ঈশ্বরের কর্ম এবং মানুষের কর্ম

মানুষের কর্মের কতখানি পবিত্র আত্মার কর্ম এবং মানুষের অভিজ্ঞতা কতখানি? এটা বলা যেতে পারে যে মানুষ এখনও এই প্রশ্নগুলি উপলব্ধি করে না, এবং এর কারণ হল এই, যে তারা পবিত্র আত্মার কর্মের নীতিগুলিকে উপলব্ধি করে না। আমি যখন বলি “মানুষের কর্ম”, তখন আমি অবশ্যই তাদের কথাই বলি যাদের কাছে পবিত্র আত্মার কর্ম রয়েছে অথবা যারা পবিত্র আত্মা কর্তৃক ব্যবহৃত হয়। আমি সেই কর্মগুলির কথা বলছি না যেগুলি মানুষের ইচ্ছা থেকে উদ্ভূত হয়, বরং সেইসব ধর্মপ্রচারক, কর্মী, অথবা সাধারণ ভ্রাতা-ভগিনীদের কথা বলছি যারা পবিত্র আত্মার কর্ম-পরিসরের অন্তর্গত। এখানে “মানুষের কর্ম” বলতে ঈশ্বরের অবতারের কর্মকে বোঝায় না, বরং কাজের সেই পরিসর ও নীতিকেই বোঝায় যা পবিত্র আত্মা মানুষের ওপর সম্পাদন করেন। যদিও এই নীতিগুলি পবিত্র আত্মার কর্মের নীতি ও পরিসর, তবু এগুলি কিন্তু ঈশ্বরের অবতারের কর্মের নীতি ও পরিসরের অনুরূপ নয়। মানুষের কর্মের মধ্যে রয়েছে মানুষের সারসত্য ও নীতি, এবং ঈশ্বরের কর্মের মধ্যে রয়েছে ঈশ্বরের সারসত্য ও নীতি।

পবিত্র আত্মায় স্রোতে সম্পাদিত কাজ, তা সে ঈশ্বরের নিজস্ব কর্মই হোক বা ব্যবহৃত মানুষের কর্ম, আদতে তা পবিত্র আত্মারই কর্ম। স্বয়ং ঈশ্বরের সারসত্য হল আত্মা, যাকে পবিত্র আত্মা বা সাতগুণ তীব্রতাবিশিষ্ট আত্মা বলা যেতে পারে। সামগ্রিক ভাবে তাঁরা ঈশ্বরের আত্মা, যদিও বিভিন্ন যুগে ঈশ্বরের আত্মাকে বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়। তবে তাঁদের সারসত্য অভিন্ন। তাই, স্বয়ং ঈশ্বরের কর্মই পবিত্র আত্মার কর্ম, অন্যদিকে ঈশ্বরের অবতারের কর্ম পবিত্র আত্মার কর্মের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। যে সকল মানুষ ব্যবহৃত হচ্ছে তাদের কর্মও পবিত্র আত্মার কর্ম। তবুও ঈশ্বরের কর্ম পবিত্র আত্মার পূর্ণ প্রকাশ, যা কিনা সম্পূর্ণ সত্য, অন্যদিকে ব্যবহৃত মনুষ্যগণের কর্মে অনেক মানবিক বিষয় মিশ্রিত থাকে, এবং তা পবিত্র আত্মার প্রত্যক্ষ প্রকাশ নয়, আর তাঁর পূর্ণ প্রকাশ তো একেবারেই নয়। পবিত্র আত্মার কর্মগুলি বিচিত্র এবং তা কোনো শর্তের দ্বারা সীমাবদ্ধ নয়। বিভিন্ন মানুষের ক্ষেত্রে পবিত্র আত্মার কর্ম ভিন্ন ভিন্ন; তা বিভিন্ন সারসত্যের প্রকাশ ঘটায়, এবং যুগ ও দেশ অনুসারে তা ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। পবিত্র আত্মা যদিও বিভিন্ন পথে এবং নীতি অনুসারে কাজ করে, যে ধরনের মানুষের উপর যেভাবেই কাজ হোক না কেন, তার নির্যাস সর্বদাই সম্পূর্ণ ভিন্ন; বিভিন্ন ধরনের মানুষের উপর যে সকল কার্য সম্পাদিত হয় তার নিজস্ব নীতি রয়েছে, এবং সেগুলি সকলই নিজস্ব লক্ষ্যবস্তুর সারমর্মের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। তার কারণ, পবিত্র আত্মার কর্মের পরিসর ভীষণভাবেই নির্দিষ্ট এবং পরিমিত। অবতাররূপী দেহে যে কার্য সম্পাদিত হয় তা মানুষের উপর সম্পাদিত কর্মের অনুরূপ নয়, এবং যে ব্যক্তির উপর এই কার্য সম্পাদিত হচ্ছে তার ক্ষমতা অনুসারেও এই কাজও ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। অবতাররূপে দেহ যে কার্য সম্পাদন করে, তা মানুষের উপর করা হয় না, এবং মানুষের উপর যে কার্য করা হয় তা পুর্বোক্ত কার্যের অনুরূপ নয়। সংক্ষেপে বললে, যেভাবেই কার্য করা হোক না কেন, বিভিন্ন বস্তুর উপর সম্পাদিত কার্য কখনোই এক হয় না, এবং যে নীতির ভিত্তিতে তিনি কার্য করেন সেই সকল নীতি যে মনুষ্যগণের উপর তিনি কার্য সাধন করেন তাদের অবস্থা ও প্রকৃতি অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। পবিত্র আত্মা বিভিন্ন ধরনের মানুষের উপর তাদের সহজাত নির্যাসের ভিত্তিতে কার্য সাধন করেন এবং তাদের উপর এমন কোনো দাবি করেন না যা তাদের নির্যাসকে অতিক্রম করে যায়, বা তাদের উপর এমন কোনো কার্যও তিনি করেন না যা তাদের সহজাত ক্ষমতাকে অতিক্রম করে যায়। তাই, মানুষের উপর পবিত্র আত্মার কর্ম তাদের সেই কর্মের লক্ষ্যবস্তুর সারসত্যকে দেখতে অনুমোদিত করে। মানুষের সহজাত সারমর্মের পরিবর্তন হয় না, তার সহজাত ক্ষমতা সীমিত। পবিত্র আত্মা মানুষকে তাদের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা অনুসারে এমন ভাবে ব্যবহার করেন বা তাদের উপর এমন ভাবে কর্ম করেন যার দ্বারা তারা উপকৃত হতে পারে। ব্যবহৃত মানুষের উপর পবিত্র আত্মা যখন কর্ম করেন, তখন সেইসব মানুষের প্রতিভা ও সহজাত ক্ষমতার বিচ্ছুরণ ঘটে, সেগুলি আর আবদ্ধ থাকে না। তাদের এই সহজাত ক্ষমতা এই কর্মের সেবায় প্রযোজ্য হয়। এমন বলা যেতে পারে যে, মানুষের যে অংশগুলি তাঁর কাজে ব্যবহার্য, তিনি সেই অংশগুলিকে ব্যবহার করেন যাতে ঐ কার্যে সুফল অর্জন করা যায়। এর বিপরীতে, অবতাররূপী দেহে যে কার্য করা হয় তা প্রত্যক্ষ ভাবে আত্মার কর্মের প্রকাশ ঘটায়, এবং তা মানুষের মন ও চিন্তার দ্বারা কলুষিত নয়; মানুষের কোনো গুণ, মানুষের কোনো অভিজ্ঞতা, কিংবা মানুষের কোনো অন্তর্নিহিত অবস্থা, এর কাছে পৌঁছতে পারে না। পবিত্র আত্মার অগণ্য কার্যের লক্ষ্যই হল মানুষের উপকার ও তাদের উন্নতিসাধনমূলক শিক্ষাদান। তবে কিছু মানুষকে নিখুঁত করা যেতে পারে, অন্যদিকে বাকিদের মধ্যে নিখুঁত হওয়ার জন্য পরিস্থিতি থাকে না, যার অর্থ হল যে, তাদের নিখুঁত করা যেতে পারে না এবং তাদের কদাচিৎ উদ্ধার করা যায়, এবং যদিও তাদের কাছে পবিত্র আত্মার কর্ম হয়তো ছিল, কিন্তু শেষপর্যন্ত তাদের বহিষ্কার করা হয়। এর অর্থ হল, যদিও পবিত্র আত্মার কর্ম হল মানুষের উন্নতিসাধনমূলক শিক্ষাদান, তবুও কেউ বলতে পারে না যে, যে সকল মানুষ পবিত্র আত্মার কর্ম লাভ করেছে, তারা সবাই সম্পূর্ণভাবে নিখুঁত হবে, কারণ নিজেদের অন্বেষণে বহু মানুষ যে পথ অনুসরণ করে, তা নিখুঁত হয়ে ওঠার পথ নয়। তারা শুধু পবিত্র আত্মার একতরফা কর্মই লাভ করে, সেখানে আত্মনিষ্ঠ মানবিক সহযোগিতা এবং সঠিক মানবিক অন্বেষণ থাকে না। এইভাবে, এই ধরনের মানুষের উপর পবিত্র আত্মার কর্ম তাদের সেবাতেই প্রযোজ্য হয়, যাদের নিখুঁত করে তোলা হচ্ছে। পবিত্র আত্মার কর্ম মানুষ প্রত্যক্ষ ভাবে দেখতে পায় না, তারা নিজেরা একে সরাসরি স্পর্শও করতে পারে না। এই কর্মকে যারা উপহার হিসাবে লাভ করে একমাত্র তারাই এটা প্রকাশ করতে পারে, অর্থাৎ, পবিত্র আত্মার কর্ম মানুষের অভিব্যক্তিসমূহের মাধ্যমে অনুগামীদের নিকট প্রদান করা হয়।

বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ ও বিভিন্ন অবস্থার মাধ্যমে পবিত্র আত্মার কর্ম সম্পন্ন ও সম্পূর্ণ হয়। যদিও ঈশ্বরের অবতারের কর্ম সম্পূর্ণ একটি যুগের কর্মের, এবং সম্পূর্ণ একটি যুগে মানুষের প্রবেশের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে, মানুষের প্রবেশ সংক্রান্ত বিস্তারিত কর্ম এখনও সেই মানুষের দ্বারাই সম্পন্ন হওয়া দরকার যারা পবিত্র আত্মার দ্বারা ব্যবহৃত হচ্ছে, ঈশ্বরের দ্বারা নয়। তাই, ঈশ্বরের কর্ম, বা ঈশ্বরের নিজস্ব সেবাব্রত, হল ঈশ্বরের অবতাররূপী দেহের কর্ম, তাঁর পরিবর্তে মানুষ যা করতে পারে না। বিভিন্ন ধরনের বহু মানুষের মাধ্যমে পবিত্র আত্মার কাজ সম্পূর্ণ হয়; কোনো ব্যক্তিবিশেষ তা সম্পূর্ণ রূপে সম্পন্ন করতে পারে না, এবং কোনো ব্যক্তিবিশেষ তা সম্পূর্ণরূপে প্রকাশও করতে পারে না। গির্জাকে যারা নেতৃত্ব দেন তাঁরাও সম্পূর্ণ রূপে পবিত্র আত্মার কর্মের প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন না, তাঁরা শুধু কিছু অগ্রণী কার্য সাধন করতে পারেন। এইভাবে পবিত্র আত্মার কর্মকে তিনটি অংশে বিভক্ত করা যেতে পারে: ঈশ্বরের নিজস্ব কর্ম, যে সকল মানুষ ব্যবহৃত হচ্ছে তাদের কর্ম, এবং পবিত্র আত্মার স্রোতে যারা রয়েছে তাদের উপর কর্ম। ঈশ্বরের নিজস্ব কর্ম হল পুরো একটি যুগের নেতৃত্বদান, যারা ব্যবহৃত হচ্ছে তাদের কর্ম হল ঈশ্বরের নিজস্ব কর্ম সমাপ্ত হওয়ার পর ঈশ্বরের দ্বারা প্রেরিত হওয়া ও ঈশ্বরের দ্বারা অর্পিত দায়িত্ব গ্রহণ, এবং এরা হল সেই সকল মানুষ যারা ঈশ্বরের কাজের সঙ্গে সহযোগিতা করে; স্রোতের মধ্যে যারা রয়েছে তাদের উপর পবিত্র আত্মার কর্মের লক্ষ্য হল তাঁর নিজস্ব সব কাজের রক্ষণাবেক্ষণ, অর্থাৎ তাঁর সমগ্র ব্যবস্থাপনা এবং তাঁর সাক্ষ্যের রক্ষণাবেক্ষণ, এবং সেইসঙ্গে যাদের নিখুঁত করা সম্বব তাদের নিখুঁত করে তোলা। একত্রে, এই তিনটি অংশই হল পবিত্র আত্মার সামগ্রিক কর্ম, কিন্তু স্বয়ং ঈশ্বরের কর্ম ব্যতিরেকে পরিচালনামূলক কার্য সম্পূর্ণতা লাভ না করে স্থানু হয়ে পড়বে। স্বয়ং ঈশ্বরের কর্মের মধ্যে সমগ্র মানবজাতির কর্মও সম্পৃক্ত রয়েছে, এবং তা সম্পূর্ণ একটি যুগের কর্মের প্রতিনিধিত্বও করে থাকে, এর অর্থ হল ঈশ্বরের নিজস্ব কর্ম পবিত্র আত্মার কর্মের প্রতিটি গতিপ্রকৃতি ও ধারার প্রতিনিধিত্ব করে, অন্যদিকে প্রেরিত-শিষ্যগণের কর্ম স্বয়ং ঈশ্বরের কর্মের পরে আসে এবং তাকে অনুসরণ করে, এবং তা কোনো যুগের নেতৃত্ব দেয় না বা, সম্পূর্ণ একটি যুগে পবিত্র আত্মার কর্মধারার প্রতিনিধিত্বও করে না। তারা শুধুমাত্র সেই কাজই করে যা মানুষের করা উচিত, যার সঙ্গে পরিচালনামূলক কার্যের কোনো সম্পর্ক নেই। ঈশ্বর স্বয়ং যে কর্ম করেন তা হল পরিচালনামূলক কর্মের অন্তর্ভুক্ত একটি প্রকল্প। মানুষের কাজ হল শুধুমাত্র সেই কর্তব্য যা ব্যবহৃত মানুষেরা পালন করে থাকে, তা পরিচালনালূক কার্যের সঙ্গে সম্পর্কহীন। যদিও প্রকৃতপক্ষে উভয়ই পবিত্র আত্মার কর্ম, তবে পরিচয় এবং কর্মের প্রতিনিধিত্বের ভিন্নতার কারণে, ঈশ্বরের নিজস্ব কর্ম ও মানুষের কর্মের মধ্যে স্পষ্ট ও মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। অধিকন্তু, পবিত্র আত্মার কাজের পরিধি ভিন্ন ভিন্ন পরিচয়বিশিষ্ট বস্তুর ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। এই-ই হল পবিত্র আত্মার কার্যের নীতিসমূহ এবং পরিসর।

মানুষের কার্য তার অভিজ্ঞতা ও তার মানবতারই জ্ঞাপক। মানুষ যা প্রদান করে ও যে কার্য করে সেগুলিই তার প্রতিনিধিত্ব করে। মানুষের অন্তর্দৃষ্টি, মানুষের বিচারশক্তি, মানুষের যুক্তি, মানুষের সমৃদ্ধ কল্পনাশক্তি—সকলই তার কাজে অন্তর্ভুক্ত। বিশেষ করে মানুষের অভিজ্ঞতা তার কার্যকে চিহ্নিত করতে পারে, এবং একজন ব্যক্তির অভিজ্ঞতাসমূহ তার কর্মের বিভিন্ন অংশে পরিণত হয়। মানুষের কর্ম তার অভিজ্ঞতার প্রকাশ ঘটাতে পারে। কিছু মানুষ যখন নেতিবাচক অভিজ্ঞতা অর্জন করে, তখন তাদের আলাপ-আলোচনার ভাষার বেশিরভাগ অংশ জুড়েই থাকে বিভিন্ন নেতিবাচক বিষয়। যদি কোনো একটা সময়কালে তাদের অভিজ্ঞতা ইতিবাচক হয়, এবং বিশেষত তাদের মনে যদি একটা ইতিবাচক পথের হদিশ থাকে, তাদের সহকারিতা খুবই প্রেরণাদায়ক হয়, এবং মানুষের তাদের কাছ থেকে ইতিবাচক উপাদান পেতে পারে। যদি একজন কর্মী একটা সময়কালের জন্য নেতিবাচক হয়ে পড়ে, তখন তার আলাপ-আলোচনা সবসময় নেতিবাচক বিষয় বহন করবে। এই ধরনের আলাপ-আলোচনা খুবই হতাশাজনক, তার সঙ্গে আলোচনার পর অন্যান্যরাও অচেতনভাবেই বিষন্ন বোধ করবে। নেতার অবস্থার ভিত্তিতে অনুগামীদের অবস্থার পরিবর্তন হয়। একজন কর্মী অভ্যন্তর থেকে যা, সে তা-ই প্রকাশ করে, এবং মানুষের অবস্থা অনুসারে পবিত্র আত্মার কর্ম প্রায়শই পরিবর্তিত হয়। তিনি মানুষের অভিজ্ঞতা অনুসারে কর্ম করেন এবং তাদের উপর বলপ্রয়োগ করেন না, কিন্তু মানুষের অভিজ্ঞতার স্বাভাবিক পরিসরেই তাদের কাছে কিছু দাবি রাখেন। এর অর্থ হল মানুষের সহকারিতা ঈশ্বরের বাক্য থেকে পৃথক। মানুষ যা সহকারিতা করে তা তাদের ব্যক্তিগত অন্তর্দৃষ্টি ও অভিজ্ঞতার পরিচয় বহন করে, তারা ঈশ্বরের কর্মের ভিত্তিতে নিজস্ব অন্তর্দৃষ্টি ও অভিজ্ঞতা প্রকাশ করে। ঈশ্বর কর্ম করার পর বা বাক্য বলার পর, তাদের দায়িত্ব হল সেগুলির মধ্যে তাদের কী অনুশীলন করা উচিত এবং কীসের মধ্যে প্রবেশ করা উচিত, তা খুঁজে বের করা, এবং অতঃপর তা অনুগামীদের জানানো। অর্থাৎ, মানুষের কর্ম তার প্রবেশ ও অনুশীলনের প্রতিনিধিত্ব করে। অবশ্যই, এই ধরনের কাজের মধ্যে মনুষ্যসুলভ শিক্ষা এবং অভিজ্ঞতা অথবা কিছু মনুষ্যসুলভ চিন্তা মিশ্রিত থাকে। পবিত্র আত্মা যেভাবেই কার্য করুন না কেন, তা মানুষের উপরই হোক বা ঈশ্বরের অবতারের উপর, কর্মীরা সবসময়ই তাদের স্বরূপ প্রকাশ করে। যদিও পবিত্র আত্মাই কর্ম করছেন, তবে, সেই কর্ম মানুষের সহজাত স্বরূপের উপর ভিত্তি করেই সম্পাদিত হচ্ছে, কারণ পবিত্র আত্মা ভিত্তি ব্যতীত কোনো কর্ম করেন না। প্রকারান্তরে বললে, এই কাজ শূন্য থেকে উদ্ভূত হয় না, বরং প্রকৃত পারিপার্শ্বিক ও বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই সবসময় এই কার্য সাধন হয়। একমাত্র এই পথেই মানুষের স্বভাবের রূপান্তর ঘটতে পারে এবং তার পুরোনো ধ্যানধারণা ও পুরোনো চিন্তাভাবনার পরিবর্তন হতে পারে। মানুষ যা দেখে, যে অভিজ্ঞতা অর্জন করে, এবং যে কল্পনা করতে পারে, তা-ই সে অভিব্যক্ত করে, এবং তা মানুষের ভাবনার দ্বারা অর্জন করা যায়, এমনকি, তা যদি মতবাদ বা পূর্বধারণা হয় তবুও। মানুষের কাজ মানুষের অভিজ্ঞতা বা সে যা দেখে, যা কল্পনা বা অনুমান করে, তার গণ্ডিকে অতিক্রম করতে করতে পারে না, তা সেই কর্মের আকার যেমনই হোক না কেন। ঈশ্বর স্বয়ং যা, তা-ই তিনি প্রকাশ করেন, এবং মানুষের পক্ষে লাভ করা অসম্ভব—অর্থাৎ তা মানুষের ভাবনাচিন্তার পরিসীমার বাইরে। সমগ্র মানবজাতিকে নেতৃত্বদানের যে কর্ম তাঁর, তিনি তা প্রকাশ করেন, এবং মানুষের যাবতীয় অভিজ্ঞতার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই, পরিবর্তে, তা তাঁর নিজস্ব ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত। মানুষ যা প্রকাশ করে তা হল তার অভিজ্ঞতা, এবং ঈশ্বর যা প্রকাশ করেন তা হল তাঁর সত্তা, যা তাঁর বৈশিষ্ট, যা মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে। ঈশ্বরের দ্বারা প্রকাশিত তাঁর সত্তার ভিত্তিতে মানুষের আহরিত অন্তর্দৃষ্টি ও জ্ঞানই হল তার অভিজ্ঞতা। এই অন্তর্দৃষ্টি ও অভিজ্ঞতাকেই বলা হয় মানুষের সত্তা, এবং মানুষের অভিব্যক্তির ভিত্তি হল তার সহজাত স্বভাব ও ক্ষমতা—এই কারণেই সেগুলিকে মানুষের সত্তাও বলা হয়। মানুষ যা অভিজ্ঞতা অর্জন করে এবং যা দেখে, সেই বিষয়েই সে আলাপ-আলোচনা করতে পারে। যে অভিজ্ঞতা তাদের নেই, যা তারা দেখেনি, বা যা তাদের চিন্তাভাবনার অতীত, অর্থাৎ যে জিনিসগুলি তাদের মধ্যে নেই, তা নিয়ে কোনো মানুষই আলোচনা করতে পারে না। মানুষ যদি এমন কোনো বিষয় প্রকাশ করে যার অভিজ্ঞতা তার নেই, তাহলে তা হয় তার কল্পনা নয়তো মতবাদ। সহজভাবে বললে, তার কথার কোনও বাস্তবিকতা নেই। তুমি যদি সমাজের বিভিন্ন বস্তুর সংস্পর্শে কখনো না আসো, তাহলে সমাজের জটিল সম্পর্কগুলির সঙ্গে কখনও স্পষ্ট সহকারিতায় সক্ষম হবে না। তোমার যদি কোনো পরিবার না থাকে, কিন্তু তখন যদি তোমার কাছে অন্যরা পারিবারিক বিষয় সম্পর্কে কথা বলে, তাহলে তুমি তাদের কথার বেশিরভাগ অংশই বুঝবে না। তাই, মানুষ যে আলোচনা বা যে কাজ করে তা তার অভ্যন্তরীণ সত্তার প্রতিফলন। কোনো ব্যক্তি যদি শাস্তি ও বিচার নিয়ে তার ধারণার কথা আলোচনা করে, অথচ তোমার এ বিষয়ে কোনো অভিজ্ঞতাই না-থাকে, তখন তুমি তার সেই জ্ঞান অস্বীকার করার স্পর্ধা রাখবে না, এবং এই বিষয়ে একশত-ভাগ দৃঢ়প্রত্যয় হওয়ার সাহস তো আরোই করবে না। কারণ তার আলোচনা এমন একটা বিষয়ে যার অভিজ্ঞতা তুমি কখনো অর্জন করোনি, যা তুমি কখনো জানোনি, এবং তোমার মন তা কল্পনাও করতে পারে না। তার জ্ঞান থেকে তুমি যা আহরণ করতে পার, তা হল শাস্তি ও বিচারের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার একটা পথ। তবে সেই পথ হবে নিছকই মতবাদ সম্পর্কিত একটা জ্ঞানের পথ; তা তোমার নিজস্ব ধারণাকে প্রতিস্থাপন করতে পারে না, এবং তোমার অভিজ্ঞতাকে তো আরোই প্রতিস্থাপন করতে পারে না। হয়তো তোমার মনে হবে যে তারা যা বলছে তা অত্যন্ত সঠিক, কিন্তু তোমার নিজস্ব অভিজ্ঞতায় দেখবে যে তা বিভিন্ন দিক থেকে একেবারেই অসম্ভব। তোমার হয়তো মনে হবে যা তুমি শুনছ তা সম্পূর্ণরূপে অসম্ভব; সেই সময় তুমি পূর্বধারণাসমূহ পোষণ করলে, এবং, যদি তুমি তা স্বীকারও করে নাও তুমি সেটা অনিচ্ছুকভাবে করবে। কিন্তু তোমার নিজস্ব অভিজ্ঞতায়, যে জ্ঞানের ভিত্তিতে তোমার ধারণা জন্মায়, তা তোমার অনুশীলনের পথ হয়ে ওঠে, এবং যত বেশি করে অনুশীলন করবে, তত বেশি করে যে বাক্য তুমি শুনেছ তার প্রকৃত মূল্য এবং অর্থ তুমি বুঝতে পারবে। নিজস্ব অভিজ্ঞতা অর্জনের পর এই অভিজ্ঞতা থেকে কী জ্ঞান তোমার লাভ করা উচিত সে বিষয়ে তুমি কথা বলতে পারবে। এবং সঙ্গে কাদের জ্ঞান খাঁটি ও ব্যবহারিক এবং কাদের জ্ঞান মতবাদভিত্তিক ও মূল্যহীন সেই পার্থক্যটা তুমি করতে পারবে। তাই, যে জ্ঞান তুমি ব্যক্ত করো তা সত্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কিনা তা মূলত তোমার এ বিষয়ে ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা রয়েছে কিনা তার উপর নির্ভর করছে। তোমার অভিজ্ঞতার যেখানেই সত্য রয়েছে, সেখানেই তোমার জ্ঞান হবে ব্যবহারিক এবং মূল্যবান। তোমার অভিজ্ঞতার মাধ্যমে তুমি বিচক্ষণতা ও অন্তর্দৃষ্টিও লাভ করতে পারবে, তোমার জ্ঞানকে গভীরতর করতে পারবে, তোমার প্রজ্ঞা তথা নিজেকে তোমার কীভাবে পরিচালনা করা উচিত সে বিষয়ে সাধারণ বোধের বৃদ্ধি ঘটাতে পারবে। যে সকল মানুষের কাছে সত্য নেই তাদের দ্বারা প্রকাশিত জ্ঞান হল মতবাদ, তা সে যতই উচ্চমার্গের হোক না কেন। যেখানে দৈহিক বিষয়গুলির প্রশ্ন জড়িত সেখানে এই ধরনের ব্যক্তিরা খুবই বুদ্ধিমান হতে পারে, কিন্তু আধ্যাত্মিক বিষয়ের প্রশ্ন এলে তারা কোনো পার্থক্য করতে পারে না। তার কারণ, আধ্যাত্মিক বিষয়ে এই ধরনের ব্যক্তিদের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। এরা হল সেই ধরনের ব্যক্তি যারা আধ্যাত্মিক বিষয়ে আলোকিত নয় এবং আধ্যাত্মিক বিষয়গুলি উপলব্ধি করে না। যে ধরনের জ্ঞানই তুমি ব্যক্ত করোনা কেন, যতক্ষণ তা তোমার সত্তাস্বরূপ, ততক্ষণ তা তোমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, তোমার প্রকৃত জ্ঞান। সেযব মানুষ শুধুমাত্র মতবাদের কথা বলে—অর্থাৎ যাদের কাছে সত্য বা বাস্তব কোনোটাই থাকে না—তারা যা আলোচনা করে তাও তাদেরই সত্তা বলা যেতে পারে, কারণ প্রগাঢ় অনুধ্যানের মাধ্যমেই তারা তাদের মতবাদে উপনীত হয়েছে এবং তা তাদের গভীর চিন্তনের ফল। তবে তা নিছকই মতবাদ, কল্পনার অধিক কিছু নয়! সমস্ত ধরনের মানুষের অভিজ্ঞতা তাদের অন্তরে যা রয়েছে তারই প্রতিফলন। আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা যার নেই সে সত্যের জ্ঞানের কথা বলতে পারে না, বিভিন্ন আধ্যাত্মিক বিষয় সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানের বিষয়ও সে কথা বলতে পারে না। একজন মানুষ অন্তর থেকে যেমন, তারই সে প্রকাশ ঘটায়—এটা সুনিশ্চিত। কেউ যদি আধ্যাত্মিক বিষয় এবং সত্য সম্পর্কে জ্ঞানার্জনের ইচ্ছা পোষণ করে, তবে তাকে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করতেই হবে। তুমি যদি মানবজীবনের সাধারণ বোধ সম্পর্কে স্পষ্টভাবে কথা বলতে না পার, তবে তুমি আধ্যাত্মিক বিষয় নিয়ে কীভাবে কথা বলতে সক্ষম হবে? যারা গির্জার নেতৃত্ব দিতে পারে, মানুষকে জীবনের সরবরাহ করতে পারে, মানুষের কাছ প্রেরিত-শিষ্য হয়ে উঠতে পারে, তাদের অবশ্যই প্রকৃত অভিজ্ঞতা থাকতে হবে; আধ্যাত্মিক বিষয় সম্পর্কে তাদের অবশ্যই একটা সঠিক ধারণা থাকতে হবে এবং সত্যের যথার্থ উপলব্ধি এবং অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। একমাত্র এই ধরনের ব্যক্তিরাই কর্মী বা প্রেরিত-শিষ্য হওয়ার যোগ্য যারা গির্জাকে নেতৃত্ব দেন। অন্যথায়, তারা শুধুমাত্র নগণ্যতম হিসাবে অনুসরণ করতে পারে, নেতৃত্ব দিতে পারে না, মানুষকে জীবনের সরবরাহ দিতে সক্ষম এমন প্রেরিত-শিষ্য তো আরোই হতে পারে না। কারণ ছোটাছুটি করা বা লড়াই করা প্রেরিত-শিষ্যদের কর্ম নয়, তাদের কাজ হল জীবনের সরবরাহ এবং মানুষকে তাদের স্বভাবের রূপান্তরসাধনে নেতৃত্ব দেওয়া। যারা এই কার্য সাধন করতে পারেন তাদের স্কন্ধে গুরুতর দায়িত্ব অর্পিত হয়, এই দায়িত্ব যে কেউ বহন করতে পারে না। জীবন সম্পর্কে যাদের জ্ঞান রয়েছে, অর্থাৎ, সত্যের অভিজ্ঞতা যাদের রয়েছে, তারাই এই ধরনের কার্য গ্রহণ করতে পারে। যারা কেবলমাত্র ত্যাগ করতে পারে, ছুটে বেড়াতেই পারে, বা নিজেদের ব্যয় করতে যায়, তাদের দ্বারা এই কার্য গ্রহণ সম্ভব নয়; সত্য সম্বন্ধে যাদের কোনো অভিজ্ঞতা নেই, যাদের অপ্রয়োজনীয় অংশ কর্তন করা হয়নি, বা যাদের বিচার হয়নি তারা এই ধরনের কাজ করতে অক্ষম। অভিজ্ঞতাহীন মানুষ, যাদের কোনো বাস্তববোধ নেই, তারা স্পষ্টভাবে বাস্তবকে দেখতে অক্ষম, কারণ, তারা নিজেরাই এই ধরনের সত্তা রহিত। সুতরাং, এই ধরনের ব্যক্তিরা যে শুধু নেতৃত্বদানে অক্ষম কেবল তাই নয়, তারা যদি বহুকাল ধরে সত্যকে পরিহার করে চলে, তবে তাদের বহিষ্কার করা হবে। যে অন্তর্দৃষ্টি তুমি প্রকাশ করো তা জীবনে যে যন্ত্রণার অভিজ্ঞতা তুমি লাভ করেছ, যে বিষয়গুলির জন্য তুমি শাস্তি পেয়েছ, এবং যে বিষয়গুলির জন্য তোমার বিচার হয়েছে, তার প্রমাণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এই কথা পরীক্ষার ক্ষেত্রেও সত্য: যেখানে একজন পরিমার্জিত হয়, যেখানে একজন দুর্বল—এগুলিই হল সেই পরিসর যেখানে মানুষের অভিজ্ঞতা থাকে, যেখানে একজনের একটা পথ থাকে। উদাহরণস্বরূপ, যদি কেউ বিবাহজনিত হতাশায় ভোগে, তবে সে প্রায়ই সহকারিতা করে, “ধন্যবাদ ঈশ্বর, ধন্য তুমি ঈশ্বর, আমাকে অবশ্যই ঈশ্বরের হৃদয়ের বাসনা পূর্ণ করতে এবং আমার পুরো জীবন সমর্পণ করতে হবে, আমার বিবাহের বিষয়টি সম্পূর্ণ ভাবে ঈশ্বরের হাতে সঁপে দিতে হবে। আমি ঈশ্বরের কাছে আমার সমস্ত জীবনের অঙ্গীকার করতে চাই”। মানুষের ভিতরে যাকিছুই আছে তা তার আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে প্রদর্শিত করতে পারে যে সে কী। একজন মানুষের কথার গতি, তা সে সোচ্চারই হোক বা নিরুচ্চার—এই ধরনের বিষয়গুলি অভিজ্ঞতার বিষয় নয় এবং তাদের যা রয়েছে এবং তারা আদতে যা, তার প্রতিফলন ঘটাতে পারে না। এই বিষয়গুলি শুধু এটুকুই বলতে পারে যে একজন মানুষের চরিত্র ভালো না মন্দ, বা তাদের প্রকৃতি ভালো না মন্দ, কিন্তু কিন্তু কোনো ব্যক্তির অভিজ্ঞতা রয়েছে কিনা সেই প্রশ্নের সঙ্গে এই বিষয়গুলি সমতুল্য নয়। কথা বলার সময় নিজেকে প্রকাশ করার ক্ষমতা, বা কথা বলার দক্ষতা বা গতি নিছকইঅনুশীলনের বিষয়, এবং তা একজনের অভিজ্ঞতার প্রতিস্থাপন করতে পারে না। তুমি যখন নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা বল, তখন তুমি যে বিষয়গুলিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করো এবং এবং যে বিষয়গুলি তোমার মধ্যে রয়েছে সেগুলি নিয়ে আলোচনা কর। আমার বক্তব্য আমার সত্তার প্রতিনিধিত্ব করে, কিন্তু আমি যা বলি তা মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে। আমি যা বলি এবং মানুষ যা অভিজ্ঞতা তা এক নয়, মানুষ তা দেখতে পায় না, মানুষ তা স্পর্শ করতে পারে না, কিন্তু তা-ই আমি। কিছু মানুষ শুধুমাত্র এমন স্বীকার করে যে, আমি যা অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি সে বিষয়েই আমি আলোচনা করি, কিন্তু তারা স্বীকার করে না যে তা হল আত্মার প্রত্যক্ষ অভিব্যক্তি। অবশ্যই, আমি যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি, আমি তাই বলি। এই আমিই ছয় সহস্র বর্ষীয় পরিচালনামূলক কার্য সম্পন্ন করেছি। মানবজাতির সৃষ্টির সূচনা পর্ব থেকে অদ্যবধি সবকিছুর অভিজ্ঞতা আমি লাভ করেছি; কী করে আমি তা আলোচনা করতে অক্ষম হব? মানুষের প্রকৃতির প্রসঙ্গ যখন আসে তখন আমি তা স্পষ্টভাবে দেখেছি; বহু পূর্বেই আমি তা পর্যবেক্ষণ করেছি। কীভাবে আমি এ বিষয়ে স্পষ্টভাবে কথা বলতে অক্ষম হতে পারি? যেহেতু মানুষের উপাদান আমি স্পষ্টভাবে দেখেছি, আমি মানুষকে শাস্তি দেওয়া ও তার বিচারের আধিকারী, কারণ সমস্ত মানুষ আমা-হতেই উৎপন্ন, কিন্তু শয়তানের দ্বারা ভ্রষ্ট হয়েছে। অবশ্যই, আমি যে কার্য করেছি তা মূল্যায়নেরও আমি অধিকারী। এই কার্য যদিও আমার দেহ দ্বারা সম্পন্ন হয়নি, এ হল আত্মার প্রত্যক্ষ অভিব্যক্তি, এ-ই সেই বস্তু যা আমার রয়েছে এবং যা আমি। তাই আমি তা প্রকাশের এবং আমার যা করণীয় উচিত তা করার অধিকারী। মানুষ যা অভিজ্ঞতা করেছে, তা-ই বলে। তা হল সেই বস্তু যা তারা দেখেছে, যেখানে তাদের মন পৌঁছতে পারে, যা তাদের ইন্দ্রিয় শনাক্ত করতে পারে। তা হল সেই বিষয় যা নিয়ে তারা সহকারিতা করতে পারে। ঈশ্বরের অবতাররূপের কথিত বাক্যগুলি আত্মার প্রত্যক্ষ অভিব্যক্তি এবং সেগুলি আত্মার দ্বারা সম্পাদিত কর্মকেই প্রকাশ করে, যার অভিজ্ঞতা দেহ লাভ করেনি বা যা দেহ দেখেনি, কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি এখনও তাঁর সত্তাকে প্রকাশ করেন, কারণ দেহের সারসত্যই হল আত্মা, এবং তিনি আত্মার কর্ম প্রকাশ করেন। এই কর্ম ইতিমধ্যেই আত্মার দ্বারা সম্পাদিত হয়েছে, যদিও তা দেহের নাগালের বাইরে। অবতাররূপ ধারণের পর, তিনি দৈহিক অভিব্যক্তির মাধ্যমে মানুষকে ঈশ্বরের সত্তাকে জানতে সক্ষম করেন, এবং মানুষকে ঈশ্বরের প্রকৃতি ও তাঁর সম্পাদিত কার্য দেখার অনুমতি দেন। মানুষের কর্ম, তাদের কোথায় প্রবেশ করা উচিত ও কী তাদের বোঝা উচিত সে ব্যাপারে একটা স্পষ্টতা দেয়; এর সাথে মানুষকে সত্যকে অনুধাবন ও সত্যের অভিজ্ঞতা লাভের পথপ্রদর্শন সম্পৃক্ত। মানুষের কাজ হল মানুষকে টিঁকিয়ে রাখা; এবং ঈশ্বরের কার্য হল মানবজাতির জন্য নবনব পথ ও নবনব যুগের সূচনা করা, নশ্বর প্রাণীদের কাছে যা জ্ঞাত নয় মানুষের জন্য তার প্রকাশ ঘটানো, এবং তাঁর স্বভাব জানার জন্য তাদের সক্ষম করে তোলা। ঈশ্বরের কর্ম হল সমগ্র মানবজাতিকে নেতৃত্বদান।

মানুষের উপকারের জন্যই পবিত্র আত্মার সকল কর্ম সম্পাদিত হয়। এর সমস্ত কিছুই মানুষের উন্নতিসাধনমূলক শিক্ষাদানের জন্য; এমন কোনো কর্ম নেই যা মানুষের উপকার করে না। সত্য গভীরই হোক বা অগভীর, এবং যারা সত্যকে গ্রহণ করে তাদের ক্ষমতা যেমনই হোক না কেন, পবিত্র আত্মা যাই করুন না কেন, তা থেকে মানুষের উপকার হয়। কিন্তু পবিত্র আত্মার কর্ম প্রত্যক্ষ ভাবে সম্পাদিত হতে পারে না; যে সকল মানুষ তাঁর সঙ্গে সহযোগিতা করে তাদের মাধ্যমেই তা প্রকাশিত হয়। একমাত্র এভাবেই পবিত্র আত্মার কর্মের ফল পাওয়া যেতে পারে। অবশ্যই, পবিত্র আত্মা যখন সরাসরি কর্ম করেন, তখন তার মধ্যে কোনোই কলুষ থাকে না; কিন্তু পবিত্র আত্মা যখন মানুষের মাধ্যমে কর্ম করেন, তখন তা ভীষণভাবেই কলুষিত হয়ে পড়ে এবং তা পবিত্র আত্মার মৌলিক কর্ম নয়। এই পরিস্থিতিতে, বিভিন্ন মাত্রায় সত্যের পরিবর্তন হয়। অনুগামীরা পবিত্র আত্মার মৌলিক অভিপ্রায় গ্রহণ করে না, বরং পবিত্র আত্মার কর্ম এবং মানুষের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের একটা মিশ্রণ গ্রহণ করে। অনুগামীগণ যা গ্রহণ করে তার যে অংশে পবিত্র আত্মার কর্ম রয়েছে তা সঠিক, অন্যদিকে মানুষের যে অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান তারা গ্রহণ করে তা পরিবর্তিত হয় কারণ সেখানে কর্মীরা ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। পবিত্র আত্মার আলোকপ্রাপ্ত ও পথনির্দেশপ্রাপ্ত কর্মীরা এই আলোকপ্রাপ্তি ও পথনির্দেশের ভিত্তিতেও অভিজ্ঞতা অর্জন করতে থাকবে। এই সমস্ত অভিজ্ঞতার সাথে যখন মানুষের মন ও অভিজ্ঞতা সংযুক্ত হয়, তদসহযোগে থাকে মনুষ্যত্ব, এবং, অতঃপর, তারা সেই জ্ঞান ও অন্তর্দৃষ্টি লাভ করে যা তাদের থাকা উচিত। সত্যের অভিজ্ঞতা অর্জনের পর এ-ই হল মানুষের অনুশীলনের পথ। এই অনুশীলনের পথ সবসময় এক হয় না, কারণ মানুষ বিভিন্ন ভাবে অভিজ্ঞতা অর্জন করে, এবং তাদের অর্জিত অভিজ্ঞতাও ভিন্ন-ভিন্ন। এই ভাবে, পবিত্র আত্মার কাছ থেকে একই আলোকপ্রাপ্তির ফল ভিন্ন-ভিন্ন জ্ঞান ও অনুশীলন হতে পারে, কারণ যাদের আলোকপ্রাপ্তি ঘটছে তারা ভিন্-ভিন্ন। অনুশীলনের সময় কেউ কেউ সামান্য ত্রুটি করে, কেউ কেউ করে গুরুতর ত্রুটি, আবার কেউ বা কেবলই ত্রুটি করে যায়। এর কারণ হল মানুষের উপলব্ধি করার ক্ষমতা ভিন্ন-ভিন্ন এবং এবং এর আরো একটা কারণ তাদের সহজাত ক্ষমতা ভিন্ন-ভিন্ন। একই বার্তা শোনার পর কিছু মানুষের এক ধরনের উপলব্ধি হয়, এবং সত্য শোনার পর কিছু মানুষের আবার অন্য ধরনের উপলব্ধি হয়। কোনো কোনো মানুষে সামান্য বিচ্যুতি ঘটে, কেউ কেউ আবার সত্যের প্রকৃত অর্থ বিন্দুমাত্র বোঝে না। অতএব, একজনের উপলব্ধিই নির্ধারণ করে দেয় সে কীভাবে অন্যদের নেতৃত্ব দেবে; এটা খাঁটি সত্য, কারণ একজন মানুষের কর্ম হল তার সত্তার অভিব্যক্তি। সত্যের প্রকৃত উপলব্ধি যাদের রয়েছে তাদের নেতৃত্ব যখন মানুষ পায় তখন তারাও সত্যের সঠিক উপলব্ধি অর্জন করে। এমনকি যদি এমনও মানুষ থাকে যাদের উপলব্ধিতে ত্রুটি রয়েছে, তেমন মানুষের সংখ্যা খুবই অল্প, এবং সকলের সেই ত্রুটি থাকে না। যদি কোনো ব্যক্তির সত্যের উপলব্ধিতে ভ্রান্তি থাকে, তবে তাকে যারা অনুসরণ করে তারাও নিঃসন্দেহে ভ্রান্ত হবে, এবং এই ধরনের মানুষরা যথার্থ অর্থেই ভ্রান্ত হবে। অনুগামীরা কতটা মাত্রায় সত্যকে উপলব্ধি করবে তা বহুলাংশে নির্ভর করে কর্মীদের উপর। ঈশ্বরের কাছ থেকে আগত সত্য অবশ্যই সঠিক এবং অভ্রান্ত, এবং এমন সম্পূর্ণ নিশ্চিত। তবে, কর্মীরা সম্পূর্ণ সঠিক নয় এবং তাদের পুরোপুরি নির্ভরযোগ্যও বলা যায় না। কর্মীদের কাছে যদি সত্যকে অনুশীলনের একটা বাস্তবসম্মত পথ থাকে তাহলে অনুগামীদের কাছেও অনুশীলনের একটা পথ রইবে। কর্মীদের কাছে যদি অনুশীলনের পথের পরিবর্তে যদি নিছকই মতবাদ থাকে, তাহলে অনুগামীদের কোনো বাস্তবতা রইবে না। অনুগামীদের ক্ষমতা ও প্রকৃতি নির্ধারিত হয় জন্মের দ্বারা এবং তা কর্মীদের সঙ্গে জড়িত নয়, কিন্তু অনুগামীরা সত্যকে কতখানি উপলব্ধি করবে এবং ঈশ্বরকে কতখানি জানবে তা কর্মীদের উপরই নির্ভর করে (তবে তা কিছু সংখ্যক মানুষের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য)। কর্মী যেমন হবে, সে যে অনুগামীদের নেতৃত্বদান করে তারাও ঠিক তেমনই হবে। একজন কর্মী যা অকপটভাবে প্রকাশ করে, তা-ই হল তার নিজের সত্তা। যারা তাকে অনুসরণ করে, তাদের কাছ থেকে সে সেই দাবিগুলিই রাখে যা সে নিজে অর্জন করতে চায় বা করতে সক্ষম। অধিকাংশ কর্মীই নিজেরা যা করে তার ভিত্তিতেই সে নিজেদের অনুগামীদের নিকটে দাবি জানায়, যদিও অধিকাংশ অনুগামীই তা করতে বিন্দুমাত্র সক্ষম থাকে না—এবং যা কেউ অর্জন করতে পারে না, তা-ই তার প্রবেশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

যাদের অপ্রয়োজনীয় অংশের কর্তন হয়েছে, যাদের সাথে মোকাবিলা করা হচ্ছে, এবং যারা শাস্তি ও বিচারের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে, তাদের কর্মে অনেক কম বিচ্যুতি থাকে, এবং তাদের কাজের অভিব্যক্তি অনেক বেশি নির্ভুল। যারা কর্মের জন্য নিজেদের স্বাভাবিকতার উপর নির্ভর করে তাদেরই গুরুতর ত্রুটি হয়ে থাকে। নিখুঁত করা হয়নি এমন মানুষদের কর্ম তাদের স্বাভাবিকতাকে অত্যাধিক ভাবে প্রকাশ করে, যা পবিত্র আত্মার কাজে প্রবল বাধা সৃষ্টি করে। তবে একজন মানুষের ক্ষমতা যতই ভালো হোক না কেন, ঈশ্বরের অর্পিত দায়িত্ব পালনের পূর্বে তাদের অপ্রয়োজনীয় অংশের কর্তন, মোকাবিলা, এবং বিচারের মধ্যে দিয়ে যেতেই হয়। যদি তারা এই ধরনের বিচারের সম্মুখীন না হয়ে থাকে, তাহলে তাদের কাজ যত ভালোভাবেই সম্পন্ন হোক না কেন, তা সত্যের নীতিসমূহের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হতে পারে না, এবং তা সর্বদা তাদের নিজস্ব স্বাভাবিকতা এবং মানবিক গুণের ফসল হয়েই রয়ে যায়। যারা অপ্রয়োজনীয় অংশের কর্তন, মোকাবিলা, এবং বিচারের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে, তাদের কাজ যাদের অপ্রয়োজনীয় অংশের কর্তন, মোকাবিলা, এবং বিচার হয়নি, তাদের কাজের তুলনায় নির্ভুলতর। যারা বিচারের মধ্যে দিয়ে যায়নি তারা মানব দেহ ও চিন্তা ছাড়া অন্য কিছুই প্রকাশ করে না, যার সঙ্গে প্রভূত পরিমাণে মিশ্রিত থাকে মনুষ্যসুলভ বুদ্ধিমত্তা ও সহজাত প্রতিভা। তা কিন্তু মানুষের দ্বারা ঈশ্বরের কর্মের যথাযথ প্রকাশ নয়। এই ধরনের মানুষদের যারা অনুসরণ করে তারা তাদের সহজাত ক্ষমতার দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে তাদের সামনে আসে। কারণ, তারা অতিরিক্ত ভাবে মানুষের অন্তর্দৃষ্টি ও অভিজ্ঞতা প্রকাশ করে, ঈশ্বরের মূল অভিপ্রায়ের সঙ্গে যার প্রায় কোনো সম্পর্কই নেই এবং তা থেকে বহুদূরে সরে গিয়েছে, এই ধরনের ব্যক্তিদের কাজ মানুষকে ঈশ্বরের সামনে আনতে পারে না, বরং তাদের মানুষের সামনে নিয়ে আসে। তাই যারা বিচার ও শাস্তির মধ্যে দিয়ে যায়নি তারা ঈশ্বরের অর্পিত দায়িত্ব পালনের যোগ্য নয়। একজন যোগ্য কর্মীর কর্ম মানুষকে সঠিক পথে আনতে পারে এবং তাদের সত্যের মধ্যে মহত্তর প্রবেশের সুযোগ দিতে পারে। তাঁর কর্ম মানুষকে ঈশ্বরের সামনে আনতে পারে। উপরন্তু, যে কর্ম তিনি করেন তা ব্যক্তি-ভেদে ভিন্নতর হতে পারে এবং তা কোনো নিয়মের দ্বারা আবদ্ধ নয়, তা মানুষকে মুক্তি ও স্বাধীনতা দেয়, এবং দেয় জীবনে ক্রমশ বৃদ্ধি ঘটানোর এবং সত্যে গভীরতরভাবে প্রবেশের সামর্থ্য। অযোগ্য কর্মীদের কর্মে অনেক খামতি থেকে যায়। তার কর্ম মূর্খতাপূর্ণ। সে মানুষকে নিছকই কিছু নিয়মের মধ্যে নিয়ে আসতে পারে, এবং সে মানুষের থেকে যা দাবি করেন তা ব্যক্তি-ভেদে ভিন্নতর হয় না; সে মানুষের প্রকৃত প্রয়োজন অনুসারে কাজ করে না। এই ধরনের কাজে প্রভূত পরিমাণে নিয়ম এবং মতবাদসমূহ থাকে, এবং তা মানুষকে বাস্তবের মধ্যে আনতে পারে না, তা মানুষকে জীবনের বিকাশের স্বাভাবিক অনুশীলনের মধ্যেও উপনীত করতে পারে না। তা মানুষকে নিছকই অর্থহীন কিছু নিয়মের মধ্যে আবদ্ধ করতে পারে। এই ধরনের পথনির্দেশ মানুষকে কেবলমাত্র বিপথগামীই করতে পারে। সে তোমায় তার মতো হওয়ার জন্যই নেতৃত্ব দেয়; তার যা আছে এবং সে যা, তারই মধ্যে সে তোমাকে নিয়ে যেতে পারে। নেতারা যোগ্য কিনা, অনুগামীদের পক্ষে তা নির্ণয়ের চাবিকাঠি হল, যে পথে তারা নিয়ে চলেছে সেই দিকে এবং তাদের কাজের ফলাফলের দিকে লক্ষ্য রাখা, এবং সত্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে অনুগামীরা নীতিগুলি গ্রহণ করছে কিনা, এবং তাদের রূপান্তরের জন্য উপযুক্ত অনুশীলনের পথ তারা গ্রহণ করছে কিনা, তা দেখা। বিভিন্ন ধরনের মানুষের বিভিন্ন ধরনের কর্মের মধ্যে পার্থক্য তোমার করা উচিত, একজন নির্বোধ অনুগামী তোমার কখনোই হওয়া উচিত নয়। মানুষের প্রবেশের ক্ষেত্রে এই বিষয়টির গুরুত্ব রয়েছে। কোন ব্যক্তির নেতৃত্বে পথ রয়েছে এবং কোন ব্যক্তির নেতৃত্বে তা নেই সেই পার্থক্য নিরূপণে যদি অক্ষম হও, তাহলে তুমি খুব সহজেই প্রতারিত হবে। তোমার নিজস্ব জীবনের উপর এই সমস্ত কিছুর একটা প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে। নিখুঁত নয় এমন মানুষের কর্মে অতিমাত্রায় স্বাভাবিকতা থাকে; এর সঙ্গে খুব বেশি করে মনুষ্যসুলভ ইচ্ছা মিশ্রিত থাকে। তাদের সত্তা হল স্বাভাবিকতাময়—যা নিয়ে তারা জন্মগ্রহণ করেছে। তা মোকাবিলা হওয়ার পরের জীবন নয়, বা রূপান্তরিত হওয়ার পরের বাস্তব নয়। এই ধরনের কোনো ব্যক্তি কীভাবে জীবনের অন্বেষণে রত মানুষকে সাহায্য করবে? সেই ব্যক্তির যে জীবন তা আসলে রয়েছে তার সহজাত বুদ্ধি ও প্রতিভায়। এই ধরনের বুদ্ধি ও প্রতিভা ঈশ্বর মানুষের কাছ থেকে ঠিক যে দাবিগুলি করেন তার অপেক্ষা সুদূরস্থিত। যদি কোনো ব্যক্তির নিখুঁতকরণ না হয়ে থাকে এবং তার ভ্রষ্ট স্বভাবের কর্তন ও মোকাবিলা না করা হয়ে থাকে, তাহলে তার প্রকাশ করে ও সত্যের মধ্যে বিরাট ব্যবধান রয়ে যাবে; সে যা ব্যক্ত করে তার সঙ্গে অনেক অস্পষ্ট বিষয় মিশ্রিত থাকবে, যেমন তার নিজস্ব কল্পনা এবং তার একতরফা অভিজ্ঞতা। অধিকন্তু, যেভাবেই সে কাজ করুক না কেন, মানুষের মনে হয় যে কোনো সামগ্রিক লক্ষ্য নেই এবং সমস্ত মানুষের প্রবেশের জন্য কোনো সত্যই উপযুক্ত নয়। মানুষের কাছ থেকে যা দাবি করা হয় তার অধিকাংশই তাদের ক্ষমতার বাইরে, যেন তারা হল উচ্চ শাখায় উপবিষ্ট হতে বাধ্য হংসকুল। এটাই মানুষের ইচ্ছার কর্ম। মানুষের ভ্রষ্ট স্বভাব, তার চিন্তাভাবনা, এবং তার ধারণা তার দেহের সমস্ত অংশে ব্যাপ্ত রয়েছে। সত্যকে অনুশীলন করার সহজাত প্রবৃত্তি নিয়ে মানুষ জন্মগ্রহণ করে না, বা সত্যকে সরাসরি উপলব্ধি করার প্রবৃত্তিও তাদের নেই। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে মানুষের ভ্রষ্ট স্বভাব—যখন এই ধরনের স্বাভাবিক ব্যক্তি কাজ করে তখন কি তা বাধা সৃষ্টি করে না? কিন্তু যে মানুষকে নিখুঁত করা হয়েছে তার সেই সত্যের অভিজ্ঞতা রয়েছে যা মানুষের বোঝা উচিত, এবং মানুষের ভ্রষ্ট স্বভাবের জ্ঞানও তার রয়েছে, যাতে তার কাজের অস্পষ্ট ও অবাস্তব অংশগুলি ধীরে ধীরে হ্রাস পায়, মানবিক কলুষতার পরিমাণ কমে যায়, এবং তার কাজ ও সেবা ঈশ্বর নির্ধারিত মানদণ্ডের সবচেয়ে কাছাকাছি আসতে পারে। এইভাবেই তার কাজ সত্যের বাস্তবতায় প্রবেশ করেছে এবং তা বাস্তবিকও হয়ে উঠেছে। মানুষের মনের চিন্তাভাবনা বিশেষত পবিত্র আত্মার কর্মকে অবরুদ্ধ করে। মানুষের সমৃদ্ধ কল্পনা ও সমীচীন যুক্তিবোধ রয়েছে, এবং বিভিন্ন বিষয় সামলানোর এক দীর্ঘ অভিজ্ঞতা তার রয়েছে। মানুষের এই দিকগুলি যদি কর্তন ও সংশোধনের মধ্যে দিয়ে না যায়, তাহলে সেগুলি সমস্ত কাজের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তাই মানুষের কাজ সর্বাঙ্গীনভাবে সঠিক হতে পারে না, বিশেষত সেইসব মানুষের যারা নিখুঁত নয়।

মানুষের কাজ একটা পরিসরের মধ্যেই থাকে এবং তা সীমিত। একজন ব্যক্তি শুধুমাত্র একটি বিশেষ পর্বের কাজই করতে পারে এবং সমগ্র যুগের কাজ তিনি করতে পারেন না—নচেৎ, সে মানুষকে সকল নিয়মের মাঝে উপনীত করবে। মানুষের কর্ম একটা নির্দিষ্ট সময় বা পর্বে প্রযোজ্য হতে পারে। কারণ মানুষের অভিজ্ঞতার একটা পরিসর রয়েছে। কেউই ঈশ্বরের কর্মের সঙ্গে মানুষের কাজের তুলনা করতে পারে না। মানুষের অনুশীলনের বিভিন্ন পথ এবং সত্যের জ্ঞান—সকলই একটি নির্দিষ্ট পরিসরে প্রযোজ্য। তুমি এমন বলতে পার না যে, যে পথে মানুষ চলে তা পূর্ণতই পবিত্র আত্মার ইচ্ছা, কারণ মানুষ পবিত্র আত্মার দ্বারা শুধুমাত্র আলোকিতই হতে পারে, এবং পবিত্র আত্মার দ্বারা সর্বতোভাবে পূর্ণ হতে পারে না। মানুষ যা যা অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারে তা সবই স্বাভাবিক মানুষ্যত্বের পরিসরের ভিতর, এবং তা স্বাভাবিক মানব মনের চিন্তার সীমাকে কখনোই অতিক্রম করতে পারে না। যারা সত্যের বাস্তবতাকে নিয়ে যাপন করতে পারে, তারা এই সীমার মধ্যেই সেই অভিজ্ঞতা লাভ করে। তারা যখন সত্যের অভিজ্ঞতা লাভ করে, তখন তা সততই পবিত্র আত্মার দ্বারা আলোকিত স্বাভাবিক মানব জীবনের এক অভিজ্ঞতা; তা এমন কোনো অভিজ্ঞতার পথ নয় যা স্বাভাবিক মানবজীবন থেকে বিচ্যুত। তারা তাদের মানব জীবন যাপনের ভিত্তিতে পবিত্র আত্মা কর্তৃক আলোকিত সত্যের অভিজ্ঞতা লাভ করে। উপরন্তু, এই সত্য ব্যক্তিভেদে পরিবর্তিত হয়, এবং এর গভীরতা ব্যক্তিবিশেষের অবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত। শুধু এমনই বলা যেতে পারে যে, তারা যে পথে হাঁটছে তা সত্যের অন্বেষণকারী কোনো ব্যক্তির স্বাভাবিক মানবজীবন, এবং তা পবিত্র আত্মার দ্বারা আলোকিত কোনো স্বাভাবিক ব্যক্তির চলার পথ—এমনও বলা যেতে পারে। এমন কেউই কখনো বলতে পারে না যে, যে পথে তারা চলেছে—তা-ই পবিত্র আত্মার পথ। স্বাভাবিক মানব অভিজ্ঞতায়, যেহেতু অনুসরণকারীরা এক নয়, তাই পবিত্র আত্মার কর্মও এক নয়। উপরন্তু, মানুষ যে পরিবেশের অভিজ্ঞতা লাভ করে তা, এবং তাদের অভিজ্ঞতার পরিধি তা-ও, সকলের ক্ষেত্রে এক না হওয়ার কারণে, এবং তাতে তাদের মন ও ভাবনাচিন্তায় সংমিশ্রণ থাকার কারণে, তাদের অভিজ্ঞতাতেও বিভিন্ন মাত্রায় মিশ্রণ থেকে যায়। প্রত্যেক ব্যক্তিই তাদের ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তিগত অবস্থার নিরিখে সত্যকে অনুধাবন করে। সত্যের প্রকৃত অর্থের উপলব্ধি তাদের সম্পূর্ণ নয় এবং তা কতগুলি দিকের মধ্যে একটি দিক মাত্র। যে সত্যের অভিজ্ঞতা মানুষ লাভ করে তার পরিসর প্রতিটি ব্যক্তির অবস্থার নিরিখে আলাদা আলাদা হয়। এইভাবেই, একই সত্যের জ্ঞান বিভিন্ন ব্যক্তির দ্বারা প্রকাশিত হলে তা আর এক থাকে না। এর অর্থ হল, মানুষের অভিজ্ঞতার সবসময়ই একটা সীমাবদ্ধতা থাকে এবং তা সম্পূর্ণভাবে পবিত্র আত্মার ইচ্ছার প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না, এবং মানুষের কাজকেও ঈশ্বরের কর্ম বলে ধারণা করা যেতে পারে না, মানুষ যা প্রকাশ করে তা ঈশ্বরের ইচ্ছার খুব কাছাকাছি এলেও, এবং এমনকি, মানুষের অভিজ্ঞতা পবিত্র আত্মার নিখুঁত করে তোলার কর্মের অত্যন্ত নিকটবর্তী হলেও, এমন ধারণা করা যেতে পারে না। মানুষ শুধুমাত্র ঈশ্বরের সেবক হতে পারে, ঈশ্বরের তাকে যে কাজের দায়িত্ব দেন তা পালন করতে পারে। মানুষ কেবলমাত্র পবিত্র আত্মার দ্বারা আলোকিত জ্ঞান এবং নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার দ্বারা অর্জিত সত্যই প্রকাশ করতে পারে। মানুষ অযোগ্য এবং পবিত্র আত্মার প্রকাশের পথ হয়ে ওঠার শর্তগুলি সে পূরণ করে না। তার কাজই ঈশ্বরের কর্ম—এমন বলার অধিকারী সে নয়। মানুষের কাজের নিজস্ব নীতি রয়েছে, এবং প্রত্যেক মানুষের অভিজ্ঞতা ভিন্নতর এবং তাদের অবস্থাও ভিন্ন-ভিন্ন। মানুষের কাজের মধ্যে পবিত্র আত্মার আলোকপ্রাপ্তির অধীনে তার সমস্ত অভিজ্ঞতা অন্তর্ভুক্ত। এই অভিজ্ঞতাগুলি শুধুমাত্র তার মানবিক সত্তার প্রতিফলন ঘটায় এবং ঈশ্বরের সত্তা বা পবিত্র আত্মার ইচ্ছার প্রতিনিধিত্ব করে না। অতএব, যে পথে মানুষ চলে, সেই পথেই পবিত্র আত্মা চলে—এমন কথা বলা যেতে পারে না, কারণ মানুষের কাজ ঈশ্বরের কর্মের প্রতিফলন ঘটাতে পারে না, এবং মানুষের কর্ম ও মানুষের অভিজ্ঞতা পবিত্র আত্মার ইচ্ছার পূর্ণাংশ নয়। মানুষের কর্ম নিয়মের কবলে পড়ে যেতে পারে, এবং তার কাজের পদ্ধতি সহজেই সীমিত পরিসরে আবদ্ধ হয়, এবং তা মানুষকে কোনো স্বাধীন পথে উপনীত করতে পারে না। অধিকাংশ অনুগামীই এই সীমিত পরিসরের মধ্যেই জীবনযাপন করে, এবং তাদের অভিজ্ঞতা অর্জনের পথের পরিসরও সীমিত। মানুষের অভিজ্ঞতা সর্বদাই সীমিত; তাদের কাজের পদ্ধতিও কয়েকটি প্রকারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, এবং তা পবিত্র আত্মার কাজ বা স্বয়ং ঈশ্বরের কাজের সঙ্গে তুলনীয় নয়। এর কারণ হল, শেষাবধি, মানুষের অভিজ্ঞতা সীমিত। ঈশ্বর যেভাবেই কাজ করুন না কেন, তা নিয়মের দ্বারা শৃঙ্খলিত নয়, যেভাবেই সেই কাজ করা হোক না কেন, তা কোনো একটি নিয়মের দ্বারা সীমাবদ্ধ নয়। ঈশ্বরের কাজের কোনো নিয়ম নেই—তাঁর সমস্ত কর্মই মুক্ত ও স্বাধীন। তাঁকে অনুসরণ করার জন্য মানুষ যত সময়ই ব্যয় করুক না কেন, সে ঈশ্বরের কর্ম পরিচালনাকারী কোনো বিধানের অন্তঃসার আহরণ করতে পারে না। তাঁর কর্ম নীতিনির্দিষ্ট হলেও তা নিত্যনতুন পথে সম্পাদিত হয়, এবং তাতে সবসময়েই নবনব উন্নয়ন ঘটে, এবং তা মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে। কোনো একটি সময়কালে ঈশ্বরের বিভিন্ন ধরনের কাজ থাকতে পারে এবং মানুষকে নেতৃত্ব দেওয়ার বিভিন্ন পথ থাকতে পারে, যাতে মানুষের নিত্যনতুন প্রবেশ ও পরিবর্তন ঘটে। তুমি তাঁর কর্মের বিধানগুলিকে চিহ্নিত করতে পারবে না কারণ তিনি নিত্যনতুন পথে কাজ করেন, এবং একমাত্র এভাবেই ঈশ্বরের অনুগামীরা কোনো নিয়মের দ্বারা শৃঙ্খলিত হয় না। স্বয়ং ঈশ্বরের কর্ম মানুষের ধারণাকে এড়িয়ে চলে এবং তার বিরোধিতা করে। একমাত্র যারা সত্যনিষ্ঠ হৃদয়ে তাঁর অনুসরণ ও অনুগমন করে তাদেরই স্বভাব রূপান্তরিত হবে, এবং কোনো নিয়মের অধীন না হয়ে বা কোনো ধর্মীয় ধ্যানধারণার দ্বারা সীমাবদ্ধ না হয়ে স্বাধীন ভাবে জীবনযাপন করতে পারবে। মানুষের কর্ম তার নিজের অভিজ্ঞতার এবং সে নিজে যা করতে পারে তার ভিত্তিতেই মানুষের কাছে বিবিধ দাবি রাখে। এই সকল চাহিদার মাপকাঠিও একটি নির্দিষ্ট পরিসরের মধ্যেই সীমিত, এবং অনুশীলনের পদ্ধতিও ভীষণভাবেই সীমিত। অনুগামীরা তাই অচেতনভাবেই এই সীমিত পরিসরের ভিতর জীবনযাপন করে; সময় যত এগোয়, তত সেগুলি নিয়ম ও আচার হয়ে দাঁড়ায়। যদি একটি সময়কালের কর্ম এমন কোনো ব্যক্তির নেতৃত্বে পরিচালিত হয় যে ঈশ্বরের ব্যক্তিগত নিখুঁতকরণের মধ্যে দিয়ে যায়নি এবং বিচার গ্রহণ করে নি, তাহলে তার অনুগামীরা সকলে অধার্মিক ও ঈশ্বরবিরোধীতায় পটু হয়ে উঠবে। অতএব, যদি কোনো ব্যক্তি যোগ্য নেতা হয়, তবে তাকে বিচারের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে এবং নিখুঁত হিসাবে গৃহীত হতে হবে। বিচারের মধ্যে দিয়ে যারা যায়নি তাদের কাছে পবিত্র আত্মার কর্ম থাকলেও, তারা অস্পষ্ট ও অবাস্তব বিষয়সকলই প্রকাশ করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষকে তারা অস্পষ্ট ও অতিপ্রাকৃতিক নিয়মের মধ্যে নিয়ে যাবে। ঈশ্বর যে কাজ সম্পাদন করেন তা মানুষের দেহের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তা মানুষের ভাবনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, বরং মানুষের মানুষের ধারণার পরিপন্থী; তা অস্পষ্ট ধর্মীয় রঙের দ্বারা কলুষিত নয়। যে ব্যক্তি ঈশ্বরের দ্বারা নিখুঁত হয়নি সে ঈশ্বরের কর্মের ফলাফল অর্জন করতে পারবে না; তা মানুষের চিন্তার বহু ঊর্ধ্বে।

মানুষের মনে যে কর্ম রয়েছে তা তাদের পক্ষে সাধন করা খুবই সহজ। উদারহণস্বরূপ, ধর্মীয় জগতের যাজক ও নেতারা কর্মের জন্য নিজেদের স্বাভাবিক গুণ ও পদের উপর নির্ভর করেন। যে সকল মানুষ দীর্ঘদিন ধরে তাদের অনুসরণ করে, তারা তাদের প্রতিভার দ্বারা সংক্রমিত হবে, এবং তাদের সত্তার কিছু অংশের দ্বারা প্রভাবিত হবে। তারা মানুষের স্বাভাবিক গুণ, সামর্থ্য ও জ্ঞানের উপর নজর দেয়, এবং তারা বিভিন্ন অতিপ্রাকৃতিক বস্তু এবং অনেক গূঢ়, অবাস্তব মতবাদসমূহের উপর (এই নিগূঢ় মতবাদসমূহকে অবশ্যই অর্জন করা যায় না) মনোযোগ দেয়। মানুষের স্বভাবের পরিবর্তনের উপর কোনো গুরুত্ব তারা দেয় না, পরিবর্তে তারা শুধু প্রচার ও কাজ করার জন্য মানুষের প্রশিক্ষণের উপর জোর দেয়, তাদের জ্ঞান উন্নত করার উপর এবং তাদের অঢেল মতবাদের উপর গুরুত্ব দেয়। মানুষের স্বভাব কতটা পরিবর্তিত হল বা মানুষ সত্যকে কতমাত্রায় উপলব্ধি করল—এসবের উপর তারা গুরুত্ব দেয় না। মানুষের সারমর্ম নিয়ে তারা ভাবিত নয়, মানুষের স্বাভাবিক ও অস্বাভাবিক অবস্থাগুলি সম্বন্ধে জানার চেষ্টা তো আরোই করে না। তারা মানুষের ধারণাগুলির বিরোধিতা বা উদ্ঘাটনও করে না মানুষের ঘাটতি এবং দুর্নীতি-সংক্রান্ত অপ্রয়োজনীয় অংশের কর্তন তো আরোই করে না। তাদের অনুগামীগণের অধিকাংশ নিজস্ব প্রতিভা দিয়ে সেবা করে, এবং তারা যা প্রদান করে তা নিছকই ধর্মীয় ধ্যানধারণা ও ধর্মবিদ্যাগত তত্ত্ব, যা বাস্তবের সঙ্গে সম্পর্কবিহীন, এবং যা মানুষকে জীবন সরবরাহে পূর্ণত অক্ষম। প্রকৃতপক্ষে, তাদের কাজের নির্যাস হল প্রতিভাকে লালন করা, এবং যে ব্যক্তির কিছুই নেই তাকে যাজক-প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের এমন একজন প্রতিভাসম্পন্ন স্নাতক হিসাবে গড়ে তোলা যে পরে কাজ করবে এবং নেতৃত্ব দেবে। ঈশ্বরের ছয় সহস্রবর্ষীয় কার্যে তুমি কোনো বিধান চিহ্নিত করতে পারো? মানুষ যে কাজ করে তার মধ্যে অনেক নিয়ম ও বিধিনিষেধ রয়েছে, এবং মানুষের মস্তিষ্ক খুবই কর্তৃত্বব্যঞ্জক। তাই, মানুষ যে জ্ঞান ও উপলব্ধি প্রকাশ করে তা তাদের অভিজ্ঞতার পরিসরের মধ্যেই সীমিত হয়। এর বাইরে মানুষ কোনোকিছু প্রকাশে অক্ষম। মানুষের অভিজ্ঞতা বা জ্ঞান তার সহজাত গুণ বা প্রবৃত্তি থেকে উৎপন্ন নয় না; তা ঈশ্বরের পথপ্রদর্শন ও প্রত্যক্ষ পালন-পোষণের ফলেই উদ্ভূত। মানুষের শুধু সেই পালন-পোষণ গ্রহণ করার ক্ষমতাই রয়েছে, এবং দেবত্ব কী, তা সরাসরি প্রকাশের কোনো ক্ষমতা মানুষের নেই। মানুষ উৎস হয়ে উঠতে অক্ষম; সেই শুধুমাত্র এমন একটা পাত্র হয়ে উঠতে পারে যা উৎস থেকে জল গ্রহণ করে। এ-ই হল মানুষের প্রবৃত্তি, মানুষ হিসাবে এই স্বাভাবিক ক্ষমতাই একজনের থাকা উচিত। ঈশ্বরবাক্য গ্রহণ করার স্বাভাবিক ক্ষমতা এবং মনুষ্যসুলভ প্রবৃত্তিকে যে হারায়, সেই ব্যক্তি সবচেয়ে মূল্যবান বস্তুটিকে হারিয়ে ফেলে, এবং সৃষ্ট মানুষের কর্মকেও হারায়। ঈশ্বরের বাক্য বা তাঁর কর্ম সম্বন্ধে একজন ব্যক্তির যদি কোনো জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা না থাকে, তাহলে সেই ব্যক্তি তার সেই কর্তব্য হারায় যা এক সৃষ্ট সত্তা হিসাবে তার পালনীয়, এবং একজন সৃষ্ট সত্তা হিসাবে সে তার মর্যাদা হারায়। দেবত্ব কী, তা প্রকাশ করাই ঈশ্বরের সহজাত প্রবৃত্তি, তা সে দেহের মাধ্যমেই প্রকাশিত হোক বা প্রত্যক্ষভাবে আত্মার মাধ্যমে; এ হল ঈশ্বরের সেবাব্রত। ঈশ্বরের কর্মের সময়ে বা তার পরে মানুষ তার নিজের অভিজ্ঞতা বা জ্ঞান প্রকাশ করে (অর্থাৎ সে নিজে কী, তা প্রকাশ করে); এ-ই হল মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি ও মানুষের কর্তব্য, এবং এটাই মানুষের অর্জন করা উচিত। যদিও ঈশ্বর যা প্রকাশ করেন সেই তুলনায় মানুষের অভিব্যক্তিতে অনেক ঘাটতি থেকে যায়, এবং যদিও মানুষের অভিব্যক্তি বহু নিয়মের দ্বারা আবদ্ধ থাকে, তবুও মানুষের অবশ্যই তার পালনীয় কর্তব্য পূরণ করা উচিত এবং যা তার করা দরকার তা তাকে অবশ্যই করতে হবে। নিজের কর্তব্য পূরণের জন্য মানুষের পক্ষে যা যা করা সম্ভব মানুষের তা সকলই করা উচিত, এবং মনে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ থাকা উচিত নয়।

বহু বছরের কর্মের পর, মানুষ তার সেই বহু বছরের অভিজ্ঞতার এবং, সেইসঙ্গে, তার সংগৃহীত প্রজ্ঞা ও নিয়মেরও এটা সারসংক্ষেপ তৈরি করবে। দীর্ঘকাল যাবৎ কাজ করেছে, এমন কেউ তিনি জানে পবিত্র আত্মার কর্মের গতিপ্রকৃতিকে কীভাবে অনুভব করতে হয়; সে জানে কখন পবিত্র আত্মা কাজ করছেন, এবং কখন করছেন না; সে জানে কোনো দায়ভার বহনের সময় কীভাবে সহকারিতা করতে হয়; এবং সে পবিত্র আত্মার কর্মের স্বাভাবিক অবস্থা এবং মানুষের জীবন-বিকাশের স্বাভাবিক অবস্থা সম্বন্ধে সচেতন। এমন ব্যক্তি বহু বছর ধরে কাজ করেছে এবং পবিত্র আত্মার কর্মকে জানে। যারা দীর্ঘকাল ধরে কাজ করেছে তারা প্রত্যয়ের সঙ্গে এবং ধীরস্থির ভাবে কথা বলেন; এমনকি, যখন তাদের কিছুই বলার থাকে না, তখনও তারা স্থিরচিত্ত থাকে। নিজেদের অন্তরে তারা পবিত্র আত্মার কর্ম অন্বেষণের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করেই যেতে পারে। তারা কর্মে অভিজ্ঞ। যে ব্যক্তি দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করেছে, যার প্রভূত অভিজ্ঞতা রয়েছে এবং যে অনেক শিক্ষালাভ করেছে, তার অভ্যন্তরে অনেক কিছু থাকে যা পবিত্র আত্মার কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে; তার দীর্ঘমেয়াদি কাজের এই-ই হল ত্রুটি। যে ব্যক্তি সদ্য কর্ম আরম্ভ করেছে, সে মনুষ্যসুলভ শিক্ষা অথবা অভিজ্ঞতার দ্বারা কলুষিত হয়নি, এবং, বিশেষত, পবিত্র আত্মা কীভাবে কাজ করেন সে সম্বন্ধে তার কোনো জ্ঞান থাকে না। কিন্তু কাজ যত এগোয়, তত সে ক্রমশ পবিত্র আত্মা কার্যের উপায় অনুধাবনের শিক্ষা গ্রহণ করে, এবং পবিত্র আত্মার কার্য প্রাপ্ত হওয়ার উদ্দেশ্যে জন্য কী করণীয়, অপরের বিপন্নতার ঠিক মূলে আঘাত হানার জন্য কী করণীয়, এবং এই ধরনের কিছু সাধারণ জ্ঞান—যা কর্মীদের তাদের থাকা দরকার—সেই বিষয়ে সচেতন হয়ে ওঠেন। সময়ের সাথে সাথে, সে এই ধরনের প্রজ্ঞা ও সাধারণ জ্ঞানের বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে অবগত হয়, এবং, এমন মনে হয়, যে, এবং কাজের সময় সে সহজেই তা ব্যবহার করে। তবে, পবিত্র আত্মা যখন তাঁর কাজের পথ পরিবর্তন করেন, তখনও সেই ব্যক্তি তার কাজের পুরোনো জ্ঞান ও নিয়মাবলিকে আঁকড়ে থাকে, এবং কর্মের নতুন গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে তার যৎসামান্যই জ্ঞান থাকে। বহু বছরের কাজ তথা পবিত্র আত্মার পূর্ণ উপস্থিতি ও পথনির্দেশ তাকে কর্ম সম্বন্ধে অধিকতর শিক্ষা এবং অধিকতর অভিজ্ঞতা দেয়। এই বিষয়গুলি তাকে পরিপূর্ণ করে তোলে আত্মবিশ্বাসে, যা কিন্তু অহংকার নয়। প্রকারান্তরে বললে, তিনি সে কার্যের বিষয়ে বস্তুতই হয় প্রসন্ন, এবং পবিত্র আত্মার কর্ম বিষয়ক তার অর্জিত সাধারণ জ্ঞান নিয়েও সে হয় পরিতৃপ্ত। বিশেষত, অন্যদের যে জ্ঞানলাভ বা উপলব্ধি হয়নি, তা তার নিজের হয়েছে—এই বোধই তাকে নিজের প্রতি আরো বিশ্বাসী করে তোলে; এমন প্রতিভাত হয় যে, তার অন্তরে পবিত্র আত্মার কর্ম নির্বাপিত হতে পারে না, এদিকে অপর কারোই এই বিশেষ আচরণ পাওয়ার যোগ্যতা নেই। একমাত্র তার মতো যেসমস্ত ব্যক্তি বহু বছর ধরে কর্ম করেছে এবং যাদের কার্যকারিতার যথেষ্ট মূল্য রয়েছে একমাত্র তারাই এমন উপভোগের যোগ্য। এই বিষয়গুলি পবিত্র আত্মার নতুন কর্মকে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে তার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি, যদিও বা সে এই নতুন কর্মকে গ্রহণ করতে পারে, তা সে রাতারাতি করতে পারে না। তা গ্রহণের আগে তাকে অনেক মোড় ও বাঁকের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। তার পুরোনো ধারণাকে মোকাবিলা করার পর, তার পুরোনো স্বভাবকে বিচারের পর, তবেই ধীরে ধীরে এই অবস্থার পরিবর্তন আনা যেতে পারে। এই ধাপগুলির মধ্যে দিয়ে না গিয়ে সে অব্যাহতি পেতে পারে না, এবং তার পুরোনো ধারণার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় এমন নতুন শিক্ষা ও কার্য সহজে গ্রহণ করতে পারে না। মানুষের মধ্যে এই বিষয়টিকেই মোকাবিলা করা সবচেয়ে কঠিন, এর পরিবর্তন করা সহজ নয়। একজন কর্মী হিসাবে যদি সে তৎক্ষণাৎ পবিত্র আত্মার কর্ম সম্বন্ধে কোনো উপলব্ধি অর্জন করতে পারে, এবং সেই কর্মের গতিপ্রকৃতির একটা সারসংক্ষেপ তৈরি করতে পারে, এবং যদি সে তার অভিজ্ঞতার দ্বারা সীমাবদ্ধ না হয়ে পুরোনো কাজের আলোকেই নতুন কাজকে গ্রহণ করতে পারে, তবে সে একজন জ্ঞানী ব্যক্তি এবং যোগ্য কর্মী। প্রায়শই মানুষ এমন হয়: নিজেদের কাজের অভিজ্ঞতার সারসংক্ষেপ বিবৃত করতে না পারলেও তারা বেশ কিছু বছর ধরে কাজ করে যায়, অথবা, এমনকি কর্ম সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা বা প্রজ্ঞাকে সংক্ষেপে বিবৃত করার পরেও তারা নতুন কাজকে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে বাধাপ্রাপ্ত হয়, এবং পুরোনো ও নতুন কাজকে যথাযথভাবে বুঝতে পারে না, বা সেগুলিকে সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে পারে না। মানুষকে সামলানো প্রকৃতপক্ষেই কঠিন! বেশিরভাগ মানুষই এমন। যারা বহু বছর ধরে পবিত্র আত্মার কাজের অভিজ্ঞতা লাভ করেছে, তাদের পক্ষে নতুন কর্মকে গ্রহণ করাটা খুব কঠিন, তাদের মধ্যে এমন সব ধারণা থাকে যেগুলিকে তারা নস্যাৎ করে দিতে পারে না, এবং অন্যদিকে, যে ব্যক্তি সবে কাজ শুরু করেছে, তার মধ্যে এই কাজের বিষয়ে সাধারণ জ্ঞানের অভাব থাকে, এবং সে এমনকি সহজতম কিছু বিষয়গুলিকেও সামলাতে পারে না। তোমরা মানুষেরা সত্যিই বড় জটিল! যারা কিছুটা প্রবীণ তারা এতই অহংকারী ও উদ্ধত যে তারা কোথা থেকে এসেছে তা-ও বিস্মৃত হয়েছে। তারা কমবয়সিদের সর্বক্ষণ অবজ্ঞা করে, তবু তারা নতুন কর্মকে গ্রহণ করতে পারে না, এবং এত বছর ধরে সংগৃহীত ও সঞ্চিত ধারণাকে ত্যাগও করতে পারে না। যদিও কমবয়সি ও অজ্ঞ মানুষেরা, স্বল্পমাত্রায় হলেও, পবিত্র আত্মার নতুন কর্মকে গ্রহণ করতে পারে, এবং তারা বেশ উৎসাহী, তবে তারা সর্বদাই দিশেহারা হয়ে পড়ে, এবং সমস্যার সময় তারা হতবিহ্বল ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। তারা উৎসাহী কিন্তু অজ্ঞ। পবিত্র আত্মার কর্ম সম্বন্ধে তাদের যৎসামান্যই জ্ঞান রয়েছে, এবং তারা তা নিজেদের জীবনে ব্যবহার করতে অপারগ; এ হল নিছকই আদ্যোপান্তভাবে অর্থহীন মতবাদ। তোমাদের মতো অনেক মানুষ রয়েছে; তাদের মধ্যে কতজন ব্যবহারের উপযুক্ত? কতজন পবিত্র আত্মার আলোকপ্রাপ্তি ও প্রদীপ্তিকে মান্য করতে পারে এবং ঈশ্বরের ইচ্ছার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হতে পারে? এমন মনে হয় যে, তোমাদের মধ্যে যারা এতদিন অনুগামী ছিলে, তারা খুবই বাধ্য ছিলে, কিন্তু, আসলে, তোমরা তোমাদের ধারণাকে ত্যাগ করোনি, তোমরা এখনো বাইবেলে অনুসন্ধান করছ, অস্পষ্টতায় বিশ্বাস করছ, অথবা বিভিন্ন ধারণার মধ্যে বিচরণ করছ। এমন কেউ নেই যে বর্তমানের প্রকৃত কাজের পরীক্ষা করে দেখে বা গভীরে যায়। তোমরা তোমাদের পুরোনো ধারণা নিয়েই আজকের পথকে গ্রহণ করছ। এই ধরনের বিশ্বাসের দ্বারা তোমরা কী অর্জন করবে? এটা বলা যেতে পারে যে তোমাদের মধ্যে এমন অনেক ধারণা প্রচ্ছন্ন রয়েছে যা প্রকাশিত হয়নি, এবং সেগুলিকে সহজে প্রকাশ না করে বরং গোপন রাখার উদ্দেশ্যে তোমরা কেবলই প্রাণপন চেষ্টা করে যাচ্ছ। নতুন কর্মকে তোমরা একনিষ্ঠভাবে গ্রহণ করো না, এবং তোমাদের পুরোনো ধারণাকে পরিত্যাগের পরিকল্পনাও তোমরা করো না; জীবনধারণের জন্য তোমাদের অনেক জীবনযাপনের দর্শন রয়েছে, এবং সেগুলি সত্যিই সংখ্যায় অনেক। তোমরা তোমাদের পুরোনো ধারণা ত্যাগ করো না, এবং অনিচ্ছা সহকারে নতুন কাজকে বুঝে নাও। তোমাদের হৃদয় অত্যন্ত কুটিল, তোমরা আসলে নতুন কর্মের ধাপগুলিকে হৃদয়ে গ্রহণ করো না। তোমাদের মতো অপদার্থ লোকেরা কি সুসমাচার প্রচারের কাজ করতে পারে? তোমরা কি সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডে এই সুসমাচার প্রচারের দায়িত্ব গ্রহণে সক্ষম? তোমাদের এই সমস্ত অভ্যাস তোমাদের স্বভাবের রূপান্তর ও ঈশ্বরকে জানার ক্ষেত্রে তোমাদের বাধা দিচ্ছে। তোমরা যদি এভাবেই চল, তাহলে তোমরা বহিষ্কৃত হতে বাধ্য।

মানুষের কাজ থেকে ঈশ্বরের কর্মের কীভাবে পৃথগীকরণ তোমাদের জানতেই হবে। মানুষের কাজের মধ্যে তোমরা কী দেখতে পাও? তার কাজের মধ্যে মানুষের অভিজ্ঞতার বহু উপাদান রয়েছে; মানুষ নিজে যা, ঠিক তা-ই সে প্রকাশ করে। ঈশ্বরের নিজস্ব কাজও ঠিক তা-ই প্রকাশ করে যা তিনি স্বয়ং, কিন্তু তাঁর সত্তা মানুষের সত্তার থেকে পৃথক। মানুষের সত্তা মানুষের অভিজ্ঞতা ও জীবনের প্রতিনিধিত্ব করে (মানুষ কী অভিজ্ঞতা অর্জন করে, বা সে জীবনে কোন কোন ঘটনার সম্মুখীন হয়, বা তার কী দর্শন রয়েছে জীবনযাপনের), এবং বিভিন্ন পরিবেশে বসবাসকারী মানুষ বিভিন্ন সত্তার প্রকাশ ঘটায়। সমাজের অভিজ্ঞতা তোমার রয়েছে কিনা এবং তুমি আসলে কীভাবে তোমার পরিবারের মাঝে জীবনযাপন করো এবং পরিবারের মধ্যে থেকে কী অভিজ্ঞতা অর্জন করো তা তোমার প্রকাশের ভিতর দেখা যেতে পারে, কিন্তু ঈশ্বরের অবতারের সামাজিক অভিজ্ঞতা রয়েছে কিনা, তা তুমি তাঁর কাজে দেখতে পাবে না। মানুষের উপাদান সম্পর্কে তিনি পর্যাপ্তরূপেই সচেতন, এবং সকল প্রকার মানুষে সকল প্রকার অভ্যাসকে তিনি প্রকাশ করতে পারেন। তিনি আরো ভালোভাবে মানুষের ভ্রষ্ট স্বভাব ও বিদ্রোহী আচরণকে প্রকাশ করতে পারেন। জাগতিক বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের সঙ্গে তিনি বাস করেন না, কিন্তু নশ্বর জীবকুলের প্রকৃতি এবং জাগতিক বুদ্ধিসম্পন্ন সকল মানুষের দুর্নীতি সম্পর্কে তিনি সচেতন। এ-ই হল তাঁর সত্তা। যদিও তিনি এই জগতের মোকাবিলা করেন না, কিন্তু জগতকে মোকাবিলা করার নিয়ম তাঁর জানা, কারণ মানুষের প্রকৃতিকে তিনি সম্পূর্ণ বোঝেন। তিনি আত্মার সেই কর্ম সম্বন্ধে জানেন যা মানুষের চোখ দেখতে পায় না এবং কান শুনতে পায় না, তিনি বর্তমান ও অতীতকেও জানেন। এর মধ্যে সেই প্রজ্ঞা রয়েছে যা জীবনযাপনের দর্শন নয়, এবং সেই বিস্ময় রয়েছে মানুষের পক্ষে যার মর্মোদ্ধার কঠিন। এ-ই হল তাঁর সত্তা, মানুষের কাছে প্রকাশিত, এবং সেইসঙ্গে, মানুষের থেকে লুক্কায়িত। তিনি যা প্রকাশ করেন তা কোনো অনন্যসাধারণ ব্যক্তির সত্তা নয়, বরং তাঁর সহজাত প্রকৃতি এবং আত্মার সত্তা। তিনি বিশ্বভ্রমণ করেন না, কিন্তু বিশ্বের সবকিছু তাঁর নখদর্পণে। তিনি সেই “মানবসদৃশ” দের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেন যাদের কোনো জ্ঞান বা অন্তর্দৃষ্টি নেই, কিন্তু সেই সমস্ত বাক্য প্রকাশ করেন যা জ্ঞান অপেক্ষা উচ্চমার্গের এবং মহান ব্যক্তিগণেরও ঊর্ধ্বে। তিনি স্থূলবুদ্ধিসম্পন্ন ও অনুভূতিহীন এক মনুষ্যগোষ্ঠীর মধ্যে বাস করেন যাদের মানবিকতাবোধ নেই, এবং যারা দেশাচার ও মানবজাতির জীবনকে উপলব্ধি না, কিন্তু তিনি মানবজাতিকে সাধারণ মানবতা নিয়ে বাঁচার, এবং, তদসহযোগে, মানবজাতির নীচ ও হীন মানবতাকে অনাবৃত করার নির্দেশ দিতে পারেন। এ সকলই তাঁর সত্তা, রক্ত-মাংসের যেকোনো মানুষের চেয়ে ঊর্ধ্বে। তাঁর যে কাজ করা উচিত তার সাধন ও ভ্রষ্ট মানবজাতির উপাদান সম্পূর্ণ রপে প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে তাঁর কোনো জটিল, কষ্টকর, এবং হীন সমাজজীবনের অভিজ্ঞতা অর্জন জরুরি নয়। একটি হীন সমাজজীবন তাঁর দেহের নৈতিক উন্নতিসাধন করে না। তাঁর কর্ম এবং বাক্য শুধুমাত্র মানুষের অবাধ্যতা প্রকাশ করে এবং মানুষকে এই দুনিয়ার মোকাবিলা করার জন্য অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা প্রদান করে না। তিনি যখন মানু্ষকে জীবনদান করেন তখন তাঁর সমাজ বা মানুষের পরিবার বিষয়ক তদন্তের প্রয়োজন ঘটে না। মানুষের উন্মোচন ও বিচার তাঁর দৈহিক অভিজ্ঞতার অভিব্যক্তি নয়; এটা দীর্ঘকাল ধরে মানুষের অবাধ্যতাকে জানার পর এবং মানুষের দুর্নীতিকে ঘৃণা করার পর এটা তাঁর তরফে মানুষের অনাচারের উন্মোচন। তাঁর কর্মের উদ্দেশ্য হল মানুষের কাছে তাঁর স্বভাবের উন্মোচন এবং তাঁর সত্তার প্রকাশ। একমাত্র তিনিই এই কার্য করতে পারেন; এই কার্য রক্তমাংসের কোনো মানুষ অর্জন করতে পারে না। মানুষের তাঁর কার্য থেকে তিনি কী ধরনের ব্যক্তি তা বলতে পারে না। কাজের ভিত্তিতে মানুষ তাঁকে সৃষ্ট ব্যক্তি হিসাবে শ্রেণিভুক্ত করতে পারে না। তাঁর সত্তার কারণেও তিনি সৃষ্ট ব্যক্তিদের শ্রেণিতে পড়তে পারেন না। মানুষ নিছকই পারে তাঁকে এক অ-মানব হিসাবে বিবেচনা করতে, কিন্তু কোন শ্রেণিতে তাঁকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, তা তারা জানে না, অতএব, মানুষ বাধ্য হয়েই তাঁকে ঈশ্বর হিসাবে শ্রেণিভুক্ত করে। মানুষের পক্ষে এমন করা অযৌক্তিক নয়, কারণ ঈশ্বর মানুষের মধ্যে এমন অনেক কর্ম করেছেন যা মানুষ করতে অপারগ।

ঈশ্বর যে কর্ম করেন তা তাঁর দৈহিক অভিজ্ঞতার প্রতিনিধিত্ব করে না; মানুষ যে কাজ করে তা তার অভিজ্ঞতার প্রতিনিধিত্ব করে। প্রত্যেকে তাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলে। ঈশ্বর সত্যকে প্রত্যক্ষ ভাবে প্রকাশ করতে পারেন, কিন্তু মানুষ কেবলমাত্র সেই অভিজ্ঞতার কথাই প্রকাশ করতে পারে যা তার সত্যের অভিজ্ঞতা অর্জনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। ঈশ্বরের কাজের কোনো বাঁধাধরা নিয়ম নেই এবং তা সময় ও ভৌগোলিক গণ্ডির দ্বারা আবদ্ধ নয়। তিনি যা, তা তিনি যে কোনো স্থানে ও কালে প্রকাশ করতে পারেন। তিনি তাঁর খুশিমতো কাজ করেন। মানুষের কাজের কিছু শর্ত ও প্রেক্ষিত রয়েছে, সেগুলি ছাড়া সে কাজ করতে অপারগ এবং ঈশ্বর সম্বন্ধে তার জ্ঞান ও সত্য সম্বন্ধে তার অভিজ্ঞতা প্রকাশে অক্ষম। কোনো কাজ ঈশ্বরের নিজস্ব না মানুষের, তা বলার জন্য তোমাকে উভয়ের পার্থক্য নিরূপণ করতে হবে। যদি ঈশ্বরের কোনো কাজ সেখানে না থাকে এবং শুধু মানুষেরই কাজ থাকে, তাহলে তুমি কেবলমাত্র এইটুকুই জানবে যে, সেই মানুষের শিক্ষা খুবই উচ্চমার্গের এবং তা অন্য কারো ক্ষমতার অতীত; তাদের কথা বলার স্বর, বিভিন্ন বিষয় সামলানোর ক্ষেত্রে তাদের নীতি, এবং কাজের ক্ষেত্রে তাদের অভিজ্ঞ ও একনিষ্ঠ কর্মপদ্ধতি অন্যান্যদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। তোমরা সকলে সুদক্ষ ও উচ্চমার্গের জ্ঞানসম্পন্ন এই ব্যক্তিদের প্রশংসা করো, কিন্তু তুমি ঈশ্বরের কর্ম ও বাক্য থেকে তুমি দেখতে পাওনা যে তাঁর মনুষ্যত্ব কতটা সুউচ্চ। পরিবর্তে, তিনি সাধারণ, এবং, তিনি যখন কাজ করেন, তখন স্বাভাবিক ও বাস্তব, অথচ নশ্বর মানবের দ্বারা অপরিমেয়, যার কারণে মানুষ তাঁর প্রতি এক প্রকার শ্রদ্ধা অনুভব করে। কোনো মানুষের হয়তো নিজের কাজের অভিজ্ঞতা সবিশেষভাবে উন্নত, অথবা হয়তো তার কল্পনা এবং যুক্তিবোধও সবিশেষভাবে উন্নত, এবং তার মনুষ্যত্বও অতীব উত্তম; এই গুণাবলী নিছকই মানুষের প্রশংসা অর্জন করতে পারে, কিন্তু তা তাদের মনে সমীহ ও ভীতি জাগায় না। যারা ভালো কাজ করতে পারে, বিশেষ যাদের প্রচুর অভিজ্ঞতা রয়েছে, এবং যারা সত্যকে অনুশীলন করতে পারে, মানুষ তাদের প্রশংসা করে, কিন্তু এই ধরনের মানুষেররা সমীহ আদায় করতে পারে না, নিছক প্রশংসা ও ঈর্ষারই উদ্রেক করে। কিন্তু যে সমস্ত মানুষ ঈশ্বরের কাজের অভিজ্ঞতা লাভ করেছে তারা ঈশ্বরের প্রশংসা করে না; পরিবর্তে, তারা মনে করে যে ঈশ্বরের কার্য মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে এবং তা মানুষের কাছে অতল, যে তা নতুন এবং বিস্ময়কর। মানুষ যখন ঈশ্বরের কর্মের অভিজ্ঞতা অর্জন করে তখন, তাঁর সম্বন্ধে তাদের সর্বপ্রথম এই জ্ঞান হয় যে তিনি অতল, জ্ঞানী, এবং বিস্ময়কর, এবং তারা অচেতনভাবেই তাঁকে শ্রদ্ধা করে এবং তার সেই কর্মের রহস্যকে অনুভব করে যা মানুষের মনোরাজ্যের সীমার বাইরে। মানুষ শুধুমাত্র তাঁর দাবি মেটানোর উপযুক্ত হয়ে উঠতে চায়, তাঁর বাসনাকে তৃপ্ত করতে চায়; তারা তাঁকে ছাপিয়ে যেতে চায় না, কারণ যে কার্য তিনি সাধন করেন তা মানুষের ভাবনা ও কল্পনার ঊর্ধ্বে ও তাঁর পরিবর্তে মানুষ তা করতে পারে না। এমনকি, মানুষ নিজেও তার ঘাটতিগুলি জানে না, তবুও ঈশ্বর একটা নতুন পথ তৈরি করেছেন এবং মানুষকে এক নতুনতর ও সুন্দরতর পৃথিবীতে নিয়ে যেতে এসেছেন, এবং তাই মানবজাতিও নতুনভাবে অগ্রগতি করেছে এবং একটা নতুন সূচনা প্রাপ্ত হয়েছে। মানুষ ঈশ্বরের জন্য যা অনুভব করে তা প্রশংসা নয়, বা, বলা যেতে পারে যে, তা নিছকই প্রশংসা নয়। তাদের গভীরতম অভিজ্ঞতা হল সম্ভ্রম ও ভালোবাসার; তাদের অনুভূতি হল এই, যে ঈশ্বর বস্তুতই বিস্ময়কর। তিনি সেই কার্য করেন যা মানুষ করতে অপারগ, তিনি সেই বাক্য বলেন যা মানুষ বলতে অপারগ। ঈশ্বরের কর্মের অভিজ্ঞতা যারা লাভ করে তাদের সততই এক অবর্ণনীয় অনুভূতি হয়। পর্যাপ্ত গভীর অনুভূতিসম্পন্ন মানুষেরা ঈশ্বরের ভালোবাসাকে উপলব্ধি করতে পারে; তারা তাঁর মাধুর্য অনুভব করতে পারে, বুঝতে পারে যে তাঁর কার্য কত প্রজ্ঞাপূর্ণ, কত বিস্ময়কর এবং, অতঃপর, তাদের মধ্যে অসীম ক্ষমতা উৎপন্ন হয়। তা ভীতি অথবা সাময়িক ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা নয়, বরং তা হল মানুষের জন্য ঈশ্বরের গভীর করুণা-বোধ এবং তার প্রতি সহিষ্ণুতা। তবে, যে সকল মানুষ ঈশ্বরের শাস্তি ও বিচারের অভিজ্ঞতা লাভ করেছে, তারা তাঁর মহিমাকে উপলব্ধি করে, এবং বোঝে যে তিনি কোনো অন্যায় সহ্য করেন না। এমনকি, যেসকল মানুষ তাঁর প্রভূত কাজের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে, তারাও তাঁকে অনুধাবন করতে অপারগ; প্রকৃতপক্ষেই যারা তাঁকে শ্রদ্ধা করে, তারা জানে যে তাঁর কাজ মানুষের ধারণার সঙ্গে মেলে না, বরং তা সদাসর্বদা মানুষের ধারণার বিপরীতেই যায়। তিনি চান না যে মানুষ সম্পূর্ণরূপে তাঁর স্তুতি করুক বা তাঁর কাছে নিজের সমর্পণের ভান করুক; বরং, তিনি চান যে তাদের মনে প্রকৃত শ্রদ্ধা ও নিবেদনের ভাব আসুক। তাঁর এত কাজের বিষয়ে প্রকৃত অভিজ্ঞতা যার রয়েছে, সে তাঁর প্রতি যে শ্রদ্ধা অনুভব করে—তা নিছক প্রশংসার বহু ঊর্ধ্বে। তাঁর শাস্তি ও বিচারের কারণে মানুষ তাঁর স্বভাবকে প্রত্যক্ষ করেছে, এবং তাই তারা অন্তর থেকে তাঁকে সম্মান করে। শ্রদ্ধা ও মান্যতা পাওয়ার জন্যই ঈশ্বরের অস্তিত্ব, কারণ তাঁর সত্তা ও স্বভাব কোনো সৃষ্ট সত্তার অনুরূপ নয়, এবং তা সৃষ্ট সত্তাদের স্বভাব ও সত্তার চেয়ে বহু ঊর্ধ্বে। ঈশ্বর স্ব-অস্তিত্বধারী এবং চিরস্থায়ী, তিনি এক অ-সৃষ্ট সত্তা, একমাত্র ঈশ্বরই শ্রদ্ধা ও আজ্ঞাকারিতার যোগ্য; মানুষ তার যোগ্য নয়। তাই যে সকল মানুষ কর্মের অভিজ্ঞতা লাভ করেছে এবং তাঁকে সত্যিকারের জেনেছে তারা তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা অনুভব করে। তবে যারা তাঁর সম্বন্ধে নিজেদের ধারণাকে ত্যাগ করতে পারে না—যারা তাঁকে ঈশ্বর হিসাবে একেবারেই মান্য করে না—তাদের তাঁর প্রতি কোনো শ্রদ্ধা নেই, এবং যদিও তারা তাঁকে অনুসরণ করে, তারা বিজিত হয়নি; তারা অবাধ্য প্রকৃতির মানুষ। এইভাবে কাজের মাধ্যমে তিনি যা অর্জন করতে চান, তা হল, যেন সৃষ্টিকর্তার প্রতি সকল সৃষ্ট সত্তার শ্রদ্ধাবনত চিত্ত থাকে, তারা যেন তাঁর উপাসনা করে, এবং তাঁর রাজত্বে নিঃশর্তভাবে নিজেদের সমর্পণ করে। যে সকল কার্য তিনি সাধন করতে চান, এই-ই হল তার চূড়ান্ত ফল। যে সকল মানুষ এই ধরনের কার্যের অভিজ্ঞতা লাভের পরও ঈশ্বরকে এমনকি শ্রদ্ধা করে না, এবং তাদের অতীতের অবাধ্যতার যদি কিছুমাত্রও পরিবর্তন না হয়ে থাকে তাহলে তারা অপসারিত হতে বাধ্য। ঈশ্বরের প্রতি যদি কোনো ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গি নিছক প্রশংসার হয় বা দূর থেকে সম্মান জানানোর হয়, এবং সে যদি তাঁকে বিন্দুমাত্র না ভালোবাসে, তবে এই পরিণতিতেই সেই ব্যক্তি পৌঁছেছে যার হৃদয়ে ঈশ্বরের জন্য কোনো ভালোবাসা নেই, এবং এই ব্যক্তি নিখুঁত হওয়ার শর্তাবলী পূরণ করে না। এত কাজও যদি একজন মানুষের প্রকৃত ভালোবাসা আদায়ে ব্যর্থ হয় তাহলে সেই ব্যক্তি ঈশ্বরকে অর্জন করেনি এবং সে প্রকৃত অর্থে সত্যকে অনুসরণ করে না। যে ব্যক্তি ঈশ্বরকে ভালোবাসে না সে সত্যকেও ভালোবাসে না এবং সে ঈশ্বরকে অর্জন করতে পারে না, ঈশ্বররের অনুমোদন তো আরোই লাভ করতে পারে না। এই ধরনের ব্যক্তিগণ যেভাবেই পবিত্র আত্মার কর্মের অভিজ্ঞতা লাভ করে থাকুক, এবং যেভাবেই বিচারের অভিজ্ঞতা লাভ করে থাকুক না কেন, তারা ঈশ্বরকে সম্মান করতে পারে না। এরা সেই ধরনের মানুষের যাদের প্রকৃতি অপরিবর্তনীয় এবং যারা অত্যন্ত দুষ্ট স্বভাবের। ঈশ্বরকে যারা শ্রদ্ধা করে না তাদের প্রত্যেককে বহিষ্কার করা হবে, শাস্তির লক্ষ্যবস্তু করে তোলা হবে, এবং তাদেরকেও মন্দ কর্ম সংঘটনকারীদের অনুরূপ দণ্ড দেওয়া হবে, এবং তারা অধার্মিক কার্য সংঘটনকারীদের তুলনায়ও অধিকতর যন্ত্রণাভোগ করবে।

পূর্ববর্তী: সাফল্য অথবা ব্যর্থতা নির্ভর করছে মানুষ কোন পথে চলবে তার উপর

পরবর্তী: ঈশ্বরকে জানার পথ হল তাঁর কাজের তিনটি পর্যায় জানা

প্রতিদিন আমাদের কাছে 24 ঘণ্টা বা 1440 মিনিট সময় থাকে। আপনি কি ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভের জন্য তাঁর বাক্য শিখতে 10 মিনিট সময় দিতে ইচ্ছুক? শিখতে আমাদের ফেলোশিপে যোগ দিন। কোন ফি লাগবে না।

সেটিংস

  • লেখা
  • থিমগুলি

ঘন রং

থিমগুলি

ফন্টগুলি

ফন্ট সাইজ

লাইনের মধ্যে ব্যবধান

লাইনের মধ্যে ব্যবধান

পৃষ্ঠার প্রস্থ

বিষয়বস্তু

অনুসন্ধান করুন

  • এই লেখাটি অনুসন্ধান করুন
  • এই বইটি অনুসন্ধান করুন

Messenger-এর মাধ্যমে আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন