অধ্যায় ১৪
ঈশ্বরের বাক্য থেকে মানুষ কিছুই অনুধাবন করে উঠতে পারে নি। পরিবর্তে, নিছক উপরিগতভাবে তারা সেগুলিকে “মূল্যবান জ্ঞান করে”, বাক্যগুলির প্রকৃত অর্থ উপলব্ধি না করেই। তাই, অধিকাংশ মানুষ তাঁর উচ্চারণসমূহের অনুরাগী হওয়া সত্ত্বেও, তিনি সুনির্দিষ্টভাবে জানিয়েছেন যে, তারা তাঁর বাক্যকে বস্তুত লালন করে না। এর কারণ হল, ঈশ্বরের দৃষ্টিতে, যদিও তাঁর বাক্য মহার্ঘ, কিন্তু মানুষ সেগুলির প্রকৃত মিষ্টত্ব আস্বাদন করেনি। সেই অর্থে, তারা শুধুমাত্র “অলীক রসালো আলুবোখারা ফলের কথা চিন্তা করেই তাদের তৃষ্ণা নিবারণ করতে পারে,” এবং এইভাবে তাদের লোভাতুর হৃদয়কে প্রশমিত করতে পারে। সকল মানুষের মধ্যে ঈশ্বরের আত্মাই শুধু যে কর্মরত তা নয়, বরং একই সাথে অবশ্যই ঈশ্বরের বাক্যের মাধ্যমেই তাদের আলোকপ্রাপ্তিও মঞ্জুর করা হয়; কিন্তু সমস্যাটি হল, তারা এতই উদাসীন যে তাঁর বাক্যের সারসত্যের যথার্থ মর্মোদ্ধার করতে তারা অপারগ। মানুষ মনে করছে, এখনই বুঝি সেই যুগ সমাগত যখন রাজ্য সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত হচ্ছে, কিন্তু কার্যত, বিষয়টা তেমন নয়। যদিও ঈশ্বর শুধু সেই বিষয়েই ভবিষ্যদ্বাণী করেন যা তিনি সম্পন্ন করেছেন, তবু প্রকৃত রাজ্য এখনও পরিপূর্ণরূপে পৃথিবীর বুকে আবির্ভূত হয় নি। পরিবর্তে, মানুষ যত পরিবর্তিত হবে, কাজ যত অগ্রসর হবে, এবং পূর্বদিকে যখন বজ্রালোক চমকিত হবে—অর্থাৎ, ঈশ্বরের বাক্য যত গভীরতর হবে—পৃথিবীর বুকে রাজ্য ধীরে ধীরে বাস্তবায়িত হবে, এই বিশ্বে তা ক্রমশ কিন্তু পূর্ণত অবতরণ করবে। রাজ্যের আবির্ভাবের প্রক্রিয়াটি একই সাথে পৃথিবীর বুকে ঐশ্বরিক কার্যেরও প্রক্রিয়া। ইতিমধ্যে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড জুড়ে, ঈশ্বর এমন এক কার্য আরম্ভ করেছেন যা সমগ্র ইতিহাসের কোনো যুগে কখনো সম্পাদিত হয়নি: সমগ্র পৃথিবীকে পুনঃসংগঠিত করার কাজ। উদাহরণস্বরূপ, ব্রহ্মাণ্ড জুড়ে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে চলেছে, যার অন্তর্ভুক্ত হল ইসরায়েল রাষ্ট্রে পরিবর্তন, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে সশস্ত্র অভ্যুত্থান, মিশরে পরিবর্তন, সোভিয়েত যুক্তরাজ্যে পরিবর্তন, এবং চিনদেশে শাসকদলের ক্ষমতাচ্যুতি। সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড যখন সুস্থিত হয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় প্রত্যাবর্তন করবে, পৃথিবীর বুকে ঈশ্বরের কার্য সমাধা হবে; অর্থাৎ তখনই পৃথিবীতে রাজ্যের আবির্ভাব ঘটবে। এই হল নিম্নোদ্ধৃত বাক্যসমূহের প্রকৃত অর্থ: “যখন পৃথিবীর সকল রাষ্ট্র বিপর্যস্ত হয়ে যাবে, ঠিক তখনই আমার রাজ্য প্রতিষ্ঠিত ও রূপায়িত হবে, এবং তখনই আমি রূপান্তরিত হবো ও সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সম্মুখীন হতে ঘুরে দাঁড়াবো।” মানুষের কাছ থেকে ঈশ্বর কিছুই গোপন করেন না; মানুষকে তিনি অবিরাম তাঁর সকল প্রাচুর্যের বিষয়ে জ্ঞাত করেছেন—তবু তিনি কী বলতে চাইছেন তা তারা বুঝে উঠতে পারে না, এবং নিছক মূর্খের মতো তাঁর বাক্যকে গ্রহণ করে যায়। কার্যের এই পর্যায়ে এসে, মানুষ ঈশ্বরের দুর্জ্ঞেয়তার বিষয়ে জানতে পেরেছে এবং, উপরন্তু, তাঁকে উপলব্ধি করার কাজে অসুবিধার বিষয়টিও অনুধাবন করতে পারে; এই কারণে, তারা অনুভব করেছে যে, বর্তমান সময়ে, ঈশ্বরে বিশ্বাস করাটা কঠিনতম কাজ, শূকরকে গান শেখানোর মতোই দুরূহ। জাঁতাকলে আটকে পড়া ইঁদুরের মতোই তারা সম্পূর্ণ অসহায়। বস্তুত, একজন মানুষের যত ক্ষমতাই থাক না কেন, বা তার দক্ষতা যত সুনিপুণই হোক, কিংবা মানুষটি অসীম সামর্থ্যের অধিকারী হোক বা না হোক, যখন ঈশ্বরের বাক্যের প্রসঙ্গ আসে, তখন এই ধরনের বিষয়গুলি অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়। মনে হয় ঈশ্বরের নজরে মানুষ যেন অগ্নিদগ্ধ কাগজের ভস্মস্তূপ ব্যতীত আর কিছু নয়—আদ্যোপান্ত মূল্যহীন, উপযোগিতার বিষয়ে তো না বলাই শ্রেয়। এই হল নিম্নলিখিত বাক্যের সম্যক অর্থের যথার্থ ব্যাখ্যা: “তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে, আমি ক্রমাগত আরো বেশি প্রচ্ছন্ন ও উত্তরোত্তর আরো বেশি দুর্জ্ঞেয় হয়ে ঊঠেছি।” এর থেকে এমনটা স্পষ্টতই প্রতীয়মান যে ঈশ্বরের কার্য একটা স্বাভাবিক ক্রমোন্নয়ন অনুসরণ করে, এবং মানুষের প্রত্যক্ষকরণ কার্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অঙ্গগুলির গ্রহণক্ষমতা অনুযায়ী তা সম্পন্ন হয়। মানুষের প্রকৃতি যখন সুদৃঢ় ও অটল, ঈশ্বরের উচ্চারিত বাক্যগুলি তখন তাদের পূর্বধারণার সম্পূর্ণ অনুবর্তী হয়, এবং এই ধারণাগুলিকে ঈশ্বরের সঙ্গে প্রায় সুসঙ্গত মনে হয়, ন্যূনতম পার্থক্যও পরিলক্ষিত হয় না। এর ফলে মানুষ “ঈশ্বরের বাস্তবতা” বিষয়ে কিছুটা সচেতন হয়ে ওঠে, কিন্তু এটি তাঁর প্রাথমিক লক্ষ্য নয়। পৃথিবীর বুকে তাঁর প্রকৃত কার্য আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করার পূর্বে মানুষকে তিনি সুস্থিত হওয়ার একটা অবকাশ দিচ্ছেন। তাই, মানুষের কাছে অতি বিভ্রান্তিকর এই প্রারম্ভিক কার্য চলাকালীন সময়ে, তারা উপলব্ধি করছে যে তাদের পূর্ববর্তী ধারণাগুলি ভ্রান্ত ছিল এবং ঈশ্বর ও মানুষ স্বর্গ ও পৃথিবীর মতোই পৃথক, বিন্দুমাত্রও অনুরূপ নয়। ঈশ্বরের বাক্যকে যেহেতু আর মানুষের পূর্বধারণার ভিত্তিতে মূল্যয়ন করা যায় না, তাই মানুষ তৎক্ষণাৎ ঈশ্বরকে এক নতুন আলোয় দেখতে শুরু করেছে; ফলস্বরূপ, তারা বিস্ময়াভিভূত হয়ে ঈশ্বরের দিকে তাকায়, যেন বাস্তববাদী ঈশ্বর এক অদৃশ্য ও ধরাছোঁয়ার অতীত ঈশ্বরের মতোই সমান অনধিগম্য, এবং যেন ঈশ্বরের অবতারের দেহ নিছক এক বাহ্যিক খোলসমাত্র, এর মধ্যে তাঁর সারসত্যের কণামাত্র নেই। যদিও তিনি আত্মার এক অবতাররূপ, তবু যে কোনো সময় তিনি আত্মারূপে রূপান্তরিত হয়ে হাওয়ায় ভেসে চলে যেতে পারেন; সেই কারণেই মানুষ কিছুটা সতর্ক ও সংবৃত মানসিকতা অবলম্বন করেছে। ঈশ্বরের নামোচ্চারণ মাত্র, তারা তাঁকে তাদের পূর্বধারণার দ্বারা সজ্জিত করে তোলে, দাবি করে যে তিনি মেঘ ও কুয়াশার উপর চড়ে বসতে পারেন, জলের উপর দিয়ে হাঁটতে পারেন, এবং মানুষের মধ্যিখানে অকস্মাৎ আবির্ভূত ও অন্তর্হিত হতে পারেন। অন্য কিছু মানুষ তো আরো বর্ণনাত্মক ব্যাখ্যা দিয়ে থাকে। মানুষের অজ্ঞতা ও অন্তর্দৃষ্টির অভাবের কারণে, ঈশ্বর বলেছিলেন, “তাদের যখন মনে হয় যে তারা আমায় প্রতিরোধ করেছে বা আমার প্রশাসনিক ফরমানসমূহ লঙ্ঘন করেছে, তখনো আমি না দেখার ভান করি।”
ঈশ্বর মানুষের কুৎসিত মুখাবয়ব ও তাদের অভ্যন্তরীন জগতকে অভ্রান্ত যথার্থতা সহকারে প্রকাশিত করেছেন, কখনো তাঁর অভীষ্ট লক্ষ্য থেকে তিলমাত্র বিচ্যুত হননি। এমনকি এমনটাও বলা যায় যে, তিনি কখনো কোনোপ্রকার ভ্রান্তি করেননি। এই প্রমাণই মানুষকে সম্পূর্ণরূপে প্রতীত করেছে। তাঁর কার্যের নিহিত নীতির কারণে, তাঁর অনেক বাক্য ও ক্রিয়াকলাপ অমোচনীয় এক ছাপ রেখে যায়, এবং সেই কারণেই মানুষ তাঁর সম্বন্ধে গভীরতর এক উপলব্ধি লাভ করে বলে মনে হয়, যেন তারা তাঁর মধ্যে আরো মহার্ঘ কিছু আবিষ্কার করেছে। “তাদের স্মৃতিতে, হয় আমি এমন এক ঈশ্বর যিনি শাস্তি প্রদান করার পরিবর্তে মানুষের প্রতি করুণা প্রদর্শন করেন, নয়তো আমি স্বয়ং ঈশ্বর যাঁর নিজের বাক্যের প্রতিই কোনো দায়বদ্ধতা নেই। এসবই মানুষের চিন্তা সঞ্জাত কল্পনা, এবং বাস্তবের সাথে তা সঙ্গতিপূর্ণ নয়।” মানবজাতি যদিও ঈশ্বরের প্রকৃত রূপের প্রতি কখনো কোনো গুরুত্ব আরোপ করেনি, তবু “তাঁর স্বভাবের পার্শ্বীয় অভিমুখ”-কে তারা তাদের হাতের তালুর মতো আনুপুঙ্খিকভাবে জানে; তারা নিয়ত ঈশ্বরের বাক্য ও ক্রিয়াকলাপের ছিদ্রান্বেষণ করছে। এর কারণ হল, নেতিবাচক বিষয়ে মনোযোগ দিতে, এবং ঈশ্বরের কর্মসকল তাচ্ছিল্যসহকারে দেখে ইতিবাচক বিষয়কে উপেক্ষা করতে মানুষ সর্বদা অত্যন্ত ইচ্ছুক। ঈশ্বর যত বলেন যে নিজেকে তিনি তাঁর বাসস্থানে নম্রভাবে প্রচ্ছন্ন রাখেন, মানুষ তাঁর কাছে তত বেশি করে দাবি রাখে। তারা বলে, “ঈশ্বরের অবতার যদি মানুষের সকল কাজকর্ম নিরীক্ষণ করছেন ও মানবজীবনের অভিজ্ঞতা লাভ করছেন, তাহলে এমন কেন হয় যে, অধিকাংশ সময় ঈশ্বর আমাদের প্রকৃত পরিস্থিতির বিষয়ে জানেনই না? তাহলে কি ঈশ্বর সত্যিই প্রচ্ছন্ন?” ঈশ্বর যদিও মানুষের অন্তরের গভীরে অবলোকন করেন, কিন্তু তারপরেও, অনিশ্চিত বা অতিপ্রাকৃত কোনোটাই না হয়ে মানুষের প্রকৃত পরিস্থিতি অনুসারেই তিনি কার্য সম্পাদন করে থাকেন। মানবতাকে তাদের পুরাতন স্বভাব থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত করার লক্ষ্যে, ঈশ্বর বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত থেকে বক্তব্য রাখার প্রচেষ্টায় কোনো খামতি রাখেন নি, মানুষের যথার্থ প্রকৃতিকে উন্মোচিত করে তাদের অনুগত্যহীনতার বিষয়ে রায় ঘোষণা করেছেন, কখনো-বা বলেছেন যে তিনি প্রত্যেকের মোকাবিলা করবেন, আবার পরক্ষণেই ঘোষণা করেছেন যে এক শ্রেণীর মানুষকে তিনি উদ্ধার করবেন; হয় মানুষের উপর চাহিদা আরোপ করেছেন, নয়তো তাদের সতর্ক করেছেন; এবং একাদিক্রমে তাদের আন্তর্প্রকৃতির কাটাছেঁড়া ও চিকিৎসার বিহিত করেছেন। এইভাবে, ঈশ্বরের বাক্যের পথনির্দেশনার অধীনে, মানুষ যেন পৃথিবীর প্রতিটি কোণায় পরিভ্রমণ করে এক প্রাচুর্যপূর্ণ উদ্যানে প্রবেশ করেছে, যেখানে প্রতিটি ফুল সুন্দরতম হওয়ার প্রতিযোগিতায় একে অপরকে পাল্লা দিচ্ছে। মানবজাতিকে ঈশ্বর যাকিছু বলেন তা তাঁর বাক্যের অন্তর্ভুক্ত হবে, ঠিক যেন ঈশ্বর এক চুম্বক যা লৌহজাত সকলকিছুকে নিজের দিকে আকর্ষণ করে। “মানুষ আমার প্রতি কোনো কর্ণপাত করে না, তাই আমিও তাদের গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করি না। আমার প্রতি তারা কোনো মনোযোগ দেয় না, তাই আমারও তাদের নিমিত্ত এত বেশি পরিশ্রম করার কোনো প্রয়োজন নেই। এই ব্যবস্থা কি উভয়ের পক্ষেই সর্বাপেক্ষা শ্রেয় নয়?” বাক্যগুলি পাঠ করে মনে হয় ঈশ্বরের সকল লোকজনকে যেন আবার ধাক্কা দিয়ে অতল গহ্বরে ফেলে দেওয়া হয়েছে, অথবা আরেকবার তাদের মর্মস্থলে আঘাত করে সম্পূর্ণ হতচকিত করে দেওয়া হয়েছে। এইভাবে, তারা পুনরায় পদ্ধতির মধ্যে প্রবেশ করে। এই বাক্যগুলির দরুন তারা সবিশেষরূপে বিভ্রান্ত: “রাজ্যে আমার লোকজনের অন্যতম সদস্য হিসাবে তোমরা যদি তোমাদের কর্তব্যে অচঞ্চল থাকতে অসমর্থ হও, তাহলে তোমরা আমার দ্বারা ঘৃণিত ও পরিত্যক্ত হবে!” অধিকাংশ মানুষ এই বাক্যের কারণে এত আহত বোধ করে যে তাদের অশ্রুর উদ্রেক ঘটে, তারা ভাবে, “অতল গহ্বর বেয়ে বের হয়ে আসতে আমাকে এত পরিশ্রম করতে হয়েছিল যে, আবার যদি আমি সেখানে গিয়ে পড়ি, তাহলে আমার তো আদৌ কোনো আশাই থাকবে না। মানবজগতে আমি কিছুই লাভ করিনি, এবং আমার জীবনে আমি সব ধরনের জটিলতা ও যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে গিয়েছি। নির্দিষ্ট করে, বিশ্বাসের মধ্যে আসার পর থেকে, আমি প্রিয়জনের পরিত্যাগ, আমার পরিবারের কাছ থেকে উৎপীড়ন, ও সমাজের অন্যদের কাছ থেকে কুৎসা রটনার মধ্য দিয়ে গিয়েছি, আর পৃথিবীর আনন্দের কিছুই আমি উপভোগ করি নি। আবার যদি আমি অতল গহ্বরে পতিত হই, তাহলে আমার জীবন কি আরো বেশি ব্যর্থতার মধ্যে যাপিত হবে না?” (কোনো মানুষ এই বিষয়ে যত বেশি চিন্তাভাবনা করবে, সে তত বেশি দুঃখভারাক্রান্ত বোধ করবে।) “আমার সকল আশাভরসা আমি ঈশ্বরের হাতে গচ্ছিত রেখেছি। তিনি যদি আমায় পরিত্যাগ করেন, তাহলে আমার বরং এখনই মৃত্যুবরণ করাই ভালো…। আচ্ছা, সকলকিছুই ঈশ্বরের দ্বারা পূর্বনির্দিষ্ট, তাহলে এখন আমি কেবল ঈশ্বরপ্রেমেরই অন্বেষণ করতে পারি। এটাই যে আমার নিয়তি, তেমনটা কে নির্ধারণ করলো?” যত বেশি মানুষ এরকম চিন্তা করে, তত বেশি তারা ঈশ্বরের আদর্শ মান ও তাঁর বাক্যের লক্ষ্যবস্তুর নিকটবর্তী হয়। এইভাবে তাঁর বাক্যের উদ্দেশ্য সাধিত হয়। ঈশ্বরের বাক্য শ্রবণ করার পর, সকল মানুষ এক অভ্যন্তরীন ভাবাদর্শগত সংগ্রামের অভিজ্ঞতা অর্জন করে। তাদের একমাত্র বিকল্প হল নিয়তির নির্দেশের কাছে আত্মসমর্পণ করা, এবং এইভাবে ঈশ্বরের উদ্দেশ্য অর্জিত হয়। ঈশ্বরের বাক্য যত বেশি রূঢ় হয়, মানুষের অন্তর্জগত ফলস্বরূপ তত বেশি জটিল হয়ে ওঠে। এটা ঠিক কোনো ক্ষতস্থানকে স্পর্শ করার মতো ব্যাপার; যত তীব্রভাবে স্পর্শ করা হবে, তত বেশি ব্যথা অনুভূত হবে, শেষে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছাবে যে মানুষ জীবন ও মৃত্যুর মাঝে দোদুল্যমান থাকবে, এবং এমনকি, বেঁচে থাকার আত্মবিশ্বাসটুকুও হারিয়ে ফেলতে পারে। বস্তুত, একমাত্র যখন মানুষ সর্বাধিক যন্ত্রণা ভোগ করে এবং আশাহীনতার চূড়ান্ত গভীরতায় উপনীত হয়, কেবল তখনই তারা তাদের প্রকৃত হৃদয়কে ঈশ্বরের হাতে সমর্পণ করতে পারে। মানবপ্রকৃতি এমনই যে, এমনকি যদি আশার লেশমাত্রও থাকে, তাহলে তারা সাহায্যের জন্য ঈশ্বরের কাছে যাবে না, পরিবর্তে তারা বরং স্বাভাবিকভাবে জীবনধারণের স্বয়ংসম্পূর্ণ পদ্ধতিগুলি অবলম্বন করবে। এর কারণ, মানবপ্রকৃতি নিজের নৈতিকতা বিষয়ে উদ্ধত, এবং মানুষের প্রবণতা হল বাকি সকলকে তাচ্ছিল্য করা। এই কারণেই ঈশ্বর বলেছিলেন, “স্বস্তিপূর্ণ অবস্থাতেও আমায় ভালোবাসতে সক্ষম, এমন একজন মানুষও আমি দেখিনি; সুখ ও শান্তির সময় একজন মানুষও আমায় তাদের আনন্দের ভাগীদার করে নিতে হাত বাড়িয়ে দেয়নি।” এটা সত্যিই নৈরাশ্যব্যঞ্জক; ঈশ্বর মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছিলেন, কিন্তু যখন তিনি মানবজগতে আসেন, তখন মানুষ তাকে প্রতিরোধ করতে এবং তাদের এলাকা থেকে তাঁকে বিতাড়ন করতে চায়, যেন তিনি পৃথিবীতে লক্ষ্যহীনভাবে ভাসমান নিতান্তই কোনো অনাথ শিশু, বা রাষ্ট্রহীন বিশ্বনাগরিক কোনো মানুষের অনুরূপ। ঈশ্বরের প্রতি কেঊ অনুরক্ত নয়, কেউ তাঁকে প্রকৃত অর্থে ভালোবাসে না, এবং কেউ কখনো তাঁর আগমনকে স্বাগত জানায়নি। বরং, ঈশ্বরের অভ্যাগম দেখে মেঘরাজির উৎফুল্ল আনন নিমেষে ছায়াচ্ছন্ন হয়ে পড়ে, যেন আকস্মিক কোনো ঝঞ্ঝা তাদের দিকে ধেয়ে আসছে, অথবা যেন ঈশ্বর তাদের পরিবারবর্গের সুখ কেড়ে নিতে পারেন, এবং যেন ঈশ্বর মানুষকে কখনো আশীর্বাদ করেননি, পরিবর্তে তাদের উপর সর্বদা কেবল দুর্ভাগ্য ডেকে এনেছেন। তাই, মানুষের মনে ঈশ্বর কোনো আশীর্বাদ নন, বরং এমন একজন যিনি সতত তাদের উপর অভিসম্পাত বর্ষণ করেন। এই কারণে, মানুষ তাঁকে কোনো গুরুত্ব দেয় না বা স্বাগত জানায় না; তারা তাঁর প্রতি সবসময় আন্তরিকতাশূন্য, এবং সর্বদা এমনই হয়ে আসছে। মানুষ তাদের হৃদয়ে এমন মানসিকতা পোষণ করে বলে ঈশ্বর বলেছেন যে, মানুষ যুক্তিবোধহীন ও নৈতিকতাশূন্য, এবং এমনকি মানুষকে যে অনুভূতিগুলির অধিকারী বলে মনে করা হয়, সেগুলি-ও তাদের মধ্যে পরিলক্ষিত হয় না। ঈশ্বরের অনুভূতির বিষয়ে মানুষ কোনো বিবেচনা প্রদর্শন করে না, পরিবর্তে ঈশ্বরের সঙ্গে মোকাবিলা করার সময় তারা বরং তথাকথিত “ন্যায়পরায়ণতা” ব্যবহার করে। বহুকাল যাবৎ তারা এইরকম, আর, এই কারণেই, ঈশ্বর বলেছেন যে, তাদের স্বভাব পরিবর্তিত হয়নি। এই বিষয়টিই প্রমাণ করে যে, তাদের মধ্যে একমুঠি পালকের থেকে অধিক উপাদান নেই। বলা যেতে পারে, মানুষ অপদার্থ দুরাত্মামাত্র, কারণ তারা নিজেদেরকেই মূল্যবান জ্ঞান করে না। তারা যদি এমনকি নিজেদেরকেই ভালো না বেসে বরং পদদলিত করে, তাহলে তা কি তাদের অপদার্থতা প্রদর্শন করে না? মানবতা এক নৈতিকতা-বিবর্জিত রমণীর মতো যে নিজেকে নিয়ে ছেলেখেলা করে এবং অসম্মানিত হওয়ার উদ্দেশ্যে স্বেচ্ছায় নিজেকে অন্যের হাতে তুলে দেয়। তারপরেও, মানুষ এখনো উপলব্ধি করে উঠতে পারে না তারা ঠিক কতটা হীন। অন্যের হয়ে কাজ করে বা অন্যের সাথে কথা বলে, নিজেদের অন্যের নিয়ন্ত্রণে স্থাপন করে, তারা আনন্দ পায়; এটাই কি সম্যকভাবে মানবজাতির কলুষতা নয়? আমি যদিও মানুষের মধ্যে একটা জীবনের অভিজ্ঞতা লাভ করি নি, এবং যথার্থ অর্থে মানবজীবনের অভিজ্ঞতাও অর্জন করি নি, কিন্তু মানুষের প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি কর্ম, প্রত্যেকটি বাক্য এবং প্রত্যেকটি কার্যকলাপের বিষয়ে আমি এক সুস্পষ্ট উপলব্ধি অর্জন করেছি। এমনকি আমি মানুষের নিগূঢ়তম লজ্জাকেও অনাবৃত করতে সক্ষম, এতটাই যে, তারা আর কখনো তাদের প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়কে প্রকাশ করার, বা তাদের লালসার কাছে নিজেদের সঁপে দেওয়ার, স্পর্ধা করে না। নিজেদের খোলসের মধ্যে পশ্চাদপসরণকারী শম্বুকের মতো তারা নিজেদের কদর্য দশা পুনর্বার উন্মোচিত করার ধৃষ্টতা দেখায় না। মানুষ নিজেদের জানে না বলে, তাদের সবচেয়ে গুরুতর ত্রুটি হল অন্যদের সামনে নিজেদের মনোহারিতা জাহির করার প্রতি, তাদের কুৎসিত মুখাবয়ব বড়াই করে প্রদর্শন করার প্রতি সাগ্রহ ঔৎসুক্য; এই বিষয়টিকেই ঈশ্বর সর্বাপেক্ষা ঘৃণা করেন। এর কারণ হল মানুষদের মধ্যে সম্পর্কগুলি অস্বাভাবিক, এবং মানুষদের ভিতর একটা স্বাভাবিক আন্তর্মানবিক সম্পর্কের অভাব আছে, আর মানুষ ও ঈশ্বরের মধ্যের সম্পর্কে তো স্বাভাবিকতা আরোই কম। ঈশ্বর এত বাক্য উচ্চারণ করেছেন, এবং এর পিছনে তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মানুষের হৃদয়ে একটা স্থান দখল করা, যাতে যে সকল দেবমূর্তি সেখানে আস্থানা গেড়ে আছে, সেগুলির থেকে তারা নিজেদের মুক্ত করতে পারে। তারপরই, ঈশ্বর সমগ্র মানবতার উপর তাঁর ক্ষমতা বিস্তার করতে পারবেন, এবং পৃথিবীর বুকে তাঁর অধিষ্ঠানের উদ্দেশ্য পূরণ করবেন।