স্বয়ং অনন্য ঈশ্বর ৩

ঈশ্বরের কর্তৃত্ব (২)

আজ আমরা “স্বয়ং অনন্য ঈশ্বর” বিষয়ে আমাদের আলোচনা চালিয়ে যাবো। এই বিষয়ের উপর আগেই আমরা দুটি আলোচনা করেছি। প্রথমটির বিষয় ছিল ঈশ্বরের কর্তৃত্ব, এবং দ্বিতীয়টির বিষয় ছিল ঈশ্বরের ন্যায়পরায়ণ স্বভাব। এই দুটি আলোচনা শোনার পর ঈশ্বরের পরিচয়, মর্যাদা এবং তাঁর সারমর্ম সম্বন্ধে তোমরা নতুন কোনো উপলব্ধিতে কি পৌঁছতে পেরেছ? ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও সত্যতা নিশ্চিত করতে এই উপলব্ধি কি কোনোভাবে তোমাদের সাহায্য করেছে? আজ “ঈশ্বরের কর্তৃত্ব” সম্পর্কে বিস্তারিত বলব ঠিক করেছি।

বিশাল এবং ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র দৃষ্টিকোণ থেকে ঈশ্বরের কর্তৃত্ব অনুধাবন

ঈশ্বরের কর্তৃত্ব অনন্য। এটি স্বয়ং ঈশ্বরের পরিচিতির চারিত্রিক অভিব্যক্তি এবং বিশেষ সারসত্য, যেমনটা কোনো সৃষ্ট বা অসৃষ্ট অস্তিত্বের অধিকারে নেই। একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই এই ধরনের কর্তৃত্বের অধিকারী। অর্থাৎ বলা যেতে পারে শুধুমাত্র স্রষ্টা—অনন্য ঈশ্বর—কেই এভাবে বর্ণনা করা যেতে পারে এবং একমাত্র তাঁর মধ্যেই এই নির্যাস রয়েছে। তা হলে আমরা ঈশ্বরের কর্তৃত্ব নিয়ে কেন আলোচনা করবো? স্বয়ং ঈশ্বরের কর্তৃত্ব কীভাবে মানুষের মনের ধারণায় থাকা “কর্তৃত্ব” থেকে আলাদা? কী বিশেষত্ব রয়েছে এর মধ্যে? এই বিষয়ের আলোচনা এখানে এত বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ কেন? তোমাদের প্রত্যেককে এ ব্যাপারটি অবশ্যই সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। “ঈশ্বরের কর্তৃত্ব” সম্পর্কে বেশির ভাগ মানুষের ধারণাই খুব অস্পষ্ট। এই ধারণাকে সম্যক অনুধাবন করতে গেলে প্রভূত প্রয়াসের প্রয়োজন এবং এ ব্যাপারে যেকোনো আলোচনাই বিমূর্ত। সুতরাং, ঈশ্বরের কর্তৃত্বের সারমর্ম, এবং মানুষ সাধারণত যে ভাবে ঈশ্বরের কর্তৃত্বকে বোঝে—এই দুইয়ের মধ্যে একটি শূণ্যস্থান থাকা অবশ্যম্ভাবী। এই ব্যবধান পূরণ করতে প্রত্যেককেই ধীরে ধীরে প্রতিটি মানুষ, ঘটনা, বস্তু এবং মনুষ্য-সাধ্য এবং মনুষ্য-বোধ্য যে সব ঘটনা বাস্তব জীবনে ঘটে তার দ্বারা ঈশ্বরের কর্তৃত্বকে জানতে হবে। “ঈশ্বরের কর্তৃত্ব” এই শব্দবন্ধ ধারণাতীত মনে হতে পারে, প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বরের কর্তৃত্ব কিন্তু বিমূর্ত নয়। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে তিনি মানুষের সঙ্গী এবং প্রতিদিনই তিনি তাকে পথ দেখান। সুতরাং বাস্তব জীবনে প্রতিটি মানুষ নিশ্চিতভাবে প্রত্যক্ষ করে এবং অনুভব করে ঈশ্বরের কর্তৃত্বের বাস্তব দিক। ঈশ্বরের কর্তৃত্ব যে সত্যই আছে তার যথেষ্ট প্রমাণ এই বাস্তব দিক। এ থেকেই যে কোন মানুষ নিঃসংশয়ে চিনতে এবং উপলব্ধি করতে পারে যে ঈশ্বর এই কর্তৃত্বের অধিকারী।

সবকিছুই ঈশ্বরের সৃষ্ট এবং সৃষ্টির পরে তিনি সবকিছুরই অধিপতি। এই আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি তিনিই নিয়ন্ত্রণ করেন সবকিছু। “ঈশ্বর সমস্তকিছুর নিয়ন্তা”—এ কথার অর্থ কী? কীভাবে এটিকে ব্যাখ্যা করা যায়? বাস্তব জীবনে এর প্রয়োগই বা কীভাবে ঘটে? ঈশ্বর যে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন সেই সত্য আমরা উপলব্ধি করলেও তা থেকে কী ভাবে আমরা তাঁর কর্তৃত্ব কে বুঝব? “ঈশ্বর সমস্তকিছুর নিয়ন্তা”—বিশেষ এই বাক্যবন্ধ থেকেই আমাদের বোধগম্য হয়, ঈশ্বরের নিয়ন্ত্রণ শুধুমাত্র এই পৃথিবী, সৃষ্টি এবং মানুষের কোনও কোনও অংশের উপরেই নয়—বিশালকায় থেকে আণুবীক্ষণিক, দৃশ্য বা অদৃশ্য, মহাকাশের নক্ষত্রমণ্ডলী থেকে এই পৃথিবীর জীবিত প্রাণী, প্রতিটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণপুঞ্জ বা অণুজীব যেগুলি খালি চোখে দেখতেও পাওয়া যায় না, এবং সেই সব অস্তিত্ব যারা অন্যরূপে বিদ্যমান—এগুলির প্রতিটির উপরেই ঈশ্বরের আধিপত্য। অর্থাৎ, “সমস্তকিছু” যা ঈশ্বর “নিয়ন্ত্রণ করেন” তার সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা হল এটিই; এটিই তাঁর কর্তৃত্বের, তাঁর সার্বভৌমত্ব ও শাসনের পরিধি।

মানুষের আবির্ভাবের আগে থেকেই এই মহাবিশ্বে এবং মহাকাশে গ্রহ এবং নক্ষত্ররাজির অস্তিত্ব ছিল। সামগ্রিকভাবে মহাবিশ্বের বিবেচনা করলে, এই সব জ্যোতিষ্ক তাদের কক্ষপথ পরিক্রমা করত ঈশ্বরেরই নিয়ন্ত্রণে এবং যত দীর্ঘ সময় আগে থেকেই হোক, ঈশ্বরেরই ইচ্ছাতেই তাদের সম্পূর্ণ অস্তিত্ব বজায় রয়েছে। কোন নির্দিষ্ট সময়ে কোন গ্রহ কোথায় যাবে, কোন গ্রহ কখন এবং কোন কাজ করবে, কোন গ্রহ নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘুরবে, এবং কখন অদৃশ্য বা প্রতিস্থাপিত হবে—এই সবকিছুই ঘটে চলে ন্যূনতম ত্রুটি ছাড়াই। গ্রহগুলির অবস্থান এবং তাদের পারস্পরিক দূরত্ব কঠোর নিয়ম মেনে চলে, যার সম্পূর্ণ বর্ণনা করা সম্ভব সুনির্দিষ্ট তথ্য দ্বারা। কোন পথে গ্রহগুলির পরিক্রমা হবে, কক্ষপথে তাদের গতি এবং চলনভঙ্গি, কোন সময় কোন গ্রহ কোথায় থাকবে—এর সবগুলিই বিশেষ নিয়ম দ্বারা নিখুঁতভাবে হিসাব করা সম্ভব এবং সেগুলি বর্ণনা করা সম্ভব। যুগ যুগ ধরে গ্রহগুলি সামান্যতম বিচ্যুতি ছাড়াই এই নিয়ম অনুসরণ করে চলেছে। কোনও শক্তিই এগুলির কক্ষপথে কোনও বদল বা বাধার সৃষ্টি করতে পারে না, পরিবর্তন করতে পারে না তাদের পরিক্রমণের সুনির্দিষ্ট ছন্দ। কারণ, যে বিশেষ নিয়ম তাদের গতি নিয়ন্ত্রিত করে, এবং যে সুনির্দিষ্ট তথ্য দ্বারা তা বর্ণনা করা যায়, তা স্রষ্টার কর্তৃত্বেই পূর্বনির্ধারিত, তারা সৃষ্টিকর্তার সার্বভৌমত্ব ও নিয়ন্ত্রণের অধীন, এবং তারা স্বেচ্ছায় এই নিয়মগুলি মেনে চলে। আবার, ক্ষুদ্রতম স্তরে কিছু নির্দিষ্ট ধাঁচ, তথ্য বা বিচিত্র ও ব্যাখ্যাতীত ঘটনা বা নিয়ম আবিষ্কার করা মানুষের পক্ষে কঠিন নয়। যদিও মানবজাতি স্বীকার করে না যে ঈশ্বর বর্তমান, এই সত্যও স্বীকার করে না যে সবকিছু স্রষ্টারই তৈরী এবং তাতে তাঁরই আধিপত্য, এমনকি স্রষ্টার কর্তৃত্বের অস্তিত্বকেও স্বীকার করে না, কিন্তু বিজ্ঞানী, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, পদার্থবিদ এরা ক্রমশই খুঁজে পাচ্ছে যে, মহাবিশ্বের সমস্ত বস্তুর অস্তিত্ব, সেই নীতি এবং নিয়ম যা তাদের গতিবিধি নির্দেশ করে, সবই শাসিত এবং নিয়ন্ত্রিত হয় এক বিশাল এবং অদৃশ্য অন্ধকার শক্তির দ্বারা। এই সব তথ্যের মুখোমুখি হয়ে মানুষ বিশ্বাস করতে বাধ্য হয় যে এই সব বিবিধ গতির ধাঁচের কেন্দ্রে এমন শক্তিমান কেউ আছেন যিনি এই সবগুলির সমন্বয় সাধন করেন। যদিও তাঁর ক্ষমতা অসাধারণ এবং যদিও কেউ কখনও তাঁর প্রকৃত রূপ দেখতে পায় নি, প্রতি মুহূর্তে তিনিই সবকিছু পরিচালনা এবং নিয়ন্ত্রণ করেন। তাঁর সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করার মত ক্ষমতা কোনও শক্তি বা মানুষের নেই। এই সব তথ্যের মুখোমুখি হয়ে মানুষকে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, সমস্ত কিছুর অস্তিত্ব—নিয়ন্ত্রণকারী নিয়ম মানুষের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে পারে না, তার পরিবর্তন কেউ ঘটাতে পারে না। তাকে এ কথাও স্বীকার করতে হবে যে এইসব নিয়ম সম্পূর্ণরূপে মানুষের বোধগম্য নয়, এবং সেগুলি প্রাকৃতিকভাবে ঘটছে না, কিন্তু একটি সার্বভৌম শক্তির দ্বারা নির্দেশিত। এগুলি সবই ঈশ্বরের কর্তৃত্বের অভিব্যক্তি যা মানবজাতি উপলব্ধি করতে পারে বৃহৎ স্তরে।

ক্ষুদ্র স্তরে, সব পর্বত, নদী পুষ্করিণী সমুদ্র এবং স্থলভাগ—যা কিছু মানুষ এই পৃথিবীতে দেখে, যতগুলি ঋতুর অভিজ্ঞতা মানুষের হয়, বৃক্ষ, প্রাণী, অণুজীব এবং মানুষ সমেত এই পৃথিবী যত জীবের আবাসভূমি—এগুলির প্রত্যেকটিই ঈশ্বরের আধিপত্য এবং নিয়ন্ত্রণের অধীন। তাঁর সার্বভৌমত্ব এবং নিয়ন্ত্রণের অধীনে, তাঁর ভাবনা অনুসারেই সব কিছুর সৃষ্টি এবং বিনাশ ঘটে; এই সব কিছুর অস্তিত্ব রক্ষার এবং পরিচালনায় নিয়ম উদ্ভূত হয় এবং তার সঙ্গে তাল মিলিয়েই সমস্ত কিছু বর্ধিত হয় এবং তাদের সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটে। কোনও মানুষ বা বস্তু নিয়মের এই শৃঙ্খলের ঊর্ধ্বে নয়। কেন এমন হয়? একমাত্র জবাব হল: ঈশ্বরের কর্তৃত্বই এর কারণ। অথবা অন্যভাবে বলা যায়, ঈশ্বরের চিন্তা এবং ঈশ্বরের বাক্যের কারণেই এইরকম হয়; স্বয়ং ঈশ্বরের নিজস্ব ক্রিয়ার ফলেই হয়। অর্থাৎ ঈশ্বরের কর্তৃত্ব এবং ঈশ্বরের মস্তিষ্কেই এইসব নিয়মের উদ্ভব, তাঁর ইচ্ছা অনুসারেই তাদের স্থানান্তর বা পরিবর্তন, এবং তাঁরই পরিকল্পনা অনুসারে সেগুলির স্থানান্তর, পরিবর্তন ঘটে বা সেগুলি বিলীন হয়ে যায়। উদাহরণ হিসেবে মহামারীর কথাই ধরা যাক। কোনও আগাম সতর্কতা ছাড়াই ছড়িয়ে পড়ে মহামারী। কেউই জানে না তার উৎস কোথায় অথবা ঠিক কী কারণে এটি ঘটে, এবং যখনই কোন একটি নির্দিষ্ট স্থানে মহামারী পৌঁছয়, তখন যাদের বিনাশ হয়েছে তারা কেউই এই বিপর্যয় থেকে অব্যাহতি পায় না। মানুষের বিজ্ঞান জানে যে, মহামারীর কারণ হলো দূষিত এবং ক্ষতিকারক জীবাণুর সংক্রমণ, এবং তাদের গতি, পরিসর ও সংক্রমণ পদ্ধতির পূর্বাভাস বা নিয়ন্ত্রণ কোনওটিই মানুষের বিজ্ঞান করতে পারে না। যদিও মহামারীকে ঠেকাতে মানুষ সর্বতোভাবে সচেষ্ট, কিন্তু কোন কোন মানুষ বা প্রাণী অবশ্যম্ভাবীভাবে এই মহামারীর আক্রমণের শিকার হবে মানুষ তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। মানুষের একমাত্র কাজ হল তাদের প্রতিরোধের চেষ্টা করা, তাদের বাধা দেওয়া এবং গবেষণা চালানো। কিন্তু কেউই জানে না সেই মূল কারণগুলি যা কোনও একটি মহামারীর শুরু বা শেষকে ব্যাখ্যা করে, এবং কেউই তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। কোনও একটি মহামারী উদ্ভব এবং সংক্রমণে মানুষ প্রথমেই সচেষ্ট হয় একটি প্রতিষেধক গড়ে তুলতে। কিন্তু প্রতিষেধক তৈরী সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই প্রায়শই একটি মহামারী নিজে থেকেই শেষ হয়ে যায়। মহামারী কেন শেষ হয়? অনেকে বলেন, জীবাণুকে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে; অনেকের মতে আবার ঋতু পরিবর্তনই হল তাদের চলে যাওয়ার আসল কারণ…। অতিকল্পিত এই অনুমানগুলি আদপেই যুক্তিগ্রাহ্য কিনা, তার কোন ব্যাখ্যা বা সুনির্দিষ্ট উত্তর বিজ্ঞান দিতে পারে না। মানবতাকে এইসব অনুমান দ্বারাই শুধু নয়, মানুষের বিচারবুদ্ধির অভাব এবং মহামারীর আতঙ্ক দ্বারাও বিবেচনা করে দেখা উচিত। চূড়ান্ত বিশ্লেষণের পরেও একথা কেউই জানে না যে মহামারী কেন শুরু হয়, আর কেনই বা তা শেষ হয়। যেহেতু মানবজাতির বিশ্বাস শুধুই বিজ্ঞানের উপর, তার উপরেই তারা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে, এবং স্রষ্টার কর্তৃত্বকে চিনতে পারেনা, অথবা তাঁর সার্বভৌমত্বকেও তারা গ্রহণ করতে পারেনা, তাই তারা উত্তরও কোনোদিন পাবে না।

ঈশ্বরের সার্বভৌমত্বে সকল প্রাণীর জন্ম হয়, তারা জীবন অতিবাহিত করে আবার নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, কারণ এটাই তাঁর কর্তৃত্ব এবং পরিচালনার অঙ্গ। কিছু জিনিস আসে এবং নিঃশব্দে চলে যায়, আর মানুষ বলতেও পারেনা যে তারা কোথা থেকে আসে, এই প্রক্রিয়া তারা বুঝতে পারেনা, তাই কেন তারা আসে আর চলে যায়, তার কারণও তাদের বোধগম্য হয় না। যদিও সব কিছুর মধ্যে যা ঘটে চলে, তার সবকিছুই তারা দেখতে পায়, শুনতে পায় এবং শরীর দিয়ে অনুভবও করে, যদিও এই সবকিছুরই প্রভাব তাদের মধ্যে থাকে, যদিও অবচেতনে তারা এই সবকিছুর আপেক্ষিক অস্বাভাবিকতা, নিয়মানুবর্তিতা এমনকি বিভিন্ন ঘটনার রহস্যময়তাকে অনুভব করে, কিন্তু তা সত্ত্বেও এর নেপথ্যে কী রয়েছে সে বিষয়ে তারা কিছুই জানে না। এই নেপথ্যের কারণ হল স্রষ্টার ইচ্ছা এবং তাঁর মন। এইসব ঘটনার পিছনে আছে অনেক গল্প, অনেক গোপন সত্য। মানুষ যেহেতু তার স্রষ্টার থেকে বহুদূরে চলে গেছে এবং সবকিছুর পিছনে যে স্রষ্টার কর্তৃত্ব আছে তা সে স্বীকার করে না, তাই স্রষ্টার কর্তৃত্বে যা কিছু ঘটছে, তার সবকিছুই সে কখনোই জানতে বা হৃদয়ঙ্গম করতে পারবে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঈশ্বরের নিয়ন্ত্রণ এবং তাঁর সার্বভৌমত্ব মানুষের কল্পনা, জ্ঞান, বোধশক্তিরও অতীত। এমনকি মানবজাতির বিজ্ঞানও তা লাভ করতে পারবে না। এটি ঈশ্বর-সৃষ্ট মানবজাতির বোধ ও ক্ষমতার বাইরে। কেউ কেউ বলে, “যেহেতু তুমি ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব নিজে প্রত্যক্ষ করোনি, তাই কীভাবে তুমি বিশ্বাস করবে যে সবকিছুই তাঁর কর্তৃত্বাধীন?” প্রত্যক্ষ করাই সবসময় বিশ্বাসের ভিত্তি নয়, আবার কোনোকিছু চিনতে বা বুঝতে পারাও নয়। তাহলে বিশ্বাস কোথা থেকে আসে? আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি যে বাস্তবতা এবং সমস্ত বিষয়ের মূল কারণ সম্পর্কিত মানুষের বোধশক্তি এবং অভিজ্ঞতার মাত্রা ও গভীরতা থেকেই বিশ্বাস আসে। তুমি যদি বিশ্বাস কর যে ঈশ্বর আছেন, কিন্তু তুমি সবকিছুর উপর ঈশ্বরের নিয়ন্ত্রণ এবং সার্বভৌমত্ব চিনতে বা উপলব্ধি করতে না পারো, তাহলে তোমার হৃদয় কোনোদিনই স্বীকার করবে না যে ঈশ্বর এইরকম সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী এবং এই কর্তৃত্ব একেবারেই অনন্য। তুমি কখনোই স্রষ্টাকে তোমার প্রভু এবং তোমার ঈশ্বর হিসাবে সদর্থে স্বীকার করতে পারবে না।

মানবতার ভাগ্য এবং মহাবিশ্বের ভাগ্য সৃষ্টিকর্তার সার্বভৌমত্ব থেকে অবিচ্ছেদ্য

তোমরা সবাই বয়ঃপ্রাপ্ত। কেউ কেউ মধ্যবয়স্ক, কেউ আবার বৃদ্ধ বয়সে পৌঁছেছো। ঈশ্বরের প্রতি অবিশ্বাস ছেড়ে তোমরা ঈশ্বরবিশ্বাসী হয়েছো, ঈশ্বর-বিশ্বাস থেকে তাঁর বাণী গ্রহণ করতে শুরু করেছো এবং তাঁর কাজের অভিজ্ঞতা লাভ করেছো। কিন্তু ঈশ্বররে সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে তোমার জ্ঞান কতটুকু? মানুষের ভাগ্য সম্পর্কে তোমাদের কতটুকু অন্তর্দৃষ্টি লাভ হয়েছে? জীবনে যা কিছু প্রার্থিত তা কি তোমরা লাভ করতে পেরেছো? তোমরা যা চেয়েছো, তোমাদের জীবনকালের শেষ কয়েক দশকে তার কতটুকু চাওয়া পূর্ণ করতে পেরেছো? এমন কতগুলি ঘটনা ঘটেছে যা কখনো আশা করো নি? মনোরম বিস্ময় হিসাবে কত জিনিস ঘটেছে? কত বিষয়ে বাঞ্ছিত ফলপ্রাপ্তির আশায় মানুষ এখনো অবচেতনে সঠিক মুহূর্তটির জন্য স্বর্গীয় ইচ্ছার উপরে নির্ভর করে অপেক্ষা করে আছে? কত জিনিস মানুষকে অসহায় এবং ব্যর্থ করে তোলে? কত জিনিসে মানুষ নিজেকে অসহায় এবং বাধাপ্রাপ্ত মনে করে? প্রত্যেকেই নিজেদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশাবাদী হয়ে অনুমান করে জীবনে সব কিছুই ঘটবে তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী, অন্ন বস্ত্রের অভাব হবে না এবং ভাগ্যের উন্নতি হবে দর্শনীয়ভাবে। কেউই দরিদ্র ও নিপীড়িত, কষ্ট ও বিপর্যয়ে পরিপূর্ণ জীবন চায় না। কিন্তু মানুষ এসব আগে থাকতে দেখতে পায় না বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। হয়ত কারো কারো কাছে অতীত হল উদ্দেশ্যহীন অভিজ্ঞতার সমষ্টি মাত্র; দৈব—ইচ্ছা কী তা তারা কখনই শিখতে পারে না এবং এটি কী তা তারা গ্রাহ্যও করে না। কোনরকম চিন্তাভাবনা ছাড়াই জন্তুর মত বেঁচে থাকে ও দিন যাপন করে; চিন্তা করে না মানবজাতির ভাগ্য কেমন হতে চলেছে বা কেন মানুষ বেঁচে আছে বা কীভাবে তাদের বেঁচে থাকা উচিত। এই ধরনের মানুষ ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কোন জ্ঞান লাভ না করেই বৃদ্ধ হয় এবং মৃত্যু পর্যন্ত জানতে পারে না জীবনের স্বরূপ কী। এই ধরনের মানুষ মৃতই। তারা আত্মাবিহীন পশুর মত জীব। যদিও মানুষ সৃষ্টির মধ্যে বাস করে এবং পৃথিবী থেকেই তাদের বস্তুগত চাহিদা পূরণের বিভিন্ন উপায় উপভোগ করে, যদিও তারা এই জড় জগতকে ক্রমাগত উন্নত হতে দেখে, তবুও তাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা—যা তাদের আত্মা এবং হৃদয় অনুভব করে এবং যে অভিজ্ঞতা অর্জন করে—সেগুলির সঙ্গে বস্তুর কোন সম্পর্ক নেই, এবং বস্তুগত কোন কিছুই অভিজ্ঞতার বিকল্প নয়। অভিজ্ঞতা হল হৃদয়ের গভীরে একটি স্বীকৃতি, যা খালি চোখে দেখা যায় না। এই স্বীকৃতি মানুষের জীবন এবং মানুষের ভাগ্য সম্পর্কে একজনের বোধ এবং উপলব্ধি। এবং তা প্রায়শই মানুষকে এই বোধের দিকে নিয়ে যায় যে, কোন এক অদৃশ্য প্রভু মানুষের জন্য সমস্ত কিছু সাজিয়েছেন এবং তাদের মধ্যে সমন্বয় ঘটিয়ে চলেছেন। এই সবকিছুর মাঝে মানুষের বিশ্বাস করা ছাড়া উপায় থাকে না যে ভাগ্যই এই সবকিছুর বিন্যাস ও সমন্বয়কারী; তাকে স্বীকার করতেই হয়, সামনে যে পথ রয়েছে তা স্রষ্টা—নির্ধারিত—প্রত্যকের ভাগ্যের উপরেই স্রষ্টার সার্বভৌমত্ব। এটি হলো অবিসংবাদিত সত্য। ভাগ্য সম্পর্কে মানুষের ধারণা এবং মনোভাব যাই হোক না কেন তাতে কিছুই যায় আসে না, কোন কিছুই বদলাতে পারে না ভাগ্যকে।

প্রতিদিন তুমি কোথায় যাবে, কী করবে, কার বা কোন কোন জিনিসের সঙ্গে তোমার সাক্ষাৎ হবে, কী বলবে এবং কীই বা তোমার সাথে ঘটবে—এর কোনোটিই কি ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব? এইসব ঘটনার কোনটিই আগে থাকতে মানুষ জানতে পারেনা। শুধু তা-ই নয়, যে পরিপ্রেক্ষিতে এগুলি ঘটবে সেগুলি নিয়ন্ত্রণ করতেও পারে না। এই অপ্রত্যাশিত ঘটনা জীবনে সব সময় ঘটে; এগুলি প্রত্যহের ঘটনা। প্রতিদিনের এই অস্থিরতা এবং তারা যেভাবে উদ্ভাসিত হয়, বা তারা যে পদ্ধতি অনুসরণ করে, তা মানুষকে ক্রমাগতই মনে করিয়ে দেয় যে লক্ষ্যহীন ভাবে কিছুই ঘটে না, প্রতিটি ঘটনা সংঘটনের প্রক্রিয়া, তাদের অনিবার্যতা, মানুষের ইচ্ছার দ্বারা অপসারিত হতে পারে না। প্রতিটি ঘটনাই স্রষ্টার কাছ থেকে মানবজাতির উদ্দেশ্যে একটি মৃদু তিরস্কার। আর তা এই বার্তাও দেয় যে মানুষ নিজের ভাগ্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। প্রতিটি ঘটনা মানবজাতির অনিয়ন্ত্রিত ও নিরর্থক উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং ভাগ্যকে নিজের হাতে নেওয়ার ইচ্ছাকে প্রতিহত করে। এগুলি মানুষের মুখে ক্রমাগত শক্তিশালী চপেটাঘাতের মতো, যা মানুষকে পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করে, শেষ পর্যন্ত কে তাদের ভাগ্যকে শাসন এবং নিয়ন্ত্রণ করে। এবং যখন তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং ইচ্ছা বারবার প্রতিহত হয় এবং ভেঙে যায়, মানুষ স্বাভাবিকভাবেই তার অদৃষ্টকে অবচেতনে স্বীকার করে নেয়—যা আসলে বাস্তবতার স্বীকৃতি, স্বর্গের ইচ্ছা এবং সৃষ্টিকর্তার সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি। এই দৈনন্দিন অনিশ্চয়তা থেকে সমগ্র মানব জীবনের ভাগ্য—কোথাও এমন কিছু নেই যা স্রষ্টার পরিকল্পনা এবং তাঁর সার্বভৌমত্ব প্রকাশ করে না; এমন কিছু নেই যা এই বার্তা পাঠায় না যে “স্রষ্টার কর্তৃত্বকে অতিক্রম করা যায় না”, যা এই চিরন্তন সত্যকে প্রকাশ করে না যে “স্রষ্টার কর্তৃত্বই সর্বোচ্চ”।

মানবজাতি এবং মহাবিশ্বের ভাগ্য নিবিড়ভাবে সৃষ্টিকর্তার সার্বভৌমত্বের সাথে জড়িত, অবিচ্ছেদ্যভাবে স্রষ্টার সমন্বয়-প্রক্রিয়ার সঙ্গে আবদ্ধ; শেষ পর্যন্ত, তারা সৃষ্টিকর্তার কর্তৃত্ব থেকে অবিচ্ছেদ্য। সব কিছু যে নিয়মে বাঁধা, তা থেকে স্রষ্টার সমন্বয়—সাধনের ক্ষমতা এবং সার্বভৌমত্ব মানুষ বুঝতে পারে; সব কিছুর অস্তিত্ব-রক্ষার নিয়ম থেকে মানুষ উপলব্ধি করে সৃষ্টিকর্তার শাসন; সমস্ত কিছুর ভাগ্য থেকে, মানুষ অনুমান করে স্রষ্টার সার্বভৌমত্বের প্রয়োগ এবং তাদের উপর নিয়ন্ত্রণ; মানুষ এবং অন্যান্য সব কিছুর জীবনচক্র থেকে মানুষ উপলব্ধি করতে পারে প্রতিটি বস্তু ও প্রাণীর মধ্যে সৃষ্টিকর্তার সমন্বয় ও ব্যবস্থাপনাকে, এবং সাক্ষী হয় কীভাবে এই সমন্বয় ও বুবস্থাপনা সমস্ত পার্থিব আইন, নিয়ম, প্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য সমস্ত শক্তি এবং ক্ষমতাকে ছাড়িয়ে যায়। এইভাবে, মানবজাতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় যে স্রষ্টার সার্বভৌমত্ব তাঁর সৃষ্ট কোনও সত্তা লঙ্ঘন করতে পারে না; কোনও শক্তিই স্রষ্টার দ্বারা পূর্বনির্ধারিত ঘটনা এবং বস্তু অধিকার করতে, বা তার পরিবর্তন ঘটাতে পারে না। এই ঐশ্বরিক আইন এবং নিয়মের অধীনেই মানুষ এবং সমস্ত কিছু প্রজন্মের পর প্রজন্ম বেঁচে থাকে এবং বর্ধিত হয়। এটিই কি সৃষ্টিকর্তার কর্তৃত্বের প্রকৃত মূর্ত প্রতীক নয়? যদিও মানুষ বস্তুনিষ্ঠ আইনে স্রষ্টার সার্বভৌমত্ব এবং প্রতিটি ঘটনা এবং বস্তুর প্রতি তাঁর নির্দেশ প্রত্যক্ষ করে, কিন্তু কতজন মানুষ মহাবিশ্বের উপর স্রষ্টার সার্বভৌমত্বের নীতিটি উপলব্ধি করতে সক্ষম? কতজন মানুষ সঠিকভাবে নিজেদের ভাগ্যের উপর সৃষ্টিকর্তার সার্বভৌমত্ব এবং ব্যবস্থাপনাকে জানতে, চিনতে, গ্রহণ করতে এবং নিজেকে তার কাছে সমর্পণ করতে পারে? সমস্ত কিছুর উপর স্রষ্টার সার্বভৌমত্বের সত্যে বিশ্বাস এবং উপলব্ধি করার পরেও, কে স্বীকার করে যে স্রষ্টা মানুষের জীবনের ভাগ্যও নির্ধারণ করেন? মানুষের ভাগ্য যে স্রষ্টার হাতেই নিহিত এই সত্য কে উপলব্ধি করতে পারে? সৃষ্টিকর্তাই মানবজাতির ভাগ্য পরিচালনা এবং নিয়ন্ত্রণ করেন, এই সত্যের মুখোমুখি হওয়ার পর তাঁর সার্বভৌমত্বের প্রতি মানবজাতির কী ধরনের মনোভাব নেওয়া উচিত? এটি এমন একটি সিদ্ধান্ত যা এই সত্যের মুখোমুখি হওয়া প্রতিটি মানুষকে নিজেদেরই নিতে হবে।

মানব-জীবনের ছয়টি সন্ধিক্ষণ

জীবনের চলার পথে প্রতিটি ব্যক্তিই একাধিক জটিল সন্ধিক্ষণে পৌঁছয়। এগুলি হল সবচেয়ে মৌলিক, এবং গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ যা মানুষের জীবনে ভাগ্যকে নির্ধারণ করে। এই পথচিহ্নগুলির একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিচে দেওয়া হল যেগুলি প্রত্যেক ব্যক্তিকে অবশ্যই তাদের জীবনে অতিক্রম করতে হবে।

প্রথম সন্ধিক্ষণ: জন্ম

একজন মানুষ কোন স্থানে জন্মায়, কোন পরিবারে জন্মায়, তার লিঙ্গ, শারীরিক আকৃতি এবং তার জন্মের সময়—এগুলিই একজনের জীবনের প্রথম সন্ধিক্ষণের বিবরণ।

কেউই এই সন্ধিক্ষণের নির্দিষ্ট বিবরণ বেছে নিতে পারে না; এগুলি সবই স্রষ্টার দ্বারা অনেক আগেই পূর্বনির্ধারিত। এগুলি কোনোভাবেই বাহ্যিক পরিবেশের দ্বারা প্রভাবিত হয় না, এবং কোনো মানবসৃষ্ট উপাদানই স্রষ্টার দ্বারা পূর্বনির্ধারিত এই সত্যকে পরিবর্তন করতে পারে না। কোন ব্যক্তির জন্মের অর্থ হল সৃষ্টিকর্তার ব্যবস্থা অনুযায়ী ইতিমধ্যেই তার ভাগ্যের প্রথম ধাপটি তিনি পূরণ করেছেন। যেহেতু তিনি এই সব খুঁটিনাটি অনেক আগেই পূর্বনির্ধারিত করে রেখেছেন, তাই সেগুলির কোন পরিবর্তন করার ক্ষমতা কারোর নেই। কোন ব্যক্তির ভাগ্য পরবর্তীকালে যেমনই হোক না কেন, তার জন্মের শর্তগুলি পূর্বনির্ধারিত, এবং সেগুলি যেমন আছে তেমনই থাকে। সেই শর্তগুলি কখনোই সেই ব্যক্তির জীবিত অবস্থার ভাগ্যের দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে না, এবং তা কোনোভাবেই সেই ব্যক্তির ভাগ্যের উপর সৃষ্টিকর্তার সার্বভৌমত্বকে প্রভাবিত করে না।

১) সৃষ্টিকর্তার পরিকল্পনাতেই নতুন জীবনের জন্ম

প্রথম সন্ধিক্ষণের যে বিশদ বিবরণ—জন্মের স্থান, পরিবার, লিঙ্গ, শারীরিক আকৃতি বা জন্মসময়—এগুলির কোন একটিকেও কি কেউ বেছে নিতে পারে? স্পষ্টতই, যে কোন মানুষের জন্মেই তার নিজের কোনো ভূমিকা থাকে না। যে কোন মানুষের জন্মই অনিচ্ছাকৃত—নির্দিষ্ট স্থানে, কালে, পরিবারে এবং একটি নির্দিষ্ট শারীরিক চেহারায়; অনিচ্ছাকৃতভাবেই সে কোন পরিবারের সদস্য হয়, হয়ে ওঠে কোন বংশপঞ্জীর শাখা। জীবনের এই প্রথম সন্ধিক্ষণে মানুষের কাছে কোনো বিকল্প থাকে না, বরং তার জন্ম হয় এমন পরিবেশে যা স্রষ্টার পরিকল্পনা অনুযায়ী স্থির হয়, কোন নির্দিষ্ট পরিবারে, নির্দিষ্ট লিঙ্গ এবং চেহারা সহ একটি নির্দিষ্ট সময়ে যা তার ভবিষ্যৎ জীবনের সাথে নিবিড়ভাবে যুক্ত। এই জটিল সন্ধিক্ষণে মানুষের কী করার আছে? অর্থাৎ, কারোর কাছেই তার জন্ম সংক্রান্ত এই বিবরণগুলির মধ্যে যেকোন একটি বিবরণও বেছে নেওয়া সম্ভব নয়। স্রষ্টার পূর্বনির্ধারণ এবং তাঁর পথপ্রদর্শন না থাকলে, এই পৃথিবীতে সদ্য জন্ম নেওয়া একটি জীবন কোথায় যাবে বা কোথায় থাকবে তা জানত না, থাকত না কোন আত্মীয়তা, পেত না কোন পরিচয় এবং প্রকৃত কোন গৃহকোণ। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার সূক্ষ্ম ব্যবস্থাপনার কারণে, এই নতুন জীবনের থাকার জায়গা আছে, আছে বাবা-মা, পরিচয় এবং আত্মীয়স্বজন এবং তাই সেই জীবন তার যাত্রাপথে চলা শুরু করে। এই সমগ্র প্রক্রিয়ায়, স্রষ্টার পরিকল্পনাতেই এই নতুন জীবনের বাস্তবায়ন নির্ধারিত হয়, এবং সেই জীবন পরবর্তীকালে যা কিছু অর্জন করে তা সবই আসলে সৃষ্টিকর্তার প্রদত্ত। পরিচয়হীন একটি মুক্ত-ভাসমান দেহ ধীরে ধীরে রক্তমাংসের অবয়বে পরিণত হয়—দৃশ্যমান, বাস্তব মানুষ—ঈশ্বরের সৃষ্টিগুলির মধ্যে অন্যতম—যে চিন্তা করে, শ্বাস-প্রশ্বাস নেয় এবং উষ্ণতা এবং শীতলতার অনুভূতিসম্পন্ন; বস্তুজগতে সৃষ্ট সত্তার সমস্ত স্বাভাবিক ক্রিয়াকলাপের অংশগ্রহণে সক্ষম; এবং তাঁর সৃষ্ট মানুষকে জীবনে যে সব অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে, তার সবগুলির মধ্য দিয়েই সে যাবে। স্রষ্টার দ্বারা কোন ব্যক্তির জন্ম পূর্বনির্ধারিত হওয়ার অর্থ হল যে তিনি সেই ব্যক্তিকে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত উপাদান প্রদান করবেন। একইভাবে, কোন ব্যক্তির জন্মের অর্থ হল সে সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সব উপাদান পাবে, এবং সেই মুহূর্ত থেকে, তারা স্রষ্টার দ্বারা প্রদত্ত অন্য এক রূপে এবং সৃষ্টিকর্তার সার্বভৌমত্বের অধীনে বাস করবে।

২) বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন পারিপার্শ্বিকে জন্মায় কেন

মানুষ প্রায়শই কল্পনা করতে পছন্দ করে যে যদি তাদের পুনর্জন্ম হয় তবে তা যেন কোন বিশিষ্ট পরিবারে হয়; যদি তারা নারী হয় তবে তারা যেন স্নো হোয়াইটের মতো সুন্দরী এবং সবার প্রিয়পাত্রী হয়, আর পুরুষ হলে হবে প্রিন্স চার্মিং-এর মত হবে, যার কোন কিছুরই অভাব নেই এবং সারা বিশ্বই যার ইশারায় সাড়া দিতে প্রস্তুত। এমন অনেক মানুষ আছে যারা নিজেদের জন্ম সম্পর্কে নানা বিভ্রমের মধ্যে থাকে এবং জন্ম নিয়ে খুবই অসন্তুষ্ট—তাদের পরিবার, আকৃতি, লিঙ্গ এমনকি নিজেদের জন্মের সময় নিয়েও বিরক্ত। তবুও মানুষ কখনই বুঝতে পারে না যে কেন তারা কোন নির্দিষ্ট পরিবারে জন্ম নিয়েছে, তাদের এই নির্দিষ্ট বাহ্যিক চেহারার কারণই বা কী। তারা জানে না তাদের জন্ম বা আকৃতি যাই হোক না কেন, ঈশ্বরের ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন উদ্দেশ্যে তাদের বিভিন্ন ভূমিকা পালন করতে হবে, এবং এই উদ্দেশ্য কখনোই পরিবর্তিত হবে না। ঈশ্বরের দৃষ্টিতে কোন মানুষের জন্মস্থান, তার লিঙ্গ, বাহ্যিক আকৃতি, সবই খুব ক্ষণস্থায়ী। তাঁর সমগ্র মানবজাতির পরিচালনার প্রতিটি পর্বে এর সবগুলিই এক একটি ক্ষুদ্র ক্রমিক বিন্দু ও চিহ্ন। কারো গন্তব্য ও পরিণতি কোনো একটি নির্দিষ্ট পর্বে তাদের জন্ম দ্বারা নির্ধারিত হয় না, বরং নির্ধারিত হয় জীবনে তারা যে উদ্দেশ্য পূরণ করে তার উপর, এবং স্রষ্টার পরিচালনামূলক পরিকল্পনা সম্পন্ন হওয়ার পর তাঁর বিচারের উপর।

বলা হয় যে প্রতিটি কার্যের একটি কারণ আছে, এবং কোনো কার্যই কারণ ছাড়া হতে পারে না। সুতরাং কোন মানুষের জন্ম আবশ্যিকভাবে তার বর্তমান এবং পুর্বজন্মের সঙ্গে জড়িত। যদি কোন ব্যক্তির মৃত্যু তার বর্তমান জীবনের মেয়াদ শেষ করে, তবে কোন ব্যক্তির জন্মে সুচিত হয় এক নতুন চক্র। যদি একটি পুরানো চক্র কোন ব্যক্তির পূর্ববর্তী জীবনের প্রতিনিধিত্ব করে, তাহলে নতুন চক্র স্বাভাবিকভাবেই তার বর্তমান জীবন। যেহেতু মানুষের জন্ম তার অতীত জীবন এবং তার বর্তমান জীবনের সঙ্গে যুক্ত, তাই তার অবস্থান, পরিবার, লিঙ্গ, চেহারা এবং জন্মের সাথে জড়িত অন্যান্য কারণগুলি অবশ্যই তার অতীত এবং বর্তমান জীবনের সাথে সম্পর্কিত। অর্থাৎ, কোন ব্যক্তির জন্মের বিষয়গুলি শুধুমাত্র তার পূর্ববর্তী জীবনের দ্বারাই প্রভাবিত নয়, তার বর্তমান জীবনের ভাগ্য অনুযায়ীও নির্ধারিত হয়, এবং এই কারণেই মানুষ বিভিন্ন পরিবেশে জন্মগ্রহণ করে। কেউ জন্মায় দরিদ্র পরিবারে, কেউ আবার ধনীগৃহে। কেউ সাধারণ কুলে, কেউ আবার বিশিষ্ট বংশে। কারোর জন্ম দক্ষিণে, আবার কেউ উত্তরে। কেউ জন্ম নেয় মরুভূমিতে, আবার কারো জন্ম হয় শ্যামল ভূখন্ডে। কিছু মানুষের জন্মে থাকে উল্লাস, হাসি এবং উদযাপন; অন্যরা নিয়ে আসে অশ্রু, বিপর্যয় এবং দুর্ভোগ। কারো কারো জন্ম হয় জীবনে মূল্য পাওয়ার জন্য, অন্যদের ছুঁড়ে ফেলা হয় আগাছার মতো। কেউ পায় সূক্ষ্ম বৈশিষ্ট্য, কেউ আবার কুটিল। কাউকে দেখলেই ভালো লাগে, কেউ বা কুৎসিত। কেউ জন্মায় মধ্যরাতে, কেউবা আবার দ্বিপ্রহরের প্রখর সূর্যতাপে। … বিভিন্ন বৈচিত্রের প্রতিটি মানুষের জন্ম হয় সৃষ্টিকর্তার দ্বারা নির্ধারিত তাদের ভাগ্য অনুসারে। তাদের জন্মই নির্ধারণ করে এই জন্মে তাদের ভাগ্য কী হবে, কোন ভূমিকা তারা পালন করবে, আর কোন উদ্দেশ্য তারা পূর্ণ করবে। এই সবকিছুই সৃষ্টিকর্তার সার্বভৌমত্বের অধীন এবং তাঁর দ্বারাই পূর্বনির্ধারিত। পূর্বনির্ধারিত জায়গা থেকে কেউ অব্যাহতি পায় না, বদলাতে পারে না তার জন্ম এবং বেছে নিতে পারে না তার ভাগ্য।

দ্বিতীয় সন্ধিক্ষণ: বড়ো হয়ে ওঠা

কোন ধরনের পরিবারে তাদের জন্ম হয়েছে, তার উপরে নির্ভর করে তাদের গৃহের পরিবেশ এবং পিতা মাতার কাছ থেকে তারা কী প্রকার শিক্ষা পাচ্ছে। এই সব উপাদান থেকেই নির্ধারিত হয় তারা কীভাবে বয়ঃপ্রাপ্ত হচ্ছে, এবং এই বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়াই হল একজন মানুষের জীবনের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ। একথা বলা নিষ্প্রয়োজন যে, এই সন্ধিক্ষণেও মানুষের কাছে কোনো বিকল্প থাকেনা। এই পর্বটিও নির্দিষ্ট ও পূর্বনির্ধারিত।

১) প্রত্যেক মানুষের বয়ঃপ্রাপ্তির নির্দিষ্ট শর্ত সৃষ্টিকর্তা আগে থেকেই নির্ধারিত করে রেখেছেন

একজন মানুষ বড়ো হওয়ার সময় কোন মানুষ, ঘটনাবলী অথবা বস্তুর দ্বারা নৈতিকভাবে উন্নীত অথবা প্রভাবিত হবে তা সে নির্বাচন করতে পারেনা। কোন ধরনের জ্ঞান অথবা দক্ষতা সে লাভ করবে, তার মধ্যে কোন অভ্যাস গড়ে উঠবে, কিছুই সে নির্বাচন করতে পারেনা। কারা তার পিতা মাতা বা আত্মীয়, কোন পরিবেশে সে বড়ো হয়ে উঠছে, এইসব বিষয়ে তার কোনো মতামত থাকেনা। তার চারপাশের মানুষ, ঘটনাবলী এবং বস্তুর সঙ্গে তার সম্পর্ক এবং তার বিকাশে এগুলি কী প্রভাব বিস্তার করে, সবকিছুই তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তাহলে এইসব বিষয়ে কে সিদ্ধান্ত নেন? কে সবকিছু সংগঠিত করেন? যেহেতু এইসব বিষয়ে মানুষের নিজের পছন্দের কোনো সুযোগ নেই, যেহেতু নিজেদের এইসব বিষয়ে তারা নিজেরা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনা, এবং স্পষ্টতই এগুলি স্বাভাবিকভাবে হয়না, তাহলে নিশ্চিতভাবেই একথা বলা যায় যে সব মানুষ, ঘটনাবলী এবং বস্তুর গঠন রয়েছে স্রষ্টার হাতে। একথা অবশ্যই বলা যায় যে স্রষ্টা যেমন প্রত্যেক মানুষের জন্মের জন্য নির্দিষ্ট পরিস্থিতির ব্যবস্থা করেন, ঠিক তেমনই তিনি তার বড়ো হয়ে ওঠার জন্যও নির্দিষ্ট পরিস্থিতির ব্যবস্থা করেন। যদি একজন মানুষের জন্ম তার পারিপার্শ্বিক মানুষজন, ঘটনাবলী ও বস্তুর মধ্যে পরিবর্তন সৃষ্টি করে, তাহলে, সেই মানুষের বৃদ্ধি এবং বিকাশও সেইসবকিছুকে অবশ্যই প্রভাবিত করবে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, কিছু মানুষ দরিদ্র পরিবারে জন্মানো সত্ত্বেও বড়ো হয় সম্পদের মাঝে। অন্য অনেকে সম্পদশালী পরিবারে জন্মানো সত্ত্বেও তাদের দুর্ভাগ্যের কারণে তাদের পরিবারের ভাগ্যের অবনতি হয়, এবং তারা দরিদ্র পরিবেশে বড়ো হয়। কারো জন্মের পিছনেই কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম নেই এবং কেউই কোনো অনিবার্য, নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে বড়ো হয়ে ওঠেনা। এগুলি কোনো মানুষ কল্পনা বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনা। এগুলি তাদের নিজ নিজ ভাগ্যের ফল এবং ভাগ্যের দ্বারাই নির্ধারিত। অবশ্যই এই সবকিছুর মূলে রয়েছে যে ভাগ্য তা স্রষ্টা প্রতিটি মানুষের জন্য পূর্বনির্ধারিত করে রেখেছেন। এগুলি মানুষের ভাগ্যের উপর স্রষ্টার সার্বভৌমত্ব, এবং তাঁর পরিকল্পনার দ্বারাই এগুলি নির্ধারিত হয়।

২) মানুষ যেসব বিবিধ পরিস্থিতিতে বেড়ে ওঠে তার থেকেই তাদের নানারকম ভূমিকার উদ্ভব হয়

মানুষের জন্মের পরিস্থিতিই মূলত নির্ধারণ করে তার বেড়ে ওঠার পরিবেশ ও পরিমন্ডল। আবার যে পরিমন্ডলে সে বেড়ে ওঠে, তা তার জন্মের পরিস্থিতিরই ফল। এইসময় একজন মানুষ ভাষা শিখতে শুরু করে, তার মন নানা ধরনের নতুন বিষয়ের সম্মুখীন হয় এবং তা মনের মধ্যে একত্রিত হয়। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে মানুষ ক্রমাগত বৃদ্ধি পায়। মানুষ যেসব জিনিস নিজের কানে শোনে, নিজের চোখে দেখে এবং নিজের মস্তিষ্কের সাহায্যে গ্রহণ করে তা ক্রমে তার অন্তর্জগতকে পরিপূর্ণ এবং উদ্দীপ্ত করে। একজন যেসব মানুষ, ঘটনা এবং বস্তুর সংস্পর্শে আসে, যে সাধারণ বোধ, জ্ঞান এবং দক্ষতা সে লাভ করে, যে চিন্তাশৈলী তাকে প্রভাবিত করে, যে পদ্ধতিতে তাকে শিক্ষাদান করা হয়, এই সবগুলিই তার জীবনের ভাগ্যকে নির্দেশ ও প্রভাবিত করে। বড়ো হওয়ার সময় মানুষ যে ভাষা শেখে এবং যেভাবে সে চিন্তা করে তা তার যৌবনের পরিবেশের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। এই পরিবেশেরই অঙ্গ হল তার বাবা মা, ভাইবোন এবং অন্যান্য মানুষজন, চারপাশের ঘটনাবলী এবং বস্তু। সুতরাং, একজন মানুষের বিকশিত হওয়ার গতিপথ নির্ধারিত হয় যে পরিবেশে সে বড়ো হয় তার দ্বারা এবং সেইসঙ্গে, তা নির্ভর করে সেই সময়ে সে যেসব মানুষজন, ঘটনাবলী এবং বস্তুর সংস্পর্শে আসে তার উপরেও। যেহেতু মানুষ যে পরিস্থিতিতে বড়ো হবে তা অনেক আগে থেকেই নির্ধারিত, তাই স্বাভাবিকভাবেই এই প্রক্রিয়ার মধ্যে সে কোন পরিবেশে থাকবে তাও পূর্বনির্ধারিত। এটি কোনো মানুষের পছন্দ বা অগ্রাধিকারের দ্বারা নির্ধারিত হয়না, বরং স্রষ্টার পরিকল্পনা এবং তাঁর সতর্ক ব্যবস্থাপনা ও মানুষের ভাগ্যের উপর তাঁর সর্বময় কর্তৃত্বের দ্বারা নির্ধারিত হয়। সুতরাং মানুষ তার বড়ো হয়ে ওঠার সময় যেসব মানুষজনের সংস্পর্শে আসে বা যেসব বস্তুর সম্মুখীন হয় তার সবকিছু স্বাভাবিকভাবেই স্রষ্টার সমণ্বয় ও ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত। মানুষ এই ধরনের জটিল আন্তঃসম্পর্কের কোনো পূর্বাভাস পায়না, তাকে নিয়ন্ত্রণ অথবা পরিমাপ করার ক্ষমতাও তার নেই। একজন মানুষ যে পরিবেশে বেড়ে ওঠে, তার উপরে প্রচুর বিভিন্ন ধরনের ব্যক্তি ও বস্তুর প্রভাব থাকে। এই বিপুল সংযোগের জালের আয়োজন বা তাকে সমণ্বিত করার ক্ষমতা কোনো মানুষেরই নেই। সব মানুষ, বস্তু অথবা ঘটনাবলীর উপস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা কেবল স্রষ্টারই আছে, কোনো মানুষ বা বস্তুর নেই, এমনকী তাদের উপস্থিতি বজায় রাখা অথবা অন্তর্ধানকে নিয়ন্ত্রণ করাও তাদের ক্ষমতার বাইরে। এ হল সংযোগের এক সুবিস্তৃত জাল যা একজন মানুষের বিকশিত হওয়াকে আকার দেয়, এবং বিভিন্ন পরিবেশ সৃষ্টি করে যার মধ্যে দিয়ে মানুষ বেড়ে ওঠে, যেমনভাবে স্রষ্টা তাকে পূর্বেই নির্ধারিত করেছেন। এটিই স্রষ্টার ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন ভূমিকা সৃষ্টি করে, মানুষের জীবনের উদ্দেশ্যকে সাফল্যের সঙ্গে পূরণ করার জন্য দৃঢ় ও শক্তিশালী ভিত্তি স্থাপন করে।

তৃতীয় সন্ধিক্ষণ: স্বাধীনতা

শৈশব এবং কৈশোর অতিক্রম করার পরে কোনো ব্যক্তি যখন ধীরে ধীরে অনিবার্যভাবে পরিণত অবস্থায় পৌঁছয়, তার পরবর্তী পদক্ষেপ হল তারুণ্য থেকে তাদের সম্পূর্ণভাবে বিদায় নেওয়া, তাদের পিতামাতাকে বিদায় জানানো এবং একজন স্বাধীন প্রাপ্তবয়স্ক হিসাবে সামনের পথের মুখোমুখি হওয়া। এই পর্বে, একজন প্রাপ্তবয়স্কের মতই তাদের অবশ্যই সমস্ত মানুষ, ঘটনা এবং বস্তুর মুখোমুখি হতে হবে, সম্মুখীন হতে হবে তাদের ভাগ্যের সকল অংশের, যে অংশগুলি শীঘ্রই তাদের সামনে আসবে। এটি হল তৃতীয় সন্ধিক্ষণ যা প্রতিটি মানুষকে অতিক্রম করতে হবে।

১) স্বাধীন হওয়ার পর, কোনো ব্যক্তি সৃষ্টিকর্তার সার্বভৌমত্ব অনুভব করতে শুরু করে

জন্ম এবং বেড়ে ওঠা যদি কোনো ব্যক্তির জীবনের যাত্রাপথে “প্রস্তুতিমূলক সময়” হয়, যা তার ভাগ্যের ভিত্তি স্থাপন করে, তাহলে স্বাধীনতা হল তার জীবনে ভাগ্যের সূচনাপর্বের আত্মকথন। কোনো ব্যক্তির জন্ম এবং বেড়ে ওঠা যদি তার ভাগ্যের প্রস্তুতিপর্বের সংগৃহীত সম্পদ হয়, তাহলে সে স্বাধীন হয় তখন, যখন সে সেই সম্পদ ব্যয় বা তা বৃদ্ধি করতে শুরু করে। যখন কেউ পিতামাতাকে ছেড়ে স্বাধীন হয়, তখন সে যে সামাজিক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়, এবং যে ধরনের কাজ ও কর্মজীবন প্রাপ্ত হয়, তা উভয়ই তার ভাগ্য দ্বারা নির্ধারিত এবং তার পিতামাতার সাথে সম্পর্কহীন। কেউ কেউ উচ্চশিক্ষার জন্য একটি ভাল বিষয় বেছে নিয়ে স্নাতক হয়ে সন্তোষজনক চাকরি খুঁজে পায় যা জীবনের যাত্রাপথের প্রথম পদক্ষেপে তাদের বিজয়ী করে তোলে। কিছু মানুষ বিভিন্ন বিষয় শিখে এবং দক্ষভাবে আয়ত্ত করেও কখনোই তাদের উপযুক্ত চাকরি খুঁজে পায় না বা যোগ্য পদ পায় না, ভালো কর্মজীবন তো দূরস্থান; জীবনের যাত্রার শুরু থেকেই, জীবনের প্রতিটি মোড়ে তারা নিজেদের ব্যর্থ দেখতে পায়, জর্জরিত হয় সমস্যায়, তাদের সম্ভাবনার পরিণতি হয় হতাশাজনক, এবং তাদের জীবন হয় অনিশ্চিত। কিছু মানুষ অধ্যবসায়ের সাথে পড়াশোনা করলেও, উচ্চশিক্ষা লাভের প্রতিটি সুযোগই অল্পের জন্য হারায়; মনে হয় তাদের ভাগ্যে কখনই সাফল্য লাভ নেই, জীবনের যাত্রার প্রথম আকাঙ্খাই মিশে যায় লঘু বাতাসে। সামনের পথ মসৃণ নাকি পাথুরে তা তারা জানে না, কিন্তু প্রথমবারের মতো অনুভব করে যে মানুষের ভাগ্য কতটা পরিবর্তনশীল, এবং তাই জীবনকে প্রত্যাশা এবং ভয়ের সাথে নিরীক্ষণ করে। খুব শিক্ষিত না হওয়া সত্ত্বেও কিছু লোক বই লেখে এবং খ্যাতি অর্জন করে; প্রায় সম্পূর্ণ নিরক্ষর কিছু মানুষ ব্যবসায় অর্থ উপার্জন করে এবং তার মাধ্যমে নিজেদের সংস্থান করতে পারে…। কোনো ব্যক্তি কী পেশা বেছে নেয়, কীভাবে জীবিকা নির্বাহ করে: এই বিষয়গুলিতে তার সিদ্ধান্ত ভালো হবে না খারাপ, তার উপর কি কারো নিজের কোন নিয়ন্ত্রণ আছে? এগুলি কি মানুষের ইচ্ছা এবং সিদ্ধান্তের সাথে সঙ্গতি রেখে চলে? বেশিরভাগ মানুষেরই এরকম ইচ্ছা থাকে: কম পরিশ্রম ও বেশি উপার্জন করা, রোদ এবং বৃষ্টিতে পরিশ্রম না করা, ভাল পোশাক পরা, সর্বত্র দীপ্তিমান এবং উজ্জ্বল হওয়া, অন্যদের উপরে কর্তৃত্ব করা এবং পূর্বপুরুষদের জন্য খ্যাতি অর্জন করা। মানুষ নিখুঁত হওয়ার আশা করে, কিন্তু জীবনের যাত্রায় প্রথম পা ফেলার পরেই তারা ধীরে ধীরে বুঝতে পারে যে মানুষের ভাগ্য কতটা ত্রুটিপূর্ণ, এবং প্রথমবার তারা এই সত্য উপলব্ধি করে যে, কেউ ভবিষ্যতের জন্য সাহসী পরিকল্পনা করতে পারে, দুঃসাহসী কল্পনারআশ্রয় নিতে পারে, কিন্তু নিজের স্বপ্নগুলির বাস্তবায়নের ক্ষমতা কারোরই নেই, এবং নিজের ভবিষ্যত নিয়ন্ত্রণ করার পরিস্থিতিতেও কেউই নেই। একজনের স্বপ্ন এবং বাস্তবতার মধ্যে সর্বদাই কিছু দূরত্ব থাকবে যার মুখোমুখি তাকে হতেই হবে; মানুষ যেমন চায় ঘটনাপ্রবাহ কখনই তেমন হয় না, এবং এই বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে মানুষ কখনই সন্তুষ্টি বা তৃপ্তি অর্জন করতে পারে না। কিছু মানুষ ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টায় কল্পনাতীত যে কোন সীমায় চলে যায়, নিজেদের জীবিকা ও ভবিষ্যত গড়ার জন্য সর্বোচ্চ প্রয়াস করে এবং বিপুল ত্যাগ স্বীকার করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজের কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে যদি তারা তাদের স্বপ্ন এবং আকাঙ্ক্ষাগুলির বাস্তবায়ন করেও, তারা কখনই তাদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারে না, এবং যতই দৃঢ়তার সাথে চেষ্টা করুক না কেন, ভাগ্য তাদের জন্য যা বরাদ্দ করেছে তারা কখনই তাকে অতিক্রম করতে পারে না। ক্ষমতা, বুদ্ধিমত্তা এবং ইচ্ছাশক্তির পার্থক্য নির্বিশেষে, ভাগ্যের সামনে সব মানুষই সমান, সে পার্থক্য করে না মহান বা নগণ্য, উচ্চ বা তুচ্ছ, উদার বা নীচের মধ্যে। কেউ কী পেশা গ্রহণ করবে, কী ভাবে জীবিকা নির্বাহ করবে এবং জীবনে কতটা বিত্তশালী হবে তা তার পিতামাতা, তার প্রতিভা, তার প্রচেষ্টা বা তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা দ্বারা নির্ধারিত হয় না, আসলে তা স্রষ্টার দ্বারা পূর্বনির্ধারিত।

২) পিতামাতাকে ছেড়ে যাওয়া এবং জীবন নাট্যে নিজের ভূমিকা পালনের আন্তরিক সূত্রপাত

পরিণত অবস্থায় পৌঁছে, মানুষ যখন পিতামাতার নির্ভরতা ছেড়ে নিজেকে পালন করতে সমর্থ হয়, সেই মুহূর্তে থেকে সে প্রকৃত অর্থে নিজের ভূমিকা পালন করতে শুরু করে, কুয়াশা কেটে গিয়ে ধীরে ধীরে তার জীবনের লক্ষ্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। হয় তো কেউ তখনও তার পিতামাতার সাথে নামমাত্র ঘনিষ্ঠতায় বদ্ধ থাকে, কিন্তু যেহেতু তার লক্ষ্য এবং জীবনে পালনীয় ভূমিকায় তার মা এবং বাবার কোনও সম্পর্ক নেই, তাই সে ধীরে ধীরে স্বাধীন হওয়ার সাথে সাথে এই ঘনিষ্ঠ বন্ধনটি ছিন্ন হয়ে যায়। জৈবিক দৃষ্টিকোণ থেকে, এ সময়েও মানুষ অবচেতনে তাদের পিতামাতার উপর নির্ভরশীল থেকে যায়, কিন্তু বস্তুনিষ্ঠভাবে বলা যায়, যে একবার তারা সম্পূর্ণভাবে বড় হয়ে গেলে, পিতামাতার থেকে তারা সম্পূর্ণ পৃথক জীবনযাপন করে, এবং স্বাধীনভাবে যে ভূমিকা গ্রহণ করে তা সম্পাদন করে। জন্ম এবং সন্তান লালন-পালন ব্যতীত, সন্তানদের জীবনে পিতামাতার দায়িত্ব কেবল তাদের বেড়ে ওঠার জন্য একটি আনুষ্ঠানিক পরিবেশ প্রদান করা, কারণ স্রষ্টার পূর্বনির্ধারণ ছাড়া আর কোনো কিছুই কোনো ব্যক্তির ভাগ্যের উপর প্রভাব ফেলে না। কোনো ব্যক্তির ভবিষ্যৎ কেমন হবে তা কেউই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না; বহু পূর্বেই এটি নির্ধারিত, এমন কি কারো পিতা-মাতাও তার ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারে না। ভাগ্যের বিষয়ে, প্রত্যেকে স্বাধীন, এবং প্রত্যেকের নিজস্ব ভাগ্য আছে। তাই, কারোর পিতামাতাই তার ভাগ্য খণ্ডাতে পারে না বা জীবনে সে যে ভূমিকা পালন করে তার উপর সামান্যতম প্রভাবও ফেলতে পারে না। একথা বলা যেতে পারে, যে পূর্বনির্ধারণ অনুসারেই কোনো এক নির্দিষ্ট পরিবারে কেউ জন্ম নেয় এবং নির্দিষ্ট এক পরিবেশে সে বেড়ে ওঠে, জীবনের লক্ষ্য পূরণের পূর্বশর্ত ব্যতীত তা আর কিছুই নয়। তারা কোনভাবেই কোনো ব্যক্তির ভাগ্য, বা কোন ধরনের ভাগ্যের মধ্যে সে তার অভীষ্ট পূরণ করবে, তা নির্ধারণ করে না। এবং তাই, কারোর পিতামাতাই তার জীবনের লক্ষ্যপুরণে সহায়তা করতে পারে না, এবং একইভাবে, কোনো আত্মীয়স্বজনও কাউকে তার জীবনে পালনীয় ভূমিকা গ্রহণ করতে সহায়তা করতে পারে না। কীভাবে কোনো মানুষ তার অভীষ্ট সিদ্ধ করবে এবং কী রকম পরিবেশে সে তার ভূমিকা পালন করবে তা সম্পূর্ণরূপে তার ভাগ্য দ্বারা নির্ধারিত হয়। অন্য কথায় বলা যায়, অপর কোনো বস্তুগত অবস্থা কোনো মানুষের অভীষ্টকে প্রভাবিত করতে পারে না, যা স্রষ্টার দ্বারা পূর্বনির্ধারিত। সব মানুষ যে বিশেষ পরিবেশে বেড়ে ওঠে সেখানেই পরিণত হয়; তারপর ধীরে ধীরে, ধাপে ধাপে, তারা তাদের জীবনের নিজস্ব পথ তৈরি করে এবং স্রষ্টার দ্বারা তাদের জন্য পরিকল্পিত নিয়তি পূরণ করে। স্বভাবতই, অনিচ্ছাকৃতভাবে, তারা মানবতার বিশাল সমুদ্রে প্রবেশ করে এবং জীবনে তাদের নিজস্ব স্থান গ্রহণ করে, যেখানে তারা সৃষ্ট প্রাণী হিসাবে সৃষ্টিকর্তার পূর্বনির্ধারিত এবং তাঁর সার্বভৌমত্বের নির্দেশিত দায়িত্ব পালন করতে শুরু করে।

চতুর্থ সন্ধিক্ষণ: বিবাহ

বয়ঃপ্রাপ্ত এবং পরিণত হওয়ার পাশাপাশি বাবা-মা-র সঙ্গে, জন্ম ও বড় হয়ে ওঠার পরিবেশের সঙ্গে, মানুষের দূরত্ব বাড়তে থাকে। জীবনে সে একটি দিকনির্দেশ খোঁজা শুরু করে এবং পিতামাতার থেকে ভিন্ন একটি শৈলীতে নিজের জীবনের লক্ষ্য অনুসরণ করতে চায়। এই পর্বে মানুষের জীবনে পিতা-মাতার আর প্রয়োজনীয়তা থাকে না, বরং সে এমন এক সঙ্গী চায় যার সঙ্গেই সে জীবন কাটাবে, অর্থাৎ একজন স্বামী বা স্ত্রী—যার সঙ্গে তার ভাগ্য নিবিড় ভাবে জড়িত। সুতরাং, স্বাধীন হওয়ার পর মানুষের জীবনের প্রথম বড় ঘটনা হলো তার বিবাহ। চতুর্থ এই সন্ধিক্ষণ মানুষকে পেরোতেই হবে।

১) ব্যক্তিগত পছন্দে কারোর বিবাহ হয় না

মানুষের জীবনে বিবাহ একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই সময় থেকেই সে সত্যিকারের অর্থে নানা ধরনের দায়িত্ব নিতে শুরু করে এবং ধীরে ধীরে সিদ্ধ করে বিভিন্ন ধরণের উদ্দেশ্য। বিবাহের অভিজ্ঞতার আগে বিবাহ সম্পর্কে মানুষ নানা বিভ্রমের মধ্যে থাকে, তবে সেই সব বিভ্রম খুবই মনোরম। মেয়েরা কল্পনা করে যে তাদের স্বামীরা হবে প্রিন্স চার্মিং এবং ছেলেদের মনে হয় তাদের বিবাহ হবে স্নো হোয়াইট এর সঙ্গে। অলীক এই কল্পনাগুলি থেকেই বোঝা যায়, প্রত্যেকেরই বিবাহের জন্য নির্দিষ্ট কিছু চাহিদা থাকে, নিজের নির্ধারিত দাবী ও মান থাকে। এই দুষ্ট বয়সে বিবাহ সম্পর্কে বহু বিকৃত বার্তার ক্রমাগত শিকার হয়ে মানুষ বহু অতিরিক্ত দাবি এবং বিচিত্র মনোভাব পোষণ করে। বিবাহের অভিজ্ঞতা আছে এমন সকল ব্যক্তিই জানে যে বিবাহকে যে যেভাবেই বুঝুক বা যে মনোভাবই পোষণ করুক না কেন—তাতে কিছুই যায় আসে না, বিবাহ ব্যক্তিগত পছন্দের বিষয় নয়।

জীবনে অনেক মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় কিন্তু কেউই জানেনা তার বিবাহিত জীবনের সঙ্গী কে হবে। যদিও বিবাহ সম্পর্কে প্রত্যেকেরই ব্যক্তিগত ধারণা এবং দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে, কেউই কিন্তু আগে থেকে জানে না যে কে সত্য এবং চূড়ান্তভাবে তাদের সঙ্গী হবে। এ ব্যাপারে কোনো মানুষেরই ব্যক্তিগত ধারণার কোন মূল্য নেই। পছন্দের কারোর দেখা পেলে তুমি তার অনুসরণ করতে পারো, কিন্তু সে তোমার প্রতি আগ্রহী কি না বা তোমার জীবনসঙ্গী হতে পারবে কিনা, সেই সিদ্ধান্ত তোমার নয়। তোমার অনুরাগের ব্যক্তিকেই যে তুমি জীবনসঙ্গী হিসেবে পাবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই; এবং হয়তো ইতিমধ্যেই তোমার জীবনে নিঃশব্দে প্রবেশ করেছে এমন কেউ যাকে তুমি আশা করনি এবং সে তোমার জীবন সঙ্গী হয়ে উঠল, যে তোমার ভাগ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার, তোমার অর্ধাংশ, যার সঙ্গে তোমার ভাগ্য নিবিড়ভাবে জড়িত। যদিও পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ বিবাহ-সম্পর্ক আছে, কিন্তু তারা প্রত্যেকে একে অপরের থেকে আলাদা—অনেক বিবাহ অসন্তোষজনক, অনেকগুলি সুখী; অনেক বিবাহ পূর্ব ও পশ্চিমে বিস্তৃত, অনেকগুলো উত্তর ও দক্ষিণে; অনেক বিবাহে দুজন পরস্পরের নিখুঁত সঙ্গী, অনেকগুলি সমান সামাজিক পদমর্যাদার; অনেক দাম্পত্য সুখী এবং এক সুরে বাজে, অনেক বিবাহ বেদনাদায়ক এবং দুঃখজনক; অনেক বিবাহ অন্যদের ঈর্ষা জাগিয়ে তোলে, আবার অনেক বিবাহই ভুল বোঝাবুঝি এবং বিরাগে ভরা; অনেকের বিবাহ আনন্দে পূর্ণ, অনেকে চোখের জলে ভেসে যায় এবং হতাশা নিয়ে আসে…। অগণিত এই ধরণের বিবাহে, বিবাহের প্রতি কখনো মানুষের আনুগত্য এবং আজীবন প্রতিশ্রুতির প্রকাশ ঘটে; তাদের ভালবাসা, বন্ধন ও অবিচ্ছেদ্যতা প্রকাশিত হয়, আবার অনেকে হাল ছেড়ে দেয় এবং পারস্পরিক দুর্জ্ঞেয়তা প্রকাশ করে। কেউ কেউ তাদের বিবাহের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে, অথবা এমনকি এর প্রতি ঘৃণাও বোধ করে। বিবাহ সাথে করে সুখ বা বেদনা যাই আনুক না কেন, প্রতিটি বিবাহের উদ্দেশ্য স্রষ্টার দ্বারা পূর্বনির্ধারিত এবং অপরিবর্তনীয়; এটি এমন এক অভীষ্ট যা প্রত্যেককে অবশ্যই সম্পূর্ণ করতে হবে। প্রতিটি বিবাহের অন্তরালে থাকা প্রতিটি ব্যক্তির ভাগ্য অপরিবর্তনীয়, সৃষ্টিকর্তার দ্বারা অনেক আগেই নির্ধারিত।

২) দুজন সঙ্গীর সম্মিলিত ভাগ্যেই বিবাহ সম্পন্ন হয়

একজন মানুষের জীবনে বিবাহ একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ। বিবাহ তার ভাগ্যের ফল এবং গুরুত্বপূর্ণ এক যোগাযোগ। এটি কোনও ব্যক্তির ব্যক্তিগত ইচ্ছা বা পছন্দের উপর প্রতিষ্ঠিত নয়, এবং কোনও বাহ্যিক কারণ দ্বারা প্রভাবিত হয় না, তবে সম্পূর্ণরূপে দুই পক্ষের ভাগ্য দ্বারা এবং দম্পতির উভয় সদস্যের ভাগ্যের উপর স্রষ্টার ব্যবস্থা এবং পূর্বনির্ধারণের দ্বারা নির্ধারিত হয়। বিবাহের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হল মানব জাতির ক্রমকে চালিয়ে যাওয়া, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, বিবাহ হল নেহাতই এমন একটি প্রথা যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মানুষকে যেতে হয় তার অভীষ্ট পূরণের জন্য। বৈবাহিক সম্পর্কে মানুষ শুধু পরবর্তী প্রজন্মকে লালন-পালনের ভূমিকাই নেয় না, সেই বিবাহ বজায় রাখার প্রয়োজনে তার সাথে জড়িত সব রকমের ভূমিকা গ্রহণ করে এবং সেই লক্ষ্যগুলিও সে সম্পূর্ণ করে যা ওই ভূমিকাগুলির জন্য প্রয়োজন। যেহেতু কোনো মানুষের জন্ম তার চারপাশের মানুষ, বস্তু ও ঘটনাবলীর পরিবর্তনকে প্রভাবিত করে, তেমনই তার বিবাহ অনিবার্যভাবে এই সব ব্যক্তি, ঘটনা ও বস্তুদের প্রভাবিত করবে এবং উপরন্তু, সেগুলিকে বিভিন্ন উপায়ে রূপান্তরিত করবে।

স্বাধীন হওয়ার পর, মানুষের নিজের জীবনের যাত্রা শুরু হয়, যা ধাপে ধাপে কোনো মানুষকে নিয়ে যায় অন্য মানুষ, ঘটনা এবং এমন সব জিনিসের দিকে যা তার বিবাহের সাথে সম্পর্কযুক্ত। একই সময়ে, এই বিবাহের অপর পক্ষও ধাপে ধাপে এগিয়ে আসে সেই একই ব্যক্তি, ঘটনা এবং জিনিসগুলির দিকে। ভাগ্যের বন্ধনে আবদ্ধ দুই অপরিচিত ব্যক্তি সৃষ্টিকর্তার সার্বভৌমত্বে জড়িয়ে পড়ে এক বিবাহবন্ধনে এবং অলৌকিকভাবে হয়ে ওঠে একটি পরিবারঃ “দুটি পঙ্গপাল জড়িয়ে যায় একই রশিতে”। সুতরাং, বিবাহে প্রবিষ্ট হলে কোনো মানুষের জীবনের যাত্রা প্রভাবিত এবং স্পর্শ করে তার সঙ্গীকে এবং অনুরূপভাবে তার সঙ্গীর জীবনের যাত্রাও তার ভাগ্যকে প্রভাবিত এবং স্পর্শ করে। অর্থাৎ, মানুষের ভাগ্য পারস্পরিকভাবে যুক্ত, এবং অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন ও স্বাধীনভাবে কেউই জীবনের লক্ষ্য সম্পূর্ণ করতে বা নিজের ভূমিকা পালন করতে পারে না। কোনো মানুষের জন্ম প্রভাব ফেলে সম্পর্কের এক বিশাল শৃঙ্খলের উপর; বেড়ে ওঠাও জড়িয়ে থাকে সম্পর্কের এক জটিল শৃঙ্খলের সাথে; এবং অনুরূপভাবে, একটি বিবাহ অনিবার্যভাবে বিদ্যমান এবং রক্ষিত হয় মানব সংযোগের এক বিশাল এবং জটিল জালের মধ্যে যেখানে জড়িয়ে থাকে সেই জালের প্রতিটি সদস্য, এবং তা প্রতিটি জড়িত মানুষের ভাগ্যের উপর প্রভাব ফেলে। দুই পরিবারের সদস্যদের যোগাযোগের ফলে কোনো বিবাহ সংঘটিত হয় না, তারা যে পরিস্থিতিতে বড় হয়েছে, তাদের চেহারা, তাদের বয়স, তাদের গুণাবলী, তাদের প্রতিভা বা অন্য কোন কারণেও নয়, বরং দুই পক্ষের যৌথ অভীষ্ট এবং একই ভাগ্যের দোসর হওয়ার কারণে হয়। এটাই বিবাহের উৎস, যা স্রষ্টার দ্বারা আয়োজিত ও সুসংবদ্ধ মানুষের ভাগ্যের ফল।

পঞ্চম সন্ধিক্ষণ: পরবর্তী প্রজন্ম

বিবাহের পর মানুষ পালন করে পরবর্তী প্রজন্মকে। কতজন এবং কী ধরণের সন্তান হবে তাতে মানুষের করণীয় কিছু নেই; এটিও সেই ব্যক্তির ভাগ্য-নির্ধারিত, স্রষ্টার দ্বারা পূর্বনির্দিষ্ট। এটি পঞ্চম সন্ধিক্ষণ যার মধ্য দিয়ে কোনো ব্যক্তিকে যেতে হয়।

কারো সন্তানের ভূমিকা পালন করার জন্য যদি কেউ জন্মগ্রহণ করে, তবে তার পিতামাতার ভূমিকা পালনের জন্যও কেউ পরবর্তী প্রজন্মকে লালন-পালন করে। ভূমিকার এই পরিবর্তন বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো মানুষের জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ের উপলব্ধি ঘটায়। এটি জীবনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে মানুষকে অভিজ্ঞতা প্রদান করে যার মাধ্যমে কোনো মানুষ স্রষ্টার সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে জানতে পারে, যা সর্বদা একইভাবে প্রণীত হয় এবং যার মাধ্যমে মানুষ এই সত্যের মুখোমুখি হয় যে স্রষ্টার পূর্বনির্ধারণকে কেউই অতিক্রম বা পরিবর্তন করতে পারে না।

১) সন্তানসন্ততি কেমন হবে তার উপর কারো নিয়ন্ত্রণ নেই

জন্ম, বড়ো হয়ে ওঠা, এবং বিবাহ সবই বিভিন্ন ধরনের এবং বিভিন্ন মাত্রায় হতাশা নিয়ে আসে। কিছু মানুষ নিজেদের পরিবার বা তাদের নিজেদের শারীরিক আকৃতি নিয়ে অসন্তুষ্ট; কেউ কেউ অপছন্দ করে তাদের পিতামাতাকে; যে পরিবেশে তারা বেড়ে উঠেছে তা নিয়ে কেউ কেউ বিরক্ত বা অভিযোগ করে। এবং এই সব হতাশার মধ্যে বেশিরভাগ মানুষের কাছে বিবাহ হল সবচেয়ে অসন্তোষজনক। জন্ম, পরিণত অবস্থা প্রাপ্তি বা বিবাহ নিয়ে কেউ যতই অসন্তুষ্ট হোক না কেন, যারাই এই বিষয়গুলির মধ্য দিয়ে গিয়েছে তারা সকলেই জানে যে, জন্মের স্থান ও সময়, শারীরিক সৌন্দর্য, পিতামাতার বা জীবনসঙ্গীর পরিচয় এসব কেউ নিজে নির্বাচন করতে পারে না, বরং এগুলোকে স্বর্গের ইচ্ছা হিসাবে সহজভাবে মেনে নিতে হয়। তারপরও যখন মানুষের পরবর্তী প্রজন্ম গড়ে তোলার সময় আসে, তখন তারা তাদের জীবনের প্রথমার্ধে বাস্তবায়িত করতে ব্যর্থ হওয়া সমস্ত বাসনা তাদের বংশধরদের মধ্যে প্রক্ষেপ করে, এই আশায় যে তাদের নিজেদের জীবনের প্রথমার্ধের সমস্ত হতাশা যেন তাদের সন্তানেরা পূরণ করে। তাই মানুষ নিজের সন্তানদের নিয়ে নানা ধরনের কল্পনায় বিভোর থাকেঃ কন্যারা যেন অনিন্দ্য সুন্দর হয়ে বেড়ে ওঠে, ছেলেরা হয় উজ্জ্বল ভদ্রলোক; মেয়েরা হবে সংস্কৃতিমনা ও প্রতিভাদীপ্ত এবং ছেলেরা হবে মেধাবী ছাত্র ও তারকা ক্রীড়াবিদ; মেয়েরা হবে সুভদ্র, গুণবতী ও বিচক্ষণ এবং ছেলেরা হবে বুদ্ধিমান, সক্ষম ও সংবেদনশীল। তারা আশা করে যে তাদের সন্তানরা, তারা মেয়ে হোক বা ছেলে, তাদের গুরুজনদের সম্মান করবে, তাদের পিতামাতার প্রতি যত্নশীল হবে, সবার প্রিয় ও প্রশংসিত হবে…। এই পর্বে, মানুষের জীবনে নবীন আশা সঞ্চারিত হয় এবং হৃদয়ে নতুন আবেগ জাগে। মানুষ জানে যে তারা এই জীবনে শক্তিহীন এবং আশাহীন, জনতার মাঝে অন্যতম হওয়ার আর কোনো সুযোগ বা আশা তাদের সামনে নেই এবং ভাগ্যকে মেনে নেওয়া ছাড়া তাদের আর কোন বিকল্প নেই। এবং তাই তারা তাদের সমস্ত আশা, তাদের অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা এবং আদর্শ পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরে, এই আশায় যে তাদের সন্তানরা যেন তাদের অপূর্ণ স্বপ্ন অর্জনে এবং তাদের আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়নে সহায়তা করতে পারে; তাদের কন্যা এবং পুত্ররা পরিবারের নাম উজ্জ্বল করে, বিশিষ্ট, ধনী বা বিখ্যাত হয়ে ওঠে। সংক্ষেপে, তারা তাদের সন্তানদের সৌভাগ্যশালী দেখতে চায়। মানুষের পরিকল্পনা এবং কল্পনা নিখুঁত; কিন্তু তারা কি জানে না যে তাদের সন্তানের সংখ্যা, অবয়ব, ক্ষমতা এবং আরও অনেক ব্যাপারই তাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নির্ধারিত হয় না, তাদের সন্তানদের ভাগ্য নির্ধারণের সামান্য ক্ষমতাও তাদের হাতে নেই? মানুষ নিজেরই ভাগ্য-বিধাতা নয়, তবুও তারা তরুণ প্রজন্মের ভাগ্য পরিবর্তনের আশা করে; নিজেদের ভাগ্য থেকে রক্ষা পেতেই তারা অক্ষম, তবুও তারা পুত্র-কন্যাদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণে সচেষ্ট হয়। তারা কি নিজেদের ক্ষমতায় অধিক আস্থাশীল নয়? এটা কি মানুষের মূর্খতা ও অজ্ঞতা নয়? সন্তানদের জন্য মানুষ যে কোন পর্যায়ে যেতে পারে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত, কোনো মানুষের পরিকল্পনা এবং আকাঙ্ক্ষা নির্ধারণ করতে পারে না যে তার কতজন সন্তান হবে বা সেই সন্তানরা কেমন হবে। দরিদ্র হয়েও কিছু মানুষ একাধিক সন্তানের জন্ম দেয়; আবার ধনী হওয়া সত্ত্বেও অনেক মানুষেরই কোনো সন্তান থাকে না। কেউ কেউ কন্যাসন্তান চায়, কিন্তু সেই ইচ্ছা পূরন হয় না; অনেকে পুত্র চাইলেও পুত্রসন্তানের জন্ম দিতে ব্যর্থ হয়। অনেকের কাছে সন্তান হলো আশীর্বাদ, আবার অনেকের কাছে তারা অভিশাপ। অনেক দম্পতি ধীশক্তিসম্পন্ন হলেও তাদের সন্তানরা হয় ধীর-মতি, অনেক পিতা-মাতা পরিশ্রমী এবং সৎ হলেও তাদের সন্তানরা হয় অলস। সদয় এবং ন্যায়পরায়ণ পিতামাতা হলেও তাদের সন্তানরা হয় ধূর্ত এবং দুশ্চরিত্র। শরীরে এবং মনে সুস্থ পিতা-মাতাও জন্ম দেয় প্রতিবন্ধী সন্তানের। অনেক পিতা মাতাই হয়তো খুব সাধারণ এবং অসফল, কিন্তু তাদের সন্তানরা চূড়ান্ত কৃতিত্ব অর্জন করে। কোনো কোনো বাবা-মা নিম্ন-মর্যাদাসম্পন্ন হলেও তাদের সন্তানেরা সাফল্যের শিখরে পৌঁছে যায়। …

২) পরবর্তী প্রজন্মকে পালনের পরে, ভাগ্য সম্পর্কে মানুষ এক নতুন উপলব্ধি অর্জন করে

ত্রিশের কাছাকাছি বয়সে বেশিরভাগ মানুষ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, জীবনের এই পর্বে ভাগ্য সম্পর্কে মানুষের কোন ধারণাই হয় না। কিন্তু মানুষ যখন সন্তান প্রতিপালন করতে শুরু করে এবং তাদের সন্তানেরা বেড়ে ওঠে, তারা নতুন প্রজন্মকেও আগের প্রজন্মের জীবন ও সমস্ত অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি করতে দেখে। এবং সন্তানদের মধ্যে নিজেদের অতীতের প্রতিফলন দেখে তারা উপলব্ধি করে যে তরুণ প্রজন্ম যে পথে হাঁটছে, তারাও একদিন সেই পথ অতিক্রম করেছিল, এবং এই পথ পূর্বপরিকল্পনা বা নির্বাচন করা যায় না। এই সত্যের মুখোমুখি হয়ে, তাদের কাছে স্বীকার করা ছাড়া কোন উপায় থাকে না যে প্রতিটি ব্যক্তির ভাগ্য পূর্বনির্ধারিত, এবং এই সত্য সম্যক উপলব্ধি না করেই, তারা ধীরে ধীরে তাদের ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষাগুলি বাতিল করে, এবং তাদের হৃদয়ের আবেগগুলি ক্ষণিক বিচ্ছুরণের পর মুছে যায়…। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ পথচিহ্নগুলিকে অতিক্রম করে জীবনের এই পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়া মানুষ জীবনের এক নতুন উপলব্ধি অর্জন করেছে, এক নতুন মনোভাব গ্রহণ করেছে। এই বয়সের কোনো মানুষ ভবিষ্যতের কাছ থেকে কতটাই বা আশা করতে পারে, আর কোন সম্ভাবনার প্রত্যাশাতেই বা তারা অপেক্ষা করবে? কোন পঞ্চাশ বছর বয়সী মহিলা এখনও প্রিন্স চার্মিং-এর স্বপ্ন দেখে? কোন পঞ্চাশ বছর বয়সী পুরুষ এখনও তার স্নো হোয়াইট খোঁজে? কোন মধ্যবয়সী মহিলা এখনও কুৎসিত হংস-শাবক থেকে রাজহাঁসে পরিণত হওয়ার আশা করে? বেশিরভাগ বয়স্ক পুরুষদের কি আর যুবকদের মতো একই কর্ম-প্রচেষ্টা থাকে? সব মিলিয়ে, পুরুষ বা মহিলা নির্বিশেষে, যে কেউ এই বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকে তার বিবাহ, পরিবার এবং সন্তানদের প্রতি তুলনামূলকভাবে যুক্তিযুক্ত, ব্যবহারিক মনোভাব নিয়ে। এই জাতীয় ব্যক্তির কাছে মূলত কোনও বিকল্প নেই, ভাগ্যকে প্রশ্ন করার কোনও তাগিদ নেই। মানুষের অভিজ্ঞতা সাপেক্ষে, এই বয়সে পৌঁছানোর সাথে সাথে স্বাভাবিকভাবেই কোনো মানুষ নির্দিষ্ট এক মনোভাব গড়ে তোলে: “ভাগ্যকে মেনে নিতে হবে; সন্তানদের নিজস্ব ভাগ্য আছে; মানুষের ভাগ্য দৈব—নির্ধারিত।” বেশিরভাগ মানুষ যারা এই সত্য উপলব্ধি করে না, তারা এই পৃথিবীর সমস্ত অস্থিরতা, হতাশা এবং কষ্ট সহ্য করার পরে, মানব জীবন সম্পর্কে তাদের অন্তর্দৃষ্টি দুটি সংক্ষিপ্ত শব্দে প্রকাশ করবে: “এটাই ভাগ্য!” যদিও এই বাক্যাংশটি মানুষের ভাগ্য সম্পর্কে জাগতিক মানুষের উপলব্ধি এবং তারা যে উপসংহারে এসেছে তা গ্রথিত করে, এবং যদিও তা মানবতার অসহায়ত্বকে প্রকাশ করে, এবং এটিকে সূক্ষ্ম এবং নির্ভুল বিবেচনা করা যায়, তবুও এটি স্রষ্টার সার্বভৌমত্ব উপলব্ধির থেকে অনেক দূরের কথা, এবং কোনোভাবেই সৃষ্টিকর্তার কর্তৃত্ব সম্পর্কে জ্ঞানের এটি কোন বিকল্প নয়।

৩) ভাগ্যের প্রতি বিশ্বাস স্রষ্টার সার্বভৌমত্বের জ্ঞানের বিকল্প নয়

এত বছর ধরে ঈশ্বরকে অনুসরণ করার পর, ভাগ্য সম্পর্কে তোমাদের জ্ঞান এবং সাধারণ পার্থিব মানুষের ধারণার মধ্যে কি কোনো মূলগত পার্থক্য খুঁজে পাও? স্রষ্টার পূর্বনির্ধারণ কি সত্যই উপলব্ধি করতে পেরেছ এবং সত্যই অবগত হয়েছো স্রষ্টার সার্বভৌমত্বে? “এটাই ভাগ্য” এই বাক্যাংশটির অন্তর্নিহিত এবং গভীরভাবে অনুভূত উপলব্ধি রয়েছে কিছু মানুষের, তবুও তারা ঈশ্বরের সার্বভৌমত্বে সামান্যতম বিশ্বাসও করে না; তারা বিশ্বাস করে না যে মানুষের ভাগ্য ঈশ্বর আয়োজিত এবং তাঁর দ্বারা সমন্বিত, এবং তারা ঈশ্বরের সার্বভৌমত্বের কাছে নতি স্বীকার করতে চায় না। এই ধরনের মানুষ যেন সাগরে ভাসমান, ঢেউয়ে আন্দোলিত, স্রোতের সাথে ভেসে যায়, নিষ্ক্রিয়ভাবে অপেক্ষা করা এবং ভাগ্যের কাছে নিজেকে ছেড়ে দেওয়া ছাড়া তারা নিরুপায়। তবুও তারা অনুভব করে না যে মানুষের ভাগ্য ঈশ্বরের সার্বভৌমত্বের অধীন; তারা স্বউদ্যোগে ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব জানতে এবং এর মাধ্যমে ঈশ্বরের কর্তৃত্ব সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে পারে না, ঈশ্বরের সমন্বয়-সাধন এবং ব্যবস্থার কাছে নতিস্বীকার করতে পারে না, দুর্ভাগ্যকে প্রতিরোধ করতে পারে না এবং ঈশ্বরের যত্ন, সুরক্ষা ও নির্দেশনায় জীবনযাপন করতে পারে না। অন্যভাবে বলা যায়, ভাগ্যকে মেনে নেওয়া আর স্রষ্টার সার্বভৌমত্বের কাছে বশ্যতা স্বীকার করাদুটো এক ব্যাপার নয়; ভাগ্যে বিশ্বাসের অর্থ এই নয় যে কোনো ব্যক্তি সৃষ্টিকর্তার সার্বভৌমত্বকে স্বীকার করে, অনুভব করে এবং জানে; ভাগ্যের প্রতি বিশ্বাস হল এর সত্যতার এবং বহিরঙ্গের প্রকাশের স্বীকৃতি মাত্র। স্রষ্টা কীভাবে মানবতার ভাগ্য শাসন করেন তা জানার থেকে এই উপলব্ধি ভিন্ন, প্রতিটি অস্তিত্বের ভাগ্যের উপর স্রষ্টার কর্তৃত্বের উৎসকে স্বীকৃতি দেওয়া থেকে এটি পৃথক এবং অবশ্যই স্রষ্টার সমন্বয়-সাধন এবং তাঁর মানবতার ভাগ্য-আয়োজনের সামনে সমর্পিত হওয়া থেকে বহু দূরের কথা। যদি কোনো ব্যক্তি কেবল ভাগ্যকে বিশ্বাস করে—এমনকি যদি সে এটি সম্পর্কে গভীরভাবে অনুভবও করে—কিন্তু এর দ্বারা মানবতার ভাগ্যের উপর স্রষ্টার সার্বভৌমত্বকে জানতে এবং স্বীকৃতি দিতে, এর বশ্যতা স্বীকার করতে এবং গ্রহণ করতে সক্ষম না হয়, তবে তাদের জীবনে কেবল দুঃখই থাকবে, ব্যর্থতা ও শূন্যতায় অতিবাহিত এক জীবন; তারা এখনও স্রষ্টার আধিপত্যের অধীনে আসতে, সর্বার্থে এক সৃষ্ট-মানব হতে এবং সৃষ্টিকর্তার অনুমোদন উপভোগ করতে অক্ষম হবে। একজন ব্যক্তি যে সদর্থে স্রষ্টার সার্বভৌমত্ব জানে এবং অনুভব করে তার সক্রিয় অবস্থায় থাকা উচিত, নিষ্ক্রিয় বা অসহায় নয়। এই ধরনের ব্যক্তি যেমন স্বীকার করে যে সব কিছুই ভাগ্য-নির্ধারিত, সেই সাথে তাদের জানা উচিত জীবন এবং ভাগ্যের একটি সঠিক সংজ্ঞা: প্রতিটি জীবনই সৃষ্টিকর্তার সার্বভৌমত্বের অধীন। যখন কেউ তার পেরিয়ে আসা পথের দিকে ফিরে তাকায়, তার যাত্রাপথের প্রতিটি পর্বের কথা মনে করে, সে দেখতে পায় যে তার প্রতিটি পদক্ষেপে, তা সে কঠিন বা মসৃণ যাই হোক, ঈশ্বর তার পথ নির্দেশ করছিলেন, পরিকল্পনা করছিলেন। এটা ঈশ্বরের সূক্ষাতিসূক্ষ ব্যবস্থা, তাঁর সযত্ন পরিকল্পনা, যা কোনো মানুষকে তার অজান্তেই পরিচালিত করেছে আজকের দিনে। সৃষ্টিকর্তার সার্বভৌমত্ব স্বীকার করতে পারা, তাঁর পরিত্রাণ পেতে পারা—এ এক বিশাল সৌভাগ্য! ভাগ্যের প্রতি কোনো ব্যক্তির বিরূপ মনোভাব প্রমাণ করে যে তাদের জন্য ঈশ্বর-আয়োজিত সমস্ত ব্যবস্থাকে তারা প্রতিহত করছে, সমর্পণের মনোভাব তাদের নেই। মানুষের ভাগ্যের উপর ঈশ্বরের সার্বভৌমত্বের প্রতি যদি কারও ইতিবাচক মনোভাব থাকে, তাহলে যখন সে নিজের যাত্রাপথের দিকে ফিরে তাকায় এবং সদর্থে ঈশ্বরের সার্বভৌমত্বকে আঁকড়ে ধরে, তখন সে আরও আন্তরিকভাবে ঈশ্বরের আয়োজিত সকল ব্যবস্থার কাছে আত্মসমর্পণ করতে চায়, মানুষের ভাগ্য নির্ধারণে ঈশ্বরের সমন্বয়সাধনের প্রতি আরও দৃঢ়সংকল্প এবং আত্মবিশ্বাসী হয় এবং ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বন্ধ করে। কারণ যখন কেউ ভাগ্যকে উপলব্ধি করতে পারে না, উপলব্ধি করতে পারে না ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব, অথচ হাতড়ে হাতড়ে স্বেচ্ছায় এগিয়ে যায় কুয়াশার মধ্যে স্খলিত ও এলোমেলো পা ফেলে, তখন সেই যাত্রা হয় খুব কঠিন, অতি হৃদয়বিদারক। তাই মানুষ যখন ভাগ্যের উপর ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব চিনতে পারে, তখন ধীমান ব্যক্তিরা তা জানতে এবং মেনে নিতে চায়, বিদায় জানাতে চায় সেই বেদনাদায়ক দিনগুলিকে যখন তারা স্বীয় প্রয়াসে একটি ভালো জীবন গড়ার চেষ্টা করেছিল, এবং অদৃষ্টের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও তথাকথিত “জীবনের লক্ষ্য” অনুসরণ বন্ধ করে। যখন কোনো মানুষের ঈশ্বর থাকে না, যখন তিনি দৃশ্যমান হন না, তাঁর সার্বভৌমত্বকে স্পষ্টভাবে সে চিনতে পারে না, তখন তার প্রতিটি দিনই নিরর্থক, মূল্যহীন, দুঃখজনক। যে কোনো স্থানেই সে থাকুক, তার কাজ যা-ই হোক, শুধুমাত্র জীবনধারণের উপায় এবং নিজ লক্ষ্যের অন্বেষণ তাকে শুধুই অসীম হৃদয়বিদারণ ও নিরন্তর যন্ত্রণা ছাড়া আর কিছুই দেয় না, এমন কি সে অতীত স্মৃতিচারণও সহ্য করতে পারে না। কেবলমাত্র যখন কেউ স্রষ্টার সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে, তাঁর সমন্বয়সাধন ও ব্যবস্থাপনার কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং সদর্থে মানবজীবনের সন্ধান করে তখনই ধীরে ধীরে তার সমগ্র হৃদয় যন্ত্রণা-মুক্ত হতে শুরু করে এবং মোচন হতে শুরু করে জীবনের সমস্ত শূন্যতা।

৪) স্রষ্টার সার্বভৌমত্বে যারা আত্মসমর্পণ করে শুধুমাত্র তারাই অর্জন করতে পারে প্রকৃত স্বাধীনতা

ঈশ্বরের সমন্বয়-সাধন এবং সার্বভৌমত্বকে যেহেতু মানুষ স্বীকৃতি দেয় না, তাই তারা সর্বদাই প্রতিবাদী ও বিদ্রোহী মনোভাব নিয়ে ভাগ্যের মুখোমুখি হয়, এবং নিজেদের বর্তমান পরিস্থিতি ও ভাগ্য পরিবর্তনের বৃথা আশায় নিয়তই ঈশ্বরের কর্তৃত্ব ও সার্বভৌমত্ব এবং ভাগ্যের নিয়ন্ত্রণাধীন বিষয়গুলি বাতিল করতে চায়। কিন্তু তারা কখনই সফল হতে পারে না এবং প্রতিটি মোড়েই ব্যর্থ হয়। মানুষের আত্মার গভীরে সংঘটিত হয় এই দ্বন্দ্ব, তার অস্থি পর্যন্ত এই দ্বন্দ্বের গভীর যন্ত্রণায় এতোই আর্ত হয়ে ওঠে, যেন তার জীবন এখনই বিনষ্ট হয়ে যাবে। এই যন্ত্রণার কারণ কী? এর কারণ কি ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব, নাকি সেই ব্যক্তি মন্দ ভাগ্য নিয়ে জন্মেছে? নিশ্চিত ভাবে কোনোটিই সত্য নয়। প্রকৃতপক্ষে সেই ব্যক্তি যে রাস্তা গ্রহণ করে, জীবনযাপনের জন্য যে পথ বেছে নেয়, তাই এর আসল কারণ। এইসব বিষয়গুলি অনেক মানুষ হয়তো উপলব্ধি করে না। কিন্তু যখন তুমি সত্যই জানবে, সদর্থে উপলব্ধি করবে যে মানুষের ভাগ্যের উপর ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব রয়েছে, যখন তুমি প্রকৃত অর্থে বুঝবে যে তোমার জন্য ঈশ্বরের পরিকল্পনা এবং সিদ্ধান্ত হল এক বিশাল সুবিধা ও সুরক্ষা, তারপর তুমি অনুভব করবে যে তোমার যন্ত্রণা হালকা হতে শুরু করেছে এবং তোমার সমগ্র সত্তা শিথিল, মুক্ত, ও স্বাধীন হয়ে আসছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অবস্থা থেকে বিচার করলে, বস্তুনিষ্ঠভাবে তারা মানব-ভাগ্যের উপর স্রষ্টার সার্বভৌমত্বের বাস্তব মূল্য এবং অর্থের সাথে যথার্থরূপে একমত হতে পারে না, যদিও বিষয়গত স্তরে, তারা আর আগের মতো জীবন যাপন করতে চায় না এবং নিজেদের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি চায়; বস্তুনিষ্ঠভাবে, তারা প্রকৃত অর্থে স্রষ্টার সার্বভৌমত্ব উপলব্ধি করতে এবং তার কাছে সমর্পিত হতে পারে না, এবং নেহাতই কম জানে কী ভাবে স্রষ্টার সম্ন্বয়-সাধন ও ব্যবস্থাপনাগুলির অনুসন্ধান করতে হয় এবং সেগুলি গ্রহণ করতে হয়। সুতরাং, মানুষ যদি সত্যই স্বীকার করতে না পারে যে মানুষের ভাগ্য এবং মানব-সংক্রান্ত প্রতিটি বিষয়ের উপর স্রষ্টার সার্বভৌমত্ব রয়েছে, তারা যদি প্রকৃত অর্থে স্রষ্টার কর্তৃত্বের কাছে আত্মসমর্পণ করতে না পারে, তবে তাদের পক্ষে “কারো ভাগ্য তার নিজের হাতে” এই ধারণায় চালিত হওয়া ও বদ্ধ হয়ে পড়া থেকে বেরিয়ে আসা খুবই কঠিন। ভাগ্য এবং সৃষ্টিকর্তার কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে তাদের তীব্র সংগ্রামের বেদনা ঝেড়ে ফেলা তাদের পক্ষে কঠিন হবে, এবং বলাই বাহুল্য, তাদের পক্ষে প্রকৃত মুক্ত ও স্বাধীন হওয়া, ঈশ্বরের উপাসনাকারী মানুষ হওয়াও কঠিন হবে। কিন্তু এই অবস্থা থেকে নিজেকে মুক্ত করার একটি অত্যন্ত সহজ উপায় আছে, তা হল আগের জীবনযাপন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া; বিদায় জানানো জীবনের পূর্ববর্তী লক্ষ্যগুলিকে; কোনো ব্যক্তির পূর্ববর্তী জীবনধারা, জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি, সাধনা, আকাঙ্ক্ষা এবং আদর্শের সংক্ষিপ্তসার নেওয়া ও বিশ্লেষণ করা; এবং তারপর সেগুলিকে মানুষের জন্য ঈশ্বরের অভিপ্রায় ও চাহিদার সাথে তুলনা করা, এবং দেখা যে সেগুলির মধ্যে কোনগুলি ঈশ্বরের অভিপ্রায় ও চাহিদার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, তাদের মধ্যে কোনগুলি জীবনের সঠিক মূল্যবোধ প্রদান করে, মানুষকে সত্যের বৃহত্তর উপলব্ধির দিকে নিয়ে যায় এবং অনুমতি দেয় মানবতা ও মানুষের বৈশিষ্ট্য নিয়ে বেঁচে থাকার। মানুষ জীবনে যে বিভিন্ন লক্ষ্য অনুসরণ করে, যে অসংখ্য উপায়ে তার জীবনযাপন করে, সেগুলিকে তুমি যদি বারংবার অনুসন্ধান করো ও সযত্নে ব্যবচ্ছেদ করে দেখো, তুমি দেখতে পাবে তাদের মধ্যে একটিও স্রষ্টার মূল উদ্দেশ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, যে উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছিলেন। এগুলির প্রত্যেকটিই মানুষকে সৃষ্টিকর্তার সার্বভৌমত্ব এবং যত্ন থেকে দূরে সরিয়ে দেয়; এগুলি সব ফাঁদ যা মানুষকে বঞ্চিত করে এবং যা তাদের নরকের দিকে নিয়ে যায়। এটি অনুভব করার পরে, তোমার কাজ হল জীবন সম্পর্কে নিজের পুরানো দৃষ্টিভঙ্গি পরিত্যাগ করা, বিভিন্ন ফাঁদ থেকে দূরে থাকা, ঈশ্বরকে তোমার জীবনের দায়িত্ব এবং তোমার জন্য ব্যবস্থা নিতে দেওয়া; তুমি শুধুমাত্র সচেষ্ট হবে ঈশ্বরের সমন্বয়-সাধন এবং নির্দেশনায় সমর্পিত হতে, ব্যক্তিগত পছন্দ বিহীন জীবনযাপনে এবং ঈশ্বর-উপাসনাকারী ব্যক্তি হতে। এটি শুনতে সহজ মনে হলেও, বাস্তবে খুবই কঠিন। কেউ কেউ এর যন্ত্রণা সহ্য করতে পারে, আবার অনেকে পারে না। অনেকে এটি মেনে চলতে ইচ্ছুক, অনেকে আবার নিরুৎসাহী। অনিচ্ছুক ব্যক্তিদের এই আকাঙ্ক্ষা এবং সংকল্পই থাকে না। তারা স্পষ্টভাবে ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে অবগত, ভালোভাবেই জানে যে ঈশ্বরই মানুষের ভাগ্যের পরিকল্পনা এবং ব্যবস্থা করেন, এবং তবুও তারা এখনও বিরোধিতা ও সংগ্রাম করে এবং তাদের ভাগ্যকে ঈশ্বরের হাতে তুলে দিতে এবং ঈশ্বরের সার্বভৌমত্বের কাছে আত্মসমর্পণ করতে অপারগ হয়; অধিকন্তু, তারা ঈশ্বরের সমন্বয়-সাধন এবং ব্যবস্থাপনায় বিরূপ। তাই সবসময় এমন কিছু লোক থাকবে যারা নিজেরাই দেখতে চায় তারা কী করতে সক্ষম; তারা স্বহস্তেই তাদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে চায়, অথবা তাদের নিজস্ব শক্তিতে সুখ অর্জন করতে চায়, তারা পরখ করে দেখতে চায় যে তারা ঈশ্বরের কর্তৃত্বের সীমা অতিক্রম করতে এবং ঈশ্বরের সার্বভৌমত্বের ঊর্ধ্বে উঠতে পারে কিনা। মানুষের বিয়োগান্তক জীবনের কারণ এই নয় যে সে একটি সুখী জীবন খোঁজে, এই নয় যে সে খ্যাতি এবং ভাগ্যের পিছনে ছুটে যায় বা অনিশ্চতার মধ্য দিয়ে নিজের ভাগ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে, বরং তার কারণ হচ্ছে, স্রষ্টার অস্তিত্বপ্রত্যক্ষ করাএবং মানুষের ভাগ্যের উপর তাঁর সার্বভৌমত্ব উপলব্ধি করার পরেও সে তার পথ সংশোধন করতে পারে না, কাদা থেকে তার পা বের করতে পারে না, উপরন্তু কঠিন সংকল্পে তার ভুলগুলিকেই অনুসরণ করে। ঐ কর্দমেই সে মাতামাতি করে, স্রষ্টার সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু করে, তিক্ত সমাপ্তি পর্যন্ত তাকে প্রতিহত করে এবং এ সব কিছুই করে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা ছাড়া। শেষ পর্যন্ত যখন সে ভেঙে পড়ে এবং রক্তাক্ত হয়, একমাত্র তখনই সে হাল ছেড়ে দিয়ে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এটিই মানুষের প্রকৃত দুঃখ। তাই আমি বলি, যারা আত্মসমর্পণ করা বেছে নেয় তারা জ্ঞানী, আর যারা সংগ্রাম করে পালিয়ে যাওয়া বেছে নেয়, তারা আসলেই মূর্খ।

ষষ্ঠ সন্ধিক্ষণ: মৃত্যু

এত ব্যস্ততা, এত হতাশা ও পরাজয় পেরিয়ে, বহু আনন্দ-বেদনা এবং উত্থান-পতনের পরে, এতগুলি অবিস্মরণীয় বছর পার করে, ঋতুচক্রের বারংবার পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করার পরে, মানুষ তার অজান্তেই অতিক্রম করেছে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ পথচিহ্নগুলিকে, এবং হঠাৎ এক ঝলকের মধ্যে, সে নিজেকে খুঁজে পায় জীবনের গোধূলিবেলায়। তার সারা শরীরে সময়ের চিহ্নঃ ঋজু হয়ে আর দাঁড়াতে পারে না, কালো চুল বদলে গেছে সাদায়, এককালের উজ্জ্বল ও ঝকঝকে চোখ এখন স্তিমিত ও ধুসর, পেলব ত্বকে বলিরেখা এবং ভাঁজ। কারও শ্রবণশক্তি দুর্বল হয়ে পড়েছে, শিথিল হয়ে পড়ে গেছে কারও দাঁত, কারও প্রতিক্রিয়া হয়েছে মন্থর, ধীর হয়ে এসেছে কারও নড়াচড়া…। এই সময়ে, মানুষ তার যৌবনের আবেগঘন বছরগুলিকে চূড়ান্ত বিদায় জানিয়েছে এবং প্রবেশ করেছে জীবনের গোধূলিতে: বার্ধক্য। এর পরে, সে মুখোমুখি হবে মৃত্যুর, যা মানব জীবনের শেষ সন্ধিক্ষণ।

১) মানুষের জীবন ও মৃত্যুর ক্ষমতা ধারণ করেন শুধুমাত্র সৃষ্টিকর্তা

পূর্বজন্মের দ্বারা যদি কারোর জন্ম নির্ধারিত হয়ে থাকে, তবে তার মৃত্যু সেই ভাগ্যের সমাপ্তি চিহ্নিত করে। যদি মানুষের জন্ম তার জীবনের অভীষ্ট পূরণের সূচনা হয়, তবে তার মৃত্যু সেই অভীষ্টের সমাপ্তি চিহ্নিত করে। কোনো ব্যক্তির জন্মের জন্য যেহেতু স্রষ্টা একটি নির্দিষ্ট পরিস্থিতি নির্ধারণ করেছেন, তাই এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে তার মৃত্যুর জন্যও তিনি এক নির্দিষ্ট পরিস্থিতির ব্যবস্থা করেছেন। অন্য কথায়, কেউই আকস্মিকভাবে জন্ম নেয় না, কারও মৃত্যু হঠাৎ করে আসে না এবং জন্ম ও মৃত্যু উভয়ই একজনের পূর্ব ও বর্তমান জীবনের সাথে অপরিহার্যভাবে জড়িত। মানুষের জন্ম এবং মৃত্যুর পরিস্থিতি উভয়ই স্রষ্টার দ্বারা পূর্বনির্ধারিত; এটি সেই ব্যক্তির অদৃষ্ট, তার ভাগ্য। কোনো ব্যক্তির জন্মের যেহেতু অনেক ব্যাখ্যা রয়েছে, তাই এটিও সত্য যে তার মৃত্যুও স্বাভাবিকভাবেই ঘটবে তার নিজস্ব, বিশেষ কিছু পরিস্থিতির সমাহারে। এই কারণেই মানুষের জীবনকাল বিভিন্ন এবং তাদের মৃত্যুর পদ্ধতি ও সময় ভিন্ন ভিন্ন। কিছু মানুষ শক্তিশালী এবং সুস্থ, তবুও মারা যায় অল্প বয়সে; আবার অনেকে দুর্বল এবং অসুস্থ থাকলেও বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকে, এবং মারা যায় শান্তিতে। অপ্রাকৃতিক কারণে মারা যায় কিছু মানুষ, অন্যদের মৃত্যু হয় স্বাভাবিকভাবে। কেউ কেউ জীবন শেষ করে বাড়ি থেকে বহু দূরে, কেউ কেউ তাদের প্রিয়জনদের পাশে শেষবারের জন্য চোখ বন্ধ করে। মাঝ আকাশে মারা যায় কিছু মানুষ, অন্যরা মাটির নিচে। কেউ মারা যায় জলে ডুবে, কেউ আবার হারিয়ে যায় দুর্যোগে। কেউ সকালে মারা যায়, কেউ বা রাতে। … প্রত্যেকেই একটি বর্ণাঢ্য জন্ম, একটি উজ্জ্বল জীবন এবং একটি গৌরবময় মৃত্যু চায়, কিন্তু কেউ তার নিজের ভাগ্যকে অতিক্রম করতে পারে না, সৃষ্টিকর্তার সার্বভৌমত্ব থেকে কেউই নিস্তার পায় না। এটাই মানুষের অদৃষ্ট। ভবিষ্যৎ সম্পর্কে মানুষ অনেক আগাম পরিকল্পনা করতে পারে, কিন্তু তাদের জন্ম ও পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার পদ্ধতি ও সময় কেউ পরিকল্পনা করতে পারে না। মৃত্যুর আগমন এড়াতে এবং প্রতিরোধে যদিও মানুষ যথাসাধ্য চেষ্টা করে, তবুও, তাদের অজ্ঞাতে, নীরবে নিকটবর্তী হয় মৃত্যু। কেউ জানে না তার কখন মৃত্যু হবে বা কীভাবে, কোথায় হবে সে তো অনেক দূরের কথা। স্পষ্টতই, জীবন ও মৃত্যুর ক্ষমতা মানুষ ধারণ করে না, প্রাকৃতিক জগতের কোনো সত্তাও নয়, বরং সৃষ্টিকর্তা-যাঁর কর্তৃত্ব অনন্য, তিনি সে ক্ষমতা ধারণ করেন। মানবজাতির জীবন ও মৃত্যু প্রাকৃতিক জগতের কোনো নিয়মের ফসল নয়, বরং সৃষ্টিকর্তার কর্তৃত্বের সার্বভৌমত্বের ফল।

২) সৃষ্টিকর্তার সার্বভৌমত্বের জ্ঞান যার নেই, মৃত্যুভয় তাকে তাড়া করবে

যখন কেউ বার্ধক্যে প্রবেশ করে, তখন যে প্রশ্নের মুখোমুখি হয় তা নিজের পরিবারের প্রতিপালন বা তার জীবনে উচ্চাকাঙ্ক্ষার সাফল্য প্রতিষ্ঠা নয়, বরং সেগুলো হচ্ছে, কীভাবে জীবনকে বিদায় জানাতে হবে, কীভাবে জীবনের অন্তিম ক্ষণের সাথে তার দেখা হবে, জীবন-বাক্যে পূর্ণচ্ছেদ কীভাবে টানতে হবে। যদিও আপাতভাবে মনে হয়, যে মৃত্যুর বিষয়ে মানুষ খুব কমই মনযোগ দেয়, কিন্তু এই বিষয়টির অনুসন্ধান কেউই এড়াতে পারে না, কারণ কেউই জানে না যে মৃত্যুর অপর প্রান্তে অন্য এক ভুবন আছে কি না, যে ভুবন মানুষের উপলব্ধি বা বোধের অগম্য, এ বিষয়ে তারা সম্পূর্ণ অজ্ঞ। এ কারণেই মৃত্যুর মুখোমুখি হতে মানুষ ভীত হয়, যথোচিতভাবে মৃত্যুর সামনাসামনি হতে তারা ভয় পায়; সর্বতোভাবে পরিহার করতে চায় বিষয়টি। এবং তাই এই অজ্ঞানতা প্রতিটি ব্যক্তিকে মৃত্যুভয়ে পূর্ণ করে, এবং জীবনের এই অনিবার্য সত্যে রহস্যের আবরণ যোগ করে, অবিরাম ছায়া ফেলে প্রতিটি ব্যক্তির হৃদয়ে।

যখন কেউ অনুভব করে যে তার স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ছে, যখন কেউ উপলন্ধি করে যে মৃত্যু আসন্ন, তখন সে এক অস্পষ্ট ভয় অনুভব করে, এক অবর্ণনীয় ভয়। মৃত্যুভয়ে মানুষ নিঃসঙ্গ এবং আরও অসহায় বোধ করে এবং সেই মুহূর্তে, সে নিজেকে প্রশ্ন করে: মানুষ কোথা থেকে এসেছে? কোথায় চলেছে মানুষ? মানুষ কি এভাবেই মারা যায়, জীবন তাকে অতিক্রম করে চলে যাবে তারই পাশ দিয়ে? এটাই কি সেই সময়কাল যা মানুষের জীবনের সমাপ্তি চিহ্নিত করে? শেষ পর্যন্ত জীবনের অর্থ কী? সর্বোপরি, জীবনের মূল্যই বা কী? তা কি শুধুই খ্যাতি এবং সৌভাগ্য? না কি নেহাতই পরিবার প্রতিপালন? … এই সুনির্দিষ্ট প্রশ্নগুলি নিয়ে কেউ চিন্তা করুক বা না করুক, মৃত্যুকে মানুষ যত গভীরভাবেই ভয় পাক, প্রত্যেক ব্যক্তির হৃদয়ের গভীরে সবসময়েই থাকে রহস্য অনুসন্ধানের আকাঙ্ক্ষা, জীবন সম্পর্কে বোধগম্যতার অনুপলব্ধি এবং তার সাথে মিশ্রিত থাকে জীবন সম্পর্কে আবেগ, অথবা পৃথিবী ছেড়ে যেতে তার অনীহা। সম্ভবত কেউই স্পষ্টভাবে বলতে পারে না যে মানুষ কীসের ভয়ে ভীত, কী খুঁজছে মানুষ, কী ব্যাপারে সে আবেগপ্রবণ এবং কী ছেড়ে যেতে সে অনিচ্ছুক …

মৃত্যুকে ভয় পায় বলেই মানুষের দুশ্চিন্তা অনেক; মৃত্যুভয়ের কারণেই মানুষের কাছে এত কিছু আছে যা সে পরিত্যাগ করতে পারে না। কিছু লোক মৃত্যুকালেও নানা কারণে অস্থির থাকে; তাদের সন্তান, প্রিয়জন, তাদের সম্পদ সম্পর্কে চিন্তা করে, যেন উদ্বিগ্ন হলেই মৃত্যু যে কষ্ট এবং ভয় নিয়ে আসে তা তারা মুছে ফেলতে পারবে, যেন জীবিতদের সাথে এক ধরণের ঘনিষ্ঠতা বজায় রাখলেই মৃত্যুর সঙ্গী হয়ে আসা অসহায়ত্ব এবং একাকীত্ব থেকে তারা বাঁচতে পারবে। মানুষের হৃদয়ের গভীরে একটি অস্পষ্ট ভয় বিদ্যমান, প্রিয়জনের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ভয়, নীল আকাশের দিকে আর কখনও চোখ না রাখার, আর কখনও পার্থিব জগত দেখতে না পাওয়ার ভয়। এক একাকী আত্মা, প্রিয়জনদের সাহচর্যে অভ্যস্ত, তার আশ্রয় ছেড়ে সম্পূর্ণ একা প্রস্থান করতে অনিচ্ছুক, অজানা এবং অপরিচিত এক জগতের উদ্দেশ্যে।

৩) খ্যাতি এবং সৌভাগ্যের সন্ধানে ব্যয় করা জীবন মৃত্যুর মুখে হতভম্ব হয়ে পড়ে

স্রষ্টার সার্বভৌমত্ব এবং পূর্বনির্ধারণের ফলে, একাকী এক আত্মা পরিচয়হীন অবস্থা থেকে খুঁজে পায় পিতামাতা এবং একটি পরিবার, সুযোগ পায় মানবজাতির সদস্য হওয়ার, সুবিধা পায় মানব জীবন অনুভবের, এবং বিশ্বকে দেখার। এই আত্মা সুযোগ লাভ করে স্রষ্টার সার্বভৌমত্ব অনুভবের, তাঁর সৃষ্টির চমৎকারিত্ব জানার, এবং অধিকন্তু, স্রষ্টার কর্তৃত্বে অবগত এবং অধীন হওয়ার। তবুও বেশিরভাগ মানুষ এই বিরল এবং ক্ষণস্থায়ী সুযোগটি সত্যই গ্রহণ করে না। ভাগ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য মানুষ সারাজীবনের শক্তি নিঃশেষ করে, ব্যস্ত থাকে সমস্ত সময়, নিজের পরিবার প্রতিপালনের চেষ্টা চেলায় এবং সম্পদ ও মর্যাদার অন্বষণে ঘুরপাক খায়। মানুষের যেগুলিকে মূল্য দেয় তা হল পরিবার, অর্থ ও খ্যাতি এবং তারা এগুলিকেই জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান বস্তু হিসাবে দেখে। সব মানুষই তাদের ভাগ্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে, কিন্তু তারা হৃদয়ের অন্তরালে এমন বিষয়গুলি ঠেলে দেয় যেগুলি পরীক্ষা করা এবং বোঝা সবচেয়ে প্রয়োজনীয়: মানুষ কেন বেঁচে আছে, তার কীভাবে জীবনযাপন করা উচিত, জীবনের মূল্য ও অর্থ কী। তারা তাদের সমগ্র জীবন অতিবাহিত করে, তা যতই দীর্ঘস্থায়ী হোক, কেবল খ্যাতি ও ভাগ্যের সন্ধানে ছুটে, যতক্ষণ না তাদের যৌবন অপসৃয়মান হয়, এবং তারা ধূসর ও বলিরেখা-সম্পন্ন হয়। তারা এইভাবে বেঁচে থাকে যতক্ষণ না তারা বুঝতে পারে যে, খ্যাতি এবং সৌভাগ্য বার্ধক্যের দিকে তাদের এগিয়ে চলাকে রোধ করতে পারে না, অর্থ হৃদয়ের শূন্যতা পূরণ করতে পারে না, জন্ম, বার্ধক্য, অসুস্থতা এবং মৃত্যুর নিয়ম থেকে কেউ রেহাই পায় না, ভাগ্য তার জন্য যা সঞ্চয় করে রেখেছে, তা কেউই এড়াতে পারে না। শুধুমাত্র যখন তারা জীবনের চূড়ান্ত সন্ধিক্ষণের মুখোমুখি হতে বাধ্য হয় তখনই তারা প্রকৃতপক্ষে উপলব্ধি করে যে কেউ যদি বিশাল সম্পদ এবং বিপুল সম্পত্তির মালিক হয়, এমনকি যদি কেউ বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত এবং উচ্চ পদের অধিকারী হয়, তবুও মৃত্যু থেকে সে বাঁচতে পারে না এবং তাকে অবশ্যই তাদের প্রকৃত অবস্থানে ফিরে যেতে হবে: নাম-গোত্রহীন একাকী এক আত্মা। যখন মানুষের পিতা-মাতা জীবিত থাকে, তখন তারা বিশ্বাস করে যে তাদের পিতা-মাতাই সবকিছু; যখন মানুষের কাছে সম্পত্তি থাকে, তখন তারা মনে করে যে অর্থই একজনের প্রধান ভিত্তি, এটিই তার জীবনযাপনের উপায়; যখন মানুষের মর্যাদা থাকে, তখন তারা এটিকে এত নিবিড়ভাবে অবলম্বন করে যে তার জন্য তাদের জীবনের ঝুঁকি পর্যন্ত নেয়। একমাত্র যখন এই পৃথিবী ছেড়ে মানুষকে চলে যেতে হয় তখনই তারা বুঝতে পারে যে তারা যেগুলির পিছনে তাদের জীবন কাটিয়েছে তা জীবনের আকাশে ক্ষণস্থায়ী মেঘ ছাড়া আর কিছুই নয়, এগুলির কোনটিকেই তারা ধরে রাখতে পারবে না, সাথে নিয়ে যেতে পারবে না কোনোটিকেই, এগুলির কোনটিই মৃত্যু থেকে তাদের রেহাই দিতে পারে না, একাকী আত্মাকে তার ফেরার যাত্রায় সঙ্গ বা সান্ত্বনা দিতে পারে না; অন্ততপক্ষে, এইগুলির কোনটিই তাকে বাঁচাতে পারে না এবং মৃত্যুকে অতিক্রম করার ক্ষমতা প্রদান করে না। পার্থিব জগতের খ্যাতি এবং সৌভাগ্য মানুষকে সাময়িক তৃপ্তি দেয়, আনন্দ দেয়, আরামের মিথ্যা অনুভূতি দেয়; কিন্তু এই প্রক্রিয়ায়, তারা মানুষকে পথভ্রান্ত করে। আর তাই মানুষ যখন মানবতার বিশাল সমুদ্রে অস্থিরভাবে ছুটে বেড়ায়, শান্তি, স্বস্তি এবং হৃদয়ের প্রশান্তি কামনা করে, তখন তারা ঢেউয়ের পর ঢেউয়ে আচ্ছন্ন হয়। যখন মানুষ সন্ধান পায় না সেই সব প্রশ্নের যেগুলি বোঝা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—তারা কোথা থেকে এসেছে, কেন তারা বেঁচে আছে, তারা কোথায় যাচ্ছে এবং আরও অনেক কিছু—তারা খ্যাতি এবং ভাগ্য দ্বারা প্রলুব্ধ হয়, তাদের দ্বারা পথভ্রষ্ট ও নিয়ন্ত্রিত হয় এবং অপরিবর্তনীয়ভাবে দিকভ্রান্ত হয়। সময় চলে যায়; চোখের পলকে পেরোয় বছর, এবং এটি উপলব্ধির আগেই, মানুষ তার জীবনের সেরা বছরগুলিকে বিদায় জানায়। যখন কোনো মানুষ শীঘ্রই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে চলেছে, তখন সে ধীরে ধীরে উপলব্ধি করে যে জগতের সব কিছুই দূরে সরে যাচ্ছে, একদা অর্জিত অধিকার সে আর ধরে রাখতে পারবে না; কোনো মানুষ তখনই প্রকৃত অর্থে অনুভব করে যে সে এক ক্রন্দনরত শিশুর মতো যে পৃথিবীতে এইমাত্র আবির্ভূত হয়েছে, এবং তার নিজের বলে এখনও কিছুই নেই। এই সময়ে, মানুষ ভাবতে বাধ্য হয় জীবনে সে কী করেছে, জীবিত থাকার মূল্য কী, তার তাৎপর্য কী, কেনই বা সে পৃথিবীতে এসেছে। এবং এই মুহুর্তে মানুষ ক্রমাগতই অনুসন্ধিৎসু হয়ে ওঠে যে সত্যই পরবর্তী জীবন আছে কিনা, স্বর্গের অস্তিত্ব সত্যই আছে কিনা, কর্মের প্রতিফল সত্যই আছে কিনা…। মৃত্যু যত নিকটবর্তী হয়, মানুষ ততই বুঝতে চায় জীবন আসলে কী; মৃত্যু যত কাছে আসে, তার হৃদয় ততই শূন্য মনে হয়; মৃত্যু যত সন্নিকটে আসে, তত বেশি সে অসহায় বোধ করে; আর তাই তার মৃত্যুভয় প্রতিদিন বাড়ে। মৃত্যুর নিকটবর্তী হওয়ার সাথে সাথে মানুষের মধ্যে এই ধরনের অনুভূতির উদ্ভাসের দুটি কারণ রয়েছে: প্রথমত, তারা সেই খ্যাতি এবং সম্পদ হারাতে চলেছে যার উপর তাদের জীবন নির্ভরশীল ছিল, তারা দৃশ্যমান বিশ্বের সব কিছু ছেড়ে যেতে চলেছে; এবং দ্বিতীয়ত, তারা মুখোমুখি হতে চলেছে, একেবারে একা, একটি অপরিচিত ভুবনের, একটি রহস্যময়, অজানা রাজ্যের, যেখানে তারা পা রাখতে ভয় পায়, যেখানে তাদের কোন প্রিয়জন নেই এবং সাহায্য পাওয়ারও কোন উপায় নেই। এই দুটি কারণে, মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে মানুষ অস্বস্তি বোধ করে, আতঙ্কিত হয় এবং অসহায়তা বোধ করে যা তারা আগে কখনও অনুভব করে নি। কেবলমাত্র মানুষ যখন এই অবস্থায় আসে তখনই সে বুঝতে পারে যে এই পৃথিবীতে পা রাখার সময় তাদের প্রথমেই বুঝতে হবে যে মানুষ কোথা থেকে আসে, কেন মানুষ বেঁচে আছে, কে মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করে ও তাকে পালন করে, এবং মানুষের অস্তিত্বের উপর সার্বভৌমত্ব আসলে কার। এই জ্ঞানই মানুষের বেঁচে থাকার প্রকৃত সাধন, তার বেঁচে থাকার অপরিহার্য ভিত্তি—কীভাবে নিজের পরিবারের ভরণপোষণ করতে হয় বা কীভাবে খ্যাতি এবং সম্পদ অর্জন করতে হয় তা শেখা নয়, জনতার মধ্যে বিশিষ্ট হওয়া বা আরও সমৃদ্ধ জীবনযাপনের পন্থা শেখা নয়, জীবনে, উন্নতি করা বা অন্যদের বিরুদ্ধে সফলভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা তো নয়ই। বেঁচে থাকার যে সব বিভিন্ন দক্ষতা আয়ত্ত করতে মানুষ তাদের জীবন ব্যয় করে, তা তাকে প্রচুর পরিমাণে পার্থিব স্বাচ্ছন্দ্য দিতে পারে, কিন্তু সেগুলি কখনই হৃদয়ে প্রকৃত শান্তি এবং সান্ত্বনা আনে না, বরং এর পরিবর্তে তা মানুষকে ক্রমাগত দিকভ্রান্ত করে, সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে অসুবিধায় পড়ে এবং জীবনের অর্থ বোঝার প্রতিটি সুযোগ হাতছাড়া করে। কীকরে সঠিকভাবে মৃত্যুর সম্মুখীন হওয়া যায় সে বিষয়ে উদ্বেগের চোরাস্রোত তৈরী করে জীবনধারণের এই দক্ষতাগুলি। মানুষের জীবন এইভাবেই ধ্বংস হয়। সৃষ্টিকর্তা প্রত্যেকের সাথেই ন্যায্য আচরণ করেন, তাঁর সার্বভৌমত্ব উপলব্ধি করতে ও জানতে তিনি প্রত্যেককেই তার জীবনকালে মূল্যবান সুযোগ দেন, তবু যখন মৃত্যু ঘনিয়ে আসে, যখন দেখা যায় মৃত্যুর অপচ্ছায়া, একমাত্র তখনই মানুষ আলো্র সন্ধান পায়—এবং তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে!

অর্থ ও খ্যাতির পিছনে ধাওয়া করে মানুষ জীবন কাটায়; এই খড়কুটোগুলিকে আঁকড়ে ধরে, মনে করে তাদের সহায়তার একমাত্র মাধ্যম এইগুলিই, যেন এইগুলি পেলেই তারা বেঁচে থাকতে সক্ষম হবে, রেহাই পাবে মৃত্যু থেকে। কিন্তু যখন তারা মৃত্যুমুখে একমাত্র তখনই তারা বুঝতে পারে যে তাদের থেকে এই জিনিসগুলি কতটা দূরে, মৃত্যুর মুখে তারা কতটা দুর্বল, কত সহজে ভেঙ্গে পড়ে, তারা কত একাকী এবং অসহায়, কোথাও যাওয়ার ঠাঁই নেই। তারা উপলব্ধি করে যে অর্থ বা খ্যাতি দিয়ে জীবন কেনা যায় না, কোনো ব্যক্তি যতই ধনী বা তার অবস্থান যতই উচ্চ হোক না কেন, মৃত্যুর মুখে সবাই সমান দরিদ্র ও নগণ্য। তারা বুঝতে পারে যে অর্থ জীবন কিনতে পারে না, মৃত্যুকে মুছে ফেলতে পারে না খ্যাতি, অর্থ বা খ্যাতি কোনও ব্যক্তির জীবন এক মিনিট, এক সেকেন্ডও দীর্ঘায়িত করতে পারে না। মানুষ যত বেশি এইভাবে অনুভব করে, ততই তারা বেঁচে থাকতে চায়; মানুষ যত বেশি এইভাবে অনুভব করে, ততই তারা মৃত্যুর সম্মুখীন হতে ভয় পায়। শুধুমাত্র সেই মুহূর্তে তারা সত্যই উপলব্ধি করে যে তাদের জীবন তাদের নয়, তাকে নিয়ন্ত্রণ করতেও তারা অপারগ, জীবন ও মৃত্যু নিয়ে কারোরই কিছু বলবার নেই—এই সব কিছুই তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে।

৪) সৃষ্টিকর্তার রাজত্বের অধীনে এসো এবং শান্তভাবে মৃত্যুর মুখোমুখি হও

কোনো ব্যক্তির জন্ম-মুহূর্তে, একাকী এক আত্মা পৃথিবীতে শুরু করে তার জীবনের অভিজ্ঞতা, তার স্রষ্টার কর্তৃত্বের অভিজ্ঞতা, যেটি সৃষ্টিকর্তা তার জন্য ব্যবস্থা করেছেন। বলা বাহুল্য, ব্যক্তির—অর্থাৎ আত্মার—জন্য এটি সৃষ্টিকর্তার সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করার, তাঁর কর্তৃত্বকে জানার এবং ব্যক্তিগতভাবে তা অনুভব করার এক অপূর্ব সুযোগ। মানুষ তার জীবনযাপন করে স্রষ্টা-নির্ধারিত ভাগ্যের নিয়মের মধ্যে, এবং বিবেকসম্পন্ন যে কোনো যুক্তিবাদী ব্যক্তির পক্ষে, তাদের জীবনের কয়েক দশক ধরে, সৃষ্টিকর্তার সার্বভৌমত্বের সাথে মিলিত হওয়া এবং তাঁর কর্তৃত্বকে জানা কঠিন নয়। সুতরাং, কয়েক দশক ধরে প্রতিটি ব্যক্তির পক্ষে তাদের নিজস্ব জীবনের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে খুব সহজেই উপলব্ধি করা উচিত যে মানুষের ভাগ্য পূর্বনির্ধারিত, এবং অতি সহজেই বোঝা উচিত বা সারমর্ম গ্রহণ করা উচিত যে জীবিত থাকার অর্থ কী। জীবনের এই শিক্ষাগুলি যখন কেউ গ্রহণ করে, তখন ধীরে ধীরে সে বুঝতে পারে জীবন কোথা থেকে এসেছে, উপলব্ধি করে হৃদয়ের প্রকৃত চাহিদা কী, জীবনের প্রকৃত পথে মানুষকে কী পরিচালিত করে এবং মানুষের জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী হওয়া উচিত। মানুষ ধীরে ধীরে উপলব্ধি করে যে কেউ যদি স্রষ্টার উপাসনা না করে, যদি কেউ তাঁর রাজত্বের অধীনে না আসে, তবে যখন মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়ার সময় আসে—যখন তার আত্মা আরও একবার স্রষ্টার মুখোমুখি হতে চলেছে—তখন তার হৃদয় অসীম ভয় ও অস্থিরতায় পূর্ণ হবে। যদি কোনো ব্যক্তি কয়েক দশক ধরে পৃথিবীতে থেকেও বুঝতে না পারে যে মানবজীবন কোথা থেকে এসেছে এবং জানতে না পারে কার হাতে মানুষের ভাগ্য রয়েছে, তবে এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে তারা শান্তভাবে মৃত্যুর মুখোমুখি হতে পারবে না। জীবনের কয়েক দশকের অভিজ্ঞতায় যে স্রষ্টার সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেছে, সে-ই হল জীবনের অর্থ এবং মূল্য সম্পর্কে সঠিক উপলব্ধি সহ এক ব্যক্তি। এই ধরনের ব্যক্তি জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে গভীর জ্ঞানসম্পন্ন, যার বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং স্রষ্টার সার্বভৌমত্বের উপলব্ধি রয়েছে এবং এসবের ঊর্ধে, যে স্রষ্টার কর্তৃত্বের কাছে নতি স্বীকার করতে সক্ষম। এই ধরনের ব্যক্তি উপলব্ধি করেন ঈশ্বরের মানবজাতিকে সৃষ্টি করার অর্থ, বোঝেন যে মানুষের উচিত স্রষ্টার উপাসনা করা, মানুষের যা কিছু আছে সবই স্রষ্টার কাছ থেকে আসে এবং অদূর ভবিষ্যতে কোনোদিন তাঁর কাছে ফিরে যাবে। এই ধরনের ব্যক্তি বোঝেন যে মানুষের জন্মের ব্যবস্থা স্রষ্টাই করেন এবং মানুষের মৃত্যুর উপর তাঁর সার্বভৌম অধিকার, এবং জীবন ও মৃত্যু উভয়ই স্রষ্টার কর্তৃত্বের দ্বারা পূর্বনির্ধারিত। সুতরাং, যখন কেউ সদর্থে এই বিষয়গুলি উপলব্ধি করতে পারে, তখন স্বাভাবিকভাবেই সে শান্তভাবে মৃত্যুর মুখোমুখি হতে সক্ষম হবে, নিজের সমস্ত পার্থিব সম্পদকে শান্তভাবে পরিহার করে, পরবর্তী সমস্ত কিছুকে সানন্দে গ্রহণ ও সমর্পণ করে, এবং জীবনের শেষ সন্ধিক্ষণে অন্ধভাবে ভীত হয়ে তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার পরিবর্তে ঈশ্বর যে ভাবে সেই সন্ধিক্ষণ আয়োজন করেছেন, তাকে ঠিক সেইভাবেই স্বাগত জানাতে সক্ষম হবে। স্রষ্টার সার্বভৌমত্ব উপলব্ধির এবং তাঁর কর্তৃত্বকে জানার সুযোগ হিসাবে যদি কেউ জীবনকে দেখে, যদি কেউ নিজের জীবনকে একজন সৃষ্ট মানুষ হিসাবে নিজের দায়িত্ব পালন করার এবং নিজের উদ্দেশ্য পুরণ করার একটি বিরল সুযোগ হিসাবে দেখে, তবে জীবন সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গী অবশ্যই সঠিক হবে, সে অবশ্যই স্রষ্টার আশীর্বাদপূর্ণ এবং স্রষ্টার দ্বারা পরিচালিত জীবনযাপন করবে, অবশ্যই স্রষ্টার আলোয় চলবে, অবশ্যই স্রষ্টার সার্বভৌমত্ব জানবে, অবশ্যই তাঁর রাজত্বের অধীনে আসবে এবং অবশ্যই তাঁর অলৌকিক কাজের সাক্ষী হবে, সাক্ষ্য দেবে তাঁর কর্তৃত্বের। বলা বাহুল্য, এমন ব্যক্তিকে অবশ্যই স্রষ্টা ভালবাসবেন ও গ্রহণ করবেন, এবং শুধুমাত্র এই ধরনের ব্যক্তিই মৃত্যুর প্রতি শান্ত মনোভাব রাখতে পারে এবং জীবনের শেষ সন্ধিক্ষণকে সানন্দে স্বাগত জানাতে পারে। এমন এক ব্যক্তি যে নির্দ্বিধায় মৃত্যুর প্রতি এই ধরনের মনোভাব পোষণ করেছিলো সে হল ইয়োব। ইয়োব তার জীবনের চূড়ান্ত সন্ধিক্ষণকে সুখের সাথে গ্রহণ করার অবস্থানে ছিল এবং সে তার জীবনের যাত্রাকে একটি মসৃণ উপসংহারে নিয়ে এসে জীবনের উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ করে, সৃষ্টিকর্তার পাশে ফিরে যায়।

৫) ইয়োবের জীবনের সাধনা এবং প্রাপ্তি তাকে শান্তভাবে মৃত্যুর সম্মুখীন হতে দেয়

ইয়োব সম্পর্কে লেখা হয়েছে: “অবশেষে ইয়োব পূর্ণপরিণত বয়সে ইহলোক ত্যাগ করলেন” (ইয়োব ৪২:১৭)। এর অর্থ হল যখন ইয়োবের মৃত্যু হয়, তাঁর কোনো অনুশোচনা ছিল না এবং তাঁকে কোনো যন্ত্রণাও ভোগ করতে হয়নি, বরং স্বাভাবিকভাবে এই পৃথিবী থেকে তিনি প্রস্থান করেন। সকলেই জানে, ইয়োব তাঁর জীবতকালে ঈশ্বরে ভীতি রেখে এবং মন্দ কর্ম পরিত্যাগ করে চলতেন। তাঁর কীর্তি ঈশ্বরের দ্বারা প্রশংসিত হয়েছে এবং অন্যান্যদের কাছে স্মরণীয় হয়ে থেকেছে, এবং তাঁর জীবনের সেই মূল্য ও গুরুত্ব আছে বলে মনে করা হয়, যা অন্য সকলের থেকেই অনেক বেশি। ইয়োব ঈশ্বরের আশীর্বাদ লাভ করেছেন এবং তাঁর দ্বারা এই পৃথিবীতে ধার্মিক হিসাবে অভিহিত হয়েছেন, এবং সেইসঙ্গে ঈশ্বর তাঁকে পরীক্ষা করে দেখেছেন এবং শয়তানও তাঁকে পরখ করেছে। তিনি ঈশ্বরের হয়ে সাক্ষ্য দিয়েছেন এবং স্বীয় যোগ্যতায় ঈশ্বরের দ্বারা ধার্মিক পরিচয়ে অভিহিত হয়েছেন। ঈশ্বর তাঁকে পরীক্ষা করে দেখার পরের দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে তিনি যে জীবন যাপন করেন, তা ছিল আগের জীবনের তুলনায় অধিক মূল্যবান, অর্থপূর্ণ, বাস্তবমুখী এবং শান্তিপূর্ণ। তাঁর ধার্মিক কীর্তির জন্য, ঈশ্বর তাঁকে পরীক্ষা করে দেখেন, এবং ধার্মিক কীর্তির জন্যই ঈশ্বর তাঁর কাছে আবির্ভূত হন এবং তাঁর সঙ্গে সরাসরি বার্তালাপ করেন। তাই তাঁকে পরীক্ষা করার পরের বছরগুলিতে ইয়োব আরো সুস্পষ্টভাবে জীবনের মূল্যকে বুঝতে এবং তার মর্ম উপলব্ধি করতে পারেন, সৃষ্টিকর্তার সার্বভৌমত্বকে আরো গভীরভাবে বুঝতে পারেন, এবং সৃষ্টিকর্তা কীভাবে তাঁর আশীর্বাদ দান এবং প্রত্যাহার করেন সেই বিষয়ে আরো সুস্পষ্ট এবং নির্দিষ্ট জ্ঞান লাভ করেন। ইয়োবের গ্রন্থে নথিভুক্ত আছে যে যিহোবা ঈশ্বর তাঁর উপর আগের থেকেও অধিক আশীর্বাদ বর্ষণ করেন, যার ফলে ইয়োব সৃষ্টিকর্তার সার্বভৌমত্বকে জানা এবং মৃত্যুকে শান্তভাবে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে অধিকতর উন্নত অবস্থায় পৌঁছে যান। তাই যখন ইয়োব বার্ধক্যে পৌঁছন এবং মৃত্যুর সম্মুখীন হন, তখন নিশ্চিতভাবেই সম্পত্তি নিয়ে তাঁর কোনো চিন্তা ছিলো না। তাঁর কোনো উদ্বেগ ছিলো না, অনুশোচনা করার মত কিছু ছিলো না, এবং নিশ্চিতভাবেই তিনি মৃত্যুকে ভয় পাননি, কারণ তিনি সমগ্র জীবন প্রকৃত পথে ঈশ্বরে ভীতি রেখে এবং মন্দ কর্ম পরিত্যাগ করে চলেছেন। নিজের পরিণাম নিয়ে তাঁর দুশ্চিন্তার কোনো কারণই ছিলো না। ইয়োব মৃত্যুর সময় যেভাবে চলেছিলেন, বর্তমানে কতজন মানুষ মৃত্যর সময় ইয়োবের মতো সেই সব পথে চলতে পারবে? কেন কেউ এমন অনাড়ম্বর বাহ্যিক প্রকৃতি বজায় রাখতে পারে না? তার একটাই কারণঃ ইয়োব তাঁর জীবন অতিবাহিত করেছেন ঈশ্বরের সার্বভৌমত্বের প্রতি বিশ্বাস, স্বীকৃতি এবং সমর্পণের বস্তুগত সাধনায়, এবং এই বিশ্বাস, স্বীকৃতি এবং সমর্পণের সাহায্যেই তিনি তাঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ অতিক্রম করেছেন, জীবনের অন্তিম পর্ব পেরিয়েছেন এবং জীবনের চরম সন্ধিক্ষণকে সাদরে গ্রহণ করেছেন। ইয়োবের অভিজ্ঞতা নির্বিশেষে তাঁর জীবনের সাধনা ও লক্ষ্য যন্ত্রণাদায়ক ছিলো না, বরং তা ছিলো আনন্দময়। শুধু তাঁর উপর সৃষ্টিকর্তার বর্ষিত আশীর্বাদ অথবা প্রশংসার কারণে তিনি সুখী ছিলেন তা নয়, বরং আরো গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল তাঁর সাধনা এবং জীবনের লক্ষ্য, সৃষ্টিকর্তার সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে তাঁর ক্রমবর্ধমান জ্ঞান এবং প্রকৃত বোধ যা তিনি অর্জন করেছিলেন ঈশ্বরে ভীতি রেখে এবং মন্দ কর্ম পরিত্যাগের মাধ্যমে, এবং সর্বোপরি সৃষ্টিকর্তার সার্বভৌমত্বের একজন প্রজা হিসাবে, ঈশ্বরের বিস্ময়কর কীর্তির সাক্ষী হিসাবে এবং মানুষ ও ঈশ্বরের সহাবস্থান, পরিচিতি এবং পারস্পরিক বোঝাপড়ার কোমল অথচ অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা এবং স্মৃতির কারণে। ইয়োব সুখী ছিলেন সৃষ্টিকর্তার অভিপ্রায়কে জানার মধ্যে স্বাচ্ছন্দ্য এবং আনন্দের কারণে, এবং ঈশ্বর যে মহৎ, বিস্ময়কর, প্রেমময় এবং অনুগত এগুলি প্রত্যক্ষ করার ফলে যে শ্রদ্ধার উদ্রেক হয়, তার কারণেই। ইয়োব কোনো কষ্ট ছাড়াই মৃত্যুর সম্মুখীন হন, কারণ তিনি জানতেন মৃত্যুর মাধ্যমে তিনি সৃষ্টিকর্তার পারশ্বে ফিরে যাবেন। তাঁর জীবনের সাধনা এবং প্রাপ্তি তাঁকে শান্তভাবে মৃত্যুর সম্মুখীণ হতে অনুমোদন দেয়, সৃষ্টিকর্তা তাঁর জীবনীশক্তি ফিরিয়ে নেবেন এই সম্ভাবনাকে শান্তভাবে গ্রহণ করতে অনু্মোদন দেয়, এবং সৃষ্টিকর্তার সম্মুখে বিশুদ্ধ ও মুক্ত চিত্তে দাঁড়াবার শক্তি প্রদান করে। বর্তমান যুগের মানুষেরা কি সেই প্রকারের আনন্দ অর্জন করতে পারবে যা ইয়োবের ছিল? তোমাদের কাছে কি তা করার উপযুক্ত অবস্থা আছে? যেহেতু বর্তমানের মানুষদের কাছে এইসব প্রয়োজনীয় অবস্থা আছে, তাহলে তারা ইয়োবের মতো সুখে দিনযাপন করতে পারে না কেন? কেন তারা মৃত্যুভয়ের পীড়া থেকে মুক্ত হতে পারে না? মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে কেউ অনিয়ন্ত্রিতভাবে প্রস্রাব করে ফেলে, অনেকে কেঁপে ওঠে, অচৈতন্য হয়ে পড়ে, স্বর্গ, মানুষ নির্বিশেষে বাক্যবাণ বর্ষণ করে, এমন কি কেউ কেউ হাহাকার বা ক্রন্দন করে। মৃত্যু নিকটে এলে অকস্মাৎ এই ধরনের প্রতিক্রিয়া কোনোভাবেই স্বাভাবিক নয়। মানুষ এইরকম অস্বস্তিকর ব্যবহার করে কারণ হৃদয়ের গভীরে তারা মৃত্যুকে ভয় পায়, কারণ ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব এবং তাঁর ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে তাদের সুস্পষ্ট জ্ঞান এবং উপলব্ধি নেই, সদর্থে তাঁর কাছে সমর্পণ করারও কোনো ধারণা নেই। মানুষ এইভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে কারণ তারা সব কিছু নিজেরাই স্থির ও নিয়ন্ত্রণ করা ছাড়া আর কিছু চায় না। তারা নিজেদের ভাগ্য, জীবন এবং মৃত্যুকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। তাই তারা যে মৃত্যুভয় থেকে কখনোই মুক্তি পায় না, এতে বিস্ময়ের কিছু নেই।

৬) একমাত্র সৃষ্টিকর্তার সার্বভৌমত্ব স্বীকার করলেই মানুষ তাঁর পার্শ্বে ফিরে যেতে পারে

যখন সৃষ্টিকর্তার সার্বভৌমত্ব এবং তাঁর ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে মানুষের স্পষ্ট জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা থাকে না, নিয়তি এবং মৃত্যু সম্পর্কে তার জ্ঞান অবশ্যই অসংলগ্ন হবে। মানুষ স্পষ্টভাবে দেখতে পায় না যে সবকিছুই রয়েছে ঈশ্বরের করতলে, তারা বুঝতে পারে না যে সবকিছুই ঈশ্বরের নিয়ন্ত্রণ এবং সার্বভৌমত্বের অধীনে, তারা বুঝতে পারে না যে মানুষ এই সার্বভৌমত্বকে পরিত্যাগ করতে অথবা তার থেকে অব্যাহতি পেতে পারে না। সেই কারণেই, যখন মৃত্যুর সম্মুখীন হবার সময় আসে, তখন তাদের শেষ কথা, দুশ্চিন্তা এবং অনুশোচনার কোনো অন্ত থাকে না। তারা কত বোঝা, কত অনিচ্ছা এবং কত বিভ্রান্তির ভারে নত হয়ে যায়। এর ফলেই তারা মৃত্যুকে ভয় পায়। এই পৃথিবীতে জন্ম নেওয়া যে কোনো মানুষের জন্যই জন্ম হল প্রয়োজনীয় এবং মৃত্যু অনিবার্য; কেউই এই ঘটনাচক্রের ঊর্ধ্বে উঠতে পারবে না। কেউ যদি যন্ত্রণাহীনভাবে এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে চায়, কেউ যদি কোনো অনিচ্ছা এবং দুশ্চিন্তা ছাড়া জীবনের অন্তিম সন্ধিক্ষণের সম্মুখীন হতে চায়, তাহলে তার একমাত্র উপায় হল কোনো অনুতাপ না রাখা। আর অনুতাপ ছাড়া বিদায় নেবার একমাত্র উপায় হল, সৃষ্টিকর্তার সার্বভৌমত্বকে জানা, তাঁর কর্তৃত্বকে জানা, এবং তাদের কাছে সমর্পণ করা। একমাত্র এইভাবেই একজন মনুষ্যজনোচিত কলহ, মন্দতা, শয়তানের দাসত্ব থেকে দূরে থাকতে পারবে এবং এইভাবেই সে ইয়োবের মত জীবন যাপন করতে পারবে, এমন জীবন যা সৃষ্টিকর্তার নির্দেশ এবং আশীর্বাদপ্রাপ্ত, এমন জীবন যা স্বাধীন ও মুক্ত, এমন জীবন যা মূল্যবান এবং অর্থপূর্ণ, এমন জীবন যা সৎ এবং মুক্তহৃদয়ের। একমাত্র এইভাবেই কেউ ইয়োবের মত সৃষ্টিকর্তার বিচার এবং বঞ্চনার কাছে, তাঁর সুসমন্বয়সাধন এবং ব্যবস্থাপনার কাছে সমর্পণ করতে পারবে। একমাত্র এইভাবেই কেউ সারা জীবন ধরে সৃষ্টিকর্তার উপাসনা করতে পারবে এবং তাঁর প্রশংসা লাভ করতে পারবে, ঠিক যেমন ইয়োব করেছিলেন, এবং তাঁর কন্ঠস্বর শুনতে পাবে এবং তাঁর আবির্ভাবকে প্রত্যক্ষ করতে পারবে। একমাত্র এইভাবেই একজন ইয়োবের মত আনন্দের সঙ্গে বাঁচতে এবং মৃত্যুবরণ করতে পারবে, কোনো যন্ত্রণা, দুশ্চিন্তা, অনুশোচনা ছাড়া। একমাত্র এইভাবেই একজন মানুষ ইয়োবের মত আলোকময় জীবন যাপন করতে পারবে, জীবনের প্রতিটি সন্ধিক্ষণ আলোকিতভাবে অতিক্রম করতে পারবে, বিনা বাধায় নিজের যাত্রাপথ আলোর মধ্যে সম্পূর্ণ করতে পারবে, সৃষ্ট জীব হিসাবে সৃষ্টিকর্তার সার্বভৌমত্বকে জানা, চেনা এবং তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভ করার উদ্দেশ্য সফলভাবে সাধন করতে পারবে এবং আলোর মধ্যেই চিরবিদায় নিয়ে সৃষ্ট জীব হিসাবে চিরকালের জন্য সৃষ্টিকর্তার পার্শ্বে দাঁড়াবার এবং তাঁর প্রশংসা পাওয়ার সুযোগ পাবে।

সৃষ্টিকর্তার সার্বভৌমত্ব জানার সুযোগ হারাবেন না

উপরে বর্ণিত ছয়টি সন্ধিক্ষণ হল স্রষ্টার দ্বারা নির্ধারিত গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়, যার মধ্য দিয়ে প্রত্যেক সাধারণ মানুষকে তাদের জীবনে যাত্রা করতে হয়। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে, এই সন্ধিক্ষণের প্রত্যেকটিই বাস্তব, কোনোটিকেই এড়িয়ে যাওয়া যায় না এবং সবই সৃষ্টিকর্তার পূর্বনির্ধারণ ও সার্বভৌমত্বের সাথে সম্পর্কযুক্ত। তাই, প্রতিটি মানুষের জন্য, এই সন্ধিক্ষণগুলির প্রতিটিই এক একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাস্থল, এবং এগুলির প্রত্যকটিই কীভাবে সাফল্যের সাথে অতিক্রম করবে তোমরা এখন সেই গুরুতর প্রশ্নের মুখোমুখি।

কয়েক দশক ধরে গড়া কোনো মানুষের জীবন দীর্ঘ বা হ্রস্ব কোনোটাই নয়। জন্ম এবং বিশ বছর বয়সের মধ্যবর্তী সময় চোখের পলকে চলে যায়, এবং জীবনের এই ক্ষণে কোনো মানুষকে প্রাপ্তবয়স্ক হিসাবে বিবেচনা করা হলেও, এই বয়সের ব্যক্তিরা মানুষের জীবন এবং ভাগ্য সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানে না। অভিজ্ঞতা অর্জনের সাথে সাথে, তারা ধীরে ধীরে মধ্যবয়সে পা রাখে। ত্রিশ এবং চল্লিশের কোঠার ব্যক্তিরা জীবন এবং ভাগ্যের এক নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করে, তবে এই ব্যাপারগুলি সম্পর্কে তাদের ধারণা কিন্তু তখনও খুব অস্পষ্ট। কিছু মানুষ অন্তত তাদের চল্লিশ বছর বয়সে বুঝতে শুরু করে মানবজাতি এবং মহাবিশ্বকে, যা ঈশ্বর সৃষ্টি করেছিলেন, এবং উপলদ্ধি করে মানুষের জীবন কী, মানুষের ভাগ্য বলতেই বা কী বোঝায়। দীর্ঘকাল ধরে ঈশ্বরের অনুগামী এবং এখন মধ্যবয়সী হলেও কিছু মানুষ ঈশ্বরের সার্বভৌমত্বের সঠিক জ্ঞান এবং সংজ্ঞার অধিকারী হতে পারে না, সদর্থে সমর্পিত হওয়া তো আরো দূরের কথা। কিছু মানুষ আশীর্বাদ-প্রার্থনা ব্যতীত আর কিছুই চিন্তা করে না, এবং যদিও তারা বহু বছর ধরে বেঁচে আছে, তারা মানুষের ভাগ্যের উপর স্রষ্টার সার্বভৌমত্বের ন্যূনতম সত্যটিও জানে না বা উপলব্ধি করে না, এবং ঈশ্বরের সমন্বয়সাধন ও ব্যবস্থাপনায় সমর্পণের জন্য ক্ষুদ্রতম পদক্ষেপও নেয়নি। এই ধরনের মানুষ সম্পূর্ণরূপে মূর্খ এবং তাদের জীবন বৃথা।

মানুষের জীবনের অভিজ্ঞতা এবং মানুষের ভাগ্য সম্পর্কে জ্ঞানের ভিত্তিতে যদি মানুষের জীবনের সময়কালকে ভাগ করা হয় তবে সেগুলিকে মোটামুটিভাবে তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত করা যেতে পারে। প্রথম পর্যায় হল যৌবন, যা জন্ম থেকে মধ্য বয়সের মধ্যে বা জন্ম থেকে ত্রিশ বছর বয়স পর্যন্ত। দ্বিতীয় পর্যায় হল পরিণতি প্রাপ্তির সময়, মধ্য বয়স থেকে বার্ধক্য, বা ত্রিশ থেকে ষাট পর্যন্ত। এবং তৃতীয় পর্যায় হল একজনের পরিণত বয়স, যা বার্ধক্যের শুরুতে, অর্থাৎ ষাট থেকে শুরু করে, পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়া পর্যন্ত স্থায়ী হয়। অর্থাৎ, জন্ম থেকে মধ্যবয়স পর্যন্ত, ভাগ্য এবং জীবন সম্পর্কে বেশিরভাগ মানুষের জ্ঞান অন্যদের ধারণা অনুকরণ করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ, এবং এগুলির কোনও বাস্তব, ব্যবহারিক উপাদান প্রায় নেই। এই সময়কালে, জীবনের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি এবং কীভাবে কোনো ব্যক্তি পৃথিবীতে তার পথ তৈরি করে, তা বেশ অগভীর এবং শিশুসুলভ। এটি মানুষের কিশোরবেলা। জীবনের সব সুখ-দুঃখের আস্বাদনের পরেই কোনো মানুষ ভাগ্য সম্পর্কে প্রকৃত উপলব্ধি লাভ করে, এবং—অবচেতনে, নিজের হৃদয়ের গভীরে—ধীরে ধীরে ভাগ্যের অপরিবর্তনীয়তা উপলব্ধি করতে পারে এবং ধীরে ধীরে বুঝতে পারে যে মানুষের ভাগ্যের উপর সৃষ্টিকর্তার সার্বভৌমত্ব সত্যই বিদ্যমান। এটি মানুষের পরিণত অবস্থা প্রাপ্তির সময়কাল। কোনো ব্যক্তি তার পরিণত বয়সে প্রবেশ করে যখন সে ভাগ্যের বিরুদ্ধে লড়াই বন্ধ করে, এবং যখন তারা বিবাদে আর আকৃষ্ট হতে ইচ্ছুক থাকে না, এবং পরিবর্তে, জীবনে তাদের অংশ জানে, দৈব-ইচ্ছার কাছে নতি স্বীকার করে, জীবনের অর্জন এবং ত্রুটিগুলি সংহত করে, এবং তাদের জীবনের বিষয়ে সৃষ্টিকর্তার রায়ের অপেক্ষা করে। এই তিনটি সময়কালে মানুষ যে বিভিন্ন অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি অর্জন করে থাকে, তা বিবেচনা করে, সাধারণ পরিস্থিতিতে, সৃষ্টিকর্তার সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে জানার সুযোগ খুব বৃহৎ নয়। যদি কেউ ষাট বছর অবধি জীবিত থাকে, তবে ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব জানার জন্য তার মাত্র ত্রিশ বছরের মত সময় আছে; যদি কেউ দীর্ঘ সময় ধরে তা জানতে চায়, তবে এটি কেবল তখনই সম্ভব যদি সে দীর্ঘজীবী হয়, অন্তত এক শতাব্দী বেঁচে থাকতে পারে। তাই আমি বলি, মানুষের অস্তিত্বের স্বাভাবিক নিয়ম অনুসারে, যদিও এটি খুব দীর্ঘ প্রক্রিয়া যখন কেউ প্রথম স্রষ্টার সার্বভৌমত্ব জানার বিষয়টির মুখোমুখি হয় তখন থেকে যখন কেউ সেই সার্বভৌমত্বের সত্যকে চিনতে সক্ষম হয়, এবং তারপর থেকে যতক্ষণ না কেউ তাতে সম্পূর্ণ সমর্পিত হতে সক্ষম হয়, যদি কেউ প্রকৃতপক্ষে বছরগুলি গণনা করে, তবে ত্রিশ বা চল্লিশটির বেশি বছর নেই যার মধ্যে এই পুরস্কারগুলি অর্জনের সুযোগ থাকে। এবং প্রায়শই, মানুষ আশীর্বাদ-প্রপ্তির বাসনায় এবং তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণে আত্মহারা হওয়ায় বুঝতে পারে না যে মানবজীবনের সারবত্তা কোথায় রয়েছে এবং উপলব্ধি করতে পারে না সৃষ্টিকর্তার সার্বভৌমত্বকে জানার গুরুত্ব। এই ধরনের লোকেরা মানবজীবন এবং স্রষ্টার সার্বভৌমত্ব অনুভব করার জন্য মানব জগতে প্রবেশের এই মূল্যবান সুযোগটিকে লালন করে না এবং তারা উপলব্ধি করে না যে সৃষ্টিকর্তার ব্যক্তিগত নির্দেশনা পাওয়া কোনো সৃষ্ট সত্তার জন্য কতটা মূল্যবান। তাই আমি বলি, যারা চায় ঈশ্বরের কাজ দ্রুত শেষ হয়ে যাক, যারা চায় যে ঈশ্বর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মানুষের শেষের ব্যবস্থা করবেন যাতে তারা অবিলম্বে প্রকৃত ঈশ্বরকে দেখতে পায় এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আশীর্বাদ লাভ করতে পারে—অবাধ্যতার অপরাধে তারা নিকৃষ্টতম দোষী এবং চরম মূর্খ। অন্যদিকে, যারা তাদের সীমিত সময়ের মধ্যে সৃষ্টিকর্তার সার্বভৌমত্ব জানার এই অনন্য সুযোগটি উপলব্ধি করতে চায়, তারাই সকল মানুষের মধ্যে জ্ঞানী, প্রখর ধীশক্তির অধিকারী। এই দুটি ভিন্ন আকাঙ্ক্ষা দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি এবং সাধনা প্রকাশ করে: যারা আশীর্বাদ খোঁজে তারা স্বার্থপর ও নীচ এবং ঈশ্বরের ইচ্ছার প্রতি অবিবেচক, কখনই ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব জানতে চায় না, কখনও এটির কাছে আত্মসমর্পণ করতে চায় না, কেবল যথেচ্ছ জীবনযাপন করতে চায়। তারা অচিন্ত্যনীয়ভাবে অধঃপতিত, এবং এই শ্রেণীর মানুষই ধ্বংস হয়ে যাবে। যারা ঈশ্বরকে জানতে চায় তারা তাদের আকাঙ্ক্ষা পরিহার করতে সক্ষম হয়, ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব এবং ঈশ্বরের ব্যবস্থার কাছে সমর্পিত হতে ইচ্ছুক, এবং তারা এমন ধরনের মানুষ হতে সচেষ্ট যারা ঈশ্বর-কর্তৃত্বের কাছে সমর্পিত এবং ঈশ্বরের ইচ্ছা পূরণ করে। এই ধরনের মানুষ ঈশ্বরের আশীর্বাদের আলোকে জীবনযাপন করে এবং তারা অবশ্যই ঈশ্বরের দ্বারা প্রশংসিত হবে। মানুষের মতামত যাই হোক না কেন তা নিরর্থক এবং ঈশ্বরের কাজ কতটা সময় নেবে সে ব্যাপারে মানুষের বলার কিছু নেই। মানুষের জন্য মঙ্গলকর হলো ঈশ্বরের সমন্বয়সাধন এবং সার্বভৌমত্বের কাছে আত্মসমর্পণ করা। তুমি যদি ঈশ্বরের সমন্বয়সাধনের কাছে নিজেকে সমৰ্পণ না করো, তবে কি পারবে তুমি? ঈশ্বরের কি তার ফলে কোনো ক্ষতি হবে? ঈশ্বরের সমন্বয়সাধনের কাছে নিজেকে সমৰ্পণ না করে যদি তুমি নিজেই নিজের দায়িত্ব নিতে সচেষ্ট হও, তাহলে তোমার সিদ্ধান্ত নেহাতই মূর্খের মতো, এবং শেষ পর্যন্ত ক্ষতির সম্মুখীন হবে একমাত্র তুমিই। শুধুমাত্র মানুষ যদি যথাশীঘ্র সম্ভব ঈশ্বরের সাথে সহযোগিতা করে, যদি সত্ত্বর তাঁর সুসমন্বয় গ্রহণ করে, তাঁর কর্তৃত্বকে জানতে চায় এবং তিনি মানুষের জন্য যা করেছেন তা উপলব্ধি করে, তবে তাদের আশা আছে। একমাত্র এইভাবেই তাদের জীবন বৃথা যাবে না এবং তারা পরিত্রাণ লাভ করবে।

মানুষের ভাগ্যের উপর ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব—এই সত্য অপরিবর্তনীয়

আমি যা বলেছি সেগুলি সব শোনার পর, ভাগ্য সম্পর্কে তোমাদের ধারণার কি পরিবর্তন হয়েছে? মানুষের ভাগ্যের উপর ঈশ্বরের সার্বভৌমত্বের বিষয়টি তুমি কীভাবে অনুধাবন করো? সহজভাবে বলতে গেলে, ঈশ্বরের কর্তৃত্বের অধীনে, প্রত্যেক ব্যক্তি সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয়ভাবে তাঁর সার্বভৌমত্ব এবং তাঁর ব্যবস্থাগুলি গ্রহণ করে এবং কোনো ব্যক্তি তার জীবনে যতই সংগ্রাম করুক বা, যতই বঙ্কিম হোক তার চলার পথ, শেষ পর্যন্ত তাকে ইশ্বরের এঁকে দেওয়া তার ভাগ্যের কক্ষপথে ফিরে আসতেই হয়। এটি স্রষ্টার কর্তৃত্বের অপ্রতিরোধ্যতা এবং মহাবিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ এবং পরিচালনায় তাঁর কর্তৃত্বের কাজ করার পদ্ধতি। এই অদম্যতা, নিয়ন্ত্রণ এবং শাসনের এই রূপ, এবং নিয়মের এই শৃঙ্খলের ফলেই সমস্ত কিছুর জীবন নির্দেশিত হয়, যা কোনো প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই মানুষকে বারবার পুনর্জন্মের অনুমতি দেয়, যা বিশ্বকে নিয়মিত ঘূর্ণায়মান রাখে, দিনের পর দিন বছরের পর বছর। তোমরা এই সব ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছো এবং সেগুলিকে বুঝতে পারো, তা আপাতভাবে হোক বা গভীরভাবে, এবং বোঝার গভীরতা নির্ভর করে তোমাদের উপলব্ধি ও সত্যের জ্ঞান, এবং ঈশ্বর সম্পর্কে জ্ঞানের উপর। সত্যের বাস্তবতা তুমি কতটা ভালভাবে জানো, ঈশ্বর-বাক্য কতটা উপলব্ধি করেছো, কত ভালভাবে ঈশ্বরের সারসত্য এবং স্বভাব জানো—এই সবই ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব এবং ব্যবস্থা সম্পর্কে তোমার উপলব্ধির গভীরতার প্রতিনিধিত্ব করে। মানুষের সমর্পণের উপর কি নির্ভর করে ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব এবং ব্যবস্থাপনার অস্তিত্ব? ঈশ্বর যে এই কর্তৃত্বের অধিকারী তা কি নির্ধারিত হয় মানুষের বশ্যতা স্বীকার দ্বারা? পরিস্থিতি নির্বিশেষে ঈশ্বরের কর্তৃত্ব বিদ্যমান। সকল পরিস্থিতিতে, ঈশ্বর প্রতিটি মানুষের ভাগ্য এবং সব কিছুই তাঁর ভাবনা এবং ইচ্ছা অনুসারে নির্দেশ দেন এবং ব্যবস্থা করেন। মানুষ বদলালেও এটির কোনো পরিবর্তন হবে না; এটি মানব—ইচ্ছা নিরপেক্ষ। সময়, স্থান এবং ভৌগোলিক কোনো পরিবর্তন দ্বারা এটির পরিবর্তন করা যায় না, কারণ ঈশ্বরের এই কর্তৃত্বই তাঁর সারসত্য। ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব জানতে এবং গ্রহণ করতে মানুষ সমর্থ কিনা, এবং এটির কাছে আত্মসমর্পণ করতে মানুষ সক্ষম কিনা—এই বিবেচনার কোনোটিই মানুষের ভাগ্যের উপর ঈশ্বরের সার্বভৌমত্বের বাস্তবতাকে সামান্যতমও পরিবর্তন করে না। অর্থাৎ, ঈশ্বরের সার্বভৌমত্বের প্রতি মানুষের মনোভাবই যাই হোক না কেন, এই সত্যটিকে কোনোভাবেই কেউ পরিবর্তন করতে পারে না যে ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব মানুষের ভাগ্য এবং সব কিছুর উপর প্রতিষ্ঠিত। যদি তুমি ঈশ্বরের সার্বভৌমত্বের কাছে আত্মসমর্পণ না-ও করো, তবুও তিনি তোমার ভাগ্যের নির্দেশদাতা; এমনকি তুমি তাঁর সার্বভৌমত্ব জানতে না পারলেও, তাঁর কর্তৃত্ব বিদ্যমান। ঈশ্বরের কর্তৃত্ব এবং মানুষের ভাগ্যের উপর ঈশ্বরের সার্বভৌমত্বের বাস্তবতা মানুষের ইচ্ছা—নিরপেক্ষ, এবং মানুষের পক্ষপাত ও পছন্দ অনুসারে পরিবর্তিত হয় না। ঈশ্বরের কর্তৃত্ব সর্বত্র, প্রতি ঘন্টায়, প্রতিটি মুহূর্তে। বিলুপ্ত হতে পারে স্বর্গ এবং পৃথিবী, কিন্তু তাঁর কর্তৃত্ব কখনই লোপ পাবে না, কারণ তিনি স্বয়ং ঈশ্বর, তিনি অনন্য কর্তৃত্বের অধিকারী, এবং কোনো মানুষ, ঘটনা বা বস্তু, স্থান বা ভূগোল দ্বারা তাঁর কর্তৃত্ব নিয়ন্ত্রিত বা সীমাবদ্ধ নয়। সর্বদা, ঈশ্বর তাঁর কর্তৃত্ব প্রয়োগ করেন, প্রদর্শন করেন তাঁর শক্তি, তাঁর পরিচালনার কাজ চালিয়ে যান যেমন তিনি সর্বদাই করেছেন। সমস্ত কিছুকে তিনি শাসন করেন, পালন করেন সব কিছুর, সমস্ত কিছুর সমন্বয়সাধন করেন—ঠিক যেমন তিনি চিরকাল করে আসছেন। কেউ এটি পরিবর্তন করতে পারবে না। এটি ধ্রুব সত্য, যা অনাদিকাল থেকে অপরিবর্তনীয়!

ঈশ্বরের কর্তৃত্বের কাছে সমর্পিত হতে ইচ্ছুক ব্যক্তির জন্য সঠিক মনোভাব এবং অনুশীলন

ঈশ্বরের কর্তৃত্ব এবং মানুষের ভাগ্যের উপর ঈশ্বরের সার্বভৌমত্বের বিষয়টি মানুষের এখন কোন মনোভাবের সাথে জানা এবং বিবেচনা করা উচিত? প্রতিটি ব্যক্তি এই বাস্তব সমস্যার সম্মুখীন। বাস্তব জীবনে সমস্যার মুখোমুখি হলে, ঈশ্বরের কর্তৃত্ব এবং তাঁর সার্বভৌমত্বকে তোমার কীভাবে জানা এবং বোঝা উচিত? যখন এই সমস্যাগুলির মুখোমুখি হও এবং তুমি জানো না যে কীভাবে সেগুলি বুঝতে হবে, পরিচালনা করতে হবে এবং সেগুলির বিষয়ে ধারণা করতে হবে, তখন তোমার সমর্পণের উদ্দেশ্য ও অভিপ্রায়, এবং ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব ও ব্যবস্থায়, তোমার প্রকৃত সমর্পণ প্রকাশের জন্য তোমার কী মনোভাব গ্রহণ করা উচিত? প্রথমে তোমাকে শিখতে হবে অপেক্ষা করতে; তারপর তোমাকে অবশ্যই শিখতে হবে অন্বেষণ করতে; এবং তারপর, সমর্পণ করতে। “অপেক্ষা করা”-র অর্থ ঈশ্বরের সময়ের জন্য অপেক্ষা, তোমার জন্য ঈশ্বর যে সকল মানুষ, ঘটনা ও বস্তুর আয়োজন করেছেন তার জন্য অপেক্ষা, তাঁর ক্রমপ্রকাশ্য অভিপ্রায় তোমার কাছে উদ্ভাসিত হওয়ার অপেক্ষা। “অন্বেষণ” এর অর্থ হল, বিভিন্ন মানুষ, ঘটনা ও বস্তুর মাধ্যমে ঈশ্বর তোমার জন্য যে সুচিন্তিত অভিপ্রায় রচনা করেছেন, তাদের পর্যবেক্ষণ ও উপলব্ধি করা, তাদের মাধ্যমে সত্যকে অনুধাবন করা, মানুষকে কী অর্জন করতে হবে এবং তাদের কোন পথে চলতে হবে তা বোঝা, ঈশ্বর মানুষের মধ্যে কী ফলাফল প্রাপ্ত করতে চান এবং তাদের মধ্যে তিনি কোন সিদ্ধি অর্জন করতে চান, তার মর্মগ্রহণ করা। “সমর্পন” বলতে অবশ্যই বোঝায় ঈশ্বরের দ্বারা সুসমন্বিত মানুষ, ঘটনা এবং বিষয়গুলি গ্রহণ করা, তাঁর সার্বভৌমত্বকে গ্রহণ করা এবং এগুলির মাধ্যমে জানতা পারা যে, সৃষ্টিকর্তা কীভাবে মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করেন, কীভাবে তিনি মানুষকে তার জীবন দান করেন, আর মানুষের অন্তরে কীভাবে সত্যের প্রতিষ্ঠা ঘটান। ঈশ্বরের আয়োজন ও সার্বভৌমত্বের অধীনে প্রতিটি বিষয়ই প্রাকৃতিক আইন মেনে চলে, এবং যদি তুমি ঈশ্বরকে তোমার জন্য সমস্ত কিছুর ব্যবস্থা করতে এবং নির্দেশ করতে দেওয়ার সংকল্প করো, তবে তোমাকে শিখতে হবে অপেক্ষা করা, তোমাকে শিখতে হবে অন্বেষণ করা এবং তোমাকে শিখতে হবে সমর্পণ করা। ঈশ্বরের কর্তৃত্বের কাছে আত্মসমর্পণে ইচ্ছুক এমন প্রত্যেক ব্যক্তিকে অবশ্যই এই মনোভাব অবলম্বন করতে হবে, ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব ও আয়োজন গ্রহণে ইচ্ছুক সকলের এই মৌলিক গুণটি থাকতেই হবে। এই ধরনের মনোভাবের ধারক হতে, এমন একটি গুণের অধিকারী হতে, তোমাকে অবশ্যই আরও পরিশ্রম করতে হবে। প্রকৃত বাস্তবতায় প্রবেশের এটিই একমাত্র উপায়।

ঈশ্বরকে তোমার অনন্য প্রভু হিসাবে গ্রহণ করাই হল পরিত্রাণ অর্জনের প্রথম পদক্ষেপ

ঈশ্বরের কর্তৃত্ব সংক্রান্ত সত্য হল সেই সত্য যা প্রতি মানুষের গুরুত্ব সহকারে সম্মান করা উচিত, হৃদয় দিয়ে তার অভিজ্ঞতা লাভ ও তাকে অনুধাবন করা উচিত, প্রতিটি মানুষের জীবনের সঙ্গেই এইসব সত্যের সম্পর্ক রয়েছে; প্রতিটি মানুষের অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে, প্রত্যেক মানুষ জীবনে যে সব গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণের মধ্য দিয়ে যায় তার সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে; ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান এবং যে আচরণের সঙ্গে তারা ঈশ্বরের কর্তৃত্বের সম্মুখীন হবে তার সঙ্গে এবং স্বাভাবিকভাবে প্রতিটি মানুষের চূড়ান্ত গন্তব্যের সঙ্গেও সম্পর্ক রয়েছে। তাই একে জানতে এবং বুঝতে সমগ্র জীবনের সমতুল জীবনীশক্তি লেগে যায়। যখন তুমি ঈশ্বরের কর্তৃত্বের দিকে প্রত্যক্ষভাবে তাকাও, যখন তুমি তাঁর সার্বভৌমত্বকে গ্রহণ করো, তুমি ধীরে ধীরে ঈশ্বরের কর্তৃত্বের অস্তিত্ব সম্পর্কিত যে সত্য, তা উপলব্ধি করতে এবং অনুধাবন করতে পারবে। কিন্তু তুমি যদি কখনও ঈশ্বরের কর্তৃত্বকে চিনতে না পারো এবং কখনও তাঁর সার্বভৌমত্বকে স্বীকার না করো, তাহলে তুমি যতই দীর্ঘজীবী হও না কেন, ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে সামান্যতম জ্ঞানও তুমি অর্জন করতে পারবে না। যদি তুমি ঈশ্বরের কর্তৃত্ব যদি প্রকৃতপক্ষে না জানো এবং বুঝতে না পারো, তাহলে যখন তুমি পথের শেষ প্রান্তে পৌঁছবে, এমন কি কয়েক দশক ধরে ঈশ্বরে বিশ্বাস করলেও, জীবনে প্রদর্শন করার মত তোমার কিছুই থাকবে না, এবং স্বাভাবিকভাবেই, মানুষের ভাগ্যের উপর ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞানও তোমার থাকবে না। এটা কি খুবই দুঃখজনক নয়? সুতরাং, তুমি জীবনে যতই পথ হাঁটো না কেন, এখন তোমার বয়স যতই হোক না কেন, তোমার অবশিষ্ট যাত্রা যতই দীর্ঘ হোক না কেন, প্রথমে তোমাকে ঈশ্বরের কর্তৃত্ব অবশ্যই স্বীকার করতে হবে ও তাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতে হবে, এবং এই সত্যটি মেনে নিতে হবে যে ঈশ্বর তোমার অনন্য প্রভু। মানুষের ভাগ্যের উপর ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে এই সত্যগুলির স্পষ্ট, নির্ভুল জ্ঞান এবং উপলব্ধি প্রত্যেকের জন্য একটি বাধ্যতামূলক পাঠ; মানুষের জীবনকে জানা এবং সত্য অর্জনের এটিই হলো মূলকথা। এই হল ঈশ্বরকে জানার জীবন, এর অধ্যয়নের মৌলিক পাঠক্রম, প্রত্যেককে প্রতিদিন যার মুখোমুখি হতে হবে, যা কেউ এড়াতে পারবে না। যদি কেউ এই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য সংক্ষিপ্ত পথ নিতে চায়, তবে আমি তোমাকে এখনই বলছি, তা অসম্ভব! তুমি যদি ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব থেকে অব্যাহতি পেতে চাও, তাহলে তার সম্ভাবনা আরও কম! ঈশ্বর মানুষের একমাত্র প্রভু, ঈশ্বরই মানুষের ভাগ্যের একমাত্র কর্তা, এবং তাই মানুষের পক্ষে নিজের ভাগ্য নির্ধারণ করা অসম্ভব, এর বাইরে পা রাখা তার পক্ষে অসাধ্য। মানুষ যতই ক্ষমতাশালী হোক, অন্যের ভাগ্যের উপর সে প্রভাব ফেলতে পারে না—তার সমন্বয়সাধন, আয়োজন, নিয়ন্ত্রণ বা পরিবর্তন তো আরোই পারে না। একমাত্র স্বয়ং ঈশ্বর, যিনি অনন্য, মানুষের জন্য সব কিছুই নির্দেশ করেন। কারণ স্বয়ং ঈশ্বর, যিনি অনন্য শুধুমাত্র তিনিই অনন্য কর্তৃত্বের অধিকারী যা মানুষের ভাগ্যের উপর সার্বভৌমত্ব রাখে, একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই মানুষের অনন্য প্রভু। ঈশ্বরের কর্তৃত্ব কেবল সৃষ্ট মানবজাতির উপরেই নয়, মানুষের কাছে দৃশ্যমান নয় এমন অ-সৃষ্ট অস্তিত্বের উপরে, নক্ষত্রের উপরে, মহাজগতের উপরেও সার্বভৌমত্ব ধারণ করে। এটি একটি অবিসংবাদিত সত্য, একটি সত্য যা প্রকৃতই বিদ্যমান, যার পরিবর্তন কোন ব্যক্তি বা বস্তু করতে পারে না। যদি তোমাদের মধ্যে এমন কেউ থাকে যে তার বর্তমান নিয়ে অসন্তুষ্ট, যদি তুমি বিশ্বাস কর যে তোমার কিছু বিশেষ দক্ষতা বা ক্ষমতা আছে, এবং এখনও ভাবছ যে ভাগ্যের দৌলতে তুমি তোমার বর্তমান পরিস্থিতির পরিবর্তন করতে পারো বা তার থেকে কোনোভাবে অব্যাহতি পেতে পারো; মানুষিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে যদি তোমার নিজের ভাগ্য বদলের চেষ্টা করো এবং তোমার সহকর্মীদের মধ্যে উজ্জ্বল হয়ে খ্যাতি এবং সৌভাগ্য লাভে সচেষ্ট হও; তাহলে আমি বলছি, তুমি শুধু নিজের জন্য কঠিন পরিস্থিতি সৃষ্টি করছো, শুধুই সমস্যা ডেকে আনছো, নিজের কবর নিজেই খনন করছো! শীঘ্রই বা পরে, একদিন, তুমি আবিষ্কার করবে তুমি ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলে এবং তোমারপ্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। তোমার উচ্চাকাঙ্ক্ষা, ভাগ্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ইচ্ছা এবং তোমার নীচ আচরণ তোমাকে এমন পথে নিয়ে যাবে যেখান থেকে প্রত্যাবর্তনের পথ থাকবে না এবং এর জন্য তোমাকে একটি তিক্ত মূল্য দিতে হবে। যদিও বর্তমানে তুমি পরিণতির তীব্রতা দেখতে পাচ্ছো না, যতই তুমি ক্রমাগত অনুভব করবে এবং গভীরভাবে উপলব্ধি করবে যে ঈশ্বর মানুষের ভাগ্য-বিধাতা, ততই তুমি ধীরে ধীরে উপলব্ধি করবে যে আমি আজ যা বলছি, এবং তার বাস্তব প্রভাব। প্রকৃতই তোমার হৃদয় ও আত্মা আছে কিনা এবং তুমি সত্যকে ভালোবাসো কি না তা নির্ভর করে ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব এবং সত্যের প্রতি তোমার মনোভাব কী তার উপর। স্বাভাবিকভাবে, এতেই নির্ধারিত হয় তুমি প্রকৃতই ঈশ্বরের কর্তৃত্ব জানতে এবং উপলব্ধি করতে পারবে কিনা। যদি তুমি তোমার জীবনে কখনও ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব এবং তাঁর ব্যবস্থাগুলি অনুভব না করে থাকো, ঈশ্বরের কর্তৃত্বকে ন্যূনতম স্বীকৃতি না দিয়ে থাকো এবং গ্রহণ না করে থাকো, তাহলে তুমি একেবারেই মূল্যহীন, এবং যে পথ তুমি নিয়েছো বা যে বিকল্প তুমি নির্বাচন করেছ, তাতে তুমি নিঃসন্দেহে ঈশ্বরের ঘৃণা ও প্রত্যাখ্যানের বিষয় হবে। কিন্তু যারা, ঈশ্বরের কাজে, তাঁর পরীক্ষাকে মেনে নিতে পারে, তাঁর সার্বভৌমত্বকে স্বীকার করতে পারে, তাঁর কর্তৃত্বের কাছে সমর্পণ করতে পারে, এবং ধীরে ধীরে তাঁর বাক্যের বাস্তব অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারে, তারা ঈশ্বর সম্পর্কে প্রকৃত জ্ঞান, তাঁর সার্বভৌমত্বের প্রকৃত উপলব্ধি অর্জন করতে পারবে; তারাই প্রকৃতপক্ষে হয়ে উঠবে সৃষ্টিকর্তার অধীন। শুধুমাত্র এই ধরনের মানুষই প্রকৃত সুরক্ষা পাবে। কারণ তারা ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব উপলব্ধি করেছে, এবং তা গ্রহণ করেছে, মানুষের ভাগ্যের উপর ঈশ্বরের সার্বভৌমত্বের সত্যতা সম্পর্কে তাদের উপলব্ধি, তার প্রতি তাদের সমর্পণ, বাস্তব এবং নির্ভুল। যখন তারা মৃত্যুর মুখোমুখি হবে, ইয়োবের মত তার মৃত্যুতে অকম্প মন থাকবে, সে সমস্ত বিষয়ে ঈশ্বরের সুসমন্বয় ও ব্যবস্থার কাছে সমর্পণ করবে, কোনো ব্যক্তিগত পছন্দ বা ব্যক্তিগত আকাঙ্খা ছাড়াই। কেবলমাত্র এমন ব্যক্তিই একজন প্রকৃত, সৃষ্ট মানুষ হিসাবে স্রষ্টার কাছে ফিরে আসতে সক্ষম হবে।

১৭ ডিসেম্বর ২০১৩

পূর্ববর্তী: অনন্য ঈশ্বর স্বয়ং (২)

পরবর্তী: স্বয়ং অনন্য ঈশ্বর (৪)

প্রতিদিন আমাদের কাছে 24 ঘণ্টা বা 1440 মিনিট সময় থাকে। আপনি কি ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভের জন্য তাঁর বাক্য শিখতে 10 মিনিট সময় দিতে ইচ্ছুক? শিখতে আমাদের ফেলোশিপে যোগ দিন। কোন ফি লাগবে না।

সেটিংস

  • লেখা
  • থিমগুলি

ঘন রং

থিমগুলি

ফন্টগুলি

ফন্ট সাইজ

লাইনের মধ্যে ব্যবধান

লাইনের মধ্যে ব্যবধান

পৃষ্ঠার প্রস্থ

বিষয়বস্তু

অনুসন্ধান করুন

  • এই লেখাটি অনুসন্ধান করুন
  • এই বইটি অনুসন্ধান করুন

Messenger-এর মাধ্যমে আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন