বিধানের যুগের কার্য
যিহোবা ইস্রায়েলীদের উপর যে কাজ করেছিলেন, তা মানবজাতির কাছে ঈশ্বরের আদি পার্থিব স্থানটিকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল, যা আবার ছিল সেই পবিত্র স্থানও যেখানে তিনি উপস্থিত ছিলেন। তিনি তাঁর কাজ ইস্রায়েলের জনগণের মধ্যেই আবদ্ধ রেখেছিলেন। প্রথমে, ইস্রায়েলের বাইরে তিনি কাজ করেননি, বরং তার পরিবর্তে এমন মানুষদের মনোনীত করেছিলেন, যারা তাঁর কাজের পরিধিকে সীমাবদ্ধ রাখার উপযুক্ত। ইস্রায়েলই সেই স্থান যেখানে ঈশ্বর আদম ও হবাকে সৃষ্টি করেছিলেন, এবং সেই স্থানের ধূলিকণা দিয়ে যিহোবা তৈরী করেছিলেন মানুষকে; এই স্থানই পৃথিবীতে তাঁর কাজের ভিত্তি হয়ে ওঠে। নোহ এবং আদমের বংশধর ইস্রায়েলীরাই ছিল পৃথিবীতে যিহোবার কাজের মানব ভিত্তি।
এই সময়, ইস্রায়েলে যিহোবার কাজের গুরুত্ব, উদ্দেশ্য এবং বিভিন্ন পদক্ষেপ ছিল সমগ্র বিশ্বে তাঁর কাজের সূচনা করার জন্য, যে কাজ ইস্রায়েলকে কেন্দ্র করে, ক্রমে অইহুদি জাতিবর্গের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে। এই নীতি অনুসারেই তিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ড জুড়ে কাজ করেন—একটি আদর্শ স্থাপন করা এবং ক্রমে তাকে প্রসারিত করা, যতক্ষণ না বিশ্বের সব মানুষ তাঁর সুসমাচার গ্রহণ করে। প্রথম ইস্রায়েলীরা ছিল নোহর বংশধর। এই মানুষেরা শুধুমাত্র যিহোবার নিঃশ্বাসের দ্বারা সমৃদ্ধ হয়েছিল, এবং জীবনের মূল প্রয়োজন মেটানোর জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান যথেষ্ট পরিমাণেই পেয়েছিল, কিন্তু যিহোবা কেমন ঈশ্বর, বা মানুষের সম্পর্কে তাঁর কী ইচ্ছা এসব তারা জানতো না, সকল সৃষ্টির প্রভুকে সম্মান কীভাবে করতে হবে, তাও তাদের অজানা ছিল। কোনো নিয়ম ও বিধান মেনে চলতে হবে কিনা,[ক] অথবা স্রষ্টার প্রতি সৃষ্ট সত্তার পালন করার মতো কোনো কর্তব্য আছে কিনা, আদমের উত্তরপুরুষেরা এসবের কিছুই জানতো না। তারা কেবল জানতো যে, স্বামী তার পরিবার প্রতিপালনের জন্য প্রভূত পরিশ্রম করবে, আর স্ত্রী তার স্বামীর কাছে নিজেকে সমর্পণ করবে এবং যিহোবার সৃষ্ট মানবজাতির বংশধারাকে অক্ষুণ্ণ রাখার কাজ করবে। অন্যভাবে বলতে গেলে, এই ধরনের লোকেরা যারা শুধুমাত্র যিহোবার নিঃশ্বাস ও তাঁর প্রাণশক্তি পেয়েছিল, কীভাবে ঈশ্বরের বিধান অনুসরণ করা যায় অথবা সকল সৃষ্টির প্রভুকে কী উপায়ে সন্তুষ্ট করা যায়, এ সম্পর্কে তারা কিছুই জানতো না। তাদের জ্ঞানের পরিধি বড়ই সামান্য ছিল। তাই যদিও তাদের হৃদয়ে কোনো কুটিলতা অথবা শঠতা ছিল না এবং তাদের মধ্যে ঈর্ষা ও বিবাদপ্রবণতাও খুবই কম ছিল, তা সত্ত্বেও সকল সৃষ্টির প্রভু যিহোবা সম্পর্কে তাদের কোনো জ্ঞান বা বোধ ছিল না। মানবজাতির এই পূর্বপুরুষরা কেবল যিহোবার বস্তু ভোজন করতে এবং যিহোবার বস্তু উপভোগ করতে জানতো, কিন্তু কীভাবে যিহোবার প্রতি সম্মান জানাতে হবে তা জানতো না; তারা অবহিত ছিল না যে যিহোবাই সেই এক ও অদ্বিতীয়, যাঁর সামনে তাদের নতজানু হয়ে প্রার্থনা করা উচিত। অতএব তাদের কীভাবে তাঁর সৃষ্ট জীব বলা যাবে? যদি তাই হত, তাহলে “যিহোবাই হলেন সকল সৃষ্টির প্রভু” এবং “তিনি মানবজাতির সৃষ্টি করেন যাতে মানুষ তাকে মূর্ত করে তুলতে পারে, তাঁকে গৌরবান্বিত করে, এবং তাঁর প্রতিনিধিত্ব করে”-এইসব কথা কি অর্থহীন হয়ে যেত না? যিহোবার প্রতি যাদের কোনো সম্মান ছিল না, তারা কীভাবে তাঁর মহিমার সাক্ষ্য হয়ে উঠতে পারতো? কীভাবেই বা তারা তাঁর মহিমার প্রকাশ হয়ে উঠতে পারতো? আমি আমার প্রতিমূর্তিতেই মানুষকে সৃষ্টি করেছি”- যিহোবার এই বাক্য কি তাহলে সেই মন্দ, সেই শয়তানের হাতের অস্ত্র হয়ে উঠতো না? এই কথাগুলি কি তাহলে যিহোবার মানবজাতি সৃষ্টির প্রতি অসম্মানের চিহ্ন হয়ে উঠতো না? সেই পর্যায়ের কাজ সম্পূর্ণ করার জন্য, যিহোবা, মানবজাতিকে সৃষ্টি করার পরে, আদম থেকে নোহ পর্যন্ত তাদের কোনো নির্দেশ দেননি অথবা পরিচালনা করেননি। বরং, বিধ্বংসী বন্যায় পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পরেই তিনি আদম ও নোহর উত্তরপুরুষ ইস্রায়েলীদের পথনির্দেশ দেওয়া শুরু করেন। ইস্রায়েলে তাঁর কাজ এবং কথন সমগ্র ইস্রায়েল ভূমি জুড়ে যারা তাদের জীবন যাপন করতো তাদের সকলকে পথনির্দেশ দিয়েছিল, এইভাবে মানবজাতিকে দেখিয়েছিল, এই নয় যে যিহোবা শুধু মানুষের মধ্যে প্রাণবায়ু সঞ্চার করতে পারেন যাতে মানুষ তাঁর কাছ থেকে জীবন লাভ করে এবং ধূলিকণা থেকে এক সৃষ্ট সত্তা হিসাবে উত্থিত হয়, বরং তিনি মানবজাতিকে ভস্মীভূতও করতে পারেন, মানবজাতিকে অভিসম্পাতও করতে পারেন, এবং তাঁর দণ্ড দিয়ে মানবজাতিকে পরিচালনাও করতে পারেন। তাই তারা এও দেখেছিল যে, যিহোবা পৃথিবীতে মানুষের জীবনের পথনির্দেশ দিতে পারেন এবং দিন ও রাত্রির সময় অনুসারে মানবজাতির মাঝে কথা বলতে ও কাজ করতে পারেন। তাঁর কাজের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল তাঁর সৃষ্ট প্রাণীরা যাতে জানতে পারে যে তাঁর চয়ন করা ধূলার থেকেই মানবজাতির জন্ম, এবং মানুষ তাঁরই হাতে সৃষ্টি হয়েছে। শুধু তাই নয়, তিনি তাঁর কাজ ইস্রায়েলেই শুরু করেছিলেন যাতে অন্যান্য মানুষ এবং রাষ্ট্র (যারা বস্তুত ইস্রায়েলের থেকে পৃথক ছিল না, বরং ইস্রায়েলীদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা আদম ও ইভেরই বংশধর) ইস্রায়েলের থেকে যিহোবার সুসমাচার গ্রহণ করতে পারে, যাতে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সকল প্রাণী যিহোবাকে সম্মান করতে ও তাঁকে মহান হিসাবে গণ্য করতে পারে। যিহোবা যদি তাঁর কাজ ইস্রায়েলে শুরু না করে তার পরিবর্তে মানবজাতিকে সৃষ্টি করে পৃথিবীর বুকে ইচ্ছামতো জীবনযাপন করতে দিতেন, তাহলে সেই ক্ষেত্রে মানুষের জৈবিক প্রকৃতির কারণেই (এক্ষেত্রে প্রকৃতির অর্থ হল, মানুষ চোখে যা দেখতে পায়না, তা তারা কোনোদিনই জানতে পারেনা, অর্থাৎ তারা কখনোই জানতে পারতো না যে যিহোবাই মানবজাতির সৃষ্টি করেছেন, এমনকি কেন তা করেছেন, তাও উপলব্ধি করতে পারতো না) তারা জানতেও পারতো না যে যিহোবাই মানবজাতির সৃষ্টি করেছেন অথবা তিনিই সকল সৃষ্টির প্রভু। যিহোবা যদি মানবজাতির সৃষ্টি করে তাদের পৃথিবীতে এনে হাত ঝেড়ে চলে যেতেন, তাদের পথনির্দেশ দেওয়ার জন্য কিছু সময় পর্যন্ত তাদের মাঝে না থাকতেন, তাহলে সমগ্র মানবজাতি শূন্যতায় ফিরে যেত; এমনকি, আকাশ ও পৃথিবী এবং তাঁর সৃষ্টি করা অগণ্য সমস্ত কিছু, এবং সকল মানবজাতি, শূন্যতায় ফিরে যেত এবং সর্বোপরি তারা শয়তানের দ্বারা পদদলিত হয়ে যেত। এইভাবে “এই পৃথিবীতে, অর্থাৎ তাঁর সৃষ্টির মাঝে, তাঁর অধিষ্ঠিত হওয়ার জন্য একটি স্থান থাকা উচিত, একটি পবিত্র স্থান” এই মর্মে যিহোবার যে ইচ্ছা তা সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়ে যেত। আর তাই, মানবজাতিকে সৃষ্টি করার পর, তিনি যে তাদের জীবনে পথনির্দেশ দেওয়ার জন্য তাদের মাঝে অবস্থান করতে এবং তাদের মাঝে থেকে তাদের সঙ্গে কথা বলতে পেরেছেন—তা সবই শুধু তাঁর বাসনা বাস্তবায়িত করার জন্য, এবং তাঁর পরিকল্পনা রূপায়ণের জন্য। ইস্রায়েলে তিনি যে কাজ করেছিলেন তা ছিল শুধুমাত্র তাঁর সেই পরিকল্পনার বাস্তব রূপায়ণের জন্য, যা তিনি তৈরী করেছিলেন তাঁর সকল বস্তু সৃষ্টি করারও আগে। এবং তাই, তাঁর সর্বপ্রথমে ইস্রায়েলীদের মাঝে কাজ করা এবং তাঁর সকল বস্তু সৃষ্টি করার মধ্যে কোনো বিরোধ নেই, বরং উভয়ই করা হয়েছিল তাঁর ব্যবস্থাপনার, তাঁর কাজের, ও তাঁর মহিমার স্বার্থে, এবং তাঁর মানবজাতি সৃষ্টির অর্থকে গভীরতর করতে। নোহর পরে আরো দুহাজার বছর পর্যন্ত তিনি পৃথিবীতে মানবজাতির জীবনের পথনির্দেশ করেছিলেন, যে সময় তিনি মানবজাতিকে শিখিয়েছিলেন যে যিহোবা, যিনি সকল সৃষ্টির প্রভু, তাঁর প্রতি কীভাবে সম্মান জ্ঞাপন করতে হয়, কীভাবে নিজেদের জীবনকে পরিচালনা করতে হয়, এবং কীভাবে জীবনযাপন অব্যাহত রাখতে হয়, এবং সবচেয়ে বেশি, কীভাবে যিহোবার সাক্ষী হিসাবে কাজ করতে হয়, তাঁর প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করতে হয়, ও তাঁকে সম্মান জ্ঞাপন করতে হয়, এমনকি সঙ্গীতের মাধ্যমে কীভাবে তাঁর স্তুতি করতে হয়, যেমন দায়ূদ ও তার ধর্মযাজকরা করেছিল।
যিহোবা যে দুহাজার বছর ধরে কাজ করেছিলেন, তার আগে মানুষ কিছুই জানতো না, এবং প্রায় সমগ্র মানবজাতি ভ্রষ্টাচারে পতিত ছিল, যতক্ষণ না, বিধ্বংসী বন্যায় পৃথিবী ধ্বংসের আগে, তারা অশ্লীলতা ও ভ্রষ্টাচারণের এতটা গভীরে পৌঁছে গেছিল যে তাদের হৃদয়ে যিহোবার কোনো স্থান ছিল না, এবং তাঁর পথের প্রতি আকাঙ্খারও কোনো স্থান ছিল না। যিহোবা কোন কাজ করতে চলেছেন তা তারা কখনোই বোঝেনি; তাদের মধ্যে যুক্তিবোধের অভাব ছিল, জ্ঞানের অভাব আরও বেশি ছিল, এবং শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়া যন্ত্রের মতো তারা সম্পূর্ণভাবে মানুষ, ঈশ্বর, পৃথিবী, জীবন ইত্যাদি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ ছিল। পৃথিবীতে তারা নানা প্রলোভনে লিপ্ত ছিল, যেমন সেই সর্প, এবং এমন কথা বলত, যা যিহোবার প্রতি অপরাধের সমান, কিন্তু যেহেতু তারা অজ্ঞ ছিল, তাই যিহোবা তাদের শাস্তি প্রদান করেননি বা অনুশাসিত করেননি। কেবল বন্যার শেষে, নোহর বয়স যখন ৬০১ বছর, তখন যিহোবা নোহর সামনে আনুষ্ঠানিকভাবে আবির্ভূত হন, এবং বিধানের যুগ শেষ হওয়া পর্যন্ত, অর্থাৎ মোট ২,৫০০ বছর ধরে, নোহ ও তার পরিবারকে পথনির্দেশ দেন এবং যেসব পশুপাখি নোহ ও তার বংশধরদের সাথে বন্যার পরেও জীবিত ছিল তাদের নেতৃত্ব দেন। ইস্রায়েলে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে কাজের মধ্যে ছিলেন মোট ২,০০০ বছর, আর একইসাথে ইস্রায়েলে ও তার বাইরে কাজ করেছিলেন ৫০০ বছর ধরে, অর্থাৎ সবমিলিয়ে হয় ২,৫০০ বছর। এই সময়কালে, তিনি ইস্রায়েলীদের নির্দেশ দেন যে যিহোবার সেবা করতে হলে তাদের মন্দির নির্মাণ করতে হবে, ধর্মযাজকের পোশাক পরিধান করতে হবে, এবং ভোরবেলা খালি পায়ে হেঁটে মন্দিরে আসতে হবে, পাছে তাদের জুতোর দ্বারা মন্দির অপবিত্র হয় এবং মন্দিরের চূড়া থেকে তাদের উপর আগুন নিক্ষেপিত হয় ও অগ্নিদগ্ধ করে তাদের মৃত্যু ঘটায়। তারা তাদের কর্তব্য পালন করেছিল এবং যিহোবার পরিকল্পনার কাছে সমর্পণ করেছিল। তারা মন্দিরে যিহোবার উপাসনা করত, এবং যিহোবার প্রকাশ গ্রহণ করার পর, অর্থাৎ, যিহোবা কথা বলার পর, তারা অসংখ্য মানুষকে নেতৃত্ব দেয় এবং তাদের শেখায় যে তাদের উচিত যিহোবাকে—তাদের ঈশ্বরকে, সম্মান প্রদর্শন করা। এবং যিহোবা তাদের বলেছিলেন যে তাদের একটি মন্দির ও একটি বেদী নির্মাণ করতে হবে, এবং যিহোবার দ্বারা নির্ধারিত সময়ে, অর্থাৎ নিস্তারপর্বের সময়, তাদের সদ্যোজাত বাছুর এবং ভেড়াকে প্রস্তুত করে উৎসর্গ হিসাবে বেদীতে রাখতে হবে যিহোবার সেবা করার জন্য, যাতে তারা নিজেদের সংযত রাখতে পারে এবং তাদের হৃদয়ে যিহোবার প্রতি সম্মান থাকে। এই বিধান তারা মান্য করছে কি না, তাই হয়ে উঠেছিল যিহোবার প্রতি তাদের আনুগত্যের মাপকাঠি। যিহোবা তাদের জন্য বিশ্রামবারের নির্দেশ দেন, তাঁর সৃষ্টির সপ্তম দিন। বিশ্রামবারের পরবর্তী দিনটি তিনি প্রথম দিন হিসাবে চিহ্নিত করেন, সেইদিনটি হল যিহোবাকে বন্দনার দিন, তাঁকে উৎসর্গ অর্পণ করার দিন এবং তাঁর উদ্দেশ্যে সঙ্গীত পরিবেশনের দিন। এই দিন যিহোবা সকল ধর্মযাজকদের ডেকে বেদীতে অর্পিত সকল উৎসর্গ জনগণকে খাওয়ার জন্য বিতরণ করার নির্দেশ দেন, যাতে তারা যিহোবার বেদীতে নিবেদন করা উৎসর্গকে উপভোগ করতে পারে। এবং যিহোবা বলেছিলেন, তারা আশীর্বাদধন্য যে তারা যিহোবার সঙ্গে খাদ্য ভাগ করার সৌভাগ্য লাভ করেছে, এবং তারাই তাঁর নির্বাচিত জনগণ (যা ছিল ইস্রায়েলীদের সঙ্গে যিহোবার চুক্তি)। এই কারণেই, আজ পর্যন্ত, ইস্রায়েলের মানুষ এখনও বলে যে যিহোবা হলেন কেবলমাত্র তাদের ঈশ্বর, অইহুদি জাতির ঈশ্বর নন।
বিধানের যুগের সময়, যিহোবা বহু সংখ্যক আদেশ নির্ধারণ করেছিলেন যাতে মোশি তা সেইসব ইস্রায়েলীদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারে, যারা তাকে অনুসরণ করে মিশরের বাইরে চলে এসেছিল। এই আদেশগুলি যিহোবা ইস্রায়েলীদের জন্যই দিয়েছিলেন, এবং মিশরীয়দের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক ছিলনা; এগুলি ছিল ইস্রায়েলীদের সংযত রাখার জন্য, এবং তাদের কাছে দাবী জানানোর জন্য তিনি এই আদেশগুলি ব্যবহার করেছিলেন। তারা বিশ্রামবার পালন করে কিনা, তারা বাবা-মার প্রতি শ্রদ্ধাশীল কিনা, তারা মূর্তির উপাসনা করে কি না—এইসব নীতির দ্বারাই বিচার করা হত তারা পাপী না ধার্মিক। এদের মধ্যে, কেউ কেউ যিহোবার আগুনে দগ্ধ হয়েছিল, কাউকে পাথরের আঘাতে হত্যা করা হয়, আবার কেউ কেউ যিহোবার আশীর্বাদ লাভ করে, এবং তা নির্ধারিত হয় তারা যিহোবার আদেশগুলি মান্য করেছে কি না সেই অনুসারে। যারা বিশ্রামবার পালন করেনি, তাদের হত্যা করা হয়েছে পাথরের আঘাতে। যেসব ধর্মযাজক বিশ্রামবার পালন করেনি, তারা যিহোবার আগুনে দগ্ধ হয়েছে। যারা বাবা-মাকে শ্রদ্ধা করেনি, তাদেরও পাথর দিয়ে আঘাত করে হত্যা করা হয়েছে। এগুলো সবই যিহোবা প্রশংসা করেছিলেন। যিহোবা তাঁর আদেশ এবং বিধান প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন যাতে, তিনি মানুষকে তাদের জীবনের নেতৃত্ব দেওয়ার সময় মানুষ যেন তাঁর বাক্য শোনে ও তা মান্য করে, এবং তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না করে। সদ্যোজাত মনুষ্যজাতিকে নিয়ন্ত্রণের অধীনে রাখতে, এবং আরও বেশি করে তাঁর ভবিষ্যৎ কার্যের ভিত্তি স্থাপন করতে তিনি এই বিধানগুলি ব্যবহার করেছিলেন। আর তাই, যিহোবার সম্পাদিত কাজের ভিত্তিতে, প্রথম যুগকে বলা হতো বিধানের যুগ। যদিও যিহোবা অনেক বাক্য উচ্চারণ করেছিলেন এবং বহু কার্য সম্পাদন করেছিলেন, কিন্তু তিনি শুধুমাত্র জনগণকে ইতিবাচকভাবে পথনির্দেশ দিয়েছিলেন, এই অজ্ঞ মানবজাতিকে তিনি শিখিয়েছিলেন কীভাবে মানবিক হতে হয়, কীভাবে জীবনযাপন করতে হয়, কীভাবে যিহোবার পথ উপলব্ধি করতে হয়। অধিকাংশ সময়েই, যে কাজ তিনি করেছিলেন তার উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে তাঁর পথ মেনে চলানো এবং তাঁর বিধানগুলি অনুসরণ করানো। তাঁর কাজ সম্পন্ন হয়েছিল সেইসব মানুষের উপর যাদের ভ্রষ্ট আচরণ ছিল অগভীর; তাঁর কাজ তাদের স্বভাবের রূপান্তর ঘটানো অথবা জীবনে অগ্রগতি ঘটানো পর্যন্ত প্রসারিত হয়নি। তিনি শুধুমাত্র মনোযোগী ছিলেন মানুষকে সংযত ও নিয়ন্ত্রিত করতে বিধানগুলি ব্যবহার করার বিষয়ে। তৎকালীন ইস্রায়েলীদের কাছে যিহোবা ছিলেন নিছকই একজন মন্দিরে থাকা ঈশ্বর, স্বর্গের একজন ঈশ্বর। তিনি ছিলেন মেঘের স্তম্ভ, আগুনের স্তম্ভ। মানুষের কাছে যিহোবার শুধু প্রয়োজন ছিল যে তারা সেগুলি মেনে চলুক যেগুলিকে আজ তারা তাঁর বিধান এবং আদেশ বলে জানে—কেউ সেগুলিকে আইনও বলতে পারে—কারণ যিহোবা যা করেছিলেন তা তাদের রূপান্তরিত করার জন্য নয়, বরং আরও বেশি করে তাদের সেগুলি দেওয়ার জন্য যা মানুষের থাকা উচিত, এবং নিজের মুখে তাদের নির্দেশ দেওয়ার জন্য, কারণ, সৃষ্ট হওয়ার পর মানুষের এমন কিছুই ছিল না যা তার থাকা উচিত। আর তাই, যিহোবা মানুষকে সেইসব বস্তু দিয়েছিলেন যা পৃথিবীর বুকে তাদের জীবনযাপনের জন্য তাদের কাছে থাকা উচিত, এইভাবে তিনি যাদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাদের এগিয়ে দিয়েছিলেন তাদের পূর্বপুরুষ আদম ও হবাকে অতিক্রম করে, কারণ যিহোবা তাদের যা দিয়েছিলেন তা আদিপর্বে আদম ও হবাকে যা দিয়েছিলেন তাকে অতিক্রম করে গিয়েছিল। যাই হোক, যিহোবা ইস্রায়েলে যে কাজ করেছিলেন, তা ছিল মানবজাতিকে পথনির্দেশ দেওয়ার জন্য এবং তাদের স্রষ্টাকে চিনতে সক্ষম করার জন্য। তিনি তাদের জয় করেননি বা রূপান্তরিত করেননি, কেবল পথনির্দেশ দিয়েছেন। এই হল বিধানের যুগে যিহোবার কার্যের যোগফল। এটাই পটভূমি, সত্য কাহিনী, সমগ্র ইস্রায়েলের ভূমিতে তাঁর কাজের নির্যাস, এবং পরবর্তী ছয় হাজার বছরের তাঁর কাজের সূচনা—যাতে মানবজাতিকে যিহোবার নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। এর থেকেই তাঁর ছয় হাজার বছরের পরিচালনামূলক পরিকল্পনায় আরো অনেক কাজের জন্ম হয়েছে।
পাদটীকা:
ক. মূল রচনায় “মেনে চলতে হবে কিনা” কথাটি নেই।