ঈশ্বর সমগ্র মানবজাতির ভাগ্য নির্ধারক
মানব প্রজাতির সদস্য এবং ধর্মপ্রাণ খ্রীষ্টান হিসাবে আমাদের সকলের দায়িত্ব এবং কর্তব্য হলো নিজেদের দেহ ও মনকে ঈশ্বরের অর্পিত দায়িত্বে নিযুক্ত করা। কারণ, আমাদের সমগ্র সত্তা ঈশ্বরের থেকেই আগত এবং তাঁর সার্বভৌমত্বের জন্যই সেটা বিদ্যমান রয়েছে। ঈশ্বরের অর্পিত দায়িত্বে এবং মানবগোষ্ঠীর ন্যায্য প্রয়োজনে যদি আমাদের দেহ ও মন কাজে না লাগে, তা হলে ঈশ্বরের দায়িত্ব পালনের জন্য যারা শহীদ হয়েছে আমরা তাদের অযোগ্য হিসাবে বিবেচিত হব এবং যে ঈশ্বর আমাদের সব কিছু দিয়েছেন তাঁর কাছে আরও অকিঞ্চিৎকর হয়ে পড়ব।
ঈশ্বর এই বিশ্বের স্রষ্টা। এই মানবজাতি তিনি সৃষ্টি করেছেন, আবার প্রাচীন গ্রীসের সংস্কৃতি এবং মানব সভ্যতার স্থপতিও তিনি। একমাত্র ঈশ্বর মানুষের শোকে দুঃখে সান্ত্বনা প্রদান করেন, একমাত্র তিনিই মানুষের কল্যাণে দিবারাত্র রত রয়েছেন। মানবজাতির উন্নয়ন তথা অগ্রগতি এবং ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব একে অপরের থেকে অবিচ্ছেদ্য। তেমনই মানবজাতির ইতিহাস এবং ভবিষ্যতও ঈশ্বরের পরিকল্পনাকে লঙ্ঘন করতে পারে না। নিষ্ঠাবান খ্রীষ্টান হলে তুমি নিশ্চিতভাবেই বিশ্বাস করবে, যে কোনও সাম্রাজ্য বা জাতির উত্থান ও পতন ঈশ্বরের পরিকল্পনাতেই ঘটে। ঈশ্বরই একমাত্র জানেন কোনও জাতি বা সাম্রাজ্যের ভাগ্যে কি হতে চলেছে, এবং একমাত্র তিনিই সেই মানবজাতির ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। মানুষ যদি এক উজ্জ্বল আগামীর আশা করে, কোনও রাষ্ট্র যদি আলোকিত এক ভবিষ্যতের আকাঙ্ক্ষায় থাকে, তাহলে মানুষকে ঈশ্বরের প্রার্থনায় নতজানু হতে হবে। স্বীকার করতে হবে নিজের সমস্ত পাপ-কর্ম এবং সে জন্য অনুতপ্ত হতে হবে, এর অন্যথায় মানুষের অদৃষ্ট এবং গন্তব্য অনিবার্য বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে।
নোহের জাহাজ তৈরির সময়কালের দিকে ফিরে দেখা যাক। মানুষ তখন অনাচারে নিমজ্জিত এবং ঈশ্বরের আশীর্বাদ তখন আর তাদের উপর ছিল না, ঈশ্বরের করুণা থেকেও তখন তারা বঞ্চিত, হারিয়েছিল ঈশ্বরের আশ্বাসও। ঈশ্বরের আলোকবর্তিকা না থাকায় তাদের জীবন তখন অন্ধকারাচ্ছন্ন। তারা হয়ে উঠেছিলেন অসচ্চরিত্র এবং ঘৃণ্য ব্যভিচারে নিজেদের ডুবিয়ে দিয়েছিল। এই ধরনের মানুষের ঈশ্বরের আশ্বাস পাওয়ার যোগ্যতা আর ছিল না; ঈশ্বরের মুখোমুখি হওয়ার বা তাঁর বাক্য শোনার যোগ্যতাও তারা হারিয়েছিল। কারণ, তারা ঈশ্বরকে পরিত্যাগ করেছিল, অবজ্ঞা করেছিল তাঁর দেওয়া সব আশীর্বাদ, ভুলে গিয়েছিল ঈশ্বরের দেওয়া শিক্ষা। তাদের হৃদয় ক্রমাগতই ঈশ্বরের থেকে আরও দূরে সরে যাচ্ছিল। সমস্ত যুক্তি এবং মানবিকতা হারিয়ে তারা ক্রমাগতই পাপের পথে চলেছিল। এভাবেই মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে এসে তারা ঈশ্বরের ক্রোধ এবং শাস্তির মুখে পড়ল। একমাত্র নোহই ঈশ্বরের উপাসনা এবং মন্দ কর্ম পরিত্যাগ করতে পেরেছিল। তাই সে ঈশ্বরের বাক্য এবং নির্দেশ শুনতে পেত। ঈশ্বরের নির্দেশ অনুযায়ী সে তার জাহাজ তৈরি করেছিল এবং জীবিত সমস্ত প্রাণীদের সেখানে আশ্রয় দিয়েছিল। এই ভাবে সবকিছু প্রস্তুত হওয়ার পর পৃথিবীতে শুরু হলো ঈশ্বরের ধ্বংসলীলা। এই মহাপ্রলয়ে একমাত্র রক্ষা পেল নোহ এবং তার পরিবারের সাত জন। কারণ নোহ ছিল যিহোবার উপাসক এবং সে মন্দ কর্ম পরিত্যাগ করতে পেরেছিল।
এখন বর্তমান কালের দিকে তাকানো যাক: ঈশ্বরের উপাসনা এবং মন্দ কর্ম পরিত্যাগ করতে সক্ষম, নোহের মত ধার্মিক মানুষ, এখন বিলুপ্ত। তা সত্ত্বেও মানবজাতির প্রতি ঈশ্বরের করুণা অব্যাহত এবং শেষ যুগ পর্যন্ত তিনি মানুষের পাপ মোচন করেন। যে সব মানুষ তাঁর আবির্ভাব কামনা করে, তাঁর বাক্য অনুধাবন করতে সক্ষম, যারা তাঁর অর্পিত দায়িত্ব ভোলে নি এবং নিজেদের হৃদয় ও শরীর সর্বতোভাবে নিবেদন করে, সেই সব মানুষকেই ঈশ্বর চান। যারা তাঁর কাছে শিশুর মত বাধ্য এবং কোনোভাবেই তাঁর বিরোধিতা করে না, তিনি সেই সব মানুষেরই অনুসন্ধান করেন। ঈশ্বরের আনুকূল্য এবং করুণা তোমার উপর তখনই বর্ষিত হবে যদি তুমি ঈশ্বরে নিবেদিত প্রাণ হও এবং অন্য সব প্রভাব থেকে মুক্ত থাকো। উচ্চ পদাধিকার, সম্মান, বিপুল জ্ঞান, অপার ঐশ্বর্য বা বহু মানুষের সমর্থনের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তা যদি তোমাকে ঈশ্বরের আহ্বান শুনতে ও তাঁর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে ব্যাহত না করে এবং তাঁর আজ্ঞাপালনে তুমি বিরত না হও, তাহলে তুমি যা করবে সেই সমস্ত কিছুই এই পৃথিবীর জন্য সব থেকে অর্থবহ এবং মানবজাতির সব থেকে ধার্মিক কাজ হিসাবে চিহ্নিত হবে। তোমার স্বাভিমান এবং লক্ষ্যের কারণে যদি তুমি ঈশ্বরের ডাক প্রত্যাখ্যান করো, তাহলে তুমি যে কাজই করো না কেন তা অভিশপ্ত হবে এবং ঈশ্বরের কাছে তুচ্ছ বলে বিবেচিত হবে। রাষ্ট্রপতি, বিজ্ঞানী, যাজক বা প্রবীণ, তুমি যেকোনো উচ্চ স্থলাভিষিক্তই হও না কেন, যদি শুধু তোমার জ্ঞান এবং কর্ম সম্পাদনের অভিজ্ঞতার উপরে নির্ভর করো, তাহলে তুমি সর্বদাই ব্যর্থ হবে এবং কোনো সময়েই ঈশ্বরের আশীর্বাদ পাবে না। কারণ তোমার কোনো কাজকেই ঈশ্বর ধার্মিক বলে গ্রহণ করবেন না, বা তা মানবজাতির উন্নয়নের জন্য করা হয়েছে বলে ঈশ্বরের কাছে স্বীকৃতি পাবে না। তিনি বলবেন, তোমার জ্ঞান এবং জনসমর্থন ব্যবহার করে তুমি যা কিছু করেছো, সেই সব কাজই ঈশ্বরের দেওয়া সুরক্ষা থেকে মানুষকে বঞ্চিত করার জন্য এবং ঈশ্বরের আশীর্বাদ প্রত্যাখ্যান করার জন্য। তিনি বলবেন যে তুমি মানুষকে অন্ধকার, মৃত্যু এবং এমন এক অসীম অস্তিত্বের দিকে নিয়ে যাচ্ছ যেখানে মানুষ ঈশ্বরকে পায় না, হারায় তাঁর আশীর্বাদ।
মানবজাতি দ্বারা সমাজবিজ্ঞানের নব নব কৃত্রিম কৌশল ব্যবহারের কারণে মানুষের মন বিজ্ঞান এবং অন্যান্য জ্ঞানের চিন্তাতেই আবৃত। জ্ঞান এবং বিজ্ঞানই হয়ে উঠেছে মানবজাতির নিয়ন্তা এবং ঈশ্বর-প্রার্থনার জন্য সেখানে খুব বেশি পরিসর বা অনুকূল পরিবেশ আর নেই। মানুষের অন্তরে ঈশ্বরের স্থান সবচাইতে নিচে নেমে গেছে। হৃদয়ে যদি ঈশ্বরের স্থান না থাকে তাহলে তা অন্ধকার, আশাহীন ও অর্থহীন হয়ে ওঠে। এই সুযোগে কিছু সমাজবিজ্ঞানী, ঐতিহাসিক এবং রাজনীতিবিদ মানুষের হৃদয় ও মস্তিষ্কে অনুপ্রবেশ করার জন্য তাদের সমাজবিজ্ঞানের তত্ত্ব, বিবর্তনের নীতি এবং আরও নানা তত্ত্বের অবতারণা করল। ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই যে মানুষের উদ্ভব, সেই পরম সত্যের সরাসরি বিরোধী এইসব তত্ত্ব। এইভাবে যেসব মানুষ বিশ্বাস করত যে ঈশ্বর সবকিছুর স্রষ্টা তাদের সংখ্যা ভীষণরকম কমে গেল এবং বিবর্তনের তত্ত্বে বিশ্বাসীদের সংখ্যা হয়ে উঠল সর্বাধিক। ধীরে ধীরে সেইসব মানুষের সংখ্যা বাড়তে লাগলো যারা পুরাতন নিয়মের যুগে ঈশ্বরের কার্য এবং তাঁর বাক্যকে শুধুই পৌরাণিক কাহিনী কিংবা কিংবদন্তি বলে মনে করতে শুরু করল। মনে মনে তারা ঈশ্বরের মহিমা এবং বিশালতা সম্পর্কে উদাসীন হয়ে উঠল। নিস্পৃহ হয়ে পড়ল ঈশ্বরের অস্তিত্ব এবং সর্বব্যাপীতায়। মানবজাতির অস্তিত্ব, দেশ ও জাতির ভাগ্য, এসব কোনো কিছুই তাদের কাছে আর গুরুত্বপূর্ণ রইল না। অর্থহীন এক পৃথিবীতে তারা শুধুমাত্র বেঁচে রইল আহার, পান এবং সুখের অন্বেষণে। … হাতে গোনা মাত্র কয়েকজনই চেষ্টা করে যেতে লাগল ঈশ্বর কোথায় কীভাবে তাঁর বিস্তৃত কার্য পরিচালনা করেন, নির্দিষ্ট করেন মানুষের ভাগ্য, সে সব জানতে। এই ভাবেই আমাদের অজান্তে মানব-সভ্যতার কাছে ধীরে ধীরে অস্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল মানুষের অভীষ্ট। এমন অনেক মানুষ এই বিশ্বে আছে যারা মনে করে এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার চাইতে মৃত্যু অনেক বেশি শ্রেয়। এমনকি সভ্যতায় অগ্রগণ্য বলে চিহ্নিত অনেক দেশের মানুষই মনে মনে এই একই ক্ষোভ পোষণ করে। মানব-সভ্যতা রক্ষা করার জন্য শাসক এবং সমাজতাত্ত্বিকরা যতই চেষ্টা করুন না কেন, ঈশ্বরের নির্দেশিকা ছাড়া তা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। মানুষের হৃদয়ের শূন্যতা কেউই পূরণ করতে পারে না, কারণ অন্য কেউ বা কোনও কিছুই মানুষের জীবনের সমতুল্য হতে পারে না এবং কোনও সামাজিক তত্ত্বই মনের শূন্যতা থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে পারে না। বিজ্ঞান, জ্ঞান, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, অবসর এবং আরাম এসবই মানুষের কাছে ক্ষণিক সান্ত্বনা মাত্র। এমন কি, এসব কিছু থাকলেও মানুষ নিশ্চিতভাবে পাপে মগ্ন হয় এবং সমাজের অবিচারের বিরুদ্ধে বিলাপ করে। এসব কিছুই তাকে নিবৃত্ত করতে পারে না লোভ এবং ঔৎসুক্য থেকে। কারণ ঈশ্বর এইভাবেই মানুষকে সৃষ্টি করেছেন যে মানুষের নির্বোধ বলিদান এবং অনাবশ্যক ঔৎসুক্য তাদের একমাত্র আরও বেশি দুর্ভোগের মধ্যেই নিয়ে যাবে, এবং কারণ হয়ে উঠবে ক্রমাগত ভীতিপ্রদ জীবনযাত্রার। তারা জানবে না কীভাবে মানবজাতির ভবিষ্যতের সম্মুখীন হবে অথবা আগামী জীবনের পথে চলবে। এমনকি তারা জ্ঞান এবং বিজ্ঞানকে ভয় করতে শুরু করবে এবং আরো গভীরভাবে ভয় করবে হৃদয়ের শূন্যতাকে। এই বিশ্বের যেখানেই তুমি বাস করো না কেন, তা সে স্বাধীন রাষ্ট্র হোক কিংবা এমন কোনও স্থান যেখানে মানবিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়, যে কোনও স্থানেই নিজের ভাগ্যকে এড়িয়ে যেতে তুমি সর্বতোভাবে অসমর্থ হবে। শাসক বা শাসিত, তুমি যেই হও না কেন, মানবজাতির ভাগ্য, রহস্য এবং গন্তব্য জানার আকাঙ্ক্ষা থেকে মুক্তি পাওয়ার ক্ষমতা তোমার নেই, অন্তরের বিভ্রান্তিকর শূন্যতা থেকে রক্ষা পাওয়ার ক্ষমতাও তোমার নেই। মানবজীবনে অহরহ ঘটা এসব ঘটনাকে সামাজিক ঘটনা হিসাবে আখ্যা দেন সমাজতাত্ত্বিকরা। অথচ আজ পর্যন্ত কোনও বিশিষ্ট মানুষ এইসব সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসেন নি। মানুষ শেষ পর্যন্ত শুধুই মানুষ, ঈশ্বরের স্থান ও জীবন কোনো মানুষই প্রতিস্থাপিত করতে পারে না। ন্যায়সঙ্গত একটি সমাজ, যাতে সকলে পর্যাপ্ত খাদ্য পায়, প্রত্যেকে সমান এবং স্বাধীন, সেই সমাজই মানবজাতির একমাত্র প্রয়োজন নয়। মানবজাতির যা সত্যিকারের প্রয়োজন তা হল ঈশ্বরের পরিত্রাণ এবং তাদের জন্য জীবনের বিধান। যখন মানুষ ঈশ্বর প্রদত্ত জীবনের বিধান এবং তাঁর পরিত্রাণ লাভ করে, কেবলমাত্র তখনই তার সমস্ত প্রয়োজন, অন্বেষণের আকাঙ্ক্ষা এবং আধ্যাত্মিক শূন্যতার সমাধান হতে পারে। যদি কোনও রাষ্ট্রের বা জাতির মানুষরা ঈশ্বরের পরিত্রাণ এবং আশীর্বাদ না পায় তাহলে সেই রাষ্ট্র বা জাতি ক্রমাগতই অবনতি এবং অন্ধকারের পথে এগিয়ে যাবে এবং ঈশ্বর তাদের নিশ্চিহ্ন করবেন।
ধরা যাক তোমার দেশ এখন উন্নতির পথে, কিন্তু তুমি যদি তোমার জনগোষ্ঠীকে ঈশ্বর থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার অনুমতি দাও, তাহলে অচিরেই তারা ঈশ্বরের আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত হবে। অদূর ভবিষ্যতেই পদদলিত হবে তোমার সভ্যতা এবং তোমার জনগণ হয়ে উঠবে ঈশ্বর-বিরোধী এবং অভিসম্পাত করবে স্বর্গকে। এবং এই ভাবেই মানুষের অজান্তেই সেই দেশের ভাগ্য বিনষ্ট হয়ে যাবে। ঈশ্বরের অভিসম্পাত পাওয়া রাষ্ট্রগুলির মোকাবিলা করার জন্য ঈশ্বর বিভিন্ন শক্তিশালী রাষ্ট্রের উত্থান ঘটাবেন, এমনকি তিনি সেই অভিশপ্ত রাষ্ট্রগুলিকে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিতেও পারেন। কোনও জাতি বা রাষ্ট্রের উত্থান এবং পতন নির্ভর করে তাদের শাসককুল ঈশ্বরের উপাসনা করে কি না এবং তাদের জনগোষ্ঠীকে ঈশ্বরের কাছাকাছি নিয়ে আসার এবং তাঁর উপাসনার জন্য উদ্বুদ্ধ করে কি না, তার ওপর। এমনকি এই শেষ যুগে, যেহেতু যারা ঈশ্বরকে আন্তরিকভাবে চায় এবং তাঁর উপাসনা করে তাদের সংখ্যা ক্রমশ কমে আসছে, তাই সেই সব দেশের জন্যই ঈশ্বরের বিশেষ করুণা বর্ষিত হয়, যেসব দেশে খ্রীষ্টধর্মই রাষ্ট্রধর্ম। সেই দেশগুলিকে তিনি ঐক্যবদ্ধ করেন পৃথিবীতে এক ধার্মিক শিবির তৈরির উদ্দেশ্যে; অপরপক্ষে নাস্তিক রাষ্ট্র এবং বাকি যে রাষ্ট্রগুলি প্রকৃত ঈশ্বরের উপাসনা করে না, তারা হয়ে ওঠে সেই ধার্মিক শিবিরের প্রতিপক্ষ। এই উপায়ে, মানবজাতির মধ্যে নিজের কাজ পরিচালনার জন্য ঈশ্বরের একটা স্থান রয়েছে, তার পাশাপাশি তিনি সেই সব দেশকেও অর্জন করেন যারা ধার্মিক কর্তৃত্বের চর্চা করে, যে দেশ তাঁকে প্রতিরোধ করে সেখানে নিষেধাজ্ঞা এবং অনুমোদন আরোপ করেন। এসব সত্ত্বেও খুব বেশি মানুষ ঈশ্বরের উপাসনা এখনও করে না। কারণ, মানবজাতি ঈশ্বরের থেকে বহুলাংশেই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, দীর্ঘকাল ধরে ভুলে আছে তাঁর অস্তিত্বের কথা। বাকি থাকে শুধু সেই রাষ্ট্রগুলি যারা ন্যায়পরায়ণতার চর্চা করে এবং অধার্মিকতার বিরোধিতা করে। ঈশ্বরের ইচ্ছার থেকে এইসব বহুদূরের ঘটনা; কারণ কোনও রাষ্ট্রের শাসক চান না যে তাদের জনগোষ্ঠীর নির্ধারক হয়ে উঠুন ঈশ্বর, কোনো রাজনৈতিক দলই ঈশ্বর উপাসনার কারণে মানুষকে সংগঠিত করে না, প্রতিটি রাষ্ট্র জাতি, শাসকগোষ্ঠী এমনকি প্রতিটি মানুষের হৃদয়েও ঈশ্বরের ন্যায়সঙ্গত স্থান বিচ্যুত হয়েছে। যদিও পৃথিবীতে ধার্মিক শক্তির অস্তিত্ব আছে, কিন্তু যে রাষ্ট্রব্যবস্থায় মানুষের হৃদয়ে ঈশ্বরের স্থান নেই, তা নেহাতই ভঙ্গুর এবং ক্ষণজীবী। ঈশ্বরের আশীর্বাদ ছাড়া যেকোনো রাজনৈতিক অঙ্গনেই থাকবে বিশৃঙ্খলা, এবং তুচ্ছ কোনও ধাক্কাও তা সামলাতে পারবে না। আর, মানুষের জীবনে ঈশ্বরের আশীর্বাদ না থাকলে তাহলে তা হবে সূর্যবিহীন পৃথিবীর মতো। মানুষের উন্নতির জন্য শাসকরা যতই পরিশ্রম করুন, যতই ধর্মীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হোক, এর কোনোটিই মানবজাতিকে অনাগত ভবিষ্যতের জোয়ার থেকে রক্ষা করতে বা তার ভাগ্য বদলাতে পারবে না। মানুষ বিশ্বাস করে, যে রাষ্ট্রে মানুষ পর্যাপ্ত খাদ্য-বস্ত্র পায় এবং শান্তিতে থাকে তাই হল ভালো রাষ্ট্র এবং তা একটি দক্ষ নেতৃত্বের হাতে আছে। কিন্তু ঈশ্বর সে কথা মনে করেন না। তিনি মনে করেন, যে সব দেশে কেউই তাঁর উপাসনা করে না সেগুলি তিনি ধ্বংস করবেন। মানুষের চিন্তাধারার সাথে ঈশ্বরের চিন্তাধারার কোনোই মিল নেই। যদি কোনও রাষ্ট্রের প্রধান ঈশ্বরের আরাধনা না করে, তাহলে সে রাষ্ট্রের ভাগ্য অত্যন্ত করুণ এবং সেই রাষ্ট্রের কোনও গন্তব্য নেই।
মানুষের রাজনীতিতে ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ কোনও ভূমিকা না থাকলেও সেই রাষ্ট্র বা জাতির ভাগ্য তিনিই নিয়ন্ত্রণ করেন। ঈশ্বর এই পৃথিবীর এবং মহাবিশ্বের নিয়ন্তা। ঈশ্বরের পরিকল্পনা এবং মানুষের ভাগ্য নিবিড় ভাবে জড়িত এবং কোনও মানুষ, জাতি বা রাষ্ট্র—কেউই ঈশ্বরের সার্বভৌমত্বের বাইরে যেতে পারে না। মানুষ যদি নিজের ভাগ্য জানতে চায়, তাহলে তাকে অবশ্যই ঈশ্বরের শরণ নিতে হবে। যারা ঈশ্বরকে অনুসরণ এবং উপাসনা করে তাদের জীবনে ঈশ্বর অগ্রগতি নিয়ে আসবেন এবং যারা তাঁর বিরোধিতা ও প্রত্যাখ্যান করে তাদের পতন এবং ধ্বংস অনিবার্য।
বাইবেলে বর্ণিত সেই দৃশ্যের কথা স্মরণ করো যখন ঈশ্বর সদোম ধ্বংস করেন, এবং মনে করো কীভাবে লোটের সহধর্মিণী লবণের স্তম্ভে পরিণত হয়েছিল। মনে করে দেখো, নীনবীর অধিবাসীরা কীভাবে চীর পরিধান করে ভস্মস্তূপে বসে তাদের পাপের জন্য অনুশোচনা প্রকাশ করেছিল, আর মনে করো, ২,০০০ বছর আগে ইহুদীরা যীশুকে ক্রুশবিদ্ধ করার পর কী হয়েছিল। ইসরায়েল থেকে ইহুদিদের বিতাড়িত করা হয়েছিল এবং পৃথিবীর অন্যত্র তারা পালিয়ে গিয়েছিল। হত্যা করা হয়েছিল অনেককেই। তাদের রাষ্ট্রের ধ্বংসের কারণে সমগ্র ইহুদি জাতি অভূতপূর্ব এক যাতনার শিকার হয়েছিল। ঈশ্বরকে ক্রুশে বিদ্ধ করে তারা যে জঘন্য পাপ করেছিল সে কারণেই ঈশ্বরের ক্রোধ তাদের উপর নেমে এসেছিল। মূল্য দিতে হয়েছিল তাদের কৃতকর্মের এবং পেতে হয়েছিল তাদের অপরাধের শাস্তি। ঈশ্বরের নিন্দা এবং তাঁকে প্রত্যাখ্যান করায় তাদের ভাগ্য নির্দিষ্ট হয়ে গিয়েছিল: ঈশ্বরের দেওয়া শাস্তি তাদের পেতেই হবে। শাসকদের কুকর্মের ফলেই তাদের সারা দেশ এবং জাতির এই তিক্ত পরিণতি এবং বিপর্যয় ঘটেছিল।
আজ ঈশ্বর আবার পৃথিবীতে এসেছেন তাঁর কার্য সম্পাদনের জন্য। একনায়কতন্ত্রের উদাহরণ, নাস্তিকতার দুর্ভেদ্য দুর্গ হিসেবে পরিচিত চীন, হল তাঁর প্রথম গন্তব্য। ঈশ্বর তাঁর প্রজ্ঞা এবং ক্ষমতা বলে একদল মানুষকে অর্জন করেছেন। সমস্ত উপায়ে চীনের শাসক গোষ্ঠী শিকারের জন্য তাঁকে খুঁজে বেড়াচ্ছে এবং তাঁর জন্য দুঃসহ নিপীড়নের বিধান দিয়েছে, বিশ্রাম বা আশ্রয়ের কোনও জায়গাই নেই। তা সত্ত্বেও তিনি যা করতে চান তা করে চলেছেন, তাঁর বাক্য এবং সুসমাচার প্রচারিত হচ্ছে সর্বত্র। তাঁর সর্বশক্তিমানতাকে কেউই পরিমাপ করতে পারে না। চীন হল সেই দেশ, যেখানে ঈশ্বর শত্রু হিসাবে বিবেচিত হলেও তিনি কিন্তু সেখানে তাঁর কাজ বন্ধ করেন নি। বরং তাঁর কাজ ও বাক্য দিনে দিনে বেশি সংখ্যক মানুষের কাছেই গৃহীত হচ্ছে। কারণ, ঈশ্বর মানবজাতির প্রত্যেক সদস্যকে যত দূর সম্ভব উদ্ধার করেন। আমরা বিশ্বাস করি, কোনও রাষ্ট্র বা শক্তি ঈশ্বরের ইচ্ছা পূরণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। যারা ঈশ্বরের কাজের পথে অন্তরায় হয়, ঈশ্বরের বাক্যের বিরোধিতা করে, ঈশ্বরের পরিকল্পনা রূপায়ণের পথে বিশৃঙ্খলা বা বিঘ্ন ঘটাতে চায়, তারা শেষ পর্যন্ত ঈশ্বরের দ্বারা শাস্তি পাবেই। নরকস্থ হবে ঈশ্বরের কাজের বিরোধীরা; কোনও রাষ্ট্র যদি ঈশ্বরের কার্য সম্পাদনে প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠে, তবে তা ধ্বংস হবে। কোনও জাতি যদি ঈশ্বরের বিরোধিতা শুরু করে, তাহলে তা পৃথিবী থেকে মুছে যাবে, তাদের কোনো অস্তিত্বই থাকবে না। আমি বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্র, দেশ এমন কি প্রতিটি ক্ষেত্রের মানুষকে অনুরোধ করছি তারা যেন ঈশ্বরের বাক্য শোনেন, ঈশ্বরের কার্য দেখেন এবং মানবজাতির ভাগ্য সম্পর্কে মনোযোগী হন, যাতে ঈশ্বর সর্বোচ্চ পবিত্রতা, সম্মান এবং সর্বোচ্চতায় এককভাবে মানবসমাজে উপাসিত হন, এবং সমগ্র মানবজাতিই ঈশ্বরের আশীর্বাদ পায়, যেমন যিহোবার আশ্বাসপুষ্ট হয়েছিলেন অব্রামের উত্তরাধিকারীরা, যেভাবে ঈশ্বরের প্রথম সৃষ্টি আদম ও হবা বসবাস করতেন এদনের উদ্যানে।
প্রবল জলোচ্ছ্বাসের মতই ঈশ্বরের কাজ এগিয়ে চলে। তাঁর যাত্রা কেউই থামাতে বা আটকাতে পারে না। যারা তাঁর বাক্য মনোযোগ দিয়ে শোনে এবং তাঁর অন্বেষণে তৃষ্ণার্ত, একমাত্র তারাই তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করতে পারে এবং তাঁর প্রতিশ্রুতি পায়। যারা তা করে না তারা অপ্রতিরোধ্য বিপর্যয় এবং উপযুক্ত শাস্তির শিকার হবে।