অনন্য ঈশ্বর স্বয়ং (২)
ঈশ্বরের ধার্মিক প্রকৃতি
এখন যখন তোমরা ঈশ্বরের কর্তৃত্ব বিষয়ক আগের আলোচনাটি শুনে ফেলেছো, আমি আত্মবিশ্বাসী যে তোমরা এই বিষয়ে বেশ কিছু বাক্যের দ্বারা সজ্জিত। তোমরা কতটা গ্রহণ, আয়ত্ত ও উপলব্ধি করবে তার সবটাই নির্ভর করে তোমরা এই বিষয়ে কতটা সচেষ্ট হবে তার উপর। আমার আশা যে তোমরা আন্তরিকতার সঙ্গে বিষয়টিদেখবে; কোনোভাবেই আগ্রহশূন্যভাবে বিষয়টিতে নিয়োজিত হওয়া উচিৎ নয়! তবে, ঈশ্বরের কর্তৃত্বকে জানা কি ঈশ্বরের সামগ্রিকতাকে জানার সমতুল্য? কেউ এমন বলতেই পারে যে ঈশ্বরের কর্তৃত্বকে জানা হল স্বয়ং অনন্য ঈশ্বরকে জানার সূচনা, এবং আরেকজন এমনও বলতে পারে যে, ঈশ্বরের কর্তৃত্বকে জানার অর্থ হল স্বয়ং অনন্য ঈশ্বরের সারমর্মকে জানার প্রবেশদ্বারে ইতিমধ্যেই পদক্ষেপ করা। এই উপলব্ধি হল ঈশ্বরকে জানার একটি অংশ। তাহলে অন্য অংশটি কী? এই বিষয়টি নিয়েই আজ আমি আলোচনা করতে চাই—ঈশ্বরের ধার্মিক প্রকৃতি।
আজকের আলোচ্য বিষয়ে সহকারিতা করার জন্য আমি বাইবেলের দুটি পর্বকে বেছে নিয়েছি: প্রথমটি ঈশ্বরের দ্বারা সদোম নগরী ধংসের বিষয়ে, যা আদিপুস্তক ১৯:১-১১ ও ১৯:২৪-২৫ ছত্রগুলিতে পাওয়া যাবে; দ্বিতীয়টির বিষয়বস্তু ঈশ্বরের নীনবী নগরীকে নিস্কৃতি দান, যা যোনা পুস্তকের তৃতীয় ও চতুর্থ অধ্যায় ছাড়াও ওই পুস্তকেরই ১:১-২ ছত্রগুলিতে পাওয়া যাবে। আমার সন্দেহ যে এই দুটি পর্বের বিষয়ে আমার কী বলার আছে তা শোনার জন্য তোমরা সবাই অপেক্ষা করছো। আমি যা বলবো স্বভাবতই তা স্বয়ং ঈশ্বরকে জানা ও তাঁর সারমর্মকে জানার পরিসর অতিক্রম করে পথভ্রষ্ট হতে পারে না, কিন্তু আজকের সহকারিতার কেন্দ্রবিন্দু কী হবে? তোমরা কেউ কি জানো? ঈশ্বরের কর্তৃত্ব বিষয়ে আমার আলোচনার কোন অংশটা তোমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল? আমি কেন বলেছিলাম যে একমাত্র ব্যক্তি যিনি এরকমের কর্তৃত্ব ও শক্তির অধিকারী তিনি ঈশ্বর স্বয়ং? তেমন বলার মাধ্যমে আমি কী ব্যাখ্যা করতে চেয়েছিলাম? এর থেকে তোমরা কী শিক্ষা নেবে বলে আমি ইচ্ছা পোষণ করেছিলাম? ঈশ্বরের কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা কি তাঁর সারসত্য যেভাবে প্রকাশিত হয়, তার-ই একটা দিক? এগুলি কি তাঁর সারসত্যের একটি অংশ, এমন একটা অংশ যা তাঁর পরিচয় ও মর্যাদাকে প্রতিপন্ন করে? এই প্রশ্নগুলো বিচার করে তোমরা কি বলতে পারো আমি কী বলতে চলেছি? তোমাদের কোন উপলব্ধি আমার কাম্য? এ বিষয়ে যত্নসহকারে চিন্তা করো।
অনমনীয় ঈশ্বর-বিরোধিতার ফলে মানুষ ঈশ্বরের ক্রোধের দ্বারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়
প্রথমে, ধর্মগ্রন্থের বেশ কিছু ছত্র দেখা যাক যেখানে ঈশ্বরের দ্বারা সদোম নগরী ধ্বংসের বিবরণ আছে।
আদিপুস্তক ১৯:১-১১ সেদিনই সন্ধ্যাবেলায় সেই দুইজন স্বর্গদূত সদোমে এসে পৌঁছালেন। লোট সেই সময়ে নগরদ্বারে বসে ছিলেন। তাঁদের দেখে লোট উঠে এগিয়ে গেলেন ও মাটিতে প্রণিপাত করে বললেন, প্রভু, অনুগ্রহ করে আপনাদের এই দাসের গৃহে পদার্পণ করে রাত্রি যাপন করুন ও পদপ্রক্ষালন করুন, আগামীকাল ভোরে উঠে আপনাদের গন্তব্য পথে যাত্রা করবেন। তাঁরা বললেন, না, আমরা নগরচত্বরে রাত্রি যাপন করব। কিন্তু লোট খুব অনুনয় বিনয় করায় তাঁরা তাঁর সঙ্গে গেলেন ও তাঁর বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করলেন। লোট খামির ছাড়াই রুটি তৈরী করে তাঁদের জন্য ভোজের আয়োজন করলেন এবং তাঁরা সেই খাদ্য গ্রহণ করলেন। কিন্তু তাঁরা শয্যাগ্রহণ করার আগেই সদোম নগরের আবালবৃদ্ধ জনতা এসে লোটের বাড়ি ঘেরাও করল। তারা লোটকে ডেকে বলল, তোমার বাড়িতে আজ রাতে যে দুজন লোক এসেছে তারা কোথায়? তাদের বের করে আমাদের কাছে নিয়ে এস, আমরা তাদের সম্ভোগ করব। লোট দরজার বাইরে এসে জনতার সামনে দাঁড়ালেন এবং তাঁর পিছনে দরজা বন্ধ করে দিয়ে তাদের বললেন, ভাইসব, আমার অনুরোধ তোমরা এই দুষ্কর্ম করো না। দেখ, আমার দুটি মেয়ে আছে, তারা কোনদিন পুরুষ সংসর্গ করে নি, তাদের নিয়ে তোমরা যা খুশী কর, কিন্তু এই দুই ব্যক্তির প্রতি তোমরা কিছু করো না, কারণ তাঁরা আমার বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করেছেন। কিন্তু তারা বলল সরে দাঁড়া। এ লোকটা এখানে প্রবাসী হয়েও আমাদের উপর মোড়লী করতে চায়! দাঁড়া, ওদের চেয়ে তোর দুদর্শা আমরা আরও বেশী করব। এই বলে তারা লোটের উপর চড়াও হয়ে দরজা ভেঙ্গে ফেলার উপক্রম করল। তখন সেই দুই ব্যক্তি হাত বাড়িয়ে লোটকে বাড়ির ভিতরে টেনে এনে দরজা বন্ধ করে দিলেন। আর দরজার বাইরে ছোট বড় যত লোক ছিল তাদের সকলের দৃষ্টিশক্তি তাঁরা লোপ করে দিলেন। ফলে সেই লোকগুলি দরজা খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে পড়ল।
আদিপুস্তক ১৯:২৪-২৫ প্রভু পরমেশ্বর তখনই আকাশ থেকে সদোম ও ঘমোরার উপর গন্ধক ও অগ্নি বর্ষণ করে সেই নগর দুটি, সমগ্র উপত্যকা ও নগরের অধিবাসী সমস্ত লোক এবং ভূমিজাত সমস্ত বস্তু ধ্বংস করলেন।
এই ছত্রগুলি থেকে এটা বোঝা দুষ্কর নয় যে সদোমের পাপাচার ও বিকৃতি ইতিমধ্যেই মানুষ ও ঈশ্বর উভয়ের কাছে ঘৃণিত একটা মাত্রায় পৌঁছে গিয়েছিল, এবং ঈশ্বরের চোখে তাই নগরীটি বিনাশযোগ্য ছিল। কিন্তু বিনাশ হবার আগে নগরীর অভ্যন্তরে কী ঘটতো? এই ঘটনাগুলি থেকে মানুষ কী অনুপ্রেরণা আহরণ করতে পারে? এই ঘটনাগুলির প্রতি ঈশ্বরের মনোভাব মানুষকে তাঁর প্রকৃতির বিষয়ে কী প্রদর্শন করে? সম্পূর্ণ আখ্যানটি উপলব্ধি করার জন্য ধর্মগ্রন্থে যা লিপিবদ্ধ হয়েছিল তা যত্নসহকারে পাঠ করা যাক …
সদোমের বিকৃতি: মানুষের কাছে ক্ষিপ্তকর, ঈশ্বরের কাছে ক্রোধোদ্দীপক
সেই রাতে লোট ঈশ্বর-প্রেরিত দুজন দূতকে আপ্যায়ন করলো এবং তাদের জন্য ভোজের আয়োজন করলো। খাওয়া-দাওয়ার পর, তারা শুয়ে পড়ার আগে, গোটা শহরের লোকজন এসে লোটের বাসস্থান ঘেরাও করলো এবং তাঁকে বাইরে ডাকলো। ধর্মগ্রন্থের নথি মোতাবেক তারা বলেছিল, “তোমার বাড়িতে আজ রাতে যে দুজন লোক এসেছে তারা কোথায়? তাদের বের করে আমাদের কাছে নিয়ে এস, আমরা তাদের সম্ভোগ করব।” কথাগুলো কে বলেছিল? কাকেই বা বলা হয়েছিল? এগুলি সদোমের অধিবাসীদের কথা, লোটের বাড়ির বাইরে চিৎকার করে বলা হয়েছিল যাতে লোট শুনতে পায়। কথাগুলো শুনলে কেমন বোধ হয়? তুমি কি রুষ্ট বোধ করো? কথাগুলো কি তোমায় বিতৃষ্ণ করে তুলছে? তুমি কি রাগে ফুঁসছো? এই বাক্যগুলি কি শয়তানের পুতিগন্ধে পরিপূর্ণ নয়? এগুলির থেকে তুমি কি এই নগরীর পাপাচার ও অন্ধকার আন্দাজ করতে পারো? এই লোকগুলোর কথাগুলো থেকে তাদের আচরণের বর্বরতা ও অসভ্যতা আঁচ করতে পারো? তাদের ব্যবহার থেকে তাদের বিকৃতির গভীরতা টের পাচ্ছো? তাদের বক্তব্যের আধেয় থেকে এটা বোঝা দুষ্কর নয় যে তাদের দুষ্ট প্রকৃতি ও পাশবিক স্বভাব নিজেদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে একটা স্তরে গিয়ে পৌঁছেছে। লোটকে বাদ দিয়ে এই নগরীর প্রত্যেকটি লোক শয়তানের থেকে ভিন্নতর কেউ নয়; আর দুজন মানুষকে দেখা মাত্র তারা তাদের অনিষ্ট ও সম্ভোগ করতে চেয়েছিল ...। এই বিষয়গুলি কোনো ব্যক্তিকে শুধু যে এই নগরীর বীভৎস ও ভয়াবহ প্রকৃতি ও একে ঘিরে মৃত্যুর যে পরিমণ্ডল তার সম্বন্ধে একটা বোধ দেয় তা নয়, এর দুষ্টতা ও রক্তপিপাসুতা সম্পর্কেও একটা ধারণা দেয়।
যখন সে নিজেকে একদল মনুষ্যত্বহীন গুণ্ডার, মানুষের আত্মা গ্রাস করার বন্য কামনায় পরিপূর্ণ এক দঙ্গল মানুষের মুখোমুখি দেখতে পেলো, তখন লোট কীভাবে জবাব দিলো? ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী: “ভাইসব, আমার অনুরোধ তোমরা এই দুষ্কর্ম করো না। দেখ, আমার দুটি মেয়ে আছে, তারা কোনদিন পুরুষ সংসর্গ করে নি, তাদের নিয়ে তোমরা যা খুশী কর, কিন্তু এই দুই ব্যক্তির প্রতি তোমরা কিছু করো না, কারণ তাঁরা আমার বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করেছেন।” এই উক্তিগুলির মাধ্যমে লোট যা বোঝাতে চেয়েছিল তা হল: দূতদের সুরক্ষিত করার জন্য সে তার দুই কণ্যাকে বিসর্জন দিতেও প্রস্তুত ছিলো। যেকোনো যুক্তিসম্মত হিসাব অনুযায়ী, এই লোকগুলির লোটের শর্তে রাজি হয়ে দূত দুইজনকে ছেড়ে দেওয়া উচিৎ ছিলো; যতোই হোক, দূতগুলি তো তাদের কাছে একদম অপরিচিত মানুষই ছিলো, লোকগুলির সাথে যাদের কোনো সম্পর্ক ছিলো না, এবং যারা কখনো তাদের কোনো স্বার্থহানি করেনি। কিন্তু তাদের দুষ্ট প্রকৃতির দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে লোকগুলি বিষয়টিতে দাঁড়ি টানতে চাইলো না, বরং তাদের প্রচেষ্টা তীব্রতর করলো। এখানে, তাদের আরেকটি বাকবিনিময় সন্দেহাতীতভাবে মানুষকে এই লোকগুলির যথার্থ কলুষিত প্রকৃতির বিষয়ে অধিকতর অন্তর্দৃষ্টি দান করে, এবং একই সঙ্গে তা মানুষকে ঈশ্বর কেন এই নগরীকে ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন তার কারণ হৃদয়ঙ্গম ও উপলব্ধি করতেও সমর্থ করে।
তাহলে এরপর তারা কী বলেছিল? বাইবেলে যা লেখা আছে তা হলো: “কিন্তু তারা বলল সরে দাঁড়া। এ লোকটা এখানে প্রবাসী হয়েও আমাদের উপর মোড়লী করতে চায়! দাঁড়া, ওদের চেয়ে তোর দুদর্শা আমরা আরও বেশী করব। এই বলে তারা লোটের উপর চড়াও হয়ে দরজা ভেঙ্গে ফেলার উপক্রম করল।” কেন তারা লোটের দরজা ভেঙে ফেলতে চেয়েছিল? কারণটা হল, তারা ওই দুই দূতের ক্ষতিসাধন করতে অতি ব্যাগ্র ছিল। দূতগুলি কী কারণে সদোমে এসেছিলো? তাদের সেখানে আসার উদ্দেশ্য ছিল লোট ও তার পরিবারকে রক্ষা করা, কিন্তু নগরীর লোকেরা ভুলক্রমে ভেবেছিল তারা বুঝি সরকারী পদের দায়িত্বভার গ্রহণ করতে এসেছে। তাদের আগমনের উদ্দেশ্য জিজ্ঞাসা না করে শুধুমাত্র অনুমানের উপর ভিত্তি করে এই নগরীর লোকজন দূতদ্বয়ের বর্বরোচিত ভাবে ক্ষতিসাধনের বাসনা করেছিল; তাদের সঙ্গে কোনো সম্পর্কই নেই এমন দুজন মানুষের তারা অনিষ্ট করতে চেয়েছিল। স্পষ্টতই, এই নগরীর লোকরা তাদের মানবতা ও যুক্তিবোধ সম্পূর্ণই হারিয়ে ফেলেছিল। তাদের বুদ্ধিভ্রংশতা ও অসভ্যতার মাত্রা ইতিমধ্যেই শয়তানের পাপাচারী প্রকৃতি, যার মাধ্যমে সে মানুষের ক্ষতিসাধন করে ও তাদের গ্রাস করে, তার তুলনায় কোনো অংশে আলাদা ছিল না।
যখন তারা দাবি করলো লোট যেন লোকদুটিকে তাদের হাতে তুলে দেয়, লোট তখন কী করলো? পাঠ্যাংশ থেকে আমরা জানতে পারি যে লোট তাদের হস্তান্তরিত করেনি। লোট কি ঈশ্বরের এই দূতদ্বয়কে চিনতো? অবশ্যই চিনতো না! তবু কীভাবে সে এই লোকদুটিকে উদ্ধার করতে সমর্থ হয়েছিল? তারা কী করতে এসেছিল তা কি সে জানতো? যদিও সে তাদের আগমনের কারণ সম্বন্ধে অনবহিত ছিল, কিন্তু এটা সে জানতো যে তারা ঈশ্বরের সেবক, আর তাই সে তাদের তার বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল। সে যে ঈশ্বরের এই সেবকদের “প্রভু” আখ্যায় আপ্যায়িত করতে পেরেছিল এটাই প্রমাণ করে যে, লোট, সদোমের অপরাপর মানুষদের থেকে বিসদৃশ, ঈশ্বরের একজন নিয়মিত অনুসরণকারী ছিল। তাই, ঈশ্বরের দূতরা যখন তার কাছে এলো, এই দুই সেবককে বাড়ির অন্দরে নিয়ে যাওয়ার জন্য সে তার নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েছিল; তদুপরি, এই দুই সেবককে সুরক্ষিত রাখার বিনিময়ে সে তার দুই কণ্যাকে উৎসর্গ করার প্রস্তাবও দিয়েছিল। এটা ছিল লোটের ধার্মিক কাজ; এটা ছিল লোটের প্রকৃতি ও সারসত্যের এক ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অভিব্যক্তি, এবং এই কারণেই ঈশ্বর লোটকে উদ্ধার করতে তাঁর সেবকদের প্রেরণ করেছিলেন। বিপদের মুখোমুখি হয়ে অন্য কোনোকিছুর পরোয়া না করে লোট এই দুই সেবককে রক্ষা করেছিল; এই সেবকদের সুরক্ষার খাতিরে এমনকি সে তার দুই কণ্যকে বিনিময় করার চেষ্টাও করেছিল। লোটকে বাদ দিলে, এই ধরনের একটা কাজ করতে পারে আর কেউ কি নগরীর মধ্যে ছিল? ঘটনাবলী প্রমাণ করে যে—না, আর কেউ ছিল না! তাই, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে লোটকে বাদ দিয়ে সদোমের প্রতিটি বাসিন্দা ছিল বিনাশের লক্ষ্যবস্তু, এবং খুব ন্যায়সঙ্গত কারণেই—তারা এর যোগ্য ছিল।
ঈশ্বরের ক্রোধের উদ্রেক ঘটানোর দরুন সদোমকে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করা হয়
সদোমের বাসিন্দারা যখন এই দুই সেবককে দেখে, তারা তাদের আগমনের হেতু জিজ্ঞাসা করেনি, এ-ও জিজ্ঞাসা করেনি তারা ঈশ্বরের অভিপ্রায় প্রাচারের উদ্দেশ্যে এসেছিল কিনা। বরং সম্পূর্ণ বিপরীতে গিয়ে, তারা একটা দাঙ্গাকারী জনতা গঠন করেছিল, এবং কোনো ব্যাখ্যার জন্য অপেক্ষা না করে, বন্য কুকুর বা হিংস্র নেকড়ের মতো তারা এই দুই সেবককে পাকড়াও করার উদ্দেশ্যে ছুটে এসেছিল। এইসবের সংঘটনকালে ঈশ্বর কি বিষয়গুলি অবলোকন করেছিলেন? মানুষের এই জাতীয় আচরণ, এই ধরনের ঘটনা সম্পর্কে ঈশ্বর তাঁর অন্তরে কী ভাবছিলেন? এই নগরী ধ্বংসের বিষয়ে ঈশ্বর মনস্থির করে করে ফেলেছিলেন; তিনি দ্বিধা বা অপেক্ষা করতেন না, তিনি আর কোনো ধৈর্যও দেখাতেন না। তাঁর দিন সমাগত ছিল, আর তাই তিনি যা করতে চেয়েছিলেন সেই কার্য শুরু করলেন। সুতরাং, আদিপুস্তক ১৯:২৪-২৫ বলে, “আর প্রভু পরমেশ্বর তখনই আকাশ থেকে সদোম ও ঘমোরার উপর গন্ধক ও অগ্নি বর্ষণ করে সেই নগর দুটি, সমগ্র উপত্যকা ও নগরের অধিবাসী সমস্ত লোক এবং ভূমিজাত সমস্ত বস্তু ধ্বংস করলেন।” এই দুটি পংক্তি যে পদ্ধতিতে ঈশ্বর এই নগরী ধ্বংস করেন এবং ঈশ্বর যা-কিছু ধ্বংস করেন তার বিবরণ দেয়। বাইবেল প্রথমে স্মরণ করে যে ঈশ্বর নগরীটিকে আগুনে ভস্মীভূত করেন এবং এই আগুনের ব্যাপ্তি সকল মানুষ ও ভূমির উপর উদ্ভূত সবকিছুকে ধ্বংস করার পক্ষে যথেষ্ট ছিল। অর্থাৎ, আকাশ থেকে বর্ষিত এই আগুন শুধুমাত্র নগরীটিকে ধ্বংস করেনি, এর মধ্যস্থ সকল মানুষ ও জীবিত বস্তুকেও ধ্বংস করেছিল, যতক্ষণ না তারা সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়েছিল। নগরীটি বিধ্বস্ত হওয়ার পর ভূমিটিকে জীবন্ত বস্তু বিরহিত অবস্থায় পরিত্যক্ত হয়েছিল; সেখানে কোনো জীবন ছিল না, জীবনের চিহ্নমাত্রও ছিল না। নগরীটি জনশূন্য নিষ্ফলা প্রান্তরে পরিণত হয়, মৃত্যুকল্প স্তব্ধতায় পূর্ণ একটি রিক্ত স্থান। এই স্থানে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে আর কখনো কোনো মন্দ কর্ম নিষ্পন্ন হবে না, আর কোনো হত্যাকাণ্ড বা রক্তপাত হবে না।
ঈশ্বর কেন এই নগরীকে এরকম আনুপুঙ্খিকভাবে পুড়িয়ে ফেলতে চেয়েছিলেন? এখানে তোমরা কী দেখতে পাও? ঈশ্বর কি সত্যিই মানুষ ও প্রকৃতিকে, তাঁর নিজের সৃষ্টিকে, এভাবে ধ্বংস হতে দেখাটা সহ্য করতে পারেন? তুমি যদি যিহোবা ঈশ্বরের রাগকে আকাশ থেকে যে আগুন নিক্ষিপ্ত হয়েছিল তা-র থেকে আলাদা করতে পারো, তাহলে, তাঁর ধ্বংসযজ্ঞের লক্ষ্যবস্তু ও নগরীটিকে যে মাত্রায় নিশ্চিহ্ন করা হয়েছিল তা বিচার করে, তাঁর রোষ কী ভীষণ ছিল তা অনুমান করা কঠিন হবে না। ঈশ্বর যখন একটি নগরীকে ঘৃণার চোখে দেখেন, তখন তিনি তার উপর শাস্তি প্রয়োগ করেন। ঈশ্বর যখন কোনো নগরীর প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে ওঠেন, মানুষকে তাঁর রাগের বিষয়ে অবহিত করতে বারংবার সাবধানবাণী প্রেরণ করেন। কিন্তু, ঈশ্বর যখন কোনো নগরীর বিলোপ ঘটানোর ও বিনাশ করার সিদ্ধান্ত নেন—অর্থাৎ, যখন তাঁর ক্রোধ ও মহিমা আহত হয়েছে—তিনি আর কোনো শাস্তি বা সতর্কবার্তা প্রেরণ করবেন না। পরিবর্তে, তিনি সরাসরি একে ধ্বংস করবেন। একে তিনি পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে দেবেন। এ-ই হল ঈশ্বরের ধার্মিক প্রকৃতি।
তাঁর প্রতি সদোমের বারংবার বৈরিতা ও প্রতিরোধের অন্তে ঈশ্বর এটিকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করেন
এখন যখন আমরা ঈশ্বরের ধার্মিক প্রকৃতি বিষয়ে একটা সাধারণ উপলব্ধি পেয়ে গেছি, আমরা আমাদের মনোযোগ আবার সদোম নগরীতে—যে স্থানকে ঈশ্বর পাপ-নগরী মনে করেছিলেন, সেখানে ফিরিয়ে আনতে পারি। এই নগরীর সারসত্যকে উপলব্ধি করার মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি ঈশ্বর কেন একে ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন এবং কেন তিনি একে এমন সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করেন। এর থেকে আমরা ঈশ্বরের ধার্মিক প্রকৃতিকে বুঝে উঠতে পারি।
মানবিক পরিপ্রেক্ষিত থেকে, সদোম মানুষের কামনা ও মানুষের পাপাচারকে সম্পূর্ণরূপে পরিতৃপ্ত করতে সক্ষম এক নগরী ছিল। রাতের পর রাত নাচ-গানের মাধ্যমে যাদুকরী ও সম্মোহক এই নগরীর সমৃদ্ধি মানুষকে মুগ্ধতা ও উন্মাদনার দিকে চালিত করেছিল। এর পাপাচার মানুষের হৃদয়কে ক্ষয়প্রাপ্ত করেছিল এবং মন্ত্রমুগ্ধ করে তাদের নৈতিক অবক্ষয়ের দিকে নিয়ে গিয়েছিল। এই নগরীতে অশুচি ও পাপিষ্ঠ আত্মারা দাপিয়ে বেড়াতো; পাপ ও হত্যায় কানায়-কানায় পূর্ণ ছিল এই নগরী এবং এর বাতাস ছিল রক্ত ও পচনের গন্ধে আচ্ছন্ন। এ ছিল এমন এক নগরী যা মানুষের রক্তকে ঠাণ্ডা করে দিত, যেখান থেকে মানুষ আতঙ্কে কুঁকড়ে পিছু হঠতো। এই নগরীর পুরুষ বা মহিলা, যুবা বা বৃদ্ধ— কেউই প্রকৃত পথের অনুসন্ধান করতো না; কেউ আলোর আকাঙ্খা করতো না বা পাপ থেকে দূরে সরে যাওয়ার বাসনা পোষণ করতো না। তারা শয়তানের নিয়ন্ত্রণে, শয়তানের কলুষ ও প্রবঞ্চনার ছত্রছায়ায় বাস করতো। তারা তাদের মানবতা, তাদের বোধশক্তি হারিয়ে ফেলেছিল, এবং মানুষের অস্তিত্বের আদি লক্ষ্যটুকু হারিয়ে ফেলেছিল। ঈশ্বরের বিরুদ্ধে প্রতিরোধকল্পে তারা অগণন দুষ্ট কর্ম সম্পাদন করেছিল; তারা তাঁর পথপ্রদর্শন প্রত্যাখ্যান করেছিল এবং তাঁর ইচ্ছার বিরোধিতা করেছিল। তাদের এই দুষ্ট কর্মই ধাপে ধাপে এই মানুষগুলিকে, এই নগরীকে, এবং এর অভ্যন্তরস্থ সকল জীবিত বস্তুকে ধ্বংসের পথে টেনে নিয়ে গিয়েছিল।
এই দুটি অনুচ্ছেদ অবশ্য সদোমের মানুষের ভ্রষ্টতার ব্যাপ্তি বিষয়ে কোনো বিশদ বিবরণ লিপিবদ্ধ করে না, পরিবর্তে এরা শুধু ঈশ্বরের দুই সেবকের নগরীতে আগমনের পর তাদের প্রতি নগরবাসীদের আচরণের বিবরণ দেয়, কিন্তু এখানে একটা সরল বাস্তব ঘটনা আছে যা সদোমের মানুষ যে কী পরিমাণে ভ্রষ্ট, পাপাচারী ও ঈশ্বর-প্রতিরোধী ছিল তা প্রকাশ করে। এর সাথে নগরবাসীদের প্রকৃত চেহারা ও সারসত্যও অনাবৃত হয়। এই লোকগুলি কেবল যে ঈশ্বরের সাবধানবাণী গ্রহণ করতেই অস্বীকার করেছিল তা নয়, তাঁর শাস্তিকে তারা ভয়ও পায়নি। বরং উল্টে, ঈশ্বরের রোষের প্রতি তারা তাচ্ছিল্য প্রকাশ করেছিল। অন্ধের মতো তারা ঈশ্বরকে প্রতিরোধ করেছিল। তিনি যা-ই করে থাকুন বা যেভাবেই তা করে থাকুন, তাদের কলুষিত প্রকৃতি শুধু তীব্রতর হয়েছিল, এবং তারা বারংবার ঈশ্বরের বিরোধিতা করেছিল। সদোমের লোকেরা ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রতি, তাঁর অভ্যুগমের প্রতি, তাঁর শাস্তির প্রতি, এবং সর্বোপরি তাঁর সাবধানবাণীর প্রতি শত্রুভাবাপন্ন ছিল। তারা মাত্রাতিরিক্ত রকমের উদ্ধত ছিল। গ্রাস ও অনিষ্ট করা যায় এমন সকল মানুষকে তারা গ্রাস করতো ও তাদের ক্ষতিসাধন করতো, এবং ঈশ্বরের সেবকদের প্রতি তাদের আচরণেও কোনো অন্যথা ঘটে নি। সদোমের লোকেরা যতকিছু অনৈতিক কাজকর্ম করেছিল তা বিবেচনা করলে, ঈশ্বরের সেবকদের অনিষ্টসাধন শুধু হিমশৈলের চূড়াটুকু মাত্র, এবং এই ঘটনার মাধ্যমে তাদের দুষ্ট প্রকৃতি যেটুকু উদ্ঘাটিত হয়েছিল বস্তুত তা বিশাল সমুদ্রে একটা জলবিন্দুর বেশি কিছু ছিল না। সেই কারণেই ঈশ্বর আগুনের সাহায্যে তাদের ধ্বংস করতে মনঃস্থ করেন। তিনি বন্যা ব্যবহার করেননি, এই নগরীকে ধ্বংস করতে তিনি ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস বা অন্য কোনো পদ্ধতিও ব্যবহার করেননি। এই নগরীকে ধ্বংস করতে ঈশ্বরের আগুনকে ব্যবহার করার তাৎপর্য কী ছিল? তা সেই নগরীর সামগ্রিক বিনাশ সংঘটিত করেছিল, তা সেই নগরীটি পৃথিবী থেকে ও অস্তিত্ব থেকে সম্পূর্ণ বিলোপপ্রাপ্তি সুনির্দিষ্ট করেছিল। এখানে “বিনাশ” বলতে শুধু নগরীটির গঠন ও কাঠামো বা বাহ্যিক চেহারার বিলুপ্তি বোঝায় না; তা এ-ও নির্দেশ করে যে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হওয়ার পর এই নগরীতে বসবাসকারী মানুষগুলির আত্মাও অস্তিত্ব থেকে মুছে গিয়েছিল। সহজ করে বললে, এই নগরীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল মানুষ, ঘটনাবলী ও বস্তুসমূহ ধ্বংস করা হল। সেই নগরীর মানুষগুলি কোনো পরবর্তী জীবন বা পুনর্জন্ম হল না; ঈশ্বর চিরকালের জন্য তাঁর সৃষ্টির মানবতা থেকে তাদের মুছে দিয়েছিলেন। অগ্নির ব্যবহার সেই স্থানের পাপের অবসানকে সূচিত করেছিল, সূচিত করেছিল যে সেখানে পাপকে দমন করা হয়েছিল; এই পাপ তার অস্তিত্ব ও প্রসার হারাবে। এই ঘটনা বোঝায় যে, যে স্থান শয়তানের পাপাচারের লালনভূমি এবং কবরস্থান, যা তাকে স্থিতি ও জীবনধারণের একটা জায়গা দিয়েছিল, তা সে হারিয়ে ফেলল। ঈশ্বর ও শয়তানের মধ্যে যুদ্ধে, ঈশ্বর কর্তৃক অগ্নির ব্যবহার তাঁর বিজয়ের একটা পরিচায়ক যার মাধ্যমে শয়তানকে চিহ্নিত করা হয়। মানুষকে ভ্রষ্ট ও গ্রাস করে ঈশ্বরের বিরোধিতা করার যে উচ্চাকাঙ্খা শয়তান পোষণ করে, তার প্রেক্ষিতে সদোমের বিনাশ শয়তানের তরফে এক সাঙ্ঘাতিক ভ্রান্ত পদক্ষেপ; একই ভাবে, মানবতার বিকাশের ইতিহাসে তা এমন একটা সময়ের লজ্জাজনক স্মারক যখন মানুষ ঈশ্বরের পথনির্দেশনাকে খারিজ করে নিজেকে পাপের কাছে সমর্পণ করেছিল। তদুপরি, এ হল ঈশ্বরের ধার্মিক স্বভাবের এক প্রকৃত উদ্ঘাটনের দলিল।
যখন আকাশ থেকে ঈশ্বর-প্রেরিত অগ্নি সদোমকে নিতান্ত ভস্মে পরিণত করেছিল, এর অর্থ হল এর পর থেকে “সদোম” নামক নগরীর অস্তিত্ব মুছে গিয়েছিল, একই সাথে নগরীর অভ্যন্তরস্থ সবকিছুর অস্তিত্বও লোপ পেয়েছিল। ঈশ্বরের রোষের দ্বারা এই নগরী বিনষ্ট হয়েছিল, তাঁর ক্রোধ ও মহিমার মধ্যে তা নিশ্চিহ্ন হয়েছিল। ঈশ্বরের ধার্মিক স্বভাবের কারণে, সদোম তার ন্যায্য শাস্তি ও যথোচিত পরিণতি লাভ করেছিল। সদোমের অস্তিত্বের পরিসমাপ্তি ঘটেছিল তার পাপের কারণে, এবং ঈশ্বরের এই নগরী, এতে বসবাসকারী কোনো মানুষজন, বা এর মধ্যে বিকশিত কোনো জীবনের প্রতি আর কখনো দৃকপাত না করার বাসনার কারণেও বটে। ঈশ্বরের “এই নগরীর প্রতি আর কখনো দৃকপাত না করার যে বাসনা” সেটাই তাঁর ক্রোধ, এবং মহিমা। ঈশ্বর এই নগরীকে ভস্মীভূত করেন কারণ এর দুষ্টতা ও পাপাচার নগরীটির প্রতি তাঁকে রাগান্বিত, বিরক্ত ও বিতৃষ্ণ করে তুলেছিল, এবং এই নগরী, বা এর কোনো বাসিন্দা, বা এর মধ্যের কোনো জীবিত বস্তুকে আর কখনো দেখতে তাঁকে অনিচ্ছুক করে তুলেছিল। নগরীর দগ্ধীভবন সমাপ্ত হয়ে যখন শুধু ভস্ম পড়ে রইলো, একমাত্র তখনই ঈশ্বরের নজরে এর অস্তিত্ব যথার্থভাবে লুপ্ত হল; এমনকি এই নগরী সংক্রান্ত তাঁর স্মৃতিও লুপ্ত হল, মুছে গেলো। অর্থাৎ, আকাশ থেকে প্রেরিত অগ্নি শুধু যে সদোমের সমগ্র নগরীকে ধ্বংস করেছিল তা নয়, শুধু যে এই নগরীর পাপাচার-পূর্ণ অধিবাসীদের ধ্বংস করেছিল তা-ও নয়, কেবল যে নগরীর অভ্যন্তরস্থ পাপ দ্বারা কলঙ্কিত সকল সামগ্রীকে ধ্বংস করেছিল তা-ও নয়; এই সকল কিছুর ঊর্ধ্বে, এই অগ্নি মানবতার অসদাচার ও ঈশ্বরের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের স্মৃতিকেও ধ্বংস করেছিল। এটাই ছিল ঈশ্বরের এই নগরীকে ভস্মীভূত করার উদ্দেশ্য।
এই মানুষগুলি অনাচারের চরমে পৌঁছে গিয়েছিল। ঈশ্বর কে, বা তারা নিজেরা কোথা থেকে এসেছে, এই মানুষগুলি তা জানতো না। তুমি যদি এদের কাছে ঈশ্বরের উল্লেখ করতে, তাহলে এরা আক্রমণ করতো, কুৎসা এবং ঈশ্বর-নিন্দা করতো। এমনকি ঈশ্বরের সেবকরা যখন তাঁর সাবধানবাণী প্রচার করতে এসেছিল, এই ভ্রষ্ট লোকগুলি শুধু যে অনুতাপের চিহ্নমাত্র দেখায়নি এবং তাদের দুষ্ট আচরণ পরিত্যাগ করেনি তা-ই নয়, বরং উল্টে বেহায়ার মতো তারা ঈশ্বরের সেবকদের ক্ষতিসাধন করেছিল। যা তারা অভিব্যক্ত ও প্রকাশিত করেছিল তা হল ঈশ্বরের প্রতি তাদের চরম বৈরিতার প্রকৃতি ও নির্যাস। আমরা দেখতে পাই, এই ভ্রষ্ট লোকগুলির ঈশ্বরের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তাদের ভ্রষ্ট স্বভাবের উদ্ঘাটনের চেয়েও বেশি কিছু ছিল, ঠিক যেমন তা ছিল নিছক সত্যোপলব্ধির অভাবজনিত কুৎসা রটনা বা উপহাসের একটি দৃষ্টান্তের থেকেও বেশি কিছু। না মূঢ়তা, না অজ্ঞানতা–কোনোটাই তাদের দুষ্ট আচরণের কারণ ছিল না; তারা যে প্রতারিত হয়েছিল বলে এমন আচরণ করেছিল, তা-ও নয়, এবং তারা যে ভুল পথে চালিত হয়েছিল বলে এমন করেছিল, তা একেবারেই নয়। তাদের আচরণ ঈশ্বরের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য, গর্হিত ও নির্ল্লজ্জ বিরোধিতা, প্রতিরোধ এবং বিক্ষোভের পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। মানুষের এ ধরনের আচরণ নিঃসন্দেহে ঈশ্বরকে রাগান্বিত করবে, এবং তা রুষ্ট করবে তাঁর প্রকৃতিকে যে প্রকৃতিকে কুপিত করা একেবারেই উচিৎ নয়। ঈশ্বর তাই প্রত্যক্ষভাবে ও প্রকাশ্যে তাঁর ক্রোধ ও মহিমাকে অর্গলমুক্ত করেন; এটাই ছিল তাঁর ধার্মিক প্রকৃতির যথার্থ উদ্ঘাটন। পাপাকীর্ণ এক নগরীর সম্মুখীন হয়ে, ঈশ্বর সম্ভাব্য ক্ষিপ্রতম উপায়ে তা ধ্বংস করতে, তার বাসিন্দা ও তাদের যাবতীয় পাপকে সম্পূর্ণতম রূপে উৎপাটন করতে, এই নগরীর মানুষজনের অস্তিত্ব মুছে দিতে, এবং এই স্থানের পাপের ক্রমবর্ধমানতাকে স্তব্ধ করতে চেয়েছিলেন। এটা করার দ্রুততম ও পূর্ণাঙ্গতম উপায় ছিল সেই স্থানকে অগ্নিদগ্ধ করা। সদোমের মানুষজনের প্রতি ঈশ্বরের মনোভাব পরিত্যাগ বা উপেক্ষাব্যঞ্জক ছিল না। বরঞ্চ এই লোকগুলিকে শাস্তি দিতে, আঘাত করতে ও সম্পূর্ণভাবে নাশ করতে তিনি তাঁর ক্রোধ, মহিমা ও কর্তৃত্বকে ব্যবহার করেছিলেন। তাদের প্রতি তাঁর যে মনোভাব তা শুধু শারীরিক বিনাশের নয়, বরং তা ছিল আত্মিক বিনাশের, তথা চিরকালীন বিলুপ্তির। “অস্তিত্ব নাশ” শব্দবন্ধের মাধ্যমে ঈশ্বর যা বলতে চান তার যথার্থ তাৎপর্য এটাই।
যদিও ঈশ্বরের ক্রোধ মানুষের কাছে লুক্কায়িত ও অজ্ঞাত, তবু তা কোনো অপরাধ বরদাস্ত করে না
সমগ্র মানবতার প্রতি, মূর্খ ও অজ্ঞান মানবতার প্রতি, ঈশ্বরের আচরণ মূলত করুণা ও সহনশীলতার ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। উল্টো দিকে, তাঁর ক্রোধ অধিকাংশ সময় ও অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রচ্ছন্ন রাখা থাকে, এবং মানুষের কাছে তা অজ্ঞাত। ফলস্বরূপ, মানুষের পক্ষে ঈশ্বরকে ক্রোধ প্রকাশ করতে দেখাটা দুষ্কর, এবং তাঁর ক্রোধকে উপলব্ধি করাটাও কঠিন। বস্তুত, ঈশ্বরের ক্রোধকে মানুষ হালকা ভাবে দেখে। মানুষ যখন ঈশ্বরের অন্তিম কাজ এবং মানুষের প্রতি সহনশীলতা ও ক্ষমাপরায়ণতার পর্যায়ের সম্মুখীন হয়—অর্থাৎ, যখন ঈশ্বরের কৃপার অন্তিম দৃষ্টান্ত ও তাঁর শেষ সাবধানবাণী মানবজাতির উপর নেমে আসে—মানুষ যদি তখনো ঈশ্বরকে প্রতিরোধ করার একই পদ্ধতি ব্যবহার করে এবং অনুতপ্ত হওয়ার, তাদের জীবনধারাকে সংশোধন করার ও তাঁর করুণাকে গ্রহণ করার কোনো চেষ্টা না করে, তাহলে তখন ঈশ্বর আর তাদের উপর তাঁর সহিষ্ণুতা ও ধৈর্য বর্ষণ করবেন না। বরং উল্টে, এই সময় ঈশ্বর তাঁর করুণা প্রত্যাহার করে নেবেন। অতঃপর, তিনি কেবলই তাঁর ক্রোধ প্রেরণ করবেন। তিনি বিভিন্ন উপায়ে তাঁর ক্রোধ অভিব্যক্ত করতে পারেন, ঠিক যেমন মানুষকে শাস্তি দিতে ও ধ্বংস করতেও তিনি বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারেন।
সদোম নগরী ধ্বংস করতে ঈশ্বরের যে অগ্নির ব্যবহার, তা হল মানবতা বা অন্য কোনো কিছুকে সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন করার জন্য তাঁর ক্ষিপ্রতম পদ্ধতি। সদোমের লোকজনের দগ্ধীভবন তাদের কায়িক দেহের চেয়ে অতিরিক্ত কিছুকে ধ্বংস করেছিল; তা সামগ্রিকভাবে তাদের মনন, তাদের আত্মা ও তাদের দেহকে ধ্বংস করেছিল, এবং এইভাবে তা নিশ্চিত করেছিল যে এই নগরীর অধিবাসীদের অস্তিত্ব শুধু লৌকিক জগৎ থেকে নয়, মানুষের কাছে যে জগৎ অদৃশ্য, তা থেকেও অবলুপ্ত হল। এ হল ঈশ্বরের ক্রোধ প্রকাশ ও অভিব্যক্ত করার এক পন্থা। উদ্ঘাটন ও অভিব্যক্তির এই পদ্ধতি ঈশ্বরের ক্রোধের সারসত্যের একটি দিক, ঠিক যেমন তা স্বভাবতই ঈশ্বরের ধার্মিক প্রকৃতির সারসত্যের একটি উদ্ঘাটনও বটে। ঈশ্বর যখন তাঁর ক্রোধ প্রেরণ করেন, তিনি তখন তাঁর প্রেমময় করুণা প্রকাশে ক্ষান্ত হন, তিনি তাঁর আর কোনো সহিষ্ণুতা বা ধৈর্যও প্রদর্শনও করেন না; এমন কোনো ব্যক্তি, বস্তু বা হেতু নেই যা তাঁকে তাঁর ধৈর্য বজায় রাখতে, পুনরায় তাঁর করুণা বিতরণ করতে, আরেকবার তাঁর সহিষ্ণুতা প্রদর্শন করতে রাজি করাতে পারে। এগুলির পরিবর্তে, মুহূর্তের জন্যও দ্বিধা না করে, ঈশ্বর তাঁর ক্রোধ ও মহিমা প্রেরণ করেন, তাঁর যেমন বাসনা তেমন-ই করেন। এই জিনিসগুলি তিনি তাঁর নিজের ইচ্ছা অনুসারে, ত্বরিত গতিতে এবং পরিচ্ছন্ন ভাবে সম্পাদন করবেন। এভাবেই ঈশ্বর তাঁর ক্রোধ ও মহিমা প্রেরণ করেন, যেগুলিকে মানুষ অবশ্যই লঙ্ঘন করবে না, এবং এ তাঁর ধার্মিক প্রকৃতির একটি অভিমুখের বহিঃপ্রকাশও বটে। মানুষ যখন ঈশ্বরকে তাদের প্রতি মমতা ও ভালোবাসা প্রদর্শন করতে প্রত্যক্ষ করে, তখন তারা তাঁর ক্রোধকে সনাক্ত করতে, তাঁর মহিমাকে দর্শন করতে বা অপরাধের প্রতি তাঁর অসহিষ্ণুতাকে অনুভব করতে অসমর্থ হয়। এই বিষয়গুলি সবসময় মানুষকে এই বিশ্বাসের দিকে চালিত করেছে যে ঈশ্বরের ধার্মিক প্রকৃতি কেবলমাত্র তাঁর করুণাঘন, সহিষ্ণু ও প্রেমময় প্রকৃতি। কিন্তু, কেউ যখন ঈশ্বরকে একটি নগরী ধ্বংস করতে বা মানবতাকে ঘৃণা করতে দেখে, মানব-সংহারে তাঁর রোষ ও তাঁর মহিমা মানুষকে তাঁর ধার্মিক প্রকৃতির অপর দিকটি এক ঝলক দেখার দেখার সুযোগ দেয়। এটাই অপরাধের প্রতি ঈশ্বরের অসহিষ্ণুতা। ঈশ্বরের যে প্রকৃতি কোনো অপরাধ সহ্য করে না, তা যেকোনো সৃজিত সত্তার সকল কল্পনাকে ছাপিয়ে যায়, এবং অসৃজিত সত্তাদের মধ্যে কেউ সেখানে হস্তক্ষেপ করতে বা তা প্রভাবিত করতে সক্ষম নয়; তা মূর্ত করা বা তার অনুকরণ করা তো আরো দুষ্কর। তাই, ঈশ্বরের স্বভাবের এই দিকটিই মানুষের সবুচেয়ে বেশি করে জানা উচিৎ। কেবলমাত্র স্বয়ং ঈশ্বরেরই এই ধরনের স্বভাব রয়েছে, এবং কেবলমাত্র স্বয়ং ঈশ্বরই এহেনস্বভাবের অধিকারী। ঈশ্বর এই প্রকার ধার্মিক স্বভাবের অধিকারী কারণ তিনি ঘৃণা করেন অসদাচার, অন্ধকার, বিদ্রোহী মনোভাব, ও শয়তানের পাপ কর্ম—যে পাপ মানবজাতিকে ভ্রষ্ট ও গ্রাস করে— এর কারণ হল যে, তিনি তাঁর বিরুদ্ধে কৃত সকল পাপ কর্মকে ঘৃণা করেন, এবং এর কারণ হল তাঁর পবিত্র ও অকলুষিত সারসত্য। এই কারণেই কোনো সৃজিত বা অসৃজিত সত্তা প্রকাশ্যে তাঁর বিরোধিতা করবে বা তাঁর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে,তা তিনি বরদাস্ত করবেন না। এমনকি যে ব্যক্তির প্রতি একদা তিনি করুণা দেখিয়েছেন বা যাকে তিনি মনোনীত করেছেন, সে-ও যদি তাঁর প্রকৃতিকে প্ররোচিত করে এবং তাঁর ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার নীতিকে লঙ্ঘন করে, তাহলে কণামাত্র করুণা বা দ্বিধার অবকাশ না রেখে ঈশ্বর অবারিত ও প্রকাশিত করবেন তাঁর ধার্মিক প্রকৃতিকে, যে প্রকৃতি কোনো অপরাধ সহ্য করেনা।
ন্যায়ের সকল বাহিনী ও সকল ইতিবাচক বিষয়ের কাছে ঈশ্বরের ক্রোধ হল এক রক্ষাকবচ
ঈশ্বরের বক্তব্য, চিন্তা ও কর্মের এই দৃষ্টান্তগুলি উপলব্ধি করার মাধ্যমে তুমি কি ঈশ্বরের সেই ধার্মিক স্বভাবকে অনুধাবন করতে সমর্থ, যা মানুষের দ্বারা লঙ্ঘিত হওয়া বরদাস্ত করবে না? সংক্ষেপে, মানুষ এর যতটুকুই উপলব্ধি করতে সক্ষম হোক, এটি স্বয়ং ঈশ্বরের প্রকৃতির একটা দিক, এবং তিনিই এর অনন্য অধিকারী। অপরাধের প্রতি ঈশ্বরের অসহিষ্ণুতা তাঁর অনন্য সারসত্য; ঈশ্বরের ক্রোধ তাঁর অনন্য প্রকৃতি; ঈশ্বরের মহিমা তাঁর অনন্য নির্যাস। ঈশ্বরের রোষের পিছনে নিহিত নীতি হল তাঁর স্বরূপ ও মর্যাদার প্রদর্শন, একমাত্র তিনিই যার অধিকারী। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এই নীতিও স্বয়ং অনন্য ঈশ্বরের সারসত্যের একটি লক্ষণ। ঈশ্বরের প্রকৃতি হল তাঁর নিজস্ব সহজাত সারসত্য, সময়ের অগ্রগতির সাথে যার আদৌ কোনো পরিবর্তন হয় না, এবং ভৌগোলিক অবস্থান পাল্টে গেলেও যা অপরিবর্তিত থাকে। তাঁর সহজাত প্রকৃতি হল তাঁর অন্তর্নিহিত সারসত্য। যার উপরেই তিনি তাঁর কার্য সম্পাদন করুন না কেন, তাঁর সারসত্য পরিবর্তিত হয় না, এবং তাঁর ধার্মিক প্রকৃতিও অপরিবর্তিত থাকে। কেউ যখন ঈশ্বরকে রাগান্বিত করে, ঈশ্বর যা প্রেরণ করেন তা হল তাঁর অন্তর্নিহিত প্রকৃতি; এই সময় তাঁর রোষের পিছনে নিহিত নীতির কোনো পরিবর্তন হয় না, তাঁর অনন্য স্বরূপ ও মর্যাদাও অপরিবর্তিত থাকে। তাঁর সারসত্যের পরিবর্তনের কারণে বা তাঁর প্রকৃতি থেকে ভিন্ন উপাদান উদ্ভূত হয় বলেই যে তিনি রেগে ওঠেন তা নয়, তিনি রেগে ওঠেন কারণ তাঁর বিরুদ্ধে মানুষের বিরোধিতা তাঁর প্রকৃতিকে আহত করে। ঈশ্বরের প্রতি মানুষের সুস্পষ্ট প্ররোচনা ঈশ্বরের নিজস্ব স্বরূপ ও মর্যাদার কাছে একটা স্পর্ধিত রণহুঙ্কার। মানুষ যখন স্পর্ধা ভরে ঈশ্বরকে দ্বন্দ্বে আহ্বান করে, ঈশ্বরের নজরে, মানুষ তাঁর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে এবং তাঁর রোষকে পরখ করছে। মানুষ যখন ঈশ্বরের বিরোধিতা করে, মানুষ যখন ঈশ্বরের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে, মানুষ যখন ক্রমাগত ঈশ্বরের রোষকে পরখ করে–এবং এরকমই একটা সময়ে পাপ অবাধে দাপিয়ে বেড়ায়–ঈশ্বরের ক্রোধ তখন স্বাভাবিকভাবেই আত্মপ্রকাশ করে ও নিজেকে পেশ করে। তাই, ঈশ্বরের ক্রোধের অভিব্যক্তি একটি ইঙ্গিত যে অচিরেই সকল অশুভ শক্তির অস্তিত্ব লোপ পাবে, এবং এটা একটা লক্ষণ যে সমস্ত বৈরী শক্তির বিনাশ ঘটবে। এটাই ঈশ্বরের ধার্মিক স্বভাবের ও ঈশ্বরের ক্রোধের অনন্যতা। যখন ঈশ্বরের আত্মমর্যাদা ও পবিত্রতার বিরুদ্ধে কেউ স্পর্ধিত প্রশ্ন করবে, যখন ন্যায়বিচারের শক্তিগুলি মানুষের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত ও উপেক্ষিত হবে, তখন ঈশ্বর তাঁর ক্রোধ প্রেরণ করবেন। ঈশ্বরের সারসত্যের কারণে, পৃথিবীর সকল শক্তি যা ঈশ্বরের বিরোধিতা করে, তাঁর প্রতিরোধ করে, এবং তাঁর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে–তা দুষ্ট, ভ্রষ্ট ও অন্যায্য; এরা শয়তানের থেকে আসে ও শয়তানের অধিকারভুক্ত। যেহেতু ঈশ্বর ন্যায্য, আলোক-সম্ভূত এবং ত্রুটিহীনভাবে পবিত্র, তাই ঈশ্বরের ক্রোধ যখন অবারিত হবে, সকল দুষ্ট, ভ্রষ্ট ও শয়তান-অধিকৃত বস্তু নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
যদিও ঈশ্বরের ক্রোধ-বর্ষণ তাঁর ধার্মিক প্রকৃতির অভিব্যক্তির একটি দিক, ঈশ্বরের রোষ কোনোভাবেই তার লক্ষ্যবস্তুর বিষয়ে বাছবিচারহীন নয়, এবং তা নৈতিকতাবিগর্হিতও নয়। বরং উল্টে, ঈশ্বর মোটেই তড়িঘড়ি রেগে ওঠেন না, এবং তাঁর ক্রোধ ও মহিমাকে লঘুভাবে প্রকাশও করেন না। উপরন্তু, ঈশ্বরের ক্রোধ অত্যন্ত নিয়ন্ত্রিত ও পরিমিত; মানুষ যেভাবে রাগে জ্বলে ঊঠতে বা তাদের রাগ উদ্গীরণ করতে অভ্যস্ত, ঈশ্বরের ক্রোধের সাথে তা আদৌ তুলনীয় নয়। বাইবেলে মানুষ ও ঈশ্বরের মধ্যে অনেক কথোপকথন লিপিবদ্ধ আছে। এই কথোপকথনে জড়িত কিছু মানুষের কথাবার্তা অগভীর, জ্ঞানগম্যিহীন ও শিশুসুলভ, কিন্তু ঈশ্বর তাদের আঘাত করেননি বা দোষী সাব্যস্তও করেননি। বিশেষ করে ইয়োবের বিচারের সময়, ইয়োবেকে তারা যে-কথা বলেছিল তা শোনার পর, যিহোবা ঈশ্বর ইয়োবের তিন বন্ধু ও অন্যান্যদের প্রতি কীরকম আচরণ করেছিলেন? তিনি কি তাদের দোষী সাব্যস্ত করেছিলেন? তিনি কি তাদের প্রতি রেগে উঠেছিলেন? এ-ধরনের কিছুই তিনি করেননি। পরিবর্তে তিনি ইয়োবেকে তাদের হয়ে সনির্বন্ধ অনুনয় ও তাদের জন্য প্রার্থনা করতে বলেছিলেন, এবং ঈশ্বর স্বয়ং তাদের ত্রুটিকে গায়ে মাখেন নি। যে প্রাথমিক মনোভাব থেকে ঈশ্বর মানুষদের প্রতি আচরণ করেন, এই দৃষ্টান্তগুলি তার প্রতিনিধিত্ব করে, এবং মানুষ যথারীতি ভ্রষ্ট ও অজ্ঞান। তাই, ঈশ্বরের ক্রোধকে অর্গলমুক্ত করা কোনোভাবেই তাঁর মেজাজের একটি অভিব্যক্তি নয়, এটা তাঁর অনুভূতিসমূহ উদ্গীরণের একটি পন্থাও নয়। মানুষের যে ভ্রান্ত ধারণা আছে, বাস্তবটা তার ঠিক উল্টো: ঈশ্বরের ক্রোধ মোটেই তাঁর রোষের একটা পূর্ণাঙ্গ বিস্ফোরক বহিঃপ্রকাশ নয়। এমন নয় যে ঈশ্বর তাঁর নিজের মেজাজ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন না বলে তাঁর ক্রোধকে লাগামমুক্ত করেন; এমনও নয় যে তাঁর রোষ স্ফুটনাঙ্কে পৌঁছে গেছে এবং একটা নির্গমনপথ তার আশু প্রয়োজন। উল্টে সত্যিটা হল, ঈশ্বরের ক্রোধ তাঁর ধার্মিক প্রকৃতির একটি প্রদর্শন ও একটি অকৃত্রিম অভিব্যক্তি, এবং এটি তাঁর পবিত্র সারসত্যের একটা প্রতীকী উদ্ঘাটন। ঈশ্বরই ক্রোধ, এবং লঙ্ঘিত হওয়া তিনি বরদাস্ত করেন না–তার মানে এই নয় যে ঈশ্বরের রোষ কারণ অনুযায়ী ভেদাভেদ করে না বা তা নীতিজ্ঞানহীন; রাগের নীতিনৈতিকতাহীন এলোপাতাড়ি বিস্ফোরণ, যে ধরনের রাগ বিভিন্ন কারণের মধ্যে কোনো পার্থক্য করে না, তার উপর একচ্ছত্র অধিকার তো ভ্রষ্ট মানুষের। কোনো মানুষ যখন পদমর্যাদা লাভ করে, তখন মেজাজের উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখাটা প্রায়শই তার পক্ষে দুরূহ হয়ে উঠবে, আর তাই সে নিজের অসন্তোষ ও আবেগ নির্গমনের সুযোগ পেলে তা লুফে নেওয়াকে উপভোগ করে; আপাতদৃষ্টিতে কোনো কারণ ছাড়াই প্রায়ই সে রেগে আগুন হয়ে উঠবে, এইভাবে সে তার সামর্থ্যকে দৃষ্টগোচর করে তুলবে এবং অন্যদের অবগত করবে যে পদমর্যাদা ও পরিচিতিতে সে সাধারণ মানুষদের থেকে স্বতন্ত্র। অবশ্য কোনো পদমর্যাদাহীন ভ্রষ্ট লোকেরাও মাঝেমাঝেই মেজাজ হারিয়ে ফেলে। প্রায়শই তাদের রাগের কারণ হয় তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থের হানি। তাদের আপন মর্যাদা ও সম্ভ্রম রক্ষা করতে তারা তাদের আবেগের দ্বার উন্মুক্ত করে দেবে ও তাদের উদ্ধত প্রকৃতিকে প্রকাশ করবে। পাপের অস্তিত্বকে রক্ষা করতে বা তাকে সমর্থন করতে মানুষ রাগে জ্বলে উঠবে ও তার আবেগ অবারিত করে দেবে, এবং এই ক্রিয়াকলাপগুলি মানুষের অসন্তুষ্টি প্রকাশের পদ্ধতি; তারা অশুচিতায় পরিপূর্ণ, অভিসন্ধি ও চক্রান্তে কানায় কানায় পরিপূর্ণ, মানুষের কলুষ ও পাপে ভরভরন্ত, এবং সর্বোপরি, মানুষের বন্য উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও বাসনা তাদের মধ্যে উপচে পড়ছে। যখন ন্যায় ও দুষ্টতার মধ্যে সংঘর্ষ বাধে, তখন ন্যায়ের অস্তিত্ব রক্ষাকল্পে বা তাকে সমর্থন করতে মানুষের রাগ জ্বলে ওঠে না; এর বিপরীতক্রমে ন্যায়ের শক্তিগুলি যখন ভীতিপ্রদর্শিত, নিগৃহীত ও আক্রান্ত হয়, তখন মানুষ না-দেখার, এড়ানোর বা সিঁটিয়ে পিছিয়ে আসার মনোভাব গ্রহণ করে। সেখানে, যখন অসাধু শক্তিগুলির সম্মুখীন হয়, মানুষ তখন মেনে নেওয়ার, ভক্তিতে গদগদ হওয়ার মানসিকতা নেয়। তাই, মানুষের রাগের উদ্গিরণ হল দুষ্ট শক্তিগুলির নির্গমন পথ, লৌকিক মানুষের অবাধ ও অরোধ্য পাপাচারের এক অভিব্যক্তি। অন্যদিকে, ঈশ্বর যখন তাঁর ক্রোধকে বিমুক্ত করবেন, সকল অশুভ শক্তির গতি তখন রুদ্ধ হবে, মানুষের পক্ষে হানিকর সকল পাপ অবদমিত হবে, যেসব বৈরীভাবাপন্ন শক্তি ঈশ্বরের কার্যকে প্রতিহত করে তাদের প্রতীয়মান, বিচ্ছিন্ন ও শাপগ্রস্ত করা হবে, এবং শয়তানের সকল অনুচর যারা ঈশ্বরের বিরোধিতা করে–তাদের শাস্তি দেওয়া হবে ও নির্মূল করা হবে। তাদের শূন্যস্থলে ঈশ্বরের কার্য নির্বাধে এগিয়ে যাবে, ঈশ্বরের পরিচালনামূলক পরিকল্পনা সময়সূচি অনুযায়ী ধাপে ধাপে সম্প্রসারিত হতে থাকবে, ঈশ্বরের মনোনীত ব্যক্তিরা শয়তানের ব্যাঘাত ও প্রতারণা থেকে মুক্ত হবে, এবং ঈশ্বর-অনুসরণকারী ব্যক্তিরা প্রশান্ত ও শান্তিপূর্ণ পরিমণ্ডলে ঈশ্বরের পথপ্রদর্শনা ও যোগান উপভোগ করবে। ঈশ্বরের ক্রোধ সকল অশুভ শক্তির সংখ্যাবৃদ্ধি ও অবাধ সঞ্চরণকে প্রতিহত করার জন্য একটি রক্ষাকবচ, এবং একই সঙ্গে এটা এমন একটা রক্ষাকবচ যা সকল ন্যায্য ও ইতিবাচক জিনিসের অস্তিত্ব ও বিস্তারকে সুরক্ষা দেয়, এবং তাদের অবদমিত ও উৎখাত হওয়া থেকে অনন্তকাল ধরে রক্ষা করে।
ঈশ্বর কর্তৃক সদোম বিনাশের মধ্যে তোমরা কি তাঁর ক্রোধের সারসত্য দেখতে পাও? তাঁর রোষের সাথে অন্যকিছু কি মিশে ছিল? ঈশ্বরের রোষ কি বিশুদ্ধ? মানুষের ভাষায় বললে, তাঁর ক্রোধ কি নির্ভেজাল? তাঁর ক্রোধের পিছনে কি কোনো কপটতা আছে? কোনো ষড়যন্ত্র আছে? অনুচ্চার্য কোনো গোপনীয়তা আছে? আমি তোমাদের কঠোর ও গম্ভীরভাবে বলতে পারি: ঈশ্বরের ক্রোধের মধ্যে এমন কোনো অংশ নেই যাতে কারো সন্দেহের উদ্রেগ হতে পারে। তাঁর ক্রোধ একটা বিশুদ্ধ, অবিমিশ্র রোষ যা অন্য কোনো অভিপ্রায় বা লক্ষ্য পোষণ করে না। তাঁর রোষের পিছনের কারণগুলি বিশুদ্ধ, নির্দোষ এবং সমালোচনার ঊর্ধ্বে। এটি তাঁর পবিত্র সারসত্যের একটি উদ্ঘাটন ও প্রদর্শন; এটি এমন একটা বিষয় সমগ্র সৃষ্টির আর কিছু যার অধিকারী নয়। এটি ঈশ্বরের অনন্য ধার্মিক প্রকৃতির একটা অংশ, এবং এটি সৃষ্টিকর্তা ও তাঁর সৃষ্টির নিজ নিজ সারসত্যের মধ্যে একটা লক্ষণীয় পার্থক্যও বটে।
অন্যদের দেখা মাত্র হোক বা তাদের অনুপস্থিতিতেই, কেউ যখন রাগান্বিত হয়ে ওঠে, প্রত্যেকের রাগের ভিন্ন ভিন্ন অভিপ্রায় ও উদ্দেশ্য থাকে। তারা হয়তো তাদের মর্যাদা গড়ে তুলছে, কিম্বা হয়তো তারা তাদের নিজের স্বার্থকে সুরক্ষিত করছে, তাদের ভাবমূর্তিকে বজায় রাখছে বা মুখরক্ষা করছে। কেউ-কেউ তাদের রাগের উপর সংযম প্রয়োগ করে, সেখানে অন্যেরা অপেক্ষাকৃত অপরিণামদর্শী এবং সামান্যতম নিয়ন্ত্রণ প্রয়োগ না করে তারা তাদের রাগকে যখন খুশি জ্বলে উঠতে দেয়। সংক্ষেপে, মানুষের রাগ তাদের ভ্রষ্ট স্বভাব থেকে উদ্ভূত হয়। এর উদ্দেশ্য যা-ই হোক, এটা দেহ-সম্ভূত ও প্রকৃতি-সম্ভূত; ন্যায় বা অন্যায়ের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই কারণ মানুষের প্রকৃতি ও সারসত্যের কিছুই সত্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তাই, ভ্রষ্ট মানুষের বদমেজাজ আর ঈশ্বরের ক্রোধকে এক নিঃশ্বাসে উল্লেখ করা উচিৎ নয়। ব্যতিক্রম ব্যতিরেকে, শয়তানের দ্বারা ভ্রষ্ট মানুষের ব্যবহার শুরু হয় ভ্রষ্টতাকে নিরাপত্তা দেওয়ার বাসনা থেকে, এবং বস্তুতই এটি ভ্রষ্টতার উপর প্রতিষ্ঠিত; এই কারণেই, তত্ত্বগতভাবে কোনো ব্যক্তির রাগ যতই যুক্তিযুক্ত মনে হোক না কেন, মানুষের রাগ ও ঈশ্বরের ক্রোধ এক নিঃশ্বাসে উল্লেখনীয় নয়। ঈশ্বর যখন তাঁর রোষ প্রেরণ করেন, দুষ্ট শক্তিগুলি সম্বৃত হয় ও দুষ্ট বিষয়গুলি বিনষ্ট হয়, অন্যদিকে ন্যায্য ও ইতিবাচক বিষয়গুলি ঈশ্বরের যত্ন ও সুরক্ষা উপভোগ করতে থাকে এবং তাদের অব্যাহত থাকতে দেওয়া হয়। ঈশ্বর তাঁর ক্রোধ প্রেরণ করেন কারণ অন্যায্য, নেতিবাচক ও দুষ্ট বিষয়গুলি ন্যায্য ও ইতিবাচক বিষয়গুলির স্বাভাবিক কাজকর্ম ও বিকাশকে প্রতিহত, বিঘ্নিত ও বিনষ্ট করে। নিজের মর্যাদা ও পরিচিতিকে সুরক্ষিত রাখা ঈশ্বরের রাগের লক্ষ্য নয়, তাঁর রাগের লক্ষ্য ন্যায্য, ইতিবাচক, সুন্দর ও শুভ বিষয়গুলির অস্তিত্বকে সুরক্ষিত করা, মানবতার স্বাভাবিক উদ্বর্তনের নিয়ম ও শৃঙ্খলাকে সুরক্ষিত করা। এটাই ঈশ্বরের ক্রোধের মূল কারণ। ঈশ্বরের রোষ তাঁর প্রকৃতির অত্যন্ত যথাযথ, স্বাভাবিক ও যথার্থ উদ্ঘাটন। ঈশ্বরের রোষের মধ্যে কোনো অলক্ষিত প্রণোদনা নেই, কোনো কপটতা বা ষড়যন্ত্রও নেই, আকাঙ্খা, চালাকি, বিদ্বেষ, হিংস্রতা, পাপাচার বা ভ্রষ্ট মানবতার অন্য কোনো সাধারণ বৈশিষ্টের তো প্রশ্নই ওঠে না। তাঁর রোষকে প্রেরণ করবার পূর্বে ঈশ্বর ইতিমধ্যেই প্রতিটি বিষয়ের নির্যাস খুব স্পষ্টভাবে ও সম্পূর্ণভাবে উপলব্ধি করে ফেলেছেন, ইতিমধ্যেই তিনি নির্ভুল ও স্বচ্ছ সংজ্ঞা ও সিদ্ধান্ত সূত্রবদ্ধ করে ফেলেছেন। এইভাবে, ঈশ্বরের সকল কাজকর্মে তাঁর উদ্দেশ্য স্ফটিকস্বচ্ছ হয়, ঠিক যেমন স্ফটিকস্বচ্ছ তাঁর মনোভঙ্গি। তিনি বিহ্বল-মস্তিষ্ক, অন্ধ, আবেগ-তাড়িত বা অসতর্ক নন, এবং নিশ্চিতভাবেই তিনি নীতিজ্ঞানবিগর্হিত নন। ঈশ্বরের ক্রোধের এটি ব্যবহারিক দিক, এবং তাঁর ক্রোধের এই ব্যবহারিক দিকটির কারণেই মানবতা তার স্বাভাবিক অস্তিত্ব অর্জন করেছে। ঈশ্বরের ক্রোধ না থাকলে মানবতা এক অস্বাভাবিক যাপন-পরিবেশের মধ্যে অবতরণ করতো, এবং সকল ন্যায্য, সুকুমার ও শুভ জিনিসগুলি ধ্বংসপ্রাপ্ত হতো ও অস্তিত্ব হারাতো। ঈশ্বরের ক্রোধ ব্যতিরেকে, সৃজিত সত্তাদের অস্তিত্বের নিয়ম-কানুনগুলি লঙ্ঘিত হতো বা এমনকি সম্পূর্ণ উৎখাত হয়ে যেত। মানব-সৃষ্টির পর থেকে, মানুষের স্বাভাবিক অস্তিত্বকে সুরক্ষিত ও অব্যাহত রাখতে ঈশ্বর অবিরত তাঁর ধার্মিক প্রকৃতিকে ব্যবহার করেছেন। তাঁর ধার্মিক প্রকৃতি ক্রোধ ও মহিমাকে ধারণ করে বলে তাঁর ক্রোধের ফলস্বরূপ সকল দুষ্ট মানুষ, বিষয় ও বস্তু, এবং মানুষের স্বাভাবিক অস্তিত্বকে বিঘ্নিত ও ক্ষতিগ্রস্ত করে এমন সবকিছু দণ্ডিত, নিয়ন্ত্রিত ও বিনষ্ট হয়। অতীতের বেশ কয়েকটি সহস্রাব্দ ধরে, ঈশ্বরের দ্বারা সম্পাদিত মানবতার পরিচালনার কার্যে, নানান ধরনের যেসব অশুচি ও দুষ্ট আত্মা ঈশ্বরের বিরোধিতা করে এবং শয়তানের অনুচর ও ভৃত্যের ভূমিকা পালন করে, তাদের আঘাত ও বিনাশ করতে ঈশ্বর ক্রমাগত তাঁর ধার্মিক প্রকৃতিকে ব্যবহার করেছেন। তাই, মানুষের পরিত্রাণের জন্য ঈশ্বরের কার্য সর্বদা তাঁর পরিকল্পনামাফিক এগিয়ে চলেছে। অর্থাৎ বলা যায় যে, ঈশ্বরের ক্রোধের অস্তিত্ব রয়েছে বলেই মানুষের সবথেকে ধার্মিক উদ্দেশ্যগুলি কখনো ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়নি।
ঈশ্বরের ক্রোধের সারসত্য বিষয়ে এখন যখন তোমাদের একটা উপলব্ধি হয়েছে, শয়তানের দুষ্টতাকে কীভাবে চিহ্নিত করতে হয় সে বিষয়ে তোমরা অবশ্যই আরো ভালো একটা উপলব্ধি অর্জন করবে!
শয়তানকে দেখে মানবিক, ন্যায়পরায়ণ ও সদ্গুনসম্পন্ন মনে হলেও, শয়তানের সারসত্য নিষ্ঠুর ও অশুভ
মানুষকে প্রতারণার মাধ্যমে শয়তান তার সুনাম নির্মাণ করে, এবং নিজেকে প্রায়শই ন্যায়পরায়ণতার একজন পুরোধা তথা আদর্শ নমুনা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে। ন্যায়পরায়ণতাকে রক্ষা করার মিথ্যে ছলনা করে সে মানুষের ক্ষতি করে, তাদের আত্মাকে গ্রাস করে, এবং মানুষকে অনুভূতিশূন্য, প্রতারিত ও প্ররোচিত করতে সব ধরনের উপায় অবলম্বন করে। তার লক্ষ্য মানুষ যাতে তার দুষ্ট আচরণের অনুমোদন করে ও সঙ্গী হয়, ঈশ্বরের কর্তৃত্ব ও সার্বভৌমতার বিরোধিতায় তারা যাতে তার সাথে যোগদান করে। কিন্তু কেউ যখন তার দুরভিসন্ধি ও চক্রান্তের স্বরূপ ধরে ফেলে এবং তার নীচ চারিত্রিক বৈশিষ্টকে বুঝে ফেলে, এবং কেউ যখন তার দ্বারা আর পদদলিত ও প্রতারিত হতে বা তার দাসত্ব করে যেতে চায় না, বা তার সঙ্গে একসাথে দণ্ডিত ও বিনষ্ট হতে চায় না, তখন শয়তান তার পূর্বের ঋষিপ্রতিম অবয়ব পাল্টে ফেলে এবং কৃত্রিম মুখোশ ছিঁড়ে ফেলে আসল চেহারাকে প্রকাশ করে, যে চেহারা পাপপূর্ণ, বিদ্বেষপূর্ণ, কুৎসিত এবং নৃশংস। যারা তাকে অনুসরণ করতে অস্বীকৃত হয় এবং যারা তার অশুভ শক্তিগুলির বিরোধিতা করে, তাদের সকলকে সমূলে বিনাশ করার থেকে বেশি আনন্দ সে আর কিছুতে পায় না। এই রকম একটা পর্যায়ে এসে, শয়তান আর একটা বিশ্বাসযোগ্য, ভদ্রলোকসুলভ চেহারা ধারণ করতে পারে না; পরিবর্তে, নিরীহ মানুষের ছদ্মবেশের আড়ালে ঢাকা তার সত্যিকারের কুৎসিত ও শয়তানোচিত অবয়ব প্রকাশিত হয়ে পড়ে। শয়তানের অভিসন্ধি একবার প্রকাশ্যে এসে গেলে, এবং তার প্রকৃত চেহারা একবার আনাবৃত হয়ে গেলে, সে রাগে ফেটে পড়বে এবং তার বর্বরতাকে উন্মোচিত করবে। এরপর, মানুষের ক্ষতি করার ও মানুষকে গ্রাস করার তার যে বাসনা তা কেবল তীব্রতর হবে। এর কারণ হল, মানুষের সত্যজ্ঞান জাগ্রত হলে সে রুষ্ট হয়, এবং স্বাধীনতা ও আলোকের আকাঙ্খায় এবং তার কারাগার ভেঙে মুক্ত হওয়ার জন্য মানুষের আকুলতার কারণে শয়তানের মধ্যে এক প্রবল প্রতিহিংসাপরায়ণতা জন্ম নেয়। তার রাগের উদ্দেশ্য তার পাপাচারকে সুরক্ষিত ও অনুমোদিত করা, এবং এই রাগ তার বর্বর প্রকৃতির একটা যথার্থ উদ্ঘাটনও বটে।
প্রত্যেকটি বিষয়ে শয়তানের আচরণ তার দুষ্ট প্রকৃতিকে উন্মোচিত করে। মানুষের উপর শয়তানের সম্পাদিত সকল মন্দ কাজের মধ্যে–মানুষ যাতে তাকে অনুসরণ করে সেই উদ্দেশ্যে মানুষকে বিভ্রান্ত করার তার প্রারম্ভিক প্রচেষ্টা থেকে শুরু করে, মানুষকে তার নিজের স্বার্থে ব্যবহার করা পর্যন্ত, যেখানে সে মানুষকে তার ক্লীন্ন ক্রিয়াকলাপের মধ্যে টেনে আনে, তার আসল চেহারা উন্মুক্ত হয়ে গেলে এবং মানুষ তাকে চিনে ফেলে পরিত্যাগ করার পর মানুষের প্রতি তার প্রতিহিংসাপরায়ণতা পর্যন্ত–এই কাজগুলির একটিও শয়তানের পাপাকীর্ণ সারসত্যকে অনাবৃত করতে ব্যর্থ হয় না, এই সত্য প্রতিপাদনেও ব্যর্থ হয় না যে, ইতিবাচক বিষয়ের সঙ্গে শয়তানের কোনো সম্পর্ক নেই এবং যে, সকল অশুভ জিনিসের উৎস শয়তান। তার প্রত্যেকটি কাজকর্ম তার পাপকে সুরক্ষিত করে, তার দুষ্ট কাজের ধারাবাহিকতা বজায় রাখে, ন্যায্য ও ইতিবাচক বিষয়গুলির বিরোধিতা করে, এবং মানুষের স্বাভাবিক অস্তিত্বের নিয়ম-কানুনকে ধ্বংস করে। শয়তানের এই কাজগুলি ঈশ্বরের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন, এবং ঈশ্বরের ক্রোধের দ্বারা এগুলি বিনষ্ট হবে। যদিও শয়তানের নিজস্ব রোষ আছে, কিন্তু তার রাগ তার দুষ্ট প্রকৃতিকে উদ্গিরণ করার একটি উপায় মাত্র। শয়তান যে কারণে ধৈর্যচ্যুত ও ক্রোধোন্মত্ত তা হল: তার অকহতব্য অভিসন্ধি ফাঁস হয়ে গেছে; তার চক্রান্ত সহজে রেহাই পায়নি; ঈশ্বরকে প্রতিস্থাপিত করে নিজে ঈশ্বর সেজে বসার জন্য তার উন্মত্ত আকাঙ্খা ও বাসনাকে আঘাত করে গতিরুদ্ধ করা হয়েছে; এবং সমস্ত মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করার তার যে লক্ষ্য তা এখন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে ও কোনোদিনও অর্জন করা যাবে না। শয়তানের চক্রান্তের সাফল্যলাভকে যা প্রতিহত করেছে এবং শয়তানের পাপের অবাধ সংঘটন ও প্রসারকে সংক্ষিপ্ত করেছে তা হল ঈশ্বর কর্তৃক পুনঃপুন তাঁর ক্রোধের আবাহন, বারংবার। এই কারণে শয়তান একই সাথে ঈশ্বরকে ঘৃণা করে ও ভয় পায়। যতবার ঈশ্বরের ক্রোধ নেমে আসে, তা যে শুধুমাত্র শয়তানের প্রকৃত বীভৎস চেহারার মুখোশ উন্মোচিত করে তা-ই নয়, শয়তানের দুষ্ট বাসনাকেও প্রকাশ্যে অনাবৃত করে, এবং তা করতে গিয়ে, মানুষের বিরুদ্ধে শয়তানের রাগের কারণও উন্মোচিত হয়ে যায়। শয়তানের রাগের বিস্ফোরণ তার দুষ্ট প্রকৃতির এক যথার্থ উদ্ঘাটন এবং তার দুরভিসন্ধির অনাবৃতকরণ। নিশ্চিতভাবে, যতবার শয়তান রাগান্বিত হয়ে ওঠে, তা মন্দ বস্তুর বিনাশ এবং ইতিবাচক বস্তুর সুরক্ষা ও অবিরামতার ইঙ্গিত দেয়; তা এই সত্যের বার্তা দেয় যে ঈশ্বরের ক্রোধকে অবমাননা করা যায় না।
ঈশ্বরের ধার্মিক প্রকৃতিকে জানার জন্য কোনো ব্যক্তি অবশ্যই তার অভিজ্ঞতা ও কল্পনার উপর নির্ভর করবে না
যখন তুমি দেখো যে তুমি ঈশ্বরের বিচার ও শাস্তির সম্মুখীন, তুমি কি বলবে যে ঈশ্বরের বাক্য খাদযুক্ত? তুমি কি বলবে যে ঈশ্বরের ক্রোধের পিছনে একটি গল্প আছে, এবং গল্পটি নির্ভেজাল নয়? ঈশ্বরের স্বভাব আবশ্যিকভাবে সম্পূর্ণ ধার্মিক নয়, এমন বলে কি তুমি ঈশ্বরনিন্দা করবে? ঈশ্বরের প্রতিটি কাজের বিষয়ে আলোচনার সময়, সর্বপ্রথম তোমায় নিশ্চিত হতে হবে যে ঈশ্বরের ধার্মিক প্রকৃতি অন্য কোনো উপাদান থেকে মুক্ত, যে তা পবিত্র ও ত্রুটিহীন। ঈশ্বরের আঘাত, শাস্তিদান এবং মানবতার বিনাশ এই কাজগুলির অন্তর্ভুক্ত। কোনো ব্যতিক্রম ছাড়া ঈশ্বরের প্রতিটি কাজ কঠোরভাবে তাঁর সহজাত প্রকৃতি ও তাঁর পরিকল্পনা অনুযায়ী সম্পাদিত হয়, এবং এতে মানবতার জ্ঞান, প্রথা বা দর্শনের কোনো ভূমিকা থাকে না। ঈশ্বরের প্রতিটি কাজ তাঁর স্বভাব ও সারসত্যের একটি অভিব্যক্তি, ভ্রষ্ট মানবতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনোকিছুর সাথে সম্পর্কশূন্য। মানবজাতির পূর্বধারণা আছে যে শুধুমাত্র মানবতার প্রতি ঈশ্বরের ভালোবাসা, করুণা ও সহনশীলতা-ই হল ত্রুটিহীন, নির্ভেজাল ও পবিত্র, এবং কেউ জানে না যে ঈশ্বরের রাগ ও তাঁর ক্রোধ অনুরূপভাবে বিশুদ্ধ; অধিকন্তু, কেউ এ ধরনের প্রশ্ন নিয়ে চিন্তাভাবনা করেনি যে ঈশ্বর কেন কোনো অপরাধ সহ্য করেন না বা তাঁর রাগ এতো ভয়ঙ্কর কেন। বরং উল্টে, কেউ কেউ ঈশ্বরের ক্রোধকে ভ্রষ্ট মানুষদের মতো নিছক একটা বদমেজাজ বলে ভুল করে, এবং ঈশ্বরের রাগকে ভ্রষ্ট মানুষদের মতো একই প্রকারের রোষ বলে ভ্রান্ত ধারণা করে। ভুলবশত তারা এমনকি এটাও ধরে নেয় যে, ঈশ্বরের রোষ মানুষের ভ্রষ্ট স্বভাবের স্বাভাবিক উদ্ঘাটনের ঠিক অনুরূপ এবং কোনো দুঃখজনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে মানুষের যে রাগ হয়, ঈশ্বরের ক্রোধের নিষ্ক্রমণ ঠিক তার মতোই, এবং তারা বিশ্বাস করে যে ঈশ্বরের ক্রোধের নির্গমন তাঁর মেজাজের একটা অভিব্যক্তি। আমি আশা করি যে, এই আলোচনার পর, ঈশ্বরের ধার্মিক প্রকৃতির বিষয়ে তোমাদের কারো আর কোনো ভ্রান্ত ধারণা, কল্পনা বা অনুমান থাকবে না। আমি আশা করি, আমার বাক্যগুলি শ্রবণ করার পর তোমরা তোমাদের হৃদয়ে ঈশ্বরের ধার্মিক স্বভাবের ক্রোধের বিষয়ে একটা প্রকৃত অবগতি লাভ করতে পারবে, ঈশ্বরের ক্রোধ সম্বন্ধে তোমাদের পূর্বেকার কোনো ভ্রান্ত উপলব্ধিকে একপাশে সরিয়ে রাখতে পারবে, এবং ঈশ্বরের ক্রোধের সারসত্য বিষয়ে তোমাদের নিজস্ব ভ্রান্ত বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গিকে পরিবর্তিত করতে পারবে। অধিকন্তু, আমি আশা রাখি যে তোমরা তোমাদের হৃদয়ে ঈশ্বরের প্রকৃতি বিষয়ে একটা যথাযথ সংজ্ঞা অর্জন করতে পারবে, ঈশ্বরের ধার্মিক স্বভাব বিষয়ে তোমাদের আর কোনো সংশয় থাকবে না, এবং ঈশ্বরের যথার্থ প্রকৃতির উপর তোমরা কোনো মানবিক যুক্তি বা কল্পনা আরোপ করবে না। ঈশ্বরের ধার্মিক প্রকৃতি হল ঈশ্বরের নিজস্ব প্রকৃত সারসত্য। তা মানুষের দ্বারা লিখিত বা আকার-প্রদত্ত কিছু নয়। তাঁর ধার্মিক প্রকৃতি কেবল তাঁরই ধার্মিক প্রকৃতি এবং সৃষ্টির কোনোকিছুর সাথে এর কোনো সম্পর্ক বা সংযোগ নেই। স্বয়ং ঈশ্বর-ই হলেন ঈশ্বর স্বয়ং। তিনি কোনোদিন সৃষ্টির একটা অংশ হবেন না, এবং এমনকি তিনি যদি সৃজিত সত্তাদের এক সদস্য হয়েও যান, তাঁর সহজাত স্বভাব ও সারসত্যের পরিবর্তন হবে না। তাই, ঈশ্বরকে জানা ও কোনো একটা বস্তুকে জানা এক জিনিস নয়; ঈশ্বরকে জানা কোনোকিছুকে ব্যবচ্ছেদ করা নয়, বা তা একটা মানুষকে বোঝার অনুরূপও নয়। ঈশ্বরকে জানার জন্য মানুষ যদি একটা বস্তুকে জানা বা একজন মানুষকে বোঝার জন্য তাদের যে ধারণা বা পদ্ধতি তা প্রয়োগ করে, তাহলে তুমি কখনো ঈশ্বর-জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হবে না। ঈশ্বরকে জানা অভিজ্ঞতা বা কল্পনার উপর নির্ভরশীল নয়, আর তাই ঈশ্বরের উপর তুমি অবশ্যই কখনো তোমার অভিজ্ঞতা বা কল্পনা আরোপ করবে না; তোমার অভিজ্ঞতা ও কল্পনা যত সমৃদ্ধই হোক না কেন, তবুও সেগুলি সীমিত। উপরন্তু, তোমার কল্পনা বাস্তব তথ্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, এবং সত্যের সাথে সঙ্গতি তো আরোই কম, এবং তা ঈশ্বরের প্রকৃত স্বভাব ও সারসত্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন। ঈশ্বরের সারসত্যকে উপলব্ধি করার জন্য তুমি যদি তোমার কল্পনার উপর নির্ভর করো তাহলে কখনোই তুমি সফল হবে না। একমাত্র পথ হল: ঈশ্বর থেকে আগত সবকিছুকে গ্রহণ করো, তারপর ধীরে ধীরে তা অনুভব ও উপলব্ধি করো। এমন একটা দিন আসবে যখন তোমার সহযোগিতা এবং সত্যের জন্য তোমার ক্ষুধা ও তৃষ্ণার কারণে তাঁকে যথার্থই উপলব্ধি করতে ও জানতে ঈশ্বর তোমায় আলোকিত করবেন। আর এর সাথেই আমাদের কথোপকথনের এই আংশটি সমাপ্ত করা যাক।
আন্তরিক অনুশোচনার মাধ্যমে মানুষ ঈশ্বরের করুণা ও সহিষ্ণুতা লাভ করে
নীচে যে বিবরণ দেওয়া হচ্ছে তা হল বাইবেলে বর্ণিত “ঈশ্বর কর্তৃক নীনবী নগরীর পরিত্রাণ”-এর গল্প।
যোনা ১:১-২ প্রভু পরমেশ্বর একদিন যোনাকে নির্দেশ দিলেন: মহানগরী নীনবীতে যাও। সেখানকার অধিবাসীদের কাছে ঘোষণা কর যে তাদের দুষ্কর্মগুলি আমার অজ্ঞাত নয়।
যোনা ৩ প্রভু পরমেশ্বর আবার যোনাকে নির্দেশ দিয়ে বললেন: মহানগরী নীনবীতে যাও। আমি তোমায় যা বলে দেব, সেই কথা ঘোষণা কর নগরবাসীর কাছে। এবার যোনা প্রভু পরমেশ্বরের বাধ্য হয়ে নীনবীতে গেলেন। এক বিরাট নগরী এই নীনবী। এর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে যেতে তিন দিন লাগত। যোনা নগরের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলতে লাগলেন। একদিনের পথ গিয়ে ঘোষণা করলেন: চল্লিশ দিনের মধ্যে নীনবী ধ্বংস হবে। নীনবীর অধিবাসীরা ঈশ্বরের কথায় বিশ্বাস করল। অনুতাপে দগ্ধ হয়ে তারা ঠিক করল, ছোট-বড় সকলে চট পরে উপবাস করবে। নীনবীর রাজার কাছে এই সংবাদ পৌঁছালে তিনিও সিংহাসন ছেড়ে উঠে এলেন। রাজবেশ ত্যাগ করে চটের পোষাক পরে ভস্মস্তূপে গিয়ে বসলেন। সারা নীনবী নগরে তিনি ঘোষণা করলেন, মহারাজ এবং তাঁর অমাত্যবৃন্দের নির্দেশ: মানুষ, পশু, গরু কিম্বা ভেড়ার পাল—কেউ-ই কিছু খাবে না, অন্ন-জল গ্রহণ করবে না। মানুষ, পশু নির্বিশেষে সকলকেই চটের পোষাক পরতে হবে এবং সকলকে একাগ্র হয়ে ঈশ্বরকে ডাকতে হবে। প্রত্যেকে কুপথ পরিহার করুক এবং দুষ্কর্ম থেকে নিবৃত্ত হোক। তাহলে হয়তো ঈশ্বর তাঁর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করবেন, প্রশমিত হবে তাঁর ভয়ঙ্কর ক্রোধ, আমাদের আর বিনাশ ঘটবে না। ঈশ্বর তাদের আচরণ দেখলেন। তিনি দেখলেন, তারা কুপথ পরিত্যাগ করেছে। তখন ঈশ্বর তাঁর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলেন, তাদের আর শাস্তি দিলেন না।
যোনা ৪ এই ঘটনায় যোনা খুবই অসন্তুষ্ট হলেন। তিনি প্রভুর কাছে অনুযোগ করে বললেন, হে প্রভু পরমেশ্বর, তুমি যে এমনটি করবে, দেশে থাকতেই কি আমি একথা বলিনি? তাই তো আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তার্শীশে পালাচ্ছিলাম। কারণ আমি জানতাম যে তুমি স্নেহময় ও ক্ষমাশীল ঈশ্বর। তুমি সহজে ক্রুদ্ধ হও না, অপার তোমার করুণা। শাস্তি দিতে উদ্যত হয়েও তুমি নিজেকে সংবরণ কর। কাজেই আমার আর বেঁচে থেকে লাভ নেই, আমায় বরং তুলে নাও। প্রভু তাঁকে বললেন, তোমার এত রাগ কি ঠিক হচ্ছে? যোনা তখন নগর থেকে বেরিয়ে নগরের পূর্ব দিকে একটা জায়গায় গিয়ে বসলেন। সেখানে তিনি একটা চালা তৈরী করলেন আর নগরের কি দশা হয় তা দেখার জন্য তার নীচে বসে রইলেন। প্রভু পরমেশ্বর তখন একটি লতাগাছকে কাজে লাগালেন। তার ছায়াতে যোনা যেন আরামে থাকেন সেইজন্য তিনি সেটির শাখা তাঁর চালার উপর ছড়িয়ে দিলেন। তাতে যোনা খুব খুশী হলেন। কিন্তু পরের দিন ভোরে ঈশ্বরের ইচ্ছায় লতাটিকে পোকায় কেটে দিল। সেটি শুকিয়ে গেল। সূর্য ওঠার পর ঈশ্বরের নির্দেশে পূর্ব দিক থেকে ‘লু’ বইতে লাগল। মাথার উপর সূর্যের প্রখর তাপ যেন আগুন ছড়াতে লাগল। যোনার চেতনা লোপ হবার উপক্রম হল। তিনি তখন মৃত্যুকামনা করে বললেন, বেঁচে থাকার চেয়ে আমার মরণই ভাল। ঈশ্বর তাঁকে বললেন, লতাটি শুকিয়ে যাওয়ায় তোমার এত রাগ করা কি ঠিক হচ্ছে? যোনা বললেন, হ্যাঁ, রাগ হবারই কথা! এরপর আমি আর কিসের জন্য বাঁচব? আমার মরণই ভাল! যিহোবা বললেন, তুমি এই লতাগাছটির জন্য কোন পরিশ্রম করনি, এর যত্নও করনি। রাতারাতি এটি বেড়ে উঠেছিল এবং পরের দিন শুকিয়ে গেছে। এর জন্য যদি তোমার এত দুঃখ হয় তাহলে ভেবে দেখ, এই মহানগরী নীনবী, যার মধ্যে রয়েছে এক লক্ষ কুড়ি হাজারেরও বেশী মানুষ—যারা ন্যায়-অন্যায় বোঝে না, আর আছে অসংখ্য পশু, তাদের জন্য কি আমার মমতা থাকবে না?
নীনবী নগরীর গল্পের সংক্ষিপ্তসার
যদিও “ঈশ্বর কর্তৃক নীনবী নগরীর পরিত্রাণ”-এর গল্পটি দৈর্ঘ্যে সংক্ষিপ্ত, তবু এটি একজন মানুষকে ঈশ্বরের ধার্মিক স্বভাবের আরেকটি দিক এক ঝলক দেখার সুযোগ করে দেয়। এই দিকটি ঠিক কী নিয়ে গঠিত তা উপলব্ধি করতে হলে আমাদের অবশ্যই ধর্মগ্রন্থ বাইবেলের কাছে ফিরে আসতে হবে এবং ঈশ্বরের ক্রিয়াকলাপের মধ্যে অন্যতম একটিকে পুনর্নিরীক্ষণ করতে হবে যা তিনি তাঁর কার্যপ্রক্রিয়া চলাকালীন সম্পন্ন করেছিলেন।
প্রথমে এই গল্পের শুরুটা লক্ষ্য করা যাক: “প্রভু পরমেশ্বর একদিন যোনাকে নির্দেশ দিলেন: মহানগরী নীনবীতে যাও। সেখানকার অধিবাসীদের কাছে ঘোষণা কর যে তাদের দুষ্কর্মগুলি আমার অজ্ঞাত নয়।” (যোনা ১:১-২)। ধর্মপুস্তক থেকে গৃহিত এই অনুচ্ছেদে আমরা জানতে পারি যে যিহোবা ঈশ্বর যোনাকে নীনবী নগরীতে যেতে আদেশ করেন। কেন তিনি যোনাকে এই নগরীতে যেতে আদেশ করেন? এই বিষয়ে বাইবেলে খুব পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে: এই নগরীর মানুষদের দুষ্টতার কথা যিহোবা ঈশ্বরের কানে এসেছে, আর সেই কারণেই তিনি কী করতে চান তা তাদের কাছে ঘোষণা করার জন্য তিনি যোনাকে প্রেরণ করেন। যদিও যোনা মানুষটি কে ছিল সে বিষয়ে কিছুই লিপিবদ্ধ নেই, কিন্তু তা নিশ্চয়ই ঈশ্বরকে জানার সঙ্গে অসম্পর্কিত, আর তাই তোমাদের যোনা নামক মানুষটিকে বোঝার দরকার নেই। তোমাদের শুধু জানতে হবে ঈশ্বর যোনাকে কী করতে আদেশ করেছিলেন এবং এরকম করার পিছনে ঈশ্বরের হেতু কী ছিল।
যিহোবা ঈশ্বরের সতর্কবার্তা নীনবী নগরীতে পৌঁছায়
এবার দ্বিতীয় অনুচ্ছেদের দিকে যাওয়া যাক, যোনা পুস্তিকার তৃতীয় অধ্যায়: “যোনা নগরের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলতে লাগলেন। একদিনের পথ গিয়ে ঘোষণা করলেন: চল্লিশ দিনের মধ্যে নীনবী ধ্বংস হবে।” নীনবীবাসীদের জানানোর জন্য ঈশ্বর এই কথাগুলি সরাসরি যোনাকে বলেছিলেন, সুতরাং এগুলিই নিশ্চয় সেই বাক্য যা যিহোবা নীনবীবাসীদের উদ্দেশ্যে বলতে চেয়েছিলেন। এই বাক্যগুলি মানুষকে জানায় যে, ঈশ্বর এই নগরীর লোকজনকে ঘৃণা ও অপছন্দ করতে শুরু করেছিলেন কারণ তাদের অসদাচার তাঁর নজরে পড়েছিল, আর তাই তিনি এই নগরীকে ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নগরী ধ্বংসের আগে ঈশ্বর নীনবীবাসীদের কাছে একটা ঘোষণা করবেন, এবং একই সঙ্গে তাদের দুষ্টতার জন্য অনুশোচনা করার ও নতুন করে শুরু করার একটা সুযোগ দেবেন। এই সুযোগ কেবল চল্লিশ দিন স্থায়ী হবে, তার পরে আর নয়। বাক্যান্তরে, নগরীর অভ্যন্তরস্থ মানুষরা যদি চল্লিশ দিনের মধ্যে অনুতাপ না করতো, তাদের পাপ স্বীকার না করতো এবং যিহোবা ঈশ্বরের সামনে নিজেদের প্রণত না করতো, তাহলে যেভাবে সদোমকে ধ্বংস করেছিলেন সেভাবেই ঈশ্বর এই নগরীকেও ধ্বংস করতেন। এই কথাই যিহোবা ঈশ্বর নীনিবীর মানুষদের বলতে চেয়েছিলেন। স্পষ্টতই, এটা কোনো সহজসরল ঘোষণা ছিল না। এটি শুধু যিহোবা ঈশ্বরের রাগকেই জ্ঞাপন করেনি, নীনবীবাসীদের প্রতি তাঁর মনোভাবকেও জ্ঞাপন করেছিল, এবং একই সঙ্গে এটি এই নগরীর অন্দরে বসবাসকারী মানুষদের প্রতি একটা গুরুতর সতর্কবার্তা হিসাবেও কাজ করেছিল। এই সতর্কবার্তা তাদের জানিয়েছিল যে, তাদের মন্দ আচরণের কারণে তারা যিহোবা ঈশ্বরের ঘৃণার পাত্র হয়ে পড়েছে এবং এই আচরণ অচিরেই তাদের বিলুপ্তির কিনারায় দাঁড় করাবে। নীনবীর প্রতিটি বাসিন্দার জীবন তাই আসন্ন বিপদের সম্মুখীন ছিল।
যিহোবা ঈশ্বরের সাবধানবাণীর প্রতি নীনবী ও সদোম নগরীর প্রতিক্রিয়ার মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য
উৎখাত করা বলতে কী বোঝায়? কথ্য ভাষায়, এর অর্থ আর অস্তিত্ব না থাকা। কিন্তু কীভাবে? একটা গোটা নগরীকে কে উৎখাত করতে পারে? মানুষের পক্ষে নিশ্চয় এরকম একটা কাজ করে ওঠা অসম্ভব। নীনবীর মানুষরা নির্বোধ ছিল না; যেইমাত্র তারা এই ঘোষণা শুনলো, এর গুরুত্ব তারা অনুধাবন করলো। তারা বুঝেছিল যে এই ঘোষণা ঈশ্বরের কাছ থেকে এসেছে, তারা বুঝেছিল যে ঈশ্বর তাঁর কার্য সম্পন্ন করতে যাচ্ছেন, এবং তারা বুঝেছিল যে তাদের দুষ্টতা যিহোবা ঈশ্বরকে রাগান্বিত করেছে এবং তাঁর রোষকে নিজেদের উপর ডেকে এনেছে, যার ফলে তারা তাদের নগরীর সাথে শীঘ্রই বিনষ্ট হবে। যিহোবা ঈশ্বরের এই সাবধানবাণী শোনার পর নগরীর মানুষরা কেমন আচরণ করলো? নৃপতি থেকে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত নগরবাসীরা কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল বাইবেলে তার সুনির্দিষ্ট বিশদ বর্ণনা আছে। ধর্মগ্রন্থে নিম্নলিখিত বাক্যগুলি লিপিবদ্ধ আছে: “নীনবীর অধিবাসীরা ঈশ্বরের কথায় বিশ্বাস করল। অনুতাপে দগ্ধ হয়ে তারা ঠিক করল, ছোট-বড় সকলে চট পরে উপবাস করবে। নীনবীর রাজার কাছে এই সংবাদ পৌঁছালে তিনিও সিংহাসন ছেড়ে উঠে এলেন। রাজবেশ ত্যাগ করে চটের পোষাক পরে ভস্মস্তূপে গিয়ে বসলেন। সারা নীনবী নগরে তিনি ঘোষণা করলেন, মহারাজ এবং তাঁর অমাত্যবৃন্দের নির্দেশ: মানুষ, পশু, গরু কিম্বা ভেড়ার পাল—কেউ-ই কিছু খাবে না, অন্ন-জল গ্রহণ করবে না। মানুষ, পশু নির্বিশেষে সকলকেই চটের পোষাক পরতে হবে এবং সকলকে একাগ্র হয়ে ঈশ্বরকে ডাকতে হবে। প্রত্যেকে কুপথ পরিহার করুক এবং দুষ্কর্ম থেকে নিবৃত্ত হোক।”
যিহোবা ঈশ্বরের ঘোষণা শোনার পর, নীনবীর লোকেরা সদোমের মানুষদের সম্পূর্ণ বিপরীত মনোভাব প্রদর্শন করেছিল–যেখানে সদোমের লোকেরা প্রকাশ্যে ঈশ্বরের বিরোধিতা করেছিল, পাপাচার থেকে আরো পাপাচারের দিকে অগ্রসর হয়েছিল, সেখানে এই বাক্যগুলি শোনার পর নীনবীবাসীরা বিষয়টিকে অবহেলা করেনি, এবং তারা প্রতিরোধও করেনি। পরিবর্তে তারা ঈশ্বরকে বিশ্বাস করেছিল এবং উপবাস ঘোষণা করেছিল। এখানে “বিশ্বাস করেছিল” শব্দবন্ধটির অর্থ কী? শব্দবন্ধটি নিজে আস্থা ও সমর্পণকে ইঙ্গিত করে। এই শব্দবন্ধটি ব্যাখ্যা করতে আমরা যদি নীনবীবাসীদের প্রকৃত আচরণকে ব্যবহার করি, তাহলে এর অর্থ দাঁড়ায় এই যে, তারা বিশ্বাস করেছিল ঈশ্বর যেমন বলেছেন তেমন তিনি করতে পারেন ও করবেন, এবং তারা অনুতাপ করতে ইচ্ছুক ছিল। আসন্ন বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়ে নীনবীর মানুষরা কী ভীতি অনুভব করেছিল? তাদের বিশ্বাসই তাদের হৃদয়ে ভীতি বপন করেছিল। তাহলে নীনবীবাসীদের বিশ্বাস ও ভীতিকে প্রতিপন্ন করতে আমরা কী ব্যবহার করতে পারি? বাইবেলে যা বলেছে তা হল: “…অনুতাপে দগ্ধ হয়ে তারা ঠিক করল, ছোট-বড় সকলে চট পরে উপবাস করবে।” অর্থাৎ, নীনবীবাসীরা সত্যিই বিশ্বাস করেছিল, আর এই বিশ্বাস থেকে এসেছিল ভীতি, যেটা তখন তাদের উপবাস করা ও চটের পোশাক পরার দিকে চালিত করেছিল। এইভাবেই তারা প্রদর্শন করেছিল যে তারা অনুতাপ করতে শুরু করছে। সদোমের মানুষদের সঙ্গে প্রতিতুলনায় সম্পূর্ণ বিপরীতে গিয়ে, নীনবীবাসীরা শুধু যে ঈশ্বরের বিরোধিতা করেনি তা-ই নয়, তারা তাদের আচরণ ও কাজকর্মের মাধ্যমে তাদের অনুতাপ পরিষ্কারভাবে প্রদর্শনও করেছিল। নিঃসন্দেহে, কেবল সাধারণ মানুষ নয়, নীনবীর সকল মানুষই এরকম করেছিল–রাজাও কোনো ব্যতিক্রম ছিল না।
নীনবীর রাজার অনুতাপ যিহোবা ঈশ্বরের প্রশংসা অর্জন করে
নীনবীর নৃপতি যখন এই সংবাদ শোনে, সে তার সিংহাসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়, তার আঙরাখা খুলে ফেলে, নিজেকে চটের পোশাকে সজ্জিত করে এবং ভস্মের উপর উপবেশন করে। তারপর সে ঘোষণা করেছিল যে, নগরীর কেউ কোনোকিছু আস্বাদন করতে পারবে না, এবং কোনো মেষ, বলীবর্দ বা অন্য কোনো পালিত পশু চারণ করতে বা জলপান করতে পারবে না। মানুষ ও পালিত পশু উভয়কেই চটবস্ত্র পরিধান করতে হবে, এবং মানুষদের ঈশ্বরের কাছে ঐকান্তিক প্রার্থনা করতে হবে। রাজা এ-ও ঘোষণা করে যে প্রত্যেককে তাদের অনাচারী পন্থা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে এবং তাদের হাতের দ্বারা সম্পাদিত সকল হিংস্রতা পরিত্যাগ করতে হবে। এই কার্যধারা বিচার করলে বোঝা যায়, নীনবীর রাজার হৃদয়ে প্রকৃত অনুতাপ এসেছিল। যে কার্যক্রম সে গ্রহণ করে–সিংহাসন থেকে উঠে দাঁড়ানো, রাজবস্ত্র ত্যাগ করা, চটের পোশাক পরিধান করা এবং ছাইয়ের উপর গিয়ে বসা–তা মানুষকে জানায় যে নীনবীর রাজা তার রাজকীয় পদমর্যাদা সরিয়ে রেখে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি চটবস্ত্র পরিধান করছিল। অর্থাৎ, যিহোবা ঈশ্বরের ঘোষণা শোনার পর নীনবীর রাজা তার দুষ্ট কর্মপন্থা বা তার হস্তে সম্পাদিত হিংস্রতা অব্যাহত রাখার জন্য তার রাজপদে কায়েম থাকেনি; বরং, যে কর্তৃত্ব তার অধিকারে ছিল তা সে সরিয়ে রেখেছিল এবং যিহোবা ঈশ্বরের কাছে অনুতাপ প্রকাশ করেছিল। নীনবীর রাজা সেই মুহূর্তে রাজা হিসাবে অনুতাপ প্রকাশ করছিল না, ঈশ্বরের একজন সাধারণ প্রজা হিসাবে অনুশোচনা করতে ও তার পাপ স্বীকার করতে সে ঈশ্বরের সম্মুখে এসেছিল। উপরন্তু, সমগ্র নগরবাসীকেও সে তার মতন করেই যিহোবা ঈশ্বরের সামনে অনুতাপ সহকারে তাদের পাপ স্বীকার করতে নির্দেশ দিয়েছিল; তদতিরিক্ত, কীভাবে তা করতে হবে সে বিষয়ে তার একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনাও ছিল, ধর্মগ্রন্থে যেমন দেখা যাচ্ছে: “মানুষ, পশু, গরু কিম্বা ভেড়ার পাল—কেউ-ই কিছু খাবে না, অন্ন-জল গ্রহণ করবে না। মানুষ, পশু নির্বিশেষে সকলকেই চটের পোষাক পরতে হবে এবং সকলকে একাগ্র হয়ে ঈশ্বরকে ডাকতে হবে। প্রত্যেকে কুপথ পরিহার করুক এবং দুষ্কর্ম থেকে নিবৃত্ত হোক।” নগরীটির শাসক হিসাবে নীনবীর রাজা সর্বোচ্চ পদমর্যাদা ও ক্ষমতার অধিকারী ছিল, এবং তার ইচ্ছা মতো সবকিছুই করতে পারতো। যিহোবা ঈশ্বরের ঘোষণার সম্মুখীন হয়ে, সে বিষয়টিকে উপেক্ষা করতে পারতো বা কেবল নিজে একাই অনুতাপ প্রকাশ ও তার পাপ স্বীকার করতে পারতো; নগরীর লোকজন অনুতাপ প্রকাশ করতে মনঃস্থির করলো কি না করলো, এই বিষয়টিকে সে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করতে পারতো। কিন্তু নীনবীর রাজা তা আদৌ করেনি। শুধু যে সে সিংহাসন থেকে উঠে দাঁড়িয়ে চটবস্ত্র পরিধান করে ছাইয়ের উপর উপবেশন করেছিল, অনুতাপ প্রকাশ করেছিল ও যিহোবা ঈশ্বরের সামনে নিজের পাপ স্বীকার করেছিল তা নয়, একই সাথে সে নগরীর মধ্যস্থ সকল মানুষ ও পালিত পশুকে একই কাজ করতে নির্দেশ দিয়েছিল। এমনকি সে মানুষকে “একাগ্র হয়ে ঈশ্বরকে ডাকতে”-ও আদেশ করেছিল। এই কার্যক্রমের মাধ্যমে নীনবীর রাজা একজন শাসকের যা করা উচিৎ সেই কাজ যথার্থই সম্পন্ন করেছিল। তার এই ধারাবাহিক ব্যবস্থাপনা এমন একটা কৃতিত্ব যা মানুষের ইতিহাসে যে-কোনো রাজার পক্ষে অর্জন করা দুষ্কর ছিল, এবং বস্তুতই অন্য কোনো রাজা এই বিষয়গুলি অর্জন করতে পারেনি। এই কাজগুলিকে মানবজাতির ইতিহাসে অভূতপূর্ব বলা যায়, এবং এগুলি মানবজাতির কাছে উভয়ত স্মরণীয় ও অনুকরণীয় হওয়ার যোগ্য। মানবসভ্যতার প্রত্যুষকাল থেকে প্রত্যেক রাজা তার প্রজাদের ঈশ্বরকে প্রতিরোধ ও বিরোধিতা করার দিকে চালিত করেছে। কেউ কখনো তার প্রজাদের তাদের দুষ্টতা-জনিত পাপ থেকে পরিত্রাণ খোঁজার জন্য, যিহোবা ঈশ্বরের ক্ষমা প্রাপ্তির জন্য এবং আসন্ন শাস্তিভোগ এড়ানোর জন্য ঈশ্বরকে অনুনয় করার দিকে পরিচালিত করেনি। নীনবীর রাজা অবশ্য তার প্রজাদের ঈশ্বরের দ্বারস্থ করার, তাদের নিজ নিজ পাপাসক্ত পন্থাকে পরিহার করার এবং তাদের হস্ত-সম্পাদিত হিংসা পরিত্যাগ করার দিকে চালিত করতে সমর্থ হয়েছিল। অধিকন্তু, সে তার সিংহাসনকে সরিয়ে রাখতেও সক্ষম হয়েছিল, এবং প্রতিদানে, যিহোবা ঈশ্বরের হৃদয় পরিবর্তন ঘটে ও তিনি অনুতাপ বোধ করেন, তাঁর ক্রোধকে সংবরণ করে নগরীর মানুষদের তিনি জীবনধারণের অনুমোদন দেন, বিনাশের হাত থেকে তাদের রক্ষা করেন। রাজার কার্যাবলীকে শুধুমাত্র মানব সভ্যতার ইতিহাসে একটা বিরল অত্যাশ্চর্য ঘটনা বলেই অভিহিত করা যেতে পারে, এবং ভ্রষ্ট মানুষের অনুতাপ ও ঈশ্বরের সম্মুখে তাদের পাপ স্বীকারের এমনকি একটা আদর্শ দৃষ্টান্তও বলা যেতে পারে।
ঈশ্বর নীনবীবাসীদের হৃদয়ের গভীরে আন্তরিক অনুতাপ লক্ষ্য করেন
ঈশ্বরের ঘোষণা শোনার পর নীনবীর নৃপতি ও তার প্রজারা ধারাবাহিক কিছু কর্ম সম্পাদন করে। এই কর্মগুলির ও তাদের আচরণের প্রকৃতি কেমন ছিল? অন্যভাবে বললে, তাদের আচরণের সামগ্রিকতার সারসত্য কী ছিল? তারা যা করেছিল কেন তা করলো? ঈশ্বরের চোখে তারা আন্তরিকভাবে অনুতপ্ত হয়েছিল, এর কারণ শুধু এই নয় যে তারা ঈশ্বরের কাছে ঐকান্তিক অনুনয় করেছিল এবং তাঁর সম্মুখে তাদের পাপ কবুল করেছিল, তারা তাদের দুষ্ট আচরণ পরিত্যাগ করেছিল বলেও বটে। তারা এরকম আচরণ করেছিল কারণ ঈশ্বরের বাক্য শ্রবণের পর তারা অবিশ্বাস্য রকমের ভয় পেয়েছিল এবং বিশ্বাস করেছিল যে তিনি যেমন বলেছেন তেমনই করবেন। উপবাস করার মাধ্যমে, চটের পোশাক পরিধান করার মাধ্যমে এবং ছাইয়ের উপর উপবেশন করার মাধ্যমে তারা তাদের পন্থা সংশোধন করার ও দুষ্টতা থেকে বিরত থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করতে চেয়েছিল, এবং তারা যিহোবা ঈশ্বরের কাছে তাঁর রোষ সংবরণ করার প্রার্থনা করেছিল, তাঁকে অনুনয় করেছিল যাতে তিনি তাঁর সিদ্ধান্ত ও তাদের উপর সমাসন্ন বিপর্যয়কে প্রত্যাহার করেন। আমরা যদি তাদের সকল আচরণকে পর্যালোচনা করি তাহলে আমরা দেখতে পাই, তারা ইতিমধ্যেই উপলব্ধি করেছিল যে তাদের আগেকার দুষ্ট কাজকর্ম যিহোবা ঈশ্বরের কাছে ঘৃণার্হ ছিল, এবং আমরা এও দেখতে পাই যে কী কারণে শীঘ্রই তিনি তাদের ধ্বংস করবেন সেটাও তারা উপলব্ধি করেছিল। এই কারণেই তারা সকলে একটা পরিপূর্ণ অনুতাপ প্রকাশ করতে, তাদের পাপাচারী পন্থা থেকে সরে দাঁড়াতে এবং তাদের হস্ত-কৃত হিংসা পরিত্যাগ করতে চেয়েছিল। অন্য কথায়, একবার যখন তারা যিহোবা ঈশ্বরের ঘোষণার বিষয়ে অবগত হয়, তাদের প্রত্যেকে অন্তরে ভীতি অনুভব করেছিল; তারা তাদের দুষ্ট আচরণ অব্যাহত রাখা থেকে বিরত হয়েছিল এবং আর কখনো সেইসব কাজ করেনি যা যিহোবা ঈশ্বরের কাছে অত্যন্ত ঘৃণার্হ ছিল। তদতিরিক্ত, যিহোবা ঈশ্বরকে তারা অনুনয় করেছিল যাতে তিনি তাদের অতীতের পাপ ক্ষমা করেন এবং তাদের অতীত কর্ম অনুসারে তাদের প্রতি ব্যবস্থা না নেন। আর কখনো দুষ্ট কাজে রত না হতে এবং যিহোবা ঈশ্বরের নির্দেশ অনুযায়ী আচরণ না করতে, এবং সম্ভব হলে আর কখনো যিহোবা ঈশ্বরের রোষের উদ্রেগ না করতে তারা ইচ্ছুক ছিল। তাদের অনুতাপ ছিল আন্তরিক ও পূর্ণাঙ্গ। তা তাদের হৃদয়ের গভীর থেকে নির্গত হয়েছিল এবং কপট ও ক্ষণস্থায়ী ছিল না।
রাজা থেকে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত নীনবীর সকল লোক একবার যখন জানতে পারলো যে যিহোবা ঈশ্বর তাদের প্রতি রাগান্বিত, ঈশ্বর স্পষ্ট ও পরিষ্কারভাবে তাদের পরবর্তী প্রত্যেকটি কাজকর্ম ও আচরণ সামগ্রিকভাবে দেখতে পেলেন, তাদের প্রত্যেকটি সিদ্ধান্ত ও বিকল্পচয়নও তিনি প্রত্যক্ষ করলেন। তাদের আচরণ অনুযায়ী ঈশ্বরের হৃদয় পরিবর্তিত হল। ঠিক সেই মুহূর্তে ঈশ্বরের মানসিক অবস্থা কেমন ছিল? বাইবেল তোমাকে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে। ধর্মগ্রন্থে নিম্নলিখিত বাক্যগুলি লিপিবদ্ধ আছে: “ঈশ্বর তাদের আচরণ দেখলেন। তিনি দেখলেন, তারা কুপথ পরিত্যাগ করেছে। তখন ঈশ্বর তাঁর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলেন, তাদের আর শাস্তি দিলেন না।” যদিও ঈশ্বর তাঁর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন, কিন্তু তাঁর মানসিক অবস্থার ক্ষেত্রে কোনো জটিলতা ছিল না। শুধুমাত্র তিনি রাগের বহিঃপ্রকাশ থেকে রাগের প্রশমনে অবস্থান্তরিত হন, এবং তারপর নীনবী নগরীর উপর বিপর্যয় ডেকে না আনার সিদ্ধান্ত নেন। নীনবীবাসীকে বিপর্যয়ের হাত থেকে নিষ্কৃতি দেওয়ার ঈশ্বরের এই সিদ্ধান্ত যে কারণে এত ত্বরিত ছিল তা হল ঈশ্বর নীনবীর প্রতিটি মানুষের হৃদয় পর্যবেক্ষণ করেন। তাদের হৃদয়ের গভীরে তারা কী ধারণ করে রেখেছিল তিনি তা দেখেছিলেন: তাদের আন্তরিক অনুতাপ ও তাদের পাপের স্বীকারোক্তি, তাঁর প্রতি তাদের ঐকান্তিক বিশ্বাস, তাদের দুষ্ট কাজ কীভাবে তাঁর প্রকৃতিকে রাগান্বিত করেছে সে বিষয়ে তাদের গভীর সংবেদন, এবং যিহোবা ঈশ্বরের আসন্ন শাস্তিদানজনিত পরিণামস্বরূপ ভীতি। একই সঙ্গে যিহোবা ঈশ্বর তাদের প্রার্থনাও শুনেছিলেন, যা তাদের অন্তরের গভীর থেকে ক্ষরিত হয়েছিল, তাঁকে অনুনয় করে বলেছিল তিনি যেন আর তাদের প্রতি রাগান্বিত না থাকেন, যাতে তারা এই বিপর্যয় এড়াতে পারে। ঈশ্বর যখন এইসব বাস্তব সত্যকে লক্ষ্য করেন, তখন তাঁর রোষ একটু-একটু করে বিলীন হয়ে যায়। তাঁর রোষ পূর্বে যত ভয়ানকই থাকুক না কেন, তিনি যখন এই মানুষগুলির হৃদয়ের গভীরে আন্তরিক অনুতাপ লক্ষ্য করেন, তাঁর হৃদয় বিগলিত হয়, আর তাই তিনি তাদের উপর বিপর্যয় বয়ে আনতে পারেন না, এবং তাদের প্রতি তিনি আর রুষ্ট রইলেন না। পরিবর্তে, তাদের প্রতি তিনি তাঁর করুণা ও সহিষ্ণুতার প্রসার অব্যাহত রাখলেন এবং তাদের পথনির্দেশ দান ও রসদ সরবরাহ চালিয়ে গেলেন।
তুমি যদি বিশ্বাস করো যে ঈশ্বর সত্য, তাহলে তুমি প্রায়শই তাঁর তত্ত্বাবধান লাভ করবে
নীনবীর মানুষদের প্রতি ঈশ্বরের অভিপ্রায়ের পরিবর্তনের সঙ্গে কোনো দ্বিধা অথবা দ্ব্যর্থবোধক বা অস্পষ্ট কিছু সম্পৃক্ত ছিল না। বরং, এটা ছিল বিশুদ্ধ রাগ থেকে বিশুদ্ধ সহিষ্ণুতায় রূপান্তর। ঈশ্বরের সারসত্যের এটি হল একটি প্রকৃত উদ্ঘাটন। ইশ্বর তাঁর কাজকর্মে কখনো অস্থিরমতি বা দ্বিধাগ্রস্ত নন; তাঁর কর্মের পিছনের নীতি ও উদ্দেশ্য সমস্তই পরিষ্কার ও স্বচ্ছ, বিশুদ্ধ ও ত্রুটিহীন, এদের মধ্যে নিশ্চিতভাবে কোনো কৌশল বা অভিসন্ধি মিশে নেই। বাক্যান্তরে, ঈশ্বরের সারসত্যে কোনো অন্ধকার বা অসাধুতা নেই। নীনবীবাসীদের প্রতি ঈশ্বর রাগান্বিত হয়েছিলেন কারণ তাদের দুষ্ট কর্ম তাঁর নজরে পড়েছিল; সেই সময় তাঁর রোষ উদ্ভূত হয়েছিল তাঁর সারসত্য থেকে। কিন্তু, তাঁর রোষ যখন প্রশমিত হয় এবং নীনবীর মানুষদের উপর আরেকবার যখন তিনি তাঁর সহিষ্ণুতা অর্পণ করেন, তখন যা কিছু তিনি উদ্ঘাটিত করেন তা-ও তাঁর আপন সারসত্যই ছিল। এই সমুদয় পরিবর্তনের কারণ ঈশ্বরের প্রতি মানুষের মনোভাবের পরিবর্তন। এই সমগ্র সময়কাল জুড়ে, ঈশ্বরের অলঙ্ঘণীয় প্রকৃতির কোনো পরিবর্তন হয়নি, ঈশ্বরের সহিষ্ণু সারসত্য অপরিবর্তিত রয়ে গেছে, এবং ঈশ্বরের প্রেমময় ও করুণাঘন সারসত্যের কোনো রূপান্তর ঘটেনি। মানুষ যখন দুষ্ট কাজ করবে এবং ঈশ্বরকে কুপিত করবে, তাঁর ক্রোধ গিয়ে তাদের আঘাত করবে। যখন মানুষ প্রকৃতই অনুতাপ করবে, ঈশ্ব্বরের হৃদয় পরিবর্তিত হবে, এবং তাঁর কোপ প্রশমিত হবে। যখন মানুষ অনমনীয় ঈশ্বর-বিরোধিতা অব্যাহত রাখবে, তাঁর রোষ অপ্রতিহত রয়ে যাবে, এবং তাঁর ক্রোধ একটু-একটু করে তাদেরকে চেপে ধরতে থাকবে যতক্ষণ না তারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এটাই ঈশ্বরের প্রকৃতির সারসত্য। ঈশ্বর তাঁর ক্রোধই প্রকাশ করুন কি তাঁর করুণা ও মমতারই প্রকাশ ঘটান, মানুষের আচরণ, ব্যবহার এবং তাদের অন্তরের গভীরে ঈশ্বরের প্রতি তারা যে মনোভাব পোষণ করে – এগুলোই নির্ধারণ করে ঈশ্বরের প্রকৃতির উদ্ঘাটনের মাধ্যমে কীসের প্রকাশ ঘটবে। ঈশ্বর যদি কোনো মানুষের উপর ক্রমাগত তাঁর কোপ বর্ষণ করেন, এই মানুষটির হৃদয় নিঃসন্দেহে ঈশ্বরের বিরোধিতা করে। যেহেতু এই মানুষটি কখনো সত্যিকারের অনুতপ্ত হয়নি, ঈশ্বরের সামনে কখনো তার মাথা অবনত করেনি, বা ঈশ্বরের প্রতি কখনো প্রকৃত বিশ্বাস পোষণ করেনি, তাই কখনোই সে ঈশ্বরের করুণা ও সহিষ্ণুতা লাভ করেনি। কেউ যদি প্রায়শই ঈশ্বরের তত্ত্বাবধান, তাঁর করুণা ও তাঁর সহনশীলতা লাভ করে, তাহলে ব্যক্তিটির অন্তরে নিঃসন্দেহে ঈশ্বরের প্রতি প্রকৃত বিশ্বাস আছে, এবং তার হৃদয় ঈশ্বর-বিরোধী নয়। এই মানুষটি প্রায়শই ঈশ্বরের সামনে আন্তরিকভাবে অনুতাপ প্রকাশ করে; সে কারণেই, এই মানুষটির উপর এমনকি যদি ঈশ্বরের অনুশাসন বার-বার নেমেও আসে, তাঁর ক্রোধ নেমে আসবে না।
এই সংক্ষিপ্ত বিবরণটি মানুষকে ঈশ্বরের হৃদয় দর্শন করার, তাঁর সারসত্যের বাস্তবতা দর্শন করার, ঈশ্বরের রোষ ও তাঁর হৃদয় পরিবর্তন যে অকারণ নয় তা দেখার সুযোগ দেয়। যখন তিনি ক্রোধান্বিত ও যখন তাঁর মনোভাবের পরিবর্তন হয়েছে, এই দুই পরিস্থিতির মধ্যে ঈশ্বর সম্পূর্ণ বৈপরীত্য প্রদর্শন করা সত্ত্বেও, যে বৈপরীত্য মানুষকে বিশ্বাস করতে বাধ্য করায় যে ঈশ্বরের সারসত্যের এই দুটি দিক–তাঁর ক্রোধ ও তাঁর সহিষ্ণুতা–এই দুইয়ের মধ্যে একটা বিশাল বিচ্ছিন্নতা বা বৈপরীত্য রয়েছে–কিন্তু নীনবীবাসীদের অনুতাপের প্রতি ঈশ্বরের মনোভাব মানুষকে আরেকবার ঈশ্বরের প্রকৃত স্বভাবের আরেকটি দিক দর্শন করার সুযোগ দেয়। ঈশ্বরের হৃদয় পরিবর্তন প্রকৃতই মানুষকে আরেকবার ঈশ্বরের করুণা ও মমতার সত্যতাকে এবং ঈশ্বরের সারসত্যের প্রকৃত উদ্ঘাটনকে দেখতে দেয়। মানুষকে শুধু এই সারবত্তা স্বীকার করতে হবে যে ঈশ্বরের করুণা ও মমতা কোনো জনশ্রুতি নয়, তা কোনো বানানো গল্পগাথাও নয়। কারণ সেই মুহূর্তে ঈশ্বরের অনুভূতি ছিল সত্য, এবং ঈশ্বরের হৃদয় পরিবর্তনও ছিল সত্য–ঈশ্বর প্রকৃতই মানুষের উপর আরেকবার তাঁর করুণা ও সহিষ্ণুতা অর্পণ করেছিলেন।
নীনবীবাসীদের অন্তরের প্রকৃত অনুতাপ তাদেরকে ঈশ্বরের করুণাধন্য করে তোলে এবং তাদের নিজেদের পরিণতির পরিবর্তন ঘটায়
ঈশ্বরের হৃদয় পরিবর্তন ও তাঁর ক্রোধের মধ্যে কি কোনো পরস্পরবিরোধিতা ছিল? নিঃসন্দেহে ছিল না! তার কারণ হল, সেই নির্দিষ্ট সময়ে ঈশ্বরের সহিষ্ণুতার নিজস্ব হেতু ছিল। হেতুটা কী হতে পারে? তা বাইবেলে উল্লেখ করা হয়েছে: “সকল মানুষ তাদের পাপাচারী পন্থা থেকে মুখ ফেরালো” এবং “দুষ্কর্ম থেকে নিবৃত্ত হয়েছে।”
এই “কুপথ” বলতে কতিপয় মন্দ কর্মের প্রতি নির্দেশ করা হচ্ছে না, বরং পাপের সেই উৎসের প্রতি নির্দেশ করা হচ্ছে যেখান থেকে মানুষের আচরণ উদ্ভূত হয়। “কুপথ পরিত্যাগ করা”-র অর্থ হল সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আর কখনো এই কাজগুলি করবে না। অর্থাৎ, তারা আর কখনো এমন মন্দ আচরণ করবে না; তাদের কাজগুলির পদ্ধতি, উৎস, উদ্দেশ্য, অভিপ্রায় ও নীতি, সবই পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে; তাদের হৃদয়ে উপভোগ ও আনন্দের সঞ্চার করতে তারা ওই পদ্ধতি ও নীতিগুলি আর কখনো ব্যবহার করবে না। “দুষ্কর্ম থেকে নিবৃত্ত হয়েছে” বাক্যে “নিবৃত্ত হওয়া” বলতে বোঝায় পরিত্যাগ করা বা বাতিল করে দেওয়া, অতীতের সঙ্গে সকল সম্পর্ক ছেদ করা এবং আর কখনো ফিরে না তাকানো। নীনবীর মানুষরা যখন তাদের হস্ত-সম্পাদিত হিংসা পরিহার করলো, তা তাদের প্রকৃত অনুতাপের প্রমাণ দিলো ও প্রতিনিধিত্ব করলো। ঈশ্বর মানুষের বাহ্যিক অবয়ব ও তাদের হৃদয়, উভয়ই পর্যবেক্ষণ করেন। নীনবীবাসীদের হৃদয়ে ঈশ্বর যখন সন্দেহাতীত ভাবে অকৃত্রিম অনুতাপ লক্ষ্য করলেন এবং এটাও লক্ষ্য করলেন যে তারা তাদের কুপথ ত্যাগ করেছে এবং তাদের হস্ত-সম্পাদিত হিংসা পরিহার করেছে, তখন তিনি তাঁর মনোভাব পরিবর্তন করলেন। অর্থাৎ, এই লোকগুলির আচরণ ও ব্যবহার এবং কাজ করার বিভিন্ন পদ্ধতি, সেই সাথে তাদের অকৃত্রিম স্বীকারোক্তি ও তাদের অন্তরের পাপ-জনিত অনুতাপের কারণে ঈশ্বরের মনোভাবের পরিবর্তন ঘটে, তাঁর অভিপ্রায়ের পরিবর্তন ঘটে, তিনি তাঁর সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করেন এবং তাদের শাস্তি না দেওয়ার বা ধ্বংস না করার সিদ্ধান্ত নেন। এইভাবে, নীনবীর লোকজন নিজেদের জন্য এক পৃথক ফলাফল অর্জন করে। তারা তাদের নিজেদের জীবন পুনরুদ্ধার করে এবং একই সঙ্গে ঈশ্বরের করুণা ও সহিষ্ণুতা অর্জন করে, এবং সেই মুহুর্তে ঈশ্বরও তাঁর ক্রোধ প্রত্যাহার করে নেন।
ঈশ্বরের করুণা ও সহিষ্ণুতা বিরল নয়–মানুষের প্রকৃত অনুতাপই বিরল
নীনবীবাসীদের প্রতি ঈশ্বর যতই কুপিত হয়ে থাকুন না কেন, যেই মুহূর্তে তারা অনশনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলো এবং চটবস্ত্র ও ভস্ম পরিধান করলো, তাঁর হৃদয় নরম হতে শুরু করলো এবং তিনি তাঁর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে শুরু করলেন। যখন তিনি তাদের নিকট প্রচার করেন যে তিনি তাদের নগরী ধ্বংস করবেন–তাদের স্বীকারোক্তি ও তাদের পাপের জন্য অনুতাপের প্রাকমুহূর্তে–ঈশ্বর তখনও তাদের উপর রাগান্বিত ছিলেন। একবার তারা যখন অনুতাপসিক্ত ধারাবাহিক কার্যক্রম সম্পন্ন করলো, নীনবীর মানুষদের প্রতি ঈশ্বরের কোপ ক্রমশ তাদের প্রতি করুণা ও সহিষ্ণুতায় রূপান্তরিত হল। একই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ঈশ্বরের প্রকৃতির এই দুটি অভিমুখের সমাপতিত উদ্ঘাটনের মধ্যে পরস্পরবিরোধী কিছু নেই। তাহলে কোনো ব্যক্তি কীভাবে এই পরস্পরবিরোধিতার অভাবকে উপলব্ধি করবে ও জানবে? নীনবীর লোকেরা যখন অনুতাপ প্রকাশ করে, ঈশ্বর পালা-ক্রমে তাঁর এই দুই বিপরীত-মেরুর সারসত্যের প্রত্যেকটিকে অভিব্যক্ত ও প্রকাশিত করেন, এবং এইভাবে মানুষকে ঈশ্বরের সারসত্যের বাস্তবতা ও অলঙ্ঘনীয়তা দেখার সুযোগ করে দেন। ঈশ্বর তাঁর আচরণের মাধ্যমে মানুষকে বলতে চান: বিষয়টা এমন নয় যে ঈশ্বর মানুষকে সহ্য করেন না, বা এমন নয় যে তিনি তাদের ক্ষমা করতে চান না; বরং আসল কথা, তারা ঈশ্বরের কাছে খুব কম সময়েই প্রকৃত অনুতাপ করে এবং খুব কম ক্ষেত্রেই তারা নিজেদের অশুভ পথ থেকে প্রকৃত অর্থে সরে দাঁড়ায় এবং হিংসা পরিত্যাগ করে। অন্যভাবে বলতে গেলে, ঈশ্বর যখন মানুষের প্রতি কুপিত, তিনি আশা করেন যে মানুষ সৎভাবে অনুতাপ করতে পারবে এবং সত্যই তিনি মানুষের প্রকৃত অনুতাপ দেখার আশা করেন, যদি তা হয়, তাহলে তিনিও উদারভাবে মানুষের ওপর তাঁর ক্ষমা ও সহনশীলতা বর্ষণ করবেন। এ কথা বলার অর্থ, মানুষের দুষ্কর্ম ঈশ্বরকে ক্রুদ্ধ করে, অন্যদিকে ঈশ্বরের ক্ষমা ও সহনশীলতা তাদের ওপর বর্ষিত হয় যারা ঈশ্বরের বাক্য শোনে ও তাঁর সামনে প্রকৃত অর্থে অনুতাপ করে, যারা দুষ্ট কর্মের পথ থেকে সরে দাঁড়াতে পারে এবং হিংসা ত্যাগ করতে পারে। ঈশ্বরের আচরণ নীনবীয়দের প্রতি তাঁর ব্যবহারে স্পষ্টরূপে প্রকাশিত হয়েছিল: ঈশ্বরের করুণা ও সহনশীলতা অর্জন করা আদৌ কঠিন নয়, এবং তিনি প্রকৃত অনুশোচনা আকাঙ্ক্ষা করেন। যদি মানুষ তাদের অশুভ পথ থেকে সরে দাঁড়ায় ও হিংসা পরিহার করে, ঈশ্বর তাঁর হৃদয় ও তাদের প্রতি তাঁর আচরণ পরিবর্তন করবেন।
সৃষ্টিকর্তার ধার্মিক প্রকৃতি বাস্তব ও সুস্পষ্ট
নীনবীর লোকজনের প্রতি ঈশ্বর যখন তাঁর মনোভাব পরিবর্তন করেন, তখন তাঁর করুণা ও সহিষ্ণুতা কি একটা ছদ্ম-অভিব্যক্তি ছিল? অবশ্যই ছিল না। তাহলে ঈশ্বর কর্তৃক এই একটি পরিস্থিতির মোকাবিলা কালে, ঈশ্বরের প্রকৃতির এই দুটি অভিমুখের মধ্যে ক্রমপরিবর্তনের মাধ্যমে কী প্রদর্শিত হয়েছে? ঈশ্বরের প্রকৃতি একটি সম্পূর্ণ সমগ্রতা–তা আদৌ খণ্ডিত নয়। মানুষের প্রতি তিনি তাঁর রোষই প্রকাশ করুন কি তাঁর করুণা ও সহিষ্ণুতা, এ সকলই তাঁর ধার্মিক প্রকৃতির অভিব্যক্তি। ঈশ্বরের প্রকৃতি প্রাণময় এবং সুস্পষ্টভাবে দৃশ্যমান, এবং বিষয়গুলি যেভাবে ক্রমবিকশিত হয় সেই অনুযায়ী তিনি তাঁর চিন্তাভাবনা ও মনোভাব পরিবর্তিত করেন। নীনবীবাসীদের প্রতি তাঁর মনোভাবের রূপান্তর মানুষকে জানায় যে তাঁর নিজস্ব চিন্তাভাবনা ও মতামত আছে; তিনি কোনো যন্ত্রমানব বা মৃন্ময় মূর্তি নন, তিনি স্বয়ং প্রাণময় ঈশ্বর। নীনবীর মানুষজনের প্রতি তিনি কুপিত হতে পারেন, ঠিক যেমন তাদের মনোভঙ্গির কারণে তিনি তাদের অতীতকে ক্ষমাও করতে পারেন। তিনি নীনবীবাসীদের উপর দুর্ভাগ্য ডেকে আনার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, এবং তাদের অনুতাপের কারণে তিনি তাঁর সিদ্ধান্ত পরিবর্তনও করতে পারেন। মানুষ কঠোরভাবে নিয়ম প্রয়োগ করতে পছন্দ করে, এবং এরকম নিয়মকে ব্যবহার করে ঈশ্বরকে সীমায়িত ও সংজ্ঞাবদ্ধ করতে পছন্দ করে, ঠিক যেমন তারা ঈশ্বরের প্রকৃতিকে বোঝার প্রচেষ্টায় সূত্র ব্যবহার করতে পছন্দ করে। তাই, মানবিক চিন্তার পরিধি যতদূর সংশ্লিষ্ট সেই অনুযায়ী, ঈশ্বর চিন্তাভাবনা করেন না, এবং তাঁর মৌলিক কোনো মতামতও নেই। কিন্তু বাস্তবে, বিষয় ও পরিস্থিতির পরিবর্তন অনুসারে ঈশ্বরের চিন্তাভাবনা ক্রমাগত রূপান্তরিত হয়। এই চিন্তাগুলির রূপান্তরণের সময় ঈশ্বরের সারসত্যের বিভিন্ন অভিমুখ উদ্ভাসিত হয়। এই রূপান্তরণ প্রক্রিয়া চলাকালীন, ঠিক যে মুহূর্তে ঈশ্বরের হৃদয় পরিবর্তন ঘটে, মানবজাতিকে তখন তিনি যা প্রদর্শন করেন তা তাঁর জীবনের বাস্তব অস্তিত্ব, এবং তিনি প্রদর্শন করেন যে তাঁর ধার্মিক প্রকৃতি ঘাত-প্রতিঘাতমূলক প্রাণশক্তিতে ভরপুর। একই সঙ্গে, মানবজাতির কাছে তাঁর ক্রোধ, তাঁর করুণা, তাঁর মমতা ও তাঁর সহিষ্ণুতার অস্তিত্বের সত্যতাকে প্রতিপন্ন করতে ঈশ্বর তাঁর নিজের প্রকৃত উদ্ঘাটনকে ব্যবহার করেন। ঘটনাদি কীভাবে বিবর্তিত হচ্ছে তার উপর নির্ভর করে তাঁর সারসত্য যে-কোনো সময় এবং যে-কোনো স্থানে প্রকাশিত হবে। তিনি সিংহের মতো ক্রোধ ও মায়ের মতো করুণা ও সহিষ্ণুতার অধিকারী। তাঁর ধার্মিক প্রকৃতি কোনো মানুষের দ্বারা জেরা, লঙ্ঘন, পরিবর্তন বা বিকৃতির অনুমোদন করে না। সকল বস্তু ও সকল বিষয়ের মধ্যে, ঈশ্বরের ধার্মিক প্রকৃতি–অর্থাৎ, ঈশ্বরের ক্রোধ ও ঈশ্বরের করুণা–যে-কোনো সময়ে ও যে-কোনো স্থানে অভিব্যক্ত হতে পারে। সকল সৃষ্টির প্রতিটি কোণে তাঁর প্রকৃতির এই অভিমুখগুলিকে তিনি প্রাণবন্ত অভিব্যক্তি প্রদান করেন, এবং প্রতিটি চলমান মুহূর্তে প্রাণপ্রাচুর্যের সাথে তিনি ওগুলি বাস্তবায়িত করেন। ঈশ্বরের ধার্মিক প্রকৃতি স্থানকালের দ্বারা সীমাবদ্ধ নয়; বাক্যান্তরে, ঈশ্বরের ধার্মিক প্রকৃতি স্থানকালের বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী যান্ত্রিকভাবে অভিব্যক্ত বা প্রকাশিত হয় না, বরং সর্বকালে ও সর্বত্র এবং অতি সহজেই তা প্রকাশিত হয়। তুমি যখন লক্ষ্য করো যে ঈশ্বরের হৃদয় পরিবর্তন ঘটেছে, তিনি তাঁর ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ স্থগিত করেছেন এবং নীনবী নগরীকে ধ্বংস করা থেকে নিবৃত্ত হয়েছেন, তখন তুমি কি বলতে পারো যে ঈশ্বর কেবল করুণাপূর্ণ ও প্রেমময়? তুমি কি বলতে পারো যে ঈশ্বরের ক্রোধ শূণ্যগর্ভ বাক্যে নির্মিত? ঈশ্বর যখন ভয়ানক ক্রোধে কুপিত হন এবং তাঁর করুণা প্রত্যাহার করে নেন, তখন তুমি কি বলতে পারো যে মানুষের প্রতি তিনি প্রকৃত কোনো প্রেম অনুভব করেন না? ঈশ্বরের দ্বারা এই ভয়ঙ্কর ক্রোধ অভিব্যক্ত হয় মানুষের মন্দ কর্মের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ; তাঁর ক্রোধ ত্রুটিপূর্ণ নয়। ঈশ্বরের হৃদয় বিচলিত হয় মানুষের অনুতাপের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ, এবং এই অনুতাপই তাঁর হৃদয় পরিবর্তন ঘটায়। যখন তিনি বিচলিত অনুভব করেন, যখন তাঁর হৃদয় পরিবর্তন ঘটে, এবং যখন তিনি মানুষের প্রতি তাঁর করুণা ও সহিষ্ণুতা প্রদর্শন করেন, এর সকলকিছুই সম্পূর্ণভাবে ত্রুটিহীন; এগুলো পরিচ্ছন্ন, বিশুদ্ধ, কলঙ্কমুক্ত ও নিখাদ। ঈশ্বরের সহিষ্ণুতা নির্ভুলভাবে সহিষ্ণুতাই, ঠিক যেমন তাঁর করুণা করুণা ব্যতীত অন্য কিছু নয়। মানুষের অনুতাপ ও তাদের আচরণের তারতম্য অনুসারে ঈশ্বরের প্রকৃতি ক্রোধ অথবা করুণা ও সহিষ্ণুতা অভিব্যক্ত করে। তিনি যা-ই প্রকাশ করুন বা অভিব্যক্ত করুন, তার সমস্তটাই বিশুদ্ধ ও প্রত্যক্ষ; তার সারসত্য সৃষ্টির সকলকিছুর সারসত্যের থেকে স্বতন্ত্র। ঈশ্বর যখন তাঁর ক্রিয়াকর্মের অন্তর্নিহিত নীতিসমূহ অভিব্যক্ত করেন, সেগুলি সকল ত্রুটি বা দোষ থেকে মুক্ত, এবং ঠিক তেমনই দোষমুক্ত তাঁর চিন্তা, তাঁর ধারণা, তাঁর নেওয়া প্রতিটি সিদ্ধান্ত ও তাঁর দ্বারা কৃত প্রতিটি কাজ। ঈশ্বর যেহেতু এরকম সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং যেহেতু তিনি এভাবেই কাজ করেছেন, তাই এভাবেই তিনি তাঁর কৃতকর্ম সম্পন্ন করেন। তাঁর কৃতকর্মের ফলাফল সঠিক ও ত্রুটিশূণ্য সম্যক এই কারণে যে তাদের উৎস নির্ভুল ও নিষ্কলঙ্ক। ঈশ্বরের ক্রোধ ত্রুটিশূন্য। একই ভাবে, ঈশ্বরের করুণা ও সহিষ্ণুতা–সমগ্র সৃষ্টির মধ্যে কেউ যার অধিকারী নয়–পবিত্র ও নিখুঁত, এবং তা সুচিন্তিত পর্যালোচনা ও অভিজ্ঞতাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারে।
নীনবীর গল্পটি পাঠ করে তোমাদের উপলব্ধির মাধ্যমে, তোমরা কি এখন ঈশ্বরের ধার্মিক প্রকৃতির সারসত্যের অপর দিকটি দেখতে পাও? ঈশ্বরের অনন্য ধার্মিক প্রকৃতির অপর পৃষ্ঠটি কি তোমরা দেখতে পাও? মানুষদের মধ্যে কেউ কি এ ধরনের প্রকৃতির অধিকারী? কেউ কি সেই ধরনের ক্রোধের অধিকারী, যা ঈশ্বরের ক্রোধ? ঈশ্বরের যেমন আছে কেউ কি তেমন করুণা ও সহিষ্ণুতার অধিকারী? সৃষ্টির মধ্যে কে এমন ভয়ঙ্কর ক্রোধ আহ্বান করে আনতে পারে এবং মানবজাতিকে ধ্বংস করার বা মানবজাতির উপর বিপর্যয় ডেকে আনার সিদ্ধান্ত নিতে পারে? এবং কে-ই বা মানুষকে করুণা অর্পন করার, সহনশীলতা দেখানোর ও ক্ষমা করার, এবং এর মাধ্যমে মানুষকে ধ্বংস করার পূর্ববর্তী সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের যোগ্যতাসম্পন্ন? সৃষ্টিকর্তা তাঁর নিজস্ব অনন্য পদ্ধতি ও নীতির মাধ্যমে তাঁর ধার্মিক প্রকৃতি অভিব্যক্ত করেন, এবং তিনি কোনো মানুষ, ঘটনাবলী বা বস্তুসমূহের দ্বারা আরোপিত নিয়ন্ত্রণ বা বাধানিষেধের অধীন নন। তাঁর অনন্য প্রকৃতির কারণে কেউ তাঁর চিন্তা বা ধারণা পরিবর্তন করতে সমর্থ নয়, এবং কেউ তাঁকে সম্মত করাতে ও তাঁর কোনো সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করাতেও সমর্থ নয়। আচরণ ও চিন্তার যে সমগ্রতা সকল সৃষ্টির মধ্যে বিদ্যমান, তা তাঁর ধার্মিক প্রকৃতির বিচারের অধীনে বিরাজ করে। তিনি ক্রোধ না করুণার প্রয়োগ করবেন, তা কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না; শুধুমাত্র সৃষ্টিকর্তার সারসত্য–বা অন্য কথায়, সৃষ্টিকর্তার ধার্মিক প্রকৃতি–এই সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সৃষ্টিকর্তার ধার্মিক স্বভাবের অনন্য প্রকৃতি এমনই!
নীনবীর মানুষদের প্রতি ঈশ্বরের মনোভাবের রূপান্তরকে বিশ্লেষণ ও উপলব্ধি করার মাধ্যমে, ঈশ্বরের ধার্মিক প্রকৃতির মধ্যে দৃশ্যমান করুণাকে বর্ণনা করতে তোমরা কি “অনন্য” শব্দটি ব্যবহার করতে সক্ষম? আগে আমরা বলেছি যে ঈশ্বরের ক্রোধ তাঁর অনন্য ধার্মিক প্রকৃতির সারসত্যের একটি অভিমুখ। এখন আমি তাঁর ধার্মিক প্রকৃতি হিসাবে দুটি বিষয় সংজ্ঞায়িত করবো–ঈশ্বরের ক্রোধ এবং ঈশ্বরের করুণা। ঈশ্বরের ধার্মিক প্রকৃতি পবিত্র; লঙ্ঘিত হওয়া বা সওয়ালের সম্মুখীন হওয়া তা সহ্য করে না; এটা এমন এক জিনিস সৃজিত বা অসৃজিত সত্তাদের মধ্যে কেউ যার অধিকারী নয়। এটি ঈশ্বরের একই সাথে অনন্য ও একচেটিয়া সম্পদ। অর্থাৎ, ঈশ্বরের ক্রোধ পবিত্র ও অলঙ্ঘনীয়। একই ভাবে, ঈশ্বরের ধার্মিক প্রকৃতির অপর দিকটি–ঈশ্বরের করুণাও পবিত্র এবং অলঙ্ঘনীয়। কোনো সৃজিত বা অসৃজিত সত্তাই ঈশ্বরের ক্রিয়াকর্মে তাঁকে প্রতিস্থাপিত বা তাঁর প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না, এবং সদোমের বিনাশে বা নীনবীর পরিত্রাণে কেউ তাঁকে প্রতিস্থাপিত করতে বা তাঁর প্রতিনিধিত্ব করতে পারতোও না। এই হলো ঈশ্বরের অনন্য ধার্মিক প্রকৃতির যথার্থ অভিব্যক্তি।
মানবজাতির প্রতি সৃষ্টিকর্তার আন্তরিক অনুভূতি
মানুষ প্রায়শই বলে যে ঈশ্বরকে জানা মুখের কথা নয়। কিন্তু, আমি বলি ঈশ্বরকে জানা আদৌ কঠিন কাজ নয়, কারণ ঈশ্বর মানুষকে দেখানোর জন্য বারংবার তাঁর ক্রিয়াকর্ম প্রদর্শিত করেন। মানবজাতির সঙ্গে তাঁর সংলাপে ঈশ্বর কখনো ক্ষান্তি দেননি, মানুষের কাছ থেকে নিজেকে কখনো তিনি প্রচ্ছন্ন রাখেননি, এবং নিজেকে তিনি লুক্কায়িতও করেননি। তাঁর চিন্তাভাবনা, তাঁর ধারণা, তাঁর বাক্য এবং তাঁর ক্রিয়াকর্ম, সকলই মানুষের কাছে প্রকাশিত। তাই, মানুষ ঈশ্বরকে জানতে চাইলে, নানা ধরনের উপায় ও পদ্ধতির মাধ্যমে তারা তাঁকে বুঝে ঊঠতে ও জেনে ঊঠতে পারে। যে কারণে মানুষ অন্ধের মতো ভাবে যে ঈশ্বর ইচ্ছে করেই তাদের এড়িয়ে গেছেন, ঈশ্বর ইচ্ছাকৃতভাবে মানুষের থেকে নিজেকে গোপন রেখেছেন, মানুষকে তাঁকে উপলব্ধি করতে বা জানতে দেওয়ার কোনো অভিপ্রায় ঈশ্বরের নেই, সেই কারণটা হল: ঈশ্বর কে তা মানুষ জানে না এবং ঈশ্বরকে উপলব্ধি করতে তারা ইচ্ছুকও নয়। এমনকি তার থেকেও বড়ো কারণ হলো, সৃষ্টিকর্তার চিন্তাভাবনা, বাক্য বা কর্মের সাথে মানুষ নিজেদের সংশ্লিষ্ট করে না…। সত্যি কথা বলতে কি, কোনো ব্যক্তি যদি শুধু তার অবসর সময়টুকু সৃষ্টিকর্তার বাক্য বা কাজের বিষয়ে মনোযোগী হতে এবং তা উপলব্ধি করতে ব্যবহার করে, এবং তারা যদি সৃষ্টিকর্তার চিন্তাভাবনা ও তাঁর হৃদয়ের কণ্ঠস্বরের প্রতি সামান্য একটু মনোযোগ দেয়, তাহলে সেই ব্যক্তির পক্ষে এটা উপলব্ধি করা কঠিন হবে না যে সৃষ্টিকর্তার চিন্তা, বাক্য ও কর্ম দৃষ্টিগ্রাহ্য ও স্বচ্ছ। একই ভাবে, এটা উপলব্ধি করতেও যৎসামান্য প্রচেষ্টা লাগবে যে সৃষ্টিকর্তা সর্বদা মানুষের মধ্যেই আছেন, তিনি সবসময় মানুষ ও সমগ্র সৃষ্টির সাথে কথোপকথনরত, এবং প্রত্যেকদিন তিনি নতুন নতুন কর্ম সম্পাদন করছেন। মানুষের সাথে তাঁর সংলাপের মধ্যে তাঁর সারসত্য ও প্রকৃতি অভিব্যক্ত হয়; তাঁর চিন্তা ও ধারণা সম্পূর্ণভাবে প্রকাশিত হয় তাঁর কর্মের মধ্যে; তিনি প্রতিনিয়ত মানবজাতিকে সঙ্গ দেন ও পর্যবেক্ষণ করেন। মানবজাতি ও সমগ্র সৃষ্টির সাথে তিনি নিস্তব্ধভাবে তাঁর নিরুচ্চার বাক্যের মাধ্যমে বলেন: “আমি স্বর্গে রয়েছি, এবং আমি আমার সৃষ্টির মাঝখানে আছি। আমি লক্ষ্য রাখছি; আমি অপেক্ষা করছি; আমি তোমার পাশেই আছি…।” তাঁর করযুগল উষ্ণ ও বলিষ্ঠ; তাঁর পদক্ষেপ লঘু; তাঁর কণ্ঠস্বর কোমল ও মাধুর্যময়; তাঁর আকার সতত সঞ্চারমান, তা সমগ্র মানবজাতিকে আলিঙ্গন করে; তাঁর মুখের অভিব্যক্তি সুন্দর ও সৌম্য। তিনি কখনো ছেড়ে যাননি, কখনো উধাও হননি। তিনি মানবজাতির নিত্যসঙ্গী, তাদের পার্শ্ব কখনো ত্যাগ করেন না। তিনি যখন নীনবী নগরীকে রক্ষা করেন তখন মানুষের জন্য তাঁর নিয়োজিত প্রযত্ন ও সবিশেষ স্নেহ এবং প্রকৃত উদ্বেগ ও ভালোবাসা একটু একটু করে প্রদর্শিত হয়েছিল। বিশেষ করে যিহোবা ঈশ্বর ও যোনার মধ্যে কথাবার্তা তাঁর নিজের সৃষ্ট মানবজাতির প্রতি সৃষ্টিকর্তার স্নেহপরায়ণতাকে পূর্ণভাবে প্রকাশ করে। ওই বাক্যগুলির মাধ্যমে তুমি মানুষের প্রতি ঈশ্বরের আন্তরিক অনুভূতির বিষয়ে এক গভীর উপলব্ধি লাভ করতে পারো …
নিম্নলিখিত অনুচ্ছেদটি যোনা পুস্তিকার ৪:১০-১১ স্তবকে লিপিবদ্ধ আছে: “যিহোবা বললেন, তুমি এই লতাগাছটির জন্য কোন পরিশ্রম করনি, এর যত্নও করনি। রাতারাতি এটি বেড়ে উঠেছিল এবং পরের দিন শুকিয়ে গেছে। এর জন্য যদি তোমার এত দুঃখ হয় তাহলে ভেবে দেখ, এই মহানগরী নীনবী, যার মধ্যে রয়েছে এক লক্ষ কুড়ি হাজারেরও বেশী মানুষ—যারা ন্যায়-অন্যায় বোঝে না, আর আছে অসংখ্য পশু, তাদের জন্য কি আমার মমতা থাকবে না?” এগুলি ঈশ্বর ও যোনার মধ্যে কথোপকথন থেকে গৃহিত যিহোবা ঈশ্বরের প্রকৃত বাক্য। এই বাক্য বিনিময় যদিও সংক্ষিপ্ত, কিন্তু তা মানবজাতির প্রতি সৃষ্টিকর্তার দরদ এবং মানবজাতিকে পরিত্যাগ করতে তাঁর অনাগ্রহে কানায় কানায় পূর্ণ। এই বাক্যগুলি ঈশ্বর তাঁর সৃষ্টির প্রতি তাঁর হৃদয়ে প্রকৃত যে মনোভাব ও অনুভূতি ধারণ করেন তাকে ব্যক্ত করে। মানুষের দ্বারা কদাচিৎ পূর্বশ্রুত এই পরিষ্কার ও সুব্যক্ত বাক্যসমূহ মাধ্যমে ঈশ্বর মানুষদের নিয়ে তাঁর প্রকৃত অভিপ্রায় বিবৃত করেছেন। এই বাক্য বিনিময় ঈশ্বর নীনবীর মানুষদের প্রতি যে মনোভাবটি পোষণ করেছিলেন তার ব্যাখ্যা করে – কিন্তু তা কেমন ধরনের মনোভাব? এ হল সেই মনোভাব, নীনবীবাসীদের অনুতাপের আগে ও পরে যা তিনি তাদের প্রতি পোষণ করেছিলেন, এবং যা নিয়ে তিনি মানবজাতির প্রতি আচরণ করেন। এই বাক্যগুলির মধ্যে তাঁর চিন্তাভাবনা ও তাঁর প্রকৃতি নিহিত আছে।
এই বাক্যগুলির মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের কোন ভাবনা প্রকাশ পায়? পাঠ করার সময় তোমরা যদি খুঁটিনাটির প্রতি মনোযোগ দাও তাহলে এটা লক্ষ্য করা তোমাদের পক্ষে কঠিন হবে না যে তিনি “অনুকম্পা” শব্দটি ব্যবহার করেছেন; এই শব্দটির ব্যবহার মানবজাতির প্রতি ঈশ্বরের প্রকৃত মনোভাবটিকে প্রদর্শন করে।
আক্ষরিক অর্থের স্তরে মানুষ “অনুকম্পা” শব্দটিকে নানা ভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে: প্রথমত, তা “ভালোবাসা ও সুরক্ষিত করা, কিছুর প্রতি দরদ অনুভব করা” বোঝায়; দ্বিতীয়ত, তা “প্রীতিপূর্ণভাবে ভালোবাসা” বোঝায়; এবং সব শেষে, তা “কোনোকিছুকে আহত করতে অনিচ্ছুক হওয়া এবং এরকম কোনো কাজ সহ্য করতে অসমর্থ হওয়া” বোঝায়। সংক্ষেপে, শব্দটি মমতাময় স্নেহ ও প্রেম, এবং সেই সঙ্গে কাউকে বা কোনোকিছুকে পরিত্যাগ করার অনিচ্ছাকে জ্ঞাপন করে; শব্দটি মানুষের প্রতি ঈশ্বরের করুণা ও সহিষ্ণুতাকে সূচিত করে। মানুষের দ্বারা সাধারণভাবে উচ্চারিত এই শব্দটিকে ঈশ্বর ব্যবহার করেছিলেন, এবং তা সত্ত্বেও শব্দটি ঈশ্বরের হৃদয়ের কণ্ঠস্বর ও মানবজাতির প্রতি তাঁর মনোভাবকে উন্মোচিত করে ধরতেও সমর্থ।
যদিও নীনবী নগরী সদোমের মতোই ভ্রষ্ট, দুষ্ট ও হিংস্র মানুষে পূর্ণ ছিল, কিন্তু তাদের অনুতাপ ঈশ্বরের হৃদয় পরিবর্তন ঘটিয়েছিল এবং তাদের ধ্বংস না করার সিদ্ধান্ত নেওয়া করিয়েছিল। ঈশ্বরের বাক্য ও নির্দেশকে তারা যেভাবে গ্রহণ করেছিল তা সদোমের নাগরিকদের থেকে সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী এক মনোভাব প্রদর্শন করার কারণে, এবং ঈশ্বরের কাছে তাদের সততাপূর্ণ সমর্পণ ও তাদের পাপের জন্য অকৃত্রিম অনুতাপ, এবং সেই সাথে সকল বিষয়ে তাদের অকপট ও হৃদ্য আচরণের কারণে, ঈশ্বর আরেকবার তাঁর নিজের আন্তরিক অনুকম্পা অভিব্যক্ত করেছিলেন এবং তাদের তা অর্পণ করেছিলেন। ঈশ্বর মানুষকে যা প্রদান করেন এবং মানুষের প্রতি তাঁর যে অনুকম্পা তার অনুকরণ করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়, এবং কোনো মানুষের পক্ষে ঈশ্বরের করুণা, তাঁর সহিষ্ণুতা, বা মানুষের প্রতি তাঁর আন্তরিক অনুভূতির অধিকারী হওয়া অসম্ভব। এমন কেউ কি আছে যাকে তুমি একজন মহান পুরুষ বা মহতী নারী বা এমনকি একজন অতিমানব মনে করো, যে একজন মহান মানব বা মহতী মানবী হিসাবে, এক উচ্চ স্থান থেকে, বা উচ্চতম স্থান থেকে, কথা বলার সময় মানবজাতি বা সৃষ্টির প্রতি এই ধরনের বক্তব্য রাখতে পারে? মানবজাতির মধ্যে কারা মানব জীবনের পরিস্থিতিকে তাদের হাতের তালুর মতো জানতে পারে? মানুষের অস্তিত্বের বোঝা ও দায়িত্বভার কে বহন করতে পারে? একটি নগরীর বিনাশ ঘোষণা করার মতো যোগ্যতাসম্পন্ন কে আছে? এবং একটি নগরীকে মার্জনা করার মতো যোগ্যতাই বা কার আছে? কে বলতে পারে যে সে তার নিজের সৃষ্টিকে সস্নেহে লালন করে? একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই তা পারেন! একমাত্র সৃষ্টিকর্তারই এই মানবজাতির প্রতি স্নেহার্দ্র মমতাবোধ রয়েছে। একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই এই মানবজাতির প্রতি সহমর্মীতা ও স্নেহ প্রদর্শন করেন। একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই এই মানবজাতির প্রতি একটা প্রকৃত অভঙ্গুর স্নেহ পোষণ করেন। একই ভাবে, একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই এই মানবজাতির উপর করুণা সংস্থাপন এবং তাঁর সমগ্র সৃষ্টিকে সস্নেহে লালন করতে পারেন। মানুষের প্রত্যেকটি কার্যকলাপ দেখে তাঁর হৃদয় উল্লম্ফিত ও ব্যথাতুর হয়ে ওঠে: মানুষের পাপাচার ও ভ্রষ্টতা দেখে তিনি রুষ্ট, মর্মপীড়িত ও শোকাহত হন; মানুষের অনুতাপ ও বিশ্বাস দেখে তিনি তৃপ্ত, আনন্দিত, ক্ষমাশীল ও উল্লসিত হন; তাঁর প্রত্যেকটি চিন্তা ও ভাবনা মানবজাতির জন্য অস্তিমান এবং মানবজাতিকে ঘিরেই আবর্তিত হয়; তিনি যা ও তাঁর যা আছে সম্পূর্ণরূপে তা মানবজাতির স্বার্থেই অভিব্যক্ত হয়; তাঁর যাবতীয় আবেগ মানবজাতির অস্তিত্বের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে বিজড়িত। মানবজাতির স্বার্থে, তিনি পরিভ্রমণ করেন ও দিগ্বিদিকে ধাবিত হন; নিঃশব্দে তিনি তাঁর জীবনের প্রত্যেকটি খণ্ড বিলিয়ে দেন; তাঁর জীবনের প্রতিটি পল-অণুপলকে উৎসর্গ করেন …। তাঁর নিজের জীবনের প্রতি কীভাবে দরদী হতে হয় তিনি কখনো জানেননি, তবু যে মানবজাতিকে তিনি স্বয়ং সৃষ্টি করেছিলেন তাকে তিনি সর্বদা লালন করেছেন…। তাঁর যাকিছু আছে তার সমস্তই তিনি এই মানবতাকে দান করেন…। বিনা শর্তসাপেক্ষে ও প্রতিদানের কোনো প্রত্যাশা ছাড়াই তিনি তাঁর করুণা ও সহিষ্ণুতা প্রদান করেন। এটা তিনি করেন যাতে মানবজাতি তাঁর চক্ষুর সম্মুখে ও তাঁর প্রদত্ত জীবন-রসদ গ্রহণ করে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে। তিনি এমনটা করেন শুধুমাত্র যাতে মানবজাতি একদিন তাঁর কাছে নিজেদের সমর্পণ করতে পারে এবং সনাক্ত করতে পারে যে তিনিই মানুষের অস্তিত্বকে পোষণ করেন এবং সকল সৃষ্টির জীবন সরবরাহ করেন।
সৃষ্টিকর্তা মানুষের প্রতি তাঁর প্রকৃত অনুভূতি ব্যক্ত করেন
যিহোবা ঈশ্বর ও যোনার মধ্যে এই কথোপকথন নিঃসন্দেহে মানুষের প্রতি সৃষ্টিকর্তার প্রকৃত অনুভূতির এক অভিব্যক্তি। একদিকে তা তাঁর সার্বভৌমত্বের অধীন সকল সৃষ্টির বিষয়ে সৃষ্টিকর্তার উপলব্ধি মানুষকে অবহিত করে; যিহোবা ঈশ্বর যেমন বলেন, “এই মহানগরী নীনবী, যার মধ্যে রয়েছে এক লক্ষ কুড়ি হাজারেরও বেশী মানুষ—যারা ন্যায়-অন্যায় বোঝে না, আর আছে অসংখ্য পশু, তাদের জন্য কি আমার মমতা থাকবে না?” অন্যভাবে বললে, নীনবীর বিষয়ে ঈশ্বরের উপলব্ধি মোটেই দায়সারা গোছের ছিল না। শুধু যে তিনি নগরীর ভিতরের সজীব বস্তুর সংখ্যা (মানুষ ও পালিত পশুদের ধরে) জানতেন তা-ই নয়, কতজন ডান ও বাঁ হাতের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করতে পারতো না তিনি তা-ও জানতেন–অর্থাৎ, তিনি জানতেন নগরীতে কতজন শিশু ও যুবা বিদ্যমান ছিল। মানবজাতি সম্বন্ধে ঈশ্বরের সর্বাত্মক উপলব্ধির এটা একটা সুনির্দিষ্ট প্রমাণ। অপর পক্ষে, মানুষের প্রতি ঈশ্বরের মনোভাবকে এই কথোপকথন মানুষদের জ্ঞাপন করে, অর্থাৎ, সৃষ্টিকর্তার হৃদয়ে মানবতার ভারকে জ্ঞাপন করে। ঠিক যেমন যিহোবা ঈশ্বর বলেছিলেন: “তুমি এই লতাগাছটির জন্য কোন পরিশ্রম করনি, এর যত্নও করনি। রাতারাতি এটি বেড়ে উঠেছিল এবং পরের দিন শুকিয়ে গেছে। এর জন্য যদি তোমার এত দুঃখ হয় তাহলে ভেবে দেখ, এই মহানগরী নীনবী, … তাদের জন্য কি আমার মমতা থাকবে না?” এগুলি যোনার প্রতি যিহোবা ঈশ্বরের তিরস্কার বাক্য, কিন্তু এ সমস্তই সত্য।
যদিও যোনাকে নীনবীর মানুষদের কাছে যিহোবা ঈশ্বরের বাক্যগুলি ঘোষণা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু না সে যিহোবা ঈশ্বরের অভিপ্রায় উপলব্ধি করেছিল, না উপলব্ধি করেছিল নগরীর মানুষদের জন্য তাঁর উদ্বেগ ও প্রত্যাশা। এই তিরস্কারের মাধ্যমে ঈশ্বর বলতে চেয়েছেন যে, মানুষ হল ঈশ্বরের নিজের হাতে উৎপাদিত ফসল, এবং প্রত্যেকটি মানুষের উপর তিনি শ্রমসাধ্য প্রচেষ্টা ব্যয়িত করেছেন, প্রতিটি মানুষ তাদের কাঁধে ঈশ্বরের প্রত্যাশা বহন করে, এবং প্রত্যেক মানুষ ঈশ্বরের জীবনের রসদ উপভোগ করে; প্রতিটি মানুষের জন্য ঈশ্বর কষ্টসাধ্য প্রচেষ্টাস্বরূপ মূল্য চুকিয়েছেন। এই তিরস্কার যোনাকে এও জানিয়েছিল যে, যোনা নিজে লতাগাছটিকে যে পরিমাণ লালন করে, ঈশ্বর মানুষকে ঠিক ততটাই লালন করেন, যে মানুষ তাঁর নিজের হাতের সৃজন। ঈশ্বর কোনোভাবেই মানবজাতিকে লঘুভাবে, বা শেষ সম্ভাব্য মুহূর্ত অবধি না দেখে, পরিত্যাগ করতেন না, বিশেষ করে যেহেতু নগরীর ভিতর এতো শিশু ও নিরপরাধ পশু ছিল। ঈশ্বরের সৃষ্টির এই সকল নবোদ্ভিন্ন ও অবোধ ফসল, যারা এমনকি নিজেদের ডান হাত ও বাঁ হাতের মধ্যে পার্থক্য করতে পারতো না, তাদের ক্ষেত্রে তো আরো অকল্পনীয় যে ঈশ্বর এতো হঠকারী ভাবে তাদের জীবন কেড়ে নেবেন ও তাদের নিয়তি নির্ধারণ করবেন। ঈশ্বর দেখার আশা রাখতেন যে তারা বড়ো হয়ে ওঠবে; তিনি আশা করতেন তারা তাদের বয়োজ্যেষ্ঠদের মতো একই পথে হাঁটবে না, আবার তাদের যিহোবা ঈশ্বরের সাবধানবাণী শুনতে হবে না, এবং তারা নীনবীর অতীতের সাক্ষ্যদান করবে। তার থেকেও বড়ো কথা, ঈশ্বর অনুতপ্ত হওয়ার পর নীনবী নগরীকে দেখার, অনুতাপ-পরবর্তীকালে নীনবীর ভবিষ্যৎকে দেখার, এবং আরো গুরুত্ব দিয়ে, নীনবীকে আরেকবার ঈশ্বরের করুণা অধীনে বাস করতে দেখার আশা পোষণ করেছিলেন। তাই, ঈশ্বরের চোখে, সৃষ্টির ওই ফসলগুলি, যারা তাদের বাঁ হাত ও ডান হাতের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করতে পারতো না, তারাই ছিল নীনবীর ভবিষ্যৎ। তারা নীনবীর অবজ্ঞেয় অতীতকে বহন করবে, ঠিক যেমন যিহোবা ঈশ্বরের পথপ্রদর্শনার অধীনে তারা নীনবীর অতীত ও ভবিষ্যৎ উভয়ের সাক্ষ্যদানের গুরু দায়িত্ব বহন করবে। তাঁর প্রকৃত অনুভূতির এই বিঘোষণে যিহোবা ঈশ্বর মানুষের জন্য সৃষ্টিকর্তার করুণার সামগ্রিকতাকে উপস্থাপিত করেছিলেন। এটি মানুষকে দেখায় যে “সৃষ্টিকর্তার করুণা” কোনো ফাঁকা বুলি নয়, এটি কোনো শূণ্যগর্ভ প্রতিশ্রুতিও নয়; এর সুনির্দিষ্ট নীতি, পদ্ধতি ও লক্ষ্য আছে। ঈশ্বর সত্য ও বাস্তব, এবং তিনি কোনো ছলনা বা ছদ্মবেশ ব্যবহার করেন না, এবং এই একই ভাবে, প্রত্যেক কালে ও যুগে তাঁর করুণা মানুষের উপর অনিঃশেষভাবে অর্পিত হয়। যাই হোক, এমনকি আজকের দিন অবধি, যোনার সঙ্গে সৃষ্টিকর্তার কথোপকথন কেন তিনি মানুষকে করুণা প্রদর্শন করেন, কীভাবে তিনি মানুষের প্রতি করুণা প্রদর্শন করেন, মানুষের ক্ষেত্রে তিনি কতটা সহিষ্ণু এবং মানুষের প্রতি তাঁর প্রকৃত অনুভূতির বিষয়ে তাঁর একমাত্র, সামগ্রিক বাচনিক বিবৃতি। এই কথোপকথনের সময় যিহোবা ঈশ্বরের সংক্ষিপ্ত বাক্যগুলি মানুষের প্রতি তাঁর ভাবনাচিন্তাকে এক অখণ্ড সমগ্রতার আকারে প্রকাশ করে; এগুলি মানুষের প্রতি তাঁর অন্তরের মনোভাবের প্রকৃত অভিব্যক্তি, এবং এগুলি মানুষের উপর তাঁর অপর্যাপ্ত করুণা বর্ষণের সুনির্দিষ্ট প্রমাণও বটে। তাঁর করুণা শুধুমাত্র মানবতার বয়োজ্যেষ্ঠ প্রজন্মের উপরেই ন্যস্ত হয় না, তা মানবতার স্বল্পবয়স্ক সদস্যদেরও মঞ্জুর করা হয়, এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে, যেমন সতত হয়ে চলেছে। ঈশ্বরের ক্রোধ যদিও মানবতার নির্দিষ্ট কোণে নির্দিষ্ট যুগে মাঝে-মাঝেই নেমে আসে, কিন্তু ঈশ্বরের করুণার প্রবাহ কখনো স্তিমিত হয়নি। তাঁর করুণার সাহায্যে তিনি তাঁর সৃষ্টির একের পর এক প্রজন্মকে পথপ্রদর্শিত ও চালিত করেন, এবং সৃষ্টির একের পর এক প্রজন্মকে রসদ যোগান ও পুষ্টিবিধান করেন, কারণ মানুষের প্রতি তাঁর প্রকৃত অনুভূতি কখনো পরিবর্তিত হবে না। যিহোবা ঈশ্বর ঠিক যেমনটি বলেছেন: “…আমার মমতা থাকবে না?” তিনি তাঁর নিজের সৃষ্টিকে সর্বদা লালন করেছেন। এই হল সৃষ্টিকর্তার ধার্মিক প্রকৃতির করুণা, এবং এটি সৃষ্টিকর্তার সামগ্রিক অনন্যতাও বটে!
পাঁচ ধরনের মানুষ
আপাতত এখানে আমি ঈশ্বরের ধার্মিক প্রকৃতি বিষয়ে আমাদের সহকারিতা থেকে অব্যাহতি নেবো। এগিয়ে গিয়ে, ঈশ্বরের অনুসরণকারীদের আমি তাদের ঈশ্বর-চেতনা এবং তাঁর ধার্মিক প্রকৃতি বিষয়ে তাদের উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতা অনুযায়ী কয়েকটি বর্গে শ্রেণীবিন্যস্ত করবো, যাতে বর্তমানে তোমরা কোন পর্যায়ে আছো এবং তোমাদের সাম্প্রতিক আত্মিক উচ্চতা কত তা তোমরা জানতে পারো। মানুষের ঈশ্বর-জ্ঞান এবং তাঁর ধার্মিক প্রকৃতি বিষয়ে উপলব্ধি অনুযায়ী মানুষ যেসব বিভিন্ন পর্যায় ও আত্মিক উচ্চতায় অধিষ্ঠান করে তাদের সাধারণভাবে পাঁচটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়। আলোচ্য বিষয়টি অনন্য ঈশ্বর ও তাঁর ধার্মিক প্রকৃতি সংক্রান্ত জ্ঞানের ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। তাই, নিম্নলিখিত বিষয়বস্তুটি পাঠ করার সময় তোমাদের সতর্কভাবে নির্ণয় করার চেষ্টা করা উচিৎ ঈশ্বরের অনন্যতা ও তাঁর ধার্মিক প্রকৃতি বিষয়ে তোমাদের ঠিক কতখানি উপলব্ধি ও জ্ঞান আছে, এবং তারপর তোমরা সঠিক কোন পর্যায়ে অবস্থান করো, তোমাদের আত্মিক উচ্চতা সত্যিই কতটা বৃহৎ, এবং তোমরা ঠিক কী ধরনের মানুষ তার বিচার করতে ওই নির্ণীত ফলাফলকে ব্যবহার করা উচিৎ।
প্রথম প্রকার: কাঁথা-কানিতে মোড়া শিশুর পর্যায়
“কাঁথা-কানিতে মোড়া শিশু” বলতে কী বোঝায়? কাঁথা-কানিতে মোড়া শিশু হল এমন একজন শিশু যে সবেমাত্র পৃথিবীতে এসেছে, এক নবজাতক। এটা সেই পর্যায় যখন মানুষ তাদের সবচেয়ে অপরিণত অবস্থায় থাকে।
এই পর্যায়ের মানুষের ঈশ্বর-বিশ্বাস বিষয়ে মূলত কোনো অবগতি বা সচেতনতা থাকে না। সকল বিষয়ে তারা হতবুদ্ধি ও অজ্ঞান। হতে পারে এই লোকগুলি দীর্ঘদিন ধরে ঈশ্বরে বিশ্বাস করেছে, কিম্বা হয়তো আদৌ খুব বেশি দিন করেনি, কিন্তু তাদের এই বিভ্রান্ত ও অজ্ঞ দশা এবং তাদের প্রকৃত আত্মিক উচ্চতা তাদেরকে কাঁথায় মোড়া শিশুর পর্যায়ে স্থাপন করে। একটি কাঁথা-কানিতে মোড়া শিশুর দশার যথাযথ সংজ্ঞা এই রকম: এই ধরনের মানুষগুলি যতদিন ধরেই ঈশ্বরে বিশ্বাস করুক না কেন, তারা সবসময় বিমূঢ়, বিভ্রান্ত এবং সরলমনাই রয়ে যাবে; কেন তারা ঈশ্বরে বিশ্বাস করে তা তারা জানে না, কে ঈশ্বর বা ঈশ্বর কে এটাও জানে না। যদিও তারা ঈশ্বরকে অনুসরণ করে, কিন্তু তাদের হৃদয়ে ঈশ্বরের কোনো যথাযথ সংজ্ঞা নেই, এবং যাঁকে তারা অনুসরণ করে তিনিই ঈশ্বর কিনা তা তারা নির্ণয় করতে পারে না, তাদের সত্যিই ঈশ্বরে বিশ্বাস করা ও তাঁকে অনুসরণ করা উচিৎ কিনা তা নিরূপণ করা তো সুদূরপরাহত। এটাই এই ধরনের মানুষের প্রকৃত অবস্থা। এই মানুষগুলির চিন্তাভাবনা ধোঁয়াশাচ্ছন্ন এবং তাদের বিশ্বাস, সহজ করে বললে, জট-পাকানো। তারা সর্বদা একটা বিহ্বল ও ভাবলেশহীন অবস্থার মধ্যে থাকে; “হতবিহ্বলতা”, “বিভ্রান্তি”, এবং “সরলচিত্ততা” হল তাদের পরিস্থিতির সংক্ষেপসার। ঈশ্বরের অস্তিত্বকে তারা কখনো দর্শনও করেনি, অনুভবও করেনি, আর তাই, তাদের সঙ্গে ঈশ্বরকে জানার বিষয়ে কথা বলাটা তাদেরকে ভিনদেশী লিপিতে লেখা একটা বই পড়তে বলার সমান যুক্তিযুক্ত– এরা তা বুঝবেও না, গ্রহণও করবে না। এদের কাছে, ঈশ্বরকে জানা ও আজগুবি গল্প শোনাটা একই বিষয়। এদের চিন্তাভাবনা যদিও ঘোলাটে হতে পারে, কিন্তু কার্যত এরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে ঈশ্বরকে জানার বিষয়টা সময় ও প্রচেষ্টার একটা চরম অপচয়। এই হল প্রথম ধরনের মানুষ: কাঁথা-কানিতে মোড়া শিশু।
দ্বিতীয় প্রকার: দুগ্ধপোষ্য শিশুর পর্যায়
একটা কাঁথা-কানিতে মোড়া শিশুর তুলনায় এই ধরনের মানুষরা কিছুটা অগ্রগতি ঘটিয়েছে। দুঃখজনকভাবে, এখনও তাদের ঈশ্বরের বিষয়ে কিছুমাত্র উপলব্ধি নেই। ঈশ্বরের বিষয়ে একটা পরিষ্কার বোধ ও অন্তর্দৃষ্টির ক্ষেত্রে এখনও তাদের ঘাটতি আছে, এবং কেন তাদের ঈশ্বরে বিশ্বাস করা উচিৎ সে বিষয়টা তাদের কাছে খুব একটা পরিষ্কার নয়, তবু তাদের অন্তরে তাদের নিজস্ব উদ্দেশ্য ও স্পষ্ট ধারণা আছে। ঈশ্বরে বিশ্বাস করাটা সমুচিত কাজ কিনা তা নিয়ে তারা নিজেদের ভাবিত করে না। ঈশ্বরে বিশ্বাসের মাধ্যমে তারা যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সন্ধান করে তা হল তাঁর অনুগ্রহ উপভোগ করা, আনন্দ ও শান্তি লাভ করা, আরামদায়ক জীবন যাপন করা, ঈশ্বরের তত্ত্বাবধান ও সুরক্ষা উপভোগ করা, এবং ঈশ্বরের আশীর্বাদের নীচে জীবন ধারণ করা। ঈশ্বরকে তারা কতটা মাত্রায় জানে তা নিয়ে তারা ভাবিত নয়; ঈশ্বরের বিষয়ে একটা উপলব্ধির সন্ধান করতে তাদের কোনো তাগিদ নেই, আর ঈশ্বর কী করছেন বা তিনি কী করতে চান তা নিয়েও তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। তাঁর অনুগ্রহ উপভোগ করার জন্য ও আরো বেশি করে তাঁর আশীর্বাদ লাভের জন্য তারা কেবল অন্ধের মতো তাঁর অনুসরণ করে; বর্তমান জীবনে একশোগুণ লাভ করা এবং আগামী সময়ে শাশ্বত জীবন লাভ করার উদ্দেশ্যে তারা অনুসরণ করে। তাদের চিন্তাভাবনা, নিজেদের তারা কতটা ব্যয়িত করে, তাদের আত্মনিবেদন এবং তাদের কষ্টভোগ – সবকিছুরই লক্ষ্য সেই এক: ঈশ্বরের অনুগ্রহ ও আশীর্বাদ লাভ করা। অন্য কোনো বিষয় নিয়ে তারা ভাবিত নয়। এই ধরনের লোকেরা যে একটিমাত্র বিষয়ে নিশ্চিত তা হল: ঈশ্বর মানুষকে নিরাপদে রাখতে পারেন এবং তাদের উপর তাঁর অনুগ্রহ সম্প্রদান করতে পারেন। বলা যেতে পারে, ঈশ্বর কেন মানুষকে উদ্ধার করতে চান অথবা তাঁর বাক্য ও কার্যের মাধ্যমে ঈশ্বর কোন ফলাফল অর্জন করতে চান সে বিষয়ে তারা কৌতূহলীও নয় এবং তাদের খুব পরিষ্কার কোনো ধারণাও নেই। ঈশ্বরের সারসত্য ও ধার্মিক প্রকৃতিকে জানার জন্য তারা কখনো কোনো প্রচেষ্টা করেনি, এবং তা করার মতো আগ্রহ চয়ন করতেও তারা অপারগ। এই সব বিষয়ে মনোযোগ দেওয়ার প্রবৃত্তির ক্ষেত্রে তাদের ঘাটতি আছে, এবং এই বিষয়গুলি জানতে তারা আগ্রহীও নয়। ঈশ্বরের কার্য, মানুষের কাছে ঈশ্বরের চাহিদা, ঈশ্বরের অভিপ্রায়, বা ঈশ্বর সম্পর্কিত অন্য কোনো বিষয়ে তারা প্রশ্ন করতে চায় না, এবং এই সকল বিষয়ে প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে তাদের আগ্রহেরও অভাব আছে। তার কারণ, তারা বিশ্বাস করে এই বিষয়গুলি তাদের ঈশ্বরের অনুগ্রহ উপভোগের সঙ্গে অসম্পর্কিত, এবং তারা কেবল সেই ঈশ্বরের বিষয়েই আগ্রহী যিনি তাদের নিজস্ব স্বার্থের সাথে প্রত্যক্ষ সম্পর্কে বিদ্যমান এবং যিনি মানুষের উপর অনুগ্রহ অর্পণ করতে পারেন। অন্য কোনো বিষয়ে তাদের কোনো আগ্রহ নেই, আর তাই, যত বছর ধরেই তারা ঈশ্বরে বিশ্বাস করুক না কেন, সত্যের বাস্তবতার মধ্যে তারা প্রবেশ করতে পারে না। বারংবার তাদের জলসিঞ্চন করা বা খাইয়ে দেওয়ার মতো কেউ যদি না থাকে, তাহলে ঈশ্বর-বিশ্বাসের পথে চলতে থাকা তাদের পক্ষে কঠিন। যদি তারা তাদের আগেকার আনন্দ ও শান্তি বা ঈশ্বরের অনুগ্রহ উপভোগ করতে না পারে, তাহলে তাদের সরে যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই প্রবল। এই হল দ্বিতীয় প্রকারের মানুষ: যে মানুষ দুগ্ধপোষ্য শিশুর পর্যায়ে অবস্থান করে।
তৃতীয় প্রকার: স্তন্যদুগ্ধ পানের অভ্যাস সদ্যো-মুক্ত শিশুর পর্যায়, বা অল্পবয়সী শিশুর পর্যায়
এই গোষ্ঠীর মানুষরা একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ স্বচ্ছ সচেতনতার অধিকারী। তারা সচেতন যে ঈশ্বরের অনুগ্রহ উপভোগ করা মানেই এই নয় যে তারা প্রকৃত অভিজ্ঞতার অধিকারী, এবং তারা এ বিষয়েও অবহিত যে, এমনকি তারা যদি আনন্দ ও শান্তির সন্ধানে, অনুগ্রহের সন্ধানে, কখনো ক্লান্তও না হয়, অথবা তারা যদি তাদের ঈশ্বরের অনুগ্রহ উপভোগের অভিজ্ঞতা অন্যদের সাথে ভাগ করে নেওয়ার মাধ্যমে বা তাদের উপর আশীর্বাদ বর্ষণের জন্য ঈশ্বরের মহিমাকীর্তনের মাধ্যমে সাক্ষ্যদানে সক্ষমও হয়, তবু এই বিষয়গুলির অর্থ এই নয় যে তারা জীবনের অধিকারী বা সত্যের বাস্তবতার অধিকারী। তাদের সম্বিতলাভের পর থেকে শুর করে, তারা এই অযৌক্তিক আশা পোষণ থেকে বিরত থাকে যে তারা কেবল ঈশ্বরের অনুগ্রহেরই সাহচর্য পাবে; বরং, ঈশ্বরের অনুগ্রহ উপভোগকালীন তারা একই সাথে ঈশ্বরের জন্যও কিছু করতে চায়। তাদের দায়িত্ব পালন করতে, কিছুটা কষ্ট ও ক্লান্তি স্বীকার করতে, ঈশ্বরের সঙ্গে কিছু মাত্রায় সহযোগিতায় রত হতে তারা ইচ্ছুক। কিন্তু, তাদের ঈশ্বর-বিশ্বাসে তাদের অনুসরণ অত্যধিক খাদযুক্ত বলে, তাদের ব্যক্তিগত অভিলাষ ও লালিত আকাঙ্খা অত্যন্ত প্রবল বলে, তাদের প্রকৃতি অসংযত রকমের উদ্ধত বলে, এদের পক্ষে ঈশ্বরের বাসনা পুরণ করা বা ঈশ্বরের অনুগত হওয়া খুবই শক্ত। তাই, বারংবার তারা তাদের ব্যক্তিগত অভিলাষ উপলব্ধি করতে পারে না বা ঈশ্বরের কাছে তাদের প্রতিশ্রুতি পালন করতে পারে না। প্রায়শই তারা নিজেদের একটা পরস্পরবিরোধী পরিস্থিতির মধ্যে আবিষ্কার করে: তারা সম্ভাব্য সর্বাধিক মাত্রায় সত্যিই ঈশ্বরকে পরিতুষ্ট করতে চায়, তবু তাঁর বিরোধিতা করতে তারা সর্বশক্তি নিয়োজিত করে, এবং তারা প্রায়ই ঈশ্বরের কাছে শপথ করে, কিন্তু অবিলম্বে তাদের প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে বসে। এর থেকেও বেশি হামেশাই তারা নিজেদের অন্য বৈপরীত্যমূলক অবস্থায় আবিষ্কার করে: তারা আন্তরিকভাবে ঈশ্বরে বিশ্বাস করে, তবু তারা তাঁকে ও তাঁর থেকে আগত সবকিছুকে অস্বীকার করে; তারা আগ্রহসহকারে প্রত্যাশা করে যে ঈশ্বর তাদের আলোকিত করবেন, পরিচালিত করবেন, রসদ যোগাবেন ও সাহায্য করবেন, কিন্তু তবু তারা তাদের নিজস্ব সমাধানের খোঁজ করে। তারা ঈশ্বরকে উপলব্ধি করতে ও জানতে চায়, তবু তাঁর নিকটে যেতে তারা অনিচ্ছুক। পরিবর্তে, তারা সর্বদা ঈশ্বরকে এড়িয়ে চলে, এবং তাঁর জন্য তাদের হৃদয়ের দরজা অবরুদ্ধ। যদিও ঈশ্বরের বাক্য ও সত্যের আক্ষরিক অর্থ বিষয়ে তাদের একটা উপরিগত উপলব্ধি ও অনুভব আছে, এবং ঈশ্বর ও সত্যের বিষয়ে একটা ভাসা-ভাসা ধারণা আছে, তবু অবচেতনভাবে তারা এখনও ঈশ্বরই সত্য কিনা তা প্রতিপন্ন বা নির্ধারণ করতে পারে না, ঈশ্বর সত্যই ধার্মিক কিনা তা-ও জোর দিয়ে বলতে পারে না। ঈশ্বরের প্রকৃতি ও সারসত্যের বাস্তবতাও তারা নির্ধারণ করতে পারে না, তাঁর প্রকৃত অস্তিত্বের কথা তো ছেড়েই দিলাম। তাদের ঈশ্বর-বিশ্বাসের মধ্যে সবসময় সংশয় ও ভ্রান্ত উপলব্ধি থাকে, এবং এর মধ্যে কল্পনা ও পূর্বধারণাও থাকে। ঈশ্বরের অনুগ্রহ উপভোগ করার সাথে সাথে, অনিচ্ছুকভাবে তারা সেরকম কিছু সত্যের অনুভব বা অনুশীলনও করে, তাদের বিশ্বাসকে সমৃদ্ধ করার জন্য, ঈশ্বর-বিশ্বাসে তাদের অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি করার জন্য, ঈশ্বর-বিশ্বাসে তাদের উপলব্ধিকে যাচাই করার জন্য, এবং তাদের নিজেদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত জীবন পথে চলার ও মানবজাতির জন্য এক ধার্মিক কর্ম-পরিকল্পনা সুসম্পন্ন করার মাধ্যমে তাদের আত্মশ্লাঘাকে পরিতৃপ্ত করার জন্য যে সত্যগুলিকে তারা সম্ভবপর বিবেচনা করে। একই সঙ্গে, আশীর্বাদ লাভের জন্য তাদের নিজস্ব বাসনাকে চরিতার্থ করতেও তারা এই কাজগুলি করে, যে বাসনা একটা বাজির অংশ, যে বাজি তারা ধরে মানুষের জন্য বৃহত্তর আশীর্বাদ লাভের আশায়, এবং ঈশ্বর-লাভ না করা পর্যন্ত বিশ্রাম না নেওয়ার তাদের যে উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও আজীবনের বাসনা তা নিষ্পন্ন করার জন্য। এই মানুষগুলি ঈশ্বরের আলোকপ্রাপ্তি লাভ করতে কদাচিৎ সমর্থ হয়, কারণ আশীর্বাদ লাভের জন্য তাদের বাসনা ও অভিপ্রায় তাদের কাছে মাত্রাতিরিক্ত রকমের গুরুত্বপূর্ণ। তা বর্জনের কোনো বাসনা তাদের নেই, এবং বস্তুত এমন কাজ করা তাদের সহ্যাতীত। তাদের ভয় এই যে আশীর্বাদ লাভের বাসনা না থাকলে, ঈশ্বরকে লাভ না করা পর্যন্ত না থামার তাদের যে দীর্ঘ-লালিত বাসনা তা না থাকলে, তারা ঈশ্বর-বিশ্বাসের প্রণোদনা হারিয়ে ফেলবে। তাই, তারা বাস্তবের মুখোমুখি হতে চায় না। তারা ঈশ্বরের বাক্য বা ঈশ্বরের কার্যের মুখোমুখি হতে চাই না। তারা ঈশ্বরের প্রকৃতি বা সারসত্যের মোকাবিলা করতে চাই না, ঈশ্বরকে জানা সংক্রান্ত বিষয়ের উল্লেখ না-ই বা করলাম। এর কারণ হল, একবার যদি ঈশ্বর, তাঁর সারসত্য ও তাঁর ধার্মিক প্রকৃতি তাদের কল্পনাকে প্রতিস্থাপিত করে, তাহলে তাদের স্বপ্ন হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে, এবং তাদের তথাকথিত বিশুদ্ধ বিশ্বাস ও বছরের পর বছর ধরে শ্রমসাধ্য কর্মের মাধ্যমে সঞ্চিত “উৎকর্ষ” অদৃশ্য হয়ে যাবে এবং কোনো কাজেই লাগবে না। একই ভাবে, তাদের “এলাকা”, বহু বছর ধরে রক্ত জল করে যা তারা জয় করেছে, তা-ও ধসে পড়ার উপক্রম হবে। এই সবকিছু ইঙ্গিত করবে যে তাদের এতো বছরের কঠোর পরিশ্রম ও প্রচেষ্টা নিষ্ফল হয়েছে, এবং তাদের আবার শূন্য থেকে শুরু করতে হবে। তাদের অন্তরে সহ্য করার পক্ষে এটা দুঃসহতম ব্যথা, এবং এরকম একটা পরিণাম দেখার কোনো বাসনা তাদের নেই, সেই কারণেই তারা সবসময় এই ধরনের একটা অচলাবস্থার মধ্যে আটকে পড়ে থাকে, ঘুরে দাঁড়াতে চায় না। এই হল তৃতীয় শ্রেণীর মানুষ: যে মানুষ স্তন্যপানের অভ্যাস থেকে সদ্যো-মুক্ত শিশুর পর্যায়ে অবস্থান করছে।
উপরে বর্ণিত তিন প্রকারের মানুষ–অর্থাৎ যে মানুষগুলি এই তিনটি পর্যায়ে অবস্থান করে–তারা ঈশ্বরের পরিচয় ও মর্যাদা বা তাঁর ধার্মিক প্রকৃতির বিষয়ে কোনো যথার্থ বিশ্বাসের অধিকারী নয়, এবং তাদের এই বিষয়গুলি সম্বন্ধে কোনো পরিষ্কার ও যথাযথ স্বীকৃতি বা অঙ্গীকারও নেই। তাই এই তিন ধরনের মানুষের পক্ষে সত্যের বাস্তবতায় প্রবেশ করা দুষ্কর, এবং তাদের পক্ষে ঈশ্বরের করুণা, আলোকপ্রাপ্তি বা প্রদীপ্তি লাভ করাও শক্ত, কারণ তাদের ঈশ্বর-বিশ্বাসের প্রণালী ও ঈশ্বরের প্রতি তাদের ভ্রান্ত মনোভাবের হেতু তাদের হৃদয়ের মধ্যে কার্য সম্পাদন তাঁর পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। ঈশ্বরের বিষয়ে তাদের সংশয়, ভ্রান্ত ধারণা ও কল্পনা তাদের ঈশ্বর-বিশ্বাস ও ঈশ্বর-জ্ঞানকে ছাপিয়ে যায়। এই তিন ধরনের মানুষরা খুব ঝুঁকির মধ্যে আছে, আর এই তিনটি খুব বিপজ্জনক পর্যায়। কেউ যখন ঈশ্বরের প্রতি, ঈশ্বরের সারসত্যের প্রতি, ঈশ্বরের পরিচয়ের প্রতি, ঈশ্বরই সত্য কিনা এই বিষয়ে এবং তাঁর অস্তিত্বের বাস্তবতা বিষয়ে একটা সংশয়ের মনোভাব বজায় রাখে, এবং এসব বিষয়ে যখন সে নিশ্চিত হতে না পারে, তাহলে কীভাবে সে ঈশ্বর থেকে আগত সবকিছুকে গ্রহণ করতে পারবে? কীভাবে সে এই সত্যকে গ্রহণ করতে পারবে যে ঈশ্বরই সত্য, পথ ও জীবন? কীভাবে সে ঈশ্বরের শাস্তি ও বিচারকে গ্রহণ করতে সমর্থ হবে? কেমন করে সে ঈশ্বরের পরিত্রাণকে স্বীকার করতে পারবে? এই প্রকারের মানুষ কেমন করে ঈশ্বরের যথার্থ পথনির্দেশ ও সরবরাহ লাভ করতে পারে? এই তিনটি পর্যায়ে যারা অবস্থান করছে তারা যে কোনো সময় ঈশ্বরের বিরোধিতা, ঈশ্বরের বিষয়ে মতামত জ্ঞাপন, ঈশ্বরের নিন্দা বা ঈশ্বরকে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে। যে কোনো মুহূর্তে তারা প্রকৃত পথ পরিত্যাগ এবং ঈশ্বরকে বর্জন করতে পারে। বলা যায়, এই তিনটি পর্যায়ের মানুষ একটা সঙ্কটজনক সময়সীমায় অবস্থান করে, কারণ তারা ঈশ্বর-বিশ্বাসের যথার্থ গতিপথে প্রবেশ করেনি।
চতুর্থ প্রকার: বিকাশমান শিশুর পর্যায়, বা বাল্যকাল
একজন মানুষকে স্তন্যপানের অভ্যাস ত্যাগ করানোর পর–অর্থাৎ, তারা যথেষ্ট পরিমাণে ঈশ্বরের অনুগ্রহ করে ফেলার পর–তারা ঈশ্বরে বিশ্বাস করার অর্থ কী তার অনুসন্ধান শুরু করে, তারা বিভিন্ন প্রশ্ন উপলব্ধি করার ইচ্ছা দেখাতে শুরু করে, যেমন মানুষ কেন জীবনধারণ করে, কীভাবে মানুষের জীবন যাপন করা উচিৎ, এবং ঈশ্বর কেন মানুষের উপর তাঁর কার্য সম্পাদন করেন। যখন এইসব অপরিষ্কার চিন্তা ও বিভ্রান্ত চিন্তা-ছক তাদের মধ্যে উদ্ভূত হয় এবং তাদের মধ্যে অবস্থান করে, তখন তারা ক্রমাগত জলসিঞ্চন প্রাপ্ত হয়, এবং তারা তাদের কর্তব্যও পালন করতে সমর্থ হয়। এই সময়কালে, ঈশ্বরের অস্তিত্বের বাস্তবিকতা বিষয়ে তাদের আর কোনো সন্দেহ থাকে না, এবং ঈশ্বরে বিশ্বাস করার অর্থ কী, এ-বিষয়ে তাদের একটা যথাযথ ধারণা থাকে। এই ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে তারা একটা ধারাবাহিক ঈশ্বর-জ্ঞান লাভ করে, এবং ক্রমশ ঈশ্বরের প্রকৃতি ও সারসত্য বিষয়ে তাদের অপরিষ্কার চিন্তা ও বিভ্রান্ত চিন্তা-নকশার কিছু কিছু উত্তর তারা পায়। তাদের প্রকৃতির পরিবর্তন ও তাদের ঈশ্বর-জ্ঞানের পরিপ্রেক্ষিতে, এই পর্যায়ের মানুষ সঠিক পথে পা ফেলতে শুরু করে, এবং তারা একটা ক্রান্তিকালের মধ্যে প্রবেশ করে। এই পর্যায়েই মানুষ জীবনের অধিকারী হতে আরম্ভ করে। জীবনের অধিকারী হওয়ার পরিষ্কার লক্ষণগুলি হল ভ্রান্ত উপলব্ধি, কল্পনা, পূর্বধারণা ও ঈশ্বরের অস্পষ্ট সংজ্ঞা প্রমুখ ঈশ্বর-জ্ঞান সংক্রান্ত যে বিবিধ প্রশ্নাবলী মানুষের হৃদয়ে থাকে তাদের ক্রমিক সমাধান, এবং তারা যে শুধু ঈশ্বরের অস্তিত্বের বাস্তবতাকে যথার্থই বিশ্বাস ও সনাক্ত করে ফেলে তাই নয়, সেই সাথে তারা ঈশ্বরের একটা যথাযথ সংজ্ঞাও লাভ করে ফেলে, এবং তাদের অন্তরে ঈশ্বরের জন্য যথার্থ স্থানটি থাকে, এবং ঈশ্বরের প্রকৃত অনুসরণ তাদের অস্পষ্ট বিশ্বাসকে প্রতিস্থাপিত করে। এই পর্যায়ে এসে মানুষ ঈশ্বর সম্পর্কিত তাদের ভ্রান্ত ধারণাগুলির বিষয়ে, এবং তাদের ভ্রান্ত অনুসরণ ও বিশ্বাস-প্রণালী বিষয়ে ক্রমশ অবগত হয়। তারা সত্যকে জানার জন্য, ঈশ্বরের বিচার, শোধন ও অনুশাসনের অভিজ্ঞতা লাভের জন্য এবং তাদের প্রকৃতির পরিবর্তন সাধনের জন্য আকুলভাবে লালায়িত হতে শুরু করে। এই পর্যায়কালে তারা ক্রমশ ঈশ্বর বিষয়ে সকল প্রকার পূর্বধারণা ও কল্পনাকে বর্জন করে, এবং একই সাথে তারা তাদের ত্রুটিপূর্ণ ঈশ্বর-জ্ঞানকে পরিবর্তিত ও সংশোধিত করে এবং ঈশ্বর বিষয়ে কিছু যথাযথ মৌলিক জ্ঞান লাভ করে। যদিও এই পর্যায়ের মানুষের অর্জিত জ্ঞানের একটি অংশ খুব নির্দিষ্ট বা যথাযথ নয়, কিন্তু অন্তত পক্ষে তারা ক্রমশ তাদের পূর্বধারণা, ভ্রান্ত জ্ঞান, এবং ঈশ্বর বিষয়ে ভ্রান্ত উপলব্ধিকে পরিত্যাগ করতে শুরু করে; আর তারা ঈশ্বর বিষয়ে তাদের নিজস্ব পূর্বধারণা ও কল্পনাকে বহাল রাখেনা। কীভাবে পরিত্যাগ করতে হয় তারা সেই শিক্ষা শুরু করে–তাদের নিজেদের পূর্বধারণার মধ্যে নিহিত বিষয়, জ্ঞান থেকে প্রাপ্ত বিষয়, এবং শয়তানের কাছ থেকে প্রাপ্ত বিষয়কে পরিত্যাগ করতে শেখে; তারা যথাযথ ও ইতিবাচক বিষয়ের কাছে সমর্পন করতে আগ্রহী হতে শুরু করে, এমনকি সেইসব বিষয়ের কাছেও যা ঈশ্বরের বাক্য থেকে আসে এবং যা সত্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। তারা ঈশ্বরের বাক্যকে উপলব্ধির, ব্যক্তিগতভাবে তাঁর বাক্যকে জানার ও পালন করার, তাদের ক্রিয়াকর্মের নীতি হিসাবে ও তাদের প্রকৃতি পরিবর্তনের ভিত্তি হিসাবে তাঁর বাক্যকে গ্রহণ করার প্রচেষ্টা শুরু করে। এ সময়, মানুষ অচেতনভাবে ঈশ্বরের বিচার ও শাস্তিকে গ্রহণ করে, এবং তাদের অজান্তেই ঈশ্বরের বাক্যকে তাদের জীবন হিসাবে মেনে নেয়। যখন তারা ঈশ্বরের বিচার, শাস্তি, ও বাক্যকে মেনে নেয়, তারা উত্তরোত্তর আরো সচেতন হয়ে ওঠে এবং অনুভব করতে সমর্থ হয় যে তাদের অন্তরে যে ঈশ্বরকে তারা বিশ্বাস করে তিনি প্রকৃতই অস্তিমান। ঈশ্বরের বাক্যে, তাদের অভিজ্ঞতায় ও জীবনে, তারা উত্তরোত্তর আরো বেশি করে অনুভব করে যে ঈশ্বর সততই মানুষের নিয়তির উপর পৌরোহিত্য করেছেন এবং সর্বদাই মানুষকে পরিচালিত করেছেন ও রসদ যুগিয়েছেন। ঈশ্বরের সাথে তাদের সাহচর্যের মাধ্যমে তারা ধীরে ধীরে ঈশ্বরের অস্তিত্বকে প্রতিপন্ন করে। তাই, তারা উপলব্ধি করার আগেই, ইতিমধ্যেই তারা অবচেতনভাবে ঈশ্বরের কার্যকে অনুমোদন করে ফেলেছে ও তাতে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, এবং তারা ঈশ্বরের বাক্যকেও অনুমোদন করেছে। মানুষ একবার ঈশ্বরের বাক্য ও কার্যকে অনুমোদন করে ফেললে, তারা অবিরত নিজেদেরকে অস্বীকার করতে থাকে, তাদের নিজস্ব পূর্বধারণাকে অস্বীকার করে, তাদের নিজস্ব জ্ঞানকে অস্বীকার করে, তাদের নিজস্ব কল্পনাকে অস্বীকার করে, এবং একই সঙ্গে অবিরত তারা সত্য কী এবং ঈশ্বরের অভিপ্রায় কী তার সন্ধানও করে চলে। বিকাশের এই সময়কালে ঈশ্বরের বিষয়ে মানুষের জ্ঞান বেশ অগভীর–এমনকি এই জ্ঞানকে তারা বাক্যের সাহায্যে পরিষ্কারভাবে বিস্তারিত করতেও অসমর্থ, এবং সুনির্দিষ্ট অনুপুঙ্খ সহযোগে একে তারা ব্যক্ত করতেও পারে না–এবং তাদের কেবলমাত্র একটা প্রত্যক্ষকরণ-ভিত্তিক উপলব্ধি থাকে; কিন্তু, পূর্বোক্ত তিনটি পর্যায়ের পাশাপাশি রাখলে, এই সময়কালে মানুষের অপরিণত জীবন ইতিমধ্যেই জলসিঞ্চন ও ঈশ্বরের বাক্যের সরবরাহ লাভ করেছে, এবং এইভাবে ইতিমধ্যেই অঙ্কুরিত হতে শুরু করেছে। তাদের জীবন মাটিতে প্রোথিত একটি বীজের মতো; আর্দ্রতা ও পুষ্টি-উপাদান পাওয়ার পর তা মাটি ভেদ করে বেরিয়ে আসে, এবং এই অঙ্কুরোদ্গম একটা নতুন জীবনের আবির্ভাবকে সূচিত করবে। এই জন্মগ্রহণ কোনো ব্যক্তিকে জীবনের লক্ষণগুলিক এক ঝলক দেখতে দেয়। মানুষের জীবন থাকলে তারা বৃদ্ধি পায়। তাই, এই বুনিয়াদের উপর দাঁড়িয়ে–ঈশ্বর-বিশ্বাসের সঠিক পথরেখার দিকে ক্রমশ অগ্রসর হয়ে, তাদের নিজস্ব পূর্বধারণা পরিত্যাগ করে, ঈশ্বরের পথনির্দেশিকা প্রাপ্ত হয়ে–মানুষের জীবন অবধারিতভাবে একটু একটু করে বিকশিত হবে। কীসের ভিত্তিতে এই বিকাশ পরিমাপ করা হয়? এর পরিমাপ করা হয় ঈশ্বরের বাক্য বিষয়ে মানুষের অভিজ্ঞতা ও ঈশ্বরের ধার্মিক প্রকৃতি বিষয়ে তাদের প্রকৃত উপলব্ধি অনুসারে। যদিও বিকাশের এই সময়কালে ঈশ্বর ও তাঁর সারসত্যের বিষয়ে তাদের জ্ঞান তাদের নিজেদের ভাষায় যথাযথভাবে বর্ণনা করাটা তাদের কাছে খুব দুষ্কর মনে হয়, তবু এই গোষ্ঠীর লোকেরা বিষয়গতভাবে আর ঈশ্বরের অনুগ্রহ উপভোগের মাধ্যমে আনন্দের সন্ধান করতে, বা ঈশ্বরের অনুগ্রহ লাভের লক্ষ্যে তাদের নিজস্ব উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য ঈশ্বরে বিশ্বাস করতে আগ্রহী থাকে না। পরিবর্তে, তারা ঈশ্বরের বাক্যের দ্বারা যাপিত একটা জীবনের অনুসরণ করতে এবং ঈশ্বরের পরিত্রাণের পাত্রে পরিণত হতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। উপরন্তু, তারা ঈশ্বরের বিচার ও শাস্তি গ্রহণ করার বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী ও প্রস্তুত। এটাই বিকাশমান পর্যায়ের কোনো মানুষের বৈশিষ্ট্যসূচক লক্ষণ।
যদিও এই পর্যায়ের মানুষদের ঈশ্বরের ধার্মিক প্রকৃতি বিষয়ে কিছু জ্ঞান থাকে, কিন্তু এই জ্ঞান খুবই আবছা ও অস্পষ্ট। যদিও এই বিষয়গুলিকে পরিষ্কারভাবে তারা বিশদ করতে পারে না, কিন্তু তারা অনুভব করে যে অভ্যন্তরীনভাবে তারা ইতিমধ্যেই কিছু জিনিস অর্জন করেছে, কারণ তারা ঈশ্বরের শাস্তি ও বিচারের মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের ধার্মিক প্রকৃতির বিষয়ে কিছু পরিমাণ জ্ঞান ও উপলব্ধি লাভ করেছে। কিন্তু, এই সমস্তই কতকটা ভাসা-ভাসা, এবং এখনও তা একটা প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। এই গোষ্ঠীর লোকদের একটা নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি আছে যা দিয়ে তারা ঈশ্বরের অনুগ্রহকে বিচার করে, যা তাদের অনুসরণের লক্ষ্যবস্তু ও তাদের অনুসরণ করার পদ্ধতির পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে অভিব্যক্ত হয়। ঈশ্বরের বাক্য ও কার্যের মধ্যে, মানুষের কাছ থেকে তাঁর বিবিধ চাহিদার মধ্যে এবং মনুষ্য বিষয়ক তাঁর উদ্ঘাটনের মধ্যে তারা ইতিমধ্যেই দেখেছে যে, এখনও যদি তারা সত্যের অনুসরণ না করে, এখনো যদি বাস্তবতার মধ্যে প্রবেশ করতে না চায়, তাঁর বাক্য উপলব্ধির সাথে সাথে এখনো যদি তারা ঈশ্বরকে সন্তুষ্ট করতে ও তাঁকে জানতে না চায়, তাহলে তারা ঈশ্বর-বিশ্বাসের অর্থই হারিয়ে ফেলবে। তারা লক্ষ্য করে যে, যতই তারা ঈশ্বরের অনুগ্রহ উপভোগ করুক না কেন, তাদের প্রকৃতির পরিবর্তন করতে ও ঈশ্বরকে সন্তুষ্ট করতে বা জানতে তারা অসমর্থ, এবং মানুষ যদি অবিরত ঈশ্বরের অনুগ্রহের অধীন হয়ে বাস করে, তাহলে কখনোই তারা বিকাশ অর্জন করবে না, জীবন লাভ করবে না, বা পরিত্রাণ লাভে সমর্থ হবে না। সারসংক্ষেপে, একজন মানুষ যদি ঈশ্বরের বাক্যকে যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে না পারে এবং তাঁর বাক্যের মধ্য দিয়ে ঈশ্বরকে জানতে অসমর্থ হয়, তাহলে তারা চিরকাল শিশুর পর্যায়েই থেকে যাবে এবং তাদের জীবনের বিকাশের পথে কখনো একটিও অগ্রগামী পদক্ষেপ নিতে পারবে না। তুমি যদি চিরটা কাল শিশুর পর্যায়ে অবস্থান করো, তুমি যদি ঈশ্বরের বাক্যের বাস্তবতার মধ্যে কখনো প্রবেশ না করো, ঈশ্বরের বাক্যকে তুমি কখনো যদি তোমার জীবন হিসাবে না পাও, কখনো যদি তুমি ঈশ্বর বিষয়ে প্রকৃত বিশ্বাস ও জ্ঞানের অধিকারী না হও, তাহলে কি তোমার ঈশ্বরের দ্বারা সম্পূর্ণ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে? তাই, যে ব্যক্তি ঈশ্বরের বাক্যের বাস্তবতার মধ্যে প্রবেশ করে, যে ব্যক্তি ঈশ্বরের বাক্যকে তাদের জীবন হিসাবে গ্রহণ করে, যে ব্যক্তি ঈশ্বরের শাস্তি ও বিচারকে গ্রহণ করতে শুরু করে, যে ব্যক্তির ভ্রষ্ট স্বভাব পরিবর্তিত হতে শুরু করে, এবং যে ব্যক্তির সত্যকে জানতে ব্যাকুল একটি হৃদয় আছে, ঈশ্বরকে জানার জন্য ও ঈশ্বরের পরিত্রাণ গ্রহণ করার জন্য যার বাসনা আছে, তারাই সেই মানুষ যারা প্রকৃতই জীবনের অধিকারী। এরাই সত্যিকারের চতুর্থ শ্রেণীর মানুষ, বিকাশমান শিশুর শ্রেণীর মানুষ, বাল্যাবস্থার পর্যায়ের মানুষ।
পঞ্চম প্রকার: জীবনের পূর্ণবিকাশের পর্যায়, বা সাবালক পর্যায়
পৌনঃপুনিক উত্থান-পতনে পূর্ণ বিকাশের পর্যায়, অর্থাৎ শৈশবের পর্যায়ের মধ্য দিয়ে অভিজ্ঞতালাভ ও টলোমলো পায়ে হাঁটার পর, মানুষের জীবন স্থিতিশীল হয়ে ওঠে, তাদের সম্মুখমুখী পদক্ষেপ আর কখনো থামে না, এবং কেউ তাদের পথরোধ করতে সক্ষম হয় না। যদিও সম্মুখবর্তী পথ এখনও অমসৃণ ও বন্ধুর, কিন্তু তারা আর দুর্বল বা ভীত-সন্ত্রস্ত নয়, এবং তারা আর হাতড়ে-হাতড়ে অগ্রসর হয় না বা উদ্দেশ্য-চ্যুত হয় না। তাদের ভিত্তি ঈশ্বরের বাক্যের বাস্তব অভিজ্ঞতার অভ্যন্তরে গভীরে প্রোথিত, এবং তাদের হৃদয় ঈশ্বরের আত্মমর্যাদা ও মহত্ত্বের দ্বারা আকৃষ্ট হয়েছে। ঈশ্বরের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে, ঈশ্বরের সারসত্যকে জানতে, ঈশ্বরের বিষয়ে সকলকিছু জানতে তারা ব্যাকুল।
এই পর্যায়ে মানুষ ইতিমধ্যেই স্পষ্টভাবে জানে তারা কাকে বিশ্বাস করে, এবং তারা পরিষ্কার ভাবে জানে কেন তাদের ঈশ্বরে বিশ্বাস করা উচিৎ এবং তাদের নিজেদের জীবনের অর্থ কী, এবং তারা এটাও স্পষ্ট করে জানে যে ঈশ্বর যাকিছু অভিব্যক্ত করে তা সত্য। তাদের অনেক বছরের অভিজ্ঞতায় তারা উপলব্ধি করে যে ঈশ্বরের বিচার ও শাস্তি ছাড়া কোনো মানুষ কখনো ঈশ্বরকে সন্তুষ্ট করতে বা জানতে সমর্থ হবে না, এবং কখনো যথার্থ অর্থে ঈশ্বরের সম্মুখে উপস্থিত হতে পারবে না। এই মানুষগুলির অন্তরে ঈশ্বরের দ্বারা পরীক্ষিত হওয়ার একটি প্রবল বাসনা আছে, যাতে পরীক্ষিত হওয়ার সময় তারা ঈশ্বরের ধার্মিক প্রকৃতি দর্শন করতে পারে, এক বিশুদ্ধতর ভালোবাসা অর্জন করতে পারে, এবং একই সাথে আরো যথার্থভাবে ঈশ্বরকে বুঝতে ও জানতে সক্ষম হয়। এই পর্যায়ে এসে মানুষ ইতিমধ্যেই শৈশব দশাকে এবং ঈশ্বরের অনুগ্রহ উপভোগের ও তাদের উদরপূর্তি করে খাদ্য গ্রহণের দশাকে সম্পূর্ণ বিদায় জানিয়েছে। ঈশ্বরকে সহনশীল করে তোলার ও তাদের প্রতি করুণা প্রদর্শন করানোর বিষয়ে এখন আর তারা কোনো অসংযত আশা পোষণ করে না; বরং ঈশ্বরের অবিরাম শাস্তি ও বিচার গ্রহণ ও প্রত্যাশা করার বিষয়ে তারা আত্মবিশ্বাসী, যাতে তারা তাদের ভ্রষ্ট স্বভাব থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করতে ও ঈশ্বরকে সন্তুষ্ট করতে পারে। তাদের ঈশ্বর-জ্ঞান ও তাদের অনুসরণ, বা তাদের অনুসরণের অন্তিম লক্ষ্য, সবকিছুই তাদের অন্তরে অতি স্পষ্ট। তাই, প্রাপ্তবয়স্ক দশার মানুষ ইতিমধ্যেই সম্পূর্ণভাবে বিদায় জানিয়েছে অনিশ্চিত বিশ্বাসের পর্যায়কে, সেই পর্যায়কে যখন পরিত্রাণের জন্য তারা অনুগ্রহের উপর নির্ভর করে, অপরিণত জীবনের সেই পর্যায়কে যা বিচার সহ্য করে টিকে থাকতে পারে না, আলস্যের পর্যায়কে, অসহায়ভাবে হাতড়ে বেড়ানোর পর্যায়কে, সেই পর্যায়কে যখন প্রায়শই চলার কোনো পথ থাকে না, আকস্মিক উষ্ণতা ও শৈত্যের মধ্যে পর্যাবৃত্তির সেই অস্থির সময়কালকে, এবং সেই পর্যায়কে যখন একজন মানুষ তাঁর চক্ষুদ্বয়কে আচ্ছাদিত রেখে ঈশ্বরের অনুসরণ করে। এই ধরনের মানুষ প্রায়শই ঈশ্বরের আলোকপ্রাপ্তি ও প্রদীপ্তি লাভ করে, এবং প্রায়শই ঈশ্বরের সাথে প্রকৃত সাহচার্য ও যোগাযোগে নিরত হয়। বলা যেতে পারে, এই পর্যায়ে অবস্থানকারী মানুষ ইতিমধ্যেই ঈশ্বরের অভিপ্রায়ের কিয়দংশ উপলব্ধি করেছে, তারা যা কিছু করে তাদের মধ্যে সত্যের নীতি খুঁজে পেতে সমর্থ হয়, এবং তারা জানে কীভাবে ঈশ্বরের আকাঙ্খাকে পূরণ করতে হয়। তদুপরি, তারা ঈশ্বরকে জানার পথও খুঁজে পেয়েছে এবং তাদের ঈশ্বর-জ্ঞানের সাক্ষ্যদান শুরু করেছে। ক্রমিক বিকাশের প্রক্রিয়া চলাকালীন তারা ঈশ্বরের অভিপ্রায় বিষয়ে একটা ধারাবাহিক উপলব্ধি ও জ্ঞান লাভ করে: মানব সৃষ্টির পিছনে ঈশ্বরের অভিপ্রায় বিষয়ে, এবং মানুষকে পরিচালনার ক্ষেত্রে ঈশ্বরের অভিপ্রায় বিষয়ে। একই সঙ্গে তারা ধীরে-ধীরে সারসত্যের পরিপ্রেক্ষিতে ঈশ্বরের ধার্মিক স্বভাবের বিষয়ে উপলব্ধি ও জ্ঞানও অর্জন করে। কোনো মানবিক ধারণা বা কল্পনা এই জ্ঞানকে প্রতিস্থাপিত করতে পারে না। যদিও একথা বলা যায় না যে, পঞ্চম পর্যায়ে উত্তীর্ণ এক ব্যক্তির জীবন পূর্ণবিকশিত অথবা মানুষটি ধার্মিক বা সম্পূর্ণ, কিন্তু তবু এই ধরনের মানুষ ইতিমধ্যেই জীবনের পূর্ণবিকাশের পর্যায়ের দিকে একটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে এবং ইতিমধ্যেই ঈশ্বরের সম্মুখে উপনীত হতে, ঈশ্বরের বাক্যের ও ঈশ্বরের মুখোমুখি দাঁড়াতে সক্ষম। এই ধরনের মানুষগুলি যেহেতু ঈশ্বরের প্রভূত বাক্যের অভিজ্ঞতা লাভ করেছে, অসংখ্য পরীক্ষার অভিজ্ঞতা লাভ করেছে এবং ঈশ্বরের কাছ থেকে অগণন অনুশাসন, বিচার ও শাস্তির ঘটনার অভিজ্ঞতা লাভ করেছে, তাই ঈশ্বরের কাছে তাদের সমর্পণ আপেক্ষিক নয়, বরং চূড়ান্ত। তাদের ঈশ্বর-জ্ঞান অবচেতন থেকে স্বচ্ছ ও সম্যক জ্ঞানে, ভাসা-ভাসা থেকে সুগভীর জ্ঞানে, ঝাপসা ও অস্পষ্ট থেকে যথাযথ ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞানে রূপান্তরিত হয়েছে। তারা কষ্টসাধ্য হাতড়ে বেড়ানো ও নিষ্ক্রিয় অনুসন্ধান থেকে সাবলীল প্রজ্ঞা ও উদ্যমী সাক্ষ্যদানের দিকে অগ্রসর হয়েছে। বলা যায়, এই পর্যায়ের মানুষ ঈশ্বরের বাক্যের সত্যের বাস্তবতার অধিকারী, পিতর যে পথে চলেছিল নিখুঁত হওয়ার সেরকমই একটা পথে তারা পদার্পণ করেছে। এরা পঞ্চম প্রকারের মানুষ, যারা একটি পূর্ণবিকাশের দশায় অবস্থান করে–সাবালক পর্যায়ে।
ডিসেম্বর ১৪, ২০১৩