ঈশ্বরের অধিষ্ঠিত দেহরূপের সারসত্য
ঈশ্বর তাঁর প্রথম অবতার রূপে পৃথিবীর বুকে সাড়ে তেত্রিশ বছর বাস করেছিলেন, এবং তার মধ্যে তিনি শুধুমাত্র সাড়ে তিন বছরই তাঁর সেবাব্রত সম্পাদন করেছিলেন। কার্য নির্বাহের কালে, এবং তাঁর কার্য শুরু করার আগেও তিনি স্বাভাবিক মানবতার অধিকারী ছিলেন; তিনি সাড়ে তেত্রিশ বছর ধরে তাঁর স্বাভাবিক মানবতায় বাস করেছিলেন। অন্তিম সাড়ে তিন বছর ধরে তিনি নিজেকে ঈশ্বরের অবতার-রূপ হিসেবে প্রকাশ করেছিলেন। সেবাব্রত সম্পাদন করার পূর্বে তিনি সাধারণ, স্বাভাবিক মানবতা নিয়েই আবির্ভূত হয়েছিলেন, এবং তাঁর দেবত্বের কোনো চিহ্নই দেখান নি, কেবলমাত্র আনুষ্ঠানিক ভাবে সেবাব্রত শুরু করার পরই তাঁর দেবত্ব উদ্ভাসিত হয়েছিল। প্রথম ঊনত্রিশ বছর ধরে তাঁর জীবন এবং কার্য এটাই দেখিয়েছিল যে, তিনি একজন প্রকৃত মানুষ, একজন মনুষ্যপুত্র, এবং এক দেহরূপের শরীর, কারণ তাঁর সেবাব্রত একান্তভাবে ঊনত্রিশ বছর বয়সের পরে শুরু হয়েছিল। “অবতার” হল ঈশ্বরের দেহরূপে আবির্ভাব; ঈশ্বর তাঁর সৃষ্ট মানবজাতির মাঝে দেহরূপেই কার্য নির্বাহ করেন। ফলত, ঈশ্বরকে অবতার রূপ ধারণ করতে হলে প্রথমে তাঁকে স্বাভাবিক মানবতাময় দেহরূপে আসতে হবে; এটাই হল সর্বপ্রাথমিক পূর্বশর্ত। বস্তুত, ঈশ্বরের অবতার রূপ ধারণের তাৎপর্য হল যে, ঈশ্বর দেহরূপে বাস এবং কার্য নির্বাহ করেন এবং ঈশ্বর তাঁর যথার্থ সারসত্য নিয়েই দেহরূপে, অর্থাৎ মানুষ রূপে পরিণত হন। তাঁর অবতার রূপের জীবন এবং কার্যকে দু’টি পর্যায়ে ভাগ করা যায়। প্রথমটি হল সেবাব্রত সম্পাদন করার পূর্বে তাঁর জীবনযাপন। তিনি এক সাধারণ মানুষের পরিবারে একেবারে স্বাভাবিক মানবতায়, স্বাভাবিক মানবজীবনের নিয়ম-নীতি মেনে, মানুষের স্বাভাবিক চাহিদা (খাদ্য, বস্ত্র, বিশ্রাম, বাসস্থান), স্বাভাবিক দুর্বলতা এবং স্বাভাবিক আবেগ নিয়েই বসবাস করেন। অন্যভাবে বললে, প্রথম স্তর চলাকালীন তিনি সম্পূর্ণ অ-দৈব, স্বাভাবিক মানবতায় বসবাস করেন, এবং সকল স্বাভাবিক মানবিক কার্যকলাপে লিপ্ত হন। দ্বিতীয় পর্যায়টি হল সেবাব্রত সম্পাদনা শুরু করার পর তাঁর জীবনযাপন। তিনি তখনও স্বাভাবিক মানবতায় সাধারণ মানুষের বাহ্যরূপেই বাস করেন, এবং বহিরঙ্গে কোনো অতিপ্রাকৃতিক চিহ্ন দেখান না। তবু তিনি কেবলমাত্র তাঁর সেবাব্রতের স্বার্থেই বাস করেন, এবং এই সময়ে তাঁর স্বাভাবিক মানবতা একমাত্র তাঁর দেবত্বের স্বাভাবিক কার্য বজায় রাখার জন্যই বিদ্যমান থাকে, কারণ ততদিনে তাঁর স্বাভাবিক মানবতা তাঁর সেবাব্রত সম্পাদনে সক্ষম হওয়ার মতো পরিণত হয়ে উঠেছে। তাই, তাঁর জীবনের এই দ্বিতীয় পর্যায়টি স্বাভাবিক মানবতায় সেবাব্রত সম্পাদন করার জন্যই, যখন তাঁর জীবন যুগপৎ স্বাভাবিক মানবতা এবং সম্পূর্ণ দেবত্বময়। যে কারণে তিনি জীবনের প্রথম পর্যায়ে সম্পূর্ণ সাধারণ মানবতায় বসবাস করেন, তা হল এই যে, তাঁর মানবতা তখনও দৈব কার্যের সম্পূর্ণতা বজায় রাখতে সক্ষম নয়, তা তখনও পরিণত নয়; একমাত্র যখন তাঁর মানবতা পরিণত হবে এবং তাঁর সেবাব্রতের ভার বহন করতে সক্ষম হবে, তখনই তিনি তাঁর করণীয় সেবাব্রত শুরু করতে পারবেন। যেহেতু তাঁর দেহরূপকে বৃদ্ধি পেতে এবং পরিণত হতে হয়, তাই তাঁর জীবনের প্রথম পর্যায়টি স্বাভাবিক মানবতাময়—অপরদিকে দ্বিতীয় পর্যায়ে যেহেতু তাঁর মানবতা তাঁর কার্য এবং সেবাব্রত সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করতে সক্ষম হয়, তাই সেবাব্রতের সময় ঈশ্বরের অবতার রূপ যে জীবনযাপন করেন, তা যুগপৎ মানবতা এবং সম্পূর্ণ দেবত্বময়। যদি জন্মের মুহূর্ত থেকেই ঈশ্বরের অবতার রূপ অতিপ্রাকৃতিক প্রতীক এবং বিস্ময়ের সম্পাদনার দ্বারা একান্তভাবে তাঁর সেবাব্রত শুরু করতেন, তাহলে তাঁর কোনোরকম দেহগত সারসত্য থাকত না। অতএব, তাঁর মানবতা তাঁর দেহগত সারসত্যের স্বার্থেই বিদ্যমান থাকে; মানবতা ব্যতীত কোনো দেহরূপ গঠিত হতে পারে না, এবং মানবতাবিহীন মানুষ আসলে মানুষই নয়। এভাবেই ঈশ্বরের দেহরূপের মানবতা হল তাঁর অবতার দেহরূপের এক অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্য। “ঈশ্বর যখন দেহরূপে অবতীর্ণ হন, তখন তিনি সম্পূর্ণ দৈব, কোনোভাবেই মানব নন”, এই কথা বললে ধর্মনিন্দা করা হয়, কারণ এই বাক্যের কোনো অস্তিত্ব নেই, এবং এটি অবতার-রূপ গ্রহণের মূলনীতিকেই লঙ্ঘন করে। সেবাব্রত সম্পাদন করতে শুরু করার পরেও তিনি তাঁর কার্য নির্বাহ করার সময় দেবত্ব নিয়ে মানবিক বাহ্যরূপেই বসবাস করেন; সেই সময়ে তাঁর মানবতা শুধুমাত্র তাঁর দেবত্বকে সাধারণ দেহরূপে কার্য নির্বাহের একমাত্র উদ্দেশ্য পূরণে সাহায্য করে। অর্থাৎ এই কার্যের কর্তা হল তাঁর মানবতার মধ্যে অধিষ্ঠিত দেবত্ব। তাঁর দেবত্ব এই কার্যে নিয়োজিত, মানবতা নয়, তবু এই দেবত্ব তাঁর মানবতার আড়ালে লুকানো থাকে; সারসত্য এই যে, তাঁর কার্য তাঁর দেবত্বের দ্বারাই সম্পন্ন হয়, মানবতার দ্বারা নয়। কিন্তু এই কার্যের নির্বাহী হল তাঁর দেহরূপ। কেউ বলতে পারে যে তিনি একাধারে একজন মানুষ এবং ঈশ্বরও, কারণ ঈশ্বরই তাঁর দেহরূপে বসবাস করেন এবং তিনি মানুষের বাহ্যরূপ ও মানবিক সারসত্যের পাশাপাশি ঈশ্বরের সারসত্যেরও অধিকারী। যেহেতু তিনি ঈশ্বরের সারসত্যযুক্ত একজন মানুষ, তিনি সকল সৃষ্ট মানুষ এবং ঈশ্বরের কার্য সম্পাদনকারী যেকোনো মানুষের চেয়ে উন্নত। এবং তাই, যে সকল লোকের তাঁর মতো মানুষের বাহ্যরূপ আছে, মানবতা আছে, তাদের মধ্যে একমাত্র তিনিই ঈশ্বরের অবতার-রূপ – অন্য সকলেই সৃষ্ট মানুষ। যদিও তাদের সকলেরই মানবতা আছে, কিন্তু সৃষ্ট মানুষদের মানবতা ভিন্ন আর কিছুই নেই, আর সেখানেই ঈশ্বরের অবতার-রূপ পৃথক: দেহরূপে তাঁর শুধু মানবতাই নেই, উপরন্তু দেবত্ব আছে তাঁর বাহ্যিক চেহারা এবং প্রাত্যহিক জীবনে তাঁর মানবতা দেখতে পাওয়া যায়, কিন্তু তাঁর দেবত্ব অনুভব করা কঠিন। যেহেতু তাঁর দেবত্ব তখনই প্রকাশিত হয় যখন তাঁর মধ্যে মানবতা থাকে এবং যেহেতু তা মানুষের কল্পনার মতো অতিপ্রাকৃত নয়, ফলে তা মানুষের পক্ষে দেখতে পাওয়া খুবই কঠিন। এমনকি আজও পর্যন্ত মানুষের পক্ষে ঈশ্বরের অবতার রূপের প্রকৃত সারসত্যের পরিমাপ করা অত্যন্ত কঠিন। আমি এই বিষয়ে এত কিছু বলার পরেও, আমার ধারণা এটা তোমাদের অধিকাংশের কাছেই এখনও এক রহস্য। বস্তুত, এই বিষয়টি খুবই সহজ: যেহেতু ঈশ্বর দেহরূপে আবির্ভূত হন, তাঁর সারসত্য হল মানবতা এবং দেবত্বের এক সংমিশ্রণ। এই সংমিশ্রণকেই স্বয়ং ঈশ্বর, পৃথিবীর বুকে স্বয়ং ঈশ্বর বলা হয়।
যীশু পৃথিবীতে যে জীবনযাপন করেছিলেন, তা ছিল দেহরূপের স্বাভাবিক জীবন। তিনি তাঁর দেহরূপের স্বাভাবিক মানবতায় জীবনযাপন করেছিলেন। তাঁর কর্তৃত্ব—অর্থাৎ তাঁর কার্য নির্বাহ এবং তাঁর বাক্য উচ্চারণ, অথবা আর্তের নিরাময় এবং পিশাচের বিতাড়ন, এইসব অসাধারণ কাজ—এগুলি অধিকাংশ সময়েই প্রকাশিত হয় নি, যতক্ষণ না তিনি তাঁর সেবাব্রত সম্পাদন করতে শুরু করেছিলেন। ঊনত্রিশ বছর বয়সের আগে, যখন তিনি সেবাব্রত শুরু করেন নি, তখনকার তাঁর জীবনই যথেষ্ট প্রমাণ যে, তিনি একজন স্বাভাবিক রক্তমাংসের মানুষ ছিলেন। এই কারণেই এবং সাথে যেহেতু তিনি তখনও তার সেবাব্রত সম্পাদন করতে শুরু করেন নি, মানুষ তাঁর মধ্যে দৈব কিছুই দেখে নি, একজন স্বাভাবিক, সাধারণ মানুষের থেকে বেশি কিছুই দেখে নি—সে সময় কিছু মানুষ তাঁকে যোষেফের পুত্র বলে বিশ্বাস করত। লোকে ভাবত তিনি একজন সাধারণ মানুষের পুত্র, তিনি যে ঈশ্বরের অবতার-রূপ ছিলেন, এ কথা বোঝার কোনো উপায় তাঁদের ছিল না; এমনকি সেবাব্রত সম্পাদন করার সময় যখন তিনি অনেক অলৌকিক কাণ্ড ঘটাচ্ছিলেন, তখনও অধিকাংশ মানুষ বলেছিল যে তিনি যোষেফের পুত্র, কারণ তিনি ছিলেন স্বাভাবিক মানবতার বাহ্যরূপসম্পন্ন খ্রিষ্ট। তাঁর স্বাভাবিক মানবতা এবং তাঁর কার্য উভয়ই তাঁর প্রথম অবতার গ্রহণের তাৎপর্য পূরণ করার জন্য বিদ্যমান ছিল, এই কথা প্রমাণ করার জন্য যে ঈশ্বর সম্পূর্ণভাবেই দেহরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন, এবং তিনি একেবারে সাধারণ মানুষ হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর কার্য সম্পাদনের পূর্বকার স্বাভাবিক মানবতা ছিল তাঁর সাধারণ দেহরূপে আবির্ভাবের প্রমাণ; এবং পরে তিনি যে কার্য নির্বাহ করেছিলেন তাতেও তাঁর সাধারণ দেহরূপ প্রমাণিত হয়, কারণ তিনি দেহরূপের স্বাভাবিক মানবতায় প্রতীক ও বিস্ময় অনুষ্ঠান করেছিলেন, আর্তের নিরাময় এবং পিশাচের বিতাড়ন করেছিলেন। তিনি অলৌকিক কাণ্ড ঘটাতে পেরেছিলেন কারণ তাঁর দেহরূপে ঈশ্বরের কর্তৃত্ব ছিল, এবং সেই দেহ ঈশ্বরের আত্মাকে আচ্ছাদিত করেছিল। তিনি এই কর্তৃত্বের অধিকারী হয়েছিলেন ঈশ্বরের আত্মার জন্য, কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে তিনি দেহরূপ ছিলেন না। তাঁকে সেবাব্রত সম্পাদনার জন্য আর্তের নিরাময় এবং পিশাচের বিতাড়ন করতে হয়েছিল, এটা ছিল তাঁর মানবতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা দেবত্বের অভিব্যক্তি, এবং তিনি যেই প্রতীকই দেখান না কেন অথবা যেভাবেই তাঁর কর্তৃত্ব প্রদর্শন করুন না কেন, তিনি তা সত্ত্বেও স্বাভাবিক মানবতায় বাস করতেন, এবং ছিলেন একজন স্বাভাবিক দেহরূপী মানুষ। ক্রুশে মৃত্যুর পর পুনরুত্থানের সময় পর্যন্ত তিনি স্বাভাবিক দেহরূপে বসবাস করেছিলেন। অনুগ্রহ প্রদান, আর্তের নিরাময়, এবং পিশাচের বিতাড়ন এই সবই ছিল তাঁর সেবাব্রতের অংশ, তিনি তাঁর স্বাভাবিক দেহরূপে এই কার্যগুলিই সম্পাদন করেছিলেন। তাঁর সকল কার্য নির্বিশেষে ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার পূর্বে তিনি কখনোই তাঁর স্বাভাবিক মানব দেহরূপ পরিত্যাগ করেন নি। তিনি ছিলেন ঈশ্বরের কার্য সম্পাদনকারী স্বয়ং ঈশ্বর, তবু যেহেতু তিনি ছিলেন ঈশ্বরের অবতার-রূপ, তিনি খাদ্য গ্রহণ করতেন, বস্ত্র পরিধান করতেন, এবং তাঁর স্বাভাবিক মানবিক চাহিদা, যুক্তিবুদ্ধি, এবং মন ছিল। এই সবই প্রমাণ করেছিল যে তিনি ছিলেন একজন স্বাভাবিক মানুষ, যা প্রমাণ করেছিল যে ঈশ্বরের অবতার-রূপ ছিলেন স্বাভাবিক মানবতাবিশিষ্ট এক দেহরূপ, অতিপ্রাকৃতিক কিছু নয়। তাঁর কাজ ছিল ঈশ্বরের প্রথম অবতারের কার্য সম্পন্ন করা এবং সেই প্রথম অবতারের করণীয় সেবাব্রত পূরণ করা। অবতার গ্রহণের তাৎপর্যই হল এই যে, একজন সাধারণ, স্বাভাবিক মানুষ স্বয়ং ঈশ্বরের কার্য সম্পাদন করে; অর্থাৎ, ঈশ্বর মানবতার দ্বারা তাঁর দৈব কার্য সম্পাদন করেন এবং তার দ্বারাই শয়তানকে পরাজিত করেন। অবতার গ্রহণের অর্থই হল ঈশ্বরের আত্মা দেহরূপে আবির্ভূত হবে, অর্থাৎ ঈশ্বর দেহরূপে আবির্ভূত হবেন; সেই দেহরূপ যে কার্য নির্বাহ করেন তা হল আত্মার কার্য, যা দেহরূপের দ্বারা বাস্তবে পরিণত, এবং প্রকাশিত হয়। ঈশ্বরের দেহরূপ ভিন্ন আর কেউ তাঁর অবতার-রূপের সেবাব্রত সম্পাদন করতে পারে না; অর্থাৎ, একমাত্র ঈশ্বরের অবতার-রূপ, এই স্বাভাবিক মানবতা—এ ছাড়া আর কেউই—এই দৈব কার্য প্রকাশ করতে পারে না। প্রথম আবির্ভাবের সময় ঊনত্রিশ বছর বয়সের আগে ঈশ্বরের মধ্যে যদি স্বাভাবিক মানবতা না থাকত—যদি তিনি জন্মমাত্র অলৌকিক কাণ্ড ঘটাতে পারতেন, যদি তিনি কথা বলতে শেখামাত্রই স্বর্গের ভাষা বলতে পারতেন, যদি তিনি পৃথিবীর বুকে প্রথমবার পা দেওয়া মাত্রই বিশ্বের সকল বিষয় বুঝতে পারতেন, প্রত্যেক মানুষের ভাবনা ও অভিপ্রায় উপলব্ধি করতে পারতেন—তাহলে তেমন মানুষকে স্বাভাবিক মানুষ বলা যেত না এবং তেমন দেহরূপকে মানুষের দেহরূপ বলা যেত না। খ্রিষ্টের ক্ষেত্রেও যদি এমনই হত, তাহলে ঈশ্বরের অবতার গ্রহণের অর্থ এবং সারসত্য বিফলে যেত। তাঁর অন্তঃস্থিত স্বাভাবিক মানবতাই প্রমাণ করে যে তিনিই দেহরূপে অবতীর্ণ ঈশ্বর; তিনি যে স্বাভাবিক মানুষের বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে যান, তা প্রমাণ করে যে তিনি একজন স্বাভাবিক দেহরূপী মানুষ; উপরন্তু, তাঁর কার্যই যথেষ্ট প্রমাণ যে, তিনিই ঈশ্বরের বাক্য, এবং ঈশ্বরের আত্মার দেহে আবির্ভূত রূপ। ঈশ্বর তাঁর কার্যের প্রয়োজনে দেহরূপ ধারণ করেন; অন্যভাবে বললে কার্যের এই পর্যায়টি দেহরূপে নির্বাহ করা আবশ্যিক, স্বাভাবিক মানবতায় করা আবশ্যিক। এটাই হল “বাক্য দেহে পরিণত হল” বা “বাক্যের দেহে আবির্ভাব”-এর পূর্বশর্ত, এবং এটাই ঈশ্বরের দু’টি অবতার গ্রহণের অন্তরালের আসল কথা। মানুষ বিশ্বাস করতে পারে যে, যীশু তাঁর সারাজীবন ধরে অলৌকিক কার্য সম্পাদন করেছেন, পৃথিবীর বুকে তাঁর কার্য সম্পন্ন হওয়ার আগে তিনি মানবতার কোনো চিহ্ন দেখান নি, তাঁর স্বাভাবিক মানবিক চাহিদা, দুর্বলতা বা আবেগ ছিল না, তাঁর কোনো মৌলিক প্রয়োজনীয়তা ছিল না বা তিনি স্বাভাবিক মানবিক ভাবনাকে আমল দিতেন না। তারা শুধুমাত্র তাঁকে এক অতিমানবিকমন এবং অতীন্দ্রিয় মানবতার অধিকারী হিসেবে কল্পনা করে। তারা বিশ্বাস করে যেহেতু তিনি ঈশ্বর, তাই তাঁর স্বাভাবিক মানুষদের মতো চিন্তাভাবনা বা জীবনযাপন না করাই উচিত, কারণ একজন স্বাভাবিক, প্রকৃত মানুষই স্বাভাবিক মানুষের মতো চিন্তা এবং জীবনযাপন করতে পারে। এগুলি সবই মানুষের ধারণা এবং কল্পনা, এবং কল্পিত ধারণাগুলি ঈশ্বরের কার্যের আসল উদ্দেশ্যের বিরোধী। স্বাভাবিক মানুষের ভাবনাচিন্তাই স্বাভাবিক মানুষের যুক্তিবুদ্ধি ও মানবতা বজায় রাখে; স্বাভাবিক মানবতা দেহরূপের স্বাভাবিক কার্যকলাপ বজায় রাখে; এবং দেহরূপের স্বাভাবিক কার্যকলাপই তার স্বাভাবিক জীবনযাপনকে সম্পূর্ণতা দান করে। একমাত্র এইরকম দেহরূপে কার্য নির্বাহ করেই ঈশ্বর তাঁর অবতার গ্রহণের উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারেন। ঈশ্বরের অবতার-রূপ যদি কেবলমাত্র মানুষের বাহ্যরূপ ধারণ করত, কিন্তু স্বাভাবিক মানুষের মতো ভাবনাচিন্তা না করত, তাহলে সেই দেহরূপের মানবিক যুক্তিবুদ্ধি থাকত না, বা প্রকৃত মানবতা আরোই থাকত না। মানবতাবিহীন এই দেহরূপ কীভাবে ঈশ্বরের অবতার-রূপের করণীয় সেবাব্রত পূরণ করতে পারত? একটি স্বাভাবিক মন মানবজীবনের সকল দিক বজায় রাখে; স্বাভাবিক মন ব্যতীত কেউ মানুষ হতে পারবে না। অন্যভাবে বললে, যে মানুষ স্বাভাবিক ভাবনাচিন্তা করে না সে মানসিকভাবে অসুস্থ, এবং যে খ্রিষ্টের কোনো মানবতা নেই, শুধু দেবত্ব আছে, তাঁকে ঈশ্বরের অবতার রূপ বলা যায় না। তাহলে কীভাবে ঈশ্বরের অবতার রূপের স্বাভাবিক মানবতা না থাকতে পারে? খ্রিষ্টের কোনো মানবতা নেই, এ কথা বলা কি ধর্মনিন্দা নয়? স্বাভাবিক মানুষেরা যে সকল কর্মে লিপ্ত হয়, তার সব কিছুই স্বাভাবিক মানবিক মনের ক্রিয়ার উপর নির্ভরশীল। তা নাহলে মানুষেরা বিকৃত ব্যবহার করবে; তারা এমনকি সাদা-কালো, ভালো-মন্দের মধ্যে পার্থক্যও করতে পারবে না; এবং তাদের কোনো মানবিক নৈতিকতা বা নীতিবোধ থাকবে না। একইভাবে, ঈশ্বরের অবতার-রূপ যদি স্বাভাবিক মানুষের মতো না ভাবেন, তাহলে তিনিও প্রকৃত স্বাভাবিক দেহরূপী মানুষ হতে পারবেন না। এমন ভাবনাহীন দেহরূপ কখনো দৈব কার্যের দায়িত্ব নিতে পারবে না। তিনি কখনো স্বাভাবিক মানুষের কর্মে স্বাভাবিকভাবে লিপ্ত হতে পারবেন না, এবং পৃথিবীতে মানুষের সঙ্গে বসবাস করতে আরোই পারবেন না। আর তাই, ঈশ্বরের অবতার গ্রহণের তাৎপর্য, তাঁর দেহরূপে আবির্ভাবের একান্ত সারসত্যই বিফলে যাবে। ঈশ্বরের অবতার রূপের মধ্যে মানবতার অস্তিত্বই দেহরূপে তাঁর স্বাভাবিক দৈব কার্যকে বজায় রাখার জন্য থাকে; তাঁর স্বাভাবিক মানবিক ভাবনাচিন্তাই তাঁর স্বাভাবিক মানবতা এবং তাঁর সকল দেহগত কার্যকলাপ বজায় রাখে। বলা যায়, দেহরূপে ঈশ্বরের সকল কার্য বজায় রাখার জন্যই তাঁর স্বাভাবিক মানবিক ভাবনাচিন্তা বিদ্যমান থাকে। তাঁর এই দেহরূপ যদি এক স্বাভাবিক মানবিক মনের অধিকারী না হয়, তাহলে ঈশ্বর দেহরূপ কার্য নির্বাহ করতে পারবেন না, এবং দেহরূপে তাঁর যা করণীয়, তা সম্পন্ন হবে না। ঈশ্বরের অবতার রূপ স্বাভাবিক মানবিক মনের অধিকারী হলেও তাঁর কার্য মানবিক ভাবনার দ্বারা বিমিশ্র হয় না; তিনি স্বাভাবিক মন ও মানবতা নিয়ে, সেই মানবতার অধিকারী হওয়ার পূর্বশর্ত মেনে তাঁর কার্যের দায়িত্ব নেন, স্বাভাবিক মানবিক ভাবনাচিন্তার দ্বারা নেন না। তাঁর দেহরূপের ভাবনাচিন্তা যত উচ্চই হোক না কেন, তাঁর কার্য যুক্তি বা বিবেচনার দ্বারা সংক্রামিত হয় না। অন্যভাবে বললে, তাঁর কার্য তাঁর দেহরূপের মনের দ্বারা প্রসূত হয় না, বরং তাঁর মানবতার মধ্যে দৈব কার্যের সরাসরি প্রকাশ ঘটে। তাঁর সকল কার্যই তাঁর অবশ্যপূরণীয় সেবাব্রত, এবং কোনোটিই তাঁর মস্তিষ্কপ্রসূত নয়। উদাহরণস্বরূপ, আর্তের নিরাময়, পিশাচের বিতাড়ন, এবং ক্রুশবিদ্ধ হওয়া, এর কোনোটিই তাঁর মানবিক মনের উৎপাদন নয়, এবং কোনো মানবিক মনের অধিকারী মানুষের দ্বারা সম্পাদিত হতেও পারত না। একইভাবে, আজকের বিজয়কার্যও ঈশ্বরের অবতার রূপের দ্বারা পূরণীয় একটি সেবাব্রত, কিন্তু এটি মানবিক ইচ্ছাপ্রসূত কোনো কাজ নয়, এটি তাঁর দেবত্বের করণীয় কার্য, যা কোনো রক্ত-মাংসের মানুষের অসাধ্য। ফলে, ঈশ্বরের অবতার রূপকে আবশ্যিক ভাবে স্বাভাবিক মানবিক মন এবং স্বাভাবিক মানবতার অধিকারী হতে হবে, কারণ তাঁকে অবশ্যই মানবতা ও স্বাভাবিক মনের দ্বারাই কার্য নির্বাহ করতে হবে। এই হল ঈশ্বরের অবতার রূপের কার্যের সারসত্য এবং অবতার রূপের একান্ত সারসত্য।
যীশু তাঁর কার্য সম্পাদনের পূর্বে তাঁর নিতান্ত স্বাভাবিক মানবতায় জীবনযাপন করতেন। কেউ বলতে পারত না যে তিনিই ঈশ্বর ছিলেন, কেউ জানতেও পারে নি যে তিনিই ছিলেন ঈশ্বরের অবতার রূপ; মানুষ তাঁকে কেবল সম্পূর্ণ সাধারণ একজন মানুষ বলেই জানত। তাঁর নিতান্ত সাধারণ, স্বাভাবিক মানবতাই প্রমাণ করত যে ঈশ্বর দেহরূপে অবতার গ্রহণ করেছিলেন, এবং অনুগ্রহের যুগ ছিল ঈশ্বরের অবতার রূপের কার্যের যুগ, আত্মার কার্যের যুগ নয়। এটাই প্রমাণ ছিল যে, ঈশ্বরের আত্মা সম্পূর্ণরূপে দেহরূপে পরিণত হয়েছিল এবং ঈশ্বরের অবতারের যুগে তাঁর দেহরূপই আত্মার সকল কার্য নির্বাহ করবেন। স্বাভাবিক মানবতাবিশিষ্ট খ্রিষ্ট হলেন সেই দেহরূপ যাতে আত্মা অধিষ্ঠিত হয়েছে, এবং তিনি স্বাভাবিক মানবতা, বোধ, এবং মানবিক ভাবনার অধিকারী। “বাস্তবে পরিণত হওয়া”-র অর্থ ঈশ্বরের মানুষ হওয়া, আত্মার দেহরূপ ধারণ; আরও সরলভাবে বললে, যখন স্বয়ং ঈশ্বর স্বাভাবিক মানবতাবিশিষ্ট দেহরূপে অধিষ্ঠান করেন, এবং এর মাধ্যমে তাঁর দৈব কার্য প্রকাশ করেন—তখন তাকেই বলা হয় বাস্তবে পরিণত হওয়া, বা অবতার গ্রহণ। তাঁর প্রথম অবতার গ্রহণের সময়, ঈশ্বরের পক্ষে আর্তের নিরাময় বা পিশাচের বিতাড়ন করা প্রয়োজনীয় ছিল, কারণ তাঁর কার্য ছিল মুক্তিদানের। সমগ্র মানবজাতিকে মুক্তি দেওয়ার জন্য তাঁকে সহানুভূতিশীল এবং ক্ষমাশীল হতে হত। ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার আগে তিনি যা করেছিলেন তা ছিল আর্তের নিরাময় এবং পিশাচের বিতাড়ন, যা মানুষকে পাপ এবং মলিনতা থেকে পরিত্রাণের কার্যের সূচনা করেছিল। যেহেতু তখন ছিল অনুগ্রহের যুগ, তাই তাঁর পক্ষে আর্তের নিরাময়, এবং তার মাধ্যমে প্রতীক ও বিস্ময়ের প্রদর্শন করার প্রয়োজন ছিল, যা ছিল সেই যুগে অনুগ্রহের পরিচায়ক—কারণ অনুগ্রহের যুগের কেন্দ্রবিন্দু ছিল অনুগ্রহ প্রদান, যার প্রতীক ছিল শান্তি, আনন্দ, এবং বস্তুগত আশীর্বাদ, যা ছিল যীশুর প্রতি মানুষের বিশ্বাসের চিহ্ন। অর্থাৎ বলা যায়, অনুগ্রহের যুগে যীশুর দেহরূপের সহজাত ক্ষমতা ছিল আর্তের নিরাময়, পিশাচের বিতাড়ন এবং অনুগ্রহ প্রদান, এবং এগুলি ছিল সেই কার্য, যা আত্মা দেহরূপে উপলব্ধ করেছিলেন। কিন্তু যখন তিনি এই ধরনের কার্য নির্বাহ করছিলেন, তখন তিনি দেহরূপে বসবাস করছিলেন, দেহরূপকে অতিক্রম করে যান নি। যে নিরাময়ের কার্যই করুন না কেন, তিনি তখনও স্বাভাবিক মানবতার অধিকারী ছিলেন, তখনও স্বাভাবিক মানুষের মতো জীবনযাপন করতেন। আমি যে কারণে বলি যে, ঈশ্বরের অবতারের যুগে তাঁর দেহরূপই আত্মার সকল কার্য সম্পন্ন করেছিল, তা এই যে, তিনি যে কার্যই নির্বাহ করে থাকুন না কেন, তা দেহরূপেই করেছিলেন। কিন্তু তাঁর কার্যের জন্য মানুষ তাঁর দেহরূপকে পূর্ণ শারীরিক সারসত্যের অধিকারী বলে গণ্য করে নি, কারণ এই দেহরূপ বিস্ময়কর কার্য সম্পাদন করতে পারত, এবং কিছু বিশেষ মুহূর্তে এমন কিছু কাজ করতে পারত, যা দেহকে অতিক্রম করে যায়। নিঃসন্দেহে এই সব কিছু তিনি তাঁর সেবাব্রত শুরু করার পরই ঘটেছিল, যেমন চল্লিশ দিন ধরে তাঁর পরীক্ষিত হওয়া বা পর্বতের ওপর রূপ পরিবর্তন ফলত, যীশুকে দিয়ে ঈশ্বরের অবতার গ্রহণের অর্থ সম্পূর্ণ হয় নি, কেবল আংশিক পূর্ণ হয়েছিল। কার্য সম্পাদন করার আগে তিনি দেহরূপে যে জীবনযাপন করেছিলেন, তা সবদিক থেকেই ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক। তিনি তাঁর কার্য শুরু করার পর, কেবলমাত্র তাঁর দেহের বাহ্যরূপটিই বজায় রেখেছিলেন। যেহেতু তাঁর কার্য ছিল দেবত্বের অভিব্যক্তি, তাই তা দেহরূপের স্বাভাবিক কার্যকলাপকে অতিক্রম করে যেত। যতই হোক, ঈশ্বরের অবতার রূপ ছিলেন রক্ত-মাংসের মানুষের চেয়ে ভিন্ন। অবশ্যই দৈনন্দিন জীবনে তাঁর খাদ্য, বস্ত্র, বিশ্রাম, এবং বাসস্থানের চাহিদা ছিল, সকল স্বাভাবিক প্রয়োজনীয় বিষয়ের চাহিদা ছিল, এবং তাঁর স্বাভাবিক মানুষের মতো বোধ ও চিন্তাশক্তি ছিল। মানুষ তখনও তাঁকে তাঁর অতিপ্রাকৃতিক কার্য ব্যতিরেকে স্বাভাবিক মানুষ বলেই ভাবত। আসলে তিনি যাই করুন না কেন, তিনি সাধারণ এবং স্বাভাবিক মানবতায় জীবনযাপন করতেন, এযাবৎ তিনি যত কার্য সম্পাদন করেছিলেন, সবেতেই তাঁর বোধ ছিল স্বাভাবিক, এবং তাঁর ভাবনাচিন্তা ছিল অন্যান্য মানুষজনের থেকেও বিশেষভাবে সরল। ঈশ্বরের অবতার রূপের এমন চিন্তাশক্তি ও বোধশক্তি থাকা প্রয়োজন ছিল, কারণ দৈব কার্যের প্রকাশ এমন এক দেহরূপের দ্বারা হওয়া প্রয়োজন ছিল যার বোধ হবে খুবই স্বাভাবিক, এবং যার ভাবনাচিন্তা হবে খুবই সরল—একমাত্র এই উপায়েই তাঁর দেহরূপ সেই দৈব কার্যের প্রকাশ ঘটাতে পারবেন। পৃথিবীর বুকে যীশুর জীবনকালের সাড়ে তেত্রিশ বছর ধরেই তিনি তাঁর স্বাভাবিক মানবতা বজায় রেখেছিলেন, কিন্তু তাঁর সাড়ে তিন বছরের সেবাব্রতের কার্যের জন্য মানুষ ভেবেছিল যে তিনি অতীন্দ্রিয়, এবং তিনি আগের চেয়ে অনেক বেশি অতিপ্রাকৃতিক। বাস্তবে যীশুর স্বাভাবিক মানবতা তাঁর সেবাব্রত সম্পাদনার আগে এবং পরে অপরিবর্তিত ছিল; তাঁর মানবতা সবসময়েই একই ছিল, কিন্তু তাঁর সেবাব্রত শুরু করার আগে এবং পরের পার্থক্যের জন্য তাঁর দেহরূপকে ঘিরে দু’টি ভিন্ন অভিমত উঠে এসেছিল। মানুষ যাই ভাবুক না কেন, ঈশ্বরের অবতার রূপ সমগ্র সময় ধরেই তাঁর স্বাভাবিক মানবতা বজায় রেখেছিলেন, কারণ তিনি স্বাভাবিক মানবতাবিশিষ্ট দেহরূপেই অবতীর্ণ হয়েছিলেন। তিনি তাঁর সেবাব্রত সম্পাদন করুন বা না করুন তাঁর দেহরূপের স্বাভাবিক মানবতা নিশ্চিহ্ন করা যায় নি, কারণ মানবতাই হল দেহরূপের প্রাথমিক সারসত্য। যীশু তাঁর সেবাব্রত সম্পাদন করার পূর্বে তাঁর দেহরূপ সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ছিল, এবং তিনি সকল সাধারণ মানবিক কর্মে লিপ্ত ছিলেন; তাঁর মধ্যে অতিপ্রাকৃতিকের লেশমাত্র ছিল না, এবং তিনি কোনো অলৌকিক চিহ্নও দেখাননি। সেই সময়ে তিনি ছিলেন একজন সাধারণ মানুষ যিনি ঈশ্বরের উপাসনা করতেন, যদিও তাঁর সাধনা অনেক বেশি সৎ এবং অন্য সকলের চেয়ে বেশি আন্তরিক ছিল। এভাবেই তাঁর নিতান্ত স্বাভাবিক মানবতা আত্মপ্রকাশ করেছিল। যেহেতু তিনি সেবাব্রত সম্পাদনের আগে কোনো কার্য নির্বাহ করেন নি, ফলে কেউ তাঁর পরিচয় সম্বন্ধে অবগত ছিল না, কেউই জানত না যে তাঁর দেহরূপ অন্য সকলের চেয়ে ভিন্ন, কারণ তিনি একটিও অলৌকিক কার্য সম্পাদন করেন নি, ঈশ্বরের নিজের কোনো কার্য নির্বাহ করেন নি। যাই হোক, সেবাব্রত সম্পাদন করতে শুরু করার পর তিনি তাঁর স্বাভাবিক মানবতার বাহ্যরূপটি বজায় রেখেছিলেন, এবং তখনও স্বাভাবিক মানবিক যুক্তিবুদ্ধি নিয়েই জীবনযাপন করতেন, কিন্তু যেহেতু তিনি স্বয়ং ঈশ্বরের কার্য নির্বাহ করতে শুরু করেছিলেন, খ্রিষ্টের সেবাব্রতের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন এবং এমন কার্য সম্পাদন করতে শুরু করেছিলেন, যা নশ্বর জীবদের, বা রক্ত-মাংসের মানুষের ক্ষমতার অতীত ছিল, ফলে মানুষ ধরে নিয়েছিল যে তাঁর স্বাভাবিক মানবতা ছিল না, এবং তাঁর দেহরূপ সম্পূর্ণরূপে স্বাভাবিক ছিল না, ছিল অসম্পূর্ণ। তিনি যেসব কার্য সম্পাদন করতেন, তার ফলে মানুষ বলতে লাগল যে তিনি দেহরূপে ঈশ্বর, যাঁর স্বাভাবিক মানবতা নেই। এই ধরনের ধারণা ভ্রান্ত, কারণ মানুষ ঈশ্বরের অবতার গ্রহণের তাৎপর্য অনুধাবন করতে পারে নি। এই ভুল বোঝাবুঝির সূত্রপাত হয়েছিল এই থেকে যে, ঈশ্বরের অবতার-রূপের দ্বারা প্রকাশিত কার্য ছিল দৈব, কিন্তু তা প্রকাশিত হয়েছিল স্বাভাবিক মানবতাবিশিষ্ট দেহরূপে। ঈশ্বর দেহরূপে আচ্ছাদিত ছিলেন, দেহের মধ্যে বসবাস করেছিলেন, এবং তাঁর মানবরূপের কার্য তাঁর মানবতাকেই অস্পষ্ট করে তুলেছিল। এই কারণেই মানুষ বিশ্বাস করত যে, ঈশ্বরের কোনো মানবতা নেই, কেবল দেবত্ব আছে।
ঈশ্বর তাঁর প্রথম অবতার গ্রহণের সময় অবতারের কার্য সম্পন্ন করেন নি; তিনি কেবল কার্যের প্রথম ধাপটি সম্পন্ন করেছিলেন অর্থাৎ যা ঈশ্বরের দেহরূপে সম্পাদন করার প্রয়োজন ছিল। তাই, অবতারের কার্য সম্পন্ন করার জন্য ঈশ্বর সকল স্বাভাবিকতা এবং বাস্তবতা নিয়ে দেহরূপে প্রত্যাবর্তন করেছেন, অর্থাৎ ঈশ্বরের বাক্যকে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক এবং সাধারণ দেহে প্রকাশ করেছেন এবং দেহরূপে তাঁর অপূর্ণ কার্য নিষ্পন্ন করেছেন। সারসত্যের দিক থেকে দ্বিতীয় অবতার রূপটি প্রথমটির মতোই, কিন্তু এটি প্রথমটির চেয়ে আরও বাস্তবোচিত, আরও স্বাভাবিক। পরিণামে দ্বিতীয় অবতার রূপ যে যন্ত্রণা ভোগ করে, তা প্রথমটির চেয়েও অধিকতর, কিন্তু এই যন্ত্রণা তাঁর দেহরূপের সেবাব্রতের ফলাফল, যা অসাধু মানুষের যন্ত্রণার মতো নয়। এটিও তাঁর দেহরূপের স্বাভাবিকতা ও বাস্তবতার থেকেই সঞ্জাত হয়। যেহেতু তিনি নিতান্ত স্বাভাবিক এবং বাস্তব দেহরূপে তাঁর সেবাব্রত সম্পাদন করেন, তাই তাঁর দেহরূপকে অনেক কষ্ট ভোগ করতে হয়। এই দেহরূপ যত বেশি স্বাভাবিক এবং বাস্তব হবে, তত বেশি তিনি তাঁর সেবাব্রতের সম্পাদনে যন্ত্রণা ভোগ করবেন। ঈশ্বরের কার্য খুবই সাধারণ দেহরূপে প্রকাশিত হয়, যা একেবারেই অতিপ্রাকৃতিক নয়। যেহেতু তাঁর দেহরূপটি স্বাভাবিক এবং একই সঙ্গে মানুষকে উদ্ধার করার দায়িত্বও তাঁর স্কন্ধে, ফলত তিনি অতিপ্রাকৃতিক দেহরূপের চেয়েও অধিকতর যন্ত্রণা ভোগ করেন—এবং এই সকল যন্ত্রণাই তাঁর দেহরূপের বাস্তবতা এবং স্বাভাবিকতা থেকে সঞ্জাত হয়। সেবাব্রত সম্পাদনের কালে এই দুই অবতার রূপ যে যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যান, তা থেকেই অবতার রূপের সারসত্য বোঝা যায়। দেহরূপ যত বেশি স্বাভাবিক হবে, তাঁকে কার্যের দায়িত্ব গ্রহণের কালে তত বেশি কষ্টভোগ করতে হবে; কার্যনির্বাহী দেহরূপটি যত বেশি বাস্তবোচিত হবে, তাঁর উপর মানুষের কল্পিত ধারণা এবং বিপদ আরও কঠোরভাবে বর্ষিত হতে পারে। এরপরেও, দেহরূপটি যত বেশি বাস্তবোচিত হবে, এবং যত বেশি তাঁর স্বাভাবিক মানুষের মতো চাহিদা ও বোধ থাকবে, ঈশ্বরের কার্যের দায়িত্ব গ্রহণে তিনি তত বেশি সক্ষম হবেন। যীশুর দেহকেই ক্রুশে বিদ্ধ করা হয়েছিল, তিনি তাঁর দেহকেই পাপ-উৎসর্গ হিসেবে ত্যাগ করেছিলেন; তিনি স্বাভাবিক মানবতাবিশিষ্ট দেহরূপের সাহায্যেই শয়তানকে পরাস্ত করেছিলেন এবং মানুষকে ক্রুশ থেকেই সম্পূর্ণ রক্ষা করেছিলেন। এবং ঈশ্বর তাঁর দ্বিতীয় অবতারে সম্পূর্ণ দেহরূপেই শয়তানকে পরাজিত করেন এবং বিজয়কার্য সম্পন্ন করেন। একমাত্র সম্পূর্ণ স্বাভাবিক এবং বাস্তব দেহরূপই বিজয়কার্যের সামগ্রিক সম্পাদন করতে পারে এবং শক্তিশালী সাক্ষ্য বহন করতে পারে। অর্থাৎ বলা যায়, মানুষের জয়যাত্রা ঈশ্বরের দেহরূপের বাস্তবতা ও স্বাভাবিকতার দ্বারাই ফলপ্রসূ করা হয়, অতিপ্রাকৃতিক অলৌকিক ঘটনা বা প্রকাশের দ্বারা নয়। ঈশ্বরের অবতার রূপের সেবাব্রত হল বাক্য উচ্চারণ করা, এবং তার সাহায্যে মানুষকে জয় করা এবং তাকে নিখুঁত করে তোলা; অন্যভাবে বললে, দেহরূপে পরিণত আত্মার কার্য, বা দেহরূপের কর্তব্য হল, বাক্য উচ্চারণ করা, এবং তার সাহায্যে মানুষকে জয় করা, প্রকাশ করা, নিখুঁত করা, এবং সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করা। আর তাই, দেহরূপে ঈশ্বরের কার্য জয়লাভের কার্য দ্বারাই পূর্ণতা লাভ করবে। প্রাথমিক মুক্তিদানের কার্য ছিল অবতার রূপের কার্যের সূত্রপাত মাত্র; যে দেহরূপ জয়লাভের কার্য সম্পাদন করবে, সে-ই সম্পূর্ণরূপে অবতারের কার্য সম্পন্ন করবে। লিঙ্গপরিচিতিতে একজন পুরুষ এবং অপরজন স্ত্রী, যাতে ঈশ্বরের অবতার গ্রহণের তাৎপর্য সম্পূর্ণ হয় এবং ঈশ্বরের বিষয়ে মানুষের কল্পিত ধারণা দূরীভূত হয়: ঈশ্বর পুরুষ ও স্ত্রী উভয়ই হতে পারেন, এবং সারসত্য এই যে, ঈশ্বরের অবতার রূপ লিঙ্গহীন। তিনি পুরুষ ও স্ত্রী উভয়কেই নির্মাণ করেছেন, এবং তাঁর কাছে লিঙ্গের কোনো ভেদাভেদ নেই। কার্যের এই স্তরে ঈশ্বর প্রতীক ও বিস্ময়ের সম্পাদন করেন না, যাতে কার্যের ফলাফল বাক্যের সাহায্যে লব্ধ হতে পারে। এর কারণ এই যে, এই সময়ে ঈশ্বরের অবতার রূপের কার্য আর্তের নিরাময় বা পিশাচের বিতাড়ন নয়, বরং বাক্যের সাহায্যে মানুষকে জয় করা, যার অর্থ ঈশ্বরের অবতার রূপের সহজাত ক্ষমতা হল বাক্যের সাহায্যে মানুষকে জয় করা, আর্তের নিরাময় বা পিশাচের বিতাড়ন নয়। স্বাভাবিক মানবতায় তাঁর কার্য অলৌকিক ঘটনার সম্পাদন করা নয়, আর্তের নিরাময় এবং পিশাচের বিতাড়ন নয়, বরং বাক্য উচ্চারণ করা, এবং তাই মানুষের কাছে এই দ্বিতীয় অবতার রূপ প্রথমটির চেয়ে বেশি স্বাভাবিক মনে হয়। মানুষ বুঝতে পারে যে, ঈশ্বরের অবতার গ্রহণ কোনো মিথ্যা নয়; কিন্তু ঈশ্বরের এই অবতার-রূপটি যীশুর থেকে ভিন্ন, এবং যদিও উভয়ই ঈশ্বরের অবতার-রূপ, তাঁরা সম্পূর্ণ একরকম নন। যীশু স্বাভাবিক, সাধারণ মানবতার অধিকারী ছিলেন, কিন্তু তার পাশাপাশি তাঁর মধ্যে নানা প্রতীক ও বিস্ময়ের উপস্থিতি ছিল। এই অবতার-রূপের মধ্যে মানুষের চোখ কোনো প্রতীক বা বিস্ময়ের চিহ্ন দেখতে পাবে না, আর্তের নিরাময় বা পিশাচের বিতাড়ন, সমুদ্রবক্ষে হেঁটে যাওয়া, চল্লিশ দিনের উপবাস, কিছুই দেখতে পাবে না... তিনি যীশুর মতো একই কার্য সম্পাদন করবেন না, এই কারণে নয় যে সারসত্যের দিক থেকে তাঁর দেহরূপ যীশুর থেকে ভিন্ন, বরং এই কারণে যে, আর্তের নিরাময় বা পিশাচের বিতাড়ন তাঁর সেবাব্রতের অংশ নয়। তিনি নিজের কার্যকে ধ্বংস করেন না, বা নষ্ট করেন না। যেহেতু তিনি তাঁর প্রকৃত বাক্যের সাহায্যে মানুষকে জয় করেন, ফলে তাঁকে অলৌকিক ঘটনার দ্বারা দমন করার কোনো প্রয়োজন নেই এবং তাই এই পর্যায়টি অবতারের কার্য সম্পন্ন করার জন্যই। তুমি আজ ঈশ্বরের যে অবতার-রূপকে দেখছ তা সম্পূর্ণরূপে স্বাভাবিক দেহরূপ, এবং এতে অতিপ্রাকৃতিকের কিছুই নেই। তিনি বাকিদের মতোই অসুস্থ হন, বাকিদের মতোই তাঁরও খাদ্য ও বস্ত্রের প্রয়োজন হয়; তিনি পুরোপুরি জৈবদেহ। এই সময়ে যদি ঈশ্বরের অবতার-রূপ অতিপ্রাকৃতিক প্রতীক ও বিস্ময়ের সম্পাদন করতেন, যদি তিনি আর্তের নিরাময়, পিশাচের বিতাড়ন, বা একটিমাত্র শব্দের দ্বারা সংহার করতে পারতেন, তাহলে জয়লাভের কার্য কীভাবে নির্বাহিত হত? এই কার্য পরজাতীয় দেশগুলিতে কীভাবে ছড়িয়ে পড়ত? আর্তের নিরাময় বা পিশাচের বিতাড়ন ছিল অনুগ্রহের যুগের কার্য, এগুলি ছিল মুক্তিলাভের কার্যের প্রথম ধাপ, এবং এখন যখন ঈশ্বর মানুষকে ক্রুশের হাত থেকে উদ্ধার করেছেন, তিনি আর এই কার্য সম্পাদন করেন না। অন্তিম সময়ে যদি যীশুর মতো কোনো “ঈশ্বর” অবতীর্ণ হত, যে আর্তের নিরাময় করত, পিশাচের বিতাড়ন করত, এবং মানুষের জন্য ক্রুশবিদ্ধ হত, তাহলে সেই “ঈশ্বর” যদিও বাইবেলে বর্ণিত ঈশ্বরের সঙ্গে হুবহু এক হত এবং সহজেই মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হত, তবু সারসত্যের দিক থেকে তা ঈশ্বরের আত্মার পরিহিত দেহরূপ হত না, বরং অশুভ আত্মার দ্বারা পরিহিত হত। কারণ ঈশ্বরের কার্যের নীতিই হল, তিনি একবার যা সম্পন্ন করেছেন, তার আর কখনো পুনরাবৃত্তি করবেন না। আর তাই, ঈশ্বরের দ্বিতীয় অবতার রূপের কার্য প্রথম অবতার রূপের চেয়ে ভিন্ন। অন্তিম সময়ে, ঈশ্বর সাধারণ, স্বাভাবিক দেহরূপে জয়লাভের কার্যকে বাস্তবায়িত করেন; তিনি আর্তের নিরাময় করেন না, মানুষের জন্য ক্রুশবিদ্ধও হন না, বরং দেহরূপে কেবল বাক্য উচ্চারণ করেন, এবং মানুষকে জয় করেন। এমন দেহরূপই ঈশ্বরের অবতার-রূপ; এমন দেহরূপই ঈশ্বরের অবতার-রূপের কার্য সম্পন্ন করতে পারে।
এই স্তরে ঈশ্বরের অবতার রূপ কষ্টভোগ করুন বা তাঁর সেবাব্রত সম্পাদন করুন, তিনি অবতার গ্রহণের অর্থ সম্পূর্ণ করতেই তা করেন, কারণ এটিই ঈশ্বরের শেষ অবতার। ঈশ্বর কেবলমাত্র দু’বারই অবতার গ্রহণ করতে পারেন। এর কোনো তৃতীয় বার হতে পারে না। প্রথম অবতার রূপ ছিল পুরুষ, দ্বিতীয়টি স্ত্রী, আর এভাবেই ঈশ্বরের দেহরূপের প্রতিমূর্তি মানুষের মনে সম্পূর্ণ হয়; উপরন্তু, এই দুই অবতার-রূপ ইতোমধ্যেই দেহরূপে ঈশ্বরের কার্য সম্পন্ন করে ফেলেছে। প্রথমবারে, ঈশ্বরের অবতার রূপ অবতার গ্রহণের অর্থ সম্পূর্ণ করার জন্য স্বাভাবিক মানবতার অধিকারী ছিলেন। এবারেও তাঁর মধ্যে স্বাভাবিক মানবতা রয়েছে, কিন্তু এই অবতারের অর্থ ভিন্ন: এবার তা গভীরতর এবং তাঁর কার্যের প্রগাঢ় তাৎপর্য রয়েছে। যে কারণে ঈশ্বর আরও একবার দেহরূপে অবতীর্ণ হয়েছেন, তা এই অবতার গ্রহণের অর্থ সম্পূর্ণ করার জন্যই। ঈশ্বর যখন এই পর্যায়ের কার্য পুরোপুরি সম্পন্ন করবেন, তখন অবতার গ্রহণের সামগ্রিক অর্থ, অর্থাৎ দেহরূপে ঈশ্বরের কার্য সম্পন্ন হব এবং জৈবদেহে তাঁর আর কোনো কার্য বাকি থাকবে না। যার অর্থ, এখন থেকে ঈশ্বর তাঁর কার্য সম্পাদনের জন্য আর কখনো দেহরূপে অবতীর্ণ হবেন না। ঈশ্বর কেবলমাত্র মানবজাতিকে উদ্ধার করতে এবং নিখুঁত করে গড়ে তুলতেই অবতার গ্রহণ করেন। অন্যভাবে বললে, ঈশ্বরের জন্য কার্যের স্বার্থ ব্যতীত আর কোনো কারণে দেহরূপে অবতীর্ণ হওয়া কোনোভাবেই প্রচলিত নয়। কার্য নির্বাহের জন্য দেহরূপে অবতীর্ণ হয়ে তিনি শয়তানকে দেখান যে ঈশ্বর এক জৈবদেহ, এক স্বাভাবিক, সাধারণ মানুষ—তা সত্ত্বেও তিনি বিশ্বের উপর বিজয়ের রাজত্ব চালাতে পারেন, শয়তানকে পরাস্ত করতে পারেন, মানবজাতিকে উদ্ধার করতে পারেন, জয় করতে পারেন! শয়তানের কাজের লক্ষ্য হল মানবজাতিকে কলুষিত করা, কিন্তু ঈশ্বরের লক্ষ্য হল মানবজাতিকে উদ্ধার করা। শয়তান মানুষকে এক অতল গহ্বরে বন্দী করে, কিন্তু ঈশ্বর তাকে সেখান থেকে উদ্ধার করেন। শয়তান সকল মানুষকে তার উপাসনা করতে বাধ্য করে, কিন্তু ঈশ্বর তাদের তাঁর রাজত্বের অধীনে নিয়ে আসেন, কারণ তিনিই সকল সৃষ্টির প্রভু। সারসত্য এই যে, তাঁর দেহরূপ হল মানবতা ও দেবত্বের সম্মেলন এবং তা স্বাভাবিক মানবতার অধিকারী। ফলত, অবতার-রূপ ব্যতিরেকে ঈশ্বর মানবজাতিকে উদ্ধার করতে পারতেন না, এবং তাঁর দেহরূপের স্বাভাবিক মানবতা ব্যতীত তাঁর দেহরূপে সম্পাদিত কার্যের এমন ফললাভ হত না। ঈশ্বরের অবতার গ্রহণের সারসত্যই হল এই যে, তাঁকে আবশ্যিক ভাবে স্বাভাবিক মানবতার অধিকারী হতেই হবে; কারণ অন্যরকম হলে তা ঈশ্বরের অবতার গ্রহণের মূল অভিপ্রায়ের বিপরীতে যাবে।
আমি কেন বলি যে যীশুর কার্যে অবতার গ্রহণের অর্থ সম্পূর্ণ হয় নি? কারণ বাক্য দেহে সম্পূর্ণরূপে দেহরূপে আবির্ভূত হয় নি। যীশু যা করেছিলেন তা ছিল দেহরূপে ঈশ্বরের কার্যের একটি অংশমাত্র; তিনি কেবল মুক্তিদানের কার্য সম্পাদন করেছিলেন, মানুষকে পুরোপুরি জয় করার কার্য নির্বাহ করেন নি। এই কারণে ঈশ্বর অন্তিম সময়ে আরও একবার দেহরূপে অবতীর্ণ হয়েছেন। এই স্তরের কার্যও সাধারণ দেহরূপেই সম্পাদিত হয়; এটি এমন এক নিতান্ত স্বাভাবিক মানুষের দ্বারা সাধিত হয়, যার মানবতা একটুও অতীন্দ্রিয় নয়। অন্যভাবে বললে, ঈশ্বর সম্পূর্ণরূপে মানুষ হয়েছেন; তিনি একজন মানুষ যার পরিচয় ঈশ্বরের, একজন পূর্ণ মানব, পূর্ণ দেহ, যিনি কার্য সম্পাদনা করছেন। মানুষের চোখে দেখা যায় এক জৈবদেহ, যা একেবারেই অতীন্দ্রিয় নয়, একজন খুবই সাধারণ মানুষ যিনি স্বর্গের ভাষায় কথা বলতে পারেন, যার মধ্যে কোনো অলৌকিকতার চিহ্ন নেই, যিনি কোনো অলৌকিক কার্য সম্পাদন করেন না, এবং একেবারেই কোনো মহান সভাগৃহে ধর্মের অন্তর্নিহিত সত্য উদ্ঘাটন করেন না। মানুষের কাছে দ্বিতীয় অবতার-রূপের কার্য একেবারেই প্রথম অবতার-রূপের মতো মনে হয় না, এতটাই ভিন্ন যে মনে হয়, দুইয়ের মধ্যে কোনো কিছুই এক নয় এবং প্রথম অবতারের কোনো কার্যই এইবারে দেখা যায় না। দ্বিতীয় অবতার-রূপের কার্য প্রথমের থেকে ভিন্ন হলেও তা প্রমাণ করে না যে তদের উৎসও এক এবং অভিন্ন নয়। তাঁদের উৎস এক কিনা, তা নির্ভর করে দেহরূপদের দ্বারা সম্পাদিত কার্যের প্রকৃতির উপর, তাঁদের বাহ্যরূপের উপর নয়। ঈশ্বর তাঁর কার্যের তিনটি পর্যায়ে দু’বার অবতার গ্রহণ করেছেন এবং উভয় বারেই ঈশ্বরের অবতার রূপের কার্য এক নতুন যুগ, নতুন কার্যের সূচনা করেছে; অবতারগুলি একে অন্যের পরিপূরক। মানুষের চোখের পক্ষে বলা অসম্ভব যে এই দুই অবতার রূপ একই উৎস থেকে এসেছে। এ কথা বলাই বাহুল্য যে, এটা মানুষের চোখ বা মানুষের মনের ক্ষমতার বাইরে। কিন্তু সারসত্যের দিক থেকে তাঁরা একই, কারণ তাঁদের কার্য একই আত্মা থেকে জাত হয়। দুই অবতার-রূপ একই উৎস থেকে জাত কিনা তা তাঁদের যুগ বা জন্মস্থান, অথবা এরকম অন্যান্য বিষয় থেকে বিচার করা যায় না, তাঁদের দ্বারা প্রকাশিত দৈব কার্যের দ্বারা বিচার করা যায়। দ্বিতীয় অবতার-রূপ যীশুর দ্বারা কৃত কোনো কার্য সম্পাদন করেন না, কারণ ঈশ্বরের কার্য প্রচলিত রীতি-নীতি মেনে চলে না, বরং প্রতিবার এক নতুন পথ উন্মুক্ত করে। দ্বিতীয় অবতার-রূপ মানুষের মনে প্রথম অবতার-রূপের প্রভাবকে গাঢ় বা দৃঢ় করার লক্ষ্যে চলেন না, বরং তাকে নিখুঁত এবং পরিপূর্ণ করা, ঈশ্বর বিষয়ে মানুষের জ্ঞানকে গভীরতর করা, মানুষের হৃদয়ে বিদ্যমান সকল বিধি ভঙ্গ করা, এবং তাঁদের হৃদয়ে ঈশ্বরের ভ্রান্ত ভাবমূর্তি নির্মূল করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেন। বলা যায় যে, ঈশ্বরের কার্যের কোনো একক পর্যায়ই মানুষকে তাঁর বিষয়ে সম্পূর্ণ জ্ঞান প্রদান করতে পারে না; প্রতিটি পর্যায় কিছু অংশমাত্র দেয়, সম্পূর্ণ নয়। যদিও ঈশ্বর সম্পূর্ণরূপে তাঁর স্বভাব প্রকাশ করেছেন, তবু মানুষের বোধগম্যতার সীমিত ক্ষমতার কারণে ঈশ্বর বিষয়ে তার জ্ঞান অসম্পূর্ণ থেকে যায়। মানুষের ভাষা ব্যবহার করে ঈশ্বরের স্বভাবের সামগ্রিকতা জ্ঞাপন করা অসম্ভব; উপরন্তু, তাঁর কার্যের একটিমাত্র পর্যায় কীভাবে ঈশ্বরকে পুরোপুরি প্রকাশ করবে? তিনি তাঁর স্বাভাবিক মানবতার আচ্ছাদনে দেহরূপ কার্য নির্বাহ করেন, এবং তাঁকে একমাত্র তাঁর দেবত্বের অভিব্যক্তির দ্বারা চেনা সম্ভব, তাঁর বাহ্যরূপের দ্বারা নয়। ঈশ্বর দেহরূপে অবতীর্ণ হন যাতে মানুষ তাঁকে তাঁর বিভিন্ন কার্যের মাধ্যমে জানতে পারে, এবং তাঁর কার্যের কোনো দু’টি পর্যায় একরকম নয়। দুই অবতার-রূপের কার্য ভিন্ন হলেও অবতারের সারসত্য, এবং তাঁদের কার্যের উৎস হুবহু এক; শুধু তাঁরা কাজের দুটি ভিন্ন পর্যায় সম্পাদন করেন এবং দুই ভিন্ন যুগে আবির্ভূত হন। যাই হোক না কেন, ঈশ্বরের অবতার-রূপগুলি একই সারসত্য এবং একই উৎসের অংশ—এই সত্য কেউ অস্বীকার করতে পারে না।