পিতরের জীবনবৃত্তান্ত প্রসঙ্গে

পিতর ছিল মানবজাতির জন্য ঈশ্বরের আদর্শ নমুনা স্বরূপ, সকলের সুপরিচিত এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। এমন বিশেষত্বহীন এক ব্যক্তিকে ঈশ্বর কেন দৃষ্টান্ত স্বরূপ করে গড়ে তুলেছিলেন আর কেন-ই বা সে পরবর্তী প্রজন্মসমূহের দ্বারা প্রশংসিত হয়েছিল? একথা বলাই বাহুল্য যে তা তার ঈশ্বর-প্রেমের অভিব্যক্তি ও সংকল্পের থেকে অবিচ্ছেদ্য ছিল। ঈশ্বরের প্রতি পিতরের প্রেমপূর্ণ অন্তরের বহিঃপ্রকাশ কীভাবে ঘটেছিল এবং তার জীবনের অভিজ্ঞতাগুলি সত্যিই ঠিক কীরকম ছিল তা জানতে, সেই সময়কার রীতিনীতিগুলিকে আরেকবার খতিয়ে দেখার জন্য এবং সেই যুগের পিতরকে লক্ষ্য করার জন্য আমাদের অবশ্যই অনুগ্রহের যুগে ফিরে যেতে হবে।

পিতরের জন্ম হয়েছিল একটি সাধারণ ইহুদি কৃষক পরিবারে। তার পিতা-মাতা কৃষিকার্যের মাধ্যমে সমগ্র পরিবারের ভরণপোষণ চালাতেন, এবং পরিবারের চার ভাই-বোনের মধ্যে সেই ছিল জ্যেষ্ঠ। এটি অবশ্যই আমাদের কাহিনীর মূল অংশ নয়; পিতর হলো আমাদের মূল চরিত্র। তার বয়স যখন পাঁচ বছর, তখন পিতরের পিতামাতা তাকে লেখা-পড়া শেখাতে শুরু করে। সেই সময়, ইহুদি লোকজন যথেষ্টই বিদ্বান ছিল, এবং কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যের মত ক্ষেত্রগুলিতে তারা বিশেষ অগ্রসর ছিল। এরকম সামাজিক পরিবেশের কারণে, পিতরের পিতা, মাতা উভয়েই উচ্চশিক্ষা লাভ করেছিল। গ্রামাঞ্চলের মানুষ হলেও তারা ছিল সুশিক্ষিত ও আজকের গড়পড়তা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের সাথে তুলনীয়। স্পষ্টতই, এরকম অনুকূল এক সামাজিক পরিমণ্ডলে জন্ম নেওয়াটা পিতরের পক্ষে ছিল আশীর্বাদস্বরূপ। মেধাবী এবং ক্ষিপ্র ধীশক্তিসম্পন্ন হওয়ায় পিতর অনায়াসে নতুন ধারণাগুলি আত্তীকরণ করেছিল। পড়াশুনো শুরু করার পর, পাঠ গ্রহণের সময় সে অতি সহজেই সবকিছু ধরে ফেলতে পারতো। এমন উজ্জ্বল পুত্রলাভের জন্য তার বাবা-মা গর্ব বোধ করতো, এবং যাতে সে বিদ্যালয়ে যেতে পারে তার জন্য তারা সর্বতো প্রচেষ্টা করতো, আশা করতো যে সে বিশিষ্ট হয়ে উঠতে ও সমাজে কোনো আমলাবর্গীয় পদমর্যাদা লাভ করতে সক্ষম হবে। নিজের অজান্তেই পিতর ঈশ্বরের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে, যার ফলস্বরূপ, চৌদ্দ বছর বয়সে উচ্চ বিদ্যালয়ে পাঠগ্রহণ করাকালীন, প্রাচীন গ্রীক সংস্কৃতির পাঠ্যক্রমের প্রতি, বিশেষ করে প্রাচীন গ্রীক ইতিহাসের কাল্পনিক চরিত্র ও কল্পিত ঘটনাবলীর সম্পর্কে সে বিতৃষ্ণ হয়ে উঠেছিল। তারপর থেকে, যৌবনের বসন্ত ঋতুতে সদ্য পা রাখা পিতর মানবজীবন এবং বৃহত্তর বিশ্ব সম্পর্কে আরো বিশদ অনুসন্ধানে সচেষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করেছিল। তার জন্য তার বাবা-মা যে কষ্টস্বীকার করেছিল তার বিবেকবোধ তাকে সেই ঋণ পরিশোধ করতে বাধ্য করে তোলেনি, কারণ সে স্পষ্ট দেখেছিল যে সকল মানুষই আত্ম-প্রতারণার মধ্যে বাস করছে, তারা প্রত্যেকেই অর্থহীন জীবন যাপন করছে, সম্পদ ও স্বীকৃতি লাভের প্রাণপন চেষ্টায় তারা নিজেদের জীবনকে জলাঞ্জলি দিয়ে চলেছে। তার অন্তর্দৃষ্টি মূলত যে সামাজিক পরিবেশে সে বসবাস করত তার সাথে সম্পর্কিত ছিল। মানুষের জ্ঞান যত বৃদ্ধি পায়, তাদের আন্তর্মানবিক সম্পর্ক ও আভ্যন্তরিক জগত ততই জটিলতর হয়ে ওঠে, আর তাই তারা তত বেশি করে এক শূন্যতার মধ্যে বিরাজ করে। এইরকম পরিস্থিতিতে, পিতর তার অবসর সময় নানান মানুষের সাক্ষাৎ করে অতিবাহিত করত, যাদের অধিকাংশই ছিল ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব। তার অন্তরে যেন একটা অস্পষ্ট অনুভূতি ছিল যে মানবজগতে যা কিছু ব্যাখ্যাতীত ধর্ম হয়তো সে সবের কারণ দর্শাতে সক্ষম, আর তাই সে প্রায়শই এক নিকটবর্তী ইহুদি উপাসনালয়ে গিয়ে সেবায় যোগদান করত। তার পিতা-মাতা এই বিষয়ে অনবহিত ছিল, এবং পিতর, যে কিনা বরাবরই সচ্চরিত্রের ও উত্তম বিদ্যার্থী ছিল, সেই পিতরই অল্পকিছুকালের মধ্যেই বিদ্যালয়ে যেতে অপছন্দ করতে শুরু করল। পিতা-মাতার তত্ত্বাবধানে, সে কোনক্রমে উচ্চ বিদ্যালয়ের পাঠক্রম সম্পূর্ণ করল। জ্ঞান-সমুদ্র থেকে সাঁতার কেটে তীরে ফেরার পর সে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল; এরপর থেকে, আর কেউ কখনো তাকে শিক্ষাদান বা গণ্ডিবদ্ধ করবে না।

বিদ্যালয়ের পাঠ সমাপ্ত করার পর সে সব ধরনের বই পড়তে শুরু করে, কিন্তু সতের বছর বয়সে, বৃহত্তর বিশ্ব সম্পর্কে তখনো তার খুব বেশি অভিজ্ঞতা ছিল না। বিদ্যালয় থেকে স্নাতক হওয়ার পর, কৃষিকাজের দ্বারা অন্ন-সংস্থানের পাশাপাশি বই পড়ার জন্য ও ধর্মীয় সেবাকার্যে যোগদানের জন্য সে যতটা বেশি সম্ভব সময় বের করে নিত। তার পিতা-মাতা, পিতরের প্রতি যাদের ছিল অত্যুচ্চ প্রত্যাশা, প্রায়শই তারা তাদের “বিদ্রোহী পুত্র”-এর কারণে স্বর্গকে অভিসম্পাত দিত, কিন্তু সেটাও ন্যায়পরায়ণতার প্রতি তার বুভুক্ষা ও পিপাসার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। তার অভিজ্ঞতা লাভের পথে পিতরকে কম বাধাবিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়নি, কিন্তু তার হৃদয় ছিল সর্বগ্রাসী, এবং সে বৃষ্টিস্নাত তৃণের মতো বিকশিত হয়ে উঠেছিল। খুব শীঘ্রই, সে ধর্মীয় জগতের কিছু বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিত্বের মুখোমুখি হওয়ার “সৌভাগ্য” লাভ করেছিলো, আর যেহেতু তার আকাঙ্ক্ষা ছিল অত্যন্ত প্রবল, তাই আরো ঘনঘন সে তাদের সঙ্গে ওঠাবসা করতে শুরু করেছিলো, যতদিন না তাদের সাহচর্যেই সে তার প্রায় সমস্ত সময়টুকু অতিবাহিত করতো। পরিতৃপ্ত সুখে নিমগ্ন পিতর হঠাৎই উপলব্ধি করল যে, এই মানুষগুলির অধিকাংশেরই বিশ্বাস শুধুমাত্র তাদের ওষ্ঠেই সীমাবদ্ধ ছিল, তাদের বিশ্বাসে তারা মনপ্রাণ ঢেলে দেয় নি। পিতর, যার আত্মা ছিল ন্যয়নিষ্ঠ ও বিশুদ্ধ, সে কীকরে এইরকম একটি আঘাত সহ্য করতে পারে? সে উপলব্ধি করল যে, যে মানুষগুলির সঙ্গে সে মেলামেশা করেছিল তাদের অধিকাংশই ছিল মানুষের বেশে পশুমাত্র—তারা ছিল মানুষের চেহারাবিশিষ্ট জন্তু। সেই সময়, পিতর অত্যন্ত অনভিজ্ঞ ছিল, তাই বেশ কয়েকবার তাদের সে অন্তর থেকে মিনতি করেছিল। কিন্তু এই ধূর্ত, চতুর ধর্মীয় ব্যক্তিত্বরা কী করেই বা এই আবেগতাড়িত যুবকের অনুনয়ে কর্ণপাত করতে পারে? সেই সময়েই পিতর মানবজীবনের প্রকৃত শূন্যতাকে অনুভব করেছিলো: জীবনের মঞ্চে প্রথম পদক্ষেপেই, সে ব্যর্থ হয়েছিল…। এক বছর পরে, সে উপাসনালয় থেকে দূরে সরে যায় এবং স্বাধীনভাবে জীবনযাপন আরম্ভ করে।

এই ব্যর্থতা ১৮-বছরের তরুণ পিতরকে অনেক বেশি পরিণত ও পরিমার্জিত করে তুলেছিল। তার মধ্যে আর তরুণসুলভ অনভিজ্ঞতার চিহ্নমাত্র ছিল না; এই ব্যর্থতা তার তরুণ বয়সের অপাপবিদ্ধতা ও সারল্যকে নির্বিকারভাবে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করেছিল, এবং সে একজন মৎস্যজীবির জীবন যাপন করতে শুরু করেছিল। এরপর দেখা গেল লোকজন তার নৌকায় বসে তার ধর্মোপদেশ শ্রবণ করছে। মৎস্যজীবী হিসাবে জীবিকা অর্জন করাকালীন, সে যেখানেই যেত সেখানেই বাণী প্রচার করত, এবং যারা তার ধর্মোপদেশ শ্রবণ করত তারা সকলেই তার সেই ধর্মোপদেশ শুনে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যেত, কারণ তার বলা কথাগুলি সাধারণ মানুষের হৃদয়তন্ত্রীতে গিয়ে আঘাত করতো, এবং পিতরের সততায় তারা সকলেই গভীরভাবে আলোড়িত হয়েছিল। প্রায়শই সে মানুষকে অন্যদের প্রতি আন্তরিক আচরণের শিক্ষা দিত, আকাশ ও পৃথিবী এবং সমস্ত কিছুর সার্বভৌম অধীশ্বরের সহায়তা প্রার্থনা করতে, এবং তাদের বিবেকবোধকে উপেক্ষা করে লজ্জাজনক কোনো কাজ না করতে পরামর্শ দিত, যে ঈশ্বরকে তারা অন্তর থেকে ভালোবাসে তাঁকে সর্বতোভাবে সন্তুষ্ট করার উপদেশ দিত…। মানুষ তার উপদেশ শ্রবণ করে প্রায়শই গভীরভাবে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়তো; তার দ্বারা অনুপ্রাণিত বোধ করত আর প্রায়ই অভিভূত হয়ে কেঁদে ফেলত। সেই সময়, তার সকল অনুসরণকারীরা তাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখত, যে অনুসরণকারীরা ছিল হতদরিদ্র এবং সেই সময়কার সামাজিক অবস্থার নিরিখে স্বাভাবিকভাবেই সংখ্যায় খুবই নগণ্য। সেই সময়ে পিতর সমাজের ধর্মীয় উপাদানসমূহ দ্বারা নির্যাতিতও হয়েছিল। এই সবের পরিণতি হিসাবে দুই বছর ধরে তাকে স্থান থেকে স্থানান্তরে ঘুরে নিঃসঙ্গ জীবন কাটাতে হয়েছিলো। দুই বছরের এই অসাধারণ অভিজ্ঞতার সময়কালে, যে প্রভূত অন্তর্দৃষ্টি লাভ করেছিলো এবং নানা বিষয়ে প্রচুর কিছু জেনেছিল যেগুলি সম্পর্কে তার কোনো পূর্বজ্ঞান ছিল না, এর ফলে তার সেই ১৪-বছরের সত্তা থেকে তাকে আর শনাক্ত করাই শক্ত ছিল, যার সঙ্গে তার এখন আর কোনো মিলই নেই বলে মনে হত। এই দু’বছরে সে নানান ধরনের মানুষের মুখোমুখি হয় এবং সমাজ সম্পর্কে নানান প্রকারের বাস্তব অভিজ্ঞতা লাভ করে, যার ফলস্বরূপ ধীরে ধীরে সে ধর্মীয় জগতের সমস্ত প্রকার আচারুনুষ্ঠান থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে শুরু করে। ঠিক সেই সময়েই, সে পবিত্র আত্মার কার্যের গতিপ্রকৃতির দ্বারাও গভীরভাবে প্রভাবান্বিত হয়েছিল; ততদিনে যীশু বহু বছর যাবত কার্য সম্পাদন করে চলেছিলেন, তাই পিতরে কাজও পবিত্র আত্মার তৎকালীন কার্য দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল, যদিও তখনও তার যীশুর সাথে সাক্ষাৎ ঘটেনি। এই কারণে, ধর্মোপদেশ প্রচার কালেই পিতর এমন অনেক কিছুই অর্জন করেছিলো যা আগের প্রজন্মের সন্তরা কখনই করেনি। অবশ্যই, সেই সময় সে যীশু সম্পর্কে খুব সামান্যই অবগত ছিল, তবে সে কখনই তাঁর সাথে মুখোমুখি সাক্ষাৎ করার সুযোগ পায়নি। সে শুধুই পবিত্র আত্মা-জাত সেই স্বর্গীয় ব্যক্তিকে চাক্ষুষ করার আশা ও প্রবল বাসনা পোষণ করত।

এক সন্ধ্যায় গোধূলিলগ্নে, পিতর তার নৌকায় চড়ে মাছ ধরছিল (তখন যা গ্যালীল সাগর নামে পরিচিত ছিল তার উপকূলের কাছাকাছি)। তার হাতে ছিল একটি ছিপ, কিন্তু তার মন অন্য চিন্তায় ব্যস্ত ছিল। অস্তগামী সূর্যের আভা জলের উপরিতলটিকে এক বিস্তৃত রক্ত-সমুদ্রের মতো রঙে রাঙিয়ে তুলেছিল। পিতরের তরুণ অথচ প্রশান্ত ও স্থিতপ্রজ্ঞ মুখমণ্ডলে আলোক প্রতিফলিত হয়েছিল; তাকে দেখে গভীর চিন্তায় নিমগ্ন বলে মনে হচ্ছিল। সেই মুহূর্তে, এক ঝলক বাতাস বয়ে গেলো, আর হঠাৎই সে তার জীবনের একাকীত্বটিকে অনুভব করল, যার ফলে তক্ষুনি এক বিবর্ণ নিরানন্দবোধ এসে ঘিরে ধরল তাকে। সমুদ্রের ঢেউ যখন আলোয় ঝকমক করছিল, তখন তাকে দেখে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল যে সে আর মাছ ধরার মতো মানসিক অবস্থায় নেই। চিন্তামগ্ন পিতর, হঠাৎই পিছন থেকে কাউকে বলতে শুনল, “হে যোনার পুত্র শিমোন, তোমার জীবনের দিনগুলি নিঃসঙ্গ কাটছে। তুমি কি আমাকে অনুসরণ করবে?” চমকে উঠে পিতর তার হাতে ধরা ছিপটি তক্ষুনি ফেলে দিল, অবিলম্বে তা সমুদ্রের তলদেশে তলিয়ে গেল। পিতর দ্রুত পিছন ফিরে দেখল তার নৌকায় এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে রয়েছেন। মানুষটিকে সে আপাদমস্তক দেখলো: মানুষটির দীর্ঘ কেশ তাঁর কাঁধ স্পর্শ করেছে, সূর্যের আলোয় তাতে ঈষৎ সোনালী আভা, পরনে তাঁর ধূসর পোশাক, মাঝারি উচ্চতার মানুষটি একজন ইহুদীর মতই মাথা থেকে পা অবধি পোশাকে সজ্জিত। ম্লান হয়ে আসা আলোয়, মানুষটির ধূসর পোশাককে ঈষৎ কালচে দেখাচ্ছিল, তাঁর মুখমণ্ডলেও যেন হালকা দীপ্তির ছোঁয়া। পিতর বহুবার যীশুর সাক্ষাৎ লাভের প্রয়াস করেছিলো, কিন্তু কোনোবারই সফল হয়নি। সেই মুহূর্তে, পিতর তার আত্মার গভীর থেকে বিশ্বাস করেছিলো যে এই মানুষটিই নিশ্চয়ই তার অন্তরস্থিত সেই পবিত্র ব্যক্তি, এবং সে তার মাছ ধরার নৌকার উপর প্রণত হয়ে বললো, “আপনিই কি সেই প্রভু যিনি স্বর্গরাজ্যের সুসমাচার প্রচার করতে এসেছেন? আমি আপনার অভিজ্ঞতার কথা শুনেছি, কিন্তু আপনাকে কখনও চোখে দেখিনি। আমি আপনার অনুগামী হতে চেয়েছি, কিন্তু আমি আপনাকে খুঁজে পাইনি।” ততক্ষণে, যীশু নৌকার ছাউনিতে নেমে এসে সেখানে তিনি শান্তভাবে বসে ছিলেন। “উঠে এসে আমার পাশে বসো!” তিনি বললেন। “যারা আমাকে সত্যিকারের ভালোবাসে আমি তাদের অন্বেষণে এসেছি। বিশেষ করে আমি স্বর্গরাজ্যের সুসমাচার ছড়িয়ে দিতে এসেছি, এবং যারা আমার সমমনোভাবাপন্ন, তাদের খোঁজে দেশময় ভ্রমণ করব। তুমি কি ইচ্ছুক?” পিতর উত্তর দেয়: “স্বর্গীত পিতা যাঁকে প্রেরণ করেছেন আমি অবশ্যই তাঁকে অনুসরণ করবো। যিনি পবিত্র আত্মার দ্বারা মনোনীত আমি অবশ্যই তাঁকে স্বীকার করবো। আমি স্বর্গীয় পিতাকে ভালোবাসি, তাহলে আমি কীকরে আপনার অনুগামী হতে ইচ্ছুক না হয়ে পারি?” পিতরের কথাগুলি ধর্মীয় পূর্বধারণায় পূর্ণ হলেও, যীশু স্মিতমুখে সন্তুষ্টিতে মাথা নাড়লেন। সেই মুহূর্তে, তাঁর অন্তরে পিতরের প্রতি এক পিতৃসুলভ ভালোবাসার বোধ জন্ম নিল।

পিতর বেশ কয়েকবছর ধরে যীশুর অনুসরণ করে এবং তাঁর মধ্যে এমন অনেক কিছু প্রত্যক্ষ করে যা অন্যদের মধ্যে ছিল না। তাঁকে এক বছর অনুসরণ করার পর, বারোজন শিষ্যের মধ্যে থেকে পিতর যীশুর দ্বারা মনোনীত হয়। (অবশ্যই, যীশু একথা উচ্চস্বরে জানাননি, এবং অন্যরাও একথা ঘুনাক্ষরেও জানত না।) তার জীবনে, পিতর নিজেকে যীশুর সম্পাদিত প্রতিটি কার্যের নিরিখে পরিমাপ করেছিলো। সবচেয়ে লক্ষ্যণীয়ভাবে, যীশুর প্রচারিত বাণীসমূহ তার অন্তরে খোদিত হয়ে গিয়েছিল। সে ছিল যীশুর প্রতি সম্পূর্ণরূপে নিবেদিত ও অনুগত, এবং তাঁর বিরুদ্ধে কখনো কোনো অনুযোগ জানায়নি। ফলস্বরূপ, যীশু যেখানেই যান না কেন, পিতর হয়ে উঠেছিল তাঁর বিশ্বস্ত সঙ্গী। পিতর যীশুর শিক্ষাদান, তাঁর নম্র বাক্যসমূহ, যে খাদ্য তিনি গ্রহণ করতেন, তাঁর বেশবাস, তাঁর আশ্রয়স্থল এবং তিনি কীভাবে ভ্রমণ করতেন—সবকিছু নিরীক্ষণ করত। প্রতিটি ক্ষেত্রে সে যীশুর সমকক্ষ হয়ে উঠতে চেষ্টা করত। নিজের নৈতিকতা বিষয়ে সে কখনই উদ্ধত ছিল না, বরং কথায় ও কর্মে যীশুর উদাহরণ অনুসরণ করে সে পুরানো যা কিছু সব পরিত্যাগ করেছিলো। ঠিক এই সময়েই পিতর অনুভব করেছিলো যে আকাশ ও পৃথিবী এবং সমস্ত কিছু সর্বশক্তিমানের হাতে এবং এও অনুভব করেছিল যে, ঠিক এই কারণেই, ব্যক্তিগত পছন্দ বলে তার কিছু থাকতে পারে না। যীশু যাকিছু ছিলেন পিতর তার সবই আত্মস্থ করেছিল ও তাকে এক দৃষ্টান্তরূপে ব্যবহার করেছিলো। যীশুর জীবন প্রতিপন্ন করে যে তাঁর ক্রিয়াকর্মে নিজের নৈতিকতা বিষয়ে তাঁর কোনো ঔদ্ধত্য ছিল না; নিজের সম্পর্কে বড়াই করার বদলে, ভালোবাসা দিয়ে তিনি মানুষকে আলোড়িত করেছিলেন। যীশু যে কী ছিলেন তার প্রমাণ অনেককিছুর মধ্যেই পাওয়া গিয়েছে, এবং এই কারণেই, পিতর তাঁর সমস্তকিছুর অনুকরণ করত। পিতরের অভিজ্ঞতাগুলি তাকে যীশুর মাধুর্যের বিষয়ে এক ক্রমবর্ধমান বোধ এনে দিয়েছিল, এবং সে এমন কথাও বলেছিল, “আমি বিশ্বব্রহ্মাণ্ড জুড়ে সর্বশক্তিমানের সন্ধান করেছি, এবং আকাশ ও পৃথিবী এবং সমস্তকিছুর বিস্ময়সমূহ আমি প্রত্যক্ষ করেছি, এবং এইরূপে আমি সর্বশক্তিমানের মাধুর্যের বিষয়ে এক গভীর অনুভূতি অর্জন করেছি। তবে, আমার নিজের অন্তরে কখনই সত্যিকারের প্রেম ছিল না, এবং স্বচক্ষে আমি কখনও সর্বশক্তিমানের মাধুর্য দর্শন করিনি। আজ আমি, সর্বশক্তিমানের দৃষ্টিতে, তাঁর অনুকূল দাক্ষিণ্য লাভ করেছি এবং অবশেষে আমি ঈশ্বরের মাধুর্য অনুভব করেছি। অবশেষে আমি আবিষ্কার করেছি যে, ঈশ্বর সকলকিছু সৃষ্টি করেছেন বলেই যে মানবজাতি তাঁকে ভালোবাসে তা নয়; আমার দৈনন্দিন জীবনে, আমি তাঁর সীমাহীন মাধুর্যের খোঁজ পেয়েছি। এই মুহূর্তে যা দেখা যাচ্ছে শুধু তার মধ্যেই কীভাবে তাঁর মাধুর্য সীমাবদ্ধ থাকতে পারে?” কালক্রমে, যা কিছু মনোরম তার অনেকখানি পিতরের মধ্যেও দৃশ্যমান হয়। সে যীশুর অত্যন্ত অনুগত হয়ে উঠেছিল, এবং অবশ্যই, বেশ কয়েকবার সে বাধাবিঘ্নের সম্মুখীনও হয়েছিল। যীশু যখন তাকে সাথে করে বিভিন্ন স্থানে ধর্মোপদেশ প্রচারের জন্য যেতেন, পিতর সর্বদাই নম্রভাবে যীশুর উপদেশসমূহ শ্রবণ করত। যীশুকে বেশ কয়েক বছর অনুসরণ করার দরুন সে কখনই উদ্ধত হয়ে ওঠেনি। যীশু যখন তাকে জানান যে তাঁর আগমনের উদ্দেশ্য হলো ক্রুশবিদ্ধ হওয়া যাতে তিনি তাঁর কার্য সম্পূর্ণ করতে পারেন, পিতর প্রায়শই নিজ অন্তরে নিদারুণ বেদনা অনুভব করত আর গোপনে একাকী অশ্রুপাত করত। তাসত্ত্বেও, সেই “দুর্ভাগ্যজনক” দিনটি অবশেষে এসে উপস্থিত হলই। যীশুকে গ্রেপ্তার করার পর, পিতর তার মাছ ধরার নৌকায় একা একা অশ্রুবিসর্জন করল এবং এর নিবারণের জন্য অনেক প্রার্থনা করল। কিন্তু তার অন্তরে, সে জানত যে এটি ঈশ্বর পিতার ইচ্ছা, এবং কারো সাধ্য ছিল না এই ভবিতব্যকে বদলায়। সে শুধু নিজ ভালোবাসার কারণেই বেদনাদীর্ণ ও অশ্রুসজল হয়ে রইল। এটি অবশ্যই এক প্রকার মানবিক দৌর্বল্য। এইভাবে, সে যখন জানতে পারল যে যীশুকে ক্রুশে বিদ্ধ করা হবে, সে যীশুকে জিজ্ঞাসা করল, “বিদায় গ্রহণের পর, আপনি কি পুনরায় আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন এবং আমাদের তত্ত্বাবধান করবেন? আমরা কি তখনও আপনাকে প্রত্যক্ষ করতে পারব?” কথাগুলি অত্যন্ত বালখিল্যসুলভ ও মানবিক ধারণাপূর্ন হলেও, যীশু পিতরের ক্লেশের তিক্ততার কথা জানতেন, তাই তাঁর প্রেমের মধ্য দিয়ে তিনি পিতরের দুর্বলতার প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন: “পিতর, আমি তোমাকে ভালোবেসেছি। তুমি কি তা জানো? যদিও তোমার কথাগুলির পিছনে কোনোই যুক্তি নেই, তবু পিতা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে আমার পুনরুত্থানের পর, আমি ৪০ দিনের জন্য মানুষের সম্মুখে আবির্ভূত হব। তুমি কি বিশ্বাস করো না যে তোমাদের সকলের উপর আমার আত্মা বারংবার অনুগ্রহ বর্ষণ করবে?” পিতর এইকথায় সামান্য স্বস্তি পেলেও, তবু তার তখনও মনে হচ্ছিল যে কী যেন একটাকিছুর অভাব রয়েছে, আর তাই, পুনরুত্থানের পর, যীশু প্রথমবার তার সম্মুখে প্রকাশ্যে আবির্ভূত হলেন। তবে, পিতরকে তার পূর্ব ধারণাগুলির বশবর্তী হয়ে থাকা থেকে বিরত রাখার লক্ষ্যে, পিতর তাঁর জন্য যে সমারোহপূর্ণ আহারের আয়োজন করে যীশু তা প্রত্যাখ্যান করলেন, এবং চোখের নিমেষে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। সেই মুহূর্ত থেকে, পিতর অবশেষে প্রভু যীশুর সম্বন্ধে এক গভীরতর উপলব্ধি লাভ করেছিল এবং তাঁকে সে আরো বেশি করে ভালোবেসেছিল। যীশু তাঁর পুনরুত্থানের পর প্রায়শই পিতরের কাছে আবির্ভূত হতেন। চল্লিশ দিনের অবসানের পরেও তিনি আরও তিনবার পিতরের কাছে আবির্ভূত হয়েছিলেন এবং তারপর তিনি স্বর্গারোহণ করেন। প্রতিটি আবির্ভাবই ঘটেছিল পবিত্র আত্মার কার্য যখন ঠিক সমাপ্তির মুখে এবং যখন নতুন কার্য আরম্ভ হতে চলেছে।

তার সমগ্র জীবন জুড়ে, জীবিকা অর্জনের জন্য পিতর মাছ ধরত, কিন্তু তার জীবনের আরো বড় উদ্দেশ্য ছিল ধর্মোপদেশ প্রদান। জীবনের সায়াহ্নে, পিতর তার প্রথম ও দ্বিতীয় পত্র এবং সেই সাথে তৎকালীন ফিলাডেলফিয়া গির্জার উদ্দেশ্যে অজস্র পত্র লিখেছিল। সেই যুগের মানুষজন তার দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিল। নিজের কীর্তিকে উপজীব্য করে মানুষকে বক্তৃতা দেওয়ার পরিবর্তে, সে তাদের উপযুক্ত জীবনের সংস্থান যুগিয়েছিলো। যীশুর বিদায়ের পূর্বে তাঁর প্রদত্ত শিক্ষা সে কখনই বিস্মৃত হয়নি, এবং সারা জীবনব্যাপী সে সেই শিক্ষাগুলির দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল। যীশুর অনুসরণ করাকালীন, সে প্রভুর প্রেমের প্রতিদান নিজের জীবনের বিনিময়ে পরিশোধ করতে চেয়েছিল ও সমস্ত ক্ষেত্রেই তাঁর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করতে বদ্ধপরিকর ছিল। যীশু তাতে সম্মত হন, তাই পিতরের বয়স যখন ৫৩ বছর (যীশুর স্বর্গারোহনের ২০ বছরেরও বেশি সময় পরে), তার আকাঙ্ক্ষা পূরণের লক্ষ্যে যীশু তার কাছে আবির্ভূত হন। পিতরের জীবনের পরবর্তী পরের সাতটি বছর অতিবাহিত হয় নিজেকে জানার কাজে। এই সাত বছরের শেষে একদিন, তাকে উলটো করে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়, আর এইভাবেই তার অসামান্য জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটেছিল।

পূর্ববর্তী: অধ্যায় ৬

পরবর্তী: অধ্যায় ৮

প্রতিদিন আমাদের কাছে 24 ঘণ্টা বা 1440 মিনিট সময় থাকে। আপনি কি ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভের জন্য তাঁর বাক্য শিখতে 10 মিনিট সময় দিতে ইচ্ছুক? শিখতে আমাদের ফেলোশিপে যোগ দিন। কোন ফি লাগবে না।

সেটিংস

  • লেখা
  • থিমগুলি

ঘন রং

থিমগুলি

ফন্টগুলি

ফন্ট সাইজ

লাইনের মধ্যে ব্যবধান

লাইনের মধ্যে ব্যবধান

পৃষ্ঠার প্রস্থ

বিষয়বস্তু

অনুসন্ধান করুন

  • এই লেখাটি অনুসন্ধান করুন
  • এই বইটি অনুসন্ধান করুন

Messenger-এর মাধ্যমে আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন