ঈশ্বরের কর্ম, ঈশ্বরের স্বভাব, এবং স্বয়ং ঈশ্বর ১

আজ আমরা এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করছি। এটা এমন একটা বিষয় যা ঈশ্বরের কর্মের সূচনাকাল থেকে আলোচিত হচ্ছে, এবং যা প্রতিটি মানুষের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রকারান্তরে বললে, এ হল এমন এক প্রসঙ্গ, ঈশ্বরবিশ্বাসের পথে যার সম্মুখীন প্রতিটি মানুষকেই হতে হয়; এ হল এমন এক বিষয়, যার সম্মুখীন হতেই হবে। এ হল এক অতি গুরুত্বপূর্ণ, অনিবার্য বিষয় যা থেকে মানবজাতি মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে না। গুরুত্বের প্রসঙ্গে বললে, প্রত্যেক ঈশ্বরবিশ্বাসীর কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কোনটি? কোনো কোনো মানুষ ভাবে যে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল ঈশ্বরের ইচ্ছাকে উপলব্ধি করা; কেউ আবার বিশ্বাস করে যে, আরো বেশি করে ঈশ্বরের বাক্য ভোজন ও পান করাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ; কেউ কেউ অনুভব করে যে, নিজেদের জানা-ই হল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়; অন্যদের অভিমত হল যে, ঈশ্বরের মাধ্যমে কীভাবে পরিত্রাণের সন্ধান পাওয়া যায়, কীভাবে ঈশ্বরকে অনুসরণ করা যায়, এবং কীভাবে ঈশ্বরের ইচ্ছা পূর্ণ করা যায়, তা জানা-ই হল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আজ আমরা এই বিষয়গুলিকে সরিয়ে রাখব। তাহলে আজ কী নিয়ে আমরা আলোচনা করছি? আলোচনার বিষয় ঈশ্বর। এ-ই কি প্রত্যেক ব্যক্তির কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়? এই বিষয়টি কোন অর্থ বহন করে? অবশ্যই, একে নিশ্চিতভাবেই ঈশ্বরের স্বভাব, ঈশ্বরের সারসত্য ও ঈশ্বরের কর্ম থেকে পৃথক করা যায় না। তাই আজ “ঈশ্বরের কর্ম, ঈশ্বরের স্বভাব, এবং স্বয়ং ঈশ্বর” এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা যাক।

মানুষ যবে থেকে ঈশ্বরে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, তবে থেকেই সে ঈশ্বরের কর্ম, ঈশ্বরের স্বভাব, এবং স্বয়ং ঈশ্বর, এহেন বিষয়াদির সম্মুখীন হয়েছে। ঈশ্বরের কর্মের প্রসঙ্গ যখন আসে, তখন কিছু মানুষ বলবে: “আমাদের উপর ঈশ্বরের কর্ম সাধিত হয়েছে; আমরা তা প্রতিদিন অনুভব করতে পারি, তাই আমরা এর সঙ্গে অপরিচিত নই”। ঈশ্বরের স্বভাবের প্রসঙ্গে বলতে গেলে, অনেকেই বলবে: “ঈশ্বরের স্বভাব হল এমন এক বিষয় যার উপর আমরা আজীবন অধ্যয়ন, অনুসন্ধান ও মনোনিবেশ করি, যাতে আমরা এর সঙ্গে পরিচিত হতে পারি।” এবং স্বয়ং ঈশ্বরের প্রসঙ্গে অনেকেই বলবে: “স্বয়ং ঈশ্বর হলেন তিনি যাঁকে আমরা অনুসরণ করি, যাঁর মধ্যে আমরা বিশ্বাস রাখি এবং যাঁকে আমরা অন্বেষণ করি, তাঁর বিষয়েও আমরা অজ্ঞ নই”। সৃষ্টিলগ্ন থেকে ঈশ্বর কখনোই তাঁর কাজ থেকে বিরত হননি; তাঁর সমস্ত কর্ম জুড়ে তিনি তাঁর স্বভাবকে ব্যক্ত করেছেন, এবং বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে তিনি তাঁর বাক্য প্রকাশ করেছেন। একইসঙ্গে, মানবজাতির কাছে নিজেকে এবং নিজের সারসত্যকে প্রকাশ করা, মানুষের প্রতি নিজের ইচ্ছা এবং মানুষের কাছ থেকে তিনি কী চান, তা প্রকাশ করার কাজে তিনি কখনো বিরত থাকেননি। অতএব, আক্ষরিক অর্থে, কেউই এই বিষয়গুলির সঙ্গে অপরিচিত নয়। তবে আজ যারা ঈশ্বরকে অনুসরণ করে তাদের কাছে প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বরের কর্ম, ঈশ্বরের স্বভাব, এবং স্বয়ং ঈশ্বর এই বিষয়গুলি খুবই অপরিচিত। এর কারণ কী? মানুষ যখন ঈশ্বরের কর্মের অভিজ্ঞতা অর্জন করে, তখন তারা ঈশ্বরের সান্নিধ্যেও আসে, তাদের এই অনুভূতি হয় যেন তারা ঈশ্বরের স্বভাবকে উপলব্ধি করেছে, অথবা, এই স্বভাব কেমন, সে সম্বন্ধে কিছুটা জ্ঞান অর্জন করেছে। সেইমতো, মানুষ মনে করে না যে সে ঈশ্বরের কর্ম বা ঈশ্বরের স্বভাব সম্পর্কে অপরিচিত। বরং মানুষ মনে করে যে সে ঈশ্বরের সঙ্গে খুবই পরিচিত এবং ঈশ্বরের বিষয়ে অনেককিছু উপলব্ধি করে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিটা হল, এই ঈশ্বর উপলব্ধি, অন্য অনেক বিষয়ের মতো, তারা পুস্তকে কী পাঠ করেছে তার মধ্যে সীমাবদ্ধ, তাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মধ্যে সীমিত, তাদের কল্পনায় নিয়ন্ত্রিত, এবং সর্বোপরি তারা নিজের চোখে যা দেখতে পায় সেই বিষয়গুলির মধ্যে আবদ্ধ—সেগুলির সবই স্বয়ং প্রকৃত ঈশ্বরের চেয়ে অনেক দূরে। এই “দূরে” মানে ঠিক কতটা দূরে? মানুষ হয়তো নিজের ব্যাপারে নিশ্চিত নয়, বা মানুষের সামান্য চেতনা রয়েছে, একটা আভাসমাত্র—কিন্তু যখন স্বয়ং ঈশ্বরের কথা আসে, যখন তাঁর সম্বন্ধে মানুষের উপলব্ধি স্বয়ং প্রকৃত ঈশ্বরের সারসত্যের চেয়ে বহু যোজন দূরে। তাই “ঈশ্বরের কর্ম, ঈশ্বরের স্বভাব, এবং স্বয়ং ঈশ্বর”-এর মতো বিষয়ের ক্ষেত্রে আমাদের একটা পদ্ধতিগত এবং বাস্তবসম্মত ভাবে আলোচনায় যুক্ত হওয়াটা বাধ্যতামূলক।

বস্তুত, ঈশ্বরের স্বভাব প্রত্যেকের কাছেই উন্মুক্ত, এবং তা প্রচ্ছন্ন নয়, কারণ ঈশ্বর সচেতনভাবে কোনো ব্যক্তিকে এড়িয়ে যাননি, এবং এবং তিনি কখনোই সচেতনভাবে নিজেকে আড়াল করেননি যাতে মানুষ তাকে জানতে না পারে, বা উপলব্ধি করতে না পারে। ঈশ্বরের স্বভাব সর্বদাই হল উন্মুক্ত থাকা এবং অকপটভাবে প্রত্যেক ব্যক্তির মুখোমুখি হওয়া। ঈশ্বরের ব্যবস্থাপনায়, ঈশ্বর তাঁর কর্ম করেন, প্রত্যেকের মুখোমুখি হন, এবং প্রত্যেক ব্যক্তির উপর তাঁর কর্ম সাধিত হয়। প্রত্যেকের মানুষকে পথনির্দেশ দেওয়ার এবং তাদের রসদ যোগানোর জন্য, তিনি নিরন্তর নিজের স্বভাবের প্রকাশ এবং তাঁর সারসত্য, তাঁর যা আছে এবং তিনি যা, তার প্রয়োগ ঘটান। প্রতি যুগে এবং প্রতি পর্যায়ে, পরিস্থিতি ভালো না মন্দ তা নির্বিশেষে, ঈশ্বরের স্বভাব সর্বদাই প্রত্যেক ব্যক্তির প্রতি উন্মুক্ত, এবং তাঁর সম্পদ ও সত্তা সর্বদাই প্রতিটি ব্যক্তিমানুষের কাছে প্রকাশিত, ঠিক যেমন তাঁর জীবন নিরন্তর এবং অবিরামভাবে মানবজাতিকে রসদ সরবরাহ ও তাদের সমর্থন করে যাচ্ছে। এই সবকিছু সত্ত্বেও, কিছু কিছু মানুষের কাছে ঈশ্বরের স্বভাব প্রচ্ছন্ন রয়ে যায়। কেন? যদিও এই সমস্ত মানুষ ঈশ্বরের কর্মের মধ্যে বাস করে ও ঈশ্বরকে অনুসরণ করে, তবুও কখনোই তারা ঈশ্বরকে উপলব্ধির চেষ্টা করেনি বা ঈশ্বরকে জানতেও চায়নি, ঈশ্বরের নিকটে আসা তো দূরস্থান। এই সকল মানুষের কাছে, ঈশ্বরের স্বভাব উপলব্ধি করার অর্থ হল যে, তাদের পরিণতি খুব নিকটেই; অর্থাৎ খুব শীঘ্রই ঈশ্বরের স্বভাব দ্বারা তাদের বিচার ও শাস্তি ঘটতে চলেছে। সেহেতু, তারা কখনোই ঈশ্বর বা তাঁর স্বভাবকে জানার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেনি, বা ঈশ্বরের ইচ্ছার গভীরতর উপলব্ধি বা জ্ঞানার্জনেও ব্যাকুল হয়নি। তারা সচেতন সহযোগিতার মাধ্যমে ঈশ্বরের ইচ্ছাকে বোঝার চেষ্টা করে না—তারা শুধু চিরকাল উপভোগ করে এবং তারা যা চায় সেইসব কাজ করেও কখনো পরিশ্রান্ত হয় না; যে ঈশ্বরে তারা বিশ্বাস করতে চায় সেই ঈশ্বরেই তারা বিশ্বাস করে; তারা বিশ্বাস করে সেই ঈশ্বরেই, যাঁর অস্তিত্ব কেবল তাদের কল্পনায়, সেই ঈশ্বর যিনি শুধুমাত্র তাদের পূর্বধারণায় বিরাজ করেন; এবং সেই ঈশ্বর যিনি তাদের দৈনন্দিন জীবন থেকে অবিচ্ছেদ্য। স্বয়ং প্রকৃত ঈশ্বরের কথা যখন আসে, তখন তারা সম্পূর্ণভাবে তাঁকে খারিজ করে দেয়, এবং তাঁকে উপলব্ধি করা বা তাঁর উপর মনোনিবেশ করার কোনো বাসনা তাদের থাকে না, তাঁর নিকটে যাওয়ার ইচ্ছা তো দূরস্থান। তারা শুধু নিজেদের সজ্জিত করার করা, নিজেদের একটা মোড়কে পরিবেশন করার জন্য ঈশ্বরের বাক্যগুলিকে ব্যবহার করছে। তারা মনে করে যে, তা ইতিমধ্যেই তাদের সফল বিশ্বাসী এবং সেইসব মানুষ হিসাবে গড়ে তুলেছে, যাদের অন্তঃকরণে ঈশ্বরবিশ্বাস রয়েছে। নিজেদের হৃদয়ে তারা তাদের কল্পনা, তাদের পূর্বধারণা, এবং এমনকি, ঈশ্বর সম্বন্ধে তাদের ব্যক্তিগত সংজ্ঞার দ্বারা পরিচালিত। অন্যদিকে, তাদের সঙ্গে স্বয়ং প্রকৃত ঈশ্বরের কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ, তারা যদি স্বয়ং প্রকৃত ঈশ্বরকে উপলব্ধি, ঈশ্বরের প্রকৃত স্বভাবের উপলব্ধি, এবং ঈশ্বরের যা আছে এবং তিনি যা, তার উপলদ্ধি করতে যায়, তবে তার অর্থ হল তাদের কর্ম, তাদের বিশ্বাস, এবং তাদের অন্বেষণ নিন্দিত হবে। এই কারণেই তারা ঈশ্বরের সারসত্য উপলব্ধি করাকে ঘৃণা করে, এবং ঈশ্বরকে আরো ভালোভাবে উপলব্ধি করতে, ঈশ্বরের ইচ্ছাকে আরো ভালোভাবে জানতে, এবং ঈশ্বরের স্বভাবকে আরো ভালোভাবে উপলব্ধি করতে সক্রিয়ভাবে অন্বেষণ ও প্রার্থনা করার জন্য অরাজি ও অনিচ্ছুক থাকে। তারা চায় ঈশ্বর হবে এমন কিছু যা মিথ্যা বানানো, এমন কিছু যা ফাঁপা এবং অস্পষ্ট। তারা চায় যে ঈশ্বর হোক ঠিক তেমনটাই, যেমন তারা কল্পনা করেছে, এমন কেউ যিনি আহ্বানমাত্র সাড়া দেবেন, অফুরান যোগান দেবেন, এবং সবসময় লভ্য থাকবেন। তারা যখন ঈশ্বরের অনুগ্রহ উপভোগ করতে চাইবে, তখন তারা ঈশ্বরকে সেই অনুগ্রহ হয়ে ওঠার কথা বলবে। যখন তাদের ঈশ্বরের আশীর্বাদের প্রয়োজন হবে, তখন তারা ঈশ্বরকে সেই আশীর্বাদ হয়ে ওঠার জন্য বলবে। যখন তারা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হবে তখন তারা তাদের সাহসী করে করে তোলার জন্য, ও তাদের ঢাল হয়ে ওঠার জন্য, ঈশ্বরের কাছে অনুরোধ জানাবে। ঈশ্বর সম্বন্ধে এইসব মানুষের জ্ঞান অনুগ্রহ ও আশীর্বাদের বৃত্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ঈশ্বরের কর্ম, ঈশ্বরের স্বভাব, এবং স্বয়ং ঈশ্বর সম্বন্ধে এইসব মানুষের উপলব্ধিও শুধুমাত্র তাদের কল্পনা এবং আক্ষরিক অর্থ ও মতবাদের মধ্যেই সীমিত। কিন্তু কিছু কিছু মানুষ আছে, যারা ঈশ্বরের স্বভাব উপলব্ধি করতে ব্যাকুল, প্রকৃত অর্থেই স্বয়ং ঈশ্বরকে চাক্ষুষ করতে চায়, ঈশ্বরের স্বভাব এবং তাঁর যা আছে এবং তিনি যা, তা প্রকৃতপক্ষেই উপলব্ধি করে। এই ব্যক্তিরা সত্যের বাস্তব ও ঈশ্বরের পরিত্রাণের অন্বেষণে রত, এবং বিজয় ও পরিত্রাণ লাভ করতে, এবং ঈশ্বরের দ্বারা নিখুঁত হতে চায়। ঈশ্বরের বাক্য পাঠের জন্য তারা তাদের হৃদয়কে কাজে লাগায়, ঈশ্বরের তাদের জন্য আয়োজিত প্রতিটি পরিস্থিতি, প্রত্যেক মানুষ, ঘটনাবলী ও বস্তুসমূহের উপলব্ধিতে নিজের হৃদয়কে ব্যবহার করে, এবং নিষ্ঠার সঙ্গে প্রার্থনা ও অন্বেষণ করে। যা তারা সবচেয়ে বেশি জানতে চায় তা হল ঈশ্বরের ইচ্ছা, যা তারা সর্বাধিক উপলব্ধি করতে চায় তা হল ঈশ্বরের প্রকৃত স্বভাব ও সারসত্য, যাতে তারা আর কখনো ঈশ্বরকে অসন্তুষ্ট না করে, এবং, নিজেদের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে, ঈশ্বরের মাধুর্য ও তাঁর প্রকৃত দিকটিকে আরো বেশি করে দেখতে পারে। এটা এই উদ্দেশ্যেও যে, যাতে এক প্রকৃত বাস্তব ঈশ্বর তাদের হৃদয়ের মাঝখানে বিরাজ করেন, এবং যাতে তাদের হৃদয়ে ঈশ্বরের একটা স্থান থাকে, যেমনটা হলে, তারা আর কল্পনা, পূর্বধারণা বা অস্পষ্টতার মধ্যে বাস করবে না। ঈশ্বরের স্বভাব ও তাঁর সারসত্য উপলব্ধি করার এক প্রবল আকাঙ্ক্ষা এই সকল মানুষের মধ্যে থাকে, কারণ, মানুষের অভিজ্ঞতার যাত্রাপথ, প্রতি মুহূর্তে, ঈশ্বরের স্বভাব ও তাঁর সারসত্যকে মানবজাতির প্রয়োজন; তাঁর স্বভাব ও সারসত্যই একজন মানুষকে আজীবৎকাল জীবনের যোগান দেয়। একবার ঈশ্বরের স্বভাব উপলব্ধি করার পর তারা ঈশ্বরকে আরো উপযুক্তভাবে সম্মান করতে, ঈশ্বরের কর্মের সঙ্গে আরো ভালোভাবে সহযোগিতা করতে, সক্ষম হবে, এবং ঈশ্বরের ইচ্ছার প্রতি আরো বেশি বিবেচনাশীল হবে, এবং যথাসর্বস্ব দিয়ে তাদের কর্তব্য পালন করবে। দুই ধরনের মানুষ ঈশ্বরের স্বভাব সম্পর্কে এহেন মনোভাব পোষণ করে। প্রথম শ্রেণির মানুষেরা ঈশ্বরের স্বভাবকে উপলব্ধি করতে চায় না। এমনকি, যদিও তারা বলে যে তারা চায় ঈশ্বরের স্বভাবকে উপলব্ধি করতে, স্বয়ং ঈশ্বরকে জানতে, ঈশ্বরের যা আছে এবং তিনি যা, তা চাক্ষুষ করতে, এবং প্রকৃত অর্থেই ঈশ্বরের ইচ্ছাকে বুঝতে, তবু, মনের গভীরে, তাদের আকাঙ্ক্ষা হল এই, যে, ঈশ্বরের অস্তিত্ব যেন না থাকে। তার কারণ, এই ধরনের মানুষেরা ধারাবাহিকভাবে ঈশ্বরকে অমান্য ও প্রতিরোধ করে; তারা নিজেদের হৃদয়ে স্থান নেওয়ার ক্ষেত্রে ঈশ্বরের সঙ্গে লড়াই করে, এবং প্রায়শই ঈশ্বরের অস্তিত্বে সন্দেহ প্রকাশ করে, বা এমনকি তা অস্বীকারও করে। তারা ঈশ্বরের স্বভাবকে বা স্বয়ং প্রকৃত ঈশ্বরকে তাদের হৃদয়ে স্থান গ্রহণ করতে দিতে চায় না। তারা শুধু নিজের বাসনা, কল্পনা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে পূরণ করতে চায়। তাই এই ধরনের মানুষেরা ঈশ্বরে বিশ্বাস করতে পারে, ঈশ্বরকে অনুসরণ করতে পারে, এবং তাঁর জন্য নিজেদের পরিবার ও চাকুরিকেও ত্যাগ করতে পারে, কিন্তু তারা তাদের দুষ্ট পন্থাগুলি থেকে বিরত হয় না। কেউ কেউ এমনকি চুরি করে, বা নৈবেদ্যর অপব্যয় করে, অথবা গোপনে ঈশ্বরকে অভিসম্পাত করে, অন্যদিকে অন্যরা নিজেদের অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের বিষয়ে বারংবার সাক্ষ্য দিতে পারে, নিজেদের বড় করে দেখাতে পারে, এবং মানুষ ও পদমর্যাদা জয়ের জন্য ঈশ্বরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারে। মানুষকে দিয়ে তাদের উপাসনা করানোর জন্য তারা বিভিন্ন পদ্ধতি ও কৌশল ব্যবহার করে, মানুষকে জয় করে নিয়ে তাদের নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে নিরন্তর প্রয়াস করে। কেউ কেউ আবার ইচ্ছাকৃত ভাবে মানুষকে ভুল পথে পরিচালনা করে যাতে মানুষ তাকে ঈশ্বর বলে মনে করে, তার সঙ্গে ঈশ্বরজ্ঞানে আচরণ করে। একথা তারা কখনোই কাউকে বলবে না যে, তারা ভ্রষ্ট হয়েছে, যে, তারা অত্যন্ত দুর্নীতিগ্রস্ত ও উদ্ধত, যে, তাদের উপাসনা করা নিষ্প্রয়োজন, কারণ তারা যতই ভালো করুক না কেন, সকলই ঈশ্বরের মহিমার কারণে, এবং তারা তা-ই করছে যা তাদের করণীয়। তারা কেন এসব বিষয় বলে না? কারণ তারা মানুষের হৃদয় থেকে নিজেদের স্থান হারানোর ভয়ে গভীরভাবে ভীত। সেই কারণেই, এই ধরনের লোকেরা কখনোই ঈশ্বরের বন্দনা করে না, এবং কখনোই ঈশ্বরের প্রতি সাক্ষ্য দেয় না, কারণ তারা কখনোই ঈশ্বরকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করেনি। ঈশ্বরকে উপলব্ধি না করে তারা কি ঈশ্বরকে জানতে পারে? অসম্ভব! এইভাবেই “ঈশ্বরের কর্ম, ঈশ্বরের স্বভাব, এবং স্বয়ং ঈশ্বর”—এই প্রসঙ্গের বাক্যগুলি শুনতে সহজ মনে হলেও, তা প্রত্যেক ব্যক্তির কাছে ভিন্ন-ভিন্ন অর্থ বহন করে। যারা প্রায়শই ঈশ্বরকে অমান্য ও প্রতিরোধ করে এবং ঈশ্বরের প্রতি বিরূপমনোভাবাপন্ন, তাদের কাছে এই বাক্যগুলির নিন্দাসূচক; অন্যদিকে যে সত্যের বাস্তবতাকে অনুসরণ করে, এবং ঈশ্বরের ইচ্ছা অন্বেষণের জন্য প্রায়শই ঈশ্বরের সম্মুখে আসে, তার কাছে এই বাক্যগুলি মাছের কাছে জলের মতো। তোমাদের মধ্যে অনেকেই রয়েছে, যারা যখন ঈশ্বরের স্বভাব ও ঈশ্বরের কর্মের কথা শোনে, তখন তাদের মাথাব্যথা শুরু হয়ে যায়, তাদের হৃদয় প্রতিরোধে পরিপূর্ণ হয়ে পড়ে, এবং তারা অত্যন্ত অস্বচ্ছন্দ হয়ে পড়ে। তোমাদের মধ্যে এমনও অনেকে রয়েছে যারা মনে করে: ঠিক এই বিষয়টিই তার প্রয়োজন, কারণ এই বিষয়টি তার পক্ষে অত্যন্ত উপকারী। এ হল এমন এক বিষয় যা তার জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বাদ রয়ে গেলে চলবে না; এ-ই হল সারাৎসার, ঈশ্বরে বিশ্বাসের ভিত্তি, এবং এমন এক বিষয় যা মানবজাতি পরিত্যাগ করতে পারে না। তোমাদের সকলের কাছে এই বিষয়টি একই সঙ্গে দূরের ও নিকটের, অপরিচিত অথচ পরিচিত বলে মনে হতে পারে। তবে, যা-ই হোক না কেন, এ হল এমন এক বিষয় তা প্রত্যেককে শুনতে হবে, জানতে হবে, এবং উপলব্ধি করতে হবে। তুমি যেভাবেই এই নিয়ে আলোচনা করো না কেন, যেভাবেই তুমি বিষয়টাকে দেখো না কেন, বা যেভাবেই তুমি একে উপলব্ধি করো না কেন, এই বিষয়টির গুরুত্বকে উপেক্ষা করা যায় না।

মানবজাতিকে সৃষ্টি করার সময় থেকেই ঈশ্বর তাঁর কর্ম করছেন। প্রারম্ভকালে, এই কাজ খুবই সরল ছিল, কিন্তু সেই সারল্য সত্ত্বেও তা ঈশ্বরের সারসত্য ও স্বভাবের অভিব্যক্তিকে ধারণ করত। আজ যদিও ঈশ্বরের কর্ম উচ্চস্তরে উন্নীত হয়েছে, এবং তাঁকে যারা অনুসরণ করে তাদের প্রত্যেকের উপর এই কর্ম তাঁর বাক্যের মহান অভিব্যক্তির মাধ্যমে বিস্ময়কর ও মূর্ত হয়েছে, তবু ঈশ্বরের ছবি চিরকাল মানবজাতির কাছে প্রচ্ছন্নই থেকেছে। যদিও তিনি দুইবার অবতারূপ ধারণ করেছেন, তবু বাইবেল-বর্ণিত সময়কাল থেকে অদ্যাবধি, কে আজ পর্যন্ত ঈশ্বরের প্রকৃত ছবি দেখেছে? তোমাদের উপলব্ধির উপর ভিত্তি করে কেউ কি ঈশ্বরের প্রকৃত ছবি দেখেছে? না। ঈশ্বরের প্রকৃত ছবি কেউ কখনো দেখেনি, অর্থাৎ, কেউই কখনো ঈশ্বরের প্রকৃত সত্তা চাক্ষুষ করেনি। এ হল এমন এক বিষয়, যা নিয়ে সকলেই সহমত। অর্থাৎ, বলা যায় যে, ঈশ্বরের প্রকৃত ছবি, বা ঈশ্বরের আত্মা, সকল মানুষের কাছে গোপন রয়েছে, যেমন ছিল তাঁর সৃষ্ট আদম ও হবার কাছেও, এবং এবং যেমন ছিল তাঁর দ্বারা গৃহীত হওয়া ধার্মিক ইয়োবের কাছেও। এদের মধ্যে কেউই ঈশ্বরের প্রকৃত ছবি দেখেনি। কিন্তু ঈশ্বর কেন জ্ঞাতসারে নিজের প্রকৃত ছবিকে আড়াল করে রাখেন? কেউ কেউ বলে: “ঈশ্বর মানুষকে আতঙ্কিত করতে ভীত”। অন্যরা বলে: “ঈশ্বর তাঁর প্রকৃত ছবিকে আড়াল করে রাখেন কারণ মানুষ অত্যন্ত ক্ষুদ্র এবং ঈশ্বর অত্যন্ত বিরাট; মানুষের তাঁকে দেখতে পাওয়া উচিত নয়, নচেৎ তাদের মৃত্যু ঘটবে।” আরো অনেকে রয়েছে যারা বলে: “ঈশ্বর তাঁর দৈনন্দিন কাজের পরিচালনা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, এবং অন্যরা যাতে তাঁকে দেখতে পারে সেজন্য তাঁর কাছে আবির্ভূত হওয়ার মতো সময় নাও থাকতে পারে”। তোমরা যাই বিশ্বাস করো না কেন, এখানে আমার একটা উপসংহার রয়েছে। কী সেই উপসংহার? ঈশ্বর আদৌ চান না যে মানুষ তাঁর প্রকৃত ছবি দেখুক। ঈশ্বর ইচ্ছাকৃত ভাবেই মানবজাতির কাছে প্রচ্ছন্ন থাকেন। অর্থাৎ, ঈশ্বরের অভিপ্রায় হল মানুষ তাঁর প্রকৃত ছবি না দেখুক। সবার কাছে এতক্ষণে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাওয়া উচিত। ঈশ্বর যদি কখনোই কোনো মানুষের কাছে নিজের ছবি প্রকাশ না করে থাকেন, তাহলে তোমরা কি মনে করো যে ঈশ্বরের ছবির অস্তিত্ব রয়েছে? (তিনি বিরাজমান।) অবশ্যই তাঁর অস্তিত্ব রয়েছে। ঈশ্বরের ছবির অস্তিত্ব সকল সন্দেহের ঊর্ধ্বে। কিন্তু ঈশ্বরের ছবি কত মহান, বা তিনি কেমন দেখতে, এই প্রশ্নগুলি নিয়ে কি মানবজাতির অনুসন্ধান চালানো উচিত? না। উত্তরটা হল নেতিবাচক। যদি ঈশ্বরের ছবিরবিষয়টি নিয়ে আমাদের অনুসন্ধান চালানো উচিত না হয়, তাহলে কী নিয়ে অনুসন্ধান চালানো সমীচিন হবে? (ঈশ্বরের স্বভাব।) (ঈশ্বরের কর্ম।) আজকের আনুষ্ঠানিক বিষয়ের উপর আলোচনা শুরুর আগে একটু আগে যে বিষয়টা নিয়ে আমরা আলোচনা করছিলাম সেখানে ফিরে যাওয়া যাক: ঈশ্বর কেন কখনোই মানবজাতির কাছে তাঁর প্রকৃত ছবি প্রকাশ করেননি? ঈশ্বর কেন ইচ্ছাকৃতভাবে মানবজাতির কাছে তাঁর ছবি প্রচ্ছন্ন রাখেন? এর একটাই কারণ, এবং তা হল: যে মানুষকে ঈশ্বর সৃষ্টি করেছেন, সে যদিও তাঁর সহস্রাধিক বছরের কার্যের অভিজ্ঞতা লাভ করেছে, কিন্ত একজন মানুষও ঈশ্বরের কর্ম, ঈশ্বরের স্বভাব এবং ঈশ্বরের সারসত্য জানে না। ঈশ্বরের চোখে এই সমস্ত মানুষ তাঁর বিরোধী, এবং যেসমস্ত মানুষ তাঁর প্রতি বৈরীভাবাপন্ন, তাদের কাছে ঈশ্বর নিজেকে প্রদর্শন করবেন না। একমাত্র এই কারণেই, ঈশ্বর কখনোই তাঁর ছবি মানবজাতির কাছে প্রকাশ করেননি, এবং এই কারণেই তিনি ইচ্ছাকৃত ভাবে তাঁর ছবি মানবজাতির কাছ থেকে আড়াল করে রাখেন। ঈশ্বরের স্বভাবকে জানার গুরুত্ব কি এবার তোমাদের কাছে পরিষ্কার?

ঈশ্বরের ব্যবস্থাপনার অস্তিত্বের সময়কাল থেকেই, কার্যসাধনের জন্য তিনি সর্বদা নিজেকে সম্পূর্ণ ভাবে নিয়োজিত করেছেন। মানুষের কাছ থেকে নিজের ছবি আবৃত করে রাখা সত্ত্বেও, তিনি সর্বদাই মানুষের পাশে থেকেছেন, মানুষের উপর কর্ম করছেন, নিজের স্বভাবকে ব্যক্ত করেছেন, নিজের সারসত্য দিয়ে সমস্ত মানবজাতিকে পথপ্রদর্শন করেছেন, এবং তাঁর ক্ষমতা, তাঁর প্রজ্ঞা ও তাঁর কর্তৃত্বের মাধ্যমে প্রতিটি মানুষের উপর তাঁর কর্ম করছেন, এবং এভাবেই বিধানের যুগ, অনুগ্রহের যুগ ও বর্তমানের রাজ্যের যুগকে রূপায়িত করেছেন। ঈশ্বর তাঁর ছবি মানুষের কাছে গোপন রাখলেও, তাঁর স্বভাব, তাঁর সত্তা ও সম্পদসমূহ, এবং মানবজাতির প্রতি তাঁর ইচ্ছা অকপটভাবে মানুষের কাছে প্রকাশিত হয়েছে, যাতে মানুষ তা চাক্ষুষ ও অনুভব করতে পারে। অর্থাৎ, যদিও মানুষ ঈশ্বরকে দেখতে পায় না বা তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না, মানবজাতি ঈশ্বরের যে স্বভাব ও সারসত্যের সম্মুখীন হয় তা সম্পূর্ণভাবেই স্বয়ং ঈশ্বরের অভিব্যক্তি। এটাই কি সত্য নয়? নিজের কর্মের জন্য ঈশ্বর যে পন্থা বা দৃষ্টিকোনই নির্বাচন করুন না কেন, তিনি সর্বদাই তাঁর প্রকৃত পরিচিতির মাধ্যমেই মানুষের সঙ্গে আচরণ করেন, তাঁর অবশ্যকর্তব্যগুলি পালন করেন, এবং যে বাক্যগুলি বলতে তিনি বাধ্য, সেইগুলি বলেন। যে অবস্থান থেকেই তিনি বক্তব্য রাখুন না কেন—তিনি তৃতীয় স্বর্গে দণ্ডায়মান হোন বা দেহরূপে, বা এমনকি স্বাভাবিক ব্যক্তি হিসাবেও—তিনি সর্বদাই কোনো ছলনা ও গোপনীয়তা না রেখে সম্পূর্ণ হৃদয় ও অন্তর দিয়ে মানুষের প্রতি সম্ভাষণ করেন। কার্যসাধনকালে, ঈশ্বর তাঁর বাক্য ও স্বভাব অভিব্যক্ত করেন, এবং নির্দ্বিধায় তাঁর যা আছে এবং তিনি যা, তা প্রকাশ করেন। তাঁর জীবন ও তাঁর সত্তা এবং তাঁর সম্পদসমূহ দিয়ে তিনি মানবজাতিকে পথপ্রদর্শন করেন। এইভাবেই “দর্শনাতীত ও স্পর্শাতীত” ঈশ্বরের তত্ত্বাবধানে মানুষ জীবনযাপন করেছিল বিধানের যুগময়—যা ছিল মানবজাতির শৈশবকালীন যুগ।

বিধানের যুগের পর ঈশ্বর প্রথম দেহধারণ করলেন—সেই অবতাররূপের মেয়াদ ছিল সাড়ে চৌত্রিশ বছর। মানুষের কাছে সাড়ে চৌত্রিশ বছর কি দীর্ঘ সময়? (তা দীর্ঘ নয়।) যেহেতু মানুষের আয়ুষ্কাল ত্রিশ বছরের কোঠার চেয়ে বহু দীর্ঘ, সেহেতু তা মানুষের কাছে খুব একটা দীর্ঘ সময় নয়। কিন্তু ঈশ্বরের অবতাররূপের পক্ষে এই সাড়ে চৌত্রিশ বছর বস্তুতই দীর্ঘ ছিল। তিনি এক ব্যক্তি হয়েছিলেন—একজন সাধারণ মানুষ যে ঈশ্বরের কর্ম ও ঈশ্বরের অর্পিত দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। এর অর্থ হল যে, তাঁকে সেই কর্ম গ্রহণ করতে হয়েছিল, যা কোনো সাধারণ মানুষ সাধন করতে পারে না, এবং সাথেসাথে, তাঁকে সেই যন্ত্রণাও সহ্য করতে হয়েছিল, যা সাধারণ মানুষের পক্ষে অসহনীয়। অনুগ্রহের যুগে, তাঁর কর্মের সূচনা থেকে ক্রুশবিদ্ধকরণের সময় পর্যন্ত, প্রভু যীশু যে পরিমাণ যন্ত্রণা সহ্য করেছেন, তা এমন কোনো বিষয় নয় যা বর্তমানের মানুষ ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যক্ষ করতে পারত, কিন্তু বাইবেলের আখ্যানের মাধ্যমে, তোমরা কি সেই বিষয়ে অন্ততপক্ষে একটা ধারণা পাও না? নথিভুক্ত তথ্যগুলিতে যত বিশদ বর্ণনাই থাকুক না কেন, সেই সময়কালে ঈশ্বরের কর্ম ক্লেশ ও যন্ত্রণায় পরিপূর্ণ ছিল। ভ্রষ্ট মানুষের কাছে সাড়ে চৌত্রিশ বছর দীর্ঘ সময় নয়; ক্ষুদ্র যন্ত্রণাভোগ হল সামান্য একটা ব্যাপার। কিন্তু সেই পবিত্র, নিষ্কলঙ্ক ঈশ্বর, যাঁকে সমগ্র মানবজাতির পাপ বহন করতে হয়েছিল, এবং পাপীদের সঙ্গে ভোজন করতে, নিদ্রা যেতে, ও বসবাস করতে হয়েছিল, তাঁর কাছে এই যন্ত্রণা ছিল অবিশ্বাস্য রকমের প্রবল। তিনি সৃষ্টিকর্তা, সমস্ত বস্তুর ক্ষেত্রে সার্বভৌম, এবং সকলকিছুর শাসক, তবুও তিনি যখন পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছিলেন, তখন তাঁকে ভ্রষ্ট মনুষ্যগণের নির্যাতন ও নিষ্ঠুরতা সহ্য করতে হয়েছিল। তাঁর কাজকে সম্পূর্ণ করতে এবং দুঃখসাগর থেকে মানবতাকে উদ্ধার করতে, তাঁকে মানুষের দ্বারা নিন্দিত হতে, এবং সমগ্র মানবজাতির পাপ বহন করতে হয়েছিল। যে পরিমাণ যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে তিনি গিয়েছিলেন, তা সাধারণ মানুষের পক্ষে তল পাওয়া ও উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। এই যন্ত্রণাভোগ কীসের প্রতিনিধিত্ব করে? তা মানবজাতির প্রতি ঈশ্বরের একনিষ্ঠতার প্রতিনিধিত্ব করে। যে অপমান তিনি সহ্য করেছিলেন, এবং মানুষের পরিত্রাণ, তাদের পাপমোচন এবং তাঁর কর্মের এই পর্যায়টিকে সম্পূর্ণ করার জন্য যে মূল্য তিনি দিয়েছিলেন, এ হল তার প্রতীক। এর আরো একটা অর্থ হল যে, ঈশ্বর মানুষকে ক্রুশ থেকে মুক্ত করবেন। এ হল সেই মূল্য, যা রক্ত ও জীবনের মধ্যে দিয়ে পরিশোধ হয়, এবং এ হল এমন এক মূল্য যা কোনো সৃষ্ট জীব চোকাতে পারবে না। এর কারণ হল যে, তাঁর কাছে ঈশ্বরের সারসত্য রয়েছে, এবং ঈশ্বরের যা আছে এবং ঈশ্বর যা, তিনি তার অধিকারী, এবং, যে, তিনি এই ধরনের যন্ত্রণা সহ্য করতে পারেন ও এহেন কার্য সাধন করতে পারেন। এ হল এমন এক কার্য, যা তাঁর দ্বারা সৃষ্ট কোনো সত্তা তাঁর পরিবর্তে সাধন করতে পারবে না। এ হল অনুগ্রহের যুগে ঈশ্বরের কার্য এবং তাঁর স্বভাবের উদ্ঘাটন। এই বিষয়টি কি ঈশ্বরের যা আছে এবং তিনি যা, তার কোনোকিছুর প্রকাশ ঘটায়? মানুষের এটা জেনে কি কোনো লাভ হবে? সেই যুগে, মানুষ যদিও ঈশ্বরের ছবিকে দেখেনি, তারা ঈশ্বরের পাপস্খালনের বলিকে গ্রহণ করেছিল, এবং ঈশ্বরের দ্বারা ক্রুশ থেকে মুক্ত পেয়েছিল। অনুগ্রহের যুগে ঈশ্বর যে কর্ম সাধন করেছেন, মানবজাতি তার সঙ্গে অপরিচিত নাও হতে পারে, কিন্তু এই সময়ে ঈশ্বরের স্বভাব ও তাঁর দ্বারা অভিব্যক্ত ইচ্ছার সঙ্গে কেউ কি পরিচিত? বিভিন্ন মাধ্যম মারফৎ মানুষ শুধুমাত্র বিভিন্ন যুগে ঈশ্বরের সম্পাদিত কর্ম সম্বন্ধে বিশদ জানে, অথবা ঈশ্বর-সম্পর্কিত সেই আখ্যানগুলি জানে, যেগুলি ঈশ্বর যেসময় তাঁর কার্য সাধন করছিলেন সেই একই সময়কালে ঘটেছিল। এই বিশদ বর্ণনা এবং আখ্যানগুলি শুধুমাত্র ঈশ্বর সম্বন্ধে কিছু তথ্য বা কিংবদন্তী, যার সঙ্গে ঈশ্বরের স্বভাব এবং সারসত্যের কোনো সম্পর্ক নেই। তাই, ঈশ্বর সম্বন্ধে মানুষ যতগুলি আখ্যানই জানুক না কেন, তার অর্থ এই নয় যে, ঈশ্বরের স্বভাব বা তাঁর সারসত্য সম্পর্কে গভীর উপলব্ধি তাদের রয়েছে। অনুগ্রহের যুগেও, বিধানের যুগের মতোই, যদিও মানুষ দেহরূপী ঈশ্বরের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও অন্তরঙ্গ সান্নিধ্য অনুভব করেছে, তবুও ঈশ্বরের স্বভাব ও ঈশ্বরের সারসত্য সম্বন্ধে তাদের জ্ঞানের অস্তিত্ব প্রায় ছিল না বললেই চলে।

রাজ্যের যুগে, ঈশ্বর আরো একবার দেহধারণ করেছেন, ঠিক যেমনভাবে তিনি প্রথমবার দেহধারণ করেছিলেন। কর্মের এই পর্বে, ঈশ্বর এখনো অকপটভাবে তাঁর বাক্য অভিব্যক্ত করেন, যে কাজ করতে তিনি বাধ্য, সেই কার্যসাধন করেন, এবং তাঁর যা আছে এবং তিনি যা, তা ব্যক্ত করেন। একইসঙ্গে, মানুষের অবাধ্যতা ও অজ্ঞতা বহন ও সহ্য করে যান। কর্মের এই সময়কালেও কি ঈশ্বর নিরন্তর তাঁর স্বভাবকে প্রকাশ ও তাঁর ইচ্ছাকে অভিব্যক্ত করেন না? তাই, মানুষের সৃষ্টিলগ্ন থেকে অদ্যাবধি, ঈশ্বরের স্বভাব, তাঁর সত্তা ও সম্পদসমূহ, এবং তাঁর ইচ্ছা প্রতিটি মানুষের কাছে প্রকাশিত রয়েছে। ঈশ্বর কখনোই ইচ্ছাকৃতভাবে তাঁর সারসত্য, তাঁর স্বভাব, বা তাঁর ইচ্ছাকে প্রচ্ছন্ন রাখেননি। ঈশ্বর কী কার্যসাধন করছেন, বা তাঁর ইচ্ছা কী, সেই সম্বন্ধে মানবজাতিও ভাবিত নয়—এই কারণেই ঈশ্বর সম্বন্ধে মানুষের এইরূপ শোচনীয় উপলব্ধি রয়েছে। প্রকারান্তরে বললে, ঈশ্বর তাঁর ছবি গোপন রেখেও, প্রতি মুহূর্তে মানবজাতির পাশে দাঁড়ান, নিরন্তর তিনি তাঁর ইচ্ছা, স্বভাব ও সারসত্যকে প্রকাশ্যে ব্যক্ত করেন। এক অর্থে, ঈশ্বরের ছবিও মানুষের কাছে প্রকাশিত, কিন্তু মানুষের দৃষ্টিহীনতা ও অবাধ্যতার কারণে, তারা কখনোই ঈশ্বরের আবির্ভাব চাক্ষুষ করতে সক্ষম হয় না। তাই, এটাই যদি ঘটনা হয়, ঈশ্বরের স্বভাব ও স্বয়ং ঈশ্বরকে উপলব্ধি কি তবে প্রত্যেকের কাছে সহজ হওয়া উচিত নয়? উত্তর দেওয়ার পক্ষে এটা খুব কঠিন প্রশ্ন, তাই নয় কি? তোমরা একে সহজ বলতে পারো, কিন্তু যখন কিছু মানুষ ঈশ্বরকে জানতে চায়, তারা প্রকৃতপক্ষে তাঁকে জানতে পারে না, বা তাঁর সম্বন্ধে একটা স্পষ্ট উপলব্ধি অর্জন করতে পারে না—তা সর্বদাই থাকে অস্পষ্ট ও অনিশ্চিত। তোমরা যদি বলো যে, এটা সহজ নয়, তাহলে সেটাও সঠিক নয়। দীর্ঘকাল ধরে ঈশ্বরের কর্মের প্রাপক হওয়ার কারণে, নিজেদের অভিজ্ঞতার মধ্যমে প্রত্যেকেরই ঈশ্বরের সঙ্গে প্রকৃত সম্পর্ক রচিত হওয়া উচিত। নিজেদের হৃদয়ে তাদের অন্ততপক্ষে কিছুটা পরিমাণে ঈশ্বরকে অনুভব করা উচিত, অথবা ঈশ্বরের সঙ্গে আধ্যাত্মিক সংযোগ ঘটে থাকা উচিত, এবং তাদের অন্ততপক্ষে কিছুটা পরিমাণে ঈশ্বরের স্বভাব বিষয়ক ধারণাগত সচেতনতা থাকা উচিত, অথবা তাঁর সম্বন্ধে কিছুটা পরিমাণে উপলব্ধি অর্জন করা উচিত। মানুষ যখন থেকে ঈশ্বরকে অনুসরণ করা শুরু করে তখন থেকে অদ্যাবধি, মানবজাতি অনেক কিছু অর্জন করেছে, কিন্তু বিভিন্ন কারণে—যেমন মানুষের অযোগ্যতা, অজ্ঞতা, বিদ্রোহী স্বভাব এবং বিভিন্ন অভিপ্রায়—মানবজাতি এর অধিকাংশই হারিয়েছে। ঈশ্বর কি ইতিমধ্যেই মানবজাতিকে যথেষ্ট দেননি? ঈশ্বর যদিও মানবজাতির কাছ থেকে তাঁর ছবি প্রচ্ছন্ন রাখেন, তবু তিনি মানবজাতিকে সরবরাহ করেন তাঁর যা আছে ও তিনি যা, তা এবং তাঁর জীবন; ঈশ্বর সম্বন্ধে মানবজাতির জ্ঞান বর্তমানে যা শুধু তা হওয়া উচিত নয়। এই কারণেই, আমি মনে করি যে, ঈশ্বরের কর্ম, ঈশ্বরের স্বভাব, এবং স্বয়ং ঈশ্বর—এই বিষয়ে তোমাদের সঙ্গে আরো আলোচনার প্রয়োজন। এর উদ্দেশ্য হল এই, যে, সহস্রাধিক বছর ধরে যে পরিচর্যা ও সহানুভূতি ঈশ্বর মানুষকে দিয়েছেন, তা যেন ব্যর্থ না হয়, এবং যাতে মানবজাতি প্রকৃত অর্থে ঈশ্বরেরতাদের প্রতি অভিপ্রায়কে উপলব্ধি ও অনুধাবন করতে পারে। এর এ-ও কারণ যে, মানুষ যাতে তাদের ঈশ্বরজ্ঞানের নতুন এক পর্যায়ে অগ্রসর হতে পারে। তা ঈশ্বরকে মানুষের হৃদয়ে তাঁর যথার্থ স্থানে ফিরিয়েও দেবে; অর্থাৎ, তাঁর প্রতি ন্যায়বিচার করবে।

ঈশ্বরের স্বভাব এবং স্বয়ং ঈশ্বরকে উপলব্ধি করতে গেলে তোমাদের ক্ষুদ্র থেকে শুরু করতে হবে। কিন্তু কোথা থেকে শুরু করবে? সূচনায় আমি বাইবেল থেকে কিছু অধ্যায় নির্বাচন করেছি। নিম্নোক্ত তথ্যগুলি বাইবেলের স্তোত্রে নিহিত রয়েছে, সেগুলির সবকটিই ঈশ্বরের কর্ম, ঈশ্বরের স্বভাব, এবং স্বয়ং ঈশ্বর—এই বিষয়টির সঙ্গে সম্পর্কিত। ঈশ্বরের কর্ম, ঈশ্বরের স্বভাব, এবং স্বয়ং ঈশ্বর—এই বিষয়টি জানার ক্ষেত্রে তোমাদের সহায়ক সামগ্রী হিসাবে বিশেষভাবে এই উদ্ধৃতিগুলি আমি খুঁজে পেয়েছি। নিজেদের মধ্যে এগুলি ভাগ করে নিলে, আমরা জানতে সক্ষম হব যে, অতীত কাজের মাধ্যমে ঈশ্বর কী ধরনের স্বভাব প্রকাশ করেছেন, এবং তাঁর সারসত্যের কোন দিকটি মানুষের কাছে অজানা। এই অধ্যায়গুলি পুরোনো হতে পারে, কিন্তু যে বিষয়ে আমরা আলোচনা করছি, তা হল এমন এক নতুন বিষয়, যা মানুষ আগে কখনোই শোনেনি। তোমাদের মধ্যে কারো কারো বিষয়টিকে অকল্পনীয় মনে হতে পারে—আদম ও হবার প্রসঙ্গ উত্থাপন করা এবং নোহের কাছে ফিরে যাওয়ার অর্থ কি একই পথে আবার চলা নয়? তোমরা যা-ই ভাবো না কেন, এই অধ্যায়গুলি এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করার পক্ষে খুবই সহায়ক, এবং এগুলি শিক্ষণ-ভাষ্য বা আজকের আলোচনার প্রাথমিক সামগ্রী হিসাবে কাজে লাগতে পারে। যখন আমি এই আলোচনাটা করা শুরু করব, তখন তোমরা এই অধ্যায়গুলিকে নির্বাচন করার নেপথ্যে আমার অভিপ্রায়গুলিকে উপলব্ধি করবে। যারা আগে বাইবেল পাঠ করেছে তারা হয়তো এই কয়টি স্তোস্ত্র পাঠ করেছে, কিন্তু হয়তো সেগুলির প্রকৃত উপলব্ধি করেনি। প্রথমে সেগুলির সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা করা যাক, তারপরে আমাদের আলোচনায় সেগুলির প্রত্যেকটিকে বিশদে বর্ণনা করব।

আদম এবং হবা মানবজাতির পূর্বপুরুষ। আমাদের যদি বাইবেলের চরিত্রগুলিকে উল্লেখ করতে হয়, তবে আমাদের এই দুজনকে দিয়ে শুরু করতে হবে। এর পরে আসে নোহ, মানবজাতির দ্বিতীয় পূর্বপুরুষ। তৃতীয় চরিত্রটি কে? (অব্রাহাম।) তোমরা সকলে কি অব্রাহামের কাহিনী জানো? তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো জানো, অন্যদের কাছে হয়তো তা ততটা স্পষ্ট নয়। চতুর্থ চরিত্রটি কে? সদোমের ধ্বংসের উপাখ্যানে কার উল্লেখ রয়েছে? (লোট।) কিন্তু এখানে লোটের প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়নি। কার প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়েছে? (অব্রাহাম-এর।) যিহোবা ঈশ্বর যা বলেছেন, মূলত তা-ই অব্রাহামের উপাখ্যানে উল্লেখ করা হয়েছে। তোমরা কি তা দেখতে পাও? পঞ্চম চরিত্রটি কে? (ইয়োব।) ঈশ্বর কি তাঁর বর্তমান পর্যায়ের কার্যে ইয়োবের অনেক উপাখ্যান উল্লেখ করেননা? তাহলে, এই উপাখ্যান নিয়ে তোমরা কি খুব বেশি ভাবিত? যদি তোমরা খুব বেশি ভাবিত হও, তাহলে কি তোমরা মন দিয়ে বাইবেলে ইয়োবের আখ্যায়িকা পাঠ করেছ? ইয়োব কী কী বলেছে, কোন কোন কাজ সে করেছে, তা কি তোমরা জানো? তোমাদের মধ্যে যারা তা সবচেয়ে বেশি পড়েছ, তারা কতবার তা পাঠ করেছ? তোমরা কি তা ঘন ঘন পাঠ করো? হংকং থেকে যে ভগিনীদ্বয় এসেছে, তোমরা তা আমাদের বলো। (আগে, আমরা যখন অনুগ্রহের যুগে ছিলাম, তখন আমি তা বার দুয়েক পড়েছি।) তারপর থেকে তুমি কি তা আর পাঠ করোনি? এ খুবই দুঃখজনক। আমি তোমাদের বলছি: ঈশ্বরের কর্মের এই পর্যায়ে তিনি বহুবার ইয়োবের উল্লেখ করেছেন, যা তাঁর অভিপ্রায়ের প্রতিফলন। তিনি যে বহুবার ইয়োবের কথা উল্লেখ করেও তোমাদের মনোযোগ জাগ্রত করেননি, তা একটা বিষয়কেই প্রমাণ করে: তোমাদের মধ্যে সেই সকল ব্যক্তি হওয়ার কোনো অভিপ্রায় নেই যারা সৎ, এবং যারা ঈশ্বরে ভীত এবং মন্দ কর্ম পরিত্যাগ করে। এর কারণ হল যে, ঈশ্বর কথিত ইয়োবের আখ্যান সম্বন্ধে মোটামুটি একটা ধারণা করে নিয়েই তোমরা সন্তুষ্ট। তোমরা শুধুমাত্র গল্পটা জেনেই তৃপ্ত, কিন্তু ইয়োব কে, এবং ঈশ্বর যে এতবার ইয়োবের বিষয়ে উল্লেখ করেন, তার নেপথ্যের কারণ কী, সে সম্বন্ধে তোমরা ভাবিত নও, এবং তা নিয়ে বিশদ উপলব্ধির চেষ্টা তোমরা করো না। ঈশ্বরের দ্বারা প্রশংসিত এহেন এক ব্যক্তি যদি তোমাদের আগ্রহী না করে, তাহলে ঠিক কীসে তোমরা মনোযোগ দিচ্ছ? এমন এক গুরুত্বপূর্ণ যে ব্যক্তির প্রসঙ্গ ঈশ্বর উল্লেখ করেছেন, তার সম্বন্ধে তোমরা যদি ভাবিত না হও, বা তাঁকে উপলব্ধির চেষ্টা না করো, তাহলে তা ঈশ্বরের বাক্য সম্বন্ধে তোমাদের মানসিকতার বিষয়ে কী বলবে? এই বিষয়টি কি এটাই প্রমাণ করবে না, যে, তোমাদের অধিকাংশই ব্যবহারিক বিষয়গুলির সঙ্গে সংস্রব রাখো না, বা সত্যকে অন্বেষণ করো না? তুমি যদি সত্যের অন্বেষণ করো, তাহলে ঈশ্বর যে মানুষদের অনুমোদন করেন এবং যে চরিত্রগণের আখ্যানমালা ঈশ্বর বিধৃত করেন, তাদের তোমরা প্রয়োজনীয় মনোযোগ দেবে। তুমি তাদের যোগ্য হতে পারবে কি না, বা তাদের আখ্যানসমূহ তুমি অনুভবযোগ্য বলে মনে করবে কি না তা নির্বিশেষে, তুমি দ্রুত গিয়ে তাদের সম্বন্ধে পাঠ করবে, তাদের অনুধাবনের চেষ্টা করবে, তাদের দৃষ্টান্ত অনুসরণের পথ খুঁজবে, এবং তোমার সামর্থ্য অনুযায়ী যথাসাধ্য তুমি করবে। সত্যের জন্য ব্যাকুল কোনো ব্যক্তির এভাবেই আচরণ করা উচিত। কিন্তু বাস্তবটা হল যে, তোমরা যারা এখানে বসে রয়েছ, তাদের অধিকাংশই কখনো ইয়োবের কাহিনী পড়োনি—এবং তা খুব স্পষ্ট।

যে বিষয়টি নিয়ে আমি এক্ষুনি আলোচনা করছিলাম সেখানে আবার ফিরে যাওয়া যাক। শাস্ত্রের এই অংশে যা পুরাতন নিয়মের বিধানের যুগের সঙ্গে সম্পর্কিত, ভীষণভাবে প্রতিনিধিত্বমূলক এমন কিছু চরিত্রের সম্বন্ধে কিছু বিশেষ আখ্যায়িকাসমূহের উপর জোর দিয়েছি, যেগুলির সঙ্গে যারা বাইবেল পড়েছে তাদের অধিকাংশই পরিচিত। এই চরিত্রগুলি সম্বন্ধে আখ্যানগুলি যারা পড়েছে, তাদের মধ্যে যে কেউই ঈশ্বর তাদের উপর যে কর্ম সাধন করেছেন, তা অনুভব করতে সক্ষম হবে, এবং ঈশ্বর যে বাক্যগুলি তাদের বলেছেন, সেগুলির বর্তমানে মানুষের কাছে সমানভাবে মূর্ত ও সুগম হবে। তুমি যখন বাইবেলের নথিবদ্ধ এই আখ্যানগুলি পাঠ করবে, তখন, ইতিহাসের সংশ্লিষ্ট সময়গুলিতে ঈশ্বর কীভাবে তাঁর কার্য সাধন করেছেন, এবং মানুষের সঙ্গে কীভাবে আচরণ করেছেন, তা আরো ভালোভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে। কিন্তু যে কারণে আজ আমি এই অধ্যায়গুলিকে আলোচনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তা এই নয়, যে, যাতে তুমি নিছকই এই উপাখ্যানগুলির বা এগুলির চরিত্রদের উপর মনোনিবেশের চেষ্টা করো। বরং তা এই জন্য যে, যাতে তুমি—এই চরিত্রগণের আখ্যানমালার মাধ্যমে—ঈশ্বরের কর্ম ও তাঁর স্বভাব প্রত্যক্ষ করতে করতে পারো। তা তোমায় সমর্থ করবে ঈশ্বরকে আরো সহজে জানতে ও উপলব্ধি করতে, তাঁর প্রকৃত দিকটিকে চাক্ষুষ করতে; তা তাঁর সম্বন্ধে তোমার অনুমান ও পূর্বধারণাগুলি দূর করবে, এবং আবছায়াময় বিশ্বাস থেকে তোমায় সঠিক পথে নিয়ে যাবে। তোমার যদি একটা দৃঢ় ভিত্তি না থাকে, তাহলে, ঈশ্বরের স্বভাব অনুভব করা এবং স্বয়ং ঈশ্বরকে জানার এই যে প্রয়াস, তা এমনকি কোথা থেকে শুরু করতে হবে সেই বিষয়েও প্রায়শই তোমায় অসহায়তা, শক্তিহীনতা এবং অনিশ্চয়তার এক অনুভূতির মধ্যে টেনে নিয়ে যেতে পারে। এটাই আমাকে একটা পদ্ধতি ও প্রকরণ তৈরিতে উদ্বুদ্ধ করেছে যা তোমাকে সাহায্য করতে পারে ঈশ্বরকে আরো ভালোভাবে উপলব্ধি করার, আরো প্রামাণ্য ভাবে ঈশ্বরের ইচ্ছাকে উপলব্ধি করার, এবং ঈশ্বরের স্বভাব ও স্বয়ং ঈশ্বরকে জানার বিষয়ে, এবং তা প্রকৃত অর্থে ঈশ্বরের অস্তিত্বকে অনুভব করা এবং মানবজাতির প্রতি তাঁর ইচ্ছাকে উপলব্ধি করতে সক্ষম করবে তোমায়। তা কি তোমাদের সকলেরই উপকারে আসবে না? এবার যখন তোমরা আখ্যানগুলি এবং শাস্ত্রের অংশগুলি আবার পাঠ করবে তখন নিজেদের অন্তঃকরণে কী অনুভব করবে? তোমরা কি মনে করো যে, আমার নির্বাচিত শাস্ত্রের অংশগুলি অনাবশ্যক? তোমাদের এইমাত্র যা বললাম, তার উপর আমাকে আবার জোর দিতে হবে: তোমাদের দিয়ে এই চরিত্রসমূহের আখ্যানমালা পাঠ করানোর অর্থ হল মানুষের উপর ঈশ্বর কীভাবে তাঁর কর্ম করেন তা চাক্ষুষ করতে, এবং মানবজাতির প্রতি তাঁর মনোভাব আরো ভালোভাবে অনুভব করতে, তোমাদের সাহায্য করা। কোন কাজটা তোমাদের সাহায্য করবে এই উপলব্ধিতে পৌঁছতে? ঈশ্বর অতীতে যে কর্ম করেছেন তা উপলব্ধি করা, এবং বর্তমানে ঈশ্বর যা কর্ম করছেন তার সঙ্গে সেটি মিলিয়ে দেখা—তাঁর বিবিধ দিককে উপলব্ধি করতে তা তোমাদের সাহায্য করবে। এই বিবিধ সকল দিক হল বাস্তব, এবং যারা ঈশ্বরকে জানতে ইচ্ছুক তাদের সকলকে সেগুলি জানতে ও উপলব্ধি করতেই হবে।

আদম ও হবার কাহিনি দিয়ে শুরু করা যাক, শাস্ত্র থেকে একটি উদ্ধৃতি দিয়ে শুরু করছি।

ক. আদম ও হবা

১. আদমের প্রতি ঈশ্বরের আদেশ

আদিপুস্তক ২:১৫-১৭ প্রভু পরমেশ্বর মানুষকে এদন উদ্যানে কৃষিকর্ম ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজে নিযুক্ত করলেন। প্রভু পরমেশ্বর মানুষকে নির্দেশ দিলেন, তুমি এই উদ্যানের যে কোন ফল খেতে পার কিন্তু সৎ এবং অসৎ জ্ঞানদায়ী যে বৃক্ষটি রয়েছে, তার ফল খেও না। যেদিন সেই বৃক্ষের ফল তুমি খাবে, নিশ্চিত জেনো, সেই দিনই হবে তোমার মৃত্যু।

এই স্তোত্রগুলি থেকে তোমরা কী অনুধাবন করো? শাস্ত্রের এই অংশ তোমাদের মনে কী অনুভূতি জাগিয়ে তোলে? কেন আমি আদমের প্রতি ঈশ্বরের আদেশ নিয়ে আলোচনার সিদ্ধান্ত নিলাম? এখন কি তোমাদের প্রত্যেকের মনে ঈশ্বরের ও আদমের প্রতিমূর্তি রয়েছে? তোমরা কি কল্পনা করার চেষ্টা করতে পারো: তোমরা যদি সেই স্থলে থাকতে, তাহলে, ঈশ্বর কেমন হতেন বলে তোমাদের মনের গভীর থেকে মনে হয়? এই নিয়ে ভাবনাটা তোমাদের মনে কীরূপ অনুভূতি জাগিয়ে তোলে? এ হল মনকে নাড়া দেওয়ার মতো হৃদয়গ্রাহী এক ছবি। যদিও এর মধ্যে রয়েছেন কেবল ঈশ্বর এবং রয়েছে মানুষ, কিন্তু তাদের মধ্যে অন্তরঙ্গতা তোমাকে শ্রদ্ধার এই অনুভূতিতে ভরিয়ে তুলবে: ঈশ্বরের অপরিসীম ভালোবাসা মানুষের উপর অকাতরে বর্ষিত হয়, এবং তা মানুষকে ঘিরে রাখে, মানুষ হল নিষ্পাপ ও বিশুদ্ধ, সে নির্ভার ও নিশ্চিন্ত, ঈশ্বরের দৃষ্টির সম্মুখে পরমানন্দে বাস করে চলেছে; মানুষের জন্য ঈশ্বর উদ্বেগ দেখান, অন্যদিকে মানুষ ঈশ্বরের সুরক্ষা ও আশীর্বাদের অধীনে বাস করে; মানুষ যা করে ও বলে তার প্রতিটি এবং ঈশ্বরের সাথে ওতপ্রোত ও অবিচ্ছেদ্য ভাবে জড়িত।

একে বলা যেতে পারে মনুষ্যসৃষ্টির পর মানুষের প্রতি ঈশ্বরের প্রথম আদেশ। এই আদেশ কোন বিষয়টি নির্দেশ করে? তা ঈশ্বরের অভিপ্রায়কে ছাড়াও মানবজাতির জন্য তাঁর উদ্বেগকেও নির্দেশ করে। এ হল ঈশ্বরের প্রথম আদেশ, এবং এই প্রথমবার ঈশ্বর মানবজাতির জন্য তাঁর উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। অর্থাৎ, মানুষ্যসৃষ্টির মুহূর্ত থেকে ঈশ্বর মানুষের প্রতি একটা দায়িত্ববোধ অনুভব করছেন। কী তাঁর দায়িত্ব? তাঁকে মানুষের সুরক্ষাবিধান করতে হবে, মানুষের দেখভাল করতে হবে। তিনি আশা করেন যে, মানুষ তাঁর বাক্যগুলিকে বিশ্বাস ও মান্য করতে পারবে। তা মানুষের কাছ থেকে ঈশ্বরের প্রথম প্রত্যাশাও বটে। সেই প্রত্যাশা নিয়েই ঈশ্বর এই বাক্যগুলি বলেছেন: “তুমি এই উদ্যানের যে কোন ফল খেতে পার কিন্তু সৎ এবং অসৎ জ্ঞানদায়ী যে বৃক্ষটি রয়েছে, তার ফল খেও না। যেদিন সেই বৃক্ষের ফল তুমি খাবে, নিশ্চিত জেনো, সেই দিনই হবে তোমার মৃত্যু।” এই সরল বাক্যগুলি ঈশ্বরের অভিপ্রায়ের প্রতিফলন ঘটায়। এগুলি এ-ও প্রকাশ করে যে, ঈশ্বর অন্তর থেকে মানুষের জন্য তাঁর উদ্বেগ দেখাতে শুরু করেছেন। সবকিছুর মধ্যে একমাত্র আদমকেই ঈশ্বরের প্রতিমূর্তি অনুযায়ী নির্মাণ করা হয়েছে; আদমই একমাত্র জীবিত সত্তা যার কাছে ঈশ্বরের প্রাণবায়ু রয়েছে; সে ঈশ্বরের সঙ্গে হাঁটতে পারে, ঈশ্বরের সঙ্গে বাক্যালাপ করতে পারে। মানুষ কী করতে পারবে ও কী করতে পারবে না, তা তাঁর আদেশের মাধ্যমে ঈশ্বর খুবই স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন।

এই কয়েকটি সহজ বাক্যে, আমরা ঈশ্বরের হৃদয় দেখতে পাই। কিন্তু কী ধরনের হৃদয় প্রতিভাত হয়? ঈশ্বরের হৃদয়ে কি ভালোবাসা রয়েছে? সেখানে কি কোনো উদ্বেগ রয়েছে? এই স্তবকগুলিতে ঈশ্বরের ভালোবাসা ও উদ্বেগ শুধু অনুধাবনই করা যায় না, তা গভীর ভাবে উপলব্ধিও করা যায়। তোমরা কি একমত নও? আমার মুখে এই বাক্য শোনার পর, তোমরা কি এখনও মনে করো যে এগুলি নিছকই সহজ-সরল কিছু বক্তব্য? আদতে এগুলি তেমন সহজ-সরল নয়, তাই নয় কি? তোমরা কি আগে এই বিষয়ে সচেতন ছিলে? ঈশ্বর যদি ব্যক্তিগতভাবে তোমাকে এই বাক্যগুলি বলতেন, তাহলে তুমি নিজের অন্তরে কীরূপ অনুভব করতে? তুমি যদি একজন মানবিক ব্যক্তি না হতে, তোমার হৃদয় যদি হিমশীতল হত, তাহলে তুমি কিছুই অনুভব করতে না, তুমি ঈশ্বরের ভালোবাসা অনুভব করতে না, এবং তুমি ঈশ্বরের হৃদয়কে উপলব্ধির চেষ্টাও করতে না। কিন্তু বিবেক ও মানবতার বোধসম্পন্ন ব্যক্তি হিসাবে, তোমার অনুভব হবে ভিন্নতর। তুমি একটা উষ্ণতা অনুভব করবে, তুমি একটা যত্ন ও ভালোবাসা অনুভব করবে, এবং তোমার একটা সুখানুভূতি হবে। তাই নয় কি? যখন তোমার এই অনুভূতিগুলি হবে, তখন তুমি ঈশ্বরের সঙ্গে কীরূপ আচরণ করবে? তুমি কি ঈশ্বরের সঙ্গে একটা ঘনিষ্ঠতা অনুভব করবে? তুমি কি হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে ঈশ্বরকে ভালোবাসবে ও শ্রদ্ধা করবে? তোমার অন্তর কি ঈশ্বরের আরো নিকটবর্তী হবে? এর থেকেই তুমি বুঝতে পারছ যে, ঈশ্বরের ভালোবাসা মানুষের পক্ষে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যা আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা হল, মানুষের তরফে ঈশ্বরের ভালোবাসার স্বীকৃতি প্রদান ও সেই ভালোবাসার অনুধাবন। আদতে, তাঁর কর্মের এই পর্যায়ে ঈশ্বর একই ধরনের অনেক বিষয় নিয়ে বলেন না কি? বর্তমানে কি এমন মানুষ রয়েছে, যারা ঈশ্বরের হৃদয়কে অনুধাবন করে? ঈশ্বরের যে অভিপ্রায়ের বিষয়ে আমি এইমাত্র বললাম তা কি তুমি অনুধাবন করতে পারো? ঈশ্বরের ইচ্ছা যখন স্পর্শযোগ্য, মূর্ত, ও বাস্তব, তখনও তোমরা তা প্রকৃতপক্ষে উপলন্ধি করতে পারো না। এই কারণেই আমি বলি যে, ঈশ্বর সম্বন্ধে তোমাদের প্রকৃত জ্ঞান বা উপলব্ধি নেই। তা কি সত্য নয়? এখনকার মতো এই প্রসঙ্গটির আলোচনা আমরা বন্ধ রাখছি।

২. ঈশ্বর হবাকে সৃষ্টি করলেন

আদিপুস্তক ২:১৮-২০ তারপর প্রভু পরমেশ্বর বললেন, মানুষের একা থাকা ভাল নয়, আমি তাকে তার যোগ্য এক সঙ্গিনী দেব। প্রভু পরমেশ্বর মৃত্তিকা থেকে ভূচর সকল পশু ও খেচর সকল পাখি সৃষ্টি করলেন এবং সেই মানুষটি তাদের কি নাম রাখবেন, তা জানার জন্য তাদের তাঁর কাছে নিয়ে এলেন। তিনি যে প্রাণীর যে নাম রাখলেন, তার সেই নামই থাকল। তিনি প্রত্যেক গৃহপালিত পশু, পাখি ও বন্যপশুর নামকরণ করলেন কিন্তু মানুষের যোগ্য কোন সঙ্গিনী তাদের মধ্যে পাওয়া গেল না।

আদিপুস্তক ২:১২-২৩ প্রভু পরমেশ্বর আদমের দেহ থেকে খুলে নেওয়া পঞ্জরাস্থি দ্বারা এক নারী সৃষ্টি করলেন এবং তাকে আদমের কাছে নিয়ে এলেন। আদম তখন বললেন, এবার আমি পেলাম তাকে যে আমার একান্ত আপন, আমারই অস্থি থেকে যার উদ্ভব! সম্ভূতা সে নরের সত্তা থেকে নারী হবে তার নাম।

শাস্ত্রের এই অংশে একটি মূল বাক্য রয়েছে: “আদম যে প্রাণীর যে নাম রাখলেন, তার সেই নামই থাকল”। তাই সমস্ত জীবিত সত্তার নাম কে দিয়েছেন? তিনি আদম, ঈশ্বর নন। এই বাক্যটি মানবজাতিকে এক বাস্তবিকতা জানায়: ঈশ্বর যখন মানুষকে সৃষ্টি করেছিলেন, তখন তিনি তাকে বুদ্ধিমত্তা দিয়েছিলেন। অর্থাৎ, মানুষের বুদ্ধি ঈশ্বরের কাছ থেকে এসেছে। এমনটা নিশ্চিত। কিন্তু কেন? ঈশ্বরকে আদমকে সৃষ্টি করার পর, আদম কি বিদ্যালয়ে গিয়েছিল? সে কি পড়তে জানত? ঈশ্বর নানাবিধ জীবিত সত্তা সৃষ্টি করার পর, আদম কি সেসকল জীবকে চিনতে পেরেছিল? ঈশ্বর কি তাকে তাদের নাম বলেছিলেন? এই জীবদের কী নামকরণ করা হবে, সে বিষয়ে ঈশ্বর অবশ্যই তাকে কোনো শিক্ষা দেননি। এমনটাই সত্য! তাহলে আদম কী করে জানল যে, কীভাবে এই জীবিত সত্তাদের নাম দিতে হবে, এবং তাদের কী ধরনের নাম দিতে হবে? এই বিষয়টি আদমকে সৃষ্টি করাকালীন ঈশ্বর তার সঙ্গে কী সংযুক্ত করেছিলেন, সেই প্রশ্নের সঙ্গেই জড়িত। এখানে আরো একটা মূল বিষয় রয়েছে, যা তোমাদের উপলব্ধি করা উচিত: আদম এই জীবিত সত্তাদের নাম দেওয়ার পরে সেই নামগুলি ঈশ্বরের শব্দভাণ্ডারে স্থান পায়। এই বিষয়ে কেন আমি উল্লেখ করছি? কারণ এর সঙ্গেও ইশ্বরের স্বভাব জড়িত, এবং এই বিষয়টির উপর আমাকে আরও বিশদে ব্যাখ্যা করতেই হবে।

ঈশ্বর মানুষকে সৃষ্টি করলেন, তার মধ্যে নিজের প্রাণবায়ু সঞ্চার করলেন, তাঁর নিজের কিছুটা বুদ্ধি, দক্ষতা এবং তাঁর যা আছে ও তিনি যা, তা প্রদানও করলেন তাকে। ঈশ্বর মানুষকে এই সকল বিষয় প্রদানের পর, মানুষ স্বাধীনভাবে কাজ করতে ও নিজের মতো করে চিন্তাভাবনা করতে সক্ষম হল। মানুষ যা ভাবনাচিন্তা করে এবং যে কার্যসাধন করে, তা যদি ঈশ্বরের চোখে শুভ হয়, তবে ঈশ্বর তা গ্রহণ করেন, এবং তার মধ্যে তিনি হস্তক্ষেপ করেন না। মানুষ যা করে তা যদি সঠিক হয় তবে ঈশ্বর তার মান্যতা দেন। তাই “আদম যে প্রাণীর যে নাম রাখলেন, তার সেই নামই থাকল”। এই বাক্যবন্ধটি কী ইঙ্গিত করছে? তা এমনটা ইঙ্গিত করছে, যে, বিভিন্ন জীবিত সত্তার যে নাম দেওয়া হয়েছে, তার পরিবর্তনের প্রয়োজন বলে ঈশ্বর মনে করেন নি। যে জীবকে আদম যে নামে ডেকেছে, ঈশ্বর “তবে তাই হোক”, বলে সেই জীবের সেই নামটিকেই স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। এই বিষয়বস্তুটি নিয়ে ঈশ্বর কি কোনো মতামত ব্যক্ত করেছিলেন? না, অবশ্যই করেননি। এর থেকে তুমি কী অনুধাবন করো? ঈশ্বর মানুষকে বুদ্ধিমত্তা দিয়েছেন, এবং মানুষ কার্যসাধনের জন্য ঈশ্বরপ্রদত্ত এই বুদ্ধিমত্তাকে ব্যবহার করেছে। মানুষ যা করে তা যদি ঈশ্বরের চোখে ইতিবাচক হয়, তাহলে তা কোনোরকম বিচার বা সমালোচনা ছাড়াই ঈশ্বরের দ্বারা স্বীকৃত, অনুমোদিত এবং গৃহীত হয়। এই কাজ কোনো ব্যক্তি, কোনো দুষ্ট আত্মা, বা শয়তান করতে পারে না। তোমরা কি এখানে ঈশ্বরের স্বভাবের একটা উদ্ঘাটন দেখতে পাও? কোনো মানুষ, কোনো দুর্নীতিগ্রস্থ ব্যক্তি, বা শয়তান কি কখনো তার চোখের সামনে তাদের নামে কোনো কাজ করার জন্য কোনো ব্যক্তিকে অনুমতি দেবে? অবশ্যই না! তারা কি এই পদের জন্য অন্য কোনো ব্যক্তি বা অন্য কোনো শক্তির সঙ্গে লড়াই করবে, যা তাদের থেকে ভিন্ন? তারা অবশ্যই তা করবে! সেটা যদি হত কোনো দুর্নীতিগ্রস্থ ব্যক্তি বা শয়তান, কিনা সেই সময় আদমের সঙ্গে ছিল, তাহলে সে অবশ্যই আদমের কাজকে অস্বীকার করত। তারও যে স্বাধীনভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা রয়েছে, তারও যে অনন্য অন্তর্দৃষ্টি রয়েছে, তা প্রমাণ করার জন্য সে নিশ্চিতভাবেই আদম যা করেছে তার সবকিছুকেই নস্যাৎ করত: “তুমি এইটাকে এই নামে ডাকতে চাও? ঠিক আছে, আমি একে এই নামে ডাকব না, আমি একে ঐ নামে ডাকব; তুমি একে টম নাম দিয়েছে, কিন্তু আমি একে হ্যারি বলে ডাকব। আমি যে কতটা বুদ্ধিমান সেটা আমাকে দেখাতে হবে।” এটা কী ধরনের প্রকৃতি? এটা কি সাঙ্ঘাতিক রকমের ঔদ্ধত্য নয়? ঈশ্বরের ক্ষেত্রে বিষয়টা কেমন? তাঁর কি এই ধরনের স্বভাব রয়েছে? আদম যা করছিল তার প্রতি কি ঈশ্বরের কোনো অস্বাভাবিক আপত্তি ছিল? উত্তরটা হবে দ্বর্থ‍্যহীনভাবে না! ঈশ্বর যে স্বভাব প্রকাশ করেন তার মধ্যে তর্কপ্রিয়তা, অহংকার ও নিজের নৈতিকতার বিষয়ে ঔদ্ধত্যের লেশমাত্র ইঙ্গিত নেই। এখানে এটুকু স্পষ্ট। এটাকে একটা গৌণ বিষয় বলে মনে হতে পারে, কিন্তু তুমি যদি ঈশ্বরের সারসত্য উপলব্ধি না করো, ঈশ্বর কীভাবে কাজ করেন এবং ঈশ্বরের মনোভাব কী, তা যদি তোমার অন্তঃকরণ বোঝার চেষ্টা না করে, তাহলে তুমি ঈশ্বরের স্বভাব জানবে না, বা ঈশ্বরের স্বভাবের প্রকাশ বা উদ্ঘাটন দেখবে না। তাই নয় কি? আমি তোমাদের কাছে এক্ষুনি যা ব্যাখ্যা করলাম, তার সঙ্গে কি তোমরা একমত? আদমের কর্মের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ ঈশ্বর সাড়ম্বরে এমনটাও ঘোষণা করেননি যে “তুমি খুব ভালো কাজ করেছ, তুমি সঠিক কাজ করেছ, আমি তোমার সঙ্গে সহমত”! তবে আদম যা করেছিল, ঈশ্বর নিজের অন্তর থেকে তা অনুমোদন, স্বীকার ও প্রশংসা করেছিলেন। সৃষ্টিলগ্নে এটাই ছিল প্রথম সেই কাজ, যা ঈশ্বরের নির্দেশে তাঁরই জন্য মানুষ করেছিল। এ ছিল এমন এক কাজ, যা ঈশ্বরের পরিবর্তে ও ঈশ্বরের তরফ থেকে মানুষ করেছিল। ঈশ্বরের চোখে, তিনি মানুষকে যে বুদ্ধিমত্তা দিয়েছেন তা থেকে এই কাজ উদ্ভূত হয়েছে। তিনি সেটাকে একটা ভালো বিষয়, একটা ইতিবাচক বিষয় হিসাবে দেখেছিলেন। সেই সময় আদম যা করেছিল, তা ছিল মানুষের মধ্যে ঈশ্বরের বুদ্ধিমত্তার প্রথম প্রকাশ। ঈশ্বরের দৃষ্টিকোণ থেকে, তা ছিল এক সুষ্ঠু বহিঃপ্রকাশ। আমি তোমাদের যা বলতে চাই তা হল এই, যে, ঈশ্বরের লক্ষ্য হল তাঁর যা আছে এবং তিনি যা, তার এবং তার বুদ্ধিমত্তার কিছুটা মানুষের মধ্যে সঞ্চার করা, যাতে মানবজাতি হয়ে উঠতে পারে এমন এক জীবিত সত্তা, যা তাঁকে প্রতীয়মান করে তোলে। কোনো এক জীবিত সত্তা তাঁর হয়ে কাজ করবে, ঠিক এমনটা দেখার জন্যই ঈশ্বর আকুল হয়ে ছিলেন।

৩. আদম ও হবার জন্য ঈশ্বর পশুচর্মের পোশাক তৈরি করলেন

আদিপুস্তক ৩:২০-২১ পরে আদম তাঁর স্ত্রীর নাম রাখলেন হবা; কেননা তিনিই হলেন জীবিত সকল মানুষের মাতা। আদম ও তার স্ত্রীর জন্য যিহোবা ঈশ্বর পশুচর্মের পোশাক প্রস্তুত করলেন এবং তাদের পরালেন।

এই তৃতীয় অনুচ্ছেদে একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক, যেখানে বলা হয়েছে যে আদম হবাকে যে নাম দিয়েছিল তার নেপথ্যে প্রকৃতপক্ষেই একটা অর্থ আছে। এর থেকে বোঝা যায় যে সৃষ্ট হওয়ার পর আদমের নিজস্ব ভাবনা ছিল এবং সে অনেক বিষয় উপলব্ধি করত। কিন্তু এখনকার মতো, সে কী উপলব্ধি করেছিল বা কতটা উপলব্ধি করেছিল, আমরা তার বিশদ ব্যাখ্যা বা অনুসন্ধানে যাচ্ছি না, কারণ তৃতীয় অনুচ্ছেদ নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে তা আমার মুখ্য উদ্দেশ্য নয়। তাহলে, কোন মূল বিষয়টাতে আমি আলোকপাত করতে চাই? এই অংশটা দেখা যাক, “আদম ও তার স্ত্রীর জন্য যিহোবা ঈশ্বর পশুচর্মের পোশাক প্রস্তুত করলেন এবং তাদের পরালেন।” আমাদের আজকের আলোচনায় শাস্ত্রের এই অংশটার কথা যদি না বলি, তবে এই বাক্যের গভীর ব্যঞ্জনা তোমরা হয়তো কখনোই উপলব্ধি করবে না। প্রথমে আমি কিছু ইঙ্গিত দেব। যদি পারো তবে কল্পনা করো, এদনের উদ্যান, সেখানে আদম ও হবা বসবাস করছে। ঈশ্বর তাদের সঙ্গে দেখা করতে এলেন, কিন্তু তারা লুকিয়ে পড়ল, কারণ তারা নগ্ন। ঈশ্বর তাদের দেখতে পেলেন না, এবং ঈশ্বর যখন তাদের ডাকলেন তখন তারা বলল, “আমরা আপনার সঙ্গে দেখা করার সাহস পাচ্ছি না, কারণ আমাদের দেহ নগ্ন”। তারা ঈশ্বরের সঙ্গে দেখা করার সাহস পাচ্ছে না, কারণ তারা নগ্ন। সুতরাং যিহোবা ইশ্বর তাদের জন্য কী করলেন? মূল পাঠে বলা হয়েছে: “আদম ও তার স্ত্রীর জন্য যিহোবা ঈশ্বর পশুচর্মের পোশাক প্রস্তুত করলেন এবং তাদের পরালেন।” এর থেকে তোমরা কি বুঝতে পেরেছ, কী দিয়ে ঈশ্বর তাদের বস্ত্র তৈরি করেছিলেন? ঈশ্বর পশুর চামড়া দিয়ে তাদের পোশাক তৈরি করেছিলেন। অর্থাৎ, ঈশ্বর মানুষের পরিধানের বস্ত্র হিসাবে পশুলোমের কোট তৈরি করেছিলেন। এগুলোই প্রথম পরিচ্ছদ যা ঈশ্বর মানুষের জন্য তৈরি করেছিলেন। আজকের মাপকাঠিতে পশুলোমের কোট একটা বিলাসবহুল সামগ্রী, এবং তা পরিধান করা সকলের সামর্থ্যের মধ্যে নয়। যদি তোমাকে কেউ জিজ্ঞাসা করে: “আমাদের পূর্বপুরুষদের প্রথম পরিহিত পোশাক কী ছিল?” তুমি উত্তরে বলতে পারো: “পশুলোমের কোট।” “এই পশুলোমের কোট কে বানিয়েছিলেন?” তুমি তখন বলতে পারো: “ঈশ্বর বানিয়েছিলেন!” এটাই এখানে প্রধান বিষয়: এই পোশাক ঈশ্বর বানিয়েছিলেন। এটাই কি আলোচনার উপযুক্ত একটা বিষয় নয়? আমার বর্ণনা শোনার পর তোমাদের মনে কি একটা ছবি ভেসে উঠেছে? তোমাদের মনে অন্তত মোটামুটি একটা ছবি ভেসে ওঠা উচিত। আজ তোমাদের এ কথা বলার মূল বিষয় কিন্তু মানুষের প্রথম পোশাক কী ছিল তা তোমাদের জানানো নয়। তাহলে মূল বিষয়টা কী? পশুলোমের কোট এখানে মূল বিষয় নয়, বরং বিষয়টা হল, মানুষ কীভাবে জানতে পারে ঈশ্বরের স্বভাব, তাঁর যা আছে, এবং তিনি যা—যেমন এখানে তিনি যা করেছেন তার মধ্যেই এগুলো প্রকাশিত হয়েছে।

“আদম ও তার স্ত্রীর জন্য যিহোবা ঈশ্বর পশুচর্মের পোশাক প্রস্তুত করলেন এবং তাদের পরালেন।” এই দৃশ্যে, ঈশ্বর যখন আদম ও হবার সঙ্গে রয়েছেন, তখন তাঁকে আমরা কোন ভূমিকায় দেখতে পাই? মাত্র দুজন মানুষ রয়েছে এমন এক বিশ্বে ঈশ্বর কোন পথে নিজেকে প্রতীয়মান করেন? তিনি কি নিজেকে ঈশ্বরের ভূমিকায় প্রতীয়মান করেন? হংকং থেকে আগত ভ্রাতা ও ভগিনীগণ, অনুগ্রহ করে উত্তর দাও। (পিতা-মাতার ভূমিকায়।) দক্ষিণ কোরিয়া থেকে আগত ভ্রাতা ও ভগিনীগণ, ঈশ্বর এখানে কোন ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন বলে তোমাদের মনে হয়? (পরিবারের প্রধান।) তাইওয়ান থেকে আগত ভ্রাতা ও ভগিনীগণ, তোমাদের কী মনে হয়? (আদম ও হবার পরিবারের কোনো এক সদস্যের ভূমিকায়, কোনো পারিবারিক সদস্যের ভূমিকায়।) তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ মনে করো যে, ঈশ্বর আদম ও হবার পরিবারের সদস্যরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন, আবার কেউ বলছ যে ঈশ্বর পরিবার প্রধান হিসাবে অবতীর্ণ হয়েছিলেন এবং অন্যরা বলছ পিতামাতা রূপে। এগুলো সবই খুবই যথাযথ। কিন্তু আমি কী বলতে চাই, তা কি তোমরা বুঝতে পারছ? ঈশ্বর এই দুই মানবকে সৃষ্টি করেছিলেন এবং তাদের নিজের সঙ্গী হিসাবে বিবেচনা করেছিলেন। তাদের একমাত্র পরিবার হিসাবে ঈশ্বর তাদের জীবনের পরিচর্যা করেছেন, এবং তাদের খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের সংস্থান করেছেন। এখানে ঈশ্বর আদম ও হবার পিতামাতা হিসাবে আবির্ভূত হয়েছেন। ঈশ্বর যখন এমনটা করেন, অনেক মানুষ দেখতে পায় না যে, ঈশ্বরের অবস্থান কত সুউচ্চ; সে দেখতে পায় না ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠত্ব, তাঁর রহস্য, এবং বিশেষ করে, তাঁর ক্রোধ অথবা মহিমা। সে যাকিছু দেখে তা হল ঈশ্বরের বিনয়, তাঁর স্নেহ, মানুষের জন্য উদ্বেগ, এবং দায়িত্বশীলতা ও মানুষের প্রতি তাঁর যত্ন। নিজেদের সন্তানের প্রতি পিতামাতা যেভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করে, ঠিক সেই মনোভাব নিয়েই ও সেই পথেই ঈশ্বর আদম ও হবার সঙ্গে আচরণ করেছিলেন। পিতামাতা যেভাবে নিজেদের পুত্রকন্যাকে ভালোবাসে, তাদের দেখাশোনা ও পরিচর্যা করে, এটা ঠিক সেই রকমও—বাস্তব, দৃশ্যমান, এবং মূর্ত। নিজেকে উচ্চ ও মহিমাময় অবস্থানে না রেখে ঈশ্বর ব্যক্তিগতভাবে পশুচর্ম দিয়ে মানুষের জন্য পোশাক তৈরি করেছেন। পশুলোমের এই কোট তাদের শালীনতা রক্ষার্থে ব্যবহৃত হয়েছিল নাকি শীত নিবারণের উদ্দেশ্যে, এখানে তা গুরুত্বপূর্ণ নয়। এখানে যা গুরুত্বপূর্ণ তা হল মানুষের দেহকে আবৃত করার এই পোশাক ঈশ্বর ব্যক্তিগতভাবে তাঁর নিজের হাতে তৈরি করেছিলেন। মনের কল্পনা দ্বারা সেই পোশাককে বাস্তবায়িত না করে, বা মানুষের কল্পনা অনুযায়ী অন্য কোনো অলৌকিক কাণ্ড না ঘটিয়েই, ঈশ্বর যথার্থভাবেই এমন একটা কাজ করেছিলেন, যা মানুষের ভাবনা অনুযায়ী ঈশ্বর করবেন না, বা তাঁর করা উচিত নয়। একে এক তুচ্ছ বিষয় বলে মনে হতে পারে—কিছু মানুষ একে আদৌ উল্লেখযোগ্য কোনো বিষয় বলেই মনে না-ও করতে পারে—কিন্তুঈশ্বরের যে অনুগামীরা ঈশ্বরের সম্পর্কে অস্পষ্ট ধারণা পোষণ করে, এর মাধ্যমে তারা ঈশ্বরের অকৃত্রিমতা ও তাঁর মাধুর্য সম্পর্কে অন্তদৃষ্টি লাভ করতে পারে, এবং তাঁর বিশ্বস্ততা ও বিনয়কে প্রত্যক্ষ করতে পারে। অসহ্য রকমের উদ্ধত যে সমস্ত মানুষ নিজেদের অত্যন্ত উচ্চস্তরীয় ও ক্ষমতাবান বলে মনে করে, এটা তাদের ঈশ্বরের অকৃত্রিমতা ও বিনয়ের সম্মুখে লজ্জায় তাদের অহংপূর্ণ মস্তক অবনত করতে বাধ্য করে। এখানে ঈশ্বরের অকৃত্রিমতা ও বিনয় মানুষকে এটা দেখতেও সক্ষম করে যে তিনি কত মধুর। এর বিপরীতে, যে “অপরিমেয়” ঈশ্বর, “ভালোবাসার যোগ্য” ঈশ্বর এবং “সর্বশক্তিমত্ত” ঈশ্বরকে মানুষ হৃদয়ে ধারণ করে, তিনি অকিঞ্চিৎকর ও কুশ্রী হয়ে ওঠেন, এবং সামান্য স্পর্শেই ভেঙে পড়েন। তুমি যখন এই স্তবকটা দেখো এবং এই আখ্যান শোনো, তখন ঈশ্বর এমন একটা কাজ করেছেন বলে কি তুমি ঈশ্বরকে নীচু নজরে দেখো? কিছু কিছু মানুষ তা করতে পারে, কিন্তু বাকিদের প্রতিক্রিয়া হবে বিপরীত। তারা মনে করবে যে, ঈশ্বর অকৃত্রিম ও ভালোবাসার যোগ্য, এবং ঈশ্বরের এই অকৃত্রিমতা ও মাধুর্যই তাদের নাড়া দিয়ে যায়। ঈশ্বরের বাস্তব দিকটা তারা যত দেখে, ততই তারা আরও বেশি করে উপলব্ধি করতে পারে ঈশ্বরের ভালোবাসার প্রকৃত উপস্থিতি, তাদের অন্তরে ঈশ্বরের গুরুত্ব, এবং প্রতিটি মুহূর্তে তিনি যেভাবে তাদের পাশে দাঁড়ান।

এবার আমাদের আগের আলোচনাকে বর্তমানের সাথে যুক্ত করা যাক। আদিতম লগ্নে তিনি যে মানবগণকে সৃষ্টি করেছিলেন, তাদের জন্য ঈশ্বর যদি এই বিভিন্ন অকিঞ্চিৎকর কাজগুলো করতে পারতেন, এমনকি সেইসব কাজও, যা মানুষ চিন্তা অথবা প্রত্যাশামাত্র করতে সাহস করবে না, তবে কি বর্তমানে তেমন কাজ ঈশ্বর মানুষদের জন্য করতে পারতেন? কেউ কেউ বলে “হ্যাঁ”। কিন্তু কেন? কারণ ঈশ্বরের সারসত্যে কোনো ছলনা নেই, নেই কোনো ছলনা তাঁর মাধুর্যেও। ঈশ্বরের সারসত্য প্রকৃত অর্থেই বিদ্যমান, এবং তা অন্য কারও দ্বারা সংযুক্ত নয়, আর তা এমন কোনো বিষয় নয়, যা স্থান, কাল, এবং যুগ ভেদে পরিবর্তিত হয়। ঈশ্বরের অকৃত্রিমতা ও মাধুর্য প্রকৃত অর্থে প্রতীয়মান হতে পারে সেই সকল কার্যের মাধ্যমেই, মানুষ যেগুলোকে মনে করে অকিঞ্চিৎকর ও অতিসাধারণ—এতই অকিঞ্চিৎকর কোনোকিছু, যা মানুষ কখনো ভাবতেই পারে না যে ঈশ্বর সংঘটন করবেন। ঈশ্বর কোনো ভান করেন না। তাঁর স্বভাব ও সারসত্যে কোনো অতিরঞ্জন, প্রচ্ছন্নতা, দম্ভ ও ঔদ্ধত্য নেই। তিনি কখনোই অহংকার করেন না, বরং তাঁর সৃষ্ট মানবজাতিকে তিনি ভালোবাসেন, তাদের প্রতি তিনি উদ্বেগ দেখান, তাদের দেখাশোনা করেন, এবং বিশ্বস্ততা ও আন্তরিকতার সঙ্গে নেতৃত্ব দেন। ঈশ্বর যা করেন, তা মানুষ যতই অল্পমাত্রায় অনুধাবন করুক, উপলব্ধি ও প্রত্যক্ষ করুক না কেন, তিনি নিশ্চিতভাবেই সেই কার্য সম্পন্ন করে চলেছেন। ঈশ্বরের যে এমন এক সারসত্য রয়েছে, তা জানলে কি মানুষের ঈশ্বরপ্রেম কোনোভাবে প্রভাবিত হবে? তা কি তাদের ঈশ্বরভীতিকে প্রভাবিত করবে? আমি আশা করি যে, যখন তোমরা ঈশ্বরের বাস্তব দিকটাকে উপলব্ধি করবে, তখন তোমরা তাঁর আরো নিকটবর্তী হবে, এবং তাঁর ভালোবাসাকে আরো যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে, এবং সেইসঙ্গে, নিজেদের হৃদয়কে ঈশ্বরের কাছে সমর্পণ করতে সক্ষম হবে, এবং ঈশ্বর সম্বন্ধে নিজেদের সংশয় ও সন্দেহ থেকে মুক্ত হবে। ঈশ্বর নীরবে মানুষের জন্য সমস্তকিছু করছেন, তাঁর আন্তরিকতা, বিশ্বস্ততা, ও প্রেমের মাধ্যমে নীরবে সবকিছু করে চলেছেন। কিন্তু তিনি যা করেন তার জন্য তাঁর মনে কখনোই কোনো আশঙ্কা বা অনুতাপ নেই, বা তিনি কখনোই চান না কেউ কোনোভাবে তাঁকে পরিশোধ করুক, বা মানবজাতির কাছ থেকে কখনোই কিছু গ্রহণ করার অভিপ্রায় তাঁর নেই। তিনি যা কিছু করেছেন, তার একমাত্র লক্ষ্য হল মানবজাতির প্রকৃত বিশ্বাস ও ভালোবাসা অর্জন করা। এর সাথেই, প্রথম বিষয়বস্তু সম্পর্কে আলোচনা এখানেই সমাপ্ত করলাম।

এই আলোচনাগুলো কি তোমাদের সাহায্য করেছে? এগুলো কতটা সহায়ক হয়েছে? (আমরা ঈশ্বরের ভালোবাসা সম্পর্কে আরো ভালো উপলব্ধি ও জ্ঞান অর্জন করেছি।)(আলোচনার এই পদ্ধতি ভবিষ্যতে আমাদের সহায়ক হতে পারে ঈশ্বরের বাক্যকে আরো ভালোভাবে উপলব্ধি করতে, তাঁর আবেগকে, এবং তিনি যে বিষয়গুলো যখন বলেছেন তখন সেগুলোর অর্থ কী ছিল তা অনুধাবন করতে, এবং তাঁর সেই সময়ের অনুভুতির বিষয়ে চেতনালাভ করতে।) এই বাক্যগুলো পাঠের পর, তোমাদের মধ্যে কেউ কি ঈশ্বরের প্রকৃত অস্তিত্ব সম্বন্ধে আরো সম্যকভাবে সচেতন হয়েছ? তোমরা কি অনুভব করছ যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব আর শূন্যগর্ভ ও অস্পষ্ট নয়? একবার এই অনুভূতি লাভের পর, তোমরা কি উপলব্ধি করতে পারছ যে ঈশ্বর তোমাদের পাশেই রয়েছেন? হয়তো এই মুহূর্তে সেই অনুভূতি স্পষ্ট নয়, বা এক্ষুনি তা অনুভবে তোমরা সমর্থ না-ও হতে পারো। কিন্তু একদিন, যেদিন তুমি বস্তুতই ঈশ্বরের স্বভাব ও সারসত্যের বিষয়ে গভীর উপলব্ধি ও প্রকৃত জ্ঞান ধারণ করবে আপন হৃদয়ে, সেদিন তুমি উপলব্ধি করবে, যে ঈশ্বর তোমার পাশেই রয়েছেন—কিন্তু তুমিই কখনো অকৃত্রিমভাবে ঈশ্বরকে নিজের হৃদয়ে গ্রহণ করোনি। এবং এটাই সত্য!

আলোচনার এই ধরন সম্পর্কে তোমাদের কী মতামত? তোমরা কি এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছ? তোমরা কি মনে করো যে ঈশ্বরের কাজ ও ঈশ্বরের স্বভাব সম্পর্কে এই ধরনের আলোচনা খুব গুরুগম্ভীর হয়ে যাচ্ছে? তোমরা কেমন অনুভব করছ? (খুব ভালো, আমরা উত্তেজিত বোধ করছি।) কেন তোমাদের খুব ভালো মনে হচ্ছে? কেন তোমরা উত্তেজিত? (ঠিক যেন এদন উদ্যানে ঈশ্বরের পাশে ফিরে যাওয়ার মতো মনে হচ্ছিল।) “ঈশ্বরের স্বভাব” আসলে মানুষের কাছ অপরিচিত বিষয়, কারণ তোমরা সচরাচর যা কল্পনা করো, এবং তোমরা বইতে যা পাঠ করো বা আলোচনায় যা শোনো, তা তোমাদের মনে যে অনুভূতি জাগিয়ে তোলে তা অন্ধের হস্তীদর্শনের শামিল—তুমি শুধু স্পর্শ দিয়ে অনুভব করছ, কিন্তু আসলে তোমার মনে কোনো ছবিই ফুটে উঠছে না। অন্ধের মতো চারদিকে হোঁচট খেলে তুমি ঈশ্বর সম্বন্ধে এমনকি একটা মোটামুটি ধারণাও পাবে না, তাঁর সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা অর্জন তো দূরস্থান; এটা শুধুমাত্র তোমার কল্পনায় ইন্ধন যোগাবে, এবং তোমাকে ঈশ্বরের স্বভাব ও সারসত্য সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে বাধা দেবে, এবং তোমার কল্পনা থেকে উদ্ভূত অনিশ্চয়তাগুলো তোমার হৃদয়কে অবশ্যম্ভাবীরূপে সংশয়পূর্ণ করবে। তুমি যখন কোনোকিছু সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে পারবে না, অথচ তা উপলব্ধির চেষ্টা চালিয়ে যাবে, তখন সর্বদাই তোমার হৃদয়ে পরস্পরবিরোধিতা ও মতবিরোধ দেখা দেবে, এবং এমনকি একটা অশান্ত অনুভূতিও তৈরি হবে, যা তোমাকে বিভ্রান্ত ও দ্বিধাগ্রস্থ করে ফেলবে। ঈশ্বরের অন্বেষণ করতে চাওয়া, ঈশ্বরকে জানতে চাওয়া, এবং তাঁকে স্পষ্টভাবে দেখার বাসনা থাকা সত্ত্বেও কখনোই উত্তর খুঁজে পেতে সক্ষম না হওয়া, এ কি যন্ত্রণাদায়ক নয়? অবশ্যই, এইসকল বাক্য শুধু তাদের প্রতিই নির্দেশিত, যারা ঈশ্বরকে ভয়মিশ্রিত সম্মান ও পরিতুষ্ট করার অন্বেষণ করতে আকাঙ্খা করে। যে সকল মানুষ এই ধরনের বিষয়গুলোর প্রতি বিন্দুমাত্র মনোযোগ দেয় না, তাদের কাছে এর কোনো গুরুত্ব নেই, কারণ তারা সবচেয়ে বেশি যা আশা করে তা হল ঈশ্বরের বাস্তবতা এবং অস্তিত্ব শুধুমাত্র কিংবদন্তী বা কল্পনাতেই থাকুক, যাতে তারা যথেচ্ছাচার করতে পারে, যাতে তারা সবচেয়ে বড় ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, যাতে তারা পরিণামের কথা না ভেবে যদৃচ্ছ মন্দ কর্ম সংঘটন করতে পারে, যাতে তাদের কোনো শাস্তির সম্মুখীন হতে না হয় বা কোনো দায়িত্ব বহন করতে না হয়, এবং যাতে মন্দ কর্ম সংঘটনকারীদের বিষয়ে ঈশ্বর যা বলেন, তা তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না হয়। এইসব মানুষ ঈশ্বরের স্বভাব অনুধাবন করতে ইচ্ছুক নয়। তারা ঈশ্বরকে ও তাঁর সম্বন্ধে সবকিছু জানার চেষ্টা করার বিষয়ে বীতশ্রদ্ধ ও ক্লান্ত। ঈশ্বরের অস্তিত্ব না থাকাই তারা শ্রেয় মনে করে। এইসব মানুষ ঈশ্বরের বিরোধিতা করে, এবং তারা সেই সকল মানুষের অন্তর্ভুক্ত, যাদের পরিত্যাগ করা হবে।

এবার আমরা নোহের আখ্যান নিয়ে আলোচনা করব এবং দেখব যে এই আখ্যান কীভাবে ঈশ্বরের কর্ম, ঈশ্বরের স্বভাব, এবং স্বয়ং ঈশ্বর—এই বিষয়টার সঙ্গে যুক্ত।

শাস্ত্রের এই অংশে ঈশ্বরকে তোমরা নোহের প্রতি কী করতে দেখো? এখানে যারা বসে রয়েছ, তারা সকলেই হয়তো শাস্ত্রপাঠের ফলে এই বিষয়ে কিছু না কিছু জানো: ঈশ্বর নোহকে দিয়ে একটা জাহাজ নির্মাণ করান, তারপর এক প্রবল বন্যার মাধ্যমে ঈশ্বর এই পৃথিবীকে ধ্বংস করে দেন। ঈশ্বর নোহকে দিয়ে এই জাহাজ নির্মাণ করান যাতে সে তার আট-সদস্যের পরিবারকে উদ্ধার করতে পারে, যার ফলে তারা বেঁচে যায় এবং পরবর্তী প্রজন্মের মানবজাতির পূর্বপুরুষ হয়ে ওঠে। এবার শাস্ত্রে চোখ বুলানো যাক।

খ. নোহ

১. ঈশ্বর বন্যার মাধ্যমে পৃথিবীকে ধ্বংস করে দেওয়ার অভিপ্রায় করেন এবং নোহকে একটা জাহাজ নির্মাণের নির্দেশ দেন

আদিপুস্তক ৬:৯-১৪ নোহের কাহিনী: নোহ তখনকার লোকদের মধ্যে ধার্মিক ও সিদ্ধপুরুষ ছিলেন। তিনি ঈশ্বরের সান্নিধ্যে জীবন যাপন করতেন। নোহের তিন পুত্র ছিল, শেম, হাম ও যাফত। সেই সময় পৃথিবী ঈশ্বরের দৃষ্টিতে ভ্রষ্ট ও দৌরাত্মে পরিপূর্ণ ছিল। ঈশ্বর পৃথিবীর প্রতি দৃষ্টিপাত করে দেখলেন, পৃথিবী ভ্রষ্ট হয়েছে, কারণ পৃথিবীর সমস্ত মানুষই তখন বিপথগামী হয়েছিল। ঈশ্বর নোহকে বললেন, আমি দেখছি পৃথিবীর সকল প্রাণীর অন্তিম কাল ঘনিয়ে এসেছে, তাদের দৌরাত্ম্যে পৃথিবী আজ পরিপূর্ণ। দেখ, আমি পৃথিবীর সঙ্গে সঙ্গে তাদেরও ধ্বংস করব। তুমি গোফর কাঠের একটি জাহাজ তৈরী কর। কাঠের লম্বা ফালি দিয়ে সেটি তৈরী করবে এবং তার ভিতরে ও বাইরে আলকাতরার প্রলেপ দেবে।

আদিপুস্তক ৬:১৮-২২ কিন্তু তোমার সঙ্গে আমি এক সম্বন্ধ স্থাপন করব। তুমি নিজের স্ত্রী, পুত্র ও পুত্রবধূদের সঙ্গে নিয়ে জাহাজে প্রবেশ করবে। আর সমস্ত জাতের জীবজন্তুর মধ্য থেকে স্ত্রী ও পুরুষ এক এক জোড়া সংগ্রহ করে তাদের প্রাণ রক্ষার জন্য নিজের সঙ্গে জাহাজে নেবে। সকল জাতের পাখী, পশু ও ভূচর সরীসৃপ প্রাণ রক্ষার জন্য তোমার সঙ্গে জাহাজে প্রবেশ করবে। তোমার ও তাদের খাওয়ার জন্য সব রকমের খাদ্যবস্তু সংগ্রহ করে মজুত করে রাখবে। নোহ ঈশ্বরের নির্দেশ অনুযায়ী সব কাজই করলেন।

এই দুটো অনুচ্ছেদ পড়ার পর নোহ কে ছিলেন সে সম্বন্ধে এখন তোমাদের একটা সাধারণ ধারণা তৈরি হয়েছে তো? নোহ কেমন মানুষ ছিল? মূল পাঠ বলে: “নোহ তখনকার লোকদের মধ্যে ধার্মিক ও সিদ্ধপুরুষ ছিলেন”। আধুনিক মানুষের উপলব্ধি অনুযায়ী, ঠিক কোন ধরনের ব্যক্তিকে তখনকার দিনে “ধার্মিক মানুষ” বলা হত? একজন ধার্মিক মানুষকে একজন নিখুঁত মানুষ হতে হবে। সেই নিখুঁত মানুষ মানুষের চোখে নিখুঁত ছিল, না ঈশ্বরের চোখে, তা কি তোমরা জানো? সন্দেহাতীতভাবেই, সেই নিখুঁত মানুষ ছিল ঈশ্বরের চোখে একজন নিখুঁত মানুষ, মানুষের চোখে নয়। এমনটা নিশ্চিত! কারণ মানুষ অন্ধ এবং তারা দেখতে পায় না, এবং শুধুমাত্র ঈশ্বরই সমগ্র পৃথিবী ও প্রতিটা মানুষকে দেখেন, এবং একমাত্র ঈশ্বরই জানতেন যে নোহ একজন নিখুঁত মানুষ। যে মুহূর্তে ঈশ্বর নোহকে দেখলেন, সেই মুহূর্ত থেকেই বন্যার মাধ্যমে পৃথিবীকে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য তাঁর পরিকল্পনার সূত্রপাত ঘটল।

সেই যুগে, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ করার জন্য ঈশ্বর নোহকে অহ্বান করবেন বলে মনস্থ করলেন। কেন সেই কাজটা করতে হত? কারণ সেই মুহূর্তে ঈশ্বরের অন্তঃকরণে একটা পরিকল্পনা ছিল। তাঁর পরিকল্পনা ছিল এক বন্যার মাধ্যমে পৃথিবীকে ধ্বংস করে দেওয়া। কেন তিনি পৃথিবীকে ধ্বংস করবেন? এখানে বলা রয়েছে: “সেই সময় পৃথিবী ঈশ্বরের দৃষ্টিতে ভ্রষ্ট ও দৌরাত্মে পরিপূর্ণ ছিল”। “পৃথিবী... দৌরাত্মে পরিপূর্ণ ছিল”—বাক্যবন্ধ থেকে তোমরা কী ধারণা করো? পৃথিবীর উপর তা ছিল এমন এক ঘটনা, যেখানে বিশ্ব ও বিশ্বের মানুষ চূড়ান্তভাবে ভ্রষ্ট হয়েছিল; সুতরাং, “পৃথিবী... দৌরাত্মে পরিপূর্ণ ছিল”। আজকের ভাষায়, “দৌরাত্মে পরিপূর্ণ”-র অর্থ হল সবকিছুই বিশৃঙ্খল। মানুষের কাছে এর অর্থ হল জীবনের সর্ব ক্ষেত্রে শৃঙ্খলার সাদৃশ্যটুকুও হারিয়ে গিয়েছিল, সব কিছুই বিশৃঙ্খল ও অনিয়ন্ত্রণীয় হয়ে উঠেছিল। ঈশ্বরের চোখে এর অর্থ ছিল যে পৃথিবীর মানুষ অত্যন্ত ভ্রষ্ট হয়ে পড়েছে। কিন্তু কতটা মাত্রায় ভ্রষ্ট? এত মাত্রায় ভ্রষ্ট যে ঈশ্বর আর সেই দৃশ্য সহ্য করতে, বা তাদের প্রতি ধৈর্য বজায় রাখতে পারছিলেন না। এতটা মাত্রায় ভ্রষ্ট যে, ঈশ্বর তাদের ধ্বংস করে দেওয়ার অভিপ্রায় পোষণ করেছিলেন। ঈশ্বর যখন এই পৃথিবীকে ধ্বংস করে দেওয়ার সংকল্প নিয়েছিলেন, তখন একটা জাহাজ নির্মাণের জন্য কোনো একজনকে খুঁজে নেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। এই কার্য সাধনের জন্য ঈশ্বর নোহকে মনোনীত করলেন; অর্থাৎ, তিনি নোহকে দিয়ে একটা জাহাজ নির্মাণ করালেন। তিনি নোহকে কেন মনোনীত করেছিলেন? ঈশ্বরের চোখে, নোহ ছিলেন একজন ধার্মিক মানুষ; ঈশ্বর তাকে যে কাজেরই নির্দেশ দিতেন, নোহ তা-ই পালন করত। অর্থাৎ বলা যেতে পারে যে ঈশ্বর তাকে যা-ই করতে বলুন নোহ তা করতে ইচ্ছুক ছিল। ঈশ্বর এরকম একজন মানুষকেই খুঁজতে চেয়েছিলেন যে তাঁর সঙ্গে কাজ করবে, তাঁর অর্পিত কর্মভার সম্পন্ন করবে—পৃথিবীতে তাঁর কাজ সম্পূর্ণ করবে। সেই সময়, নোহ ব্যতীত অন্য কোনো ব্যক্তি কি ছিল, যে এই রকম একটা কাজ সম্পন্ন করতে পারত? অবশ্যই না! নোহ ছিল একমাত্র প্রার্থী, একমাত্র ব্যক্তি যে ঈশ্বরের অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে পারত, এবং তাই ঈশ্বর তাকে মনোনীত করেছিলেন। কিন্তু সেই সময় মানুষকে উদ্ধারের জন্য ঈশ্বরের যে সীমারেখা ও মাপকাঠি ছিল, তা কি এখনও একই রয়েছে? উত্তরটা হল, অবশ্যই একটা পার্থক্য আছে! আমি কেন এ কথা জিজ্ঞাসা করছি? সেই সময়ে ঈশ্বরের চোখে একমাত্র নোহই ধার্মিক ব্যক্তি ছিল, যার অর্থ হল, তার স্ত্রী বা তার কোনো পুত্র বা কোনো পুত্রবধূই ধার্মিক ব্যক্তি ছিল না, কিন্তু নোহর কারণে ঈশ্বর তাদের অব্যাহতি দেন। ঈশ্বর এখন যেভাবে দাবি করেন সেভাবে তিনি তাদের কাছ থেকে কোনো দাবি করেননি, এবং তার পরিবর্তে, নোহর পরিবারের আটজন সদস্যকেই তিনি জীবিত রেখেছিলেন। নোহর ন্যায়পরায়ণতার কারণে তারা ঈশ্বরের আশীর্বাদ লাভ করেছিল। নোহ ছাড়া তাদের কেউই ঈশ্বরের অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে পারত না। তাই নোহই একমাত্র ব্যক্তি যার পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পরও বেঁচে যাওয়ার কথা ছিল, বাকিরা শুধুমাত্র পারিপার্শ্বিক কারণবশত সুবিধা পেয়েছিল। এর মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে, ঈশ্বর আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁর পরিচালনামূলক কার্য আরম্ভ করার পূর্বের যুগে যে নীতি ও মাপকাঠি নিয়ে মানুষের সঙ্গে আচরণ করতেন ও দাবি জানাতেন, তা ছিল অপেক্ষাকৃতভাবে শিথিল। ঈশ্বর নোহর আট-সদস্যভুক্ত পরিবারের সঙ্গে যেভাবে আচরণ করেছিলেন, তা আজকের দিনের মানুষের কাছে “নিরপেক্ষতার” অভাব বলে মনে হয়। কিন্তু মানুষের উপর যে বিপুল পরিমাণ কাজ তিনি এখন করেন, এবং এবং তিনি এখন যে বিপুল সংখ্যক বাক্য প্রচার করেন তার সাথে তুলনা করলে, তাঁর সেই সময়ের কর্মের কর্মের প্রেক্ষাপটে নোহর আটজনের পরিবারের সঙ্গে তাঁর আচরণ ছিল নিছকই এক কর্মসংক্রান্ত নীতি। তুলনামূলক বিচারে, নোহর আটজনের পরিবার ঈশ্বরে কাছ থেকে বেশি অর্জন করেছে, নাকি বর্তমানের মানুষ বেশি অর্জন করে?

নোহকে যে আহ্বান করা হয়েছিল, সেটা একটা সাধারণ ঘটনা, কিন্তু আমাদের আলোচনার মূল বিষয়, অর্থাৎ এই ঘটনায় প্রকাশিত ঈশ্বরের স্বভাব, তাঁর ইচ্ছা, ও তাঁর সারসত্য, তা তত সরল নয়। ঈশ্বরের এই বিভিন্ন দিকগুলো উপলব্ধি করতে গেলে, আমাদের প্রথমে উপলব্ধি করতে হবে কোন ধরনের ব্যক্তিকে ঈশ্বর আহ্বান করতে ইচ্ছা করেন, এবং এর মাধ্যমেই তাঁর স্বভাব, ইচ্ছা, ও সারসত্য উপলব্ধি করতে হবে। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাহলে, ঈশ্বরের চোখে সেই মানুষটা ঠিক কীরকম যাকে তিনি আহবান করেন? তাকে অবশ্যই হতে হবে এমন একজন ব্যক্তি, যে তাঁর বাক্য শুনতে পারে, এবং যে তাঁর নির্দেশ অনুসরণ করতে পারে। একইসঙ্গে, তাকে এমন একজন ব্যক্তিও হতে হবে যার একটা দায়িত্ববোধ রয়েছে, এমন একজন যে ঈশ্বরের বাক্যকে অবশ্যপূরণীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য হিসাবে বিবেচনা করে পালন করবে। তাকে কি এমন কোনো ব্যক্তি হতে হবে যে ঈশ্বরকে জানে? না। সেই সময়ে, নোহ ঈশ্বরের শিক্ষার বেশি কিছু শোনেনি, বা ঈশ্বরের কোনো কাজের অভিজ্ঞতাও লাভ করেনি। সুতরাং, ঈশ্বর সম্বন্ধে নোহর জ্ঞান ছিল খুবই স্বল্প। যদিও লিপিবদ্ধ রয়েছে যে নোহ ঈশ্বরের সঙ্গে পথ চলেছিল, কিন্তু সে কি কখনও ঈশ্বরের ছবি প্রত্যক্ষ করেছিল? উত্তরটা হল, অবশ্যই না। কারণ সেইসময়, শুধুমাত্র ঈশ্বরের বার্তাবাহকরাই মানুষের মধ্যে আসত। কথন বা কার্যে তারা ঈশ্বরের প্রতিনিধিত্ব করতে পারলেও, তারা নিছকই ঈশ্বরের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়গুলোকেই জ্ঞাপন করত। ঈশ্বরের ছবি মানুষের সামনাসামনি উন্মোচিত হয়নি। শাস্ত্রের এই অংশে আমরা মূলত দেখি নোহকে কী করতে হয়েছিল, এবং তার প্রতি ঈশ্বরের নির্দেশগুলো কী ছিল। সুতরাং, এখানে ঈশ্বর কোন সারসত্য প্রকাশ করেছেন? ঈশ্বর যা করেন, তা সকলই অত্যন্ত নিখুঁত ভাবে পরিকল্পিত। তিনি যখন দেখেন যে কোনো ঘটনা বা পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে, তখন তাঁর চোখে সেই ঘটনা বা পরিস্থিতির পরিমাপের একটা মাপকাঠি থাকে, এবং সেই মাপকাঠিই নির্ধারণ করে যে তিনি এর মোকাবিলায় কোনো পরিকল্পনার সূচনা করবেন কি না, বা এই ঘটনা বা পরিস্থিতির মোকাবিলায় কী ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণীয়। তিনি উদাসীন নন, বা সকল বস্তুর প্রতি তাঁর অনুভূতিতে কোনো ঘাটতি নেই। বস্তুত, বিষয়টা ঠিক তার বিপরীত। এখানে একটা স্তবক রয়েছে যাতে বলা আছে ঈশ্বর নোহকে কী বলেছেন: “আমি দেখছি পৃথিবীর সকল প্রাণীর অন্তিম কাল ঘনিয়ে এসেছে, তাদের দৌরাত্ম্যে পৃথিবী আজ পরিপূর্ণ। দেখ, আমি পৃথিবীর সঙ্গে সঙ্গে তাদেরও ধ্বংস করব”। ঈশ্বর যখন এই বাক্য বলেছিলেন, তখন কি তিনি বুঝিয়েছিলেন যে তিনি শুধুমাত্র মনুষ্যজাতিকেই ধ্বংস করবেন? না! ঈশ্বর বলেছিলেন যে, তিনি সকল জীবিত প্রাণীকে ধ্বংস করবেন। ঈশ্বর কেন ধ্বংস চেয়েছিলেন? এখানে ঈশ্বরের স্বভাবের আরো একটা উদ্‌ঘাটন রয়েছে, ঈশ্বরের চোখে মানুষের অনাচারের প্রতি, এবং সমস্ত প্রাণীর কলুষতা, দৌরাত্ম্য ও অবাধ্যতার প্রতি ঈশ্বরের ধৈর্যের একটা সীমা রয়েছে। কী সেই সীমা? ঈশ্বর এভাবে বলছেন: “ঈশ্বর পৃথিবীর প্রতি দৃষ্টিপাত করে দেখলেন, পৃথিবী ভ্রষ্ট হয়েছে, কারণ পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীই তখন বিপথগামী হয়েছিল”। “কারণ পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীই তখন বিপথগামী হয়েছিল”—এই কথার অর্থ কী? এর অর্থ হল, যেকোনো জীবিত বস্তু, এর মধ্যে তারাও রয়েছে যারা ঈশ্বরকে অনুসরণ করত, যারা ঈশ্বরের নাম ভজনা করত, যারা একসময় ঈশ্বরকে অগ্নিদগ্ধ উৎসর্গ করেছিল, যারা মৌখিক ভাবে ঈশ্বরকে স্বীকার করেছিল এবং এমনকি ঈশ্বরের স্তুতিও করেছিল—একসময় তাদের আচরণ অনাচারে পরিপূর্ণ হয়ে যায়, এবং তা ঈশ্বরের দৃষ্টিগোচর হয়, তাঁকে এদের ধ্বংস করতেই হত। সেটাই ছিল ঈশ্বরের সীমা। তাই কতদূর পর্যন্ত মানুষের প্রতি ও সমস্ত প্রাণীর অনাচারের প্রতি ঈশ্বর ধৈর্যশীল ছিলেন? ততক্ষণ পর্যন্ত, যতক্ষণ না ঈশ্বরের অনুগামী ও অবিশ্বাসী নির্বিশেষে সমস্ত মানুষ সঠিক পথ থেকে সরে আসে। ততক্ষণ পর্যন্ত, যতক্ষণ না মানুষ যে শুধুমাত্র নৈতিকভাবে ভ্রষ্ট ও মন্দত্বে পরিপূর্ণ হয়ে পড়েছিল তা-ই নয়, বরং ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করার জন্য কেউই অবশিষ্ট ছিল না, ঈশ্বরই যে এই বিশ্বের শাসনকর্তা এবং তিনিই যে মানুষকে আলোর মধ্যে ও সঠিক পথে আনতে পারেন, তা বিশ্বাস করার মতো মানুষ অবশিষ্ট থাকা তো দূরের কথা। ততক্ষণ পর্যন্ত, যতক্ষণ না মানুষ ঈশ্বরের অস্তিত্বে ঘৃণা করেছিল, এবং ঈশ্বরের অস্তিত্বকে না-মঞ্জুর করেছিল। মানুষে অনাচার এই মাত্রায় পৌঁছনোর পর ঈশ্বর আর তা সহ্য করতে পারেননি। কীসের দ্বারা তা প্রতিস্থাপিত হতে পারতো? ঈশ্বরের ক্রোধ ও ঈশ্বরের শাস্তির আগমনের দ্বারা। তা কি ঈশ্বরের স্বভাবের আংশিক প্রকাশ ছিল না? বর্তমান এই যুগে, এমন কোনো মানুষ কি নেই, যারা ঈশ্বরের চোখে ধার্মিক? এমন কোনো মানুষ কি নেই, যারা ঈশ্বরের চোখে নিখুঁত? এই যুগ কি তেমনই এক যুগ, যেখানে ঈশ্বরের চোখে পৃথিবীর সকল প্রাণীর আচরণ কলুষে পরিপূর্ণ? এই সময়ে ওএই যুগে, যাদের ঈশ্বর সম্পূর্ণ করে তুলতে চান, এবং যারা ঈশ্বরকে অনুসরণ ও তাঁর পরিত্রাণ গ্রহণ করতে পারে, তারা ব্যতীত আর সকলেই কি ঈশ্বরের ধৈর্যের সীমাকে পরীক্ষা করছে না? তোমাদের চারপাশে যাকিছু ঘটে—যাকিছু তোমরা নিজেদের চোখে দেখো, নিজেদের কানে শোনো, এই জগতে প্রতিদিন ব্যক্তিগতভাবে যাকিছুর অভিজ্ঞতা লাভ করো—তা সকলই কি হিংসায় পরিপূর্ণ নয়? ঈশ্বরের চোখে, এমন এক বিশ্বের, এমন এক যুগের, বিলোপসাধনই কি কাম্য নয়? যদিও বর্তমান যুগের পটভূমি নোহর যুগের পটভূমির চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন, কিন্তু মানুষের অনাচারের প্রতি ঈশ্বরের অনুভূতি ও ক্রোধ অবিকল একই রয়েছে। ঈশ্বর তাঁর কাজের কারণে ধৈর্যশীল হতে সক্ষম, কিন্তু পরিবেশ ও পরিস্থিতির নিরিখে এই পৃথিবীর অনেক আগেই ধ্বংস হয়ে যাওয়া উচিত ছিল। বন্যার দ্বারা এই পৃথিবীকে যখন ধ্বংস করা হয়েছিল, তখনকার পরিস্থিতিকে বর্তমান পরিস্থিতি বহুদূর অতিক্রম করে গেছে। কিন্তু পার্থক্যটা কী? এটা আবার সেই বিষয়ও যা ঈশ্বরের হৃদয়কে সবচেয়ে ভারাক্রান্ত করে, এবং হয়তো তা এমন কিছু যা তোমরা কেউই অনুধাবন করতে পারো না।

তিনি যখন বন্যার দ্বারা এই পৃথিবীকে ধ্বংস করেছিলেন, তখন তিনি একটা জাহাজ নির্মাণ ও কিছু প্রস্তুতিমূলক কার্য সম্পাদনের জন্য নোহকে আহ্বানে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর জন্য এই ধারাবাহিক কাজগুলো সম্পন্ন করার জন্য একজন মানুষকে—নোহকে—আহ্বান করতে পেরেছিলেন। কিন্তু বর্তমান যুগে এমন কোনো মানুষ নেই যাকে ঈশ্বর আহ্বান করতে পারেন। কিন্তু কেন? যারা এখানে বসে রয়েছে, তাদের প্রত্যেকেই সম্ভবত খুব ভালো করে কারণটা উপলব্ধি করে ও জানে। তোমরা কি চাও যে আমি তা উচ্চারণ করি। তা করলে হয়তো তোমাদের সম্মানহানি ঘটবে, এবং সকলে মর্মাহত হবে। কেউ কেউ হয়তো বলবে: “যদিও আমরা ধার্মিক ব্যক্তি নই, এবং আমরা ঈশ্বরের চোখে নিখুঁত মানুষ নই, কিন্তু ঈশ্বর যদি আমাদের কোনো কার্য সম্পাদনের নির্দেশ দিতেন, তা সত্ত্বেও আমরা তা করতে সক্ষম হতাম। আগে, তিনি যখন বলেছিলেন যে একটা ভয়াবহ বিপর্যয় আসছে, তখন আমরা খাদ্যসামগ্রী ও অন্যান্য দ্রব্য তৈরি করতে শুরু করে দিয়েছিলাম, যা বিপর্যয়ের সময় কাজে লাগবে। এই সবকিছুই কি ঈশ্বরের দাবিগুলোর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ভাবে সম্পন্ন করা হয়নি? আমরা কি প্রকৃতই ঈশ্বরের কর্মের সঙ্গে সহযোগিতা করিনি? আমরা যা করেছি, তা কি নোহর কাজের সঙ্গে তুলনীয় নয়? আমরা যা করেছি, তা করা কি প্রকৃত আনুগত্য নয়? আমরা কি ঈশ্বরের নির্দেশ অনুসরণ করিনি? ঈশ্বরের বাক্যের উপর বিশ্বাস রয়েছে বলেই কি আমরা ঈশ্বর যা বলেছেন তা করিনি? তাহলে ঈশ্বর এখনও কেন মর্মাহত? ঈশ্বর কেন বলেন যে তাঁর আহবান করার মতো কেউ নেই?” তোমাদের ও নোহর কার্যকলাপের মধ্যে কি কোনো পার্থক্য রয়েছে? কী সেই পার্থক্য? (বিপর্যয়ের জন্য বর্তমানে খাদ্য প্রস্তুত করাটা আমাদের নিজস্ব অভিপ্রায় ছিল।) (আমাদের কাজ “ধার্মিক” হিসাবে গণ্য হতে পারে না, অথচ ঈশ্বরের চোখে নোহ একজন ধার্মিক মানুষ ছিল।) তোমরা যা বলেছ তা খুব একটা অপ্রাসঙ্গিক নয়। নোহ যা করেছিল, তা বর্তমানে মানুষ যা করছে তার তুলনায় মূলত ভিন্ন। নোহ যখন ঈশ্বরের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করেছিল, তখন সে জানত না ঈশ্বরের অভিপ্রায় কী। সে জানত না ঈশ্বর কী সম্পাদন করতে চান। ঈশ্বর তাকে শুধুমাত্র একটা আদেশ দিয়েছিলেন ও তাকে কিছু কাজ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন, এবং নোহ বিশেষ কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই সেই কাজে প্রবৃত্ত হয় ও তা সম্পন্ন করে। সে গোপনে ঈশ্বরের অভিপ্রায় খুঁজে বার করার চেষ্টা করেনি, বা ঈশ্বরকে প্রতিরোধ করেনি, বা আন্তরিকতার অভাব দেখায়নি। সরল ও বিশুদ্ধ চিত্তে সে শুধু সেইমতো কার্য সাধন করেছিল। ঈশ্বর তাকে যে কাজই করতে বলেছিলেন, সে তা করেছিল, এবং সে যা করেছিল, ঈশ্বরের বাক্যকে মান্য করা ও শোনাই ছিল সেই কাজের উপর তার বিশ্বাসের ভিত্তি। এমন অকপট ও সহজ ভাবেই সে ঈশ্বরের অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছিল। তার সারসত্য, তার কর্মের সারসত্য, ছিল আনুগত্য, অনুমান না করা, প্রতিরোধ না করা, এবং সর্বোপরি, ব্যক্তিগত স্বার্থ বা নিজস্ব লাভ-ক্ষতির কথা না ভাবা। উপরন্তু, ঈশ্বর যখন বললেন যে, এক বন্যা দিয়ে তিনি এই পৃথিবীকে ধ্বংস করে দেবেন, তখন সে প্রশ্ন করেনি কবে, বা এ-ও জিজ্ঞাসা করেনি যে সমস্ত জিনিসের কী পরিণতি হবে, এবং সে অবশ্যই ঈশ্বরকে এই প্রশ্নটাও করেনি যে তিনি কীভাবে এই পৃথিবীকে ধ্বংস করতে চলেছেন। সে শুধু ঈশ্বরের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করে গিয়েছিল। সে ঈশ্বরের ইচ্ছা অনুযায়ী যথাযথ উপায় ও প্রকরণ ব্যবহার করে অবিলম্বে তার কাজ আরম্ভ করে দিয়েছিল। ঈশ্বরকে তুষ্ট করার মনোভাব নিয়ে ঈশ্বরের নির্দেশ অনুসারে সে কাজ করেছিল। সে কি এই কাজ করছিল যাতে সে নিজে বিপর্যয় এড়িয়ে যেতে পারে? না। সে কি ঈশ্বরকে জিজ্ঞাসা করেছিল যে বিশ্ব আর কত সময় পর ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে? না, সে তা করেনি। সে কি ঈশ্বরকে জিজ্ঞাসা করেছিল, বা সে কি জানত, যে সেই জাহাজ নির্মাণ করতে কত সময় লাগবে? সে নিজেও তা জানত না। সে শুধু নির্দেশ মান্য করেছিল, শুনেছিল ও সেইমতো কাজ করেছিল। কিন্তু বর্তমান যুগে মানুষ এরকম নয়: ঈশ্বরের বাক্যের মাধ্যমে কোনো একটা তথ্য ফাঁস হওয়া মাত্র, বাতাসে পাতার শনশন আওয়াজ টের পাওয়া মাত্রই, তারা অবিলম্বে কাজে লেগে পড়ে, যা-ই ঘটুক বা যতই মূল্য হোক, পরবর্তী সময়ে তারা কী পান, ভোজন, ও ব্যবহার করবে তা প্রস্তুত করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে, এমনকি যখন বিপর্যয় আসবে তখন কোন পথে তারা পালাবে সেই পরিকল্পনাও করতে থাকে। তার চেয়েও আকর্ষণীয় ব্যাপার হল, এই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে, মানুষের মস্তিষ্ক “কার্য সম্পন্ন করতে” খুবই দক্ষ। ঈশ্বর কোনো নির্দেশ দেননি এরকম কোনো পরিস্থিতিতে মানুষ যথাযথভাবে সমস্তকিছুর জন্য পরিপাটি পরিকল্পনা ছকে ফেলতে পারে। এরকম পরিকল্পনাগুলোকে বর্ণনা করার জন্য তোমরা “নিখুঁত” শব্দটা ব্যবহার করতে পারো। ঈশ্বর যা বলেন, ঈশ্বর যে অভিপ্রায় পোষণ করেন, বা ঈশ্বর যা চান, তা নিয়ে কেউ-ই চিন্তিত নয়, এবং কেউ-ই তা অনুধাবনের চেষ্টা করে না। এটাই কি বর্তমান যুগের মানুষ ও নোহর মধ্যে সবচেয়ে বড় পার্থক্য নয়?

নোহর কাহিনীর এই নথিতে তোমরা কি ঈশ্বরের স্বভাবের একটা অংশ দেখতে পাও? মানুষের অনাচার, কলুষতা ও হিংসার প্রতি ঈশ্বরের ধৈর্যের একটা সীমা রয়েছে। তিনি যখন সেই ধৈর্যের সীমায় উপনীত হবেন, তখন তিনি আর ধৈর্যশীল থাকবেন না, এবং পরিবর্তে, তাঁর নতুন ব্যবস্থাপনা ও নতুন পরিকল্পনা আরম্ভ করবেন, তাঁর করণীয় কার্যসকল নির্বাহ করা আরম্ভ করবেন, তাঁর কর্ম ও তাঁর স্বভাবের অন্য দিকটাকে প্রকাশ করবেন। তাঁর এই কাজ এটা প্রদর্শন করার জন্য নয় যে মানুষ কখনোই যেন তাঁকে ক্ষুব্ধ না করে, অথবা তিনি কর্তৃত্ব ও ক্রোধে পূর্ণ, এবং তা এটা দেখানোর জন্যও নয় যে তিনি মানবজাতিকে ধ্বংস করতে পারেন। বিষয়টা হল, তাঁর স্বভাব ও তাঁর পবিত্র সারসত্য এই ধরনের মানবজাতিকে তাঁর সম্মুখে ও তাঁর আধিপত্যের অধীনে বেঁচে থাকার আর অনুমতি দিতে পারে না, বা তাদের প্রতি ধৈর্যশীল হয়ে থাকতে পারে না। অর্থাৎ, যখন সমগ্র মানবজাতি তাঁর বিরুদ্ধে, যখন সারা পৃথিবীতে এমন কেউ নেই যাকে তিনি উদ্ধার করতে পারেন, তখন এহেন মানবজাতির প্রতি তাঁর আর কোনো ধৈর্য অবশিষ্ট থাকবে না, এহেন মানবজাতিকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে তাঁর পরিকল্পনাকে তিনি নিঃসংশয়ে বাস্তবায়িত করবেন। ঈশ্বরের এমন এক পদক্ষেপ তাঁর স্বভাবের দ্বারা নির্ধারিত হয়। এ হল এক আবশ্যক পরিণাম, এবং ঈশ্বরের আধিপত্যের অধীনে থাকা প্রত্যেক সৃষ্ট সত্তাকে এই পরিণাম বহন করতেই হবে। এর মাধ্যমে কি এটা বোঝা যায় না যে এই বর্তমান যুগে তাঁর পরিকল্পনাকে সম্পূর্ণ করার জন্য এবং তিনি যাদের উদ্ধার করতে চান তাদের উদ্ধারের জন্য ঈশ্বর আর অপেক্ষা করতে পারছেন না? এই পরিস্থিতিতে, কী নিয়ে ঈশ্বর সবচেয়ে বেশি ভাবনা করেন? যারা তাঁকে আদৌ অনুসরণ করে না বা যারা তাঁর বিরোধিতা করে, তারা তাঁর প্রতি কেমন আচরণ করে বা কীভাবে তাঁর প্রতিরোধ করে, বা মানবজাতি কীভাবে তাঁকে অপবাদ দেয়, তা নিয়ে তিনি ভাবিত নন। তিনি শুধু এই নিয়েই ভাবিত যে যারা তাঁকে অনুসরণ করে, যারা তাঁর পরিচালনামূলক পরিকল্পনায় তাঁর পরিত্রাণের লক্ষ্যবস্তু, তারা তাঁর দ্বারা সম্পূর্ণ হয়েছে কি না, তারা তাঁর সন্তুষ্টিবিধানের যোগ্য হয়েছে কি না। যারা তাঁকে অনুসরণ করে তাদের ছাড়া বাকি মানুষদের ক্ষেত্রে, তিনি শুধুমাত্র নিজের ক্রোধ প্রকাশ করতে মাঝেমাঝে শাস্তি প্রদান করেন। উদাহরণস্বরূপ: সুনামি, ভূমিকম্প, এবং আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত। একইসঙ্গে, তিনি অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে তাদের রক্ষা ও পরিচর্যা করে চলেছেন যারা তাঁকে অনুসরণ করে এবং যারা তাঁর দ্বারা উদ্ধার পেতে চলেছে। ঈশ্বরের স্বভাব এইরকম: একদিকে, যাদের তিনি সম্পূর্ণ করে তোলার অভিপ্রায় পোষণ করেন, তাদের প্রতি তাঁর অসীম ধৈর্য ও সহনশীলতা থাকতে পারে, এবং তাদের জন্য তিনি যথাসাধ্য প্রতীক্ষা করতে পারেন; অন্যদিকে, যে সকল শয়তানোচিত ব্যক্তি তাঁর অনুসরণ করে না ও তাঁর বিরোধিতা করে, তাদের তিনি মনেপ্রাণে ঘৃণা ও অপছন্দ করেন। যদিও এই শয়তানোচিত ব্যক্তিরা তাঁর অনুসরণ বা উপাসনা করল কি না সেবিষয়ে তিনি বিন্দুমাত্র ভাবিত নন, তবে তাঁর অন্তরে তাদের জন্য ধৈর্য থাকা সত্ত্বেও তিনি তাদের অপছন্দ করেন, এবং যখন তিনি এই শয়তানোচিত ব্যক্তিদের পরিণাম নির্ধারণ করেন, তিনি তাঁর পরিচালনামূলক পরিকল্পনার পদক্ষেপসমূহের আগমনের নিমিত্ত প্রতীক্ষারতও রয়েছেন।

এবার পরের অনুচ্ছেদটা পড়া যাক।

২. বন্যার পরে নোহকে ঈশ্বরের আশীর্বাদ

আদিপুস্তক ৯:১-৬ ঈশ্বর নোহ এবং তাঁর পুত্রদের আশীর্বাদ করে বললেন, তোমরা প্রজাবন্ত হও এবং বৃদ্ধিলাভ করে পৃথিবী পরিপূর্ণ কর। পৃথিবীর সকল পশু, আকাশের সকল পাখী, ভূচর যাবতীয় সরীসৃপ ও সমুদ্রের মৎস্যকুল তেমাদের ভয়ে ভীত ও সন্ত্রস্ত হবে। তোমাদের হাতেই তাদের সকলকে সমর্পণ করা হয়েছে। সঞ্চরণশীল সমস্ত প্রাণীই হবে তোমাদের ভক্ষ্য। হরিৎ উদ্ভিদ্‌রাজির মত সেগুলিও আমি তোমাদের দিলাম। কেবল তোমরা কাঁচা মাংস অর্থাৎ রক্তসমেত মাংস ভক্ষণ করো না। কারণ রক্তই জীবন। তোমাদের রক্তপাত ও জীবনহানির প্রতিশোধ আমি অবশ্যই নেব। কোন পশু যদি মানুষের রক্তপাত ঘটায়, আমি তার প্রতিশোধ নেব এবং মানুষের ক্ষেত্রে কেউ যদি অন্যের জীবনহানি করে তবে আমি তারও প্রতিশোধ নেব। মানুষের রক্তপাত যে করবে তারও রক্তপাত হবে মানুষের হাতে কারণ ঈশ্বরের সাদৃশ্যে সৃষ্ট হয়েছে মানুষ।

এই অনুচ্ছেদে তোমরা কী দেখতে পাচ্ছ? আমি কেন এই স্তবকগুলোকেই বেছে নিয়েছি? জাহাজে নোহ ও তার পরিবারের জীবন সম্পর্কে কোনো উদ্ধৃতি আমি কেন বেছে নিইনি? কারণ আমরা আজ যে বিষয়ে আলোচনা করছি তার সঙ্গে সেই তথ্যের খুব একটা বেশি সংযোগ নেই। যে বিষয়টার উপর আমরা মনোনিবেশ করছি তা হল ঈশ্বরের স্বভাব। তোমরা যদি ঐসব বিষয়ে বিশদ জানতে চাও তাহলে নিজেরা বাইবেল তুলে নিয়ে পাঠ করে দেখতে পারো। এখানে আমরা ঐসব বিষয়ে আলোচনা করব না। আজ আমরা মূল যে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করছি, তা হল কীভাবে ঈশ্বরের কার্য সম্বন্ধে জানা যেতে পারে।

নোহ যখন ঈশ্বরের নির্দেশ অনুযায়ী একটা জাহাজ নির্মাণ করল এবং যে দিনগুলোতে ঈশ্বর বন্যার মাধ্যমে পৃথিবীকে ধ্বংস করে দিলেন সেই দিনগুলো বেঁচে থাকল, তখন তার আটজনের পরিবার রক্ষা পেল। নোহর পরিবারভুক্ত আটজন সদস্য ব্যতীত সমগ্র মানবজাতি ধ্বংস হল, এবং পৃথিবীর সমস্ত জীবিত প্রাণীকুলও ধ্বংস হল। নোহকে ঈশ্বর আশীর্বাদ দিলেন, এবং তাঁকে ও তাঁর পুত্রদের কিছু বিষয়ে বললেন। সেগুলো ছিল সেইসকল বিষয় যা ঈশ্বর তার উপর অর্পণ করেছিলেন, এবং সেগুলো তার প্রতি ঈশ্বরের আশীর্বাদও ছিল। এই আশীর্বাদ ও প্রতিশ্রুতিই ঈশ্বর তাদের দেন যারা তাঁকে শুনতে পায় ও তাঁর নির্দেশ গ্রহণ করে, এবং এইভাবেই ঈশ্বর মানুষকে পুরস্কৃত করেন। অর্থাৎ, ঈশ্বরের চোখে নোহ একজন নিখুঁত মানুষ বা ধার্মিক মানুষ ছিল কি না, অথবা সে ঈশ্বর সম্বন্ধে কতটুকু জানত, তা নির্বিশেষে, সংক্ষেপে বলতে গেলে, সে ও তার তিন পুত্র ঈশ্বরের বাক্যগুলো পালন করেছিল, ঈশ্বরের কার্যের সঙ্গে সহযোগিতা করেছিল, এবং ঈশ্বেরের নির্দেশাবলির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ভাবে তাদের যা করণীয় তা করেছিল। এর ফলস্বরূপ, বন্যার অভিঘাতে এই পৃথিবীর ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে, তারা ঈশ্বরের জন্য মানবজাতি ও বিভিন্ন ধরনের প্রাণীকুলকে সংরক্ষণ করেছিল, ঈশ্বরের পরিচালনামূলক পরিকল্পনার পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল। যা কিছু সে করেছিল সেসবের কারণে ঈশ্বর তাকে আশীর্বাদ করেছিলেন। হয়তো আজকের মানুষের কাছে নোহ যা করেছিল তা এমনকি উল্লেখের যোগ্যও ছিল না। কেউ কেউ হয়তো এমনকি এমনও ভাবতে পারে: “নোহ কিছুই করেনি, তাকে অব্যাহতি দেবেন বলে ঈশ্বর মনস্থির করে রেখেছিলেন, তাই সে নিশ্চিতভাবেই রেহাই পেত। তার বেঁচে যাওয়াটা তার নিজের কর্মের কারণে নয়। ঈশ্বর এটাই ঘটাতে চেয়েছিলেন, কারণ মানুষ নিষ্ক্রিয়।” ঈশ্বর কিন্তু তেমনটা ভাবছিলেন না। ঈশ্বরের কাছে একজন মানুষ মহানই হোক বা অকিঞ্চিৎকর, যতক্ষণ তারা তাঁর বাক্য শুনছে, তাঁর নির্দেশ ও তাঁর অর্পিত দায়িত্ব পালন করছে, এবং তাঁর কর্ম, তাঁর অভিপ্রায়, ও তাঁর পরিকল্পনার সঙ্গে সহযোগিতা করতে পারছে, যাতে তাঁর অভিপ্রায় ও পরিকল্পনা মসৃণভাবে সম্পন্ন হতে পারে, ততক্ষণ তাদের সেই আচরণ তাঁর স্মরণে থাকার ও তাঁর আশীর্বাদ লাভের যোগ্য। এই ধরনের মানুষকে ঈশ্বর মূল্যবান মনে করেন, এবং তাদের তাদের কাজকর্ম এবং তাঁর প্রতি তাদের ভালোবাসা ও মমতাকে তিনি সযত্নে লালন করেন। এ-ই হল ঈশ্বরের মনোভাব। তাহলে কেন তিনি নোহকে আশীর্বাদ করেছিলেন? কারণ এভাবেই তিনি মানুষের এহেন ক্রিয়াকলাপ ও আনুগত্যকে বিবেচনা করেন।

নোহর প্রতি ঈশ্বরের আশীর্বাদের প্রসঙ্গে কেউ কেউ বলবে: “মানুষ যদি ঈশ্বরের যা বলছেন তা শোনে এবং ঈশ্বরকে সন্তুষ্ট করে, তবে ঈশ্বরের উচিত মানুষকে আশীর্বাদ করা। এমনটা কি বলাই বাহুল্য নয়?” আমরা কি একথা বলতে পারি? কিছু মানুষ বলবে: “না।” কেন আমরা একথা বলতে পারি না? কিছু মানুষ বলে: “মানুষ ঈশ্বরের আশীর্বাদ উপভোগের যোগ্য নয়।” এমনটা পুরোপুরি সঠিক নয়। কারণ ঈশ্বরের অর্পিত দায়িত্ব যখন একজন ব্যক্তি গ্রহণ করে, তখন তা বিচারের জন্য ঈশ্বরের একটা মাপকাঠি রয়েছে যে তাদের কাজকর্ম ভালো না মন্দ, এবং সেই ব্যক্তি তাঁকে মান্য করেছে কি না, এবং সেই ব্যক্তি ঈশ্বরের ইচ্ছাকে সন্তুষ্ট করেছে কি না, এবং তারা যা করে তা সেই মানদণ্ড পূর্ণ করতে পেরেছে কি না। ঈশ্বর যে বিষয়ে যত্নবান তা হল মানুষের হৃদয়, তাদের উপরিভাগের ক্রিয়াকলাপ নয়। বিষয়টা এরকম নয় যে মানুষ কোনো একটা কাজ করলে, তারা যেমনভাবেই সেই কাজ করুক তা নির্বিশেষে, ঈশ্বরের উচিত তাকে আশীর্বাদ প্রদান করা। এটা শুধুই ঈশ্বরের সম্পর্কে মানুষের ভুল ধারণা। ঈশ্বর শুধুমাত্র কোনোকিছুর অন্তিম পরিণতিটুকুই দেখেন না, বরং আরো বেশি গুরুত্ব দেন একজন মানুষের অন্তর কেমন, এবং বিভিন্ন বিষয়ের ক্রমবিবর্তনকালে সেই ব্যক্তির মনোভাব কেমন তার উপর, এবং তিনি দেখেন যে তাদের অন্তরে আনুগত্য, বিবেচনা, এবং ঈশ্বরকে সন্তুষ্ট করার বাসনা রয়েছে কি না। সেই সময়ে ঈশ্বর সম্বন্ধে নোহ কতখানি জানত? বর্তমানে তোমরা যতটা তত্ত্বকথা জানো তা কি ততটাই ছিল? সত্যের পরিপ্রেক্ষিতগুলোর ক্ষেত্রে, যেমন ঈশ্বর বিষয়ক ধারণাসমূহ ও জ্ঞান প্রসঙ্গে, সে কি তোমাদের মতোই সিঞ্চন ও পরিচালনা লাভ করেছিল? না, সে তেমনটা লাভ করেনি! কিন্তু এমন একটা সত্য রয়েছে যা অনস্বীকার্য: বর্তমানের মানুষের চেতনায়, মনে, এবং এমনকি হৃদয়ের গহীনেও, ঈশ্বর সম্বন্ধে ধারণা ও মনোভাব অস্পষ্ট ও অনিশ্চিত। তোমরা এমনকি এটাও বলতে পারো যে, মানুষের একাংশ ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্বন্ধেও একটা নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করে। কিন্তু নোহর অন্তঃকরণে ও চেতনায় ঈশ্বরের অস্তিত্ব ছিল অমোঘ ও সন্দেহাতীত, এবং তাই ঈশ্বরের প্রতি তার আনুগত্য ছিল নিষ্কলঙ্ক, এবং তা পরীক্ষায় অবিচল থাকতে পেরেছিল। তার হৃদয় ছিল নির্মল ও ঈশ্বরের প্রতি উন্মুক্ত। ঈশ্বরের প্রতিটা বাক্য অনুসরণের জন্য নিজেকে প্রত্যয় প্রদান করতে তার খুব বেশি মতবাদসমূহ বিষয়ক জ্ঞানের প্রয়োজন হয়নি, বা ঈশ্বরের অর্পিত দায়িত্ব গ্রহণে সক্ষম হওয়ার জন্য এবং ঈশ্বর তাকে যাকিছু করার নির্দেশ দিচ্ছেন তা করতে সমর্থ হওয়ার জন্য ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করার মতো প্রভূত তথ্যেরও প্রয়োজন পড়েনি। নোহ ও বর্তমানের মানুষের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য এটাই। ঈশ্বরের চোখে সুনির্দিষ্টভাবে একজন নিখুঁত মানুষ যা, তার প্রকৃত সংজ্ঞাও এটা। ঈশ্বর নোহর মতো মানুষদেরই চান। সে হল সেই ধরনের মানুষ ঈশ্বর যার প্রশংসা করেন, এবং সে ঠিক সেই ধরনের মানুষ ঈশ্বর যাকে আশীর্বাদ করেন। এ থেকে তোমরা কি কোনো আলোকপ্রাপ্তি লাভ করেছ? মানুষ বাহ্যিক ভাবে মানুষকে দেখে, কিন্তু ঈশ্বর যা দেখেন তা হচ্ছে মানুষের অন্তঃকরণ ও তাদের সারসত্য। ঈশ্বর কোনো ব্যক্তিকে তাঁর প্রতি নিরুৎসাহ হওয়ার বা সংশয় পোষণ করার অনুমতি দেন না, কিংবা তাঁকে সন্দেহ অথবা কোনোভাবে তাঁর পরীক্ষা নেওয়ার অনুমোদনও তিনি মানুষকে দেন না। সুতরাং, যদিও বর্তমানের মানুষ ঈশ্বরের বাক্যের মুখোমুখি—এমনকি এটাও বলতে পারো যে তারা ঈশ্বরেরই সম্মুখীন—তবু, তাদের হৃদয়ের গভীরে কিছু একটা আছে বলে, অর্থাৎ তাদের ভ্রষ্ট সারমর্মের অস্তিত্বের কারণে, এবং ঈশ্বরের প্রতি তাদের বিরূপ মনোভাবের কারণে, ঈশ্বরের প্রতি প্রকৃত বিশ্বাস অর্জনে তারা বাধাপ্রাপ্ত এবং তাঁর প্রতি অনুগত হওয়ার বিষয়েও তারা অবরুদ্ধ। এই কারণে, নোহর উপর ঈশ্বর যে আশীর্বাদ বর্ষণ করেছিলেন, সেই একই আশীর্বাদ তাদের পক্ষে অর্জন করা অতীব কষ্টসাধ্য।

মানুষের সঙ্গে সন্ধিচুক্তির প্রতীক হিসাবে কীভাবে ঈশ্বরকে রামধনু ব্যবহার করলেন, সেই সম্পর্কিত শাস্ত্রের এই অংশের উপর মনোনিবেশ করা যাক।

৩. ঈশ্বর মানুষের সঙ্গে তাঁর সন্ধিচুক্তির প্রতীক হিসাবে রামধনু ব্যবহার করেন

আদিপুস্তক ৯.১১-১৩ আমি এক সন্ধি চুক্তি স্থাপন করব, তার শর্ত হবে এই যে, আর কখনো জলপ্লাবনে সমস্ত প্রাণী বিনষ্ট হবে না এবং আর কখনো পৃথিবীবিধ্বংসী প্লাবন হবে না। ঈশ্বর আরও বললেন, তোমাদের ও তোমাদের সঙ্গে যত প্রাণী আছে তাদের সঙ্গে পুরুষানুক্রমে স্থায়ী যে সন্ধি চুক্তি আমি স্থাপন করলাম, তার নিদর্শন হবে এইঃ আকাশের গায়ে আমি আমার ধনু স্থাপন করব, আর তা-ই হব পৃথিবীর সঙ্গে স্থাপিত আমার সন্ধি চুক্তির প্রতীক।

রামধনু কী তা অধিকাংশ মানুষই জানে, এবং রামধনু সংক্রান্ত কিছু আখ্যান তারা শুনেছে। বাইবেলে রামধনু বিষয়ক যে আখ্যায়িকা রয়েছে, সেই প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে যে, কিছু মানুষ তা বিশ্বাস করে, আবার অন্যরা তা আদ্যন্ত অবিশ্বাস করে। যা-ই হোক না কেন, রামধনু সংক্রান্ত যে সমস্ত ঘটনা ঘটেছিল, তা সকলই ছিল ঈশ্বরের কর্ম, এবং ঈশ্বর যে প্রক্রিয়ায় মানুষকে পরিচালনা করেছেন সেই অনুসারেই তা সংঘটিত হয়েছিল। সেই ঘটনাবলী বাইবেলে যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ করা রয়েছে। সেই সময়ে ঈশ্বর কী মেজাজে ছিলেন, বা ঈশ্বর কথিত বাক্যগুলির নেপথ্যে কী অভিপ্রায় ছিল, তা এই নথিগুলি বলে না। উপরন্তু, ঈশ্বর যখন সেগুলি উচ্চারণ করেছিলেন, তখন তিনি কী অনুভব করেছিলেন তা-ও কেউ-ই অনুধাবন করতে পারে না। তবে, ভাষ্যের ছত্রগুলিতে, এই পুরো ঘটনা প্রসঙ্গে ঈশ্বরের মনের অবস্থা উদ্‌ঘাটিত হয়ে। মনে হয় বুঝি তাঁর সেই সময়কার চিন্তাধারা ঈশ্বরের বাক্যের প্রতিটি শব্দ ও বাক্যের মাধ্যমে জীবন্ত ও প্রাণোচ্ছল হয়ে উঠেছে।

ঈশ্বরের চিন্তাধারা নিয়েই মানুষের ভাবনাচিন্তা করা উচিত, এবং সেটাই তাদের সবচেয়ে বেশি জানার চেষ্টা করা উচিত। এর কারণ হল যে, ঈশ্বরের চিন্তাধারা মানুষের ঈশ্বরোপলব্ধির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত, এবং মানুষের ঈশ্বরোপলব্ধি মানুষের কাছে জীবনে প্রবেশের ক্ষেত্রে এক অপরিহার্য যোগসূত্র। তাহলে, সেই ঘটনাবলী যখন ঘটেছিল, তখন ঈশ্বর কী চিন্তাভাবনা করছিলেন?

প্রথমে, ঈশ্বর সেই মানবজাতি সৃষ্টি করেছিলেন যারা তাঁর চোখে অত্যন্ত ভালো এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ ছিল, কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণার পর তাদের বন্যার দ্বারা ধ্বংস করা হয়। এই ধরনের মানবজাতিকে মুহূর্তের মধ্যে এভাবে ধ্বংস করার জন্য ঈশ্বর কি আহত হয়েছিলেন? অবশ্যই তিনি আহত হয়েছিলেন! তাঁর সেই যন্ত্রণার প্রকাশ কী ছিল? বাইবেলে কীভাবে তা লিপিবদ্ধ রয়েছে? বাইবেলে তা এই বাক্যগুলির দ্বারা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে: “আমি এক সন্ধি চুক্তি স্থাপন করব। তার শর্ত হবে এই যে, আর কখনো জলপ্লাবনে সমস্ত প্রাণী বিনষ্ট হবে না এবং আর কখনো পৃথিবীবিধ্বংসী প্লাবন হবে না”। এই সরল বাক্যটি ঈশ্বরের ভাবনা প্রকাশ করে। এই পৃথিবীর ধ্বংস তাঁকে খুবই যন্ত্রণা দিয়েছিল। মানুষের বচনে, তিনি খুবই দুঃখ পেয়েছিলেন। আমরা অনুমান করতে পারি: যে পৃথিবী আগে প্রাণময় ছিল, তা বন্যায় ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পরে তা কেমন দেখতে লাগছিল? যে পৃথিবী আগে মানুষের দ্বারা পরিপূর্ণ ছিল, তাকে সেই সময় কেমন দেখতে লাগছিল? মানুষের কোনো বসতি নেই, কোনো জীবিত প্রাণী নেই, চারদিকে জলরাশি, এবং জলরাশির উপর চরম ধ্বংসলীলা। ঈশ্বর যখন এই পৃথিবীকে সৃষ্টি করেছিলেন, তখন তাঁর মূল অভিপ্রায় কি এমনতর ছিল? অবশ্যই নয়! ঈশ্বরের মূল অভিপ্রায় ছিল যে, তিনি পৃথিবীকে প্রাণময় দেখবেন, তিনি দেখতে চেয়েছিলেন যে, তাঁর সৃষ্ট মানুষজন তাঁর উপাসনা করছে, তিনি এমনটা চাননি যে, একমাত্র নোহই তাঁর উপাসনা করুক, বা নিজের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের জন্য একমাত্র নোহই তাঁর ডাকে সাড়া দিক। যখন মানবজাতি অদৃশ্য হয়ে গেল, এটা তাঁর মূল অভিপ্রায় ছিলনা, বরং সেটা ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। তাঁর হৃদয় কীভাবে যন্ত্রণাবিদ্ধ না হয়ে থাকতে পারে? তাই যখন তিনি তাঁর স্বভাবকে প্রকাশ ও তাঁর আবেগসমূহ ব্যক্ত করছিলেন, তখনই ঈশ্বর একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কী ধরনের সিদ্ধান্ত তিনি গ্রহণ করেন? মানুষের সঙ্গে সন্ধিচুক্তি হিসাবে আকাশের গায়ে একটা ধনুক (যে রামধনু আমরা দেখি) স্থাপন করার সিদ্ধান্ত, যা এই মর্মে প্রতিশ্রুতি দেবে, যে, ঈশ্বর আর কখনো মানবজাতিকে বন্যার দ্বারা ধ্বংস করবেন না। সেইসঙ্গে, তার মাধ্যমে মানুষকে এ-ও বলা হয়েছে, যে, ঈশ্বর বন্যার মাধ্যমে পৃথিবীকে ধ্বংস করেছিলেন যাতে মানুষ চিরকাল মনে রাখে যে ঈশ্বর কেন এহেন কাজ করেন।

ঈশ্বর কি সেইসময় পৃথিবীর ধ্বংসই চেয়েছিলেন? অবশ্যই সেটা ঈশ্বর চাননি। বিশ্বচরাচর ধ্বংস হওয়ার পর পৃথিবীর সেই করুণ দৃশ্যের একটা ক্ষুদ্র অংশ আমরা হয়তো কল্পনা করতে সক্ষম হব, কিন্তু ঈশ্বরের চোখে সেই সময়ের চিত্রটা কী ছিল তার সুদূরতম কল্পনাও আমরা করতে পারব না। আমরা এটা বলতে পারি যে, একালের মানুষই হোক বা সেকালের, বন্যার দ্বারা পৃথিবী ধ্বংসের পর যখন ঈশ্বর পৃথিবীর সেই দৃশ্য, সেই রূপ দেখেছিলেন, তখন তিনি কী অনুভব করেছিলেন, তা কেউই কল্পনা বা উপলব্ধি করতে সক্ষম নয়। মানুষের অবাধ্যতার কারণেই ঈশ্বর তা করতে বাধ্য হয়েছিলেন, কিন্তু বন্যার দ্বারা পৃথিবীর এই ধ্বংসের ফলে ঈশ্বরের অন্তর যে যন্ত্রণা ভোগ করেছিল তা হল এমন এক বাস্তব যার মর্মোদ্ধার অথবা অনুধাবন কোনো মানুষ করতে পারে না। এই কারণেই, ঈশ্বর মানবজাতির সঙ্গে একটি সন্ধিচুক্তি করেছিলেন, যার মাধ্যমে তিনি মানুষকে বলতে চেয়েছিলেন, তারা যেন মনে রাখে, যে, ঈশ্বর একবার এহেন ঘটনা ঘটিয়েছেন, এবং তাদের কাছে এ-ও প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, যে, ঈশ্বর আর কখনোই এভাবে পৃথিবীকে ধ্বংস করবেন না। এই সন্ধিচুক্তিতে আমরা ঈশ্বরের হৃদয় প্রত্যক্ষ করি—আমরা দেখি যে, যখন তিনি এই মানবজাতিকে ধ্বংস করেছিলেন, তখন তাঁর হৃদয় যন্ত্রণাবিদ্ধ হয়েছিল। মানুষের ভাষায় বলতে গেলে, ঈশ্বর যখন মানবজাতিকে ধ্বংস করলেন, যখন তিনি দেখলেন যে মানবজাতি অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে, তখন তাঁর মন কেঁদেছিল, তাঁর হৃদয় থেকে যেন রক্তক্ষরণ ঘটেছিল। এটাই কি তা বর্ণনা করার সবচেয়ে ভালো পন্থা নয়? মানবিক আবেগগুলিকে বোঝানোর জন্য মানুষের দ্বারা এই কথাগুলি ব্যবহৃত হয়, কিন্তু যেহেতু মানুষের ভাষায় অনেক ঘাটতি রয়েছে, সেহেতু ঈশ্বরের অনুভূতিও আবেগকে বর্ণনার জন্য এই ভাষার ব্যবহার আমার খুব একটা মন্দ লাগে না, আবার তা খুব একটা আতিশয়োক্তি বলেও মনে হয় না। সেই সময় ঈশ্বরের মেজাজ কেমন ছিল, সেবিষয়ে এটা তোমাদের খুবই বাঙ্ময়, অত্যন্ত যথাযথ এক ধারণা দেয়। এখন, যখন তোমরা একটা রামধনু দেখো তখন, তোমরা কী ভাববে? তোমরা অন্ততপক্ষে এটা স্মরণ করবে যে, বন্যার দ্বারা পৃথিবীকে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য ঈশ্বর একসময় কীভাবে দুঃখভোগ করেছিলেন। তুমি এ-ও স্মরণ করবে যে, যদিও ঈশ্বর এই পৃথিবীকে ঘৃণা করতেন ও এই মানবজাতিকে অপছন্দ করতেন, তবুও আপন হাতে সৃষ্ট এই মানুষদের যখন তিনি ধ্বংস করেছিলেন, তখন তাঁর হৃদয় যন্ত্রণাবিদ্ধ হয়েছিল, তাদের পরিহার করতে তিনি অস্বস্তি ও অনিচ্ছা বোধ করছিলেন, এবং তা তাঁর কাছে অসহনীয় হয়ে উঠেছিল। নোহর আট-সদস্যভুক্ত পরিবারই ছিল তাঁর একমাত্র সান্ত্বনা। সকল কিছু সৃষ্টি করার জন্য তাঁর শ্রমসাধ্য প্রয়াস যাতে বৃথা না যায়, তা নোহর সহযোহিতার ফলেই সুনিশ্চিত হয়েছিল। যে সময় ঈশ্বর যন্ত্রণাভোগ করছিলেন, সেই সময় একমাত্র এই বিষয়টিই তাঁর বেদনা প্রশমন করতে পেরেছিল। সেই সময় থেকে, মানবজাতির প্রতি তাঁর সমস্ত প্রত্যাশা ঈশ্বর নোহর পরিবারের উপর ন্যস্ত করেন, এই আশায় যে, তারা বাস করবে তাঁর আশীর্বাদের অধীনে, অভিশাপের নয়, এই আশায় যে, তারা আর কখনো দেখবে না, যে, ঈশ্বর বন্যার দ্বারা পৃথিবীকে ধ্বংস করছেন, এই আশায় যে, তারা আর ধ্বংস হয়ে যাবে না।

এর থেকে আমরা ঈশ্বরের স্বভাবের কোন অংশটির বিষয়ে শিক্ষা নিতে পারি? ঈশ্বর মানুষকে অপছন্দ করতেন কারণ মানুষ তাঁর প্রতি ছিল বিরূপ, কিন্তু তাঁর হৃদয়ে মানবজাতির জন্য তাঁর যত্ন, উদ্বেগ ও করুণা অপরিবর্তিতই ছিল। এমনকি যখন তিনি মানবজাতিকে ধ্বংস করেছিলেন, তখনও তাঁর হৃদয় অপরিবর্তিত ছিল। মানবজাতি যখন দুর্নীতিতে পূর্ণ ছিল এবং ভয়াবহ মাত্রায় ঈশ্বরের প্রতি অবাধ্য ছিল, তখন, তাঁর স্বভাব ও সারসত্যের কারণে, এবং তাঁর নীতিসমূহের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে, ঈশ্বরকে এই মানবজাতি ধ্বংস করতেই হত। কিন্তু, ঈশ্বরের সারসত্যের কারণে, তিনি তখনো মানবজাতিকে করুণা করতেন, এবং এমনকি মানবজাতিকে উদ্ধার করতেও তিনি বিভিন্ন পন্থা প্রয়োগ করতে চেয়েছিলেন, যাতে তারা বেঁচে থাকতে পারে। তবে মানুষ ঈশ্বরের বিরোধিতা করেছিল, ঈশ্বরকে অমান্য করেই গিয়েছিল, এবং ঈশ্বরের পরিত্রাণ গ্রহণে অস্বীকার করেছিল; অর্থাৎ, তাঁর শুভ অভিপ্রায় গ্রহণে অস্বীকার করেছিল। ঈশ্বর যেভাবেই তাদের আহ্বান করুন না কেন, তাদের স্মরণ করিয়ে দিন না কেন, তাদের সরবরাহ করুন না কেন, তাদের সাহায্য করুন না কেন, বা তাদের প্রতি সহনশীল হোন না কেন, মানুষ তা অনুধাবন ও উপলব্ধি করেনি, তারা তাতে কোনো মনোযোগও দেয়নি। নিজের যন্ত্রণাতেও, ঈশ্বর তখনো মানুষকে তাঁর সর্বোচ্চ সহিষ্ণুতা প্রদান করতে ভোলেননি, তিনি অপেক্ষা করে গিয়েছিলেন যে, মানুষ তার ভুল শুধরে নেবে। তিনি তাঁর সীমায় পৌঁছনোর পর, সকল দ্বিধা ত্যাগ করে তিনি তাঁর যা করণীয় কার্য সম্পাদন করেন। প্রকারান্তরে বললে, যে মুহূর্তে ঈশ্বর মানবজাতিকে ধ্বংসের পরিকল্পনা করেছিলেন, সেই মুহুর্তকাল থেকে তাঁর মানবজাতিকে ধ্বংস করার কাজ শুরু হওয়ার মধ্যে, একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা এবং প্রক্রিয়া ছিল। মানুষকে তার ভুল সংশোধনে সমর্থ করার জন্যই ছিল এই প্রক্রিয়া, এবং সেটিই ছিল ঈশ্বর মানুষকে দেওয়া শেষ সুযোগ। মানবজাতিকে ধ্বংস করার সেই প্রাক্কালে ঈশ্বর কী করেছিলেন? তিনি উল্লেযোগ্যভাবে মানুষকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, উপদেশ প্রচার করেছিলেন। তাঁর হৃদয়ে যতই দুঃখ–যন্ত্রণা থাকুক না কেন, তিনি মানুষকে তাঁর যত্ন, উদ্বেগ, এবং প্রভূত করুণা বিতরণ করে গিয়েছিলেন। তা থেকে আমরা কী প্রত্যক্ষ করি? সন্দেহাতীতভাবেই, আমরা দেখি, যে, মানবজাতির প্রতি ঈশ্বরের ভালোবাসা সততই খাঁটি, তা নিছকই কোনো মুখের কথা নয়। তা সত্য, বোধগম্য ও অনুধাবনীয়, তা কপট, অবিশুদ্ধ, চাতুরিপূর্ণ বা ভণ্ডামি নয়। তিনি যে প্রেমার্হ তা মানুষকে দেখানোর জন্য ঈশ্বর কখনোই কোনো ছলনার আশ্রয় নেন না, বা নিজের কোনো মিথ্যা প্রতিমূর্তিও তৈরি করেন না। মানুষের কাছে তাঁর মাধুর্য দেখনোর জন্য, বা তাঁর মাধুর্য ও পবিত্রতা জাহির করার উদ্দেশ্যে, তিনি কখনোই মিথ্যা সাক্ষ্য ব্যবহার করেন না। ঈশ্বরের স্বভাবের এই দিকগুলি কি মানুষের ভালোবাসার যোগ্য নয়? সেগুলি কি উপাসনার যোগ্য নয়? সেগুলি কি লালন করার যোগ্য নয়? এইখানে এসে আমি তোমাদের প্রশ্ন করতে চাই: এই বাক্যগুলি শোনার পর তোমাদের কি মনে হয়, যে, ঈশ্বরের মহত্ত্ব নিছকই কাগজে লেখা কিছু শূন্যগর্ভ বাক্য? ঈশ্বরের মাধুর্য কি শুধু শূন্যগর্ভ বাক্যসমূহ? না! অবশ্যই তা নয়! তাঁর কাজের প্রতিটি সময়ে ব্যবহারিক অভিব্যক্তি ধারণ করে ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠত্ব, মহত্ত্ব, পবিত্রতা, সহনশীলতা, ভালোবাসা, এবং ইত্যবিধ—ঈশ্বরের স্বভাব ও সারসত্যের বিভিন্ন দিকের মধ্যে প্রত্যেকটির প্রতিটি খুঁটিনাটি—এবং মানুষের প্রতি তাঁর ইচ্ছার মধ্যে সেগুলি মূর্ত হয়ে ওঠে, এবং সেগুলি প্রত্যেক ব্যক্তির মধ্যে পরিপূর্ণ ও প্রতিফলিতও হয়। পূর্বে তুমি এ বিষয়টি উপলব্ধি করেছ কি না তা নির্বিশেষে, সম্ভাব্য সকল উপায়ের প্রয়োগ ঘটিয়ে ঈশ্বর প্রত্যেক ব্যক্তির বিষয়ে যত্নশীল হন, প্রত্যেক ব্যক্তির হৃদয়কে উষ্ণ করতে, এবং প্রত্যেক ব্যক্তির চেতনাকে জাগ্রত করতে, তাঁর একনিষ্ঠ হৃদয়, প্রজ্ঞা ও বিভিন্ন পদ্ধতির ব্যবহার করেন। এ হল এক অবিসংবাদিত সত্য। এখানে যতজন মানুষই বসে থাকুক না কেন, ঈশ্বরের সহনশীলতা, ধৈর্য ও মাধুর্য সম্পর্কে প্রত্যেক ব্যক্তিরই ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতা এবং পৃথক পৃথক অনুভূতি রয়েছে। ঈশ্বর সম্পর্কে এই সকল অভিজ্ঞতা ও তাঁর সম্বন্ধে ধারণা—সংক্ষেপে বলতে গেলে, এই সব ইতিবাচক বিষয়—এসেছে ঈশ্বরেরই কাছ থেকে। তাহলে, ঈশ্বর সম্বন্ধে প্রত্যেকের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের সমন্বয় ঘটিয়ে, এবং সেগুলিকে আজকে আমরা বাইবেলের এই যে অনুচ্ছেদগুলি পাঠ করলাম, তার সঙ্গে সংযুক্ত করে, তোমরা কি এখন ঈশ্বর সম্বন্ধে আরো বাস্তব ও যথাযথ উপলব্ধি লাভ করলে?

এই উপাখ্যান পাঠের পর, এবং এই ঘটনার মাধ্যমে ঈশ্বরের যে স্বভাব প্রকাশিত হয়েছে তা কিছুটা উপলব্ধি লাভ করে, ঈশ্বর সম্বন্ধে তোমরা নতুন কী ধরনের জ্ঞানের অধিকারী হলে? তা কি ঈশ্বর ও তাঁর হৃদয় সম্পর্কে তোমাদের গভীরতর উপলব্ধি দান করেছে? নতুন করে নোহর আখ্যান পড়ার পর এখন কি তোমাদের ভিন্ন অনুভূতি হচ্ছে? তোমাদের মতে বাইবেলের স্তবকগুলির নিয়ে আলোচনা কি অপ্রয়োজনীয়? আমাদের সেগুলি নিয়ে আলোচনা করার পর, তোমরা কি এখনো মনে করো, যে, তা অপ্রয়োজনীয়? অবশ্যই তা প্রয়োজনীয়! আমরা যা পাঠ করি তা যদিও এক কাহিনীমাত্র, কিন্তু তা ছিল ঈশ্বরকৃত কার্যের এক প্রকৃত নথি। তোমাদের এই কাহিনীগুলির বা এই চরিত্রের বিশদ বিবরণ অনুধাবনে সক্ষম করে তোলা আমার লক্ষ্য নয়, বা তোমরা যাতে এই চরিত্রটি নিয়ে পাঠ করো, বা তোমরা যাতে ফিরে গিয়ে আবার বাইবেল পাঠ করো, তা-ও অবশ্যই আমার উদ্দেশ্য নয়। তোমরা কি তা উপলব্ধি করো? এই আখ্যানমালা কি ঈশ্বরের সম্বন্ধে জ্ঞানার্জনে তোমাদের সহায় হয়েছে? তোমাদের ঈশ্বর উপলব্ধিতে এই কাহিনীগুলি কী যোগ করেছে? হংকং থেকে থেকে আগত ভ্রাতা ও ভগিনীরা, তোমরা এটা বলো। (আমরা দেখেছি যে ঈশ্বরপ্রেম হল এমন এক বিষয়, আমাদের মতো কোনো ভ্রষ্ট মানুষই যার অধিকারী নয়।) দক্ষিণ কোরিয়া থেকে আগত ভ্রাতা ও ভগিনীরা, তোমরা কিছু বলো। (ঈশ্বরের মানবপ্রেম নিখাদ। ঈশ্বরের মানবপ্রেম তাঁর মহত্ত্ব, পবিত্রতা, শ্রেষ্ঠত্ব, এবং তাঁর সহনশীলতাকে বহন করে। আমরা যদি গভীরতরভাবে সেবিষয়য়ে উপলব্ধি অর্জনের চেষ্টা করি, তবে তা বিফলে যাবে না।) (ঠিক একটু আগেই যে আলোচনাটা হল, তার মাধ্যমে আমি একাধারে ঈশ্বরের ধার্মিক ও পবিত্র স্বভাব দেখতে পাই এবং মানবজাতির প্রতি ঈশ্বরের উদ্বেগ, মানবজাতির প্রতি ঈশ্বরের করুণাও আমি প্রত্যক্ষ করি, এবং এ-ও দেখতে পাই, যে, ঈশ্বর যা কিছু করেন তা দ্বারা, এবং তাঁর প্রতিটি চিন্তা ও ধারণায়, তিনি মানবজাতির প্রতি তাঁর প্রেম ও উদ্বেগ প্রকাশ করেন।) (পূর্বে, আমার এই উপলব্ধি ছিল যে, মানুষ সাঙ্ঘাতিক রকমের দুষ্ট হয়ে পড়েছিল বলে এক বন্যার মাধ্যমে ঈশ্বর পৃথিবীকে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন, এবং ঈশ্বর এই মানবজাতিকে অপছন্দ করতেন বলেই বুঝি তিনি তাদের ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। আজ, যখন ঈশ্বর নোহর উপাখ্যান শোনালেন, এবং বললেন যে ঈশ্বরের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছিল, তখন আমি উপলব্ধি করি যে এই মানবজাতিকে ধ্বংস করতে ঈশ্বর আদতে অনিচ্ছুকই ছিলেন। মানুষ যেহেতু খুবই অবাধ্য ছিল, সেহেতু তাদের ধ্বংস করা ছাড়া ঈশ্বরের আর কোনো উপায় ছিল না। বস্তুত, সেই সময়ে ঈশ্বরের হৃদয় অত্যন্ত বিষন্ন ছিল। এর থেকে, ঈশ্বরের স্বভাবের মধ্যে মানবজাতির জন্য তাঁর যত্ন ও তাঁর উদ্বেগ দেখতে পাই। এই বিষয়টি আমার আগে জানা ছিল না।) খুব ভালো! তোমরা এবার পরের উত্তরে যেতে পারো (শোনার পরে আমি খুবই প্রভাবিত হয়েছি। আমি পূর্বেও বাইবেল পাঠ করেছি, কিন্তু আজকের মতো অভিজ্ঞতা আমার কখনোই হয়নি, যেখানে ঈশ্বর সরাসরি এই বিষয়গুলি বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন যাতে আমরা তাঁকে জানতে পারি। বাইবেলকে প্রত্যক্ষ করায় ঈশ্বর আমাদের এইভাবে পরিচালনা করার ফলে, আমি জানতে সক্ষম হয়েছি যে মানুষের অনাচারের সামনে ঈশ্বরের স্বভাব আসলে মানবজাতির প্রতি প্রেমময় ও যত্নশীল। মানুষ যে সময় থেকে ভ্রষ্ট হয়েছিল তখন থেকে শুরু করে বর্তমানের এই অন্তিম সময় পর্যন্ত, যদিও ঈশ্বরের একটি ধার্মিক স্বভাব রয়েছে, তবুও, তাঁর ভালোবাসা ও যত্ন অপরিবর্তিত রয়েছে। এটা দেখায় যে, সৃষ্টিলগ্ন থেকে অদ্যাবধি, মানুষ ভ্রষ্ট হয়েছে কি না তা নির্বিশেষে ঈশ্বরের প্রেমময় সারসত্য কখনোই পরিবর্তিত হয়নি।) (আজ আমি দেখলাম যে, তাঁর কার্যের কাল বা স্থানের পরিবর্তনের দরুন ঈশ্বরে সারসত্যের পরিবর্তন হবে না। আমি এ-ও দেখলাম, যে, ঈশ্বর এই পৃথিবী সৃষ্টিই করুন বা মানুষ ভ্রষ্ট হওয়ার পর তা ধ্বংসই করুন, তিনি যাকিছু করেন তার প্রত্যেকটির একটা অর্থ আছে এবং সেগুলি তাঁর স্বভাবকে ধারণ করে। অতঃপর আমি দেখলাম যে, ঈশ্বরের ভালোবাসা অসীম ও অপরিমেয়, এবং, যেমনটা অন্য ভ্রাতা, ভগিনীরাও উল্লেখ করেছেন, ঈশ্বর যখন এই পৃথিবীকে ধ্বংস করেছিলেন, তখন তাঁর মানবজাতির প্রতি যত্ন ও করুণাও আমি প্রত্যক্ষ করলাম।) (এগুলি এমন বিষয় যা সত্যিই আমি আগে জানতাম না। আজ, শোনার পর, আমি অনুভব করছি যে, ঈশ্বর বস্তুতই বিশ্বাসযোগ্য, বিশ্বাসভাজন, এবং তাঁর উপর বিশ্বাস রাখলে তা কখনো বৃথা যায় না, এবং তিনি যথার্থই বিরাজমান। আমি অন্তর থেকে প্রকৃতপক্ষেই উপলব্ধি করতে পারছি, যে, ঈশ্বরের স্বভাব ও প্রেম সত্যিই মূর্ত। আজ শোনার পর আমার এই অনুভূতিই হয়েছে।) চমৎকার! মনে হচ্ছে যে, তোমরা যা শ্রবণ করেছ, তা তোমরা অন্তর থেকে গ্রহণ করেছ।

বাইবেলের যে আখ্যানসমূহ নিয়ে আমরা আজ আলোচনা করলাম, সেগুলি সহ বাইবেলের সমস্ত স্তবকে তোমরা কি কিছু একটা লক্ষ্য করেছ? ঈশ্বর তাঁর নিজস্ব ভাবনা প্রকাশের জন্য, বা মানবজাতির জন্য তাঁর ভালোবাসা ও যত্নকে ব্যাখ্যা করার জন্য, কখনো কি তাঁর নিজের ভাষা ব্যবহার করেছেন? মানবজাতির প্রতি তাঁর উদ্বেগ, বা প্রেমের বিবরণকালে তিনি এহেন সহজসরল ভাষা ব্যবহার করছেন, এমন অপর কোনো নথি রয়েছে কি? নেই। এমনটা কি সঠিক নয়? তোমাদের মধ্যে অনেকেই বাইবেল পাঠ করেছ বা বাইবেল ছাড়া অন্যান্য গ্রন্থ পাঠ করেছ। তোমাদের মধ্যে কেউ কি এমন বাক্য দেখেছ? উত্তরটা হল যে, অবশ্যই দেখো নি! অর্থাৎ, ঈশ্বরের বাক্য সহ বাইবেলের কোনো নথিতে বা তাঁর কার্য লিপিবদ্ধ করা রয়েছে এমন কোথাও, কোনো যুগে বা কোনো সময়কালে তাঁর নিজস্ব অনুভূতির বর্ণনা দিতে গিয়ে, বা মানবজাতির জন্য তাঁর ভালোবাসা ও যত্নের প্রকাশ ঘটাতে গিয়ে, ঈশ্বর কখনোই তাঁর নিজস্ব পদ্ধতি ব্যবহার করেননি, বা তাঁর অনুভূতি ও আবেগ ব্যক্ত করার উদ্দেশ্যে ঈশ্বর কখনোই কোনো ভাষণ বা ক্রিয়াকর্ম ব্যবহার করেননি—এটাই কি ঘটনা নয়? কেন আমি তা বলি? কেন আমাকে এমনটা উল্লেখ করতে হল? কারণ। এ-ও ঈশ্বরের মাধুর্য ও তাঁর স্বভাবকে মূর্ত করে।

ঈশ্বর মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন; তারা কলুষিত হয়েছে কি না বা তারা তাঁকে অনুসরণ করে কি না তা নির্বিশেষে, ঈশ্বর মানুষের সঙ্গে তাঁর সবচেয়ে লালিত প্রিয়জন হিসাবেই আচরণ করেন—অথবা, যেমনটা মানুষ বলবে, তাঁর প্রিয়তম মানুষ হিসাবে—তাঁর ক্রীড়ার সামগ্রী হিসাবে নয়। যদিও ঈশ্বর বলেছেন যে তিনিই সৃষ্টিকর্তা এবং মানুষ তাঁরই সৃষ্টি, এতে পদমর্যাদায় সামান্য পার্থক্য আছে বলে মনে হতে পারে, কিন্তু প্রকৃত সত্য হ’ল মানবজাতির জন্য ঈশ্বর যা কিছু করেছেন তা এই প্রকৃতির এক সম্পর্ককে ছাড়িয়ে গিয়েছে। ঈশ্বর মানবজাতিকে ভালবাসেন, মানবজাতির যত্ন নেন, এবং মানবজাতির জন্য উদ্বিগ্ন হন, সেইসঙ্গে নিরন্তর এবং অবিরামভাবে, মানবজাতির জন্য প্রদান করেন। তিনি অন্তরে কখনই এমনটা অনুভব করেন না, যে, এ কোনো অতিরিক্ত কাজ বা এমন কিছু যা প্রচুর কৃতিত্বের যোগ্য। কিংবা তিনি অনুভব করেন না যে, মানবতাকে উদ্ধার করা, তাদের জন্য সরবরাহ করা, এবং তাদের সবকিছু প্রদান করা মানবজাতির জন্য বিরাট বড় কোনো অবদান রাখছে। তিনি শুধুই মানবজাতির জন্য প্রদান করেন, প্রশান্তভাবে ও নীরবে, তাঁর নিজস্ব উপায়ে, এবং তাঁর নিজস্ব সারসত্যের মাধ্যমে, এবং তাঁর যা আছে ও তিনি স্বয়ং যা, তার মাধ্যমে। মানবজাতি তাঁর কাছ থেকে যত বেশি সংস্থান এবং যত বেশি সাহায্যই গ্রহণ করুক না কেন, ঈশ্বর কখনই তা নিয়ে চিন্তা করেন না বা কৃতিত্ব গ্রহণের চেষ্টা করেন না। তা ঈশ্বরের সারসত্য দ্বারা নির্ধারিত হয়, এবং তা ঈশ্বরের স্বভাবের এক সঠিক অভিব্যক্তিও বটে। এই কারণে, বাইবেলই হোক বা অন্য কোনো গ্রন্থে, কোথাও-ই আমরা দেখি না, যে, ঈশ্বর তাঁর নিজস্ব চিন্তা ব্যক্ত করছেন, কোথাও-ই আমরা খুঁজে পাই না, যে, মানবজাতিকে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ তোলা, বা মানবজাতিকে দিয়ে তাঁর স্তুতি করানোর লক্ষ্য নিয়ে ঈশ্বর মানুষের কাছে বর্ণনা করছেন, অথবা ঘোষণা করছেন, যে, কেন তিনি এই কাজগুলি করেন, বা কেন তিনি মানবজাতির জন্য এতটা চিন্তা করেন। এমনকি, যখন তিনি আহত হন, যখন তাঁর হৃদয় তীব্র যন্ত্রণায় কাতর হয়, তখনো মানবজাতির প্রতি তাঁর দায়িত্ব, বা মানবজাতির প্রতি তাঁর উদ্বেগের বিষয়ে তিনি কখনোই বিস্মৃত হন না; এই সমস্ত সময়জুড়ে তিনি একাকী, নীরবেএই আঘাত ও যন্ত্রণা সহ্য করেন। ঠিক তার বিপরীতে, মানবজাতির জন্য ঈশ্বর রসদ যুগিয়ে যান, যেমন তিনি সর্বদা করে এসেছেন। যদিও মানবজাতি প্রায়শই ঈশ্বরের স্তুতি করে এবং তাঁর হয়ে সাক্ষ্য দেয়, এই ধরনের কোনো আচরণই ঈশ্বর দাবি করেননি। কারণ, ঈশ্বর কখনোই চান না যে, মানুষের জন্য যে ভালো কাজগুলি তিনি করেন, তার বিনিময় ঘটুক কৃতজ্ঞতা দিয়ে, তা পরিশোধ করা হোক। প্রকারান্তরে, যারা ঈশ্বরে ভীত হতে এবং মন্দ কর্ম পরিত্যাগ করতে পারে, যারা ঈশ্বরকে প্রকৃতই অনুসরণ করতে পারে, যারা তাঁর নির্দেশ শোনে, এবং যারা তাঁর প্রতি অনুগত, এবং যারা তাঁকে মান্য করতে পারে—এহেন মনুষ্যগণ প্রায়শই ঈশ্বরের আশীর্বাদ লাভ করবে, এবং ঈশ্বর নির্দ্বিধায় রেখে সেই আশীর্বাদ বর্ষণ করবেন। উপরন্তু, মানুষ ঈশ্বরের কাছ থেকে যে আশীর্বাদ লাভ করে, তা প্রায়শই হয় তাদের কল্পনাতীত, যে কাজ তারা করেছে বা যে মূল্য তারা দিয়েছে, তার মাধ্যমে মানুষ যা কিছুর ন্যায্যতা প্রতিপাদন করতে পারে এ তারও ঊর্ধ্বে। মানুষ যখন ঈশ্বরের আশীর্বাদ উপভোগ করে, তখন ঈশ্বর কী করছেন সেবিষয়ে কি কেউ মাথা ঘামায়? ঈশ্বর কী অনুভব করছেন তা নিয়ে কি কেউ উদ্বেগ প্রকাশ করে? কেউ কি ঈশ্বরের যন্ত্রণা উপলব্ধির চেষ্টা করে? উত্তর নিঃসন্দেহেই, না! ঈশ্বর সেইসময় যে যন্ত্রণা অনুভব করছিলেন, নোহ সহ কোনো মানুষই কি তা উপলব্ধি করতে পেরেছিল? কোনো মানুষই কি তা অনুধাবন করতে পেরেছিল যে ঈশ্বর কেন এহেন এক সন্ধিচুক্তি স্থাপন করবেন? তারা পারেনি। মানবজাতি ঈশ্বরের যন্ত্রণা স্বীকার যে করে না, তার কারণ এই নয় যে, তারা ঈশ্বরের যন্ত্রণাকে উপলব্ধি করে না, তার কারণ এ-ও নয়, যে, ঈশ্বর ও মানুষের মধ্যে ব্যবধান রয়েছে। বা তাদের মর্যাদার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে; বরং, কারণটা হল এই, যে, মানবজাতি ঈশ্বরের অনুভূতির বিষয়ে বিন্দুমাত্র ভাবিত নয়। মানবজাতি মনে করে যে ঈশ্বর স্বাধীন—তাঁর এমন প্রয়োজন নেই, যে মানুষ তাঁর বিষয়ে যত্নশীল হোক, তাঁকে উপলব্ধি করুক, এবং তাঁর প্রতি বিবেচনাশীল হোক। ঈশ্বর হলেন ঈশ্বর, তিনি বেদনা-বিরহিত, আবেগশূন্য; তিনি বিষন্ন হন না, দুঃখবোধ করেন না, তিনি এমনকি কাঁদেনও না। ঈশ্বর হলেন ঈশ্বর, তাই তাঁর আবেগের বহিঃপ্রকাশের কোনো প্রয়োজন নেই, এবং আবেগগত সান্ত্বনারও তাঁর কোনো প্রয়োজন নেই। যদি কোনো নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে তাঁর এই বিষয়গুলির প্রয়োজন ঘটে, তাহলে তিনি নিজেই তা সামলে নিতে পারবেন, এবং মানবজাতির কাছ থেকে কোনো সাহায্যের প্রয়োজন তাঁর পড়বে না। এর বিপরীতে দুর্বল, অপরিণত মানবজাতিরই প্রয়োজন রয়েছে ঈশ্বরের সান্ত্বনার, রসদের, উৎসাহের, এবং এমনকি প্রয়োজন রয়েছে সর্বদা ও সর্বদার তাদের আবেগকে সান্ত্বনার সান্তওনা প্রদানেরও: এই ধরনের বিষয়গুলি মানবজাতির হৃদয়ের গভীরে লুকিয়ে থাকে: মানুষ দুর্বল; তাদের সবরকমভাবে দেখভাল করারর জন্য ঈশ্বরকে প্রয়োজন হয়, ঈশ্বরের কাছ থেকে যে যত্ন তারা লাভ করে তা তাদের প্রাপ্য, যা কিছু তাদের পাওয়া উচিত বলে তাদের ধারণা, তা তারা ঈশ্বরের কাছ থেকে দাবি করতেই পারে। ঈশ্বর শক্তিমান; তাঁর সবকিছু আছে, তাঁর উচিত মানবজাতির অভিভাবক এবং আশীর্বাদ বর্ষণকারী হওয়া। যেহেতু তিনি ইতিমধ্যেই ঈশ্বর, সেহেতু তিনি সর্বশক্তিমান এবং মানবজাতির কাছ থেকে তাঁর কখনোই কিছু চাহিদা নেই।

মানুষ যেহেতু ঈশ্বরের কোনো উদ্‌ঘাটনের প্রতিই মনোযোগ দেয় না, সেহেতু সে কখনোই ঈশ্বরের দুঃখ, যন্ত্রণা বা আনন্দ অনুভব করে না। বরং, প্রকারান্তরে, ঈশ্বর মানুষের সব অনুভূতিকে নিজের হাতের তালুর মতো জানেন। ঈশ্বর সবসময় এবং সব স্থানে প্রত্যেকের চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করেন, প্রত্যেক ব্যক্তির পরিবর্তনশীল চিন্তাভাবনা পর্যবেক্ষণ করেন, এবং এইভাবেই, তাদের সান্ত্বনা ও উপদেশ দেন, এবং তাদের পথনির্দেশ দেন তথা প্রদীপ্ত করেন। ঈশ্বর মানবজাতির উপর যা করেছেন, এবং মানুষের নিমিত্ত যে মূল্য তিনি দিয়েছেন, সেই সকল বিষয়ের পরিপ্রেক্ষিতে, মানুষ কি বাইবেল অথবা ঈশ্বর এখনও পর্যন্ত যা বলেছেন তা থেকে এমন একটা অনুচ্ছেদ খুঁজে বের করতে পারে, যা স্পষ্টভাবে এমনটা বলে থাকে, যে, ঈশ্বর মানুষের কাছ থেকে কিছু একটা দাবি করবেন? না! বিষয়টা ঠিক তার উলটো, ঈশ্বরের ভাবনাকে মানুষ যতই উপেক্ষা করুক না কেন, তিনি এখনো বারংবার মানবজাতিকে নেতৃত্ব দেন, বারংবার মানবজাতির জন্য রসদের যোগান দেন এবং তাদের সাহায্য করেন, যাতে তারা ঈশ্বরের পথ অনুসরণে সক্ষম হয়, যাতে তারা সেই গন্তব্য অর্জন করতে পারে যা ঈশ্বর তাদের জন্য প্রস্তুত করেখেছেন। ঈশ্বরের ক্ষেত্রে তাঁর যা আছে এবং তিনি যা, তাঁর অনুগ্রহ, তাঁর করুণা, এবং তাঁর সমস্ত পুরস্কার তাদেরই উপর নির্দ্বিধায় বর্ষিত হয় যারা তাঁকে ভালোবাসে এবং তাঁর অনুসরণ করে। কিন্তু তিনি যে যন্ত্রণা ভোগ করেছেন, বা তাঁর মনের অবস্থা, কখনোই কোনো ব্যক্তির কাছে প্রকাশ করেন না, এবং কোনো ব্যক্তি সম্বন্ধে তিনি এই মর্মে অভিযোগ করেন না, যে, সে তাঁর প্রতি বিবেচনাশীল নয় না, বা, যে, সে তাঁর ইচ্ছা সম্বন্ধে অবগত নয়। তিনি এই সবকিছুই নীরবে সহ্য করেন, এবং শুধু সেই দিবসের অপেক্ষা করে যান, যেদিন মানবজাতি এবিষয়ে উপলব্ধিলাভে সক্ষম হবে।

কেন আমি এই প্রসঙ্গগুলির অবতারণা করছি? যে বিষয়গুলি আমি বলেছি, তা থেকে তোমরা কী দেখছ? ঈশ্বরের সারসত্য ও স্বভাবে এমন একটা কিছু রয়েছে, যা খুব সহজে চোখে না-ও পড়তে পারে, এমন একটা কিছু, যার অধিকারী একমাত্র ঈশ্বর এবং কোনো মানুষ নয়, নয় এমনকি তারাও, যাদের অন্যরা মহৎ ব্যক্তি, ভালো মানুষ বলে মনে করে বা যাদের তারা ঈশ্বর বলে কল্পনা করে। সেই বিষয়টি কী? তা হল ঈশ্বরের নিঃস্বার্থতা। নিঃস্বার্থতার প্রসঙ্গে তুমি হয়তো ভাবতে পারো যে, তুমিও খুব নিঃস্বার্থ, কারণ তুমি কখনোই তোমার সন্তানদের সঙ্গে দরাকষাকষি বা তর্কাতর্কি করো না, বা তুমি মনে করো যে তোমার পিতামাতার বিষয়ে তুমি বুঝি খুবই নিঃস্বার্থ। তুমি যা-ই ভাবো না কেন, অন্ততপক্ষে তোমার “নিঃস্বার্থ” শব্দটির একটি ধারণা রয়েছে, এবং তা এক ইতিবাচক শব্দ হিসাবে গণ্য করো, এবং মনে করো যে, নিঃস্বার্থ ব্যক্তি হয়ে ওঠাটা হল একটা মহত্ত্ব। যখন তুমি নিঃস্বার্থ, তখন নিজেকে খুবই উচ্চাসনে বসাও। কিন্তু এমন কোনো মানুষ নেই যে সমস্ত কিছুর মধ্যে, মানুষ, ঘটনাবলি ও বস্তুসমূহের মধ্যে, এবং তাঁর কর্মে, ঈশ্বরের নিঃস্বার্থতা দেখতে পায়। কেন এমন হয়? কারণ মানুষ অত্যন্ত স্বার্থপর! কেন আমি এমনটা বলি? মানবজাতি এক বস্তুগত জগতের মধ্যে বাস করে। তুমি ঈশ্বরকে অনুসরণ করতে পারো, কিন্তু ঈশ্বর কীভাবে তোমার জন্য রসদের যোগান দেন, তোমাকে ভালোবাসেন, এবং তোমার জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করেন, তা তুমি কখনোই দেখো না বা উপলব্ধি করো না। তাহলে, তুমি কী দেখো? তুমি সেই আত্মীয়পরিজনদের দেখো, যাদের সঙ্গে তোমার রক্তের সম্পর্ক রয়েছে, যারা তোমাকে ভালোবাসে বা ভীষণ স্নেহ করে। তুমি সেই বিষয়গুলিকেই দেখো, যা তোমার দেহের পক্ষে উপকারী, তুমি সেইসকল মানুষ ও বস্তুগুলি নিয়েই ভাবিত যেগুলিকে বা যাদের তুমি ভালোবাসো। এ-ই হল মানুষের তথাকথিত নিঃস্বার্থতা। তবে, এইরূপ “নিঃস্বার্থ” মানুষেরা কখনো সেই ঈশ্বরকে নিয়ে ভাবিত নয়, যিনি তাদের জীবনদান করেছেন। ঈশ্বরের নিঃস্বার্থতার বিপরীতে, মানুষের তথাকথিত নিঃস্বার্থতা আদতে স্বার্থসর্বস্বতা ও ঘৃণ্যতার দ্যোতক। নিঃস্বার্থ মানুষ যাতে বিশ্বাসী, তা শূন্যগর্ভ এবং অবাস্তব, কলুষিত, তা ঈশ্বরের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ, এবং ঈশ্বরের সঙ্গে সকল প্রকার সম্পর্ক বিরহিত। মানুষের নিঃস্বার্থতা শুধু তার নিজের জন্য, অন্যদিকে ঈশ্বরের নিঃস্বার্থতা হল তাঁর সারসত্যের প্রকৃত উদ্‌ঘাটন। নিঃস্বার্থতার কারণেই ঈশ্বর মানুষের উদ্দেশ্যে নিরন্তর রসদ যুগিয়ে চলেন। যে বিষয়টি নিয়ে আমি আজ আলোচনা করছি, তা নিয়ে তোমরা হয়তো গভীরভাবে প্রভাবিত না-ও হতে পারো, এবং হয়তো নিছকই সম্মতিসূচক ভাবে মাথা নাড়িয়ে চলেছ, কিন্তু যখন তুমি তোমার অন্তঃকরণে ঈশ্বরের অন্তরকে উপলব্ধির চেষ্টা করবে, তখন তুমি অনিচ্ছাকৃতভাবেই আবিষ্কার করবে: যে, এই পৃথিবীর সকল মানুষ, ঘটনাবলী ও বস্তুসমূহের মধ্যে, একমাত্র ঈশ্বরের ভালোবাসাই বাস্তব ও মূর্ত, কারণ তোমার জন্য কেবলমাত্র ঈশ্বরের ভালোবাসাই নিঃশর্ত এবং নিষ্কলঙ্ক। ঈশ্বর ব্যতীত বাকি সকলের তথাকথিত নিঃস্বার্থতা ছদ্ম, অগভীর, মেকি; সেখানে একটা ভারসাম্যের প্রশ্ন জড়িত, এবং তা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারে না। তোমরা এমনকি এমনও বলতে পারো, যে, তা কলুষিত এবং ঘৃণার্হ। তোমরা কি এই বাক্যগুলির সঙ্গে সহমত?

আমি জানি যে তোমরা এই বিষয়গুলির সঙ্গে খুবই অপরিচিত, এবং এই বিষয়গুলির গভীরে প্রবেশ করার জন্য তোমাদের একটু সময়ের প্রয়োজন রয়েছে, এবং তারপরই তোমাদের প্রকৃত উপলব্ধি জন্মাবে। এই সমস্ত প্রশ্ন ও বিষয়গুলির সঙ্গে তোমরা যত বেশি অপরিচিত থাকবে, তত বেশি করে এটা প্রমাণিত হবে যে তোমাদের অন্তরে এই বিষয়গুলির অস্তিত্ব নেই। আমি যদি এই বিষয়গুলি কখনোই না উল্লেখ করতাম, তাহলে কি তোমাদের মধ্যে কেউ এগুলি সম্বন্ধে কিছু জানতে? আমি বিশ্বাস করি তোমরা এগুলি সম্বন্ধে কখনোই কিছু জানতে পারতে না। এমনটা নিশ্চিত। তোমরা যতই অনুধাবন বা উপলব্ধি করতে পারো না কেন, যে বিষয়গুলির আলোচনা আমি করলাম, সংক্ষেপে বলতে গেলে, মানুষের মধ্যে সেগুলির ঘাটতি সর্বাধিক, এবং এগুলি সম্বন্ধেই তাদের সবচেয়ে বেশি করে জানা উচিত। এই বিষয়গুলি প্রত্যেকের জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ—সেগুলি মূল্যবান এবং সেগুলি জীবন, এবং যে বিষয়গুলি সম্মুখের পথের পাথেয় হিসাবে তোমাদের সঞ্চয় করতেই হবে। পথনির্দেশিকা হিসাবে এই বাক্যগুলি ব্যতীত, ঈশ্বরের স্বভাব ও সারসত্য সম্বন্ধে তোমাদের উপলব্ধি ব্যতীত, ঈশ্বরের বিষয়ে তোমাদের মধ্যে একটা প্রশ্নচিহ্ন থেকে যাবে। তুমি যদি ঈশ্বরকে উপলব্ধিই না করো, তাহলে তুমি কীভাবে তাঁকে যথাযথভাবে বিশ্বাস করবে? ঈশ্বরের আবেগ, তাঁর ইচ্ছা, তাঁর মনের অবস্থা, তিনি কী ভাবছেন, কী তাঁকে দুঃখ দেয়, কী-ই বা তাঁকে আনন্দ দেয়, তার কিছুই তুমি জানো না, সুতরাং, তুমি কীভাবে ঈশ্বরের হৃদয়ের প্রতি বিবেচনাশীল হবে?

ঈশ্বর যখন বিষণ্ণ থাকেন, তখন তিনি এমন এক মানবজাতির সম্মুখীন হন, যারা তাঁর প্রতি বিন্দুমাত্র মনোযোগী নয়, এমন এক মানবজাতি, যারা দাবি করে যে তারা তাঁকে অনুসরণ করে এবং ভালোবাসে, কিন্তু তবুও তাঁর অনুভূতিগুলিকে পূর্ণত উপেক্ষা করে। কীভাবে তাঁর হৃদয় আহত না হয়ে থাকতে পারে? ঈশ্বরের পরিচালনামূলক কার্যের ক্ষেত্রে, তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে তাঁর কর্ম সম্পাদন করেন, এবং প্রত্যেক ব্যক্তির সঙ্গে বাক্য বিনিময় করেন, এবং কোনোরকম দ্বিধা ও গোপনীয়তা ছাড়াই তিনি তাদের মুখোমুখী হন; কিন্তু, এর বিপরীতে, যারা তাঁকা অনুসরণ করে তাদের প্রত্যেকেই তাঁর প্রতি থেকে নিজেকে নিরুদ্ধ রেখেছে, কেউই সক্রিয়ভাবে তাঁর নিকটে আসতে, তাঁর হৃদয়ের প্রতি বিবেচনাশীল হতে, বা তাঁকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করতে, ইচ্ছুক নয়। ঈশ্বর যখন আনন্দময় ও সুখী থাকেন, তখনও কেউই তাঁর আনন্দ বা সুখের অংশীদার হয় না। মানুষ যখন ঈশ্বরকে ভুল বোঝে, তখনও তাঁর আহত হৃদয়ের শুশ্রুষার জন্য কেউ থাকে না। যখন তাঁর হৃদয় যন্ত্রণাকাতর হয়, তখনও তিনি এমন একজনকেও পান না যে তাঁকে তার উপর ভরসা করতে দিতে ইচ্ছুক। ঈশ্বরের পরিচালনামূলক কার্যের এই সহস্রাধিক বৎসরকালে, একজনও কেউ আসে নি, যে ঈশ্বরের আবেগগুলিকে উপলব্ধি করেছে, যে সেগুলিকে অনুধাবন বা স্বীকার করেছে, আর ঈশ্বরের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁর সুখ, দুঃখ ভাগ করে করে নিতে পারবে, এমন কোনো ব্যক্তির বিদ্যমান হওয়া তো দূরস্থান। ঈশ্বর নিঃসঙ্গ। ঈশ্বর একাকী! দুর্নীতিগ্রস্ত মানবজাতি তাঁর বিরোধিতা করে বলেই যে ঈশ্বর নিঃসঙ্গ, শুধু তেমনটাই কিন্তু নয়, তিনি এই কারণে আরো বেশি নিঃসঙ্গ, যে, যারা আধ্যাত্মিক হতে যায়, যারা ঈশ্বরকে জানতে ও উপলব্ধি করতে চায়, এবং, এমনকি, যারা তাঁর জন্য নিজেদের সমগ্র জীবন ব্যয় করতে ইচ্ছুক, তারাও তাঁর ভাবনাচিন্তাগুলি জানে না, বা তাঁর স্বভাব ও তাঁর আবেগগুলিকে উপলব্ধি করে না।

নোহর কাহিনির শেষভাগে, আমরা দেখি, যে, নিজেদের অনুভূতি প্রকাশের জন্য ঈশ্বর এক অচিরাচরিত পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন। এ হল এক সবিশেষ পদ্ধতি: মানুষের সঙ্গে এক সন্ধিচুক্তি স্থাপন, যা ঈশ্বরের দ্বারা বন্যার মধ্যমে পৃথিবীর ধ্বংসের সমাপ্তি ঘোষণা করেছে। উপরিগতভাবে, এই সন্ধিচুক্তি স্থাপনকে খুব সাধারণ একটা বিষয় বলে মনে হতে পারে। এ হল নিছকই বাক্যের মাধ্যমে দুটি পক্ষকে একত্রে বেঁধে রাখার ব্যবস্থা, যাতে এই চুক্তির লঙ্ঘন প্রতিরোধ করা যায়, যাতে উভয়পক্ষেরই স্বার্থরক্ষা ঘটে। আকারের দিক থেকে এ খুবই সাধারণ এক বিষয়, কিন্তু, এই কাজের নেপথ্যে ঈশ্বরের যে অভিপ্রায় এবং প্রেরণা রয়েছে, সেই নিরিখে এ হল ঈশ্বরের স্বভাব ও তাঁর মানসিক অবস্থার প্রকৃত উদ্‌ঘাটন। যদি তুমি এই বাক্যগুলিকে অবহেলা এবং উপেক্ষা করো, যদি আমি তোমাদের বিষয়গুলির সত্য সম্বন্ধে কখনোই না বলি, তাহলে মানবজাতি কখনোই ঈশ্বরের ভাবনাগুলিকে জানতে পারবে না। ঈশ্বর যখন এই সন্ধিচুক্তি করেছিলেন, তোমাদের কল্পনায় তিনি হয়তো তখন হাসছিলেন, বা হয়তো তিনি গুরুগম্ভীর ছিলেন, কিন্তু, যে সাধারণতম অনুভূতিগুলিরই ঈশ্বরের হয়েছে বলে মানুষ কল্পনা করুক না কেন, কেউই সক্ষম হয়নি দেখতে তাঁর অন্তর বা তাঁর যন্ত্রণা, তাঁর একাকিত্ব তো দূরস্থান। কেউই ঈশ্বরকে দিয়ে তার উপর বিশ্বাস স্থাপন করাতে বা তাঁর আস্থাভাজন হয়ে উঠতে পারেনি, বা এমন কেউ হয়ে উঠতে পারেনি যার কাছ ঈশ্বর ভরসা করে তাঁর চিন্তাভাবনা বা যন্ত্রণা প্রকাশ করতে পারেন। এই কারণেই, এই কাজটি করা ছাড়া ঈশ্বরের কোনো গতান্তর ছিল না। উপরিগতভাবে, মানবজাতি তখন যেমন ছিল, সেভাবে তাকে বিদায় জানিয়ে, অতীতের বিষয়গুলির মীমাংসা করে, এবং বন্যার দ্বারা পৃথিবীকে ধ্বংসের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে, ঈশ্বর খুব সহজ একটা কাজ করেছেন। তবে, সেই মুহূর্ত থেকে, ঈশ্বর নিজের হৃদয়ের গভীরে সেই যন্ত্রণা অবদমিত রেখেছেন। যে সময়ে ঈশ্বরের পাশে ভরসা করার মতো কেউ ছিল না, তখন তিনি মানবজাতির সঙ্গে একটা চুক্তি করেছিলেন, তাদের বলেছিলেন, যে, তিনি আর বন্যার দ্বারা এই পৃথিবীকে ধ্বংস করবেন না। যখন কোনো রামধনুর উদয় ঘটে, তখন তা মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেয়, যে, এমন কোনো ঘটনা ঘটেছিল, এবং তা তাদের পাপাচার থেকে বিরত থাকার বিষয়ে সতর্কও করে দেয়। এমনকি সেই যন্ত্রণাদগ্ধ অবস্থাতেও ঈশ্বর মানবজাতির কথা ভোলেননি এবং তখনো তাদের জন্য এতখানি উদ্বেগ দেখিয়েছিলন। তা কি ঈশ্বরের ভালোবাসা ও নিঃস্বার্থতা নয়? কিন্তু মানুষ যখন যন্ত্রণাভোগ করে, তখন তারা কী ভাবে? সেই সময়েই কি ঈশ্বরকে তাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয় না? তেমন সময়গুলিতেই, মানুষ সবসময় ঈশ্বরকে তাদের সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য টেনে আনে। যে সময়েই হোক না কেন, ঈশ্বর কখনোই মানুষকে নিরাশ করেন না, তিনি সততই তাদের সক্ষম করে তুলবেন যাতে তারা দুর্দশামুক্ত হয়ে আলোয় বসবাস করতে পারে। যদিও ঈশ্বর মানবজাতির উদ্দেশ্যে রসদের যোগান দেন, মানুষের হৃদয়ে ঈশ্বরের ভূমিকা আরামদায়ক বটিকা ও স্বাচ্ছন্দ্যপ্রদায়ক পাঁচনের বেশি কিছু নয়। ঈশ্বর যখন যন্ত্রণাভোগ করেন, তাঁর হৃদয় যখন আহত হয়, তখন নিজের পাশে একজন সৃষ্ট সত্তা বা ব্যক্তিকে চাওয়াটা ঈশ্বরের পক্ষে যেন নিঃসন্দেহেই অতিরিক্ত কিছু চাওয়া হয়ে যায়। মানুষ কখনোই ঈশ্বরের অনুভূতির প্রতি মনোযোগ দেয় না, তাই ঈশ্বরও কারো সান্ত্বনা দাবি করেন না প্রত্যাশাও করেন না। তিনি শুধু নিজের মনের ভাব প্রকাশের জন্য নিজস্ব পদ্ধতিসমূহ ব্যবহার করেন। মানুষ মনে করে না, যে, যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যাওয়াটা ঈশ্বরের পক্ষেও কঠিন, কিন্তু যখন তুমি ঈশ্বরকে প্রকৃতপক্ষেই উপলব্ধি করার চেষ্টা করো, তখন তুমি ঈশ্বর যা কিছু করেন তার মধ্যে ঈশ্বরের আন্তরিক অভিপ্রায়কে যথার্থরূপেই উপলব্ধি করতে পারো, ঈশ্বরের মহত্ত্ব ও তাঁর নিঃস্বার্থতা অনুভব করো। যদিও ঈশ্বর রামধনু ব্যবহার করে মানুষের সঙ্গে একটা সন্ধিচুক্তি করেছেন, কেন তিনি কখনোই কাউকে বলেননি যে কেন তিনি তা করেছেন সেটা—কেন তিনি এই সন্ধিচুক্তি স্থাপন করেছিলেন—অর্থাৎ, তিনি কখনোই তাঁর প্রকৃত চিন্তাভাবনাগুলি কাউকেই ব্যক্ত করেননি। তার কারণ হল, স্বহস্তে সৃষ্ট মানবজাতির প্রতি ঈশ্বরের প্রেমের গভীরতা উপলব্ধি করতে পারবে, এমন কেউ-ই নেই, এবং, এমন-ও কেউ নেই, যে, মানবজাতির ধ্বংসসাধনকালীন তাঁর হৃদয় যে যন্ত্রণাভোগ করেছিল, তা উপলব্ধি করতে পারে। তাই, তিনি যা অনুভব করেছিলেন, তা যদি তিনি মানুষকে বলতেনও, তবুও তারা তা বিশ্বাস তথা গ্রহণে সক্ষম হত না। যন্ত্রণায় থাকা সত্ত্বেও, তবু তিনি তাঁর কাজের পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা জারি রাখেন। ঈশ্বর সর্বদাই মানবজাতিকে তাঁর শ্রেষ্ঠ দিক ও শ্রেষ্ঠ বিষয়সকলই প্রদান করেম, কিন্তু সমস্ত যন্ত্রণা তিনি একাকী, নীরবে সহন করেন। ঈশ্বর কখনোই তাঁর সেই যন্ত্রণাসমূহের বিষয়ে প্রকাশ্যে উন্মোচন করেন না। পরিবর্তে, তিনি সেগুলি সহ্য করেন, এবং নীরবে অপেক্ষা করেন। ঈশ্বরের সহনশীলতা শীতল, অসাড় বা অসহায় নয়, বা, তা দুর্বলতার লক্ষণও নয়। বরং, ঈশ্বরের ভালোবাসা ও সারসত্য সর্বদাই নিঃস্বার্থ থেকেছে। এ হল তাঁর সারসত্য ও স্বভাবের প্রাকৃতিক উদ্ঘাটন, এবং প্রকৃত সৃষ্টিকর্তা হিসাবে ঈশ্বরের পরিচিতির এক যথার্থ মূর্তরূপ।

তবে, কেউ কেউ হয়তো আমার বক্তব্যের অপব্যাখ্যা করবে। “মানুষ যাতে ঈশ্বরের প্রতি দুঃখবোধ করে, সেই উদ্দেশ্যেই কি ঈশ্বরের অনুভূতি এত চাঞ্চল্যকর ও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বর্ণনা করা?” এখানে কি অভিপ্রায় এমনটাই? (তা নয়।) আমার এই বিষয়গুলি বলার একমাত্র উদ্দেশ্য হল তোমরা যাতে ঈশ্বরকে আরো ভালোভাবে জানো, তাঁর অসংখ্য দিকগুলি উপলব্ধি করো, তাঁর আবেগগুলি উপলব্ধি করো, এবং এমনটা অনুধাবন করো, যে, ঈশ্বরের সারসত্য এবং স্বভাব সুনির্দিষ্টভাবে এবং ক্রমাগত তাঁর কাজের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তা বর্ণিত হয়নি মানুষের শূন্যগর্ভ কথা, তাদের আক্ষরিক অর্থ ও মতবাদসমূহের মাধ্যমে। অর্থাৎ, ঈশ্বর এবং ঈশ্বরের সারসত্য বস্তুতই বিদ্যমান—সেগুলি চিত্র নয়, কল্পনা নয়, মানুষের দ্বারা নির্মিত নয়, এবং কোনোমতেই মানুষের দ্বারা উদ্ভাবিত নয়। তোমরা কি এখন তা স্বীকার করো? তোমরা যদি তা স্বীকার করো, তাহলে আমার আজকের আলোচনাটি তার লক্ষ্য অর্জন করেছে।

আমরা আজ তিনটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি। আমি বিশ্বাস করি যে, আমাদের এই তিনটি বিষয়ে আলোচনা থেকে তোমাদের প্রত্যেকে অনেক কিছু অর্জন করেছ। আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি যে, এই তিনটি বিষয়ের মাধ্যমে ঈশ্বরের যে চিন্তাভাবনার প্রসঙ্গ আমি বর্ণনা করেছি, বা ঈশ্বরের যে স্বভাব ও সারসত্যের বিষয়ে আমি উল্লেখ করেছি, তা মানুষের কল্পনার ও ঈশ্বরোপলব্ধির রূপান্তর ঘটিয়েছে, এমনকি তা প্রত্যেকের ঈশ্বরবিশ্বাসের রূপান্তর ঘটিয়েছে, এবং উপরন্তু, প্রত্যেকের নিজ-নিজ অন্তরে আরাধ্য ঈশ্বরে প্রতিমূর্তিরও রূপান্তর ঘটিয়েছে। যাই ঘটুক না কেন, আমি আশা করি যে, বাইবেলের এই দুটি অংশ থেকে ঈশ্বরের স্বভাব সম্পর্কে তোমরা যা শিক্ষা গ্রহণ করলে, তা তোমাদের পক্ষে মঙ্গলপ্রদ হবে, এবং আমি আশা করি যে, ফিরে যাওয়ার পর, তোমরা এই নিয়ে আরো চিন্তাভাবনায় সচেষ্ট হবে। আজকের সভা এখানেই শেষ হল। বিদায়!

নভেম্বর ৪, ২০১৩

পূর্ববর্তী: ঈশ্বরের স্বভাব এবং তাঁর কাজের দ্বারা অর্জিত হতে চলা ফলাফল জানার উপায়

পরবর্তী: ঈশ্বরের কর্ম, ঈশ্বরের স্বভাব এবং স্বয়ং ঈশ্বর ২

প্রতিদিন আমাদের কাছে 24 ঘণ্টা বা 1440 মিনিট সময় থাকে। আপনি কি ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভের জন্য তাঁর বাক্য শিখতে 10 মিনিট সময় দিতে ইচ্ছুক? শিখতে আমাদের ফেলোশিপে যোগ দিন। কোন ফি লাগবে না।

সেটিংস

  • লেখা
  • থিমগুলি

ঘন রং

থিমগুলি

ফন্টগুলি

ফন্ট সাইজ

লাইনের মধ্যে ব্যবধান

লাইনের মধ্যে ব্যবধান

পৃষ্ঠার প্রস্থ

বিষয়বস্তু

অনুসন্ধান করুন

  • এই লেখাটি অনুসন্ধান করুন
  • এই বইটি অনুসন্ধান করুন

Messenger-এর মাধ্যমে আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন