অধ্যায় ৩৬
সমস্তকিছু আমার হস্তের দ্বারা আয়োজিত হয়। যদৃচ্ছ কর্ম সম্পাদনের স্পর্ধা কে করে? কেই-বা অনায়াসে তা পরিবর্তন করতে পারে? মানুষ বায়ুতে ইতস্তত ভাসমান, ধূলিকণার ন্যায় সঞ্চরণশীল, তাদের মুখমণ্ডল ধূলিধূসরিত, যা তাদের আপাদমস্তক বিতৃষ্ণাজনক করে তুলেছে। এক ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে আমি মেঘরাজির মধ্য থেকে লক্ষ্য করি: যে মানুষ একদা প্রাণশক্তিতে পূর্ণ ছিল, সে এরকম হয়ে গিয়েছে কেন? এবং কেন-ই বা সে এবিষয়ে অনবহিত, এবং এর প্রতি অসংবেদনশীল? কেন সে “নিজেকে সংবরণ করে না” এবং নিজেকে আবিলতায় আচ্ছন্ন হতে দেয়? নিজের সম্বন্ধে তার প্রেম ও শ্রদ্ধা এমনই অপ্রতুল। আমার প্রশ্নকে মানুষ সর্বদাই কেন এড়িয়ে যায়? আমি কি সত্যিই তার প্রতি নিষ্ঠুর ও অমানবিক? প্রকৃতই কি আমি অত্যধিক কর্তৃত্বব্যঞ্জক ও যুক্তিবোধহীন? তাহলে সততই তারা কেন আমার দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকায়? সর্বদাই কেন তারা আমায় ঘৃণা করে? আমি কি তাদের পথের প্রান্তে এনে দাঁড় করিয়েছি? আমার শাস্তির মধ্যে মানুষ কখনো কিছু আবিষ্কার করেনি, কারণ নিজের কাঁধের জোয়ালটি দুই হাতে আঁকড়ে ধরা ব্যতীত আর কিছুই সে করে না, দুই চক্ষু আমার উপর নিবদ্ধ রাখে, যেন-বা কোনো শত্রুকে নিরীক্ষণ করছে—এবং কেবল সেই মুহূর্তেই আমি অনুভব করি সে কতখানি কঙ্কালসার। এই কারণেই আমি বলি যে পরীক্ষার মাঝে কেউই কখনো অবিচল থাকেনি। মানুষের আত্মিক উচ্চতা কি ঠিক এমনই নয়? আমার কি তাকে তার “মাপজোক”-এর অঙ্কগুলি বলার প্রয়োজন রয়েছে? মানুষের “উচ্চতা” ভূমিতে হামাগুড়ি দিয়ে চলা ক্ষুদ্র কোনো কীট অপেক্ষা অধিক কিছু নয়, এবং তার “বক্ষদেশ”-এর প্রস্থ নেহাতই কোনো সর্পের সমান। এর মাধ্যমে মানুষকে আমি খর্ব করছি না—এগুলিই কি তার আত্মিক উচ্চতার যথাযথ পরিমাপ নয়? আমি কি মানুষের মর্যাদা লাঘব করেছি? মানুষ ক্রীড়ারত কোনো শিশুর ন্যায়। এমনকি কখনো কখনো সে জন্তুদের সাথেও খেলাধুলা করে, তবুও সে আনন্দিত রয়; এবং কোনো বেড়ালের মতো সে-ও এক চিন্তা-ভাবনামুক্ত জীবন যাপন করে। হয়তো আত্মার পরিচালনার কারণে, কিংবা স্বর্গস্থ ঈশ্বরের ভূমিকার দরুন, ধরাধামে মানুষের অমিতব্যয়ী জীবনশৈলীর ব্যাপারে আমি গভীরভাবে অবসন্ন বোধ করি। মানুষের জীবনের কারণে—যে জীবন কোনো পরজীবীর জীবনের অনুরূপ—“মানবজীবন” শব্দবন্ধটির বিষয়ে আমার “আগ্রহ” কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে, এবং সেকারণেই মানবজীবনের প্রতি আমি কিয়ৎপরিমাণে “শ্রদ্ধাসম্পন্ন” হয়ে পড়েছি। কারণ মনে হয় একমাত্র মানুষই বুঝি এক অর্থপূর্ণ জীবন সৃষ্টি করতে সক্ষম, যেখানে আমি সেই কাজে অসমর্থ। সুতরাং আমি শুধুই পিছু হঠে “পর্বত”-এ প্রত্যাবর্তন করতে পারি, কারণ মানুষের মাঝে দুঃখকষ্টের অভিজ্ঞতা লাভ ও তা পর্যবেক্ষণ করতে আমি অক্ষম। অথচ মানুষ সেটাই করতে আমায় জরুরি ভিত্তিতে জবরদস্তি করে—আমার কোনো বিকল্প নেই! মানুষের বন্দোবস্ত মান্য করা, তার সাথে একত্রে অভিজ্ঞতার সারসংক্ষেপ করা, এবং তার পাশাপাশি মানবজীবনের মধ্য দিয়ে যাওয়া ব্যতীত আমার গত্যন্তর নেই। স্বর্গে, একদা আমি সমগ্র নগর পরিভ্রমণ করেছিলাম, এবং স্বর্গের নিচে, একদা সকল রাষ্ট্রে পর্যটনে গিয়েছিলাম। তবু কেউ কখনো আমায় খুঁজে পায়নি; তারা কেবল আমার চলাফেরার শব্দ শুনেছে। মানুষের নজরে, আমি কোনো চিহ্ন বা ছায়ামাত্র না রেখে যাওয়া-আসা করি। মনে হয় বুঝি তাদের অন্তরে আমি এক অদৃশ্য মূর্তিতে পরিণত হয়েছি, অথচ মানুষ তা বিশ্বাস করে না। এমন কি হতে পারে যে এসবকিছুই মানুষের নিজের মুখে কবুল করা সত্য ঘটনা নয়? এই পর্যায়ে এসে, কে-ই বা অস্বীকার করে যে তার শাস্তি পাওয়া উচিত? সুনির্দিষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণের মুখোমুখি মানুষ কি এখনো তাদের মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে?
মানুষের মাঝে আমি এক “ব্যবসায়িক চুক্তি” সম্পাদন করছি, আমি তার যাবতীয় অশুদ্ধি ও অন্যায়পরায়ণতা অপনোদন করি, এবং এইভাবে তার “প্রক্রিয়াকরণ” ঘটাই যাতে সে আমার ইচ্ছার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। তবু এই পর্যায়ের কাজে মানুষের সহযোগিতা অপরিহার্য, কারণ সর্বদাই সে সদ্যধৃত মৎস্যের ন্যায় লম্ফঝম্প করছে। সেকারণেই, কোনো দুর্ঘটনা নিবারণার্থে, ধরা পড়া সমস্ত “মৎস্য”-কে আমি হত্যা করেছিলাম, তার পর থেকে মৎস্যগুলি আজ্ঞাকারী হয়ে উঠেছিল, এবং তাদের সামান্যতম অনুযোগ ছিল না। যখন আমার মানুষের প্রয়োজন হয়, তখন সে সততই লুক্কায়িত। মনে হয় যেন-বা কখনোই সে আশ্চর্যজনক দৃশাবলী প্রত্যক্ষ করেনি, বুঝি বা গ্রামাঞ্চলে তার জন্ম হয়েছিল এবং নাগরিক বিষয়াদি সম্পর্কে কিছুমাত্র অবগত নয়। মানুষের যে অংশগুলিতে ঘাটতি সেখানে আমি প্রজ্ঞা যোগ করি, এবং তাকে আমার বিষয়ে অবহিত করি; যেহেতু মানুষ নিতান্তই দীনদরিদ্র, সেহেতু ব্যক্তিগতভাবে আমি মানুষের মাঝে এসে তাকে “ঐশ্বর্যের পথ” প্রদান করি, নিজ চক্ষুদ্বয় উন্মোচিত করতে তাকে বাধ্য করি। এর মাধ্যমে আমি কি তাকে উদ্ধার করছি না? তা কি মানুষের প্রতি আমার অনুকম্পা নয়? ভালোবাসা কি শর্তনিরপেক্ষভাবে সম্প্রদান? ঘৃণা কি তাহলে শাস্তি? মানুষকে আমি বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত থেকে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়েছি, কিন্তু সেগুলিকে সে নিছক বাক্যাবলী ও মতবাদসমূহ বলে গণ্য করে। মনে হয় আমার উচ্চারণসমূহ বুঝি ত্রুটিপূর্ণ সামগ্রী, মানুষের হাতে যা অকাজের বস্তু হিসাবে স্বল্পমূল্যে বিক্রি করা হয়। সেকারণেই, মানুষকে আমি যখন বলি যে এক প্রচণ্ড ঝটিকা পার্বত্য জনপদটি গ্রাস করতে আসছে, তখন কেউই একে কোনো গুরুত্ব দেয় না, তাদের মধ্যে কেবল স্বল্প কয়েকজন, সংশয়িত চিত্তে, নিজেদের ঘরবাড়ি স্থানান্তরিত করে। বাকিরা স্থান পরিবর্তন করে না, যেন-বা নির্লিপ্ত, যেন-বা আমি আকাশে উড্ডীন কোনো ভরত পক্ষী—আমার বক্তব্যের কোনোকিছুই তারা উপলব্ধি করে না। কেবল যখন পর্বতরাজি পতিত এবং ধরিত্রী ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়, একমাত্র তখনই মানুষ আমার বাক্যনিচয়ের বিষয়ে চিন্তা করে, শুধু তখনই তারা তাদের স্বপ্ন থেকে জেগে ওঠে, কিন্তু সময় ইতিমধ্যেই উপনীত হয়েছে, ভয়ঙ্কর বন্যা তাদের গ্রাস করে, তাদের শবদেহগুলি জলতলে ভাসতে থাকে। জগতের দুর্দশা দেখে, মানুষের দুর্ভাগ্যের দরুন আমি এক দীর্ঘশ্বাস ফেলি। মানুষের নিয়তির স্বার্থে প্রচুর সময় আমি ব্যয় করেছি, এবং এক বিপুল মূল্য আমি পরিশোধ করেছি। মানুষ মনে করে আমার বুঝি কোনো অশ্রুনালী নেই—কিন্তু আমি, অশ্রুনালী বিরহিত এই “কিম্ভূতকিমাকার ব্যক্তি”, মানুষের নিমিত্ত অনেক অশ্রু বিসর্জন করেছি। মানুষ, অবশ্য, এর কিছুই জানে না, ধরাধামে সে কেবলই তার হাতের খেলনা নিয়ে ক্রীড়ারত থাকে, বুঝি-বা আমার কোনো অস্তিত্বই নেই। সেকারণেই, আজকের পরিস্থিতিতে, মানুষ অসাড় ও স্থূলবুদ্ধিই রয়ে যায়; তারা এখনো ভূগর্ভস্থ কুঠুরিতে “হিমায়িত”, যেন-বা আজও তারা কোনো গুহামধ্যে শায়িত। মানুষের ক্রিয়াকলাপ প্রত্যক্ষ করার পর, আমার হাতে একমাত্র বিকল্প থাকে প্রস্থান করা …
মানুষের দৃষ্টিতে, আমি মানুষের পক্ষে শুভপ্রদ অনেক কার্য করেছি, এবং সেকারণে তারা আমায় বর্তমান যুগের এক পথিকৃৎ হিসাবে গণ্য করে। তবুও তারা কখনো আমায় মনুষ্য-নিয়তির সার্বভৌম নিয়ন্ত্রক এবং সমস্তকিছুর সৃষ্টিকর্তা বলে মনে করেনি। মনে হয় বুঝি তারা আমায় উপলব্ধি করে না। যদিও মানুষ একদা “উপলব্ধি দীর্ঘজীবী হোক” বলে আওয়াজ তুলেছিল, কিন্তু “উপলব্ধি” শব্দটি বিশ্লেষণ করার পিছনে কেউই অধিক সময় ব্যয় করেনি, যা থেকে প্রতিপন্ন হয় যে আমাকে ভালোবাসার কোনো বাসনা মানুষের নেই। আজকের দিনে, মানুষ কখনো আমায় মূল্যবান গণ্য করেনি, তাদের অন্তরে আমার কোনো স্থান নেই। আসন্ন দুঃখযন্ত্রণার দিনে তারা কি আমার প্রতি এক প্রকৃত ভালোবাসা প্রদর্শন করতে পারবে? মানুষের ন্যায়পরায়ণতা নিরাকার, দর্শন ও স্পর্শের অতীত কোনো বস্তু হয়ে রয়ে গেছে। আমার যা কাঙ্ক্ষিত তা হল মানুষের হৃদয়, কারণ মানবশরীরে সর্বাপেক্ষা মূল্যবান অঙ্গ হল হৃদয়। আমার কৃতকর্মগুলি কি মানুষের হৃদয়ের দ্বারা পরিশোধযোগ্য নয়? মানুষ তাদের হৃদয় কেন আমায় প্রদান করে না? সততই কেন তারা তা আপন বক্ষে আঁকড়ে রাখে, ছেড়ে দিতে কেন অনিচ্ছুক? মানুষের হৃদয় কি তাদের আজীবনের শান্তি ও আনন্দ নিশ্চিত করতে পারে? মানুষের কাছে আমি দাবিসমূহ উত্তোলিত করলে সর্বদাই তারা কেন ভূমি থেকে একমুষ্টি ধূলি তুলে আমার দিকে ছুঁড়ে মারে? তা কি মানুষের সুচতুর অভিসন্ধি? মনে হয় তারা বুঝি গন্তব্যহীন কোনো পথচারীকে প্রতারণা করার চেষ্টা করছে, তাকে নিজেদের গৃহে ফিরে যাওয়ার জন্য প্রলুব্ধ করছে, যেখানে তারা নিষ্করুণ হয়ে ওঠে এবং তাকে হত্যা করে। আমার সাথেও মানুষ এমনই করতে চেয়েছে। যেন তারা কোনো জল্লাদ, যে নির্বিকারচিত্তে কাউকে হত্যা করবে, যেন-বা তারা শয়তানদের রাজা, নরহত্যা যার কাছে সহজাত প্রবৃত্তির সামিল। কিন্তু অধুনা মানুষ আমার সম্মুখে আসে, এখনো ওই ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করতে চায়—তবু তাদের নিজস্ব পরিকল্পনাসমূহ আছে, এবং আমিও এর পাল্টা ব্যবস্থা নিয়ে রেখেছি। যদিও মানুষ আমায় ভালোবাসে না, তবু কীভাবে আমি এই সময়ে আমার পাল্টা ব্যবস্থাসমূহ মানুষের কাছে প্রকাশ না করে পারি? মানুষকে সামলানোর ক্ষেত্রে আমার অপার ও অপরিমেয় দক্ষতা রয়েছে; তার প্রতিটি অংশ আমার দ্বারা ব্যক্তিগতভাবে নিয়ন্ত্রিত ও অধিকৃত হয়। পরিশেষে, মানুষকে আমি তার ভালোবাসার বস্তুর থেকে বিচ্ছেদ-বেদনা সহ্য করাবো, এবং আমার আয়োজনের কাছে সমর্পণ করতে বাধ্য করবো, এবং তখন মানুষের অনুযোগ করার মতো কী থাকবে? আমার যাবতীয় কৃতকর্ম কি মানুষের স্বার্থেই নয়? বিগত দিনে, আমার কার্যের পদক্ষেপগুলির বিষয়ে আমি মানুষকে কখনো অবহিত করিনি—কিন্তু আজ, সময়কাল যখন ভিন্নতর, যেহেতু আমার কার্যের বিষয়বস্তুও পৃথক, সেহেতু পূর্বাহ্নেই মানুষকে আমি স্বীয় কার্যের বিষয়ে অবগত করেছি, যাতে এর দরুন তারা অধঃপতিত না হয়। এ-ই কি আমার দ্বারা মানুষের মধ্যে অন্তঃপ্রবিষ্ট করা সেই টিকা নয়? যে কারণেই হোক, আমার বাক্যসমূহ মানুষ কখনো গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করেনি; যেন-বা তাদের উদরে ক্ষুধা রয়েছে এবং খাদ্যবস্তুর ব্যাপারে তাদের কোনো বাছবিচার নেই, যার ফলে তাদের পাকস্থলী দুর্বল হয়ে পড়েছে। কিন্তু মানুষ তাদের “স্বাস্থ্যবান শারীরিক সংগঠন”-কে মূলধন হিসাবে গ্রহণ করে এবং “চিকিৎসক”-এর সাবধানবাণীর প্রতি কর্ণপাত করে না। তাদের অসংবেদী মনোভাব লক্ষ্য করে, মানুষের সম্পর্কে আমি উদ্বিগ্ন বোধ করি। যেহেতু মানুষ অপরিণত, এবং এখনও মানবজীবনের অভিজ্ঞতা লাভ করেনি, সেহেতু তাদের কোনো ভীতিবোধ নেই; তাদের অন্তরে “মানবজীবন” শব্দটির অস্তিত্ব নেই, এর বিষয়ে তাদের কোনো বিবেচনাই নেই, এবং আমার বাক্যসমূহ শ্রবণ করে তারা কেবলই ক্লান্ত বোধ করে, যেন-বা আমি কথাবার্তায় অসংলগ্ন কোনো বৃদ্ধা মহিলায় পরিণত হয়েছি। সংক্ষেপে, ঘটনা যা-ই হোক না কেন, আমি আশা পোষণ করি যে মানুষ আমার হৃদয়কে উপলব্ধি করতে পারবে, কারণ মানুষকে মৃত্যুভূমিতে প্রেরণের কোনো বাসনা আমার নেই। আমি আশা রাখি যে এই মুহূর্তে আমার যে মেজাজ মানুষ তা উপলব্ধি করতে পারবে, এবং ঠিক এই সময়টিতে যে দায়ভার আমি বহন করছি তার প্রতি সহানুভূতিশীল হবে।
এপ্রিল ২৬, ১৯৯৯২