বোধ করেন। অন্য ভাবে বললে, ঈশ্বরের দেহরূপী অবতার যখন মানুষের মাঝে তাঁর নতুন কার্যের সূত্রপাত করতে সক্ষম হন, এবং অপ্রতিহতভাবে তাঁর করণীয় কার্যের সম্পাদন শুরু করেন, এবং যখন তিনি অনুভব করেন যে সকলকিছু সুসম্পন্ন হয়েছে, তখন ফলাফলটি তাঁর কাছে ইতিমধ্যেই দৃষ্টিগোচর। এই কারণেই তিনি সন্তুষ্ট ও তাঁর হৃদয় উৎফুল্ল। ঈশ্বরের প্রফুল্লতা কীভাবে অভিব্যক্ত হয়? উত্তরটি কী হতে পারে, তা কি তোমরা কল্পনা করতে পারো? ঈশ্বর কি আনন্দে অশ্রুপাত করতে পারেন? ঈশ্বরের পক্ষে অশ্রুপাত করা কি সম্ভব? ঈশ্বর কি করতালি দিতে পারেন? ঈশ্বর কি নৃত্যে প্রবৃত্ত হতে পারেন? ঈশ্বর কি গান গেয়ে উঠতে পারেন? যদি পারেন, তাহলে কোন গীত তিনি গাইবেন? অবশ্যই, ঈশ্বর কোনো এক শ্রুতিমধুর, মর্মস্পর্শী গান গেয়ে উঠতে পারেন, এমন এক সঙ্গীত যা তাঁর হৃদয়ের আনন্দ ও তৃপ্তিকে প্রকাশ করতে পারে। এই গান তিনি মানবজাতির উদ্দেশ্যে, তাঁর নিজের জন্য, এবং সকলকিছুর উদ্দেশ্যে গেয়ে উঠতে পারেন। ঈশ্বরের আনন্দ যে কোনো ভাবেই প্রকাশ পেতে পারে—এই সবকিছুই স্বাভাবিক কারণ ঈশ্বরের সুখদুঃখ রয়েছে, এবং তাঁর বিবিধ অনুভূতি বিবিধ উপায়ে ব্যক্ত হতে পারে। এটি তাঁর অধিকার, এবং আর কোনোকিছুই এর থেকে বেশি স্বাভাবিক ও যথাযথ হতে পারে না। এই বিষয়ে মানুষের অন্য কিছু চিন্তা করা উচিত নয়। ঈশ্বরের উপর তোমাদের “বন্ধনী শক্ত করা মন্ত্র”[ক] প্রয়োগের চেষ্টা করা উচিত নয়, তোমাদের এমনটা বলা সঙ্গত নয় যে, তাঁর এটা বা ওটা করা অনুচিত, তাঁর এহেন বা সেহেন ধরনের আচরণ অনুচিত, এবং উচিত নয় তাঁর আনন্দ বা তাঁর সম্ভাব্য অন্য যেকোনো অনুভূতিকে এইভাবে সীমাবদ্ধ করা। মানুষ মনে করে যে ঈশ্বর খুশি হতে পারেন না, অশ্রুবিসর্জন করতে পারেন না, কাঁদতে পারেন না—কোনো ভাবাবেগই বুঝি তিনি প্রকাশ করতে পারেন না। এই দুটি আলোচনার মাধ্যমে আমরা যে আলাপচারিতা করেছি, তার পরে আমার বিশ্বাস যে, তোমরা ঈশ্বরকে আর এইভাবে দেখবে না, বরং ঈশ্বরকে কিছু স্বাধীনতা ও অব্যাহতি মঞ্জুর করবে। তা অতি উত্তম বিষয়। ভবিষ্যতে, ঈশ্বরকে দুঃখিত হতে শুনলে তোমরা যদি তাঁর দুঃখকে প্রকৃতই অনুভব করতে পারো, এবং তাঁকে আনন্দিত হতে শুনলে যদি তাঁর আনন্দকে যথার্থই অনুভবে সমর্থ হও, তাহলে, অন্ততপক্ষে, তোমরা এটুকু স্পষ্টভাবে জানতে ও উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে যে, কী ঈশ্বরকে খুশি করে, আর কী-ই বা তাঁকে করে দুঃখিত। যখন ঈশ্বর বিষণ্ণ বলে তুমি নিজেও বিষণ্ণ বোধ করতে, এবং ঈশ্বর আনন্দিত বলে আনন্দিত বোধ করতে সক্ষম হবে, তখন তিনি তোমার হৃদয়কে সম্পূর্ণরূপে অর্জন করে ফেলবেন, এবং তোমার নিজের ও তাঁর মধ্যে আর কোনো প্রতিবন্ধক থাকবে না। তুমি মানবীয় কল্পনা, পূর্বধারণা, ও জ্ঞানের দ্বারা ঈশ্বরকে গণ্ডিবদ্ধ করার চেষ্টা করবে না আর। সেই সময়ে, ঈশ্বর জীবন্ত ও প্রাণবন্ত হয়ে উঠবেন তোমার অন্তরে। তিনি হয়ে উঠবেন তোমার জীবনের ঈশ্বর এবং তোমার সম্পর্কিত সকলকিছুর প্রভু। তোমাদের কি এই জাতীয় উচ্চাকাঙ্ক্ষা রয়েছে? তোমরা কি তা অর্জন করতে পারবে বলে আত্মবিশ্বাসী?

এবার, ধর্মগ্রন্থ থেকে নিম্নলিখিত অনুচ্ছেদটি পাঠ করা যাক:

৬. পর্বতে প্রদত্ত যীশুর উপদেশ

ঐশ্যরাজ্যের সুখ (মথি ৫:৩-১২)

লবণ ও জ্যোতি (মথি ৫:১৩-১৬)

বিধান (মথি ৫:১৭-২০)

ক্রোধ (মথি ৫:২১-২৬)

ব্যভিচার (মথি ৫:২৭-৩০)

বিবাহবিচ্ছেদ (মথি ৫:৩১-৩২)

শপথ (মথি ৫:৩৩-৩৭)

চোখের বদলে চোখ (মথি ৫:৩৮-৪২)

তোমার শত্রুদের ভালোবাসো (মথি ৫:৪৩-৪৮)

দান করার বিষয়ে নির্দেশ (মথি ৬:১-৪)

প্রার্থনা (মথি ৬:৫-৮)

৭. প্রভু যীশুর উপাখ্যানসমূহ

বীজবপনকারীর উপাখ্যান (মথি ১৩:১-৯)

শ্যামাঘাসের উপাখ্যান (মথি ১৩:২৪-৩০)

সরিষা বীজের উপাখ্যান (মথি ১৩:৩১-৩২)

খামিরের উপাখ্যান (মথি ১৩:৩৩)

শ্যামাঘাসের উপাখ্যানের ব্যাখ্যা (মথি ১৩:৩৬-৪৩)

গুপ্তধনের উপাখ্যান (মথি ১৩:৪৪)

মুক্তার উপাখ্যান (মথি ১৩:৪৫-৪৬)

টানাজালের উপাখ্যান (মথি ১৩:৪৭-৫০)

৮. আদেশসমূহ

মথি ২২:৩৭-৩৯ যীশু উত্তর দিলেন, তুমি কায়মনোবাক্যে তোমার ঈশ্বরকে ভালবাসবে—এটি হল সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সর্বপ্রথম আদেশ। আর দ্বিতীয়টিও এরই তুল্য, তুমি তোমার প্রতিবেশীকে আত্মজ্ঞানে ভালবাসবে।

প্রথমে “পর্বতে অবস্থানকালে প্রদত্ত ধর্মোপদেশ”-এর বিভিন্ন অংশের প্রত্যেকটির দিকে তাকিয়ে দেখা যাক। এই বিভিন্ন অংশগুলির সবকটিই কোন বিষয়টি আলোচনা করে? নিশ্চিতভাবে বলা যায়, এই সকল বিভিন্ন অংশগুলির বিষয়বস্তু বিধানের যুগের বিধিনিষেধগুলির তুলনায় আরো সমুন্নত, অধিকতর বস্তুগত, এবং মানুষের জীবনের নিকটতর। আধুনিক পরিভাষায় বললে, এই বিষয়গুলি মানুষের বাস্তব অনুশীলনের সঙ্গে আরো বেশি প্রাসঙ্গিক।

নিম্নবর্ণিত সুনির্দিষ্ট বিষয়বস্তুটির সম্বন্ধে পাঠ করা যাক: ঐশ্যরাজ্যের সুখ বিষয়ক যীশুর ধর্মোপদেশগুলি তোমার কীভাবে উপলব্ধি করা উচিত? বিধান সম্পর্কে তোমার কী অবগত থাকা বিধেয়? ক্রোধকে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করা উচিত? ব্যভিচারীদের কীভাবে মোকাবিলা করা উচিত? বিবাহবিচ্ছেদের বিষয়ে কীভাবে কথা বলা বিধিসম্মত, এবং এর বিষয়ে কী ধরনের আইনকানুন রয়েছে? কারা বিবাহবিচ্ছিন্ন হতে পারে এবং কারা পারে না? শপথ, প্রতিহিংসা, শত্রুকে ভালোবাসা, এবং বদান্য হওয়া বিষয়গুলিকেই বা কীভাবে দেখা বিধেয়? এবং এজাতীয় আরো অনেক বিষয়। এই বিষয়গুলির সবই মানবজাতির ঈশ্বর-বিশ্বাস সম্বন্ধীয় অনুশীলন, ও তাদের ঈশ্বর-অনুসরণের প্রতিটি দিকের সঙ্গে সম্পর্কিত। এই অনুশীলনগুলির কয়েকটি আজও প্রযোজ্য হলেও ইদানিং মানুষের কাছ থেকে যা প্রার্থিত তার তুলনায় এগুলি অপেক্ষাকৃত অগভীর—এগুলি মানুষের ঈশ্বর-বিশ্বাসের পথে সম্মুখীন হওয়া মোটামুটি প্রাথমিক কিছু সত্য। প্রভু যীশু যখন তাঁর কার্য সম্পাদন শুরু করেছিলেন, তখন ইতিমধ্যেই তিনি মানুষের জীবন চরিত্রের উপর কাজ করতে আরম্ভ করেছিলেন, কিন্তু তাঁর কার্যের এই দিকগুলি বিধানের ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। এই সব নিয়মাবলী এবং এই প্রসঙ্গগুলির বিষয়ে কথা বলার পদ্ধতির সাথে সত্যের কি কোনো সম্পর্ক রয়েছে? অবশ্যই রয়েছে! পূর্বাতন যাবতীয় বিধিনিষেধ ও নীতিসমূহ, এবং অনুগ্রহের যুগের এই ধর্মানুশাসনসমূহ, উভয়ই ঈশ্বরের স্বভাব এবং তাঁর যা আছে ও তিনি যা, তা-র সঙ্গে সম্পর্কিত, এবং অবশ্যই, সত্যের সঙ্গেও সম্পর্কিত। ঈশ্বর যা-ই অভিব্যক্ত করুন, এবং ভাষা বা অভিব্যক্তির যে প্রণালীই তিনি ব্যবহার করে থাকুন না কেন, তাঁর দ্বারা প্রকাশিত সকল বিষয়ের ভিত্তি, ব্যুৎপত্তি ও সূচনাবিন্দু রয়েছে তাঁর স্বভাব এবং তাঁর যা আছে ও তিনি যা, তা-র নীতিসমূহের মধ্যে। এ হল এক নিপাট সত্য। তাই তাঁর এই উক্তিগুলি এখন কিছুটা অগভীর বলে মনে হলেও, তুমি তাদের অসত্য বলতে পারো না, কারণ, ঈশ্বরের ইচ্ছা পূর্ণ করার এবং তাদের জীবন চরিত্রে একটা পরিবর্তন অর্জনের লক্ষ্যে, অনুগ্রহের যুগের মানুষজনের কাছে এই বিষয়গুলি অপরিহার্য ছিল। এই ধর্মোপদেশগুলির যে কোনো একটি সত্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, এমন কি তুমি বলতে পারো? না, পারো না! এগুলির প্রত্যেকটিই সত্য, কারণ এই সকলই ছিল মানবজাতির প্রতি ঈশ্বরের চাহিদা; এগুলির সমস্তই ছিল নীতিসমূহ ও ঈশ্বর-প্রদত্ত এক পরিসর, এগুলির মাধ্যমেই প্রদর্শিত হতো যে একজন ব্যক্তির কীভাবে নিজেকে পরিচালিত করা উচিত, এবং এগুলি ঈশ্বরের স্বভাবেরই প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু, সেই সময়ে জীবন-বিকাশের যে পর্যায়ে তারা অবস্থান করছিল তা-র ভিত্তিতে, শুধুমাত্র এই বিষয়গুলিই তারা গ্রহণ ও উপলব্ধি করতে সক্ষম ছিল। যেহেতু মানবজাতির পাপ তখনো অবধি মীমাংসিত হয়নি, তাই প্রভু যীশু কেবলমাত্র এই বাক্যগুলিই নিঃসৃত করতে পারতেন, এবং তাদের কেমন আচরণ করা উচিত, তাদের কী করা উচিত, কোন নীতিসমূহ ও পরিসরের মধ্যে তাদের কাজকর্ম সম্পন্ন হওয়া উচিত, এবং কীভাবে তাদের ঈশ্বরে বিশ্বাস ও তাঁর চাহিদাগুলি পূরণ করা উচিত, তৎকালীন মানুষদের এইসব বিষয়গুলি জানাতে একমাত্র এই ধরনের পরিসরে অন্তর্ধৃত সরল কৌশলগুলিই তিনি ব্যবহার করতে পারতেন। এই সমস্তকিছুই নির্ধারিত হয়েছিল তৎকালীন মানবজাতির আত্মিক উচ্চতার উপর ভিত্তি করে। বিধানের অধীনে বসবাসকারী মানুষদের পক্ষে এই শিক্ষাগুলি গ্রহণ করা সহজসাধ্য ছিল না, অতএব প্রভু যীশুর প্রদত্ত শিক্ষাকে এই পরিসরের মধ্যেই সীমিত থাকতে হয়েছিল।

এবার, “প্রভু যীশুর উপাখ্যানসমূহ”-এর অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলির দিকে একবার দৃষ্টিপাত করা যাক।

প্রথমটি হল বীজবপনকারীর উপাখ্যান। এটি খুবই কৌতূহলোদ্দীপক এক উপাখ্যান; বীজ বপন করা হল মানবজীবনের এক সাধারণ ঘটনা। দ্বিতীয়টি হল শ্যামাঘাসের উপাখ্যান। “শ্যামাঘাস” কী, তা যে ফসল বুনন করেছে, এবং সকল প্রাপ্তবয়স্করা নিশ্চয়ই জানবে। তৃতীয়টি হল সরিষা বীজের উপাখ্যান। সরিষা কী, তা তোমাদের সকলেই নিশ্চয় জানো, জানো না কি? যদি না জানো, তাহলে বাইবেলে একবার দেখে নিতে পারো। চতুর্থ উপাখ্যানটি হল খামিরের উপাখ্যান। এখন, অধিকাংশ মানুষ জানে যে গাঁজিয়ে তোলার কাজে খামির ব্যবহৃত হয়, এবং তা হল এমন এক পদার্থ, যা মানুষ তাদের প্রাত্যহিক জীবনে ব্যবহার করে। ষষ্ঠ উপাখ্যান, গুপ্তধনের উপাখ্যান; সপ্তম, মুক্তার উপাখ্যান; এবং অষ্টম, টানাজালের উপাখ্যানকে ধরে, বাদবাকি সবকটি উপাখ্যানই মানুষের বাস্তব জীবন থেকে গৃহিত হয়েছে, এবং মানুষের জীবনই হল তাদের উৎসস্থল। এই উপাখ্যানগুলি কোন প্রকারের চিত্র অঙ্কিত করে? চিত্রটি হল যে, ঈশ্বর একজন স্বাভাবিক মানুষে পরিণত হয়েছেন এবং মানবজাতির পাশাপাশি জীবনযাপন করছেন, মানুষের সাথে বার্তা বিনিময়ের জন্য ও তাদের প্রয়োজনীয় রসদ সরবরাহের উদ্দেশ্যে জীবনের ভাষা, মানবীয় ভাষা, ব্যবহার করছেন। ঈশ্বর যখন দেহধারণ করে মানবজাতির মাঝে দীর্ঘকাল বসবাস করেছিলেন, তখন মানুষের বিভিন্ন জীবনশৈলীর অভিজ্ঞতা লাভ ও সেসমস্ত প্রত্যক্ষ করার পর, এই অভিজ্ঞতাগুলি তাঁর শিক্ষাদানের উপাদানে পরিণত হয়, যার মাধ্যমে তিনি তাঁর ঐশ্বরিক ভাষাকে মনুষ্যসুলভ ভাষায় রূপান্তরিত করেছিলেন। নিশ্চিতভাবে, তাঁর জীবনে এই যে বিষয়গুলি তিনি দর্শন ও শ্রবণ করেছিলেন তা মনুষ্যপুত্রের মানবিক অভিজ্ঞতাকেও সমৃদ্ধ করেছিল। যখন কোনো সত্য তিনি মানুষকে অনুধাবন করাতে চাইতেন, ঈশ্বরের কোনো ইচ্ছাকে উপলব্ধি করাতে চাইতেন, তখন ঈশ্বরের ইচ্ছা ও মানবজাতির প্রতি তাঁর চাহিদার বিষয়ে মানুষকে জানাতে তিনি উপরের উপাখ্যানগুলির অনুরূপ নীতিকাহিনীসমূহ ব্যবহার করতে পারতেন। এই উপাখ্যানগুলি মানুষের জীবনের সঙ্গে জড়িত ছিল; সেগুলির একটিও মানুষের জীবনের সাথে সংযোগ-বিরহিত ছিল না। প্রভু যীশু যখন মানবজাতির সঙ্গে বসবাস করেছিলেন, তখন তিনি কৃষকদের তাদের শস্যক্ষেত্রের তদারকি করতে দেখেছিলেন, এবং শ্যামাঘাস কী ও গাঁজানো কাকে বলে, তা তিনি জানতেন; তিনি বুঝেছিলেন যে মানুষ গুপ্তধন পছন্দ করে, তাই তিনি গুপ্তধন ও মুক্তা উভয়ের রূপকই ব্যবহার করেছিলেন। তাঁর জীবনে, অনেকবার তিনি মৎস্যজীবীদের তাদের মাছ ধরার জাল নিক্ষেপ করতে দেখেছিলেন; প্রভু যীশু এই কাজ ও মনুষ্যজীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য কর্মকাণ্ড লক্ষ্য করেছিলেন, এবং এই ধরনের জীবনের অভিজ্ঞতাও তিনি লাভ করেছিলেন। ঠিক অন্য যেকোনো স্বাভাবিক মানুষের মতোই, তিনি মানুষের দৈনন্দিন কর্মপরম্পরা এবং তাদের দিনে তিনবার খাদ্যগ্রহণের অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে একজন গড়পড়তা মানুষের অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন, এবং অন্যদের জীবনগুলি পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। এই সবকিছুর পর্যবেক্ষণ ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা অর্জনের পর, তিনি এই নিয়ে চিন্তা করেননি যে, কীভাবে এক সুন্দর জীবনের অধিকারী হওয়া যায় বা কীভাবে তিনি আরো স্বাধীন ও আরামদায়কভাবে জীবনযাপন করতে পারবেন। পরিবর্তে, তাঁর নির্ভেজাল মনুষ্যজীবনের অভিজ্ঞতা থেকে, প্রভু যীশু মানুষের জীবনের দুঃখকষ্টকে প্রত্যক্ষ করলেন। শয়তানের শাসনের অধীনে বাসরত মানুষের দুঃখকষ্ট, দুরবস্থা, ও বিমর্ষতাকে তিনি লক্ষ্য করলেন, এবং দেখলেন যে, তারা শয়তানের ভ্রষ্টতার অধীনে এক পাপমগ্ন জীবন যাপন করছে। তাঁর ব্যক্তিগতভাবে মনুষ্যজীবনের অভিজ্ঞতা অর্জনকালে, ভ্রষ্টতার মাঝে বসবাসকারী মানুষগুলি যে কতটা অসহায়, তা-ও তিনি অনুভব করেছিলেন, যারা পাপের মধ্যে জীবনধারণ করে, শয়তান ও মন্দের অত্যাচারের শিকার হয়ে যে মানুষগুলি দিকভ্রান্ত হয়েছে, তাদের দুর্দশাপীড়িত অবস্থা তিনি প্রত্যক্ষ এবগ অনুভব করেছিলেন। প্রভু যীশু যখন এই বিষয়গুলি চাক্ষুষ করেন, তখন কি তিনি তা তাঁর দেবত্বের মাধ্যমে দর্শন করেন, নাকি করেন তাঁর মানবতার মাধ্যমে? তাঁর মধ্যে প্রকৃতই মানবতা ছিল, এবং তা যথেষ্ট পরিমাণে সক্রিয় ছিল; তিনি এই সমস্তকিছুই অনুভব ও অবলোকনে ছিলেন সক্ষম। কিন্তু নিশ্চিতভাবে, এই বিষয়গুলি তিনি তাঁর সারসত্য দ্বারাও দর্শন করেছিলেন, যে সারসত্য হল তাঁর দেবত্ব। অর্থাৎ, স্বয়ং খ্রীষ্ট, প্রভু যীশু, যিনি ছিলেন একজন মানব, তিনি এসবই দেখেছিলেন, এবং তিনি যাকিছু দেখেছিলেন তা তাঁকেঅবতাররূপ ধারণকালীন তাঁর দ্বারা গৃহীত কার্যের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনুভব করিয়েছিল। যদিও তিনি নিজেও জানতেন যে, দেহরূপে যে দায়িত্ব তাঁকে গ্রহণ করতে হবে, তা অতি সুবিশাল, এবং যে ব্যথার তিনি সম্মুখীন হবেন, তা কতখানি নিষ্ঠুর হবে তাও তিনি জানতেন, তবু মানবজাতিকে যখন তিনি অসহায়ভাবে পাপে নিমজ্জিত অবস্থায় দেখলেন, যখন তিনি তাদের জীবনের শোচনীয়তা ও বিধানের অধীনে তাদের নিস্তেজ লড়াইকে দেখলেন, তখন তিনি উত্তরোত্তর আরো মনঃকষ্ট অনুভব করলেন, এবং পাপাচার থেকে মানবজাতিকে উদ্ধার করতে আরো অধীর হয়ে পড়লেন। যে ধরনের সমস্যারই তাঁকে সম্মুখীন হতে হোক না কেন, বা যে প্রকারের যন্ত্রণাই তাঁকে ভোগ করতে হোক না কেন, পাপের মধ্যে জীবনযাপনরত মানবজাতিকে পুনরুদ্ধার করার সংকল্পে ক্রমাগত তিনি আরো দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে উঠলেন। বলা যায়, এই প্রক্রিয়া চলাকালীন, যে কার্য তাঁকে সম্পন্ন করতে হতো, এবং যে দায়িত্ব তাঁর উপর অর্পিত হয়েছিল, তা প্রভু যীশু ক্রমাগত স্পষ্টতরভাবে উপলব্ধি করতে শুরু করলেন। একই সঙ্গে যে কার্যের দায়িত্বভার তিনি গ্রহণ করতে যাচ্ছিলেন তা নিষ্পন্ন করার জন্য—মানবজাতির সকল পাপ ধারণ করার জন্য, যাতে মানবজাতি আর পাপের মধ্যে বাস না করে তাই তাদের হয়ে প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য, এবং সেই সাথে, যাতে তাঁর পাপস্খালনে বলি হয়ে ওঠার ফলে মানুষের পাপাচারকে ঈশ্বর ক্ষমা করতে পারেন, মানবজাতির উদ্ধারের নিমিত্ত তাঁর যে কার্য, যাতে তিনি তা আরো এগিয়ে নিয়ে পারেন, তা-র জন্য তিনি উত্তরোত্তর তিনি আরো ব্যগ্র হয়ে উঠেছিলেন। বলা যায় যে, প্রভু যীশু, তাঁর অন্তরে, মানবজাতির জন্য নিজেকে উৎসর্গ করতে, নিজেকে বলিদান দিতে ইচ্ছুক ছিলেন। একই সাথে, তিনি পাপস্খালনের বলিরূপে ভূমিকা পালন করতে, ক্রুশকাষ্ঠে বিদ্ধ হতেও তিনি ইচ্ছুক ছিলেন, সেই কার্য সম্পূর্ণ করতে তিনি বস্তুতই অধীর হয়ে উঠেছিলেন। মানবজীবনের দুরবস্থা চাক্ষুষ করার পর, তিনি আরো বেশি করে যত শীঘ্র সম্ভব, এক দণ্ড বা এমনকি এক লহমাও কালবিলম্ব না করে, তাঁর ব্রত পূরণ করতে চেয়েছিলেন। এমন এক আশু প্রয়োজনীয়তা অনুভব করার পর তাঁর যন্ত্রণা কতটা তীব্র হবে, সেবিষয়ে তিনি চিন্তামাত্র করেন নি, এবং কতখানি লাঞ্ছনা তাঁকে সহ্য করতে হবে সে বিষয়েও তিনি আর কোনো আশঙ্কা পোষণ করেন নি। তাঁর হৃদয়ে তিনি কেবল একটিমাত্র প্রত্যয় ধারণ করে রেখেছিলেন: নিজেকে তিনি উৎসর্গ করতে পারলে, পাপস্খালনের বলি হিসাবে ক্রুশবিদ্ধ হতে পারলে, তা হবে ঈশ্বরের ইচ্ছা পালন করা, এবং ঈশ্বর নতুন কার্যের সূচনা করতে পারবেন। মানবজাতির জীবন ও তাদের পাপমগ্ন অস্তিত্বের পরিস্থিতি সম্পূর্ণভাবে রূপান্তরিত হবে। তাঁর প্রত্যয় ও তাঁর এই কর্মসংকল্প মানুষের উদ্ধারের সঙ্গে জড়িত ছিল, এবং তাঁর একটিমাত্র লক্ষ্য ছিল, তা হল ঈশ্বরের ইচ্ছা পালন করা, যাতে ঈশ্বর সাফল্যের সঙ্গে তাঁর কার্যের পরবর্তী পর্যায় আরম্ভ করতে পারেন। সেই সময় প্রভু যীশুর মনে এই চিন্তাই ছিল।

দেহরূপে জীবনযাপনরত ঈশ্বরের অবতার স্বাভাবিক মানবিকতার অধিকারী ছিলেন; তাঁর আবেগ ও যৌক্তিকতা ছিল একজন স্বাভাবিক মনুষ্যসুলভ। আনন্দ কী, বেদনা কী, তা তিনি জানতেন, এবং মানবজাতিকে এই ধরনের এক জীবন যাপন করতে দেখে তিনি গভীরভাবে অনুভব করেছিলেন যে, মানুষকে নিছক কিছু শিক্ষাদান, তাদের জন্য কিছু রসদের সংস্থান, বা তাদের কোনোকিছু শেখানো, তাদের পাপমুক্ত করার পক্ষে যথেষ্ট হবে না। আবার কেবলমাত্র আদেশসমূহ মান্য করতে বাধ্য করানোর মাধ্যমেও তাদের পাপমুক্ত করা যাবে না—যখন তিনি মানবজাতির পাপ নিজের মধ্যে ধারণ করে পাপময় দেহের প্রতিরূপ হয়ে উঠবেন, একমাত্র তখনই তিনি তার বিনিময়ে মানবজাতির স্বাধীনতা ও মানবজাতির প্রতি ঈশ্বরের ক্ষমা অর্জন করে আনতে পারবেন। তাই, মানুষের পাপমগ্ন জীবনের অভিজ্ঞতা অর্জন ও তা চাক্ষুষ করার পর, প্রভু যীশুর অন্তরে এক তীব্র বাসনা প্রতিভাত হয়ে উঠলো—তাদের পাপের মধ্যে সংগ্রামরত জীবন থেকে মানবজাতিকে নিজেদের মুক্ত করার সুযোগ দান করা। এই বাসনার দরুন তিনি ক্রমাগত আরো বেশি করে অনুভব করলেন যে, তাঁকে যথাশীঘ্র সম্ভব ক্রুশারোহন করে মানুষের পাপগুলি গ্রহণ করতে হবে। মানুষের মধ্যে বসবাস করে তাদের পাপমগ্ন জীবনের দুর্দশাকে দর্শন, শ্রবণ ও অনুভব করার পর, প্রভু যীশুর মনে এই চিন্তাগুলিই উদিত হয়েছিল। মানবজাতির নিমিত্ত ঈশ্বরের অবতার যে এই ধরনের ইচ্ছা পোষণ করতে পেরেছিলেন, তিনি যে এই ধরনের স্বভাব অভিব্যক্ত ও প্রকাশিত করতে পেরেছিলেন—একজন গড়পড়তা মানুষ কি তা পেরে উঠতো? এই রকমের এক পরিবেশে বাস করার পর একজন গড়পড়তা মানুষ কী দেখতো? কোন চিন্তা তার মাথায় আসতো? একজন গড়পড়তা মানুষ যদি এই সবকিছুর সম্মুখীন হতো, তাহলে কি সে এক সমুন্নত পরিপ্রেক্ষিত থেকে সমস্যাগুলির প্রতি দৃষ্টিপাত করতো? অবশ্যই তা করতো না! যদিও বাহ্যিক অবয়বে ঈশ্বরের অবতার হলেন অবিকল কোনো মানুষের মতো, এবং যদিও তিনি মনুষ্যসুলভ জ্ঞানের শিক্ষা গ্রহণ করেন ও মানবোচিত ভাষায় বাক্যালাপ করেন, এবং কখনো কখনো এমনকি তাঁর চিন্তাভাবনাকেও মানবজাতির নিজস্ব পদ্ধতিতে বা তাদের বাকরীতি অনুসারে প্রকাশ করেন, তবু, যে প্রণালীতে তিনি মানুষকে ও বিষয়াদির সারসত্যকে নিরীক্ষণ করেন, তা কোনোক্রমেই ভ্রষ্ট মানুষের দ্বারা মানবজাতি ও বিষয়াদির সারমর্ম অবলোকনের পদ্ধতির অনুরূপ ছিল না। কোনো ভ্রষ্ট মানুষের পক্ষে তাঁর পরিপ্রেক্ষিত ও অবস্থানগত উচ্চতা অর্জন করা সম্ভব ছিল না। এর কারণ হল ঈশ্বর সত্য, এর কারণ হল, যে দেহরূপ তিনি পরিগ্রহ করেন, তা-ও ঈশ্বরের সারসত্যকেই ধারণ করে, এবং তাঁর চিন্তাচেতনা ও তাঁর মানবতার দ্বারা যা অভিব্যক্ত হয়, সেগুলিও সত্যই। দেহরূপে তিনি যা ব্যক্ত করেন ভ্রষ্ট মানুষের কাছে তা সত্যের এবং জীবনের রসদ। এই সংস্থান কেবল কোনো একজন মানুষের জন্যই নয়, তা সমগ্র মানবজাতির উদ্দেশ্যে। কোনো ভ্রষ্ট মানুষের অন্তরে, তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এমন কতিপয় মানুষই কেবল অধিষ্ঠান করে। শুধুমাত্র এই মুষ্টিমেয় মানুষদের নিয়েই তাদের যত প্রযত্ন ও মাথাব্যথা। যখন দিগন্তে বিপর্যয় উপনীত হয়, তখন সর্বাগ্রে তারা তাদের সন্তানসন্ততি, স্বামী-স্ত্রী, পিতা-মাতার কথা চিন্তা করে। বড়োজোর, একটু বেশি দরদী কোনো মানুষ তার কোনো আত্মীয় বা ভালো কোনো বন্ধুর নিমিত্ত কিছুটা চিন্তা ব্যয় করবে, কিন্তু এরকম দরদী কোনো মানুষের চিন্তাও কি তা অতিক্রম করে আরো দূরে প্রসারিত হয়? না, তা কখনোই হয় না! কারণ, যতোই হোক, মানুষ শুধু মানুষই, এবং সমস্তকিছুকে তারা কেবলমাত্র মানুষের অবস্থানগত উচ্চতা ও পরিপ্রেক্ষিত থেকেই অবলোকন করতে সক্ষম। কিন্তু, ঈশ্বরের অবতার ভ্রষ্ট কোনো মানুষের থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। ঈশ্বরের অবতাররূপী দেহ যত সাধারণ, যত স্বাভাবিক, যত সামান্যই হোক না কেন, বা এমনকি মানুষ তাঁর দিকে যত তাচ্ছিল্যের চোখেই দেখুক না কেন, তবু মানবজাতির প্রতি তাঁর বিবেচনা ও তাঁর মনোভাব এমনই বস্তু যা কোনো মানুষের অনধিগম্য, অননুকরণীয় করতে পারে না। সর্বদাই তিনি দেবত্বের পরিপ্রেক্ষিত থেকেই, তাঁর সৃষ্টিকর্তারূপী অবস্থানগত উচ্চতা থেকেই, মানবজাতিকে পর্যবেক্ষণ করবেন। সর্বদাই তিনি ঈশ্বরের সারসত্য ও মানসিকতার মধ্য দিয়েই মানবজাতিকে লক্ষ্য করবেন। কোনোক্রমেই তিনি একজন গড়পড়তা মানুষের অবনমিত উচ্চতা থেকে, বা একজন ভ্রষ্ট মানুষের পরিপ্রেক্ষিত থেকে মানবজাতিকে অবলোকন করতে সক্ষম হবেন না। মানুষ মানবজাতিকে নিরীক্ষণ করে মানবীয় দৃষ্টির সাহায্যে, এবং মাপকাঠি হিসাবে তারা মানবোচিত জ্ঞান এবং মনুষ্যসুলভ আইনকানুন ও ন্যায়নীতির মতো বিষয়গুলির প্রয়োগ ঘটায়। এগুলি মানুষর দৃষ্টিগ্রাহ্য পরিসরেরই অন্তর্ভুক্ত এবং ভ্রষ্ট মানুষের দ্বারা অর্জনসাধ্য পরিসরেরও অন্তর্ভুক্ত। ঈশ্বর যখন মানবজাতির দিকে তাকান, তখন তিনি ঐশ্বরিক দৃষ্টির সাহায্যে দৃষ্টিপাত করেন, এবং মাপকাঠি হিসাবে তিনি তাঁর সারসত্য এবং তাঁর যা আছে ও তিনি যা, সেগুলির প্রয়োগ ঘটান। সেই পরিসরের মধ্যে এমন বস্তুসকল রয়েছে, যা মানুষের দৃষ্টিগোচর নয়, আর এখানেই ঈশ্বরের অবতার ও ভ্রষ্ট মানুষ সম্পূর্ণ পৃথক। এই পার্থক্য নিরূপিত হয় মানুষ ও ঈশ্বরের স্বতন্ত্র সারসত্যের দ্বারা—এই পৃথক সারসত্যই তাদের পরিচয় ও অবস্থান, এবং যে পরিপ্রেক্ষিত ও উচ্চতা থেকে তারা বিষয়াদিকে নিরীক্ষণ করে, সেসকল নির্ধারণ করে। প্রভু যীশুর মধ্যে তোমরা কি স্বয়ং ঈশ্বরের অভিব্যক্তি ও উদ্ঘাটন দেখতে পাও? তোমরা বলতে পারো যে, প্রভু যীশু যা করেছিলেন ও বলেছিলেন, তা তাঁর সেবাব্রত ও ঈশ্বরের নিজস্ব পরিচালনামূলক কার্যের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল, বলতে পারো যে, এর সবই ছিল ঈশ্বরের সারসত্যের অভিব্যক্তি ও উদ্ঘাটন। যদিও তাঁর একটি মানবীয় উদ্ভাস বস্তুতই ছিল, কিন্তু তাঁর ঐশ্বরিক সারসত্য এবং তাঁর দেবত্বের উদ্ঘাটনকে অস্বীকার করা যায় না। এই মানবীয় উদ্ভাস কি সত্যিই কোনো মনুষ্যসুলভ প্রকাশ ছিল? মূলগত উপাদানের দিক দিয়ে, তাঁর মানবীয় উদ্ভাস ভ্রষ্ট মানুষের মানবোচিত বহিঃপ্রকাশের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। প্রভু যীশু ছিলেন ঈশ্বরের অবতার। যদি তিনি যথার্থই চিরাচরিত তথা ভ্রষ্ট মানুষদের একজন হতেন, তাহলে কি তিনি মানবজাতির পাপমগ্ন জীবনকে এক ঐশ্বরিক পরিপ্রেক্ষিতে অবলোকনে সক্ষম হতেন? কখনও হতেন না! মনুষ্যপুত্র ও সাধারণ মানুষের মধ্যে এটাই হল পার্থক্য। ভ্রষ্ট মানুষেরা সবাই পাপের মধ্যে বাস করে, এবং পাপাচার প্রত্যক্ষ করার পর, সেই বিষয়ে তাদের মধ্যে বিশেষ কোনো অনুভূতি পরিলক্ষিত হয় না; তারা সকলেই একই প্রকার, ঠিক কাদায় বসবাসরত এক শূকরের মতো, যে আদৌ কোনো অস্বচ্ছন্দ বা মলিনতা অনুভব করে না—উল্টে বরং, ভালো খাওয়াদাওয়া করে ও গভীর নিদ্রা যায়। কেউ যদি খোঁয়াড়টি সাফসুতরো করে, তাহলেই বরং শূকরটি সত্যিকারের অস্বচ্ছন্দ বোধ করবে, এবং সে পরিচ্ছন্ন থাকবে না। অচিরেই, সেটি আবার কাদায় গড়াগড়ি দেবে, সম্পূর্ণ স্বচ্ছন্দে, কারণ সেটি হল এক কলুষিত পশু। শূকরদের মানুষ নোংরা মনে করে, কিন্তু তুমি যদি কোনো শূকরের বাসস্থান সাফ করো, তাহলে সে কিছুমাত্র আরাম বোধ করে না—এই কারণেই কেউ তার নিজের বাড়ির ভিতর শূকর রাখে না। মানুষ যে চোখে শূকরদের দেখে তা শূকরেরা নিজে যেমন অনুভব করে তা-র থেকে সর্বদাই আলাদা হবে, কারণ মানুষ ও শূকর সমগোত্রীয় নয়। আর যেহেতু অবতাররূপী মনুষ্যপুত্র ভ্রষ্ট মনুষ্যগণের সমগোত্রীয় নন, সেহেতু কেবলমাত্র ঈশ্বরের অবতারই এক ঐশ্বরিক পরিপ্রেক্ষিতে, ঈশ্বরের উচ্চতায়, অবস্থানরত হতে পারেন, যেখান থেকে তিনি মানবজাতি এবং সমস্তকিছুর প্রতি দৃষ্টিপাত করেন।

দেহধারণ করে মানবজাতির মাঝে বসবাস করাকালীন যে যন্ত্রণা ঈশ্বরকে ভোগ করতে হয়, সেই বিষয়ে কী বলা যায়? এই যন্ত্রণাটি কী? কেউ কি প্রকৃতই তা উপলব্ধি করে? কিছু মানুষ বলে যে, ঈশ্বর প্রভূত কষ্টভোগ করেন, তারা বলে তিনি স্বয়ং ঈশ্বর হওয়া সত্ত্বেও মানুষ তাঁর সারসত্য উপলব্ধি করে না, বরং তাঁকে একজন মানুষ হিসাবে গণ্য করতে চায়, এতে তিনি ক্ষুব্ধ হন ও নিজেকে অবিচারের শিকার বলে বোধ করেন—তারা বলে যে, এই সব কারণেই, ঈশ্বরের যন্ত্রণা যথার্থই বিপুল। অন্যেরা বলে যে ঈশ্বর নিরপরাধ ও অপাপবিদ্ধ, কিন্তু মানবজাতির মতো একইভাবে তিনিও কষ্টভোগ করেন, মানবজাতির পাশাপাশি তিনিও উৎপীড়ন, কুৎসারটনা, এবং অসম্মান ভোগ করেন; তারা বলে যে, তাঁকেও ভুল বোঝাবুঝি ও তাঁর অনুগামীদের আনুগত্যহীনতা সহ্য করতে হয়—এই কারণেই, তাদের বক্তব্য অনুসারে, ঈশ্বরের যন্ত্রণাভোগ সত্যিই অপরিমেয়। এখন, মনে হচ্ছে যে, তোমরা ঈশ্বরকে প্রকৃত অর্থে উপলব্ধি করো না। বস্তুত, তোমরা যে কষ্টভোগের কথা বলো তা ঈশ্বরের ভোগ করা প্রকৃত কষ্ট হিসাবে পরিগণিতই হয় না, কারণ এর থেকেও তীব্র যন্ত্রণা রয়েছে। তাহলে স্বয়ং ঈশ্বরের সত্যিকারের যন্ত্রণাটি কী? ঈশ্বরের অবতাররূপী দেহের প্রকৃত বেদনাটি কী? ঈশ্বরের কাছে, মানবজাতির তাঁকে বুঝতে না পারাটা কষ্টভোগ বলে গণ্য হয় না, এবং মানুষের ঈশ্বরের বিষয়ে কিছু ভ্রান্ত উপলব্ধি থাকা, ও তাঁকে ঈশ্বর বলে মনে না করাটাও যন্ত্রণা হিসাবে পরিগণিত হয় না। তবু, মানুষ প্রায়শই মনে করে যে, ঈশ্বর নিশ্চয়ই বিপুল অবিচারের শিকার হয়েছেন, মনে করে যে, অবতাররূপে অবস্থানকালীন, ঈশ্বর মানবজাতিকে তাঁর ছবিটি প্রদর্শন করতে পারেন না, এবং মানুষকে তাঁর মাহাত্ম্য দর্শন করার সুযোগ দিতে পারেন না, এবং ঈশ্বর তাঁর তুচ্ছ দেহরূপের ভিতর সবিনয়ে লুক্কায়িত রয়েছেন, তারা মনে করে যে, এমনটি ঈশ্বরের কাছে নির্ঘাত এক নিদারুণ উৎপীড়ন। ঈশ্বরের যন্ত্রণা সম্বন্ধে মানুষ যা উপলব্ধি করতে পারে ও তারা যা দেখতে পায়, সেগুলিকে তারা আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করে, এবং ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে যাবতীয় প্রকারের সহানুভূতি প্রক্ষেপ করে, এবং এমনকি মাঝেমধ্যেই তাঁর কষ্টভোগের দরুন তাঁকে কিছুটা তারিফও জানায়। বাস্তবে, একটা পার্থক্য আছে; ঈশ্বরের বেদনার বিষয়ে মানুষ যা উপলব্ধি করে, এবং তিনি প্রকৃতই যা অনুভব করেন, এই দুইয়ের মধ্যে একটা ফারাক রয়েছে। আমি তোমাদের অকপটে বলছি—ঈশ্বরের কাছে, তা তিনি ঈশ্বরের আত্মাই হন কি ঈশ্বরের অবতাররূপী দেহই হন, উপরে বর্ণিত যন্ত্রণাগুলি প্রকৃত বেদনা নয়। তাহলে প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বর কোন যন্ত্রণা ভোগ করেন? কেবলমাত্র ঈশ্বরের অবতারের পরিপ্রেক্ষিত থেকেই ঈশ্বরের যন্ত্রণাভোগ বিষয়ে আলোচনা করা যাক।

ঈশ্বর যখন অবতাররূপ ধারণ করেন, মানবজাতির মাঝে মানুষের পাশাপাশি যাপনরত একজন গড়পড়তা, স্বাভাবিক মানুষে পরিণত হন, তখন কি তিনি মানুষের জীবনধারণের পদ্ধতি, নিয়মকানুন, ও দর্শনগুলি দেখতে ও অনুভব করতে পারেন না? বেঁচে থাকার এই পদ্ধতি ও বিধানগুলি তাঁকে কেমন অনুভব করায়? তিনি কি তাঁর অন্তরে ঘৃণাবোধ করেন? কেন তিনি ঘৃণাবোধ করবেন? মানবজাতির জীবনধারণের পদ্ধতি ও নিয়মকানুনগুলি কী কী? কোন নীতিগুলির উপর সেগুলি প্রতিষ্ঠিত? কোন ভিত্তিভূমির উপর সেগুলি দাঁড়িয়ে রয়েছে? বেঁচে থাকার উপায়ের সঙ্গে সম্পর্কিত রয়েছে মানবজাতির পদ্ধতিসমূহ, নিয়মকানুন, ইত্যাদি—এগুলির সবকিছুই শয়তানের যুক্তিবোধ, জ্ঞান, ও দর্শনের উপর ভিত্তি করে রচিত। এহেন বিধানসমূহের অধীনে জীবনধারণরত মানুষগুলির কোনো মানবতা নেই, কোনো সত্য নেই—তারা সকলেই সত্যকে অগ্রাহ্য করে এবং ঈশ্বরের প্রতি বৈরীভাবাপন্ন। আমরা ঈশ্বরের সারসত্যের প্রতি একবার দৃষ্টিনিবদ্ধ করি, তাহলে দেখি যে, তাঁর সারসত্য শয়তানের যুক্তি, জ্ঞান, ও দর্শনের ঠিক বিপরীত। তাঁর সারসত্য ন্যায়পরায়ণতা, সত্য, ও পবিত্রতা এবং সকল ইতিবাচক বস্তুর অন্যান্য বাস্তবিকতার দ্বারা পরিপূর্ণ। যে ঈশ্বর এই সারসত্যের অধিকারী এবং এমনতর এক মানবজাতির মাঝে বসবাস করেন, তিনি কেমন বোধ করেন? তাঁর অন্তরে তিনি কী অনুভব করেন? এই অন্তর কি ব্যথায় জর্জরিত নয়? তাঁর হৃদয় ব্যথিত, এমন এক বেদনা, যা কোনো মানুষ উপলব্ধি বা অনুভবে অক্ষম। এর কারণ হল যে, তিনি যাকিছুর মুখোমুখি হন, মোকাবিলা করেন, শ্রবণ, দর্শন, ও অভিজ্ঞতা লাভ করেন তার সবই হল মানবজাতির কলুষ, দুষ্টতা, এবং সত্যের বিরুদ্ধে তাদের বিদ্রোহ ও প্রতিরোধ। মানুষ থেকে যাকিছু আসে, তা-ই হল তাঁর যন্ত্রণার উৎস। অর্থাৎ, যেহেতু তাঁর সারসত্য ভ্রষ্ট মানুষদের মতো নয়, সেহেতু তাঁর তীব্রতম যন্ত্রণার উৎস হয়ে ওঠে মানুষের কলুষ। ঈশ্বর যখন দেহধারণ করেন, তখন কি তিনি এমন কাউকে খুঁজে পেতে পারেন, যে তাঁর মতো একই ভাষায় বক্তব্য রাখে? মানবজাতির মাঝে এমন একজন মানুষও খুঁজে পাওয়া যাবে না। এমন কাউকেই পাওয়া সম্ভব নয়, যে ঈশ্বরের সঙ্গে কথোপকথন চালাতে বা মতামত বিনিময় করতে পারে—এই ব্যাপারে ঈশ্বরের অনুভূতি কেমন বলে তোমার মনে হয়? মানুষ যাকিছু আলোচনা করে, ভালোবাসে, অনুসরণ করে ও কামনা করে, সেগুলির সমস্তই পাপ ও দুষ্ট প্রবণতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। ঈশ্বর যখন এই সবকিছুর সম্মুখীন হন, তখন তাঁর হৃদয়কে কি তা ছুরির মতো বিদ্ধ করে না? এই সবকিছুর মুখোমুখি হওয়ার পরেও কি তাঁর অন্তরে আনন্দ থাকতে পারে? তিনি কি সান্ত্বনা খুঁজে পেতে পারেন? যারা তাঁর সঙ্গে বসবাস করছে তারা বিদ্রোহী মানসিকতা ও পাপাচারে পরিপূর্ণ মানুষ—কীভাবে তাঁর হৃদয় যন্ত্রণাদীর্ণ না হয়ে পারে? এই যন্ত্রণা প্রকৃতপক্ষে কতটা বিপুল, এবং তা নিয়ে কারই বা কোনো মাথাব্যথা আছে? কে-ই বা এবিষয়ে ভ্রুক্ষেপ করে? আর কে-ই বা এর যথাযথ কদর করতে সক্ষম? ঈশ্বরের হৃদয়কে উপলব্ধি করার কোনো উপায় মানুষের হাতে নেই। তাঁর দুঃখবেদনা হল এমন একটা বিষয়, যা উপলব্ধি করতে মানুষ সবিশেষরূপে অক্ষম, এবং মানুষের শীতলতা ও অসাড়তা ঈশ্বরের কষ্টকে গভীরতর করে তোলে।

কিছু মানুষ আছে যারা প্রায়শই খ্রীষ্টের দুর্দশার প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করে, কারণ বাইবেলের একটা স্তবকে লেখা আছে: “যীশু তাকে বললেন শিয়ালের গর্ত আছে, আকাশের পাখিদের বাসা আছে, কিন্তু মানবপুত্রের মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই।” এটা শোনার পর, মানুষ তা গুরুত্ব সহকারে নেয়, এবং ভাবে যে ঈশ্বরকে যত কষ্ট সইতে হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে এটাই হল কঠোরতম, এবং খ্রীষ্টকে যত যন্ত্রণা সহন করতে হয়েছে, সেগুলির মধ্যে এটিই হল তীব্রতম। এখন, প্রকৃত তথ্যের পরিপ্রেক্ষিত থেকে দেখলে, বিষয়টা কি তেমনই? না; এই অসুবিধাগুলোকে ঈশ্বর যন্ত্রণা বলে মনে করেন না। দেহরূপে তাঁর সমস্যাসমূহের দরুন ঈশ্বর কখনো অবিচারের বিরুদ্ধে উচ্চকিত হন নি, এবং কখনোই তিনি কোনোকিছুর জন্য মানুষকে তাঁর ঋণ পরিশোধে বা তাঁকে পুরস্কৃত করায় বাধ্য করেন নি। কিন্তু, যখন তিনি মানবজাতি-সংক্রান্ত সকলকিছু, তাদের পাপাচারী জীবন ও ভ্রষ্ট মানুষের দুষ্টতা প্রত্যক্ষ্ করেন, যখন তিনি প্রত্যক্ষ করেন যে, মানবজাতি শয়তানের করায়ত্ত ও শয়তানের হাতে বন্দী এবং পলায়নে অক্ষম, যখন তিনি দেখেন, যে, পাপের মধ্যে বসবাসকারী মানুষ সত্য কী, তা জানে না, তখন তিনি এই সকল পাপ বরদাস্ত করতে পারেন না। মানুষের প্রতি তাঁর বিরাগ নিয়ত বৃদ্ধি পায়, কিন্তু তাঁকে এই সবকিছুই সহ্য করতে হয়। এটাই হল ঈশ্বরের তীব্র যন্ত্রণাভোগ। ঈশ্বর এমনকি তাঁর অন্তরের কণ্ঠস্বর বা তাঁর ভাবাবেগকে তাঁর অনুগামীদের মাঝে সম্পূর্ণরূপে ব্যক্তও করতে পারেন না, এবং তাঁর অনুগামীদের কেউই তাঁর কষ্টকে প্রকৃত অর্থে উপলব্ধিতে সক্ষম নয়। এমনকি কেউই তাঁর হৃদয়কে উপলব্ধি করার বা সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে না, যে হৃদয় দিনের পর দিন, বছরের পর বছর, বারংবার এই কষ্ট সহ্য করে যায়। এসবের মধ্যে তোমরা কী দেখতে পাও? ঈশ্বর যা দিয়েছেন মানুষের কাছ থেকে তার বিনিময়ে তিনি কোনোকিছুই দাবি করেন না, কিন্তু ঈশ্বরের সারসত্যের কারণে, তিনি মানবজাতির দুষ্টতা, কলুষ, এবং পাপাচারকে একেবারেই সহ্য করতে পারেন না, পরিবর্তে তিনি চরম বিতৃষ্ণা ও ঘৃণা বোধ করেন, যার ফলে ঈশ্বরের হৃদয় ও তাঁর দেহরূপকে অন্তহীন যন্ত্রণা সহন করতে হয়। তোমরা কি তা দেখতে পেয়েছো? খুব সম্ভবত, তোমাদের কেউই তা দেখতে পাও নি, কারণ তোমাদের কেউই প্রকৃত অর্থে ঈশ্বরকে উপলব্ধি করো নি। সময়ের সাথে সাথে, তোমাদের নিজেদেরই তা ক্রমে ক্রমে অনুভব করা উচিত।

এবার, ধর্মগ্রন্থের নিম্নলিখিত অনুচ্ছেদটির দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক:

৯. যীশু অলৌকিক কার্য সম্পাদন করলেন

i. যীশু পাঁচ সহস্র মানুষকে খাদ্য জোগালেন

যোহন ৬:৮-১৩ শিমোন পিতরের ভাই আন্দ্রিয় ছিলেন যীশুর শিষ্যদের মধ্যে একজন। তিনি যীশুকে বললেন, এখানে একটি ছেলের কাছে যবের পাঁচখানা রুটি আর দুখানা ভাজা মাছ আছে কিন্তু এত লোকের পক্ষে এ কিছুই না। যীশু বললেন, সবাইকে বসিয়ে দাও। প্রচুর ঘাসে ঢাকা ছিল জায়গাটা। লোকেরা সব বসে পড়ল সেখানে। সেই জনতার মধ্যে পুরুষের সংখ্যাই ছিল পাঁচ হাজার। যীশু রুটিগুলি নিয়ে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিলেন। তারপর উপবিষ্ট লোকদের মধ্যে সেগুলি পরিবেশন করার জন্য শিষ্যদের দিলেন। মাছের বেলাতেও তিনি তাই-ই করলেন। যে যত চাইল, পেল। যথেষ্ট পরিমাণে সকলের খাওয়া হলে যীশু তাঁর শিষ্যদের বললেন, এবার যা কিছু পড়ে আছে সব জড়ো কর যেন কিছুই নষ্ট না হয়। তাঁরা তখন সব জড়ো করলেন। লোকদের খাওয়াদাওয়ার পর পাঁচখানা যবের রুটি থেকে যে টুকরোগুলি বেঁচেছিল তাতে তাঁদের বারোটি ঝুড়ি ভরে গেল।

ii. লাসারের পুনরুত্থান ঈশ্বরকে মহিমান্বিত করলো

যোহন ১১:৪৩-৪৪ তারপর যীশু উচ্চকন্ঠে ডেকে বললেন, লাসার, বেরিয়ে এস। লাসার বেরিয়ে এল। তার হাত পা ছিল কাপড়ের ফালি দিয়ে জড়িয়ে বাঁধা আর মুখে জড়ান ছিল একটা কাপড়। যীশু বললেন, ওর বাঁধন খুলে দাও, যেতে দাও ওকে।

প্রভু যীশুর দ্বারা সম্পাদিত অলৌকিক ঘটনাগুলির মধ্যে থেকে, আমরা শুধু এই দুটিকেই নির্বাচন করেছি কারণ এখানে যে বিষয়ে আমি আলোচনা করতে চাই, তা প্রতিপাদন করার জন্য এদুটিই পর্যাপ্ত। এই অলৌকিক ঘটনাদুটি সত্যিই বিস্ময়কর, এবং যথার্থভাবেই অনুগ্রহের যুগ চলাকালীন প্রভু যীশুর দ্বারা সম্পন্ন অলৌকিক কার্যগুলির প্রতিনিধিস্থানীয়।

প্রথমে, প্রথম অনুচ্ছেদটির দিকে এক ঝলক দেখা যাক: যীশু পাঁচ সহস্র মানুষকে খাদ্য জোগালেন।

“পাঁচখানা রুটি আর দুখানা ভাজা মাছ”-এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্যটি কী? সাধারণভাবে, পাঁচ খণ্ড রুটি ও দুটি মাছ দিয়ে কতজন মানুষকে পর্যাপ্তভাবে ভোজন করানো যায়? একজন গড়পড়তা মানুষের ক্ষুধাকে তুমি যদি তোমার পরিমাপের ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করো, তাহলে তা কেবল দুজন মানুষের পক্ষে যথেষ্ট হবে। সবচেয়ে মৌলিক অর্থে এই হল “পাঁচখানা রুটি আর দুখানা ভাজা মাছ”-এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য। কিন্তু, এই অনুচ্ছেদে, পাঁচ খণ্ড রুটি ও দুখানা মাছ দিয়ে কতজন মানুষকে ভোজন করানো হয়েছে? শাস্ত্রে নিম্নলিখিত বাক্যটি নথিভুক্ত আছে: “প্রচুর ঘাসে ঢাকা ছিল জায়গাটা। লোকেরা সব বসে পড়ল সেখানে। সেই জনতার মধ্যে পুরুষের সংখ্যাই ছিল পাঁচ হাজার।” পাঁচ খণ্ড রুটি ও দুখানা মাছের সঙ্গে তুলনায় পাঁচ হাজার কি একটি বড়ো সংখ্যা? সংখ্যাটি যে এতো বড়ো, তাতে কী প্রমাণ হয়? এক মানবীয় পরিপ্রেক্ষিত থেকে, পাঁচ খণ্ড রুটি ও দুটি মাছ পাঁচ হাজার মানুষের মধ্যে বণ্টন করা অসম্ভব ব্যাপার হবে, কারণ মানুষের সংখ্যা ও খাদ্যের পরিমানের মধ্যে তারতম্যটি অত্যন্ত বেশি। এমনকি প্রত্যেক মানুষ কেবল ক্ষুদ্র একগ্রাস খাদ্যও গ্রহণ করে, তাহলেও তা পাঁচ হাজার লোকের পক্ষে যথেষ্ট হবে না। কিন্তু এখানে, প্রভু যীশু এক অলৌকিক কার্য সম্পাদন করেন—তিনি যে শুধু পাঁচ হাজার মানুষের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্যের সংস্থান নিশ্চিত করলেন তা-ই নয়, উপরন্তু আরো খাদ্য উদ্বৃত্ত রয়ে গেলো। ধর্মগ্রন্থে লেখা আছে: “যথেষ্ট পরিমাণে সকলের খাওয়া হলে যীশু তাঁর শিষ্যদের বললেন, এবার যা কিছু পড়ে আছে সব জড়ো কর যেন কিছুই নষ্ট না হয়। তাঁরা তখন সব জড়ো করলেন। লোকদের খাওয়াদাওয়ার পর পাঁচখানা যবের রুটি থেকে যে টুকরোগুলি বেঁচেছিল তাতে তাঁদের বারোটি ঝুড়ি ভরে গেল।” এই অলৌকিক ঘটনাটি মানুষকে প্রভু যীশুর পরিচিতি ও মর্যাদা অনুধাবন করতে, এবং ঈশ্বরের পক্ষে কিছুই যে অসম্ভব নয়, তা উপলব্ধি করতে সমর্থ করেছিল—এইভাবে, তারা ঈশ্বরের সর্বশক্তিমত্তার সত্যকে প্রত্যক্ষ করেছিল। পাঁচ খণ্ড রুটি ও দুখানা মাছ পাঁচ হাজার মানুষকে ভোজন করানোর পক্ষে পর্যাপ্ত ছিল, কিন্তু যদি কোনো খাদ্যই না থাকতো, তখনো কি ঈশ্বর পাঁচ হাজার লোককে আহার করাতে সক্ষম হতেন? নিশ্চিতভাবেই, তিনি তা-ও করতে পারতেন! এ হল এক অলৌকিক কাণ্ড, তাই মানুষ অবধারিতভাবে ভেবেছিল যে, তা ধারণাতীত, অবিশ্বাস্য ও রহস্যজনক, কিন্তু ঈশ্বরের কাছে, এহেন কর্মসম্পাদন কোনো বিষয়ই ছিল না। ঈশ্বরের কাছে যদিও তা ছিল এক সাধারণ বিষয়, তবু, ব্যাখ্যাদানের নিমিত্ত এটিকে এখন আলাদা করে বেছে নেওয়া হবে কেন? কারণ, এই অলৌকিক সংঘটনের পিছনে যা নিহিত, তা হল প্রভু যীশুর অভিপ্রায়, যা মানবজাতি আগে কখনো ঠাহর করেনি।

প্রথমে, বোঝার চেষ্টা করা যাক যে এই পাঁচ হাজার জন মানুষ কী ধরনের ব্যক্তি ছিল। তারা কি প্রভু যীশুর অনুসরণকারী ছিল? শাস্ত্র থেকে আমরা জানতে পারি যে, তারা তাঁর অনুসরণকারী ছিল না। প্রভু যীশু কে, তা কি তারা জানতো? নিশ্চিতভাবেই জানতো না! অন্ততপক্ষে, তারা জানতো না যে তাদের সামনে যে মানুষটি দাঁড়িয়ে আছেন তিনি খ্রীষ্ট, অথবা হয়তো কিছু মানুষ কেবল তাঁর নামটুকুই জানতো এবং তাঁর কার্যকলাপের বিষয়ে কিছু কথাবার্তা জানতো বা শুনেছিল। কেবলমাত্র তাঁর সম্বন্ধে গল্পগাথাগুলি শোনার পরেই প্রভু যীশুর বিষয়ে তাদের কৌতূহল জেগে উঠেছিল, কিন্তু তুমি অবশ্যই এমনটা বলতে পারো না যে তারা তাঁকে অনুসরণ করতো, তাঁকে উপলব্ধির করার তো প্রশ্নই ওঠে না। প্রভু যীশু যখন এই পাঁচ হাজার মানুষকে দেখেন, তারা তখন ক্ষুধার্ত এবং কেবল নিজেদের ক্ষুন্নিবারণের চিন্তাতেই ব্যস্ত ছিল, সুতরাং এহেন এক পরিস্থিতিতেই প্রভু যীশু তাদের কামনা পূরণ করেছিলেন। তাদের ইচ্ছা যখন তিনি পূরণ করেন, তখন তাঁর অন্তরে কী ছিল? যে মানুষগুলি শুধু উদরপূর্তি করে ভোজন করতে চেয়েছিল, তাদের প্রতি তাঁর মনোভাব কী ছিল? সেই সময়, প্রভু যীশুর চিন্তা ও তাঁর মনোভাব ঈশ্বরের স্বভাব ও সারসত্যের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। শূন্যজঠর ও শুধুমাত্র একটা পূর্ণ আহারের আকাঙ্ক্ষী এই পাঁচ সহস্র মানুষের মুখোমুখি হয়ে, তাঁর প্রতি কৌতূহল ও প্রত্যাশায় ভরপুর এই মানুষগুলির সম্মুখীন হয়ে, কেবলমাত্র তাদের উপর অনুগ্রহ বর্ষণের উদ্দেশ্যেই প্রভু যীশু এই অলৌকিক সংঘটন প্রয়োগ করবেন বলে ভেবেছিলেন। কিন্তু, তাঁর মনে এমন কোনো আশা জাগ্রত হয়নি যে তারা তাঁর অনুগামীতে পরিণত হবে, কারণ তিনি জানতেন যে তারা শুধু তামাসায় অংশ নিতে ও তাদের পেট পুরে খেতে চেয়েছিল, তাই সেখানে তাঁর কাছে যা ছিল তা দিয়েই তিনি যতটা সম্ভব করেছিলেন, এবং পাঁচ খণ্ড রুটি ও দুখানা মাছ দিয়ে পাঁচ সহস্র লোককে খাইয়েছিলেন। এই লোকগুলি, যারা রোমাঞ্চকর ব্যাপার দেখতে ভালোবাসতো, যারা অলৌকিক ঘটনা চাক্ষুষ করতে চাইতো, তিনি তাদের চোখ খুলে দিয়েছিলেন, এবং ঈশ্বরের অবতার যা সম্পন্ন করতে পারেন, তা তারা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছিল। যদিও তাদের কৌতূহল চরিতার্থ করার জন্য প্রভু যীশু স্পর্শগ্রাহ্য কিছু দ্রব্যের ব্যবহার করেছিলেন, কিন্তু তাঁর অন্তরে তিনি আগেই জানতেন যে এই পাঁচ হাজার মানুষ শুধু একটা উত্তম আহার্য পেতে চেয়েছিল, তাই তাদের কাছে তিনি ধর্মপ্রচার করেন নি বা আদৌ কিছুই বলেন নি—তিনি কেবল এই অলৌকিক ঘটনাটি সংঘটনকালে তাদের তা দেখার সুযোগ দিয়েছিলেন। যারা তাঁকে সত্যিকারের অনুসরণ করতো তাঁর সেই শিষ্যদের সঙ্গে তিনি যে আচরণ করতেন, এই লোকগুলির সঙ্গে কোনোক্রমেই তিনি সেই একই আচরণ করতে পারতেন না, কিন্তু ঈশ্বরের অন্তরে, সকল প্রাণীই তাঁর শাসনের অধীন, এবং যখন প্রয়োজন হবে তখন তাঁর দৃষ্টিসীমার মধ্যে সকল জীবকেই তিনি ঈশ্বরের অনুগ্রহ উপভোগ করতে দেবেন। যদিও এই লোকগুলি তিনি কে তা জানতো না, এবং তাদের তাঁর বিষয়ে কোনো উপলব্ধি, বা তাঁর সম্বন্ধে কোনো নির্দিষ্ট ধারণা, বা এমনকি, ঐ রুটি ও মাছ আহার করার পরেও তাঁর প্রতি কোনো কৃতজ্ঞতাবোধ ছিল না, কিন্তু এগুলি ঈশ্বরের কাছে কোনো মতান্তরের বিষয় ছিল না—সেই মানুষগুলিকে তিনি ঈশ্বরের অনুগ্রহ উপভোগ করার এক চমৎকার সুযোগ দিয়েছিলেন। কিছু মানুষ বলে থাকে যে ঈশ্বর তাঁর সকল কার্যে নীতিনিষ্ঠ, বলে যে, তিনি নাকি অবিশ্বাসীদের দেখভাল করেন না বা তাদের সুরক্ষা দেন না, এবং বিশেষ করে বলে, যে, তিনি নাকি তাদের তাঁর অনুগ্রহ উপভোগের সুযোগ দেন না। ঘটনাটি কি প্রকৃতই তাই? ঈশ্বরের দৃষ্টিতে, যতক্ষণ তারা স্বয়ং তাঁর সৃষ্ট জীবিত প্রাণী, ততক্ষণ তিনি তাদের পরিচালনা ও তত্ত্বাবধান করবেন, এবং বিবিধ উপায়ে তিনি তাদের সাথে আচরণ করবেন, তাদের জন্য পরিকল্পনা করবেন, এবং তাদের শাসন করবেন। সকল কিছুর প্রতি এটাই হল ঈশ্বরের চিন্তাভাবনা ও মনোভাব।

যদিও এই পাঁচ হাজার মানুষ, যারা সেই রুটি ও মাছ আহার করেছিল, তাদের প্রভু যীশুর অনুগামী হওয়ার কোনো পরিকল্পনা ছিল না, কিন্তু তিনি তাদের কাছে কঠোর কোনো দাবি রাখেন নি; তোমরা কি জানো, যে, তাদের পেট ভরে আহার সমাপন হলে, প্রভু যীশু কী করেছিলেন? তিনি কি আদৌ তাদের উদ্দেশ্যে ধর্মপ্রচার করেছিলেন? এই কার্য সম্পাদনের পর তিনি কোথায় গিয়েছিলেন? শাস্ত্রবাক্যে লিপিবদ্ধ নেই যে প্রভু যীশু লোকগুলিকে কিছু বলেছিলেন, কেবল বলা আছে যে, সেই অলৌকিক কার্য সম্পাদনের পর তিনি শান্তভাবে চলে গিয়েছিলেন। তাহলে তিনি কি এই লোকগুলির কাছে কোনো চাহিদা জ্ঞাপন করেছিলেন? এর মধ্যে কি কোনো ঘৃণাবোধ ছিল? না, এসব কিছুই ছিল না। তিনি কেবল সেই ব্যক্তিগণ, যারা তাঁর অনুগমনে সক্ষম ছিল না, তাদের প্রতি আর কোনো মনোযোগ দিতে চান নি, এবং সেই সময়ে তাঁর হৃদয় বেদনায় কাতর ছিল। কারণ তিনি মানবজাতির নৈতিক অধোগমন প্রত্যক্ষ করেছিলেন, এবং তাঁর প্রতি মানবজাতির প্রত্যাখ্যানকে অনুভব করেছিলেন, সেই মানুষদেরকে দেখার ও তাদের সঙ্গে অবস্থান করার পরে, মানুষের মূঢ়তা ও অজ্ঞতার কারণে তিনি দুঃখ বোধ করেছিলেন, এবং তাঁর হৃদয় বেদনায় দীর্ণ হয়েছিল, তিনি শুধু যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেই ব্যক্তিগণকে ছেড়ে চলে আসতে চেয়েছিলেন। প্রভু তাঁর অন্তরে এই লোকগুলির কাছে কোনো জ্ঞাপন করেন নি, তিনি তাদের প্রতি কোনো মনোযোগ দিতে চান নি, তাদের জন্য তিনি তাঁর শক্তি ব্যয় করতে চান নি। তিনি জানতেন তারা তাঁর অনুগমনে সক্ষম নয়, কিন্তু তা সত্ত্বেও, তাদের প্রতি তাঁর মনোভাব তখনো খুব স্পষ্ট ছিল। তিনি শুধু তাদের প্রতি সদয় আচরণ করতে, তাদের উপর অনুগ্রহ অর্পণ করতে চেয়েছিলেন, এবং বস্তুত তাঁর শাসনাধীন প্রতিটি জীবের প্রতি এটাই ছিল ঈশ্বরের মনোভাব—সকল জীবের প্রতি সহৃদয় আচরণ করা, রসদ সংস্থান করে তাদের পুষ্টিসাধন করা। প্রভু যীশু ঈশ্বরের অবতার ছিলেন বলেই, খুব স্বাভাবিক ভাবেই তিনি ঈশ্বরের নিজস্ব সারসত্যের প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন, এবং এই লোকগুলির প্রতি সদয় আচরণ করেছিলেন। এক জনহিতৈষী ও সহিষ্ণু হৃদয় নিয়ে তাদের তিনি বিবেচনা করেছিলেন, এবং এমন একটা হৃদয় থেকেই তাদের প্রতি তিনি সহৃদয়তা প্রদর্শন করেছিলেন। এই লোকগুলি প্রভু যীশুকে যেভাবেই দেখে থাকুক না কেন, এবং ফলাফল যেমনই হোক না কেন, প্রত্যেক সত্তাকে তিনি দেখেছিলেন সমগ্র সৃষ্টির প্রভু হিসাবে তাঁর অবস্থানের ভিত্তিতে। যাকিছু তিনি প্রকাশ করেছিলেন, ব্যত্যয়হীন ভাবে তা ছিল ঈশ্বরেরই স্বভাব, এবং তাঁর যা আছে ও তিনি যা। প্রভু যীশু শান্তভাবে এই কার্য সম্পাদন করেছিলেন, আর তারপর তিনি শান্তভাবে চলে গিয়েছিলেন—এটি ঈশ্বরের স্বভাবের কোন দিক? একে কি ঈশ্বরের প্রেমময় সহৃদয়তা বলা যায়? একে কি ঈশ্বরের পরার্থপরতা বলা যেতে পারে? একজন গড়পড়তা মানুষ কি এমনটা করতে সক্ষম? নিশ্চিতভাবেই তা নয়! সারমর্মগতভাবে, প্রভু যীশু এই যে পাঁচ হাজার জন মানুষকে পাঁচ টুকরো রুটি ও দুটি মাছের সাহায্যে ভোজন করালেন, তারা কারা ছিল? এমন কি বলা যায় যে, তারা তাঁর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ মানুষ ছিল? এমনটা কি বলা যায় যে, তারা সকলেই ঈশ্বর-বিদ্বেষী ব্যক্তি ছিল? নিশ্চিতভাবেই বলা যায় এরা মোটেই প্রভুর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না, এবং সারমর্মের দিক থেকে, তারা ছিল সর্বতোভাবেঈশ্বরের প্রতি বৈরীভাবাপন্ন। কিন্তু ঈশ্বর তাদের প্রতি কেমন আচরণ করলেন? মানুষগুলির ঈশ্বর-বিদ্বেষকে নিষ্ক্রিয় করতে তিনি একটি পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলেন—এই পদ্ধতিটিকে বলে “সহৃদয়তা।” অর্থাৎ, প্রভু যীশু এই লোকগুলিকে পাপী মানুষ বলে জানলেও, ঈশ্বরের দৃষ্টিতে তবু তারা তাঁরই সৃষ্টি ছিল, তাই তিনি তখনো এই পাপীদের প্রতি সহৃদয় আচরণই করেছিলেন। এটাই হল ঈশ্বরের সহিষ্ণুতা, এবং এই সহিষ্ণুতা ঈশ্বরের নিজস্ব পরিচয় ও সারসত্যের দ্বারা নির্ধারিত হয়। তাই, এ হল এমন এক বিষয়, যা ঈশ্বর-সৃষ্ট কোনো মানুষের পক্ষে করে ওঠা সক্ষম নয়—একমাত্র ঈশ্বরই তা করতে পারেন।

যখন তুমি যথার্থভাবেই মানবজাতির প্রতি ঈশ্বরের চিন্তাভাবনা ও মনোভাব অনুধাবন করতে সক্ষম হবে, যখন সৃষ্টির প্রতিটি সত্তার জন্য ঈশ্বরের ভাবাবেগ ও উদ্বেগকে প্রকৃতপক্ষেই উপলব্ধি করতে পারবে, তখনই তুমি সৃষ্টিকর্তার দ্বারা সৃজিত প্রত্যেকটি মানুষের উপর যে নিষ্ঠা ও ভালোবাসা ব্যয়িত হয়েছে, তা উপলব্ধিতে সক্ষম হবে। এটা ঘটে গেলে, ঈশ্বরের ভালোবাসাকে বর্ণনার জন্য তুমি দুটিমাত্র শব্দ ব্যবহার করবে। সেই শব্দদুটি কী? কিছু মানুষ বলে “নিঃস্বার্থ”, এবং কিছু মানুষ বলে “মানবহিতৈষী”। এই দুটির মধ্যে, ঈশ্বরের ভালোবাসাকে বর্ণনা প্রসঙ্গে “মানবহিতৈষী” শব্দটি সবচেয়ে কম সুপ্রযুক্ত। মহানুভব বা উদারচেতা কোনো মানুষের বর্ণনা প্রসঙ্গে মানুষ এই শব্দটি ব্যবহার করে থাকে। এই শব্দটি আমি ঘৃণা করি, কারণ শব্দটি ন্যায়নীতির প্রতি কোনো বিবেচনা ব্যতিরেকেই যথেচ্ছ ও বাছবিচারহীনভাবে বদান্যতা বিতরণ করাকে নির্দেশ করে। এ হল এক মাত্রাতিরিক্ত আবেগাত্মক প্রবণতা, যা নির্বোধ ও বিভ্রান্ত মানুষদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। ঈশ্বরের ভালোবাসার বর্ণনায় এই শব্দটি ব্যবহার করা হলে, অবধারিতভাবেই এক ঈশ্বরনিন্দাসূচক দ্যোতনা চলে আসে। এখানে আমি দুটো শব্দ বলছি যেগুলি আরো যথাযথভাবে ঈশ্বরের ভালোবাসাকে বর্ণনা করে। সেদুটি কী? প্রথমটি হল “বিপুল”। এই শব্দটি কি খুবই ব্যঞ্জনাময় নয়? দ্বিতীয়টি হল “বিশাল”। ঈশ্বরের ভালোবাসাকে বর্ণনা করতে এই যে শব্দদুটি আমি ব্যবহার করেছি তাদের মধ্যে বাস্তব অর্থ নিহিত আছে। আক্ষরিক অর্থে নিলে, “বিপুল” শব্দটি কোনো বস্তুর আয়তন বা ধারণক্ষমতা নির্দেশ করে, কিন্তু বস্তুটি যত বড়োই হোক না কেন, মানুষ সেটিকে স্পর্শ ও দর্শন করতে পারে। এর কারণ হল যে, বস্তুটির অস্তিত্ব রয়েছে—সেটি কোনো বিমূর্ত বিষয় নয়, বরং তা হল এমন একটা কিছু, যা মানুষকে এক অপেক্ষাকৃত নির্ভুল ও ব্যবহারিক ভাবে ধারণা দিতে পারে। বস্তুকে তুমি দ্বিমাত্রিক বা ত্রিমাত্রিক যে পরিপ্রেক্ষিতেই দেখো, তোমাকে এর অস্তিত্ব কল্পনা করতে হবে না, কারণ এট হল এমন এক বস্তু, যা বাস্তবে প্রকৃতই অস্তিমান। যদিও ঈশ্বরের ভালোবাসা বর্ণনা প্রসঙ্গে “বিপুল” শব্দটির প্রয়োগ তাঁর ভালোবাসাকে পরিমিত করার একটা প্রচেষ্টা বলে মনে হতে পারে, কিন্তু, একই সাথে, শব্দটি এমন অনুভূতিও দেয় যে, তাঁর ভালোবাসা অপরিমেয়। আমি ঈশ্বরের ভালোবাসাকে পরিমাপযোগ্য বলছি কারণ তাঁর ভালোবাসা শূন্যগর্ভ নয়, এবং তা কিংবদন্তিতে বর্ণিত কোনো বিষয়ও নয়। বরং, এটা এমন একটা জিনিস যা ঈশ্বরের কর্তৃত্বাধীন সকল বস্তুই ভাগ করে নেয়, সকল সত্তাই যা বিভিন্ন মাত্রায় ও বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত থেকে উপভোগ করে। যদিও মানুষ একে দর্শন বা স্পর্শ করতে পারে না, কিন্তু এই ভালোবাসা সকল বস্তুর মধ্যে বহন করে আনে পুষ্টিসাধকতা ও প্রাণশক্তি, যা তাদের জীবৎকালে ক্রমে ক্রমে প্রকাশিত হয়, এবং প্রতিটি অপসৃয়মান মুহূর্তে তাদের উপভোগ করা ঈশ্বরের ভালোবাসাকে তারা তাৎপর্যপূর্ণ মনে করে, এবং সেই ভালোবাসার সাক্ষ্য বহন করে। ঈশ্বরের ভালোবাসাকে আমি অপরিমেয় বলছি কারণ ঈশ্বর কর্তৃক সকল বস্তুকে সংস্থান ও পুষ্টিসাধনের রহস্যটি অনুধাবন করা মানুষের পক্ষে কঠিন, যেমন কঠিন সকলকিছুর জন্য, বিশেষত মানবজাতির জন্য, ঈশ্বরের চিন্তাভাবনাকে বুঝে ওঠা। অর্থাৎ, মানবজাতির নিমিত্ত ঈশ্বর যে কতখানি পরিশ্রম করেছেন, তা কেউই জানে না। তাঁর স্বহস্তে সৃজিত মানবজাতির প্রতি সৃষ্টিকর্তার ভালোবাসার গভীরতা বা গুরুত্ব কেউই উপলব্ধি করতে পারে না, কেউই তা বুঝে উঠতে সক্ষম নয়। ঈশ্বর ভালোবাসাকে বিপুল বলে বর্ণনা করার উদ্দেশ্য মানুষকে এর প্রসার এবং এর অস্তিত্বের সত্যতাকে হৃদয়ঙ্গম ও উপলব্ধি করতে সহায়তা করা। এর আরেকটা লক্ষ্য হল যে, মানুষ যাতে “সৃষ্টিকর্তা” শব্দটির প্রকৃত অর্থ আরো গভীরভাবে অন্তরঙ্গম করতে পারে, এবং যাতে তারা “সৃষ্টি” অভিধাটির সম্যক অর্থ বিষয়ে এক গভীরতর উপলব্ধি লাভ করতে পারে। “বিশাল” শব্দটি সাধারণত কীসের বর্ণনা দেয়? সাধারণত, এটি সমুদ্র বা মহাবিশ্বের বর্ণনা প্রসঙ্গে ব্যবহৃত হয়, যেমন: “বিশাল মহাবিশ্ব”, বা “বিশাল সমুদ্র”। মহাবিশ্বের প্রসারতা এবং নীরব গভীরতা মানুষের বোধশক্তির অতীত; এ হল এক বিষয়, যা মানুষের কল্পনাকে আকর্ষণ করে, যার প্রতি তারা প্রভূত বিস্ময়বোধ অনুভব করে। এর রহস্য ও নিগূঢ়তা দৃষ্টিগোচর হলেও ধরা-ছোঁয়ার অতীত। সমুদ্রের কথা ভাবলে তুমি তার প্রসারের কথা চিন্তা করো—সমুদ্রকে দেখে সীমাহীন মনে হয়, এবং তুমি এর রহস্যময়তা ও অপরিসীম ধারণক্ষমতা অনুভব করতে পারো। এই কারণেই ঈশ্বরের ভালোবাসাকে বর্ণনা করতে আমি “বিশাল” শব্দটি ব্যবহার করেছি, যাতে এই ভালোবাসার মহার্ঘতা অনুভব করতে মানুষের সুবিধা হয়, যাতে তারা আরো সহজে তাঁর ভালোবাসার প্রগাঢ় সৌন্দর্যের অনুভূতি পায়, এবং তারা উপলব্ধি করতে পারে যে, ঈশ্বরের ভালোবাসার ক্ষমতা অপার ও সুদূরপ্রসারী। এই শব্দটি আমি ব্যবহার করেছিলাম মানুষকে তাঁর ভালোবাসার পবিত্রতা এবং তাঁর ভালোবাসার মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের যে মর্যাদা ও অপ্রতিরোধ্যতা প্রকাশিত হয়, তা অনুভবে সহায়তার উদ্দেশ্যে। এখন কি তোমাদের মনে হচ্ছে যে ঈশ্বরের ভালোবাসার বর্ণনা প্রসঙ্গে “বিশাল” হল এক উপযুক্ত শব্দ? ঈশ্বরের ভালোবাসা কি, “বিপুল” ও “বিশাল”, এই শব্দদুটির উচ্চতাকে স্পর্শ করতে পারে? অবশ্যই পারে! মানুষের ভাষায়, এই দুটি শব্দই একমাত্র কিছুটা সুপ্রযুক্ত, এবং ঈশ্বরের ভালোবাসাকে বর্ণনা করার ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত ধারেকাছে আসে। তোমাদের কি তা-ই মনে হয় না? আমি যদি তোমাদের ঈশ্বরের ভালোবাসাকে বর্ণনা করতে বলি, তাহলে তোমরা কি এই শব্দদুটি ব্যবহার করবে? খুব সম্ভবত করবে না, কারণ ঈশ্বরের ভালোবাসার বিষয়ে তোমাদের উপলব্ধি ও মূল্যায়ন এক দ্বিমাত্রিক পরিপ্রেক্ষিতের পরিসরের ভিতর সীমাবদ্ধ, এবং তা ত্রিমাত্রিক ক্ষেত্রের উচ্চতায় উন্নীত হয় নি। তাই, আমি যদি তোমাদের ঈশ্বরের ভালোবাসাকে বর্ণনা করতে বলি, তখন তোমরা উপযুক্ত শব্দের অভাব বোধ করবে কিম্বা এমনকি হয়তো নির্বাক হয়ে যাবে। আজ আমি যে শব্দদুটির কথা বলেছি, সেগুলি হয়তো তোমাদের পক্ষে উপলব্ধি করা কঠিন, কিম্বা হয়তো তোমরা আমার সঙ্গে একমতই নও। তা থেকে শুধু এটাই প্রমাণিত হয় যে, ঈশ্বরের ভালোবাসার বিষয়ে তোমাদের মূল্যায়ন ও উপলব্ধি উপরিগত ও এক সংকীর্ণ পরিসরের মধ্যে সীমাবদ্ধ। আমি আগেও বলেছি যে ঈশ্বর স্বার্থশূন্য; তোমাদের এই “স্বার্থশূন্য” শব্দটি মনে পড়ছে? এমন কি সম্ভব, যে, ঈশ্বরের ভালোবাসাকে শুধুমাত্র স্বার্থশূন্য বলেই অভিহিত করা যায়? তা কি অতি সংকীর্ণ এক পরিসর নয়? এই বিষয়টার উপর তোমাদের আরো বেশি চিন্তাভাবনা করা উচিত, যাতে এর থেকে তোমরা কিছু অর্জন করতে পারো।

প্রথম অলৌকিক কার্যটি থেকে ঈশ্বরের স্বভাব ও তাঁর সারসত্য সম্বন্ধে যা আমরা জানলাম, তা উপরে বর্ণিত হল। যদিও এই গাথাটি মানুষ হাজার হাজার বছর ধরে পাঠ করে আসছে, যদিও এর রূপরেখাটি সরল, এবং মানুষকে তা এক অনলঙ্কৃত ঘটনা অবলোকনের সুযোগ দেয়, তবু এই সরল কাহিনীচিত্রণের মধ্য দিয়ে আমরা আরো মূল্যবান কিছু প্রত্যক্ষ করতে পারি, যা হল ঈশ্বরের স্বভাব এবং তাঁর যা আছে ও তিনি যা। তাঁর যা আছে ও তিনি যা, সেই বিষয়গুলিই স্বয়ং ঈশ্বরের প্রতিনিধিত্ব করে, এবং তা হল ঈশ্বরের নিজস্ব চিন্তাভাবনার এক অভিব্যক্তি। ঈশ্বর যখন তাঁর চিন্তাকে প্রকাশিত করেন, তখন তা তাঁর অন্তরের কণ্ঠস্বরের এক অভিব্যক্তি হয়ে দাঁড়ায়। তিনি আশা করেন যে, এমন মানুষ থাকবে, যে তাঁকে উপলব্ধি করতে, তাঁকে জানতে ও তাঁর ইচ্ছাকে প্রণিধান করতে পারবে, এবং যে তাঁর হৃদয়ের কণ্ঠস্বরকে শুনতে পাবে এবং তাঁর ইচ্ছা পূর্ণ করার জন্য সক্রিয় সহযোগিতায় সক্ষম হবে। এই যে কার্যগুলি প্রভু যীশু সাধন করেছিলেন, এগুলি ছিল ঈশ্বরের নিরুচ্চার অভিব্যক্তি।

এবার, নিম্নলিখিত অনুচ্ছেদটির দিকে লক্ষ্য করা যাক: লাসারের পুনরুত্থান ঈশ্বরকে মহিমান্বিত করলো।

এই অনুচ্ছেদটি পাঠ করার পর তোমাদের মনে কী প্রভাব পড়ল? প্রভু যীশুর সম্পাদিত এই অলৌকিক কর্মটির তাৎপর্য আগেরটির অপেক্ষা অনেক বৃহত্তর, কারণ কোনো অলৌকিক সংঘটনই এক মৃত মানুষকে কবর থেকে ফিরিয়ে আনার চেয়ে বেশি বিস্ময়কর হতে পারে না। সেই যুগে, প্রভু যীশু যে এই রকমের কিছু সম্পন্ন করেছিলেন, তা অতীব তাৎপর্যমণ্ডিত। ঈশ্বর যেহেতু দেহধারণ করেছিলেন, তাই মানুষ কেবল তাঁর বাহ্যিক চেহারা, তাঁর ব্যবহারিক দিক, ও তাঁর অকিঞ্চিৎকর দিকটি দেখতে পেতো। কিছু মানুষ যদিও তাঁর চরিত্রের কিছু বিষয় বা যেসকল বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী হিসাবে তিনি প্রতিভাত হতেন সেগুলির কিছুটা প্রত্যক্ষ ও উপলব্ধি করেছিল, কিন্তু প্রভু যীশু কোথা থেকে এসেছেন, তাঁর সারসত্যে তিনি প্রকৃতই কে ছিলেন, এবং আর কী কী কার্য সম্পন্ন করতে তিনি সত্যিই সমর্থ ছিলেন, এসব কেউই জানতো না। মানবজাতির কাছে এই সমস্তকিছুই অজ্ঞাত ছিল। ফলে অনেক মানুষ প্রভু যীশুর সম্পর্কে এই প্রশ্নগুলির উত্তর পাওয়ার এবং সত্যটি জানার জন্য প্রমাণ খুঁজতে চাইছিলো। তাঁর নিজের পরিচয়কে প্রতিপন্ন করতে ঈশ্বর কি কিছু করতে পারেন? ঈশ্বরের কাছে, এ ছিল অতি সহজ কাজ—ছেলেখেলা মাত্র। তাঁর পরিচয় ও সারসত্যকে প্রতিপন্ন করতে যেকোনো স্থানে, যেকোনো সময় তিনি কিছু একটা করতে পারতেন, কিন্তু ঈশ্বরের কার্য সাধনের নিজস্ব পদ্ধতি ছিল—পরিকল্পনা সহকারে, এবং ধাপে ধাপে। তিনি বাছবিচার না করেই কার্যাদি সম্পন্ন করতেন না, বরং মানুষকে দেখার অনুমোদন দেবে, প্রকৃতই এমন অর্থসম্পৃক্ত কোনো কার্য সম্পাদনের উদ্দেশ্যে তিনি সঠিক সময় ও সঠিক সুযোগের সন্ধান করেছিলেন। এই ভাবেই, তিনি তাঁর কর্তৃত্ব ও পরিচয় প্রতিপন্ন করেছিলেন। তাহলে, লাসারের পুনরুত্থান কি প্রভু যীশুর স্বরূপ প্রতিপন্ন করতে পেরেছিল? নিম্নলিখিত শাস্ত্রবাক্যটির দিকে নজর করা যাক: “তারপর যীশু উচ্চকন্ঠে ডেকে বললেন, লাসার, বেরিয়ে এস। লাসার বেরিয়ে এল…।” যখন প্রভু যীশু এমন করলেন, তখন তিনি শুধু একটিই কথা উচ্চারণ করেছিলেন: “লাসার, বেরিয়ে এস।” লাসার তখন তার কবর থেকে বেরিয়ে এলো—প্রভুর কয়েকটি বাক্য উচ্চারণেই এমনটা সম্ভব হয়েছিল। এই সময়ে, প্রভু যীশু কোনো পূজাবেদী প্রতিষ্ঠা করেননি, এবং তিনি অন্য কোনো কর্ম সম্পাদন করেননি। তিনি কেবলমাত্র এই একটিই বাক্য বলেছিলেন। একে কি আমরা অলৌকিক ঘটনা বলব নাকি আজ্ঞা বলব? নাকি এ কোনো প্রকারের মায়াবিদ্যা? বাহ্যিক ভাবে দেখলে, একে অলৌকিক ঘটনা বলা যেতে পারে, এবং, একে যদি তুমি আধুনিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখো, তবে অবশ্যই একে অলৌকিক ঘটনাই বলবে। তবে, একে মৃত ব্যক্তির আত্মাকে পুনরুজ্জীবিত করে তোলার জাদু হিসেবে অভিহিত করা যায় না, এবং তা কোনোভাবেই কোনোধরনের মায়াবিদ্যারও অংশ নয়। বরং এমন বলা সঠিক হবে যে, এই অলৌকিক ঘটনা আসলে সৃষ্টিকর্তার কর্তৃত্বের একটি সাধারণ, সামান্য প্রদর্শনমাত্র। এই হল সৃষ্টিকর্তার কর্তৃত্ব এবং ঈশ্বরের ক্ষমতা। মানুষের মৃত্যু ঘটানো, তার দেহ থেকে আত্মার অভিগমন ঘটানো, এবং সে মৃতস্থানে না অন্য কোন স্থানে যাবে তা নির্ধারণের কর্তৃত্ব ঈশ্বরের রয়েছে। কোন সময় মানুষের মৃত্যু হবে, এবং মৃত্যুর পর তার কোথায় গতি হবে—তা ঈশ্বরের দ্বারা নির্ধারিত হয়। তিনি যেকোনো স্থানে এবং কালে এই ধরনের সিদ্ধান্তগুলি গ্রহণ করতে পারেন, কোনো মানুষ, ঘটনাবলী, বস্তুসমূহ, স্থান বা ভূগোল তাঁর পথরোধ করতে পারে না। তিনি যা চান, তা-ই করতে পারেন, কারণ সকল বস্তু এবং প্রাণী তাঁরই নিয়মের অধীন, তাঁরই বাক্যে এবং কর্তৃত্বেই সকল বস্তুর সৃষ্টি, স্থিতি, এবং লয় ঘটে। তিনি মৃতব্যক্তিকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারেন, এবং এই কর্মও তিনি যে কোনও স্থানে ও যেকোনো কালে সম্পাদন করতে পারেন। এই কর্তৃত্ব কেবলমাত্র সৃষ্টিকর্তারই রয়েছে।

প্রভু যীশু যখন লাসারকে মৃতাবস্থা থেকে পুনরুজ্জীবিত করার মতো কার্যাদি সম্পন্ন করেছিলেন, তখন তাঁর লক্ষ্য ছিল মানুষের ও শয়তানের দেখার জন্য প্রমাণ দান করা, এবং মানুষ ও শয়তানকে জানতে দেওয়া যে, মানবজাতি সংক্রান্ত সকলকিছু, মানবজাতির জন্ম ও মৃত্যু, ঈশ্বরেরই দ্বারা নির্ধারিত হয়, এবং তিনি অবতাররূপ ধারণ হয়েছিলেন বটে, কিন্তু দৃষ্টিগ্রাহ্য ভৌত জগত, এবং মানবদৃষ্টির অগোচর আধ্যাত্মিক জগতেরও, কর্তৃত্বভার ছিল তাঁরই হাতে। এমনটি করার উদ্দেশ্য ছিল মানবজাতি ও শয়তানকে জানান দেওয়া যে, মানবজাতি বিষয়ক সকলকিছুর নিয়ন্ত্রণ শয়তানের হাতে নেই। তা ছিল ঈশ্বরের কর্তৃত্বের এক উদ্ঘাটন ও প্রতিপাদন, এবং একই সঙ্গে, তা ছিল সকলকিছুর উদ্দেশ্যে ঈশ্বরের এই বার্তাটি প্রেরণ করার একটি পদ্ধতি, যে, মানবজাতির জন্ম ও মৃত্যু ঈশ্বরেরই হাতে ন্যস্ত। প্রভু যীশুর দ্বারা লাসারের পুনরুজ্জীবন ছিল সৃষ্টিকর্তার মানবজাতিকে শিক্ষা ও নির্দেশ দানের অন্যতম পদ্ধতি। তা ছিল এক সুনির্দিষ্ট কর্মোদ্যোগ, যেখানে মানবজাতিকে নির্দেশদান ও সংস্থান সরবরাহের জন্য তিনি তাঁর ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের প্রয়োগ করেছিলেন। তিনিই যে সমস্ত কিছুর কর্তা, কোনো বাক্যব্যয় না করে, মানবজাতিকে এই সত্য দর্শনের সুযোগ করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে তা ছিল সৃষ্টিকর্তার ব্যবহৃত এক পন্থা। তা ছিল ব্যবহারিক কর্মের মাধ্যমে মানবজাতিকে তাঁর এই সত্য জ্ঞাপন করার এক পদ্ধতি, যে, তাঁর মধ্য দিয়ে ভিন্ন আর অন্য কোনো পরিত্রাণ নেই। মানবজাতিকে শিক্ষাদানের নিমিত্ত তাঁর ব্যবহৃত এই যে নিরুচ্চার পন্থা, তা চিরস্থায়ী ও অনপনেয়, মানুষের হৃদয়ে তা এমন এক অভিঘাত ও আলোকপ্রাপ্তি নিয়ে আসে, যা কখনও বিবর্ণ হয় না। লাসারের পুনরুত্থান ঈশ্বরকে মহিমান্বিত করেছিল—ঘটনাটি ঈশ্বরের প্রতিটি অনুগামীর মনে এক গভীর অভিঘাত সৃষ্টি করেছে। এই ঘটনাটি গভীরভাবে উপলব্ধি করে, এমন প্রতিটি মানুষের মনে তা এই বোধ, এই দর্শনকে দৃঢ়মূল করে, যে, একমাত্র ঈশ্বরই মানবজাতির জন্ম-মৃত্যুকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। যদিও ঈশ্বরের এই ধরনের প্রাধিকার রয়েছে, এবং যদিও লাসারের পুনরুজ্জীবনের মাধ্যমে মানবজাতির জন্ম-মৃত্যুর উপর তাঁর সার্বভৌমত্বের এক বার্তা তিনি প্রেরণ করেছিলেন, কিন্তু তা তাঁর প্রাথমিক কার্য ছিল না। ঈশ্বর কখনো অর্থহীন কিছু করেন না। তাঁর প্রত্যেকটি কার্যই অতীব মূল্যবান, এবং সেগুলি হল এক রত্নভাণ্ডারের অপ্রতিম রত্নরাজি। “কোনো এক ব্যক্তিকে কবর থেকে উত্থিত করা”-র কাজটিকে কোনোক্রমেই তিনি তাঁর কার্যের প্রাথমিক বা একমাত্র লক্ষ্য অথবা প্রকরণ করে তুলবেন না। ঈশ্বর এমন কোনো কার্য সম্পাদন করেন না, যা অর্থহীন। একটি একক ঘটনা হিসাবে লাসারের পুনরুত্থান ঈশ্বরের কর্তৃত্ব প্রদর্শন এবং প্রভু যীশুর স্বরূপ প্রতিপন্ন করার জন্য যথেষ্ট ছিল। এই কারণেই, প্রভু যীশু এজাতীয় অলৌকিক কর্মের পুনরাবৃত্তি ঘটান নি। ঈশ্বর সকলকিছু তাঁর নিজস্ব নীতি অনুসারে সম্পন্ন করেন। মানবীয় ভাষায় বলা যেতে পারে, শুধুমাত্র গুরুতর বিষয়েই ঈশ্বর মনোনিয়োগ করেন। অর্থাৎ, কার্যাদি সম্পাদনকালে, তিনি তাঁর কার্যের উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হন না। তিনি জানেন যে, এই পর্যায়ে তিনি কী নিষ্পন্ন করতে চান, কোন লক্ষ্য তিনি অর্জন করতে চান, এবং তিনি কঠোর নিয়মানুবর্তিতা সহযোগে তাঁর পরিকল্পনামাফিক কার্য সম্পাদন করবেন। কোনো ভ্রষ্ট মানুষের যদি এধরনের ক্ষমতা থাকতো, তাহলে সে কেবল চিন্তা করতো যে, কোন উপায়ে তার এই ক্ষমতার প্রকাশ ঘটানো যায়, যাতে অন্যেরা জানতে পারে সে কত দুর্ধর্ষ, যাতে তারা তার সামনে মাথা নত করে, যাতে সে তাদের নিয়ন্ত্রণ ও গ্রাস করতে পারে। এই দুষ্টতা শয়তানের থেকে আসে—একে অনাচার বলে। ঈশ্বরের এমন স্বভাব নেই, এবং তাঁর সারসত্যও এমনতর নয়। তাঁর কার্যাদি সম্পাদনের উদ্দেশ্য নিজেকে জাহির করা নয়, তা হল মানবজাতিকে আরো বেশি উদ্ঘাটন ও পথনির্দেশনা প্রদান করা, আর এই কারণেই, মানুষ বাইবেলে এজাতীয় ঘটনার দৃষ্টান্ত খুবই কম দেখতে পায়। এমনটা বলা হচ্ছে না যে প্রভু যীশুর ক্ষমতা সীমিত, বা তিনি এই জাতীয় কার্য সম্পাদনে অপারক। বিষয়টি নিছকই এই, যে, ঈশ্বর তা করতে চান নি, এর কারণ হল যে, প্রভু যীশু কর্তৃক লাসারের পুনরুজ্জীবনের অত্যন্ত ব্যবহারিক তাৎপর্য ছিল, এবং, এর কারণ এ-ও যে, অলৌকিক কর্ম সম্পাদন, মানুষকে মৃতাবস্থা থেকে ফিরিয়ে আনা, ঈশ্বরের অবতাররূপের প্রাথমিক কার্য ছিল না, তাঁর প্রাথমিক কার্য ছিল মানবজাতির মুক্তির কার্য। তাই, প্রভু যীশুর দ্বারা নিষ্পন্ন কার্যের মুখ্য অংশ ছিল মানুষকে শিক্ষাদান, তাদের সংস্থান সরবরাহ করা, এবং তাদের সহায়তা করা, এবং লাসারের পুনরুজ্জীবন জাতীয় ঘটনাগুলি প্রভু যীশু সম্পাদিত সেবাব্রতের নিছকই এক ক্ষুদ্র অংশ ছিল। অধিকন্তু, বলা যায় যে, যেহেতু “জাহির করা”-টা ঈশ্বরের সারসত্যের কোনো অঙ্গ নয়, সেহেতু যে আরো বেশি করে অলৌকিকতার প্রদর্শন না করে প্রভু যীশু ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের উপর সংযম আরোপ করছিলেন, এমন নয়, এমনটাও নয় যে, পারিপার্শ্বিক সীমাবদ্ধতার কারণে তিনি তা করেন নি, এবং তাঁর ক্ষমতার অভাবের কারণে যে তিনি তা করেন নি, এমন তো অবশ্যই নয়।

লাসারকে মৃতাবস্থা থেকে ফিরিয়ে আনার সময় প্রভু যীশু কেবল এই সামান্য কয়টি শব্দ ব্যবহার করেছিলেন: “লাসার, বেরিয়ে এস।” এছাড়া তিনি আর কিছুই বলেন নি। তাহলে, এই শব্দগুলি কী প্রতিপন্ন করে? শব্দগুলি দেখায় যে, মৃত ব্যক্তিকে পুনর্জীবন দান সহ যেকোনো কাজ ঈশ্বর বাক্যোচ্চারণের মাধ্যমে সম্পন্ন করতে পারেন। ঈশ্বর যখন সকলকিছু সৃষ্টি করেছিলেন, যখন তিনি এই বিশ্বের সৃজন ঘটিয়েছিলেন, তিনি তা সম্পন্ন করেছিলেন বাক্যের মাধ্যমেই—ওষ্ঠোচ্চারিত নির্দেশের মাধ্যমে, কর্তৃত্বব্যঞ্জক বাক্যের দ্বারাই, এবং এইভাবে, সকলকিছুর সৃজন ঘটেছিল, এবং এভাবেই, তা সুসম্পন্ন হয়েছিল। প্রভু যীশু কথিত এই শব্দকটি হুবহু আকাশ ও পৃথিবী এবং সমস্ত কিছুর সৃষ্টিকালে ঈশ্বরের উচ্চারিত শব্দসমূহের অনুরূপ ছিল; একই ভাবে, শব্দগুলির মধ্যে ঈশ্বরের কর্তৃত্ব ও সৃষ্টিকর্তার ক্ষমতা নিহিত ছিল। ঈশ্বরের মুখনিঃসৃত বাক্যের কারণেই সকল বস্তু গঠিত হয়ে নিজ নিজ অবস্থান ধরে রেখেছিল, এবং একই ভাবে, প্রভু যীশুর মুখনিঃসৃত বাক্যের দরুনই লাসার তার কবর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়েছিল। এ ছিল ঈশ্বরের প্রাধিকার, যা তাঁর অবতাররূপ দেহের মাধ্যমে প্রদর্শিত ও বাস্তবায়িত হয়েছিল। এহেন কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার অধিকারী হলেন সৃষ্টিকর্তা, এবং মনুষ্যপুত্র, যাঁর মধ্যে সৃষ্টিকর্তা বাস্তবায়িত হয়েছিলেন। লাসারকে মৃতাবস্থা থেকে ফিরিয়ে এনে ঈশ্বর মানবজাতিকে এই উপলব্ধিটির বিষয়ে শিক্ষা প্রদান করেছিলেন। এবার এইখানেই আমরা এই প্রসঙ্গটির আলোচনা সমাপ্ত করবো। এর পর, আরো কিছু শাস্ত্রবাক্য পাঠ করা যাক।

১০. ফরিশীদের যীশুর বিষয়ে বিচার

মার্ক ৩:২১-২২ যীশুর আত্মীয়েরা একথা শুনে তাঁকে ধরে আনতে গেল সেখানে। তারা বলল, যীশু পাগল হয়ে গেছেন। জেরুশালেম থেকে এসেছিলেন কয়েকজন শাস্ত্রী, তাঁরা বললেন, যীশুর ওপর বেলসবুল ভর করেছে, ভূতের রাজার সাহায্যেই ও ভূত তাড়ায়।

১১. ফরিশীদের প্রতি যীশুর ভর্ৎসনা

মথি ১২:৩১-৩২ আর এজন্যই আমি তোমাদের বলছি, মানুষের সমস্ত পাপ ও ঈশ্বর নিন্দা ক্ষমা করা হবে, কিন্তু পবিত্র আত্মার বিরুদ্ধে নিন্দার ক্ষমা নেই। মানবপুত্রের বিরুদ্ধে কেউ কোনো কথা বললে সে ক্ষমা লাভ করবে, কিন্তু পবিত্র আত্মার বিরুদ্ধে যদি কেউ কোনো কথা বলে তার ক্ষমা সে কিছুতেই পাবে না—ইহকালেও নয়, পরকালেও নয়।

মথি ২৩:১৩-১৫ ভণ্ড শাস্ত্রী ও ফরিশীর দল, ধিক তোমাদের। তোমরা লোকের সামনে স্বর্গরাজ্যের দরজা বন্ধ করে দাও। নিজেরা তো প্রবেশ করই না, যারা চায় তাদেরও ঢুকতে দাও না। ভণ্ড শাস্ত্রী ও ফরিশীর দল, ধিক তোমাদের। তোমরা বিধবাদের বিষয়-সম্পত্তি গ্রাস কর, অথচ ধর্মের ভাণ করে লম্বাচওড়া প্রার্থনা আওড়াও, এজন্য বিচারে তোমাদের আরও গুরুতর শাস্তি হবে। ভণ্ড শাস্ত্রবিদ ও ফরিশীর দল। ধিক তোমাদের! একটি লোককে ধর্মান্তরিত করার চেষ্টায় তোমরা জলে স্থলে ঘুরে বেড়াও, আর কাউকে যদি তা করতে পার তাহলে তোমরা তাকে নিজেদের চেয়েও বড় পাষণ্ড করে তোল।

উপরের অনুচ্ছেদদুটির বিষয়বস্তু পৃথক। আগে প্রথম অনুচ্ছেদটির দিকে এক ঝলক নজর দেওয়া যাক: ফরিশীদের যীশুর বিষয়ে বিচার।

বাইবেলে, স্বয়ং যীশু ও তাঁর কার্যকলাপের বিষয়ে ফরিশীদের মূল্যায়ন হল: “… তারা বলল, যীশু পাগল হয়ে গেছেন। … যীশুর ওপর বেলসবুল ভর করেছে, ভূতের রাজার সাহায্যেই ও ভূত তাড়ায়” (মার্ক ৩:২১-২২)। প্রভু যীশুর সম্পর্কে শাস্ত্রবিদ ও ফরিশীদের এই রায়ে তারা যে নিছক অপরাপর মানুষের কথার অনুকরণ করছিল তা নয়, এমনও নয় যে তা ছিল কোনো ভিত্তিহীন অনুমান—প্রভু যীশুকে তারা যেমন দেখেছিল ও তাঁর কার্যাবলীর বিষয়ে যা শুনেছিল, তা থেকেই তাঁর সম্বন্ধে তারা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিল। আপাতদৃষ্টিতে তাদের এই সিদ্ধান্ত যদিও বিচারের নামেই গৃহিত হয়েছিল, এবং মানুষের নজরে তা সুপ্রতিষ্ঠিত বলে মনে হয়েছিল, কিন্তু যে ঔদ্ধত্যের সঙ্গে তারা প্রভু যীশুর বিচার করেছিল, তা সংযত রাখা এমনকি তাদের পক্ষেও কঠিন ছিল। প্রভু যীশুর প্রতি তাদের ঘৃণাসঞ্জাত প্রমত্ত কর্মোদ্যম অনাবৃত করেছিল তাদের নিজস্ব উদ্দাম উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে, তাদের দুষ্ট শয়তানোচিত মুখাবয়বকে, এবং সেইসাথে, তাদের যে পরশ্রীকাতর প্রকৃতির কারণে তারা ঈশ্বরের প্রতিরোধ করেছিল, তা। প্রভু যীশুর সম্পর্কে তাদের ফয়সালায় তাদের এই উক্তিগুলি তাদের উন্মত্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষা, ঈর্ষা, এবং ঈশ্বর ও সত্যের প্রতি তাদের বৈরিতার কুৎসিত ও পরশ্রীকাতর প্রকৃতির দ্বারা চালিত হয়েছিল। প্রভু যীশুর কার্যকলাপগুলির উৎসের বিষয়ে তারা খোঁজখবর নেয় নি, এবং তাঁর বাক্যনিচয় ও কার্যাবলীর সারসত্যের বিষয়েও তারা অনুসন্ধান করেনি। বরং, অন্ধের মতো, প্রমত্ত উত্তেজনার বশে, এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিদ্বেষ নিয়ে, তারা তাঁর কীর্তিগুলিকে আক্রমণ ও অমর্যাদা করেছিল। এমনকি তারা জেনেশুনে তাঁর আত্মার, অর্থাৎ পবিত্র আত্মার, যিনি হলেন ঈশ্বরের আত্মা, তাঁর মর্যাদাহানি ঘটিয়েছিল। তাদের “যীশু পাগল হয়ে গেছেন”, “বেলসবুল”, এবং “ভূতের রাজা” কথাগুলির মাধ্যমে তারা এই অর্থই নির্দেশ করেছিল। অর্থাৎ, ঈশ্বরের আত্মাকে তারা বেলসবুল ও শয়তানদের রাজপুত্র বলে অভিহিত করেছিল। দেহের আচ্ছাদনে ভূষিত ঈশ্বরের আত্মার অবতাররূপের কার্যকে তারা পাগলামি বলে চিহ্নিত করেছিল। তারা শুধু যে ঈশ্বরের আত্মাকে বেলসবুল ও শয়তানদের রাজপুত্র বলে অশ্রদ্ধা প্রকাশ করেছিল তা-ই নয়, উপরন্তু ঈশ্বরের কার্যের নিন্দা করেছিল এবং প্রভু যীশু খ্রীষ্টেরও নিন্দা ও অবমাননা করেছিল। তাদের প্রতিরোধ ও ঈশ্বর-নিন্দার সারসত্য শয়তান ও দানবদের প্রদত্ত প্রতিরোধ ও ঈশ্বর-নিন্দার হুবহু অনুরূপ ছিল। তারা শুধু যে ভ্রষ্ট মানবদের প্রতিনিধিত্ব করেছিল তা-ই নয়, বরং, আরো বেশি করে, তারা ছিল শয়তানের মূর্ত রূপ। মানবজাতির মাঝে তারা ছিল শয়তানের কর্মকাণ্ডের এক মাধ্যম, এবং তারা ছিল শয়তানের দুষ্কর্মের সহযোগী ও হীন অনুচর। তাদের ঈশ্বর-নিন্দা ও প্রভু যীশু খ্রীষ্টকে হেয় করার সারমর্ম ছিল মর্যাদার জন্য ঈশ্বরের বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রাম, ঈশ্বরের সঙ্গে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা, এবং ঈশ্বরকে তাদের অন্তহীন যাচাইকরণ। ঈশ্বরের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিরোধ ও তাঁর প্রতি তাদের বৈরীমনোভাব, এবং সেই সাথে, তাদের কথাবার্তা ও চিন্তাভাবনার সারমর্ম সরাসরি ঈশ্বরের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশ করেছিল এবং ঈশ্বরের আত্মাকে তা করেছিল রাগান্বিত। সেই কারণেই, তাদের বক্তব্য ও কর্মের ভিত্তিতে ঈশ্বর এক যুক্তিযুক্ত বিচার নিরূপণ করেছিলেন, এবং ঈশ্বর এবং তাদের ক্রিয়াকলাপকে ঈশ্বর পবিত্র আত্মার বিরুদ্ধে অশ্রদ্ধা প্রকাশের পাপ বলে সিদ্ধান্তে এসেছিলেন। এই বিশ্বে এবং আগামী বিশ্বেও বটে, এই পাপ অমার্জনীয়, যা শাস্ত্রের পরবর্তী অনুচ্ছেদে সমর্থিত হয়েছে: “পবিত্র আত্মার বিরুদ্ধে নিন্দার ক্ষমা নেই”, এবং “পবিত্র আত্মার বিরুদ্ধে যদি কেউ কোনো কথা বলে তার ক্ষমা সে কিছুতেই পাবে না—ইহকালেও নয়, পরকালেও নয়।” আজ, ঈশ্বরের এই বাক্যগুলির প্রকৃত অর্থের বিষয়ে আলোচনা করা যাক: “তার ক্ষমা সে কিছুতেই পাবে না–ইহকালেও নয়, পরকালেও নয়।” অর্থাৎ, রহস্য উন্মোচন করে দেখা যাক যে, কীভাবে ঈশ্বর এই বাক্যগুলি কার্যায়িত করেন: “তার ক্ষমা সে কিছুতেই পাবে না–ইহকালেও নয়, পরকালেও নয়।”

আমরা যা যা বিষয়ে আলোচনা করেছি তার সবই ঈশ্বরের স্বভাব এবং মানুষ, ঘটনাবলী, ও বস্তুসমূহের প্রতি তাঁর মনোভাবের সঙ্গে সম্পর্কিত। স্বভাবতই, উপরের দুটি অনুচ্ছেদও এর কোনো ব্যতিক্রম নয়। শাস্ত্রবাক্যের এই দুটি অনুচ্ছেদের মধ্যে তোমরা কি কিছু লক্ষ্য করেছো? কেউ কেউ বলে এগুলির মধ্যে তারা ঈশ্বরের ক্রোধ দেখতে পায়। কিছু মানুষ বলে যে, তারা ঈশ্বরের স্বভাবের সেই দিকটি দেখতে পায়, যা মানবজাতির অপরাধকে মার্জনা করে না, বলে যে, মানুষ যদি ঈশ্বরের সম্মানহানিকর কোনো কাজ করে, তাহলে তারা তাঁর মার্জনা লাভ করবে না। এই দুটি অনুচ্ছেদে মানুষ যে ঈশ্বরের ক্রোধ ও মানবজাতির অপরাধের প্রতি তাঁর অসহিষ্ণুতা দর্শন ও অনুভব করে, একথা সত্য হলেও, তবু তাঁর মনোভাবকে তারা যথার্থভাবে উপলব্ধি করে না। যে মানুষগুলি তাঁর নিন্দা করে ও তাঁকে রাগান্বিত করে, তাদের প্রতি ঈশ্বরের প্রকৃত মনোভাব ও তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির প্রচ্ছন্ন উল্লেখ এই দুটি অনুচ্ছেদে অন্তর্নিহিত রয়েছে। তাঁর মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গিই নিম্নলিখিত অনুচ্ছেদটির প্রকৃত অর্থকে প্রতিপন্ন করে: “পবিত্র আত্মার বিরুদ্ধে যদি কেউ কোনো কথা বলে তার ক্ষমা সে কিছুতেই পাবে না—ইহকালেও নয়, পরকালেও নয়।” মানুষ যখন ঈশ্বরনিন্দা করে, এবং যখন তাঁকে রাগান্বিত করে, তখন তিনি একটি রায় দান করেন, এবং এই রায়টিই হল তাঁর দ্বারা উচ্চারিত পরিণতি। বাইবেলে এটি এই ভাবে বর্ণিত হয়েছে: “আর এজন্যই আমি তোমাদের বলছি, মানুষের সমস্ত পাপ ও ঈশ্বর নিন্দা ক্ষমা করা হবে, কিন্তু পবিত্র আত্মার বিরুদ্ধে নিন্দার ক্ষমা নেই” (মথি ১২:৩১), এবং “ভণ্ড শাস্ত্রী ও ফরিশীর দল, ধিক তোমাদের!” (মথি ২৩:১৩)। কিন্তু, সেই শাস্ত্রবিদ ও ফরিশীদের, এবং এই বাক্যগুলি উচ্চারণ করার পর যারা প্রভু যীশুকে উন্মাদ বলে অভিহিত করেছিল তাদের পরিণাম কী ছিল, বাইবেলে কি তার উল্লেখ আছে? এমন কি নথিভুক্ত আছে যে তারা কোনো শাস্তি ভোগ করেছিল? না, নেই—তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। এখানে “না” বলার অর্থ এটা নয়, যে, এমন কোনো তথ্যসূত্র ছিল না, বস্তুত বরং কেবল এটুকুই বলা হচ্ছে যে মানুষের চর্মচক্ষে দৃষ্টিগ্রাহ্য কোনো পরিণামের উল্লেখ ছিল না। “এটি নথিভুক্ত ছিল না” বললে ঈশ্বরের মনোভাব এবং কিছু নির্দিষ্ট ব্যাপারের পরিচালনায় তাঁর অনুসৃত নীতির বিষয়টি পরিস্ফুট হয়। যে মানুষ তাঁর নিন্দা করে বা তাঁকে প্রতিরোধ করে, বা যারা তাঁর বিরুদ্ধে কুৎসা রটায়—যে মানুষগুলি ইচ্ছাকৃতভাবে তাঁকে আক্রমণ করে, কলঙ্কিত করে, ও গালাগাল করে—তাদের প্রতি ঈশ্বর অন্ধ বা বধির হয়ে থাকেন না, বরং তাদের প্রতি তিনি এক স্পষ্ট মনোভাব পোষণ করেন। এই মানুষগুলিকে তিনি ঘৃণা করেন, এবং তাঁর অন্তরে তিনি তাদের দোষী সাব্যস্ত করেন। এমনকি তাদের পরিণতি কী হবে, তা-ও তিনি প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন, যাতে মানুষ জানতে পারে যে, ঈশ্বর-নিন্দুকদের প্রতি তাঁর একটি স্পষ্ট মনোভাব রয়েছে, এবং কীভাবে তিনি তাদের পরিণতি নির্ধারণ করবেন সে বিষয়ে যাতে তারা অবহিত হয়। কিন্তু, এই বাক্যগুলি ঈশ্বর বলার পরেও, এই লোকগুলিকে ঈশ্বর যে ভাবে মোকাবিলা করবেন, সেই বিষয়ে সত্যটি মানুষ কদাচিৎ হৃদয়ঙ্গম করতে পারে, এবং সেই ব্যক্তিগণের প্রতি ঈশ্বরের দ্বারা ঘোষিত পরিণাম ও রায়দানের অন্তর্নিহিত নীতিটি তারা বুঝে উঠতে পারে না। অর্থাৎ, তাদের মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে ঈশ্বরের যে নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি ও পদ্ধতি রয়েছে, মানুষ তা উপলব্ধি করতে পারে না। বিষয়টি ঈশ্বরের কার্য সম্পাদনের নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। কিছু মানুষের মন্দ আচরণের মোকাবিলা করতে ঈশ্বর ঘটনার সংঘটনকে ব্যবহার করেন। অর্থাৎ, তিনি তাদের পাপের ঘোষণা করেন না এবং তাদের পরিণাম নিরূপণ করেন না, বরং, তাদের শাস্তি ও উপযুক্ত প্রতিফল বিতরণ করতে, তিনি সরাসরি ঘটনার সংঘটনকে ব্যবহার করেন। এই ঘটনাসমূহ সংঘটনকালে, মানুষের ঐহিক দেহ শাস্তি ভোগ করে, অর্থাৎ এই শাস্তি এমন, যে তা মানবদৃষ্টির অগোচর। কিছু মানুষের দুষ্ট আচরণের মোকাবিলা করার সময়, ঈশ্বর কেবল তাঁর বাক্যের সাহায্যে তাদের কঠোর ভাষায় অভিসম্পাত করেন এবং তাঁর ক্রোধও তাদের উপর বর্ষিত হয়, কিন্তু যে শাস্তি তারা ভোগ করে, তা মানুষের দৃষ্টিগোচর না-ও হতে পারে। তবু, মানুষের দৃষ্টিগ্রাহ্য পরিণাম, যেমন শাস্তিপ্রাপ্ত বা নিহত হওয়া অপেক্ষা এহেন পরিণাম আরো বেশি গুরুতর হতে পারে। এর কারণ হল যে, কোনো পরিস্থিতিতে ঈশ্বর যখন এই প্রকারের মানুষদের উদ্ধার না করার, তাদের প্রতি আর কোনো করুণা প্রদর্শন না করার বা সহিষ্ণুতা না দেখানোর, এবং তাদের আর কোনো সুযোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন, তখন তাদের প্রতি তিনি একটা উপেক্ষা করার মনোভাব গ্রহণ করেন। এখানে “উপেক্ষা করা” বলতে কী বোঝানো হচ্ছে? এই শব্দবন্ধটির প্রাথমিক অর্থ হল কোনোকিছুকে একপাশে সরিয়ে রাখা, সেটিকে উপেক্ষা করা এবং সেটির প্রতি আর কোনো মনোযোগ না দেওয়া। কিন্তু এখানে, ঈশ্বর যখন কাউকে উপেক্ষা করেন, তখন এর অর্থের দুটি ভিন্ন ব্যাখ্যা থাকে: প্রথম ব্যাখ্যাটি হল যে, তিনি সেই ব্যক্তিটির জীবন ও তার সংক্রান্ত সকলকিছুর দেখভালের দায়ভার শয়তানের হাতে তুলে দিয়েছেন, এবং ঈশ্বর আর ব্যক্তিটির ব্যাপারে দায়বদ্ধ থাকবেন না এবং আর তিনি আর তাকে পরিচালিত করবেন না। ব্যক্তিটি উন্মাদ হোক কি নির্বোধ, বা সে জীবিত হোক কি মৃত, কিংবা তার শাস্তির হেতু সে যদি নরকেও অবতরণ করে থাকে, তবু এসব কিছুর সাথেই ঈশ্বরের কোনো লেনদেন থাকবে না। এর অর্থ হল যে, এহেন এক জীবের সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক থাকবে না। দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটি হল এই, যে, ঈশ্বর সংকল্প করেছেন যে তিনি স্বয়ং, তাঁর স্বহস্তে, সেই ব্যক্তিটির ব্যাপারে কিছু একটা ব্যবস্থা নিতে চান। হতে পারে যে, সেই ব্যক্তিটির পরিষেবাকে তিনি কাজে লাগাবেন, কিম্বা তাকে তিনি তাঁর প্রতিতুলনার আধার হিসাবে ব্যবহার করবেন। হতে পারে যে, এমনতর মানুষদের মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে তাঁর কোনো বিশেষ পদ্ধতি থাকবে, তাদের প্রতি আচরণে থাকবে কোনো বিশেষ প্রণালী, দৃষ্টান্তস্বরূপ, ঠিক যেমন ছিল পৌলের ক্ষেত্রে। ঈশ্বরের হৃদয়ের নীতি ও মনোভাব অনুসারে তিনি এই প্রকারের মানুষদের মোকাবিলা করার সংকল্প করেছেন। তাই মানুষ যখন ঈশ্বরকে প্রতিরোধ ও কালিমালিপ্ত করে এবং তাঁর নিন্দা করে, তারা যদি তাঁর স্বভাবকে উত্তক্ত করে তোলে, কিম্বা তারা যদি তাঁর সহিষ্ণুতার সীমাকে অতিক্রম করে যায়, তখন এসবের পরিণতি চিন্তা করতেও ভয় হয়। সবথেকে ভয়ঙ্কর পরিণতি ঘটে তখন যখন ঈশ্বর তাদের জীবন ও তাদের সংক্রান্ত সবকিছু চিরকালের জন্য শয়তানের হাতে হস্তান্তরিত করে দেন। অনন্তকালব্যাপী তাদের মার্জনা করা হবে না। এর অর্থ হল যে, সেই ব্যক্তিটি শয়তানের মুখের গ্রাসে, তার হাতের ক্রীড়নকে পরিণত হয়েছে, এবং সেই ক্ষণ থেকে তাদের বিষয়ে ঈশ্বরের আর কিছুই করণীয় নেই। তোমরা কল্পনা করতে পারো, যে, শয়তান কর্তৃক ইয়োবের প্রলোভন কি বিরাট মর্মবিদারক ঘটনা ছিল? যদিও শর্ত অনুযায়ী শয়তানের ইয়োবের জীবনের ক্ষতি করার অনুমোদন ছিল না, তবু ইয়োবে অসহ যাতনা ভোগ করেছিল। আর যাকে পুরোপুরি শয়তানের হাতে সঁপে দেওয়া হয়েছে, যে সম্পূর্ণরূপে শয়তানের করায়ত্ত, যে ঈশ্বরের প্রযত্ন ও করুণা একেবারেই হারিয়েছে, যে আর সৃষ্টিকর্তার নিয়মের অধীন নয়, যাকে ঈশ্বর-বন্দনার অধিকার ও ঈশ্বরের নিয়মাধীন এক সত্তা হওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে, এবং যার সঙ্গে সৃষ্টির প্রভুর সম্পর্ক সম্পূর্ণরূপে ছিন্ন হয়েছে, তার উপর শয়তান যে ধ্বংসলীলা চালাবে, তা কল্পনা করা কি আরো বেশি কঠিন নয়? শয়তানের দ্বারা ইয়োবের নিপীড়ন মানুষের দৃষ্টিগোচর ছিল, কিন্তু ঈশ্বর যদি কোনো মানুষের জীবন শয়তানের কাছে হস্তান্তরিত করেন, তখন তার পরিণতি মানুষের কল্পনাতীত হয়ে দাঁড়ায়। উদাহরণস্বরূপ, কিছু মানুষ হয়তো একটা গরু, বা গাধা হয়ে পুনর্জন্ম লাভ করতে পারে, সেখানে আরো কিছু মানুষ কলুষিত, দুষ্ট আত্মাদের দ্বারা কবলিত ও আবিষ্ট হয়ে পড়তে পারে, এবং এই ধরনের আরো অনেক কিছু। ঈশ্বরের দ্বারা শয়তানের নিকট হস্তান্তরিত কিছু মানুষের পরিণতি এমনই হয়। বাইরে থেকে দেখে মনে হয়, এই যে মানুষগুলি, যারা প্রভু যীশুকে বিদ্রূপ, কালিমালিপ্ত, অভিযুক্ত, ও নিন্দিত করেছিল, তারা কোনো ফলশ্রুতি ভোগ করেনি। কিন্তু বাস্তব সত্যটা হল যে, সকলকিছুর মোকাবিলা করার জন্যই ঈশ্বরের একটা কর্মপদ্ধতি আছে। প্রত্যেক প্রকারের মানুষের সাথে যে-যে ভাবে তিনি মোকাবিলা করেন, তাতে তাদের পরিণতির বিষয়ে মানুষকে অবহিত করার জন্য কোনো সুস্পষ্ট ভাষা তিনি না-ও ব্যবহার করতে পারেন। কখনো কখনো সরাসরি কথা না বলে তিনি বরং প্রত্যক্ষভাবে ক্রিয়াশীল হন। তিনি যে কোনো ফলাফলের ব্যাপারে কিছু বলেন না, তার মানে এই নয় যে, তা নেই—বস্তুত, সেক্ষেত্রে এমনটাও হতে পারে যে, পরিণতিটি আরো বেশি নিদারুণ। বাহ্যিকভাবে, এমন মনে হতে পারে যেন, কিছু মানুষ আছে যাদের কাছে ঈশ্বর তাঁর মনোভাবের বিষয়ে পরিস্ফুট করে কিছু বলেন না, কিন্তু বাস্তবে, বহু দিন হল ঈশ্বর সেই ব্যক্তিগণের প্রতি কোনোপ্রকার মনোযোগ দিতে ইচ্ছুক নন। তিনি আর তাদের মুখদর্শন করতে চান না। তাদের সম্পাদিত ক্রিয়াকর্ম ও তাদের আচরণের কারণে, তাদের প্রকৃতি ও সারমর্মের কারণে, ঈশ্বর কেবল চান যেন তারা তাঁর চোখের সামনে থেকে অন্তর্হিত হোক, তিনি সরাসরি তাদের শয়তানের হাতে অর্পণ করতে চান, তাদের আত্মা, অন্তঃকরণ, ও শরীর শয়তানকে প্রদান করতে চান, এবং শয়তানকে তাদের নিয়ে তার ইচ্ছে মতো যা খুশি করার অনুমতি দিতে চান। ঈশ্বর যে কী পরিমাণ তাদের ঘৃণা করেন, কী মাত্রায় তাদের প্রতি তিনি বিতৃষ্ণ তা স্পষ্ট। কোনো মানুষ যদি ঈশ্বরকে এতটাই রাগান্বিত করে যে ঈশ্বর এমনকি তাদের আর দেখতে পর্যন্ত চান না, এবং তাদের বিষয়ে সম্পূর্ণ হাল ছেড়ে দিতেও তিনি প্রস্তুত, এতটাই যে এমনকি তিনি নিজে তাদের সাথে মোকাবিলাও করতে চান না—যদি তাঁর ক্রোধ এই পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছায় যে, তিনি তাদের শয়তানের হাতে তুলে দিয়ে তার যা ইচ্ছে তা-ই করতে দেবেন, তার যে রকম খুশি শয়তানকে তিনি সেভাবেই তাদের নিয়ন্ত্রণ, ভোগ, ও ব্যবহার করার অনুমতি দেবেন—তাহলে বুঝতে হবে যে, সেই মানুষটির আর কোনো আশা নেই। তার মানব হওয়ার যে অধিকার, তা চিরতরে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে, এবং ঈশ্বরের সৃষ্টির এক সত্তা হওয়ার যে অধিকার, তা-ও সমাপ্তিলগ্নে এসে উপনীত হয়েছে। এ-ই কি নিদারুণতম শাস্তি নয়?

উপরে বর্ণিত সবকিছুই হল এই বাক্যটির এক সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা: “তার ক্ষমা সে কিছুতেই পাবে না–ইহকালেও নয়, পরকালেও নয়”, এবং তা শাস্ত্র থেকে গৃহিত এই অনুচ্ছেদগুলির এক সরল টীকাভাষ্যের ভূমিকাও পালন করে। আমার বিশ্বাস, তোমরা সকলে এখন এই বিষয়টায় একটা উপলব্ধি লাভ করেছো।

এবার শাস্ত্র থেকে নিম্নলিখিত অনুচ্ছেদটি পাঠ করা যাক।

১২. পুনরুত্থানের পর তাঁর শিষ্যদের প্রতি যীশুর উক্তি

যোহন ২০:২৬-২৯ এক সপ্তাহ পর আবার শিষ্যরা একটি ঘরে একত্র হয়ে ছিলেন। থোমাও ছিলেন তাঁদের সঙ্গে। ঘরের সব দরজা বন্ধ থাকা সত্ত্বেও যীশু আবির্ভূত হলেন সেখানে। তাঁদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বললেন, তোমাদের শান্তি হোক! তারপর থোমাকে বললেন, এখানে তোমার আঙ্গুল দাও, দেখ আমার হাত দুখানি। হাত বাড়িয়ে আমার কুক্ষিদেশ স্পর্শ কর। সংশয় রেখো না মনে, বিশ্বাস কর। থোমার কন্ঠ থেকে উৎসারিত হল, প্রভু আমার, ঈশ্বর আমার! যীশু তাঁকে বললেন, তুমি আমায় দেখেছ বলেই বিশ্বাস করলে। ধন্য তারা, যারা আমায় না দেখে বিশ্বাস করে।

যোহন ২১:১৬-১৭ যীশু দ্বিতীয়বার তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, যোহনের পুত্র শিমোন, তুমি কি আমায় ভালবাস? তিনি তাঁকে বললেন, হ্যাঁ প্রভু, আপনি জানেন, আপনাকে আমি ভালবাসি। যীশু তাঁকে বললেন, তাহলে আমার মেষপালের তত্ত্বাবধান কর। তিনি তৃতীয়বার বললেন, যোহনের পুত্র শিমোন, তুমি কি আমায় ভালবাস? তৃতীয়বার যীশু ‘তুমি কি আমায় ভালবাস’-এ কথা জিজ্ঞাসা করায় পিতর খুব ক্ষুণ্ণ হলেন। বললেন, প্রভু, আপনি তো সবই জানেন। আপনি জানেন যে আপনাকে আমি ভালবাসি। যীশু তাঁকে বললেন, আমার মেষগুলিকে চরাও।

তাঁর পুনরুত্থানের পর প্রভু যীশু তাঁর শিষ্যদের নিকট যে বিশেষ কিছু কার্য সম্পাদন ও বাক্য উচ্চারণ করেছিলেন, এই অনুচ্ছেদগুলি তা-র বিবরণ দেয়। প্রথমে, পুনরুত্থানের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী প্রভু যীশুর মধ্যে যদি কোনো পার্থক্য থেকে থাকে, তবে সেদিকে একবার তাকিয়ে দেখা যাক। তিনি কি তখনো বিগত দিনের সেই একই প্রভু যীশু ছিলেন? শাস্ত্রে পুনরুত্থান পরবর্তী প্রভু যীশুর বর্ণনাসূচক নিম্নলিখিত পঙক্তিটি রয়েছে: “ঘরের সব দরজা বন্ধ থাকা সত্ত্বেও যীশু আবির্ভূত হলেন সেখানে। তাঁদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বললেন, তোমাদের শান্তি হোক।” এটা খুব পরিষ্কার যে, সেই সময়ে প্রভু যীশু আর কোনো পার্থিব দেহে বাস করছিলেন না, বরং তখন তিনি এক আধ্যাত্মিক দেহে অবস্থান করছিলেন। এর কারণ তিনি দেহের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে গিয়েছিলেন; যদিও দরজা বন্ধ ছিল, তবু তিনি মানুষের মাঝে আবির্ভূত হয়ে তাদের দেখা দিতে পেরেছিলেন। এ হল পুনরুত্থানের পরবর্তীকালীন প্রভু যীশু ও পুনরুত্থানের পূর্বে দেহরূপে জীবনধারণরত প্রভু যীশুর মধ্যে সবচেয়ে বড়ো তফাৎ। যদিও সেই মুহূর্তের আধ্যাত্মিক শরীরের রূপ ও পূর্বের প্রভু যীশুর চেহারার মধ্যে কোনো পার্থক্য ছিল না, কিন্তু সেই মুহূর্তের প্রভু যীশুকে দেখে মানুষের মনে হয়েছিল তিনি যেন কোনো অপরিচিত ব্যক্তি, এর কারণ মৃতাবস্থা থেকে পুনরুত্থিত হওয়ার পর তিনি এক আধ্যাত্মিক দেহে পরিণত হয়েছিলেন বলে, এবং তাঁর পূর্ববর্তী দেহরূপের তুলনায়, এই আধ্যাত্মিক শরীর মানুষের কাছে বেশি বিহ্বলকর ও বিভ্রান্তকর ছিল। এর ফলে প্রভু যীশু ও মানুষের মধ্যে আরো দূরত্বও সৃষ্টি হয়েছিল, এবং মানুষ তাদের অন্তরে অনুভব করেছিল যে, সেই মুহূর্তের প্রভু যীশু আরো বেশি রহস্যময় হয়ে গিয়েছেন। মানুষের দিক থেকে এই অবগতি ও অনুভূতি সহসা তাদের ধরা-ছোঁয়ার অতীত কোনো এক ঈশ্বরে বিশ্বাসের একটি যুগে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। সুতরাং, তাঁর পুনরুত্থানের পর প্রথম যে কার্যটি প্রভু যীশু করেছিলেন, তা ছিল সকল মানুষকে তাঁকে দেখার সুযোগ করে দেওয়া, তিনি যে অস্তিমান, সে বিষয়ে নিশ্চিত করা, এবং তাঁর পুনরুত্থানের সত্যটি প্রতিপন্ন করা। তদুপরি, এই কাজটির মাধ্যমে তিনি দেহরূপে কর্মরত থাকাকালীন, তাঁর তাদের কাছে তিনি দৃষ্টিগোচর ও স্পর্শগ্রাহ্য খ্রীষ্ট থাকাকালীন, মানুষের সাথে তাঁর সম্পর্ক যেমন ছিল, সেই অবস্থায় ফিরিয়ে এনেছিলেন। এর একটি ফলাফল হল যে, মানুষের মনে এ বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ রইলো না, যে, ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার পর প্রভু যীশু মৃতাবস্থা থেকে পুনরুত্থিত হয়েছেন, এবং প্রভু যীশুর দ্বারা মানবজাতির পুনরুদ্ধারের কার্য সম্পর্কেও তাদের মনে কোনো সন্দেহ থাকলো না। এর আরেকটি ফলশ্রুতি হল যে, তাঁর পুনরুত্থানের পর মানুষের কাছে প্রভু যীশুর আবির্ভাব এবং মানুষকে তাঁকে দেখতে ও স্পর্শ করতে দেওয়ার এই ঘটনাটি মানবজাতিকে সুদৃঢ়ভাবে অনুগ্রহের যুগের সঙ্গে সংযুক্ত করলো, এতে নিশ্চিত হল যে, সেই দিন থেকে, মানুষ আর এই অনুমানের ভিত্তিতে পূর্ববর্তী বিধানের যুগে প্রত্যাবর্তন করবে না, যে, প্রভু যীশু “অন্তর্হিত হয়েছেন” বা তিনি “কিছুই না বলে চলে গিয়েছেন”। এইভাবে, তিনি সুনিশ্চিত করলেন যে, প্রভু যীশুর শিক্ষা ও তাঁর সম্পাদিত কার্যকে অনুসরণ করে তারা তাদের অগ্রগমন অব্যাহত রাখবে। এইভাবে, অনুগ্রহের যুগে কার্যের এক নতুন পর্যায়ের আনুষ্ঠানিক সূচনা ঘটলো, এবং সেই মুহূর্ত থেকে, যে মানুষগুলি বিধানের অধীনে জীবনধারণ করছিলেন, আনুষ্ঠানিকভাবে তারা বিধান ভেঙে বেরিয়ে এসে এক নতুন যুগে, এক নতুন শুভারম্ভে প্রবেশ করলো। এগুলিই হল পুনরুত্থানের পর প্রভু যীশুর মানবজাতির সামনে আবির্ভূত হওয়ার বহুমুখী অর্থ।

প্রভু যীশু এখন যখন এক আধ্যাত্মিক দেহে বাস করছিলেন, তাহলে মানুষ কীভাবে তাঁকে দর্শন ও স্পর্শ করতে পারলো? এই প্রশ্নটি প্রভু যীশুর মানবজাতির কাছে আবির্ভাবের তাৎপর্যকে ছুঁয়ে যায়। শাস্ত্রের যে অনুচ্ছেদটি আমরা সদ্য পাঠ করলাম, সেখানে কিছু কি তোমরা লক্ষ্য করেছো? সাধারণত, আধ্যাত্মিক শরীরকে দেখা বা ছোঁয়া যায় না, এবং পুনরুত্থানের পর প্রভু যীশু যে কার্য গ্রহণ করেছিলেন, তা ইতিপূর্বেই সম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। তাই তত্ত্বগতভাবে, মানুষের মাঝে তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য তাঁর আদি প্রতিমূর্তিতে ফিরে আসার আদৌ কোনো প্রয়োজন ছিল না, কিন্তু থোমার মতো মানুষের কাছে প্রভু যীশুর আধ্যাত্মিক শরীরের আগমন তাঁর এই আবির্ভাবের তাৎপর্যকে আরো বেশি সুনির্দিষ্ট করে তুলেছিল, যার ফলে আরো গভীরভাবে তা মানুষের হৃদয়ের মধ্যে প্রবেশ করেছিল। তিনি যখন থোমার কাছে এসেছিলেন, সন্দিগ্ধ থোমাকে তিনি তাঁর হাত স্পর্শ করতে দিয়েছিলেন, এবং তাকে বলেছিলেন: “এখানে তোমার আঙ্গুল দাও, দেখ আমার হাত দুখানি। হাত বাড়িয়ে আমার কুক্ষিদেশ স্পর্শ কর। সংশয় রেখো না মনে, বিশ্বাস কর।” এই বাক্য ও কর্মগুলি এমন বিষয় ছিল না যা প্রভু যীশু কেবলমাত্র তাঁর পুনরুত্থানের পরেই বলতে ও করতে চেয়েছিলেন; বস্তুত, এই কাজগুলি তিনি ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার পুর্বেই বলতে ও করতে চেয়েছিলেন, কারণ থোমার সন্দেহপ্রবণতা যে তখনই শুরু হয়েছিল এমন নয়, বরং যখন থেকে সে প্রভু যীশুর অনুগমন করছিল তখন থেকে পুরোটা সময়কাল জুড়েই তা তার মধ্যে ছিল। এটা স্পষ্টতই প্রতীয়মান যে, ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার আগেই প্রভু যীশুর থোমার মতো মানুষের সম্বন্ধে ইতিপূর্বেই একটা উপলব্ধি ছিল। তাহলে এর থেকে আমরা কী বুঝি? তাঁর পুনরুত্থানের পরেও তিনি তখনো সেই একই প্রভু যীশু ছিলেন। তাঁর সারসত্যের কোনো পরিবর্তন ঘটে নি। কিন্তু, তিনি ছিলেন মৃতাবস্থা থেকে পুনরুত্থিত প্রভু যীশু যিনি আধ্যাত্মিক জগৎ তাঁর দি প্রতিমূর্তি, মূল স্বভাব, এবং দেহরূপে থাকাকালীন সময় থেকে মানবজাতি সম্বন্ধে তাঁর অর্জিত উপলব্ধি সহযোগেই প্রত্যাবর্তন করেছিলেন, তাই প্রথমেই তিনি থোমার কাছে গিয়েছিলেন ও থোমাকে তাঁর পাঁজর স্পর্শ করতে দিয়েছিলেন, থোমাকে শুধু পুনরুত্থানের পর তাঁর আধ্যাত্মিক দেহ দেখতে দিতেই নয়, বরং যাতে থোমা তাঁর আধ্যাত্মিক শরীরের অস্তিত্ব স্পর্শ ও পরখ করে দেখতে পারে, এবং তার সন্দেহের সম্পূর্ণ বিদূরণ ঘটে। প্রভু যীশু ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার পূর্বে, তিনি খ্রীষ্ট কিনা সে বিষয়ে থোমা সর্বদাই সন্দিগ্ধ ছিল, এবং সে বিশ্বাস করতে অসমর্থ ছিল। স্বচক্ষে সে যা দেখতে পেতো, নিজের হাতে সে যা স্পর্শ করতে পারতো, শুধু সেসবের উপরেই তার ঈশ্বর-বিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত ছিল। এই প্রকারের মানুষের বিশ্বাস সম্বন্ধে প্রভু যীশুর একটা উত্তম উপলব্ধি ছিল। এরা শুধু স্বর্গস্থ ঈশ্বরেই বিশ্বাস করতো, এবং এদের আদৌ কোনো বিশ্বাস ছিল না ঈশ্বর-প্রেরিত অবতারে বা দেহরূপী খ্রীষ্টে, এবং এরা তাঁকে গ্রহণও করতে পারতো না। থোমা যাতে প্রভু যীশুর অস্তিত্বের বাস্তবতাকে মেনে নেয় এবং তা বিশ্বাস করে, মেনে নেয় যে, যথার্থই তিনি ঈশ্বরের অবতার, সেই উদ্দেশ্যেই থোমাকে তিনি হাত বাড়িয়ে তাঁর পাঁজর স্পর্শ করতে দিয়েছিলেন। প্রভু যীশুর পুনরুত্থানের পূর্ববর্তী ও পরবর্তীকালে থোমার সংশয়ের মধ্যে কি কোনো বৈসাদৃশ্য ছিল? সবসময়ই সে সন্দিগ্ধচিত্ত ছিল, এবং প্রভু যীশুর আধ্যাত্মিক দেহ ব্যক্তিগতভাবে তার কাছে আবির্ভূত হয়ে তাঁর শরীরের পেরেকের ক্ষতচিহ্নগুলি তাকে পরখ করে দেখতে না দিলে, কেউই কোনোভাবে তার সন্দেহগুলির নিরসন ঘটিয়ে তাকে সংশয়মুক্ত করতে পারতো না। তাই, যখন থেকে প্রভু যীশু থোমাকে তাঁর পাঁজর স্পর্শ করার অনুমতি দিয়েছিলেন এবং বাস্তবিকই তাকে পেরেকের ক্ষতচিহ্নগুলি অনুভব করতে দিয়েছিলেন, তবে থেকে থোমার সংশয় অন্তর্হিত হয়েছিল, এবং সে প্রকৃতই অবহিত হয়েছিল যে, প্রভু যীশু পুনরুত্থিত হয়েছেন, এবং সে মেনে নিয়েছিল ও বিশ্বাস করেছিল যে, প্রভু যীশুই হলেন প্রকৃত খ্রীষ্ট ও ঈশ্বরের অবতার। যদিও এই সময় থেকে থোমা আর কখনও সংশয় প্রকাশ করতো না, কিন্তু চিরকালের জন্য সে খ্রীষ্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সুযোগ হারিয়েছিল। চিরকালের জন্য সে তাঁর সঙ্গে মিলিত হওয়ার, তাঁকে অনুসরণ করার, তাঁকে জানার সুযোগ হারিয়েছিল। খ্রীষ্টের দ্বারা নিখুঁত হয়ে ওঠার সুযোগ সে খুইয়ে ফেলেছিল। যারা সংশয়ে পরিপূর্ণ ছিল, প্রভু যীশুর আবির্ভাব ও তাঁর বাক্যগুলি তাদের বিশ্বাসের সম্বন্ধে একটা সিদ্ধান্ত ও একটি রায় দিয়েছিল। সংশয়বাদীদের জানানোর জন্য, যারা শুধু স্বর্গস্থ ঈশ্বরে বিশ্বাস করতো কিন্তু খ্রীষ্টে বিশ্বাস করতো না তাদের অবহিত করার উদ্দেশ্যে, তিনি তাঁর প্রকৃত বাক্যাবলী ও কার্যকলাপকে ব্যবহার করেছিলেন: ঈশ্বর তাদের বিশ্বাসের তারিফ করতেন না, তাঁর প্রতি সংশয়ান্বিত হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে অনুসরণ করার জন্য তাদের প্রশংসাও করতেন না। যে দিন তারা পরিপূর্ণভাবে ঈশ্বরে ও খ্রীষ্টে বিশ্বাস করেছিল, একমাত্র সেই দিনই ঈশ্বর তাঁর মহান কার্যের সমাপন ঘটাতে পারতেন। নিঃসন্দেহে, সেই একই দিনে, তাদের সন্দেহের বিষয়ে একটি রায়দানও করা হয়েছিল। খ্রীষ্টের প্রতি তাদের মনোভাব তাদের নিয়তি নির্ধারণ করেছিল, এবং তাদের দৃঢ়বদ্ধ সংশয়ের কারণে তাদের বিশ্বাস ফলপ্রসূ হয় নি, এবং তাদের অনমনীয়তার কারণে তাদের আশা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল। স্বর্গস্থ ঈশ্বরে তাদের বিশ্বাস যেহেতু বিভ্রমের ভিত্তির দাঁড়িয়ে ছিল, এবং যেহেতু খ্রীষ্টের প্রতি তাদের সংশয়ই বস্তুত ঈশ্বরের প্রতি তাদের প্রকৃত মনোভাব ছিল, তাই প্রভু যীশুর শরীরে পেরেকের ক্ষতচিহ্নগুলি তারা স্পর্শ করা সত্ত্বেও তাদের বিশ্বাস তখনো নিষ্ফলাই রয়ে গিয়েছিল, এবং তাদের অর্জিত ফলাফল ছিল বাঁশের ঝুড়িতে করে জল বইবার শামিল—পুরোটাই ব্যর্থ। একই সাথে, থোমাকে প্রভু যীশু যা বলেছিলেন, তা অতি স্পষ্টতই ছিল তাঁর প্রতিটি মানুষকে অবগত করার এক পদ্ধতি: পুনরুত্থিত প্রভু যীশু হলেন সেই প্রভু, যীশু যিনি সাড়ে তেত্রিশটা বছর মানবজাতির মাঝে কার্য সম্পাদন করে অতিবাহিত করেছিলেন। যদিও তাঁকে ক্রুশকাষ্ঠে পেরেকবিদ্ধ করা হয়েছিল এবং তিনি মৃত্যুর ছায়াচ্ছন্ন উপত্যকার অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন, এবং যদিও তাঁর পুনরুত্থান ঘটেছিল, কিন্তু কোনো দিক দিয়েই তাঁর কোনো রূপান্তর ঘটেনি। যদিও এখন তাঁর শরীরে পেরেকের ক্ষতচিহ্ন ছিল, এবং যদিও তিনি পুনরুত্থিত হয়ে কবর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে এসেছিলেন, কিন্তু তাঁর স্বভাব, মানবজাতি সম্পর্কে তাঁর উপলব্ধি, এবং মানবজাতির প্রতি তাঁর অভিপ্রায় সামান্যতমও পরিবর্তিত হয় নি। একই সঙ্গে, মানুষের উদ্দেশ্যে তিনি বার্তা দিচ্ছিলেন যে ক্রুশকাষ্ঠ থেকে তিনি অবতরণ করেছেন, পাপকে পরাভূত করেছেন, দুঃখযন্ত্রণাকে বশীভূত করেছেন, এবং মৃত্যুকে জয় করেছেন। পেরেকের ক্ষতচিহ্নগুলি ছিল শয়তানের বিরুদ্ধে তাঁর জয়লাভের সাক্ষ্যচিহ্ন মাত্র, সেগুলি প্রতিপন্ন করেছিল যে, তিনি সমগ্র মানবজাতিকে সাফল্যের সঙ্গে পুনরুদ্ধার করার মানসেপাপস্খালনের বলিতে পরিণত হয়েছেন। মানুষকে তিনি জানাচ্ছিলেন যে, ইতিমধ্যেই তিনি মানবজাতির পাপসমূহকে গ্রহণ করেছেন এবং তাঁর পুনরুদ্ধারের কার্য তিনি সম্পূর্ণ করেছেন। যখন তাঁর শিষ্যদের দর্শন করতে তিনি ফিরে এসেছিলেন, তখন তাঁর আবির্ভাবের মাধ্যমে তিনি তাদের এই বার্তা জ্ঞাপন করেছিলেন: “আমি এখনো জীবিত, এখনো আমার অস্তিত্ব রয়েছে; আজ তোমাদের সামনে আমি প্রকৃতই দাঁড়িয়ে রয়েছি, যাতে তোমরা আমায় দেখতে পাও ও স্পর্শ করতে পারো। সবসময়ই আমি তোমাদের সঙ্গে থাকবো।” প্রভু যীশুর থোমার ঘটনাটিকে পরবর্তীকালের মানুষদের উদ্দেশ্যে এক সাবধানবাণী হিসাবেও ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন: তাঁর প্রতি বিশ্বাসে যদিও প্রভু যীশুকে তুমি দর্শন বা স্পর্শ কোনোটাই করতে সক্ষম হবে না, তবু তোমার প্রকৃত বিশ্বাসের কারণে তুমি আশীর্বাদধন্য, এবং তোমার প্রকৃত বিশ্বাসের কারণেই তুমি তাঁকে দেখতে পাবে, আর এই প্রকারের মানুষই হল যারা আশীর্বাদ পেয়েছে।

থোমার সামনে আবির্ভূত হওয়ার পর প্রভু যীশু যা বলেছিলেন, বাইবেলে লিপিবদ্ধ সেই বাক্যগুলি অনুগ্রহের যুগের সকল মানুষের জন্য অত্যন্ত সহায়ক ছিল। থোমার সামনে তাঁর আবির্ভাব এবং তার উদ্দেশ্যে কথিত তাঁর বাক্যগুলি পরবর্তী প্রজন্মের উপর এক গভীর ছাপ রেখেছিল; এগুলির মধ্যে চিরকালীন তাৎপর্য নিহিত রয়েছে। থোমা সেই ধরনের মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে যারা, ঈশ্বরে বিশ্বাস করে অথচ ঈশ্বরের প্রতি সংশয় প্রকাশ করে। এরা সন্দিগ্ধ প্রকৃতির, অশুভ হৃদয়ের অধিকারী মানুষ, এরা নির্ভরযোগ্য নয়, এবং ঈশ্বর যেসকল কার্যসাধনে সক্ষম, তাতে এরা বিশ্বাস করে না। এরা ঈশ্বরের সর্বশক্তিমত্তা ও তাঁর সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস করে না, এবং ঈশ্বরের অবতারেও তাদের বিশ্বাস নেই। কিন্তু, প্রভু যীশুর পুনরুত্থান তাদের এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলিকে সম্পূর্ণ নস্যাৎ করে দিয়েছিল, এবং ঘটনাটি তাদের নিজস্ব সংশয়কে আবিষ্কার করার, তাদের নিজস্ব সন্দেহকে শনাক্ত করার, এবং তাদের নিজস্ব বিশ্বাসঘাতকতাকে স্বীকার করে নেওয়ার একটা সুযোগ দান করেছিল, এবং এইভাবে, তারা প্রভু যীশুর অস্তিত্ব ও পুনরুত্থানে যথার্থরূপে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল। থোমার সঙ্গে যা ঘটেছিল, তা ছিল পরবর্তী প্রজন্মের জন্য এক সাবধানবাণী ও সতর্কীকরণ, যাতে আরো বেশি সংখ্যক মানুষ থোমার মতো সন্দিগ্ধবাদী না হওয়ার বিষয়ে নিজেদের সতর্ক করতে পারে, এবং যদি নিজেদের তারা সংশয়াকীর্ণ করেই তোলে, তাহলে তারা অন্ধকারের মধ্যে নিমজ্জিত হবে। যদি তুমি ঈশ্বরের অনুসরণ করো, কিন্তু ঠিক থোমার মতোই, নিশ্চিত হওয়ার জন্য, যাচাই করার জন্য, ঈশ্বর আছেন কি নেই তা অনুমান করার জন্য, সর্বদাই প্রভুর পাঁজর স্পর্শ করতে এবং তাঁর পেরেকের ক্ষতচিহ্ন অনুভব করতে চাও, তাহলে ঈশ্বর তোমায় পরিত্যাগ করবেন। তাই, প্রভু যীশু চেয়েছিলেন যে, মানুষ যেন থোমার মতো না হয়, যে, যা তারা স্বচক্ষে দেখতে পাবে, একমাত্র তাই-ই বিশ্বাস করবে, বরং তিনি চেয়েছিলেন যে, তারা যেন বিশুদ্ধ, সৎ মানুষ হয়, যেন তারা ঈশ্বরের প্রতি কোনো সন্দেহ পোষণ না করে, বরং তিনি চেয়েছিলেন তারা যেন শুধু তাঁকে বিশ্বাস করে ও তাঁর অনুগমন করে। এই ধরনের মানুষরাই হল আশীর্বাদধন্য। এ হল মানুষের কাছে প্রভু যীশুর এক অতি ক্ষুদ্র চাহিদা, এবং তাঁর অনুগামীদের উদ্দেশ্যে এক সাবধানবাণী।

যারা সংশয়াকীর্ণ, তাদের প্রতি প্রভু যীশুর মনোভাব উপরে আলোচিত হল। কিন্তু যারা তাঁকে সৎভাবে বিশ্বাস করতে ও অনুসরণ করতে সক্ষম, তাদের উদ্দেশ্যে প্রভু যীশু কী বলেছিলেন ও তাদের জন্য কী করেছিলেন? এর পর প্রভু যীশু ও পিতরের মধ্যে এক সংলাপের মধ্য দিয়ে সেই দিকেই আমরা দৃকপাত করতে চলেছি।

এই কথোপকথনে, প্রভু যীশু বারংবার পিতরকে একটাই জিনিস জিজ্ঞেস করেছিলেন: “যোহনের পুত্র শিমোন, তুমি কি আমায় ভালবাস?” এটি একটি উচ্চতর আদর্শমান যা প্রভু যীশু তাঁর পুনরুত্থানের পর দাবি করেছিলেন পিতরের মতো মানুষের কাছে, যে ব্যক্তিগণ খ্রীষ্টে প্রকৃত অর্থেই বিশ্বাস রাখে এবং প্রভুকে ভালোবাসার জন্য উদ্যমীভাবে সচেষ্ট হয়, তাদের কাছে। এই প্রশ্নটি এক প্রকারের তদন্ত ও জিজ্ঞাসাবাদ ছিল, কিন্তু তার চেয়েও বেশি, এটি ছিল পিতরের মতো মানুষদের কাছে এক চাহিদা ও এক প্রত্যাশা। প্রভু যীশু এই জিজ্ঞাসাবাদের পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলেন, যাতে মানুষ আত্ম-প্রতিফলন করে এবং নিজেদের অভ্যন্তরকে পরীক্ষা করে দেখে প্রশ্ন করে: মানুষের কাছে প্রভু যীশুর চাহিদাগুলি কী? আমি কি প্রভুকে ভালোবাসি? আমি কি একজন ঈশ্বরপ্রেমী মানুষ? কীভাবে আমার ঈশ্বরকে ভালোবাসা উচিত? এই প্রশ্নটি প্রভু যীশু শুধুমাত্র পিতরের উদ্দেশ্যে করলেও, আসলে তাঁর অন্তরে, পিতরকে লক্ষ্য করে প্রশ্নগুলি নিক্ষেপ করার মাধ্যমে, ঈশ্বরপ্রেমের অন্বেষণকারী আরো অনেক মানুষের কাছেও এই একই রকম প্রশ্ন পেশ করার এই সুযোগটি ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। পিতর শুধু এই জাতীয় মানুষগুলির প্রতিনিধির ভূমিকা পালনের, প্রভু যীশুর স্বমুখ থেকে প্রশ্নটি গ্রহণের অশিসলাভ করেছিল।

পুনরুত্থানের পর থোমার উদ্দেশ্যে প্রভু যীশু যে বাক্য উচ্চারণ করেছিলেন: “এখানে তোমার আঙ্গুল দাও, দেখ আমার হাত দুখানি। হাত বাড়িয়ে আমার কুক্ষিদেশ স্পর্শ কর। সংশয় রেখো না মনে, বিশ্বাস কর,” তার সাথে তুলনাক্রমে, পিতরের উদ্দেশ্যে তিনবার জিজ্ঞাসিত তাঁর এই প্রশ্নটি: “যোহনের পুত্র শিমোন, তুমি কি আমায় ভালবাস?” মানুষকে প্রভু যীশুর মনোভাবের কঠোরতা, এবং জিজ্ঞাসাবাদের সময় তাঁর উপলব্ধ তাগিদকে আরো ভালো করে অনুভব করার সুযোগ দেয়। শঠ প্রকৃতির, সন্দিগ্ধমনা থোমার ক্ষেত্রে, প্রভু যীশু তাকে হাত বাড়িয়ে তাঁর শরীরে পেরেকের ক্ষতচিহ্নগুলি স্পর্শ করতে দেন, যার ফলে সে প্রতীত হয় যে, প্রভু যীশুই ছিলেন পুনরুত্থিত মনুষ্যপুত্র, এবং খ্রীষ্ট হিসাবে প্রভু যীশুর পরিচয়কে সে মেনে নেয়। আর প্রভু যীশু যদিও থোমাকে কঠোরভাবে ভর্ৎসনা করেন নি এবং মৌখিকভাবে তার সম্বন্ধে কোনো স্পষ্ট মতামতও ব্যক্ত করেন নি, তবু তিনি ব্যবহারিক কর্মের সাহায্যে থোমাকে অবগত করেছিলেন যে তিনি তাকে বুঝতেন, একই সঙ্গে এই ধরনের মানুষের প্রতি তিনি তাঁর মনোভাব ও নির্ণয়ও প্রদর্শন করেছিলেন। ওই প্রকারের মানুষের কাছ থেকে প্রভু যীশুর চাহিদা ও প্রত্যাশা তাঁর উক্তিতে দেখা যাবে না, কারণ থোমার মতো মানুষগুলির মধ্যে আদৌ প্রকৃত বিশ্বাসের কোনো লেশমাত্র থাকে না। এমন ব্যক্তিদের প্রতি প্রভু যীশুর চাহিদা শুধু এটুকুর মধ্যেই সীমিত, কিন্তু পিতরের মতো মানুষের প্রতি যে মনোভাব তিনি ব্যক্ত করেছিলেন, তা ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। পিতরকে তিনি হাত বাড়িয়ে তাঁর ক্ষতচিহ্নগুলি ছুঁয়ে দেখতে আদেশ করেন নি, বা পিতরকে এমন কথাও তিনি বলেন নি যে: “সংশয় রেখো না মনে, বিশ্বাস কর।” পরিবর্তে, বারংবার পিতরকে তিনি একই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেন। প্রশ্নটি ছিল চিন্তা-উদ্রেককারী ও অর্থপূর্ণ এমন এক প্রশ্ন, যা খ্রীষ্টের প্রত্যেক অনুগামীর মনে অনুশোচনা ও ভীতির অনুভূতি সৃষ্টি করবেই, এবং একই সঙ্গে তা তাদের প্রভু যীশুর চিন্তিত ও দুঃখভারাক্রান্ত মানসিক অবস্থাকেও অনুভব না করিয়ে ছাড়ে না। আর যখন তারা বেদনা ও যন্ত্রণায় কাতর, তখনই তারা প্রভু যীশু খ্রীষ্টের দুশ্চিন্তা ও তাঁর প্রযত্নকে উপলব্ধি করতে বেশি সক্ষম; তারা তাঁর ঐকান্তিক শিক্ষাদান এবং খাঁটি ও সৎ মানুষ হওয়ার কঠোর আবশ্যিক শর্তগুলি হৃদয়ঙ্গম করে। প্রভু যীশুর প্রশ্ন মানুষকে অনুভব করায় যে, এই সরল বাক্যগুলির মাধ্যমে মানুষের প্রতি ঈশ্বরের যে চাহিদা ব্যক্ত হয়েছে তা কেবলই তাঁকে বিশ্বাস ও অনুসরণ করা নয়, বরং তা হল প্রেমময়তার অর্জন, তোমার প্রভু ও তোমার ঈশ্বরের প্রতি প্রেম। এমন ভালোবাসাই হল যত্নবান ও আজ্ঞাকারী হওয়া। এই ভালোবাসা হল মানুষের ঈশ্বরের নিমিত্ত বাঁচা-মরা, ঈশ্বরকে যথাসর্বস্ব সমর্পণ করা, এবং ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে যথাসর্বস্ব ব্যয় ও সম্প্রদান করা। এই প্রকারের ভালোবাসা হল ঈশ্বরকে তৃপ্তি দেওয়া, তা তাঁকে সাক্ষ্য উপভোগ করতে ও উদ্বেগমুক্ত থাকতে দেওয়াও বটে। এ-ও হল মানবজাতির ঈশ্বরের প্রতি ঋণপরিশোধ, মানুষের দায়িত্ব, বাধ্যবাধকতা এবং কর্তব্য, এবং এ হল এমন এক পথ, যা মানুষের আজীবন অনুসরণীয়। এই প্রশ্ন তিনটি পিতর ও নিখুঁত করা হবে এমন সকল মানুষের কাছে প্রভু যীশুর এক চাহিদা ও এক সনির্বন্ধ অনুরোধ। এই প্রশ্ন তিনটিই পিতরকে তার জীবনের পথে শেষ অবধি হেঁটে যেতে চালিত ও প্রণোদিত করেছিল, এবং বিদায়গ্রহণকালীন প্রভু যীশুর জিজ্ঞাসিত এই প্রশ্নগুলিই পিতরকে তার নিখুঁত হয়ে ওঠার পথে পা রাখার দিকে চালিত করেছিল, প্রভুর প্রতি তার ভালোবাসার দরুন, এই প্রশ্নগুলিই তাকে প্রভুর অন্তরের প্রতি যত্নশীল হতে, প্রভুকে মান্য করতে, প্রভুকে সান্ত্বনা নিবেদন করতে, এবং এই ভালোবাসার নিমিত্ত তার সমগ্র জীবন ও তার সম্পূর্ণ সত্তাকে উৎসর্গ করার দিকে চালিত করেছিল।

অনুগ্রহের যুগ চলাকালীন, ঈশ্বরের কার্যের লক্ষ্যবস্তু ছিল মুখ্যত দুই ধরনের মানুষ। প্রথম প্রকারটি হল সেই ধরনের মানুষেরা যারা তাঁকে বিশ্বাস ও অনুসরণ করেছিল, যারা তাঁর আদেশসমূহ মেনে চলতে পেরেছিল, আর, যারা ক্রুশকাষ্ঠকে বহন করতে, এবং অনুগ্রহের যুগের পথে চলা অব্যহত রাখতে সক্ষম হয়েছিল। এই প্রকারের মানুষেরা ঈশ্বরের আশীর্বাদ লাভ করতো এবং ঈশ্বরের অনুগ্রহ উপভোগ করতো। দ্বিতীয় প্রকারের মানুষেরা ছিল পিতরের মতো, যাদের নিখুঁত করে তোলা সম্ভব ছিল। তাই, পুনরুত্থিত হওয়ার পর, প্রভু যীশু প্রথমেই এই দুটি অত্যন্ত অর্থপূর্ণ কাজ করলেন। প্রথম কাজটি করা হল থোমার সাথে, অন্যটি করা হল পিতরের সাথে। এই দুটি কাজ কীসের ব্যঞ্জনাবাহী? তারা কি ঈশ্বরের মানবজাতিকে উদ্ধারের যথার্থ অভিপ্রায়কে তুলে ধরে? তারা কি মানবজাতির প্রতি ঈশ্বরের আন্তরিকতার দ্যোতক? থোমার সঙ্গে যে কাজ তিনি করলেন, সেটির উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে সতর্ক করে দেওয়া, যাতে তারা সংশয়বাদী না হয়ে শুধুই বিশ্বাস করে যায়। পিতরের সাথে তিনি যে কাজটি করলেন, সেটির উদ্দেশ্য ছিল পিতরের মতো মানুষের বিশ্বাসকে শক্তিদান করা, এবং এহেন ব্যক্তিগণের প্রতি তাঁর চাহিদাগুলি স্পষ্ট করে তোলা, তাদের কোন লক্ষ্যের অন্বেষণ করা উচিত তা দেখিয়ে দেওয়া।

পুনরুত্থিত হওয়ার পর, যে ব্যক্তিগণের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা প্রভু যীশু আবশ্যক মনে করেছিলেন তাদের কাছে তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন, তাদের সঙ্গে আলাপচারিতা করেছিলেন, এবং, মানুষের প্রতি তাঁর অভিপ্রায় ও প্রত্যাশাসমূহ পরিত্যাগ করে, তিনি তাদের উদ্দেশ্যে চাহিদা জ্ঞাপন করেছিলেন। অর্থাৎ, ঈশ্বরের অবতার হিসাবে, মানবজাতির জন্য তাঁর উদ্বেগ ও মানুষের কাছে তাঁর চাহিদা কোনোদিন পরিবর্তিত হয় নি; তাঁর দেহরূপে থাকাকালীন এবং ক্রুশকাষ্ঠে পেরেক-বিদ্ধ ও পুনরুত্থিত হওয়ার পর তাঁর আধ্যাত্মিক দেহে অধিষ্ঠানকালীন—সর্বদাই এগুলি একই থেকে গিয়েছিল। ক্রুশকাষ্ঠে আরোহন করার পূর্বে এই শিষ্যদের বিষয়ে তিনি চিন্তিত ছিলেন, এবং তাঁর অন্তরে তিনি প্রতিটি মানুষের অবস্থা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণার অধিকারী ছিলেন, এবং প্রতিটি মানুষের ঘাটতিগুলি তিনি বুঝতে পারতেন এবং, অবশ্যই, তাঁর মৃত্যু, পুনরুত্থান, এবং আধ্যাত্মিক দেহে রূপান্তরের পরেও প্রতিটি মানুষ সম্পর্কে তাঁর উপলব্ধি তাঁর দেহরূপে অবস্থানকালীন যেমন ছিল তেমনই রয়ে গিয়েছিল। তিনি জানতেন যে, খ্রীষ্ট হিসাবে তাঁর পরিচয়ের বিষয়ে মানুষ সম্পূর্ণ নিশ্চিত ছিল না, কিন্তু দেহরূপে থাকাকালীন মানুষের কাছ থেকে তিনি কঠোর কিছু দাবি করেন নি। কিন্তু, পুনরুত্থিত হওয়ার পর, তাদের কাছে তিনি আবির্ভূত হন, এবং তাদের সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিত করেন যে প্রভু যীশু ঈশ্বরের থেকে উদ্ভূত এবং তিনি ঈশ্বরের অবতার, এবং তাঁর আবির্ভাব ও পুনরুত্থানের ঘটনাটিকে তিনি মানবজাতির আজীবনের সাধনার মহত্তম দর্শন ও অনুপ্রেরণা হিসাবে ব্যবহার করেন। মৃতাবস্থা থেকে তাঁর পুনরুত্থান শুধু যে তাঁর সকল অনুগামীদের শক্তি যুগিয়েছিল তা-ই নয়, একই সঙ্গে তা মানবজাতির মাঝে তাঁর অনুগ্রহের যুগের কার্যকে আনুপুঙ্খিকভাবে বাস্তবায়িতও করেছিল, আর এই কারণেই, অনুগ্রহের যুগে প্রভু যীশুর পরিত্রাণের সুসমাচার মানবজাতির প্রতিটি কোণে ছড়িয়ে পড়েছিল। তোমার কি মনে হয় যে, তাঁর পুনরুত্থানের পর, প্রভু যীশুর আবির্ভাবের কোনো তাৎপর্য ছিল? তুমি যদি সেই সময়ের থোমা বা পিতর হতে এবং নিজের জীবনে এত অর্থপূর্ণ কোনো ঘটনার সম্মুখীন হতে, তাহলে ঘটনাটি তোমার উপর কী প্রকারের অভিঘাত সৃষ্টি করতো? তুমি কি এই ঘটনাটিকে তোমার ঈশ্বর-বিশ্বাসের জীবনে সর্বোত্তম ও মহত্তম দর্শন বলে বিবেচনা করতে? তুমি যখন ঈশ্বরের অনুগমন করছো, তাঁকে পরিতুষ্ট করার জন্য কঠোর প্রচেষ্টা করছো, এবং আজীবৎকাল ঈশ্বরপ্রেমে প্রয়াসী থেকেছো, তখন কি তুমি এই ঘটনাটিকে তোমার এক চালিকাশক্তি বলে গণ্য করতে? এই মহত্তম দর্শনের প্রচারের জন্য তুমি কি গোটা একটা জীবনের প্রচেষ্টা ব্যয় করতে? প্রভু যীশুর পরিত্রাণের প্রচারকে তুমি কি ঈশ্বরের অর্পিত এক দায়িত্ব হিসাবে গ্রহণ করতে? যদিও তোমরা এর অভিজ্ঞতা লাভ করোনি, তবু ঈশ্বর আর তাঁর ইচ্ছার বিষয়ে এক স্পষ্ট উপলব্ধি লাভ করতে আধুনিক মানুষদের কাছে থোমা ও পিতরের দৃষ্টান্তদুটিই যথেষ্ট। বলা যায় যে, দেহধারণ করে ঈশ্বর স্বয়ং মানবজাতির মাঝে বসবাস ও মানবজীবনের অভিজ্ঞতা লাভ করার পর, এবং মানবজাতির নৈতিক অধোগমন ও তৎকালীন মানবজীবনের পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করার পর, মানবজাতি যে কতটা অসহায়, শোচনীয়, ও করুণা-উদ্রেককর অবস্থার মধ্যে রয়েছে, তা দেহরূপী ঈশ্বর গভীরতর ভাবে অনুভব করলেন। দেহরূপে বসবাসকালীন তাঁর অধিকারলব্ধ মানবতার কারণে, তাঁর দেহীসুলভ প্রবৃত্তির দরুন মানুষের পরিস্থিতির সাথে ঈশ্বর আরো বেশি সহমর্মিতা অর্জন করেছিলেন। এর ফলে, তাঁর অনুগামীদের জন্য তিনি গভীরতর উদ্বেগ অনুভব করেছিলেন। এই বিষয়গুলি সম্ভবত তোমরা উপলব্ধি করতে পারো না, কিন্তু তাঁর প্রত্যেক অনুগামীর জন্য দেহরূপী ঈশ্বরের অনুভূত এই দুশ্চিন্তা ও প্রযত্নকে আমি দুটি মাত্র শব্দ ব্যবহার করে বর্ণনা করতে পারি: “তীব্র উদ্বেগ”। এই পরিভাষাটি মানবীয় ভাষা থেকে উদ্ভূত এবং অত্যন্ত মনুষ্যোচিত হওয়া সত্ত্বেও তাঁর অনুগামীদের প্রতি ঈশ্বরের অনুভূতিকে যথার্থরূপে অভিব্যক্ত ও বর্ণিত করে। মানুষের জন্য ঈশ্বরের গভীর উদ্বেগের বিষয়ে বলা যায় যে, তোমাদের অভিজ্ঞতা অর্জনের পথে ক্রমে ক্রমে তোমরা এটি অনুভব করবে ও এর আস্বাদন লাভ করবে। কিন্তু, এটি কেবলমাত্র তোমার নিজের স্বভাবের পরিবর্তন অন্বেষণের ভিত্তিতে, ঈশ্বরের স্বভাবের বিষয়ে ক্রমিক উপলব্ধির মাধ্যমেই অর্জিত হতে পারে। প্রভু যীশু যখন এভাবে আবির্ভূত হয়েছিলেন, তখন তা মানবতার মধ্যে তাঁর অনুগামীদের জন্য তাঁর তীব্র উদ্বেগকে তাঁর আধ্যাত্মিক দেহে, কিংবা বলা যায় যে, তাঁর দেবত্বের মধ্যে, মূর্ত ও সঞ্চারিত করেছিল। তাঁর আবির্ভাব মানুষকে আরেকবার ঈশ্বরের উদ্বেগ ও তত্ত্বাবধানের অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি লাভের সুযোগ দিয়েছিল, একই সঙ্গে তা সুদৃঢ়ভাবে প্রতিপন্ন করেছিল যে, ঈশ্বরই কোনো যুগের অবতারণা করেন, কোনো যুগকে উন্মোচিত করেন, এবং কোনো যুগের পরিসমাপ্তিও ঘটান। তাঁর আবির্ভাবের মাধ্যমে, সকল মানুষের বিশ্বাসকে তিনি শক্তিশালী করে তুলেছিলেন এবং জগতের কাছে এই সত্যকে প্রতিপন্ন করেছিলেন যে, তিনিই স্বয়ং ঈশ্বর। তা তাঁর অনুসরণকারীদের চিরকালীন নিশ্চয়তা প্রদান করেছিল, এবং তাঁর আবির্ভাবের মাধ্যমেই তিনি তাঁর নতুন কার্যের একটি পর্যায়ের সূত্রপাতও ঘটিয়েছিলেন।

১৩. তাঁর পুনরুত্থানের পর যীশু রুটি ভক্ষণ এবং শাস্ত্রব্যাখ্যা করলেন

লুক ২৪:৩০-৩২ যীশু তাঁদের সঙ্গে খেতে বসে রুটি নিয়ে আশীর্বাণী উচ্চারণ করলেন এবং সেই রুটি টুকরো করে তাঁদের দিলেন। সেই মুহূর্তে তাঁদের চোখ খুলে গেল। তাঁরা তাঁকে চিনতে পারলেন। সঙ্গে সঙ্গে যীশু তাঁদের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। তাঁরা তখন পরস্পর বলতে লাগলেন, পথে যখন তিনি আমাদের সঙ্গে কথা বলছিলেন এবং শাস্ত্র ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন, তখন আমাদের অন্তরে এক আবেগের উত্তাপ অনুভব করছিলাম না?

১৪. শিষ্যেরা যীশুকে ঝলসানো মাছ খেতে দিল

লুক ২৪:৩৬-৪৩ এই সমস্ত কথা তাঁরা বলছেন, তখন যীশু স্বয়ং তাঁদের মাঝখানে এসে দাঁড়ালেন। তাঁকে দেখে তাঁরা ভীত চকিত হয়ে ভাবলেন যে তাঁরা ভূত দেখছেন। যীশু তখন তাঁদের বললেন, কেন ভয় পাচ্ছ তোমরা? কেনই বা তোমাদের সংশয় দেখা দিচ্ছে? এই দেখ আমার হাত, পা, এ আমি স্বয়ং, আমাকে ছুঁয়ে দেখ—অপদেবতার আমার মত অস্থি মাংস নেই। (এই বলে তিনি নিজের হাত, পা তাঁদের দেখালেন।) বিস্ময় ও আনন্দে আত্মহারা হলেও তখনও তাঁরা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তিনি তাঁদের বললেন, তোমাদের কাছে খাবার কিছু আছে? তাঁরা তাঁকে এক টুকরো ভাজা মাছ দিলেন। তিনি তাঁদের চোখের সামনেই সেই মাছ খেলেন।

এবার, আমরা শাস্ত্রের উপরুল্লিখিত অনুচ্ছেদগুলির দিকে চোখ রাখবো। প্রথম অনুচ্ছেদটি হল তাঁর পুনরুত্থানের পর প্রভু যীশুর রুটি ভক্ষণ ও ধর্মগ্রন্থের ব্যাখ্যাদানের বিবরণ, এবং দ্বিতীয় অনুচ্ছেদটিতে প্রভু যীশুর এক টুকরো ঝলসানো মাছ খাওয়ার বিবরণ দেওয়া হয়েছে। এই দুটি অনুচ্ছেদ ঈশ্বরের স্বভাবকে জানার ক্ষেত্রে কীভাবে তোমাদের সাহায্য করতে পারে? প্রভু যীশুর রুটি ও তারপর ঝলসানো মাছ খাওয়ার এই বিবরণগুলি থেকে যে প্রকার চিত্র তোমরা পাও, তা কি কল্পনা করতে পারো? প্রভু যীশু যদি তোমাদের সামনে দাঁড়িয়ে রুটি ভক্ষণ করতেন, তাহলে তোমাদের অনুভূতি কেমন হতো, তা কি কল্পনা করতে পারো? কিংবা তিনি যদি তোমাদের সঙ্গে এক টেবিলে বসে, মানুষের সাথে মাছ ও রুটি আহার করতেন, তাহলে সেই মুহূর্তে তোমার কী ধরনের অনুভূতি হতো? যদি তুমি নিজেকে প্রভুর অতি অন্তরঙ্গ হিসাবে, তোমার খুব ঘনিষ্ঠ বলে অনুভব করতে, তবে সেই অনুভূতিটি সঠিক। পুনরুত্থানের পর লোকজনের ভিড়ের সামনে রুটি ও মাছ খেয়ে প্রভু যীশু ঠিক এই ফলাফলটিই অর্জন করতে চেয়েছিলেন। তাঁর পুনরুত্থানের পর প্রভু যীশু যদি মানুষের সঙ্গে শুধু কথাবার্তাই বলতেন, তারা যদি তাঁর অস্থিমজ্জাকে অনুভব করতে না পেরে পরিবর্তে তাঁকে এক অনধিগম্য আত্মা হিসাবে অনুভব করতো, তাহলে তাদের কেমন লাগতো? তারা কি নিরাশ হতো না? আশাহত হয়ে, মানুষগুলি কি নিজেদের পরিত্যক্ত বলে বোধ করতো না? তারা কি প্রভু যীশু ও নিজেদের মধ্যে একটা দূরত্ব অনুভব করতো না? ঈশ্বরের সাথে মানুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই দূরত্ব কী ধরনের নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করতো? নিশ্চিতভাবেই মানুষ শঙ্কিত বোধ করতো, তারা তাঁর কাছে আসতে সাহস করতো না, এবং এভাবেই, তাদের মধ্যে তাঁকে এক সম্ভ্রমসূচক দূরত্বে রাখার মনোভাব তৈরি হতো। এর পর থেকে, তারা প্রভু যীশু খ্রীষ্টের সঙ্গে তাদের অন্তরঙ্গ সম্পর্ককে ছিন্ন করে অনুগ্রহের যুগের পূর্বেকার স্বর্গস্থ ঈশ্বর ও মানবজাতির মধ্যের সম্পর্কে ফিরে যেতো। মানুষের ধরা-ছোঁয়ার অতীত আধ্যাত্মিক দেহের ঈশ্বরের সঙ্গে তাদের অন্তরঙ্গতার মূলোৎপাটন ঘটাতো, এবং এর ফলে প্রভু যীশু খ্রীষ্টের দেহরূপে থাকাকালীন তাঁর ও মানুষের মধ্যে গড়ে ওঠা দূরত্বহীন অন্তরঙ্গ সম্পর্কের অবসান ঘটতো। আধ্যাত্মিক শরীর মানুষের মধ্যে একমাত্র যে আবেগগুলিকে আলোড়িত করতো তা হল ভীতি, এড়িয়ে যাওয়া, এবং নির্বাক ভাবে চেয়ে থাকার এক অনুভূতি। তারা তাঁর কাছাকাছি আসার বা তাঁর সাথে কথোপকথনে লিপ্ত হওয়ার স্পর্ধা করতো না, তাঁকে অনুসরণ করা, ভরসা করা, বা তাঁর গুণমুগ্ধ হওয়া তো দূর অস্ত। ঈশ্বর তা দেখতে চান নি যে, মানুষের তাঁর প্রতি এমনতর অনুভূতি রয়েছে। তিনি দেখতে চান নি যে, মানুষ তাঁকে এড়িয়ে যাচ্ছে বা তাঁর থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে নিচ্ছে; তিনি শুধু চাইতেন মানুষ তাঁকে বুঝুক, তাঁর নিকটে আসুক, এবং তাঁর পরিবারের একজন হোক। যদি তোমার নিজের পরিবার, তোমার ছেলেমেয়ে, তোমাকে দেখেও চিনতো পারতো না, তোমার কাছে আসার সাহস করতো না, বরং সবসময় তোমায় এড়িয়ে যেতো, তাদের জন্য সবকিছু করার পরেও যদি তুমি তাদের সহানুভূতি অর্জন করতে ব্যর্থ হতে, তাহলে তুমি কেমন বোধ করতে? তা কি বেদনাদায়ক হোতো না? তুমি কি ভগ্নহৃদয় হয়ে পড়তে না? মানুষ যখন তাঁকে এড়িয়ে চলে, তখন ঈশ্বরও ঠিক এমনটাই বোধ করেন। তাই, পুনরুত্থানের পরেও, প্রভু যীশু মানুষের কাছে তাঁর রক্ত-মাংসের আকার সমেত আবির্ভূত হয়েছিলেন, এবং তখনো তিনি তাদের সঙ্গে পান-ভোজন করেছিলেন। মানুষকে ঈশ্বর তাঁর পরিজন হিসাবে দেখেন, এবং ঈশ্বর চান মানবজাতিও তাঁকে তাদের প্রিয়তম জন বলে গণ্য করুক; একমাত্র এভাবেই ঈশ্বর মানুষকে প্রকৃতপক্ষে অর্জন করতে পারবেন, এবং একমাত্র এভাবেই মানুষ ঈশ্বরকে যথার্থভাবেই ভালোবাসতে ও আরাধনা করতে পারে। এখন কি তোমরা উপলব্ধি করতে পারছো, যে, আমি কোন অভিপ্রায় নিয়ে শাস্ত্রের এই দুটি অনুচ্ছেদ বেছে নিয়েছিলাম, যেখানে প্রভু যীশু তাঁর পুনরুত্থানের পর রুটি ভক্ষণ করেন ও ধর্মগ্রন্থের ব্যাখ্যা দেন, এবং যেখানে শিষ্যেরা তাঁকে এক টুকরো ঝলসানো মাছ আহার করতে দেয়।

এমন বলা যায় যে, তাঁর পুনরুত্থানের পর প্রভু যীশু ক্রমান্বয়ে যে বাক্যপরম্পরা উচ্চারণ করেছিলেন ও যে কার্যগুলি সম্পন্ন করেছিলেন, তাতে ঐকান্তিক চিন্তাভাবনা প্রয়োগ করা হয়েছিল। সেগুলি মানবজাতির প্রতি ঈশ্বরের অন্তর্ধৃত অনুকম্পা ও মমতায় পূর্ণ ছিল, এবং তাঁর দেহরূপে থাকাকালীন মানবজাতির সাথে গড়ে তোলা অন্তরঙ্গ সম্পর্কের প্রতি তাঁর অন্তর্নিহিত লালন ও সযত্ন তত্ত্বাবধানেও তা ছিল ভরপুর। অধিকন্তু, সেগুলি পূর্ণ ছিল অতীতচারিতায় এবং দেহরূপে থাকাকালীন তাঁর অনুগামীদের সাথে খাওয়াদাওয়া ও একত্র বসবাসের জীবনের প্রতি যে আকুল আকাঙ্ক্ষা তিনি অনুভব করেছিলেন, তা দিয়ে। তাই, তিনি চান নি যে, মানুষ ঈশ্বর ও নিজেদের মধ্যে কোনো দূরত্ব অনুভব করে, কিংবা মানবজাতি নিজেদের ঈশ্বরের থেকে দূরে সরিয়ে নেয়। আরো বেশি করে, তিনি চান নি মানবজাতি এমন মনে করুক যে, তাঁর পুনরুত্থানের পর প্রভু যীশু আর সেই পূর্ববৎ মানব-অন্তরঙ্গ প্রভু নন, তিনি চান নি তারা ভাবুক যে, তিনি আর মানবজাতির সাথে একাত্ম নন কারণ তিনি আধ্যাত্মিক জগতে ফিরে গিয়েছেন, প্রত্যাবর্তিত হয়েছেন সেই পিতার কাছে, যাঁর দর্শন বা নাগাল মানুষ কখনোই পায় না। তাঁর আর মানবজাতির মধ্যে মর্যাদার কোনো পার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে বলে মানুষ অনুভব করুক, এমনটা তিনি চান নি। ঈশ্বর যখন সেই মানুষদের দেখেন যারা তাঁর অনুসরণ করতে চায় অথচ তাঁকে এক সম্ভ্রমপূর্ণ দূরত্বে ঠেলে রাখে, তখন তাঁর হৃদয় ব্যথিত হয়, কারণ এর অর্থ হল যে, তাদের অন্তর তাঁর থেকে অনেক দূরবর্তী, এবং তাঁর পক্ষে তাদের অন্তর জয় করা খুবই দুরূহ হবে। সেই কারণেই মানুষের কাছে যদি তিনি তাদের ধরা-ছোঁয়ার অতীত এক আধ্যাত্মিক দেহে আবির্ভূত হতেন, তাহলে তা পুনরায় মানুষকে ঈশ্বরের থেকে দূরবর্তী করে তুলতো, এবং এর ফলে মানুষের মনে এই ভ্রান্ত উপলব্ধি জন্ম নিতো যে, পুনরুত্থানের পর খ্রীষ্ট মানুষের থেকে স্বতন্ত্র এক উচ্চমার্গের সত্তায় পরিণত হয়েছেন, এমন এক সত্তা যিনি আর মানুষের সাথে এক টেবিলে বসে খাদ্যগ্রহণ করতে পারেন না, কারণ মানুষ পাপিষ্ঠ, কলুষিত, এবং কারণ তারা কখনোই ঈশ্বরের নিকটবর্তী হতে পারে না। মানবজাতির এই ভ্রান্ত উপলব্ধিগুলি দূর করার উদ্দেশ্যে, প্রভু যীশু এমন একাধিক কাজ করেছিলেন যেগুলি দেহরূপে করতে তিনি অভ্যস্ত ছিলেন, বাইবেলে যেমন লিপিবদ্ধ আছে: “রুটি নিয়ে আশীর্বাণী উচ্চারণ করলেন এবং সেই রুটি টুকরো করে তাঁদের দিলেন।” অতীতে যেমন করতেন সেই একই ভাবে তাদের কাছে তিনি শাস্ত্রবাক্যসমূহের ব্যাখ্যাদানও করেছিলেন। প্রভু যীশুর সম্পাদিত এই সকল কাজগুলি, যারা তাঁকে দেখেছিল তাদের সকলকেই অনুভব করিয়েছিল যে, প্রভু বদলে যান নি, এখনো তিনি সেই আগের প্রভু যীশুই রয়েছেন। যদিও তাঁকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল এবং তিনি মৃত্যুর অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন, কিন্তু তবু তিনি পুনরুত্থিত হয়েছিলেন, এবং মানবজাতিকে ত্যাগ করে যান নি। মানুষের মাঝে আসার জন্য তিনি প্রত্যাবর্তন করেছিলেন, তাঁর কোনোকিছুই পরিবর্তিত হয় নি। মানুষের সামনে দণ্ডায়মান মনুষ্যপুত্র তখনো সেই একই প্রভু যীশু ছিলেন। তাঁর হাবভাব এবং মানুষের সঙ্গে তাঁর বাচনশৈলী অতিপরিচিত হিসাবেই প্রতিভাত হয়েছিল। তখনো তিনি দরদ, অনুগ্রহ, ও সহনশীলতায় কতই না ভরপুর ছিলেন—তখনো তিনি ছিলেন সেই একই প্রভু যীশু, যিনি অপরকে আত্মজ্ঞানে ভালোবাসতেন, মানবজাতিকে যিনি সত্তর গুণ সাতবার ক্ষমা করতে পারতেন। আগে সবসময় যেমন করতেন, সেভাবেই তিনি মানুষের সাথে খাওয়াদাওয়া করেছিলেন, তাদের সঙ্গে শাস্ত্র আলোচনা করেছিলেন, এবং আরো যা বলার তা হল, ঠিক আগের মতোই, তিনি রক্ত-মাংসেই গঠিত ছিলেন, এবং তাঁকে স্পর্শ ও দর্শন করা যেতো। মনুষ্যপুত্রসুলভ ভাবেই মানুষকে তিনি অন্তরঙ্গতা, স্বাচ্ছন্দ্য, এবং হারানো কোনোকিছু আবার ফিরে পাওয়ার আনন্দ অনুভবের সুযোগ দিয়েছিলেন। অত্যন্ত স্বস্তির সঙ্গে, মনে সাহস নিয়ে ও আত্মবিশ্বাসের সাথে, সেই মনুষ্যপুত্রের উপর তারা ভরসা করতে ও তাঁর দিকে প্রত্যাশার চোখে তাকাতে শুরু করলো, যিনি তাদের পাপের দরুন মানবজাতিকে মার্জনা করতে পারতেন। একই সাথে, তারা বিনা দ্বিধায় প্রভু যীশুর নামে প্রার্থনা করতে আরম্ভ করলো, প্রার্থনা করতে শুরু করলো তাঁর অনুগ্রহ ও তাঁর আশীর্বাদ লাভের জন্য, এবং তাঁর কাছ থেকে শান্তি ও আনন্দ পেতে, তাঁর কাছ থেকে প্রযত্ন ও সুরক্ষা লাভ করতে, এবং তারা আরম্ভ করলো প্রভু যীশুর নামে অসুস্থের রোগনিরাময় ঘটাতে ও দানবদের পরিহার করা।

প্রভু যীশু যে সময়ে দেহরূপে কার্য সম্পাদন করেছিলেন, তখন তাঁর অধিকাংশ অনুগামী তাঁর স্বরূপ ও তাঁর বাক্যাবলীর যাথার্থ্য সম্পূর্ণরূপে প্রতিপাদন করে উঠতে পারেনি। তিনি যখন ক্রুশকাষ্ঠের দিকে এগিয়ে চলেছিলেন, তাঁর অনুগামীরা তখন দর্শকের মনোভাব অবলম্বন করেছিল। এরপর, তাঁর ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার সময় থেকে তাঁকে কবরস্থ করা পর্যন্ত, তাঁর প্রতি মানুষ এক আশাভঙ্গের মনোভাব পোষণ করেছিল। এই সময়কালে, দেহরূপে থাকাকালীন, প্রভু যীশুর উক্ত বাক্যগুলির প্রতি সংশয়ের মানসিকতা থেকে মানুষের মন ইতিমধ্যেই সেগুলিকে পুরোপুরি অস্বীকার করার দিকে ঢলতে শুরু করেছিল। এরপর, কবর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে, তিনি যখন একের পর এক মানুষের কাছে আবির্ভূত হলেন, তখন যারা স্বচক্ষে তাঁকে দর্শন করেছিল বা তাঁর পুনরুত্থানের খবর শুনেছিল, তাদের অধিকাংশই তাদের মানসিকতা অস্বীকারের দিক থেকে ক্রমশ সংশয়বাদের দিকে সরিয়ে নিয়ে যায়। কেবল প্রভু যীশু যখন থোমাকে তাঁর পার্শ্বদেশে হাত রাখতে দেন, এবং তাঁর পুনরুত্থানের পর জনতার সামনে রুটি ছিঁড়ে মুখে তোলেন এবং তারপর তাদের সম্মুখে একটি ঝলসানো মাছ ভক্ষণ করতে উদ্যত হন, একমাত্র তখনই তারা যথার্থই এই সত্যকে স্বীকার করে নেয়, যে, প্রভু যীশু ছিলেন দেহরূপী খ্রীষ্ট। বলা যায়, সেই মানুষগুলির চোখের সামনে দণ্ডায়মান রক্ত-মাংসের এই আধ্যাত্মিক দেহ তাদের প্রত্যেককে যেন এক স্বপ্ন থেকে জাগিয়ে তুলছিল: তাদের সামনে দণ্ডায়মান মনুষ্যপুত্র ছিলেন স্মরণাতীত কাল থেকে অস্তিমান সেই একমেবাদ্বিতীয়ম। তাঁর একটি আকার ছিল, রক্ত-মাংসের শরীর ছিল, এবং তিনি ইতিপূর্বেই দীর্ঘদিন যাবৎ তিনি মানবজাতির পাশাপাশি বসবাস ও আহারবিহার করেছিলেন…। এই সময়, তাঁর অস্তিত্ব যে কত বাস্তব, আর তা যে কত অপরূপ, মানুষ তা অনুভব করলো। একই সঙ্গে, তারা হর্ষোৎফুল্ল ও সুখী এবং আবেগাপ্লুত হয়ে উঠলো। তাঁর পুনরাবির্ভাব মানুষকে সুযোগ দিল যথাযথভাবে তাঁর বিনয়কে প্রত্যক্ষ করার, মানবজাতির সঙ্গে তাঁর অন্তরঙ্গতা ও বন্ধনকে অনুভব করার, এবং তাদের বিষয়ে তিনি যে কত চিন্তাভাবনা করেছিলেন, তা অনুভব করার। প্রভু যীশুকে যারা প্রত্যক্ষ করেছিল, এই সংক্ষিপ্ত পুনর্মিলন তাদের অনুভব করিয়েছিল যেন পূর্ণ এক জীবৎকাল অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে। তাদের উদ্ভ্রান্ত, বিহ্বল, শঙ্কিত, উদ্বিগ্ন, আকুল ও অসাড় হৃদয়গুলি সান্ত্বনা খুঁজে পেয়েছিল। তারা আর সংশয়াকীর্ণ বা ভগ্নমনোরথ হয়ে রইলো না, কারণ তারা অনুভব করল যে, এখন একটা আশা আছে, ভরসা করার মতো কিছু একটা রয়েছে। তাদের সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা এই মনুষ্যপুত্র সর্বক্ষণ পশ্চাতে থেকে প্রহরীর মতো তাদের রক্ষা করবেন; শাশ্বতকাল ব্যাপী সুদৃঢ় দুর্গের মতো তিনি তাদের নিরাপত্তা দেবেন, হয়ে উঠবেন তাদের আশ্রয়স্থল।

প্রভু যীশু পুনরুত্থিত হয়েছিলেন বটে, তাঁর হৃদয় ও তাঁর কার্য মানবজাতিকে ত্যাগ করে নি। মানুষের সামনে আবির্ভূত হওয়ার মাধ্যমে, তিনি তাদের জানিয়েছিলেন যে, যেমন রূপেই তিনি অধিষ্ঠান করুন না কেন, সর্বকালে ও সর্বত্র তিনি তাদের সঙ্গ দেবেন, তাদের সঙ্গে পথ চলবেন, এবং তাদের সাথে থাকবেন। তিনি তাদের জানিয়েছিলেন যে, সর্বদা ও সর্বত্র মানবজাতিকে তিনি সংস্থান যুগিয়ে যাবেন ও তাদের পরিচালিত করবেন, তাঁকে দর্শন ও স্পর্শ করতে দেবেন, এবং নিশ্চিত করবেন যে, তারা যেন আর কখনো অসহায় বোধ না করে। প্রভু যীশু মানুষকে এটাও জানাতে চেয়েছিলেন যে, এই বিশ্বে তারা নিঃসঙ্গ হয়ে বসবাস করে না। মানবজাতির জন্য ঈশ্বরের তত্ত্বাবধান আছে; ঈশ্বর তাদের সঙ্গে রয়েছেন। সবসময়ই তারা ঈশ্বরের উপর নির্ভর করতে পারে, এবং তিনি হলেন তাঁর সকল অনুগামীর পরিজন। ভরসা করার জন্য ঈশ্বর আছেন বলে, মানবজাতি আর নিঃসঙ্গ বা অসহায় থাকবে না, এবং যারা তাঁকে পাপস্খালনের বলি হিসাবে স্বীকার করে নেবে, তারা পাপে আবদ্ধ রইবে না। মানুষের দৃষ্টিতে, তাঁর পুনরুত্থানের পর প্রভু যীশুর সম্পাদিত কার্যের এই অংশগুলি অতি নগণ্য বিষয়, কিন্তু আমার পরিপ্রেক্ষিত, তাঁর প্রতিটি কার্যই অত্যন্ত অর্থপূর্ণ, অতি মূল্যবান, অতীব গুরুত্বপূর্ণ এবং তাৎপর্যের ভারে ভরপুর।

যদিও প্রভু যীশুর দেহরূপে কার্য সম্পাদনের সময়কালটি দুঃখকষ্ট ও যন্ত্রণাভোগে পরিপূর্ণ ছিল, তবু তিনি তাঁর রক্ত-মাংসের আধ্যাত্মিক শরীরে আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে দেহরূপে তাঁর তৎকালীন মানবজাতিকে পুনরুদ্ধারের কার্য সম্পূর্ণ ও সুচারুরূপে নিষ্পন্ন করেছিলেন। অবতাররূপ ধারণের মাধ্যমে তিনি তাঁর সেবাব্রতের সূচনা করেছিলেন, এবং তাঁর স্থূলরূপে মানবজাতির কাছে আবির্ভূত হওয়ার মাধ্যমে তিনি তাঁর সেবাব্রতের সমাপ্তি ঘটিয়েছিলেন। তিনি অনুগ্রহের যুগের আগমন ঘোষণা করেছিলেন, তাঁর খ্রীষ্ট পরিচয়ের মাধ্যমে নবযুগের সূচনা ঘটিয়েছিলেন। তাঁর খ্রীষ্ট পরিচয়ের মাধ্যমেই, অনুগ্রহের যুগে তিনি কার্য নিষ্পন্ন করেছিলেন, এবং অনুগ্রহের যুগে তিনি তাঁর সকল অনুগামীকে শক্তিশালী ও পথনির্দেশ করেছিলেন। ঈশ্বরের কার্যের বিষয়ে এমন বলা যায় যে, যা তিনি শুরু করেন তা সত্যিই তিনি সমাপ্ত করেই ছাড়েন। তাতে পর্যায়সমূহ ও পরিকল্পনা রয়েছে, এবং এই কাজ তাঁর প্রজ্ঞা, তাঁর সর্বশক্তিমত্তা, তাঁর চমৎকার কীর্তিসমুদয়, এবং তাঁর প্রেম ও করুণায় পূর্ণ। নিশ্চিতভাবেই, ঈশ্বরের সকল কার্যের মধ্যে সঞ্চারমান মূল সূত্রটি হল মানবজাতির প্রতি তাঁর প্রযত্ন; এটি তাঁর উদ্বেগের অনুভূতিতে সম্পৃক্ত, যে অনুভূতিকে তিনি কখনো উপেক্ষা করতে পারেন না। বাইবেলের এই শ্লোকগুলির মধ্যে, পুনরুত্থানের পর প্রভু যীশুর সম্পাদিত প্রতিটি কাজের মধ্যে, মানবজাতির জন্য ঈশ্বরের অপরিবর্তনশীল আশা ও উদ্বেগ প্রকাশ পেয়েছিল, যেমন প্রকাশ পেয়েছিল মানবজাতির প্রতি তাঁর সযত্ন তত্ত্বাবধান ও সস্নেহ লালন। সেই শুরু থেকে আজ অবধি, এগুলির কোনোটিই কখনো বদলায় নি—তোমরা কি তা অনুভব করছো? যখন তোমরা তা অনুভব করো, তখন তোমাদের হৃদয় কি অচেতনভাবেই ঈশ্বরের সমীপবর্তী হয় না? তোমরা যদি সেই যুগে বাস করতে এবং প্রভু যীশু যদি তাঁর পুনরুত্থানের পর তোমাদের দৃষ্টিগোচর এক ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য রূপে তোমাদের সামনে আবির্ভূত হতেন, এবং তোমাদের সামনে বসে তিনি যদি রুটি ও মাছ ভক্ষণ করতেন, তোমাদের শাস্ত্রব্যাখ্যা শোনাতেন, এবং তোমাদের সাথে আলাপচারিতা করতেন, তখন তোমাদের কেমন অনুভূতি হতো? তোমরা কি উৎফুল্ল বোধ করতে? নাকি নিজেকে অপরাধী বলে মনে হতো? আগেকার ভ্রান্ত উপলব্ধি এবং ঈশ্বরকে এড়িয়ে যাওয়া, ঈশ্বরের সঙ্গে সংঘাত ও তাঁর বিষয়ে সংশয়—সবকিছুই কি একেবারে উবে যেতো না? ঈশ্বর ও মানুষের মধ্যে সম্পর্কটি কি তখন আরো স্বাভাবিক ও যথাযথ হয়ে উঠতো না?

বাইবেলের এই সীমিত কয়টি অধ্যায়ের ব্যাখ্যা করার মাধ্যমে, তোমরা কি ঈশ্বরের স্বভাবের মধ্যে কোনো ত্রুটি খুঁজে পেলে? তোমরা কি ঈশ্বরের ভালোবাসায় কোনো খাদ খুঁজে পাও? ঈশ্বরের সর্বশক্তিমত্তা বা প্রজ্ঞার মধ্যে তোমরা কি কোনো প্রতারণা বা মন্দ কোনোকিছু দেখতে পাও? নিশ্চিতভাবেই পাও না! এখন কি তোমরা নিঃসংশয়ে বলতে পারো যে ঈশ্বর পবিত্র? তোমরা কি নিশ্চিতভাবে বলতে পারো যে ঈশ্বরের প্রতিটি ভাবাবেগ হল তাঁর সারসত্য ও স্বভাবের এক উদ্ঘাটন? আমার আশা, এই বাক্যগুলি পাঠ করার পরে, সেগুলির থেকে যে উপলব্ধি তোমরা লাভ করবে তা তোমাদের সহায়তা দান করবে এবং তোমাদের স্বভাব-পরিবর্তন ও ঈশ্বর-ভীতির অন্বেষণে তা তোমাদের পক্ষে উপকারী হবে, এবং তোমাদের জন্য তা ফলদায়ী হবে, যে ফল নিয়ত বিকশিত হয়, যাতে, এই অন্বেষণ-প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, তোমরা ঈশ্বরের সন্নিকট থেকে সন্নিকটতর অবস্থানে নীত হবে, ঈশ্বর যে গুণমান দাবি করেন, তোমরা উত্তরোত্তর তার সমীপবর্তী হবে। সত্যের অন্বেষণে তোমরা আর ক্লান্ত বোধ করবে না, এবং সেটিকে তোমরা আর কখনো কোনো পীড়াদায়ক বা অপ্রয়োজনীয় বিষয় হিসাবে অনুভব করবে না। বরং, ঈশ্বরের প্রকৃত স্বভাব ও ঈশ্বরের পবিত্র সারসত্যের অভিব্যক্তির দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে, তোমরা আলোকের কামনা করবে, ন্যায়বিচারের কামনা করবে; সত্যান্বেষণের জন্য, ঈশ্বরের ইচ্ছা-পূরণের উদ্দেশ্যে, ক্রমাগত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার অভিকাঙ্ক্ষী হবে, এবং পরিণত হবে ঈশ্বরের দ্বারা অর্জিত এক ব্যক্তিতে, হয়ে উঠবে এক যথার্থ মানুষ।

অনুগ্রহের যুগে ঈশ্বরের প্রথমবার অবতাররূপ ধারণ করাকালীন তাঁর দ্বারা সম্পাদিত কিছু কার্যের বিষয়ে আজ আমরা আলোচনা করেছি। এই কার্যগুলি থেকে, দেহরূপে যে স্বভাব তিনি অভিব্যক্ত ও প্রকাশিত করেছিলেন, এবং তাঁর যা আছে ও তিনি যা, তা-র প্রতিটি দিক আমরা দর্শন করেছি। তাঁর যা আছে ও তিনি যা, তা-র এই সব দিকগুলি খুবই মনুষ্যোচিত বলে মনে হয়, কিন্তু বাস্তবে যা কিছু তিনি প্রকাশিত ও অভিব্যক্ত করেছিলেন, তার সারসত্য তাঁর নিজস্ব স্বভাবের থেকে অবিচ্ছেদ্য। ঈশ্বরের অবতারের যে পদ্ধতি ও যে দিকগুলি মানবদেহে তাঁর স্বভাবকে অভিব্যক্ত করে, সেগুলির প্রত্যেকটিই তাঁর নিজের সারসত্যের সাথে ওতপ্রোতভাবে সংযুক্ত ছিল। তাই, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা যে, অবতারত্বের পথ ধরে ঈশ্বর মানবজাতির কাছে এসেছিলেন। দেহরূপে যে কার্যগুলি তিনি সম্পাদন করেছিলেন সেগুলিও খুব গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু দেহের মধ্যে বাসরত প্রত্যেকটি মানুষের কাছে, ভ্রষ্টতার মধ্যে জীবনধারণরত প্রতিটি মানুষের কাছে, আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি হল তাঁর দ্বারা প্রকাশিত স্বভাব ও তাঁর দ্বারা অভিব্যক্ত ইচ্ছা। তোমরা কি এই বিষয়টি উপলব্ধি করতে সক্ষম? ঈশ্বরের স্বভাব এবং তাঁর যা আছে ও তিনি যা, তা উপলব্ধি করার পর, ঈশ্বরকে তোমাদের কেমনভাবে গ্রহণ করা উচিত, সে ব্যাপারে তোমরা কি কোনো সিদ্ধান্তে এসেছো? অবশেষে, এই প্রশ্নটির উত্তরে, আমি তোমাদের তিনখানি পরামর্শ দিতে চাই: প্রথমত, ঈশ্বরকে পরীক্ষা কোরো না। ঈশ্বরের বিষয়ে তুমি যতখানিই উপলব্ধি করে থাকো না কেন, তাঁর স্বভাবের বিষয়ে তুমি যতখানিই অবগত হও না কেন, কোনোক্রমেই তাঁকে পরীক্ষা করতে যেও না। দ্বিতীয়ত, মর্যাদার জন্য ঈশ্বরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা কোরো না। ঈশ্বর তোমাকে যে ধরনের পদমর্যাদাই প্রদান করুন না কেন বা তোমার উপর যে প্রকারের কাজের দায়িত্বই অর্পণ করুন না কেন, যে ধরনেরই কর্তব্য সম্পাদনের জন্য তিনি তোমার প্রতিপালন করুন না কেন, এবং ঈশ্বরের নিমিত্ত তুমি নিজেকে যতখানিই ব্যয় করো ও যতখানিই ত্যাগস্বীকার করো না কেন, পদমর্যাদার জন্য কোনোক্রমেই তাঁর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমো না। তৃতীয়ত, ঈশ্বরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা কোরো না। তোমাকে নিয়ে ঈশ্বর যা করেন, তোমার জন্য তিনি যাকিছুর আয়োজন করেন, এবং তোমার কাছে তিনি যা কিছু নিয়ে আসেন, সেগুলি তুমি উপলব্ধি করো বা না করো, অথবা সেগুলির প্রতি তুমি সমর্পিত হতে পারো বা না পারো তা নির্বিশেষে, কোনোক্রমেই ঈশ্বরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হোয়ো না। এই তিনটে পরামর্শ মেনে চলতে পারলেই তুমি যথেষ্ট নিরাপদ থাকবে, এবং তোমার মধ্যে ঈশ্বরকে রাগান্বিত করে তোলার প্রবণতা থাকবে না। এখানেই আমরা আজকের আলাপ-আলোচনা সমাপ্ত করবো।

নভেম্বর ২৩, ২০১৩

পাদটীকা:

ক. “বন্ধনী শক্ত করা মন্ত্র” হচ্ছে চীনাভাষার উপন্যাস “পশ্চিমের পথে যাত্রা”-তে ভিক্ষু তাং সানজাং এর ব্যবহৃত একটি মন্ত্র। সান উকং কে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এই মন্ত্র তিনি ব্যবহার করেন, তার মাথার চারিদিকে একটি ধাতব পাত মন্ত্রের দ্বারা শক্ত করে তাকে প্রচণ্ড শিরঃপীড়া দিয়ে, এবং এইভাবে তাকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসে। মানুষকে বেঁধে রাখে এরকম কোনো বস্তুকে বর্ণনা করার জন্য এটা একটা রূপকে পরিণত হয়েছে।

পূর্ববর্তী: ঈশ্বরের কর্ম, ঈশ্বরের স্বভাব এবং স্বয়ং ঈশ্বর ২

পরবর্তী: স্বয়ং অনন্য ঈশ্বর ১

প্রতিদিন আমাদের কাছে 24 ঘণ্টা বা 1440 মিনিট সময় থাকে। আপনি কি ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভের জন্য তাঁর বাক্য শিখতে 10 মিনিট সময় দিতে ইচ্ছুক? শিখতে আমাদের ফেলোশিপে যোগ দিন। কোন ফি লাগবে না।

সেটিংস

  • লেখা
  • থিমগুলি

ঘন রং

থিমগুলি

ফন্টগুলি

ফন্ট সাইজ

লাইনের মধ্যে ব্যবধান

লাইনের মধ্যে ব্যবধান

পৃষ্ঠার প্রস্থ

বিষয়বস্তু

অনুসন্ধান করুন

  • এই লেখাটি অনুসন্ধান করুন
  • এই বইটি অনুসন্ধান করুন

Messenger-এর মাধ্যমে আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন