ঈশ্বরের কর্ম, ঈশ্বরের স্বভাব এবং স্বয়ং ঈশ্বর ২
শেষ সাক্ষাতের সময় আমরা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়ে আলোচনা করেছিলাম। তোমাদের মনে আছে সেটা কী ছিল? আমি আবার সেটার পুনরাবৃত্তি করছি। আমাদের শেষ আলোচনার বিষয় ছিল: ঈশ্বরের কাজ, ঈশ্বরের স্বভাব ও স্বয়ং ঈশ্বর। এই বিষয়টা কি তোমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ? এর কোন অংশটা তোমাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ? ঈশ্বরের কাজ, ঈশ্বরের স্বভাব, না কি স্বয়ং ঈশ্বর? এর কোনটায় তোমরা সবচেয়ে বেশি আগ্রহী? তোমরা কোন অংশটা সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি শুনতে চাও? আমি জানি তোমাদের পক্ষে এই প্রশ্নের জবাব দেওয়া কঠিন, কারণ ঈশ্বরের কাজের প্রতিটি দিকেই তাঁর স্বভাব প্রত্যক্ষ করা সম্ভব, আর সর্বদা সর্বত্র তাঁর কাজের মধ্যেই তাঁর স্বভাব প্রকাশিত হয়, আর তার ফলস্বরূপ, স্বয়ং ঈশ্বরকে প্রতিভাত করে; ঈশ্বরের সামগ্রিক পরিচালনামূলক পরিকল্পনায়, ঈশ্বরের কাজ, তাঁর স্বভাব, এবং স্বয়ং ঈশ্বর, সবগুলোই একে অপরের সাথে অবিচ্ছেদ্য।
ঈশ্বরের কাজ সম্পর্কে আমাদের শেষ যে আলোচনা হয়েছিল, তার বিষয়বস্তু ছিল বাইবেলে উল্লিখিত বহুকাল আগে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনার বিবরণ। সেগুলো সবই ছিল মানুষ ও ঈশ্বর সম্পর্কিত কাহিনী, মানুষের সাথে যা ঘটেছিল সেই সংক্রান্ত বিষয়, আবার এর মধ্যে ঈশ্বরের অংশগ্রহণ এবং বহিঃপ্রকাশের বিষয়ও জড়িত ছিল, সুতরাং ঈশ্বরকে জানার বিষয়ে এই কাহিনীগুলোর নির্দিষ্ট মূল্য ও তাৎপর্য রয়েছে। মানবজাতিকে সৃষ্টি করার ঠিক পরেই, ঈশ্বর মানুষের সাথে জড়িত হতে ও তাদের সাথে কথা বলতে শুরু করেছিলেন, এবং তাঁর স্বভাবও মানুষের কাছে প্রকাশিত হতে শুরু করেছিল। অন্য ভাষায়, ঈশ্বর যখন থেকে মানবজাতির সাথে প্রথম জড়িত হয়েছিলেন, তখন থেকেই তিনি কোনো বিঘ্ন ছাড়াই মানুষের কাছে তাঁর সারসত্য, তাঁর যা আছে ও তিনি যা, তা প্রকাশ করা শুরু করেছিলেন। অতীতের মানুষ বা বর্তমানের মানুষ প্রত্যক্ষ বা উপলব্ধি করতে সক্ষম কি না, তা নির্বিশেষেই ঈশ্বর মানুষের সাথে কথা বলেন ও তাদের মাঝে কাজ করেন, এর মাধ্যমে তাঁর স্বভাব প্রকাশ করেন ও তাঁর সারসত্য অভিব্যক্ত করেন—এটা সত্য, এবং কোনো মানুষের পক্ষেই তা অস্বীকার করা সম্ভব নয়। এর থেকে এটাও বোঝা যায় যে ঈশ্বর যতই মানুষের সাথে কাজ করেন ও জড়িত হন, ততই তাঁর স্বভাব, তাঁর সারসত্য, তাঁর যা আছে এবং তিনি যা, এই বিষয়গুলো প্রতিনিয়ত উন্মুক্ত ও প্রকাশিত হতে থাকে। তিনি মানুষের থেকে কখনোই কিছু লুকিয়ে রাখেননি বা আড়াল করে রাখেননি, পরিবর্তে কোনোকিছু ধরে না রেখেই সর্বসমক্ষে তাঁর নিজের স্বভাব প্রকাশ করেছেন। এইভাবে, ঈশ্বর প্রত্যাশা করেন যে মানুষ তাঁকে জানতে সক্ষম হবে এবং তাঁর স্বভাব ও সারসত্য উপলব্ধি করতে পারবে। তিনি চান না যে তাঁর স্বভাব ও সারসত্যকে মানুষ চিরকালীন রহস্য বলে মনে করুক, আবার তেমনই এটাও চান না যে মানুষ ঈশ্বরকে একটা প্রহেলিকার মতো গণ্য করুক কখনো যার সমাধান করা যাবে না। শুধুমাত্র যখন মানবজাতি ঈশ্বরকে জানতে পারবে, তখনই মানুষ সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথের বিষয়ে জানবে এবং তাঁর নির্দেশনা গ্রহণ করতে পারবে, এবং শুধুমাত্র এই ধরনের মানবজাতিই ঈশ্বরের রাজত্বে প্রকৃতপক্ষে জীবনযাপনে সক্ষম হতে পারে এবং তাঁর আশীর্বাদ সহযোগে আলোর মধ্যে বাস করতে পারে।
যেসব বাক্য ও স্বভাব ঈশ্বরের কাছ থেকে নির্গত ও প্রকাশিত হয় সেগুলোই তাঁর ইচ্ছাকে উপস্থাপিত করে, এবং সেগুলো তাঁর সারসত্যকেও উপস্থাপিত করে। যখন ঈশ্বর মানুষের সাথে জড়িত হন, তখন তিনি যা-ই বলুন বা করুন, অথবা নিজের যেমন স্বভাবই প্রকাশ করুন, ঈশ্বরের সারসত্য এবং তাঁর যা আছে ও তিনি যা, এই বিষয়গুলোকে মানুষ যেভাবেই দেখুক না কেন, এগুলো সবই মানুষের জন্য ঈশ্বরের ইচ্ছাকে উপস্থাপিত করে। মানুষ কতটা উপলব্ধি করতে পারে, আত্মস্থ করতে পারে বা বুঝতে পারে সেসব নির্বিশেষে, এগুলো সবই উপস্থাপিত করে ঈশ্বরের ইচ্ছাকে—মানুষের জন্য ঈশ্বরের ইচ্ছাকে। এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই! মানবজাতির প্রতি ঈশ্বর যে ইচ্ছা পোষণ করেন তার মধ্যে রয়েছে মানুষ কেমন হবে, তারা কী করবে, কীভাবে জীবনযাপন করবে এবং তাঁর ইচ্ছাপূরণ করার জন্য কীভাবে সক্ষম হবে—এইসমস্ত বিষয়ে তিনি কী চান। এই বিষয়গুলো কি ঈশ্বরের সারসত্যের থেকে অবিচ্ছেদ্য? অন্য ভাষায়, ঈশ্বর যখন মানুষের কাছ থেকে তাঁর চাহিদা প্রকাশ করেন, সেই সময়েই তাঁর স্বভাব এবং তাঁর যা কিছু আছে, সেসবও প্রকাশ করেন। এতে কোনো মিথ্যা নেই, কোনো ভান নেই, কোনো গোপনীয়তা নেই এবং কোনো অলঙ্করণ নেই। তবুও মানুষ কেন ঈশ্বরের স্বভাব জানতে অক্ষম, কেনই বা কখনো তা স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করতে পারেনি? মানুষ কখনো ঈশ্বরের ইচ্ছা উপলব্ধি করতে পারেনি কেন? ঈশ্বরের দ্বারা যা উন্মুক্ত ও প্রকাশিত হয়েছে সেটাই স্বয়ং ঈশ্বরের যা আছে ও তিনি যা; এটাই তাঁর প্রকৃত স্বভাবের প্রতিটি পরত এবং দিক—তাহলে মানুষ তা প্রত্যক্ষ করতে পারে না কেন? কেন মানুষ পুঙ্খানুপুঙ্খ জ্ঞান আহরণে অক্ষম? এর একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে। তাহলে কী সেই কারণ? সৃষ্টির সময় থেকেই, মানুষ ঈশ্বরকে কখনোই ঈশ্বর তুল্য মর্যাদা দেয় নি। প্রাচীনতম কালে, ঈশ্বর মানুষের জন্য যা কিছু করেছিলেন তা নির্বিশেষে—যে মানুষ সবেমাত্র সৃষ্টি হয়েছে—সেই মানুষ ঈশ্বরকে একজন সঙ্গীর চেয়ে বেশি কিছু মনে করেনি, এমন কেউ যার ওপর নির্ভর করা যায়, এবং মানুষের ঈশ্বরের বিষয়ে কোনো জ্ঞান বা উপলব্ধি ছিল না। অর্থাৎ বলা যায়, মানুষ জানতো না যে এই সত্তা—যে সত্তার উপর সে নির্ভর করেছে ও যাকে তার সঙ্গী হিসাবে দেখেছে—সেই সত্তা যা প্রকাশ করছেন সেটাই ছিল ঈশ্বরের সারসত্য, আর সে এটাও জানতো না যে এই সত্তাই তিনি, যিনি সমস্তকিছুর উপর শাসন করেন। সহজভাবে বলা যায়, সেই সময়ের মানুষ ঈশ্বরকে বিন্দুমাত্র বুঝতেই পারে নি। তারা জানত না যে আকাশ, পৃথিবী এবং সমস্ত কিছু তিনিই তৈরী করেছেন, এবং তিনি কোথা থেকে এসেছেন ও তিনি কী, এই সমস্ত বিষয়ে তারা ছিল একেবারেই অজ্ঞ। অবশ্য সেই সময়ে ঈশ্বর চাননি যে মানুষ ঈশ্বরকে জানুক বা তাঁকে অনুধাবন করুক, অথবা তিনি যা কিছু করেছেন তা উপলব্ধি করুক, বা তাঁর ইচ্ছা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করুক, কারণ এগুলো ছিল মানবজাতির সৃষ্টির পরের প্রাচীনতম সময়। ঈশ্বর যখন বিধানের যুগের কাজের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেন, তখন তিনি মানুষের জন্য কিছু করেছিলেন এবং তাদের কাছে কিছু দাবি করাও শুরু করেছিলেন, কীভাবে ঈশ্বরের প্রতি উৎসর্গ নিবেদন করতে হবে এবং কীভাবে তাঁর উপাসনা করতে হবে, তা জানিয়েছিলেন। শুধুমাত্র তারপরেই মানুষ ঈশ্বর সম্পর্কে কিছু সহজ ধারণা অর্জন করেছিল, এবং শুধু তখনই সে জানতে পেরেছিল মানুষ ও ঈশ্বরের মধ্যে পার্থক্য, এবং জেনেছিল যে ঈশ্বরই মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন। মানুষ যখন জানতে পেরেছিল যে ঈশ্বর হলেন ঈশ্বর আর মানুষ হচ্ছে মানুষ, তখন তার ও ঈশ্বরের মাঝে একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব এসে গিয়েছিল, তবু ঈশ্বর তখনও বলেননি যে মানুষের কাছে তাঁর বিষয়ে বিশাল জ্ঞান বা গভীর উপলব্ধি থাকতে হবে। এইভাবে, ঈশ্বর তাঁর কাজের পর্যায় এবং পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে মানুষের থেকে বিভিন্ন চাহিদা পোষণ করেন। এর থেকে তোমরা কী দেখতে পাচ্ছ? ঈশ্বরের স্বভাবের কোন দিকটা তোমরা উপলব্ধি করতে পারছ? ঈশ্বর কি বাস্তব? মানুষের কাছ থেকে ঈশ্বরের যে চাহিদা তা কি যথাযথ? একেবারে শুরুর সময়ে, মানবজাতিকে সৃষ্টি করার পরে, যে সময়ে মানুষের উপর ঈশ্বরের বিজয়ের কাজ এবং মানুষকে নিখুঁত করে তোলার কাজ তখনও করা হয়নি, এবং তিনি তাদের উদ্দেশ্যে খুব বেশি বাক্য উচ্চারণ করেননি, সেই সময়ে মানুষের কাছ থেকে ঈশ্বরের দাবি ছিল সামান্যই। মানুষ কী করেছিল এবং কেমন আচরণ করেছিল তা নির্বিশেষে—এমনকি যদি সে এমন কিছুও করে থাকে যা ঈশ্বরকে ক্ষুব্ধ করেছিল—ঈশ্বর সেই সবই ক্ষমা করে দিয়েছিলেন ও উপেক্ষা করেছিলেন। কারণ তিনি জানতেন তিনি মানুষকে কী দিয়েছেন ও তাদের মধ্যে কী রয়েছে, আর তাই তিনি জানতেন মানুষের কাছ থেকে কতদূর পর্যন্ত তাঁর দাবি করা উচিত। এমনকি যদিও সেই সময়ে তাঁর চাহিদার পরিমাণ নিতান্ত সামান্য ছিল, কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে তাঁর প্রকৃতি মহৎ ছিল না, বা তাঁর প্রজ্ঞা ও সর্বশক্তিমানতা শুধু শূন্যগর্ভ বাক্য ছিল। মানুষের কাছে ঈশ্বরের স্বভাব এবং স্বয়ং ঈশ্বরকে জানার একটাই পথ আছে: ঈশ্বরের ব্যবস্থাপনা ও মানবজাতির পরিত্রাণের কাজের পদক্ষেপ অনুসরণ করা, এবং মানবজাতির উদ্দেশ্যে ঈশ্বর যে বাক্য উচ্চারণ করেন তা স্বীকার করা। ঈশ্বরের যা আছে এবং তিনি যা, তা জানার পরে, এবং তাঁর প্রকৃতিকে জানার পরেও কি মানুষ ঈশ্বরকে তাঁর আসল ছবি দেখাতে বলবে? না, মানুষ তা বলবে না, এমনকি তা বলার সাহসটুকুও করবে না, কারণ ঈশ্বরের স্বভাব এবং তাঁর যা আছে ও তিনি যা, তা উপলব্ধি করার পরে, মানুষ ইতিমধ্যেই স্বয়ং সত্য ঈশ্বরকে ও তাঁর বাস্তব ছবিকে প্রত্যক্ষ করে ফেলবে। অনিবার্য পরিণাম এটাই।
ঈশ্বরের কাজ ও তাঁর পরিকল্পনা যখন অপ্রতিহত অগ্রগতি লাভ করলো, এবং ঈশ্বর যখন মানুষের সাথে রামধনুর চুক্তি স্থাপন করলেন এই প্রতীক হিসাবে যে তিনি আর কখনও বন্যার সাহায্যে পৃথিবীকে ধ্বংস করবেন না, তার পরে ঈশ্বর সেই মানুষদের অর্জন করার প্রভূত আকাঙ্ক্ষা অনুভব করলেন যারা তাঁর সাথে এক মন হতে পারবে। একইভাবে, তিনি সেই সব মানুষদের অর্জন করারও আশু ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন যারা পৃথিবীতে তাঁর ইচ্ছা পালন করতে পারবে, এবং তাছাড়াও, এমন এক দল মানুষকে অর্জন করতে চেয়েছিলেন যারা অন্ধকারের শক্তি থেকে মুক্ত হতে সক্ষম ও শয়তানের দ্বারা আবদ্ধ থাকবে না, এমন এক দল মানুষ যারা পৃথিবীতে তাঁর সাক্ষ্য দিতে সক্ষম। এই ধরনের এক দল লোককে অর্জনের ইচ্ছা ঈশ্বরের দীর্ঘদিনের, সৃষ্টির সময় থেকেই তিনি এটার অপেক্ষা করছিলেন। অর্থাৎ, বন্যা ব্যবহার করে ঈশ্বরের পৃথিবীকে ধ্বংস করা, অথবা মানুষের সাথে তাঁর সম্পাদিত চুক্তি নির্বিশেষে, ঈশ্বরের ইচ্ছা, মনের গঠন, পরিকল্পনা, ও আশা, সব একই রয়ে গিয়েছিল। ঈশ্বর যা করতে চেয়েছিলেন, সৃষ্টির বহু আগে থেকেই তিনি যা আকাঙ্ক্ষা করেছিলেন, তা ছিল মানবজাতির মধ্যে থেকে যাদের তিনি অর্জন করতে চেয়েছিলেন তাদের অর্জন করা—এমন এক দল মানুষকে অর্জন করা, যারা তাঁর স্বভাব উপলব্ধি ও অনুধাবন করতে পারবে এবং তাঁর ইচ্ছা উপলব্ধি করতে পারবে, এমন এক দল মানুষ যারা তাঁর উপাসনা করতে পারবে। এমন একদল মানুষ প্রকৃতপক্ষেই তাঁর সাক্ষ্য দিতে পারবে, এবং বলা যায় যে তারা তাঁর অন্তরঙ্গ হয়ে উঠবে।
আজ, চলো আমরা ঈশ্বরের পদাঙ্ক পুনরায় অনুসন্ধান করার এবং তাঁর কাজের ধাপ অনুসরণ করার কাজ চালিয়ে যাই, যাতে আমরা ঈশ্বর সম্পর্কিত মতামত ও ধারণাগুলোকে অনাবৃত করতে পারি, ঈশ্বরের বিষয়ে বিভিন্ন রকমের সমস্ত বিশদ বিবরণ, যেগুলো দীর্ঘকাল “অবরুদ্ধ” করে রাখা হয়েছে, সেগুলো উন্মোচন করতে পারি। এই বিষয়গুলোর মাধ্যমে আমরা জানতে পারবো ঈশ্বরের স্বভাব, উপলব্ধি করতে পারবো তাঁর নির্যাস, নিজেদের অন্তরে ঈশ্বরকে প্রবেশ করতে দেবো, এবং আমরা প্রত্যেকেই ধীরে ধীরে ঈশ্বরের থেকে আমাদের দূরত্ব হ্রাস করে ক্রমে ঈশ্বরের ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠবো।
আমরা গতবারে যা আলোচনা করেছিলাম তার একটা অংশের বিষয় ছিল, ঈশ্বর কেন মানুষের সাথে চুক্তি স্থাপন করেছিলেন। এই বার আমরা শাস্ত্রের নিম্নলিখিত কয়েকটি অনুচ্ছেদের বিষয়ে আলোচনা করবো। চলো শাস্ত্রবাক্যের থেকে পাঠ করেই শুরু করা যাক।
ক. অব্রাহাম
১. ঈশ্বর অব্রাহামকে একটি পুত্রসন্তান প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেন
আদিপুস্তক ১৭:১৫-১৭ ঈশ্বর অব্রাহামকে আরও বললেন, তুমি তোমার স্ত্রী সারীকে আর সারী বলে ডাকবে না। তার নাম হবে সারা। আমি তাকে আশীর্বাদ করব, সে হবে বহুজাতির আদিমাতা এবং তার থেকে উৎপন্ন হবে প্রজাকুলের নৃপতিবৃন্দ। অব্রাহাম তখন উপুড় হয়ে প্রণিপাত করলেন ও হাসলেন। তিনি মনে মনে বললেন, একশো বছর বয়স যার, সেই বৃদ্ধের কি সন্তান হবে? নব্বই বছরের বৃদ্ধা সারা কি সন্তান প্রসব করবে?
আদিপুস্তক ১৭:২১-২২ কিন্তু আগামী বছর এই সময়ে সারার যে পুত্র জন্মগ্রহণ করবে, সেই ইস্হাকের সঙ্গেই আমি আবদ্ধ হব এই সন্ধি চুক্তিতে। কথা শেষ করে ঈশ্বর অব্রাহামের কাছ থেকে অন্তর্হিত হলেন।
ঈশ্বর যে কাজের বিষয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, কেউই তাতে বাধা সৃষ্টি করতে পারে না
তাহলে, তোমরা সকলে এইমাত্র অব্রাহামের কাহিনী শুনলে, তাই না? বন্যায় পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পরে ঈশ্বর তাকে নির্বাচন করেছিলেন, তার নাম ছিল অব্রাহাম, এবং যখন সে শতবর্ষীয় আর তার স্ত্রী সারা নব্বই বর্ষীয়, তখন সে ঈশ্বরের প্রতিশ্রুতি লাভ করে। ঈশ্বর তাঁকে কী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন? ঈশ্বরের সেই প্রতিশ্রুতি এই শাস্ত্রবাক্যে উল্লেখ করা আছে: “আমি তাকে আশীর্বাদ করব, সে হবে বহুজাতির আদিমাতা এবং তার থেকে উৎপন্ন হবে প্রজাকুলের নৃপতিবৃন্দ।” ঈশ্বরের তাকে পুত্র সন্তানের প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পটভূমি কী ছিল? শাস্ত্রবাক্যে সে বিষয়ে এই বিবরণ পাওয়া যায়: “অব্রাহাম তখন উপুড় হয়ে প্রণিপাত করলেন ও হাসলেন। তিনি মনে মনে বললেন, একশো বছর বয়স যার, সেই বৃদ্ধের কি সন্তান হবে? নব্বই বছরের বৃদ্ধা সারা কি সন্তান প্রসব করবে?” অন্য ভাষায়, এই বয়স্ক দম্পতি সন্তানধারণের পক্ষে খুবই প্রবীণ ছিল। আর ঈশ্বর যখন তাকে প্রতিশ্রুতি দিলেন, তখন অব্রাহাম কী করেছিল? সে হেসে লুটিয়ে পড়ে নিজেকে বলেছিল, “একশো বছর বয়স যার, সেই বৃদ্ধের কি সন্তান হবে?” অব্রাহাম মনে করেছিল এমনটা হওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়—অর্থাৎ সে ভেবেছিল ঈশ্বরের এই প্রতিশ্রুতি একটা রসিকতা ছাড়া আর কিছুই নয়। মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে এটা এমন কিছু যা মানুষের পক্ষে অর্জন করা অসম্ভব, এবং একইভাবে তা ঈশ্বরের পক্ষেও অনৰ্জনীয় ও অসাধ্য। সম্ভবত, অব্রাহামের কাছে এটা হাস্যকর বিষয় ছিল: “ঈশ্বর মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, তবুও তিনি মনে হয় কোনোভাবে জানেন না যে এত বয়স্ক কেউ সন্তান ধারণে অক্ষম; ঈশ্বর মনে করেন তিনি আমাকে সন্তান ধারণের অনুমতি দিতে পারেন, তিনি বলেছেন যে তিনি আমাকে একটা পুত্রসন্তান দেবেন—এটা নিশ্চিতভাবেই অসম্ভব!” তাই অব্রাহাম হেসে লুটিয়ে পড়েছিল, মনে মনে ভেবেছিল: “অসম্ভব—ঈশ্বর আমার সাথে তামাশা করছেন, এটা সত্যি হতেই পারে না!” সে ঈশ্বরের বাক্যকে গুরুত্ব দেয়নি। তাহলে, ঈশ্বরের দৃষ্টিতে অব্রাহাম কেমন মানুষ ছিল? (ধার্মিক।) সে একজন ধার্মিক মানুষ, এটা কোথায় বলা হয়েছিল? তোমরা ভাবো যে ঈশ্বর যাদের আহ্বান করেন তারা সকলেই ধার্মিক ও ত্রুটিমুক্ত, তারা সকলেই ঈশ্বরের সাথে চলার মতো মানুষ। তোমরা তত্ত্বকথা মেনে চলো! তোমাদের অবশ্যই স্পষ্টভাবে বুঝতে হবে যে ঈশ্বর যখন কাউকে সংজ্ঞায়িত করেন, তিনি নির্বিচারে তা করেন না। এখানে ঈশ্বর বলেননি যে অব্রাহাম ধার্মিক ছিল। ঈশ্বরের অন্তরে প্রত্যেক ব্যক্তিকে পরিমাপ করার মানদণ্ড রয়েছে। যদিও অব্রাহাম কী ধরনের মানুষ তা ঈশ্বর বলেননি, কিন্তু তার আচরণের উপর ভিত্তি করে, ঈশ্বরের উপর অব্রাহামের বিশ্বাস কেমন ছিল বলে মনে হয়? সামান্য বিমূর্ত ছিল? নাকি সে সুবিশাল বিশ্বাসী ছিল? না, তা নয়! তার হাসি ও চিন্তাভাবনাই তার স্বরূপ বুঝিয়ে দেয়, সুতরাং তাকে ধার্মিক বলে বিশ্বাস করাটা শুধুই তোমাদের কল্পনা, তত্ত্বকথার অন্ধ প্রয়োগ, এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন মূল্যায়ন। ঈশ্বর কি অব্রাহামের হাসি ও ছোট ছোট অভিব্যক্তিগুলো দেখেছিলেন? তিনি কি সেগুলোর সম্পর্কে জানতেন? হ্যাঁ জানতেন। কিন্তু তাতে কী ঈশ্বর তাঁর সঙ্কল্পে পরিবর্তন করেছিলেন? না! ঈশ্বর যখন পরিকল্পনা ও সংকল্প করেছিলেন যে তিনি এই ব্যক্তিকেই মনোনীত করবেন, তখনই তা সম্পন্ন হয়ে গিয়েছিল। মানুষের চিন্তাভাবনা বা আচরণ কোনোটাই ঈশ্বরকে প্রভাবিত করতে পারে না বা তাঁর বিষয়ে বিন্দুমাত্রও হস্তক্ষেপ করতে পারে না; ঈশ্বর নির্বিচারে তাঁর পরিকল্পনা বদলাবেন না, আবার মানুষের আচরণ যদি অজ্ঞতাপূর্ণও হয়, তাতেও সাময়িক আবেগের বশে ঈশ্বর তাঁর পরিকল্পনা বদলাবেন না বা বাতিল করবেন না। তাহলে আদিপুস্তক ১৭:২১-২২-এ কী লেখা আছে? “কিন্তু আগামী বছর এই সময়ে সারার যে পুত্র জন্মগ্রহণ করবে, সেই ইস্হাকের সঙ্গেই আমি আবদ্ধ হব এই সন্ধি চুক্তিতে। কথা শেষ করে ঈশ্বর অব্রাহামের কাছ থেকে অন্তর্হিত হলেন।” অব্রাহাম কী বলেছিল বা ভেবেছিল, সে বিষয়ে ঈশ্বর বিন্দুমাত্রও মনোযোগ দেননি। তাঁর এই উপেক্ষার কারণ কী? কারণ সেই সময়ে ঈশ্বর চাননি যে মানুষ সুবিশাল বিশ্বাসী হোক, বা ঈশ্বর সম্পর্কে তার সুবিশাল জ্ঞান থাকুক, অথবা ঈশ্বর কী করেছেন বা বলেছেন সে বিষয়ে উপলব্ধি করতে সক্ষম হোক। অর্থাৎ, তিনি কী করার সংকল্প করেছেন, কাদের বেছে নিতে তিনি বদ্ধপরিকর, অথবা তাঁর কাজের নীতি, এসব সম্পর্কে মানুষ উপলব্ধি করুক তা তিনি মানুষের কাছে আকাঙ্ক্ষা করেন নি, কারণ তখন মানুষের আত্মিক উচ্চতা ছিল নিতান্তই অপর্যাপ্ত। সেই সময়ে, অব্রাহাম যা করেছিল, যেভাবে আচরণ করেছিল, সবই ঈশ্বর স্বাভাবিক হিসাবেই গণ্য করেছিলেন। তিনি নিন্দা বা তিরস্কার করেননি, বরং শুধু বলেছিলেন: “আগামী বছর এই সময়ে সারার পুত্র ইস্হাক জন্মগ্রহণ করবে।” এই বাক্য ঘোষণা করার পরে ঈশ্বরের কাছে এই বিষয়টা ধাপে ধাপে সত্য হয়েছিল; ঈশ্বরের দৃষ্টিতে, তাঁর পরিকল্পনা অনুসারে যা সম্পন্ন হওয়ার ছিল, তা ইতিমধ্যেই অর্জিত হয়ে গিয়েছিল। এই বিষয়ের আয়োজন সমাপ্ত করার পরে ঈশ্বর বিদায় নিয়েছিলেন। মানুষ যা করে বা ভাবে, যা বোঝে, মানুষের পরিকল্পনা—এগুলোর কোনোটারই ঈশ্বরের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। ঈশ্বরের নির্ধারিত সময় ও পর্যায়ের সাথে সামঞ্জস্য রেখে, সবকিছুই ঈশ্বরের পরিকল্পনা অনুসারে চলে। ঈশ্বরের কাজের নীতি এমনই। মানুষ যা কিছু চিন্তা করে বা জানে তাতে ঈশ্বর হস্তক্ষেপ করেন না, আবার শুধুমাত্র মানুষ বিশ্বাস করে না বা বোঝে না বলে তিনি নিজের পরিকল্পনা ত্যাগ করেন না বা তাঁর কাজ থেকে বিরত থাকেন না। এইভাবে ঈশ্বরের পরিকল্পনা এবং চিন্তা অনুযায়ীই যে কোনো ঘটনা সম্পন্ন হয়। বাইবেলেও আমরা নির্দিষ্টভাবে ঠিক এটাই দেখতে পাই: ঈশ্বর তাঁর নির্ধারিত সময়েই ইস্হাকের জন্মগ্রহণ করিয়েছিলেন। এই ঘটনা কি প্রমাণ করে যে মানুষের ব্যবহার ও আচরণ ঈশ্বরের কাজে বাধা সৃষ্টি করেছিল? ঈশ্বরের কাজে এগুলো বাধা হয়ে দাঁড়ায় নি! ঈশ্বরের প্রতি মানুষের বিশ্বাসের স্বল্পতা, এবং ঈশ্বর সম্পর্কিত তার ধারণা ও কল্পনা কি ঈশ্বরের কাজকে প্রভাবিত করেছিল? না, তা করেনি! বিন্দুমাত্রও না! ঈশ্বরের পরিচালনামূলক পরিকল্পনা কোনো মানুষ, বস্তু বা পরিবেশের দ্বারা প্রভাবিত হয় না। তিনি যা সংকল্প করেন, তা নির্ধারিত সময়ে ও তাঁর পরিকল্পনা অনুসারেই সম্পন্ন হবে, আর তাঁর কাজে কোনো মানুষই হস্তক্ষেপ করতে পারে না। ঈশ্বর মানুষের মূর্খতা ও অজ্ঞতার কিছু নির্দিষ্ট বিষয় উপেক্ষা করেন, এমনকি তাঁর প্রতি মানুষের প্রতিরোধ ও পূর্বধারণার কিছু বিষয়ও উপেক্ষা করেন, এবং সেসব নির্বিশেষে তাঁর অবশ্য করণীয় কাজ সম্পাদন করেন। এটাই ঈশ্বরের স্বভাব, আর এটাই তাঁর সর্বশক্তিমানতার প্রতিফলন।
২. অব্রাহামের দ্বারা ইস্হাকের উৎসর্গ
আদিপুস্তক ২২:২-৩ ঈশ্বর বললেন, তোমার একমাত্র পুত্র ইস্হাক, যাকে তুমি ভালবাসো, তাকে নিয়ে তুমি মোরিয়া দেশে যাও এবং সেখানে যে পর্বতের কথা আমি বলব, সেই পর্বতের উপর তাকে বলিদান করে হোমানলে উৎসর্গ কর। অব্রাহাম ভোরে উঠে হোমের জন্য কাঠ কেটে গাধার পিঠে চাপালেন, দুই জন দাস এবং পুত্র ইস্হাককে সঙ্গে নিলেন এবং হোমের জন্য কাঠ চেরাই করলেন। তারপর ঈশ্বর যে স্থানের কথা তাঁকে বলেছিলেন সেই স্থান অভিমুখে যাত্রা করলেন।
আদিপুস্তক ২২:৯-১০ ঈশ্বর কর্তৃক নির্দিষ্ট স্থানে উপস্থিত হয়ে অব্রাহাম সেখানে একটি বেদী নির্মাণ করে তার উপরে কাঠ সাজালেন, তারপর তাঁর পুত্র ইস্হাককে বেঁধে বেদীর কাঠের উপর শুইয়ে দিলেন। তারপর তিনি তাকে বলি দেওয়ার উদ্দেশ্যে হাতে খড়্গ তুলে নিলেন।
অব্রাহামের দ্বারা ইসহাকের বলিপ্রদানই ঈশ্বরের দ্বারা মানবজাতির ব্যবস্থাপনা ও পরিত্রাণের কাজের সূচনা করেছিল
অব্রাহামকে পুত্রসন্তান দেওয়ার ফলে অব্রাহামের প্রতি ঈশ্বরের বাক্য পূরণ হয়েছিল। এর অর্থ এই নয় যে ঈশ্বরের পরিকল্পনা এখানেই থেমে গিয়েছিল; বরং ঠিক তার বিপরীতভাবে, মানবজাতির ব্যবস্থাপনা ও পরিত্রাণের জন্য ঈশ্বরের অভূতপূর্ব পরিকল্পনা সবেমাত্র শুরু হয়েছিল, এবং অব্রাহামকে পুত্রসন্তানের আশীর্বাদ ছিল তাঁর সামগ্রিক পরিচালনামূলক পরিকল্পনার ভূমিকা মাত্র। সেই মুহূর্তে, কে-ই বা জানত যে শয়তানের সাথে ঈশ্বরের যুদ্ধ তখনই নিঃশব্দে শুরু হয়ে গেছে যখন অব্রাহাম ইস্হাককে উৎসর্গ করেছিল?
মানুষ নির্বোধ হলেও ঈশ্বর পরোয়া করেন না—তিনি শুধু মানুষকে প্রকৃত হতে বলেন
এরপরে চলো দেখা যাক ঈশ্বর অব্রাহামের সাথে কী করেছিলেন। আদিপুস্তক ২২:২-এ ঈশ্বর অব্রাহামকে নিম্নলিখিত আদেশ দিয়েছিলেন: “তোমার একমাত্র পুত্র ইস্হাক, যাকে তুমি ভালবাসো, তাকে নিয়ে তুমি মোরিয়া দেশে যাও এবং সেখানে যে পর্বতের কথা আমি বলব, সেই পর্বতের উপর তাকে বলিদান করে হোমানলে উৎসর্গ কর।” ঈশ্বরের বাক্যের অর্থ ছিল সুস্পষ্ট: ঈশ্বর অব্রাহামকে বলেছিলেন তার একমাত্র পুত্র, যাকে সে ভালোবাসতো, সেই ইস্হাককে অগ্নিদগ্ধ বলি হিসাবে উৎসর্গ করতে। আজ এটার দিকে তাকালে, ঈশ্বরের আদেশ কি এখনও মানুষের পূর্বধারণার থেকে ভিন্ন? হ্যাঁ! সেই সময়ে ঈশ্বর যা করেছিলেন তা মানুষের পূর্বধারণার একেবারে বিপরীত; তা মানুষের বোধের অতীত। মানুষ তাদের পূর্বধারণা থেকে এরকম বিশ্বাস করে: যখন একজন বিশ্বাস করতে পারেনি, অসম্ভব বলে মনে করেছিল, তখন ঈশ্বর তাকে একটা পুত্রসন্তান দিয়েছিলেন, এবং সে পুত্র লাভ করার পর ঈশ্বর তাকে বলেছিলেন তার পুত্রকে বলি দিতে। এটা কি একেবারেই অবিশ্বাস্য নয়! ঈশ্বর আসলে কী করতে চেয়েছিলেন? ঈশ্বরের প্রকৃত অভিপ্রায় কী ছিল? তিনি নিঃশর্তে অব্রাহামকে একটা পুত্রসন্তান দিয়েছিলেন, আবার তিনি চেয়েছিলেন অব্রাহাম একটা নিঃশর্ত বলিদান করুক। এই চাহিদা কি অত্যধিক ছিল? তৃতীয় পক্ষের দৃষ্টিকোণ থেকে, এটা শুধুমাত্র অত্যধিকই নয়, বরং “অকারণে সমস্যা সৃষ্টি করার” মতো একটা ব্যাপার ছিল। কিন্তু অব্রাহামের নিজের মনে হয়নি যে ঈশ্বর খুব বেশি দাবি করছেন। যদিও এ বিষয়ে তার নিজস্ব কিছু ছোটখাট মতামত ছিল, এবং যদিও সে ঈশ্বরের প্রতি সন্দিহান ছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও সে বলিদান দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল। এইখানে, তুমি এমন কী দেখতে পাচ্ছ যা থেকে প্রমাণিত হয় যে অব্রাহাম তার পুত্রকে উৎসর্গ করতে ইচ্ছুক ছিল? এই বাক্যগুলোয় কী বলা হচ্ছে? মূল পাঠ্যে এই বর্ণনা পাওয়া যায়: “অব্রাহাম ভোরে উঠে হোমের জন্য কাঠ কেটে গাধার পিঠে চাপালেন, দুই জন দাস এবং পুত্র ইস্হাককে সঙ্গে নিলেন এবং হোমের জন্য কাঠ চেরাই করলেন। তারপর ঈশ্বর যে স্থানের কথা তাঁকে বলেছিলেন সেই স্থান অভিমুখে যাত্রা করলেন।” (আদিপুস্তক ২২:৩)। “ঈশ্বর কর্তৃক নির্দিষ্ট স্থানে উপস্থিত হয়ে অব্রাহাম সেখানে একটি বেদী নির্মাণ করে তার উপরে কাঠ সাজালেন, তারপর তাঁর পুত্র ইস্হাককে বেঁধে বেদীর কাঠের উপর শুইয়ে দিলেন। তারপর তিনি তাকে বলি দেওয়ার উদ্দেশ্যে হাতে খড়্গ তুলে নিলেন।” (আদিপুস্তক ২২:৯-১০)। যখন অব্রাহাম তার হাত বাড়িয়ে নিজের সন্তানের বলিদানের জন্য ছুরি হাতে নিয়েছিল, সেই কাজ কি ঈশ্বর প্রত্যক্ষ করেছিলেন? হ্যাঁ, করেছিলেন। এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া—শুরু থেকে, যখন ঈশ্বর অব্রাহামকে বলেছিলেন ইস্হাকের বলি দিতে, তখন থেকে যখন অব্রাহাম তার পুত্রকে বলি দেওয়ার জন্য সত্যিই ছুরি তুলে ধরেছিল—এই সম্পূর্ণ ঘটনা ঈশ্বরকে অব্রাহামের হৃদয়কে প্রদর্শিত করেছিল, আর ঈশ্বরের বিষয়ে তার আগের মূর্খতা, অজ্ঞতা ও ভুল বোঝাবুঝি নির্বিশেষে, সেই মুহূর্তে ঈশ্বরের প্রতি অব্রাহামের হৃদয় ছিল প্রকৃত ও সৎ, আর সে সত্যিই ইস্হাককে ফিরিয়ে দিতে যাচ্ছিল, যে পুত্র ঈশ্বর তাকে দিয়েছেন, তাকে আবার ঈশ্বরের কাছেই প্রত্যর্পণ করতে উদ্যত হয়েছিল। অব্রাহামের মধ্যে ঈশ্বর আনুগত্য দেখতে পেয়েছিলেন, ঠিক সেই আনুগত্য যা তিনি কামনা করেছিলেন।
ঈশ্বর এমন অনেক কিছুই করেন যা মানুষের কাছে বোধগম্য নয়, এমনকি বিশ্বাসযোগ্যও নয়। ঈশ্বর যখন কারোর সমন্বয়সাধন করতে চান, সেই সমন্বয়সাধন প্রায়ই মানুষের ধারণার বিপরীত এবং তা মানুষের বোধগম্যও নয়, তবুও নির্দিষ্টভাবে এই অসঙ্গতি এবং দুর্বোধ্যতাই মানুষের জন্য ঈশ্বরের বিচার ও পরীক্ষা। ইতিমধ্যে, অব্রাহাম নিজের মধ্যে ঈশ্বরের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়েছিল, যেটা ছিল ঈশ্বরের প্রয়োজনীয়তা পূরণে তার সক্ষম হওয়ার সবচেয়ে প্রাথমিক শর্ত। শুধুমাত্র যখন অব্রাহাম ঈশ্বরের চাহিদা মান্য করতে সক্ষম হয়েছিল, যখন সে ইস্হাককে উৎসর্গ করতে উদ্যত হয়েছিল, তখনই ঈশ্বর প্রকৃতপক্ষে আশ্বাস ও অনুমোদন অনুভব করেছিলেন মানবজাতির প্রতি—অব্রাহামের প্রতি, যাকে তিনি নির্বাচন করেছিলেন। শুধুমাত্র তখনই ঈশ্বর নিশ্চিত হয়েছিলেন যে তাঁর নির্বাচিত এই ব্যক্তিই তাঁর প্রতিশ্রুতি ও তাঁর পরবর্তীকালের পরিচালনামূলক পরিকল্পনা সম্পাদনের উপযোগী এক অপরিহার্য নেতা। এটা শুধু একটা বিচার ও পরীক্ষা হলেও ঈশ্বর এতে তৃপ্তি বোধ করেছিলেন, তিনি তাঁর জন্য মানুষের ভালোবাসা অনুভব করেছিলেন, এবং এর আগে কখনোই তিনি মানুষের কাছ থেকে এত স্বাচ্ছন্দ্য পাননি। যে মুহূর্তে অব্রাহাম ইস্হাককে হত্যা করার জন্য ছুরি হাতে নিয়েছিল, ঈশ্বর কি তাকে থামিয়েছিলেন? ঈশ্বর অব্রাহামকে ইস্হাকের বলি দিতে দেননি, কারণ ইস্হাকের প্রাণ নেওয়ার কোনো অভিপ্রায়ই তাঁর ছিল না। তাই ঈশ্বর একেবারে সঠিক সময়েই অব্রাহামকে থামিয়ে দিয়েছিলেন। ঈশ্বরের কাছে অব্রাহামের আনুগত্য ইতিমধ্যেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে গিয়েছিল, সে যেটুকু করেছিল সেটাই যথেষ্ট ছিল, সে যা করতে চেয়েছিল তার পরিণাম ঈশ্বর আগেই দেখে নিয়েছিলেন। এই পরিণাম কি ঈশ্বরের কাছে সন্তোষজনক ছিল? বলা যেতে পারে যে এই পরিণাম ঈশ্বরের কাছে সন্তোষজনক ছিল, ঈশ্বর এটাই চেয়েছিলেন, এটাই ঈশ্বর দেখার আকাঙ্ক্ষা করেছিলেন। একথা কি সত্যি? যদিও ভিন্ন ভিন্ন প্রসঙ্গে ঈশ্বর প্রত্যেক ব্যক্তিকে পরীক্ষার জন্য ভিন্ন উপায় ব্যবহার করেন, কিন্তু অব্রাহামের মধ্যে ঈশ্বর যা চেয়েছিলেন তা দেখতে পেয়েছিলেন, তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন যে অব্রাহামের হৃদয় প্রকৃত, তার আনুগত্য নিঃশর্ত। ঠিক এই “নিঃশর্ত” বিষয়টাই ঈশ্বরের আকাঙ্ক্ষিত। মানুষ প্রায়শই বলে, “আমি ইতিমধ্যে এটা উৎসর্গ করেছি, ইতিমধ্যেই ওটা ত্যাগ করেছি—ঈশ্বর তা সত্ত্বেও এখনও আমার প্রতি সন্তুষ্ট নন কেন? তিনি কেন বারবার আমার বিচার করে চলেছেন? তিনি কেন আমার পরীক্ষা নিয়ে চলেছেন?” এ থেকে একটা জিনিস বোঝা যায়: ঈশ্বর তোমার হৃদয় প্রত্যক্ষ করেননি এবং তোমার হৃদয় অর্জন করেননি। অর্থাৎ বলা হচ্ছে যে, অব্রাহাম যেমন নিজের হাতে তার পুত্রকে হত্যা করার জন্য এবং তাকে ঈশ্বরের কাছে উৎসর্গ করার জন্য ছুরি তুলে নিয়েছিল, সেই রকম আন্তরিকতা ঈশ্বর তোমার মধ্যে প্রত্যক্ষ করেননি। তিনি তোমার নিঃশর্ত আনুগত্য দেখেন নি, এবং তোমার কাছ থেকে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেননি। তাহলে এটাই স্বাভাবিক যে ঈশ্বর তোমার পরীক্ষা নিতেই থাকবেন। তাই নয় কি? এই বিষয়টা আমরা এখানেই ছেড়ে দেব। এরপর আমরা পড়ব “অব্রাহামকে ঈশ্বরের প্রতিশ্রুতি।”
৩. অব্রাহামকে ঈশ্বরের প্রতিশ্রুতি
আদিপুস্তক ২২:১৬-১৮ যিহোবা বললেন, তুমি যেহেতু এমন কাজ করেছ, তোমার একমাত্র পুত্রকে উৎসর্গ করতেও অস্বীকার করোনি, তাই আমি আমার নিজের নামে শপথ করেছি: আমি নিশ্চয়ই তোমাকে প্রচুর বর দান করব। আকাশের নক্ষত্ররাজি ও সমুদ্রতটের বালুকারাশির মত আমি তোমার বংশবৃদ্ধি করব। তোমার বংশধরেরা শত্রুদের পুরী অধিকার করবে। আর তোমার বংশজদের মাধ্যমে পৃথিবীর সকল জাতি আশীর্বাদলাভ করবে। আমি তোমার জন্য এসব করব কারণ তুমি আমার আদেশ মান্য করেছ।
এটা অব্রাহামের প্রতি ঈশ্বরের আশীর্বাদের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ। সংক্ষিপ্ত হলেও এর বিষয়বস্তু বেশ সমৃদ্ধ: এর মধ্যে অব্রাহামকে ঈশ্বরের উপহার দেওয়ার কারণ, পটভূমি এবং তিনি অব্রাহামকে কী দিয়েছিলেন, তার উল্লেখ রয়েছে। ঈশ্বর যে আনন্দ ও উত্তেজনার সাথে এই বাক্যগুলো উচ্চারণ করেছিলেন, ও সেইসাথে যারা তাঁর বাক্য শুনতে সক্ষম তাদের অর্জন করার জন্য ঈশ্বরের আকাঙ্ক্ষার তাগিদও এতে অনুভূত হয়। যারা ঈশ্বরের বাক্য মান্য করে চলে ও তাঁর আদেশ অনুসরণ করে, এমন মানুষের প্রতি ঈশ্বরের স্নেহ ও কোমলতা আমরা এর মধ্যে দেখতে পাই। একইভাবে, তিনি মানুষকে অর্জন করার জন্য যে মূল্য প্রদান করেন, এবং তাদের অর্জন করার জন্য তিনি যে যত্ন এবং চিন্তাভাবনা করেন, সেটাও আমরা এতে দেখতে পাই। এছাড়াও, “আমি আমার নিজের নামে শপথ করেছি,” এই বাক্যগুলো যে অনুচ্ছেদে আছে, তা আমাদের এ বিষয়েও জোরালো ধারণা দেয় যে ঈশ্বরের পরিচালনামূলক পরিকল্পনার এই কাজের নেপথ্যে ঈশ্বর, এবং ঈশ্বর একাই, কী পরিমাণ তিক্ততা ও যন্ত্রণা সহ্য করেছেন। এটা বেশ চিন্তাকে জাগিয়ে তোলার মতো অনুচ্ছেদ, এবং পরবর্তীকালে যারা এসেছিল তাদের ক্ষেত্রে এটা বিশেষ তাৎপর্য বহন করে, এবং তাদের উপরে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে।
মানুষ তার আন্তরিকতা ও আনুগত্যের কারণেই ঈশ্বরের আশীর্বাদ লাভ করে
অব্রাহামকে দেওয়া ঈশ্বরের যে আশীর্বাদের কথা আমরা এখানে পড়লাম, তা কি সুবিশাল কোনো আশীর্বাদ ছিল? সেটা ঠিক কতটা বিশাল ছিল? এখানে একটা মূল বাক্য রয়েছে: “আর তোমার বংশজদের মাধ্যমে পৃথিবীর সকল জাতি আশীর্বাদলাভ করবে।” এই বাক্য থেকেই বোঝা যায়, অব্রাহাম যে আশীর্বাদ লাভ করেছিল তা অতীত বা ভবিষ্যতের কাউকেই কখনো দেওয়া হয়নি। যখন ঈশ্বরের আদেশে অব্রাহাম তার নিজের একমাত্র পুত্র—তার আদরের একমাত্র পুত্রসন্তানকে ঈশ্বরের কাছে প্রত্যর্পণ করেছিল (মনে রাখবে, আমরা “উৎসর্গ” শব্দটা ব্যবহার করব না, বরং বলব সে ঈশ্বরের কাছে তার পুত্রকে প্রত্যর্পণ করেছিল), তখন ঈশ্বর যে শুধু অব্রাহামকে ইসহাকের বলি দিতে দেননি তা নয়, তিনি তাকে আশীর্বাদও করেছিলেন। তিনি অব্রাহামকে কোন প্রতিশ্রুতি দিয়ে আশীর্বাদ করেছিলেন? তিনি তার বংশধরের সংখ্যা বৃদ্ধি করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আশীর্বাদ করেছিলেন। এবং কোন হারে সেই বৃদ্ধি হবে? শাস্ত্রবাক্য অনুসারে নিম্নলিখিত বিবরণ পাওয়া যায়: “আকাশের নক্ষত্ররাজি ও সমূদ্রতটের বালুকারাশির মত আমি তোমার বংশবৃদ্ধি করব। তোমার বংশধরেরা শত্রুদের পুরী অধিকার করবে। আর তোমার বংশজদের মাধ্যমে পৃথিবীর সকল জাতি আশীর্বাদলাভ করবে।” কোন প্রসঙ্গে ঈশ্বর এই বাক্য উচ্চারণ করেছিলেন? অর্থাৎ, অব্রাহাম কীভাবে ঈশ্বরের আশীর্বাদ লাভ করেছিল? এই শাস্ত্রবাক্যে ঈশ্বর ঠিক যেভাবে বলেছেন, সেভাবেই সে এগুলো লাভ করেছিল: “কারণ তুমি আমার আদেশ মান্য করেছ।” অর্থাৎ, যেহেতু অব্রাহাম ঈশ্বরের আদেশ অনুসরণ করেছিল, যেহেতু ঈশ্বর যা বলেছিলেন ও আদেশ করেছিলেন সেই সমস্তকিছু সে সামান্যতম অভিযোগ না করেই পালন করেছিল, তাই ঈশ্বর তাঁকে এইরকম প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এই প্রতিশ্রুতির একটা গুরুত্বপূর্ণ বাক্য সেই সময় ঈশ্বরের চিন্তাকে স্পর্শ করেছিল। তোমরা কি সেটা দেখতে পেয়েছ? “আমি আমার নিজের নামে শপথ করেছি,” ঈশ্বরের এই বাক্যের প্রতি তোমরা হয়ত খুব বেশি মনোযোগ দাওনি। এই বাক্যের অর্থ, এই বাক্য উচ্চারণের সময় ঈশ্বর নিজের নামে শপথ নিচ্ছিলেন। শপথ নেওয়ার সময় মানুষ কার নামে শপথ নেয়? তারা স্বর্গের নামে শপথ নেয়, অর্থাৎ বলা যায় যে তারা ঈশ্বরের কাছে ও ঈশ্বরের নামে শপথ নেয়। ঈশ্বর নিজের নামে শপথ নিচ্ছেন, এই ঘটনার খুব বেশি উপলব্ধি লোকজনের মধ্যে হয়ত নেই, কিন্তু আমি সঠিক ব্যাখ্যা দিলে তোমরা সেটা উপলব্ধি করতে পারবে। ঈশ্বরের বাক্য শুধুমাত্র শুনতে পায় কিন্তু তাঁর হৃদয় উপলব্ধি করতে পারে না, এমন একজন ব্যক্তির সম্মুখীন হয়ে ঈশ্বর আরো একবার একাকী ও বিহ্বল অনুভব করেছিলেন। হতাশায়—এবং, বলা যেতে পারে, অবচেতনভাবে—ঈশ্বর খুব স্বাভাবিক কাজই করেছিলেন: অব্রাহামকে প্রতিশ্রুতি প্রদানের সময় ঈশ্বর নিজের হৃদয়ে হাত রেখে নিজেকে সম্বোধন করেছিলেন, এবং মানুষ তখন ঈশ্বরের কাছ থেকে এই বাক্য শুনতে পেয়েছিল, “আমি আমার নিজের নামে শপথ করেছি।” ঈশ্বরের কাজের মাধ্যমে তুমি নিজের কথা ভাবতে পারো। যখন তুমি নিজের হৃদয়ে হাত রেখে নিজের সাথে কথা বলো, তুমি কী বলছ সে বিষয়ে কি তোমার স্পষ্ট ধারণা থাকে? তোমার আচরণ কি আন্তরিক থাকে? তুমি কি অকপটে, মন থেকে, কথা বলো? এইভাবে, আমরা এখানে দেখতে পাই যে, অব্রাহামের সাথে কথা বলার সময় ঈশ্বর ছিলেন স্থিরসংকল্প এবং আন্তরিক। অব্রাহামের সাথে কথা বলার সময় এবং আশীর্বাদ প্রদানের সময়, ঈশ্বর নিজের সাথেও কথা বলছিলেন। তিনি নিজেকে বলছিলেন: আমি অব্রাহামকে আশীর্বাদ করব, এবং তার বংশধরদেরকে আকাশের তারার মতো অসংখ্য এবং সমুদ্রের তীরে বালির মতো প্রচুর করে তুলব, কারণ সে আমার কথা মান্য করেছে এবং সে-ই আমার নির্বাচিত ব্যক্তি। ঈশ্বর যখন বললেন “আমি আমার নিজের নামে শপথ করেছি,” তখন তিনি সংকল্প করেছিলেন যে অব্রাহামের মাধ্যমেই তিনি ইসরায়েলের নির্বাচিত ব্যক্তিদের তৈরি করবেন, যার পরে তিনি তাঁর কাজের গতির সাথে সাথে এই ব্যক্তিদের নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। অর্থাৎ, অব্রাহামের বংশধরদের মাধ্যমে ঈশ্বর তাঁর ব্যবস্থাপনার কাজ নির্বাহ করাবেন, এবং ঈশ্বরের কাজ এবং যা তিনি অভিব্যক্ত করেছেন তার সূচনা হবে অব্রাহামের মধ্যে দিয়ে এবং তা চালিত হবে অব্রাহামের বংশধরদের মধ্যে, এইভাবেই মানুষকে উদ্ধারের ঈশ্বরের ইচ্ছা বাস্তবায়িত হবে। এটা আশীর্বাদ কি না, তোমাদের কী অভিমত? মানুষের কাছে এটার থেকে বড় আশীর্বাদ আর কিছু নেই; বলা যায় যে এটাই সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ। অব্রাহামের অর্জিত আশীর্বাদটি তার বংশধরের সংখ্যাবৃদ্ধি নয়, বরং তা হচ্ছে ঈশ্বরের ব্যবস্থাপনা, ঈশ্বরের অর্পিত দায়িত্ব এবং অব্রাহামের বংশধরদের মধ্যে তাঁর কাজ—ঈশ্বরের এই সবকিছুর সম্পাদন। এর অর্থ হল, অব্রাহামের দ্বারা অর্জিত আশীর্বাদ ক্ষণস্থায়ী ছিল না, বরং তা ঈশ্বরের পরিচালনামূলক পরিকল্পনা অগ্রসর হওয়ার সাথে সাথেই অগ্রসর হয়েছিল। যখন ঈশ্বর কথা বলেছিলেন, যখন নিজের নামে শপথ নিয়েছিলেন, তখন ইতিমধ্যেই তিনি একটা সংকল্প তৈরি করে নিয়েছিলেন। এই সঙ্কল্পের প্রক্রিয়া কি প্রকৃত ছিল? তা কি বাস্তবিক ছিল? ঈশ্বর সংকল্প নিয়েছিলেন যে এর পর থেকে তাঁর প্রচেষ্টা, তাঁর প্রদত্ত মূল্য, তাঁর যা আছে ও তিনি যা, তাঁর সমস্তকিছু, এমনকি তাঁর জীবন, অব্রাহাম ও তার বংশধরদের প্রদান করা হবে। একইভাবে ঈশ্বর এটাও সংকল্প নিয়েছিলেন যে এই একদল মানুষের মধ্যে দিয়ে শুরু করে, তিনি তাঁর কর্ম প্রকাশিত করবেন, তাঁর প্রজ্ঞা, কর্তৃত্ব, ও ক্ষমতা মানুষকে প্রত্যক্ষ করতে দেবেন।
যারা ঈশ্বরকে জানে ও তাঁর সাক্ষ্য দিতে পারে, তাদের অর্জন করাই ঈশ্বরের অপরিবর্তনীয় অভিপ্রায়
নিজের সাথে কথা বলার সময়ই ঈশ্বর অব্রাহামের সাথেও কথা বলেছিলেন, কিন্তু ঈশ্বর প্রদত্ত আশীর্বাদের কথা শোনা ছাড়াও, অব্রাহাম কি ঈশ্বরের সমস্ত বাক্যের মধ্যে নিহিত থাকা প্রকৃত ইচ্ছা সেই মুহূর্তে উপলব্ধি করতে পেরেছিল? না সে পারে নি! তাই সেই মুহূর্তে, ঈশ্বর যখন নিজের নামে শপথ নিচ্ছিলেন, ঈশ্বরের অন্তর তখনও ছিল একাকী ও দুঃখিত। তখনও তাঁর অভিপ্রায় ও পরিকল্পনা উপলব্ধি করতে বা বুঝতে পারার মতো একজন ব্যক্তিও ছিল না। সেই মুহূর্তে, অব্রাহাম সমেত একজনও তাঁর সঙ্গে আত্মবিশ্বাসের সাথে কথা বলতে সক্ষম হয়নি, আর তাঁর অবশ্যকরণীয় কাজে তাঁর সহযোগিতা করতে পারে এমন ব্যক্তি তো একেবারেই ছিল না। আপাতভাবে, ঈশ্বর অব্রাহামকে অর্জন করেছিলেন, যে ছিল এমন একজন যে তাঁর বাক্য মান্য করতে পারে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, এই ব্যক্তির ঈশ্বর সম্পর্কিত জ্ঞান ছিল প্রায় না থাকারই মতো। এমনকি যদিও ঈশ্বর অব্রাহামকে আশীর্বাদ করেছিলেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও ঈশ্বরের হৃদয় সন্তুষ্ট ছিল না। ঈশ্বর সন্তুষ্ট ছিলেন না, একথার অর্থ কী? এর অর্থ হচ্ছে যে ঈশ্বরের ব্যবস্থাপনা সবেমাত্র শুরু হয়েছিল, এর অর্থ হল, তিনি যে মানুষদের অর্জন করতে চেয়েছেন, যাদের দেখার আকাঙ্ক্ষা করেছেন, যাদের ভালোবেসেছেন, তারা তখনও তাঁর থেকে অনেক দূরে ছিল; তাঁর প্রয়োজন ছিল সময়ের, তাঁর প্রয়োজন ছিল অপেক্ষা করার, তাঁর প্রয়োজন ছিল ধৈর্য্যশীল হওয়ার। কারণ সেই সময়ে স্বয়ং ঈশ্বর ব্যতীত আর কেউই জানত না তাঁর কী প্রয়োজন ছিল, তিনি কী অর্জন করতে চেয়েছিলেন, অথবা কীসের আকাঙ্ক্ষা করেছেন। সুতরাং, ঈশ্বর বেশ উত্তেজিত বোধ করার পাশাপাশি একইসাথে অন্তরে বেদনাহতও অনুভব করেছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি তাঁর পদক্ষেপ থামাননি, তাঁর অবশ্য করণীয় কাজের পরবর্তী ধাপের পরিকল্পনা তিনি চালিয়ে গেছেন।
অব্রাহামের প্রতি ঈশ্বরের প্রতিশ্রুতির মধ্যে তোমরা কী দেখতে পাও? ঈশ্বর অব্রাহামের উপর প্রভূত আশীর্বাদ বর্ষণ করেছিলেন শুধুমাত্র এই কারণে যে সে ঈশ্বরের বাক্য মান্য করেছিল। যদিও আপাতভাবে এটাকে স্বাভাবিক ও যুক্তিসঙ্গত বলে মনে হয়, কিন্তু এর মধ্যে আমরা ঈশ্বরের অন্তর দেখতে পাই: ঈশ্বর তাঁর প্রতি মানুষের আনুগত্যকে বিশেষভাবে মূল্য দেন, এবং তাঁর প্রতি মানুষের উপলব্ধি ও আন্তরিকতাকে লালন করেন। এই আন্তরিকতাকে ঈশ্বর কতটা লালন করেন? তিনি এটা কতখানি লালন করেন তা তোমরা হয়ত বুঝতে পারবে না, এবং হয়ত এমন কেউই নেই যে এটা উপলব্ধি করতে পারে। ঈশ্বর অব্রাহামকে একটা পুত্র সন্তান দিয়েছিলেন, এবং সেই পুত্র বড় হওয়ার পরে ঈশ্বর অব্রাহামকে সেই সন্তান ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে বলি দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। অব্রাহাম ঈশ্বরের আদেশ অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ করেছিল, সে ঈশ্বরের বাক্য মান্য করেছিল, এবং তাঁর আন্তরিকতা ঈশ্বরকে টলিয়ে দিয়েছিল আর এটাকে ঈশ্বর মূল্যবান হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। ঈশ্বর এটাকে কতখানি মূল্যবান মনে করেছিলেন? আর কেনই বা এত মূল্যবান মনে করেছিলেন? এমন একটা সময়ে যখন কেউই ঈশ্বরের বাক্য অনুধাবন করতে পারে নি, তাঁর হৃদয় উপলব্ধি করতে পারে নি, সেই সময় অব্রাহাম এমন কিছু করেছিল যা স্বর্গকে টলিয়ে দিয়েছিল, পৃথিবীতে কম্পন সৃষ্টি করেছিল, আর এটা ঈশ্বরকে সন্তুষ্টির অভূতপূর্ব অনুভূতি দান করেছিল, এবং ঈশ্বরের বাক্য মান্য করতে সক্ষম এমন একজনকে অর্জন করার আনন্দ তাঁকে এনে দিয়েছিল। এই সন্তুষ্টি ও আনন্দ এসেছিল একজন প্রাণীর কাছ থেকে যে ঈশ্বরের নিজের হাতে সৃষ্ট, এবং এটাই ঈশ্বরের কাছে মানুষের অর্পিত প্রথম “বলিদান”, মানুষকে সৃষ্টি করার পর যা ছিল ঈশ্বরের কাছে সবচেয়ে মূল্যবান। ঈশ্বরের পক্ষে এই বলিদানের জন্য অপেক্ষা করা কঠিন ছিল, এবং যাকে তিনি নিজে সৃষ্টি করেছেন, সেই মানুষের কাছ থেকে প্রথম সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপহার হিসাবে এই বলিদানকে তিনি বিবেচনা করেছিলেন। এটার মধ্যেই ঈশ্বর তাঁর প্রচেষ্টার ও তাঁর প্রদত্ত মূল্যের প্রথম ফল দেখতে পেয়েছিলেন, এবং এটার ফলেই তিনি মানবজাতির মধ্যে আশার আলো দেখতে পেয়েছিলেন। পরবর্তীকালে, এই ধরনের একদল মানুষের জন্য ঈশ্বর আরো বেশি আকাঙ্ক্ষা করেছিলেন তাঁকে সঙ্গে দেওয়ার জন্য, তাঁর সাথে আন্তরিক আচরণ করার জন্য, এবং আন্তরিকতার সঙ্গে তাঁর যত্ন করার জন্য। এমনকি ঈশ্বর এমন আশাও করেছিলেন যে অব্রাহাম যেন চিরকাল জীবিত থাকে, কারণ তিনি চেয়েছিলেন অব্রাহামের মতো একটা হৃদয় তাঁকে সঙ্গ দিক, এবং তাঁর ব্যবস্থাপনা চালিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর সাথে থাকুক। ঈশ্বর যেমনই আকাঙ্ক্ষা করুন না কেন, এটা শুধু একটা ইচ্ছা, একটা ধারণাই ছিল—কারণ অব্রাহাম ছিল শুধুই এমন একজন মানুষ যে তাঁকে মান্য করতে সক্ষম, ঈশ্বর সম্পর্কে তার বিন্দুমাত্র উপলব্ধি বা জ্ঞান ছিল না। ঈশ্বর মানুষের থেকে যে মান আশা করেন, অর্থাৎ ঈশ্বরকে জানা, তাঁর সাক্ষ্য দিতে সক্ষম হওয়া, এবং তাঁর সমমনস্ক হওয়া, সেই মানের থেকে অব্রাহাম ছিল সুদূরে। সুতরাং অব্রাহাম ঈশ্বরের সাথে চলতে পারে নি। অব্রাহাম কর্তৃক ইস্হাকের বলিদানের মধ্যে ঈশ্বর অব্রাহামের আন্তরিকতা ও আজ্ঞাকারিতা প্রত্যক্ষ করেছিলেন, আর দেখেছিলেন যে সে ঈশ্বরের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। যদিও ঈশ্বর তার আন্তরিকতা ও আনুগত্য গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু সে তবুও ঈশ্বরের সঙ্গী হওয়ার অনুপযুক্ত ছিল, অযোগ্য ছিল এমন একজন হয়ে উঠতে যে ঈশ্বরকে জানে ও বোঝে, এবং ঈশ্বরের প্রকৃতির বিষয়ে যার যথেষ্ট ধারণা আছে; ঈশ্বরের সাথে সমমনস্ক হয়ে ওঠা এবং ঈশ্বরের ইচ্ছা পালন করার থেকে সে অনেক দূরে ছিল। সুতরাং অন্তর থেকে ঈশ্বর তখনও একাকী ও উদ্বিগ্ন ছিলেন। ঈশ্বর যত বেশি একাকী এবং উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলেন, ততই তাঁর প্রয়োজন ছিল তাঁর ব্যবস্থাপনাকে যত দ্রুত সম্ভব চালিয়ে নিয়ে যাওয়া, এবং যত শীঘ্র সম্ভব তাঁর পরিচালনামূলক পরিকল্পনা সম্পন্ন করার জন্য ও তাঁর ইচ্ছা পূর্ণ করার জন্য উপযুক্ত একদল মানুষকে নির্বাচন ও তাদের অর্জন করতে সক্ষম হওয়া। এটাই ছিল ছিল ঈশ্বরের আন্তরিক আকাঙ্ক্ষা, এবং সূচনালগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত তা অপরিবর্তিত রয়েছে। সূচনালগ্নে মানুষকে সৃষ্টি করার সময় থেকেই, ঈশ্বর একদল বিজেতার আকাঙ্ক্ষা করেছেন, এমন এক দল যারা তাঁর সাথে চলবে এবং তাঁর স্বভাব বুঝতে, জানতে এবং উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে। ঈশ্বরের এই ইচ্ছা কখনও পরিবর্তিত হয় নি। তাঁকে এখনও যতই অপেক্ষা করতে হোক, সামনের রাস্তা যতই কঠিন হোক, এবং তাঁর আকাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য যত দূরেই থাকুক, ঈশ্বর মানুষের প্রতি তাঁর প্রত্যাশা কখনও পরিবর্তন করেননি বা ত্যাগ করেননি। এখন আমি এটা বলার পরে, তোমরা কি ঈশ্বরের ইচ্ছার কিছুটা উপলব্ধি করতে পারছ? সম্ভবত তোমাদের উপলব্ধি খুব একটা গভীর নয়—তবে তা ধীরে ধীরে গড়ে উঠবে!
অব্রাহাম যে সময়কালের মধ্যে জীবিত ছিল, সেই সময় ঈশ্বর একটি নগরকেও ধ্বংস করেছিলেন। সেই নগরের নাম ছিল সদোম। নিঃসন্দেহে অনেকেই সদোমের কাহিনী আগে শুনেছে, কিন্তু এই নগর ধ্বংসের অন্তরালে থাকা ঈশ্বরের কোন চিন্তাভাবনাগুলো এই ধ্বংসের পটভূমি তৈরি করেছিল, তা সকলেরই অজানা।
তাই আজ অব্রাহামের সাথে ঈশ্বরের নিম্নলিখিত কথোপকথনের মাধ্যমে, আমরা তাঁর সেই সময়কার চিন্তাভাবনার বিষয়ে জানব, তাঁর স্বভাব সম্পর্কেও জানব। এরপর, চলো শাস্ত্রের নিম্নলিখিত অনুচ্ছেদগুলো পড়া যাক।
খ. ঈশ্বর অবশ্যই সদোমকে ধ্বংস করবেন
আদিপুস্তক ১৮:২৬ এবং যিহোবা বললেন, আমি যদি সদোমে পঞ্চাশজন ধার্মিক ব্যক্তি দেখতে পাই, তাহলে তাদের জন্যই আমি সম্পূর্ণ স্থানটিকে অব্যাহতি দেব।
আদিপুস্তক ১৮:২৯ অব্রাহাম তাঁকে আবার বললেন, যদি সেখানে চল্লিশ জন পাওয়া যায় তাহলে? প্রভু বললেন, তাহলে সেই চল্লিশ জনের জন্য আমি সেই নগর ধ্বংস করব না।
আদিপুস্তক ১৮:৩০ তখন অব্রাহাম যিহোবাকে বলল, ধরুন যদি সেখানে ত্রিশ জন এমন লোক পাওয়া যায়? তিনি বললেন, তাহলে আমি এই কাজ করব না।
আদিপুস্তক ১৮:৩১ অব্রাহাম আবার বলল, ধরুন যদি সেখানে এমন কুড়িজন লোক থাকে? তিনি বললেন, তাহলে আমি এই নগর ধ্বংস করব না।
আদিপুস্তক ১৮:৩২ সে আবার বলল, ধরুন যদি সেখানে মাত্র দশজন এমন লোক থাকে? যিহোবা বললেন, তাহলেও আমি এটা ধ্বংস করব না।
এগুলো বাইবেল থেকে আমার বেছে নেওয়া কয়েকটা উদ্ধৃতি। এগুলো সম্পূর্ণ এবং মূল সংস্করণ নয়। তোমরা সেগুলো দেখতে চাইলে নিজে থেকে বাইবেলে সেগুলো দেখে নিতে পারো; সময় বাঁচানোর জন্য, আমি মূল বিষয়বস্তুর কিছু অংশ বাদ দিয়েছি। এখানে আমি শুধুমাত্র কয়েকটি মূল অনুচ্ছেদ ও বাক্যই বেছে নিয়েছি, অনেক বাক্য বাদ দিয়েছি যেগুলোর আমাদের আজকের আলোচনার উপর কোনো প্রভাব নেই। আমাদের আলোচিত সমস্ত অনুচ্ছেদ এবং বিষয়বস্তুতে আমরা কাহিনীর বিবরণ এবং এতে থাকা মানুষের আচরণের ওপর বেশি লক্ষ্য করি না; পরিবর্তে, আমরা শুধু সেই সময়ে ঈশ্বরের চিন্তাভাবনা ধারণা কেমন ছিল সেই সম্পর্কে কথা বলি। ঈশ্বরের চিন্তাভাবনা ও ধারণায়, আমরা ঈশ্বরের স্বভাব দেখতে পাবো, এবং ঈশ্বর যাকিছু করেছেন তা থেকে আমরা স্বয়ং সত্য ঈশ্বরকে দেখতে পাবো—এর মাধ্যমেই আমরা আমাদের উদ্দেশ্য পূরণ করব।
যারা ঈশ্বরের বাক্য মান্য করতে পারে ও তাঁর আদেশ অনুসরণ করতে পারে, ঈশ্বর শুধু তাদেরই খেয়াল রাখেন
উপরোক্ত অনুচ্ছেদে অনেক মূল শব্দ রয়েছে: যেমন সংখ্যা। প্রথমত, যিহোবা বলেছিলেন, নগরের মধ্যে পঞ্চাশজন ধার্মিক লোক খুঁজে পেলেই তিনি সম্পূর্ণ স্থানটাকে রেহাই দেবেন, অর্থাৎ তিনি নগরটা ধ্বংস করবেন না। তাহলে, প্রকৃতপক্ষে সদোমে কি পঞ্চাশজন ধার্মিক ব্যক্তি ছিল? না ছিল না। তার ঠিক পরেই অব্রাহাম ঈশ্বরকে কি বলেছিল? সে বলেছিল, ঘটনাচক্রে যদি চল্লিশজন এমন লোক পাওয়া যায়? এবং ঈশ্বর বলেছিলেন, আমি তাহলে এই কাজ থেকে বিরত থাকব। তারপর অব্রাহাম বলেছিল, ধরুন যদি ত্রিশজন এমন লোক পাওয়া যায়? এবং ঈশ্বর বলেছিলেন, আমি তাহলে এই কাজ করব না। এবং যদি কুড়িজনকে পাওয়া যায়? আমি তাহলে এই কাজ করব না। দশজন? তাহলেও আমি এ কাজ করব না। নগরের মধ্যে কি প্রকৃতপক্ষে দশজন ধার্মিক ব্যক্তি ছিল? দশজন ছিল না—কিন্তু একজন ছিল। আর সেই একজন কে ছিল? সে ছিল লোট। সেই সময়ে সদোমে মাত্র একজনই ধার্মিক ব্যক্তি ছিল, তবে ঈশ্বর কি এই সংখ্যার বিষয়ে খুব কঠোর বা অনমনীয় ছিলেন? না, তা ছিলেন না! আর তাই যখন মানুষ অবিরত জিজ্ঞাসা করে গিয়েছিল, “চল্লিশজন হলে কী হবে?” “ত্রিশজন হলে কী হবে?”, এইভাবে “দশজন হলে কী হবে?” এই প্রশ্ন উপস্থিত হলে ঈশ্বর বলেছিলেন, “সেখানে যদি শুধু দশজনও এমন লোক থাকে, তাহলেও আমি এই নগর ধ্বংস করব না; আমি এই নগরকে অব্যাহতি দেব, আর এই দশজনের পাশাপাশি বাকিদেরও ক্ষমা করে দেব।” যদি মাত্র দশজনও থাকত, তাহলেও তা যথেষ্ট দুঃখজনক ব্যাপার হতো, কিন্তু দেখা গেল যে সদোমে এমনকি ততজন ধার্মিকও ছিল না। তাহলে তোমরা দেখতে পাচ্ছ, ঈশ্বরের দৃষ্টিতে সেই নগরের মানুষদের পাপ ও মন্দ কর্মের মাত্রা এতটাই ছিল যে তাদের ধ্বংস করা ছাড়া ঈশ্বরের আর কোনো বিকল্প ছিল না। ঈশ্বর যখন বলেছিলেন যে পঞ্চাশজন ধার্মিক থাকলেই তিনি নগরটাকে ধ্বংস করবেন না, তখন তিনি কী বোঝাতে চেয়েছিলেন? এই সংখ্যা ঈশ্বরের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল এই নগরে ঈশ্বরের কাঙ্ক্ষিত ধার্মিক প্রকৃতির মানুষ আদৌ ছিল কি না। যদি নগরে একজনও ধার্মিক ব্যক্তি থাকত, তাহলেও ঈশ্বর তাঁর সেই নগর ধ্বংসের কারণে তাদের ক্ষতি হতে দিতেন না। এর অর্থ হল, ঈশ্বর এই নগরকে ধ্বংস করুন বা না করুন এবং সেখানে যতই ধার্মিক লোক থাকুক, তাঁর কাছে এই পাপপূর্ণ নগর ছিল অভিশপ্ত ও ঘৃণিত, এবং এই নগরের ধ্বংস হওয়া উচিত, তাঁর চোখের সামনে থেকে নিশ্চিহ্ন হওয়া উচিত, শুধু ধার্মিকদের রয়ে যাওয়া উচিত। যুগ নির্বিশেষে এবং মানবজাতির বিকাশের পর্যায় নির্বিশেষে, ঈশ্বরের মনোভাব অপরিবর্তিত থেকে যায়: তিনি মন্দকে ঘৃণা করেন এবং যারা তাঁর দৃষ্টিতে ধার্মিক তাদের বিষয়ে চিন্তা করেন। ঈশ্বরের এই স্পষ্ট মনোভাব ঈশ্বরের সারসত্যেরও প্রকৃত প্রকাশ। নগরের মধ্যে যেহেতু মাত্র একজন ছাড়া আর কেউ ধার্মিক ব্যক্তি ছিল না, তাই ঈশ্বর আর দ্বিধা করেননি। অনিবার্যভাবে সদোমের ধ্বংসসাধনই ছিল এর শেষ ফলাফল। এতে তোমরা কী প্রত্যক্ষ করলে? সেই যুগে, নগরের মধ্যে পঞ্চাশজন ধার্মিক ব্যক্তি থাকলে ঈশ্বর তা ধ্বংস করতেন না, এমনকি দশজন থাকলেও করতেন না, এর অর্থ হল ঈশ্বর মানবজাতিকে ক্ষমা করার সিদ্ধান্ত নিতেন ও তাদের প্রতি সহিষ্ণুতা দেখাতেন, অথবা তাদের পথনির্দেশ দেওয়ার কাজ করতেন, সেই অল্প কিছুসংখ্যক মানুষের জন্য যারা তাঁকে সম্মান করতে ও তাঁর উপাসনা করতে সক্ষম। মানুষের ধার্মিক কর্মের উপর ঈশ্বরের আস্থা সুবিশাল, যারা তাঁকে উপাসনা করতে সক্ষম ও তাঁর সম্মুখে ভালো কাজ করতে সক্ষম তাদের উপরেও তাঁর প্রভূত আস্থা।
প্রাচীনতমকাল থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত, কখনো কি তোমরা বাইবেলে পড়েছ যে ঈশ্বর কোনো মানুষের কাছে সত্য জ্ঞাপন করছেন, বা ঈশ্বরের পথের বিষয়ে কথা বলছেন? না, কখনোই না। মানুষের প্রতি ঈশ্বরের যে বাক্যগুলো আমরা পড়েছি, সেগুলোতে শুধুমাত্র বলা রয়েছে মানুষের কী করণীয়। কেউ কেউ এগিয়ে এসে সেই কাজ করেছিল, কেউ করেনি; কেউ বিশ্বাস করেছিল আবার কেউ করেনি। সেখানে যা ছিল তা শুধু এই। এইভাবে, সেই যুগের ধার্মিক ব্যক্তি—যারা ঈশ্বরের চোখে ধার্মিক ছিল—তারা ছিল শুধুমাত্র সেইসব মানুষ যারা ঈশ্বরের বাক্য শুনতে পারতো ও ঈশ্বরের আদেশ পালন করতে পারতো। তারা ছিল সেই সেবক যারা ঈশ্বরের বাক্য মানুষের মাঝে সম্পাদন করেছিল। এই রকম মানুষরা ঈশ্বরকে জানে, এমনটা কি বলা যায়? তাদের কি ঈশ্বরের দ্বারা নিখুঁত হয়ে ওঠা মানুষ হিসাবে গণ্য করা যায়? না, যায় না। সুতরাং তাদের সংখ্যা যতই হোক না কেন, ঈশ্বরের দৃষ্টিতে কি এরা ঈশ্বরের অন্তরঙ্গ বিবেচিত হওয়ার উপযোগী? এদের কি ঈশ্বরের সাক্ষী বলা যেতে পারে? অবশ্যই না! নিশ্চিতভাবেই তারা ঈশ্বরের অন্তরঙ্গ বা সাক্ষী বলে গণ্য হওয়ার মতো মূল্যবান নয়। তাহলে, ঈশ্বর এই মানুষদের কী বলে সম্বোধন করেছিলেন? বাইবেলের পুরাতন নিয়মে এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে যেখানে ঈশ্বর তাদের “আমার সেবক” বলে সম্বোধন করেছেন। অর্থাৎ সেই সময়ে, ঈশ্বরের দৃষ্টিতে এই ধার্মিক লোকেরা ছিল ঈশ্বরের সেবক, তারা ছিল সেইসব মানুষ যারা পৃথিবীতে তাঁর সেবা করেছিল। আর ঈশ্বর কীভাবে এই উপাধির বিষয়ে ভেবেছিলেন? তিনি তাদের এই নামে সম্বোধন করেছিলেন কেন? মানুষকে তিনি যে নামে ডাকেন, সেই উপাধি স্থির করার বিষয়ে ঈশ্বরের হৃদয়ে কি কোনো মানদণ্ড রয়েছে? অবশ্যই রয়েছে। ধার্মিক, নিখুঁত, ন্যায়পরায়ণ, বা সেবক—ঈশ্বর মানুষকে যে নামেই ডাকুন না কেন, তাঁর মানদণ্ড রয়েছে। যখন তিনি কাউকে নিজের সেবক বলে সম্বোধন করেন, তখন তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস থাকে যে এই ব্যক্তি তাঁর দূতদের গ্রহণ করতে সক্ষম, তাঁর আদেশ পালনে সক্ষম, এবং দূতদের প্রদত্ত আদেশ পালনে সক্ষম। এই ব্যক্তি কী সম্পাদন করে? ঈশ্বর মানুষকে যা করতে আদেশ করেন, পৃথিবীতে যা কিছু সম্পাদন করতে বলেন, তারা সেটা পালন করে। সেই সময়, ঈশ্বর মানুষকে যা করতে বলেছিলেন এবং যে কাজ পৃথিবীতে সম্পাদন করতে বলেছিলেন, সেটাকে কি ঈশ্বরের পথ বলা যেতে পারে? না, পারে না। কারণ সেই সময়ে, ঈশ্বর শুধু চেয়েছিলেন মানুষ যেন কয়েকটা সহজ কাজ করে; তিনি সহজ কয়েকটা আদেশ উচ্চারণ করেছিলেন, মানুষকে শুধু এটা ওটা করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন, এর থেকে বেশি কিছু নয়। ঈশ্বর তাঁর পরিকল্পনা অনুসারে কাজ করছিলেন। কারণ সেই সময়ে অনেক অবস্থার উপস্থিত হওয়া বাকি ছিল, উপযুক্ত সময় আসা বাকি ছিল, এবং মানুষের পক্ষে ঈশ্বরের পথ অবলম্বন করা কঠিন ছিল, ফলে ঈশ্বরের হৃদয় থেকে প্রকৃত পথ নির্গত হওয়া তখনও শুরু হয়নি। ঈশ্বর যে ধার্মিক ব্যক্তিদের কথা বলেছিলেন, যাদের আমরা এখানে দেখতে পাই—ত্রিশ হোক বা কুড়ি জন—তাদের তিনি তাঁর সেবক হিসাবে দেখতেন। ঈশ্বরের দূতরা এই ভৃত্যদের কাছে এলে তারা তাদের গ্রহণ করতে পারত, তাদের আদেশ অনুসরণ করতে পারত, এবং তাদের কথা অনুসারে কাজ করতে পারত। ঈশ্বরের দৃষ্টিতে যারা সেবক হিসাবে গণ্য হতো তাদের জন্য ঠিক এটাই ছিল করণীয় এবং অর্জনীয়। মানুষকে উপাধি প্রদানের বিষয়ে ঈশ্বর বিচক্ষণ। ঈশ্বর যে তাদের সেবক বলে সম্বোধন করেছিলেন তা এই জন্য নয় যে আজ তোমরা যেমন অবস্থায় রয়েছে তারা সেই অবস্থায় ছিল—এই জন্যও নয় যে তারা প্রচুর ধর্মপ্রচার শুনেছিল, অথবা তারা জানতো ঈশ্বর কী করতে চলেছেন, ঈশ্বরের ইচ্ছাকে অনেকটাই বুঝতে পারতো, এবং তাঁর পরিচালনামূলক পরিকল্পনাকে উপলব্ধি করতে পেরেছিল—বরং এইজন্য যে তাদের মানবিকতায় তারা ছিল সৎ, এবং তারা ঈশ্বরের বাক্যের সাথে সঙ্গত থাকতে সমর্থ ছিল; ঈশ্বর যখন তাদের আদেশ করতেন, তারা তাদের কাজ সরিয়ে রেখে ঈশ্বর যে আদেশ করেছেন তা নির্বাহ করতে সক্ষম ছিল। তাই ঈশ্বরের কাছে এই সেবক নামের অন্য আর একটা অর্থ হলো যে তারা পৃথিবীতে ঈশ্বরের কাজে সহায়তা করেছে, এবং যদিও তারা ঈশ্বরের দূত ছিল না, তবুও তারা পৃথিবীতে ঈশ্বরের বাক্যের সম্পাদনকারী ও প্রয়োগকর্তা ছিল। তাহলে তোমরা দেখতেই পাচ্ছ, এই সেবক বা ধার্মিক ব্যক্তিরা ঈশ্বরের অন্তরে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। পৃথিবীতে ঈশ্বরের যে কাজের সূচনা করার ছিল, তাঁর সাথে সহযোগিতা করার মতো লোক না থাকলে তা সম্ভব ছিল না, আর ঈশ্বরের সেবকরা যে ভূমিকা পালন করেছিল তা ঈশ্বরের দূতদের দ্বারা সম্পাদিত হওয়া সম্ভব ছিল না। ঈশ্বর এই সেবকদের যে সমস্ত কাজের আদেশ দিয়েছিলেন তার প্রতিটাই তাঁর কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল, আর তাই তাদের হারানো তাঁর পক্ষে কঠিন ছিল। ঈশ্বরের সাথে এই সেবকদের সহযোগিতা না থাকলে মানবজাতির মাঝে তাঁর কাজ স্থবির হয়ে পড়ত, ফলস্বরূপ ঈশ্বরের পরিচালনামূলক পরিকল্পনা ও তাঁর আশা নিষ্ফল হয়ে যেত।
ঈশ্বর যাদের খেয়াল রাখেন তাদের প্রতি তিনি অসীম করুণাময়, এবং যাদের তিনি ঘৃণা ও প্রত্যাখ্যান করেন তাদের প্রতি তিনি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ
বাইবেলের বর্ণনা অনুযায়ী, সদোমে কি ঈশ্বরের দশজনও সেবক ছিল? না, ছিল না! সেই নগর কি ঈশ্বরের কাছ থেকে অব্যাহতি পাওয়ার যোগ্য ছিল? সেই নগরের শুধু একজন ব্যক্তি—লোট—ঈশ্বরের দূতদের স্বাগত জানাতে পেরেছিল। এর মর্মার্থ হল, সেই নগরে ঈশ্বরের একজনই ভৃত্য ছিল, এবং তাই লোটকে বাঁচানো ও সদোম নগরকে ধ্বংস করা ছাড়া ঈশ্বরের আর কোনো বিকল্প ছিল না। অব্রাহাম এবং ঈশ্বরের মধ্যের কথোপকথন যে কথোপকথন উপরে উদ্ধৃত করা হয়েছে, তা আপাতভাবে সহজ মনে হলেও তা বেশ গভীর কিছু বিষয় তুলে ধরে, যেমন: ঈশ্বরের কর্মের নির্দিষ্ট কিছু নীতি রয়েছে, এবং কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তিনি দীর্ঘকাল পর্যবেক্ষণ ও চিন্তাভাবনা করবেন; সঠিক সময় হওয়ার আগে তিনি কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন না বা কোনো সিদ্ধান্তে হঠাৎ উপনীত হবেন না। অব্রাহাম এবং ঈশ্বরের মধ্যের কথোপকথন থেকে আমরা দেখতে পাই, ঈশ্বরের হাতে সদোমের ধ্বংস হওয়াটা বিন্দুমাত্রও ভুল ছিল না, কারণ ঈশ্বর ইতিমধ্যেই জানতেন সেই নগরে চল্লিশজন, ত্রিশজন, এমনকি কুড়িজন ধার্মিক লোকও নেই। এমনকি দশজনও ছিল না। সেই নগরের একমাত্র ধার্মিক ব্যক্তি ছিল লোট। সদোমে যা ঘটেছিল এবং সদোমের যা পরিস্থিতি ছিল তা ঈশ্বর লক্ষ্য করেছিলেন, আর সেগুলো ঈশ্বরের কাছে একেবারে তাঁর নিজের হাতের তালুর মতোই পরিচিত ছিল। সুতরাং, তাঁর সিদ্ধান্ত ভুল হতেই পারতো না। এর বিপরীতে, ঈশ্বরের সর্বশক্তিমানতার তুলনায় মানুষ কতই না অসাড়, নির্বোধ, অজ্ঞ, এবং কতই না অদূরদর্শী। আর এটাই আমরা অব্রাহাম ও ঈশ্বরের মধ্যের কথোপকথনে দেখতে পাই। ঈশ্বর সূচনালগ্ন থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত তাঁর স্বভাব প্রকাশিত করে চলেছেন। এখানেও একইভাবে, আমাদের ঈশ্বরের স্বভাবকেই দেখতে হবে। সংখ্যার বিষয়টা সহজ—এগুলোর আলাদা কোনো তাৎপর্য নেই—কিন্তু এখানে ঈশ্বরের স্বভাবের বেশ গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশ রয়েছে। পঞ্চাশজন ধার্মিক লোক থাকলে ঈশ্বর সেই নগরকে ধ্বংস করতেন না। এর কারণ কি ঈশ্বরের করুণা? তাঁর ভালোবাসা ও সহনশীলতা? তোমরা কি ঈশ্বরের স্বভাবের এই দিকটা প্রত্যক্ষ করেছ? এমনকি দশজন ধার্মিক ব্যক্তি থাকলেও ঈশ্বর সেই নগরকে ধ্বংস করতেন না, শুধু এই দশজন ধার্মিক ব্যক্তির কারণে। এটাই তো ঈশ্বরের ভালোবাসা ও সহনশীলতা, নাকি তা নয়? ধার্মিক ব্যক্তিদের প্রতি ঈশ্বরের করুণা, সহনশীলতা ও উদ্বেগের কারণে, তিনি এই নগর ধ্বংস করতেন না। এটাই ঈশ্বরের সহিষ্ণুতা। এবং পরিশেষে, আমরা কী পরিণতি দেখি? যখন অব্রাহাম বলেছিল, “যদি সেখানে মাত্র দশজন এমন লোক থাকে?” ঈশ্বর জবাব দিয়েছিলেন, “আমি এটা ধ্বংস করব না।” এরপরে অব্রাহাম আর কিছু বলে নি, কারণ সদোমে তার কথামতো দশজন ধার্মিক ব্যক্তিও ছিল না, আর তার বলার মতোও আর কিছু ছিল না, আর তখনই সে উপলব্ধি করেছিল ঈশ্বর কেন সদোমকে ধ্বংস করার জন্য বদ্ধপরিকর। এর মধ্যে তোমরা ঈশ্বরের কোন স্বভাব প্রত্যক্ষ করলে? ঈশ্বর কী ধরনের সংকল্প গ্রহণ করেছিলেন? ঈশ্বর সংকল্প করেছিলেন, যদি নগরে দশজনও ধার্মিক ব্যক্তি না থাকে, তাহলে তিনি এর অস্তিত্বের অনুমতি দেবেন না, এবং অনিবার্যভাবেই তা ধ্বংস করে দেবেন। এটাই কি ঈশ্বরের ক্রোধ নয়? এই ক্রোধ কি ঈশ্বরের স্বভাবকে উপস্থাপিত করে? এই স্বভাবই কি ঈশ্বরের পবিত্র সারসত্যের উদ্ঘাটন? এটাই কি ঈশ্বরের ধার্মিক সারসত্যের সেই উদ্ঘাটন, যা মানুষের লঙ্ঘন করা একেবারেই অনুচিত? সদোমে দশজনও ধার্মিক ব্যক্তি নেই, এটা নিশ্চিত হওয়ার পরে ঈশ্বর সংশয়মুক্ত হয়েছিলেন এই নগর ধ্বংস করার বিষয়ে এবং এই নগরের বাসিন্দাদের গুরুতর দণ্ড প্রদানের বিষয়ে, কারণ তারা ঈশ্বরের বিরোধিতা করেছিল, এবং তারা ছিল অত্যন্ত ঘৃণ্য ও দুর্নীতিগ্রস্ত।
আমরা এই অনুচ্ছেদগুলো এইভাবে বিশ্লেষণ করলাম কেন? কারণ এই কয়েকটি সহজ বাক্যই অপার করুণা ও গভীর ক্রোধ সমন্বিত ঈশ্বরের স্বভাবকে সম্পূর্ণভাবে ব্যক্ত করে। সদোমের ধার্মিকদের মূল্যবান জ্ঞান করা, ও তাদের প্রতি করুণা, সহিষ্ণুতা ও যত্ন প্রদর্শনের সাথে সাথে ঈশ্বরের হৃদয়ে ছিল সদোমের সমস্ত দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষদের প্রতি তীব্র ঘৃণা। এটাই তো অপার করুণা এবং গভীর ক্রোধ, তাই না? ঈশ্বর কোন উপায়ে এই নগর ধ্বংস করেছিলেন? অগ্নির দ্বারা। আর তিনি অগ্নির মাধ্যমেই এটা ধ্বংস করলেন কেন? যখন তুমি কিছু আগুনে পুড়ে যেতে দেখ, অথবা যখন তুমি কিছু একটা পুড়িয়ে দিতে চলেছ, সেটার প্রতি তোমার কী অনুভূতি হয়? তুমি কেন সেটা পুড়িয়ে ফেলতে চাও? তোমার কি মনে হয় যে তোমার আর এটার প্রয়োজন নেই, তুমি আর এটার দিকে তাকাতেও চাও না? তুমি এটাকে পরিত্যাগ করতে চাও? ঈশ্বরের এই অগ্নির ব্যবহারের অর্থ হচ্ছে পরিত্যাগ ও ঘৃণা, এবং তিনি আর সদোম নগরীকে দেখতে চান না। এই আবেগের কারণেই ঈশ্বর সদোমকে অগ্নির মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। আগুনের ব্যবহারেই বোঝা যাচ্ছে ঈশ্বর ঠিক কতখানি ক্রুদ্ধ ছিলেন। ঈশ্বরের করুণা ও সহনশীলতা অবশ্যই বর্তমান, কিন্তু ক্রোধ প্রকাশ করার সময়ে তাঁর পবিত্রতা ও ধার্মিকতা মানুষকে ঈশ্বরের সেই দিকটিও প্রদর্শন করে যেখানে কোনোরকম অপরাধ সহ্য করা হয় না। মানুষ যখন ঈশ্বরের আদেশ মান্য করতে সম্পূর্ণরূপে সক্ষম হয়, তাঁর চাহিদার সাথে সঙ্গতিপূর্ণভাবে কাজ করে, তখন ঈশ্বর মানুষের প্রতি তাঁর অপার করুণা বর্ষণ করেন; আবার মানুষ যখন দুর্নীতি, ঘৃণা, ও তাঁর প্রতি শত্রুতায় পূর্ণ হয়, তখন ঈশ্বর প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ হন। তাঁর এই প্রচণ্ড ক্রোধের মাত্রা কতটা? ঈশ্বরের এই ক্রোধ ততক্ষণ পর্যন্ত থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি মানুষের মধ্যে প্রতিরোধ ও মন্দকর্মের অবসান না দেখছেন, যতক্ষণ না এগুলো তাঁর চোখের সামনে থেকে অপসারিত হচ্ছে। শুধুমাত্র তখনই ঈশ্বরের ক্রোধের অবসান ঘটবে। অন্য ভাষায়, কোনো ব্যক্তি, সে যেই হোক না কেন, যদি তার হৃদয় ঈশ্বরের থেকে দূরে চলে গিয়ে থাকে ও তাঁর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে থাকে, কখনোই আর ফিরে না আসে, তাহলে বাহ্যিকভাবে বা তাদের অনুমাননির্ভর আকাঙ্ক্ষায়—যেরকমভাবেই তারা তাদের শরীর ও মনে ঈশ্বরের উপাসনা, অনুসরণ, ও মান্য করতে ইচ্ছা প্রকাশ করুক না কেন, ঈশ্বরের ক্রোধ অবিরাম অর্গলমুক্ত হতে থাকবে। মানুষকে যথেষ্ট সুযোগ দেওয়ার পরে, ঈশ্বর যখন সুতীব্রভাবে তাঁর ক্রোধ প্রকাশ করবেন, তখন তা আর ফিরিয়ে নেওয়ার কোনো উপায় থাকবে না, এবং তিনি এমন এক মানবজাতির প্রতি আর কখনোই করুণাময় ও সহিষ্ণু হবেন না। ঈশ্বরের স্বভাবের এটা এমন এক দিক যা কোনো অপরাধ বরদাস্ত করে না। এখানে, ঈশ্বরের দ্বারা নগরের ধ্বংসসাধনের বিষয়টা মানুষের কাছে স্বাভাবিক বলেই মনে হয়, কারণ, ঈশ্বরের দৃষ্টিতে পাপে পরিপূর্ণ একটা নগর বিদ্যমান বা অবশিষ্ট থাকতে পারে না, এবং ঈশ্বরের হাতে সেটার ধ্বংসসাধনই যুক্তিযুক্ত ছিল। তবুও তাঁর সদোম ধ্বংস করার আগে এবং পরের ঘটনা থেকে আমরা ঈশ্বরের স্বভাবের সামগ্রিকটা দেখতে পাই। সদয়, সুন্দর, ও ভালো সমস্তকিছুর প্রতি তিনি সহিষ্ণু ও করুণাময়; আবার মন্দ, পাপী, ও দুষ্ট সবকিছুর প্রতি তিনি অত্যন্ত ক্রোধপূর্ণ, এতটাই যে তাঁর সেই ক্রোধ অবিশ্রান্ত। এগুলো হল ঈশ্বরের স্বভাবের দুটি প্রধান এবং সবচেয়ে বিশিষ্ট দিক, এবং এগুলো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ঈশ্বরের দ্বারাই প্রকাশিত হয়েছে: অপার করুণা এবং সুতীব্র ক্রোধ। তোমাদের বেশিরভাগই ঈশ্বরের করুণার কিছুটা অভিজ্ঞতা লাভ করেছ, কিন্তু খুব কম জনই ঈশ্বরের ক্রোধ উপলব্ধি করেছ। ঈশ্বরের করুণা ও প্রেমময়তা প্রত্যেকের মধ্যেই দেখা যায়; অর্থাৎ, ঈশ্বর প্রত্যেকের প্রতিই অশেষ করুণাময়। তবুও খুব কম ক্ষেত্রেই—অথবা বলা যেতে পারে, কখনোই—তোমাদের মধ্যে কোনো ব্যক্তি বা তোমাদের মধ্যে কোনো একদল লোকের প্রতি ঈশ্বর গভীরভাবে রাগান্বিত হননি। চিন্তা কোরো না! আগে হোক বা পরে, ঈশ্বরের ক্রোধ প্রত্যেকেই দেখতে পাবে ও তার অভিজ্ঞতা লাভ করবে, কিন্তু এখনও সেই সময় আসে নি। এমনটা কেন? কারণ ঈশ্বর যখন কারোর প্রতি প্রতিনিয়ত ক্রুদ্ধ থাকেন, অর্থাৎ যখন তিনি তাদের উপর নিজের সুতীব্র ক্রোধের অর্গল মুক্ত করেন, তখন বুঝতে হবে যে সেই ব্যক্তির প্রতি তাঁর দীর্ঘদিনের ঘৃণা ও প্রত্যাখ্যানের মনোভাব ছিল, তিনি তাদের অস্তিত্বও ঘৃণা করেন, তাদের অস্তিত্ব আর তিনি সহ্য করতে পারেন না; আর তাঁর ক্রোধ তাদের উপর পড়লেই তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। বর্তমানে ঈশ্বরে কাজ এখনও সেই স্থানে পৌঁছয় নি। ঈশ্বর সুতীব্রভাবে ক্রোধান্বিত হলে তোমরা কেউই তা সহন করতে পারবে না। তাহলে তোমরা দেখতেই পাচ্ছ, এই সময়ে তোমাদের প্রতি ঈশ্বর শুধুমাত্র অপার করুণাময়, তাঁর সুতীব্র ক্রোধ এখনও তোমাদের দেখা বাকি। যদি তোমাদের মধ্যে কেউ এখনও নিশ্চিত না হয়ে থাকো, তাহলে তোমার উপর ঈশ্বরের ক্রোধ বর্ষিত হওয়ার প্রার্থনা করতে পারো, তাহলেই তুমি বুঝতে পারবে ঈশ্বরের ক্রোধ এবং মানুষের অপরাধ বরদাস্ত না করা তাঁর স্বভাব সত্যিই বিদ্যমান রয়েছে কি না। সে সাহস আছে তোমাদের?
অন্তিম সময়ের মানুষেরা শুধুমাত্র ঈশ্বরের বাক্যেই তাঁর ক্রোধ প্রত্যক্ষ করে, ঈশ্বরের ক্রোধের প্রকৃত অভিজ্ঞতা লাভ করে না
শাস্ত্রের এই অনুচ্ছেদগুলোর মধ্যে ঈশ্বরের স্বভাবের যে দুটো দিক আমরা প্রত্যক্ষ করলাম, তা কি আলোচনার যোগ্য? এই কাহিনী শুনে কি ঈশ্বর সম্পর্কে তোমাদের নতুন একটা উপলব্ধি হয়েছে? কী ধরনের উপলব্ধি হয়েছে তোমাদের? বলা যায়, সৃষ্টির লগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত, এই সর্বশেষ দলের মানুষদের মতো আর কোনো দলই ঈশ্বরের এত করুণা ও প্রেমপূর্ণ মহানুভবতা উপভোগ করেনি। যদিও এই চূড়ান্ত পর্যায়ে ঈশ্বর বিচার ও শাস্তির কাজ করেছেন এবং মহিমা ও ক্রোধ সহকারে তাঁর কাজ করেছেন, কিন্তু বেশিরভাগ সময়ে তাঁর কাজ সম্পন্ন করার জন্য ঈশ্বর শুধুমাত্র বাক্য ব্যবহার করেন; বাক্য ব্যবহার করেই তিনি শিক্ষা দেন ও সিঞ্চন করেন, সরবরাহ করেন ও আহারদান করেন। ইতিমধ্যে ঈশ্বরের ক্রোধ সর্বদা প্রচ্ছন্নই থেকে গেছে, আর ঈশ্বরের বাক্যের মাধ্যমে তাঁর ক্রোধের অভিজ্ঞতা লাভ করা ছাড়া, খুব স্বল্প সংখ্যক ব্যক্তিই ব্যক্তিগতভাবে তাঁর ক্রোধের অভিজ্ঞতা লাভ করেছে। অর্থাৎ বলা যায়, ঈশ্বরের বিচার ও শাস্তির কাজের সময়, যদিও ঈশ্বরের বাক্যে প্রকাশিত ক্রোধ থেকে মানুষ তাঁর মহিমা এবং অপরাধের প্রতি তাঁর অসহিষ্ণুতার মনোভাব অনুভব করতে পারে, কিন্তু ঈশ্বরের ক্রোধ তাঁর বাক্যের সীমা অতিক্রম করে যায় না। অন্য ভাষায়, ঈশ্বর বাক্যের মাধ্যমে মানুষকে তিরস্কার করেন, তাকে অনাবৃত করেন, তার বিচার করেন, তাকে শাস্তি দেন, এমনকি নিন্দাও করেন—কিন্তু ঈশ্বর এখনও মানুষের প্রতি তীব্রভাবে ক্রোধান্বিত হননি, এমনকি তাঁর বাক্য ছাড়া আর কোনোভাবেই মানুষের উপর তাঁর ক্রোধ বর্ষণ করেননি। এইভাবে, ঈশ্বরের যে করুণা ও প্রেমপূর্ণ মহানুভবতার অভিজ্ঞতা মানুষ এই যুগে লাভ করেছে, তা ঈশ্বরের প্রকৃত স্বভাবেরই প্রকাশ, এদিকে, মানুষ ঈশ্বরের যে ক্রোধ অনুভব করেছে তা শুধুমাত্র তাঁর কথনের স্বর ও অনুভূতির প্রভাব। অনেকেই এই প্রভাবকে ভুলবশত ঈশ্বরের ক্রোধের প্রকৃত অভিজ্ঞতা ও প্রকৃত জ্ঞান বলে ভেবে নেয়। ফলস্বরূপ, বেশিরভাগ মানুষই বিশ্বাস করে যে ঈশ্বরের বাক্যের মধ্যে তারা তাঁর করুণা ও প্রেমপূর্ণ মহানুভবতা প্রত্যক্ষ করেছে, মানুষের অপরাধের প্রতি ঈশ্বরের অসহিষ্ণুতাও তারা দেখেছে, এমনকি তাদের মধ্যে বেশিরভাগই মানুষের প্রতি ঈশ্বরের করুণা ও সহিষ্ণুতার স্তুতিও করেছে। তবে মানুষের আচরণ যত খারাপই হোক অথবা তার স্বভাব যত ভ্রষ্টই হোক না কেন, ঈশ্বর সর্বদাই তা সহ্য করেছেন। এই সহ্য করার মধ্যে ঈশ্বরের উদ্দেশ্য হলো, তিনি যে বাক্য বলেছেন, যে প্রচেষ্টা করেছেন, ও যে মূল্য প্রদান করেছেন, সেগুলোর প্রভাব তাদের উপর পড়ার জন্য অপেক্ষা করা, যাদের তিনি অর্জন করতে চান। এই ধরনের ফলাফলের জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়, এবং মানুষের জন্য বিভিন্ন ধরনের পরিবেশ সৃষ্টি করার প্রয়োজন হয়, ঠিক যেমন জন্মের পরেই মানুষ যেমন প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে যায় না; প্রাপ্তবয়স্ক হতে আঠারো বা উনিশ বছর সময় লাগে, কারোর ক্ষেত্রে আবার সত্যিকারের পরিণত অবস্থাপ্রাপ্ত হতে কুড়ি বা ত্রিশ বছরও সময় লেগে যায়। ঈশ্বর এই প্রক্রিয়ার সমাপ্তির জন্য অপেক্ষা করেন, এমন সময়ের আগমনের জন্যই অপেক্ষা করেন, এই ফলাফলের এসে পৌঁছনোর জন্য অপেক্ষা করেন। তাঁর এই অপেক্ষার সমস্ত সময়কালে, ঈশ্বর অপার করুণাময়। তবে, ঈশ্বরের কাজের সময়কালে, খুবই অল্প সংখ্যক লোককে আঘাত করা হয় এবং কিছুজন ঈশ্বরের বিরুদ্ধে গুরুতর বিরোধিতার কারণে শাস্তি পায়। এই ধরনের উদাহরণগুলো মানুষের অপরাধের প্রতি ঈশ্বরের অসহিষ্ণুতার স্বভাবের বৃহত্তর প্রমাণ, এবং নির্বাচিত মানুষদের প্রতি তাঁর সহিষ্ণুতা ও সহনশীলতার বাস্তব অস্তিত্বকে এগুলো সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিত করে। অবশ্যই, এইসব সাধারণ উদাহরণে, এই কয়েকটা বিচ্ছিন্ন উদাহরণে, এইসব মানুষদের মধ্যে ঈশ্বরের স্বভাবের যে আংশিক প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায়, তা তাঁর সামগ্রিক পরিচালনামূলক পরিকল্পনাকে প্রভাবিত করে না। প্রকৃতপক্ষে, কাজের এই চূড়ান্ত পর্যায়ে, ঈশ্বর তাঁর অপেক্ষার সম্পূর্ণ সময়কাল জুড়ে সহ্য করেছেন, এবং তাঁর অনুগামীদের পরিত্রাণের জন্য তিনি তাঁর সহনশীলতা ও তাঁর জীবন বিনিময় করেছেন। তোমরা তা দেখতে পাও? ঈশ্বর অকারণে তাঁর পরিকল্পনা ব্যাহত করেন না। তিনি তাঁর ক্রোধ বন্ধনমুক্ত করতে পারেন, এবং তিনি করুণাময়ও হতে পারেন; এটাই ঈশ্বরের স্বভাবের প্রধান দুই অংশের উদ্ঘাটন। এটা কি যথেষ্ট স্পষ্ট, নাকি নয়? অন্য ভাষায়, ঈশ্বরের বিষয়ে বলতে গেলে, ঠিক ও ভুল, ন্যায় ও অন্যায়, ইতিবাচক ও নেতিবাচক—সবই মানুষকে পরিষ্কারভাবে দেখানো হয়েছে। তিনি কী করবেন, তিনি কী পছন্দ করেন, কোনটা ঘৃণা করেন—সবই সরাসরি তাঁর স্বভাবে প্রতিভাত হয়। এই ধরনের বিষয়গুলো ঈশ্বরের কাজেও সুস্পষ্ট ও পরিষ্কারভাবে দেখা যায় আর সেগুলো অস্পষ্ট বা সাধারণ নয়; পরিবর্তে, এগুলোতে ঈশ্বরের স্বভাব, তাঁর যা আছে এবং তিনি যা, সেগুলো মানুষ বিশেষভাবে মূর্ত, সত্য এবং বাস্তবিক পদ্ধতিতে দেখতে পায়। এটাই স্বয়ং প্রকৃত ঈশ্বর।
ঈশ্বরের স্বভাব কখনোই মানুষের থেকে প্রচ্ছন্ন ছিল না—মানুষের হৃদয়ই ঈশ্বরের থেকে বিপথগামী ছিল
আমি যদি এইসমস্ত বিষয়ে আলোচনা না করতাম, তোমরা কেউই বাইবেলের এই কাহিনীগুলো থেকে ঈশ্বরের স্বভাব প্রত্যক্ষ করতে পারতে না। এটাই সত্যি। কারণ, যদিও বাইবেলের কাহিনীগুলোতে ঈশ্বরের কিছু কাজ নথিবদ্ধ আছে, কিন্তু সেখানে ঈশ্বরের বাক্য বেশ কম, এবং ঈশ্বর তাঁর স্বভাবের প্রত্যক্ষ পরিচয় প্রকাশ করেননি, এবং খোলাখুলিভাবে তাঁর ইচ্ছাও মানুষের কাছে প্রকাশ করেননি। পরবর্তী প্রজন্ম এই নথিবদ্ধ বিবরণকে কাহিনী ছাড়া আর কিছু মনে করেনি, আর তাই মানুষ মনে করে, ঈশ্বর নিজেকে মানুষের থেকে প্রচ্ছন্ন রাখেন এবং মানুষের কাছ থেকে যা গোপন আছে তা ঈশ্বরের ছবি নয়, বরং তাঁর স্বভাব ও ইচ্ছা। আমার আজকের আলোচনার পরে, তোমাদের কি এখনও মনে হয় যে ঈশ্বর মানুষের থেকে সম্পূর্ণ আড়ালে রয়েছেন? তোমরা কি এখনও ভাবো যে ঈশ্বরের স্বভাব মানুষের থেকে আড়ালে রয়েছে?
সৃষ্টির লগ্ন থেকে ঈশ্বরের স্বভাব তাঁর কাজের সাথে পা মিলিয়ে চলেছে। তা কখনোই মানুষের থেকে গোপন ছিল না, বরং সর্বসমক্ষে সম্পূর্ণ প্রকাশিত ও, মানুষের কাছে স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা ছিল। তবুও, সময় গড়িয়ে যাওয়ার সাথে সাথে মানুষের হৃদয় ঈশ্বরের থেকে ক্রমে দূরবর্তী হয়ে পড়েছে, আর মানুষের ভ্রষ্টাচার যত গভীরতর হয়েছে, মানুষ ও ঈশ্বর ততই পরস্পরের থেকে আরও দূরে সরে গেছে। ধীরে ধীরে কিন্তু নিশ্চিতভাবে, মানুষ ঈশ্বরের দৃষ্টি থেকে অদৃশ্য গিয়েছে। মানুষ ঈশ্বরকে “প্রত্যক্ষ” করতে অসমর্থ হয়ে উঠেছে, ফলে তার কাছে ঈশ্বরের বিষয়ে কোনো “সংবাদ” আর নেই; তাই সে জানে না ঈশ্বর আছেন কি না, এমনকি সে এতদূর এগিয়ে যায় যে ঈশ্বরের অস্তিত্বই সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করে। এর ফলে, ঈশ্বরের স্বভাব, এবং তাঁর যা আছে এবং তিনি যা, এই সমস্ত বিষয়ে মানুষের যে উপলব্ধির অভাব, তা ঈশ্বর প্রচ্ছন্ন রয়েছেন বলে হয়নি, বরং ঈশ্বরের থেকে তার হৃদয় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে বলেই হয়েছে। যদিও মানুষ ঈশ্বরে বিশ্বাস করে, কিন্তু তার হৃদয় ঈশ্বরবিহীন, আর ঈশ্বরকে কীভাবে ভালোবাসতে হয় সে বিষয়ে সে অজ্ঞ, এবং ঈশ্বরকে ভালোবাসতেও সে চায় না, কারণ তার হৃদয় কখনোই ঈশ্বরের ঘনিষ্ঠ হতে চায় না ও সর্বদাই ঈশ্বরকে পরিহার করে চলে। ফলস্বরূপ, মানুষের হৃদয় ঈশ্বরের থেকে দূরে চলে গেছে। তাহলে তার হৃদয় কোথায়? প্রকৃতপক্ষে, মানুষের হৃদয় কোথাও যায়নি: ঈশ্বরকে তার হৃদয় সমর্পণ না করে অথবা ঈশ্বরের দেখার জন্য তা প্রকাশ না করে মানুষ তার হৃদয়কে নিজের জন্যই রেখে দিয়েছে। তা সত্ত্বেও এমন ঘটনাও ঘটে যে কেউ কেউ প্রায়শই ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে, “হে ঈশ্বর, আমার হৃদয়ের প্রতি দৃষ্টিপাত করো—আমার সকল চিন্তাভাবনাই তোমার জানা,” আবার কেউ কেউ তো এমনকি তাদের প্রতি ঈশ্বরের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য শপথ গ্রহণ করে, যাতে শপথ ভঙ্গ করলে ঈশ্বর যেন তাদের শাস্তি দিতে পারেন। যদিও মানুষ ঈশ্বরকে নিজের অন্তঃস্থলে দৃষ্টিপাত করতে দেয়, কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে সে ঈশ্বরের সমন্বয়সাধন ও ব্যবস্থাপনা মান্য করতে সক্ষম, আবার তার অর্থ এটাও নয় যে সে তার নিজের ভাগ্য, ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও সমস্ত কিছু ঈশ্বরের নিয়ন্ত্রণে সঁপে দিয়েছে। তাই, ঈশ্বরের কাছে তুমি যে শপথ করো বা যা-ই ঘোষণা করো তা নির্বিশেষে ঈশ্বরের দৃষ্টিতে তোমার হৃদয় তাঁর প্রতি এখনও অবরুদ্ধ, কারণ তুমি ঈশ্বরকে শুধু তোমার হৃদয়ের প্রতি দৃষ্টিপাত করতে দাও, তা নিয়ন্ত্রণ করার অনুমতি দাও না। অন্য ভাষায়, তুমি তোমার হৃদয় ঈশ্বরকে একেবারেই সমর্পণ করোনি, ঈশ্বরের শোনার জন্য কিছু তুমি শুধু শ্রুতিমধুর কথা বলো মাত্র; এদিকে তুমি তোমার ষড়যন্ত্র, কূটকৌশল, ও কুপরিকল্পনা সহ বিভিন্ন রকমের প্রতারণামূলক উদ্দেশ্য ঈশ্বরের কাছ থেকে গোপন রাখো, এবং নিজের ভাগ্য ও নিয়তি নিজের হাতেই ধরে রাখো, গভীর ভয় পাও যে সেগুলো ঈশ্বর কেড়ে নেবেন। সুতরাং, ঈশ্বর কখনোই তাঁর প্রতি মানুষের আন্তরিকতা দেখতে পান না। যদিও মানুষের হৃদয়ের গভীর পর্যন্ত ঈশ্বর পর্যবেক্ষণ করতে পারেন, এবং মানুষ কী ভাবছে ও কী করতে চায় তা দেখতে পান, দেখতে পান তার হৃদয়ে কী রাখা আছে, দেখতে পান যে মানুষের হৃদয় ঈশ্বরের নয়, এবং সে ঈশ্বরকে তার হৃদয়ের নিয়ন্ত্রণ দেয়নি। অর্থাৎ বলা যায়, ঈশ্বর পর্যবেক্ষণ করার অধিকারী হলেও নিয়ন্ত্রণের অধিকার পাননি। মানুষের ব্যক্তিগত সচেতনতায় সে নিজেকে ঈশ্বরের ব্যবস্থাপনায় সঁপে দিতে চায় না, বা সেরকম কোনো উদ্দেশ্য তার নেই। মানুষ শুধু যে নিজেকে ঈশ্বরের কাছে রুদ্ধ করে রেখেছে তা-ই নয়, বরং এমন লোকও আছে যারা নিজেদের হৃদয় গুটিয়ে নেওয়ার উপায় চিন্তা করে, সুমধুর কথাবার্তা ও চাটুকারিতার মাধ্যমে মিথ্যা ধারণা তৈরি করে ঈশ্বরের আস্থা অর্জন করে এবং নিজেদের আসল চেহারা ঈশ্বরের দৃষ্টিসীমার বাইরে লুকিয়ে রাখে। ঈশ্বরকে দেখতে না দেওয়ার পিছনে তাদের উদ্দেশ্য হল, তারা ঠিক কেমন, তা তাঁকে বুঝতে না দেওয়া। তারা তাদের হৃদয় ঈশ্বরের কাছে সমর্পণ করতে চায় না, বরং নিজেদের কাছেই রেখে দিতে চায়। এর অন্তর্নিহিত অর্থ হল, মানুষ যা করে এবং সে যা চায় তা সবই তার পরিকল্পিত, হিসাব করা, এবং নিজের সিদ্ধান্ত প্রসূত; এজন্য তার ঈশ্বরের অংশগ্রহণ বা হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয় না, ঈশ্বরের সমন্বয়সাধন ও ব্যবস্থার প্রয়োজন তো আরোই নেই। অর্থাৎ, ঈশ্বরের আদেশ, তাঁর অর্পিত দায়িত্ব, বা ঈশ্বর মানুষের থেকে যা দাবি করেন, এর যেকোনো বিষয়েই মানুষ নিজের উদ্দেশ্য, অভিপ্রায়, সেই সময়কার অবস্থা ও পরিস্থিতির ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নেয়। মানুষ সর্বদা নিজের পরিচিত জ্ঞান ও অন্তর্দৃষ্টি এবং নিজের বুদ্ধিমত্তাকেই বিচারের কাজে ও কোন পথ বেছে নেওয়া উচিত সেই সিদ্ধান্ত নিতে কাজে লাগায়, এর মধ্যে ঈশ্বরকে হস্তক্ষেপ বা নিয়ন্ত্রণ করতে সে দেয় না। ঈশ্বর মানুষের যে হৃদয় প্রত্যক্ষ করেন, সেটা এমনই।
সূচনালগ্ন থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত, শুধু মানুষই ঈশ্বরের সাথে কথোপকথনে সক্ষম। অর্থাৎ, ঈশ্বরের সমস্ত সজীব বস্তু ও প্রাণীকূলের মধ্যে, মানুষ ছাড়া আর কেউই ঈশ্বরের সাথে কথোপকথনে সক্ষম নয়। মানুষের কান তাকে শোনার ক্ষমতা দেয়, চোখ তাকে দেখতে সক্ষম করে; তার রয়েছে নিজস্ব ভাষা, নিজস্ব ধারণা, ও স্বাধীন ইচ্ছা। ঈশ্বর যা কিছু বলেন তা শোনার জন্য, ঈশ্বরের ইচ্ছা উপলব্ধির জন্য, ও তাঁর অর্পিত দায়িত্ব গ্রহণের জন্য যা কিছু প্রয়োজন সবই মানুষের রয়েছে, আর তাই ঈশ্বর তাঁর সমস্ত ইচ্ছা মানুষের ওপর অর্পণ করেন, মানুষকে এমন এক সঙ্গী বানাতে চান যে তাঁর সমমনস্ক হবে ও তাঁর সাথে চলতে পারবে। যখন থেকে তিনি ব্যবস্থাপনার শুরু করেছেন, ঈশ্বর অপেক্ষা করে রয়েছেন কবে মানুষ তাঁকে হৃদয় সমর্পণ করবে, যাতে তিনি তাকে পরিশোধন ও প্রস্তুত করতে পারেন, তাকে ঈশ্বরের কাছে সন্তোষজনক ও প্রিয় করে তুলতে পারেন, তাকে ঈশ্বরকে সম্মান জ্ঞাপনে এবং মন্দ কর্ম পরিত্যাগে সক্ষম করতে পারেন। ঈশ্বর চিরকাল এই ফলাফলের প্রত্যাশা করেছেন ও এর জন্য অপেক্ষা করেছেন। বাইবেলের তথ্যের মধ্যে কি এই রকম কোনো মানুষ আছে? অর্থাৎ, ঈশ্বরকে হৃদয় সমর্পণ করতে পারে, এমন কারোর উল্লেখ কি বাইবেলে আছে? এই যুগের আগে কি এমন কোনো নজির আছে? আজ চলো আমরা বাইবেলের বিবরণ পড়তে থাকি আর এক নজরে দেখে নিই যে ইয়োব নামক এই চরিত্রটা যা করেছিল, তার সাথে আজকে আমরা যে বিষয়ে কথা বলছি, অর্থাৎ “ঈশ্বরের কাছে হৃদয় সমর্পণ করা”, তার কোনো যোগাযোগ আছে কি না। চলো দেখা যাক ইয়োব ঈশ্বরের কাছে সন্তোষজনক ছিল কি না এবং ঈশ্বর তাকে ভালোবাসতেন কি না।
ইয়োবের বিষয়ে তোমাদের ধারণা কেমন? মূল শাস্ত্র উদ্ধৃত করে কেউ কেউ বলে যে ইয়োব ঈশ্বরের পরমভক্ত, সৎ ও বিশ্বস্ত সেবক। মন্দের পথ তিনি পরিহার করে চলতেন। ঈশ্বরের পরমভক্ত, সৎ ও বিশ্বস্ত সেবক। “মন্দের পথ তিনি পরিহার করে চলতেন”: ইয়োব সম্পর্কে ঈশ্বরের মূল্যায়ন এমনই। নিজেদের ভাষায় বলতে গেলে তোমরা ইয়োবকে কীভাবে বর্ণনা করবে? কেউ কেউ বলে যে ইয়োব একজন ভালো এবং যৌক্তিকতাসম্পন্ন মানুষ ছিল, কিছু লোক বলে যে ঈশ্বরের প্রতি তার প্রকৃত বিশ্বাস ছিল, আবার কারো কারো মতে ইয়োব ছিল একজন ধার্মিক ও মানবিকতা সম্পন্ন মানুষ। তোমরা ইয়োবের বিশ্বাস দেখেছ, অর্থাৎ বলা যায়, নিজেদের হৃদয়ে তোমরা তাকে প্রভূত গুরুত্ব দাও এবং তার বিশ্বাসের বিষয়ে ঈর্ষাও বোধ করো। আজ তাহলে দেখা যাক, ইয়োব এমন কীসের অধিকারী ছিল যার জন্য ঈশ্বর তার প্রতি এত সন্তুষ্ট ছিলেন। তাহলে চলো, নিচের এই শাস্ত্র পড়া যাক।
গ. ইয়োব
১. ঈশ্বরের দ্বারা, এবং বাইবেলে, ইয়োবের মূল্যায়ন
ইয়োবে ১:১ উস দেশে ইয়োব নামে ব্যক্তি বাস করতেন। তিনি ছিলেন ঈশ্বরের পরমভক্ত, সৎ ও বিশ্বস্ত সেবক। মন্দের পথ তিনি পরিহার করে চলতেন।
ইয়োবে ১:৫ ভোজের পরের দিন ভোরে ইয়োব তাঁর পুত্রদের শুচীকরণের জন্য প্রত্যেকের নামে বলি উৎসর্গ করতেন কারণ তিনি মনে করতেন তাঁর পুত্রেরা হয়তো অনিচ্ছাকৃতভাবে ঈশ্বরকে অবজ্ঞা করে পাপ করে ফেলেছে।
ইয়োবে ১:৮ এবং যিহোবা শয়তানকে বললেন, তুমি কি আমার সেবক ইয়োবের কথা বিবেচনা করেছ, তার মত লোক পৃথিবীতে কেউ নেই, যে নিখুঁত এবং ন্যায়পরায়ণ, যে ঈশ্বরে ভয় পায় ও মন্দ পথ পরিত্যাগ করে?
এই অনুচ্ছেদগুলোতে তোমরা কী মূল বিষয় দেখতে পেলে? শাস্ত্রের এই তিনটে সংক্ষিপ্ত বর্ণনার সবকটাই ইয়োবের সাথে সম্পর্কিত। সংক্ষিপ্ত হলেও, এগুলো পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করে ইয়োব ঠিক কেমন ধরনের মানুষ ছিল। ইয়োবের দৈনন্দিন আচরণ ও কার্যকলাপের বর্ণনা থেকে সকলেই বুঝতে পারে যে ঈশ্বর ইয়োবের যে মূল্যায়ন করেছিলেন তা ভিত্তিহীন ছিল না, বরং তার সুস্পষ্ট ভিত্তি ছিল। এগুলো থেকে আমরা জানতে পারি, ইয়োব সম্পর্কে মানুষের মূল্যায়নই হোক (ইয়োব ১:১) অথবা ঈশ্বরের মূল্যায়নই হোক (ইয়োব ১:৮), দুটোই ছিল মানুষের ও ঈশ্বরের কাছে ইয়োবের কর্মের ফলাফল (ইয়োব ১:৫)।
প্রথমে চলো আমরা এই অনুচ্ছেদটা পড়ে নিই: “উস দেশে ইয়োব নামে ব্যক্তি বাস করতেন। তিনি ছিলেন ঈশ্বরের পরমভক্ত, সৎ ও বিশ্বস্ত সেবক। মন্দের পথ তিনি পরিহার করে চলতেন।” এটাই বাইবেলে ইয়োবের প্রথম মূল্যায়ন, আর এই বাক্যটা হচ্ছে ইয়োবের সম্বন্ধে লেখকের মূল্যায়ন। স্বাভাবিকভাবেই, এটা ইয়োব সম্পর্কে মানুষের মূল্যায়নকেও উপস্থাপিত করে, যে মূল্যায়ন হচ্ছে, “তিনি ছিলেন ঈশ্বরের পরমভক্ত, সৎ ও বিশ্বস্ত সেবক। মন্দের পথ তিনি পরিহার করে চলতেন।” তারপরে, চলো ঈশ্বর ইয়োবের যে মূল্যায়ন করেছেন সেটা পড়ে নেওয়া যাক: “তার মত লোক পৃথিবীতে কেউ নেই, যে নিখুঁত এবং ন্যায়পরায়ণ, যে ঈশ্বরে ভয় পায় ও মন্দ পথ পরিত্যাগ করে।” এই দুটোর মধ্যে, একটা এসেছে মানুষের থেকে, আর অপরটা এসেছে ঈশ্বরের থেকে; এই দুটো মূল্যায়নেরই বিষয়বস্তু একই। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে ইয়োবের আচরণ ও ব্যবহার মানুষের কাছে পরিচিত ছিল, এবং সেগুলো ঈশ্বরের দ্বারাও প্রশংসিত ছিল। অন্য ভাষায়, মানুষের সম্মুখে ইয়োবের আচরণ ও ঈশ্বরের সম্মুখে ইয়োবের আচরণ একই ছিল; সে সর্বদাই ঈশ্বরের সম্মুখে নিজের আচরণ ও উদ্দেশ্য উন্মুক্ত রেখেছিল, যাতে ঈশ্বর তা পর্যবেক্ষণ করতে পারেন, আবার সে ছিল ঈশ্বরে ভীত ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগকারী এক ব্যক্তি। এইভাবে, ঈশ্বরের চোখে পৃথিবীর সকল মানুষের মধ্যে শুধু ইয়োবই ছিল নিখুঁত ও ন্যায়পরায়ণ, ঈশ্বরে ভীত ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগকারী এক ব্যক্তি।
ইয়োবের দৈনন্দিন জীবনে ঈশ্বরে ভীতি ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগের সুনির্দিষ্ট বহিঃপ্রকাশ
এরপর, ইয়োবের ঈশ্বরে ভীতি ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগের সুনির্দিষ্ট বহিঃপ্রকাশের দিকে নজর দেওয়া যাক। এর আগের আর পরের অনুচ্ছেদের সাথে সাথে ইয়োব ১:৫-ও পড়া যাক, যার মধ্যে ইয়োবের ঈশ্বরে ভীতি ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগের সুনির্দিষ্ট বহিঃপ্রকাশের উল্লেখ রয়েছে। এটা তার দৈনন্দিন জীবনে ঈশ্বরে ভীতি ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগের সাথে সম্পর্কিত; সবচেয়ে স্পষ্টভাবে যা প্রকাশিত তা হল, সে যে শুধু নিজের ঈশ্বরে ভীতি ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগের স্বার্থে তার যা করা উচিত তা করেছিল তেমন নয়, বরং তার পাশাপাশি সে নিজের পুত্রদের তরফ থেকেও ঈশ্বরের সম্মুখে নিয়মিতভাবে অগ্নিদগ্ধ বলি উৎসর্গ করত। সে ভয় পেতো যে ভোজের সময় তার পুত্রের হয়তো অনেকবার “অনিচ্ছাকৃতভাবে ঈশ্বরকে অবজ্ঞা করে পাপ করে ফেলেছে”। ইয়োবের মধ্যে এই ভীতির বহিঃপ্রকাশ কেমন ছিল? মূল পাঠ্য থেকে তার নিম্নলিখিত বিবরণ পাওয়া যায়: “ভোজের পরের দিন ভোরে ইয়োব তাঁর পুত্রদের শুচীকরণের জন্য প্রত্যেকের নামে বলি উৎসর্গ করতেন।” ইয়োবের এই আচরণ থেকে আমরা প্রত্যক্ষ করতে পারি যে তার ঈশ্বর ভীতির বহিঃপ্রকাশ শুধু তার বাহ্যিক আচরণে ছিল তা নয়, বরং তা তার হৃদয় থেকেই এসেছিল, আর এই ঈশ্বর ভীতি সর্বদা তার দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটা দিকেই সর্বদা প্রতিভাত হয়েছিল, কারণ সে শুধুমাত্র নিজেই মন্দ কর্ম পরিত্যাগ করেছিল তা নয়, বরং প্রায়শই তার পুত্রদের তরফ থেকেও অগ্নিদগ্ধ বলি উৎসর্গ করত। অন্য ভাষায়, ইয়োব যে শুধু নিজের অন্তরে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে পাপ করা এবং নিজের হৃদয়ে ঈশ্বরকে ত্যাগ করার বিষয়ে গভীরভাবে ভীত ছিল তা নয়, বরং তার পুত্ররা হয়ত ঈশ্বরের বিরুদ্ধে পাপ করতে পারে এবং হৃদয় থেকে তাঁকে ত্যাগ করতে পারে বলেও চিন্তিত ছিল। এর থেকে প্রত্যক্ষ করা যায় যে ইয়োবের ঈশ্বরে ভীতি যে সত্য তা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ, এবং যে কোনো মানুষেরই সন্দেহের ঊর্ধ্বে। সে কি এমনটা মাঝে মাঝে করত, নাকি প্রায়শই করত? পাঠ্যটির শেষ বাক্যটি হল “ইয়োব নিয়মিতভাবে এই কাজ করতেন” এই কথার অর্থ হল, ইয়োব পুত্রদের কার্যকলাপের দিকে মাঝেমধ্যে নজর রাখত, অথবা নিজের যখন ইচ্ছা হতো তখন করত, এমনটা নয় অথবা সে প্রার্থনার মাধ্যমে ঈশ্বরের কাছে স্বীকার করত, তাও নয়। পরিবর্তে, সে নিয়মিতভাবে তার পুত্রদের পবিত্র করার জন্য পাঠাত এবং তাদের জন্য অগ্নিদগ্ধ বলি উৎসর্গ করত। এখানে “নিয়মিতভাবে” শব্দটার অর্থ হচ্ছে, সে এক বা দুই দিনের জন্য বা শুধু এক মুহূর্তের জন্য এমনটা করত না। এতে বোঝা যাচ্ছে যে ঈশ্বরের প্রতি ইয়োবের ভীতির বহিঃপ্রকাশ ক্ষণস্থায়ী ছিল না, এবং তা জ্ঞান বা কথিত বাক্যের মধ্যেই থেমে থাকেনি; পরিবর্তে, ঈশ্বর ভীতি ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগের পথ তার হৃদয়কে পরিচালিত করেছিল, তার আচরণকে নির্দেশিত করেছিল, এবং তার হৃদয়ে এটাই ছিল তার অস্তিত্বের মূল। সে যে নিয়মিতভাবে এ কাজ করত তা থেকে বুঝতে পারা যায় যে সে প্রায়ই এই ভয় করত যে সে হয়ত ঈশ্বরের বিরুদ্ধে পাপ করে ফেলবে, এবং তার পুত্র ও কন্যারাও হয়ত ঈশ্বরের বিরুদ্ধে পাপ করে ফেলবে। এটা থেকেই বোঝা যায় তার অন্তরে ঈশ্বর ভীতি ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগের পথ ঠিক কতখানি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সে নিয়মিতভাবেই এটা করত কারণ অন্তরে সে ভীত ও সন্ত্রস্ত থাকত—এই মনে করে ভীত থাকত যে সে মন্দ কর্ম করেছে ও ঈশ্বরের বিরুদ্ধে পাপ করেছে, ঈশ্বরের পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে, এবং তাই সে আর ঈশ্বরকে সন্তুষ্ট করতে সক্ষম নয়। একই সাথে, সে নিজের পুত্রকন্যাদের বিষয়েও উদ্বিগ্ন থাকত এই ভয়ে যে তারা হয়ত ঈশ্বরকে ক্ষুব্ধ করে ফেলেছে। দৈনন্দিন জীবনে ইয়োবের স্বাভাবিক আচরণ এমনই ছিল। বিশেষ করে এই স্বাভাবিক আচরণই প্রমাণ করে যে ইয়োবের ঈশ্বর ভীতি ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগ শূন্যগর্ভ কথা নয়, এই ধরনের বাস্তবিকতা ইয়োব প্রকৃতপক্ষেই জীবনে যাপন করেছিল। “ইয়োব নিয়মিতভাবে এই কাজ করতেন”: এই বাক্যগুলো থেকে ঈশ্বরের সম্মুখে ইয়োবের প্রাত্যহিক ক্রিয়াকলাপের বিষয়ে জানা যায়। যখন সে নিয়মিতভাবে এই কাজ চালিয়ে যেত, তার আচরণ ও তার হৃদয় কী ঈশ্বরের সামনে পৌঁছেছিল? অন্য ভাষায়, ঈশ্বর কি প্রায়শই তার এই আচরণ ও হৃদয় সম্পর্কে সন্তুষ্ট হতেন? তাহলে, কী অবস্থায় এবং কী প্রসঙ্গে ইয়োব নিয়মিত এ কাজ করত? কেউ কেউ বলে, “ঈশ্বর প্রায়ই ইয়োবের কাছে অবতীর্ণ হতেন বলেই সে এমনটা করত।” কারো কারো মতে, “তার মন্দ কর্ম পরিত্যাগের ইচ্ছা থাকার কারণেই সে নিয়মিত এমনটা করত।” আবার কেউ কেউ বলে, “হয়ত সে ভেবেছিল যে সহজে তার সৌভাগ্য আসেনি, এবং সে জানত যে এগুলো ঈশ্বর তাকে দিয়েছেন, তাই ঈশ্বরকে ক্ষুব্ধ করা বা তাঁর বিরুদ্ধে পাপ করার ফলে সে সমস্ত সম্পত্তি হারিয়ে ফেলতে পারে, এই ভয়ে সে গভীরভাবে ভীত ছিল।” এই সমস্ত দাবির মধ্যে একটাও কি সত্য? স্পষ্টতই না। কারণ ঈশ্বরের দৃষ্টিতে, ইয়োবের যে বিষয়টা ঈশ্বর সবচেয়ে বেশি গ্রহণ ও লালন করেছিলেন তা শুধু এই নয় যে সে নিয়মিতভাবে এই কাজ করত, তার চেয়েও বেশি করে তা ছিল তাকে শয়তানের হাতে তুলে দেওয়ার পরে ও প্রলুব্ধ করার পরে ঈশ্বর, মানুষ ও শয়তানের সামনে তার আচরণ। নিচের অংশে সবচেয়ে নিশ্চিত প্রমাণ রয়েছে, যে প্রমাণ ইয়োবের প্রতি ঈশ্বরের মূল্যায়নের সত্যতা দেখায়। চলো এরপরে শাস্ত্রের নিম্নলিখিত অনুচ্ছেদগুলো পড়া যাক।
২. ইয়োবকে শয়তানের প্রথম প্রলোভন (তার গবাদিপশু চুরি হয়ে যায় এবং সন্তানদের উপরেও বিপর্যয় নেমে আসে)
ক. ঈশ্বরের কথিত বাক্যসমূহ
ইয়োবে ১:৮ এবং যিহোবা শয়তানকে বললেন, তুমি কি আমার সেবক ইয়োবের কথা বিবেচনা করেছ, তার মত লোক পৃথিবীতে কেউ নেই, যে নিখুঁত এবং ন্যায়পরায়ণ, যে ঈশ্বরে ভয় পায় ও মন্দ পথ পরিত্যাগ করে?
ইয়োবে ১:১২ এবং যিহোবা শয়তানকে বললেন, দেখো, ওর যা কিছু আছে সব আমি তোমার হাতে ছেড়ে দিলাম, কিন্তু তুমি শুধু ওকে স্পর্শ করতে পারবে না। তাই শয়তান যিহোবার সামনে থেকে চলে গেল।
খ. শয়তানের জবাব
ইয়োবে ১:৯-১১ শয়তান বলল, ইয়োব কি বিনা স্বার্থে ঈশ্বরের উপাসনা করে? আপনি তাকে এবং তার পরিবারের সকলকে সর্বদা রক্ষা করছেন, আপনার আশীর্বাদে সে সকল কাজে সাফল্য লাভ করছে। তার ধনসম্পত্তি ও পশুপাল বেড়েই চলেছে। কিন্তু আপনি যদি এখন তার ধনসম্পদ ও সর্বস্ব কেড়ে নেন তাহলে সে আপনার মুখের উপরেই আপনাকে অভিসম্পাত দেবে।
ইয়োবের বিশ্বাসকে ত্রুটিমুক্ত করার লক্ষ্যে, ঈশ্বর ইয়োবকে প্রলোভন দেখানোর জন্য শয়তানকে অনুমতি দেন
বাইবেলে ইয়োব ১:৮-ই হল প্রথম লিপিবদ্ধ নথি, যেখানে আমরা যিহোবা ঈশ্বর ও শয়তানের কথোপকথন দেখতে পাই। তাহলে, ঈশ্বর কী বলেছিলেন? মূল পাঠ্যে এই নিম্নলিখিত বিবরণ রয়েছে: “এবং যিহোবা শয়তানকে বললেন, তুমি কি আমার সেবক ইয়োবের কথা বিবেচনা করেছ, তার মত লোক পৃথিবীতে কেউ নেই, যে নিখুঁত এবং ন্যায়পরায়ণ, যে ঈশ্বরে ভয় পায় ও মন্দ পথ পরিত্যাগ করে?” শয়তানের সামনে এটাই ছিল ইয়োবের সম্পর্কে ঈশ্বরের মূল্যায়ন; ঈশ্বর বলেছিলেন সে একজন নিখুঁত ও ধার্মিক মানুষ, এমন একজন যে ঈশ্বরে ভীত, এবং মন্দকর্ম পরিত্যাগ করেছে। শয়তান ও ঈশ্বরের এইসমস্ত কথোপকথনের আগেই ঈশ্বর সংকল্প নিয়েছিলেন যে তিনি ইয়োবকে প্রলুব্ধ করার জন্য শয়তানকে ব্যবহার করবেন—তিনি ইয়োবকে শয়তানের হাতে তুলে দেবেন। এক দিক থেকে, এটা প্রমাণ করবে যে ইয়োবের সম্পর্কে ঈশ্বরের পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন কত সঠিক ও নির্ভুল ছিল, আর ইয়োবের সাক্ষ্যের দ্বারা শয়তান অপমানিত হবে, আবার অপরদিকে এটা ইয়োবের ঈশ্বর বিশ্বাস ও ঈশ্বর ভীতিকে নিখুঁত করে তুলবে। এইভাবে, যখন শয়তান ঈশ্বরের সামনে এসেছিল, তিনি তার সাথে কোনো অস্পষ্ট কথা বলেননি। তিনি সোজাসুজি মূল বিষয়ে এসে শয়তানকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন: “তুমি কি আমার সেবক ইয়োবের কথা বিবেচনা করেছ, তার মত লোক পৃথিবীতে কেউ নেই, যে নিখুঁত এবং ন্যায়পরায়ণ, যে ঈশ্বরে ভয় পায় ও মন্দ পথ পরিত্যাগ করে?” ঈশ্বরের প্রশ্নে নিম্নলিখিত অর্থ নিহিত রয়েছে: ঈশ্বর জানতেন যে শয়তান সমস্ত স্থান পরিভ্রমণ করেছে এবং ইয়োবের উপরেও প্রায়শই নজরদারী করেছে, যে ইয়োব ছিল ঈশ্বরের সেবক। সে প্রায়শই ইয়োবকে প্রলুব্ধ ও আক্রমণ করেছে, তার ঈশ্বর বিশ্বাস ও তার ঈশ্বর ভীতি যে যথেষ্ট দৃঢ় নয়, সেটা প্রমাণের জন্য তার উপর সর্বনাশ নিয়ে আসার উপায় বার করার চেষ্টা করে গেছে। শয়তানও তৎপর হয়ে ইয়োবকে ধ্বংস করার সুযোগ খুঁজছিল, যাতে ইয়োব ঈশ্বরকে ত্যাগ করে এবং সে তাকে ঈশ্বরের হাত থেকে ছিনিয়ে নিতে পারে। যদিও, ঈশ্বর ইয়োবের হৃদয়ে দৃষ্টিপাত করে প্রত্যক্ষ করেছিলেন যে ইয়োব নিখুঁত এবং ন্যায়পরায়ণ, সে ঈশ্বরে ভীত এবং মন্দকর্ম পরিত্যাগ করে চলে। ইয়োব একজন নিখুঁত ও ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি, সে ঈশ্বরে ভীত এবং মন্দ কর্ম পরিত্যাগ করে চলে, ইয়োব কখনোই ঈশ্বরকে ত্যাগ করে শয়তানকে অনুসরণ করবে না, এ কথা শয়তানকে বলার জন্য ঈশ্বর একটা প্রশ্ন ব্যবহার করেছিলেন। ইয়োবের বিষয়ে ঈশ্বরের এই মূল্যায়ন শুনে শয়তানের মধ্যে জন্ম নিল ক্রোধ, অবমাননা থেকে যে ক্রোধের সৃষ্টি, এবং শয়তান ইয়োবকে ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য আরও ক্রুদ্ধ ও অধৈর্য হয়ে উঠেছিল, কারণ শয়তান কখনও বিশ্বাস করেনি যে কেউ নিখুঁত ও ন্যায়নিষ্ঠ হতে পারে, বা ঈশ্বরকে ভয় করতে পারে ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগ করতে পারে। এর পাশাপাশি, শয়তান মানুষের ত্রুটিহীনতা এবং ন্যায়নিষ্ঠতাকেও ঘৃণা করত, এবং যারা ঈশ্বরে ভীত ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগ করে চলত, তাদেরও ঘৃণা করত। ইয়োব ১:৯-এ লেখা রয়েছে, “শয়তান বলল, ইয়োব কি বিনা স্বার্থে ঈশ্বরের উপাসনা করে? আপনি তাকে এবং তার পরিবারের সকলকে সর্বদা রক্ষা করছেন, আপনার আশীর্বাদে সে সকল কাজে সাফল্য লাভ করছে। তার ধনসম্পত্তি ও পশুপাল বেড়েই চলেছে। কিন্তু আপনি যদি এখন তার ধনসম্পদ ও সর্বস্ব কেড়ে নেন তাহলে সে আপনার মুখের উপরেই আপনাকে অভিসম্পাত দেবে।” ঈশ্বর শয়তানের এই কলুষিত প্রকৃতির বিষয়ে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত ছিলেন, আর এটাও ভালোভাবে জানতেন যে শয়তান বহুদিন থেকেই ইয়োবের অনিষ্ট করার পরিকল্পনা করে রেখেছে, আর এই কারণেই, ইয়োব যে নিখুঁত ও ন্যায়নিষ্ঠ এবং সে ঈশ্বরে ভয় পায় ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগ করে চলে, এই কথা আরো একবার বলার মাধ্যমে ঈশ্বর শয়তানকে তার পথে আনতে চেয়েছিলেন, যাতে শয়তান তার প্রকৃত চেহারা প্রকাশ করে এবং ইয়োবকে আক্রমণ ও প্রলুব্ধ করে। অন্য ভাষায়, ঈশ্বর ইচ্ছাকৃতভাবে জোর দিয়ে বলেছিলেন যে ইয়োব নিখুঁত ও ন্যায়নিষ্ঠ, সে ঈশ্বরকে ভয় পায় ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগ করে, আর এইভাবে, ইয়োবের নিখুঁত ও ন্যায়নিষ্ঠ মানুষ হওয়ার প্রতি, ঈশ্বরে ভীতি এবং মন্দকে পরিত্যাগের প্রতি শয়তানের ঘৃণা ও ক্রোধ ব্যবহার করেই ঈশ্বর শয়তানকে প্ররোচিত করেছিলেন ইয়োবকে আক্রমণ করার জন্য। এর ফলস্বরূপ, ইয়োব যে একজন নিখুঁত এবং ন্যায়নিষ্ঠ ব্যক্তি, যে ঈশ্বরকে ভয় করে এবং মন্দ কর্ম পরিত্যাগ করে—ঈশ্বর এই সত্যের মাধ্যমে শয়তানকে লজ্জিত করবেন, এবং শয়তান এইভাবেই সম্পূর্ণরূপে অপমানিত ও পরাজিত হবে। এর পরে, শয়তান আর ইয়োবের ত্রুটিহীনতা, ন্যায়নিষ্ঠতা, ঈশ্বরে ভীতি, বা মন্দ কর্ম পরিত্যাগের বিষয়ে সন্দেহ করবে না বা অভিযোগ আনতে পারবে না। এইভাবে, ঈশ্বরের পরীক্ষা এবং শয়তানের প্রলোভন প্রায় অনিবার্য ছিল। ঈশ্বরের পরীক্ষা এবং শয়তানের প্রলোভন সহ্য করে নিতে সক্ষম একমাত্র ব্যক্তি ছিল ইয়োব। এই বাক্যবিনিময়ের পরে, ইয়োবকে প্রলুব্ধ করার অনুমতি শয়তানকে দেওয়া হয়েছিল। এইভাবেই শয়তানের প্রথম দফার আক্রমণ শুরু হয়েছিল। এই আক্রমণের লক্ষ্য ছিল ইয়োবের সম্পত্তি, কারণ শয়তান ইয়োবের বিরুদ্ধে নিম্নলিখিত অভিযোগ এনেছিল: “ইয়োব কি বিনা স্বার্থে ঈশ্বরের উপাসনা করে? … আপনার আশীর্বাদে সে সকল কাজে সাফল্য লাভ করছে। তার ধনসম্পত্তি ও পশুপাল বেড়েই চলেছে।” এর ফলস্বরূপ, ঈশ্বর শয়তানকে বলেছিলেন ইয়োবের যা ছিল সেই সমস্ত কিছু কেড়ে নিতে—এটাই ছিল শয়তানের সাথে ঈশ্বরের কথা বলার মূল উদ্দেশ্য। তা সত্ত্বেও, ঈশ্বর শয়তানের কাছে একটা দাবি করেছিলেন: “এবং যিহোবা শয়তানকে বললেন, দেখো, ওর যা কিছু আছে সব আমি তোমার হাতে ছেড়ে দিলাম, কিন্তু তুমি শুধু ওকে স্পর্শ করতে পারবে না” (ইয়োবে ১:১২)। শয়তান ইয়োবকে প্রলুব্ধ করার অনুমতি দেওয়ার আগে এবং তাকে শয়তানের হাতে তুলে দেওয়ার আগে ঈশ্বর শয়তানের ওপর এই শর্তই আরোপ করেছিলেন, আর তিনি শয়তানের ওপর এই সীমাবদ্ধতা আরোপ করেছিলেন: তিনি শয়তানকে আদেশ দিয়েছিলেন যাতে ইয়োবের কোনো ক্ষতি সে না করে। কারণ ঈশ্বর জানতেন যে ইয়োব একজন নিখুঁত ও ন্যায়পরায়ণ লোক, এবং যেহেতু ঈশ্বর বিশ্বাস করতেন যে ইয়োব ঈশ্বরের প্রতি নিঃসন্দেহে নিখুঁত ও ন্যায়পরায়ণ এবং যে সেই পরীক্ষা সহ্য করে নিতে পারবে, তাই ঈশ্বর ইয়োবকে প্রলুব্ধ করার জন্য শয়তানকে অনুমোদন দিয়েছিলেন, কিন্তু শয়তানের উপর একটা সীমাবদ্ধতাও আরোপ করেছিলেন: শয়তান ইয়োবের সমস্ত সম্পত্তি কেড়ে নিতে পারলেও সে তার গায়ে একটা আঁচড়ও ফেলতে পারবে না। এর অর্থ কী? এর অর্থ হল, সেই মুহূর্তে ঈশ্বর ইয়োবকে সম্পূর্ণভাবে শয়তানের হাতে তুলে দেননি। শয়তান যেকোনো উপায়ে ইয়োবকে প্রলুব্ধ করতে পারত, কিন্তু ইয়োবকে কোনোভাবেই আঘাত করতে পারত না—এমনকি কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারত না—কারণ মানুষের সমস্ত কিছুই ঈশ্বরের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, আর মানুষের জন্ম-মৃত্যুর নিয়ন্তাও তিনিই। এই অনুমতি শয়তানের নেই। ঈশ্বরের থেকে এই বাক্যগুলো শোনার পর, শয়তান তার কাজ শুরু করার জন্য আর অপেক্ষা করতে পারেনি। সে ইয়োবকে প্রলুব্ধ করার জন্য সমস্ত রকমের উপায় ব্যবহার করেছিল, আর অনতিবিলম্বেই ইয়োব তার এক পর্বত সম মূল্যের ভেড়া ও বলদ এবং ঈশ্বর প্রদত্ত সমস্ত সম্পত্তি হারিয়ে ফেলেছিল…। ঈশ্বরের পরীক্ষা এভাবেই তার সামনে এসেছিল।
যদিও বাইবেল অনুসারে আমরা ইয়োবের এই প্রলোভনের উৎস সম্পর্কে জানতে পারি, কিন্তু ইয়োব নিজে, যে এই প্রলোভনের সম্মুখীন হয়েছিল, সে কি জানত কী ঘটে চলেছে? ইয়োব ছিল নিছকই এক নশ্বর মানুষ; তার চারপাশে যা ঘটে চলেছিল সে সম্পর্কে সে নিশ্চিতভাবেই অজ্ঞ ছিল। তবুও, তার ঈশ্বরে ভীতি এবং তার ত্রুটিহীনতা ও ন্যায়নিষ্ঠতাই তাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল যে সে ঈশ্বরের পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছে। আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে কী ঘটেছে সে বিষয়ে সে কিছুই জানত না, আবার এই পরীক্ষার পিছনে ঈশ্বরের কী উদ্দেশ্য রয়েছে তাও ছিল তার অজানা। কিন্তু সে জানত যে তার সাথে যাই ঘটুক না কেন, তার উচিত নিজের ত্রুটিহীনতা ও ন্যায়নিষ্ঠতার প্রতি সৎ থাকা, এবং ঈশ্বরে ভীতি ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগের পথে অবিচল থাকা। এই বিষয়গুলোর প্রতি ইয়োবের মনোভাব এবং প্রতিক্রিয়া ঈশ্বর স্পষ্টভাবে দেখেছিলেন। ঈশ্বর কি দেখেছিলেন? তিনি ইয়োবের ঈশ্বরে ভীত হৃদয় দেখেছিলেন, কারণ শুরু থেকে ইয়োবের পরীক্ষা পর্যন্ত ইয়োবের হৃদয় ঈশ্বরের সামনে উন্মুক্ত ছিল, ঈশ্বরের সামনে মেলে ধরা ছিল, এবং ইয়োব তার ত্রুটিহীনতা বা ন্যায়নিষ্ঠতা পরিত্যাগ করেনি, অথবা সে ঈশ্বরে ভীতি ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগের পথ পরিহার করেনি বা তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়নি—ঈশ্বরের কাছে এর চেয়ে সন্তোষের বিষয় আর কিছুই ছিল না। এর পরে, আমরা দেখব ইয়োব কোন প্রলোভনের মধ্যে দিয়ে গিয়েছিল, এবং কীভাবে সে এই পরীক্ষাগুলোর মোকাবিলা করেছিল। শাস্ত্র থেকে পাঠ করা যাক।
গ. ইয়োবের প্রতিক্রিয়া
ইয়োবে ১:২০-২১ ইয়োব তখন উঠে দাঁড়ালেন, পোশাক ছিঁড়ে ফেললেন, মাথা কামিয়ে ফেললেন, এবং মাটিতে লুটিয়ে পরে প্রার্থনা করলেন, এবং বললেন, মায়ের গর্ভ থেকে নগ্ন অবস্থায় আমি এসেছি, নগ্ন অবস্থাতেই আবার ফিরে যাব: যিহোবা দিয়েছিলেন, যিহোবা ই ফিরিয়ে নিয়েছেন, যিহোবার নাম ধন্য হোক।
ইয়োব তার অধিকৃত সমস্তকিছু প্রত্যর্পণের উদ্যোগ নিয়েছিল তার ঈশ্বর ভীতির কারণে
“ওর যা কিছু আছে সব আমি তোমার হাতে ছেড়ে দিলাম, কিন্তু তুমি শুধু ওকে স্পর্শ করতে পারবে না,” ঈশ্বর শয়তানকে এ কথা বলার পরে, শয়তান প্রস্থান করেছিল, আর ঠিক তার পরেই ইয়োব শয়তানের আকস্মিক এবং ভয়ঙ্কর আক্রমণে আক্রান্ত হয়েছিল: প্রথমে, তার বলদ ও গাধা লুণ্ঠিত হয়েছিল এবং তার কয়েকজন ভৃত্যকে হত্যা করা হয়েছিল, এরপর তার ভেড়া এবং আরো কয়েকজন ভৃত্য আগুনে দগ্ধ হয়েছিল, তারপরে তার উটগুলোও দখল করা হয়েছিল এবং আরো কিছু ভৃত্য খুন হয়েছিল; পরিশেষে তার পুত্র ও কন্যাদের জীবনও কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। ইয়োবের প্রথম প্রলোভনের সময় সে এইরকম বারংবার আক্রমণের অভিঘাতের যন্ত্রণা সহ্য করেছিল। ঈশ্বরের আদেশ অনুসারে, এই সমস্ত আক্রমণের সময় শয়তান শুধুমাত্র ইয়োবের সম্পত্তি ও সন্তানদেরই লক্ষ্যবস্তু করেছিল, স্বয়ং ইয়োবের ক্ষতি করেনি। তা সত্ত্বেও, ইয়োব প্রচুর সম্পত্তির অধিকারী একজন ধনী মানুষ থেকে অবিলম্বেই একজন কপর্দকশূন্য মানুষে রূপান্তরিত হয়েছিল। কেউই এই আকস্মিক বিস্ময়কর বিপর্যয় সহ্য করে নিতে বা এতে যথাযথ প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারতো না, তবুও ইয়োব এতে তার একটা অসাধারণ দিক প্রদর্শন করেছিল। শাস্ত্রে নিম্নলিখিত বিবরণ দেওয়া রয়েছে: “ইয়োব তখন উঠে দাঁড়ালেন, পোশাক ছিঁড়ে ফেললেন, মাথা কামিয়ে ফেললেন, এবং মাটিতে লুটিয়ে পরে প্রার্থনা করলেন।” সে তার সন্তান ও সমস্ত সম্পত্তি হারিয়ে ফেলেছে, এ কথা শোনার পরে এই ছিল ইয়োবের প্রথম প্রতিক্রিয়া। সর্বোপরি, তাকে বিস্মিত বা আতঙ্কিত হয়ে পড়তে দেখা যায়নি, রাগ বা ঘৃণা প্রদর্শন তো আরোই দূরের কথা। তাহলে তোমরা দেখতেই পাচ্ছ যে নিজের অন্তরে সে ইতিমধ্যেই উপলব্ধি করে ফেলেছিল যে এই বিপর্যয়গুলো কোনো দুর্ঘটনা ছিল না, বা মানুষের সম্পাদিতও ছিল না, আর শাস্তি বা প্রতিফল তো আরোই নয়। বরং সে যিহোবার পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছে, এবং যিহোবাই তার সম্পত্তি ও সন্তানদের কেড়ে নিতে চেয়েছেন। সেই সময় ইয়োব খুব শান্ত ও স্বচ্ছ মস্তিষ্কে ছিল। যে বিপর্যয় তার উপর নেমে এসেছিল, সেখানে তার নিখুঁত ও ন্যায়নিষ্ঠ মানবিকতাই তাকে যুক্তিপূর্ণ ও সঠিক বিচার করতে ও সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম করেছিল, আর ফলস্বরূপ, সে অস্বাভাবিক শান্ত আচরণ করেছিল “ইয়োব তখন উঠে দাঁড়ালেন, পোশাক ছিঁড়ে ফেললেন, মাথা কামিয়ে ফেললেন, এবং মাটিতে লুটিয়ে পরে প্রার্থনা করলেন।” “পোশাক ছিঁড়ে ফেললেন” অর্থাৎ সে ছিল বিবস্ত্র ও কপর্দকশূন্য; “মাথা কামিয়ে ফেললেন” যার অর্থ হল সে ঈশ্বরের কাছে নবজাতক শিশুর মতোই প্রত্যাবর্তন করেছিল; “মাটিতে লুটিয়ে পরে প্রার্থনা করলেন”—এর অর্থ হল সে এই পৃথিবীতে বিবস্ত্র অবস্থাতেই এসেছিল, আজও তার কাছে কিছুই নেই, সে ঈশ্বরের কাছে নবজাতক শিশুর মতোই প্রত্যাবর্তন করেছিল। ইয়োবের উপর যা নেমে এসেছিল সেগুলোর প্রতি ইয়োবের যে আচরণ, তা ঈশ্বরের কোনো জীবের পক্ষেই অর্জন করা সম্ভব ছিল না। যিহোবার প্রতি তার বিশ্বাসের মাত্রা বিশ্বাসের সমস্ত স্তরের ঊর্ধ্বে চলে গিয়েছিল; এটাই ছিল তার ঈশ্বর ভীতি ও ঈশ্বরের প্রতি তার আনুগত্য; শুধু তাকে দেওয়ার জন্যই নয়, তার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়ার জন্যও সে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাতে সক্ষম হয়েছিল। এছাড়াও, সে তার অধিকারে থাকা সমস্ত কিছু, এমনকি নিজের জীবনও ঈশ্বরকে নিজে থেকে ফিরিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিতে সক্ষম হয়েছিল।
ইয়োবের ঈশ্বরে ভীতি ও ঈশ্বরের প্রতি আনুগত্য মানবজাতির কাছে একটা উদাহরণ, আর তার ত্রুটিহীনতা ও ন্যায়নিষ্ঠতাই ছিল মানবিকতার সেই চূড়া, যা মানুষের অর্জন করা উচিত। সে ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ না করলেও, তিনি যে সত্যিই আছেন, তা উপলব্ধি করেছিল, এবং এই উপলব্ধিই ছিল তার ঈশ্বর ভীতির কারণ, আর এই ঈশ্বর ভীতির কারণেই সে ঈশ্বরকে মান্য করতে পেরেছিল। সে ঈশ্বরকে তার সমস্ত কিছু নিয়ে নেওয়ার অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছিল, তবুও তার কোনো অভিযোগ ছিল না, এবং সে ঈশ্বরের সামনে লুটিয়ে পড়ে তাঁকে বলেছিল যে এই মুহূর্তেই যদি ঈশ্বর তার পার্থিব দেহও নিয়ে নেন, সে সানন্দে, কোনো অভিযোগ না করেই তাঁকে তা করতে দেবে। তার সম্পূর্ণ আচরণই ছিল তার নিখুঁত ও ন্যায়নিষ্ঠ মানবিকতার ফলাফল। অর্থাৎ বলা যায়, তার সরলতা, সততা এবং দয়ালু মনোভাবের ফলেই ইয়োব ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে নিজস্ব উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতায় অবিচল থাকতে পেরেছিল। এই ভিত্তির উপর নির্ভর করে সে নিজের প্রতি চাহিদা তৈরী করেছিল এবং তার প্রতি ঈশ্বরের পথনির্দেশ ও সমস্তকিছুর মধ্যে ঈশ্বরের যে কর্ম সে দেখেছে, তার সাথে সঙ্গতভাবে ঈশ্বরের সম্মুখে তার চিন্তা, ব্যবহার, আচরণ ও তার কাজের নীতিকে সমন্বিত করে নিয়েছিল। সময়ের সাথে সাথে, তার অভিজ্ঞতা তার মধ্যে বাস্তবিক ও প্রকৃত ঈশ্বর ভীতি তৈরী করেছিল এবং মন্দকে পরিত্যাগ করতে তাকে সক্ষম করে তুলেছিল। যে সততার প্রতি ইয়োব অবিচল ছিল, এটাই ছিল সেই সততার উৎস। ইয়োব সৎ, সরল ও দয়ালু মানবতার অধিকারী ছিল, এবং ঈশ্বরে ভীতি, ঈশ্বরকে মান্য করা, ও মন্দকে পরিত্যাগ করার প্রকৃত অভিজ্ঞতা তার ছিল, সেই সাথে এই জ্ঞানও তার ছিল যে “যিহোবা দিয়েছিলেন, যিহোবাই ফিরিয়ে নিয়েছেন।” শুধুমাত্র এই বিষয়গুলোর কারণেই সে শয়তানের এইরকম প্রচণ্ড আক্রমণের মধ্যেও নিজের সাক্ষ্যে অটল থাকতে সক্ষম হয়েছিল, এবং ঈশ্বরের পরীক্ষা তার উপর নেমে আসার সময় শুধু এইগুলোর কারণেই সে ঈশ্বরকে নিরাশ করেনি এবং তাঁকে সন্তোষজনক উত্তর দিতে সক্ষম হয়েছিল। যদিও প্রথম প্রলোভনের সময় ইয়োবের আচরণ খুব অকপট ছিল, কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মগুলো আজীবনের প্রচেষ্টার পরেও হয়ত নিশ্চিতভাবে এমনতর সহজতা অর্জন করতে পারবে না, অথবা তারা ইয়োবের মতো আচরণের অধিকারী হতে পারবে না যেমন উপরে বর্ণনা করা হয়েছে। আজ, ইয়োবের সহজসরল আচরণ প্রত্যক্ষ করে, এবং যারা ঈশ্বরে বিশ্বাস ও ঈশ্বরকে অনুসরণ করার দাবি করে তাদের “আমৃত্যু শর্তহীন আনুগত্য ও বিশ্বস্ততা”-র চিৎকার ও সংকল্পকে এর সাথে তুলনা করে, তোমরা কি গভীরভাবে লজ্জিত বোধ করছ, নাকি করছ না?
ইয়োব এবং তার পরিবার যে সমস্ত কষ্টভোগ করেছিল, শাস্ত্রে সেগুলো পড়ার পর তোমার প্রতিক্রিয়া কী? তুমি কি নিজের ভাবনায় হারিয়ে গেছ? তুমি কি বিস্মিত? ইয়োবের উপর যে পরীক্ষাগুলো নেমে এসেছিল, সেগুলোকে কি “ভয়ঙ্কর” বলে আখ্যা দেওয়া যায়? অন্য ভাষায়, শাস্ত্রে বর্ণিত ইয়োবের পরীক্ষার পড়ার পক্ষেই যথেষ্ট ভয়ঙ্কর, বাস্তব জীবনে সেগুলো কেমন হতে পারে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তাহলে, তুমি দেখতে পাচ্ছ, ইয়োবের উপর যা নেমে এসেছিল তা কোনো “কৃত্রিম কসরত” ছিল না, বরং ছিল প্রকৃত “বন্দুক” এবং “গুলি” সমন্বিত একটা প্রকৃত “যুদ্ধ”। কিন্তু কার হাতে সে এইসব পরীক্ষার শিকার হয়েছিল? অবশ্যই এগুলো ছিল শয়তানের কাজ, এবং শয়তান নিজের হাতেই এসব করেছিল। কিন্তু তা হলেও, এগুলো ঈশ্বর অনুমোদন করেছিলেন। কি উপায়ে ইয়োবকে প্রলুব্ধ করতে হবে সেটা কি ঈশ্বর শয়তানকে বলে দিয়েছিলেন? না দেন নি। ঈশ্বর শুধুমাত্র একটা শর্ত আরোপ করেছিলেন যা শয়তানকে অবশ্যই মেনে চলতে হতো, এবং তারপরে ইয়োবের উপর প্রলোভন নেমে এসেছিল। যখন ইয়োবের উপর প্রলোভন নেমে এসেছিল, তা মানুষকে শয়তানের মন্দত্ব ও কদর্যতা, মানুষের প্রতি তার বিদ্বেষ ও ঘৃণা, এবং ঈশ্বরের প্রতি তার শত্রুতা সম্পর্কে ধারণা দিয়েছিল। এতে আমরা দেখতে পাই যে এই প্রলোভনের নিষ্ঠুরতা শব্দে বর্ণনা করা যায় না। বলা যেতে পারে, শয়তান যে বিদ্বেষপূর্ণ উপায়ে মানুষকে নিপীড়ন করেছিল, এবং তার যে কদর্য চেহারা, তা এই মুহূর্তে সম্পূর্ণরূপে প্রকাশিত হয়েছিল। ঈশ্বরের অনুমতি তাকে যে সুযোগ এনে দিয়েছিল, শয়তান সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছিল ইয়োবের উপর এমন প্রচণ্ড ও নির্দয় নিপীড়ন করার জন্য, যার নৃশংসতার মাত্রা ও পদ্ধতি আজকের মানুষের পক্ষে অকল্পনীয় ও অসহনীয়। ইয়োব শয়তানের দ্বারা প্রলুব্ধ হয়েছিল এবং এই প্রলোভনের সময় সে নিজের সাক্ষ্যে অটল ছিল, এমনটা বলার পরিবর্তে এটা বলাই ভালো যে ঈশ্বর তার জন্য যে পরীক্ষা নির্ধারিত করেছিলেন, তাতে নিজের ত্রুটিহীনতা ও ন্যায়নিষ্ঠতা রক্ষা করার জন্য এবং ঈশ্বরে ভীতি ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগের পথকে সুরক্ষিত রাখার উদ্দেশ্যে, ইয়োব শয়তানের সাথে এক প্রতিযোগিতার সূত্রপাত করেছিল। এই প্রতিযোগিতায় ইয়োব নিজের পর্বতসমান মূল্যের ভেড়া ও গবাদি পশু হারিয়েছিল, সমস্ত সম্পত্তি হারিয়েছিল, এমনকি নিজের পুত্রকন্যাদেরও হারিয়েছিল। তবুও, সে নিজের ত্রুটিহীনতা, ন্যায়নিষ্ঠতা, বা ঈশ্বরে ভীতি পরিত্যাগ করেনি। অন্য ভাষায়, শয়তানের সাথে এই প্রতিযোগিতায় ইয়োব নিজের ত্রুটিহীনতা, ন্যায়নিষ্ঠতা, বা ঈশ্বরে ভীতি পরিত্যাগ করার পরিবর্তে সমস্ত সম্পত্তি ও সন্তানদের হারিয়ে ফেলাকেই শ্রেয় মনে করেছিল। মানুষ হওয়া বলতে কী বোঝায়, সে সেটারই ভিত্তিমূলে অটল থাকাকে বেছে নিয়েছিল। ইয়োব কীভাবে তার সম্পত্তি হারিয়ে ফেলেছিল, তার একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণ শাস্ত্রে উল্লেখ করা রয়েছে, পাশাপাশি তার আচরণ ও মনোভাবের উল্লেখও রয়েছে। এই বাহুল্যবর্জিত, সংক্ষিপ্ত বিবরণগুলো থেকে ধারণা পাওয়া যায় যে ইয়োব এই প্রলোভনের মুখোমুখি হয়েও প্রায় শান্তই ছিল, কিন্তু আসলে যা ঘটেছিল তার যদি পুনরাবৃত্তি করা হতো—শয়তানের বিদ্বেষপূর্ণ প্রকৃতিকেও হিসাবে রেখে—তাহলে বিষয়গুলো যেমনভাবে এইসব বাক্যের মধ্যে বর্ণনা করা আছে সেরকম সহজ বা সরল হতো না। বাস্তব আরো অনেক বেশি নিষ্ঠুর ছিল। মানবজাতির প্রতি এবং ঈশ্বর যাদের অনুমোদন করেন তাদের প্রতি শয়তানের আচরণ এমনই বিধ্বংসী ও ঘৃণ্য। ঈশ্বর যদি না বলতেন যে শয়তান ইয়োবের ক্ষতি করবে না, তাহলে শয়তান নিঃসন্দেহেই ইয়োবকে নিঃসঙ্কোচে হত্যা করত। কেউ ঈশ্বরের উপাসনা করুক তা শয়তান চায় না, অথবা যারা ঈশ্বরের দৃষ্টিতে ধার্মিক এবং যারা নিখুঁত ও ন্যায়নিষ্ঠ, তারা ঈশ্বরে ভীতি ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগ অব্যাহত রাখুক এমনটাও সে চায় না। মানুষের ঈশ্বরে ভীতি ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগের অর্থ হল শয়তানকে এড়িয়ে চলা ও তাকে পরিত্যাগ করা, এবং তাই শয়তান ঈশ্বরের অনুমতির সুযোগ নিয়ে নির্দয়ভাবে সমস্ত ক্রোধ এবং ঘৃণা ইয়োবের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল। তাহলে দেখো, ইয়োব মন থেকে দেহ পর্যন্ত, বাইরে থেকে অন্তর পর্যন্ত, কত যন্ত্রণাই না ভোগ করেছিল। আজ, আমরা সেই সময়ের ঘটনা কেমন ছিল তা প্রত্যক্ষ করতে পারি না, বাইবেলের বিবরণ থেকে আমরা শুধুমাত্র ইয়োবের যন্ত্রণার শিকার হওয়ার সময় তার অনুভূতির সংক্ষিপ্ত আভাস পেতে পারি।
ইয়োবের অটল সততা শয়তানকে লজ্জিত করে এবং সে আতঙ্কে পলায়ন করতে বাধ্য হয়
ইয়োব যখন এমন যন্ত্রণার সম্মুখীন হচ্ছিল, তখন ঈশ্বর কী করেছিলেন? ঈশ্বর পর্যবেক্ষণ করেছিলেন, নিরীক্ষণ করেছিলেন, এবং পরিণামের অপেক্ষা করেছিলেন। পর্যবেক্ষণ ও নিরীক্ষণের সময় ঈশ্বর কেমন অনুভব করেছিলেন? অবশ্যই তিনি শোকাহত হয়েছিলেন। কিন্তু এটা কি সম্ভব যে শুধু শোক অনুভব করেছিলেন বলে, ইয়োবকে প্রলোভিত করতে শয়তানকে অনুমতি দেওয়ার জন্য ঈশ্বর অনুতপ্ত হয়েছিলেন? উত্তর হচ্ছে, না, তিনি এরকম অনুশোচনা অনুভব করে থাকতে পারেন না। কারণ তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে ইয়োব একজন নিখুঁত ও ন্যায়নিষ্ঠ ব্যক্তি, সে ঈশ্বরকে ভয় পেত ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগ করে চলত। ঈশ্বর শুধু তাঁর সম্মুখে ইয়োবের ন্যায়পরায়ণতা যাচাইয়ের সুযোগ শয়তানকে করে দিয়েছিলেন, আর শয়তানের নিজের মন্দত্ব ও ঘৃণ্যতাকে প্রকাশিত করতে চেয়েছিলেন। এছাড়াও, এটা ছিল ইয়োবের কাছে সমস্ত পৃথিবীর মানুষ, শয়তান, এবং ঈশ্বরের সকল অনুগামীদের সামনে নিজের ন্যায়পরায়ণতা এবং ঈশ্বর-ভীতি ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগের সাক্ষ্য দেওয়ার একটা সুযোগ। চূড়ান্ত পরিণতি কি এটা প্রমাণ করেছিল যে ইয়োবের বিষয়ে ঈশ্বরের মূল্যায়ন সঠিক ও নির্ভুল ছিল? ইয়োব কি প্রকৃতপক্ষেই শয়তানকে পরাস্ত করতে পেরেছিল? ইয়োব যে কথাগুলো বলেছিল, যার মধ্যে দিয়ে তার পরিচয় পাওয়া যায়, আমরা এখানে তা পড়ছি, যা থেকে প্রমাণ হয় যে সে শয়তানকে পরাস্ত করতে পেরেছিল। সে বলেছিল: “মায়ের গর্ভ থেকে নগ্ন অবস্থায় আমি এসেছি, নগ্ন অবস্থাতেই আবার ফিরে যাব।” এমনই ছিল ঈশ্বরের প্রতি ইয়োবের আনুগত্যের মনোভাব। এরপর সে বলেছিল: “যিহোবা দিয়েছিলেন, যিহোবাই ফিরিয়ে নিয়েছেন, যিহোবার নাম ধন্য হোক।” ইয়োবের এই কথাগুলোই প্রমাণ করে যে ঈশ্বর মানুষের অন্তরের গভীর পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করেন, তিনি মানুষের মস্তিষ্কের ভিতর পর্যন্ত প্রত্যক্ষ করতে পারেন, আর এগুলোই প্রমাণ করে যে ইয়োবের প্রতি তাঁর অনুমোদন অভ্রান্ত ছিল, ঈশ্বরের অনুমোদিত এই ব্যক্তি যথার্থই ধার্মিক ছিল। “যিহোবা দিয়েছিলেন, যিহোবাই ফিরিয়ে নিয়েছেন, যিহোবার নাম ধন্য হোক।” এই কথাগুলো ছিল ঈশ্বরের প্রতি ইয়োবের সাক্ষ্য। এই সাধারণ কথাগুলোই শয়তানকে ভীত করেছিল, তাকে লজ্জিত করেছিল এবং এর ফলে সে আতঙ্কিত হয়ে পলায়ন করেছিল, এছাড়াও, কথাগুলো শয়তানকে শৃঙ্খলে আবদ্ধ করেছিল এবং তার কাছে আর কোনো সংস্থান ছাড়েনি। একইভাবে, এই কথাগুলো শয়তানকে যিহোবা ঈশ্বরের কাজের বিস্ময়করতা এবং শক্তিও অনুভব করিয়েছিল, এবং উপলব্ধি করিয়েছিল এমন একজন মানুষের অসাধারণ মহিমা, যার হৃদয় ঈশ্বরের পথের দ্বারা শাসিত। এছাড়াও, এগুলো ঈশ্বরে ভীত ও মন্দকর্ম পরিত্যাগের পথে চলা এক ক্ষুদ্র, নগণ্য মানুষের শক্তিশালী জীবনীশক্তি শয়তানকে প্রদর্শন করেছিল। এইভাবে শয়তান প্রথম প্রতিযোগিতায় পরাজিত হয়েছিল। “এ থেকে শিক্ষালাভের” পরেও, ইয়োবকে ছেড়ে দেওয়ার কোনো অভিপ্রায় শয়তানের ছিল না, আবার এ থেকে তার কলুষিত স্বভাবের কোনো পরিবর্তনও হয়নি। শয়তান ইয়োবের ওপর আক্রমণ চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে সচেষ্ট ছিল, আর তাই সে আরো একবার ঈশ্বরের সম্মুখে উপস্থিত হল …
এরপরে, শাস্ত্র থেকে ইয়োবের দ্বিতীয়বার প্রলোভনের শিকার হওয়ার বিষয়ে পড়া যাক।
৩. শয়তান আরো একবার ইয়োবকে প্রলুব্ধ করে (ইয়োবের সারা শরীর জুড়ে যন্ত্রণাময় ফোঁড়া দেখা দিল)
ক. ঈশ্বর যা বলেছিলেন
ইয়োবে ২:৩ এবং যিহোবা শয়তানকে বললেন, তুমি কি আমার সেবক ইয়োবের কথা বিবেচনা করেছ, তার মত লোক পৃথিবীতে কেউ নেই, যে নিখুঁত এবং ন্যায়পরায়ণ, যে ঈশ্বরে ভয় পায় ও মন্দ পথ পরিত্যাগ করে? যদিও তুমি আমাকে তার বিরুদ্ধে চালিত করেছ যাতে অকারণে তার ক্ষতি করতে পারো, কিন্তু তবুও সে তার সততায় অবিচল রয়েছে।
ইয়োবে ২:৬ তখন যিহোবা শয়তানকে বললেন, দেখো, সে এখন তোমার হাতে, কিন্তু তার প্রাণ যেন রক্ষা পায়।
খ. শয়তান যা বলেছিল
ইয়োবে ২:৪-৫ শয়তান তখন যিহোবাকে উত্তর দিল, মানুষ নিজের চামড়া বাঁচাতে সবকিছু করতে পারে, হ্যাঁ, মানুষের যা আছে সেই সবই সে তার প্রাণ বাঁচানোর জন্য দিয়ে দিতে পারে। কিন্তু এখন একবার তার রক্তমাংসের শরীরে আঘাত করে দেখুন, সে আপনার মুখের উপর আপনাকে অভিসম্পাত করবে।
গ. ইয়োব যেভাবে পরীক্ষার মোকাবিলা করল
ইয়োবে ২:৯-১০ ইয়োবের স্ত্রী তখন তাঁকে বললেন, এখনও তুমি তোমার বিশ্বাস আঁকড়ে ধরে আছ? এর চেয়ে বরং ঈশ্বরকে ধিক্কার দিয়ে মৃত্যুবরণ কর। ইয়োব তাঁকে বললেন, তুমি মূর্খের মত কথা বলছ, ঈশ্বরের হাত থেকে আমরা কি শুধু মঙ্গলই গ্রহণ করব? অমঙ্গল কিছুই গ্রহণ করব না? এতসব দুর্বিপাকের যন্ত্রণার মধ্যেও ইয়োব ঈশ্বরের বিরুদ্ধে কোন কথা বললেন না, নিন্দা করলেন না।
ইয়োবে ৩:৩-৪ যেদিন আমি জন্মগ্রহণ করেছিলাম অভিশপ্ত হোক সেই দিন, যে রাতে আমি এসেছিলাম মাতৃজঠরে, সেই রাতও হোক অভিশপ্ত। সেই দিনটি হোক অন্ধকারে আচ্ছন্ন, ঈশ্বর যেন সেই দিনটি আর স্মরণ না করেন, আর যেন কখনও আলোকিত না হয় সেই দিন।
ঈশ্বরের পথের প্রতি ইয়োবের ভালোবাসা বাকি সমস্তকিছুকে অতিক্রম করে গিয়েছিল
শয়তান ও ঈশ্বরের মধ্যে যে কথোপকথন হয়েছিল, তা শাস্ত্রে নথিভুক্ত আছে: “এবং যিহোবা শয়তানকে বললেন, তুমি কি আমার সেবক ইয়োবের কথা বিবেচনা করেছ, তার মত লোক পৃথিবীতে কেউ নেই, যে নিখুঁত এবং ন্যায়পরায়ণ, যে ঈশ্বরে ভয় পায় ও মন্দ পথ পরিত্যাগ করে? যদিও তুমি আমাকে তার বিরুদ্ধে চালিত করেছ যাতে অকারণে তার ক্ষতি করতে পারো, কিন্তু তবুও সে তার সততায় অবিচল রয়েছে” (ইয়োবে ২:৩)। এই কথোপকথনে, ঈশ্বর শয়তানের কাছে একই প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করেন। প্রথম পরীক্ষার সময় ইয়োব যা প্রদর্শন করেছিল ও যাপন করেছিল, এই প্রশ্নের মাধ্যমে আমরা সে সম্পর্কে যিহোবা ঈশ্বরের ইতিবাচক মূল্যায়ন দেখতে পাই, এবং শয়তানের প্রলোভনের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার আগে ঈশ্বর ইয়োবের যে মূল্যায়ন করেছিলেন, তার থেকে এই মূল্যায়ন অভিন্ন। এর অর্থ হল, ইয়োবের ওপর প্রলোভন নেমে আসার আগে, ঈশ্বরের দৃষ্টিতে সে ছিল নিখুঁত, আর তাই ঈশ্বর তাকে ও তার পরিবারকে রক্ষা করেছিলেন, এবং তাকে আশীর্বাদ করেছিলেন; ঈশ্বরের দৃষ্টিতে সে আশীর্বাদ পাওয়ার যোগ্য ছিল। এই প্রলোভনের পরে, নিজের সম্পত্তি ও সন্তানদের হারিয়ে ফেলেও ইয়োব নিজের মুখে পাপবাক্য উচ্চারণ করেনি, বরং যিহোবার নামের গুণগান চালিয়ে গিয়েছিল। সে বাস্তবে যে আচরণ করেছিল সেজন্য ঈশ্বর তার প্রশংসা করেছিলেন, এবং তার জন্য ঈশ্বর তাকে পূর্ণ নম্বর দিয়েছিলেন। কারণ ইয়োবের দৃষ্টিতে, তার সন্তান বা তার সম্পত্তি তাকে ঈশ্বরকে পরিত্যাগ করানোর পক্ষে যথেষ্ট ছিল না। অন্যভাবে বলা যায়, তার হৃদয়ে ঈশ্বরের যে স্থান তা তার সন্তানদের দ্বারা বা যেকোনো পরিমাণ সম্পত্তির দ্বারাই প্রতিস্থাপিত হতে পারতো না। প্রথম প্রলোভনের সময় ইয়োব ঈশ্বরকে দেখিয়েছিল যে ঈশ্বরের প্রতি তার ভালোবাসা, এবং ঈশ্বরে ভীতির পথ ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগের পথের প্রতি তার প্রেম, বাকি সমস্তকিছুকে ছাপিয়ে গেছে। শুধু এটুকুই যে এই পরীক্ষা থেকে ইয়োব যিহোবা ঈশ্বরের কাছ থেকে পুরস্কার লাভ করার অভিজ্ঞতা লাভ করেছিল, এবং তাঁর দ্বারা সম্পত্তি ও সন্তানদের কেড়ে নেওয়ার অভিজ্ঞতাও লাভ করেছিল।
ইয়োবের কাছে, এটা ছিল এক প্রকৃত অভিজ্ঞতা যা তার আত্মাকে পরিশুদ্ধ করেছিল; এটা ছিল জীবনের একটা বাপ্তিস্ম যা তার অস্তিত্বকে পরিপূর্ণ করেছিল, এবং এছাড়াও, এটা ছিল একটা জমকালো ভোজের সমান, যেখানে তার ঈশ্বরের প্রতি আনুগত্য ও তার ঈশ্বর-ভীতি পরীক্ষিত হয়েছিল। এই প্রলোভন ইয়োবকে ধনী ব্যক্তি থেকে কপর্দকশূন্য ব্যক্তিতে রূপান্তরিত করেছিল, আর এই প্রলোভন তাকে মানবজাতির প্রতি শয়তানের নিপীড়নের অভিজ্ঞতা লাভ করতেও দিয়েছিল। চরম দারিদ্রও ইয়োবকে দিয়ে শয়তানকে ঘৃণা করাতে পারেনি; বরং শয়তানের জঘন্য কাজে সে প্রত্যক্ষ করেছিল শয়তানের কদর্যতা ও ঘৃণ্যতা, সেইসাথে প্রত্যক্ষ করেছিল ঈশ্বরের প্রতি শয়তানের শত্রুতা ও বিদ্রোহ, এবং এটাই তাকে আরও বেশি করে উৎসাহ দিয়েছিল সর্বদা ঈশ্বরে ভীতি ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগের পথে অটল থাকতে। সে শপথ করেছিল যে সে কখনও সম্পত্তি, সন্তান, বা আত্মীয়দের মতো বাহ্যিক কারণে ঈশ্বরকে পরিত্যাগ করবে না এবং ঈশ্বরের পথ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে না, অথবা কখনও শয়তান, সম্পত্তি, বা কোনো ব্যক্তির দাস হবে না; যিহোবা ঈশ্বর ছাড়া কেউই তার প্রভু বা তার ঈশ্বর হতে পারবে না। এমনই ছিল ইয়োবের আকাঙ্ক্ষা। অন্যদিকে, ইয়োব এই প্রলোভন থেকে কিছু অর্জনও করেছিল: ঈশ্বর প্রদত্ত পরীক্ষায় সে প্রচুর সম্পদ অর্জন করেছিল।
ইয়োবের জীবনের গত কয়েক দশক সময়কালে, সে যিহোবার কাজ প্রত্যক্ষ করেছিল এবং নিজের জন্য তাঁর আশীর্বাদ লাভ করেছিল। এই আশীর্বাদ পেয়ে সে চরম অস্বস্তি ও ঋণী বোধ করেছিল, কারণ তার বিশ্বাস ছিল সে ঈশ্বরের জন্য কিছুই করেনি, তা সত্ত্বেও এত আশীর্বাদ লাভ করেছে এবং এত অনুগ্রহ উপভোগ করেছে। এই কারণে সে প্রায়শই মনে মনে প্রার্থনা করত, আশা করত যে সে ঈশ্বরকে প্রতিদান দিতে পারবে, আশা করত যে সে ঈশ্বরের কাজ ও মহানুভবতার সাক্ষ্য দেওয়ার সুযোগ পাবে, এবং আশা করত যে ঈশ্বর তার আনুগত্যের পরীক্ষা নেবেন, এবং এছাড়াও, যতক্ষণ না তার বিশ্বাস ও আনুগত্য ঈশ্বরের অনুমোদন লাভ করছে, ততক্ষণ যেন তার বিশ্বাস পরিশুদ্ধ হতে পারে। তাপরে, যখন ইয়োব পরীক্ষার সম্মুখীন হল, সে বিশ্বাস করেছিল যে ঈশ্বর তার প্রার্থনা শুনেছেন। ইয়োব এই সুযোগকে সমস্তকিছুর চেয়ে বেশি করে লালন করেছিল, আর তাই এটাকে হালকাভাবে নেওয়ার সাহস করেনি, কারণ এর মাধ্যমে তার আজীবনের ইচ্ছা বাস্তবায়িত হতে পারে। এই সুযোগ আসার অর্থ ছিল, তার আনুগত্য এবং ঈশ্বর ভীতির পরীক্ষা নেওয়া হতে পারে, এবং তা পরিশুদ্ধ করে তোলা যেতে পারে। এছাড়াও, এর অর্থ ছিল যে ইয়োবের কাছে ঈশ্বরের অনুমোদন পাওয়ার সুযোগ এসেছে, যেটা তাকে ঈশ্বরের আরো ঘনিষ্ঠ করে তুলবে। পরীক্ষা চলাকালীন, এইরকম বিশ্বাস ও সাধনা তাকে আরো নিখুঁত হয়ে ওঠার সুযোগ দিয়েছিল, এবং ঈশ্বরের ইচ্ছার বৃহত্তর উপলব্ধি অর্জনের সুযোগ দিয়েছিল। এছাড়াও ঈশ্বরের আশীর্বাদ ও অনুগ্রহ লাভ করার কারণে ইয়োব আরো কৃতজ্ঞ হয়ে উঠেছিল, নিজের অন্তরে সে ঈশ্বরের কর্মের প্রতি আরো স্তুতি জ্ঞাপন করেছিল, সে ঈশ্বরের প্রতি আরো ভীত ও সশ্রদ্ধ হয়ে উঠেছিল, এবং আরো বেশি করে আকাঙ্ক্ষা করেছিল ঈশ্বরের মাধুর্য, মহানুভবতা, ও পবিত্রতা। সেই সময়ে, যদিও ঈশ্বরের দৃষ্টিতে ইয়োব তখনও এমন একজন মানুষ ছিল যে ঈশ্বরে ভীত ও মন্দকে পরিত্যাগ করে চলে, কিন্তু তার অভিজ্ঞতার দিক থেকে বিচার করলে, ইয়োবের বিশ্বাস ও জ্ঞান দ্রুতহারে অগ্রগতি লাভ করেছিল: তার বিশ্বাস বৃদ্ধি পেয়েছিল, তার আনুগত্য দৃঢ় ভিত্তি লাভ করেছিল, আর ঈশ্বরের প্রতি ভীতি আরও প্রবল হয়ে উঠেছিল। যদিও এই পরীক্ষা ইয়োবের আত্মা ও জীবনকে রূপান্তরিত করে দিয়েছিল, কিন্তু এই রূপান্তর ইয়োবকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি, অথবা তার কে মন্থর করতেও পারেনি। এই পরীক্ষা থেকে সে কী অর্জন করেছে সে কথা হিসাব করার সময়, এবং তার নিজের কী কী ঘাটতি আছে তা বিবেচনা করার সময়, সে নীরবে প্রার্থনা করেছে, অপেক্ষা করেছে তার উপর পরবর্তী পরীক্ষা নেমে আসার, কারণ সে আকাঙ্ক্ষা করেছিল তার বিশ্বাস, আনুগত্য ও ঈশ্বর ভীতি যেন ঈশ্বরের পরবর্তী পরীক্ষা চলাকালীন আরও উচ্চস্তরে উন্নীত হয়।
ঈশ্বর মানুষের অন্তর্নিহিত চিন্তাভাবনা, এবং তাদের সব কথা ও কাজকর্ম পর্যবেক্ষণ করেন। ইয়োবের চিন্তাভাবনা যিহোবা ঈশ্বরের কানেও পৌঁছে গিয়েছিল, আর ঈশ্বর তার প্রার্থনা শুনেছিলেন, এবং এইভাবেই প্রত্যাশিতভাবে ঈশ্বরের পরবর্তী পরীক্ষা ইয়োবের উপর নেমে এসেছিল।
চরম যন্ত্রণাভোগের মধ্যেই ইয়োব মানবজাতির প্রতি ঈশ্বরের যত্নকে প্রকৃতভাবে উপলব্ধি করেছিল
যিহোবা ঈশ্বর শয়তানকে প্রশ্নগুলো করার পর, শয়তান গোপনে খুশি হয়েছিল। কারণ শয়তান জানত যে সে আরো একবার সেই মানুষটার উপর আক্রমণ করার অনুমতি পেতে চলেছে যে ঈশ্বরের দৃষ্টিতে নিখুঁত—শয়তানের কাছে এটা একটা বিরল সুযোগ। শয়তান এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ইয়োবের দৃঢ় প্রত্যয়ের ভিত্তি সম্পূর্ণ ধ্বংস করতে চেয়েছিল, ঈশ্বরের প্রতি তার আস্থা বিনষ্ট করতে চেয়েছিল, যাতে সে আর ঈশ্বরে ভীত না হয় অথবা যিহোবার নামের বন্দনা না করে। এটা শয়তানকে একটা সুযোগ করে দিত: স্থান-কাল নির্বিশেষে, সে ইয়োবকে তার আদেশে চালিত একটা খেলার পুতুলে পরিণত করে দিত। শয়তান কোনোরকম চিহ্ন না রেখেই নিজের দুষ্ট উদ্দেশ্য আড়াল করেছিল, কিন্তু নিজের মন্দ প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে নি। শাস্ত্রে লিপিবদ্ধ যিহোবা ঈশ্বরের কথার উত্তরে এই সত্যের ইঙ্গিত পাওয়া যায়: “শয়তান তখন যিহোবাকে উত্তর দিল, মানুষ নিজের চামড়া বাঁচাতে সবকিছু করতে পারে, হ্যাঁ, মানুষের যা আছে সেই সবই সে তার প্রাণ বাঁচানোর জন্য দিয়ে দিতে পারে। কিন্তু এখন একবার তার রক্তমাংসের শরীরে আঘাত করে দেখুন, সে আপনার মুখের উপর আপনাকে অভিসম্পাত করবে” (ইয়োবে ২:৪-৫)। ঈশ্বর ও শয়তানের এই কথোপকথন থেকে শয়তানের বিদ্বেষ সম্পর্কে প্রয়োজনীয় ধারণা ও জ্ঞান লাভ না করতে পারা অসম্ভব। শয়তানের এই সমস্ত বিভ্রান্তিকর কথা শোনার পরে, সত্যকে ভালোবাসে এবং মন্দকে ঘৃণা করে এমন সকল ব্যক্তি নিঃসন্দেহে শয়তানের হীনতা ও নির্লজ্জতার প্রতি তীব্র ঘৃণা পোষণ করবে, তারা শয়তানের এই বিভ্রান্তিকর আচরণে আতঙ্কিত ও বিরক্ত বোধ করবে, এবং একই সাথে ইয়োবের জন্য গভীর প্রার্থনা ও আন্তরিক কামনা করবে, প্রার্থনা করবে যে এই ন্যায়নিষ্ঠ ব্যক্তি যেন ত্রুটিহীনতা অর্জন করতে পারে, কামনা করবে এই ঈশ্বরে ভীত ও মন্দকর্ম পরিত্যাগকারী ব্যক্তি যেন সর্বদাই শয়তানের প্রলোভন জয় করতে পারে, এবং ঈশ্বরের পথনির্দেশ ও আশীর্বাদের মাঝে আলোর মধ্যে জীবনযাপনে সক্ষম হয়; এবং একইভাবে, এমন মানুষেরা এটাও আশা করবে যে ইয়োবের ন্যায়পরায়ণ কার্যকলাপ যেন চিরকাল তাদের সকলকে উদ্দীপনা ও উৎসাহ জোগায়, যারা ঈশ্বরে ভীতির ও মন্দকর্ম পরিত্যাগের পথের সাধনা করে। যদিও শয়তানের বিদ্বেষপূর্ণ উদ্দেশ্য এই ঘোষণার মধ্যেই দেখতে পাওয়া যায়, তবুও ঈশ্বর সানন্দে শয়তানের “অনুরোধে” সম্মতি দিয়েছিলেন—কিন্তু সেইসাথে তিনি একটা শর্তও আরোপ করেছিলেন: “সে এখন তোমার হাতে, কিন্তু তার প্রাণ যেন রক্ষা পায়” (ইয়োবে ২:৬)। যেহেতু এইবারে শয়তান ইয়োবের রক্তমাংসের শরীরের ক্ষতি করার জন্য তার হস্ত প্রসারিত করার অনুমতি চেয়েছিল, তাই ঈশ্বর বলেছিলেন, “কিন্তু তার প্রাণ যেন রক্ষা পায়”। এই কথাগুলোর অর্থ হল, ঈশ্বর ইয়োবের দেহ শয়তানের হাতে তুলে দিয়েছিলেন, কিন্তু তার প্রাণের দায়িত্ব ঈশ্বরের উপরেই ন্যস্ত ছিল। শয়তান ইয়োবের প্রাণ হরণে সক্ষম না হলেও, এটা বাদে যেকোনো উপায় বা পদ্ধতি সে ইয়োবের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করতে পারত।
ঈশ্বরের অনুমতি লাভের পরে, শয়তান ইয়োবের দিকে ধাবিত হল ও তার দেহের চামড়ায় যন্ত্রণা দেওয়ার উদ্দেশ্যে হাত বাড়াল, তার সারা শরীর যন্ত্রণাময় ফোঁড়ায় ভরে দিল, এবং ইয়োব তার চামড়ায় ভীষণ যন্ত্রণা অনুভব করল। ইয়োব যিহোবা ঈশ্বরের বিস্ময়করতা ও পবিত্রতার বন্দনা করল, আর তা শয়তানের দুঃসাহস আরও ভীষণরকম বাড়িয়ে তুলল। যেহেতু শয়তান মানুষের দেহে নিপীড়নের আনন্দ অনুভব করেছিল, তাই সে তার হাত বাড়িয়ে ইয়োবের দেহে আঁচড়ে দিয়েছিল, যার ফলে তার যন্ত্রণাদায়ক ফোঁড়াগুলোতে পচন ধরে গিয়েছিল। ইয়োব সঙ্গে সঙ্গেই নিজের দেহে অকল্পনীয় যন্ত্রণা ও পীড়ন অনুভব করল, সে নিজের পা থেকে মাথা পর্যন্ত ঘষতে শুরু করল, যেন তার আত্মার উপর যে আঘাত করা হয়েছে তা থেকে তার দেহের এই যন্ত্রণা কিছুটা স্বস্তি দেবে। সে উপলব্ধি করেছিল যে ঈশ্বর তার পাশে থেকে তাকে পর্যবেক্ষণ করছেন, এবং সে সমস্তরকম চেষ্টা করল নিজেকে ইস্পাতকঠিন রাখতে। সে আরো একবার ভূমিতে নতমস্তক হয়ে বলল: “তুমি মানুষের অন্তর প্রত্যক্ষ করো, তার দুর্দশা পর্যবেক্ষণ করো, তার দুর্বলতায় তুমি উদ্বিগ্ন কেন? যিহোবা ঈশ্বরের নাম ধন্য হোক।” শয়তান ইয়োবকে অসহনীয় যন্ত্রণা ভোগ করতে দেখল, কিন্তু তাকে যিহোবা ঈশ্বরের নাম পরিত্যাগ করতে দেখতে পেল না। তাই ইয়োবের অস্থিতে আঘাত করার জন্য সে দ্রুত নিজের হাত বাড়িয়ে দিল, তার প্রতিটা অঙ্গে আঘাত করতে মরিয়া হয়ে উঠল। মুহূর্তের মধ্যে, ইয়োব অভূতপূর্ব যন্ত্রণা অনুভব করল; যেন তার অস্থি থেকে মাংস ছিঁড়ে আলাদা করে ফেলা হয়েছে, এবং যেন তার অস্থিগুলোকে টুকরো টুকরো করে ভেঙে দেওয়া হচ্ছে। এই মর্মান্তিক যন্ত্রণা তাকে ভাবতে বাধ্য করল যে তার মরে যাওয়াই ভালো…। সে এই যন্ত্রণা সহ্য করার সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল…। সে চিৎকার করে কাঁদতে চেয়েছিল, ব্যথা কমানোর প্রয়াসে নিজের শরীরের চামড়া ছিঁড়তে চেয়েছিল—তবুও সে তার চিৎকারের কণ্ঠরোধ করেছিল, শরীরের চামড়া ছেঁড়া থেকে বিরত থেকেছিল, কারণ সে শয়তানকে তার দুর্বলতা দেখতে দিতে চায় নি। তাই ইয়োব আরও একবার নতজানু হল, কিন্তু এইবারে সে যিহোবা ঈশ্বরের উপস্থিতি অনুভব করল না। সে জানত যিহোবা ঈশ্বর প্রায়শই তার সামনে, পিছনে, এবং উভয় পাশেই উপস্থিত থাকতেন। তবুও এই যন্ত্রণার সময় ঈশ্বর তার দিকে একবারও তাকাননি; তিনি নিজের মুখমণ্ডল আবৃত করে আড়ালে ছিলেন, কারণ তাঁর মানুষ সৃষ্টি করার উদ্দেশ্য তাদের কষ্ট দেওয়া ছিল না। এই সময়ে, ইয়োব কাঁদছিল, এই শারীরিক কষ্ট সহ্য করার যথাসাধ্য চেষ্টা করছিল, কিন্তু এর মধ্যেও সে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দেওয়া থেকে নিজেকে আটকাতে পারেনি: “মানুষ প্রথম আঘাতেই লুটিয়ে পড়ে, সে দুর্বল ও শক্তিহীন, সে নবীন ও অজ্ঞ—তুমি তার প্রতি এত যত্নবান ও কোমল হতে চাও কেন? তুমি আমার ওপর আঘাত হানো, কিন্তু সেটা করতে গিয়ে নিজেও ব্যথিত হও। মানুষের কোন জিনিসটা তোমার যত্ন ও উদ্বেগের উপযুক্ত?” ইয়োবের প্রার্থনা ঈশ্বরের কানে পৌঁছেছিল, এবং তিনি নীরব ছিলেন, কোনো আওয়াজ না করে লক্ষ্য করে যাচ্ছিলেন…। নিজের জানা সমস্ত রকমের কৌশল প্রয়োগ করার পর শয়তান নীরবে বিদায় নিল, কিন্তু তাতেও ইয়োবের প্রতি ঈশ্বরের পরীক্ষা সমাপ্ত হয়নি। যেহেতু ইয়োবের মধ্যে ঈশ্বরের যে শক্তি প্রকাশিত হয়েছিল তা তখনও জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি, তাই শয়তানের পশ্চাদপসরণের মধ্যে দিয়ে ইয়োবের কাহিনী সমাপ্ত হয়নি। অন্যান্য চরিত্রগুলোর প্রবেশের সাথে সাথে, আরো দর্শনীয় দৃশ্যের অবতারণা হওয়া তখনও বাকি ছিল।
সমস্তকিছুতে ঈশ্বরের নামের স্তুতিই হল ইয়োবের ঈশ্বর ভীতি ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগের অপর একটা বহিঃপ্রকাশ
ইয়োব শয়তানের ধ্বংসসাধন ভোগ করেছিল, তবুও সে যিহোবা ঈশ্বরের নাম পরিত্যাগ করেনি। ইয়োবের স্ত্রীই ছিল প্রথম, যে এগিয়ে এসে ইয়োবকে আক্রমণ করেছিল, এমনভাবে শয়তানের ভূমিকা পালন করেছিল যা মানুষের চোখে দৃশ্যমান। মূল শাস্ত্রে এটার বিবরণ এইভাবে দেওয়া আছে: “ইয়োবের স্ত্রী তখন তাঁকে বললেন, এখনও তুমি তোমার বিশ্বাস আঁকড়ে ধরে আছ? এর চেয়ে বরং ঈশ্বরকে ধিক্কার দিয়ে মৃত্যুবরণ কর” (ইয়োবে ২:৯)। মানুষের ছদ্মবেশে শয়তান এই কথাগুলোই বলেছিল। এই কথাগুলো ছিল আক্রমণ, অভিযোগ, সেইসাথে প্রলোভন, প্ররোচনা এবং অপবাদমূলক। ইয়োবের উপর শারীরিক আক্রমণে ব্যর্থ হয়ে, শয়তান তারপর সরাসরি ইয়োবের সততায় আক্রমণ করেছিল, এটা ব্যবহার করতে চেয়েছিল যাতে ইয়োব নিজের সততা পরিত্যাগ করে, ঈশ্বরকে ত্যাগ করে এবং আর বেঁচে থাকতেই না চায়। একইভাবে, শয়তান এই ধরনের কথার প্রয়োগে ইয়োবকে প্রলোভিত করতেও চেয়েছিল: ইয়োব যদি যিহোবার নাম পরিত্যাগ করে, তাহলে তাকে এরকম যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে না; সে দেহের এই যন্ত্রণা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারবে। স্ত্রীর মুখে এই পরামর্শ শুনে ইয়োব তাকে এই বলে তিরস্কার করেছিল, “তুমি মূর্খের মত কথা বলছ, ঈশ্বরের হাত থেকে আমরা কি শুধু মঙ্গলই গ্রহণ করব? অমঙ্গল কিছুই গ্রহণ করব না?” (ইয়োবে ২:১০)। ইয়োব অনেক আগে থেকেই এই কথাগুলো জানত, কিন্তু সেগুলোর বিষয়ে তার জ্ঞান যে সত্যি, তা এইবারে প্রমাণিত হয়ে গিয়েছিল।
ইয়োবের স্ত্রী যখন তাকে ঈশ্বরকে অভিশাপ দিয়ে মৃত্যুবরণ করে নিতে বলেছিল, তখন সে বোঝাতে চেয়েছিল যে: “তোমার ঈশ্বর তোমার সাথে এমন আচরণ করছেন, তাহলে তুমি তাঁকে অভিশাপ দেবে না কেন? এখনও বেঁচে থেকে তুমি কী করছ? তোমার ঈশ্বর তোমার সাথে এত অন্যায় করেছেন, তবুও তুমি বলছ ‘যিহোবার নাম ধন্য হোক’। তুমি তাঁর নামের বন্দনা করছ, তা সত্ত্বেও তিনি তোমার ওপর বিপর্যয় কীভাবে আনতে পারেন? এখনই ঈশ্বরের নাম পরিত্যাগ করো, তাঁকে আর অনুসরণ কোরো না। তাহলে তোমার সব সমস্যা দূর হয়ে যাবে।” সেই মুহূর্তে, ঈশ্বর ইয়োবের মধ্যে যে সাক্ষ্য প্রত্যক্ষ করতে চেয়েছিলেন, তা সৃষ্ট হয়েছিল। কোনো সাধারণ মানুষ এমন সাক্ষ্য বহন করতে পারত না, অথবা আমরা বাইবেলের কোনো কাহিনীর মধ্যেও এমন ঘটনা পড়তে পাই না—কিন্তু ইয়োব এই কথাগুলো উচ্চারণের অনেক আগেই ঈশ্বর তা দেখে নিয়েছিলেন। ঈশ্বর এই সুযোগকে শুধু এইজন্য ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন যাতে ইয়োব সকলের কাছে প্রমাণ করতে পারে যে ঈশ্বর সঠিক ছিলেন। স্ত্রীর কাছ থেকে এমন পরামর্শ শুনে ইয়োব নিজের সততা ত্যাগ করেনি বা ঈশ্বরকে পরিত্যাগ করেনি, বরং সে-ও তার স্ত্রীকে বলেছিল: “ঈশ্বরের হাত থেকে আমরা কি শুধু মঙ্গলই গ্রহণ করব? অমঙ্গল কিছুই গ্রহণ করব না?” এই কথাগুলো কি খুব গুরুত্বপূর্ণ? এখানে, শুধুমাত্র একটা বিষয়ই এই কথাগুলোর গুরুত্ব প্রমাণ করতে পারে। এই কথাগুলোর গুরুত্ব হচ্ছে যে এগুলো ঈশ্বরের হৃদয়ে ঈশ্বরের দ্বারা অনুমোদিত, এগুলোই ঈশ্বর কামনা করেছিলেন, ঈশ্বর এগুলোই শুনতে চেয়েছিলেন, এবং এই ফলাফলই ঈশ্বর দেখতে চেয়েছিলেন; আর এই কথাগুলোই ছিল ইয়োবের সাক্ষ্যের গভীরতম নির্যাস। এর মাধ্যমেই ইয়োবের ত্রুটিহীনতা, ন্যায়পরায়ণতা, ঈশ্বর ভীতি ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগের মনোভাব প্রমাণিত হয়েছিল। ইয়োবের চমৎকারিত্ব এর মধ্যেই নিহিত ছিল যে যখন তাকে প্রলুব্ধ করা হয়েছিল, এমনকি তার গোটা শরীর ফোঁড়ায় আবৃত হয়ে গিয়েছিল, যখন সে এমন চরম যন্ত্রণা সহ্য করেছিল, যখন তার স্ত্রী ও পরিজনরা তাকে পরামর্শ দিয়েছিল, তখনও সে এরকম কথা উচ্চারণ করতে পেরেছিল। অন্য ভাবে বললে, তার অন্তরের বিশ্বাস ছিল যে যেরকম প্রলোভনই আসুক, অথবা কষ্ট বা যন্ত্রণা যত কঠিনই হোক, এমনকি যদি মৃত্যুও তার উপর নেমে আসে, সে ঈশ্বরকে ত্যাগ করবে না, অথবা ঈশ্বরে ভীতি ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগের পথ ছেড়ে যাবে না। তাহলে দেখছ, তার অন্তরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল ঈশ্বরের, তার হৃদয়ে শুধুমাত্র ঈশ্বরই ছিলেন। এই কারণেই আমরা শাস্ত্রে ইয়োবের সম্পর্কে এই রকম বিবরণ দেখতে পাই: এতসব দুর্বিপাকের যন্ত্রণার মধ্যেও ইয়োব ঈশ্বরের বিরুদ্ধে কোন কথা বললেন না, নিন্দা করলেন না। সে শুধু নিজের মুখেই পাপবাক্য উচ্চারণ করা থেকে বিরত ছিল তা নয়, বরং নিজের হৃদয়েও সে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করেনি। ঈশ্বরের সম্পর্কে সে কোনো আঘাতকারী শব্দ উচ্চারণ করেনি, তেমনই তাঁর বিরুদ্ধে কোনো পাপও করেনি। ঈশ্বরের স্তুতি শুধু তার মুখেই উচ্চারিত হয় নি, বরং হৃদয়েও সে ঈশ্বরের নামের বন্দনা করেছিল; তার মুখ ও হৃদয় ছিল অভিন্ন। ঈশ্বর এই প্রকৃত ইয়োবকেই প্রত্যক্ষ করেছিলেন, আর ঠিক এই কারণেই তিনি তাকে এত মূল্যবান মনে করেছিলেন।
ইয়োবের সম্পর্কে মানুষের বিভিন্ন ভুল ধারণা
ইয়োব যে দুঃখ কষ্টের সম্মুখীন হয়েছিল, তা ঈশ্বরের প্রেরিত দূতদের জন্য নয়, আবার তা ঈশ্বরের নিজের হাতেও সম্পাদিত হয়নি। বরং, শয়তান, ঈশ্বরের শত্রু, ব্যক্তিগতভাবে তা করেছিল। ফলে, ইয়োবকে যে কষ্ট সহ্য করতে হয়েছিল তার মাত্রা ছিল অপরিসীম। তবুও এই মুহূর্তে ইয়োব নিজের হৃদয়ে ঈশ্বর সম্পর্কিত তার দৈনন্দিন জ্ঞান, তার দৈনন্দিন কাজের নীতি, এবং ঈশ্বরের প্রতি তার মনোভাব সম্পূর্ণভাবে দেখিয়েছিল—এটাই সত্য। ইয়োব যদি প্রলুব্ধ না হত, ঈশ্বর যদি তাকে পরীক্ষা না করতেন, তাহলে ইয়োব যখন বলেছিল “যিহোবা দিয়েছিলেন, যিহোবাই ফিরিয়ে নিয়েছেন, যিহোবার নাম ধন্য হোক,” তখন তুমি হয়ত বলতে ইয়োব ভণ্ড, ঈশ্বর তাকে এত কিছু দিয়েছেন, নিশ্চয়ই সেইজন্যই সে যিহোবার নামের গুণকীর্তন করেছে। যদি পরীক্ষার সম্মুখীন হওয়ার আগে ইয়োব বলত, “ঈশ্বরের হাত থেকে আমরা কি শুধু মঙ্গলই গ্রহণ করব? অমঙ্গল কিছুই গ্রহণ করব না?” তাহলে তুমি বলতে যে ইয়োব বাড়িয়ে বলেছে, আর যেহেতু সে প্রায়ই ঈশ্বরের আশীর্বাদ পেত, তাই সে ঈশ্বরের নাম পরিত্যাগ করত না। তুমি বলতে যে ঈশ্বর যদি তার উপর বিপর্যয় নিয়ে আসতেন, তাহলে নিশ্চিতভাবেই সে ঈশ্বরের নাম পরিত্যাগ করত। তবুও ইয়োব যখন এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হল, যে পরিস্থিতি কেউ প্রত্যাশা করে না বা দেখতেও চায় না, যে পরিস্থিতিতে কেউই পড়তে চায় না, যে পরিস্থিতি নিজের উপর এসে পড়ার বিষয়ে সকলে ভয় পায়, এমনকি যে পরিস্থিতি দেখে ঈশ্বরও সহ্য করতে পারেন না—তেমন পরিস্থিতিতেও ইয়োব তার এই সততা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিল: “যিহোবা দিয়েছিলেন, যিহোবাই ফিরিয়ে নিয়েছেন, যিহোবার নাম ধন্য হোক।” এবং “ঈশ্বরের হাত থেকে আমরা কি শুধু মঙ্গলই গ্রহণ করব? অমঙ্গল কিছুই গ্রহণ করব না?” ইয়োবের এই সময়ের আচরণ দেখার পরে, যারা বড় বড় কথা বলতে ভালোবাসে, যারা তত্ত্ব ও মতবাদের কথা বলতে ভালোবাসে, তারা সকলেই বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। যারা শুধু মুখের কথায় ঈশ্বরের নামের গুণকীর্তন করে, অথচ কখনও ঈশ্বরের পরীক্ষা স্বীকার করেনি, তারা সেই সততার মাধ্যমে নিন্দিত হয় যে সততায় ইয়োব অটল থেকে গিয়েছিল, এবং যারা কখনও বিশ্বাস করেনি যে মানুষ ঈশ্বরের পথে দৃঢ় থাকতে সক্ষম, তাদের ইয়োবের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে বিচার করা হয়। এই পরীক্ষার সময় ইয়োবের আচরণ এবং তার কথিত শব্দের সম্মুখীন হয়ে কেউ কেউ বিভ্রান্ত বোধ করবে, কেউ ঈর্ষা বোধ করবে, কেউ সন্দেহ বোধ করবে, এমনকি কেউ কেউ অনাগ্রহও বোধ করবে, ইয়োবের সাক্ষ্যকে তারা অবজ্ঞা করবে কারণ তারা যে শুধু পরীক্ষার সময় ইয়োবের ভোগ করা যন্ত্রণাগুলো দেখে ও তার কথিত শব্দগুলো পড়ে তা নয়, এর সাথে সাথে ইয়োবের উপর পরীক্ষা নেমে আসার সময় তার মানবিক “দুর্বলতা” গুলোও দেখে। এই “দুর্বলতা” কে তারা ইয়োবের ত্রুটিহীনতার মধ্যে অনুমান করে নেওয়া ত্রুটি বলে বিশ্বাস করে, ঈশ্বরের দৃষ্টিতে নিখুঁত একজন ব্যক্তির মধ্যের ত্রুটি বলে গণ্য করে। অর্থাৎ বলা যায়, বিশ্বাস করা হয় যে যারা নিখুঁত ও ত্রুটিহীন এবং যাদের কোনো দাগ বা কলঙ্ক নেই, তাদের মধ্যে কোনো দুর্বলতা থাকে না, যন্ত্রণার কোনো জ্ঞান থাকে না, তারা কখনোই দুঃখিত বা বিষণ্ণ বোধ করে না, তারা ঘৃণা বা কোনো বাহ্যিক চরমপন্থী আচরণ থেকে মুক্ত; আর তার ফলস্বরূপ, বিশাল সংখ্যক মানুষ বিশ্বাস করে না যে ইয়োব প্রকৃতই নিখুঁত ছিল। পরীক্ষার সময় তার আচরণের বেশিরভাগই মানুষ অনুমোদন করে না। উদাহরণস্বরূপ, নিজের সম্পত্তি ও সন্তানদের হারানোর পরে, মানুষ যেমন কল্পনা করে, ইয়োব তেমনভাবে কান্নায় ভেঙে পড়েনি। তার “শোভনতার অভাব”-এর জন্য মানুষ তাকে অনুভূতিহীন মনে করে, কারণ তার নিজের পরিবারের জন্যও তার চোখে জল ছিল না বা তার মমত্ববোধও ছিল না। ইয়োব সম্পর্কে মানুষের প্রাথমিক খারাপ ধারণা এটাই। এরপর সে যে আচরণ করেছিল সেটাকে তারা এমনকি আরও বিভ্রান্তিকর বলে মনে করে: “পোশাক ছিঁড়ে ফেলল”, এটাকে মানুষ ঈশ্বরের প্রতি তার অশ্রদ্ধা বলে ব্যাখ্যা করে, এবং “মাথা কামিয়ে ফেলল” বিষয়টা ভুলবশতঃ বিশ্বাস করে ইয়োবের ধর্মনিন্দা ও ঈশ্বরের বিরোধিতা বলে। ইয়োবের এই কথাটা ছাড়া, “যিহোবা দিয়েছিলেন, যিহোবাই ফিরিয়ে নিয়েছেন, যিহোবার নাম ধন্য হোক,” মানুষ ইয়োবের মধ্যে অন্য কোনো ন্যায়পরায়ণতাই নির্ণয় করতে পারে না যা ঈশ্বরের দ্বারা প্রশংসিত হয়েছিল, এবং সেই কারণে তাদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষেরই ইয়োব সম্পর্কে মূল্যায়ন শুধুমাত্র উপলব্ধির অভাব, ভুল ধারণা, সন্দেহ, নিন্দা, ও তাত্ত্বিক অনুমোদনের চেয়ে বেশি কিছু নয়। তাদের কেউই প্রকৃতপক্ষে যিহোবা ঈশ্বরের এই বাক্য বুঝতে ও উপলব্ধি করতে সক্ষম নয় যে ইয়োব একজন নিখুঁত ও ন্যায়পরায়ণ মানুষ ছিল, এমন একজন যে ঈশ্বরে ভয় পেত এবং মন্দ কর্ম পরিত্যাগ করে চলত।
ইয়োব সম্পর্কে তাদের উপরোক্ত মনোভাবের ভিত্তিতে তার ন্যায়পরায়ণতা সম্পর্কে মানুষের আরো কিছু সন্দেহ রয়েছে, কারণ শাস্ত্রে ইয়োবের কাজের ও আচরণের যে বিবরণ রয়েছে তা মানুষের কল্পনামতো পৃথিবী কাঁপিয়ে দেওয়ার মতো বিরাট কিছু ছিল না। সে যে শুধু কোনো মহৎ কৃতিত্ব করেনি তা-ই নয়, বরং ছাইয়ের মাঝে বসে নিজের গা চুলকানোর জন্য কলসির টুকরো তুলে নিয়েছিল। এই কাজও মানুষকে বিস্মিত করে এবং ইয়োবের ন্যায়পরায়ণতার প্রতি তাদের সন্দেহ—এমনকি অবিশ্বাস—জাগিয়ে তোলে, কারণ নিজের শরীর চুলকানোর সময় সে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেনি বা ঈশ্বরের কাছে কোনো প্রতিশ্রুতি করেনি; এছাড়াও, তাকে যন্ত্রণায় চোখের জল ফেলতেও দেখা যায়নি। সেই সময়, মানুষ শুধু ইয়োবের দুর্বলতাই দেখতে পায়, এবং তাই এমনকি যখন তারা ইয়োবকে এ কথা বলতে শোনে “ঈশ্বরের হাত থেকে আমরা কি শুধু মঙ্গলই গ্রহণ করব? অমঙ্গল কিছুই গ্রহণ করব না?” তখন তারাও একেবারেই উদাসীন থাকে বা সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, তখনও ইয়োবের কথিত শব্দগুলো থেকে তার ন্যায়পরায়ণতা নির্ধারণ করতে পারে না। তার পরীক্ষায় যন্ত্রনা ভোগ করার সময় ইয়োবের আচরণ মানুষের মধ্যে ইয়োব সম্পর্কে যে প্রাথমিক ধারণা তৈরী করে তা হচ্ছে, সে ভীরুও ছিল না, অথবা উদ্ধতও ছিল না। ইয়োবের আচরণের পিছনে যে কাহিনী ছিল, যা তার হৃদয়ের গভীরে অভিনীত হয়ে চলেছিল, তা মানুষ দেখতে পায় না, অথবা তার হৃদয়ের ঈশ্বর ভীতি বা মন্দকে পরিত্যাগের পথের নীতিতে তার অবিচল থাকাও তারা দেখতে পায় না। তার প্রশান্ত আচরণ মানুষকে ভাবতে বাধ্য করে যে ইয়োবের ত্রুটিহীনতা ও ন্যায়পরায়ণতা শুধু শূন্যগর্ভ শব্দ ছাড়া কিছু ছিল না, এবং তার ঈশ্বর ভীতি নিছকই শোনা কথা; ইতিমধ্যে, তার বাহ্যিকভাবে প্রকাশিত “দুর্বলতা” মানুষের উপর গভীর ছাপ ফেলে, ইয়োবের প্রতি তাদের “নতুন দৃষ্টিভঙ্গি” প্রদান করে, এমনকি ঈশ্বর যে মানুষটাকে নিখুঁত ও ন্যায়পরায়ণ বলে সংজ্ঞায়িত করেন, তার প্রতি “নতুন উপলব্ধি” প্রদান করে। যখন ইয়োব নিজের মুখে নিজের জন্মের দিনটাকে অভিসম্পাত করেছিল, তখনই এই ধরনের “নতুন দৃষ্টিভঙ্গি” এবং “নতুন উপলব্ধি” প্রমাণিত হয়।
যদিও ইয়োবের ভোগ করা যন্ত্রণার মাত্রা যে কোনো মানুষের কাছেই অকল্পনীয় ও অসহনীয়, তবুও সে কোনো ধর্মদ্রোহি কথা বলেনি, শুধু নিজের মতো করে শরীরের যন্ত্রণা কমাবার চেষ্টা করেছিল মাত্র। শাস্ত্রে লিপিবদ্ধ রয়েছে, সে বলেছিল: “যেদিন আমি জন্মগ্রহণ করেছিলাম অভিশপ্ত হোক সেই দিন, যে রাতে আমি এসেছিলাম মাতৃজঠরে, সেই রাতও হোক অভিশপ্ত” (ইয়োবে ৩:৩)। হয়ত কেউ কখনোই এই কথাগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করেনি, আবার হয়ত এমনও কিছু মানুষ আছে যারা এগুলোর প্রতি মনোযোগ দিয়েছে। তোমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে, এই কথাগুলো থেকে কি মনে হয় যে ইয়োব ঈশ্বরের বিরোধিতা করেছিল? এগুলো কি ঈশ্বরের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ? আমি জানি তোমাদের মধ্যে অনেকেরই ইয়োবের রয়েছে, আর তোমাদের বিশ্বাস যে ইয়োব যদি নিখুঁত ও ন্যায়পরায়ণ হয়, তাহলে তার কোনো দুর্বলতা বা শোক প্রকাশ করা উচিত ছিল না, পরিবর্তে ইতিবাচকভাবে শয়তানের যে কোনো আক্রমণের সম্মুখীন হওয়া উচিত ছিল, এমনকি শয়তানের প্রলোভনের সম্মুখে হাসা উচিত ছিল। শয়তান তাকে যে দৈহিক যন্ত্রণা দিয়েছিল, তার কোনোটার প্রতিই তার সামান্যতম প্রতিক্রিয়া থাকাও উচিত ছিল না, এবং তার হৃদয়ে কোনোরকম আবেগ প্রদর্শন করাও তার উচিত ছিল না। এমনকি তার বলা উচিত ছিল ঈশ্বর যেন এই পরীক্ষা আরও কঠোর করে দেন। একজন অটল এবং প্রকৃতই ঈশ্বরে ভীত ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগকারী মানুষের এটাই প্রদর্শন করা উচিত এবং তার এই সমস্ত কিছুর অধিকারী হওয়া উচিত। এই চরম যন্ত্রণার মধ্যে, ইয়োব শুধু তার জন্মের দিনটাকে অভিসম্পাত করেছিল। সে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেনি, ঈশ্বরের বিরোধিতা করার অভিপ্রায়ও তার ছিল না। এটা করার চেয়ে বলা অনেক সহজ, কারণ প্রাচীন কাল থেকে আজ পর্যন্ত, কেউ কখনো এই ধরনের প্রলোভনের অভিজ্ঞতা লাভ করেনি বা ইয়োবের সাথে যা ঘটেছিল তা ভোগ করেনি। তাহলে আর কেউই কখনো ইয়োবের মতো একই রকমের প্রলোভনের সম্মুখীন হয়নি কেন? কারণ, ঈশ্বরের দৃষ্টিতে আর কেউই এই দায়ভার বা অর্পিত দায়িত্ব বহন করতে সমর্থ নয়, ইয়োব যা করেছিল তা আর কেউই করতে পারত না, এছাড়াও, এরকম যন্ত্রনা তাদের উপর এসে পড়া সত্ত্বেও, নিজেদের জন্ম দিবসকে অভিসম্পাত করা ছাড়াও, ঈশ্বরের নাম ত্যাগ না করে কেউই থাকতে পারত না, এবং ইয়োবের মতো ক্রমাগত যিহোবা ঈশ্বরের গুণকীর্তন চালিয়ে যেতে পারত না। আর কেউ কি এটা করতে পারত? ইয়োবের সম্পর্কে এ কথা বলার সময় আমরা কি তার আচরণের প্রশংসা করছি? সে ছিল একজন ন্যায়পরায়ণ মানুষ, এবং ঈশ্বরের এমন সাক্ষ্য বহনে সমর্থ, এবং সে শয়তানকে মাথা নিচু করে পালাতে বাধ্য করতে সক্ষম ছিল, যাতে সে আর কখনো তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করার জন্য ঈশ্বরের সামনে আসতে না পারে—তাহলে তাকে প্রশংসা করায় ভুল কী আছে? এমন কি হতে পারে যে তোমাদের গুণমান ঈশ্বরের চেয়ে উচ্চতর? এমন কি হতে পারে যে তোমাদের উপর পরীক্ষা এসে পড়লে তোমরা এমনকি ইয়োবের চেয়েও ভালোভাবে তার সম্মুখীন হতে পারবে? ইয়োব ছিল ঈশ্বরের দ্বারা প্রশংসিত—তোমাদের এতে কী আপত্তি থাকতে পারে?
ইয়োব নিজের জন্ম দিবসকে অভিসম্পাত করেছিল, কারণ সে তার জন্য ঈশ্বরকে কষ্ট পেতে দিতে চায়নি
আমি প্রায়ই বলি যে ঈশ্বর মানুষের হৃদয়ের অন্তঃস্থল প্রত্যক্ষ করেন, আর মানুষ শুধু মানুষের বাহ্যিক দিকটাই দেখে। যেহেতু ঈশ্বর মানুষের হৃদয়ের অন্তঃস্থল প্রত্যক্ষ করেন, তাই তিনি তাদের সারসত্য উপলব্ধি করতে পারেন, যেখানে মানুষ অন্যদের বহিরঙ্গের ভিত্তিতেই তাদের সারসত্য নির্ধারণ করে। যখন ইয়োব নিজের মুখে নিজের জন্মের দিনটাকে অভিসম্পাত করেছিল, তার এই কাজ তার তিনজন বন্ধুর পাশাপাশি সমস্ত আধ্যাত্মিক সত্তাদেরও বিস্মিত করেছিল। মানুষ ঈশ্বরের থেকে এসেছে, এবং ঈশ্বর তাকে যে জীবন ও দেহ প্রদান করেছেন, ও সেইসাথে তার জন্মের দিবস, সেজন্য তার ঈশ্বরের কাছে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত, এগুলোকে অভিসম্পাত করা উচিত নয়। সাধারণ মানুষ যা উপলব্ধি ও ধারণা করতে পারে তা এটাই। ঈশ্বরের অনুগামী যে কারোর কাছেই এই ধারণা পবিত্র ও অলঙ্ঘনীয়, এবং এটা এমন একটা সত্যি যা কখনো পরিবর্তিত হতে পারে না। অপরদিকে, ইয়োব নিয়ম ভঙ্গ করেছিল: সে নিজের জন্ম দিবসকে অভিসম্পাত করেছিল। এই কাজটা সাধারণ মানুষের কাছে নিষিদ্ধ এলাকা অতিক্রমের সমতুল্য ছিল। ইয়োবের যে শুধু মানুষের সহানুভূতি ও সমবেদনার অধিকার নেই তা-ই নয়, ঈশ্বরের ক্ষমা পাওয়ার অধিকারও তার নেই। একই সাথে, আরো অনেকেই ইয়োবের ন্যায়পরায়ণতা সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে ওঠে, কারণ এরকম মনে হয় যে ইয়োবের প্রতি ঈশ্বরের অনুগ্রহ তাকে অসংযমী করে তুলেছিল; তা তাকে এতটাই সাহসী ও বেপরোয়া করে তুলেছিল যে তার জীবদ্দশায় ঈশ্বরের দেওয়া আশীর্বাদ ও যত্নের জন্য সে তাঁকে ধন্যবাদ তো জানায়ইনি, বরং তার জন্মের দিনটাকে ধ্বংসের জন্য অভিসম্পাতও করেছিল। এটা ঈশ্বরের বিরোধিতা ছাড়া আর কী? এরকম অগভীর বিষয়গুলোকে মানুষ ইয়োবের এই কাজের নিন্দা করার জন্য প্রমাণ হিসাবে ব্যবহার করে, কিন্তু কে বুঝতে পারে যে সেই সময় ইয়োব সত্যিই কী ভাবছিল? ইয়োব কেন এমন করেছিল, তার কারণ কেই বা জানে? এখানে শুধুমাত্র ঈশ্বর এবং ইয়োব নিজে অন্তর্নিহিত কাহিনী ও কারণগুলো জানে।
যখন শয়তান ইয়োবের অস্থিতে আঘাত করার জন্য নিজের হাত বাড়িয়েছিল, তখন ইয়োব তার কবলে পড়ে গিয়েছিল, তার কাছে পালাবার উপায় বা প্রতিরোধ করার কোনো শক্তিই ছিল না। তার শরীর ও আত্মা এক সাঙ্ঘাতিক যন্ত্রণা ভোগ করেছিল, এবং রক্তমাংসের মানুষ কতটা তুচ্ছ, ভঙ্গুর এবং ক্ষমতাহীন তা এই যন্ত্রণা থেকেই সে গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিল। একই সময়ে সে এটাও গভীরভাবে অনুভব ও উপলব্ধি করেছিল যে কী কারণে ঈশ্বর মানবজাতির দেখাশোনা ও যত্ন করার মনোভাব পোষণ করেন। শয়তানের থাবায় পড়ে ইয়োব বুঝতে পারে যে রক্ত মাংসের মানুষ আসলে কতটা দুর্বল ও শক্তিহীন। নতজানু হয়ে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করার সময় তার মনে হয়েছিল ঈশ্বর যেন নিজের মুখমণ্ডল আচ্ছাদিত করছেন এবং লুকোতে চাইছেন, কারণ ঈশ্বর তাকে সম্পূর্ণ ভাবেই শয়তানের হাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন। একই সময়ে, ঈশ্বরও তার জন্য কেঁদেছিলেন, এবং তার জন্য দুঃখিতও হয়েছিলেন; ঈশ্বর তার ব্যথায় ব্যথিত, তার আঘাতে আহত হয়েছিলেন…। ইয়োব ঈশ্বরের কষ্ট অনুভব করেছিল এবং ঈশ্বরের কাছে তা যে কতটা অসহনীয় তাও উপলব্ধি করতে পেরেছিল…। ইয়োব ঈশ্বরের উপর আর কোনো শোক নিয়ে আসতে চায়নি বা ঈশ্বর তার জন্য কাঁদুন তাও চায়নি, তার জন্যে ঈশ্বর কষ্ট পান তা তো একেবারেই চায়নি। এইরকম পরিস্থিতিতে, শরীরের অসহনীয় যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে ইয়োব শুধু চাইছিল তার দেহ পরিত্যাগ করতে, কারণ তাতে ঈশ্বরও তার যন্ত্রণায় কষ্ট পাওয়া থেকে মুক্তি পাবেন—কিন্তু তা সে পারেনি, এবং শুধুমাত্র এই শারীরিক যন্ত্রণাই নয়, সাথে সাথে ঈশ্বরকে উদ্বিগ্ন না করার ইচ্ছার যন্ত্রণাও তাকে ভোগ করতে হয়েছিল। এই দুই যন্ত্রণা—একটা শরীরের, অন্যটা আত্মার—ইয়োবের উপর এক হৃদয়বিদারক, মর্মস্পর্শী পীড়া সৃষ্টি করেছিল, এবং সে উপলব্ধি করেছিল যে রক্তমাংসের মানুষের সীমাবদ্ধতা তাকে কতটা হতাশ ও অসহায় করে তুলতে পারে। এই পরিস্থিতিতে, তার ঈশ্বরের প্রতি আকুতি আরও তীব্রতর হয়ে উঠেছিল, এবং শয়তানের প্রতি ঘৃণাও আরও প্রগাঢ় হয়ে উঠেছিল। সেই সময়ে, তার জন্য ঈশ্বরের এই যন্ত্রণা বা অশ্রু দেখার চেয়ে ইয়োব সম্ভব হলে বেছে নিত মানবজগতে কখনো জন্ম না নেওয়া বা আদৌ তার অস্তিত্বই না থাকা। সে তার শরীরকে ঘৃণা করতে শুরু করেছিল, নিজের প্রতি, নিজের জন্মের দিনটার প্রতি, এমনকি তার সাথে সংযুক্ত সমস্ত কিছুর প্রতি বিরক্ত ও বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠেছিল। সে তার জন্মদিন বা সেই সম্পর্কিত কোনোকিছুর আর উচ্চারণ পর্যন্ত হোক তা আর চায়নি, তাই সে তার মুখ খুলে নিজের জন্মদিনের প্রতি অভিসম্পাত জানিয়েছিল: “যেদিন আমি জন্মগ্রহণ করেছিলাম অভিশপ্ত হোক সেই দিন, যে রাতে আমি এসেছিলাম মাতৃজঠরে, সেই রাতও হোক অভিশপ্ত। সেই দিনটি হোক অন্ধকারে আচ্ছন্ন, ঈশ্বর যেন সেই দিনটি আর স্মরণ না করেন, আর যেন কখনও আলোকিত না হয় সেই দিন” (ইয়োবে ৩:৩-৪)। ইয়োবের এই কথাগুলো তার নিজের সম্পর্কেই ঘৃণা প্রদর্শন করে, “যেদিন আমি জন্মগ্রহণ করেছিলাম অভিশপ্ত হোক সেই দিন, যে রাতে আমি এসেছিলাম মাতৃজঠরে, সেই রাতও হোক অভিশপ্ত,” একইভাবে নিজের প্রতি দোষারোপ ও ঈশ্বরকে পীড়া দেওয়ার জন্য ঋণের বোধ তার কথায় প্রতিফলিত হয়, “সেই দিনটি হোক অন্ধকারে আচ্ছন্ন, ঈশ্বর যেন সেই দিনটি আর স্মরণ না করেন, আর যেন কখনও আলোকিত না হয় সেই দিন।” এই দুই অনুচ্ছেদ ইয়োবের সেই সময়কার অনুভূতিকে চূড়ান্তভাবে প্রকাশ করে এবং তার ত্রুটিহীনতা ও ন্যায়নিষ্ঠতাকে যথাযথভাবে বর্ণনা করে। একই সময়ে, ঠিক ইয়োব যেমন চেয়েছিল, তেমনভাবেই ঈশ্বরের প্রতি তার বিশ্বাস ও আনুগত্য, এবং সেইসাথে তার ঈশ্বর ভীতিও প্রকৃতই উন্নততর স্তরে পৌঁছেছিল। অবশ্যই, তার এই উন্নতি ছিল সুনির্দিষ্টভাবে সেই প্রভাব, যা ঈশ্বর প্রত্যাশা করেছিলেন।
ইয়োব শয়তানকে পরাজিত করে ঈশ্বরের চোখে একজন প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠে
যখন ইয়োব প্রথম তার পরীক্ষার মধ্য দিয়ে গেল, তখন তার কাছ থেকে সমস্ত সম্পত্তি ও তার সন্তানসন্ততিদের কেড়ে নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু এর ফলে তার পতন ঘটেনি বা সে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে কোনো পাপবাক্য উচ্চারণ করেনি। সে শয়তানের প্রলোভন জয় করেছিল, এবং তার বস্তুগত সম্পদ, তার সন্তানসন্ততি, এবং এবং তার পার্থিব সম্পত্তি হারানোর পরীক্ষাও অতিক্রম করেছিল, অর্থাৎ বলা যায় যে ঈশ্বর তার থেকে সমস্ত কিছু কেড়ে নেওয়ার সময়েও সে ঈশ্বরকে মান্য করতে সক্ষম হয়েছিল এবং ঈশ্বর যা করেছেন তার জন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ ও স্তুতি নিবেদন করতেও সক্ষম হয়েছিল। শয়তানের প্রথমবারের প্রলোভনের সময় ইয়োবের আচরণ এমনই ছিল, এবং ঈশ্বরের প্রথম পরীক্ষার সময়ও তার সাক্ষ্য এমনই ছিল। দ্বিতীয় পরীক্ষায় শয়তান ইয়োবকে যন্ত্রণা দেওয়ার লক্ষ্যে হস্ত প্রসারিত করেছিল, এবং ইয়োব এমন যন্ত্রণা অনুভব করেছিল যা সে আগে কখনো অনুভব করেনি, তবুও তার সাক্ষ্য সবাইকে স্তম্ভিত করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট ছিল। শয়তানকে আরও একবার পরাজিত করার জন্য সে তার মনোবল, দৃঢ়তা, ও ঈশ্বরের প্রতি আনুগত্যের পাশাপাশি তার ঈশ্বরে ভীতিকে ব্যবহার করেছিল, এবং তার আচরণ ও তার সাক্ষ্য আরো একবার ঈশ্বরের অনুমোদন ও আনুকূল্য লাভ করেছিল। এই প্রলোভনের সময়, ইয়োব তার প্রকৃত আচরণের মাধ্যমে শয়তানের কাছে ঘোষণা করেছিল যে শারীরিক যন্ত্রণা ঈশ্বরের প্রতি তার বিশ্বাস ও আনুগত্যকে পরিবর্তন করতে বা ঈশ্বরের প্রতি তার সমর্পণ ও ঈশ্বরে ভীতিকে ছিনিয়ে নিতে সক্ষম নয়; সে মৃত্যুর সম্মুখীন হয়েছে বলে কখনোই ঈশ্বরকে পরিত্যাগ করবে না বা নিজের ত্রুটিহীনতা ও ন্যায়পরায়ণতাকে ত্যাগ করবে না। ইয়োবের সংকল্প শয়তানকে কাপুরুষ করে দিয়েছিল, তার বিশ্বাস শয়তানকে ভীরু ও কম্পমান করে তুলেছিল, যে তীব্রতার সাথে সে জীবন-মরণের যুদ্ধে শয়তানের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল তা শয়তানের মধ্যে এক গভীর ঘৃণা ও অসন্তোষের জন্ম দিয়েছিল; তার ত্রুটিহীনতা ও ন্যায়পরায়ণতা শয়তানের কাছে তার ক্ষতি করার কোনো উপায় অবশিষ্ট রাখেনি, এতটাই যে শয়তান ইয়োবের প্রতি তার আক্রমণ বন্ধ করেছিল এবং তার বিরুদ্ধে যিহোবা ঈশ্বরের সম্মুখে করা অভিযোগ ফিরিয়ে নিয়েছিল। যার অর্থ ছিল যে ইয়োব পৃথিবীকে অতিক্রম করেছিল, দেহকে অতিক্রম করেছিল, শয়তানকে অতিক্রম করেছিল, এবং মৃত্যুকেও অতিক্রম করে গিয়েছিল। সে ছিল সমগ্র ও সম্পূর্ণভাবে ঈশ্বরের একজন মানুষ। এই দুটো পরীক্ষার সময়, ইয়োব তার সাক্ষ্যে অটল ছিল, প্রকৃতপক্ষেই নিজের ত্রুটিহীনতা ও ন্যায়পরায়ণতাকে জীবনে যাপন করেছিল, এবং ঈশ্বরে ভীতি ও মন্দকে পরিত্যাগের জীবন-নীতির পরিধিকে প্রশস্ত করেছিল। এই দুই পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে অতিক্রম করা ইয়োবের মধ্যে এক সমৃদ্ধতর অভিজ্ঞতার জন্ম দিয়েছিল, এবং এই অভিজ্ঞতা তাকে আরো বেশী পরিণত ও পোক্ত করে তুলেছিল, তাকে আরো বেশী শক্তিশালী ও দৃঢ়প্রত্যয়ী করে তুলেছিল, এবং যে সততার প্রতি সে অটল ছিল তার যথার্থতা ও যোগ্যতা সম্পর্কে তাকে আরো প্রত্যয়ী করে তুলেছিল। যিহোবা ঈশ্বরের পরীক্ষাগুলো ইয়োবকে মানুষের সম্পর্কে ঈশ্বরের যত্নের এক গভীর উপলব্ধি ও বোধ প্রদান করেছিল, এবং তাকে ঈশ্বরের ভালোবাসার মূল্যবানতার ধারণা পেতে দিয়েছিল, যেখান থেকে তার ঈশ্বরে ভীতির সাথে ঈশ্বরের প্রতি বিবেচনা ও ভালোবাসাও যুক্ত হয়েছিল। যিহোবা ঈশ্বরের পরীক্ষাগুলো ইয়োবকে তাঁর থেকে বিচ্ছিন্ন করেনি, বরং তার হৃদয়কে ঈশ্বরের আরও নিকটে নিয়ে এসেছিল। ইয়োবের শারীরিক যন্ত্রণা যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছিল, তখন তার জন্য যিহোবা ঈশ্বরের যে উদ্বেগ সে উপলব্ধি করতে পেরেছিল, তার ফলে তার কাছে নিজের জন্মদিবসকে অভিশাপ দেওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প অবশিষ্ট ছিল না। এই আচরণ দীর্ঘ-পরিকল্পিত ছিল না, বরং তা ছিল তার হৃদয়ের অভ্যন্তর থেকে ঈশ্বরের প্রতি বিবেচনা ও ভালোবাসার এক স্বাভাবিক প্রকাশ, তা ছিল এক স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ যা এসেছিল ঈশ্বরের প্রতি তার বিবেচনা ও ভালোবাসা থেকে। অর্থাৎ বলা যায় যে যেহেতু সে নিজেকে ঘৃণা করতো, এবং ঈশ্বরকে কষ্ট দিতে অনিচ্ছুক ও অরাজি ছিল, সেই কারণেই তার বিবেচনা ও ভালোবাসা নিঃস্বার্থপরতার পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিল। এই সময়ে, ইয়োব ঈশ্বরের প্রতি তার দীর্ঘস্থায়ী আরাধনা, আকুতি ও নিষ্ঠাকে ঈশ্বরের প্রতি বিবেচনা ও ভালোবাসার স্তরে উত্তোলিত করেছিল। সেই একই সাথে, সে ঈশ্বরের প্রতি তার বিশ্বাস ও আনুগত্যকে এবং তার ঈশ্বরে ভীতিকে, বিবেচনা ও ভালোবাসার স্তরে উন্নীত করেছিল। সে নিজেকে এমন কোনো কাজ করা থেকে বিরত রেখেছিল যা ঈশ্বরের ক্ষতিসাধন করতে পারে, এবং নিজেকে এমন কোনো আচরণের অনুমতি দেয়নি যা ঈশ্বরকে আহত করতে পারে, এবং তার নিজের কারণে ঈশ্বরের উপর কোনোপ্রকার দুঃখ, শোক, বা বিষণ্ণতা নিয়ে আসা থেকে বিরত থেকেছিল। ঈশ্বরের চোখে এই ইয়োব সেই আগের ইয়োব হলেও, তার বিশ্বাস, আনুগত্য ও ঈশ্বরভীতি ঈশ্বরকে সম্পূর্ণ পরিতৃপ্তি ও আনন্দ প্রদান করেছিল। এই সময়ে ইয়োব সেই ত্রুটিহীনতা অর্জন করেছিল যা ঈশ্বর তার থেকে প্রত্যাশা করেছিলেন; ঈশ্বরের চোখে সে হয়ে উঠেছিল এমন এক মানুষ যে সত্যিই “নিখুঁত ও ন্যায়পরায়ণ” বলে অভিহিত করার যোগ্য। তার ধার্মিক ক্রিয়াকলাপ তাকে শয়তানের বিরুদ্ধে জয়ী হতে ও ঈশ্বরের প্রতি নিজের সাক্ষ্যে অবিচল থাকতে সাহায্য করেছিল। একইভাবে, তার ন্যায়পরায়ণ ক্রিয়াকলাপ তাকে নিখুঁত করে তুলেছিল, এবং তার জীবনের মূল্যকে বরাবরের চেয়ে উন্নীত ও সীমাহীন স্তরে নিয়ে গিয়েছিল, এবং সেগুলো সেইসাথে তাকে করে তুলেছিল এমন প্রথম ব্যক্তি যে আর কখনোই শয়তানের দ্বারা আক্রান্ত বা প্রলোভিত হবে না। যেহেতু ইয়োব ন্যায়পরায়ণ ছিল, তাই সে শয়তানের দ্বারা অভিযুক্ত ও আক্রান্ত হয়েছিল; যেহেতু ইয়োব ন্যায়পরায়ণ ছিল, তাই তাকে শয়তানের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল; এবং যেহেতু ইয়োব ন্যায়পরায়ণ ছিল, তাই সে শয়তানকে অতিক্রম ও পরাজিত করতে পেরেছিল, এবং নিজের সাক্ষ্যে অবিচল থাকতে পেরেছিল। অতঃপর ইয়োব হয়ে উঠেছিল প্রথম ব্যক্তি যাকে আর কখনোই শয়তানের হাতে সমর্পণ করা হবে না, সে সত্যিই ঈশ্বরের সিংহাসনের সম্মুখে এসেছিল এবং শয়তানের গুপ্তচরবৃত্তি বা অধঃপতনবিহীন অবস্থায় ঈশ্বরের আশীর্বাদধন্য হয়ে আলোতে বাস করেছিল…। সে ঈশ্বরের চোখে হয়ে উঠেছিল একজন প্রকৃত মানুষ; তাকে মুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল …
ইয়োবের সম্বন্ধে
ইয়োব কীভাবে পরীক্ষাগুলোর মধ্যে দিয়ে গেছিল তা জানার পর তোমাদের মধ্যে বেশিরভাগজনই হয়ত ইয়োবের সম্পর্কে আরও বিস্তারিতভাবে জানতে আগ্রহী হবে, বিশেষত সে কীভাবে ঈশ্বরের প্রশংসা অর্জন করল সেই রহস্য সম্পর্কে। চলো আজ তাহলে ইয়োবকে নিয়ে কথা বলা যাক!
ইয়োবের প্রাত্যহিক জীবনে আমরা তার ত্রুটিহীনতা, ন্যায়পরায়ণতা, ঈশ্বরে ভীতি ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগকে দেখতে পাই
ইয়োবের সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে আমাদের শুরু করতে হবে ঈশ্বরের নিজের মুখে উচ্চারিত ইয়োবের মূল্যায়ন দিয়ে: “তার মত সৎ ও বিশ্বস্ত লোক পৃথিবীতে কেউ নেই। সে আমার ভক্ত, মন্দের পথ সে পরিহার করে চলে।”
প্রথমে ইয়োবের ত্রুটিহীনতা ও ন্যায়পরায়ণতা সম্পর্কে জানা যাক।
“নিখুঁত” ও “ন্যায়পরায়ণ” এই দুটো শব্দ সম্পর্কে তোমাদের কী ধারণা? তোমরা কি বিশ্বাস করো যে ইয়োবের মধ্যে নিন্দা করার মতো কিছু ছিল না, সে সম্মান পাওয়ার যোগ্য ছিল? এটা অবশ্য “নিখুঁত” ও “ন্যায়পরায়ণ” এই শব্দ দুটোর আক্ষরিক ব্যাখ্যা ও ধারণা হবে। কিন্তু ইয়োবের সম্পর্কে প্রকৃত ধারণা পেতে গেলে বাস্তব জীবনের পরিপ্রেক্ষিতেই পেতে হবে—শুধুমাত্র বাক্য, বই বা তত্ত্ব কোনো উত্তর দিতে পারবে না। আমরা প্রথমে ইয়োবের পারিবারিক জীবনের দিকে লক্ষ্য করব, তার জীবনের স্বাভাবিক আচরণ কেমন ছিল, তা জানব। এ থেকে আমরা তার জীবনের নীতি ও উদ্দেশ্যের পাশাপাশি তার ব্যক্তিত্ব ও সাধনা সম্পর্কেও জানতে পারবো। এখন ইয়োব ১:৩-এর শেষ কথাগুলো পড়া যাক: “সমগ্র প্রাচ্য দেশে তিনি ছিলেন সব চেয়ে ধনী ব্যক্তি।” এই কথাগুলো থেকে যা বোঝা যায় তা হল ইয়োবের মর্যাদা ও অবস্থান ছিল খুবই উঁচু, যদিও আমাদের বলা হয়নি যে সে কেন সমগ্র প্রাচ্যের সকলের চেয়ে মহান ছিল, তার প্রচুর সম্পদের জন্য, নাকি সে নিখুঁত ও ন্যায়পরায়ণ এবং ঈশ্বর-ভীত ও মন্দকর্ম পরিত্যাগকারী ছিল বলে, কিন্তু সামগ্রিকভাবে আমরা জানি যে ইয়োবের মর্যাদা ও অবস্থান খুবই প্রশংসনীয় ছিল। বাইবেলে বলা আছে, ইয়োব সম্পর্কে মানুষের প্রাথমিক ধারণা ছিল যে সে নিখুঁত, সে ঈশ্বরে ভীত ও সে মন্দ কর্ম পরিত্যাগ করেছে, এবং সে প্রভূত সম্পত্তি ও শ্রদ্ধেয় মর্যাদার অধিকারী। এইরকম একটা পরিবেশ ও এইরকম একটা পরিস্থিতিতে বসবাসকারী একজন সাধারণ মানুষ হিসাবে ইয়োবের খাদ্যাভ্যাস, তার জীবনের গুণমান, ও তার ব্যক্তিগত জীবনের বিভিন্ন দিকগুলো অধিকাংশ মানুষের মনোযোগের কেন্দ্র হয়ে উঠত; তাই আমাদের অবশ্যই শাস্ত্রবাক্যের পাঠ চালিয়ে যেতে হবে: “ইয়োবের পুত্রেরা তাদের বাড়িতে পালা করে সকলের জন্য ভোজের আয়োজন করত এবং তিন বোনকে তারা সেই ভোজে নিমন্ত্রণ করত। ভোজের পরের দিন ভোরে ইয়োব তাঁর পুত্রদের শুচীকরণের জন্য প্রত্যেকের নামে বলি উৎসর্গ করতেন কারণ তিনি মনে করতেন তাঁর পুত্রেরা হয়তো অনিচ্ছাকৃতভাবে ঈশ্বরকে অবজ্ঞা করে পাপ করে ফেলেছে। (ইয়োবে ১:৪-৫)” এই অনুচ্ছেদ থেকে আমরা দুটো বিষয় জানতে পারি: প্রথমটা হল যে ইয়োবের পুত্র-কন্যারা নিয়মিত প্রচুর খাদ্য ও পানীয় সহযোগে ভোজের আয়োজন করত; আর দ্বিতীয়টা হল, ইয়োব প্রায়ই অগ্নিদগ্ধ বলি উৎসর্গ করত কারণ সে প্রায়ই তার পুত্র-কন্যাদের নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ত, তার ভয় হত যে তারা পাপ করছে, তাদের হৃদয়ে তারা ঈশ্বরকে পরিত্যাগ করেছে। এর মধ্যে দুই ভিন্ন ধরনের মানুষের জীবনযাত্রা বর্ণিত হয়েছে। প্রথম হল ইয়োবের পুত্র-কন্যারা, যারা ঘনঘন ভোজের আয়োজন করত, তারা তাদের পার্থিব সম্পদের প্রাচুর্যের কারণে মন ভরে আহার ও পানীয় আহরণ করে বিলাসবহুল জীবন যাপন করত। এইরকম জীবনযাপনের ফলে অপরিহার্যভাবে তারা প্রায়ই পাপকর্ম করত ও ঈশ্বরকে ক্ষুব্ধ করে তুলত—তবুও তারা নিজেদের পরিশুদ্ধ করেনি বা অগ্নিদগ্ধ বলি উৎসর্গ করেনি। তাহলে তোমরা দেখতেই পাচ্ছ যে সেইসময়ে তাদের মনে ঈশ্বরের জন্যে কোনো জায়গা ছিল না, তারা ঈশ্বরের অনুগ্রহ নিয়ে কখনো চিন্তা করেনি, ঈশ্বরকে ক্ষুব্ধ করতে ভয় পায়নি, এবং নিজেদের হৃদয়ে ঈশ্বরকে পরিত্যাগ করতেও ভয় পায়নি। অবশ্য আমাদের কেন্দ্রবিন্দু ইয়োবের সন্তানেরা নয়, বরং এই ধরণের পরিস্থিতির সামনে পড়ে ইয়োব কী করেছে সেইটা কেন্দ্রবিন্দু; এটাই সেই অন্য বিষয় যা ওই অনুচ্ছেদে বর্ণনা করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ইয়োবের প্রাত্যহিক জীবন এবং তার মানবিকতার নির্যাস। বাইবেলে যেখানে ইয়োবের পুত্র ও কন্যাদের ভোজের কথা বলা হয়েছে, সেখানে কোথাও ইয়োবের উল্লেখ নেই, শুধু এটুকুই বলা হয়েছে যে তার পুত্র-কন্যারা একসাথে ঘনঘন ভোজন ও পানাহার করত। অন্যভাবে বললে, ইয়োব কখনো এই ভোজ আয়োজন করেনি, কখনো তার পুত্র ও কন্যার সাথে লাগামহীন ভোজনে যোগও দেয়নি। যদিও ইয়োব সমৃদ্ধিশালী ছিল এবং প্রচুর সম্পদ ও ভৃত্যের মালিক ছিল, কিন্তু তার জীবন বিলাসবহুল ছিল না। জীবনযাপনের এই সর্বশ্রেষ্ঠ পরিবেশেও সে বিভ্রান্ত হয়নি, তার সম্পত্তির প্রাচুর্য তাকে দৈহিক উপভোগে নিমজ্জিত করতে পারেনি, ঐশ্বর্যের কারণে সে অগ্নিদগ্ধ বলি উৎসর্গ করতে ভুলে যায়নি, এবং ঐশ্বর্য তার হৃদয় থেকে ধীরে ধীরে ঈশ্বরকে পরিত্যাগ করার কোনো কারণও সৃষ্টি করতে পারেনি। স্পষ্টতই, ইয়োব সেইসময় তার জীবনযাত্রায় অনুশাসন মেনে চলত, তার উপরে ঈশ্বরের আশীর্বাদ থাকার ফলে সে লোভী বা ভোগবাদী ছিল না, এবং জীবনের গুণমানের বিষয়েও তার কোনো কঠোর মনোভাব ছিল না। বরং সে ছিল বিনয়ী, নম্র, সে নিজেকে আড়ম্বরপূর্ণ ভাবে জাহির করেনি, এবং সে ঈশ্বরের সম্মুখে সতর্ক ও যত্নশীল ছিল। সে প্রায়ই ঈশ্বরের অনুগ্রহ ও আশীর্বাদ নিয়ে চিন্তাভাবনা করত, এবং সবসময়েই ঈশ্বরে ভীত ছিল। তার প্রাত্যহিক জীবনে সে প্রায়ই সকালে উঠে তার পুত্র-কন্যাদের কারণে অগ্নিদগ্ধ বলি উৎসর্গ করত। অন্যভাবে বলা যায়, ইয়োব শুধু যে নিজে ঈশ্বরে ভীত ছিল তাই নয়, সে আশা করত যে তার সন্তানেরাও একইভাবে ঈশ্বরকে ভয় পাবে এবং ঈশ্বরবিরুদ্ধ কোনো পাপ কাজ করবে না। ইয়োবের হৃদয়ে তার পার্থিব সম্পদের কোনো জায়গা ছিল না, বা সেগুলো তার হৃদয়ে ঈশ্বরের স্থান অধিকার করেনি; তার নিজের স্বার্থেই হোক বা তার সন্তানদের স্বার্থেই হোক, ইয়োবের প্রাত্যহিক কর্ম ঈশ্বর ভীতি ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগের সঙ্গে যুক্ত ছিল। যিহোবার ঈশ্বর-ভীতি তার মুখের কথাতেই থেমে থাকেনি, বরং সেটাকে সে তার কাজে বাস্তবায়িত করেছিল, এবং তা তার দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটা কাজেই প্রতিফলিত হয়েছিল। ইয়োবের এই বাস্তব আচরণ থেকে আমরা দেখতে পাই যে সে ছিল সৎ, এবং তার মধ্যে ন্যায় ও ইতিবাচক বিষয়ের প্রতি ভালোবাসার এক নির্যাস ছিল। ইয়োব যে প্রায়ই তার পুত্রকন্যাদের পরিশোধনের জন্যে পাঠাত, তা থেকে বোঝা যায় যে তার সন্তানদের আচরণে তার অনুমোদন ছিল না, বরং মনে মনে সে তাদের আচরণে বীতশ্রদ্ধ ছিল এবং তাদের নিন্দা করত। সে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিল যে তার পুত্রকন্যাদের আচরণ যিহোবা ঈশ্বরের কাছে প্রীতিকর নয়, এবং তাই সে প্রায়ই তাদের বলত যিহোবা ঈশ্বরের সম্মুখে গিয়ে তাদের পাপ স্বীকার করতে। ইয়োবের কর্ম আমাদের কাছে তার মানবিকতার অন্য একটা দিক তুলে ধরে, যেখানে সে কখনোই তাদের সঙ্গ দেয়নি যারা প্রায়ই পাপ করে ও ঈশ্বরকে ক্ষুব্ধ করে, বরং তাদের পরিত্যাগ করেছে ও এড়িয়ে চলেছে। এমনকী তারা তার পুত্র-কন্যা হওয়া সত্ত্বেও সে তার আদর্শ থেকে সরে যায়নি, বা তাদের পাপকর্মকে নিজের ভাবাবেগের কারণে প্রশ্রয় দেয়নি। বরং সে তাদের উপদেশ দিয়েছে নিজেদের পাপ স্বীকার করে যিহোবা ঈশ্বরের সহিষ্ণুতা লাভ করতে, এবং তাদের সতর্ক করেছে যাতে তারা তাদের লোভ ও আনন্দের স্বার্থে ঈশ্বরকে পরিত্যাগ না করে। অন্যদের সাথে ইয়োবের আচরণের নীতিগুলো তার ঈশ্বরভীতি ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগের নীতির থেকে অবিচ্ছেদ্য। ঈশ্বর যা গ্রহণ করেছেন তা সে ভালোবেসেছে, এবং ঈশ্বর যা প্রত্যাখ্যান করেছেন তাকে সে ঘৃণা করেছে; নিজেদের হৃদয়ে যারা ঈশ্বরে ভীত তাদের সে ভালোবেসেছে, এবং যারা মন্দ কাজ করেছে বা ঈশ্বরের বিরুদ্ধে পাপ করেছে তাদের ঘৃণা করেছে। এরকম ভালোবাসা ও ঘৃণা তার প্রাত্যহিক জীবনে প্রকাশিত হয়েছে, এবং ঈশ্বরের চোখে ইয়োবের ন্যায়পরায়ণতা ছিল এটাই। স্বাভাবিকভাবেই, সেইসাথে এটা প্রাত্যহিক জীবনে অন্যদের সাথে ইয়োবের সম্পর্কের ক্ষেত্রে তার মানবিকতার এক বহিঃপ্রকাশ ও যাপন, যে বিষয়ে আমাদের অবশ্যই জানতে হবে।
ইয়োবের পরীক্ষা চলাকালীন তার মানবিকতার প্রকাশ (পরীক্ষা চলাকালীন ইয়োবের যে ত্রুটিহীনতা, ন্যায়পরায়ণতা, ঈশ্বর-ভীতি, ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগ, তাকে উপলব্ধি করা)
আমরা উপরে যা আলোচনা করেছি তা ইয়োবের পরীক্ষা পূর্ববর্তী প্রাত্যহিক জীবনে মানবিকতার বিভিন্ন দিক। নিঃসন্দেহে, এই বিভিন্ন প্রতিভাস ইয়োবের ন্যায়পরায়ণতা, ঈশ্বরভীতি ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগ করার একটা প্রাথমিক পরিচয় ও ধারণা প্রদান করে, এবং স্বাভাবিকভাবেই তা একটা প্রাথমিক স্বীকৃতিও প্রদান করে। “প্রাথমিক” বলছি কারণ ইয়োবের ব্যক্তিত্ব এবং সে যে মাত্রায় ঈশ্বরের প্রতি সমর্পন ও ঈশ্বর-ভীতির পথে সাধনা করেছিল, বেশীরভাগ মানুষেরই এখনও সে সম্পর্কে প্রকৃত ধারণা নেই। বলা যায় যে বাইবেলের দুটো অনুচ্ছেদে ইয়োবের বাক্য থেকে ইয়োবের সম্বন্ধে যে কিছুটা অনুকূল ধারণা পাওয়া যায়, ইয়োব সম্পর্কে অধিকাংশ মানুষের ধারণা তার চেয়ে বেশী গভীরে প্রসারিত নয়; সেই বাক্যদুটো হল, “যিহোবা দিয়েছিলেন, যিহোবাই ফিরিয়ে নিয়েছেন, যিহোবার নাম ধন্য হোক।” এবং “ঈশ্বরের হাত থেকে আমরা কি শুধু মঙ্গলই গ্রহণ করব? অমঙ্গল কিছুই গ্রহণ করব না?” তাই আমাদের ভীষণভাবে বোঝা প্রয়োজন যে ইয়োব যখন ঈশ্বরের পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছিল, তখন সে কীভাবে তার মানবিকতাকে নিজের জীবনে যাপন করেছিল; এইভাবেই ইয়োবের প্রকৃত মানবিকতার রূপকে সামগ্রিক ভাবে সকলের কাছে উপস্থাপিত করা যাবে।
যখন ইয়োব জেনেছিল যে তার সম্পত্তি চুরি হয়ে গেছে, তার পুত্র-কন্যারা প্রাণ হারিয়েছে, এবং তার ভৃত্যরা নিহত হয়েছে, তখন তার প্রতিক্রিয়া এরকম ছিল: “ইয়োব তখন আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। শোকে অভিভূত হয়ে তিনি তাঁর পোশাক ছিঁড়ে ফেললেন, মাথা কামালেন এবং মাটিতে উপুড় হয়ে প্রার্থনা করলেন” (ইয়োব ১:২০)। এই বাক্যগুলো থেকে আমরা একটা বিষয় দেখতে পাই: এই খবর শোনার পর ইয়োব আতঙ্কিত হয়ে পড়েনি, সে কেঁদে ওঠেনি বা যে ভৃত্যরা তাকে এই সংবাদ দিয়েছিল তাদের দোষারোপ করেনি, আর অপরাধস্থানে দিয়ে তদন্ত করে আসলে কী ঘটেছে তা খুঁজে বার করা তো আরোই দূরের কথা। সে তার সম্পত্তি হারিয়ে যাওয়ার কারণে কোনো কষ্ট বা আফশোস অভিব্যক্ত করেনি, বা তার সন্তান ও প্রিয়জনদের হারানোর ফলে কান্নায় ভেঙে পড়েনি। পরিবর্তে সে তার পোশাক ছিঁড়ে ফেলেছিল, মাথা কামিয়ে ফেলেছিল, মাটিতে বসে পড়েছিল, এবং উপাসনা করেছিল। ইয়োবের কার্যকলাপ কোনো সাধারণ মানুষের মতো নয়। তার এই কাজ অনেককেই বিভ্রান্ত করে দেয়, এবং তারা নিজেদের হৃদয়ে ইয়োবকে তার “অনুভূতিহীনতা”-র জন্য তিরস্কার করে। সম্পত্তির এই আকস্মিক ক্ষতির জন্য সাধারণ মানুষ মনমরা ও হতাশ হয়ে পড়ে, অথবা কিছুক্ষেত্রে তারা গভীর মানসিক অবসাদে চলে যায়। কারণ তাদের কাছে সম্পত্তি হল সারা জীবনের কাজের ফল—এর উপরেই তাদের বেঁচে থাকা নির্ভর করে, এটাই সেই আশা যা তাদের বাঁচিয়ে রাখে; সম্পত্তি হারানো মানে তাদের সারাজীবনের চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাওয়া, তাদের আর কোনো আশা নেই, এমনকী তাদের কোনো ভবিষ্যতও নেই। নিজের সম্পত্তি এবং সেই সম্পত্তির সাথে তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের প্রতি যে কোনো সাধারণ মানুষের মনোভাব এরকমই, এবং তাছাড়াও মানুষের চোখে সম্পত্তির গুরুত্বও এরকম। সেই গুরুত্ব এতটাই, যে তার সম্পত্তির ক্ষতি হয়ে যাওয়ার প্রতি ইয়োবের উদাসীন মনোভাবে অধিকাংশ মানুষ বিভ্রান্ত বোধ করে। ইয়োবের হৃদয়ে তখন কী ঘটছিল তার ব্যাখ্যার মাধ্যমে আজকে আমরা এই সব মানুষের অন্তরের এই বিভ্রান্তি দূরীভূত করতে চলেছি।
সাধারণ বুদ্ধিতে বলে যে ঈশ্বরের কাছ থেকে এরকম প্রভূত ঐশ্বর্য পেয়েও সেই সম্পদ হারানোর জন্য ঈশ্বরের সামনে ইয়োবের লজ্জিত হওয়া উচিত, কারণ সে সেই সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ ও যত্ন করতে পারেনি; ঈশ্বর তাকে যে সম্পদ দিয়েছিলেন তা সে রাখতে পারেনি। তাই, যখন সে শুনতে পেয়েছিল যে তার সম্পত্তি চুরি হয়ে গেছে, তার প্রথম প্রতিক্রিয়া হওয়া উচিত ছিল সেই অপরাধের জায়গায় যাওয়া আর যা যা হারিয়েছে সেই সবকিছুর একটা তালিকা তৈরি করা, ও তারপর ঈশ্বরের কাছে দোষ স্বীকার করা যাতে সে আরো একবার ঈশ্বরের আশীর্বাদ লাভ করতে পারে। কিন্তু ইয়োব এর কোনোটাই করেনি, এবং এরকম না করার জন্য তার নিজস্ব কিছু কারণ ছিল। ইয়োব গভীরভাবে বিশ্বাস করত যে তার যা কিছু আছে সব ঈশ্বরই তাকে দিয়েছেন, কিছুই তার নিজের শ্রমের ফল নয়। তাই, সে এই আশীর্বাদকে মূলধন হিসাবে ব্যবহার করার কথা ভাবেনি, বরং তার বেঁচে থাকার নীতিগুলোকে দৃঢ়বদ্ধ করেছিল সর্বশক্তি দিয়ে যে পথ তার ধরে রাখা উচিত তা ধরে রাখার জন্য। সে ঈশ্বরের আশীর্বাদকে সযত্নে লালন করেছিল এবং তার জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেছিল, কিন্তু সে আশীর্বাদে মোহিত হয়ে পড়েনি, বা আরও আশীর্বাদ প্রার্থনাও করেনি। সম্পত্তির প্রতি তার মনোভাব এরকমই ছিল। সে আশীর্বাদ লাভ করার লক্ষ্যেও কিছু করেনি, আবার ঈশ্বরের আশীর্বাদ কমে যাওয়ায় বা হারিয়ে যাওয়ায় চিন্তিত বা শোকস্তব্ধও হয়ে যায়নি; সে কখনোই ঈশ্বরের আশীর্বাদ লাভের ফলে বন্য ও বিকারগ্রস্তের মতো আনন্দিতও হয়নি, আবার প্রায়শই ঈশ্বরের আশীর্বাদ উপভোগ করার কারণে ঈশ্বরের করুণাকে ভুলে যায়নি বা ঈশ্বরের পথকে এড়িয়েও চলেনি। তার সম্পত্তির প্রতি ইয়োবের মনোভাব মানুষের কাছে তার প্রকৃত মানবিকতার রূপ প্রকাশিত করে: প্রথমত, ইয়োব লোভী ছিল না, এবং জাগতিক জীবনে সে চাহিদাবিহীন মানুষ ছিল। দ্বিতীয়ত, তার যা আছে সবই ঈশ্বর কেড়ে নেবেন এরকম দুশ্চিন্তা বা ভয় ইয়োবের কখনোই ছিল না, আর এটাই ঈশ্বরের প্রতি তার হৃদয়ের মনোভাব ও আনুগত্য; অর্থাৎ, ঈশ্বর তার কাছে থেকে সবকিছু কেড়ে নেবেন কি না বা কখন নেবেন সে বিষয়ে তার কোনো চাহিদা বা অভিযোগ ছিল না, এবং সে কারণ জানতে না চেয়েই শুধু ঈশ্বরের আয়োজনের প্রতি সমর্পিত থাকতে চেয়েছে। তৃতীয়ত, সে কখনো বিশ্বাস করেনি যে তার সম্পদ তার নিজের শ্রমের ফল, বরং বিশ্বাস করতো এই সমস্তই তার প্রতি ঈশ্বরের দান। এটাই হল ঈশ্বরের প্রতি ইয়োবের বিশ্বাস, আর এটাই তার দৃঢ়তার চিহ্ন। ইয়োবের মানবিকতা ও তার প্রকৃত দৈনন্দিন সাধনা কি এই তিনটে বক্তব্যে পরিষ্কার হয়েছে? ইয়োবের মানবিকতা ও সাধনা তার সম্পত্তির ক্ষতির সম্মুখে শান্ত আচরণের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ইয়োবের প্রাত্যহিক জীবনের সাধনাই তাকে ঈশ্বরের পরীক্ষার সময়ে আত্মিক উচ্চতা ও দৃঢ়তা প্রদান করেছিল এই বাক্য বলার: “যিহোবা দিয়েছিলেন, যিহোবাই ফিরিয়ে নিয়েছেন, যিহোবার নাম ধন্য হোক”। এই কথাগুলো রাতারাতি অর্জিত হয়নি, বা অকস্মাৎ ইয়োবের মস্তিষ্কে আবির্ভূত হয়নি। তার বহু বছরের জীবনের অভিজ্ঞতা লাভের সময় সে যা দেখেছে ও অর্জন করেছে এগুলো আসলে সেটাই। যারা ঈশ্বরের কাছে শুধু আশীর্বাদের সন্ধান করে, যারা ভয় পায় যে ঈশ্বর তাদের কাছ থেকে সমস্ত কিছু ছিনিয়ে নেবেন, এবং সেটাকে ঘৃণা করে ও সে সম্পর্কে অভিযোগ করে, তাদের তুলনায় ইয়োবের আনুগত্য কী অনেক বেশী বিশুদ্ধ নয়? যারা বিশ্বাস করে যে ঈশ্বর আছেন, কিন্তু তিনিই যে সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ড পরিচালনা করেন তা বিশ্বাস করে না, তাদের সকলের সাথে তুলনা করলে ইয়োব কি প্রভূত সততা ও ন্যায়পরায়ণতার অধিকারী নয়?
ইয়োবের যৌক্তিকতা
ইয়োবের বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং ন্যায়নিষ্ঠ ও সৎ মানবিকতাই তাকে সম্পত্তি ও সন্তানাদি হারানোর কালে সর্বাধিক যৌক্তিকতাপূর্ণ বিচার ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে চালিত করেছিল। এই ধরনের যুক্তিপূর্ণ পছন্দগুলো তার প্রাত্যহিক সাধনার সাথে, এবং ঈশ্বরের যেসকল কর্মের বিষয়ে সে তার দৈনন্দিন জীবনে জানতে পেরেছিল তার সাথে, অবিচ্ছেদ্য ভাবে জড়িত ছিল। ইয়োবের সততাই তাকে বিশ্বাস করতে সমর্থ করে তুলেছিল যে যিহোবাই সমস্ত বস্তুর নিয়ন্তা; তার বিশ্বাসই তাকে জানতে দিয়েছিল সমস্ত বস্তুর উপরে যিহোবা ঈশ্বরের সারভৌমত্বের বিষয়ে; তার জ্ঞানই তাকে যিহোবা ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব ও আয়োজন মান্য করার বিষয়ে ইচ্ছুক ও সক্ষম করে তুলেছিল; তার আনুগত্যই যিহোবা ঈশ্বরের প্রতি ভীতির ক্ষেত্রে তাকে আরো খাঁটি করে তুলেছিল; তার ভীতি তাকে মন্দ কর্ম পরিত্যাগের পথে আরো বিশুদ্ধ করে তুলেছিল; পরিশেষে, ইয়োবের ঈশ্বর ভীতি ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগের কারণেই সে নিখুঁত হয়ে উঠেছিল; তার নিখুঁত হয়ে ওঠাই তাকে প্রাজ্ঞ করে তুলেছিল, দিয়েছিল পরম যৌক্তিকতা।
“যুক্তিবাদী” শব্দটাকে আমাদের কীভাবে উপলব্ধি করা উচিত? আক্ষরিক ব্যাখ্যা অনুসারে এর অর্থ হল মঙ্গলময় বোধের অধিকারী হওয়া, চিন্তাভাবনায় যুক্তিসঙ্গত ও সংবেদনশীল হওয়া, দৃঢ় বক্তব্য, ক্রিয়াকলাপ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম হওয়া, এবং সঠিক ও স্বাভাবিক নৈতিক মানের অধিকারী হওয়া। তবুও ইয়োবের যৌক্তিকতা এত সহজে ব্যাখ্যা করা যায় না। যখন বলা হয় যে ইয়োব পরম যৌক্তিকতার অধিকারী ছিল, সে কথা তার মানবিকতা ও ঈশ্বরের সম্মুখে তার আচরণের বিষয়েই বলা হয়। সৎ হওয়ার কারণে, ইয়োব ঈশ্বরের সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস করতে ও তা মান্য করতে সক্ষম হয়েছিল, আর এটাই তাকে এমন জ্ঞান প্রদান করেছিল, যা বাকিদের পক্ষে অর্জন করা অসম্ভব ছিল; তার সাথে যা ঘটেছিল, সে এই জ্ঞানের মাধ্যমেই তা আরো সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে, বিচার করতে, ও সংজ্ঞায়িত করতে পেরেছিল, আর এগুলোই তাকে কী করতে হবে ও কীসে দৃঢ় থাকতে হবে তা নির্ভুল ও বিচক্ষণভাবে বেছে নিতে সক্ষম করেছিল। অর্থাৎ বলা যায় যে তার বাক্য, আচরণ, তার ক্রিয়াকলাপের পিছনে নিহিত নীতি, এবং কার্যকলাপের বিধি ছিল নিয়মিত, স্পষ্ট, ও সুনির্দিষ্ট, এবং তা অন্ধ, আবেগপ্রবণ, বা অনুভূতিপ্রবণ ছিল না। তার সাথে যা ঘটেছিল সেটার প্রতি কেমন আচরণ করতে হবে তা সে জানত, সে জানত কীভাবে জটিল ঘটনাগুলোর মধ্যে সম্পর্কে ভারসাম্য বজায় রাখতে এবং পরিচালনা করতে হয়, যে পথে দৃঢ় থাকা উচিত সেখানে কীভাবে দৃঢ় থাকতে হয় তা সে জানত, তাছাড়াও, যিহোবা ঈশ্বরের দেওয়া ও ফিরিয়ে নেওয়ার প্রতি কেমন মনোভাব দেখানো উচিত তা-ও সে জানত। এটাই ছিল ইয়োবের প্রকৃত যৌক্তিকতা। সুনির্দিষ্টভাবে এরকম যৌক্তিকতায় সজ্জিত ছিল বলেই তার সম্পত্তি ও পুত্র-কন্যাদের হারিয়েও ইয়োব বলেছিল, “যিহোবা দিয়েছিলেন, যিহোবাই ফিরিয়ে নিয়েছেন, যিহোবার নাম ধন্য হোক।”
যখন ইয়োব সমস্ত শরীরে প্রবল যন্ত্রণার সম্মুখীন হয়েছিল, যখন সে তার আত্মীয় ও বন্ধুদের অভিযোগের সম্মুখীন হয়েছিল, এবং যখন সে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিল, তখন ইয়োব যে আচরণ করেছিল তা আরও একবার তার প্রকৃত রূপ সকলকে দেখিয়েছিল।
ইয়োবের বাস্তবিক রূপ: প্রকৃত, বিশুদ্ধ, এবং কৃত্রিমতা বিহীন
ইয়োব ২:৭-৮ পড়া যাক: “শয়তান যিহোবার কাছ থেকে চলে গেল এবং ইয়োবের আপাদমস্তক যন্ত্রণাদায়ক ক্ষতে ভরিয়ে দিল। এবং সে গা চুলকানোর জন্য ভাঙ্গা কলসীর টুকরো নিয়ে ছাইয়ের গাদায় গিয়ে বসল।” সারা শরীরে যন্ত্রণাময় ফোঁড়ার প্রাদুর্ভাবের সময় ইয়োবের আচরণের বিষয়ে এই বিবরণ দেওয়া হয়েছে। এই সময়ে, ইয়োব যন্ত্রণা সহ্য করতে ছাইয়ের ওপর গিয়ে বসেছিল। কেউই তার তার চিকিৎসা করেনি, তার শরীরের যন্ত্রণা কমাতে কেউই সাহায্য করেনি; পরিবর্তে সে নিজের যন্ত্রণাময় ফোঁড়ার উপরিভাগ চেঁছে তোলার জন্য পাত্রের টুকরো ব্যবহার করেছিল। বাহ্যিকভাবে, এটা শুধু ছিল ইয়োবের যন্ত্রণার একটা পর্যায় মাত্র, এর সাথে ইয়োবের মানবিকতা বা ঈশ্বরের প্রতি ভীতির কোনো সম্পর্ক ছিল না, কারণ ইয়োব সেই সময়ে কোনো কথাই বলেনি যা থেকে তার মানসিক অবস্থা ও দৃষ্টিভঙ্গি বোঝা যায়। তবু তা সত্ত্বেও ইয়োবের ক্রিয়াকলাপ এবং আচরণই তার মানবিকতার প্রকৃত প্রকাশ। আগের অধ্যায়ের বিবরণে আমরা পড়েছি যে ইয়োব ছিল প্রাচ্যের শ্রেষ্ঠ মানুষ। ইতিমধ্যে, দ্বিতীয় অধ্যায়ের এই অনুচ্ছেদ থেকে আমরা দেখতে পাই যে প্রাচ্যের শ্রেষ্ঠ মানুষ সত্যিসত্যিই ছাইয়ের গাদায় বসে নিজের শরীর চুলকানোর জন্য ভাঙা কলসীর টুকরো তুলে নিয়েছিল। এই দুটো বিবরণের মধ্যে কি স্পষ্ট পার্থক্য দৃশ্যমান নয়? এই বৈপরীত্যই ইয়োবের প্রকৃত সত্তা আমাদের দেখায়: সম্মানীয় অবস্থান ও মর্যাদা থাকা সত্ত্বেও সে কখনো এসবের প্রতি কোনো অনুরাগ বা মনোযোগ প্রদর্শন করেনি; তার সামাজিক অবস্থানকে অন্যরা কীভাবে দেখত সে বিষয়ে তার কোনো মনোযোগ ছিল না, অথবা তার আচরণ বা ক্রিয়াকলাপ তার মর্যাদায় কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে কি না, সে বিষয়েও সে নিরুদ্বেগ ছিল; সে নিজের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য কোনো চেষ্টা করেনি, বা নিজের মর্যাদা ও অবস্থানের কারণে আসা মহিমাও সে উপভোগ করেনি। সে শুধু যিহোবা ঈশ্বরের নজরে নিজের জীবনযাপনের মূল্য ও গুরুত্বের প্রতি মনোযোগ দিয়েছিল। তাই ইয়োবের সারসত্যই ছিল তার প্রকৃত রূপ: সে খ্যাতি ও সৌভাগ্যকে ভালোবাসেনি, এগুলোর জন্য জীবন অবিবাহিতও করে নি; সে ছিল প্রকৃত, বিশুদ্ধ, এবং কৃত্রিমতা বিহীন।
ইয়োব কর্তৃক ভালোবাসা ও ঘৃণার পৃথকীকরণ
ইয়োবের ও তার স্ত্রীর এই কথোপকথনের মাধ্যমেও তার মানবিকতার অপর একটা দিক প্রদর্শিত হয়: “ইয়োবের স্ত্রী তখন তাঁকে বললেন, এখনও তুমি তোমার বিশ্বাস আঁকড়ে ধরে আছ? এর চেয়ে বরং ঈশ্বরকে ধিক্কার দিয়ে মৃত্যুবরণ কর। ইয়োব তাঁকে বললেন, তুমি মূর্খের মত কথা বলছ, ঈশ্বরের হাত থেকে আমরা কি শুধু মঙ্গলই গ্রহণ করব? অমঙ্গল কিছুই গ্রহণ করব না?” (ইয়োবে ২:৯-১০)। ইয়োবকে যন্ত্রণায় কষ্ট পেতে দেখে তার স্ত্রী যন্ত্রণা থেকে অব্যাহতি পেতে সাহায্য করার জন্য তাকে পরামর্শ দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তার এই “হিতকারী উদ্দেশ্য” ইয়োব অনুমোদন করেনি; পরিবর্তে এতে সে ক্রোধান্বিত হয়েছিল, কারণ তার স্ত্রী যিহোবা ঈশ্বরের প্রতি তার বিশ্বাস ও আনুগত্যকে অস্বীকার করেছিল, যিহোবা ঈশ্বরের অস্তিত্বকেও অস্বীকার করেছিল। এটা ছিল ইয়োবের পক্ষে অসহনীয়, কারণ সে কখনোই নিজেকে, বা অন্য কাউকেই এমন কোনো কাজ করতে অনুমতি দেয়নি যা ঈশ্বরের বিরোধিতা করে বা তাঁকে আহত করে। অন্যদের মুখে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে ধর্মনিন্দাকারী এবং অপমানজনক বাক্য শোনার পরেও সে কীভাবে উদাসীন থাকতে পারত? তাই সে নিজের স্ত্রীকে “নির্বোধ স্ত্রীলোক” বলে সম্বোধন করেছিল। নিজের স্ত্রীর প্রতি ইয়োবের মনোভাবে ছিল ক্রোধ ও ঘৃণা, সেইসাথে নিন্দা ও তিরস্কার। এটাই ছিল ইয়োবের মানবিকতার স্বাভাবিক প্রকাশ—ভালোবাসা এবং ঘৃণার পৃথকীকরণ—আর এটাই ছিল তার ন্যায়পরায়ণ মানবিকতার প্রকৃত উপস্থাপনা। ইয়োবের মধ্যে ন্যায়নিষ্ঠতার উপলব্ধি ছিল—যার ফলে সে মন্দত্বের প্রবণতাকে ঘৃণা করতে পেরেছিল, এবং অযৌক্তিক ধর্মদ্রোহ, হাস্যকর যুক্তি ও আজগুবি বক্তব্যকে ঘৃণা করতে, নিন্দা করতে ও প্রত্যাখ্যান করতে সক্ষম হয়েছিল, আর জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত ও নিকটজন কর্তৃক পরিত্যক্ত হওয়ার সময় সে তার নিজস্ব সঠিক নীতি ও অবস্থানে প্রকৃতই দৃঢ় থাকতে পেরেছিল।
ইয়োবের উদারতা এবং আন্তরিকতা
যেহেতু ইয়োবের আচরণ থেকেই আমরা তার মানবিকতার বিভিন্ন দিকের অভিব্যক্তি দেখতে পাই, তাহলে নিজের জন্ম দিবসকে অভিসম্পাত করার জন্য যখন ইয়োব মুখ খুলেছিল, সেখান থেকে আমরা তার মানবিকতার কোন দিকটা প্রত্যক্ষ করতে পারি? নিচের অংশে আমরা এই বিষয়টা নিয়েই আলোচনা করবো।
নিজের জন্মদিবসকে ইয়োবের অভিসম্পাত করার ঘটনার উৎপত্তি বিষয়ে আমি উপরে আলোচনা করেছি। তোমরা সেখানে কী দেখতে পাও? ইয়োব যদি কঠিন হৃদয়সম্পন্ন একজন মানুষ হতো, তার মধ্যে ভালোবাসা না থাকত, সে যদি নিঃস্পৃহ, আবেগবর্জিত ও মানবিকতাহীন হতো, তাহলে কি সে ঈশ্বরের হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষার বিষয়ে যত্নবান হতে পারত? ঈশ্বরের হৃদয়ের বিষয়ে যত্নবান ছিল বলেই কি সে নিজের জন্মের দিনটির প্রতি অভিসম্পাত করেছিল? অন্য ভাষায়, যদি ইয়োব কঠিন হৃদয়ের মানবিকতা বর্জিত মানুষ হতো, তাহলে ঈশ্বরের যন্ত্রণা কি তাকে পীড়িত করতে পারত? ঈশ্বর তার দ্বারা ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন বলেই কি সে তার জন্মের দিনটাকে অভিসম্পাত দিয়েছিল? উত্তর হল, একেবারেই না! সহৃদয় হওয়ার কারণে ইয়োব ঈশ্বরের হৃদয়ের প্রতি যত্নবান ছিল; ঈশ্বরের হৃদয়ের প্রতি যত্নবান ছিল বলেই ইয়োব ঈশ্বরের বেদনা অনুভব করেছিল; সহৃদয় ছিল বলেই সে ঈশ্বরের যন্ত্রণা অনুধাবন করার ফলে নিজে আরও বেশি যন্ত্রণা ভোগ করেছিল; ঈশ্বরের যন্ত্রণা অনুভব করেছিল বলেই সে তার জন্মের দিনটাকে ঘৃণা করতে শুরু করেছিল, এবং সেজন্যই তার জন্মের দিনটাকে অভিসম্পাত করেছিল। বাইরের লোকেদের কাছে, পরীক্ষার সময় ইয়োবের সম্পূর্ণ আচরণ ছিল দৃষ্টান্তমূলক। শুধুমাত্র নিজের জন্মের দিনটাকে অভিসম্পাত করাই ইয়োবের ত্রুটিহীনতা ও ন্যায়নিষ্ঠতার উপর একটা প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দেয়, অথবা একটা পৃথক মূল্যায়ন প্রদান করে। প্রকৃতপক্ষে, এটাই ছিল ইয়োবের মানবিকতার সারসত্যের বিশুদ্ধতম প্রকাশ। তার মানবিকতার সারসত্য প্রচ্ছন্ন বা মোড়কে আবৃত ছিল না, অথবা অন্য কারোর দ্বারা সংশোধিত ছিল না। নিজের জন্মের দিনটাকে অভিসম্পাত করার মাধ্যমে সে তার গভীর হৃদয়ের উদারতা ও আন্তরিকতা প্রদর্শন করেছিল; সে ছিল এমন একটা প্রস্রবণের মতো, যার জল এতই স্বচ্ছ ও পরিষ্কার যে তার তলদেশ পর্যন্ত দৃশ্যমান।
ইয়োবের বিষয়ে এই সমস্ত কিছু জানার পরে, বেশিরভাগ লোকই নিঃসন্দেহে ইয়োবের মানবিকতার সারসত্যের বিষয়ে বেশ নির্ভুল ও বস্তুগত মূল্যায়ন করবে। এছাড়াও তাদের মধ্যে ঈশ্বর কর্তৃক ব্যক্ত ইয়োবের ত্রুটিহীনতা ও ন্যায়নিষ্ঠতা সম্পর্কে দৃঢ়, বাস্তবিক এবং আরো উন্নত উপলব্ধি ও প্রশংসার মনোভাব থাকা উচিত। আশা করি, এই উপলব্ধি ও প্রশংসা মানুষকে ঈশ্বরে ভীতি ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগের প্রকৃত পথে চলার সূচনা করতে সাহায্য করবে।
ঈশ্বরের ইয়োবকে শয়তানের হাতে তুলে দেওয়া এবং ঈশ্বরের কাজের লক্ষ্যের মধ্যে সম্পর্ক
যদিও অধিকাংশ মানুষ এখন বুঝতে পেরেছে যে ইয়োব ত্রুটিমুক্ত ও ন্যায়নিষ্ঠ ছিল এবং সে ঈশ্বরে ভীত ছিল ও মন্দকে পরিত্যাগ করে চলত, কিন্তু এই উপলব্ধি ঈশ্বরের অভিপ্রায় সম্পর্কে তাদের কোনো বৃহত্তর ধারণা দেয় না। ইয়োবের মানবিকতা ও সাধনার প্রতি ঈর্ষান্বিত হওয়ার পাশাপাশি তারা ঈশ্বরকে প্রশ্ন করে: ইয়োব এত নিখুঁত ও ন্যায়নিষ্ঠ ছিল, লোকজন তাকে এত সম্মান করত, তাহলে ঈশ্বর তাকে শয়তানের হাতে তুলে দিয়ে তাকে এত যন্ত্রণার সম্মুখীন করেছিলেন কেন? এই ধরনের প্রশ্ন অনেকের হৃদয়েই থাকতে বাধ্য—অথবা বলা যায়, এই সংশয় অনেকের হৃদয়েরই প্রশ্ন। যেহেতু এই বিষয়টা অনেককেই বিহ্বল করেছে, তাই আমাদের অবশ্যই এই প্রশ্নটা আলোচনা করতে হবে এবং যথাযথভাবে এটার ব্যাখ্যা করতে হবে।
ঈশ্বর যা করেন তার সবকিছুই প্রয়োজনীয় এবং অসাধারণ তাত্পর্যময়, কারণ তিনি মানুষের মধ্যে যা করেন তা তাঁর ব্যবস্থাপনা এবং মানবজাতির পরিত্রাণের সঙ্গে সম্পর্কিত। স্বাভাবিকভাবেই, ঈশ্বর জোবের মধ্যে যে কাজ করেছিলেন তা ভিন্ন নয়, যদিও জোব ঈশ্বরের দৃষ্টিতে নিখুঁত এবং ন্যায়নিষ্ঠ ছিলেন। অন্য কথায়, ঈশ্বর যা করেন বা যে উপায়ে তিনি তা করেন তা নির্বিশেষে, মূল্য নির্বিশেষে, তাঁর উদ্দেশ্য নির্বিশেষে, তাঁর কাজের উদ্দেশ্যের পরিবর্তন হয় না। তাঁর উদ্দেশ্য হল ঈশ্বরের বাক্যগুলি মানুষের মধ্যে কাজ করানো, সেইসঙ্গে মানুষের জন্য ঈশ্বরের চাহিদা এবং ইচ্ছা পূরণ করানো; অন্য কথায়, এটি হল ঈশ্বর তাঁর পদক্ষেপ অনুযায়ী যা ইতিবাচক বলে বিশ্বাস করেন মানুষের মধ্যে সেই কাজ সম্পাদন করা, ঈশ্বরের হৃদয়ের নাগাল পেতে এবং ঈশ্বরের সারসত্য অনুধাবন করতে মানুষকে সক্ষম করে তোলা, এবং মানুষকে ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব ও আয়োজন মেনে চলার অনুমতি দেওয়া, এইভাবে মানুষকে ঈশ্বরে ভীতি ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগ অর্জন করানো—এর সবই হল ঈশ্বরের সমস্ত কাজে তাঁর উদ্দেশ্যের একটি দিক। অন্য দিকটি হল, যেহেতু শয়তান হল ঈশ্বরের কাজের বিপরীত যা তাঁর কাজকে মহিমান্বিত করে, আর ঈশ্বরের কাজের সেবার সামগ্রী, তাই মানুষ প্রায়শই শয়তানকে প্রদত্ত হয়; এই হল সেই উপায় যা ঈশ্বর মানুষকে শয়তানের প্রলোভন দেখার অনুমতি দিতে ব্যবহার করেন, এবং শয়তানের দুষ্টতা, কদর্যতা, ও নীচতাকে আক্রমণ করেন, এইভাবে মানুষ শয়তানকে ঘৃণা করে এবং যা কিছু নেতিবাচক তা জানতে ও চিনতে সক্ষম হয়। এই প্রক্রিয়াটি তাদের সক্ষম করে তোলে ধীরে ধীরে শয়তানের নিয়ন্ত্রণ এবং অভিযোগ, হস্তক্ষেপ, ও আক্রমণ থেকে নিজেদের মুক্ত করতে—যতক্ষণ না ঈশ্বরের বাক্যসমূহ, তাদের জ্ঞান এবং ঈশ্বরের প্রতি আনুগত্য, এবং ঈশ্বরের প্রতি তাদের বিশ্বাস ও তাঁর প্রতি ভীতির সৌজন্যে তারা শয়তানের আক্রমণ এবং অভিযোগের উপর জয়লাভ করে; তবেই তারা সম্পূর্ণরূপে শয়তানের আধিপত্য থেকে মুক্তি পাবে। মানুষের মুক্তির অর্থ হল শয়তান পরাজিত হয়েছে, এর অর্থ হল তারা আর শয়তানের মুখের আহার নয়—তাদের গিলে ফেলার পরিবর্তে, শয়তান তাদের পরিত্যাগ করেছে। এর কারণ হল এই ধরনের মানুষ ন্যায়নিষ্ঠ হয়, কারণ তাদের বিশ্বাস, আনুগত্য এবং ঈশ্বরের প্রতি ভয় রয়েছে, এবং তারা শয়তানের সঙ্গে সম্পর্ক সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ করে। তারা শয়তানকে লজ্জিত করে, তারা শয়তানকে ভীরুতে পরিণত করে, এবং তারা শয়তানকে পুরোপুরি পরাজিত করে। ঈশ্বরের অনুসরণে তাদের প্রত্যয়, এবং ঈশ্বরের আনুগত্য ও ঈশ্বরের প্রতি ভীতি শয়তানকে পরাজিত করে, এবং শয়তানকে বাধ্য করে তাদের সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করতে। শুধুমাত্র এই ধরনের মানুষই প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বরের দ্বারা অর্জিত হয়েছে, এবং এটিই হল মানুষকে রক্ষা করায় ঈশ্বরের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য। যদি তারা পরিত্রাণ পেতে চায়, এবং ঈশ্বরের দ্বারা সম্পূর্ণরূপে অর্জিত হতে চায়, তবে যারা ঈশ্বরকে অনুসরণ করে তাদের অবশ্যই শয়তানের কাছ থেকে ছোট ও বড় উভয় ধরনের প্রলোভন ও আক্রমণেরই সম্মুখীন হতে হবে। যারা এই প্রলোভন ও আক্রমণের মধ্যে থেকে উদ্ভূত হয় এবং শয়তানকে সম্পূর্ণরূপে পরাজিত করতে সক্ষম হয় তারাই হল সেই মানুষ যারা ঈশ্বরের কাছে পরিত্রাণ পেয়েছে। এর অর্থ হল, যারা ঈশ্বরের কাছে পরিত্রাণ পেয়েছে তারা হল সেইসব মানুষ যারা ঈশ্বরের পরীক্ষার মধ্য দিয়ে গেছে এবং যারা শয়তানের দ্বারা বহুবার প্রলুব্ধ ও আক্রান্ত হয়েছে। যারা ঈশ্বরের কাছে পরিত্রাণ পেয়েছে তারা ঈশ্বরের ইচ্ছা এবং প্রয়োজনীয়তাগুলি বোঝে, এবং ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব ও আয়োজনের অনুবর্তী হতে সক্ষম, এবং তারা শয়তানের প্রলোভনের মাঝে পড়ে ঈশ্বরে ভীতি ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগের পথ থেকে সরে যায় না। যারা ঈশ্বরের কাছে পরিত্রাণ পায় তারা সততার অধিকারী, তারা দয়ালু, তারা প্রেম এবং ঘৃণার মধ্যে পার্থক্য করে, তাদের ন্যায়বিচারের বোধ রয়েছে ও তারা যুক্তিবাদী, এবং তারা ঈশ্বরের যত্ন করতে ও তাঁর সব কিছু মূল্যবান মনে করতে সক্ষম। এই ধরনের মানুষ শয়তানের দ্বারা আবদ্ধ নয়, তারা শয়তানের গুপ্তচরবৃত্তি, অভিযোগ বা অপব্যবহারের শিকার হয় না; তারা সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন, তারা সম্পূর্ণরূপে মুক্ত ও অব্যাহতিপ্রাপ্ত। জোব ঠিক এমনই একজন স্বাধীন মানুষ ছিলেন, এবং ঈশ্বর কেন তাকে শয়তানের হাতে তুলে দিয়েছিলেন তার সুনির্দিষ্ট তাৎপর্য ঠিক এটিই।
ইয়োব শয়তানের দ্বারা নিপীড়িত হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সে চিরন্তন স্বাধীনতা ও মুক্তিও অর্জন করেছিল, এবং সে আর কখনও শয়তানের ভ্রষ্টাচার, নিপীড়ন ও অভিযোগের শিকার না হওয়ার অধিকার অর্জন করেছিল, পরিবর্তে সে ঈশ্বরের মুখমণ্ডলের আলোকে মুক্ত এবং ভারমুক্ত জীবনযাপন করতে এবং ঈশ্বর প্রদত্ত আশীর্বাদের মধ্যে বেঁচে থাকতে পেরেছিল। কেউই তার এই অধিকার ছিনিয়ে নিতে, নষ্ট করতে বা বাজেয়াপ্ত করতে পারেনি। ঈশ্বরের প্রতি ইয়োবের বিশ্বাস, সংকল্প ও আনুগত্য এবং তার ঈশ্বর ভীতির বিনিময়ে তাকে এটা প্রদান করা হয়েছিল। পৃথিবীতে খুশী ও আনন্দ জিতে নেওয়ার জন্য, স্বর্গের দ্বারা অভিষিক্ত ও পৃথিবীর দ্বারা স্বীকৃত অধিকার ও স্বীকৃতি লাভ করার জন্য, পৃথিবীতে ঈশ্বরের প্রকৃত জীব হিসাবে বাধাহীন ভাবে সৃষ্টিকর্তাকে উপাসনা করার জন্য ইয়োব নিজের জীবনের মূল্য প্রদান করেছিল। ইয়োব যে প্রলোভন সহ্য করেছিল তার সবচেয়ে বড় ফলাফলও আবার এটাই ছিল।
মানুষের যখন উদ্ধার লাভ করা বাকি থাকে, তখন তাদের জীবনে শয়তান প্রায়ই হস্তক্ষেপ করে, এমনকি তা নিয়ন্ত্রণও করে। অন্য ভাষায়, যাদের উদ্ধার করা হয়নি, তারা শয়তানের কাছে বন্দী, তাদের কোনো স্বাধীনতা নেই, তারা শয়তানের দ্বারা পরিত্যক্ত হয়নি, তারা ঈশ্বরের উপাসনা করার যোগ্য বা অধিকারী নয়, এবং তাদের শয়তান ঘনিষ্ঠভাবে অনুসরণ করে ও ভয়ঙ্করভাবে আক্রমণ করে। বলার মতো কোনো সুখ এরকম মানুষদের নেই, বলার মতো স্বাভাবিক অস্তিত্বের অধিকার তাদের নেই, এবং বলার মতো মর্যাদাও তাদের নেই। শুধুমাত্র যদি তুমি উঠে দাঁড়িয়ে শয়তানের সাথে যুদ্ধ করতে পারো, ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস, আনুগত্য এবং ঈশ্বরের ভীতিকে অস্ত্র করে শয়তানের সাথে এমন সুতীব্র জীবন-মৃত্যুর লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে পারো, যাতে শয়তান সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হয় এবং তোমাকে দেখলেই লেজ গুটিয়ে ফেলে ও ভীত হয়ে ওঠে, যাতে সে যদি সম্পূর্ণভাবে তোমার বিরুদ্ধে আক্রমণ ও অভিযোগ করা বন্ধ করে দেয়—শুধু তখনই তুমি উদ্ধার লাভ করবে ও স্বাধীন হয়ে উঠবে। যদি তুমি শয়তানের শৃঙ্খল সম্পূর্ণ ছিঁড়ে বেরোনোর বিষয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হও, অথচ শয়তানকে পরাজিত করার পক্ষে সহায়ক অস্ত্র তোমার কাছে না থাকে, তাহলে তখনও তুমি বিপদের মধ্যেই থাকবে। সময়ের সাথে সাথে, যখন তুমি শয়তানের কাছে এতটাই অত্যাচারিত হয়েছ যে তোমার মধ্যে কণামাত্র শক্তিও অবশিষ্ট নেই, অথচ তখনও তুমি সাক্ষ্য বহনে সমর্থ হওনি, তোমার বিরুদ্ধে শয়তানের অভিযোগ ও আক্রমণের থেকে তখনও সম্পূর্ণ মুক্তিলাভ করতে পারোনি, তাহলে তোমার পরিত্রাণের খুব সামান্যই আশা থাকবে। পরিশেষে, যখন ঈশ্বরের কাজের উপসংহার ঘোষিত হবে, তখনও তুমি শয়তানের মুঠোতেই থেকে যাবে, নিজেকে মুক্ত করতে অসমর্থ অবস্থায়, এবং এইভাবে তোমার আর কখনোই কোনো সুযোগ বা আশা থাকবে না। অর্থাৎ এর তাৎপর্য হল, এই ধরনের লোকেরা সম্পূর্ণরূপে শয়তানের বন্দীদশাতেই থেকে যাবে।
ঈশ্বরের পরীক্ষাগুলি গ্রহণ করো, শয়তানের প্রলোভনগুলি অতিক্রম করো, এবং ঈশ্বরকে তোমার সমগ্র সত্তা অর্জন করতে দাও
ঈশ্বরের স্থায়ী বিধান এবং মানুষের সমর্থনের কাজ করার সময়, তিনি মানুষের কাছে তাঁর ইচ্ছা এবং প্রয়োজনীয়তাগুলির সম্পূর্ণতার বিষয়ে বলেন এবং তাঁর কাজ, স্বভাব এবং তাঁর যা আছে এবং তিনি যা, তা মানুষের কাছে দেখান। উদ্দেশ্য হল মানুষকে মর্যাদা দিয়ে সজ্জিত করা, এবং মানুষকে ঈশ্বরের অনুসরণ করার সময় তাঁর কাছ থেকে বিভিন্ন সত্য অর্জন করানো—সেই সব সত্য যা শয়তানের সঙ্গে লড়াই করার জন্য মানুষকে ঈশ্বরের প্রদত্ত অস্ত্র। এইভাবে সজ্জিত হয়ে, মানুষকে ঈশ্বরের পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে। মানুষকে পরীক্ষা করার জন্য ঈশ্বরের অনেক উপায় এবং পন্থা রয়েছে, কিন্তু সেগুলির প্রতিটির জন্য ঈশ্বরের শত্রু শয়তানের “সহযোগিতা” প্রয়োজন। এর অর্থ হল, শয়তানের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য মানুষকে অস্ত্র দেওয়ার পরে, ঈশ্বর মানুষকে শয়তানের হাতে তুলে দেন এবং শয়তানকে মানুষের উচ্চতা “পরীক্ষা” করার অনুমতি দেন। মানুষ যদি শয়তানের যুদ্ধের সৈন্যবিন্যাস থেকে বেরিয়ে আসতে পারে, যদি সে শয়তানের ঘেরাটোপ থেকে বাঁচতে পারে এবং তারপরেও বেঁচে থাকতে পারে, তাহলে মানুষ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে। কিন্তু মানুষ যদি শয়তানের যুদ্ধের সৈন্যবিন্যাস ত্যাগ করতে ব্যর্থ হয় এবং শয়তানের বশ্যতা স্বীকার করে, তাহলে সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে না। ঈশ্বর মানুষের যে বিশেষ দিকেরই পরীক্ষা করুন না কেন, তাঁর পরীক্ষার মানদণ্ডগুলি হল, শয়তানের দ্বারা আক্রান্ত হলে মানুষ তার সাক্ষ্যে অটল থাকে কি না, এবং শয়তানের ফাঁদে পড়ে সে ঈশ্বরকে পরিত্যাগ করেছে কি না আর শয়তানের কাছে আত্মসমর্পণ এবং পরাজয় স্বীকার করেছে কি না। বলা যেতে পারে যে, মানুষকে রক্ষা করা যাবে কি না তা নির্ভর করে সে শয়তানকে অতিক্রম ও পরাস্ত করতে পারবে কি না তার উপর, এবং সে স্বাধীনতা অর্জন করতে পারবে কি না তা নির্ভর করে এর উপর যে সে নিজে সেই অস্ত্রগুলো উত্তোলন করতে সক্ষম কিনা, যেগুলো শয়তানের দাসত্ব কাটিয়ে ওঠার জন্য ঈশ্বর তাকে দিয়েছিলেন, যাতে শয়তান সম্পূর্ণরূপে আশা ত্যাগ করে এবং তাকে একা ছেড়ে দেয়। শয়তান যদি আশা ত্যাগ করে এবং কাউকে পরিত্যাগ করে, এর অর্থ হল শয়তান আর কখনও এই ব্যক্তিকে ঈশ্বরের কাছ থেকে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবে না, আর কখনও সেই ব্যক্তিকে দোষারোপ এবং তার বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না, আবার কখনও তাদের উপর যথেচ্ছাপূর্বক অত্যাচার বা আক্রমণ করবে না; শুধুমাত্র এই ধরনের কেউ একজনই প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বর দ্বারা অর্জিত হবে। এই হল সেই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে ঈশ্বর মানুষকে অর্জন করেন।
ইয়োবের সাক্ষ্যের দ্বারা পরবর্তী প্রজন্মকে দেওয়া সতর্কবাণী ও আলোকপ্রাপ্তি
ঈশ্বরের কোনো ব্যক্তিকে সম্পূর্ণভাবে অর্জন করার প্রক্রিয়াকে উপলব্ধি করার সাথে একই সময়েই মানুষ ঈশ্বরের ইয়োবকে শয়তানের হাতে তুলে দেওয়ার উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারবে। তখন মানুষ আর ইয়োবের যন্ত্রণা দেখে বিহ্বল নয়, এর তাৎপর্য তাদের মধ্যে নতুন সমাদর পেয়েছে। তারা নিজেরা ইয়োবের মতো প্রলোভনের সম্মুখীন হবে কি না সে বিষয়ে আর উদ্বিগ্ন নয়, এবং ঈশ্বরের পরীক্ষার সম্মুখীন হওয়াকে আর প্রতিরোধ বা অস্বীকার করে না। ইয়োবের বিশ্বাস ও আনুগত্য, এবং তার শয়তানকে অতিক্রম করার সাক্ষ্য, মানুষের কাছে বিরাট বড় সহায়তার এবং উৎসাহের উৎস হয়ে রয়েছে। ইয়োবের মধ্যে তারা নিজেদের পরিত্রাণের আশা প্রত্যক্ষ করে, আর এটাও দেখে যে ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস, আনুগত্য ও ভীতির মাধ্যমে শয়তানকে পরাজিত করা ও তার উপর প্রাধান্য বিস্তার করা সম্পূর্ণভাবে সম্ভব। তারা দেখে যে যতক্ষণ তারা ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব ও আয়োজন মেনে চলবে, যতক্ষণ সবকিছু হারানোর পরেও ঈশ্বরকে পরিত্যাগ না করার দৃঢ় সংকল্প ও বিশ্বাস বজায় রাখতে পারবে, ততক্ষণ তারা শয়তানকে অপমানিত এবং পরাজিত করতে পারে, তারা এও দেখে যে শয়তানকে ভীত করে তুলতে ও প্রহারের মাধ্যমে পশ্চাদপসরণে বাধ্য করতে তাদের প্রয়োজন শুধুমাত্র নিজের সাক্ষ্যে অটল থাকার দৃঢ় সংকল্প ও অধ্যবসায়—এমনকি তার জন্য যদি প্রাণও হারাতে হয়। ইয়োবের সাক্ষ্য পরবর্তী প্রজন্মগুলোর জন্য একটা সতর্কবাণী, এবং এই সতর্কবাণী তাদের বলে যে তারা যদি শয়তানকে পরাজিত না করে, তাহলে তারা কখনোই শয়তানের অভিযোগ ও হস্তক্ষেপ থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারবে না, বা কখনোই শয়তানের নিপীড়ন ও আক্রমণ থেকে অব্যাহতি পাবে না। ইয়োবের সাক্ষ্য পরবর্তী প্রজন্মকে আলোকিত করেছে। এই আলোকপ্রাপ্তি মানুষকে শেখায় যে তারা নিখুঁত ও ন্যায়নিষ্ঠ হলে শুধুমাত্র তবেই ঈশ্বরে ভীতি অর্জন ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগে সক্ষম হবে; এটা তাদের শেখায় যে শুধু ঈশ্বরে ভীতি অর্জন ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগে সক্ষম হলে তবেই তারা ঈশ্বরের শক্তিশালী ও দৃঢ় সাক্ষ্য বহন করতে পারবে; ঈশ্বরের শক্তিশালী ও দৃঢ় সাক্ষ্য বহন করতে পারলে তবেই তারা নিজেদের শয়তানের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করতে পারবে এবং ঈশ্বরের পথনির্দেশ ও সুরক্ষার ছায়ায় জীবনযাপন করতে পারবে—আর শুধুমাত্র তখনই তারা প্রকৃতপক্ষে উদ্ধার লাভ করবে। যারা পরিত্রাণের অন্বেষণ করে তাদের সকলেরই উচিত ইয়োবের ব্যক্তিত্ব ও জীবনের সাধনা অনুকরণ করা। সে তার সমগ্র জীবনকালে যা যাপন করেছিল এবং তার পরীক্ষার সময়কালে যে আচরণ করেছিল, সেগুলো তাদের সকলের কাছে একটা মূল্যবান সম্পদ যারা ঈশ্বরে ভীতি অর্জন ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগের পথের সাধনা করতে চায়।
ইয়োবের সাক্ষ্য ঈশ্বরকে স্বস্তি এনে দিল
যদি আমি এখন তোমাদের বলি যে ইয়োব একজন ভালো মানুষ ছিল, তোমরা হয়ত এই কথার নিহিত মর্ম উপলব্ধি করতে পারবে না, আমার এই সমস্ত কথার অন্তরালে থাকা আবেগ উপলব্ধি করতে পারবে না; কিন্তু সেই দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করো যেদিন তোমাদের ইয়োবের মতো বা অনুরূপ পরীক্ষার অভিজ্ঞতা লাভ করা হয়ে যাবে, যখন প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে যাওয়া হয়ে যাবে, যখন তোমাদের সেইসব পরীক্ষার অভিজ্ঞতা লাভ করা হয়ে যাবে যা ঈশ্বর ব্যক্তিগতভাবে তোমাদের জন্য আয়োজন করেছেন, যখন তুমি তোমার সমস্ত কিছু দিয়ে দেবে, এবং শয়তানের উপর প্রাধান্য বিস্তার করার জন্য ও প্রলোভনের মাঝেও ঈশ্বরের সাক্ষ্য বহন করার জন্য লাঞ্ছনা ও কষ্ট সহ্য করবে—তখনই তুমি আমার এই সমস্ত কথার অর্থ উপলব্ধি করতে পারবে। সেই সময়ে তুমি বুঝতে পারবে যে তুমি ইয়োবের থেকে কতই না নগণ্য, তুমি ইয়োবের মাধুর্য অনুভব করতে পারবে, বুঝবে সে সত্যিই অনুকরণযোগ্য। সেই সময় এলে তুমি উপলব্ধি করতে পারবে যে ইয়োবের ঐসব চিরায়ত বাক্যগুলো এই সময়ে বসবাসকারী ভ্রষ্ট মানুষের জন্য কতখানি গুরুত্বপূর্ণ, আর এটাও উপলব্ধি করবে যে ইয়োব যা অর্জন করেছিল তা বর্তমানের মানুষদের পক্ষে অর্জন করা কতটা কঠিন। যখন তুমি বুঝতে পারবে যে এটা বেশ কঠিন, তখনই তুমি উপলব্ধি করতে পারবে ঈশ্বরের হৃদয় কতখানি উদ্বিগ্ন ও চিন্তিত, তুমি উপলব্ধি করবে এই ধরনের মানুষদের অর্জন করতে ঈশ্বর কতখানি উচ্চ মূল্য প্রদান করেছেন, এবং মানবজাতির জন্য ঈশ্বর যা করেন ও যতটা ব্যয় করেন তা কত মূল্যবান। এখন এই সমস্ত বাক্য শোনার পর তোমরা কি ইয়োবের নির্ভুল উপলব্ধি ও সঠিক মূল্যায়ন করতে পেরেছ? তোমাদের দৃষ্টিতে, ইয়োব কি প্রকৃতই নিখুঁত ও ন্যায়নিষ্ঠ একজন মানুষ ছিল যে ঈশ্বরে ভীত ছিল এবং মন্দকে পরিত্যাগ করেছিল? আমার বিশ্বাস তোমাদের বেশিরভাগই নিশ্চিতভাবেই হ্যাঁ বলবে। কারণ ইয়োব যে কাজ করেছিল বা যা প্রকাশ করেছিল তা যেকোনো মানুষের কাছে বা শয়তানের কাছে অনস্বীকার্য। এগুলোই শয়তানের বিরুদ্ধে ইয়োবের বিজয়লাভের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রমাণ। ইয়োবের মধ্যেই এই প্রমাণের জন্ম হয়েছিল, আর এটাই ছিল ঈশ্বরের প্রাপ্ত প্রথম সাক্ষ্য। এইভাবে, ইয়োব যখন শয়তানের প্রলোভন জয় করে ঈশ্বরের সাক্ষ্য বহন করেছিল, তখন ঈশ্বর তার মধ্যে আশা প্রত্যক্ষ করেছিলেন, তাঁর হৃদয় ইয়োবের দ্বারা স্বস্তি লাভ করেছিল। সৃষ্টির সময় থেকে শুরু করে ইয়োবের সময় পর্যন্ত ঈশ্বর এই প্রথমবার ঈশ্বর প্রকৃতপক্ষে অনুভব করেছিলেন স্বস্তি কী, এবং মানুষের দ্বারা স্বস্তি লাভ করার অর্থ কী। এই প্রথমবার তিনি প্রকৃত সাক্ষ্য প্রত্যক্ষ করেছিলেন এবং অর্জন করেছিলেন, যা তাঁরই জন্যে বহন করা হয়েছিল।
আমি বিশ্বাস করি, ইয়োবের সাক্ষ্য এবং তার বিভিন্ন দিকের বিবরণ শোনার পর, বেশিরভাগ মানুষের কাছেই তাদের সামনের পথের বিষয়ে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকবে। একইভাবে, আমি এটাও বিশ্বাস করি যে যারা উদ্বেগ আর ভয়ে পরিপূর্ণ, তাদের অধিকাংশই ধীরে ধীরে শরীরে ও মনে স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করতে শুরু করবে, এবং একটু একটু করে স্বস্তি অনুভব করতে শুরু করবে …
পরবর্তী অনুচ্ছেদগুলোতেও ইয়োব সম্পর্কিত বিবরণ রয়েছে। চলো পড়তে থাকি।
৪. ইয়োব নিজের কানে ঈশ্বরকে শ্রবণ করেছিল
ইয়োবে ৯:১১ তিনি আমার সামনে দিয়ে চলে যান কিন্তু আমি তাঁকে দেখতে পাই না, চলে যান আমার পাশ দিয়ে আমি তাঁকে চিনতে পারি না।
ইয়োবে ২৩:৮-৯ দেখ, আমি পূর্ব দিকে গিয়েছি কিন্তু সেখানে তিনি নেই, পশ্চিমে গিয়েছি, সেখানেও তাঁকে পাইনি। আমি উত্তর দিকে তাঁকে খুঁজেছি কিন্তু তাঁর দেখা পাইনি, দক্ষিণ দিকে তাকিয়েছি কিন্তু দেখতে পাইনি তাঁকে।
ইয়োবে ৪২:২-৬ আমি জানি, তুমি সব কিছুই করতে পার, তোমার কোন সঙ্কল্প ব্যর্থ করা যায় না। তুমি বলেছ, তুমি কে যে অসার কথা দিয়ে, আমার প্রজ্ঞাকে আচ্ছন্ন করতে সাহস কর? সত্যিই, আমি যা বুঝি না তাই বলেছি, আমার অজানা পরামশ্চর্য বিষয় সম্পর্কে উক্তি করেছি। তুমি বলেছিলে শোন, আমি তোমাকে যা প্রশ্ন করি, তার উত্তর দাও। এর আগে আমি তোমার বিষয় কানে শুনেছিলাম কিন্তু এখন স্বচক্ষে তোমাকে দেখছি। তাই নিজের সম্পর্কে এখন আমি লজ্জিত ও মর্মাহত, ধূলায় ও ভস্মে বসে আমি তোমার কাছে নতি স্বীকার করছি।
যদিও ঈশ্বর নিজেকে ইয়োবের সম্মুখে প্রকাশ করেননি, কিন্তু ঈশ্বরের সার্বভৌমত্বে ইয়োবের বিশ্বাস ছিল
এই কথাগুলোর অভিঘাত কেমন? এর মধ্যে যে একটা সত্য আছে, তা কি তোমাদের মধ্যে একজনও উপলব্ধি করতে পেরেছে? প্রথমত, ইয়োব কী করে জানতে পেরেছিল যে ঈশ্বর বলে একজন আছেন? তারপর, সে কীভাবে জানল যে আকাশ, পৃথিবী এবং সমস্ত কিছু ঈশ্বরই শাসন করেন? এই দুটো প্রশ্নের উত্তর এই অনুচ্ছেদে আছে: “এর আগে আমি তোমার বিষয় কানে শুনেছিলাম কিন্তু এখন স্বচক্ষে তোমাকে দেখছি। তাই নিজের সম্পর্কে এখন আমি লজ্জিত ও মর্মাহত, ধূলায় ও ভস্মে বসে আমি তোমার কাছে নতি স্বীকার করছি।” এই বাক্যগুলো থেকে আমরা জানতে পারি যে ঈশ্বরকে নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করার পরিবর্তে, সে কিংবদন্তি থেকে ঈশ্বরের বিষয়ে জানতে পেরেছিল। এই সমস্ত পরিস্থিতিতেই সে ঈশ্বরকে অনুসরণ করার পথে চলতে শুরু করেছিল, তার পরেই সে নিজের জীবনে এবং সমস্ত কিছুর মধ্যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছিল। এখানে একটা অনস্বীকার্য সত্য রয়েছে—কী সেই সত্য? ঈশ্বরে ভীতি ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগের পথ অনুসরণে সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও, ইয়োব কখনোই ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করেনি। এই দিক দিয়ে দেখলে, সে কি বর্তমানের মানুষদের মতোই ছিল না? ইয়োব কখনো ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করেনি, যার তাৎপর্য হল, ঈশ্বরের সম্পর্কে শুনে থাকলেও সে জানত না ঈশ্বর কোথায় রয়েছেন, বা ঈশ্বর ঠিক কী রকম, অথবা ঈশ্বর কী করছেন। এগুলো সবই বিষয়গত ব্যাপার; নিরপেক্ষভাবে বলতে গেলে, যদিও সে ঈশ্বরকে অনুসরণ করতো, কিন্তু ঈশ্বর কখনোই তার সামনে আবির্ভূত হননি বা তার সাথে কথা বলেননি। এ কথা সত্যি নয় কি? যদিও ঈশ্বর ইয়োবের সাথে কথা বলেননি বা তাকে কোনো আদেশ দেননি, কিন্তু সে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রত্যক্ষ করেছিল, এবং সমস্ত কিছুর মাঝে, ও যে কিংবদন্তিতে সে নিজের কানে ঈশ্বরের সম্পর্কে শুনেছিল সেখানে, তাঁর সার্বভৌমত্ব উপলব্ধি করেছিল, যার পর সে ঈশ্বরে ভীতি ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগের জীবনে প্রবেশ করে। ইয়োবের ঈশ্বরকে অনুসরণ করার উৎপত্তি এবং প্রক্রিয়া ছিল এরকম। কিন্তু সে যতই ঈশ্বরে ভীতি ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগের পথে চলুক, যতই সততায় দৃঢ় থাকুক, ঈশ্বর কখনোই তার কাছে আবির্ভূত হননি। চলো এই অনুচ্ছেদটা পড়া যাক। সে বলেছিল “তিনি আমার সামনে দিয়ে চলে যান কিন্তু আমি তাঁকে দেখতে পাই না, চলে যান আমার পাশ দিয়ে আমি তাঁকে চিনতে পারি না” (ইয়োবে ৯:১১)। এই বাক্যগুলোয় যা বলা হচ্ছে তা হল, ইয়োব ঈশ্বরকে নিজের চারিপাশে অনুভব করেও থাকতে পারে, আবার না করেও থাকতে পারে—কিন্তু কখনোই সে ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করতে সক্ষম হয়নি। অনেক সময় সে কল্পনা করেছে যে ঈশ্বর তার সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছেন, অথবা কর্ম সম্পাদন করছেন, বা মানুষকে পথনির্দেশ দিচ্ছেন, কিন্তু সে কখনো সেসবের সত্যতা জানতে পারেনি। ঈশ্বর তখনই মানুষের কাছে আসেন যখন সে সেটার প্রত্যাশা করছে না; মানুষ জানে না ঈশ্বর কখন তার কাছে আসেন বা কোথায় তার সামনে আসেন, কারণ মানুষ ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করতে পারে না, আর এইভাবেই মানুষের কাছ থেকে ঈশ্বর সর্বদা আড়ালেই থেকে যান।
ঈশ্বর তার কাছে প্রচ্ছন্ন থাকেন, এই ঘটনা ইয়োবের ঈশ্বর বিশ্বাসকে নড়াতে পারেনি
শাস্ত্রের পরবর্তী অনুচ্ছেদে, ইয়োব তারপর বলল, “দেখ, আমি পূর্ব দিকে গিয়েছি কিন্তু সেখানে তিনি নেই, পশ্চিমে গিয়েছি, সেখানেও তাঁকে পাইনি। আমি উত্তর দিকে তাঁকে খুঁজেছি কিন্তু তাঁর দেখা পাইনি, দক্ষিণ দিকে তাকিয়েছি কিন্তু দেখতে পাইনি তাঁকে” (ইয়োবে ২৩:৮-৯)। এই বিবরণে আমরা জানতে পারি যে ইয়োবের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী, ঈশ্বর তার কাছ থেকে সর্বদাই প্রচ্ছন্ন ছিলেন; তার সামনে কখনোই উন্মুক্তভাবে আবির্ভূত হননি, তার সাথে সরাসরি কোনো বাক্য বিনিময়ও করেননি, তা সত্ত্বেও ইয়োবের হৃদয়ে ঈশ্বরের অস্তিত্বের দৃঢ় বিশ্বাস প্রতীয়মান ছিল। সে সর্বদা কল্পনা করেছে যে হয়ত ঈশ্বর তার সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন, অথবা তার পাশে থেকে কর্ম সম্পাদন করছেন, এবং সে ঈশ্বরকে দেখতে না পেলেও তিনি তার পাশেই রয়েছেন, তার বিষয়ে সমস্ত কিছু পরিচালনা করছেন। ইয়োব কখনো ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করেনি, কিন্তু সে নিজের বিশ্বাসে অটল থাকতে পেরেছিল, যা আর কেউই করতে পারেনি। অন্যান্যরা তা করতে পারেনি কেন? এর কারণ হল, ঈশ্বর ইয়োবের সাথে কথা বলেননি বা তার সামনে আবির্ভূত হননি, সুতরাং ইয়োব যদি প্রকৃতই বিশ্বাস না করত, তাহলে সে ঈশ্বরে ভীতি ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগের পথ ধরে এগিয়ে যেতে অথবা সেখানে অবিচল থাকতে সক্ষম হতো না। তাই নয় কি? ইয়োবের এইসব কথা বলার বিষয়ে যখন তুমি পড়ো, তোমার কেমন অনুভূতি হয়? তোমার কি মনে হয় ইয়োবের ত্রুটিহীনতা ও ন্যায়নিষ্ঠতা, ঈশ্বরের সম্মুখে তার ন্যায়পরায়ণতা, এগুলো বিশুদ্ধ, ঈশ্বরের দিক থেকে কোনো অত্যুক্তি নয়? ঈশ্বর যদিও ইয়োবের সাথে অন্যান্য লোকেদের মতোই আচরণ করেছিলেন এবং তার সামনে আবির্ভূত হননি বা তার সঙ্গে কথাও বলেননি, তা সত্ত্বেও ইয়োব তার সততায় দৃঢ় ছিল, তবুও ঈশ্বরের সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস করেছিল, এবং তাছাড়াও, ঈশ্বরকে ক্ষুব্ধ করে ফেলার ভীতির কারণে সে প্রায়ই ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে অগ্নিদগ্ধ উৎসর্গ নিবেদন করত ও তাঁর সম্মুখে প্রার্থনা করত। ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ না করেও তাঁকে ভয় করার যে ক্ষমতা ইয়োবের ছিল, তাতে আমরা ইতিবাচক বিষয়ের প্রতি তার প্রভূত ভালোবাসা দেখতে পাই, এবং তার বিশ্বাস কতটা দৃঢ় ও বাস্তব ছিল তাও উপলব্ধি করতে পারি। ঈশ্বর তার থেকে প্রচ্ছন্ন ছিলেন বলে সে ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করেনি, আবার তাঁকে কখনো প্রত্যক্ষ না করার কারণেও সে তাঁর ওপর বিশ্বাস হারায়নি এবং তাঁকে ত্যাগ করেনি। পরিবর্তে, ঈশ্বরের সমস্ত কিছুকে শাসন করার প্রচ্ছন্ন কাজের মাঝে, সে ঈশ্বরের অস্তিত্ব উপলব্ধি করেছিল, এবং ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব ও ক্ষমতা অনুভব করেছিল। ঈশ্বরের প্রচ্ছন্ন থাকার কারণে সে ন্যায়নিষ্ঠতা ত্যাগ করেনি, অথবা ঈশ্বর তাঁর সামনে কখনো আবির্ভূত হননি বলেও সে ঈশ্বরে ভীতি অর্জন ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগের পথ ত্যাগ করেনি। ইয়োব কখনোই ঈশ্বরকে তাঁর অস্তিত্বের প্রমাণ দেওয়ার জন্য তার কাছে প্রকাশ্যে আবির্ভূত হওয়ার অনুরোধ করেনি, কারণ সে ইতিমধ্যেই সমস্ত কিছুর মধ্যে ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব প্রত্যক্ষ করেছিল, এবং তার বিশ্বাস ছিল যে সে এমন আশীর্বাদ ও অনুগ্রহ অর্জন করে ফেলেছে যা অন্যরা অর্জন করতে পারেনি। যদিও ঈশ্বর ইয়োবের কাছ থেকে প্রচ্ছন্ন থেকেছিলেন, কিন্তু তাঁর প্রতি ইয়োবের বিশ্বাসে কখনোই নড়চড় হয়নি। এইভাবেই সে সেই ফসল সংগ্রহ করতে পেরেছিল যা অন্য কারো কাছেই ছিল না: ঈশ্বরের অনুমোদন এবং ঈশ্বরের আশীর্বাদ।
ইয়োব ঈশ্বরের নামের গুণকীর্তন করেছিল এবং আশীর্বাদ বা বিপর্যয়ের কথা ভাবেনি
ইয়োবের সম্পর্কে একটা সত্য কখনোই শাস্ত্রের কাহিনীতে উল্লেখ করা হয়নি, আর সেই সত্যই আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়বস্তু। যদিও ইয়োব কখনো ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করেনি বা নিজের কানে তাঁর বাক্য শ্রবণ করেনি, কিন্তু ইয়োবের হৃদয়ে ঈশ্বরের একটা স্থান ছিল। ঈশ্বরের প্রতি ইয়োবের মনোভাব কেমন ছিল? ঠিক তেমনই ছিল যেমন আগে উল্লেখ করা হয়েছে, “যিহোবার নাম ধন্য হোক”। সে নিঃশর্তে, প্রসঙ্গ নির্বিশেষে এবং কোন কারণ ছাড়াই ঈশ্বরের নামের গুণকীর্তন করত। আমরা দেখি যে ইয়োব ঈশ্বরকে নিজের হৃদয় সমর্পণ করেছিল, ঈশ্বরের হাতে হৃদয়ের নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিয়েছিল; সে তার অন্তরের সকল চিন্তাভাবনা, সকল সিদ্ধান্ত, ও সকল পরিকল্পনা কোনো আড়াল ছাড়াই ঈশ্বরের সামনে উন্মুক্ত করে রেখেছিল। তার হৃদয় ঈশ্বরের বিরুদ্ধাচরণ করেনি, সে কখনো ঈশ্বরকে তার জন্য কিছু করতে বলেনি বা তাকে কিছু দিতে বলেনি, এবং তার এমন কোনো অসংযত আকাঙ্ক্ষাও ছিল না যে সে তার ঈশ্বর উপাসনা থেকে কিছু অর্জন করতে পারবে। ইয়োব ঈশ্বরের সাথে কোনো ব্যবসায়িক আলোচনা করেনি, এবং ঈশ্বরের কাছে কোনো অনুরোধ বা দাবিও করেনি। সমস্ত বস্তুর উপর ঈশ্বরের শাসনভারের অতীব ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের কারণেই সে তাঁর নামের গুণকীর্তন করেছিল, সে আশীর্বাদ লাভ করবে বা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে তার উপর তা নির্ভরশীল ছিল না। তার বিশ্বাস ছিল, ঈশ্বর মানুষকে আশীর্বাদ করুন বা তাদের উপর বিপর্যয় নিয়ে আসুন, তাঁর ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের পরিবর্তন হবে না, আর তাই মানুষের পরিস্থিতি নির্বিশেষে ঈশ্বরের নামের গুণগান করা উচিত। ঈশ্বরের সার্বভৌমত্বের কারণেই মানুষ তাঁর আশীর্বাদ লাভ করে, আবার যখন মানুষের উপর বিপর্যয় নেমে আসে, সেটাও তাঁর সার্বভৌমত্বের কারণেই ঘটে। ঈশ্বরের ক্ষমতা ও কর্তৃত্বই মানুষের সমস্ত বিষয় শাসন করে ও তার আয়োজন করে; মানুষের ভাগ্যের খামখেয়ালীপনা হল ঈশ্বরের ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের প্রকাশ, এবং কারোর দৃষ্টিভঙ্গি নির্বিশেষেই ঈশ্বরের নামের গুণগান করা উচিত। ইয়োব তার সারাজীবন ধরে এই অভিজ্ঞতাই লাভ করেছিল এবং এটাই জানতে পেরেছিল। ইয়োবের সমস্ত চিন্তাভাবনা ও ক্রিয়াকলাপ ঈশ্বরের কানে পৌঁছেছিল এবং তাঁর সম্মুখে উপনীত হয়েছিল, এবং ঈশ্বরের চোখে এগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয়েছিল। ঈশ্বর ইয়োবের এই জ্ঞানকে লালন করেছিলেন এবং এইরকম হৃদয় থাকার জন্য তাকে মূল্যবান মনে করেছিলেন। এই হৃদয় সর্বদা ও সর্বত্র ঈশ্বরের আদেশের অপেক্ষা করেছে, এবং তার উপর যা-ই নেমে আসুক, স্থান-কাল নির্বিশেষে এই হৃদয় সেগুলোকে স্বাগত জানিয়েছে। ইয়োব ঈশ্বরের কাছে কোনো দাবি করেনি। সে নিজের কাছে দাবি করেছিল যাতে সে ঈশ্বর প্রদত্ত সমস্ত ব্যবস্থাপনার অপেক্ষা করতে পারে, সেগুলো গ্রহণ করতে পারে, সেগুলোর সম্মুখীন হতে পারে এবং সেগুলো মান্য করতে পারে; ইয়োব এটাকেই কর্তব্য বলে বিশ্বাস করত, এবং ঈশ্বরও ঠিক এটাই চেয়েছিলেন। ইয়োব কখনো ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করেনি, অথবা তাঁকে কোনো বাক্য উচ্চারণ করতে, কোনো আদেশ জারি করতে, কোনো শিক্ষা প্রদান করতে, বা ইয়োবকে কোনো বিষয়ে নির্দেশ দিতে শোনেনি। আজকের ভাষায় বলা যায়, যখন ঈশ্বর তাকে সত্যের বিষয়ে কোনো আলোকপ্রদান, পথনির্দেশ, বা সংস্থান প্রদান করেননি, তখনও ঈশ্বরের প্রতি তার এইরকম জ্ঞান ও মনোভাবের অধিকারী হতে সক্ষম হওয়া—এটা ছিল খুবই মূল্যবান বিষয়, এবং তার এই সমস্ত বিষয় প্রদর্শন করার সক্ষমতাই ঈশ্বরের কাছে যথেষ্ট ছিল, আর তার সাক্ষ্য ঈশ্বর প্রশংসা ও লালন করেছিলেন। ইয়োব কখনো ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করেনি, বা ঈশ্বর ব্যক্তিগতভাবে তাকে কোনো শিক্ষা দিচ্ছেন এমনটা শোনেনি, কিন্তু যারা ঈশ্বরের সামনে শুধুমাত্র গভীর তত্ত্বের ভাষায় কথা বলতে সক্ষম ছিল, যারা শুধুমাত্র নিজেদের জাহির করতে ও উৎসর্গের কথা বলতে সক্ষম ছিল, কিন্তু যাদের কখনোই ঈশ্বরের কোনো প্রকৃত জ্ঞান ছিল না, এবং যারা কখনোই প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বরকে ভয় করেনি, তাদের চেয়ে ঈশ্বরের কাছে ইয়োবের হৃদয় এবং ইয়োব নিজে অনেক বেশি মূল্যবান ছিল। কারণ ইয়োবের হৃদয় ছিল বিশুদ্ধ, তা ঈশ্বরের কাছে গোপন ছিল না, এবং তার মানবিকতা ছিল সৎ ও দয়ালু, এবং সে ন্যায়বিচার ও ইতিবাচক সমস্ত কিছু পছন্দ করত। শুধুমাত্র এমন এক হৃদয় ও মানবিকতার অধিকারী একজন মানুষই ঈশ্বরের প্রকৃত পথে চলতে, এবং ঈশ্বর ভীতি অর্জন করতে ও ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগ করতে সক্ষম ছিল। এমন একজন মানুষই ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব প্রত্যক্ষ করতে পারত, তাঁর কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা প্রত্যক্ষ করতে পারত, এবং তাঁর সার্বভৌমত্ব ও ব্যবস্থাপনার প্রতি আনুগত্য অর্জন করতে পারত। শুধুমাত্র এমন একজন মানুষই প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বরের নামের গুণগান করতে পারত। কারণ ঈশ্বর তাকে আশীর্বাদ করবেন নাকি তার উপর বিপর্যয় ডেকে আনবেন সে সেদিকে তাকায়নি, কারণ সে জানত সবকিছুই ঈশ্বরের হাতে নিয়ন্ত্রিত, এবং মানুষের সে বিষয়ে উদ্বিগ্ন হওয়াটা মূর্খতা, অজ্ঞতা, ও যুক্তিহীনতার চিহ্ন, এবং সমস্তকিছুর উপর ঈশ্বরের সার্বভৌমত্বকে সন্দেহ করার ও ঈশ্বরকে ভয় না পাওয়ার চিহ্ন। ঈশ্বর যেমন চেয়েছিলেন, ইয়োবের জ্ঞান ছিল ঠিক তেমনই। তাহলে, ঈশ্বরের বিষয়ে ইয়োবের তাত্ত্বিক জ্ঞান কি তোমাদের থেকে বেশি ছিল? যেহেতু ঈশ্বরের কাজ ও বাক্যের পরিমাণ সেই সময় ছিল নগণ্য, তাই তখন ঈশ্বর সম্পর্কিত জ্ঞান অর্জন করা সহজ ছিল না। ইয়োবের এইরকম কৃতিত্ব অর্জন কোনো তুচ্ছ বিষয় ছিল না। সে ঈশ্বরের কাজের অভিজ্ঞতা লাভ করেনি, অথবা তাঁকে কখনো কথা বলতে শোনেনি, বা তাঁর চেহারা দেখেনি। ঈশ্বরের বিষয়ে সে যে এমন মনোভাব লাভ করতে পেরেছিল, তা সম্পূর্ণভাবেই ছিল তার মানবিকতা ও ব্যক্তিগত সাধনার ফলাফল, বর্তমানকালের মানুষের যে রকম মানবিকতা ও সাধনার অধিকারী নয়। এইভাবে, সেই যুগে ঈশ্বর বলেছিলেন, “তার মত সৎ ও বিশ্বস্ত লোক পৃথিবীতে কেউ নেই।” সেই যুগেই ঈশ্বর তার বিষয়ে ইতিমধ্যেই এইরকম মূল্যায়ন করে ফেলেছিলেন, এইরকম উপসংহারে পৌঁছেছিলেন। আজকের দিনে তা এর থেকে কত বেশি সত্যি হত?
যদিও ঈশ্বর মানুষের থেকে প্রচ্ছন্ন থাকেন, কিন্তু সমস্ত বস্তুর মাঝে নিহিত তাঁর কর্মই তাঁকে জানার জন্য মানুষের পক্ষে যথেষ্ট
ইয়োব ঈশ্বরের চেহারা প্রত্যক্ষ করেনি বা তাঁর উচ্চারিত বাক্য শোনেনি, ব্যক্তিগতভাবে ঈশ্বরের কাজের অভিজ্ঞতা লাভ করা তো আরো দূরের কথা; তা সত্ত্বেও তার ঈশ্বর ভীতি এবং পরীক্ষার সময় তার সাক্ষ্য সকলেই প্রত্যক্ষ করেছিল, আর সেগুলো ঈশ্বর ভালবেসেছিলেন, আনন্দিত হয়েছিলেন, ও সেগুলোর প্রশংসাও করেছিলেন, এবং মানুষ সেগুলোকে ঈর্ষা করে ও শ্রদ্ধা করে, এছাড়াও সেগুলোর গুণকীর্তনও করে। তার জীবনে মহৎ বা অসাধারণ কিছু ছিল না: যেকোনো একজন সাধারণ মানুষের মতোই সে একটা বিশেষত্ত্বহীন জীবনযাপন করেছিল, সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে কাজে যেত আবার সূর্যাস্তের সময় বিশ্রাম নেওয়ার জন্য বাড়িতে ফিরে আসত। পার্থক্য হচ্ছে যে তার জীবনের বিশেষত্ত্বহীন অনেকগুলো দশকের সময় সে ঈশ্বরের পথের বিষয়ে অন্তর্দৃষ্টি লাভ করেছিল, এবং ঈশ্বরের বিশাল শক্তি ও সার্বভৌমত্বকে উপলব্ধি করতে ও বুঝতে পেরেছিল, যা অন্য কেউ কখনো পারেনি। সে অন্যান্য সাধারণ মানুষের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান ছিল না, তার জীবন যেমন বিশেষভাবে কাঠিন্যের মাঝে জীবনকে আঁকড়ে ধরে থাকার মতো এক জীবন ছিল না, আবার তেমনই তার অদৃশ্য কোনো বিশেষ দক্ষতাও ছিল না। তবে তার যা ছিল তা হচ্ছে একটা সৎ, দয়ালু, ও ন্যায়নিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব, যে ব্যক্তিত্ব ন্যায্যতা, ন্যায়পরায়ণতা, ও ইতিবাচক বিষয়কে ভালোবাসত—যেসবের কোনোটাই বেশিরভাগ সাধারণ মানুষের থাকে না। সে ভালোবাসা ও ঘৃণার পার্থক্য অনুধাবন করেছিল, ন্যায়বিচার সম্পর্কিত উপলব্ধি তার ছিল, সে ছিল অদম্য ও অবিচল, এবং সে তার চিন্তাধারায় বিশদ বিবরণের প্রতি অত্যন্ত মনোযোগী ছিল। এইভাবেই, পৃথিবীতে তার বিশেষত্ত্বহীন জীবনযাপনের সময় সে ঈশ্বরের সম্পাদিত সমস্ত অসাধারণ বিষয় প্রত্যক্ষ করেছিল, এবং সে দেখেছিল তাঁর মহানুভবতা, পবিত্রতা, ও ন্যায়পরায়ণতা, দেখেছিল মানুষের জন্য তাঁর চিন্তা, অনুগ্রহ, ও সুরক্ষা, এবং দেখেছিল পরম ঈশ্বরের সম্মান ও কর্তৃত্ব। ইয়োব যে এই সমস্তকিছু অর্জন করতে পেরেছিল যা যেকোনো সাধারণের মানুষের অর্জনের ঊর্ধ্বে, তার প্রথম কারণ হচ্ছে তার একটা বিশুদ্ধ হৃদয় ছিল, আর সেই হৃদয় ছিল ঈশ্বরের মালিকানার অধীন এবং সৃষ্টিকর্তার দ্বারা পরিচালিত। দ্বিতীয় কারণ ছিল তার সাধনা: তার অনবদ্য ও নিখুঁত হওয়ার সাধনা, স্বর্গের ইচ্ছার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ একজন মানুষ হয়ে ওঠার সাধনা, যে ঈশ্বরের প্রিয়, এবং যে মন্দ কর্ম পরিত্যাগ করেছে। ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করতে বা ঈশ্বরের বাক্য শুনতে অক্ষম হলেও ইয়োব এই বিষয়গুলোর অধিকারী ছিল এবং এগুলোর সাধনা করত; যদিও সে কখনো ঈশ্বরকে দেখেনি, কিন্তু ঈশ্বর যে উপায়ে সমস্ত কিছুর উপর শাসন করেন তা সে জানতে পেরেছিল, এবং ঈশ্বর যে প্রজ্ঞার মাধ্যমে তা করেন সেটাও উপলব্ধি করেছিল। ঈশ্বরের উচ্চারিত বাক্য কখনো না শুনলেও ইয়োব জানত, মানুষকে পুরস্কৃত করা এবং মানুষের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া, সব কাজই ঈশ্বরের নির্দেশ। তার জীবনের বছরগুলো কোনো সাধারণ ব্যক্তির থেকে আলাদা না হলেও, সে তার জীবনের বিশেষত্ত্বহীন হওয়াকে সমস্ত কিছুর উপর ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব বিষয়ে তার জ্ঞানকে প্রভাবিত করতে দেয়নি, বা তার ঈশ্বর ভীতি ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগের পথ অনুসরণের উপর প্রভাব ফেলতে দেয়নি। তার দৃষ্টিতে, সমস্ত কিছুর বিধান ঈশ্বরের কর্মে পরিপূর্ণ, এবং কোনো একজনের জীবনের যেকোনো অংশেই ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব প্রত্যক্ষ করা সম্ভব। সে ঈশ্বরকে দেখেনি, কিন্তু উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিল যে ঈশ্বরের কাজ সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে, আর পৃথিবীতে তার বিশেষত্ত্বহীন জীবনের প্রতিটা কোণেই সে ঈশ্বরের অসাধারণ ও বিস্ময়কর কাজ দেখতে ও উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিল, এবং ঈশ্বরের বিস্ময়কর আয়োজনও প্রত্যক্ষ করতে পেরেছিল। ঈশ্বরের প্রচ্ছন্ন ও নীরব থাকা ঈশ্বরের কর্মের বিষয়ে ইয়োবের উপলব্ধিতে বাধা সৃষ্টি করেনি, আবার এগুলো সমস্ত কিছুর উপর ঈশ্বরের সার্বভৌমত্বের বিষয়ে তার জ্ঞানকেও প্রভাবিত করেনি। যে ঈশ্বর সমস্তকিছুর মধ্যে প্রচ্ছন্ন রয়েছেন, নিজের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় সেই ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব ও আয়োজনের উপলব্ধিই ছিল ইয়োবের জীবন। নিজের দৈনন্দিন জীবনে সে সেইসাথে ঈশ্বরের হৃদয়ের কণ্ঠস্বর ও ঈশ্বরের বাক্য শুনেছিল এবং উপলব্ধি করতে পেরেছিল, যিনি সমস্তকিছুর মধ্যে নীরব থেকেও সমস্তকিছুর বিধান পরিচালনা করার মাধ্যমে তাঁর হৃদয়ের কণ্ঠস্বর ও তাঁর বাক্য প্রকাশ করেন। তাহলে দেখতে পাচ্ছ, মানুষের মধ্যে যদি ইয়োবের মতো মানবিকতা ও সাধনা থাকে, তাহলে তারা ইয়োবের মতো একই উপলব্ধি ও জ্ঞান অর্জন করতে পারে, এবং তার মতোই সমস্তকিছুর উপর ঈশ্বরের সার্বভৌমত্বের উপলব্ধি ও জ্ঞান অর্জন করতে পারে। ঈশ্বর ইয়োবের কাছে আবির্ভূত হননি বা তার সাথে কথা বলেননি, কিন্তু সে নিখুঁত ও ন্যায়পরায়ণ হতে, এবং ঈশ্বর ভীতি অর্জন করতে ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগে সক্ষম হয়েছিল। অন্য ভাষায়, ঈশ্বর মানুষের কাছে আবির্ভূত না হলেও বা তার সাথে কথা না বললেও, সমস্তকিছুর মধ্যে ঈশ্বরের কাজ এবং সমস্ত কিছুর উপর তাঁর সার্বভৌমত্বই ঈশ্বরের অস্তিত্ব, ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের বিষয়ে অবগত হয়ে ওঠার জন্য মানুষের পক্ষে যথেষ্ট, এবং ঈশ্বরের ক্ষমতা ও কর্তৃত্বই মানুষকে ঈশ্বরে ভীতির ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগের পথ অনুসরণ করানোর পক্ষে যথেষ্ট। যেহেতু ইয়োবের মতো একজন সাধারণ মানুষ ঈশ্বরে ভীতি ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগ অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল, তাই প্রতিটা ঈশ্বর অনুগামী সাধারণ মানুষেরও তাতে সক্ষম হওয়া উচিত। এই কথাগুলো যুক্তিপূর্ণ সিদ্ধান্তের মতো শুনতে লাগলেও, এগুলো বস্তুর বিধানের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ নয়। তবুও প্রত্যাশার সাথে বাস্তব ঘটনা মেলেনি: মনে হতে পারে যে ঈশ্বরে ভীতি অর্জন ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগ ইয়োব এবং একমাত্র ইয়োবের জন্যই সংরক্ষিত। “ঈশ্বরে ভীতি অর্জন ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগ”-এর উল্লেখ করলেই মানুষ মনে করে যে তা শুধুমাত্র ইয়োবেরই করা উচিত, যেন ঈশ্বরে ভীতি ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগের পথ ইয়োবের নামেই চিহ্নিত করা আছে, অন্যদের সাথে সেটার যেন কোনো সম্পর্কই নেই। এর কারণ পরিষ্কার: যেহেতু শুধুমাত্র ইয়োবই এমন একটা চরিত্রের অধিকারী ছিল যা সৎ, সহৃদয় ও ন্যায়নিষ্ঠ, এবং যা ন্যায্যতা, ন্যায়পরায়ণতা ও ইতিবাচক বিষয়গুলোকে ভালোবাসতো, তাই শুধু ইয়োবই ঈশ্বরে ভীতির ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগের পথ অনুসরণ করতে সক্ষম হয়েছিল। তোমরা সকলে নিশ্চয়ই এখানে নিহিত তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পেরেছ—যেহেতু কেউই এমন মানবিকতার অধিকারী নয় যা সৎ, দয়ালু, ও ন্যায়পরায়ণ, এবং যা ন্যায্যতা ও ন্যায়পরায়ণতা এবং ইতিবাচক সমস্তকিছু ভালোবাসে, তাই কেউই ঈশ্বরে ভীতি অর্জন ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগ করতে পারে না, আর তাই মানুষ কখনও ঈশ্বরের আনন্দ লাভ করতে পারে না বা পরীক্ষার মধ্যে অবিচল থাকতে পারে না। এর অর্থ এটাও যে ব্যতিক্রম হিসাবে ইয়োবকে বাদ দিয়ে, সব মানুষ এখনও শয়তানের দ্বারা আবদ্ধ এবং বন্দী; তারা সকলেই শয়তানের দ্বারা অভিযুক্ত, আক্রান্ত, এবং নির্যাতিত। এদেরকেই শয়তান গ্রাস করার চেষ্টা করে, এবং এদের সকলেরই কোনো স্বাধীনতা নেই, এরা এমন বন্দি যাদের যাদের শয়তান আটক করে রেখেছে।
মানুষের হৃদয়ে যদি ঈশ্বরের প্রতি শত্রুতা থাকে, তাহলে মানুষ কী করে ঈশ্বরে ভীত হবে ও মন্দকে পরিত্যাগ করবে?
যেহেতু বর্তমানের মানুষেরা ইয়োবের মতো একই মানবতার অধিকারী নয়, তাহলে তাদের প্রকৃতি ও সারমর্ম কী, এবং ঈশ্বরের প্রতি তাদের মনোভাব কেমন? তারা কি ঈশ্বরকে ভয় পায়? তারা কি মন্দকে পরিত্যাগ করে? যারা ঈশ্বরে ভীত নয় বা মন্দকে পরিত্যাগ করে না, তাদের সংক্ষিপ্তসার শুধুমাত্র এই দুটো শব্দের মাধ্যমেই ব্যাখ্যা করা যায়: “ঈশ্বরের শত্রু”। তোমরা প্রায়ই এই দুটো শব্দ বলো, কিন্তু সেগুলোর প্রকৃত অর্থ কখনো জানতে পারোনি। “ঈশ্বরের শত্রু” শব্দগুলোর সারমর্ম হল: এই কথাগুলো বোঝায় না যে ঈশ্বর মানুষকে শত্রু হিসাবে দেখেন, বরং এর অর্থ হল মানুষই ঈশ্বরকে শত্রু বলে মনে করে। প্রথমত, যখন মানুষ ঈশ্বরকে বিশ্বাস করতে শুরু করে, তখন তাদের মধ্যে এমন কি কেউ আছে যার নিজস্ব লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, বা উচ্চাশা থাকে না? এমনকি যদিও তাদের একাংশ ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে এবং তাঁর অস্তিত্ব প্রত্যক্ষ করেছে, তবুও ঈশ্বরের প্রতি তাদের বিশ্বাসে এখনও রয়েছে সেই উদ্দেশ্য, এবং ঈশ্বরের প্রতি তাদের বিশ্বাসের চূড়ান্ত লক্ষ্য হল তাঁর আশীর্বাদ এবং নিজেদের প্রার্থিত বস্তু লাভ করা। মানুষের জীবনের অভিজ্ঞতায়, তারা নিজেদের মনে প্রায়ই ভাবে: “আমি আমার পরিবার ও কর্মজীবন ঈশ্বরের জন্য ত্যাগ করেছি, আর তিনি আমায় কী দিয়েছেন? আমাকে অবশ্যই এটা হিসাব করে দেখতে হবে আর নিশ্চিত হতে হবে—আমি কি সম্প্রতি কোন আশীর্বাদ লাভ করেছি? এই সময়ের মধ্যে আমি অনেক কিছু দিয়েছি, অনেক দৌড়ে বেড়িয়েছি, এবং অনেক কষ্ট পেয়েছি—ঈশ্বর কি প্রতিদানে আমায় কোনও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন? তিনি কি আমার ভালো কাজগুলো মনে রেখেছেন? আমার পরিণতি কেমন হবে? আমি কি ঈশ্বরের আশীর্বাদ পেতে সক্ষম হবো? ...” প্রত্যেক ব্যক্তি নিজেদের হৃদয়ের অভ্যন্তরে প্রতিনিয়ত এই ধরণের গণনা করে চলে, এবং ঈশ্বরের কাছে নিজেদের চাহিদা জানায় যাতে রয়েছে তাদের উদ্দেশ্য, উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং এক লেনদেনের মানসিকতা। অর্থাৎ বলা যায় যে মানুষ নিজের হৃদয়ে প্রতিনিয়ত ঈশ্বরকে পরীক্ষা করছে, প্রতিনিয়ত ঈশ্বরের বিষয়ে পরিকল্পনা করছে, প্রতিনিয়ত তার ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যের জন্য ঈশ্বরের সঙ্গে তর্ক করছে, এবং ঈশ্বরের কাছ থেকে একটা বিবৃতি বার করে নেওয়ার চেষ্টা করছে, দেখতে চাইছে সে যা চায় ঈশ্বর তাকে তা দিতে পারেন কি না। একই সময়ে যখন সে ঈশ্বরের সাধনা করছে, তখনও মানুষ ঈশ্বরের সাথে ঈশ্বরসুলভ আচরণ করে না। মানুষ সবসময় ঈশ্বরের সঙ্গে বোঝাপড়াতে আসতে চেয়েছে, অবিরাম তাঁর কাছে চাহিদা প্রকাশ করে, এবং এমনকি তাঁকে প্রতি পদক্ষেপে চাপ দেয়, এক ইঞ্চি তাকে দেওয়া হলে এক মাইল নেওয়ার চেষ্টা করে। ঈশ্বরের সঙ্গে লেনদেনের চেষ্টা করার সময়, মানুষ তাঁর সঙ্গে বিতর্কেও জড়ায়, এমনকি এমনও কিছু মানুষ আছে যারা পরীক্ষার মধ্যে পড়লে, বা কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে, প্রায়শই দুর্বল, নিষ্ক্রিয়, এবং কাজে শ্লথ হয়ে পড়ে, এবং ঈশ্বরের বিষয়ে অভিযোগে পূর্ণ হয়ে ওঠে। যে সময় থেকে মানুষ প্রথম ঈশ্বরে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, তখন থেকেই সে ঈশ্বরকে একজন প্রাচুর্যে পরিপূর্ণ ভাণ্ডার মনে করেছে, সমস্ত পরিস্থিতিতে প্রভূত উপযোগিতাসম্পন্ন বলে বিবেচনা করেছে, এবং নিজেকে ঈশ্বরের সবচেয়ে বড় পাওনাদার বলে ভেবে নিয়েছে, যেন ঈশ্বরের কাছ থেকে আশীর্বাদ এবং প্রতিশ্রুতি পাওয়ার চেষ্টাটা তার জন্মগত অধিকার এবং বাধ্যতা, এদিকে ঈশ্বরের দায়িত্ব হল মানুষকে রক্ষা করা, তার পরিচর্যা করা, এবং তাকে সংস্থান যোগান দেওয়া। যারা ঈশ্বরে বিশ্বাস করে তাদের সকলের কাছে “ঈশ্বরে বিশ্বাস” করার মৌলিক জ্ঞান এরকমই, এবং এরকমই তাদের ঈশ্বর বিশ্বাসের ধারণার গভীরতম উপলব্ধি। মানুষের প্রকৃতি ও সারসত্য থেকে শুরু করে তার বিষয়গত সাধনা পর্যন্ত, কোথাও ঈশ্বর ভীতির সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। মানুষের ঈশ্বর বিশ্বাসের লক্ষ্যের সাথে সম্ভবত ঈশ্বরের উপাসনা করার কোনো সম্পর্কই নেই। অর্থাৎ বলা যায় যে মানুষ কখনোই বিবেচনা করেনি বা উপলব্ধি করেনি যে ঈশ্বরে বিশ্বাস করতে হলে ঈশ্বরে ভীতি ও তাঁর উপাসনার প্রয়োজন। এইধরনের অবস্থার আলোকে মানুষের সারসত্য অত্যন্ত সুস্পষ্ট। কী সেই সারসত্য? তা হল, মানুষের হৃদয় বিদ্বেষপরায়ণ, তা বিশ্বাসঘাতকতা ও প্রতারণা পোষণ করে, ন্যায় ও ধার্মিকতা এবং ইতিবাচক কোনোকিছুই ভালোবাসে না, এবং তা অবজ্ঞাজনক ও লোভী। মানুষের হৃদয় ঈশ্বরের জন্য এর চেয়ে বেশি অবরুদ্ধ আর হতে পারে না; সে কখনোই তার হৃদয় ঈশ্বরকে দেয়নি। ঈশ্বর কখনোই মানুষের প্রকৃত হৃদয় দেখেননি, বা তিনি কখনোই মানুষের দ্বারা পূজিত হননি। ঈশ্বর কত বড় মূল্য পরিশোধ করেন, বা তিনি কত কাজ করেন, বা মানুষকে কত সংস্থান যোগান দেন, সেসব নির্বিশেষে মানুষ এই সবকিছুর প্রতি অন্ধ ও চূড়ান্ত উদাসীন থাকে। মানুষ কখনোই ঈশ্বরকে তার হৃদয় অর্পণ করেনি, সে তার হৃদয়ের বিষয়ে শুধু নিজেই বিবেচনা করতে চায়, নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে চায়—এর অন্তর্নিহিত অর্থ হল মানুষ ঈশ্বরে ভীতি ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগের পথ অনুসরণ করতে চায় না, অথবা ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব ও তাঁর আয়োজন মান্য করতে চায় না, বা ঈশ্বরকে ঈশ্বর হিসাবে উপাসনা করতেও চায় না। এটাই মানুষের বর্তমান অবস্থা। এখন চলো আবার ইয়োবের দিকেই ফেরা যাক। প্রথমত, সে কি ঈশ্বরের সঙ্গে কোনও বোঝাপড়া করেছিল? ঈশ্বর ভীতি ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগের পথে অবিচল থাকার পিছনে কি তার কোনও প্রচ্ছন্ন অভিসন্ধি ছিল? সেই সময়ে, ঈশ্বর কি কাউকে অন্তিম সময়ের আগমনের বিষয়ে কিছু বলেছিলেন? সেই সময়ে, ঈশ্বর কারোর কাছেই অন্তিম অবস্থার বিষয়ে কোনও প্রতিশ্রুতি দেননি, এবং এই পটভূমিতে দাঁড়িয়ে ইয়োব ঈশ্বরে ভীতি ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগে সক্ষম হয়েছিল। বর্তমানের মানুষের সঙ্গে কি ইয়োবের কোনও তুলনা চলে? তাদের মধ্যে প্রচুর অসমতা রয়েছে; তারা একেবারেই ভিন্ন দলে রয়েছে। যদিও ঈশ্বর সম্পর্কে ইয়োবের খুব বেশি জ্ঞান ছিল না, কিন্তু সে তার হৃদয় ঈশ্বরকে অর্পণ করেছিল এবং তার হৃদয় ঈশ্বরেরই ছিল। সে কখনোই ঈশ্বরের সঙ্গে কোনো লেনদেন করেনি, এবং তার ঈশ্বরের কাছে কোনও অতিরঞ্জিত আশা বা চাহিদা ছিল না; পরিবর্তে সে বিশ্বাস করত যে “যিহোবা দিয়েছিলেন, যিহোবাই ফিরিয়ে নিয়েছেন।” তাঁর জীবনের বহু বছরের ঈশ্বরে ভীতি ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগের পথে দৃঢ় থেকে সে এটাই প্রত্যক্ষ করেছিল এবং অর্জন করেছিল। একইভাবে, “ঈশ্বরের হাত থেকে আমরা কি শুধু মঙ্গলই গ্রহণ করব? অমঙ্গল কিছুই গ্রহণ করব না?” এই কথায় যে অর্থ উপস্থাপিত হয়েছে তাও সে অর্জন করেছিল। তার জীবনের অভিজ্ঞতার সময়ে ঈশ্বরের প্রতি তার মনোভাব ও আনুগত্যের ফলে সে এই দুটো বাক্য প্রত্যক্ষ করেছিল ও উপলব্ধি করেছিল, এবং শয়তানের প্রলোভনের বিরুদ্ধে লড়াইতে জয়লাভের পক্ষে এগুলোই ছিল তার শক্তিশালী অস্ত্র, এবং ঈশ্বরের পক্ষে সাক্ষ্য বহন করার ক্ষেত্রে এগুলোই ছিল তার ভিত্তিমূল। এই পর্যায় পর্যন্ত এসে, তোমরা কি একজন ভালো মানুষ হিসাবে ইয়োবের ছবি আঁকতে পারছ? তোমরাও কি এমন মানুষ হওয়ার আশা করো? তোমরা কি শয়তানের প্রলোভনের মধ্যে দিয়ে যেতে ভয় পাও? তোমরা কি ঈশ্বরের কাছে এই প্রার্থনার সংকল্প নিচ্ছ যাতে তিনি ইয়োবের মতো একই পরীক্ষায় তোমাদের ফেলেন? নিঃসন্দেহে বেশিরভাগ মানুষই এই ধরনের প্রার্থনা করার সাহস করবে না। তাহলে, স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে যে তোমাদের বিশ্বাস দুঃখজনকভাবে ক্ষুদ্র; ইয়োবের তুলনায় তোমাদের বিশ্বাস একেবারেই উল্লেখ করার যোগ্যও নয়। তোমরা ঈশ্বরের শত্রু, তোমরা ঈশ্বরকে ভয় পাও না, ঈশ্বরের পক্ষে তোমাদের সাক্ষ্যে দৃঢ় থাকতে পারো না, এবং তোমরা শয়তানের আক্রমণ, অভিযোগ ও প্রলোভন জয় করতে অক্ষম। তোমরা কীভাবে ঈশ্বরের প্রতিশ্রুতি লাভ করার যোগ্য হতে পারো? ইয়োবের কাহিনী শুনে এবং মানুষকে উদ্ধার করার পিছনে ঈশ্বরের উদ্দেশ্য উপলব্ধি করে বা মানুষের পরিত্রাণের অর্থ উপলব্ধির পরে, এখন কি তোমাদের ইয়োবের মতো একই পরীক্ষা গ্রহণ করার মতো বিশ্বাস আছে? তোমাদের মধ্যে কি ঈশ্বর ভীতি ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগের পথ অনুসরণ করার সামান্য সংকল্পটুকুও থাকা উচিত নয়?
ঈশ্বরের পরীক্ষার বিষয়ে কোনো ভ্রান্ত ধারনা রেখো না
ইয়োবের পরীক্ষার শেষে তার থেকে সাক্ষ্য লাভ করার পরে, ঈশ্বর সংকল্প করেছিলেন যে তিনি ইয়োবের মতো এক দল বা একাধিক দল মানুষকে অর্জন করবেন, তিনি এও সংকল্প করেছিলেন, শয়তান ঈশ্বরের সঙ্গে বাজি রেখে যে সব উপায়ে ইয়োবকে প্রলুব্ধ করেছিল, আক্রমণ করেছিল, ও তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছিল, সেইসব উপায়ে শয়তানের দ্বারা আর কাউকে আক্রমণ বা দুর্ব্যবহার পেতে দেবেন না; ঈশ্বর শয়তানকে দুর্বল, বোকা এবং অজ্ঞ মানুষের সঙ্গে এমন করার অনুমতি আর কখনোই দেননি—শয়তান যে ইয়োবকে প্রলুব্ধ করেছিল, সেটাই যথেষ্ট ছিল! শয়তানকে ইচ্ছেমত মানুষের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতে না দেওয়াটা ঈশ্বরেরই করুণা। ইয়োব যে শয়তানের প্রলোভন ও দুর্ব্যবহার সহ্য করেছিল, ঈশ্বরের কাছে সেটাই যথেষ্ট ছিল। ঈশ্বর আর কখনো শয়তানকে এমন কিছু করতে দেননি, কারণ ঈশ্বরের অনুসরণকারী মানুষের জীবন ও সমস্তকিছু ঈশ্বরের দ্বারা শাসিত ও সমন্বিত, এবং শয়তান ঈশ্বরের নির্বাচিত মানুষদের ইচ্ছামতো চালিত করার অধিকারী নয়—তোমাদের এই কথাটা খুব ভালো করে বুঝতে হবে! ঈশ্বর মানুষের দুর্বলতার প্রতি যত্নবান, এবং তার মূর্খতা ও অজ্ঞতা বুঝতে পারেন। যদিও যাতে মানুষকে সম্পূর্ণরূপে উদ্ধার করতে পারা যায়, সেজন্য ঈশ্বরকে তাদের শয়তানের হাতে তুলে দিতে হয়, কিন্তু মানুষকে যে বোকার মতো চালিত করা হচ্ছে এবং তারা শয়তানের দুর্ব্যবহারের শিকার হচ্ছে, তা তিনি দেখতে চান না, এবং মানুষ সবসময় যন্ত্রণা সহ্য করছে এমনও তিনি দেখতে চান না। মানুষ ঈশ্বরের দ্বারাই সৃষ্ট, এবং ঈশ্বর যে মানুষকে শাসন করেন ও সমস্তকিছুর আয়োজন করেন তা স্বর্গের দ্বারা নিরূপিত অভিষিক্ত এবং পৃথিবীর দ্বারা স্বীকৃত; এটা ঈশ্বরেরই দায়িত্ব, এবং ঈশ্বর এই কর্তৃত্বের দ্বারাই সমস্ত কিছুর ওপর শাসন করেন! ঈশ্বর শয়তানকে মানুষের সঙ্গে ইচ্ছামত দুর্ব্যবহার করার বা অসদাচরণ করার অনুমতি দেন না, তিনি মানুষকে বিপথগামী করার জন্য শয়তানকে বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করতেও দেন না, এবং তাছাড়াও, তিনি মানুষের প্রতি ঈশ্বরের সার্বভৌমত্বে শয়তানকে হস্তক্ষেপ করতে দেন না, বা যে সব বিধানের মাধ্যমে ঈশ্বর সমস্তকিছুর উপর শাসন করেন শয়তানকে সেগুলো পদদলিত করতে বা ধ্বংস করতেও দেন না, মানবজাতির পরিচালনা ও পরিত্রাণের মতো ঈশ্বরের মহান কাজকে তো নয়ই! ঈশ্বর যাদের উদ্ধার করতে চান, এবং যারা ঈশ্বরের সাক্ষ্য বহন করতে সক্ষম, তারাই হল ঈশ্বরের ছয় হাজার বছরের পরিচালনামূলক পরিকল্পনার মূল ও নির্যাস, ও সেইসাথে তাঁর ছয় হাজার বছরের কাজের জন্য তাঁর প্রচেষ্টার মূল্যও বটে। কীভাবে ঈশ্বর নির্দ্বিধায় এই মানুষগুলোকে শয়তানের হাতে তুলে দিতে পারেন?
ঈশ্বরের পরীক্ষার বিষয়ে মানুষ প্রায়শই উদ্বিগ্ন ও ভীত থাকে, অথচ তারা সর্বদা শয়তানের ফাঁদের মধ্যে বাস করছে, এক বিপজ্জনক এলাকায় বাস করছে যেখানে শয়তান তাদের আক্রমণ ও পীড়ন করে—তবুও তারা ভয় কাকে বলে জানে না, তারা অবিচলিত। ব্যাপারটা কী হচ্ছে? মানুষ যেটুকু দেখতে পায়, ঈশ্বরের প্রতি তার বিশ্বাস শুধু সেটুকুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। মানুষের জন্য ঈশ্বরের ভালোবাসা ও উদ্বেগ, বা মানুষের প্রতি তাঁর মমত্ব ও বিবেচনাকে সে বিন্দুমাত্র সমাদর করে না। বরং ঈশ্বরের পরীক্ষা, বিচার, ও শাস্তি, এবং তাঁর মহিমা ও ক্রোধ সম্পর্কে সামান্য উদ্বেগ ও ভয় থাকায়, ঈশ্বরের শুভ উদ্দেশ্য নিয়ে মানুষের ন্যূনতম উপলব্ধিও নেই। পরীক্ষার উল্লেখ করলেই মানুষের মনে হয় যেন ঈশ্বরের কোনো প্রচ্ছন্ন উদ্দেশ্য রয়েছে, কেউ কেউ তো এমনও মনে করে যে ঈশ্বরের মন্দ পরিকল্পনা রয়েছে, তারা জানে না ঈশ্বর তাদের সাথে আসলে কী করবেন; এইভাবে, ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব ও আয়োজনের প্রতি আনুগত্যের কথা সোচ্চারে ঘোষণা করার সাথেসাথেই তারা মানুষের উপর ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব ও মানুষের জন্য তাঁর আয়োজনের যথাসম্ভব বিরোধিতা করে ও সেগুলোকে প্রতিহত করে, কারণ তারা বিশ্বাস করে, সতর্ক না থাকলে ঈশ্বর তাদের ভুল পথে চালিত করবেন, তাদের ভাগ্যকে যদি তারা নিজের নিয়ন্ত্রণে না রাখে তাহলে তাদের যা আছে ঈশ্বর সেই সমস্তকিছু কেড়ে নিতে পারেন, এমনকি তাদের জীবনও শেষ হয়ে যেতে পারে। মানুষ শয়তানের শিবিরেই রয়েছে, কিন্তু সে কখনো শয়তানের দ্বারা নির্যাতিত হওয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন হয় না, এবং সে শয়তানের দ্বারা নির্যাতিত হয়, কিন্তু শয়তানের কাছে বন্দী হয়ে পড়াকে ভয় করে না। সে শুধু বলতে থাকে যে ঈশ্বরের পরিত্রাণ সে স্বীকার করে, কিন্তু সে কখনোই ঈশ্বরের উপর বিশ্বাস করেনি বা এ কথা বিশ্বাস করেনি যে ঈশ্বর সত্যিই মানুষকে শয়তানের থাবা থেকে উদ্ধার করবেন। মানুষ যদি ইয়োবের মতো ঈশ্বরের সমন্বয়সাধন ও আয়োজনের কাছে সমর্পণ করতে পারে, এবং ঈশ্বরের হাতে নিজের সমস্ত সত্তাকে সঁপে দিতে পারে, তাহলে মানুষও কি পরিশেষে ইয়োবের মতোই ঈশ্বপ্রের আশীর্বাদ লাভ করবে না? মানুষ যদি ঈশ্বরের নিয়মকে গ্রহণ করতে পারে ও তাঁর নিয়মের কাছে সমর্পণ করতে পারে, তাহলে হারানোর কী আছে? তাই আমি তোমাদের পরামর্শ দেবো তোমাদের কাজে সতর্ক থাকতে, এবং তোমরা যা কিছুর সম্মুখীন হতে চলেছ সেগুলোর প্রতি সাবধান থাকতে। হঠকারী বা আবেগপ্রবণ হয়ো না, এবং ঈশ্বরের সাথে ও তিনি তোমাদের জন্য যে মানুষ, ঘটনা, ও বস্তুর আয়োজন করেছেন সেগুলোর সাথে তোমাদের উষ্ণ রক্ত, তোমাদের স্বাভাবিক প্রকৃতি বা তোমাদের কল্পনা ও পূর্বধারণার ভিত্তিতে আচরণ কোরো না; নিজেদের কাজে তোমাদের সতর্ক হতে হবে, এবং আরও বেশি প্রার্থনা ও অনুসন্ধান করতে হবে, যাতে ঈশ্বরের ক্রোধ জাগ্রত করে তোলা থেকে বিরত থাকতে পারো। এটা মনে রেখো!
এরপর আমরা দেখব পরীক্ষার পরে ইয়োব কেমন ছিল
৫. পরীক্ষা-পরবর্তী সময়ে ইয়োব
ইয়োবে ৪২:৭-৯ ইয়োবকে এই কথাগুলো বলার পর যিহোবা তেমানের অধিবাসী এলিফসকে বললেন, আমি তোমার উপরে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ, এবং তোমার দুই বন্ধুর উপরেও: কারণ তোমরা আমার সম্পর্কে যা সঠিক তা বলোনি, যেমন আমার সেবক ইয়োব বলেছে। সুতরাং তোমরা এখন সাতটা বৃষ আর সাতটা মেষ নিয়ে আমার সেবক ইয়োবের কাছে যাও, আর নিজেদের জন্য অগ্নিদগ্ধ বলি উৎসর্গ করো; আমার সেবক ইয়োব তখন তোমাদের জন্য প্রার্থনা করবে: তার জন্য আমি সেই প্রার্থনা স্বীকার করবো: নাহলে তোমরা যে আমার সেবক ইয়োবের মতো আমার সম্পর্কে যা সঠিক তা বলোনি, সেজন্য আমি তোমাদের মূর্খতার জন্য তোমাদের সাথে বোঝাপড়া করবো। তখন তেমানবাসী এলিফস, শুহার অধিবাসী বিলদদ্ এবং নামাথ নিবাসী সোফর সেই স্থান ত্যাগ করলো, এবং যিহোবার আদেশ অনুসারে সব কাজ করলো: যিহোবাও তখন ইয়োবের প্রার্থনা স্বীকার করলেন।
ইয়োবে ৪২:১০ ইয়োব যখন তার বন্ধুদের জন্য প্রার্থনা করলেন, তখন যিহোবা ইয়োবের দুর্দশার অবসান ঘটালেন: সেইসাথে আগে ইয়োবের যা ছিল তার দ্বিগুণ যিহোবা তাকে দানও করলেন।
ইয়োবে ৪২:১২ অর্থাৎ ইয়োবের প্রথম জীবনের চেয়ে পরবর্তীকালে যিহোবা তাকে আরও বেশি আশীর্বাদ করেছিলেন: কারণ ইয়োব পেয়েছিলেন চোদ্দ হাজার মেষ, ছয় হাজার উট, দু’হাজার বৃষ, আর এক হাজার গর্দভী।
ইয়োবে ৪২:১৭ অবশেষে ইয়োব পূর্ণপরিণত বয়সে ইহলোক ত্যাগ করলেন
যারা ঈশ্বরে ভীত এবং মন্দকে পরিত্যাগ করে ঈশ্বর তাদের স্নেহের দৃষ্টিতে দেখেন, এবং যারা নির্বোধ তাদের হীন নজরে দেখেন
ইয়োব ৪২:৭-৯-এ ঈশ্বর বলেন ইয়োব তাঁর সেবক। ইয়োবের বিষয়ে তাঁর এই “সেবক” শব্দের ব্যবহারই ঈশ্বরের হৃদয়ে ইয়োবের গুরুত্ব প্রদর্শন করছে; যদিও ঈশ্বর ইয়োবকে এর চেয়ে বেশি সম্মানের কোনো নামে ডাকেননি, কিন্তু এই আখ্যার সাথে ঈশ্বরের হৃদয়ে ইয়োবের গুরুত্বের কোনো সম্পর্ক নেই। এখানে “সেবক” হল ইয়োবের জন্য ঈশ্বরের দেওয়া ডাকনাম। ঈশ্বরের এই বারংবার “আমার সেবক ইয়োব” উল্লেখ করার মাধ্যমেই বোঝা যায় তিনি ইয়োবের প্রতি কতটা সন্তুষ্ট ছিলেন। ঈশ্বর যদিও “সেবক” শব্দের অন্তর্নিহিত অর্থের বিষয়ে কিছু বলেননি, কিন্তু ঈশ্বরের কাছে “সেবক” শব্দের সংজ্ঞা কী তা শাস্ত্রের এই অনুচ্ছেদে দেখা যায়। ঈশ্বর প্রথমে তেমান নিবাসী এলিফসকে বললেন: “আমি তোমার উপরে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ, এবং তোমার দুই বন্ধুর উপরেও: কারণ তোমরা আমার সম্পর্কে যা সঠিক তা বলোনি, যেমন আমার সেবক ইয়োব বলেছে।” এই বাক্যগুলোর মাধ্যমেই ঈশ্বর প্রথমবার প্রকাশ্যে মানুষকে বললেন যে ইয়োব ঈশ্বরের পরীক্ষার পরে যা বলেছে ও করেছে সেই সমস্তকিছু তিনি গ্রহণ করেছেন, এবং ইয়োব যা বলেছে ও করেছে তা যে সঠিক ও নির্ভুল, এই প্রথমবার ঈশ্বর প্রকাশ্যে তার স্বীকৃতি দিলেন। ঈশ্বর এলিফস ও অন্যদের প্রতি জন্য ক্রুদ্ধ ছিলেন তাদের ভ্রান্ত ও অযৌক্তিক কথাবার্তার জন্য, কারণ, ইয়োবের মতো তারাও ঈশ্বরের আবির্ভাব প্রত্যক্ষ করেনি বা তাদের জীবনে ঈশ্বরের বাক্য শুনতে পায়নি, কিন্তু তা সত্ত্বেও ইয়োবের ঈশ্বর সম্বন্ধে এরকম নির্ভুল জ্ঞান ছিল, অথচ তারা শুধু ঈশ্বরের সম্পর্কে অন্ধভাবে অনুমানই করতে পেরেছিল, তাদের সমস্ত কাজেই তারা ঈশ্বরের ইচ্ছা লঙ্ঘন করত এবং ঈশ্বরের ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিত। ফলতঃ, ইয়োব যা বলেছিল ও করেছিল সেই সমস্তকিছু গ্রহণ করার সাথেসাথে অন্যদের প্রতি ঈশ্বর ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন, কারণ তাদের মধ্যে তিনি যে শুধু ঈশ্বর-ভীতির বাস্তবতা দেখতে পাননি তা-ই নয়, তারা যা বলেছিল তার মধ্যেও ঈশ্বর-ভীতির চিহ্নমাত্র দেখতে পাননি। আর তাই এরপর ঈশ্বর তাদের কাছে দাবী করেন: “সুতরাং তোমরা এখন সাতটা বৃষ আর সাতটা মেষ নিয়ে আমার সেবক ইয়োবের কাছে যাও, আর নিজেদের জন্য অগ্নিদগ্ধ বলি উৎসর্গ করো; আমার সেবক ইয়োব তখন তোমাদের জন্য প্রার্থনা করবে: তার জন্য আমি সেই প্রার্থনা স্বীকার করবো: নাহলে তোমরা যে আমার সেবক ইয়োবের মতো আমার সম্পর্কে যা সঠিক তা বলোনি, সেজন্য আমি তোমাদের মূর্খতার জন্য তোমাদের সাথে বোঝাপড়া করবো।” এই অনুচ্ছেদে ঈশ্বর এলিফস ও অন্যদের এমন কিছু করতে বলছেন যা তাদের পাপমুক্ত করবে, কারণ তাদের মূর্খতা ছিল যিহোবা ঈশ্বরের বিরুদ্ধে পাপ, এবং সেই কারণে এই ভুল সংশোধন করার জন্য তাদের অগ্নিদগ্ধ বলি উৎসর্গ করতে হয়েছিল। অগ্নিদগ্ধ বলি সাধারণত ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হয়, কিন্তু এইক্ষেত্রে যা কিছুটা অস্বাভাবিক তা হচ্ছে এই অগ্নিদগ্ধ বলি ইয়োবের প্রতি উৎসর্গ করা হয়েছিল। ঈশ্বর ইয়োবকে গ্রহণ করেছিলেন কারণ ইয়োব পরীক্ষা চলাকালীন ঈশ্বরের সাক্ষ্য বহন করেছিল। এদিকে, ইয়োবের এই বন্ধুরা ইয়োবের পরীক্ষার সময়েই অনাবৃত হয়েছিল; তাদের মূর্খতার কারণে তারা ঈশ্বরের দ্বারা তিরস্কৃত হয়েছিল, এবং তারা ঈশ্বরের ক্রোধ জাগিয়ে তুলেছিল, তাই তাদের ঈশ্বরের থেকে শাস্তি পেতে হতো—ইয়োবের উদ্দেশ্যে অগ্নিদগ্ধ বলি উৎসর্গ করার শাস্তি—যার পরে ইয়োব তাদের প্রতি ঈশ্বরের ক্রোধ ও শাস্তি নিরসন করার জন্য তাদের হয়ে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছিল। ঈশ্বরের অভিপ্রায় ছিল তাদেরকে লজ্জিত করা, কারণ তারা এমন লোক ছিল না যারা ঈশ্বরে ভীত এবং মন্দ কর্ম পরিত্যাগ করেছে, এবং তারা ইয়োবের সততাকে নিন্দা করেছিল। এক দিক থেকে, ঈশ্বর তাদের বলছিলেন যে তিনি তাদের কাজকে গ্রহণ করেননি, কিন্তু সানন্দে ও সমাদরে ইয়োবকে গ্রহণ করেছিলেন; অন্য দিক থেকে, ঈশ্বর তাদের বলছিলেন যে ঈশ্বরের দ্বারা গৃহীত হলে মানুষ ঈশ্বরের সম্মুখে উন্নীত হয়, মানুষ তার মূর্খতার কারণে ঈশ্বরের কাছে ঘৃণিত, এই কারণেই সে ঈশ্বরকে ক্ষুব্ধ করে, এবং এই কারণেই সে ঈশ্বরের দৃষ্টিতে নীচ ও অধম। এগুলোই হল দুই ধরনের মানুষের ঈশ্বর প্রদত্ত সংজ্ঞা, এগুলোই এই দুই ধরনের মানুষের প্রতি ঈশ্বরের মনোভাব, এবং এগুলোই এই দুই ধরনের মানুষের মূল্য ও অবস্থান সম্পর্কে ঈশ্বরের স্পষ্টভাষণ। যদিও ঈশ্বর ইয়োবকে সেবক বলে অভিহিত করেছিলেন, কিন্তু ঈশ্বরের চোখে এই সেবক ছিল প্রিয়, এবং ঈশ্বর তাকে অন্যদের হয়ে প্রার্থনা করার ও তাদের ত্রুটি ক্ষমা করে দেওয়ার কর্তৃত্ব প্রদান করেছিলেন। এই সেবক ঈশ্বরের সাথে সরাসরি কথা বলতে ও সরাসরি ঈশ্বরের সম্মুখে আসতে সক্ষম ছিল, এবং তার মর্যাদা ছিল অন্যদের থেকে উচ্চতর ও সম্মানীয়। এটাই ঈশ্বরের উচ্চারিত “সেবক” শব্দের আসল অর্থ। ইয়োবকে এই বিশেষ সম্মান প্রদান করা হয়েছিল তার ঈশ্বরে ভীতি এবং মন্দ কর্ম পরিত্যাগের কারণে, এবং ঈশ্বর অন্যদের সেবক নামে অভিহিত করেননি কারণ তারা ঈশ্বরে ভীত ছিল না এবং তারা মন্দ কর্ম পরিত্যাগ করেনি। ঈশ্বরের এই দুই সম্পূর্ণ ভিন্ন মনোভাব হল দুই প্রকারের মানুষের প্রতি তাঁর মনোভাবের প্রকাশ: যারা ঈশ্বরে ভীত ও মন্দ কর্ম পরিত্যাগ করেছে তারা ঈশ্বরের দ্বারা গৃহীত ও তাঁর চোখে মূল্যবান, অপরদিকে যারা নির্বোধ তারা ঈশ্বরে ভীত নয়, তারা মন্দ কর্ম পরিত্যাগ করতে পারে না, এবং তারা ঈশ্বরের আনুকূল্য পেতে অসমর্থ; তারা সাধারণত ঈশ্বরের কাছে ঘৃণিত ও নিন্দিত, এবং ঈশ্বরের চোখে নীচ।
ঈশ্বরের ইয়োবকে কর্তৃত্ব প্রদান
ইয়োব তার বন্ধুদের জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছিল, এবং তারপর, ইয়োবের এই প্রার্থনার জন্য ঈশ্বর তাদের মূর্খতার উপযুক্ত মোকাবিলা থেকে বিরত থেকেছিলেন—তিনি তাদের দণ্ড দেননি বা তাদের উপর প্রতিশোধ নেননি। তা কেন? কারণ তাদের জন্য ঈশ্বরের সেবক ইয়োব যে প্রার্থনা করেছিল তা ঈশ্বরের কানে পৌঁছেছিল; ঈশ্বর তাদের ক্ষমা করেছিলেন কারণ তিনি ইয়োবের প্রার্থনা গ্রহণ করেছিলেন। তাহলে এর মধ্যে আমরা কী দেখতে পাচ্ছি? যখন ঈশ্বর কাউকে আশীর্বাদ করেন তখন তিনি তাকে অনেক পুরষ্কার দেন, এবং তা শুধু জাগতিক পুরষ্কারই নয়: ঈশ্বর তাদের কর্তৃত্বও প্রদান করেন, অন্যদের হয়ে প্রার্থনা করার অনুমতি দেন, এবং সেই অন্যদের সীমালঙ্ঘনকে ঈশ্বর উপেক্ষা করেন ও ভুলে যান, কারণ এদের প্রার্থনা তিনি শোনেন। ঠিক এই কর্তৃত্বই ঈশ্বর ইয়োবকে দিয়েছিলেন। ইয়োবের প্রার্থনার মাধ্যমে তাদের তিরস্কৃত হওয়ার অবসান ঘটিয়ে ঈশ্বর সেই নির্বোধ মানুষদের লজ্জিত করেছিলেন—যেটা নিশ্চিতভাবেই এলিফস ও অন্যদের প্রতি ঈশ্বরের বিশেষ দণ্ড।
ইয়োব আরও একবার ঈশ্বরের কাছ থেকে আশীর্বাদ লাভ করে, এবং আর কখনোই শয়তানের দ্বারা অভিযুক্ত হয় না
যিহোবা ঈশ্বরের উচ্চারণের মধ্যে এই বাক্যগুলো রয়েছে যে “তোমরা আমার সম্পর্কে যা সঠিক তা বলোনি, যেমন আমার সেবক ইয়োব বলেছে।” ইয়োব আসলে ঠিক কী বলেছিল? তা আমরা আগে আলোচনা করেছি, এবং ইয়োবের গ্রন্থের অনেক পৃষ্ঠায় ইয়োবের এই কথাগুলো লিপিবদ্ধ রয়েছে। এই এত এত পৃষ্ঠার এত শব্দের মধ্যে, ইয়োব কখনও একবারও ঈশ্বরের সম্পর্কে অভিযোগ করেনি বা সন্দেহপ্রকাশ করেনি। সে শুধু পরিণামের অপেক্ষা করেছে। তার এই অপেক্ষা, যা তার আনুগত্যের আচরণ, তার ফল হিসাবে, এবং ঈশ্বরকে সে যে কথাগুলো বলেছিল তার ফল হিসাবে, ঈশ্বর তাকে গ্রহণ করেছিলেন। যখন সে এই পরীক্ষাগুলো সহ্য করছিল, কষ্ট ভোগ করছিল, তখন ঈশ্বর তার পাশে ছিলেন, এবং যদিও তার এই কষ্ট ঈশ্বরের উপস্থিতির ফলে কমে যায়নি, তবুও ঈশ্বর যা দেখতে চেয়েছিলেন এবং যা শুনতে চেয়েছিলেন তা দেখেছিলেন ও শুনেছিলেন। ইয়োবের প্রতিটা কাজ ও প্রতিটা কথা ঈশ্বরের দৃষ্টি ও কর্ণগোচর হয়েছিল; ঈশ্বর শুনেছিলেন এবং দেখেছিলেন—এটাই সত্য। সেই সময়ে, সেই সময়কাল ধরে, ঈশ্বর সম্পর্কে যে জ্ঞান ছিল ও তার হৃদয়ে ঈশ্বর সম্পর্কে যে চিন্তাভাবনা ছিল, তা বর্তমানের মানুষের মতো এত সুনির্দিষ্ট ছিল না, কিন্তু সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে, সে যা কিছু বলেছিল ঈশ্বর তা চিনতে পেরেছিলেন, কারণ তার আচরণ ও তার হৃদয়ের চিন্তাভাবনা, ও সেইসাথে সে যা প্রকাশ ও অভিব্যক্ত করেছিল, তা ঈশ্বরের চাহিদার পক্ষে যথেষ্ট ছিল। ইয়োব যখন পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল, সেই সময়ে তার হৃদয়ে সে যা চিন্তাভাবনা করেছিল ও যা করার সংকল্প নিয়েছিল, তা ঈশ্বরকে এমন এক পরিণাম প্রদর্শন করেছিল যা ছিল তাঁর কাছে সন্তোষজনক, এবং এরপরে ঈশ্বর ইয়োবের পরীক্ষার সমাপ্তি ঘটান, ইয়োব তার সমস্যা থেকে মুক্তি পায়, এবং তার পরীক্ষা দূরীভূত হয় এবং আর কখনো তাকে সেসবের সম্মুখীন হতে হয়নি। যেহেতু ইয়োবকে ইতিমধ্যেই পরীক্ষার সম্মুখীন করা হয়েছে, এবং সে পরীক্ষায় অবিচল থাকতে পেরেছে ও শয়তানকে সম্পূর্ণভাবে পরাজিত করেছে, তাই ঈশ্বর তাকে তার ন্যায্য প্রাপ্য আশীর্বাদ প্রদান করেছিলেন। ইয়োব ৪২:১০,১২ অনুযায়ী, ইয়োব আরও একবার আশীর্বাদ লাভ করেছিল, এবং তার পরিমাণ ছিল প্রথমবারের থেকেও বেশী। এই সময়ে শয়তান নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছিল, এবং আর কিছু বলেনি বা করেনি, এবং এরপর থেকে শয়তান আর কখনো ইয়োবের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেনি বা তাকে আক্রমণ করেনি, এবং ইয়োবের প্রতি ঈশ্বরের আশীর্বাদ নিয়ে আর কোনো অভিযোগ করেনি।
ইয়োব তার জীবনের পরবর্তী অর্ধেক অংশ ঈশ্বরের আশীর্বাদের মধ্যে যাপন করে
যদিও সেই সময়ে ঈশ্বরের আশীর্বাদ শুধু ভেড়া, গবাদি পশু, উট ও অন্যান্য জাগতিক সম্পদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, কিন্তু ঈশ্বর তাঁর হৃদয় থেকে ইয়োবকে যে আশীর্বাদ প্রদান করতে চেয়েছিলেন তা এর থেকে অনেকাংশে বেশী ছিল। এইসময়ে ঈশ্বর ইয়োবকে কী ধরনের চিরন্তন প্রতিশ্রুতি প্রদান করতে চেয়েছিলেন, তা কী কোথাও লিপিবদ্ধ ছিল? ইয়োবের প্রতি ঈশ্বরের আশীর্বাদে ঈশ্বর ইয়োবের সমাপ্তির বিষয়ে উল্লেখ করেননি বা সে বিষয় স্পর্শ করেননি, এবং ঈশ্বরের হৃদয়ে ইয়োব যে স্থানই অধিকার করে থাকুক না কেন, সংক্ষেপে বলা যায় যে ঈশ্বর আশীর্বাদ প্রদানে অত্যন্ত পরিমিত ছিলেন। ঈশ্বর ইয়োবের সমাপ্তির বিষয়ে কোনো ঘোষণা করেননি। এর অর্থ কী? সেই সময়ে, যখন ঈশ্বরের পরিকল্পনা মানুষের পরিসমাপ্তি ঘোষণা করার মতো পর্যায়ে পৌঁছয়নি, সেই পরিকল্পনা তখনও ঈশ্বরের কাজের সর্বশেষ স্তরে পৌঁছনো বাকি, তখন ঈশ্বর সমাপ্তির কোনো উল্লেখ করেননি, তিনি শুধু মানুষকে জাগতিক আশীর্বাদ প্রদান করতেন। এর অর্থ হল, ইয়োবের জীবনের শেষার্ধ ঈশ্বরের আশীর্বাদের মধ্যেই কেটেছিল, যার ফলে সে অন্যদের থেকে পৃথক হয়ে উঠেছিল—কিন্তু অন্যদের মতো তারও বয়স বেড়েছিল, এবং যে কোনো সাধারণ মানুষের মতোই এমন একটা দিন এসেছিল যেদিন সে পৃথিবীকে বিদায় জানিয়েছিল। তাই এ কথা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে যে “অবশেষে ইয়োব পূর্ণপরিণত বয়সে ইহলোক ত্যাগ করলেন” (ইয়োবে ৪২:১৭)। এখানে “পূর্ণপরিণত বয়সে ইহলোক ত্যাগ করলেন”—এর অর্থ কী? ঈশ্বর মানুষের সমাপ্তি ঘোষণা করার পূর্ববর্তী যুগে, ঈশ্বর ইয়োবের জন্য একটা জীবনকাল নির্ধারণ করেছিলেন, এবং সেই সময় উপনীত হলে ঈশ্বর তাকে পৃথিবী থেকে স্বাভাবিকভাবে বিদায় নেওয়ার অনুমতি দেন। ইয়োবের দ্বিতীয় আশীর্বাদ থেকে তার মৃত্যু পর্যন্ত ঈশ্বর তার জীবনে আর কোনো দুর্দশা যোগ করেননি। ঈশ্বরের কাছে ইয়োবের মৃত্যু ছিল স্বাভাবিক, এবং সেইসাথে প্রয়োজনীয়ও; এটা ছিল একটা খুব স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, তাকোনো বিচারের রায় বা দণ্ড ছিল না। ইয়োব যখন জীবিত ছিল, সে ঈশ্বরের উপাসনা করত এবং ঈশ্বরে ভীত ছিল; মৃত্যুর পরে তার পরিসমাপ্তি কেমন হয়েছিল তা ঈশ্বর কিছু বলেননি, সে বিষয়ে কোনো মন্তব্যও করেননি। ঈশ্বর কী করেন ও বলেন সে সম্বন্ধে উপযুক্ততার উপযুক্ততার বোধ আছে, এবং তাঁর কাজ ও তাঁর বাক্যের বিষয় ও নীতি তাঁর কাজের স্তর ও যুগের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। ঈশ্বরের হৃদয়ে ইয়োবের মতো একজন মানুষের জন্য কী ধরনের সমাপ্তি নিহিত ছিল? ঈশ্বর কী তাঁর হৃদয়ে কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন? অবশ্যই হয়েছিলেন! বিষয়টা শুধু এই যে তা মানুষের অজানা; ঈশ্বর মানুষকে তা বলতে চাননি, বা মানুষকে তা বলার কোনো অভিপ্রায়ও তাঁর ছিল না। সুতরাং বাহ্যিকভাবে বলতে গেলে, ইয়োব তার পূর্ণ পরিণত বয়সে ইহলোক ত্যাগ করে, এবং এমনই ছিল ইয়োবের জীবন।
সমগ্র আয়ুষ্কাল ধরে ইয়োব যে জীবন যাপন করেছিল তার মূল্য
ইয়োব কি মূল্যবান জীবন যাপন করেছিল? সেই মূল্য কোথায় নিহিত ছিল? কেন বলা হয় যে সে একটা মূল্যবান জীবন যাপন করেছিল? মানুষের কাছে তার মূল্য কী ছিল? মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, শয়তানের ও সারা পৃথিবীর মানুষের সামনে ঈশ্বরের সাক্ষ্য বহন করার দিক থেকে সে সেই মানবজাতির প্রতিনিধিত্ব করেছিল যাদের ঈশ্বর উদ্ধার করতে চান। ঈশ্বরের জীবের যে কর্তব্য পালন করা উচিত তা সে পূরণ করেছিল, সে একটা নজির সৃষ্টি করেছিল, এবং ঈশ্বর যাদের রক্ষা করতে চান তাদের আদর্শ হিসাবে কাজ করেছিল, মানুষকে দেখিয়েছিল যে ঈশ্বরের উপর ভরসা রেখে শয়তানের বিরুদ্ধে জয়ী হওয়া সম্পূর্ণরূপে সম্ভব। ঈশ্বরের কাছে তার মূল্য কী ছিল? ঈশ্বরের কাছে ইয়োবের জীবনের মূল্য নিহিত ছিল তার ঈশ্বরে ভীতি, ঈশ্বরের আরাধনা, ঈশ্বরের কর্মের সাক্ষ্য বহন করা, ঈশ্বরের কাজের বন্দনা করা, এবং ঈশ্বরকে স্বস্তি ও আনন্দ এনে দেওয়ার মধ্যে; ঈশ্বরের কাছে, ইয়োবের জীবনের মূল্য এর মধ্যেও নিহিত ছিল যে মৃত্যুর আগে, ইয়োব কীভাবে পরীক্ষার অভিজ্ঞতা লাভ করেছিল ও শয়তানের বিরুদ্ধে জয়লাভ করেছিল, শয়তানের ও সারা পৃথিবীর মানুষের সামনে কীভাবে সে ঈশ্বরের সাক্ষ্য বহন করেছিল, যার ফলে ঈশ্বর মানবজাতির কাছে মহিমা অর্জন করতে পেরেছিলেন, ঈশ্বরের হৃদয় স্বস্তি পেয়েছিল এবং তাঁর উৎসুক হৃদয় একটা পরিণাম প্রত্যক্ষ করেছিল ও আশা দেখতে পেয়েছিল। ঈশ্বরের সাক্ষ্যপ্রদানে কোনো একজনের অবিচল থাকার সামর্থ্যের জন্য এবং ঈশ্বরের হয়ে শয়তানকে লজ্জিত করতে সক্ষম হওয়ার জন্য ইয়োবের সাক্ষ্য ঈশ্বরের মানবজাতিকে পরিচালনার কাজে একটা নজির সৃষ্টি করেছিল। এটাই কি ইয়োবের জীবনের মূল্য নয়? ইয়োব ঈশ্বরের হৃদয়কে স্বস্তি দিয়েছিল, তাঁকে গৌরব অর্জনের আনন্দ আস্বাদন করিয়েছিল, এবং ঈশ্বরের পরিচালনামূলক পরিকল্পনাকে এক বিস্ময়কর সূচনা প্রদান করেছিল। এই সময়ের পর থেকে, ইয়োবের নাম হয়ে উঠেছিল ঈশ্বরের মহিমা অর্জনের প্রতীক, এবং শয়তানের বিরুদ্ধে মানবজাতির জয়ের প্রতীক। ইয়োব নিজের আয়ুষ্কালে যে জীবন যাপন করেছিল, ও সেইসাথে শয়তানের বিরুদ্ধে তার উল্লেখযোগ্য জয়লাভ, ঈশ্বরের দ্বারা সর্বদা সযত্নে লালিত হবে, এবং তার ত্রুটিহীনতা, ন্যায়পরায়ণতা ও ঈশ্বরে ভীতি আগামী প্রজন্ম গভীর শ্রদ্ধা করবে ও অনুকরণ করবে। সে ঈশ্বরের কাছে সর্বদা এক নিখুঁত প্রোজ্জ্বল মুক্তার মতো সযত্নলালিত হবে, এবং একইভাবে সে মানবজাতির কাছেও মূল্যবান হিসাবে পরিগণিত হওয়ার যোগ্য।
এরপর, বিধানের যুগে ঈশ্বরের কার্য লক্ষ্য করা যাক।
ঘ. বিধানের যুগের নীতিসমূহ
দশটি আদেশ
বেদি নির্মাণের নীতি
ভৃত্যের প্রতি আচরণের নিয়ম
চুরি ও ক্ষতিপূরণের নিয়ম
বিশ্রামবারের বর্ষ পালন এবং তিনটি ভোজ পালন
বিশ্রামবারের নিয়ম
বলি উৎসর্গের বিধি
অগ্নিদগ্ধ বলি উৎসর্গ
শস্যের উৎসর্গ
শান্তির উৎসর্গ
পাপস্খালনের বলি
সীমালঙ্ঘনের উৎসর্গ
যাজকদের দ্বারা বলি উৎসর্গের নিয়মাবলী (হারোণ ও তার পুত্রদের তা মেনে চলার আদেশ দেওয়া হয়েছিল)
যাজকদের দ্বারা অগ্নিদগ্ধ বলি উৎসর্গ
যাজকদের দ্বারা শস্যের বলি উৎসর্গ
যাজকদের দ্বারা পাপস্খালনের বলি উৎসর্গ
যাজকদের দ্বারা সীমালঙ্ঘনের বলি উৎসর্গ
যাজকদের দ্বারা শান্তির বলি উৎসর্গ
যাজকের দ্বারা বলি ভক্ষণের নিয়মাবলী
বিশুদ্ধ ও অশুদ্ধ পশু (আহারের যোগ্য ও আহারের অযোগ্য)
সন্তানজন্মের পর নারীর শুদ্ধিকরণের নিয়মাবলী
কুষ্ঠ পরীক্ষার জন্য মানদণ্ড
যারা কুষ্ঠরোগ থেকে সুস্থ হয়ে উঠেছেন তাদের জন্য নিয়মাবলী
সংক্রামিত বাড়ি পরিষ্কারের নিয়ম
যারা অস্বাভাবিক স্রাব থেকে ভুগছেন তাদের জন্য নিয়মাবলী
প্রায়শ্চিত্তের দিন, যা বছরে একবার অবশ্যই পালন করতে হবে
গবাদি পশু ও ভেড়া বধ করার নিয়ম
অইহুদিদের কুরুচিকর অভ্যাস অনুসরণ করার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা (পরিবারের লোকেদের মধ্যে যৌনসংগম না করা ও অন্যান্য)
যে সকল নীতি মানুষকে অবশ্যই মেনে চলতে হবে (“তোমাদের পবিত্র হয়ে উঠতে হবে: কারণ আমি যিহোবা, তোমাদের ঈশ্বর, পবিত্র” (লেবীয় পুস্তক ১৯:২))
যারা নিজের সন্তানদের মোলেক দেবতার কাছে আহুতি দেয় তাদের মৃত্যুদণ্ড
ব্যাভিচার সংক্রান্ত অপরাধের শাস্তির নিয়মাবলী
যাজকদের যেসকল নিয়ম পালন করতে হবে (তাদের দৈনন্দিন আচরণের নিয়ম, পবিত্র বস্তু ভোজনের নিয়ম, বলি উৎসর্গ করার নিয়ম, ইত্যাদি)
যেসকল ভোজনোৎসব পালন করতে হবে (বিশ্রামবার, নিস্তারপর্ব, পঞ্চাশত্তমীর পর্ব, প্রায়শ্চিত্তের দিন, এবং অন্যান্য)
অন্যান্য নিয়ম (দীপ জ্বালানো, জুবিলি বর্ষ, জমি পুনরুদ্ধার, মানত করা, দশমাংসের উৎসর্গ, প্রভৃতি)
বিধানের যুগের নীতিসমূহই ঈশ্বরের সমগ্র মানবজাতিকে পথপ্রদর্শনের প্রকৃত প্রমাণ
তাহলে, বিধানের যুগের এইসব নিয়ম আর নীতি তোমরা পড়েছো, তাই তো? এই নীতিগুলো কী একটা বিস্তৃত পরিসরে ব্যাপ্ত? প্রথমত, এগুলো দশটি আদেশের কথা বলে, তারপর পূজাবেদী নির্মাণের নীতির কথা বলে, এবং এইভাবে চলতে থাকে। এরপরে আসে বিশ্রামবার ও তিনটি ভোজনোৎসন পালনের নিয়ম, এবং তারপর আসে উৎসর্গ প্রদানের নিয়মাবলী। এখানে কত ধরনের বলি উৎসর্গের কথা আছে তা তোমরা লক্ষ্য করেছো? অগ্নিদগ্ধ বলি উৎসর্গ, শস্যের বলি উৎসর্গ, শান্তির বলি উৎসর্গ, পাপস্খালনের বলি উৎসর্গ, এইরকম আরও অনেক। এরপর রয়েছে যাজকদের দ্বারা বলি উৎসর্গের নিয়ম, এর মধ্যে রয়েছে যাজকের দ্বারা অগ্নিদগ্ধ বলি ও শস্যের বলি উৎসর্গ, এবং অন্যান্য রকমের উৎসর্গ। নিয়মাবলীর অষ্টম গুচ্ছ হল যাজকদের দ্বারা এই বলি উৎসর্গ ভক্ষণ সংক্রান্ত। তারপর রয়েছে মানুষকে জীবনে কী কী পালন করতে হবে তার নিয়ম। এখানে মানুষের জীবনের বহু আঙ্গিকের জন্য নানা নিয়ম রয়েছে, যেমন তারা কী খেতে পারবে বা পারবে না সেই সংক্রান্ত নিয়ম, সন্তান জন্মের পর মহিলাদের শুদ্ধিকরণ সংক্রান্ত নিয়ম, এবং যারা কুষ্ঠ রোগ থেকে সুস্থ হয়ে উঠেছে তাদের জন্য নিয়ম। এই নিয়মনীতিগুলোতে, ঈশ্বর এমনকি ব্যাধি নিয়েও আলোচনা করেছেন, এবং ভেড়া ও গবাদিপশু বধের নীতিও রয়েছে। ভেড়া ও গবাদি পশু ঈশ্বরের সৃষ্ট, তাই তোমাকে ঈশ্বরের নির্দেশ অনুসারেই তাদের বধ করতে হবে; নিঃসন্দেহেই ঈশ্বরের বাক্যে যৌক্তিকতা রয়েছে; নিঃসন্দেহে ঈশ্বরের ফরমান অনুযায়ী, কাজ করাই সঠিক, এবং তা অবশ্যই মানুষের জন্য উপকারী! কিছু ভোজনের উৎসব ও নিয়মের পালনও করতে হবে, যেমন বিশ্রামবার, নিস্তারপর্ব, প্রভৃতি—ঈশ্বর এই সমস্ত বিষয়ে আলোচনা করেছেন। এখন শেষ নিয়মগুলোর দিকে লক্ষ্য করা যাক: অন্যান্য নিয়ম—দীপ জ্বালানো, জুবিলি বর্ষ পালন, জমি পুনরুদ্ধার, মানত করা, দশমাংসের বলি উৎসর্গ প্রভৃতি। এইসমস্ত কিছু এক ব্যাপক ক্ষেত্র পরিবেষ্টন করছে না কি? প্রথমে যে বিষয়ে কথা বলা প্রয়োজন তা হল মানুষের দ্বারা উৎসর্গ। এরপর রয়েছে চুরি ও ক্ষতিপূরণের নীতি, এবং তারপর বিশ্রামবার পালন…; জীবনের সমস্ত খুঁটিনাটি এখানে জড়িত। অর্থাৎ, ঈশ্বর যখন তাঁর পরিচালনামূলক পরিকল্পনার আনুষ্ঠানিক কাজ শুরু করেছিলেন, তখন তিনি মানুষের পালনের জন্য নানা নিয়মনীতির প্রতিষ্ঠা করেন। এই নিয়মগুলো তৈরি করা হয়েছিল যাতে মানুষ পৃথিবীতে মানুষের মতো স্বাভাবিকভাবে জীবন যাপন করতে পারে, এমন এক স্বাভাবিক জীবন যা ঈশ্বর ও তাঁর পথপ্রদর্শনের থেকে অবিচ্ছেদ্য। প্রথমে ঈশ্বর মানুষকে বলেছিলেন কীভাবে বেদী নির্মাণ করতে হবে, কীভাবে সেই বেদী প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এরপর তিনি মানুষকে বলেছিলেন কীভাবে বলি উৎসর্গ করতে হবে, এবং প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মানুষকে কীভাবে জীবন যাপন করতে হবে—জীবনে কীসের প্রতি তার মনোযোগ দেওয়া উচিত, কী তার মেনে চলা উচিত, এবং তার কী করা উচিত ও কী করা উচিত নয়। ঈশ্বর মানুষের জন্য যা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তা ছিল সর্বব্যাপী, এবং এই আচার, নিয়ম, ও নীতির দ্বারা ঈশ্বর মানুষের আচরণের মানদণ্ড ঠিক করেছিলেন, তাদের জীবনকে পথনির্দেশ দিয়েছিলেন, তাদের ঈশ্বরের বিধান মেনে চলার পথের সূচনার নির্দেশ দিয়েছিলেন, তাদের ঈশ্বরের বেদীর সম্মুখে আসার পথ দেখিয়েছিলেন, এবং ঈশ্বর মানুষের জন্য যে সকল বস্তু সৃষ্টি করেছেন, যা শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা, ও সংযমের অধিকারী, সেসবের মাঝে মানুষকে একটা জীবন যাপন করার জন্য পথনির্দেশ দিয়েছিলেন। ঈশ্বর প্রথমে এই সহজ নিয়ম ও নীতির মাধ্যমে মানুষের সীমা নির্দিষ্ট করেছিলেন, যাতে মানুষ পৃথিবীতে ঈশ্বর উপাসনার এক স্বাভাবিক জীবন নির্বাহ করতে পারে, মানুষের মতো স্বাভাবিক জীবন লাভ করতে পারে; ঈশ্বরের ছয় হাজার বছরের পরিচালনামূলক পরিকল্পনার প্রারম্ভকালীন সুনির্দিষ্ট বিষয়টা এরকমই। এইসব নিয়ম ও নীতি এক বিশাল ক্ষেত্র জুড়ে বিস্তৃত, এগুলো বিধানের যুগে মানবজাতির উদ্দেশ্যে ঈশ্বরের নির্দিষ্ট নির্দেশ, বিধানের যুগের আগের মানুষদের এই নির্দেশগুলো স্বীকার করতে ও পালন করতে হতো, এইগুলো বিধানের যুগে ঈশ্বরের কর্মের নথি, এবং এগুলো মানবজাতির কাছে ঈশ্বরের নেতৃত্ব ও নির্দেশনার বাস্তব প্রমাণ।
ঈশ্বরের শিক্ষা ও বিধানের থেকে মানবজাতি চিরকালের জন্য অবিচ্ছেদ্য
এইসমস্ত নিয়মনীতির মধ্যে আমরা দেখতে পাই যে তাঁর কাজ, তাঁর ব্যবস্থাপনা, এবং সমগ্র মানবজাতির প্রতি ঈশ্বরের মনোভাব অত্যন্ত গুরুত্বপ্রদানকারী, বিবেকবান, পুঙ্খানুপুঙ্খ, ও দায়িত্বপূর্ণ। তিনি মানবজাতির মধ্যে তাঁর অবশ্যকরণীয় কাজ নিজের পদক্ষেপ অনুযায়ী করেন, সেখানে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ত্রুটি পর্যন্ত থাকে না, ত্রুটিহীনভাবে এবং কোনো অংশ বাদ না দিয়ে তিনি মানবজাতিকে তাঁর যা বলার তা বলেন, এবং মানুষকে দেখান যে তারা তাঁর নেতৃত্ব থেকে অবিচ্ছেদ্য, এবং তিনি যা বলেন ও করেন তা মানবজাতির জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা মানুষকে প্রত্যক্ষ করান। পরের যুগের মানুষ কেমন তা নির্বিশেষে, একেবারে শুরুতে—বিধানের যুগের সময়—ঈশ্বর এই সহজ কাজগুলো করেছিলেন। ঈশ্বর জানতেন যে ঈশ্বর, বিশ্ব, ও মানবজাতি সম্পর্কে মানুষের ধারণা সেই যুগে ছিল বিমূর্ত ও অস্বচ্ছ, এমনকি যদিও মানুষের কিছু সচেতন ধারণা ও উদ্দেশ্য ছিল, কিন্তু সেই সবই ছিল অস্বচ্ছ ও ত্রুটিপূর্ণ, আর তাই মানবজাতি তাদের প্রতি ঈশ্বরের প্রদত্ত শিক্ষা ও বিধানের থেকে অবিচ্ছেদ্য ছিল। আদি মানবজাতি কিছুই জানত না, তাই ঈশ্বরকে মানুষের বেঁচে থাকার জন্য তাদের সবচেয়ে বাহ্যিক ও প্রাথমিক নীতি এবং জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় বিধান থেকেই শেখানো শুরু করতে হয়েছিল, যা ধীরে ধীরে তাদের হৃদয়ে প্রবেশ করেছিল। বাক্যের দ্বারা প্রকাশিত এই নিয়মগুলোর মাধ্যমে, এবং এই নীতিগুলোর মাধ্যমে, ঈশ্বর মানুষকে তাঁর সম্পর্কে ধীরে ধীরে ধারণা প্রদান করেছিলেন, ক্রমান্বয়ে তাঁর নেতৃত্বের উপলব্ধি ও ধারণা প্রদান করেছিলেন, এবং মানুষ ও তাঁর নিজের মধ্যে সম্পর্কের একটা প্রাথমিক ধারণা দিয়েছিলেন। শুধুমাত্র এই প্রভাব অর্জনের পরেই, ঈশ্বর তাঁর পরবর্তী কাজের দিকে ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে পেরেছিলেন। সুতরাং, এইসব নিয়মনীতি, এবং বিধানের যুগে ঈশ্বরের সম্পাদিত কাজই হলো মানবজাতিকে উদ্ধারের জন্য ঈশ্বরের কাজের ভিত্তিপ্রস্তর, এবং তাঁর পরিচালনামূলক পরিকল্পনার কাজের প্রথম পর্যায়। যদিও বিধানের যুগের কাজের আগে ঈশ্বর আদম, হবা ও তাদের বংশধরদের উদ্দেশ্যে কথা বলেছিলেন, কিন্তু সেই আদেশ ও শিক্ষা তেমন সুসংবদ্ধ ছিল না যে মানুষের জন্য সেগুলো এক এক করে জারি করা যেতে পারে, এবং সেগুলো লিখিতও ছিল না, বা সেগুলো নিয়মেও পরিণত হয়নি। এর কারণ হলো, সেই সময়ে ঈশ্বরের পরিকল্পনা ততদূর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল না; একমাত্র এই ধাপ পর্যন্ত মানুষকে নেতৃত্ব দিয়ে নিয়ে আসার পরই তিনি বিধানের যুগের এইসকল নিয়মের কথা বলা আরম্ভ করতে পারতেন, এবং মানুষকে দিয়ে সেগুলো পালন করানোর কাজ শুরু করতে পারতেন। এটা ছিল একটা প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া, এবং এর ফলাফল ছিল অবশ্যম্ভাবী। এই সহজ আচার ও নিয়মগুলো মানুষকে ঈশ্বরের ব্যবস্থাপনার কাজের ধাপগুলো দেখায়, এবং ঈশ্বরের পরিচালনামূলক পরিকল্পনার মধ্যে প্রকাশিত ঈশ্বরের প্রজ্ঞাকে প্রদর্শন করায়। ঈশ্বর জানেন কোন বিষয় ও কোন উপায় ব্যবহার করে শুরু করতে হয়, কোন ব্যবহার করে এগিয়ে যেতে হয়, এবং কোন উপায়ে তা শেষ করতে হয়, যাতে তিনি এমন একদল মানুষকে অর্জন করতে পারেন যারা তাঁর সাক্ষ্য বহন করবে এবং ঈশ্বরের মতোই সমমনস্ক হবে। তিনি জানেন মানুষের ভিতরে কী আছে, তাদের কীসের ঘাটতি আছে। তিনি জানেন তাঁকে কী সরবরাহ করতে হবে, তাঁর কীভাবে মানুষকে নেতৃত্ব দিতে হবে, এবং একইভাবে তিনি এও জানেন মানুষের কী করা উচিত ও কী করা উচিত নয়। মানুষ একটা পুতুলের মতো: যদিও ঈশ্বরের ইচ্ছা সম্বন্ধে তার বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না, তবুও ঈশ্বরের ব্যবস্থাপনার কাজের নেতৃত্বাধীন হয়ে সে এগিয়ে এসেছে, ধাপে ধাপে, আজকের দিন পর্যন্ত। তাঁকে কী করতে হবে তা নিয়ে ঈশ্বরের হৃদয়ে কোনো অস্পষ্টতা ছিল না; তাঁর হৃদয়ে এক স্বচ্ছ ও উজ্জ্বল পরিকল্পনা ছিল, এবং যে কাজ তিনি করতে চেয়েছিলেন তা তাঁর নিজের পদক্ষেপ ও তাঁর নিজের পরিকল্পনা অনুযায়ীই নির্বাহ করেছেন, উপরিতল থেকে গভীরের দিকে অগ্রসর হয়েছেন। যদিও পরবর্তী ক্ষেত্রে তিনি কী করতে চলেছিলেন সে বিষয়ে ঈশ্বর কোনো ইঙ্গিত দেননি, কিন্তু তাঁর পরবর্তী কার্যাবলী তাঁর পরিকল্পনা অনুসারে যথাযথ ভাবে অগ্রসর ও সম্পাদিত হয়ে চলেছিল, যেটা ঈশ্বর যা এবং তাঁর যা আছে তারই বহিঃপ্রকাশ, এবং যেটা সেইসাথে ঈশ্বরের কর্তৃত্বও। তাঁর পরিচালনামূলক পরিকল্পনার কোন পর্যায়ে তিনি কাজ করছেন তা নির্বিশেষে, তাঁর স্বভাব ও তাঁর সারসত্য তাঁকে উপস্থাপিত করে। এটা সম্পূর্ণরূপে সত্য। যুগ, অথবা কাজের পর্যায় নির্বিশেষে এমন কিছু জিনিস আছে যা কখনো পরিবর্তিত হবে না: যেমন কোন ধরনের মানুষকে ঈশ্বর ভালোবাসেন, কোন ধরনের মানুষকে তিনি ঘৃণা করেন, তাঁর স্বভাব, এবং তাঁর যা আছে ও তিনি যা। যদিও বিধানের যুগের কাজের সময় প্রতিষ্ঠিত এই সমস্ত নিয়ম ও নীতিগুলো আজকের মানুষের কাছে খুবই সহজ ও অগভীর বলে মনে হয়, এবং যদিও এগুলো উপলব্ধি ও অর্জন করা সহজসাধ্য, কিন্তু এগুলোর মধ্যেই রয়েছে ঈশ্বরের প্রজ্ঞা, এবং রয়েছে তাঁর স্বভাব, এবং তাঁর যা আছে ও তিনি যা। কারণ এই আপাত-সহজ নীতিগুলোর মধ্যেই মানবজাতির প্রতি ঈশ্বরের দায়িত্ববোধ ও যত্ন প্রকাশিত হয়, ও সেইসাথে অভিব্যক্ত হয় তাঁর ভাবনার সূক্ষ্ম নির্যাস, এবং এইভাবে মানুষকে প্রকৃতপক্ষে উপলব্ধি করায় এই সত্যের যে ঈশ্বর সমস্তকিছু শাসন করেন এবং সমস্তকিছু তাঁর হাতেই নিয়ন্ত্রিত হয়। মানুষ যত জ্ঞানই আয়ত্ত করুক, যত তত্ত্ব ও রহস্য উপলব্ধি করুক, ঈশ্বরের দৃষ্টিতে এগুলোর কোনোটাই মানবজাতির প্রতি তাঁর বিধান ও তাঁর নেতৃত্বকে প্রতিস্থাপিত করতে পারবে না; মানবজাতি সর্বদা ঈশ্বরের পথনির্দেশ ও তাঁর ব্যক্তিগত কাজের সাথে অবিচ্ছেদ্য থাকবে। মানুষ ও ঈশ্বরের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক এমনই। ঈশ্বর তোমাকে কোনো আদেশ প্রদান করুন, অথবা কোনো একটা নিয়ম, বা তাঁর ইচ্ছাকে তোমার উপলব্ধি করতে পারার জন্য সত্যের যোগান দিন, যাই করুন না কেন, সমস্ত কিছু নির্বিশেষে তাঁর লক্ষ্য হল মানুষকে এক সৌন্দর্যপূর্ণ আগামীর দিকে নিয়ে যাওয়া। ঈশ্বরের উচ্চারিত বাক্য এবং যে কাজ তিনি করেন, সেগুলো উভয়ত তাঁর নির্যাসের একটা দিকের উদ্ঘাটন, এবং তাঁর স্বভাব ও প্রজ্ঞার একটা দিকের উদ্ঘাটন; এগুলো তাঁর পরিচালনামূলক পরিকল্পনার একটা অপরিহার্য ধাপ। এটা একেবারেই এড়িয়ে যাওয়া উচিত নয়! ঈশ্বর যা করেন তার মধ্যেই তাঁর ইচ্ছা নিহিত থাকে; ঈশ্বর অনুচিত মন্তব্যকে ভয় পান না, বা তাঁর সম্বন্ধে মানুষের যেকোনো ধারণা বা চিন্তাভাবনায় ভীত নন। তিনি শুধুমাত্র নিজের কাজ করেন এবং কোনো মানুষ, বিষয় ও বস্তুর দ্বারা সীমাবদ্ধ না হয়ে তাঁর পরিচালনামূলক পরিকল্পনা অনুযায়ী তাঁর ব্যবস্থাপনা চালিয়ে যেতে থাকেন।
বেশ। আজকে এই পর্যন্তই থাক, পরের বার আবার দেখা হবে!
নভেম্বর ৯, ২০১৩